জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • রমাদান ২০২২
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
  • লেখক
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • রমাদান ২০২২
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
  • লেখক
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

ইসলামী অর্থনীতি

অন্তর্গতঃ অর্থনীতি, উচ্চতর অধ্যয়ন
Share on FacebookShare on Twitter

প্রথম খণ্ডঃ ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন

এ খণ্ডে আছে
১ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার ইসলামী সমাধান
২ কুরআনের অর্থনৈতিক নির্দেশনা
৩ ইসলামী অর্থ্যব্যবস্থা ও পুঁজিবাদের মধ্যে পার্থক্য
৪ ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি ও লক্ষ্য
৫ কুরআনের আলোকে অর্থনৈতিক জীবনের কতিপয় মৌলিক নীতিমালা

সূচীপত্র

  1. আমাদের কথা
  2. গ্রন্থকারের কথা
  3. ভূমিকা
  4. সবকথার গোড়ার কথা
  5. প্রথম খণ্ডঃ ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন
    1. প্রথম অধ্যায়ঃ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার সমাধান
      1. খণ্ডিত বিষয়পূজার বিপর্যয়
      2. অর্থনৈতিক সমস্যা আসলে কি?
      3. অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আসল কারণ
      4. প্রবৃত্তিপূজা এবং বিলাসিতা
      5. বস্তু পূজা
      6. প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক [Antagoinstic Compitiion] অর্থব্যবস্থা
      7. আরো কতিপয় ব্যবস্থা
      8. সমাজতন্ত্রের প্রস্তাবিত সমাধান
      9. নতুন শ্রেণী
      10. নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা
      11. ব্যক্তিত্বের বলি
      12. ফ্যাসিবাদের সমাধান
      13. ইসলামের সমাধান
      14. ইসলামের মূলনীতি
      15. সম্পদ উপার্জন নীতি
      16. ইসলামের স্বত্বাধিকার নীতি
      17. ১. ইসলামে ব্যায়নীতি
      18. ২. অর্থপূজার মূলোচ্ছেদ
      19. ৩. সম্পদ বন্টন ও জননিরাপত্তা
      20. ভাববার বিষয়
    2. দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ কুরআনের অর্থনৈতিক নির্দেশনা
      1. ১. মৌলিক তত্ত্ব
      2. ২. বৈধ অবৈধের সীমা নির্ধারণের অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর
      3. ৩. আল্লাহ-নির্ধারিত সীমার ভেতরে ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি
      4. ৪. অর্থনৈতিক সাম্যের অস্বাভাবিক ধারণা
      5. ৫. বৈরাগ্যনীতির পরিবর্তে মধ্যপন্থা এবং বিধিনিষেধ
      6. ৬. অর্থসম্পদ উপার্জনে হারাম হালাল বিবেচনা করা
      7. ৭. অর্থসম্পদ উপার্জনের অবৈধ পন্থা
      8. ৮. কার্পণ্য ও পুঞ্জিভূত করার উপর নিষেধাজ্ঞা
      9. ৯. অর্থপূজা ও লোভ লালসার নিন্দা
      10. ১০. অপব্যয়ের নিন্দা
      11. ১১. অর্থ ব্যয়ের সঠিক খাত
      12. ১২. আর্থিক কাফফারা
      13. ১৩. দান কবুল হবার আবশ্যিক শর্তাবলী
      14. ১৪. আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের বাস্তব গুরুত্ব
      15. ১৫. আবশ্যিক যাকাত ও তার ব্যাখ্যা
      16. ১৬. মালে গনীমতের এক পঞ্চমাংশ
      17. ১৭. যাকাত ব্যয়ের খাত
      18. ১৮. উত্তরাধিকার আইন
      19. ১৯. অসীয়তের বিধান
      20. ২০. অজ্ঞ ও নির্বোধের স্বার্থ সংরক্ষণ
      21. ২১. জাতীয় মালিকানায় সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণ
      22. ২২. করারোপের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি
      23. ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
      24. গ্রন্থসূত্র
    3. তৃতীয় অধ্যায়ঃ ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও পুঁজিবাদের মধ্যে পার্থক্য
      1. এক: উপার্জনে বৈধ অবৈধের পার্থক্য
      2. দুই: ধন সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা
      3. তিন : অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ
      4. চার: যাকাত
      5. পাঁচ: মীরাসী আইন
      6. ছয়: গনীমতলব্ধ ও সম্পদ ও বিজিত সম্পত্তি বন্টন
      7. সাত: মিতব্যয়িতার নির্দেশ
    4. চতুর্থ অধ্যায়ঃ ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি ও লক্ষ্য
      1. ইসলামী অর্থব্যবস্থার ধরন
      2. ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্য
        1. ক. ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ
        2. খ. নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির সাঞ্জস্য
        3. গ. সহযোগিতা, সামঞ্জস্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা
      3. ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি
        1. ক. ব্যক্তিমালিকানা ও তার সীমারেখা
        2. খ. সমবন্টন নয়, ইনসাফপূর্ণ বন্টন
        3. গ. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার
        4. ঘ. যাকাত
        5. ঙ. উত্তরাধিকার আইন
      4. শ্রম, পুঁজি ও সংগঠনের মর্যাদা
      5. যাকাত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
      6. সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা
      7. অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার সম্পর্ক
    5. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কুরআনের আলোকে অর্থনৈতিক জীবনের কতিপয় মৌলিক নীতিমালা
      1. ১. ইসলামী সমাজের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য
      2. ২. নৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির ইসলামী পদ্ধতি
      3. ৩. জীবিকার ধারণা এবং ব্যয়ের দৃষ্টিভংগি
      4. ৪. ব্যয়ের মূলনীতি
      5. ৫. মিতব্যয়ের মূলনীতি
      6. ৬. অর্থনৈতিক সুবিচর
  6. দ্বিতীয় খন্ডঃ ইসলামী অর্থব্যবস্থার কতিপয় দিক
    1. ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ ভূমির মালিকানা
      1. ১. কুরআন এবং ব্যক্তিমালিকানা
      2. ২. রাসূল (সা) ও খেলাফতে রাশেদার যুগের দৃষ্টান্ত
        1. প্রথম প্রকারে ভূমির মালিকানা বিধান
        2. দ্বিতীয় প্রকারের ভূমির মালিকানা বিধান
        3. তৃতীয় প্রকারের ভূমির মালিকানা বিধান
        4. চতুর্থ প্রকারের ভূমির মালিকানার বিধান
        5. চাষাবাদের ভিত্তিতে মালিকানার অধিকার
        6. সরকার কর্তৃক দানকৃত জমি
        7. ভূমি দান করার শরয়ী বিধান
        8. জমিদারীর শরয়ী নীতি
        9. মালিকানা অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
      3. ৩. ইসলাম ব্যবস্থা এবং একক মালিকানা
      4. ৪. কৃষি জমির সীমা নির্ধারণ
      5. ৫. বর্গাচাষ পদ্ধতি এবং ইসলামের সুবিচার নীতি
      6. ৬. অধিকারভূক্ত সম্পদ ব্যয়ের সীমা
    2. সপ্তম অধ্যায়ঃ সুদ
      1. ১. সুদ সম্পর্কে ইসলামের বিধান
        1. রিবার অর্থ
        2. জাহেলী যুগের রিবা
        3. ব্যবসা ও রিবার মধ্যে নীতিগত পার্থক্য
        4. রিবা হারাম হবার কারণ
        5. সুদ হারামের ব্যাপারে কঠোর নীতি
      2. ২. সুদের প্রয়োজন : একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা
        1. সুদ কি যুক্তিসম্মত
          1. ক. ঝুঁকি ও ত্যাগের বিনিময়
          2. খ. সহযোগিতর বিনিময়
          3. গ. লাভে অংশীদারিত্ব
          4. ঘ. সময়ের বিনিময়
        2. সুদের হারের যৌক্তিকতা
        3. সুদের এ হর নির্ধারণের ভিত্তি
        4. সুদের অর্থনৈতিক ‘লাভ ও তার প্রয়োজন’
        5. সুদ কি যথার্থ প্রয়োজনীয় ও উপকারী?
      3.  ৩. সুদের বিপর্যয়
      4. ৪. সুদমুক্ত অর্থনীতি বিনির্মাণ
        1. কয়েকটি বিভ্রান্তি
        2. সংস্কারের পথে প্রথম পদক্ষেপ
        3. সুদ রহিত করার সুফল
        4. সুদবিহীন অর্থব্যবস্থায় ঋণ সংগ্রহের উপায়
        5. ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ
        6. বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ
        7. সরকারের অলাভজনক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে
        8. আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে ‍ঋণ গ্রহণ
        9. লাভজনক কাজে পুঁজি বিনিয়োগ
        10. ব্যাংকিং এর ইসলামী পদ্ধতি
      5. ৫. অমুসলিম দেশ থেকে অর্থনৈতিক ও শিল্পঋণ গ্রহণ
    3. অষ্টম অধ্যায়ঃ যাকাতের তাৎপর্য এবং গুরুত্ব
      1. ১. যাকাতের তাৎপর্য এবং গুরুত্ব
        1. যাকাতের অর্থ
        2. যাকাত নবীগণের সুন্নত
      2. ২. সামাজিক জীবনে যাকাতের স্থান
      3. ৩. যাকাত দানের নির্দেশ
      4. ৪. যাকাত ব্যয়ের খাত
      5. ৫. যাকাতের মৌলিক বিধান
      6. ৬. যাকাতের নিসাব ও হার কি পরিবর্তন করা যেতে পারে?
      7. ৭. কোম্পানীর শেয়ারে যাকাত
      8. ৮. শ্রম ও অর্থের অংশীদারী অবস্থায় যাকাত
      9. ৯. খনিজ সম্পদে যাকাতের নিসাব
      10. ১০. যাকাত ও ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য
      11. ১১. যাকাতের পরও কি আয়কর আরোপ করা বৈধ?
    4. নবম অধ্যায়ঃ ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার
      1. হকের বেশে বাতিল
      2. পয়লা প্রতারণা : পুঁজিবাদ এবং ধর্মহীন গণতন্ত্র
      3. দ্বিতীয় প্রতারণা : সামাজিক সুবিচার ও সমাজতন্ত্র
      4. শিক্ষিত মুসলমানদের চরম মানসিক গোলামী
      5. সামাজিক সুবিচারের অর্থ
      6. সামাজিক সুবিচার কেবল ইসলামেই রয়েছে
      7. সুবিচারই ইসলামের লক্ষ্য
      8. সামাজিক সুবিচার
      9. ব্যক্তিত্বের বিকাশ
      10. ব্যক্তিগত জবাবদিহি
      11. ব্যক্তিস্বাধীনতা
      12. সামাজিক সংস্থা ও তার কর্তৃত্ব
      13. পুঁজিবাদ ও সমাজিতন্ত্রের ত্রুটি
      14. সমাজতন্ত্র সামাজিক নিপীড়নের এক নিকৃষ্ট রূপ
      15. ইসলামের সুবিচার
      16. ব্যক্তিস্বাধীনতা সীমা
      17. সম্পদ অর্জনের শর্তাবলী
      18. অর্জিত সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ
      19. সমাজসেবা
      20. যুলুম নির্মূল করা
      21. জনস্বার্থে জাতীয়করণের সীমা
      22. রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ের শর্ত
      23. একটি প্রশ্ন
    5. দশম অধ্যায়ঃ শ্রম, বীমা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ
      1. ১. শ্রম সমস্যা ও তা সমাধানের পথ
        1. বিকৃতির কারণ
        2. আসল প্রয়োজন
        3. সমস্যার সমাধান
        4. সংস্কারের মূলনীতি
      2. ২. বীমা
      3. ৩. মূল্য নিয়ন্ত্রণ
    6. একাদশ অধ্যায়ঃ অর্থনৈতিক আইনে পুনর্বিন্যাস ও তার মূলনীতি
      1. সংস্কারের পূর্বে চিন্তার প্রয়োজন
      2. ইসলামী আইনের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন
      3. পুনর্বিন্যাসের জন্য অপরিহার্য শর্তাবলী
      4. প্রথম শর্ত
      5. দ্বিতীয় শর্ত
      6. তৃতীয় শর্ত
      7. চতুর্থ শর্ত
      8. কঠোরতা হ্রাসের সাধারণ নীতি
      9. সুদের ক্ষেত্রে কঠোরতা হ্রাসের কতিপয় অবস্থা

প্রথম অধ্যায়ঃ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার সমাধান

[গ্রন্থকার এ নিবন্ধটি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সমিতির’ আমন্ত্রণে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেজী হলে ১৯৪১ সালের ৩০ অক্টোবর তারিখে পাঠ করেন।]
আধুনিককালে দেশ ও জাতি এবং সামষ্টিকভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সম্ভবত এর আগে এতোটা স্পষ্টভাবে এর উপর এতো অধিক গুরুত্ব আর কখনো দেয়া হয়নি। “স্পষ্টভাবে” শব্দটি এজন্যে ব্যবহার করেছি যে, আসলে মানুষের জীবনে তার জীবিকা যে পর্যায়ের গুরুত্ব পাওয়া দাবি রাখে, প্রতিটি যুগেই ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, দেশ এবং সমগ্র মানুষ এর প্রতি সে অনুযায়ী গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে। কিন্তু বর্তমানকালে অর্থনৈতিক সমস্যার উপর যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা অতীতের সকল গুরুত্বকে ছাড়িয়ে গেছে। যে জিনিস এ গুরুত্বকে ‘স্পষ্টতা’ ও ‘স্বাতন্ত্র্য’ দান করেছে, তা হলো, আজকাল অর্থনীতি রীতিমতো একটি বিরাট শাস্ত্র হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। এর উপর বড় বড় গ্রন্থ রচিত হয়েছে। চকপ্রদ অসংখ্য পরিভাষিা সৃষ্টি হয়েছে; অর্থনীতির বিকাশ ও সম্প্রসারণের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অগণিত জাঁকজমকপূর্ণ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। আবার এর সাথে সাথে মানব জীবনের অপরিহার্য সামগ্রীর উৎপাদন, সংগ্রহ, সরবরাহ ও উপার্জনের পন্থাপদ্ধতিও হয়ে উঠেছে জটিল থেকে জটিলতর। এসব কারণে আজ বিশ্বে অর্থনৈতিক সমস্যার উপর যে ব্যাপক আলোচনা, বিতর্ক, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ চলছে, তার তুলনায় মানব জীবনের অন্যান্য সকল সমস্যা যেন ম্লান হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার য, যে বিষয়ের প্রতিগোটা বিশ্বের দৃষ্টি এভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তার সহজ সুষ্ঠু সমাধান হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন যেন আরো অধিক জটিল ও ধূম্রজালে পরিণত হচ্ছে। অর্থনীতি-বিজ্ঞঅনের জটিল জটিল পরিভাষা আর অর্থনীতিবিদদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ, গবেষণাপ্রসূত কথাবার্তা এ বিষয়ে জনগণকে রীতিমতো শংকিত ও আতংকিত করে তুলেছে। সাধারণ মানুষ এসব পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা ও বিতর্ক শুনে নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যার ভয়াবহতায় ভীত এবং তা সমাধানের সম্ভাবনা সম্পর্কে চরমভাবে নিরাশ হয়ে পড়েছে। কোন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসকের মুখে তার রোগের জটিল ল্যাটিন নাম শুনে যেনন ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং তার রোগমুক্তি সম্পর্কে নিরাশ হয়ে যায়, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কে একালের মানুষের অবসথাও ঠিক তাই হয়েছে।
অথচ অর্থনীতির এসব পরিভাষা ও শাস্ত্রীয় বিতর্কের ধূম্রজাল অপসারণে করে বিষয়টিকে সাদাসিধে ও স্বাভাবিকভাবে দেখলে অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকৃত রূপ সহজেই উপলব্ধি করা যায় এবং এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্বে আজ পর্যন্ত যেসব উপায় পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর সার্থকতা ও ব্যর্থতার দিকও অনায়াসেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাছাড়া এ সমস্যা সমাধানের সঠিক ও স্বাভাবিক পদ্ধতি কোনটি তা বুঝতেও তেমন কষ্ট হয় না।

খণ্ডিত বিষয়পূজার বিপর্যয়

পূর্বেই বলেছি যে, পরিভাষা এবং শাস্ত্রীয় জটিলতার ভোজবাজি অর্থনৈতিক সমস্যাকে অত্যন্ত অস্পষ্ট ও দূরূহ করে তুলেছে। এ সমস্যা আরো অধিক জটিল হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সমস্যাকে মানব জীবনের অন্যান্য সমস্যা থেকে পৃথক করে একটি স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সমস্যা হিসেবে দেখার ফলে। বস্তুত মানব জীবনের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যা হচ্ছে একটি। কিন্তু সামগ্রি জীবন থেকে অর্থনৈতিক সমস্যাকে পৃথক করে সম্পূর্ণ আলাদা একটি সমস্যা হিসেবে দাঁড় করানো হযেছে। ধীরে ধীরে এর স্বাতন্ত্র্য এমন পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে যে, অর্থনৈতিক সমস্যাকেই মানব জীবনের একমাত্র সমস্যা মনে করা হচ্ছে। প্রথমোক্ত ভুল থেকে এটি অনেক বড় ভ্রান্তি। এর কারণেই এ সমস্যাট গাঁট খোলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরো সহজে বোধগম্য হতে পারে। কোনো হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ যদি মানবদেহের সামগ্রিক কাঠামো থেকে হৃদপিন্ডকে আলাদা করে দেখতে শুরু করে এবং সেই কাঠামোর মধ্যে হৃদপিণ্ডের যে গুরুত্ব তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হৃদপিণ্ডকে নেহায়েত হৃদপিন্ড হিসেবে বিচার করে এবঙ শেষ পর্যন্ত যদি সে হৃদপিণ্ডকেই গোটা মানব দেহ বলে বিবেচনা করতে থাকে তাহলে কিরূপ মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হবে তা সহজেই অনুমেয়। এবার ভেবে দেখুন, মানব স্বাস্থ্যের গোটা সমস্যাকে যদি হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করার চেষ্টা করা হয়, তবে এ সমস্যা করোটা জটিল ও সমাধান অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং বেচারা রোগীর জীবনই বা কতোট বিপদসংকুল হয়ে পড়ে। এ দৃষ্টান্ত সামনে রেখে ভেবে দেখুন, যদি অর্থনৈতিক সমস্যাকে মানুষের অন্যসব সমস্যা থেকে বের করে এনে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখা হয়, অতঃপর একে মানুষের একমাত্র সমস্যা বলে ধরা হয় এবং কেবল এর মাধ্যমেই জীবনের অন্যসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়, তাহলে এ থেকে বিভ্রান্তি আর হতাশা ছাড়া মানুষ আর কি পেতে পারে!
আধুনিক কালের অন্যান্য অনিষ্টের মধ্যে বিশেষজ্ঞ (Specialists) তৈরীর অনিষ্ট একটি বড় অনিষ্ট। এর ফলে জীবন এবং এর সমস্যাবলীর উপর সামগ্রিক দৃষ্টি দিন দিন ক্ষীন থেকে ক্ষীণতার হয়ে পড়ছে। মানুষ এখন জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি-বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি গোটা জগতের জটিলতা ও সমস্যাবলী কেবল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মাধ্যমেই সমাধান করতে চায়; যার মগজে মনোবিজ্ঞান চেপে বসেছে, সে শুধু মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই একটি পূর্ণ জীবনদর্শন রচনার প্রয়াস পায়; যার দৃষ্টি যৌনতত্ত্বের গিড়ে আবদ্ধ হয়েছে, সে মনে করে গোটা মানব জীবন কেবল যৌনতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এমনকি, মানুষের মধ্যে আল্লাহ্‌র সম্পর্কে বিশ্বাসও নাকি এ পথেই সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপভাবে যারা অর্থনীতি শাস্ত্রের গহীনে নিমগ্ন হয়েছে তারা মানুষের মনে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করতে চায় যে, জীবনের আসল ও মূল সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা; অন্যসব সমস্যা এ মূল সমস্যারই শাখা প্রশাখা মাত্র। অথচ, সত্য কথা হলো এসব সমস্যা হলো একটি পূর্ণাংগ এককের বিভিন্ন অংশ মাত্র। সেই পূর্ণাংগ এককের মধ্যে এসব সমস্যার প্রত্যেকটিরই একটি নির্দিষ্ট অবস্থান রয়েছে। আর সেই অবস্থানের ভিত্তিতেই প্রতিটি সমস্যারই নির্দিষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। মানুষ একটি দেহের অধিকারী। আর এ দেহটি চলছে প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে। এ হিসেবে মানুষ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়, কিন্তু মানুষ কেবল দেগ মাত্রই নয়; তাই শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞান দ্বারা মানুষের সকল সমস্যার সমাধান করা যেতে পারেনা। মানুষ একটি প্রাণবিশিষ্ট সত্তা। তাই সে জৈবিক নিয়মের অধীন। এদিক থেকে মানুষ জীববিজ্ঞানের (Bioloigy) বিষয়বস্তু। কিন্তু মানুষ কেবল একটি জীবই নয়। সুতরাং কেবল জীববিজ্ঞঅন বা প্রাণীবিজ্ঞান (Zoology) থেকে মানব জীবনের পূর্ণাংগ আইনবিধান গ্রহণ করা যেতে পারেনা। বেঁচে থাকার জন্যে মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন। এ হিসেবে অর্থনীতি মানব জীবনের একটি বড় অংশকে পরিবেষ্টন করে আছে। কিন্তু মানুষ কেবল পানাহার গ্রহণকারী, পোশাক পরিধানকারী এবং বাসস্থান নির্মাণকারী পশু নয়। তাই শুধুমাত্র অর্থনীতির উপর মানব জীবনদর্শনের ভিত রচনা করা যায় না। মানুষকে তার জাতি রক্ষার জন্যে বংশবৃদ্ধি করতে হয়। তাই তার মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড যৌন প্রবৃত্তি। এ হিসেবে মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সাথে যৌন বিজ্ঞানে সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তাই বলে গোটা মানুষটি কেবল একটি বংশবৃদ্ধির যন্ত্র নয়; তাই শুধুমাত্র যৌন বিষয়ক চশমা দিয়ে তাকে দেখা সংগত হতে পারেনা। মানুষের একটি মন আছে। এতে অনুভূতি ও চেতনা শক্তি এবং আবেগ, আকাংখা ও লোভলালসা বর্তমান। এ হিসেবে মনোবিজ্ঞান মানুষের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু মানুষের আপাদমর্তক কেবল মন আর মন নয়। তাই শুধু মনোবিজ্ঞান দিয়ে তার জীবনের স্কীম তৈরী করা যেতে পারেনা। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তার প্রকৃতিই তাকে অন্য মানুষের সাথে মিলে মিশে জীবন যাপন করতে বাধ্য করে। এ হিসেবে মানব জীবনের একটি বড় অংশ সমাজ বিজ্ঞানের সাথে জড়িত। কিন্তু মানুষ নিছক একটি সামাজিক জীব মাত্রই নয়। তাই কেবল সমাজ বিজ্ঞানীরা তার জীবন ব্যবস্থা রচনা করতে পারেনা। মানুষ একটি বুদ্ধিমান জীব। তার মধ্যে অনুভূতির উর্ধ্বে বিবেক বুদ্ধির দাবীও রয়েছে। সে বিবেক বুদ্ধিগত প্রশান্তিও চায়। এ হিসেবে যুক্তিবিদ্যা তার একটি বিশেষ দাবী পূরণ করে। কিন্তু মানুষের গোটা সত্তা কেবল বুদ্ধিবিবেক নয়। তাই কেবল তর্কশাস্ত্র দিয়ে তার জীবরে কর্মসূচী তৈরী করা যেতে পারেনা। মানুষ একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সত্তাও বটে। তাই অনুভূতি ও যুক্তির উর্ধ্বে ভালমন্দ ও ন্যায় অন্যায়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্যে ‍উপনীত হওয়ার আকাংখা তার মধ্যে বর্তমান। এ হিসেবে মানব জীবনের একটি অংশ জুড়ে রয়েছে নীতিবিজ্ঞান ও অধ্যাত্মতত্ত্ব। কিন্তু মানুষ কেবল নীতিবোধ ও আধ্যাত্মিকতা সর্বস্ব জীন নয়। তাই শুধুমাত্র নীতিবিজ্ঞান ও অধ্যাত্মবিদ্যা দিয়ে তার জীবন ব্যবস্থা রচিত হতে পারেনা।
প্রকৃত ব্যাপার হলো, মানুষ একই সাথে এ সবগুলো বিষয়ের সমন্বয়। এ সবগুলো বিষয় তার মধ্যে যথাস্থানে বর্তমান রয়েছে; এছাড়া মানব জীবনের আরা একটি বড় দিক রয়েছে; তা হলো গোটা বিশ্ব জগতের সামগ্রিক ব্যবস্থার সে একটি অংশও। তাই তার জীবন ব্যবস্থা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, গোটা জগতের সামগ্রিক ব্যবস্থায় তার অবস্থান কোথঅয় এবং এর একটি অংশ হিসেবে তার কি ধরনের কাজ করা উচিত? তাছাড়া নিজ উদ্দেশ্য লক্ষ্য নির্ণয় করাও তার জন্যে অপরিহার্য। আর সে হিসেবে কি কাজ তার করা উচিত, সে সিদ্ধান্তও তাকে গ্রহণ করতে হবে। শেষোক্ত দুটি প্রশ্ন মানব জীবরে মৌলিক প্রশ্ন। এগুলোর ভিত্তিতেই রচিত হয় জীবনদর্শন। অতপর মানব জীবরে সাথে সম্পর্কিত বিশ্বের সকল জ্ঞান বিজ্ঞান সেই জীবনদর্শনের অধীনেরই নিজ নিজ পরিসরভুক্ত তথ্য ও জ্ঞান আহরণ করে এবং কমবেশী এ সবগুলোর সমন্বয়েই রচিত হয় মানব জীবরে কর্মসূচী। অতপর এর ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় মানব জীবনের গোটা কাঠামো।
আপনি যদি আপনার জীবরে কোনো একটি সমস্যাকে বুঝতে চান, তবে দূরবীন লাগিয়ে কেবল সে সমস্যার মধ্যে নিজের দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা যে কোনো সঠিক পন্থায়ন সে কথাটাই এতোক্ষণে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে। এতে আরো স্পষ্ট হয়েছে যে, সমস্যাটির সাথে জড়িত জীবনের সেই নির্দিষ্ট বিভাগের প্রতি অন্ধ প্রবণতা নিয়ে গোটা জীবনসমস্যার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করাও সঠিক কাজ নয়; বরং সে নির্দিষ্ট সমস্যাটিকে জীবনসমস্যার সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে তার অবস্থানের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করার মাধ্যমেই তার সঠিক সমাধান উপলব্ধি করা যেতে পারে। বস্তুত বিচার বিশ্লেষণের এটাই নির্ভুল পন্থা। একইভাবে আপনি যদি জীবনের ভারসাম্যের সমধ্যে কোনো বিকৃতি দেখতে পান এবং তা শোধরাতে চান, তবে স বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, কোনো একটি সমস্যাকে সমগ্র জীবনসমস্যা ধরে নিয়ে একে কেন্দ্র করে জীবনের গোটা কারখানাকে ঘুরাতে থাকলে যে বিপদ সৃষ্টি হতে তার চেয়ে বড় বিপদ আর কিছু হতে পারেনা। এরূপ পদক্ষেপের মাধ্যমে তো আপনি গোটা ভারসাম্যকে বিনষ্টই করে দেবেন। সংশোধনের সঠিক পন্থা হলো, আপনাকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগি নিয়ে পূর্ণাং জীবন কাঠামোকে এর মৌলিক দর্শনসহ প্রাসংগিক বিষয়াদি পর্যন্ত সবকিছু দৃষ্টিতে আনতে হবে এবং বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কোথায় বিকৃতি সৃষ্টি হয়েছে আর তার ধরনই বা কি?
মানুষের অর্থনৈকিত সমস্যা বুঝা এবং যথার্থভাবে তা সমাধানের ক্ষেত্রে যে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে তার বড় কারণ হলো, কিছু লোক সমস্যাটিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখছে। আবার কিছু লোক এর গুরুত্বের প্রতি এতোটা বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়েছে যে, তারা এটাকেই মানব জীবনের একমাত্র সমস্যা বলে ধরে নিয়েছে। আবার অন্য কিছু লোকের বাড়াবাড়ি চরম সীমায় উপনীতি হয়েছে। তারা জীবনের মূল দর্শন, নৈতিকতা ও সমাজের গোটা কাঠামোকে অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ অর্থনীতিকে যদি মানব জীবনের মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ অর্থনীতিকে যদি মানব জীবনের মূলভিত্তি মনে করা হয়, তাহলে তো মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য আর একটি গরুর জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনা। একটি গরু এর চূড়ান্ত চেষ্টা সাধনা নিয়োজিত করে সবুজ শ্যামল ঘাস খেয়ে সুখী শক্তিমান জীবন এবং জগতের চারণভূমিতে স্বাধীন পশুর মর্যাদা লাভ করার জন্যে। মানুষও যদি কেবল অর্থনীতি সর্বস্ব হয়ে পড়ে তাহলে এই পশুটির সাথে তার আর কোনো পার্থক্য থাকেনা।
অনুরূপভাবে নীতিবিদ্যা, অধ্যাত্মবিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, সমাজ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং অন্যান্য সব বিষয় ও শাস্ত্রের মাঝে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রভাবশালী করার দ্বারা সাংঘাতিক বিপর্যয় ও ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। কারণ, মানব জীবনের এসকল বিভাগের ভিত্তি তো অর্থনীতি নয়। সবকিছুকে যদি অর্থনীতির ভিত্তির উপর দাঁড় করানো হয়, সেক্ষেত্রে নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা প্রবৃত্তিপূজা ও বস্তুপূজায় রূপান্তরিক হবে, যুক্তিবিদ্যা অন্যবিদ্যায়, সমাজ বিজ্ঞানের সমগ্র স্তর সামাজিক তত্ত্ব ও তথ্য বিচারেরর পরিবর্তে ব্যবসায়িক কার্যধারায় এবং মনোবিজ্ঞঅন মানসিকতা অধ্যয়নের পরিবর্তে মানুষকে নিছক অর্থনৈতিক জীব হিসাবে বিশ্লেষণ করার শাস্ত্রে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় মানবতার প্রতি এর চেয়ে বড় অবিচার আর হতে পারেনা।

অর্থনৈতিক সমস্যা আসলে কি?

আমরা যদি পরিভাষাগত এবং শাস্ত্রীয় জটিলতার ধূম্রজালকে একপাশে রেখে একেবারে সহজ, সরল ও সাধারণভাবে দেখি তাহলে সহজেই মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যর প্রকৃত রূপ বুঝতে পারি। সমাজের বিবর্তন ও ক্রমোন্নতির ধারা অব্যাহত রেখে কিভাবে সকল মানুষের অপরিহার্য জীবন সামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়; কিভাবে সমাজের প্রতিটি মানুষকে তর সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী উন্নত করা যায় এবং কিভাবে তার ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করে যোগ্যতার চরম শিখরে পৌছার সযোগ করে দেয়া যায়, আসলে তা-ই হলো মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার মূলকথা।
সুপ্রাচীন কালে মানুষের জীবিকার বিষয়টি ছিলো পশুপাখির জীবিকার মতোই সহজ ও জটিলমুক্ত। আল্লাহর এই যমীনের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সীমাসংখ্যাহীণ জীবন সামগ্রী। প্রতিটি সৃষ্টির জন্যে যা প্রয়েঅজন তার তুলনায় জীবিকার সরবরাহ ছিল অঢেল ও অগাধ। প্রত্যেকেই স্বীয় জীবিকার অন্বেষণে বের হতো আর পৃথিবীর ভাণ্ডার থেকে তা সংগ্রহ করে নিত। এজন্যে কাউকেও মূল্য পরিশোধ করতে হতো না। এক সৃষ্টির জীবিকার অপর সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধও ছিল না। প্রাচীনতম কালে মানুষের অবস্থাও প্রায় এরকমই ছিলো। সে সময়ে মানুষবেরিয়ে পড়তো আর প্রকৃতির ভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করে নিতে নিজের প্রয়োজনীয় জীবিকা। এসব রুজি ছিল ফল পাকড়া এবং শিকার করা পশুপাখি। সে সময়ে মানুষ প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে ঢেকে নিতো নিজেদের শরীর। পৃথিবীর বুকে যেখানেই সুযোগ দেখতো, সেখানেই মাথা গোঁজার জন্যে জায়গা বানিয়ে নিতো।
কিন্তু এ অবস্থায় দীর্ঘকাল থাকার জন্যে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ মানুষের মধ্যে এমন সৃজনশীল প্রতিভা ও আকাংখা অন্তর্নিহিত করে দিয়ে্যেছন যার ফলে মানুষ ব্যষ্টিক ও স্বতন্ত্র জীবন যাপন রীতি পরিত্যাগ করে সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের প্রক্রিয়া অবলম্বন এবং নিজের কর্মকৌশলের মাধ্যমে প্রাকৃতির সরবরাহকৃত উপকরণ ব্যবহার করে নিজেদের জীবন উপকরণকে আরো উন্নত করার প্রয়াস পেয়েছে। নারীপুরুষের মাঝে স্থায়ী সম্পর্কের প্রকৃতিগত আকাংখা, মানবশিশুর দীর্ঘ সময় ধরে মা বাবার প্রতিপালনের মুখাপেক্ষী হওয়অ, নিজ সন্তান-সন্ততি ও বংশের প্রতি মানুষে গভীর আকর্ষণ এবং রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের প্রতি মহব্বত ভালবাসা এসব প্রবণতা মানব প্রকৃতিতে এমনভাবে নিহিত রাখা হযেছে যাতে মানুষ সমাবদ্ধ জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। একইরূপে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত উপকরণে তুষ্ট না হয়ে কৃষিকাজর মাধ্যমে নিজের খাদ্য উৎপাদন, পত্রপল্লব দিয়ে দেহ আবৃত করার পরিবর্তে নিজের জন্যে শিল্পসম্মত পোশাক তৈরী, গুহায় থাকার উপর সন্তুষ্ট না থেকে ঘরবাড়ী বানানো এবং নিজের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে দৈহিক যন্ত্রপাতির উপর তুষ্ট না হয়ে লোহা পাথর, কাঠ, ইত্যাদির সাহায্যে যন্ত্রপাতি নির্মাণ করা ইত্যাদি সবই প্রকৃতি মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত করে দিয়েছে। এরই অপরিহার্য ফল স্বরূপ মানুষ ধীরে ধীরে সমাজবদ্ধ হয়েছে। এটা মানুষের কোনো অপরাধ নয়; বরঞ্চ এই ছিলো মানব প্রকৃতির দাবি এবং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।
সামাজিক জীবনে প্রবেশের সাথে সাথে মানুষের জন্যে কিছু বিষয় অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। সে বিষয়গুলো হচ্ছেঃ
এক
ধীরে ধীরে মানুষের জীবনোপকরণের চাহিদা বেড়ে গেল। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের যাবতীয় চাহিদা নিজেই পূরণ করতে অসমর্থ হয়ে পড়লো। ফলে একজনের কিছু চাহিদা অন্যদের সাথে এবং অন্যদের কিছু চাহিদা তার সাথে সম্পর্কিত হলো এবং মানুষ পরস্পরের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লো।
দুই
জীবন যাপনের অপরিহার্য সামগ্রীর বিনিময় (Exchange) রীতি চালু করা অবশ্য হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বিনিময়ের একটি মাধ্যম (Medium of Exchange) নির্দিষ্ট হলো
তিন
প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী তৈরী করার জন্যে যন্ত্রপাতির আবিষ্কার ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হলো এবং চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে মানুষ নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার এবং তা থেকে উপকৃত হতে লাগলো।
চার
এসববের সাথে সাথে মানুষ এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চাইলো যে, নিজর শ্রমের মাধ্যমে সে যেসব জিনিস লাভ করেছে, যেসব যন্ত্রপতি দিয়ে সে কাজ করছে, যে জমিতে সে ঘর বানিয়েছে এবং যেখানে সে নিজের পেশাগত কাজ করছে, সেসবকিছুই যেনো তার অধিাকারে থাকে এবং তার মৃত্যুর পর ঐসব লোকেরাই যেনো এসবের স্বত্বাধিকারী হয়, যারা অন্যদের তুলনায় তার অধিকতর নিকটবর্তী।
এভাবে বিভিন্ন পেশার জন্ম হয়, ক্রয়বিক্রয় ও দ্রব্যসামগ্রীর ‍মূল্য নির্ধারণ রীতি চালূ হয়, মূল্য নিরূপণের মানদন্ড হিসেবে মুদ্রার প্রচলন হয়, আন্তর্জাতিক আদান প্রদান এবং আমদানী রপ্তানীর সুযোগ সৃষ্টি হয়, নতুন নতুন উৎপাদন উপকরণ ( Means of Production) আবিষ্কৃত হয় এবং স্বত্বাধিকার ও উত্তরাধিকার রীতি চালূ হয়। এসবই ছিলো স্বাভাবিক এবং প্রকৃতির দাবী এবং এগুলোর মধ্যে কোনটিই গুনাহ্‌র কাজ ছিলনা যে, এখন তার জন্যে তওবা করতে হবে।
এছাড়া মানব সমাজের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে নিম্নোক্ত জিনিসগুলোও অপরিহার্য হয়ে পড়েঃ
[১] মানুষের শক্তি সামর্থ এবং যোগ্যতা প্রতিভার ক্ষেত্রে স্বয়ং আল্লাহ যে পার্থক্য রেখে দিয়েছেন, তর ফলশ্রুতিতে কিছু মানুষ তার প্রকৃত চাহিদার চেয়ে অধিক উপার্জনে সক্ষম হওয়া কিছু লোক চাহিদা মেটানোর মতো উপার্জন করা এবং আর কিছু লোক নিজেদের চাহিদা পূরণ করার মতো উপার্জন করতে না পারা স্বাভাবিক ছিল।
[২] উত্তরাধিকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পত্তির কারণে কিছু লোকের জীবনের সূচনাই অগাধ উপায় উপকরণের মধ্যে হওয়া, কিছু লোক স্বল্প উপায় উপকরণ নিয়ে যাত্রা শুরু করা এবং আর কিছু লোক সহায় সম্বলহীন অবস্থায় নিঃসম্বল হয়ে জীবন যুদ্ধে নামাও অপরিহার্য ছিল।
[৩] প্রাকৃতিক কার্যকারণেই প্রতিটি জনবসতিতে এমন কিছু লোকও বর্তমান থাকা স্বাভাবিক ছিল যারা জীবিকা উপার্জনের কাজে অংশগ্রহণে অযোগ্য এবং বিনিময়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জীবনসামগ্রী সংগ্রহ করতেও অক্ষম। যেমন শিশু, বৃদ্ধ, রোগী, অক্ষম প্রভৃতি।
[৪] এছাড়া প্রত্যেক সমাজে এমন কিছু লোক থাকা স্বাভাবিক ছিল যারা সেবা গ্রহণ করবে, আর কিছু লোক থাকবে যারা সেবা প্রদান করবে। এভাবেই সৃষ্টি হবে স্বাধীন শিল্প কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য এবং কৃষিকার্য; চালূ হবে অপরের চাকুরী করা এবং শ্রম বিনিময়ের প্রথা।
মানব সমাজে এসবই ঘটেছে স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক কার্যকারণে। এসব অবস্থা সংগঠিত হবার করণে এমন কোনো অন্যায় বা অপরাধ হয়নি যে, এখন সেগুলোকে উচ্ছেদের চিন্তা করতে হবে। সামাজিক বিপর্যয় ও বিকৃতির অন্যন্য কারণ থেকে যেসব অনিষ্ট সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়ে বহুলোক ঘাবড়ে যায়। ফলে কখনো ব্যক্তি মালিকানাকে, কখনো অর্থকড়িকে, কখনো যন্ত্রপাতিকে, কখনো মানুষের মধ্যে বিরাজমান স্বাভাবিক অসাম্যকে এবং কখনোবা সমাজকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু আসলে এটা ভ্রান্ত মূল্যায়ন এবং রোগ ও ওষুধ নিরূপণের ভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। মানব প্রকৃতির দাবী অনুসারে যে সামাজিক বিবর্তন ঘটে এবং তার ফলে সমাজ কাঠামো যে রূপ পরিগ্রহ করে, তা প্রতিহত করার চেষ্টা করা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। এরূপ চেষ্টায় সাফল্যের তুলনায় ধ্বংস ও অনিষ্টের আশংকাই অধিক। কিভাবে সামাজিক উন্নয়ন প্রতিহত করা যায়, কিংবা কিভাবে স্বাভাবিক রূপ কাঠামোকে পাল্টানো যায়- মানুষের আসল অর্থনৈতিক সমস্যা এটা নয়। বরঞ্চ তার আসল অর্থনৈতিক সমস্যা হলো, সমাজের স্বাভাবিক ক্রমবিকাশের ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে সামাজিক যুল্‌ম অবিচার কিভাবে প্রতিহত করা যায়। ‘প্রতিটি সৃষ্টি তার জীবিকা লাভ করুক’ –প্রকৃতির এই উদ্দেশ্য কিভাবে পূর্ণ করা যায় এবং কিভাবেই বা সেইসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা যায়, যেগুলোর কারণে কেবল উপায় উপকরণ নেই বলে অসংখ্য মানুষের শক্তি সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রতিভা বিনষ্ট হয়ে যায়; মূলত এগুলো হচ্ছে মানুষের সত্যিকার অর্থনৈতিক সমস্যা।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আসল কারণ

এবার আমরা দেখবো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকৃতি ও বিপর্যয়ের সত্যিকার কারণ কি আর এই বিকৃতি ও বিপর্যয়ের ধরনই বা কি?
মূলত, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিকৃত ও বিপর্যয়ের সূচনা হয় স্বার্থপরতার ক্ষেত্রে বেপরোয়া সীমালংঘন থেকে। অতপর অন্যান্য নৈতিক অসাধুতা এবং ভ্রান্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাহায্যে এ বিকৃতি-বিপর্যয় আরো বৃদ্ধি এবং প্রসার লাভ করে। এমনকি, তা গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে জীবনের অন্যান্য বিভাগেও তার বিষাক্ত ছোবল সম্প্রসারিত করে থাকে। আমি একটু আগেই বলেছি, ব্যক্তিমালিকানা এবং কিছু লোকের তুলনায় অপর কিছু লোকের আর্থিক অবস্থা ভালো হওযা মূলত প্রকৃতিরই দাবী এবং অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা মূলত কোনো প্রকার অনিষ্টের কারণ নয়। মানুষের সকল নৈতিক গুণবৈশিষ্ট্য যদি সুসামাঞ্জস্যের সাথে কাজ করার সুযোগ পায় আর বাইরেও যদি ইনসাফ ও সুবিচার ভিত্তিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে, তবে এ দুটি জিনিস থেকে কোনো প্রকার অনিষ্ট সৃষ্টি হতে পারেনা। কিন্তু স্বাভাবিক কারণে যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল তাদের স্বার্থপরতা, সংকীর্ণ ‍দৃষ্টিভংগি, অনিষ্ট চিন্তা, কার্পণ্য, লোভ লালসা, দুর্নীতি এবং প্রবৃত্তিপূজার ফলে এগুলোকে অনিষ্ট সৃষ্টির কারণ বানিয়ে দিয়েছে। শয়তান তাদের কুমন্ত্রণা দিয়ে বুঝিয়েছে যে, প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে অধিক যেসব অর্থসামগ্রী তোমাদের হাতে আসে এবং যেগুলো তোমাদের মালিকানাবুক্ত হয়, সেগুলো ব্যয়-বিনিয়োগের সঠিক এবং যুক্তিসংগত খাত হলো দুটিঃ এক, সেগুলো নিজের আরাম আয়েশ, বিলাসিতা, আনন্দ স্ফুর্তি এবং সুখ স্বাচ্ছন্দের কাজে ব্যয় করবে। আর দ্বিতীয় হলো, আরো অধিক অর্থসামগ্রীর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে সেগুলোকে বিনয়োগ করবে এবং সম্ভব হলে এগুলোর মাধ্যমে মানুষের প্রভু এবং অন্নদা হয়ে বসেব।

প্রবৃত্তিপূজা এবং বিলাসিতা

শয়তান এ পয়লা শিক্ষার পরিণতি এই দাঁড়ালো যে, সম্পদশালীরা সমাজের সেসব লোকের অধিকার মেনে নিতে অস্বীকার করলো যারা বঞ্চিত কিংবা যারা প্রয়োজনের তুলনায় কম সম্পদ লাভ করেছে। তারা এ লোকগুলোকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুরবস্থায় নিক্ষেপ করতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করলো না। নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে তারা একথা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলো যে, তাদের আচরণের ফলে সমাজের বহু মানুষ অপরাধের কাজে লিপ্ত হতে পারে, অনেকে নৈতিক অধঃপতনের গহ্বরে নিমজ্জিত হতে পারে এবং শারীরিক দুর্বলতা ও রোগব্যধির শিকার হতে পারে। ফলে তারা তাদের মানসিক ও শারীরিক শক্তি ও যোগ্যতা প্রতিভা বিকশিত করা এবং সমাজ সভ্যতার উন্নতিতে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম হয়ে পড়বে। এতে সামষ্টিকভাবে সেই সমাজটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধনীগণ নিজেরাও যার অংশ। সমাজের বিত্তশালী সদস্যরা এতোটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ এরা নিজেদের প্রকৃত প্রয়োজনের উপর আরো অসংখ্য প্রয়োজনকে সংযোজন করে নিয়েছে। আর নিজেদের দুষ্ট প্রবৃত্তির মনগড়া এসব উদগ্র কামনা বাসনা পূরণের জন্যে তারা এমন অসংখ্য মানুষকে নিয়োজিক করেছে যাদের যোগ্যতা প্রতিভা সমাজ সভ্যতার কল্যাণময় সেবায় ব্যবহৃত হতে পারতো। জ্বিনা ব্যভিচারকে তারা নিজেদের জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় কাজ বানিয়ে নিয়েছে। আর এ লালসা চরিতার্থ করার জন্র তারা অসংখ্য নারীকে দেহব্যবসা ও রূপ-যৌবনের বিপণি সাজাতে বাধ্য করলো। গানবাজনাকে তারা তাদের অপরিহার্য প্রয়োজনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিল। এজন্যে তৈরী করা হলো গায়ক গায়িকা, নর্তকী এবং বাদকদের দল; বহু লোককে নিয়োগ করা হলো বাদ্যযন্ত্র তৈরীর কাজে। তাদের আনন্দস্ফুর্তি ও চিত্ত বিনোদনের জন্য নানা ধরনের ভাঁড়, রসিক, অভিনেতা অভিনত্রী, গাল্পিক, অংকনশিল্পী, চিত্রশিল্পী এবং অন্যান্য অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় পেশা ও পেশাদারের জন্ম হলো। এসব ধরশালীদের বিলাস চরিতার্থ করার জন্যে অগণিত লোককে ভালো কল্যঅণময় কাজের পরিবর্তে বনের পশুপাখি তাড়িয়ে ফেরার কাজে নিযুক্ত করা হয়। তাদের আনন্দস্ফুর্তি ও নেশার প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে অসংখ্য মানব সন্তানকে নিয়োগ করা হয় মদ, কোকেন, আফিম এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য তৈরী ও সরবরাহের কাজে। মোটকথা, এভাবে শয়তানের এসব সাথীরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ‍ও নির্দয়ভাবে সমাজের একটি বিরাট অংশকে শুধুমাত্র নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং দৈহিক ধ্বংসের গহ্বরে নিমজ্জিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ আরো অগ্রসর হয়ে সমাজের আরেকটি বড় অংশকে সঠিক ও কল্যাণময় কাজ থেকে তাড়িয়ে নিয়ে অর্থহীন, অপমানকর ও ক্ষতিকর কাজে নিযুক্ত করেছিল। সমাজের গতিকে এর সঠিক ও ন্যায়সংগক পথ থেকে বিচ্যুত করে এমন পথে পরিচালিত করলো, যা মানবতাকে নিয়ে যায় ধ্বংসের অতল গহ্বরে। সম্পদশালীদের যুল্‌ম, অবিচার ও ধ্বংসাত্মক কার্যধারার এখানেই শেষ নয়। তারা কেবল মানবীয় মূলধনকে (Human Capital) অপচয় ও ধ্বংস করেছে তাই নয়। বরং সেইসাথে তারা বস্তুগত মূলধনকেও ভ্রান্ত পথে বিনিয়োগ ও ব্যয় ব্যবহার করেছে। নিজেদের প্রয়োজনে তারা বড় বড় প্রাসাদ, অন্দরমহল, গুলবাগিচা, প্রমোদকঞ্জ, নৃত্যশালা, নাট্যশালা, প্রেক্ষাগার এমনকি মরার পর সমাধির জন্যও তারা বিরাট ভূমিখন্ডের উপর জাঁজমকপূর্ণ সমাধিসৌধ নির্মাণ করে নিল। এভাবে আল্লাহর অসংখ্য বান্দার বাসস্থঅন ও জীবিকার জন্যে যে জমি ও দ্রব্যসামগ্রী কাজে লাগতে পারতো, তা মাত্র গুটিকয়েক বিলাসী ব্যক্তির পৃথিবীতে জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থান ও বিদায়ের ব্যবস্থা করার জন্যে ব্যয় করা হলো। দামী দামী অলংকার মনোরম পোশাক উঁচুদরের সাজসজ্জা সৌন্দর্য ও বিলাসিতার সামগ্রী, জাঁকালো মডেলের যানবাহন এবং আরো অনেক জানা অজানা বাহারী সামগ্রীর জন্য তারা অঢেল সম্পদ ব্যয় করলো। এমনকি, এসব যালিমরা জানালা দরজায় দামী দামী পর্দা ঝুলালো, ঘরের দেয়ালগুলোতে বহু টাকা ব্যয় করে ছবি চিত্র এঁকে নিলো, ঘরের মেঝোতে বিছিয়ে দিলো হাজার হাজার টাকা মূল্যের কার্পেট ও গালিচা। তারা তাদের কুকুরগুলোকে পর্যন্ত মখমলের পোশাক আর সোনার শিকল পরিয়ে দিলো। এভাবে বিপুল পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী এবং অসংখ্য মানুষের শ্রম ও সময় যা দুঃস্থ মানুষের দেহাচ্ছাদন ও ক্ষুধা নিবৃত্ত করার কাজে লাগতে পারতো, তা মাত্র গুটিকয়েক বিলাসী ব্যক্তি ও প্রবৃত্তির দাসানুদাসের লালসা চরিতার্থ করার জন্যে নিঃশেষ হয়ে গেলা।

বস্তু পূজা

এযাবত যে মারাত্মক চিত্র তুলে ধরলাম, এসবই হলো শয়তানী নেতৃত্বের মাত্র একটি দিকের পরিণতি। শয়তানী নেতৃত্বের অন্য দিকটির পরিণতি এর চেয়েও ভয়াবহ। প্রকৃত প্রয়োজনের অধিক যে সম্পদ ও উপায় উপকরণ কোনো ব্যক্তির হস্তগত হয়েছে, সেগুলোকে ‘জমিয়ে রাখবে এবং আরও সম্পদ অর্জনের কাজে বিনিয়োগ করবে’ এই নীতি একেবারেই ভ্রান্ত। একথা সুস্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ পৃথিবীতে যেসব উপায় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, তা সৃষ্টিজগৎ ও মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ করার জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। সৌভাগ্যক্রমে তোমার হাতে যদি কিছু অধিক সম্পদ এসে গিয়ে থাকে, তবে জেনে রেখো এটা অপরের অংশই তোমার হাতে এসেছে। তুমি কেন তা জমিয়ে জমিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছো? তোমার চারপাশে তাকাও, দেখবে যারা জীবিকা সংগ্রহ করতে অক্ষম, কিংবা যারা তাদের জীবিকা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে, অথবা যারা নিজেদের প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে কম পেয়েছে, মনে করবে এরাই হলো সেই সব লোক যাদের জীবিকার অংশ তোমার হাতে এসে গেছে। তারা আহরণ করতে পারেনি; সুতরাং ‍তুমি নিজেই তা তাদের কাছে পৌছে দিও। এটাই হচ্ছে সঠিক কর্মনীতি। এর পরিবর্তে তুমি যদি সে সম্পদকে আরো অধিক সম্পদ লাভের কাজে ব্যবহার কর তবে তা হবে এক চরম ভ্রান্তি। কেননা এগুলোর সাহায্যে তুমি আরো যতো সম্পদই সংগ্রহ করবে তাতো তোমার প্রয়োজনের চাইতে আরো অনেক বেশীই হবে। সুতরাং সম্পদের পর সম্পদ লাভ করে সেগুলোর মাধ্যমে তোমার বিকৃত লোভ লালসা আর কামনা বাসনা চরিতার্ঞ করা ছাড়া কল্যাণকর আর কি হতে পারে! তুমি তোমার সময়, শ্র, এবং যোগ্যতার যতোটা অংশ প্রয়োজনীয় জীবিকা লাভের কাজে ব্যয় কর, মূলত ততোটুকুই কেবল এগুলোর সঠিক ও যুক্তিসংগত প্রয়োগ। কিন্তু প্রয়োনের অতিরিক্স সম্পদ লাভের জন্যে সেগুলোকে কাজে লাগালে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তুমি একটি অর্থনৈতিক পশু, বরং অর্থ উপার্জনের একটি মেশিন ছাড়া আর কিছু নও। অথচ তোমার সময়, শ্রম এবং মানসিক ও দৈহিক যোগ্যতা অর্থ উপার্জনের কাজে প্রয়োগ করা ছাড়াও আরো অনিক মহান ও উত্তম প্রয়োগক্ষেত্র রয়েছে। সুতরাং বিবেক বুদ্ধি ও স্বভাব প্রকৃতির দিক থেকে এ নীতি একেবারই ভ্রান্, যা শয়তান তার শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছে। তাছাড়া এই নীতিকে বাস্তবায়িত করার জন্যে যে কর্মপন্থা তৈরী করা হয়েছে সেটা এতোই অভিশপ্ত এর পরিণাম ফল এতোই ভয়াবহ যে, তা কল্পনা করাও কষ্টকর।
প্রয়োজনের অধিক অর্থসম্পদকে আরো অধিক অর্থসম্পদ কবজা করার কাজে দুইভাবে বিনিয়োগ করা যায়ঃ
এক. সুদের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান করা;
দুই. ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ করা।
ধরনগতদিক থেকে উভয় পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য অবশ্যি আছে। কিন্তু উভয় পদ্ধতির সমন্বিত কর্মের অনিবার্য পরিণতিতে সমাজ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
একটি শ্রেণী হলো তারা, যারা নিজেদের প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী অর্থসম্পদরে মালিক হয় এবং সে সম্পদকে আরো বেশী সম্পদ আহরণের কাজে অর্থাৎ সম্পদের পাহাড় গড়ার কাজে বিনিয়োগ করে। এ শ্রেণীর লোকেরা সংখ্যার কম হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় শ্রেণীটি হলো তারা, যারা নিজেদের প্রকৃত প্রয়োজনের সমান বা তার চেয়ে কম অর্থসম্পদের অধিকারী হয়, কিংবা একেবারে বঞ্চিত হয়ে থাকে। এই শ্রেণীকি সংখ্যায় প্রথমোক্ত শ্রেণীর তুলনায় অনেক বেশী হয়।
উভয় শ্রেণীর স্বার্থ সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী, পরস্পর বিরোধী এবং সাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বরং উভয় শ্রেণীর স্বার্থ মাঝে সম্পর্ক হয়ে থাকে সংঘাতময়, দ্বন্দ্বমুখর এবং প্রতিবাদী। এভাবেই প্রকৃতি মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে যে সুস্থ ও সম্মতিপূর্ণ বিনিময় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা সংঘাত ও শত্রুতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার [Antagoinstic Compitiion] উপর ভিত্তিশীল হয়ে পড়ে।

প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক [Antagoinstic Compitiion] অর্থব্যবস্থা

অতঃপর এ সংঘাতময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতোই বাড়তে থাকে, ততোই ধনীকে শ্রেণীর সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে এবং দরিদ্র শ্রেণীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতের প্রকৃতিই এমন যে, এতে বিত্তশালীরা তাদের সম্পদের জোরে কম বিত্তের মালিকদের কাছ থেকে সম্পদ চুষে নেয় এবং তাদেরকে নিঃস্ব ও দরিদ্রদের দলে ঠেলে দেয়। এভাবে দিন দিন বিশ্বের অর্থসম্পদ স্বল্প থেকে স্বল্পতর সংখ্যক লোকের হাতে কুক্ষিগত হতে থাকে এবং অধিত থেকে অধিক লোক দিন দিন নিঃস্ব ও দরিদ্র হয়ে যায় কিংবা ধনীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
প্রথমদিকে এ সংঘাতের সূচনা হয় স্বল্প পরিসরে। অতঃপর এর পরিধি বাড়তে বাড়তে দেশ হতে দেশে এবং জাতি হতে জাতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ক্রমে গোটা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলে। এ প্রক্রিয়া এখানেই শেষ হয় না; এরপরও ‘আরও চাই আরও চাই’ বলে যেন চিৎকার করতে থাকে। যে প্রক্রিয়ায় এ বৈষম্য সংঘটিত হয়, তা হলো, কোনো একটি দেশের কিছুলোকের হাতে যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদ থাকে তখন তারা উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদকে লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে এবং এই অর্থ প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের কাজে ব্যয় হতে থাকে। এখন তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি লাভসমেত উঠে আসাটা নির্ভর করে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সে দেশের ভেতরে বিক্রয় হওয়ার উপর। কিন্তু বাস্তবে এমনটি সর্বদা হয়না এবং মূলত তা হতে পারেও না। কারণ যাদের হাতে প্রয়োজহনের চেয়ে কম সম্পদ রয়েছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা তো ক্ষীণই হয়ে থাকে। তাই প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা সরকারী জিনিস ক্রয় করতে পারে না। অপরদিকে যাদের কাছে অতিরিক্ত সম্পদ থাকে তারা তাদের আয়ের একটি বিরাট অংশ অধিক মুনাফা অর্জন করার কাজে বিনিয়োগ করে। তাই তারা নিজেদের সাকুল্য মূলধন পণ্য ক্রয়ের জন্যে ব্যয় করেনা। ফলে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর একটি বিরাট অংশ অনিবার্যভাবে অবিক্রিত থেকে যায়। অন্য কথায় এর অর্থ হলো, ধনীদের বিনিয়োগকৃত অর্থের একটি অংশ অনাদায়ী থেকে যায়। এই অর্থ দেশের শিল্পের [INDUSTRY] নিকট ঋণ হিসেবে পাওনা থাকে। এ হচ্ছে একটি মাত্র আবর্তনের অবস্থা। এভাবে যতোবারই পুঁজি আবর্তিত হয় ততোবারই পূঁজিপতিরা তাদের লব্ধ আয়ের একটি অংশ আবার লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করবে এবং প্রত্যেক আবর্তনেই অনাদায়ী অর্থের পরিমাণও বাড়তে থাকবে। এভাবে দেশীয় শিল্পের কাছে এ ধরনের ঋণ দ্বিগুণ, চারগুণ, হাজারগুণ বৃদ্ধি পায় যা স্বয়ং সেই রাষ্ট্রের পক্ষেও কখনো আদায় করা সম্ভব হয়না। এ প্রক্রিয়ায় একেকটি দেশ দেউলিয়াত্বের চরম বিপদে নিপতিত হয়। এ অবস্থা থেকে বাঁচার একটিই মাত্র উপায় থাকে। তা হলো, দেশের মধ্যে অবিক্রিত থেকে যাওয়া সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী বহিবিশ্বে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ এমন দেশের সন্ধান করা যার ঘাড়ে নিজের দেউলিয়াত্ব চাপিয়ে দেয়া যায়।
এভাবেই এ সংঘাতময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ময়দানে পদার্পণ করে। একথা স্পষ্ট যে, কেবল একটি মাত্র দেশই শয়তানী অর্থনীতি অনুসারে পরিচালিত হয়ানা, বরঞ্চ বিশ্বের অসংখ্য দেশে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। প্রত্যেক দেশই নিজেকে দেউলিয়াপনা থেকে বাঁচানোর জন্যে, অন্য কথায় নিজের দেউলিয়াত্ব অপর কোনো দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্যে বাধ্য হয়ে পড়েছে। এভাবেই আরম্ভ হয় আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আর এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা কয়েকটি রূপ ধারণ করে।
প্রথমত, প্রত্যেক দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের জন্যে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। প্রত্যেকেই স্বল্পতম ব্যয়ে অধিক পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করে। তাই শ্রমিক কর্মচারীদের অত্যন্ত কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক কারবারে সাধারণ জনগণ এতোটা কম আয় লাভ করে, যা দিয়ে তাদের প্রকৃত প্রয়োজনও পূরণ হয়না।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক দেশ নিজের পরিসীমা ও নিজ প্রভাব বলয়ের অধীন দেশসমূহের অপর দেশের পণ্য-সামগ্রী আমদানীর উপর বিধিনিশেষ আরোপ করে। নিজের আয়ত্তাধীন সব ধরনের কাঁচামালের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যাতে অপর কোনো দেশ তা হস্তগত করতে না পারে। এর ফলে শুরু হয় আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বসংঘাত যার পরিণতিতে বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা।
তৃতীয়ত, যেসব দেশ অপর দেশ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া দেউলিয়াত্বের বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনা, তাদের উপর অসংখ্য লুটেরার দল হিংস্র স্বাপদের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরা সে দেশে কেবল নিজ দেশের উদ্বত্ত পণ্য বিক্রি করে তাই নয় বরং নিজ দেশে যেসব ধনসম্পদ লাভজনক কাজে খাটানোর সুযোগ নেই, তাও অধিক মুনাফা লুটার উদ্দেশ্যে সেসব দেশে বিনিয়োগ করে। শেষ পর্যন্ত এসব দেশেও সেই একই সমস্যা সৃষ্টি হয়, যা প্রথমত নিজ দেশে অর্থ বিনিয়োগকারী দেশগুলোতে সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ যে পরিমাণ অর্থ তারা এসব দেশে বিনিয়োগ করে তা পুরাটা উদ্ধার হয়ে আসেনা। আবার এ বিনিয়োগ থেকে যে পরিমাণ আয়ই হাতে আসে তার একটা বড় অংশ তারা অধিকতর লাভজনক কাজে বিনিয়েগ করে। শেষ পর্যন্ত দেশগুলোর ঘাড়ে ঋণের বোঝা এতোটা বৃদ্ধি পায়, যা গোটা দেশকে নগদ দামে বিক্রি করেও শেষ পর্যন্ত গোটা বিশ্ব দেউলিয়া হয়ে পড়বে। তখন এই দেউলিয়াত্বের বোঝা চাপিয়ে দেবার মতো কোনো দেশই আর বিশ্বর বুকে অবশিষ্ট থাকবেনা। এমনকি শেষ পর্যন্ত অর্থ বিনিয়োগ এবং উদ্বৃত্ত পণ্য চালানের জন্যে বুধ, বৃহস্পতি কিংবা মংগলগ্রহে ছুটোছুটি করতে হবে বাজারের সন্ধানে।

আরো কতিপয় ব্যবস্থা

এই সর্বগ্রাসী দ্বন্দ্বসংঘাতে ব্যাংক মালিক, আড়তদার, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের ক্ষুদ্র একটি দল গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক উপায় উপকরণ এমনভাবে করায়ত্ব করে বসে আছে যে, তাদের মোকাবিলায় সমগ্র বিশ্বের মানবজাতি সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার দৈহিক শ্রম ও মনমস্তিষ্কের যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতভাবে উপার্জনের কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আল্লাহর এ রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা জীবনসামগ্রী থেকে নিজের অংশ সংগ্রহ করা তার জন্যে একেবারেই দুষ্কর। ছোট ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক এবং সাধারণ কৃষিজীবীদের পক্ষে পরিশ্রম করে প্রয়োজন মেটানোর মতো উপার্জন করার কোনো সুযোগ আজ আর অবশিষ্ট নেই। অর্থনৈতিক জগতের এ অধিপতিদের গোলাম, চাকর এবং মজুর হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। ওদিকে শিল্পপতি, পুঁজি-মালিক ও ব্যবসায়ীরা অপেক্ষাকৃত স্বল্প জীবিকার বিনিময়ে মানুষের দৈহিক ও মানসিক সকল শক্তি ও যোগ্যতা প্রতিভা এবং গোটা সময় ক্রয় করে নিচ্ছে। ফলে গোটা মানবজাতি এখন নিছক একটি অর্থনৈতিক পশুতে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে গোটা মানবজাতি এখন নিছক একটি অর্থনৈতিক পশুতে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংগ্রামের চাপে পড়ে নিজের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎর্ষ সাধন করা, ক্ষুধা নিবারণের চেয়ে উচ্চতর কোনো উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্যারোপ করা এবং জীবিকার সন্ধান ছাড়া অন্য কোন মহত্তর উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিকে বিকাশিত করা খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়। প্রকৃতপক্ষে, এ শয়তানী ব্যবস্থার দারুন অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত এতোই কঠিন রূপ ধারণ করেছে যে, জীবনের অন্যসব দিক ও বিভাগ একেবারেই মুহ্যমান ও অকেজো হয়ে পড়েছে।
মানুষের আরো দুর্ভোগ্য যে, বিশ্বের নৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং আইন প্রণয়ন নীতিও এই শয়তানী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবে চরমভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য পর্যন্ত সকল দেশে নীতিশাস্ত্রের শিক্ষকবৃন্দ মিতব্যয়িতা ও ব্যয় সংকোচনের উপর বিশেষ গুরুত্বাররোপ করেছেন যা আয় হবে তার পুরোটা ব্যয় করাকে বোকামী এবং নৈতিক ত্রুটি বলে মনে করা হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে এ শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, স্বীয় আয়ের কিচু না কিছু অংশ বাঁচিয়ে তা ব্যাংকে জমা রাখতে হবে, কিংবা বীমা পলিসি ক্রয় অথবা কোন কোম্পানীর শেয়ার কিনতে হবে। বস্তুত মানবতার জন্যে যা ধ্বংসকর ও মারাত্মক, নীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিতে তাকেই আজ সত্য ও সৌন্দর্যের মাপকাঠি বানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রশক্তির কথা আর কি বলবো? বাস্তবে রাজনীতি ও রাষ্ট্রশক্তি পুরোপুরিই শয়তানী ব্যবস্থার করায়ত্ত হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে যুল্‌ম ও শোষণ থেকে মানবতাকে রক্ষা করাই ছিল রাষ্ট্রশক্তির দায়িত্ব; কিন্তু আজ স্বয়ং রাষ্ট্রশক্তিই যুল্‌ম ও শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। চতুর্দিকে শয়তানের দোসররাই নিরংকুশভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আছে।
একইভাবে বিশ্বের আইনকানুনও এ শয়তানী ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েছে। এসব আইন কার্যত মানুষকে পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী বানিয়ে দিয়েছে। ফলে মানুষ যেভাবে পারে সমাজস্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যথেচ্ছ চেষ্টা করছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈধঅবৈধ বাছবিচার প্রায় তিরোহিত হয়ে গেছে। অন্য লোকের সম্পদ শোষণ ও লুণ্ঠন করা কিংবা অন্যকে ধ্বংস করে নিজে অর্থশালী হবার সকল উপায় পন্থাকে আজ আইনের দৃষ্টিতে বৈধ করা হয়েছে। মদ ‍উৎপাদন এবং মদের ব্যবসা, চরিত্রহীনতার আখড়া তৈরী করা, কামোদ্দীপক ফিল্ম বানানো, অশ্লীল ফিচার ও প্রবন্ধ লেখা, যৌন উত্তেজনামূলক ছবি প্রকাশ করা, জুয়ার আড্ডা বসানো, সুদী প্রতিষ্ঠান কায়েম করা, জুয়ার নিত্য নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা, মোটকথা মানবতাকে ধ্বংসকারী যা কিছু করা হোক না কেন, এর কোনোটাই আইন বিরোধী নয়। আইন এসব করার শুধু যে অনুমতি দেয় তাই নয়; বরং এসব করার অধিকার সংরক্ষণের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। অতঃপর এসব উপায়ে অর্জিত ধনসম্পদ যখন কারো কাছে জমা হয়, তখন তার মৃত্যুর পরও যাতে উক্ত সম্পদ সেখানেই কুক্ষিগত থাকে, আইন তারও ব্যবস্থা করে দেয়।
এজন্যে আইনের জ্যেষ্ঠ পুত্রের উত্তরাধিকার প্রথা [Rule of primogeniture], কোনো কোনো ক্ষেত্রে পালকপুত্র গ্রহণের বিধান এবং যৌথপরিবার প্রথার {Joint family system}ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব আইনের উদ্দেশ্য হলো, ধনভান্ডারের মালিক একটি অজগরের মৃত্যু হলে, আর একটি অজগরকে তার জায়গায় বসিয়ে দেয়া। আর দুর্ভাগ্যবশত সেই অজগর যদি কোনো বাচ্চা রেখে না যায়, তবে অন্যের একটি বাচ্চা ধার করে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়, যাত সঞ্চিত ধনভান্ডার সমাজে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
এসব কারণে আজ গোটা মানবজাতির জন্যে সৃষ্টি হয়েছে এক বিরাট জটিল ও দুরূহ সমস্যা। আল্লাহ এ দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনসামগ্রীর ব্যবস্থা কিভাবে করা যায়, আর প্রতিটি মানুষের সামর্থ্য, যোগ্যতা ও প্রতিবা অনুযায়ী উন্নতি লাভ এবং স্বীয় ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করার সুযোগ করে দেয়ার উপায়ই বা কি হতে পারে তার ব্যবস্থা করাই আজ মূল বিষয়।

সমাজতন্ত্রের প্রস্তাবিত সমাধান

সমাজতন্ত্র অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের একটি রূপ পরিকল্পনা পেশ করেছে। সমাজতন্ত্রের মতে অর্থসম্পদ ও উৎপাদনের যাবতীয় উপায় উপকরণ ব্যক্তির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জাতীয় মালিকানায় অর্পণ এবং ব্যক্তিদের মধ্যে প্রয়েঅজনীয় জীবনসামগ্রী বন্টন করার দায়িত্ব সমাজ সংগঠনের উপর ন্যস্ত করাই অর্থনৈতিক সমস্যার যথার্থ সমাধান। বাহ্য দৃষ্টিতে এ সমাধান খুবই যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। কিন্তু এর বাস্তব কর্যকারিতার উপর যতোই গভীর দৃষ্টি ফেলবেন, ততোই এর ত্রুটিসমূহ আপনার কাছে উন্মুক্ত হতে থাকবে। শেষ পর্যন্তহ আপনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, যে রোগের চিকিৎসার জন্যে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, আসলে সেই রোগটির চেয়ে এ ব্যবস্থা অধিক মারাত্মক।

নতুন শ্রেণী

একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, উৎপাদনের উপায় উপকরণের ব্যবহার এবং উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী বন্টনের ব্যবস্থ তত্ত্বগত দিক থেকে [Theoretically] যতোই গোটা সমাজের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হোকনা কেন, বাস্তবে তা একটি ক্ষুদ্র নির্বাহ সংস্থার [Executive] উপরই একান্তভাবে নির্ভর করতে হবে। প্রথমত এ ক্ষুদ্র দলটি সমাজের [Community] দ্বারাই নির্বাচিত হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু যাবতীয় অর্থনৈতিক উপায় উপকরণ যখন তাদের করায়ত্ব হয়ে পড়বে এবং তাদের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জীবিকা বন্টন করার কাজ শুরু হবে, তখন অবশ্যই সমাজের প্রতিটি অধিবাসী তাদের মুষ্টিতে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় বন্দী হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় দেশে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস পাবেনা। তাদেরকে ক্ষমতার মসনদ থেকে হটাতে পারে, এমন সংগঠিত কোনো শক্তিই তাদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ পাবেনা। কোনো ব্যক্তির উপর থেকে তাদের কৃপাদৃষ্টি উঠে গেলে সেই হতভাগার পক্ষে এই বিশাল পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার মত উপায় উপকরণ পাওয়ার কোনো অধিকারই থাকবে না। কেননা দেশের সমস্ত ধনসম্পদ ও উপায় উপকরণ তো সেই ক্ষুদ্র দলটিরই নিরংকুশ কর্তৃত্বাধীনে আবদ্ধ। তাদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে বা তা অমান্য করে ধর্মঘট করার দুঃসাহস দেখানো কোনো শ্রমিক মজুরের পক্ষে সম্ভব হবেনা। কারণ সেখানে কলকারখানা এবং ক্ষেত খামারের মালিক থাকবে একটিই- একাধিক নয়; কাজেই একজনের কারখানায় অসুবিধা হলে আরেক মালিকের কারখানায় গিয়ে চাকুরী করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারেনা। সেখানে সারা দেশের কলকারখনা ও ক্ষেত খামারের মালিক তো কেবল তো সেই একটি মাত্র ক্ষুদ্র দল। সে আবার রাষ্ট্র-ক্ষমতারও মালিক। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার জনসমর্থন লাভের সম্ভাবনা থাকবেনা। এভাবে এই অর্থনৈতিক রূপ পরিকল্পনাটির ‍চূড়ান্ত পরিণতি এই দাঁড়াবে যে, সকল ছোট বড় পুঁজিপতি, সকল কলকারখানার মালিক এবং সকল ক্ষেত খামারের অধিকারীদের খতম করে একমাত্র বড় পুঁজিপতি, একমাত্র বৃহৎ কারখানা মালিক ও একমা্রত বিরাট মজিদার সারা দেশের উপর একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে জেঁকে বসবে। বস্তুত এ বিরাট শক্তিধর দলটি একই সাথে ‘জার’ ও ‘কাইজারের’ ভূমিকায়ঢ অবতীর্ণ হবে।

নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা

এরূপ শক্তি ও প্রভুত্ব এবঙ এ ধরনের নিরংকুশ কর্তৃত্ব এমন এক জিনিস, যার নেশায় মত্ত হয়ে মানুষ শোষক, অত্যাচারী ও নিপীড়ক না হয়ে পারে না। বিশেষ করে এ ধরনের কর্তৃত্বের অধিকারীরা যদি আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর সম্মুখে একদিন নিজেদের কার্যকলাপের জবাবদিহী করার ধারণা বিশ্বাসী না হয়, তাহলে তাদের নিপীড়নের আর কোনো সীমা পরিসীমাই থাকে না। তা সত্ত্বেও যদি ধরে নেয়া হয় যে, এরূপ সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত করার পর এই ক্ষুদ্র দলটি সীমালংঘন করবেনা এবং ‍সু্বিচারের সাথেই যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে, তথাপিও এ ধরনের একটি ব্যবস্থার অধনে ব্যক্তির পক্ষে তার ব্যক্তিত্ব সর্বাংগীন বিকশিত করার কোনো সুযোগ থাকতে পারেনা। ব্যক্তিত্বকে উন্নতি ও ক্রমবিকাশ দান করার জন্যে মানুষের প্রয়োজন স্বাধীনতা। প্রয়োজন কিছু উপায় উপকরণের অধিকারী হওয়ার যাতে সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছা মাফিক তার ব্যবহার ও প্রয়োগ করতে পারে এবং সেগুলোকে নিজের ঝোঁক প্রবণতা অনুযায়ী কাজে লাগিয়ে নিজের সুপ্ত যোগ্যতা ও প্রতিভাকে বিকশিত করে তুলতে পারে কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর কোনো সম্ভাবনা নেই। সেখানে উপায় উপকরণ ব্যক্তির আয়ত্তে থাকেনা, থাকে সমাজের নির্বাহী সংস্থার হাতে। আর সেই নির্বাহী সংস্থা সমাজস্বার্থের যে ধারণা পোষণ করে সে অনুযায়ীই সেসব উপায় উপকরণকে ব্যবহার এবং প্রয়োগ করে। ব্যক্তি যদি সেই উপায় উপকরণের দ্বারা উপকৃত হতে চায়, তবে তাকে সেই সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করতে হবে; শুধু তাই নয়, বরঞ্চ তাদের প্রস্তাবিত সামাজিক স্বার্থে কাজ করার উপযোগীরূপে গড়ে তোলার জন্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তাদের হাতে সোপর্দ করতে হবে, যাতে করে তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদে গড়ে তুলতে পারে। এ ব্যবস্থা কার্যত সমাজের সকল মানুষকে মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তির হাতে এমনভাবে সমর্পণ করে দেয়, যেনো মানুষগুলো নিষ্প্রাণ জড়পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তি সমাজের মানুষগুলোকে নিজেদের নীল নকশার ছাঁচে এমনভাবে ঢেলে সাজায় যেমনভাবে চর্মকার চামড়া কেচে জুতো তৈরী করে এবং কর্মকার লোহা গলিয়ে লৌহসামগ্রী তৈরী করে থাকে।

ব্যক্তিত্বের বলি

মানব সমাজ ও সভ্যতার জন্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা অত্যন্ত মারাত্মক। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, এ ব্যবস্থার অধীনে প্রয়োজনীয় জীবনসামগ্রী সুবিচারের সাথেই বন্টন করা হবে, তবু এর উপকারিতা এর ক্ষতির তুলনায় একেবারেই নগণ্য। মানুষ বিভিন্নমুখী শক্তিসামর্থ্য ও যোগ্যতা প্রতিভা নিয়ে তুলনায় একেবারেই নগণ্য। মানুষ বিভিন্নমুখী শক্তিসামর্থ্য ও যোগ্যতা প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে; সেগুলো পূর্ণরূপে বিকশিত হওয়া এবং সম্মিলিত সমাজ জীবনে সে অনুযায়ী নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করার মধ্যেই সমাজ সভ্যতার সর্বাংগীন উন্নতি নির্ভরশীল। কিন্তু এসব সুযোগ সুবিধা লাভ করা এমন ব্যবস্থার অধীনে কখনো সম্ভব হতে পারেনা, যেখানে মানুষকে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঁচামালের মত ঢেলে কাঠছাঁট করে গড়ে তোলা হয়। কতিপয় ব্যক্তি, তা তারা যতোই যোগ্য এবং সদিচ্ছাসম্পন্ন হোকনা কেন, কোনো অবস্থাতেই তাদের জ্ঞান ও দৃষ্টি এতোটা সর্ব্যাপী হতে পারেনা ,যে লক্ষ্য কোটি মানুষের জন্মগত যোগ্যতা প্রতিভা এবং তাদের স্বভাগত ঝোঁক প্রবণতার সঠিক পরিমাপ করা এবং যেগুলোকে বিকশিত করে তোলার যথার্থ পন্থা নির্ণয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এটা একেবারেই অসম্ভব। এক্ষেত্রে তারা নিছক বিজ্ঞানের দিক থেকেও ভুল করতে পারে। আর সমাজের স্বার্থ এবং সামাজিক প্রয়োজন সম্পর্কে তাদের মানসিকতায় মানব-পরিকল্পনার যে পোকা কিলবিল করছে সেদিক থেকেও তারা তাদের অধীনস্থ গোটা ভূখন্ডের মানুষকে তাদের সেই ছাঁচেই ঢেলে সাজাতে চাইবে। এতে সমাজের যাবতীয় বৈচিত্র সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে এক প্রাণহীন সাদৃশ্য রূপান্তরিত হবে। এর ফলে বন্ধ হয়ো যাবে সমাজের স্বাভাবিক উন্নতি ও ক্রমবিকাশ আর আরম্ভ হবে এক ধরনের সম্পূর্ণ কৃত্রিম স্থবিরতা। এতে মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তি সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রতিভাসমূহ থেৎলে যাবে। অবশেষে দেখা দেবে এক মারাত্মক সামাজিক ও নৈতিক অধপতন। মানুষ তো আর বাগানের ঘাস কিংবা গুল্মলতা নয় যে, একজন মালি তাকে কাটছাঁট করে সাজিয়ে রাখবে, আর মালির পরিকল্পনা অনুযায়ীই সে বড় হবে কিংবা ছোট হবে! প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বতন্ত্র ক্রমোন্নতি লাভ করে তার নিজস্ব স্বাভাবিক গতিতে। এই স্বাভাবিক গতিকে হরণ করে কেউ তাকে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী চালাতে চাইলে তা ক্রমোন্নতি লাভ করতে পারেনা। বরঞ্চ এমতাবস্থায় সে হয় বিদ্রোহ করবে আর না হয় শুষ্ক মৃতপ্রায় হয়ে থাকবে।
সমাজতন্ত্র অর্থননৈতিক সমস্যাকে মানব জীবনের মূল সমস্যা ধরে নিয়ে গোটা মানব জীবনকে ঘানির গরুর মতো এর চারপাশের ঘুরাতে চায়। মুলত এটা সমাজতন্ত্রের মৌলিক ভ্রান্তি। জীবনের কোনো একটি সমস্যার ক্ষেত্রেও সমাজতন্ত্রের দৃষ্টি স্বচ্ছ ও বাস্তবধর্মী নয়। বরঞ্চ সমাজতন্ত্র জীবনের সকল সমস্যাকে কেবল অর্থনীতির সংগীন চশমা দিয়েই দেখে থাকে। ধর্ম নৈতিকতা ইতিহাস বিজ্ঞান সমাজ বিজ্ঞান মোটকথা নিজের পরিসীমার মধ্যে প্রতিটি দিক ও বিভাগকে সংকীর্ণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ একরোখা ও একদেশদর্শী গোঁড়ামীপূর্ণ দৃষ্টিভংগির কারণেই সমাজতন্ত্রের আওতায় মানব জীবনের গোটা ভারসাম্য সম্পূর্ণ বিনষ্ট ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।

ফ্যাসিবাদের সমাধান

সুতরাং পরিষ্কার হলো যে, সমাজতান্ত্রিক মতবাদ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার কোনো সঠিক স্বাভাবিক সমাধান নয়। বরঞ্চ এ এক অস্বাভাবিক কৃত্রিম সমাধান। এর প্র্রতিকূলে আরেকটি সমাধান পেশ করেছে ফ্যসিবাদ এবং জাতীয় সমাজতন্ত্র। এ মতবাদের দৃষ্টিতে জীবিকার উপকরণসমূহের উপর ব্যক্তির মালিকানা বহাল থাকবে তবে সমাজস্বার্থের খাতিরে তা রাষ্ট্রের মজবুত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বাস্তবে এ ব্যবস্থার ফলাফল সমাজতন্ত্রের ফলাফল থেকে মোটেই ভিন্ন কিছু নয়। এ মতবাদও সমাজতন্ত্রের মতোই ব্যক্তিকে সমাজস্বার্থের কাছে বিলীন করে দেয় আর তা ব্যক্তিত্বের স্বাধীন বিকাশের কোনো সুযোগই অবশিষ্ট রাখেনা। তাছাড়া যে রাষ্ট্র ব্যক্তি মালিকানা ও অধিকারকে নিজ অধিকারে কুক্ষিগত করে রাখে সেতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতোই নিপীড়ক, অত্যাচারী ও বল প্রয়োগকারী হতে বাধ্য। একটি দেশের সকল ধনসম্পদ, ব্যবসা বাণিজ্য ও যাবতীয় উপায় উপকরণ নিজ কর্তৃত্বের অধীনে করায়ত্ত করে রাখা এবং নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল মানুষকে কাজ করতে বাধ্য করার জন্যে প্রয়োজন নিরংকুশ ক্ষশতা ও শক্তির। আর যে রাষ্ট্র এরূপ নিরংকুষ ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী হয়, তার হাতে দেশের সমগ্র অধিবাসীর সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়া এবং শাসকদের গোলামে পরিণত হওয়া নিশ্চিত ব্যাপার।

ইসলামের সমাধান

এবার আমি আপনাদের সামনে অর্থনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে ইসলাম যে সমাধান দিয়েছে তা পেশ করতে চাই।

ইসলামের মূলনীতি

ইসলাম মানব জীবনের সকল সমস্যার ক্ষেত্রে তিনটি নীতি গ্রহণ করেছে। এক. ইসলাম মানব জীবনের স্বাভাবিক নিয়মনীতিগুলোকে যতাযথভাবে অক্ষুণ্ণ রাখতে চায় এবং যেখানে স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুতি ঘটে, সেখানেই ইসলাম তার মোড় ঘুরিয়ে স্বাভাবিক পথের উপর এনে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।
দুই. ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজ ব্যবস্থায় কেবল বাহ্যিকভাবে কিচু নিয়ম বিধি চালু করে দেয়াই যথেষ্ট নয়। বরঞ্চ ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে নৈতিক চরিত্র গঠন ও মন মানসিকতার সংশোধনের উপর। কারণ এভাবেই মানব প্রবৃত্তির যাবতীয় খারাপ ও মন্দ ভাবধারা শিকড় কেটে দেয়া সম্ভব। বস্তুত এটি ইসলামে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ইসলামের সমাজ সংশোধন ও সংস্কার প্রচেষ্টার ভিত্তি এর উপরই প্রতিষ্ঠিত।
তিন. ইসলামের তৃতীয় মূলনীতি হলো, রাষ্ট্রীয় শক্তি ও আইনের প্রয়োগ কেবলমাত্র সর্বশেষ ও নিরুপায় মুহূর্তেই করা যাবে, তার পূর্বে নয়। ইসলামী শরীয়তের গোটা ব্যবস্তার মধ্যেই এই মূলনীতিটির নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়।
শয়তারে কুচক্রে পড়ে মানুষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব অস্বাভাবিক পন্থা অবলম্বন করেছে সেগুলো সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ইসলাম কেবলমাত্র নৈতিক সংশোধনের এবং যতোটা সম্ভব রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও আইন প্রয়োগ না করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। ‘জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা সাধনায় মানুষ স্বাধীন থাকবে’; ‘স্বীয় শ্রম-মেহনতের মাধ্যমে মানুষ যা উপার্জন করবে তার উপর তার স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে’ এবং ‘মানুষের মধ্যে তাদের যোগ্যতা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে পার্থক্য ও তারতম্য করা হবে’ প্রভৃতি দৃষ্টিভংগিকে ইসলাম ততোক্ষণ পর্যন্ত স্বীকৃত প্রদান করে, যতোক্ষণ এগুলো স্বাভাবিকতার মধ্যে অবস্থান করবে। তাছাড়া ইসলাম এগুলোর উপর এমনসব বিধি নিষেদও আরোপ করে, যা সেগুলোকে স্বাভাবিকতার সীমা অতিক্রম করা এবং নিপীড়ন ও অবিচারের হাতিয়ারে পরিণত হওয়অ থেকে বিরত রাখে।

সম্পদ উপার্জন নীতি

প্রথমে জীবিকা বা সম্পদ উপার্জনের প্রশ্নটিই ধরা যাক। ইসলাম মানুষের এই স্বাভাবিক অধিকারকে স্বীকার করে যে, সে নিজের স্বভাব প্রকৃতির ঝোঁ প্রবণতা এবং সামর্থ ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেই জীবন সামগ্রীর সন্ধান করবে। কিন্তু ইসলাম মানুষকে তার জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে নৈতিক চরিত্র বিনষ্টকারী কিংবা সমাজ ব্যবস্থা বিকৃতকারী কোনো উপায় পন্থা অবলম্বন করার অধিকার দেয়নি। ইসলাম জীবিকা উপার্জনের উপায় পন্থার ক্ষেত্রে হালাল হারামের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ইসলাম বেছে বেছে ক্ষতিকর উপায় পন্থাকে হারাম করেছে। ইসলামী বিধান মতে মদ এবং যাবতীয় মাদকদ্রব্য কেবল হারাম নয়, বরঞ্চ এগুলোর উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় এবং সংরক্ষণও নিষিদ্ধ। যিনা ব্যভিচার, নাজগান এবং এ ধরনের অন্যান্য উপায় পন্থাকেও অর্থোপার্জনের বৈধ পন্থা বলে ইসলাম স্বীকার করেনা। উপার্জনের এমনসব উপায় পন্থাকেও ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে, যেগুলোতে একজনের লাভ বা স্বার্থসিদ্ধি নির্ভর করে অন্যদের কিংবা সমাজের ক্ষতি ও স্বার্থহানির উপর। ঘুষ, চুরি, জুয়া, ঠকবাজি ও প্রতারণামূলক ব্যবসা, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মওজুদ করে রাখা, উপার্জনের উপায় উপকরণের উপর এক বা কতিপয় ব্যক্তির একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করা যাতে অন্যদের উপার্জনের চেষ্টা সাধনার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে প্রভৃতি ধরনের উপায় পন্থা ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাছা ইসলাম বেছে বেছে সেসব ব্যবসায় বাণিজ্য ও কায়কারবারকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, যেগুলো ধরণগত দিক থেকেই বিবাগ [Litigation] সৃষ্টিকারী, কিংবা যেগুলোর লাভ লোকসান নির্ভর করে সম্পূর্ণরূপে ভাগ্য বা ঘটনাচক্রের উপর অথবা যেগুলোতে উভয় পক্ষের স্বার্থ ও অধিকার নির্দিষ্ট করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ব্যবসা বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিবিধান অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, বর্তমানে যেসব পন্থায় মানুষ লক্ষপতি কোটিপতি হচ্ছে, তন্মধ্যে অধিকাংশ পন্থাই এমন, যেগুলোর উপর ইসলাম কঠোর আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ইসলাম উপার্জনের যেসব উপায় পন্থা বৈধ ঘোষণা করে, সেগুলোর পরিসীমার মধ্যে অবস্থান করে কাজ করলে সীমাহীন সম্পদ গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।

ইসলামের স্বত্বাধিকার নীতি

কোনো ব্যক্তি বৈধ উপায়ে যে ধন সম্পদ উপার্জন করে তার উপর ইসলাম ব্যক্তির স্বাত্বাধিকার অবশ্যই স্বীকার করে; কিন্তু উপার্জিত ধনসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয় নাই। বরঞ্চ তার উপর বিভিন্নভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। একথা সবারই জানা যে, ‍উপার্জিত ধন সম্পদ ব্যবহার করার তিনটিই মাত্র পন্থা আছে। সেগেো হলোঃ
এক. খরচ বা ব্যয় করা,
দুই. লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করা এবং
তিন. মওজুদ করা।
সম্পদ ব্যবহারের এই তিনটি পন্থার উপর ইসলাম যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবার আমি সংক্ষেপে গেুলো তুলে ধরছিঃ

১. ইসলামে ব্যায়নীতি

ব্যয়ের যেসবচ পন্থা পদ্ধতি নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত করে কিংবা যেগুলোর দ্বারা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ইসলামে তা সবই নিষিদ্ধ। কেউ জুয়া খেলে নিজের অর্থ সম্পদ উড়াতে পারেনা। মদ্যপান ও ব্যভিচার করার অনুমতি ইসলামে নেই। গান, বাদ্য, নৃত্য এবং বাজে আনন্দ বিহার প্রভৃতিতে কেউ নিজের অর্থকড়ি খরচ করতে পারে না। কোন পুরুষ রেশমের পোশাক এবং সোনার অলংকার ব্যবহার করতে পারবেনা। চিত্র এঁকে দেয়াল সজ্জিত করতে পারবেনা। মোটকথা, ইসলাম ব্যয়ের এমনসব দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে যার মাধ্যমে মানুষ তার প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার কাজে অর্থ ব্যয় করে।
অন্যদিকে ইসলাম অর্থ ব্যয়ের সেইসব পন্থা পদ্ধতিকে বৈধ রেখেছে, যার দ্বারা মানুষ মধ্য ধরনের পবিত্র পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পারে। এভাবে ব্যয় করার পর কিচু উদ্বৃত্ত থাকলে ইসলাম তা পুণ্য ও সৎকাজে, জনকল্যাণের কাজে এবং সেইসব লোকদের সাহায্যার্থে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করার মতো জীবিকা অর্জনের অসমর্থ। ইসলামে দৃষ্টিতে সর্বোত্তম কর্মনীতি হলো, মানুষ হালাল পথে যা কিছু উপার্জন করবে, তা তার বৈধ ও যুক্তিসংগত প্রয়োজন পূরণার্থে ব্যয় করবে। এরপরও যা কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে তার অভাবগ্রস্তদের দান করবে যাতে তারা তাদের অপরিহার্য প্রয়োজনে তা খরচ করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যকে ইসলাম মহত্তম চরিত্রের মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করেছে এবং একটি মহান আদর্শ হিসেবে এর প্রতি অত্যধিক ‍গুরুত্বারোপ করেছে। সমাজে যখনই ইসলামী নৈতিকতা বিজয়ী হবে, তখন সমাজ জীবনে সেইসব লোকদের সর্বাধিক সম্মনের চোখে দেখা হবে যারা ন্যায় পথে এং সৎপথে তা ব্যয় করে। পক্ষান্তরে যারা অর্থসম্পদ সঞ্চয় ও মওজুদ করে পুঞ্জিভূত করে রাখার চেষ্টা করে, কিংবা উপার্জিত সম্পদের উদ্বৃত্ত অংশকে আরও সম্পদ লাভের কাছে খাটায়- সমাজে তাদের কোনো মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হবে না।

২. অর্থপূজার মূলোচ্ছেদ

কেবল নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে এবং সমাজের নৈতিক প্রভাবও অনুশাসনের দ্বারা অস্বাভাবিক লোভ ও লালসাগ্রস্ত লোকদের অপরাধ প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে। এতোসবের পরও সমাজে এমন লোক অবশিষ্ট থাকতে পারে যারা নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্স অর্থসম্পদকে আরো অধিক অর্থোপার্জনের কাজে বিনিয়েঅগ করতে প্রয়াস পাবে। তাই ইসলাম মানুষের এ প্রবণতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং প্রয়োজনের অধিক অর্থসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতিপয় আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদ ‍সুদের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করাকে ইসলামী আইনে অকাট্যভাবে হারাম করে দেয়অ হয়েছে। আপনি যদি কাউকেও নিজের অর্থসম্পদ ঋণ প্রদান করে থাকেন তাহলে, ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ নিজের প্রয়োজন মেটানো জন্যে ব্যয় করুক অথবা জীবিকা উপার্জনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করুক সর্বাবস্থায়ই আপনি কেবল আপনার মূল অর্থ ফেরত পাবারিই অধিকার রাখেন, মূরে চেয়ে বেশী নয়। এমনিভাবে ইসলাম যুল্‌ম ও শোষণমুলক পুঁজিবাদী কর্মনীতির ভিত্তিমূল চূর্ণ করে দিয়েছে এবং সেই বড় হাতিয়ারটিকে সম্পূর্ণ ভোতা করে দিয়েছে যার মাধ্যমে পুঁজির মালিক শুধু তার পুঁজি খাটিয়ে সমাজের সমস্ত অর্থসম্পদ শুষে নিয়ে নিজের কর্য়ত্ত করার সুযোগ পায়।
কিন্তযু উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদের নিজের ব্যবসা, শিল্প, কারিগরী কিংবা অন্যন্য কায়কারবার বিনিয়েগ করা, অথবা অন্যদের কারবারে লাভ লোকসান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে খাটানোর প্রক্রিয়াকে ইসলাম বৈধ ঘোষণা করেছে। আর এ প্রক্রিয়ায় প্রয়োনাতিরিক্ত যে সম্পদ লোকদের হাতে জমা হবে, তার মন্দ প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করার জন্যও ইসলাম আরও কিছু ব্যবস্থা প্রদান করেছে।

৩. সম্পদ বন্টন ও জননিরাপত্তা

ইসলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদ সঞ্চয় ও মওজুদ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলামের দাবী হলো, তোমার কাছে যা কিছু অর্থসম্পদ আছে, তা হয় নিজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ে ব্যয় কর, না হয় কোনো বৈধ কারবারে বিনিয়োগ কর, অথবা অন্যদের দান করে দাও, যাতে তারা তা দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতে পারে। ইসলাম চায় এভাবে সমস্ত অর্থসম্পদ সমাজের মধ্যে অবিরাম আবর্তিত হতে থাকুক। কিন্তু যারা এ কাজ করবেনা, বরঞ্চ অর্থসম্পদ জমা করতে থাকবে, তাদেরকে প্রতিবচর আইন অনুযায়ী সঞ্চিত অর্থ থেকে বার্ষিক ২.৫% ভাগ হারে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। এ অর্থ সেইসব লোকের সাহায্যার্থ ব্যয় করা হবে, যারা জীবিকা উপার্জনের সংগ্রামে অংশ নেবার যোগ্য নয়, কিংবা অংশ নেয়ার পরও নিজের প্রয়োজন মেটাবার মতো উপার্জন থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। ইসলামী পরিভাষায় এ ব্যবস্থার নাম হলো যাকাত। ইসলাম যাকাত আদায় ও বন্টনের যে ব্যবস্থ দিয়েছে তা হলো, যাকাত আদায় করে জনগণের যৌথ কোষাগারে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বায়তুল মালে জমা করা হবে। কোষাগার সেই সমস্ত লোকের প্রয়োজন পূলণের যিম্মাদার হবে, যারাই সাহায্যের মুখাপেক্ষী হবে। মূলতঃ যাকাত সামাজিক বীমার সর্বোত্তম ব্যবস্থা। সামাজিক সাহায্য সহযোগিতার সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার অভাবে যেসব অনিষ্ট ও বিপর্য সৃষ্টি হয়, বায়তুল মালের ব্যবস্থা সেগুলোর মূলোচ্ছেদ করে দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে জিনিস মানুষকে সম্পদ সঞ্চয় এবং লাভজনক কাজে বিনিয়েঅগ করতে বাধ্য করে এবং যার ফলে জীবনবীমা প্রভৃতি প্রয়োজন দেখা দেয়, তা হলো সেখানে প্রতিটি মানুষের জীবন কেবল নিজের উপায় উপাদানের উপরই নির্ভরশীল। সে ব্যবস্থায় কিচু সঞ্চয় না করলে বৃদ্ধ অবস্থায় না খেয়ে মরতে হয়। সন্তান সন্তরি জন্যে কিচু না রেখে গেলে তারা ‍দুয়অরে দুয়ারে ভিক্ষা করেও এক টুকরা রুটি জাটাতে পারেনা। কিছু সঞ্চয় না রেখে রোগাক্রান্ত হলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। এ ব্যবস্থায় যদি সঞ্চয় না থাকে আর হঠাৎ যদি ঘর পুড়ে যায়, ব্যবসা লাটে উঠে, কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়, তাহলে আশ্রয় বা সাহায্য পাওয়া বা নির্ভর করার কোনো আশায় থাকে না।
একইভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষ পুঁজিপতিদের ক্রীতাসে পরিণত হতে বাধ্য হয় এবং শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের আরোপিত যাবতীয় অন্যায় শর্ত মেনে নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়, এর কারণও এটাই য, পুঁজিপতি শ্রমের বিনিময়ে যে মজুরী দেয় তা মেনে না নিলে শ্রমিকদের বিবস্ত্র থাকতে হবে আর অনাহারে ধুকে ধুকে মরতে হবে। পুঁজিপতির ‘দান’ থেকে মুখ ফিরালে শ্রমিকের জন্যে দু’বেলার অন্ন জুটানো সম্ভব হবে না।
আধুনিক কালের মানব জাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে পুঁজিবাদের আরো এক দুষ্ট অভিশাপ। একদিকে দারিদ্র আর ক্ষুধার জ্বালায় ধুকে ধুকে মরছে লক্ষ কোটি দরিদ্র অনাহারী মানুষ, আর অপরদিকে জমির অঢেল উৎপন্ন ফসল আর কারখানার উৎপাদিত বিপুল পণ্যসামগ্রীর ভাণ্ডার স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু দরিদ্র লোকদের পক্ষে তা ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না, ক্রয় করার ক্ষমতা তাদের নেই। এমনকি লক্ষ লক্ষ মন গম সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, অথচ অনাহারী মানুষের ভাগ্যে একুঠো খাবর জুটছেনা। এ অভিশাপের প্রধান কারণ এই যে, সাহায্যের মুখাপেক্ষী মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাবার মতো কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। যদি এই দরিদ্র লোকদের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা ‍সৃষ্টি করা হতো, তবে শিল্প, বাণিজ্য এবং কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে মানুষের দক্ষতা ও নৈপূণ্য আরো অধিক বিকশিত হতো।
ইসলাম যাকাত এবং বায়তুলমালের মাধ্যমে এ ধরনের সকল অনিষ্টের মূলোচ্ছেদ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল প্রতিটি মুহূর্ত একজন সাহায্যকারী বন্ধুর মতো প্রত্যেক মানুষের পাশে অবস্থান করে। ভবিষ্যতের চিন্তায় চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। প্রয়েঅজন হলে যে কোনো লোক বায়তুল মালে গিয়ে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে পারে। এ অবস্থায় ব্যাংক ডিপোজিট এবং বীমা পলিসির আর কি প্রয়োজন থাকতে পারে? হতে পারে আপনি শিশুসন্তান রেখে ইহকাল ত্যাগ করছেন। কিন্তু দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আপনি নিশ্চিন্তে পরপারে পাড়ি জমান। আপনার পরে আপনার সন্তানদের সকল দায়িত্ব বহন করবে বায়তুলমাল। রোগগ্রস্ততা, বৃদ্ধাবস্থা, আসমানী এবং যমীনী বিপদ, মোটকথা, বর্বাবস্থায় বায়তুলমাল আপনার সার্বক্ষণিক সাহায্যকারী. যার উপর নির্দ্বিধায় নির্ভর করতে পারেন। পুঁজিপতির যে কোনো অন্যায় শর্ত মেনে নিয়ে আপনাকে তার কাজ করতে বাধ্য হতে হবে না। বায়তুলমালের বর্তমানে আপনার ক্ষুধার্ত থাকা, বিবস্ত্র থাকা এবং নিরুপায় হবার কোনো ভয় নাই। তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল এমনব্যক্তিকেই প্রয়োজনীয় জীবনসামগ্রী ক্রয় করার যোগ্য বানিয়ে দেয়, যারা অর্থ উপার্জনের সম্পূর্ণ অযোগ্য, কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে কম উপার্জন করে থাকে। এভাবেই পণ্য উৎপাদন ও বন্টনের মধ্যে পারস্পরিক সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই কোনো দেশের দেউলিয়াত্বকে অন্যদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার জন্যে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ানো এবং অবশেষে গ্রহলোক পর্যন্ত দৌড়াবার কোনো প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকবেনা।
কিছু কিছু ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত হয়ে পড়া অর্থসম্পদ সমাজে ছড়িয়ে দেবার জন্যে ইসলাম যাকাত ছাড়াও অন্য যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তা হলো উত্তরাধিকার আইন। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য আইনের প্রবণতা হলো, কোন ব্যক্তি সারাজীবন ধরে যতো অর্থসম্পদ পুঞ্জিভূত করেছে, তার মৃত্যুর পরও তাকে একইভাবে পুঞ্জিভূত রোখা। পক্ষান্তরে ইসলাম, কোনো ব্যক্তি সারাজীবন গুণে গুণে যে অর্থসম্পদ পুঞ্জিভূত করেছে, তার মৃত্যুর পর তা অন্যদের মধ্যে বিলি বন্টন করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। ইসলামী আইনে পুত্র কন্যা, বাবা মা, স্ত্রী, ভাইবোন- এরা সবাই এক ব্যক্তির উত্তরাধিকার এবং তার রেখে যাওয়া সম্পদ একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম বিধি অনুযায়ী এদের মধ্যে বণ্টিত হওয়া জরুরী। কোনো নিকটাত্মীয় বর্তমান না থাকলে দূর আত্মীয়ের সন্ধান করা হবে এবং সম্পদ তাদের মধ্যে বিলি করা হবে। নিকটের বা দূরের কোনো আত্মীয় যদি বর্তমান না থাকে তবে পালকপুত্র গ্রহণ করে তাকে সম্পদের একচ্ছত্র মালিক বানিয়ে দেবার অধিকার ইসলাম কাউকে প্রদান করে না। কেউ যদি কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয় না রেখে মারা যায়, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজই তার সমস্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী। তার পুঞ্জিভূত করে রেখে যাওয়া সমস্ত অর্থসম্পদ জাতীয় কোষাগার বায়তুলমালে জমা করা হবে। এভাবে কোনো ব্যক্তি যদি বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থম্পদও পুঞ্জিভূত করে, তার মুত্যুর পর দুই তিন পুরুষ সময়কালের মধ্যেই তা বহু ছোট ছোট ভাগে খন্ড বিখন্ড ও বিভক্ত হয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। এমনি করে সম্পদের প্রতিটি পুঞ্জিভূত ভাণ্ডার বিস্তৃত ও বিকেন্দ্রীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে ঘরে ঘরে।

ভাববার বিষয়

অর্থব্যবস্থার অতি ক্ষুদ্র একটি চিত্র এখানে আমি উপস্থাপন করলাম। এর উপর আপনার চিন্তাভাবনা করে দেখুন। শয়তানের ভ্রান্ত শিক্ষার ফলে ব্যক্তিমালিকানায় যেসব অনিষ্ট দেখা দেয় ইসলামী অর্থব্যবস্থা কি তা সবই বিদূরিত করে দেয়না? তাহলে সমাজতান্ত্রিক সতবাদ, কিংবা ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি, কিংবা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক মতবাদ গ্রহণ করে অর্থব্যবস্থার এমন কৃত্রিম প্রক্রিয়া অবলম্বন করার কোনো প্রয়োজন আছে কি? বিশেষ করে যেসব ব্যবস্থা কোনো একটি অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম তো নয়ই, বরঞ্চ তদস্থলে সৃষ্টি করে আরো অসংখ্য বিপর্যয়। এখানে আমি পুরো ইসলামী অর্থব্যবস্থার কথা আলোচনা করিনি। ভূমি ব্যবস্থা ও বাণিজ্যিক বিরোধের [Trade Disputes] মীমাংসা এবং শিল্প ও কৃষির জন্যে ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী পুঁজি সংগ্রহ সরবরাহের যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যেতে পারে এবং যার পূর্ণ অবকাশ ইসলামে রয়েছে তার পূর্ণাংগ রূপরেখা এ স্বল্প পরিসরে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ইসলাম যেভাবে আমদানী রফতানী শুল্ক এবং দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যবসায়িক পণ্যের চলাচলের উপর শুল্কের কড়াকড়ি শিথিল করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অবাধ চলাচল ও বিনিময়ের পথ ‍উন্মুক্ত করেছে, সে বিষয়েও আমি এ নিবন্ধে আলোচনা করতে পারিনি। এগুলোর চেয়ে একটি বড় বিষয় এখানে বলার সুযোগ পাইনি। তা হলো রাষ্ট্র পরিচালনা, সিভিল সার্ভেস এবং সামরিক খাতে যথাসম্ভব ব্যয় সংকোচন করে এবং আদালতের স্পম্প ডিউটি প্রথার মূলোচ্ছেদ করে ইসলাম সমাজের ঘাড় থেকে বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা হালকা করে দিয়েছে। করলব্ধ আয়কে মাথাভারী প্রশাসনিক খাতে ব্যয় করার পরিবর্তে সমাজের কল্যাণ ও সুখ শান্তির কাজে ব্যয় করার বিরাট সুযোগ ইসলাম করে দিয়েছে। এগুলোর ফলে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানব সমাজের জন্যে পরিণত হয় এক বিরাট রহমত ও আশীর্বাদে। অন্ধ বিদ্বেষ পরিহার করে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অজ্ঞতাপূর্ণ সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগি এবং পৃথিবীব্যপী প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বিরোধী শাসন ব্যবস্থার তীব্র প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে যদি স্বাধীন বিবেক বিবেচনার দৃষ্টিতে ইসলামী অর্থব্যবস্থাকে অধ্যয়ন করা হয়, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস একজন বিবেকবান ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকেও এমন পাওয়া যাবেনা, যিনি মানুষের অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্যে এ ব্যবস্থাকে অধিকতর উপকারী, বিশুদ্ধ ও যুক্তিসংগত বলে স্বীকার করবেন না। কিন্তু কারো মন মগজে যদি এরূপ কোনো ভ্রান্তধারণা জন্ম নেয় যে, ইসলামের গোটা বিশ্বাসগত, নৈতিক চরিত্রগত এবং সমাজ ব্যবস্থাগত কাঠামোর মধ্য থেকে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে সাফল্যের সাথে পরিচালনা করা যেতে পারে, তবে আমি নিবেদন করবো, দয়া করে এই ভ্রান্ত ধারণা মনমগজ থেকে ধুয়ে ‍মুঝে বের করে ফেলুন। ইসলামের অর্থনীতি এর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আইন ও বিচার বিভাগীয় এবং সামাজিক ও পারিবারিক ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এসবগুলোর ভিত্তি ইসলামের নৈতিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই নৈতিক ব্যবস্থাও আবার স্বয়ংক্রিয় নয়। বরঞ্চ তা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এক সর্বজ্ঞানী সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তাঁর সম্মুখে জবাবদিহী রার দৃঢ় বিশ্বাসের উপর। মৃত্যুর পর আখিরাতে আল্লাহর আদালতে পার্থিব জীবনের সমস্ত কার্যকলাপ বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা হবে এবং এই বিচার অনুযায়ী শাস্তি অথবা পুরস্কার লাভের উপর দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতে হবে। স্বীকার করে নিতে হবে মুহাম্মদ (সা) আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নৈতিক ও আইনগত যে বিধি ব্যবস্থা পৌঁছে দিয়েছেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যার একটি অংশ, তা পরিপূর্ণরূপে আল্লাহরই হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই আকীদা বিশ্বাস, নৈতিক ব্যবস্থা এবং পূর্ণাংগ জীবন যাপন পদ্ধতিকে হুবহু গ্রহণ না করলে শুধুমাত্র ইসলামের অর্থব্যবস্থা তার সঠিক স্পিরিট অনুযায়ী একদিনও চলতে পারবেনা এবং তা দ্বারা সত্যিকার কোনো কল্যাণ লাভ করা সম্ভব হবেনা।

Page 2 of 12
Prev123...12Next

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • রমাদান ২০২২
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
  • লেখক

@BJI Dhaka City South