দ্বিতীয় খণ্ড
ইসলামের উপর বাতিলের হামলা ও তার কারণ
এ দেশের খৃষ্টান মিশনারীরা এ দেশের মুসলমানদেরকে খৃষ্ট ধর্মের দিকে আহবান জানানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে সম্প্রতি কতিপয় প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। সেসব প্রস্তাব পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এগুরো পড়ে পাঠকদের মধ্যে কয়ঝন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে কার্যকর পদক্ষেপের উদ্যোগী হয়েছেন আর কয়জনই বা ঈষৎ পরিতাপ করে আমার নিজ কাজে মন দিয়েছেন তা আমি জানি না । তবে একথা সত্য যে, হৈ-হল্লা করার প্রবণতা আমাদের একটা মজ্জাগগত ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল আমাদের এরূপ অভ্যাস হয়ে গেছে যে, যখনই বিরোধীদের কোনো বড় হামলা বা বিশেষ পরিকল্পনার খবর আমরা পাই তখন সহসাই চমকে উঠি এবং বেশামাল ও উদ্বেগাকুল অবস্থায় কিছু অগোচাল ধরনের পদক্ষেপও নিয়ে বসি। আমর যে-ই বিপদ একটু কমে যায় অমনি নিশ্চিত হয়ে বসে পড়ি। খৃষ্টান মিশনার ও আর্য প্রচারকদের নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের ৫০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ দীর্ঘ সময় ধরে তারা অত্যন্ত নীরবে কাজ করেছে। এমন একটি বছর যায়নি যখন তারা নতুন কিছু সংখ্যক লোককে স্বধর্মে দীক্ষিত করেনি। কিন্তু আমরা তাদের নীরবতাকে নিজেদের মত নিষ্ক্রিয়তার লক্ষণ মনে করেছি এবং কখনো নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা করিনি। আমাদের অবস্থা মারেবের গ্রামবাসীদের মত। নিজেদের পিতৃ-পুরুষদের বানানো বাঁধকে তারা দেবতাদের নির্মিত বাঁধ মনে করতো। তারা ভাবতো, ঐ বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া বা দুর্বল হওয়া সম্ভব নয় যখন ইঁদুর বাঁধে ছিদ্র করতে শুরু করতো তখনও তারা এই ভেবে নিশ্চিত হয়ে বসে রইরো যে, দেবতাদের নির্মিত এ বাঁধ ভাঙ্গা ইঁদুরের কাজ নয়। কিন্তু সেই ইঁদুরগুরো বহু বছর ধরে একাধিক্রমে চেষ্টা চালিয়ে এতটা সফলতা লাভ করলো যে বাঁধ থেকে পানি চুইয়ে পড়তে লাগলো। পরে কিছুটা পানির প্রবলতায় ও কিছুটা প্রাচীরের ভাঙ্গনে এমন ফল হলো যে, একদিন সহসা বাঁধ একেবারেই ভেঙ্গে পড়রো এবং দূর-দূরান্তের জনবসতিগুরো পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেল। আমাদের দশাও সেই রকম। ইসলামের বাঁধ ভীষণ মজবুত বলে আমাদের একটা ভরসা আছে। বস্তুতঃ সে ভরসা থাকাও উচিত। কিন্তু আমাদের নিজেদের ত্রুটির কারণে সেই বাঁধকে দুর্বল বানিয়ে ফেলছি। তার ফলে ইঁদুরেরা এর মধ্যে ছিদ্র করার চেষ্টা করছে এবং কিছু কিছু সফলও হচ্ছে।
অন্যদের সাফল্য আমাদের অযোগ্যতারই ফল
আমাদের ভেবে দেখা উচিত যে, কি কারণে আর্যপ্রচারকগণ ও খৃষ্টান মিশনারীরা আমাদের মোকাবিলা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারছে। তাদের ধর্মকে যাঁচাই বাছাই করে দেখুন, দেখবেন তা এমন সব হাস্যকর রীতিনীতির সমাবেশ যা তারা আমাদের কাছে পেশ করা তো দূরের কথা নিজেরা কখনো এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বসরো নিজেরাই লজ্জা পাবে। তাহলে এহেন অচল পণ্য নিয়ে তারা কিভাবে বাজারে আসছে এবং কেমন করেই বা সফলতা লাভ করছে? এর একটা কারণ তো থাকা চাই। এ প্রশ্নের ব্যাপারে চিন্তা করলে স্পষ্টতই মনে হয় যে, তাদের এ সাফল্য তাদের যোগ্যতার নয় আমাদের অযোগ্যতার ফল। তাদের বাণিজ্যের এ চাকচিক্য এজন্য নয় যে, তাদের পণ্য ভালো এবং বাজারে তার চাহিদা আছে। বরং এটা শুধু এজন্য বিক্রি হচ্ছে যে, বাজারে আমাদের পণ্যের কদর আমরাই নষ্ট করেছি। এটা আমাদের সুনিশ্চিত বিশ্বাস যে, কোনো ব্যক্তি একবার ইসলামের দীক্ষা নিলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে এ সত্য ধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা যদি পেশ করাই না হয় সাদারণ মুসলমানদের কাছে কেবল ঐতিহ্যগত ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামই যদি থেকে যায় এবং তাদেরকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব যদি বুঝানো না হয় তাহলে এর দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে ভরসা করা যায় কিভাবে? আর ভরসা করলেও সে ভরসা টিকবার নিশ্চয়তা কোথায়?
বিপদের মূল কারণঃ আমাদের ধর্মীয় দুর্যোগাদির স্থায়ী উৎস
একটু গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা কররে বোঝা যাবে যে, একমাত্র আমাদের দুর্বলতার জন্যই অমুসলিম প্রচারকরা মুসরমান সমাজে নিজ ধর্মের প্রচার চালানোর ও তাদেরকে ধর্মান্তরিত করার ধৃষ্টতা দেখিয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে যতদিন এসব দুর্বলতা ও ত্রুটি থাকবে ততদিন এ বিপদের ঝুঁকিও থাকবে। আমাদের হতভাগা শ্রবণেন্দ্রীয় নিয়তই এরূপ খবর শুনতে থাকবে যে. আজ অমুক জায়গায় আর্য ও খৃষ্টানদের হামলা হয়েছে, আজ অমুক জায়গায় মুসলমানরা বিধর্মীদের টোপের শিকার হয়েছে। সাময়িকভাবে এসব বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভাসাভাসা কতিপয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা এবং তারপর নিশ্চিত হয়ে বসে থাকার এ ব্যাধি দূর হবে না। বরং এতে করে কিছুদিন পর এমন অবস্থা হবার আশংকা রয়েছে যে, আমরা এসব খবর শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যাব এবং এদিকে মনোযোগ দেয়াই বন্ধ করে দেব। এর যদি কোনো কার্যকর প্রতিকার করতে হয় তবে আমাদের মূল দুর্বলতাগুরোর চিকিৎসায় মনোযোগী হতে হবে এবং তাকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করার জন্য কাযৃকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে করে আমাদের মধ্য থেকে সেই মূল বস্তুটাই দূর হয়ে যাবে যা দুশমনদেরকে আমাদের উপর হামলা চালানোর উৎসাহ যোগায়। আমার দৃষ্টিতে আমাদের এ দুর্বলতা তিন রকমের এবং এগুলোই সমস্ত অকল্যাণের মূল উৎসঃ
(১) অজ্ঞতা
প্রথমতঃ মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ অজ্ঞ ও মূর্খ। বিশেষতঃ ইসলামের ব্যাপারে তাদের অজ্হতা এমন পর্যায়ে যে, অনেকে কলেমা পড়াও জানে না। সত্রি বলতে কি, মুসলমান পরিবারে জন্মেও অনেকে নামের মুসলমানও নেই। এজন্য এ ধরনের লোকদেরকে শত্রুরা সহজেই ইসলাম থেকে বিচ্যুৎ করতে সক্ষম।
(২) দারিদ্র
দ্বিতীয়তঃ মুসলমানরা সীমাতিরিক্ত দরিদ্র। অজ্ঞতা ও দারিদ্র একাকার হয়ে তাদেরকে বিত্তশালী অমুসলিম প্রচারকদের আক্রমনের সহজ শিকার বানিয়ে দেয়।
(৩) ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা
তৃতীয়তঃ মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা হেতু তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হয়। সেখানে তাদের সরল মনের উপর শিশুকাল থেকেই খৃষ্টবাদের ছাপ পড়তে আরম্ভ করে। পরবর্তীকালে এ ছাপই গোপন কিংবা প্রকাশ্য ধর্মান্তরিত হওয়ার সহায়ক হয়।
এই হলো আমাদের ধর্মীয় বিভ্রান্তির স্থায়ী উৎস।–[এটা ১৯২৫ সালের পর্যবেক্ষণের ফল। সতর্ক বিচার-বিবেচনায় দেখা যাবে, এ যুগেও কম-বেশী এগুরোই মুসলমানদের ধর্মীয় অনগ্রসরতা ও বিভ্রান্তির মূল উৎস।-অনুবাদক] এ বিভ্রান্তির কারণ এতো অধিক সংখ্যক যে, তা গুণে শেষ করা যায় না এবং এখানে তার বিস্তারিত আলোচনাও সম্ভব নয়। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, এর মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক জিনিস হলো নিম্নরূপঃ ৱ
মুসলমানদের পরাধীনতা, আলেম সমাজের উদাসীনতা, মুসলিম সমাজে অনৈসলামী রসম-রেওয়াজের প্রচলন, বিশ্ব মুসলিম শক্তির বহুধা বিচ্ছিন্নতা এবং টাকা-পয়সার শক্তি সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে বাস্তব অনুভূতির অভাব –যা তাদের দারিদ্র বৃদ্ধির প্রধান অন্যতম কারণ।
আমাদের সরলতা ও অদূরদর্শিতা বনাম শত্রুদের চতুরতা ও দূরদর্শিতা
উল্লেখিত করণসমূহ ও দুর্বলতাসমূহের মধ্যে একটিও এমন নয় যার জন্য আমরা নিজেদের ছাড়া কাউকে দোষারোপ করতে পারি। এর কোনোটিরই উৎস আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে নয়। এখন এগুরোর প্রতিরোধের জন্য যদি আমরা প্রচারাভযান চারাই অথবা সেমিনার সিম্পজিয়াম অনুষ্ঠিত করি অথবা সেমিনার সিম্পজিয়াম অনুষ্ঠিত করি অথবা যেসব জায়গায় মুসলমানরা ইসলাম তেকে বিপথগামী হচ্ছে সেখানে আমাদের প্রচারকদের পাঠিয়ে দেই, তাহলে তাতে করে বর্তমান রোগের চিকিৎসা হবে না, ভবিষ্যতের রোগ থেকেও নিরাপত্তা লাভ করা যাবে না। অথচ এ ধরনের কাজই আমরা এ যাবত করে আসছি। আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের কর্মপদ্ধীত যদি এ রকম হতো, তাহলে হয়তো এভাবে আমরা কিছুটা সফলকাম হতে পারতাম। কিন্তু তারা তো প্রচারাভিযান ও ওয়াজ-নছিহত শুধু আমাদেরকে কর্মব্যস্ত করাকার জন্য একটা চক্রান্ত হিসেবে করে থাকে। নচেৎ আসলে তাদের কর্মপদ্ধীত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাসত্ব, আমাদের আলেম সমাজের উদাসীনতা, আমাদের জাতীয় অনৈক্য, আমাদের অন্য সমম্ত দুর্বলতাকে পুরোপুরিভাবেই কাজে লাগায়। তারা হাজার হাজার হাসপাতাল স্থাপন করেছে। সেখানে নিজ ধর্মের প্রচার চালিয়ে থাকে। তারা হাজার হাজার এতিমখানা খুলছে। সেখানে অসংখ্য এতিম বালক-বালিকাদেরকে খৃষ্টবাদের ট্যাবলেট গেলানো হয়। তারা তাদের কার্যক্রমকে এতটা নিখুঁত করে তৈরী করে রেখেছে যে, যেখানেই দুর্ভিক্ষ কিংবা অন্য কোন প্রকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়, সেখানে সমস্ত নিরাশ্রয় লোকদেরকে আশ্রয় দেয়, ভাত-কাপড়ের রিলিফ দেয়ার মাধ্যমে নিজ ধর্ম প্রচার করে থাকে। তারা সারা ভারতবর্ষে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। সেখানে অতি ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে বালক বালিকাদেরকে ধর্মান্তরিত হতে উৎসাহিত করা হয়। তারা নিজেদের মধ্যে এমন ধৈর্য ও স্থিরতা, এতটা ত্যাগ ও সেবার মনোবাব এবং এমন সাচ্চা ধর্মীয় নিষ্ঠা গড়ে তুলেছে যে, তারা বছরের পর বছর এক জায়গায় চরম একাকীত্ব ও বৈরাগ্যে অবস্থান কাটিয়ে দেয়। তারা যোগী-সন্যাসী ও ফকীর-দরবেশদের জীবন-যাপন করে এবং অতি নীরবে লোকদের মধ্যে নিজ ধর্মের প্রচার চালায়। তাদের মধ্যে এমন গভীর বুদ্ধিমত্তা বিদ্যমান যে, একেবারে খালেছভাবে না হলেও অন্ততঃপক্ষে কৃত্রিমভাবে লোকদের সামনে উঁচু মানের পরহেজগারীমূলক এবং সরল ও অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করে এবং এমন উন্নত নৈতিক চরিত্র জাহির করে থাকে যে, মৌখিক ও ছাপানো উপদেশের চেয়ে তাদের বাস্তব সদাচরণই বেশী করে প্রচার মাধ্যমের রূপ পরিগ্রহ করে। তদুপরি আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তারা আমাদের উপর অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে থাকে। এ কর্মপদ্ধতি কতখানি গভীর ও কার্যকর তা বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ যেন এক ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব যা এক সাথে ভীষণ শব্দও করে, দালান কোঠাও ভেঙ্গে চুরে গুড়িয়ে দেয় এবং বড় বড় প্রাসাদের ভিত্তিও ধ্বসিয়ে দেয়। এর মোকাবিলায় মামুলি তকতা দিয়ে বাঁধ দিলে কিংবা অনুরূপ কোনো লেপপোচ দিলে তাতে কোনো কাজ হয় না। এজন্য আমাদেরকেও বিরুদ্ধবাদীদের মতই গভীর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নচেৎ আমাদের আত্মরক্ষা চেষ্টার সাফল্য অসম্ভব।