পাঁচ
চীনে ইসলাম প্রচার
আফ্রিকার পর মুসলমানদের সফল প্রচারাভিযানের দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হলো দূরপ্রাচ্য। এখানে শুধুমাত্র বণিকগণ, সিপাহীগণ এবং বিভিন্ন পেশার সাধারণ মুসলমানগণ নিজ স্বভাবসূলভ প্রচার স্পৃহা ও ধর্মীয় আবেগের বশেই ইসলাম প্রচার করেন। তারা কখনো আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য লাভ না করেও এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনমূলক আক্রমণের শিকার হয়ে।ো নিজ ধর্মের প্রচার-প্রসাবে বিস্ময়কর সাফল্য ল্যাভ করেন। সেই সাফল্যের কারণেই বর্তমানে চীন ও মালয় দ্বীপপুঞ্জে সব সমেন অন্ততঃ ৮/৯ কোটি মুসলমানের বাস।
চীনের ইসলামের প্রথম সূচনা হয় বনু উমাইয়ার যুগে। অবশ্য সাগর থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যে আরব বণিকগণ ছড়িয়ে পড়েছিলেন তারা খোলাফায়ে রাশেদীনের পুণ্যময় যুগেই চীণ ভূখণ্ডেও ইসলামের আালো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে এ জাতি ইসলামের সাথে যথার্থভাবে পরিচিত হয় বনু উমাই্য়া শাসনামলে –যখন চীনের সাথে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে যখন জনৈক ষড়যন্ত্রকারী সম্রাট সোয়ানসোংকে নিংসাহনচ্যুত করে তখন সাহায্যার্থে চার হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন এবং তাদেরই বাহুবলের কল্যাণে সম্রাট সোয়াসোং পুনরায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন। এই সৈন্যরা সত্যিকার ইসলাম প্রচারক ছিলেন। তারা এরপর আর দেশে ফিরে যাননি। বরং চীনেই বসবাস স্থাপন করেন এবং ওখানেই বিয়ে করেন। তারা সাধারণ চীনা জনগণের মধ্যে ক্রমান্বয়ে ইসলাম প্রচারের কাজ চালু করেন। ফলে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সমগ্র ক্যান্টেম অঞ্চল ইসলামের আলোকে আলোকিত হয়ে যায়।
ইসলাম প্রচার-স্তরে স্তরে
এ ঘটনার ছয়শ’ বছর পর আর একবার চীনে বাহির থেকে ইসলাম প্রচারকগণ প্রবেশ করেন এবং তারা সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েন। এরা ছিলেন আরব, ইরান ও তুরস্কের মুহাজির। হিজরী ৭ম শতকে তারা মঙ্গোলীয় আক্রমণের শিকার হয়ে দেশ ত্যাগ করে এখানে চলে আসেন। এদের কারণে একশ’ থেকে দেড়শ’ বছরের মধ্যে চীনের অধিকাংশ অঞ্চল ইসলাম বিস্তার লাভ করে। বিশেষতঃ উত্তর পশ্চিম চীনে বড় বড় অঞ্চল ইসলামে দীক্ষিত হয়। ১৩শ’ শতকে মার্কো পোলো লিখেছেন যে, প্রায় সমগ্র উনান প্রদেশ মুসলমান হয়ে গেছে। ১৪শ’ শতকের অন্য একটি ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, ‘তালিফো’র সমস্ত অধিবাসীরা মুসলমান। দক্ষিণ চীন সম্পর্কে ইবনে বতুতা লিখেছেন যে, সব শহরগুলোতেই মুসলিম মহল্লা রয়েছে। এসব মহল্লার সকল অধিবাসী মুসলমান এবং তারা দাদের ভদ্রতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। মুসলমানরা চীনা মহিলাদেরকে বিয়ে করে এবং তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখে। এজন্য খুব দ্রুত ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে। ১৫শ’ শতকে আলী আকবর নামক জনৈক মুসলি বণিক লিখেছেন যে, পিকিং-এর প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলিম পরিবার বাস করে। ১৭শ’ শতকের শুরুতে চীনা ইহুদীদর একটি বিরাট দল মুসলমান হয়ে যায়। ১৮শ’ শতকের কিন লং জিঙ্গারিয়ার বিদ্রোহ দমন করার পর সেখানে দম হাজার পরিবারকে পুনর্বাসিত করেন। এই দশ হাজার পরিবারের সকলেই পার্শ্ববর্তী মুসলিম জনসবতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়ে যায়। শানতোং অঞ্চলে এক দুর্ভিক্ষের সময় মুসলমানরা দশ হাজার চীনা বালককে আশ্রয় দেয় এবং তারা সকলেই পরে ইসলামে দীক্ষিত হয়। অন্য একটি দুর্ভিক্ষের সময় কোয়ান তুং অঞ্চলে প্রায় দশ হাজার চীনা বালক মুসলমানদের হস্তগত হয় এবং তাদের সকলকে ইসলামী ট্রেনিং দিয়ে লালন-পালন করা হয়।
এ ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থা ছাড়াও সাধারণ অবস্তায়ও মুসলমানরা এত বেশী পরিমাণে প্রচারকার্য চালাতেন যে, সাইয়েদ সোলায়মান নামক জনৈক চীনা মুসলমানের সাক্ষ্যমতে প্রতি বছর নতুন ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা গণনা করে শেষ করা কঠিন।
এ যুগেও চীনা মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের ঝোঁক রয়েছে। ব্যবসায়ী ও কারিগর ছাড়াও সরকারের মুসলিম কর্মচারীরা নিজ নিজ পরিচিত মহলে ইসলামের শিক্ষা বিস্তার করে থাকেন। চীনা সেনাবাহিনীর মুসলিম সিপাহী ও অফিসাররাও এ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। চীনা মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের যথার্থ গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। এজন্য প্রথমে কানসু প্রদেশে এবং পরে আরও দশটি প্রদেশে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনে বাহির থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যা হয়তো এক লাখের বেশী হবে না। কিন্তু এই বিশ্বজনীন প্রচার স্পৃহাই তাদের সংখ্যা ৫ কোটিতে পৌঁছিয়ে দিয়েছে।
এসব দেখে একজন রুশ পর্যবেক্ষক উদ্বেগের সাথে বলেছেন যে, ইসলাম প্রসারের এক গতি অব্যাহত থাকলে একদিন হয়তো মুসলমানরা দূরপ্রাচ্যের রাজণীর কাঠামোটাই পাল্টে ফেলবে।–[চীনের ইসলাম প্রচারের এ গতি ১৯২৫ সালের। কম্যুনিষ্ট অভ্যুত্থানের পর এ গতি অব্যাহত তো থাকেইনি বরঞ্চ ১৯৬১ সালের লোগ গণনা অনুসারে চীনে মুসলমানের সংখ্যা এক কোটি বলা হয়েছে। এ পরিসংখ্যানের কোনো সন্তোষজন ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি।-অনুবাদক]