স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি- দৃশ্য
ভারতীয় লেখক Asoka Raina তার Inside Raw ; The story of Indian’s the secret Service বইতে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দৃশ্যে সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেনঃ
“ঘটনা দ্রুত গড়িয়ে চললো । পাকিস্তানী প্রতিরোধের দ্বীপগুলো এড়িয়ে ভারতীয় বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হলো ঢাকার দিকে । ভারতীয় Raw এজেন্টদের পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতেই পাকিস্তানী প্রতিরোধ বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে এভাবে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছিলো । পাকিস্তানীরা অনেক জায়গায় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল । কিন্তু মুক্তি বাহিনীর দ্বারা নাজেহাল হয়ে এবং ভারতীয় বাহিনীর অব্যাহত সাফল্যে তারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলো । ঢাকা ও তার আশ পাশের উপর ক্রমাগত আক্রমন পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ডকে স্থবির করে দিয়েছিলো এবং এখান থেকে সৈন্যরা কোন নির্দেশনাই পাচ্ছিলো না ।
জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা যখন যুদ্ধ বিরতির চেষ্টা চালাচ্ছিল, ভারত তখন ১২ই ডিসেম্বর ঢাকার উপর চূড়ান্ত আঘাতের জন্য তৈরি হচ্ছিলো । এসময় ভারতীয় গোয়েন্দারা একটা বেতার বার্তা ধরে ফেলে, যা ঢাকার উপর চূড়ান্ত আঘাত এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণের নিমিত্ত হয়ে দাঁড়ায় । সেই বেতার বার্তাটি ছিল এইঃ ‘আমরা দুপুর বারটায় গভর্নর হাউজে বৈঠকে বসছি ।’ এ বার্তা থেকে এটা ধরে নেয়া হলো একটা উচ্চপর্যায়ের বৈঠক সেখানে হতে যাচ্ছে । বৈঠকটি বানচাল করার পরিকল্পনা নেয়া হলো । কিন্তু সমস্যা হলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড বোমা বর্ষণের লক্ষ্যস্থল গভর্নর হাউজের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারছিল না । বিমান এবং সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টারে সকল দৌড়াদৌড়ি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো । বয়ে যাচ্ছিলো সময় । বিষয়টা অন্য সংস্থার কাছে পাঠানো হলো । RAW –এর যেসব এজেন্ট ঢাকায় কাজ করছিল দ্রুত তাঁদের একটি মিটিং ডাকা হলো । এ এজেন্টরা ২৫ শে মার্চ রাতে সেনা অভিযানের পূর্ব মুহূর্তে ঢাকা ত্যাগ করেছিলো । এ এজেন্টদের মধ্যে একজন তার কাছে অবশিষ্ট ঢাকার একটা পর্যটন ম্যাপ মাত্র দিতে পারলো । ম্যাপটার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ । তবু কোন রকমে তাকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে আকাশ থেকে দেখা যায়, এমন একটা ভূমি চিহ্ন নির্দিষ্ট করে গভর্নর হাউজকে চিহ্নিত করা হলো । RAW- এর তৈরি এ নির্দেশনা ম্যাপটি বিমান বাহিনীর পাইলটের কাছে পৌছানো হলো । — ভারতীয় বিমান বাহিনীর হান্টার বিমান বোমা বোঝাই করে বেলা ১২ টার দিকে কোলকাতা থেকে আকাশে উড়লো । বোমা ফেলা হলো ।
পরে পাওয়া তথ্যে জানা গিয়েছিলো, গভর্নর মালিক দৌড়ে নেমে গিয়েছিলেন ভু- গর্ভস্থ বাংকারে । নামায পড়েছিলেন । কিছুক্ষন পরে বেরিয়ে এসে তার মন্ত্রীসভার সহযোগীদের সমেত তিনি পদত্যাগ করেছিলেন । ” ( MR. A. M Malik, the governor wrote the draft of his cabinet resignation letter to the president Yahiya with shaking ball point on a scrap of office paper as the Indai MIG- 21s destroyed his official residence——- All morning Mr. Malik and his cabinet had been unable to decide whether to resign or hang on. The Indian air raids finally decided him——- The resignation effectively throws all responsibility for a last ditch stand on the east Pakistan army commander Lt. Gen. A.A.K Niajy, who yesterday vowed to fight to the last man. —-The Times, DEC, 15, 1971 )
তারপর রেডক্রসের নিয়ন্ত্রণাধীন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন । তখন পাকিস্তান সরকারের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সামরিক প্রশাসক জেনারেল নিয়াজীর উপরে যুদ্ধ পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়লো । বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ তখন প্রায় শেষ । এর দুদিন পর নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন । আর বাংলাদেশের জন্ম হলো ।” Inside Raw ; The story of Indian’s the secret Service, page- 60-66 )
১৬ ই ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে চারটায় জেনারেল নিয়াজী রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিল ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার হাতে তুলে দেন । আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করলেন জেনারেল নিয়াজী এবং জেনারেল অরোরা । এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল উসমানী হাজির ছিলেন না । চারটের দিকে জগজিৎ সিং অরোরা এবং অন্যান্য জেনারেলরা এ অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য ঢাকা অবতরণ করতে পারলেন । কিন্তু জেনারেল উসমানীর আসা হয়নি । বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি উসমানী বিভিন্ন সমরাঙ্গন সফর করার উদ্দেশ্যে ১১ ই ডিসেম্বর থেকে কোলকাতায় অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি ।” ( মূলধারা-৭১, পৃষ্ঠা- ২৩৬ )
একথা সর্বৈব মিথ্যা এবং বানোয়াট । জেনারেল উসমানীর বক্তব্যই এর জলজ্যান্ত প্রমান । তিনি বলেন, ঐ দিনের আগের দিন আমি ময়নামতির রণাঙ্গনে, ১৬ই ডিসেম্বর দুপুরে জেনারেল অরোরার সাথে মধ্যাহ্ন ভোজন করি । ১৬ ই ডিসেম্বর দুপুরে তদানীন্তন লেঃ কর্নেল সফিউল্লাহর ‘এস’ ফোরস রণাঙ্গন পরিদর্শন করার জন্য আমার যাবার কথা ছিল । জেনারেল জগজিৎ সিং সেদিন না যেতে অনুরোধ করে বললেন, সেদিন ‘এস’ ফোরস পরিদর্শনে অসুবিধা হতে পারে, যাহেতু তারা অগ্রসর হচ্ছেন । আমি তখন আমার সফরসুচি পরিবর্তন করে সিলেটে ‘জেড’ ফোরস পরিদর্শনে যাবার সিদ্ধান্ত নেই । —- বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানতেন আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে । তাছাড়া মিত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানতেন আমি কোথায় ।” ( সাপ্তাহিক বিক্রম, ১২ই ডিসেম্বর, ১৯৮৮ )
দেখা যাচ্ছে ১৬ই ডিসেম্বর দুপুরে জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল উসমানী একসাথেই ছিলেন । বিকেল চারটার সময় জেনারেল অরোরা ঢাকায় আসেন । যে সংবাদ পেয়ে জেনারেল অরোরা ঢাকায় আসতে পারলেন, সে সংবাদ পেলে জেনারেল উসমানী ঢাকায় আসতে পারবেন না কেন ? আসলে তাকে জানানো হয়নি । জানানো হয়নি তাকে ঢাকা আসতে বিরত রাখার জন্যই । জেনারেল উসমানীর মতো উল্লেখযোগ্য অন্যান্য ব্রিগেড কমান্ডারদেরকে ঢাকা আসতে বাঁধা দেয়া হয়েছে । জনাব এম, আর আখতার মুকুল লিখছেন, “আমাদের যেসব ব্রিগেড কমান্ডার যুদ্ধ করে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিলেন, তাঁদেরকে ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় আসতে না দিয়ে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো । —– সাবরুম সেক্টর থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসরমান তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানকে তার ‘জেড’ ফোরস নিয়ে সিলেটের দিকে যাবার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো । ‘কে’ ফোরসের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ কসবা আখাউরা দুর্বার গতিতে ঢাকার পথে দাউদকান্দি পর্যন্ত এসে হাজির হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় বাহিনী তাকে পথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয় । অথচ খালেদ মোশাররফের দুই নং সেক্টরের ‘ক্র্যাক প্লাটুনের’ প্রধান ক্যাপ্টেন হায়দার তার দলবল নিয়ে ঢাকার আশেপাশে পরবর্তী নির্দেশের জন্য আপেক্ষা করছিলেন ।” ( আমি বিজয় দেখেছি— পৃষ্ঠা- ২১৭, ২১৮ )
‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ শীর্ষক গ্রন্থে ‘এস’ ফোরসের অধিনায়ক শফিউল্লাহর এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ভারতীয় কমান্ডার তার ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া পছন্দ করেননি । আখাউরা দখলের পর ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক তাকে বললেন আখাউরা প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকার জন্য এবং তার বাহিনী ভৈরবের দিকে যাবে বলে জানালেন । তখন ‘এস’ ফোরসের অধিনায়ক সামনে এগিয়ে যাবার ইচ্ছা পোষণ করলে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক তাকে বললেন, “তাহলে তো আপনাকে নিজস্ব প্রবেশ পথ নিতে হবে ।’ ‘এস’ ফোরসের অধিনায়ক বললেন, তাই হবে । ভৈরবে পৌঁছে ভারতীয় কমান্ডার বললেন, আপনি ফরটিনথ ডিভিশনকে ঘিরে রাখুন । তিনি বললেন, ফরটিনথ ডিভিশনকে ঘিরে রাখার জন্য কিছু ফোরস রেখে আমিও ঢাকার দিকে যাবো । ভারতীয় কমান্ডার বললেন, আমাদের ফোরস তো হেলিকপ্টারে নরসিংদী যাচ্ছে, আপনি কিভাবে যাবেন ? ‘এস’ ফোরসের কমান্ডার বললেন, আমাই হেটে চলে যাবো । নরসিংদী আসার পর ভারতীয় কমান্ডার আমাদের কমান্ডারকে বললেন, আপনি নরসিংদী থাকুন, আমরা ঢাকা যাচ্ছি । ‘এস’ ফোরসের কমান্ডার মেজর শফিউল্লাহ বললেন, ‘নরসিংদীতে আমার থাকার কোন প্রয়োজন নেই । আমিও ঢাকা যাবো ।’ অতপর নরসিংদীর সব যানবাহন ভারতীয় বাহিনী নিজেরা নিয়ে ডেমরা পৌঁছেন । আমাদের কমান্ডার তার বাহিনীসহ পায়ে হেঁটে ভোলতা পুলের কাছে আসেন । সেখান থেকে কোনাকুনি পথে রূপগঞ্জ দিয়ে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ডেমরার পেছনে গিয়ে ওঠেন ।” ( একাত্তরের রণাঙ্গন, পৃষ্ঠা- ১৫২ )
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের এ দুর্দশার কাহিনী প্রমান করে, ভারতীয় বাহিনী আমাদের সেক্টর কমান্ডারদের শুধু ঢাকা আসতেই বাঁধা দেননি, মুক্তিবাহিনীকে তারা অনুগত অনুল্লেখযোগ্য বাহিনীর বেশি মর্যাদা দিতে চায়নি । যার কারনে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা পর্যন্ত অত্যন্ত অপমানকর আচরনের সম্মুখীন হয়েছেন । এমনকি বাংলাদেশ সরকারও তাঁদের তাচ্ছিল্য ও অপমানকর আচরন থেকে রেহাই পায়নি । এ সম্পর্কে একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ৯ নং সেক্টর কমান্ডার জনাব মেজর এম, এ জলিল । তিনি লিখেছেনঃ
“বরিশাল সদর থেকে নির্বাচিত জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ( প্রাদেশিক ) জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ইতিপূর্বেই পশ্চিম বঙ্গ ঘুরে বরিশাল ফেরত এসে আমাকে জানালেন যে, লেঃ জেনারেল অরোরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙালি সামরিক অফিসারের কাছে অস্ত্র সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন । এ তথ্য লাভের মাত্র একদিন পরেই আমি কিছু মুক্তিযোদ্ধা সহকারে ভারত অভিমুখে রওয়ানা হয়ে প্রথমে পৌছি পশ্চিম বাংলার বারাসাত জেলার হাছনাবাদ বর্ডার টাউনে । ঐ অঞ্চলের বি, এস, এফের কমান্ডার লেঃ কর্নেল শ্রী মুখারজীর সাথে প্রথম আলোচনা হয় । কমান্ডার মুখারজী অত্যন্ত হৃদয়বান বাঙালি অফিসার । তিনি সর্বান্তকরনেই আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সরাসরি লেঃ জেনারেল অরোরার কাছে নিয়ে গেলেন কোলকাতার ফোরট উইলিয়ামে তার হেডকোয়ার্টারে । তিনি আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না । সাক্ষী- প্রমান দাবী করলেন আমার । তখনই আমাকে সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং উসমানী সাহেবের নাম নিতে হয়েছে । উত্তরে জেনারেল অরোরা সাহেব আমাদের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে যা বাজে মন্তব্য করলেন টা, কেবল ‘ইয়াস্কী’- দের মুখেই সদা উচ্চারিত হয়ে থাকে । সোজা ভাষায় তার উত্তর ছিল, ‘ঐ দুটি ব্লাডি ইদুরের কথা আমি জানি না । ওদের কোন মূল্য নেই আমার কাছে । অন্য কোন সাক্ষী থাকলে বলো ।’
মহা মুশকিল দেখছি, ব্যাটা বলে কি ? আমার স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের সম্পর্কেই যে ব্যক্তি এরূপ কদর্য উক্তি করতে ছাড়েনি, তিনি আমার মতো চুনোপুঁটিদের কি চোখে দেখবেন তা অনুধাবন করতেই একটা অজানা আতংকে আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত হয়ে উঠলো ।” ( অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, পৃষ্ঠা- ২২ )
অন্যান্য অনেক ভারতীয় দায়িত্বশীলদের মধ্যেও এ মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় । মুক্তিবাহিনীর ভুমিকাকে তারা সবসময় তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য ও অনুল্লেখযোগ্য করে দেখবার চেষ্টা করেছেন । ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং তার ‘দি লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতাকে সারা সীমান্ত জুড়ে ভোকরানো অভিযান’ বলে অভিহিত করেন এবং ঘুমন্ত সিংহের উপর পিঁপড়ার আক্রমন- এর সাথে তুলনা করেন ।” ( The liberation of Bangladesh—page- 123 )
তিনি লিখেন, ‘সকল পর্যায়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা থেকে যে স্ট্রাটেজি অবশেষে উদ্ভাবিত হলো তা হচ্ছে- মুক্তিবাহিনী অপারেশনের নামে ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে সীমান্ত সজীব রেখে পাকিস্তানী বাহিনীকে বের করে নিয়ে আসা ।” ( The liberation of Bangladesh—page- 92 )
মুক্তিবাহিনীর যোগ্যতার উপর কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার দ্বারা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কমে যায় । কারন, এটা পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা যায় যে, এ ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর থেকে ( পাকিস্তানী ) সামরিক আধিপত্য শিথিল করতে সময় লাগবে ।” ( The liberation of Bangladesh—page- 106 )
ভারতে ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লসমন সিং –ও এ একই সুরে কথা বলেন । তিনি তার Indian Sword Strikes in East Pakistan গ্রন্থে উত্তর- পশ্চিম সেক্টরের যুদ্ধ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি একমত যে, গেরিলাদের একার পক্ষে পাকিস্তান বাহিনীকে ধ্বংস করা অসম্ভব ছিলো, তবে তারা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা, গোলযোগ এবং সংঘাত অব্যাহতভাবে টিকিয়ে রাখতে পারতো ।” ( Indian Sword Strikes in East Pakistan, page- 20 )
মিঃ লসমন সিংহ আরও অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনীকে ফায়ফরমাশ খাটা সহকারীর ভূমিকায় নামিয়ে ছেড়েছেন । তিনি বলছেন, ‘তারা ( মুক্তিবাহিনী ) পথপ্রদর্শক স্থানীয় বিষয়াদির ব্যাখ্যা দানকারী, তথ্য ও কাজের লোক সংগ্রহকারী হিসেবে অত্যন্ত উপকারী ছিল ।” ( Indian Sword Strikes in East Pakistan—page- 181 )
যারা বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদেরকে এই দৃষ্টিতে দেখতো, তারা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে কোন দৃষ্টিতে দেখবে তা সহজেই অনুমেয় । সুতরাং মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কে ঢাকা আসতে দিয়ে তাকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হতে দেবে কেন ? তারা হয়তো মনেও করেছে যে, যুদ্ধটা পাক- ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে । সুতরাং আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক অবান্তর । সম্ভবত এ কারনেই নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল ভারত সরকারই গ্রহন করে এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ভারত সরকার তাঁদের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানেক শ’র হাতে সমর্পণ করে ।” ( At 6. 30 PM on December 14, General Niaji ——– appearec at the American consulate general in Dhaka seeking help. He wanted the Indians for ceasefire—— V.S. Consul General Herbert Spivak followed protocol to the letter and sent Niaji’s plea to Washington for rebroadcasting. It was received in the state department at 7.45 PM Dhaka time. The state department, despite its public pleas for peace did not expedite General Niaji’s ceasefire message, the cable was forwarded to ambassador Farland in Islamabad, to have him seck with Yahiya — It was 3.30 AM in Dhaka before Washington received sufficient confirmation from Islamabad —- the message was finally sent to ambassador keating in New delhi. Where it was received at 12.56 PM it took another hour and a half to decode the message, locate Indian officials and deliver it to them ————— The Anderson paper, PP- 267, 268 মূলধারা- ৭১, পৃষ্ঠা- ২৩৩ )
জেনারেল মানেক শ‘ই আত্মসমর্পণের শর্ত- শরায়েত নিয়ে দরকষাকষি করেন । তিনি নিছক যুদ্ধ বিরতির নিয়াজীর ‘প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দাবী করেন, ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর শর্তহীন আত্মসমর্পণই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার একমাত্র ভিত্তি হতে পারে ।” ( মূলধারা- ৭১, পৃষ্ঠা- ২৩৪-২৩৫/ “since you ( Niaji ) have indicated your desire to stop fighting. I (General Maneckshaw ) expect you to issue orders to all forces under your command in Bangladesh to ceasefire immediately to my advancing forces wherever they are located——— immediately I receive a positive response from you I shall direct Gen. Aurora —– to refrain from all air and ground action against your force. “—Daily Telegraph, Dec, 16, 1971 )
যুদ্ধ বিরতির এ প্রস্তাব এবং যুদ্ধ বিরতির এসব শর্ত- শরায়েত সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল উসমানী কিছুই জানতেন না, তাঁদের অবহিত করা হয়নি । সব যখন শেষ, তখন ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ১২ টার দিকে ভেসে আসা একটা খবরের মতো বাংলাদেশ সরকার জানতে পারলেন যে, আজ আত্মসমর্পণ হচ্ছে ।” ( ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বেলা প্রায় ১২ টার সময় কোলকাতাস্থ থিয়েটার রোডে মুজিব নগর সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে খবর এসে পৌছল যে, ঢাকার হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছে । —— তাজউদ্দিন আহমাদ প্রতি মুহূর্তের খবরের জন্য উদগ্রীব ছিলেন । এমন সময় খবর এলো, আজ বিকেলেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় আত্মসমর্পণ হবে । —‘আমি বিজয় দেখেছি’’—-এম,আর আখতার মুকুল। পৃষ্ঠা- ৩০৮ )
এ থেকে প্রমান হয়, ভারত যুদ্ধ পরিচালনা, যুদ্ধ বন্ধ, ইত্যাদি নীতিগত ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনীর ভুমিকাকে অবান্তর মনে করতো । অর্থাৎ তাঁদের কাছে ওটা ছিল একটা পাক- ভারত যুদ্ধ ।” ( লক্ষণীয়, ভারতের ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের ফ্ল্যাগ অফিসার কমান্ডার ইন-চীফ ভাইস এডমিরাল এস, কৃষ্ণান – এর বাংলাদেশের যুদ্ধের উপর লিখিত ‘নো ওয়ে বাট সাবেন্ডার’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ শিরোনাম ছিল, ‘An account of the Indo-pakistan war in the bay of bengal’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর ভারতের মিঃ প্রান চোপড়ার লিখিত একটি বইয়ের নামঃ The second revolution of India. )
যৌথ কমান্ডটা যেনো ছিল কৌশলগত এবং কূটনৈতিক একটা বর্ম মাত্র ।” ( আসলে শুধু সামরিক দিক বিবেচনা করলে ভারী অস্ত্র- শস্ত্র বিবর্জিত বাংলাদেশ বাহিনীর জন্য এ ধরনের পৃথক মোতায়েন ব্যবস্থা গ্রহনযোগ্য নয়, কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে এটা দেখানো দরকার ছিল যে, বৃহৎ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বাহিনী ভিন্নভাবে যুদ্ধ করছে ।”-( The liberation of Bangladesh—page- 36 )
তাছাড়া তাঁর ( সুখওয়ান্ত সিংহ ) গ্রন্থে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রনয়নের ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক এবং প্রবাসী সরকারের কোন ভুমিকাই স্বীকার করা হয়নি । তাঁর বর্ণনা মতে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে লেঃ জেনারেল কে, কে, সিং- এর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি টীম ।” ( মাসিক ডাইজেস্ট, জানুয়ারী ১৯৮৬ )
মুক্তিবাহিনীর প্রতি তাচ্ছিল্য এবং অমর্যাদাকর ব্যবহার দেখে এটাই মনে হয়েছে । মুক্তিবাহিনীর প্রতি তারা এ মানসিকতা পোষণ করলেও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল উসমানীর ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা এবং মর্যাদাবোধকে তারা ভয় পেত । জেনারেল উসমানী তাঁর দেশ, তাঁর বাহিনীর মর্যাদার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন । ভারতীয় বাহিনীর মিলিটারি অপারেশনের ডেপুটি ডাইরেক্টর মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিংহ বলেছেন, “তিনি ( উসমানী) মুক্তিযুদ্ধকালে যেখানেই গেছেন, একটা স্বাধীন দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেই মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্তির দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো । আমার মনে আছে, একবার এক ভারতীয় আর্মি কমান্ডার তাকে অভ্যর্থনার জন্য রানওয়েতে তৈরি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিমান অবতরণ করাতে অস্বীকার করেন, যদিও তাঁর বিমান আগেই এয়ারফিল্ডে এসে পড়ে । বেচারা পাইলটকে প্রায় দশ মিনিট আকাশে চক্কর দিতে হয় । সাথের বিমানে আরোহী ভারতীয় কমান্ডার আগে নেমে তাকে অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত হবার পরই তাঁর বিমান অবতরণ করে । উসমানীর মনোভাব ছিল যে, তিনি দেশ থেকে নির্বাসিত হলেও দেশের উপর তাঁর পূর্ণ অধিকার আছে । তাঁর দেশের জন্য সাহায্য প্রয়োজন, ভিক্ষা নয় । প্রাথমিকভাবে তাঁর সৈন্যরা ব্যর্থ হয়েছে, পরাজিত হয়নি । যদিও তিনি জুনিয়র র্যাংকের ছিলেন, তবু মর্যাদা এবং অন্যান্য যে কোন দিকে থেকেই ভারতীয় প্রতিপক্ষের কোন অংশেই কম ছিলেন বলে মনে করতেন না।” ( The liberation of Bangladesh—page-34 )
জেনারেল উসমানী সাহায্য ছাড়া অন্য কোন ধরনের হস্তক্ষেপ এবং মুরুব্বিয়ানা সহ্য করতে চাইতেন না । সুখওয়ান্ত সিং- ই বলেছেন, “নিজ দেশের স্বাধীন সত্ত্বা সম্পর্কে তাঁর যে ভয়ংকর অহংকার ছিল তাঁর দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েই তিনি এটা চেয়েছিলেন । তাঁর বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সাথে সংযুক্ত বলে বিবেচিত হোক, এটা তিনি কিছুতেই চাইতেন না ।” ( The liberation of Bangladesh—page-34 )
জেনারেল অরোরার একক নেতৃত্বে যৌথ কমান্ড গঠন করাকেও তিনি সহজভাবে নিতে পারেননি, কিন্তু সম্পূর্ণ অস্বীকার করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না । তাই দেখা যায়, যৌথ কমান্ড গঠন করার পরও তিনি মুক্তিবাহিনীকে সরাসরি কমান্ড করতেন । কিন্তু কোন বেতারযন্ত্র না থাকায় সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হতো না ।” ( একাত্তরের রণাঙ্গন— পৃষ্ঠা- ১৮৫) । মেজর জেনারেল লসমন সিং- এর অভিযোগ থেকেও এ বক্তব্যের সত্যতা প্রমানিত হয় । তিনি লিখেন, “মুক্তিবাহিনী তাঁর কমান্ডে আসলেও তারা অনেক সময় তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মতো কাজ করতো এবং এর ফলে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের সমস্যা দেখা দিতো । এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন পরিস্কার নির্দেশনা পাননি ।” ( Indian Sword Strikes in East Pakistan—page- 178 )
কথাটাকে আরও পরিস্কার করে তিনি লিখেন, “শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সরাসরি জেনারেল উসমানীর কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে এসেছে, যা তাঁদেরকে দেয়া আমাদের পরিকল্পনা এবং নির্দেশের সাথে সব সময় সংগতিপূর্ণ হতো না ।” ( Indian Sword Strikes in East Pakistan—page- 181 )
এ ধরনের স্বাধীনচেতা এবং দেশ ও জাতির মর্যাদার ব্যাপারে আপোষহীন মুক্তিযুদ্ধের যে সর্বাধিনায়ক উসমানী, তাকে ঢাকায় নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ডাকা হবে কেন ? ভারতীয়রা ভয় করছে যে, নিজ দেশে ভারতীয় জেনারেলের কাছে পরাজিত শত্রু- পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য বসে বসে দেখতে কিছুতেই জেনারেল উসমানী রাজী হবেননা, এ অসংগত ব্যবস্থা তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না । এ জন্যই আত্মসমর্পণের গোটা ঘটনাটাই তাঁর কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছে এবং কৌশলে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় ।” ( জেনারেল উসমানী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটিতে কেন হাজির থাকেননি, তাঁর আরেকটা বিবরন পাওয়া গেছে সাংবাদিক ( বর্তমানে দৈনিক মানব জমিন- এর সম্পাদক ) মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছ থেকে । তিনি বলছেনঃ
নয় মাস আমরা যুদ্ধ করেছি পাক হানাদার বাহিনীর সাথে । —- পাক বাহিনী শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে ১৬ই ডিসেম্বর । মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো প্রায় এক লাখ পাকিস্তানী আধুনিক সৈন্য । মুজিব নগর সরকারের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন মাত্র । এ নিয়ে বিতর্ক ১৯৭২ সাল থেকেই । জেনারেল উসমানী জীবিত থাকা অবস্থায় বলে যাননি, কেন তিনি সেখানে আসেননি । তৎকালীন সরকারও কোন সময়ই বলেনি । ১৯৭১ সালের অক্টোবর । প্রবাসী মুজিব নগর সরকার এবং ভারত সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয় । সাতটি বিষয়ে সমঝোতা । চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন ভারতের একজন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম । চুক্তি স্বাক্ষরের ভয়াবহতা ভেবে এ অনুষ্ঠানেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন । জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি এ চুক্তি । মুজিবনগর সরকারের অনেকেই জানতেন না । মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মরহুম তাজউদ্দিন—- প্রশাসনিক, সামরিক এবং বাণিজ্যিক বিষয়ই ছিল চুক্তির প্রধান লক্ষ্য । প্রশাসনকে গতিশীল করার জন্য সিদ্ধান্ত হলো মুক্তিযুদ্ধ করেনি এমন কর্মকর্তাদেরকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হবে অভিজ্ঞ কর্মচারীর শুন্যতা পূরণ করবে ভারতীয় কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা । লক্ষ্য করে দেখবেন স্বাধীনতার পরে বেশ কিছু ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের অফিসার ঢাকা এসেছিলেন । বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না । অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটা প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী থাকবে । যা পরে রক্ষীবাহিনী হিসেবে গঠিত হয়েছিল । প্রশিক্ষনে ছিলেন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাগণ । সামরিক সমঝোতার মধ্যে আরও ছিলো বাংলাদেশে ভারতের সেনাবাহিনী থাকবে । প্রতি বছর নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ হবে । ৭২ সালের নভেম্বর থেকে এর কাজ শুরু হবে ।
বাণিজ্যিক সমঝোতা ছিল খোলা বাজার প্রতিষ্ঠা । সীমান্তের তিন মাইল জুড়ে চালু হবে খোলা বাজার । কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না । শুধু বছর শেষে হিসেব- নিকেশ হবে । প্রাপ্য মেটানো হবে পাঊন্ড স্টারলিংয়ের মাধ্যমে । বিদেশ বিষয়ে ভারত যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে । সাউথ ব্লকের এনেক্স হবে সেগুনবাগিচা । এক কথায় বলা চলে উল্লেখিত চুক্তি বলে ভারত বাংলাদেশের সামরিক এবং পররাষ্ট্র বিষয়ের কর্তৃত্ব পেয়ে যায় ।
পাকিস্তানের সাথে চূড়ান্ত লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান । মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পাবেন না । এ কারনেই জেনারেল উসমানী আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে দর্শকের ভূমিকা পালন করতে রাজী হননি । [ শেখ মুজিব চুক্তিটি অগ্রাহ্য করলেন—– মতিউর রহমান চৌধুরী, নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত, বাড়ি ৫০, সরক ২ এ, ধানমণ্ডী থেকে প্রকাশিত, ‘কাগজ’ ৯ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১১ জানুয়ারী, ১৯৯০] )
এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শত অনুরোধ সত্ত্বেও জেনারেল উসমানী কোন দিনই মুখ খুলেননি, বলা হয়, “যুদ্ধ বিধ্বস্ত নতুন দেশের কর্মবীর হিসেবে হাজারো জটিল সমস্যায় ব্যাপৃত —— শেখ মুজিবুর রহমান পুরনো দিনের কোন কথা নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হোক এটা হয়তো অভিপ্রেত মনে করেননি । আর তাই হয়তো জেনারেল উসমানীকে কিছু কিছু কথা প্রকাশ না করতে তিনি অনুরোধ করেছেন । একদিকে বঙ্গোপ সাগর এবং অপর তিন দিকে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধানের পক্ষে হয়তো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সব সত্য কথা সবসময় প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে উঠে না । আর যেহেতু জেনারেল উসমানী বঙ্গবন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন, কিছু কিছু কথা প্রকাশ করবেন না, তাই তিনি নীরব রইলেন । ‘হাফ ট্রুথ’ প্রকাশ করার লোক তিনি ছিলেন না ।” ( জেনারেল উসমানী নীরব রইলেন কেন ? —- এম, মমিন উল্লাহ, মাসিক ডাইজেস্ট, জানুয়ারী ১৯৮৬ )
কিন্তু অনেক পড়ে অবশেষে তিনি মুখ খুলতে চাইলেন । তিনি প্রকাশ করতে চাইলেন অন্ধকারের ঘটনাগুলো । ১৯৮৩ সালের ২৪ শে নভেম্বর বিচিত্রা এক সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় তাকে প্রশ্ন করে, ‘পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণ আপনার কাছে হলো না কেন ? জেনারেল উসমানী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক ঘটনা আমি জানি যাতে অনেকেরই অসুবিধা হবে।” ( অনেক ঘটনার মধ্যে দিল্লীর সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে গোপন চুক্তিও একটা । সাংবাদিক জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী গোপন চুক্তির যে বিবরন উপরে দিয়েছেন, তাঁর চেয়েও নির্দিষ্ট ও বিস্তারিত বিবরন দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন প্রধান, স্বাধীনতার পর দিল্লীতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা সরকারের স্পীকার জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী । তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক লিখিত চুক্তিতে, প্যাক্ট নয়, এগ্রিমেন্টে আসেন । ঐ চুক্তি বা এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী দুপক্ষ কিছু প্রশাসনিক, সামরিক এবং বাণিজ্যিক সমঝোতায় আসেন । প্রশাসনিক বিষয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ভারতের যে প্রস্তাবে রাজী হন, তাহলো যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে । বাকিদের চাকুরিচ্চুত করা হবে এবং সেই শুন্য জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা । স্বাধীনতার পর বেশ কিছু ভারতীয় কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসে গিয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধু এসে তাঁদেরকে বের করে দেন ।
সামরিক সমঝোতা হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাঁদের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না । প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে । কতদিন অবস্থান করবে তাঁর কোন সময় সীমা নির্ধারিত থাকবে না । ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর এ সম্পর্কে পুননীরিক্ষনের জন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে । অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হবে । ঐ লিখিত সমঝোতাই হচ্ছে বাংলাদেশের রক্ষী বাহিনীর উৎস । আর ভারত- পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ বিষয়ক সমঝোতাটি হলো সম্ভাব্য ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধের অধিনায়কত্ব করবেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান, মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক নন ।
যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধীনে থাকবে । চুক্তির এ অনুচ্ছেদটির কথা জেনারেল উসমানীকে জানানো হলে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন । এর প্রতিবাদে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকেন না ।” )
আমি একটা বই লিখছি । তাতে সব ঘটনাই পাবেন ।” চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার প্রাক্কালে সি এম এইচ হাসপাতালে দেয়া জীবনের এ সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে অসুস্থ জেনারেল জানানঃ
“আমার একটা দুঃখ আছে, আমি বাংলা ভাষা দিয়ে লিখতে পারি না । ইংরেজী স্কুলে লেখাপড়া করেছি তাই । তবে আমি বসে নেই, আমি অনেক ঘটনার নোট টুকে রেখেছি । ইংরেজীতে একটা আত্মজীবনী লিখবো । অনেক অজানা ইতিহাস থাকবে তাতে । সেটা জেনারেল উসমানীর জীবন কথা হবে না, সেটা হবে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস । দেশবাসীর কাছে আমি ঋণী । অনেক আগের পাওনা তাঁদের । —– বইটা শেষ করে প্রকাশ করতে না পারলে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে আমার লাশের মতো অনেক অজানা কথা, অনেক অপ্রকাশিত ইতিহাস কবরের মাটিতে চাপা পড়বে । এটা হওয়া উচিৎ না——- ভাবছি, ভালো হয়ে ফিরে এসে অবশ্যই বইটা লিখবো । আর কিসের ভয় । কারে ভয় । এক বঙ্গবন্ধুকে ভয় করতাম ।” ( এ ভয় কিন্তু তাকে নীতিচ্চুত করতে পারেনি । শেখ মুজিব যখন ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করলেন, তখন তিনি এর প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন । )
সেই লোকটারে কথা দিয়েছিলাম, কিছু কিছু কথা লিখবো না, বলবো না । তিনিও নাই, আমার দেয়া কথাও নাই । এই সব কথা বর্তমান এবং আগামী দিনের নাগরিকদের জানা দরকার । হ্যাঁ, আমি লন্ডন থেকে ফিরেই নিয়মিত লিখবো ।” ( বিচিত্রা, ২৪ শে নভেম্বর, ১৯৮৩ )
কিন্তু জেনারেল উসমানী আর ফিরে আসেননি । ফিরে এলো তাঁর লাশ । তিনি জাতিকে যা জানাতে চেয়েছিলেন, তা অজানাই থেকে গেলো । যা বলা তিনি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন, তা তাঁর না বলাই রয়ে গেলো । অজানা রয়ে গেলো, কি ছিল সে ষড়যন্ত্র ? যার শিকার হয়েছিলো দেশ, দেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তিনি । বলার অনেক কথা, ইতিহাস জমে ছিল তাঁর বুকে । ১১ নং সেক্টরের অধীনস্থ মুক্তিযুদ্ধের ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের সৈয়দ আবুল হোসেন রাজার একটা উক্তিঃ “সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে দিল্লীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী কেবিনেটের যে সভা হয়, তাতে যোগদান শেষে দেশে ফিরে ( জেনারেল উসমানী ) রণাঙ্গনে দেয়া তাঁর ভাষণে আমাদেরকে বলতেন, ‘আজ থেকে আআমদের তিনটি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে । এর একটি হচ্ছে- পাক হানাদার বাহিনী, অপরটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের দুটি বিভক্ত শিবির । কিন্তু তৃতীয় শত্রুর কথা তিনি মোটেও বললেন না । উনি ব্যথিত সুরে বলতেন, প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি আযাদ করার জন্য যারা আজ আমাদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করছে, তাঁদের নিকট আমার সতর্ক বানীঃ আমরা কারো করুণার পাত্র রূপে যুদ্ধ করছি না ।” ( আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উসমানী না থাকার নেপথ্য কথা—- গোলাম ফারুক, ডিসেম্বর, ১৯৮৮ )
তৃতীয় শত্রুটির নাম সেদিন জেনারেল উসমানী ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে বলতে না পারলেও সে শত্রুকে আমরা চিনি । কিন্তু কি জেনে, কি দেখে, কি বুঝে, কোন কারনে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল উসমানী সেদিন হানাদার পাক বাহিনীর সাথে স্বাধীন বাংলা সরকার ও ভারতকে একই শত্রুর কাতারে শামিল করলেন, তা আর কোন দিনই জানা যাবে না । জানা যাবে না, কি তিনি বলতে চেয়েছিলেন আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লন্ডন যাবার প্রাক্কালে । এ জানাটা বাদ দিয়ে বর্তমানে প্রচলিত ইতিহাস শুনে কি জাতির, যে প্রয়োজন তা মিটাতে পারে ।” ( এই যে, এতো স্বাধীনতা যুদ্ধের বই বাজারে— আমি তাঁর অনেকগুলাই দেখেছি । পাবলিক লাইব্রেরীতে গেছি- দেখেছি সব মুক্তিযুদ্ধের রূপ কথা । —– জেনারেল উসমানী । বিচিত্রায় প্রকাশিত, ২৪ শে নভেম্বর ১৯৮৩ )