পোপ, ক্রুসেডের পাপ ও পাশ্চাত্য
বিশ্বে আজ যখন মুসলিম ও পশ্চিমের খ্রিষ্টানদের মধ্যে এক অলিখিত ক্রুসেড ( Clash of Civilization ) চলছে, তখন পোপ জনপল অতীত ক্রুসেডের নিন্দা করলেন । তিনি সম্প্রতি বলেছেন, “পবিত্র স্থান উদ্ধারের জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছিল মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত ।” পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেছেন, ক্রুসেডের ৯০০ বছর পূর্তির মুখে পোপের এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ । তাঁদের মতে এ উপলক্ষে পোপ মুসলমানদের কাছে ক্ষমাও চাইতে পারেন । এ আশাবাদ হয়তো খুব বেশি । তবে ২০০ বছরব্যাপী পরিচালিত ক্রুসেডে খৃষ্টান ইউরোপ যে পাপ করেছিলো মানবতার বিরুদ্ধে, সে পাপের জন্য মানবতাবাদী পরিচয়দানকারী ইউরোপ অনুতাপ- অনুশোচনা কিছু করতেই পারে । কারন ইউরোপের অনেক ঐতিহাসিকেরও কলম কাঁপছে ইউরোপের সে পাপের বর্ণনা দিতে । ইউরোপের ক্রুসেডারদের মধ্যে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড মহান ও সিংহদিল আখ্যা পেয়েছেন ইউরোপে । সেই রিচার্ড সম্পর্কে ইউরোপের ঐতিহাসিক কক্সবার্ট বলেন, “গথ আলারিক, হুন এটিলা কখনো নিজেদেরকে সভ্য জাতির রাজা বলে প্রকাশ করেন নি । কিন্তু কোন অর্থেই ‘মানবজাতির চাবুক’ আখ্যা লাভে রিচার্ড অপেক্ষা তাঁদের দাবী অধিক নয় ।” জেরুজালেম দখলের পর খ্রিষ্টানরা সে নগরীতে যে হত্যাকাণ্ড চালায় তাঁর তুলনা শুধু ঐ হত্যাকাণ্ডই । এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকা লিখেছে, “ক্রুসেডারদের ধ্বংস ছিল কি ভয়াবহ । তাঁদের ঘোড়াগুলো হাঁটু রক্ত পাড়ি দিয়ে মসজিদে পৌছেছিল । শিশুদের পা ধরে দেয়ালে আছড়ে মারা হয়েছে ।” অথচ হযরত উমর যখন এই জেরুজালেমে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন, তখন একফোঁটা রক্তপাতও হয়নি । আবার গাজী সালাহুদ্দিন যখন ক্রুসেডারদের কাছ থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করেছিলেন, তখনো আল্লাহু আকবর ছাড়া কোন হিংসাত্মক কথা বা কোন রক্তপাত সেখানে হয়নি । ইউরোপের খৃষ্টান ক্রুসেডারদের সেখানে বর্বরতা এবং মুসলমানদের মহানুভবতা ছিল অবিশ্বাস্য ধরনের এক কিংবদন্তীর মতো । খৃষ্টান ঐতিহাসিক স্টানলি লেন পুল স্বীকার করেছেন যে, “ক্রুসেডারদের নিষ্ঠুর এবং কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের দোষস্খলনের
কোন ওজরই কল্পনা করা যায়না । সালাহুদ্দীনের শৌর্য পূর্ণ সদয় এবং সদাশয় কার্যাবলীর পাশে ইল্যান্ডাধিপতি ও ফরাসী রাজপ্রতিনিধিদের নিস্থুরতা বিস্ময়কর বলে মনে হবে । কিন্তু দীর্ঘকালব্যাপী মহাযুদ্ধে মুসলমানরাই যে সুসভ্যতা, সহিষ্ণুতা, মহানভবতা, মার্জিত আচরন, প্রভৃতি যাবতীয় সদ্গুনের অধিকারী ছিল ক্রুসেডের পাঠকগণকে তা বলা একান্তই নিষ্প্রয়োজন ।” এই ইতিহাস পাঠ করে আজকের ইউরোপের মজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক ।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি লজ্জা পোপ পাবার কথা । কারন তাঁর পূর্বসূরি পোপ ছিলেন দশ বছরব্যাপী দীর্ঘ ক্রুসেডের গোড়ার লোক । ১০৯৫ সালের ২৯ নভেম্বর খৃষ্টান জগতের ধর্মগুরু পোপ আরবান দ্বিতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘হলি’ ক্রুসেড শুরু করেন । ‘পবিত্র’ যুদ্ধের নামে তারা হত্যা ধ্বংসের উন্মত্ততা চালায় ১২৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত । দুশো বছরব্যাপী এই পাপ কাণ্ডের দায়িত্ব বর্তায় প্রধানত পোপের ঘাড়েই । সুতরাং এর জন্য বেশি লজ্জা, বেশি দুঃখ, বেশি অনুশোচনা পোপ আরবান দ্বিতীয় এর উত্তরসূরি পোপ জন পলেরই হওয়া উচিৎ । মনে হয় এই বোধ থেকেই পোপ ক্রুসেডের সিদ্ধান্তটিকে ভুল বলে অভিহিত করেছেন এবং তিনি যখন ক্রুসেডের ৯০০ বছর কাল পূর্তি দিবসের মুখোমুখি হবেন, তখন মুসলমানদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা, যা পর্যবেক্ষকরা অনুমান করছেন, বিস্ময়কর কিছু হবে না ।
তবে এ ক্ষমা প্রার্থনার চেয়ে আমাদের কাছে বড় হল পাশ্চাত্যের গোটা খৃষ্টান জগতের কাছে পোপ এ কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করবেন যে, ক্রুসেড নামের আড়ালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা কাহিনী রচনা করা হয়েছে, যতো অপবাদ ছড়ানো হয়েছে, শত শত বছর ধরে যে আতংক ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আজও হচ্ছে সব মিথ্যা, সব ভুয়া ।
এই ঘোষণা, এই স্বীকৃতি আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । কারন ৯০০ বছর আগে যে ক্রুসেড ঘোষণা করা হয়েছিলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে সে ক্রুসেড এখনো চালানো হচ্ছে অন্য নামে, অন্যভাবে এবং এর জন্য বিস্ময়করভাবে দোষী করা হচ্ছে মুসলমানদেরকেই । হান্টিংটনদের লিখা যারা পড়েছেন, তারা জানেন কিভাবে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে । আমার সাম্প্রতিক একটা অভিজ্ঞতার কথাও এখানে বলি ।
আমার সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের শেষ পর্যায়ে নিউইয়র্কে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব দি চার্চেস অব ক্রাইস্ট ইন দি ইউএসএ’ এর অফিসে গিয়েছিলাম । আমাদের সফরের যে প্রোগ্রাম, তাঁর অংশ হিসেবে সেখানে যাওয়া । সুতরাং প্রোগ্রামটা আগে থেকেই নির্দিষ্ট ছিল । এই খৃষ্টান সংস্থাটি আন্তঃধর্ম সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করে যাচ্ছে । সংস্থার কো-ডাইরেক্টর এফ, ব্রেইনারের সাথে তাঁর অফিসে আমাদের দেখা হয় । সেখানেই নয়া ক্রুসেড বা যুদ্ধ সম্পর্কে কথা উঠে । প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর তা সাথে আমাদের কাজের কথা শুরু হলঃ
মিঃ ব্রেইনার তাঁর কর্মজীবনের শুরু থেকেই একজন মিশনারী । আগে ইংল্যান্ডে কাজ করেছেন, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে । দীর্ঘ তাঁর অভিজ্ঞতা । কিন্তু তিনি প্রথমেই বিস্ময়করভাবে যে কথা বললেন, তা হলো, মুসলমান তো পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাঁর এখন পশ্চিমকে শত্রু ভাবছে । এই অবস্থায় সম্পর্কের উন্নয়ন বা আলোচনা ফলপ্রসূ কিভাবে হতে পারে ? এই ধরনের প্রশ্ন দিয়েই তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন । তাঁর চোখে মুখে বেদনার ছাপ । অর্থাৎ তিনি অন্তর দিয়েই কথাগুলো বলেছেন । তাঁর অর্থ, তিনি বিশ্বাস করেন মুসলমানরাই পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং অন্যায়ভাবে মুসলমানদের শত্রু ভাবছে । আমি মনে করি মিঃ ব্রেইনার তাঁর এই বক্তব্য এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পশ্চিমের সাধারন জনমতের প্রতিনিধিত্ব করেন । আর ‘শত্রু’ শব্দের এই ব্যবহার বোধ হয় ঠিক নয় । ‘শত্রু’ শব্দের বদলে ‘ভয়’, ‘অবিশ্বাস’, ‘বিক্ষুব্ধ’ শব্দ ব্যবহারই মনে হয় সংগত হতো ।
তারপর তাঁকে বলেছিলাম, পশ্চিমকে ভয় করার, পশ্চিমকে অবিশ্বাস করার এবং পশ্চিমের উপর বিক্ষুব্ধ হওয়ার মুসলমানদের যথেষ্ট কারন রয়েছে । প্রথম কারন হলোঃ আজকের পাশ্চাত্য মুসলিম ইস্টকে শাসন ও শোষণ করেছে । স্থানভেদে দেড়শ, দুইশ এবং আড়াইশো বছর পর্যন্ত । এই শাসন- শোষণের বেদনা মুসলমানরা ভুলে নি । ভুলতে পারেনি পশ্চিমেরই কিছু দেশের কিছু ভুমিকার কারনে । উপনিবেশ তারা ছেড়ে দিলেও শক্তি, অর্থ ও বিজ্ঞান- টেকনোলজির জোরে তারা আধিপত্যবাদী হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখে মুসলিম দেশগুলোর উপর । আরেকটি কারন বলেছিলাম, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া, বসনিয়া প্রভৃতি ইস্যুতে পশ্চিম কার্যত হয় মুসলমানদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, নয়তো পশ্চিমের কারনেই সমস্যাগুলির সমাধান হয়নি অথবা সমাধান বিলম্বিত হয়েছে । স্লোভেনিয়া- সার্বদের মধ্যে যুদ্ধ তিন সপ্তাহ এবং ক্রোয়েশিয়া- সার্বদের মধ্যে যুদ্ধ তিন মাসের বেশি চলতে দেয়া হয়নি, অথচ বসনিয়ার যুদ্ধ আজ সাড়ে তিন বছরেও শেষ হচ্ছে না । এই জলজ্যান্ত ঘটনাগুলো পশ্চিমের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলছে । শেষ যে কারণটির কথা আমি মিঃ ব্রেইনার কে বলেছিলাম, সেটা মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমের কিছু এন,জিও, এর ভূমিকা নিয়ে । দারিদ্রের সুযোগ গ্রহন করে তারা সাহায্যের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে । ঔপনিবেশিক শাসনের পুরানো জ্বালা- পীড়িত মানুষ একে নতুন এক ঔপনিবেশিক অভিযান বলে মনে করছে । মুলতঃ এসবই পশ্চিমের প্রতি মুসলমানদের ভয়, অবিশ্বাস এবং বিক্ষুব্ধতার জন্য দায়ী ।
মিঃ ব্রেনার এসব কারনের ব্যাপারে আমার সাথে একমত হয়েছিলেন, তবে বলেছিলেন, এর কোনটির জন্যই পশ্চিমের জনগন দায়ী নয়, দায়ী একশ্রেনীর সরকার ।
আমিও তাঁর সাথে একমত । কিন্তু প্রশ্ন হলো, পশ্চিমের ঐ জনগনের সাথে মুসলমানদের যে ভুল বোঝাবুঝি তা দূর করবে কে ? এবং উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ এবং সমঝোতার সেতুবন্ধন তৈরি করার দায়িত্ব নেবে কে ?
আমার মনে হয় খৃষ্টান জগতের ধর্মগুরু পোপ এবং মিঃ ব্রেইনারের সংস্থার মতো পশ্চিমের সংগঠনগুলো এ দায়িত্ব নিতে পারে । এদের সাথে যদি মুসলমানদের আবেগ- অনুভূতির প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম দেশ ভিত্তিক ইসলামী সংগঠনগুলোর অব্যাহত যোগাযোগের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে দুই জাতি, দুই সভ্যতা পরস্পরের কাছাকাছি আসা সম্ভব ।
আমার মনে হয়, পোপ ক্রুসেডের নিন্দা করে এই সম্ভাবনাময় নতুন এক ইতিহাসের যাত্রা পথের সূচনা করেছেন । সাতশো বছরের পুরানো ক্রুসেডের নিন্দা করে তিনি কার্যত পশ্চিম ও মুসলমানদের মধ্যে চলমান ‘ক্রুসেডকেও নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন । কিন্তু একথা তিনি প্রকাশ্যে বলেননি, স্পষ্টত বলেননি । তিনি বলেননি যে, ৯০০ বছর আগে ক্রুসেড ঘোষণা করে খ্রিষ্টানরা যে ভুল করেছিলো, বর্তমান মুসলিম এবং পশ্চিম সংঘাতের জন্য মুসলমানদের দায়ী করে খৃষ্টান পশ্চিম সে ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করছে এবং মুসলমানদের অসহায় আত্মরক্ষার প্রয়াসকে আক্রমন বলে তারা ভুল করছে । আমি মনে করি পোপের একথা বলার সময় এখনো যায়নি । এ বছর ২৯শে নভেম্বর মুসলমানদের খ্রিষ্টানদের সেই ভুল ও অন্যায় ক্রুসেড ঘোষণায় ৯০০ বছর পূর্তি হচ্ছে । এই কালো দিন খৃষ্টান পাশ্চাত্য আত্মসমালচনার এক ঐতিহাসিক সূচনা বানাতে পারে । পোপ এবং পশ্চিম তাঁদের অতীত ও বর্তমান ভুল শোধরানোর ঘোষণা দিয়ে এই মুহূর্তকে এক নতুন ইতিহাসের মাইলস্টোনে পরিনত করতে পারেন ।
( প্রবন্ধটি ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে লিখিত )