৯. তাকলীদ
তাকলীদবিহীন যুগ
জেনে রাখো, পহেলা এবং দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে কোনো নির্দিষ্ট ফিকহী মাযহাবের তাকলীদ করবার প্রচলন ছিলনা। এ প্রসংগে আবু তালিব মাক্কী তাঁর ‘কুওয়্যাতুল কুলূব’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ “এইসব (ফিকাহর) গ্রনন্থাবলী তো পরবর্তীকালে রচিত ও সংকলিত হয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় হিজরী শতকে লোকদের কথাকে (শরীয়তের বিধানরূপে) পেশ করা হতো না। কোনো এক ব্যাক্তির মাযহাবের ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়া হতো না। সকল (মাসয়ালার) ক্ষেত্রে এক ব্যাক্তির মতই উল্লেখ করা হতো না এবং কেবল এক ব্যাক্তির মাযহাবকেই বুঝার চেষ্টা করা হতো না।
আমি বলবো, তখন লোকদের অবস্থা ছিলো এর চাইতেও সম্পুর্ণ পৃথক ধরণের। তখন মুসলমানদের মধ্যে দুই শ্রেণীর লোক ছিলো। এক শ্রেণীর লোকেরা ছিলেন সাধারণ মুসলমান। সাধারণ মুসলমানরা সর্বসম্মত বা মতবিরোধহীন মাসয়ালাসমূহের ক্ষেত্রে মুজতাহিদগণের তাকলীদ করতেন না, বরঞ্চ সরাসরি শরীয়ত প্রণেতা আলাইহিস সালামের অনুসরণ অনুকরণ করতেন। তারা অযু গোসল প্রভৃতির নিয়ম পদ্ধতি এবং নামায যাকাত প্রভৃতির বিধান তাদের মুরুব্বীদের নিকট থেকে অথবা নিজেদের এলাকার আলিমদের থেকে শিখতেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করতেন। আর যখন কোনো বিরল ঘটনা ঘটতো তখন মত ও মাযহাব নির্বিশেষে যে কোনো মুফতী তারা পেতেন তার নিকটই সে বিষয় এ ফতোয়া চাইতেন। ইবনে হুমাম তাঁর ‘আত তাহরীর’ গ্রন্থের শেষ দিকে লিখেছেনঃ
“সেকালে লোকেরা কখনো একজন আলিমের নিকট ফতোয়া চাইতেন আবার কখনো আরেকজন আলিমের নিজট। কেবল একজন মুফতীর নিকটই ফতোয়া চাওয়ার নিয়ম ছিল না।”
আলিম শ্রেণীর লোকেরা আবার দুই ধরনের ছিলেন।
(১) এক ধরণের আলিম ছিলেন তাঁরা, যাঁরা কিতাব, সুন্নাহ এবং আছারে সাহাবার উপর গবেষণা ও অনুসন্ধান কাজে নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেককে পূর্ণশক্তিতে প্রয়োগ করেন এবং এতোটা উচ্চতর যোগ্যতা অর্জন করেন যে, জনগণ ফতোয়ার ব্যাপারে তাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। আর তাঁরা ফতোয়া দানের ব্যাপারে এতোটা ব্যুতপত্তি লাভ করেন যে, সাধারণত সকল মাসায়েলের জবাব দানের যোগ্যতা অর্জন করেন। কোনো মাসাআলার জবাবা দানের ক্ষেত্রে এমন ব্যুতপত্তির অধিকারী আলীমদেরই বলা হয় ‘মুজতাহিদ’।
এরূপ (ইজতিহাদী) যোগ্যতা দুভাবে অর্জিত হয়। কখনো সম্ভাব্য সকল প্রক্রিয়ায় প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে রেওয়ায়েত সংগ্রহ করার মাধ্যমে এ যোগ্যতা অর্জন করা হয়। কারণ, আহকামের একটা বিরাট অংশ রয়েছে হাদীসের মধ্যে। আরেকটা বিরাট অংশ রয়েছে সাহাবায়ে কিরা, তাবেয়ী এবং তাবে’তাবেয়ীগণের আছারের মধ্যে। (তাই একজন মুজতাহিদ আত্যন্ত সাফল্যের সাথে এই রেওয়ায়েতের ভান্ডার থেকে মাসায়েল অবগত হতে পারেন)। আর এ কথাতো পরিস্কার যে, একজন চোখ-কান খোলা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন আলিম ভাষা এবং বাক্য প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে অনবহিত থাকেন না। তাছাড়া এমন ব্যাক্তিকে বিরোধপূর্ণ রেওয়ায়েতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের নিয়ম পদ্ধতি এবং দালায়েলের তারতীব নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়েও ব্যুৎপত্তির অধিকারী হতে হয়। এরূপ যোগ্যতার বাস্তব উদাহরণ হলেন দুই মহান ইমাম, আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইসহাক ইবনে রাহুইয়া (রাহিমাহুমুল্লাহ)।
আবার কখনো তাখরীজের তরীকাসমূহকে পূর্ণভাবে আত্মস্থ করা এবং প্রত্যেকটি বিষয়ে ফিকাহর ইমামগণ বর্ণিত উসূলী নিয়ম কানুন আয়ত্ত করার মাধ্যমে এ যোগ্যতা অর্জিত হয়। তবে সেইসাথে হাদীস এবং আছারের একতা যুক্তিসংগত পুঁজি আয়ত্ত থাকা শর্ত। এরূপ ইজতিহাদী যোগ্যতার পূর্ণাংগ উদাহরণ হলেন দুই মহান ইমাম, আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রাহিমাহুমুল্লাহ)।
(২) আরেকধরণের আলিম ছিলেন তাঁরা, যাঁরা কুরআন ও সুন্নাহর উপর এতোটা ব্যুৎপত্তি রাখতেন যে, ফিকাহর মূলনীতি এবং মৌলিক মাসয়ালাসমূহ বিস্তারিত দলিল প্রমাণের সাথে অবগত হবার যোগ্যতা রাখতেন। অবশ্য এরূপ কিছু কিছু মাসয়ালার ক্ষেত্রে আবার নিরবতা অমলম্বন করতেও বাধ্য হতেন এবং এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য বিশেষজ্ঞ আলিমগণের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। কেননা, স্বাধীন মুজতাহদের মতো তাঁরা ইজতিহাদের পরিপূর্ণ যোগ্যতা রাখতেন না। অতএব এসব আলিম কিছু কিছু মাসায়েলের ক্ষেত্রে ছিলেন গায়রে মুজতাহিদ। সাহাবী এবং তাবেয়ীগণের ব্যাপারে তো মুতাওয়াতির বর্ণনার মাধ্যমে একথা প্রমাণিত যে, যখনই তাঁদের নিকট কোনো হাদীস পৌছুতো, তখন তাঁরা কোনো প্রকার বিধি নিয়মের তোয়াক্কা না করেই তার উপর আমল করতেন।
ব্যাক্তিকেন্দ্রিক তাকলীদের সূচনা
তৃতীয় হিজরী শতাব্দী ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মুজতাহিদদের তাকলীদের বার্তা নিয়ে আসে। লোকেরা একজন নির্দিষ্ট মুজতাহিদের মাযহাব অউসরণের বন্ধনে নিজেদের বন্দী করে নেয়। এক ব্যাক্তির তাকলীদ করার বন্ধন থেকে খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই মুক্ত থাকে। এরূপ তাকলীদ করাকে লোকেরা তখন অপরিহার্য বানিয়ে নিয়েচ্ছিল। এর একটা বিশেষ কারণও ছিলো। তা হলো, কোনো ফিকাহ চর্চাকারী কোনো অবস্থাতেই দুটি অবস্থা থেকে মুক্ত ছিল না।
১. একটি হলো এই যেঃ হয়তো তাঁর যাবতীয় প্রচেষ্টা নিবদ্ধ হয় ইতিপূর্বে মুজতাহিদগণ যেসব মাসায়েলের জবাব দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো অবগত হওয়া, সেগুলোর দলিল প্রমাণ আয়ত্ত করা, সেগুলোর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা এবং কোনটির উপর কোনটি অগ্রাধিকারযোগ্য তা নির্ণয় করার কাজে। এটা ছিলো একটা বড় কঠিন কাজ। এমন একজন মুজতাহিদ ইমামের অনুসরণ ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না, যিনি ফিকাহর প্রতিটি অধ্যায়ে মাসয়ালাকে বিভক্ত করে বর্ণনা করেছেন এবং দলিল প্রমাণযুক্ত করে মাসয়ালাসমূহকে শক্তি ও সমৃদ্ধি দান করেছেন। এরূপ ইমামের অনুসরণ এজন্যে প্রয়োজন ছিলো, যাতে তাঁর দলিল প্রমাণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সাহায্যে যাবতীয় মাসায়েল খতিয়ে দেখা যায় এবং একটিকে আরেকটির উপর অগ্রাধিকার দেয়া যায়। এরূপ কোনো মুজতাহিদ ইমাম এর ইকতিদা করার সু্যোগ না পেলে তার জন্যে একজন সফল ফকীহ হবার পথ জটিল হয়ে পড়তো। আর এ কথাতো অনস্বীকার্য যে, কোনো কাজের সহজ পথ খোলা থাকতে জটিল পথে অগ্রসর হবার কোনো অর্থ হয় না।
ফিকাহর এই গবেষক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে একটি কথা খুবই বাস্তব যে, তিনি তার ইমাম মুজতাহিদের (যার অনুসরণ তিনি করেছেন) কোনো বক্তব্যকে উত্তম মনে করে তার সাথে একমত হবেন। আবার কোনো কোনো বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ ও করবেন। এক্ষেত্রে সামগ্রিক পর্যালোচনাইয় যদি তার ঐকমত্য অধিক হয় আর মতপার্থক্য হয় কম, তবে এই গবেষক ফকীহকে সেই ইমাম মুজতাহিদের মাযহাবের ‘আসহাবুল উজুহ’র৬৩ অন্তর্ভূক্ত গণ্য করা হয়।
[৬৩. ‘আসহাবুল উজুহর’ সেই সব আলিমদের বলা হয়, যারা কোনো ইমাম মুজতাহিদের মুকাল্লিদ এবং তাঁর মূলনীতি ও বক্তব্যকে ভিত্তি করেই মাসায়েল ইস্তেম্বাত করেন বটে, কিন্তু প্রাসংগিক মাসায়েলের ক্ষেত্রে নিজস্ব বিশেষ বিশেষ দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে ইমাম মুজতাহিদের সাথে আবার মতপার্থক্য ও করেন। এ ধরণের ইখতিলাফী মতামতও সেই ইমাম মুজতাহিদের মাযহাবের অংশ বলে গণ্য করা হয়। —অনুবাদক]
পক্ষান্তরে, মতপার্থক্য যদি অধিক হয়, তবে তাকে উক্ত মাযহাবের ‘আসহাবুল উজুহ’র অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় না। কিন্তু তা সত্বেও তাকে ঐ ইমামাএর মাযহাবের ফকীহ বলেই গণ্য করা হয়। তবে ইনি ঐ সমস্ত লোকদের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যারা অপর কোনো ইমামের এবং তাঁর মাযহাবের অধিকাংশ মূলনীতি ও প্রসংগিক বিষয়ের ইকতিদা করেন।
তাছাড়া, এই আলিমের ইজতিহাদের মধ্যে এমনসব মাসয়ালার জবাবও পাওয়া যায়, যেসব বিষয়ে তাঁর পূর্বেকার ফকীহদের ইজতিহাদে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এমনটিতো হবেই। কারন, মানুষ নিত্য নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় আর ইজতিহাদের দরজাও রয়েছে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। এমতাবস্থায় ইজতিহাদ করাতো তাঁর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই এ ধরণের (নতুন) ঘটনায় তিন স্বীয় ইমামের চিন্তা বাদ দিয়ে সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ এবং আছার অনুসন্ধান করেন এবং মাসয়ালা ইস্তেম্বাত করেন। তবে এরূপ নতুন মাসায়েল নিঃসন্দেহে ঐসব মাসায়েলের তুলনায় অনেক কম, যেগুলোর জবাব পূর্ববর্তী ইমামা ও আলিমগণ প্রদান করেছেন। এরূপ মুজতাহিদকে সম্পর্ক রক্ষাকারী স্বাধীন মুজতাহিদ (মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব) বলা হয়।
২. দ্বিতীয় অবস্থা এই হতে পারে যে, তিনি ঐ সমস্ত মাসায়েল অবগত হবার জন্যে সর্বাধিক মনোনিবেশ করবেন, যেগুলো ফতোয়া জিজ্ঞাসাকারীরা জিজ্ঞাসা করে, অথচ পূর্ববর্তী ইমাম ও আলিমগণ সেগুলোর জবাব দিয়ে যাননি। এই ফকীহ এমন একজন ইমাম মুজতাহিদের ইকতিদা করার ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত ফকীহর চাইতেও অধিক মুখাপেক্ষী, যার সংকলিত ফিকহী মূলনীতি থেকে প্রতিটি অধায়ে তাঁর জন্যে ফায়দা হাসিল করা সম্ভব। কেননা, ফিকহী মাসায়েলসমূহ তো পুঁতির মালার মতো একটার সাথে আরেকটা গ্রথিত এবং সকল প্রাসংগিক বিষয় মূল বিষয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এমতাবস্থায় তিনি যদি সকল মাযহাবের ফিকাহর যাচাই বাছাই এবং সকল মুজতাহিদের চূলচেড়া বিশ্লেষণ শুরু করেন, তবে তিনি নিজেকে এমন এক অথৈ সমুদ্রে নিক্ষেপ করবেন, জীবনভর চেষ্টা করেও যা অতিক্রম করা সমচব হবে না এবং সম্ভবতঃ জীবনেও কুলকিনারায় পৌছুতে পারবেন না। সুতরাং তাঁর জন্যে পথ একটাই খোলা থাকে। তা হলো, অতীতে যেসব মাসায়েলের জবাব দেয়া হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে চিন্তা গবেষণা করে করে প্রাসংগিক মাসায়েলসমূহের জবাব দেবেন। তবে ইমাম মুজতাহিদের সাথে তাঁর কোথাও মতপার্থক্য হবে না যে তা নয়। কখনো কখনো কুরআন, সুন্নাহ, আছার ও স্থায়ী কিয়াসের ভিত্তিতে ইমামের সাথে তাঁর মতপার্থক্য হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তা হবে মতৈক্যের তুলনায় নেহাত কম। এরূপ মুজতাহিদকে মুজতাহিদ ফিল মাযহাব (মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত মুজতাহিদ) বলা হয়।
তৃতীয় আরেকটি অবস্থা হতে পারে এই যে, প্রথমতঃ তিনি ঐ সমস্ত মাসায়েল জানার জন্যে তাঁর পুরো প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবেন, ইতিপূর্বে মুজতাহিদ ও আলিমগণ সেগুলোর জবাব প্রদান করেছেন। অতঃপর কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে নিজের মনোনিত ও পছন্দনীয় মাসায়েল্গুলোর ভিত্তিতে আরো অধিক প্রাসংগিক মাসায়েল বের করার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু এরূপ করতে পারাটা একেবারে অসম্ভব ও অবাস্তব। কেননা, ওহী অবতীর্ণের বরকতময় যুগ এই লোকদের অনেক আগেই অতিক্রম হয়ে গেছে। সে কারণে এ সময়কার প্রত্যেক আলিম অসংখ্য জরুরী ইলমী বিষয়ে অতীত আলিমগণের মুখাপেক্ষী। তাঁকে অতীত আলিমগণের সুত্রেই জানতে হবে হাদীসসমূহের মতন ও সনদ্গত পার্থক্য, রাবীগণের মর্যাদাগত পার্থক্য, হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতাগত তারতম্য এবং মতবিরোধপূর্ণ হাদীস ও আছারসমূহের মধ্যে সমতা বিধানের পন্থা। তাঁদের সুত্রেই তাঁকে জানতে হবে কোনসব হাদীস ফিকাহর উৎস? জটিল ও অপ্রচলিত শব্দাবলীর বিশ্লেষণ কিভাবে করতে হয়? উসূলে ফিকাহর জ্ঞান লাভ করার পন্থা কি? এবং ঐ সব মাসায়েল পূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং পারস্পরিক বিরোধের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে বর্ণনা করার পন্থা কি, যেগুলো অতীত মুজতাহিদ ও আলিমগণের থেকে বর্ণিত হয়েছে? তাছাড়া ঐসকল বিরোধপূর্ণ রেওয়ায়াতে ও মাসায়েল সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করার পর সেগুলোর ফায়সালা করা এবং সেগুলোকে দলিল প্রমাণের কষ্টিপাথরে যাচাই করার পন্থাও তাঁকে তাঁদের সুত্রে গ্রহণ করতে হবে। এই অসংখ্য জিনিসের জ্ঞান লাভ করতে করতে যখন তিনি জীবন সায়াহ্নে এসে পৌছুবেন, তখন আরো জরুরী ও প্রাসংগিক মাসায়েল উদ্ভাবন করার কাজে আত্মনিয়োগ করা তাঁর পক্ষে কেমন করে সম্ভব হতে পারে? আর মানুষ যতো মেধাবী ই হোক না কেন, তার একটা সীমা আছে। এ সীমার বাইরে কিছু করতে সে অক্ষম।
অবশ্য চিন্তা গবেষণা ও দৃষ্টিভংগির এই পূর্ণতা ঐসব আলিমরা অবশ্যি লাভ করেছিলেন, যাঁরা ওহী বন্ধ হবার কাছাকাছি যুগে ইজতিহাদের শিরচূড়ায় আরোহণ করেছেলেন। কারণ, তাঁদের ইজতিহাদের যুগ এবং অহী বন্ধ হবার সময়ের মধ্যে খুব বেশী ফারাক ছিল না। তখন জ্ঞান বিজ্ঞান এ সময়কার মতো বেশুমার শাখা প্রশাখায় সম্প্রসারিত হয়নি। এবং ইজতিহাদকৃত মাসায়েলের বিরাট সম্ভার সমুপস্থিত ছিলো না। কিন্তু তা সত্বেও মাত্র গুটিকয়েক লোকের পক্ষেই এই পূর্ণতা লাভ করা সম্ভব হয়েছিলো। আর এ গুটিকয়েক লোকের অবস্থাও এরূপ ছিলো যে, তাদের পূর্ণতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকা সত্বেও তাঁরা স্বীয় উস্তাদগণের অনুসরণের বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন না। উস্তাদগণের ইলমী পথ-নির্দেশনার সাহায্যেই তাঁরা ইজতিহাদের পথে পা বাড়ান। কিন্তু, যেহেতু তাঁরা এই শাত্রে যথেষ্ট পরিশ্রম করে গেছেন এবং চিন্তা গবেষণার বিরাট ভান্ডার সৃষ্টি করে গেছেন, সেহেতু তাঁরা স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমাম ও মুজতাহিদের মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
তাকলীদের অপরিহার্যতা এবং এই সঠিক অর্থ
মোটকথা, মুজতাহিদ ইমামগণের মাযহাব অনুসরণ করাটা এমন একটি কুদরতী রহস্য যা আল্লাহ (হিকমত ও কল্যাণের খাতিরে) আলিমদের অন্তরে ইলহাম করে দিয়েছেন আর এ ব্যাপারে সচেতনভাবে হোক কিংবা অচেতনভাবে তাঁরা একমত হয়েছেন।৬৪
[৬৪. এটি গ্রন্থকারের ব্যাক্তিগত মতামত। এ বিষয়ে আলিমগণের মধ্যে ভিন্ন দৃষ্টিভংগি রয়েছে। —অনুবাদক]
শাফেয়ী ফকীহ ইবনে যিয়াদ ইয়েমেনীর বক্তব্যে আমাদের উপরোক্ত মতের প্রতি সমর্থন রয়েছে। দুটি প্রস্নের জবাবে ইমাম বুলকীনী ইমাম শাফেয়ীর মতের বিপক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন, তার জবাবে ইবনে যিয়াদ ইয়েমেনী বলেনঃ
“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বুল্কীনীর বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না যতোক্ষণ না তাঁর ইলমী মর্যাদা অবগত হবে। তিনি ছিলেন মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব, গায়রে মুস্তাকিল এবং আতলিত তাখরীজ ও তারজীহ। “মুজতাহদ মতলক মুনতাসিব’ বলে আমি বুঝাচ্ছি, তিনি এমন ব্যাক্তি যিনি ঐ ইমামের মাযহাবে অগ্রগণ্যতার অধিকার রাখেন, যে ইমামের মাযহাবের সাথে তিনি সম্পর্কিত। এমনকি মাযহাবের ভিতরে প্রাধান্য পাওয়া কোনো মতেরও তিনি বিরোধিতা করার যোগ্যতা রাখেন। শাফেয়ীর মাযহাবের প্রাচীন ও পরবর্তী অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ আলিমের অবস্থাই অনুরূপ। সম্মুখে তাদের বৃত্তান্ত ও মর্যাদাগত ক্রমিক পর্যালোচনা উল্লেখ করা হবে। বুলকীনীকে যারা মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব বলে গণ্য করেন তাদের মধ্য অন্যতম হলেন তাঁর ছাত্র আবু যুরআ। তিনি বলেন, “একবার আমি আমার উস্তাদ ইমাম বুলকীনীকে জিজ্ঞেস করলামঃ শাইখ তকীউদ্দিন সবকী ইজতিহাদের রাজপথে চলেন না কেন, তাঁর মধ্যে তো ইজতিহাদের সমুদয় শর্তাবলী বর্তমান? তিনি কী কারণে তাকলীদ করেন? আবু যুরয়া বলেন, আমি লজ্জায় তাঁর (বুলকীনীর) নাম আর উল্লেখ করলাম না। অথচ তাঁর সম্পর্কেও আমার একই প্রশ্ন! আমার প্রশ্ন শুনে তিনি চুপ থাকেন। অতঃপর আমি নিজেই জবাব দিতে লাগলামঃ আমার মতে সেই সরকারী চাকুরী চলে যাবার ভয়ে তিনি এমনিটি করেছেন, যা চার মাযহাব থেকে খারিজ হয়ে স্বাধীনভাবে ইজতিহাদ করবেন, তার সরকারী চাকরী হবে না। বিচারপতির পদ তার জন্যে হারাম হয়ে যাবে। লোকেরা তার কাছে ফতোয়া চাইতে আসবে না। এবং তাকে বিদয়াতী বলে আখ্যায়িত করবে। আমার বক্তব্য শুনে তিনি মুচকি হাসলেন এবং এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন।” কিন্তু আবু যুরআর বক্তব্যের প্রতি আমার মন সায় দেয় না। এই নিকৃষ্ট স্বার্থ তাদেরকে কী করে ইজতিহাদ থেকে বিরত রাখতে পারত তা আমার বুঝে আসে না। ইজতিহাদের সমুদয় শর্তাবলী তাদের মধ্যে বর্তমান থাকা সত্বেও বিচারপতির পদ এবং উপার্জনের উপায় উপকরণ তাদেরকে ইজতিহাদ থেক বিরত রাখবে, এমন অবস্থা থেকে তাঁদের মর্যাদা তো অনেক উর্ধ্বে ছিলো। এই মনীষীদের সম্পর্কে এরূপ খারাপ ধারণা করা কিছুতেই বৈধ হতে পারেনা। কেননা ইজতিহাদের পূর্ণ যোগ্যতা যাদের রয়েছে, তাঁদের জন্যে ইজতিহাদ করা যে ওয়াজিব এ ব্যাপারে আলিমগণ সর্বসম্মত, একথা আগেই আলোচিত হয়েছে। সুতরাং চাকুরী বাকুরী বা পার্থিব সুযোগ সুবিধার জন্য তারা একটি ওয়াজিব বিষয়কে সারা জীবন পরিত্যাগ করেছেন, এমন কথা কি বিশ্বাস করা যেতে পারে? এমন ধরণের মন্তব্য করা আবু যুরয়ার পক্ষে কী করে উচিত হতে পারে? তিনি কেমন করে বূলকীনীর ব্যাপারেও এ মন্তব্য প্রযোজ্য মনে করে? অথচ জালালুদ্দীন সুয়ূতী তাঁর ‘শরহুত তানবীহ’র তালাক অধ্যায়ে লিখেছেনঃ
“ইমামগণের মতামতের মধ্যে যে পার্থক্য পরিলক্ষত হয় (অর্থাৎ একই বিষয়ে একজন ইমাম যে একাধিক মত দিয়েছেন),তার কারণ হলো তাদের ইজতিহাদের পরিবর্তন হওয়া। যখন তারা যে জিনিসকে সঠিক কবললেন, তাদের ইজতিহাদের দৃষ্টিতে সে সময়ের জন্য সেটাই সঠিক। আর সে কিতাবের গ্রন্তকার হলেন এমন এক ব্যাক্তি যার ইজতিহাদের মর্যাদাকে অস্বীকার করা যেতে পারে না। একথা অনেক আলিমই স্পষ্টভাষায় বলেছেন যে, উল্লেখিত গ্রন্থকার, ইবনে সব্বাগ, ইমামুল হারামাইন এবং গাযালী ‘মুজতাহিদ মতলকের’ মর্যাদায় উপনীত হয়েছেন। ফতোয়ায়ে ইবনুস সিলাহে যে বলা হয়েছে ‘এরা ইজতিহাদে মতলক নয় বরঞ্চ ইজতিহাদ ফীল মাযহাবের মর্যাদায় উপনীত হয়েছিলেন’, তার অর্থ হলো, তাঁরা ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ (সম্পর্কযুক্ত স্বাধীন মুজতাহিদ)। ‘ইজতিহাদে মতলক মুসতাকিল’ এবং (দুই) ‘ইজতিহাদে মতলক মুনতাসিব’। স্বয়ং ইবনে সিলাহ তাঁর ‘কিতাবুল ফাতায়া’ এবং নববী তাঁর ‘শরহে মুহাযযাব’ গ্রন্থে ‘ইজতহাদে মতলক’কে দুই প্রকার বলেছেন। প্রথমটি হলো ‘মুসতাকিল’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘মুনতাসিব’। চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রথমোক্ত ধরনের ইজতিহাদের দরজা চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে, যা এখন আর খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। শেষোক্ত ধরণের ইজতিহাদের দরজা খোলা রয়েছে। কিয়ামতের শর্তাবলী প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত খোলা থাকবে। কোনো যুগেই তা থেমে যাওয়া বৈধ নয়। কারণ, তা ফরযে কিফায়া। কোনো যুগের লোকের যদি এই ইজতিহাদ করার ক্ষেত্রে কসুর করে, এমনকি তা ত্যাগ করে বসে, তবে তারা সকলেই গুনাহগার হবে। একথা আমাদের আলিমগণ স্পষ্টভাবেই বলেছেন। মাউরিদী তাঁর গ্রন্থ ‘আল হাদীতে’ রূইয়ানী তাঁ ‘আল বাহারে’ এবং বগবী তাঁর ‘আত তাহযীব’ গ্রন্থে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলছেন। এ ছাড়াও আরো অনেক আলিম তাঁদের গ্রন্থাবলীতে কথাটি পরিষ্কার করে লিখেছেন। প্রকাশ থাকে যে, ইজতিহাদ ফীল মাযহাব দ্বারা এ ফরযে কিফায়া আদায় হতে পারেনা। ইবনে সিলাহ একথা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলেছেন এবং নববীও ‘শরহে মুহাযযাব’ এ তা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। আমিও আমার “আর রদ্দু আ’লা মান আখলাদা ইলাল আরদি ওয়া জাহালা আন্নাল ইজতিহাদা ফী কুল্লি আসরিন ফারদুন” গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছি। এই আলিমগণ (যাদের কথা উপরে উল্লেখ করেছি) কেবল শাফেয়ী হবার কারণে ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ হওয়া থেকে হতে পারেননি। নববী এবং ইবনে সিলাহ তাঁর ‘তবকাতে’ স্পষ্টভাষায় এ সত্যটি প্রকাশ করেছেন। ইবনে সাবকীও একই কথা বলেছেন। এ কারণেই তোমরা দেখতে পাচ্ছো এই মনীষীরা শাফেয়ী মাযহাবের গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন এবং তাঁদের ফিকহী গ্রন্থাবলীকে শাফেয়ী মাযহাবের ফিকাহর কিতাব বলা হয়। শাফেয়ী হিসেবে তাঁরা ফতোয়া দিয়েছেন এবং তাঁদের ফতোয়াসমূহকেও শাফেয়ী মাযহাবের ফতোয়া বলা হয়। যেমন এই গ্রন্থকার এবং ইবনে সিবাহকে বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষতার দায়িত্ব অর্পন করা হয়, ইমামুল হারামাইন এবং গাযালীকে নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসায় এবং ইবনে আবদুস সালামকে কায়রোর মাদরাসায়ে জাবীয়া এবং যাহিরিয়ার ইনচার্জ নিয়োগ করা হয়। আর ইবনে দাকীকুল ঈদকে মাদরাসায়ে সিলাহিয়ার দায়িত্ব অর্পন করা হয়, যা নাকি আমাদের ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কবরের পাশেই অবস্থিত ছিলো। তাছাড়া মাদরাসায়ে ফাজিলিয়া এবং কামিলিয়ার দায়িত্ব ও অর্পন করা হয়। অবশ্য যিনি এর চাইতে উর্ধ্বে উঠে ‘ইজতিহাদ মতলক মুসতাকিল’ এর মর্যাদায় উপনীত হন তিনি শাফেয়ী হওয়া থেকে মুক্ত হরে পারেন। তাঁর মতামতকেও শাফেয়ী ফিকাহর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় না। কিন্তু আমি যতোটা জানি একমাত্র আবু জাফর ইবনে জারীর তাবারী ছাড়া আর কেউ এ মর্যাদায় উপনীত হতে পারেননি। তিনি প্রথমত শাফেয়ীই ছিলেন। পরে একটি স্বাধীন ফিকহী মুজতাহিদ ইমামের মর্যাদা লাভ করেন। এ কারণের রাফেয়ী প্রমুখ বলেছেনঃ তাঁর (তাবারীর) মতামত (শাফেয়ীর) মাযহাবের মধ্যে গণ্য নয়।”
সুয়ূতীর ভাষ্যে ইবনে সাবকীর যে মর্যাদা পরিষ্কার হলো, আমার মতে তা আবু যুরয়ার মতের চাইতে উত্তম। আর আমার মতে এটাই প্রকৃত ঘটনা। কিন্তু তিনি যে বললেন, ইবনে জরীরকে শাফেয়ী মাযহাবের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করা যাবেনা, একথা আমি সমর্থন করি না। কেননা আল্লামা রাফেয়ীই (সুয়ূতী যার কথা উল্লেখ করেছেন) তাঁর কিতাবুয যাকাতের শুরুতে লিখেছেনঃ “ইবনে জারীর তাবারীর মতামত আমাদের মাযহাবের মতামত বলে গণ্য নয়। অবশ্য তিনি নিজে আমাদের মাযহাবের লোক।” নববী তার ‘আত তাহযীব’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ আবু আসিম ইবাদী ইবনে জরীরকে শাগেয়ী ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, তিনি আমাদের প্রথম সারির আলিমদের অন্তর্ভুক্ত। তিবি রবী মুরাদী এবং হাসান জা’ফরানী থেকে শাফেয়ী ফিকাহর জ্ঞান লাভ করেন।” তাকে শাফেয়ীর সাথে সম্পৃক্ত করার অর্থ হলো, তাঁর ইজতিহাদ ও দলিল গ্রহণ পদ্ধতি এবং সেগুলোর বিন্যাস শাফেয়ীর ইজতিহাদের আস্থে সামঞ্জস্যশীল। কোথাও যদি সামঞ্জস্যশীল না-ও হয়, তাতে তার বিশেষ গুরুত্ব লাভ হয় না। আর এতে করে (শাফেয়ীর) মাযহাব থেকে মুক্তও হয়ে যান না। মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আল বুখারীও এই পর্যায়েরই একজন। তাঁকেও শাফেয়ী ফকীহদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তাঁকে যারা শাফেয়ী ফকীহদের মধ্যে গণ্য করেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন শাইখ তাজুদ্দীন সবকী। তাঁর মতেঃ “ইমাম বুখারী হুমাইদী থেকে এবং হুমাইদী শাফেয়ী থেকে ফিকাহ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।” আমাদের আল্লামা শাইখও বুখারীকে শাফেয়ী বলে গণ্য করতেন। তাঁর দলিল হলো সবকীর বক্তব্য। আমরা উপরে নববীর যে বক্তব্য উল্লেখ করেছি, তাও এ বক্তব্যের সমর্থক। শাইখ তাজুদ্দীন সবকী তাঁর তবকাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনঃ
“কোনো তাখরীজকারী যদি এমন কোনো তাখরীজ করেন যা সম্পুর্ণ বিরল ও অসাধারণ, তবে এই তাখরীজকারীর জীবনে যদি মাযহাব এবং তাকলীদ প্রভাবশীল হয় তবে তাকে (শাফেয়ী) মাযহাবের লোক বলে গণ্য করা হবে। যেমনঃ শাইখ আবু হামিদ গাযালী এবং কিফাল। পক্ষান্তরে তাঁর জীবনে যদি ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব ও তাকলীদ প্রভাবশীল না হয়ে থাকে, তবে তাকে শাফেয়ী বলে গণ্য করা হবে না। যেমনঃ মুহাম্মাদ ইবনে জরীর মুহাম্মাদ ইবনে খুযাইমা, মুহাম্মাদ ইবনে নসর আল মরূযী এবং মুহাম্মাদ ইবনুল মুনযির। এখন প্রশ্ন থেকে যায় মুযনী এবং ইবনে শুরাইহ কোন পর্যায়ের লোক? গবেষণা থেকে বুঝা যায়, তাঁদের অবস্থান মাঝামাঝি পর্যায়ে। উপরোক্ত চার মুহাম্মাদের মতো তাঁরা শাফেয়ী থেকে খারিজও নন, আবার ইরাকী এবং খোরাসানীদের মতো শাফেয়ী মাযহাবের শিকলেও আবদ্ধ নন।”
তাছাড়া, সবকী তার ‘তবকাতে’ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ইমাম আবিল হাসান আশ’আরী সম্পর্কেও লিখেছেনঃ “তিনি ও শাফেয়ী ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত। শাইখ আবু ইসহাক মরূযী থেকে তিনি ফিকাহ শিখেছেন।”৬৫
[৬৫. ইবনে যিয়াদ ইয়েমেনীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি এখানে শেষ হলো। –গ্রন্থকার]
‘কিতাবুল আনওয়ারে’ ও তাকলীদ সম্পর্কে আমাদের মতের সমর্থন রয়েছে। এর গ্রন্থকার লিখেছেনঃ
“যেসব লোক নিজেদেরকে শাফেয়ী, আবু হানীফা, মালিক এবঙ্গাহমদ ইবনে হাম্বলের মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত করেন, তারা কয়েক শ্রেণীরঃ প্রথমত, সাধারণ মানুষ। এরা সরাসরি নয়, বরঞ্চ ঐসব আলিম ও ফকীহদের মাধ্যমে ইমামের তাখলীদ করেন, যারা ইজেদেরকে ইমামের মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। যেমন শাফেয়ী মাযহাবের সাধারণ মানুষ সেই মাযহাবের ফকীহ ও আলিমগনের মাধ্যমেই ইমাম শাগেয়ীর মাযহাবের তাকলীদ করেন। দ্বিতীয়ত, ঐ সব লোক যারা ইজতিহাদের মর্যাদায় পৌছেছেন। যদিও একজন মুজতাহিদ আরেকজন মুজতাহিদের তাকলীদ করেন না, কিন্তু তা সত্বেও এদেরকে ইমাম মুজতাহিদের প্রতি সম্পৃক্ত করা হয়। কারণ, তাঁরা ইজতিহাদের পদ্ধতি, দলিল্ল ও যুক্তি গ্রহণের ধরন ও বিন্যাস্রীতি ইমাম মুজতাহিদ মতলক থেকেই গ্রহণ করেছেন। তৃতীয়ত, উপরোক্ত দুই শ্রেণীর মধ্যবর্তী শ্রেণী। এরা যদিও ইজতিহাদের দরজা লাভ করেননি, কিন্তু ইমাম কর্তৃক গৃহীত ইজতিহাদের নীতিমালা এদের নিকট সুস্পষ্ট ছিল। এরা এ ব্যাপারে যোগ্য ছিলেন যে, ইমামের যেসব মতামত ও মাসয়ালায় যুক্তি প্রমাণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিল না, তাঁরা ইমামের অপর যুক্তি প্রমাণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্বলিত মাসয়ালার ভিত্তিতে সেগুলোর জবাব দিতে পারতেন। এরা মূলতঃ ইমামের মুকাল্লিদই ছিলেন, যেমন প্রথমোক্ত শ্রেণীর লোকেরা এঁদের ইস্তিম্বাত করা বক্তব্য মতামত অনুসরণ করেও ইমামেরই মুকাল্লিদ।”
একটি অভিযোগ এবং তার জবাব
প্রশ্ন করা যেতে পারে,
“শরীয়ত যখন একটিই, তখন সে শরীয়তে একটি জিনিস এক সময় ওয়াজিব না থাকা আর অপর সময় ওয়াজিব হয়ে যাওয়াটা কেমন ব্যাপারঃ একই শরীয়াতে তো এমনটি হতে পারে না। সুতরাং ‘প্রথমত মুজতাহিদ মুসতাকিল-এর ইকতিদা ওয়াজিব ছিল না, পরে তা ওয়াজিব হয়ে যায়।’ এটা পরস্পরবিরোধী কথা নয় কি?” এর জবাবে আমি বলবোঃ প্রকৃতপক্ষে ওয়াজিব তো হচ্ছে, উম্মতের মধ্যে এমনসব লোক বর্তমান থাকা, যারা প্রাসংগিক বিধানসমূহকে মজবুত দলিল প্রমাণের দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত করার যোগ্যতা রাখেন। সমস্ত হকপন্থী এই ওয়াজিবের ব্যাপারে সর্বসম্মত। একইভাবে এ বিষয়টিও সর্বসম্মত যে, যে জিনিস কোনো ওয়াজিব বিধান লাভ করার মাধ্যম, স্বয়ং সে জিনিসটিও ওয়াজিব। আর কোনো ওয়াজিব বিষয় লাভ করার যদি একাধিক মাধ্যম বা পন্থা থাকে, তবে সেগুলোর কোনো একটি গ্রহণ করা ওয়াজিব। কিন্তু কোনো ওয়াজিব বিষয় লাভ করার উপায় বা পন্থা যদি একটিই বর্তমান থাকে, তবে সেটিই ওয়াজিব। যেমন, ক্ষুধায় এক ব্যাক্তির জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য কয়েকটি পন্থা বা উপায় তার কাছে রয়েছে। সে ইচ্ছা করলে খাবার কিনে খেতে পারে, বাগান থেকে ফল পেড়ে খেতে পারে অথবা খাওয়ার উপযুক্ত প্রাণী শিকার করে খেতে পারে। এখন এ ব্যাক্তির জন্যে তিনটি উপায়ের ‘যে কোনো একটি’ অবলম্বন করা ওয়াজিব, নির্দিষ্ট একটি নয়। কিন্তু সে যদি এমন কোনো স্থানে থাকে, যেখানে কোনো ফল এবং শিকার পাবার সুযোগ নেই, তবে সেক্ষেত্রে পয়সাদিয়ে খাবারক্রয় করেই ক্ষুধা নিবারণ করা তার জন্যে ওয়াজিব। (আলোচ্য মাসয়ালাটি এ দৃষ্টান্তের সাথে তুলনীয়)। এই মূল ওয়াজিব হাসিল করার জন্যেও অতীত আলিমগণের নিকট কয়েকটা পন্থা ছিলো। সুতরাং কয়েকটা পথের মধ্যে যে কোনো একটিকে অবলম্বন করাই ছিলো তাদের জন্যে ওয়াজিব, নির্দিষ্ট একটিকে অবলম্বন করে নয়। অতঃপর তাঁরা যখন একটি পথ৬৬ অবলম্বন করলেন, তখন সেই একটি ছাড়া বাকী সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।
[৬৬. অর্থাৎ তাকলীদের পথ। এখানে সেই প্রশস্ত অর্থে তাকলীদের কথা বুঝানো হয়েছে, যার স্বরূপ একটু আগেই আলোচিত হয়েছে। –অনুবাদক]
এমতাবস্থায় সকলের জন্যে এই একটি পথের অনুসরণই ওয়াজিব হয়ে পড়ে। উলামায়ে সলফ হাদীস লিখতেন না। কিন্তু আধুকিনকালে কি দেখছো? এখন হাদীস লেখা ওয়াজিব হয়ে পড়েছে। কারণ, মৌখিকভাবে হাদীস বর্ণনার ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং গ্রন্থাবলীর মাধ্যম ছাড়া এখন আর হাদীস জানার কোনো উপায় নেই।
(আরবী ভাষার) ব্যাকরণ ও ভাষাতত্বের ব্যাপারেও একই কথা। উলামায়ে সলফ এগুলির প্রতি কিছুমাত্র মনোযোগ আরোপ করেতেন না। সুতরাং তাঁরা এ বিষয়ে শিক্ষালাভের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। অথচ আমাদের যুগের আলিমদের জন্যে আরবী ভাষাতত্ব ও ব্যাকরণ শেখা ওয়াজিব হয়ে পড়েছে। কারণ ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরবী থেকে বর্তমান সময়টা ব্যাবধান বিরাট। এরকম আরো অনেক উদাহরণই পেশ করা যেতে পারে।
কখন নির্দিষ্ট ইমামের তাকলীদ করা ওয়াজিব
একজন ইমামের তাকলীদ করার বিষয়টি ও এই মূলনীতির আলোকেই কিয়াস করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট ইমামের তাকলীদ করাটা কখনো ওয়াজিব থাকে। আবার কখনো ওয়াজিব থাকে না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবেঃ ভারতবর্ষ কিংবা ইউরোপ বা আমেরিকায় যদি কোনো জাহিল মুসলমান বর্তমান থাকে আর সেখানে মালেকী, শাফেয়ী এবং হাম্বলী মাযহাবে কোনো আলিম বা গ্রন্থ না থাকে, তবে এ ব্যাক্তির জন্যে আবু হানীফার মাযহাবের তাকলীদ করা ওয়াজীব এবং এ মাযহাবের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া বৈধ নয়। কারণ, এমতাবস্থায় সে এই মাযহাবের বন্ধন থেকে বেরিয়ে পড়লে, ইসলামের বন্ধন থেকেই মুক্ত হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে কোনো ব্যাক্তি যদি মক্কা বা মদীনায় অবস্থানকারী হয়, তবে তার জন্যে নির্দিষ্ট এক ইমামের তাকলীদ করা ওয়াজিব নয়। কেননা সেখানে সকল মাযহাব সম্পর্কে অবগত হওয়া তার পক্ষে খুবই সহজ।