মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বনের উপায়
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাবী
অনুবাদকের কথা
সাহাবায়ে কিরামের(রাঃ) যুগ থেকেই ইসলামে ইজতিহাদী বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়ে আসছে। ইজতিহাদী মতপার্থক্য কখনো মুজতাহিদগণের খামখেয়ালির কারণে সৃষ্টি হয়নি। বরঞ্চ ইজতিহাদ এবং মতপার্থক্যের মূল ভিত্তি ছিলো সুন্নাতে রাসুল(সঃ) এবং সাহাবায়ে কিরামের আছার। সাহাবায়ে কিরাম(রাঃ), তাবেয়ী এবং ইমাম মুজতাহিদগণের কালে মতপার্থক্য ইসলামের জন্য ক্ষতিকর কিছু ছিলোনা। বরঞ্চ তখন তা ছিলো রহমত ও কল্যাণময়। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু লোক মতপার্থক্যকে বড় করে দেখতে থাকে। এটাকে বিদ্বেষ, গোঁড়ামী ও বিবাদ বিসম্বাদের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত করে। ফলে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন দল উপদলের। অজ্ঞতাবশত এদের এক দল নিজেদের মতকেই সঠিক আর ভিন্ন মতকে বেঠিক বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। ফলে সত্য সন্ধানী লোকেরা পড়েন বিপাকে। সাধারণ মানুষ হয় বিভ্রান্ত।
এ ধরণের মতপার্থক্য ও মতবিরোধপুর্ণ বিষয়ে কোন্ মত গ্রহনীয় আর কোন্ মত বর্জনীয়, একজন সত্যসন্ধানী কিভাবে উবয় মতের মধ্যে সমতা বিধান এবং তা অবলম্বনের জন্যে সঠিক পন্থাটাই বা কি সে সম্পর্কে মশহুও মুজতাহিদ ও মুজাদ্দিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহ্লাবী তার ‘আল ইনসাফ ফী বায়ানী আসবাবিল ইখতিলাফ’ গ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দরভাবে যুক্তিসিধ পর্যালোচনা ও সমাধান পেশ করেছেন।
গ্রন্থটি মুসলমানদের বিভিন্ন মসলকের মধ্যকার বিদ্বেষ, গোঁড়ামী, মতবিরোধ, বিবাদ বসম্বাদ ও রেষারেষী দূর করে তাদেরকে সীসাঢালা প্রাচীরের মধ্যে গ্রথিত ইটসমূহের ন্যায় মজবুতভাবে ঐক্যবদ্ধ উম্মাতে পরিণত করতে দারূণভাবে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। সেই মহান উদ্দ্যেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে অনেকদিন থেকেই গ্রন্থখানা অনুবাদ করার আশা পোষণ করে আসছিলাম। এ কাজের গুরুত্বের কথা আরো অনেকেই চিন্তা করেছেন, বলেছেন। অবশেষে করুণাময় আল্লাহ ত’আলার উপর ভরসা করে এ গুরুত্বপুর্ণ কাজে হাত দিই। ‘মতবিরোধপুর্ণ বিষয়ে সঠিকপন্থা অবলম্বনের উপায়’ শিরোনামে সেই মুল্যবান গ্রন্থটিরই বঙ্গানুবাদ পাঠকগণের হাতে তুলে দিতে পেরে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করছি।
গ্রন্থটি আরবী ভাষায় লিখিত। খ্যাতনামা আরব আলিম আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ সম্পাদিত এবং বৈরুতের ‘দারুন নাফায়েস’ কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৮৪ ঈসায়ীতে মুদ্রিত গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করন আমার হস্তগত হয়। অপরদিকে ভারতে গ্রন্থটির উর্দূ অনুবাদ করেছেন খ্যাতনামা আলিম মাওলানা সদরুদ্দীন ইসলাহী। তিনি গ্রন্থটিকে ‘ইখতিলাফে মাসায়েল মে ই’তেদাল কী রাহ’ নাম দিয়েছেন এবং সুসম্পাদিত করেছেন। বিভিন্ন অধ্যায় এবং অনুচ্ছেদে বিভক্ত ক্রেছেন। সেগুলোতে চমৎকারভাবে শিরোনাম ও উপশিরোনাম বসিয়ে সহজবোধ্য করেছেন।
অনুবাদকালে আমি দ’টি গ্রন্থকেই সামনে রেখেছি। টিকা টিপ্পনীর ক্ষেত্রে সহযোগীতা গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে মাওলানা ইসলাহী প্রদত্ব শিরোনাম ও উপশিরোনামসমূহ হূবহূ গ্রহন করেছি।
অনুবাদ চলাকালে গ্রন্থটি মাসিক পৃথিবীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এ সহযোগিতার জন্য আমি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক পত্রিকাটির নির্বাহি সম্পাদক অধ্যাপক এ,কে,এম নাজির আহমদ এর নিকট আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
আল্লাহ তা’আলা এ গ্রন্থটির মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী উলামায়ে কিরাম ও অন্যান্য শিক্ষিত সমাজকে ইজতিহাদী ও মাযহাবী মতপার্থক্যের ক্ষেতে সঠিক মতামত ও দৃষ্টিভংগি প্রতিষ্ঠার তৌফিক দিন এবং গ্রন্থকার ও অনুবাদককে আদালতে আখিরাতে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন।
আবদুস শহীদ নাসিম
সেপ্টেম্বর, ১৯৯১
গ্রন্থকারের ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। সালাত পেশ করছি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর প্রতি। এক সময় আল্লাহতায়ালা আমার অন্তরে সত্য ও ন্যায়ের জ্ঞান প্রতিভাত করে দেন। ফলে উম্মাতের মুহহামদীয়ার মধ্যে বিরাজিত মতপার্থক্য ও মতবিরোধসমূহের কারণ এবং আল্লাহ ও রাসূলের নিকট কোনটি সত্য-সঠিক তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। এসব বিষয়ের এমন সহজ সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সমাধান পেশ করার যোগ্যতা ও আল্লাহতায়ালা আমাকে দান করেচন, যে ব্যাখ্যা ও সমাধান পেশ করার পর আর কোন সংশয় ও জটিলতা বাকি থাকবে না।
অতপর লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) এবং ইসলামী মিল্লাতের পরবর্তী মনীষীগনের মধ্যে মতপার্থক্যের, বিশেষ করে ফিকহী বিধি বিধানের ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের কারণ কি ছিলো? আমি পরিবেশ ও প্রশ্নকর্তার জ্ঞানবুদ্দি এবং ধারণ ক্ষমতার আলোকে সেইসব সত্যের একাংশ তাদের নিকট বর্ণনা করি, যা আল্লাহতায়ালা আমার অন্তরে প্রতিভাত করে দিয়েছিলেন। এসব বিবরণ একটি পুস্তিকার রূপ লাভ করে। আমি পুস্তিকাটির নাম রাখলামঃ ‘আল ইনসাফ ফী বয়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ’।