সোনার মখমল
এক দুঃসাহসী সাহাবীর নাম- আবু লুবাবা।
রাসূলের (সা) সাথে অধিকাংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আবু লুবাবা। বদর যুদ্ধের সময় তিনি বিশেষভাবে সম্মানও লাভ করেন। বদর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মুসলিম বাহিনী।
যুদ্ধের মহান সেনাপতি স্বয়ং রাসূলে করীম (সা)। সৈনিকের চেয়ে বাহনের সংখ্যা কম।
রাসূল (সা) এখানেও দেখালেন সমত ও মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
রাসূলের (সা) উটের ওপরও তিনজন সওয়ারী।
রাসূল (সা) ছাড়াও তাঁর উটে হওয়ার হলেন আবু লুবাবা ও আলী (রা)।
তাঁরা পালা করে উটের পিঠে ওঠানাম করছিলেন। রাসূল (সা) ও আলী যখন উটের পিঠে, তখন রশি হাতে হেঁটে চলছেন আবু লুবাবা।
এইভাবেই চলছে।
পথ অতিক্রম করছেন সত্যের মুজাহিদ।
এক সময় পালা এলো রাসূলের (সা)। উটের পিঠে বসবেন আবু লুবাবা এবং আলী (রা)।
আর রশি হাতে হেঁটে চলবেন স্বয়ং সেনাপতি রাসূল (সা)।
এতে রাসূল (সা) খুশি হলেও কেঁদে উঠলো আবু লুবাবার কোমল হৃদয়। কেঁদে উঠলো তার বিবেক। তিনি আরজ করে বিনয়ের সাথে বললেন, হে রাসূল (সা)! দয়ার নবীজী আমার! দয়া করে আপনি উটের পিঠে বসুন। আমি রশি হাতে হেঁটে চলি।
রাসুল (সা) শুনলেন আবু লুবাবার কথা। একটু হাসলেণ। তারপর বললেন, তোমরা আমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী নও। আর এমনও নয় যে, তোমাদের চেয়ে আমার বেশি সওয়াবের প্রয়োজন নেই। অতএব তোমরা দু’জন উটের পিঠে বসো। আর আমি রশি হাতে হেঁটে চলি।
এই হলো দয়ার নবীজীর (সা) সাম্য ও ভ্রতৃত্বের নমুনা।
এই হলো রাসূলের (সা) মানবতাবোধ। পৃথিবীর এমন কোনো শাসক, সেনাপতি কিংবা নেতা নেই, যিনি রাসূলের (সা) চেয়ে বেশি মানবতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন।
আবু লুবাবা নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসতেন রাসূলকে (সা)। তাঁকে ভালবাসতেন পৃথিবর সকল কিছুর বিনিময়ে। রাসূল (সা) ঠিক তেমনি মহব্বত করতেন আবু লুবাবা- এই সত্যের সৈনিককে।
এজন্য হিজরি দ্বিতীয় সনের শাওয়াল মাসে মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কায়নুকার সাথে সংঘটিত যুদ্ধে এবং একই সনের জিলহজ্জ মাসে সংঘটিত ‘সাবীক’ যুদ্ধে আবু লূবাবা যোগদান করতে পারেননি।
কারণ এই সময় রাসূল (সা) তাকে মদিনায় স্থলাভিষিক্ত করেন।
রাসূল (সা) পনের দিন যাবত বনু কায়নুকা অবরোধ করে রাখেন।
এই সময় আবু লূবাবা মদিনায় ইমারাত বা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন।
রাসূলের (সা) পক্ষ থেকে এই বিরল সম্মানের অধিকারী হলেন আবু লুবাবা।
আবু লুবাবার ঈমান ছিল পর্বতের মত অটুট। শক্ত। সামন্য ভুলের কারণেও তিনি মহান বারী তায়ালার কাছে এমনভাবে মাগফিরাত কামনা করতেন, যা ছিল সত্যিই বিরল।
একবার এমনি একটি ভুলের কারণে নিজে অনুতপ্ত হয়ে ছুটে গেলেন মসজিদে নববীতে।
এরপর একটি মোটা ও ভারী বেড়ি দিয়ে নিজেই ঘোষণা দিলেন: যতক্ষণ আল্লাহপাক আমার তওবা কবুল না করেন, ততোক্ষণই এভাবে বাঁধা অবস্থায় থাকবো।
এভাবে কতদিন বাঁধা ছিলেন আবু লূবাবা?
কারো মতে দশ, আবারো কারো মতে বিশ দিন-রাত।
এসময়ে জরুরি প্রয়োজনে যেমন নামায ও অন্যান্য প্রয়োজনে তার স্ত্রী তাকে বেড়ি খুলে দিতেন। আবার প্রয়োজন মিটে গেলেই বেড়ি বেধে নিতেন।
এই অবস্থায় আবু লূবাবা আহার-পানাহার প্রায় ছেড়েই দিলেন। এতে করে তার শ্রবণ শক্তি কমে যায়। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। আর দুর্বলতায় শরীর ভেঙ্গে যায়। দুর্বলতার কারণে একদিন তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
তবুও নিজেকে মুক্ত করলেন না আবু লুবাবা।
রাসূল (সা) জানেন সবকিছু। তিনিও অপেক্ষায় আছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশের। রাসূলে করীম (সা) আছেন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামার (রা) ঘরে।
তখন শেষ রাত।
প্রভাতের আগেই নাযিল হলো আয়াত।
রাসূল (সা) হেসে উঠলেন।
রাসূলের (সা) হাসি দেখে উম্মু সালাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে সকল সময় খুশি রাকুন। বলবেন কি আপনার হাসির কারণ কী?
রাসূর (সা) বললেন, আবু লুবাবার তওবা কবুল হয়েছে।
উম্মু সালামা জানতে চাইলেন, আমি কি এই সুসংবাদটি মানুষকে জানাতে পারি?
তখনো হেজাব বা পর্দার আয়াত নাযিল হয়নি। রাসূল (সা) বললেন, হ্যাঁ উম্মু সালামা, তুমি এই সুসংবাদটি সবাইকে জানাতে পারো।
রাসূলের (সা) সম্মতি পেয়ে তিনি হুজরার দরোজায় দাঁড়িয়ে সকলকে বিষয়টি জানালেন।
উপস্থিত সবাই ছুটে গেলেন আবু লূবাবাকে মুক্ত করার জন্য।
আবু লুবাবা তার সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, না কক্ষনো নয়। রাসূল (সা) নিজে এসে যতক্ষণ আমার বেড়ি খুলে না দেবেন, ততোক্ষণই এভাবে থাকবো।
রাসূল (সা) ফজরের নামাজের জন্য এলেন মসজিদে। আর তখনই তিনি নিজে হাতে বেড়ি খুলে দিলেন আবু লুবাবার।
তওবা কবুল হওয়ায় দারুণ খুশি হলেন আবু লূবাবা।
হিজরী ৮ম শনে মক্কা বিজয় অভিযানে বনু আমর ইবন আওফের ঝান্ডা ছিল হযরত আবু লুবাবার হাতে।
এছাড়াও, রাসূলে (সা) সময়ে সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধেই অংশ নিয়েছিলেন আবু লুবাবা।
যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন সকল সময়ই দুঃসাহসী এবং দুর্বার।
আবার যুদ্ধের বাইরেতিনি ছিলেন একজন বড় আবেদ।
আল্লাহ এবং রাসূলের (সা) মহব্বতে তিনি তার জীবনটি উৎসর্গ করে দেন। আবু লুবাবা ছিলেন ইসলামের পূর্ণ অণুসারী।
কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতেন পূর্ণভাবে। সেখানে কোনোরকম দুর্বলতার স্থান ছিল না।
কম কথা নয়, আবু লূবাবার তওবা কবুল হওয়ার ঘোষণা সম্বলিত আয়াত নাযিল করেছেন মহান রাব্বুল আলামীন।
এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
যাদের হয় তারা সবাই জ্যোতির অধিক।
হযরত আবু লুবাবা (রা)।
সারাটি জীবন যিনি মিথ্যার শেকল গলিয়েছেন সত্যের শিখায়।
আর শেষ পর্যন্ত যিনি হয়ে উঠেছেন কাঁটি সোনা। সোনার মখমল।
ঢেউয়ের মিনার
হযরত আবদুল্লাহ।
এক মহান সৈনিক।
তার চোখে থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতো সত্যের দ্যুতি। সু্ন্দরের ঔজ্জ্বল্য। আবদুল্লাহর ইসলামেরজন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।
উৎসর্গ করেছিলেণ আল্লাহ এবং রাসূলের (সা) মহব্বতে। তাদের ভালোবাসায়।
আবদুল্লাহর সেই ভালবাসায় কোনো খাঁদ ছিল না। ছিল না কোনো কৃত্রিমতা।
কী এক গভীর ভালোবাসায় পিতার দশ বছর আগেই হযরত আবদুল্লাহ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
আবদুল্লাহর পিতার নাম আমর।
আমরও পুত্রের ইসলাম গ্রহণের দশ বছর পর ইসলাম কবুল করলেন।
পিতা এবং পুত্র- দু’জনই এখন ইসলামের খাদেম।
আল্লাহ েএবং রাসূলের (সা) জন্য, ইসলামের জন্য নিজেদের জানমালকে উৎসর্গ করলেন।
দু’জনই মক্কা বিজয়ের পূর্বে মদিনায় হিজরত করলেন।
ইসলাম গ্রহণের পর আবদুল্লাহ তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় রাসূলের (সা) সাহচর্যে ব্যয় করেন।
তিনি লেখাপড়া জানতেন।
এজন্য রাসূলের কাছে থাকা অবস্থায় দয়ার নবীজী যখনই বলতেন, তিনি সাথে সাথেই তা লিখে রাখতেন। হোক না তা রাসূলের (সা) রাগান্বিত কিংবা শান্ত অবস্থায়।
কোনো কোনো সাহাবী আবদুল্লাহকে বলতেন, রাসূল (সা) স্বাভাবিক বা শান্ত অবস্থায় যা বলেন সেটা লেখ। কিন্তু তাঁর রাগান্বত অবস্থার কথাগুলো কি লিখে রাখা ঠিক এমনটি না করাই ভাল।
বিষয়টি রাসূল (সা) জানার পর তিনি বললেন, কেন লিখবে না? অবশ্যই লিখবে। আমার সকল কথাই তুমি হুবহু লিখতে পার। কারণ, সত্য ছাড়া আমি আর কিছুই বলিনে, বলতে পারিনে।
এই হলো আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূলের (সা) চরিত্র।
কী অপরিসীম জোছনার পেলব!
কী তার রূপ-বৈচিত্র্য!
যিনি, যে মহান সেনাপতি এমন হন, সঙ্গত কারণে তাঁর সৈনিক বা সাথীদের চরিত্রও কলুষমুক্ত, ভয়হীন, স্বপ্ন জাগানিয়া হওয়াই স্বাভাবিক।
আবদুল্লাহও ছিলেন এমনি এক সাহসী সৈনিক।
তিনি সত্য ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না।
আবদুল্লাহ রাসূলের (সা) সান্নিধ্যে এমনভাবে ছিলেন, যেন মৌচাকে বসে আছে এমন মৌমাছি।
দয়ার নবীজীও (সা) আবদুল্লাহকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাকে গুরুত্বও দিতেন সমান।
আব্দুল্লাহ তার পিতার চেয়েও বেশি ভালবাসা পেয়েছেন রাসূলের (সা)।কেন পাবেন না।
আবদুল্লাহ প্ররয় সারাক্ষণই রাসূলের (সা) সান্নিধ্যে থাকতেন। এরপরও যদি একটু সময় পেতেন, সেটুকু তিনি ব্যয় করতেন দিনে রোজা রেখে এবং রাতে নামায আদায়ের মাধ্যমে।
তিনি আল্লাহর ইবাদাতে এত বেশি মগ্ন হয়ে যেতেন যে, নিজের দুনিয়াবী সকল চাওয়া-পাওয়া, আহার-নিদ্রা, এমনকি স্ত্রী, সন্তানস, পরিবারও তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যেত।
তিনি অন্য কোনো দিকে খেয়াল করার ফুরসতটুকু পেতনে না।
ছেলের এমন অবস্থা দেখে আবদুল্লাহর পিতা একবার রাসূলের (সা) কাছে জানালেন সকল কিছু। জানালেন পুত্র আবদুল্লাহর এমনি নির্মোহ ও নিরাসক্তির কথা।
রাসূল (সা) সবকিছু শুনে আবদুল্লাহকে ডেকে বললেন,
‘আবদুল্লাহ! রোজা রাখো, ইফতার করো, নামাজ পড়, বিশ্রাম নাও এবং স্ত্রী-পরিজনের হকও আদায় করো। এটাই হলো আমার তরীকা। যে আমার তরীকা প্রত্যাখ্যান করবে সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না।’
রাসূলের (সা) নির্দেশ বলে কথা!
আবদুল্লাহ রাসূলের (সা) নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন।
হযরত আবদুল্লাহ স্বভাবে অত্যন্ত সাহসী।
রাসূলের (সা) যুগে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, প্রত্যেকটিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।
যুদ্ধের জন্য তার ওপর অর্পিত হতো সোয়ারী পশুর ব্যবস্থা ও জিনিসপত্র পরিবহনের দায়িত্ব।
তিনি এ দায়িত্ব অত্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইয়ারমুকের যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে হযরত ওমর ইবনুল আস তার নেতৃত্বের ঝান্ডা তুলে দেন আবদুল্লাহর হাতে। আবদুল্লাহ এই নেতৃত্বের ঝান্ডার মর্যাদা রক্ষা করেন।
এই দুঃসাহসী সৈনিক, জ্ঞানের দিক দিয়ে আবার ছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। মাতৃভাষা আরবি ছাড়াও তিনি জানতেন হিব্রু ভাষা। হিব্রু ভাষায় তিনি ছিলেন সুপন্ডিত।
জিহাদের ময়দানে সকল সময় আবদুল্লাহকে প্রথম সারিতে দেখা যেত।
আবার জিহাদ শেষ হলেই দেখা যেত আবদুল্লাহকে মসজিদের নামাজে প্রথম কাতারে।
এভাবেই আল্লাহ, রাসূল (সা) এবং ইসলামের ভালোবাসায় সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছেন আবদুল্লাহ।
আবার জিহাদ এবং ইবাদত সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অগ্রগামী।
মহান রাব্বুল আলামীন এমনই জীবনই তো চান।
অধিক পছন্দ করেন তিনি এমন সমর্পিত বান্দাকে।
হযরত আবদুল্লাহ!
কী এক অসামান্য সফল জীবন!
যেন আলোকিত এক ঢেউয়ের মিনার!
সফল জীবন
তিনি রাসূলকে (সা) পাননি। পাননি প্রিয় নবীজীর সান্নিধ্য। কিন্তু তাতে কি! তার সেই অপূর্ণতা তিনি নিজের চেষ্টা, সাধনা, ত্যাগ আর রাসূলের (সা) প্রতি প্রতি ভালবাসায় পুশিয়ে নিয়েছিলেন নবীজীর প্রিয় সাহাবীদের মাধ্যমে।
এই আলোকিত মানুষটির নাম আলকামা।
আলকামা হযরত উমর, আলী, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদসহ অনেক সাহাবীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তাদের জ্ঞান সমুদ্র থেকে কলস ভরে তুলে নিয়েছিলেন জীবন চলার পাথেয়। নিবারণ করেছিলেন তৃষ্ণা।
সত্যের পিপাসা তো এমনিই।
সেই পিপাসা একমাত্র জ্ঞারে সুপেয়, সুনির্মল স্বচ্ছ পানি ছাড়া আর কিছুতেই মেটে না।
আলকামার জ্ঞান তৃষ্ণা ছিল প্রচণ্ড।
ছিল সত্যের প্রতি আনুগত্য এবং অনুরাগ।
আর অঢেল ভালবাসা ছিল আল্লাহর রাসূলের (সা) প্রতি।
ফলে আর শঙ্কা কিসের?
কিসের অভবা?
না, কোনো শঙ্কা নয়। বরং গভীর নিষ্ঠা আর একাগ্রতায় তিনি আল্লাহর কুরআন, রাসূলের আদর্শ এবং তাঁর সার্বিক জ্ঞানে তিনি এতই সমৃদ্ধহয়েওঠেন যে তার অন্যতম শিক্ষক ইবন মাসউদ বলতে বাধ্য হন, ‘আমি যত কিছু পড়েছি ও জেনেছি, তা সবই আলকামা পড়েছে ও জেনেছে।’
আলকামার ছিল অসাধারণ স্মৃতি শক্তি।
অত্যন্ত প্রখর ছিল তার ধারণ-ক্ষমতা।
কোনো কিছু একবার মুখস্থ করলে তা আর ভুলতেন না। সেটা সমুদ্রিত গ্রন্থের মতই রয়ে যেত তার হৃদয়ে।
আলকামা এ প্রসঙ্গে নিজেই বলতেন,
‘যে জিনিস আমি আমার যৌবনে মুখস্থ করেছি তা এখনও আমার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে আছে, যে তা যখন পাঠ করি, তখন মনে হয় বই দেখে পড়ছি।’
মহান আল্লাহ পাক যাকে জ্ঞানভান্ডার ও মেধা দান করেন, তিনি অবশ্যই ধন্য। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ এক বিশাল নিয়ামত।
আলকামাও আল্লাহর এই বিশেষ নিয়ামত পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন।
সামান্য কিছু নয়, বরং পুরো হাদিসে হাফেজ ছিলেন। সেই সাথে আল কুরআন এবং আল ফিকাহর জ্ঞানেও ছিলেন সমৃদ্ধ।
আলকামা ছিলেন একজন বড় তাবেঈ। অসাধারণ ছিল তার জ্ঞানভান্ডার। ছিলেণ হাদিসে মুহাদ্দিস এবং হাফেজ।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতবড় একজন হাদিসে হাফেজ ও মুহাদ্দিস নিজেকে কখনই বড় মনে করতেন না। এমনকি মুহাদ্দিস হিসাবে নিজেকে পরিচিত করতেও ছিলেন কুণ্ঠিত ও লজ্জিত।
একেই বলে প্রকৃত জ্ঞানী।
যে গাছে ফল যত বেশি, সেই গাছের ডালগুলি ততোই নুয়ে পড়ে। জ্ঞানীর ক্ষেত্রেও কথাটি সমান প্রযোজ্য।
কিন্তু আজকের চিত্র ভিন্ন। খালি কলস বাজে বেশি- এমন অবস্থা।
আলকামা ছিলেন যেমন জ্ঞানী, তেমনি সত্যনিষ্ঠ ও বিনীয়।
রাসূলের (সা) আদর্শে তিনি তার জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন।
সাহাবীরা (রা) ছিলেন তার সামনে রাসূলের (সা) জীবন্ত প্রতিনিধি।
প্রকৃত অর্থে একজন ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির মতই তিনি সাহাবীদের (রা) কাছ থেকে আহরণ করেছেন জ্ঞান ও আত্মার খোরাক।
কী চমৎকার এক নিদর্শন!
যারা রাসূলকে (সা) দেখেনি, তারা ইবন মাসউদকে দেখেই রাসূলের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা নিতে পারতো।
আবার যারা ইবন মাসউদকে দেখেনি, তারা আলকামাকে দেখে রাসূল (সা) ও ইবন মাসউদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক বেশি অবগত হতে পারতো। এটা নিশ্চয়ই কম কথা নয়।
আলকামার এই স্বভাব চরিত্র যেমন ছিল তার হৃদয়ে, তেমনি ছিল তার চাল-চলনে ও নৈমিত্তিক যাপিত জীবনে।
আলকামা আল কুরআনকে তার প্রতিটি কাজের বাহনে রূপ দিয়েছিলেন। ঠিক সেইভাবে রাসূলের (সা) আদর্শকেও জীবনের সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতেন।
জ্ঞঅন চর্চার পাশাপাশি আলকামা ছিলেন জিহাদের ব্যাপারেও সমান সতর্ক। জিহাদের জন্য তিনি ছিলেন পিপাসায় কাতর।
তার ভেতরে ছিল এক সাহসের ফুলকি।
ছিল সমুদ্রে মত গর্জনমুখর।
সেই গর্জন কেবলি ফুঁসে উঠতো তার মধ্যে।
হিজরি বত্রিশ সন।
আমীর মুয়াবিয়ার সময়কাল।
সামনে কনস্টান্টিনোপল অভিযান সম্পর্কে রাসূলের (সা) একটি ভবিষ্যৎ বাণী ছিল।
এই বাহিনীতে যোগ দিলেন আলকামা।
বাহিনীর সবাই বিজয়ের অংশীদার ও সাক্ষী হওয়ার জন্য শাহাদাতের প্রবল প্রেরণায় ছিলেন উজ্জীবিত।
আর আলকামা?
তিনি তো শহীদি জীবনকে কামনা করেন সর্বক্ষণ।
শুরু হলো জিহাদের যাত্রা। সে ছিল এক দুঃসাহসী অভিযান।
বাহিনীর সবাই প্রাণবন্ত।
একজন মুজাহিদ। নাম মুদিদ। তিনি একটি কিল্লার ওপর আক্রমণের সময় মাথায় বাঁধার জন্য চেয়ে নিলেন আলকামার চাদরটি।
মুজাহিদটি শহীদ হলেন এক পর্যায়ে।
আলকামার চাদরটিও হয়ে উঠলো শহীদের রক্তে লালে লাল!
এই রক্তে রাঙা চাদরটিকে আলকামা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতেন।
যেতেন জুমআর নামাজেও।
বলতেন, ‘আমি এই চাদরটি আমা কাঁধে এজন্য ঝুলিয়ে রাখি যে, এতে একজন শহীদের খুনের স্পর্শ আছে।’
আহ! কী মমতাভরা উচ্চারণ তার!
এত বড় একজন জ্ঞানী তাবেঈ। কত তার মর্যাদা!
অথচ তিনি খ্যাতি থেকে তিনি সর্বদা নিজেকে দূরে রাখতেন। গুটিয়ে রাখতেন নিজেকে। মনে-প্রাণে তিনি এটাকে ঘৃণা করতেন। এজন্য এড়িয়ে চলতেন সম্ভাব্য খ্যাতি ও প্রাচারণার পথগুলো।
হযরত আলকামা!
কী অসাধারণ ছিল তার শিক্ষা ও জ্ঞানের বহর!
কী অসাধারণ ছিল তার মানসিক ও নৈতিম শক্তি।
সন্দেহ নেই, এমন ব্যক্তিই তো আল্লাহর পছন্দ। পছন্দ রাসূলেরও (সা)। প্রকৃত অর্থে, আল্লাহ এবং রাসূলকে (সা) ভালবেসে সাহসের পর্বতে সুদৃঢ়ভাবে অবিচল থাকতে পারলেই কেবল অর্জন করা যায় হযরত আলকামা (রহ) মত সফল জীবন।