হাওয়ার গম্বুজ
যায়িদ ইবন সাবিত। বয়সে একেবারে কিশোর।
রাসুল (সা) যখন প্রথম হিজরত করেন মদিনায়, তখন যায়িদের বয়স মাত্র এগার বছর।
রাসূল (সা্য) তখনও মদিনায় পৌঁছেননি।
অথচ রাসূলের (সা) ওপর বিশ্বাস এনে ইসলাম কবুল করলেন এগার বছরের এই কিশোর।
ইসলাম গ্রহণের পরপরই তিনি শুরু করলেন কুরআন অধ্যয়ন।
বয়সে কিশোর। কিন্তু নিয়মিত কুরআন পড়ার কারণে মদিনার মানুষ তাকে সম্মানের চোখে দেখতো।
যায়িদ ইবন সাবিত ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।
এই প্রখর ছিল তার মেধা যে, মাত্র এগার বছর বয়সে, রাসূলের (সা) মদিনায় আসার আগেই তিনি সতেরটি সূরার হাফেজ হয়েছিলেন।
যায়িদের স্মতি শক্তিও ছিল দারুণ।
আল কুরআনের যেটুকু পড়তেন, তা সবই মুখস্থ রাখতে পারতেন।
রাসূল (সা) হিজরত কনে মদিনায় এলেন।
তিনি মদিনায় পা রাখার পরই মদিনার মানুষ যায়িদকে সাথে করে নিয়ে গেল রাসূলের (সা) দরবারে।
রাসূল (সা) তাকে দেখেই বুঝে গেলেন যে, এ এক অসাধারণ মেধাবী কিশোর। আর রাসূল (সা) যখন জানলেন যে, এই কিশোর সতেরটি সূরার হাফেজ হয়ে গেছেন ইতিমধ্যেই, তখন তো তাঁর বিস্ময়ের আর সীমা রইলো না।
রাসুল (সা) অসম্ভব খুশি হলেন এ্ই সংবাদে।
এরপর রাসূল (সা) স্বয়ং তাকে কুরআন তিলাওয়াত করতে বললেন। যায়িদ রাসূলের (সা) আদেশ পালন করলেন।
তার কণ্ঠে কুরআনের সহীহ তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হলেন রাসূল (সা)।
মদিনায় আছেন রাসুল (সা)।
প্রতিদিনই এসময় তাঁর কাছে আসতে থাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে চিঠিপত্রের বহর।
এর মধ্যে আছে পার্শবর্তী দেশ ও এলাকার রাজা-বাদশা, গোত্রপতি, আমির-উমরাহদের চিঠি।
অধিকাংশ চিঠির ভাষাই ছিল সুরইয়ানী ও ইবরানী (হিব্রু)।
মদিনায় তখন এই দু’টি ভাষা জানতো কেবল ইহুদিরা।
কিন্তু ইহুদিরা কখনই মুসলমানকে ভালো চোখে দেখতো না। বরং দুশমনী করাই ছিল তাদের প্রধানতমকাজ।
মদিনার মুসলমানরও এই দু’টি ভাষা জানতো না।
ফলে বেশ সমস্যা দেখা দিল। কি করা যায়?
ভাবছেন রাসূল (সা)।
হঠাৎ তিনি ডাকলেন যায়িদ ইবনে সাবিতকে।
কাছে, একান্ত কাছে ডেকে নিয়ে রাসুল (সা) যায়িদকে বললেন ভাষা দু’টি শিখে নেবার জন্য।
রাসূলের (সা) নির্বাচন!
যায়িদ নিজেই বলছেন সেই স্মৃতিবাহী ঘটনার কথা।
‘রাসূল (সা) মদিনায় এলে আমাকে তাঁর সামনে হাজির করা হলো। তিনি আমাকে বললেন, ‘যায়িদ, আমার জন্য তুমি ইহুদিদের লেখা শেখ। আল্লাহর কসম! তারা আমার পক্ষ থেকে ইবরানী ভাষায় যা কিছু লিখছে, তার ওপর আমার আস্থা হয় না।’ রাসূলের (সা) নির্দেশে আমি ইবরানী ভাষা শিখলাম। মাত্র আধা মাসের মধ্যে এতে দক্ষতা অর্জন করে ফেললাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) ইহুদিদেরকে কিছু লেখার দরকার হলে আমিই লিখতাম এবং রাসূলকে (সা) কিছু লিখলে আমিই তা পাঠ করে শুনাতাম।’
হযরত যায়িদ!
কি অসাধারণ ছিল তার মেধা এবং স্মরণ শক্তি।
তার এই মহান গুণের জন্য, এই দক্ষতা অর্জনের জন্য রাসূল (সা) যাবতীয় লেখালেখির দায়িত্ব অর্পণ করেন যায়িদের ওপর।
যায়িদ আরবি ও ইবরানী- দুই ভাষাতেই লিখতেন।
রাসূলের (সা) সর্বপ্রথম সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন উবাই ইবন কাব আল আনসারী।
আর উবাই-এর অনুপস্থিতিতে রাসূলের (সা) েএই মহান দায়িত্ব পালন করতেন যায়িদ ইবন সাবিত।
তারা ওহী ছাড়াও লিখতেন রাসূলের (সা) চিঠিপত্র।
রাসূলের (সা) ওফাত পর্যন্ত যায়িদ এই দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে।
রাসূলের (সা) ওফাতের পর- হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা) খিলাফত কালেও যায়িদ এই দায়িত্ব পালন করেন।
রাসূলের (সা) সময়ে যখন চিঠিপত্র কিংবা ওহী লেখার প্রয়োজন হতো, তখন যায়িদ হাড়, চামড়া, খেজুরের পাতা প্রভৃতি ব্যবহার করতেন।
পবিত্র আল কুরআনই ইসলামের মূল ভিত্তি। এই পবিত্র আল কুরআন সংগ্রহ ও সংকলনের মহা গৌরবজনক সম্মানের অধিকারী হযরত যায়িদ ইবন সাবিতও।
রাসূলের ওফাতরে পর, প্রথম খলিফা হযরত আবুবকরের (রা) সময়ে আরব উপদ্বীপে একদল মানুষ মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগ কর) হয়ে মুসায়লামা আল কাজ্জাবের দলে যোগদেয়।
মুসায়লামা ইয়ামামায় নিজেকে নবী বলে ঘোষণা করে।
হযরত আবুবকর (রা) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
যদিও এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে এবং মুসায়লামা মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়- তবে যুদ্ধে একে একে শহীদ হয়ে যায় সত্তরজন হাফেজে কুরআন।
একটি যুদ্ধে এত বিপুল সংখ্যক হাফেজে কুরআনের শাহাদাত কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে হযরত উমরকে (রা) শঙ্কিত করে তোলে।
তিনি খলিফা হযরত আবু বকর (রা) কে আল কুরআন সংরক্ষণের জন্য তা লিপিবদ্ধ খরার জন্য বিশেষভাবে পরামর্শ দেন।
হযরত আবুবকর (রা) হযরত উমরের (রা) এই পরামর্শ গ্রহণ করেন।
তিনি আল কুরআন লিপিবদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানালেন যায়িদ েইবন সাবিতকে। বললেন, ‘তুমি একজন বুদ্ধিমান নওজোয়ান। তোমার প্রতি সবার আস্থা আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) জীবিতকালে তুমি ওহী লিখেছিলে। সুতরাং তু্মিই এই কাজটি সম্পাদন কর।’
হযরত আবুবকরের (রা) প্রস্তাবটি শোনার পর যায়িদ তার অনুভূতি ব্যক্ত করলেন এইভাবে:
‘আল্লাহর কসম! তারা আমাকে আল কুরআন সংগ্রহ করার যে নির্দেশ দিয়েছিল তা করার চেয়ে একটি পাহাড় সরানোর দায়িত্ব দিলে তা আমার কাছে অধিকতর সহজ হতো।’
আল কুরআন সংরক্ষণের কাজে হযরত যায়িদকে সহযোগিতার জন্য আবু বকর (রা) আরও একদল সাহাবাকে দিলেন। দলটির সংখ্যা ছিল পঁচাত্তর। তাদের মধ্যে উবাই ইবন কাব ও সাঈদ ইবনুল আসও ছিলেন।
যায়িদ খেজুরের পাতা, পাতলা পাথর ও হাড়ের ওপর লেখা কুরআনের সকল অংশ সংগ্রহ করলেন। এরপর হাফেজদের পাঠের সাথে তা মিলিয়ে দেখলেন।
যায়িদ নিজেও একজন আল কুরআনের হাফেজ ছিলেন এবং রাসূলের (সা) জীবিতকালে আল কুরআন সংগ্রহ করেছিলেন।
হযরত যায়িদ!
কি সৌভাগ্যবান এক আলের জ্যোতি।
রাসূলের (সা) ওহী লেখার দায়িত্ব যে বিশেষ সাহাবীদের ওপর ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যায়িদ ইবন সাবিত।
যায়িদ সকল সময় রাসূলের (সা) সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করতেন।
রাসূলের (সা) পাশে যখন বসতেন তখন কলম, দোয়াত, কাগজ, খেজুরের পাতা, চওড়া ও পাতলা হাড়, পাথর ইত্যাদি তার চারপাশে প্রস্তুত রাখতেন। যাতে করে রাসূলের (সা) ওপর ওহী নাযিলের সাথে সাথেই তিনি তা লিখতে পারেন।
রাসূলের (সা) প্রতি ছিল যায়িদের সীমাহীন ভালোবাসা। ছিল তাঁর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য।
যায়িদের এই ভালোবাসার কারণে তিনি সকল সময় চেষ্টা করতেন প্রাণপ্রিয় রাসূলের (সা) কাছাকাছি থাকার জন্য।
ভোরে, যখন ফর্সা হয়নি দূরের আকাশ, যখন কিছুটা অন্ধকারে ঢেকে থাকতো সমগ্র পৃথিবী, ঠিক সেই প্রত্যুষে নীরবে, অতি সন্তর্পণে যায়িদ পৌঁছে যেতেন সেহরীর সময়ে।
দয়ার নবীজীও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন যায়িদকে।
বিস্ময়করই বটে!
রাসূলকৈ (সা) দেখার আগেই যায়িদ মাত্র এগার বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, সতেরটি সূরারও হাফেজের অধিকারী হলেন।
যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন যায়িদের বয়স মাত্র তের বছর।
তার প্রবল ইচ্ছা ও বাসনা ছিল যুদ্ধে যাবার।
কিন্তু বয়স কম থাকার কারণে তাকে অনুমতি দেননি মহান সেনাপতি রাসুল (সা)।
কিন্তু যখন উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হলো, তখন যায়িদের বয়স ষোল বছর। এখন কে আর তাকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখে!
না, কেউ তার গতিরোধ করেননি।
যায়িদ প্রবল প্লানের মত তরঙ্গ-উচ্ছ্বাসে যোগ দিলেন উহুদ যুদ্ধে। যুদ্ধ করলেণ প্রাণপণে। সাহসের সাথে।
যুদ্ধের ময়দানে যায়িদ। ষোল বছরের এক টগবগে যুবক।
যুবক তো নয় যেন আগুনের পর্বত, বারুদের ঘোড়া!
কম কথা নয়!
মাত্র এগার বছরে ইসলাম গ্রহণ।
সতেরটি সূরার হাফেজে কুরআন।
কাতেবে ওহীর মর্যাদা লাভ।
রাসূলের (সা) সেক্রেটারি হবার গৌরব অর্জন।
জিহাদের ময়দানে এক সাহসী তুফান।
রাসূলের নির্দেশে দু’টি নতুন ভাষা শেখার আনন্দ।
সম্পূর্ণ হাফেজে কুরআন।
রাসূলের (সা) একান্ত সাহচর্য ও ভালোবাসা লাভ- এসবই হযরত যায়িদের জন্য নির্মাণ করেছে মর্যাদাপূন্ণ এক গৌরবজনক সুশীতল হাওয়ার গম্বুজ।
যায়িদের (রা) মত এমন সৌভাগ্যের অধিকারী ক’জন হতে পারে?
তারাই হতে পারে সফল, যাদের হৃদয়ে আছে ঈমান, সাহস, ত্যাগ আর ইসলামের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা।
বাতাসের ঘোড়া
তীব্র পিপাসায় কাতর তিনি।
তার বুকটা যেন সাহারা মরুভূমি। কিসের পিপাসা?
কিসের তৃষ্ণা?
সে তো কেবল জিহাদের।
সে তো কেবল শাহাদাতের।
হ্যাঁ, এমনি তীব্রতর পিপাসা বুকে নিয়ে তিনি কেবল্ ছটফট করছেন। হৃদয়ে তার তুমুল তুফান।
চোখের তারায় ধিকি ধিকি জ্বলে আরব মহাসাগর।
কোথায়? কতদূর?
আর কত অপেক্ষা
এ প্রতীক্ষা বড় কষ্টকর। বড়ই যন্ত্রণার।
তিনি ছুটে গেলেন প্রশান্তির মহাসাগর দয়ার নবীর (সা) কাছে।
খুব মিনতির সুরে বললেন, দেখুন দয়ার রাসূল (সা), আমাকে দেখুন। কেমন অস্থির হয়ে আছে আমার হৃদয়। হৃদয় তো নয়, যেন ধুধু পোড়া মাঠ। চৈত্রের দাবদাহ। হে রাসুল, আপনি আমার পিপাসা মেটান।
পিপাসা!
এ পিপাসা বড় কঠিন পিপাসা।
এ পিপাসা বড় সুন্দর পিপাসা।
কিন্তু হলে কি হবে তার জন্য তো বয়স পূর্ণতার প্রয়োজন।
রাসূল তো কেবল রাসুলই নন।
তিনি একজন সেনাপতিও বটে। কত দিকে খেয়াল রাখতে হয় তাঁর। রাসুল দেখছেন পিপাসিত এক কিশোরকে।
তিনি পিপাসিত বটে, কিন্তু তার পিপাসা মেটাবার মত তখন বয়স হয়নি। তবুও তার আরজিরত মধ্যে কোনো খাদ নেই।
নেই এতটুকু কৃত্রিমতা।
রাসূল (সা) এবার ভালো করে চেয়ে দেখেলেন তাকে। তারপর মৃদৃ হেসে কোমল কণ্ঠে বললেন,
তুমি জিহাদে যেতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু জিহাদে যাবার মত তোমার তো এখনও সেই বয়সই হয়নি!
তবুও নাছোড় তিনি। বললেন, সামনেই উহুদ যুদ্ধ। দয়া করে এই যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিন হে দয়ার রাসূল (সা)।
রাসূল আবারও হাসলেন। বললেন, না। তা হয় না। এত অল্প বয়সে যুদ্ধে যেতে চাইলেও আমি সেটার অনুমতি দিতে পারি না। তুমি ফিরে যাও।
রাসূলের (সা) দরদী কণ্ঠের সুধা পান করে তিনি ফিরে এলেন।
ফিরে এলেন, কিন্তু বুকের ভেতর তৃষ্ণাটা রয়েই গেল আগের মত।
মাঝে মাঝেই সেটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
দিন যায়। প্রহর গড়া।
সময়ের সাথে সাথে তার পিপাসাটাও বেড়ে যায়।
কেবলই ভাবছেন, কবে কখন আসবে আমার জন্য সেই মোহনীয় কাল? কবে? প্রতিটি প্রহর তো মহাকালের মত মনে হচ্ছে?
না, এরপর আর বেশিদিন তাকে অপেক্ষা করতে হলো না। এসে গেল সেই প্রতীক্ষিত দিন।
উহুদের পর এলো খন্দকের যুদ্ধ।
উহুদের যুদ্ধে তিনি বয়স কম হবার কারণে যেতে পারেননি। রাসূল (সা) অনুমতি দেননি। কিন্তু এবার?
খন্দকের যুদ্ধ।
এটাও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে যাবার জন্য তিনি রাসূলের (সা) অনুমতি চাইলেন।
রাসূল (সা) এবার তাকে অনুমতি দিলেন।
রাসূলেল (সা) সম্মতি লাভের পর আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। মনে হলো তিনি এমন এক দুর্লভ সম্পদ লাভ করেছেন, যার মূল্য গোনার মত শক্তি কারো নেই।
সেই তো শুরু।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাননি তিনি।
যখনই জিহাদরে ডাক এসেছে, তখনই তিনি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেছেন। আর প্রশান্ত ও পরিতৃপ্তির সাথে বলেছৈন, আমি উপস্থিত, আমি উপস্থিত যে দয়ার নবীজী।
রাসূল (সা) যুদ্ধ করেছেন উনিশটি। তার মধ্যে সতেরটি যুদ্ধেই শরীক হয়েছিলেন এই দুঃসাহী মুজাহিদ। আর কি বিস্ময়কর ব্যাপর, প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি ছিলেন সমান সাহসী।
মুজাহিদ তো নয়, যেন বিদ্যুতের তেজ। বাতাসের ঘোড়া! হাওয়া দু’ভাগ করে তার তরবারি থেকে কেবলি ঠিকরে বেরুচ্ছে আগুনের ফুলীক।
মূতার যুদ্ধ!
যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি শেষ।
তিনিও চললেন যুদ্ধের ময়দানে।
সঙ্গে আছেন আর িএক দুঃসাহসী মুজাহিদ। সম্পর্কে চাচা।
কিন্তু তিনি দুধারী তরবারির অধিকারী। দুটোতেই সমান দক্ষ। কোনোটার চেয়ে কোনোটাই কম নয়।
একটি তার যুদ্ধের তরবারি, আর অন্যটি কলম।
হ্যাঁ, কবি তিনি। বিখ্যাত কবি। তার কবিতার ফলায়ও সমান বিদ্ধ হয়।
কাফের, মুশরিক, আর অগণিত ইসলামের দুশমন।
নাম তার আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা।
তিনি রাসূলের (সা) একজন উঁচুমানের সাহাবী।
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা।
তিনিও চলেছৈন মূতার যুদ্ধে।
একটি মাত্র উট।
সেই উটে আরোহণ করেছেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তার সাথে একই উটের দ্বিতীয় আরোহী তারই ভাতিজা, টগবগে এক মুজাহিদ।
চাচা-ভাতিজা।
কেউ কারো চেয়ে কম নয়।
কম নয় তাদের শাহাদাতের পিপাসা।
দু’জনই সমানে সমান।
উট এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত সামনের দিকে।
পিঠে তার দু’জন দুঃসাহসী মুজাহিদ।
চাচা নামকরা িএক বিখ্যাত কবি।
উটের পিঠে চলতে চলতে তিনি আবৃত্তি করছেন কবিতা।
ভাতিজা তার মুগ্ধ শ্রোতা।
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কবিতার এক জায়গায় ছিল শাহাদাতেরতীব্র স্বপ্ন ও আকঙ্ক্ষার কথা। সেই অংশটুকু শুনেই কাঁদতে শুরু করলেন সাথী ভাতিজা।
তিনি কাঁদছেন!
ভয়ে নয়।
শঙ্কায় নয়।
দুর্বলতায় নয়।
তবুও তিনি কাঁদছেন ক্রমাগত।
কিন্তু কেন?
বুঝে ফেললেন চাচা কবি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা।
তার কান্নার কারণ বুঝে ওঠার সাথে সাথেই চাচা ঝাঁকিয়ে রাগের সাথে বললেন,
“ওরে ছোটলোক! আমার শাহাদাতের ভাগ্য হলে তোর ক্ষতি কি?”
যেমন চাচা, তেমনি ভাতিজা!
শাহাদাতের পিপাসায় দু’জনই সমান কাতর।
ভাতিজার শাহাদাতের পিপাসা মেটেনি বটে, তবে মিটেছিল জীবনের পিপাসা।
কারণ, তিনি ছিলেন রাসূলের (সা) একান্ত আপন।
রাসূলের স্নেহে তিনি ছিলেন ধন্য।ভ
তিনি যেমন রাসূলকে (সা) ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে, তেমনি রাসূলও (সা) তাকে মহব্বত করতেন অঢেল, অনেক।
কে তিনি?
কে তিনি?
যিনি ছুঁতে পেরেছিলেন আল্লাহ ও রাসূলের (সা) ভালোবাসার পর্বতের চূড়া?
তিনি তো আর কেউ নন-
এক দুর্বিনীত দুঃসাহসী বাতাসের ঘোড়া- যায়িদ ইবন আরকাম।
মহান মেজ্ববান
একটি প্রশান্তময় গৃহ।
ছায়াঘেরা শান্ত সুনিবিড়।
কল্যাণ আর অফুরন্ত আলোর রোশনিতে সীমাহীন উজ্জ্বল।
কার বাড়ি? কোন্ বাড়ি?
আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেন সবাই।
এতো মদিনার সেই বাড়ি, যে বাড়িতে প্রথমে পবিত্র পা রেখেছিলেন নবী মুহাম্মদ (সা)।
মহান আলেঅকিত রাসুল! রাসূলের (সা) সঙ্গে চিলেন সেদিন তাঁরেই সাথী হযরত আবু বকর (রা)।
হ্যাঁ, সেইদিন।
যেদিন রাসুল (সা) আবুবকরকে নিয়ে পৌঁছুলেন মদিনায়।
মদিনার কুবা পল্লী।
চারপাশ তার স্নিগ্ধ, শান্ত।
কী এক মোহময় পরিবেশ।
অসীমতার মায়ার বন্ধন।
রোশনীতে আলো ঝলমল। যেন সোনার মোহর ছড়িয়ে আছে পূর্ণিমা জোছনায়।
চকচক করছে কুবা পল্লীর প্রতিটি ধূলিকণা। ধূলিকণা!
তাও যেন রূপ নিয়েছে একেবারে খাঁটি সোনায। একেবারেই খাদহীন। কে জানে না কুবা পল্লীর নাম?
কে চেনে না তার পথঘাট, গলিপ্রান্তর?
সবাই চেনে।
সবাই জানে।
জানে এবং চিনে মদিনার ও মক্কার প্রতিটি মানুষ।
কেন চিনবে না?
কুবা পল্লী তো বুকে ধারণ করে আছে এক উজ্জ্বল ইতিহসা, ইতিহাসের চেয়েও মহান এক সত্তা।
আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতি পেলেন দয়ার নবীজী (সা)। এটাই প্রথম হিজরত!
রাসূল (সা) চলেছেন অতি সন্তর্পণে। সামনে দিকে। সাথে আছেন বিশ্বস্ত বন্ধু হযরত আবু বকর (রা)।
রাসূল (সা) ছেড়ে যাচ্ছেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি মক্কা। সেই মক্কা!
যেখানে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সাগর সমান রহমত নিয়ে।
যেখানে কেটেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের দিনগুলো।
কত স্মৃতি, কত কথা, কত ঘটনা প্রবাহ মনে পড়ছে দয়ার নবীজীর (সা)।
তিনি হাঁটছেন আর পেছনে তাকাচ্ছেন।
দয়ার নবীজীর ভারী হয়ে উঠলো স্মৃতিবাহী হৃদয়।
তাঁকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে ভালোবাসার মক্কা!
মক্কা থেকে রাসূল (সা) চলেছেন মদিনার দিকে। এটাই আল্লাহর মঞ্জুর। এটাই প্রথম হিজরত।
মদিনর উপকণ্ঠে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে কুবা পল্লী।
বহু পূর্ব থেকেই কুবা পল্লীর রয়েছে ঐতিহ্যেঘেরা সুনাম ও খ্যাতি।
আল্লাহর প্রিয় হাবীব রাসূলে মকবুল (সা) ও তাঁর সাথী আবুবকর কুবা পল্লীতে পৌঁছেই একটু থমকে দাঁড়ালেন।
তারপর।
তারপর তিনি এবং তাঁর সাথী প্রবেশ করলেন কুবা পল্লীর অতি খান্দানী একটি বাড়িতে।
বাড়িটি কার?
কে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি?
তিনি আর কেউ নন। নাম কুলসুম ইবনুল হিদম (রা)।
রাসূলও (সা) দারুণ পছন্দ করলেন বারিটি। এখানেই তিনি তাঁর সাথী আবুবকরসহ কাটিয়ে দিলেন একে একে চারটি দিন।
কুলছুম ইবনুল হিদমের (রা) বাড়িতে চারদিন থাকার পর দয়ার নবীজী (সা) পৌছুলেন মদিনার মূল ভূখণ্ডে।
এখঅনে এসে রাসূল (সা) ও আবুবকর (রা) অবস্থান করেন আর এক সৌভাগ্যবান সাহাবী আবু আইউব আল আনসারীর বাড়িতে।
কিন্তু রাসূল (সা) মদিনার পদধূলি দিয়েই যার বাড়িতে উঠলেন, তিনি কুলসুম ইবনুল হিদম।
রাসূল (সা) উপস্থিত তার বাড়িতে!
কি সৌভাগ্যের ব্যাপার!
আনন্দ আর ধরে না তার হৃদয়ে।
খুশিতে বাগবাগ।
কিযে করবেন রাসূলের (সা) জন্য, কিভাবে যে বরণ করে নেবেন এই মহিমান্বিত মেহমানকে। দিশা করতে পার ছেন না কুলসুম ইবনুল হিদম (রা)।
মুহূর্তেই তিনি হাঁকডাক শুরু করলেন। ডেকে জড়ো করলেন বাড়ির চাকর-বাকরকে।
ডাক পেয়েই ছুটে এলো সকলেই। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল নাজীহ। কুলসুম নাজীহকে তার নাম ধরে ডাক পারলেন।
রাসূলের (সা) কানে গেল নামটি।
নাজীহ অর্থ সফলকাম।
রাসূল (সা) নামটি শুনেই সাথী আবুবকরকে (রা) বললেন, হে আবুবরক! তুমি সফলকাম হয়েছো।
এই বাড়িতে শুধু রাসূলই (সা) নন। সে সময় রাসূলের (সা) অনেক সঙ্গী-সাথীই মেহমান হিসেবে তার বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন।
যেমন রাসূল (সা) ও আবুবকর (রা) কুলসুমের (রা) বাড়িতে অবস্থানের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলেন মক্কার পথ পেছনে ফেলে আলী ও সুহাইব (রা)।
তাঁরাও অবস্থান করলেণ কুলসুমের (রা) বাড়িতে।
এছাড়াও তার বাড়িতে উঠেছিলেন মক্কা থেকে আগত রাসূলের (সা) একান্ত সাথী আবু মাবাদ আল মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রা), যায়িদ ইবনে হারিসা (রা), আবু মারসাদ কান্নায ইবন হিসন (রা), আবু কাবশা (রা) প্রমুখ সাহাবী।
চমর দুঃসময়ে কুলসুম এইভাবে খুলে রেখেছিলেন তাঁর বাড়ির দরোজা নবীর (সা) সাথীদের জন্য।
রাসূল (সা) মদিনায় আছেন।
মক্কা থেকে একে একে অনেকেই এসেছেন সেখানে হিজরত করে।
খুব কাছের সময়।
মদিনায় তৈরি হচ্ছে মসজিদে নববী। সেই সাথে তৈরির কাজ চলছে রাসূলের (সা) বিবিদের আবাসস্থল।
তখন।
ঠিক তখনই ইন্তেকাল করলেন কুলসুম ইবনুল হিদম (রা)।
রাসূলের (সা) মদিনায় আগমনের পর কোনো আনসারী সাহাবীর (রা) এটাই প্রথম ইন্তেকাল!
না। এতটুকুও কষ্ট পেলেন না কুলসুম ইবনুল হিমদ (রা)।
বরং তিনি এক প্রফুল্ল চিত্তে, মহা খুশি ও আনন্দের মধ্যেই চলে গেলেন, জীবনের ওপারে।
কেন তিনি কষ্ট পাবেন?
কেন তিনি ব্যথিত হবেন
তাঁর তো রয়েছে রাসূলের (সা) ভালোবাসা। রয়েছে তার চেয়ে অনেক অধিক সম্পদ। রাসূলের (সা) মেজবান হবার, প্রথম সৌভাগ্যের পরশ।
সফল তিনি।
সফল আশ্চর্য এক মহান মেজবান কুলসুম ইবনুল হিদম দুনিয়া ও আখেরাতে।