সাইয়েদ আহমদ বেরিলভী (র) ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (র)
এ কারণে শাহ ওয়ালিউল্লাহর মৃত্যুর পর অর্ধশতক অতিক্রম হবার আগেই ভারতবর্ষে একটি আন্দোলনের উদ্ভব হলো। শাহ ওয়ালিউল্লাহ জনগণের দৃষ্টিসমক্ষে যে লক্ষ্যবিন্দুকে উজ্জল করে গিয়েছিলেন এ আন্দোলন ছিল সেই একই লক্ষ্যের অনুসারী। সাইয়ৈদ সাহেবের পত্রাবলী ও বাণী এবং শাহ ইসমাইল শহীদের ‘মানসাবে ইমামাত’, ’ইকবাত’, ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’, ও অন্যান্য রচনাবলী পাঠ করলে উভয় স্থানেই শাহ ওয়ালিউল্লাহরই সরব কণ্ঠ শ্রুত হবে। শাহ সাহেব কার্যতঃ যা করেছিলেন, তা হলো এই যে, তিনি হাদীস ও কোরআনের শিক্ষা এবং নিজের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সৎ ও চিন্তাসম্পন্ন লোকদের একটি বিরাট দল সৃষ্টি করেন। অতঃপর তাঁর চার পুত্র বিশেষ করে শাহ আবদুল আজীজ (র) বিপুলভাবে এ দলটির কলেবর বৃদ্ধি করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার ব্যক্তি ছড়িয়ে পড়েন। তাঁরা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তার ধারক, তাদের হৃদয়পটে ইসলামের নির্ভুল চিত্র অংকিত ছিল। তাঁরা নিজেদের বিদ্যা, বুদ্ধি ও উন্নত চরিত্রের কারণে সাধারণ লোকের মধ্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর শাগরিদগণের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে পরিণত হন। এ জিনিসটি পরোক্ষভাবে সেই আন্দোলনের জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, যেটি শাহ সাহেবের ভক্ত গোষ্ঠির মধ্য থেকে নয় বরং তাঁর গৃহ থেকে জন্মলাভ করার প্রতীক্ষায় ছিল।
() সাইয়েদ আহমদ ১২০১হিজরীতে (১৭৮৬খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন ও ১২৪৬হিজরীতে (১৮৩১) খৃঃ) শাহাদাৎ বরণ করেন। শাহ ইসমাইল শহীদ ১১৯৩হিজরীতে (১৭৭৯) খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন ও ১২৪৬হিজরীতে (১৮৩১খৃঃ) শাহাদাৎ লাভ করেন। সম্ভবতঃ ১৮১০হিজরীর কাছাকাছি সময়ে সাইয়েদ আহমদের মধ্যে বিপ্লবী আন্দোলনের শিখা প্রজ্জলিত হয়।
সাইয়েদ আহমদ বেরিলবী (র) ও শাহ ইসমাইল শহীদ (র) উভয়ই আত্মিক ও চিন্তাগত দিক থেকে একই অস্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আর এই একক অস্তিত্বকে আমি স্বতন্ত্র মুজাদ্দিদ মনে করি না বরং শাহ ওয়ালিউল্লাহর তাজদীদের পরিশিষ্ট মনে করি। তাঁদের কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত সার হলোঃ
(১) তাঁরা সাধারণ মানুষের ধর্ম, চরিত্র, আচার-ব্যবহার ও লেন -দেনের সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যেসব স্থানে তাঁদের প্রভাব পৌছে সেখানে জীবনধারায় এমন বিপুল বিপ্লব সাধিত হয় যে, মানুষের চোখে সাহাবাদের জামানার চিত্র ভেসে উঠে।
(২) ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে ভারতের ন্যায় একটি পতনোন্মুখ দেশে তাঁরা যেভাবে ব্যাপকহারে জিহাদের প্রস্তুতি করেন এবং এ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যেভাবে নিজেদের সাংগঠনিক যোগ্যতার পূর্ণতা প্রকাশ করেন, তা এক প্রকার অসম্ভবই ছিল। অতঃপর একান্ত দূরদর্শিতার সাথে তাঁরা কার্যারম্ভের জন্যে উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষকে নির্বাচিত করেন। বলাবাহুল্য ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে এটিই ছিল এ কাজের উপযোগী স্থান। অতঃপর এই জেহাদে তাঁরা এমন চরিত্রনীতি ও যুদ্ধ আইন ব্যবহার করেন যে, তার মাধ্যমে একজন দুনিয়াদার স্বার্থবাদী যোদ্ধার মোকাবিলায় একজন খোদার পথে জেহাদকারী বিশিষ্টতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এভাবে তাঁরা দুনিয়ার সম্মুখে আর একবার সঠিক ইসলামী আদর্শ ও ধ্যানধারণার বিকাশ ঘটান। তাঁদের যুদ্ধ দেশ, জাতি বা দুনিয়ার স্বার্থকেন্দ্রিক ছিলনা। বরং একান্তভাবে খোদার পথে ছিল। খোদার সৃষ্টিকে জাহেলিয়াতের শাসনমুক্ত করে তাদের ওপর স্রষ্টা ও বিশ্ব জাহানের মালিকের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া তাঁদের দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এ উদ্দেশ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হযে নিয়মানুযায়ী প্রথমে তাঁরা ইসলাম অথবা জিজিয়ার দিকে আহবান করেন। অতঃপর নিজেদের পক্ষ থেকে পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত হবার পর তাঁরা অস্ত্রদারণ করতেন। আর অস্ত্রধারণ করার পর ইসলামের মার্জিত ও উন্নত যুদ্ধ আইনের পুরোপুরি আনুগত্য করতেন। কোন নির্যাতনমূলক ও হিংস্রকার্য তাছদের দ্বারা সম্পাদিত হয়নি। তাঁরা যে লোকালয়ে প্রবেশ করেন, সংস্কারক হিসাবেই প্রবেশ করেন। তাঁদের সেনাদলের সংগে শরাব থাকতো না, ব্যাণ্ড বাজতো না, প্রতিতাদের পল্টন তাঁদের সংগে থাকতো না, তাঁদের সেনানিবাসে ব্যভিচারীদের আড্ডাখানায় পরিণত হতো না এবংএমন কোন দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়নি যে, তাঁদের সেনাদল কোন স্থান অতিক্রম করছে আর সেখানকার মহিলারা তাদের সতীত্ব হারিয়ে মাতম করতে বসেছে। তাঁদের সিপাহীরা দিনের বেলায় ঘোড়ার পিঠে আর রাতে জায়নামাজের ওপর থাকতেন। তাঁরা খোদার ভয়ে ভীত থাকতেন, আখেরাতের হিসাব ও জবাবদিহিকে হামেশা সম্মুখে রাখতেন। এ ব্যাপারে তাঁরা কোন প্রকার লাভ-ক্ষতির পরোয়া করতেন না। তাঁরা কোথাও পরাজিত হলে কাপুরুষ প্রমানিত হননি। আবার কোথাও বিজয় লাভ করে নিষ্ঠুর ও অহংকারী প্রমাণিত হননি। তাঁদের আগে ও পরে এ ধরনের নির্ভেজাল ইসলামী জেহাদ আর অনুষ্ঠিত হয়নি।
(৩) তাঁরা একটি ক্ষুদ্রমত এলাকায় স্বল্পকালীন রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ লাভ করেন। এ সময় তাঁরা যথার্থ খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়্যাত (নবুয়্যাত পন্থানুসারী খেলাফত) এর পদ্ধতিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেন। ফকিরী শাসন, সাম্য পরামর্শ, সভা, ন্যায়বিচার, ইনসাফ, শরিয়তের আইন, হক অনুযায়ী অর্থ গ্রহণ করা এবং হক অনুযায়ী খরচ করা, দুর্বল হলেও মজলুমের সাহায্য করা, শাক্তিশালী হলেও জালেমের বিরোধিতা করা, খোদাভীরুতার সাথে দেশ শাসন করা এবং সততার ভিত্তিতে রাজনীতি পরিচালনা করা ইত্যাদি সকল দিব দিয়েই তাঁরা সেই ইসলামী খেলাফতের পূর্ণাংগ নমূনা পেশ করেন। সিদ্দিক (রা) ও ফরুকের (রা) আমলের খেলাফতের চিত্রকে তাঁরা পুনরুজ্জীবিত করেন।
কতিপয় জাগতিক কারণে তাঁরা ব্যর্থ হন। এ কারণগুলি আমি পরে বর্ণনা করছি৩৬। কিন্তু চিন্তাজগতে তাঁরা যে, আলোড়ন সৃষ্টি করে যান তার প্রভাব এক শতাব্দীর অধিক সময় অতিক্রান্ত হবার পর আজও হিন্দুস্থানে পরিদৃষ্ট হচ্ছে।
(৩৬) ব্যর্থতা-অর্থে- সত্যিকার নয়, আপাতঃ দৃষ্টিতে যে ব্যর্থতা ধরা পড়ে। খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার যথাসাধ্য প্রচেষ্ঠা চালানোই মুসলমানদের সত্যিকার সাফল্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা অবশ্যি সফলকাম হয়েছিলেন। তবে তাঁদের ব্যর্থতা পার্থিব ফলাফলের দিক দিয়ে পরিস্ফুট। কার্যতঃতাঁরা জাহেলিয়াতের কর্তৃত্ব নিমূর্ল করে ইসরামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। আমরা এরই কারণ সমূহ পর্যালোচনা করবো। যাতে করে পরবর্তীকালে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ঐ কারণসমূহের ব্যাপারে সতর্ক থাকা সম্ভব হয়।