ব্যর্থতার কারণ
এই সর্বশেষ সংস্কামূলক আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণসমূহ পর্যালোচনা করা সাধারণতঃ তাদের রুচিবিরুদ্ধ যাঁরা নিছক ভক্তি সহকারেই মহানীষীদের কথা আলোচনা করার পক্ষপাতী। এজন্য আমার আশংকা হচ্ছে যে, উপরোক্ত শিরোনামায় আমি যা কিছু পেশ করবো, তা আমার অনেক ভাইয়ের মনোবেদনার কারণ হবে। কিন্তু পূর্ববর্তী মনীষীগণের উদ্দেশ্যে নিছক প্রশংসাবাণী বিতরণ করাই যদি আমাদের এই সমগ্র আলোচনার উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে বরং আগামীতে দ্বীনের সংস্কারের কাজে তাঁদের কার্যাবলী থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে সামালোচকের দৃষ্টিতে ইতিহাস পর্যালোচনা করা এবং এই মনীষীদের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করার সাথে সাথে উদ্দেশ্য সাধনে তাদের ব্যর্থতার কারণসমূহ অনুসন্ধান করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র) এবং তাঁর পুত্রগণ হক পরস্ত আলেম ও সৎ লোকদের যে মহান দল সৃষ্টি করেন অতঃপর সাইয়েদ আহমদ বেরিলবী (র) ও শাহ ইসমাইল শহীদ (র) সৎ ও খোদাভীরু লোকদের যে বাহিনী গঠন করেন তার বিবরণ পড়ে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হই। মনে হয়, বুঝি আমরা ইসলামের প্রথম যুগের সাহাবা ও তাবেঈনের জীবন চরিত্র পাঠ করছি। আমরা অবাক হয়ে ভাবি যে, আমাদের এতো নিকটতর যুগে এমন অদ্ভুত উন্নত চরিত্রের লোকদের আগমন হয়েছিল! কিন্তু এই সংগে আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে, এতো বড় সংস্কার ও বৈপ্লবিক আন্দোলন, যার নেতৃবৃন্দও কর্মীগণ এমন সৎ, খোদাভীরু ও অক্লান্ত মুজাহিদ ছিলেন, তাঁরা চরম প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও হিন্দুস্থানে ইসলামীরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হননি কেন? অথচ এর বিপরীত পক্ষে সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে আগত ইংরেজ এখানে নির্ভেজাল জাহেলী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। ভক্তির উচ্ছাসে অন্ধ হয়ে এ প্রশ্নটির জবাবদানে বিরত থাকার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, লোকেরা সত্য সততা, খোদাভীরুতা ও জেহাদকে খোদার দুনিয়ায় সংশোধনের ক্ষেত্রে দুর্বল প্রভাবের অধিকারী মনে করতে থাকবে। এ চিন্তা তাদেরকে নিরাশ করবে যে, এতোবড় সৎ ও খোদাভীরু লোকদের প্রচেষ্টায় যখন কিছু হলো না তখন ভবিষ্যতেও আর কিছু হবে না। এ ধরনের সন্দেহ আমি লোকদের মুখে শুনেছি। বরং হালে যখন আমি আলিগড়ে যাই, তখন ষ্ট্রেচী হলের বিরাট্ সমাবেশ আমার সম্মুখে এই সন্দেহই পেশ করা হয়। এ সন্দেহ অপনোদান করার জন্যে আমাকে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিতে হয়। উপরন্ত আমি এও জানি যে অধুনা উলামা ও সৎলোকদের যে বিরাট দল আমাদের মধ্যে আছেন, তাদেরও বেশীর ভাগ এ ব্যাপারে একেবারেই চিন্তাশূন্য। অথচ এ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো হলে এমন সব শিক্ষা আমরা লাভ করতে পারি, যার আলোকে আগামীতে আরো বেহতের ও অধিকতর নির্ভূল কার্য সম্পাদিত হতে পারে।
প্রথম কারণ
হযরত মুজাদ্দিদে আলফিসানির যুগ থেকে নিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর প্রতিনিধিবৃন্দের সময় পর্যন্ত যাবতীয় সংস্কারমূলক কাজে যে, জিনিসটি প্রথম আমার চোখে বাধে, তা হলো এই যে, তারা তাসাউফের ব্যাপারে মুসলমানদের রোগ পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেননি এবং অজানিতভাবে তাদেরকে পুনর্বার সেই খাদ্য দান করেন যা থেকে তাদেরকে পূর্ণরূপে দূরে রাখার প্রয়োজন ছিল। তাঁরা যে তাসাউফ পেশ করেন তার মূল কাঠামোর বিরুদ্ধে আমার কোন আপত্তি নেই বরং প্রাণবন্তুর দিক দিয়ে তা ইসলামের আসল তাসাউফ। এ তাসাউফ ‘এহসান’ থেকে মোটেই ভিন্নতর নয়। কিন্তু যে বস্তুটিকে আমি পরিতাজ্য, বলছি তা হলো তাসাউফের রূপক উপমা ও ভাষা ব্যবহার এবং তাসাউফের সাথে সামঞ্জস্যশীল পদ্ধতি জারি রাখা। বলাবাহুল্য, সত্যিকার ইসলামী তাসাউফ এ বিশেষ খোলসের মুখাপেক্ষী নয়। এর অন্য ছাঁচ ও আছে। এর জন্যে অন্য প্রকার ভাষাও ব্যবহার করা যেতে পারে। উপমা এরূপক থেকেও অব্যহতি লাভ করা যেতে পারে। পীর-মুরিদ ও এ ব্যাপারে যাবতীয় বাস্তব আকৃতি পরিহার করে অন্য আকৃতি গ্রহণ করা যেতে পারে। তা হলে সেই পুরানো ছাঁচ যার মধ্যে দীর্ঘকাল থেকে জাহেলী তাসাউফের আধিপত্য চলে আসছিল তাকে গ্রহন করার জন্যে চাপ দেওয়ার কি-ইবা প্রয়োজন ছিল। এর ব্যাপক ও বিপুল প্রচার মুসলমানদের মধ্যে যেসব কঠিন নৈতিক ও আকিদাগত রোগের সৃষ্টি করেছে, তা বিচক্ষণ ব্যক্তির দৃষ্টির আগোচরে নেই। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোন ব্যক্তি যতই নির্ভুল শিক্ষাদান করুক না কেন এই ছাঁচ ব্যবহার করার সাথে সাথেই শত শত বছরের প্রচলনের ফলে এর সাথে যেসব রোগ সংশ্লিষ্ট হয়েছে সেগুলির পুনরাবির্ভাব ঘটে।
কাজেই পানির ন্যায় হালাল বস্তুও যেমন ক্ষতিকর প্রমাণিত হলে রোগীর জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, অনুরূপভাবে এ ছাঁচ বৈধ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র এ কারণেই পরিত্যাজ্য যে, এরই আবরণে মুসলমানদের মধ্যে আফিমের নেশা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর নিকটবর্তী হতেই পুরাতন রোগীদের মানসপটে আবার সেই ঘুমপাড়ানীর কথা ভেসে ওঠা, যে শত শত বছর থেকে গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তাদেরকে নিদ্রাভিভূত করেছে। পীরের হাতে বায়াত হবার পর মুরীদের মধ্যে সেই বিশেষ মানসিকতা সৃষ্টি হয়, যা একমাত্র পীর মুরিদীর জন্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ -“পীরের কথায় শিরাজীর রঙে রঙিন হও” ধরনের মানসিকতা, যার পর পীর সাহেব ও গায়রুল্লাহর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। তাদের চিন্তা ও দৃষ্টি স্থবিরত্বে পৌঁছে সমালোচনা শক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, বুদ্ধি ও জ্ঞানের ব্যবহার স্থগিত হয় এবং মন-মস্তিষ্কের ওপর শায়খের বন্দেগীর এমন পরিপূর্ণ আধিপত্য বিস্তার লাভ করে যার ফলে শায়খ যেন তাদের প্রতিপালক এবং তারা শায়খের প্রতিপালিত হিসেবে পরিগণিত হয়। অতঃপর কাশফ ও ইলহামের আলোচনা শুরু হবার সাথে সাথে মানসিক দাসত্বের বাঁধন আরো বেশী শক্তিশালী হতে থাকে। তারপর শুরু হয় সুফিদের রূপক ও উপমার প্লাবন। এর ফলে মুরিদদের কাল্পনাশক্তি যেন চাবুক খাওয়া অশ্বের ন্যায় তাদেরকে নিয়ে তীর বেগে ছুটতে থাকে। এ অবস্থায় তরা প্রতি মুহূর্তে অদ্ভুত তেলেসমাতির দুনিয়ায় সফর করতে থাকে, বাস্তবের দুনিয়ায় অবস্থান করার সুযোগ তার খুব কমই লাভ করে।
মুসলমানদের এ রোগ সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দিদে আলফিসানি ও হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ অনবগত ছিলেন না। উভয়ের রচনায় এর সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সম্ভবতঃ এ রোগের ব্যাপকতা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ছিল না। এ কারণেই তারা এ রোগীদেরকে পুনর্বার এমন পথ্য দান করেন যা এই রোগে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। ফলে তাদের উভয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ধীরে ধীরে আবার সেই পুরাতন রোগে আক্রান্ত হতে থাকে৩৭। যদিও মাওলানা শাহ ইসমাইল শহীদ (র) এ সত্য যথার্থ রূপে উপলব্ধি করে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার (র) নীতি অনুসরণ করেন, কিন্তু শাহ ওয়ালুউল্লাহর (র) রচনাবলীতেই এর যথেষ্ট সাজ-সরঞ্জাম ছিল এবং শাহ ইসমাইলের রচনাবলীও তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই সাইয়েদ আহমদের আন্দোলনেও পীর-মুরিদির সিলসিলা চালু হয়ে গিয়েছিল। তাই সুফিবাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে এ আন্দোলনও মুক্ত হতে পারেনি। এমন কি সাইয়েদ আহমদের শাহাদাত লাভের পরই তাঁর সমর্থকদের মধ্যে এমন একটি দলের উদ্ভব হয় যারা শিয়াদের ন্যায় তার অদৃশ্য হবার কথা বিশ্বাস করেন এবং আজও তার পুনরাবির্ভাবের প্রতীক্ষায় আছেন।
বর্তমানে যিনি তাজদীদে দ্বীনের কাজ করতে চাইবেন তাঁকে অবশ্যি সুফীদের ভাষা-পরিভাষা, রূপক -উপমা, পীর-মুরিদী এবং তাদের পদ্ধতি স্মরণ করিয়ে দেয় এমন প্রতিটি জিনিস থেকে মুসলমানদেরকে দুরে সরিয়ে রাখাতে হবে এক্ষেত্রে বহুমুত্র রোগীকে যেমন চিনি থেকে দুরে সরিয়ে রাখা হয় মুসলামানদেরকে অনুরূপভাবেই উল্লিখিত বিষয়গুলো থেকে দুরে সরিয়ে রাখতে হবে।
(৩৭) হযরত মুজাদ্দিদ আলফিসানির ইন্তেকালের পর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সমর্থকবৃন্দ তাকে ‘কাইউমে আউয়াল’ ও তাঁর খলিফাদেরকে ‘কাইউমে সানি’ উপাধি দান করে। কাইউম খোদার একটি সিফাত।
দ্বিতীয় কারণ
এ আন্দোলনকে সমালোচনার দৃষ্টিতে অধ্যায়ন করার সময় দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমি অনুভব করেছি, তা হলো এই যে, সাইয়েদ আহমদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ যে এলাকায় অবস্থান করে জেহাদ পরিচালনা করেন, এবং সেখানে তারা ইসলামী হুকুমাত কায়েম করেন, সে এলাকাটিকে পূর্ব থেকেই এ বিপ্লবের জন্যে ভালোভাবে প্রস্তুত করেননি। তাঁদের সেনাবাহিনী অবশ্যি উন্নত নৈতিক ও অধ্যাত্মিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে একত্রিত হয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিম বিপ্লব অনুষ্ঠানের জন্যে প্রথমে স্থানীয় লোকেরা ইসলামী রাষ্ট্রকে বুঝবার এবং তার সাহায্যকারী (আনসার ) হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতো। উভয় নেতৃবৃন্দই সম্ভবতঃএই বিভ্রান্তির শিকার হন যে, সীমান্তের লোকেরা যেহেতু মুসলমান এবং অমুসলিম শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত, কাজেই তারা ইসলামী শাসনকে স্বাগতম জানাবে। এ জন্যেই তাঁরা সেখানে পৌঁছেই জেহাদ শুরু করে দেন এবংযতগুলো দেশ তাদের কর্তৃত্বাধীনে আসে, তার সবগুলোতেই খেলাফত কায়েম করেন। কিন্তু অবশেষে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান হয়ে যায় যে, নামের মুসলমানকে সত্যিকার মুসলমান মনে করা এবং সত্যিকার মুসলমানের দ্বারা যে কাজ সম্ভব তাদের নিকট থেকে সে কাজের আশা রাখা একটি নিছক প্রতারণা ছিল। তারা খেলাফতের বোঝা বহন করার শক্তি রাখতো না। তাদের ওপর এ বোঝা রাখার ফলে তারা নিজেরা ভুপতিত হয়েছে এবংএই পবিত্র ইমারতটিকেও ভূপতিত করেছে।
আগামীতে প্রতিটি সংস্কারমুলক কাজে ইতিহাসের এ শিক্ষাকে সম্মুখে রাখা প্রয়োজনঃ এ সত্যটি পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা উচিত যে, যে রাজনৈতিক বিপ্লবের শিকড় সামগ্রিক চিন্তা চরিত্র ও তমুদ্দুনের মধ্যে আমূল বিদ্ধ না থাকে তা কোনোদিন সার্থক হতে পার না। কোন সাময়িক শক্তির মাধ্যমে এমন বিপ্লব কোথাও সংঘটিত হয়ে গেলেও তা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। আর বিলুপ্ত হবার সময় পিছনে তার কোন চিহ্নই রেখে যায়না। ৩৮
(৩৮) এ কারণেই বর্তমানে সীমান্ত প্রদেশে হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদের কোন প্রভাব অনেক অনুসন্ধানের পরও পাওয়া যায় না। এমন কি সেখানকার লোকেরা বর্তমান বিভিন্ন উর্দু বইপত্রের মাধ্যমের তাঁদের নাম জানতে পারছে।
তৃতীয় কারণ
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই বুজর্গগনের তুলনায় কয়েক হাজার মাইল দুর থেকে আগত ইংরেজদের এমন কি শ্রেষ্ঠত্ব ছিল, যার ফলে তারা এখানে জাহলী রাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হয়? কিন্তু এঁরা নিজেদের দেশে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে পারলেন না? আঠার ও ঊনিশ ঈসায়ী শতকের ইউরোপের ইতিহাস সম্মুখে না থাকলে এর নির্ভুল জবাব পাওয়া যাবে না। শাহ সাহেব ও তাঁর অনুগামিগণ ইসলামের সংস্কারের জন্যে যে কার্য সম্পাদন করেন, তার সমগ্র শক্তি কে তুলাদণ্ডের একদিকে এবং অন্যদিকে তার সমকালীন জাহেলীয়াতের শক্তিকে স্থাপন করলে তবেই পূর্ণরূপে অনুমান করা সম্ভব হবে যে, এই বস্তুজগতে যে নীতি -নিয়ম কার্যকরী রয়েছে তার পরিপ্রক্ষিতে এই দুই শক্তির আনুপাতিক হার কি ছিল? একথা মোটেই অতিশয়োক্তি হবেনা যদি আমি বলি যে, এই দুই শক্তির মধ্যে এক তোলা ও এক মণের সম্পর্ক ছিল। এ জন্যে বাস্তবে যে ফলাফল সূচিত হয়েছে তার থেকে ভিন্নতর কিছু হওয়া সম্ভপর ছিল না।
যে যুগে আমাদের দেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ শাহ আবদুল আজিজ ও শাহ ইসমাইল শহীদ জন্মগ্রহণ করেন, সে যুগেই ইউরোপ নব শক্তি ও নব উদ্দীপনা নিয়ে মধ্য যুগের নিদ্রা থেকে জেগে উঠেছিল। সেখানে জ্ঞান ও শিল্প অনুসন্ধানকারী, উদ্ভাবক ও আবিষ্কারক এত বিপুল সংখ্যায় জন্মলাভ করেছিলেন যে, তাঁরা সবাই মিলে এই দুনিয়ার চেহারাই পালটিয়ে দেন। এই যুগেই হিউম, কাষ্ট ফিশতে (Fichte) , , হেগেল, কোঁতে (Comet) , শ্লিয়ার মাশার, (Schlier Macher) , ও মিল এর ন্যায় দার্শনিকগন জন্মগ্রহণ করেন। তারা তর্কশাস্ত্র, দর্শন, মনস্তত্ব এবং যুক্তিবিদ্যার সমগ্র শাখা-প্রশাখায় বিপ্লব সাধন করেন। এ যুগেই শরীরবিদ্যায় গ্যালভানী (Galvani) ও ভলটা (Volta) , রসায়নশাস্ত্রে ল্যাভয়সিয়র (Lavoisier) , প্রিষ্টলি (Priestly) , ডেভী (devy) , ও বার্জিলিয়াস (Berzilivs) এবং জীববিদ্যায় লিনে (Linne) , হলার (Haller) , বিশাত (Bichat) ও উলফ (Wolf) – এর ন্যায় পণ্ডিতদের আবির্ভাব হয়। তাদের গবেষণা শুধু বিজ্ঞানের উন্নতির সহায়ক হয়নি বরং বিশ্বজাহান ও মানুষ সম্পর্কে একটি নয়া মতবাদেরও জন্ম দেয়। এ যুগেই কুইসনে (Quisney) , টার্গট (Turgot) , এডাম স্মিথ (Adam smith) ও ম্যালথাসের গবেষনার মাধ্যমে নয়া অর্থনীতি বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়। এ যুগেই ফ্রান্সের রুশো, ভল্টেয়ার, মন্টিসকো, ডেনিস ডাইডর্ট (Denis diderot) , লা ম্যাটারি (La-mattrie) , ক্যাবানিস (Cabanis) , বাফন (Buffon) ও রোবিনেট (Robinet) , ইংল্যাণ্ডে টমাসপেন (Thomaspoune) , উইলিয়াম গডউইন (William Godwin) , ডেভিড হার্টলে (David Hartley) , জোসফ প্রিষ্টলে (Joseph-priestly) ও এরাসমাস ডারউইন এ জার্মানীতে গেটে, হার্ডার, শিলার (Schiler) , উইন্কেলম্যান (Winekelmann) , লিসিং (Lessing) ও হোলবাস (Holbach) এবং আরো অনেক গবেষকের জন্ম হয়। তাঁরা নৈতিক দর্শন, সাহিত্য, আইন, ধর্ম, রাজনীতি, এবং সামাজবিদ্যায় সকল শাখায় বিপুল প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁরা নির্ভীকভাবে প্রাচীন মতবাদ ও চিন্তাধারার কঠোর সমালোচনা করে চিন্তা এক নতুন দুনিয়া সৃষ্টি করেন।
প্রেসের ব্যবহার, প্রচারের আধিক্য, আধুনিক প্রকাশভংগী ও কঠিন পরিভাষার পরিবর্তে সাধারণের বোধগম্য ভাষা ব্যবহার করার কারনে তাদের চিন্তার ব্যাপক প্রচার হয়। তাঁরা মাত্র গুটিকায় ব্যক্তিকে নয় বরং বিভিন্ন জাতিকে সামগ্রিকভাবে প্রভাবিত করেন। পুরাতন মানসিকতা, নৈতিক বৃত্তি ও রীতি -প্রকৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, জীবনাদর্শ ও জীবন ব্যবস্থা এবং তমুদ্দুন ও রাজনীতির সমগ্র ব্যবস্থার মধ্যে ব্যবস্থায় মধ্যে তাঁরা আমূল পরিবর্তন করেন।
এ যুগেই ফরাসী বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। এর থেকে একটি সভ্যতার জন্ম হয়। এ যুগেই যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে শিল্পক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়। ফলে একটি নতুন তমুদ্দুস, নতুন শক্তি ও নয়া জীবন সমস্যার উদ্ভব হয়। ও যুগেই ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প অসাধারণ উন্নতি লাভ করে। এর ফলে ইউরোপ এমন সব শক্তির অধিকারী হয়, যা ইতিপূর্বে আর কোনো জাতির ছিলনা। এযুগেই পুরাতন যুদ্ধনীতির স্থলে নয়া যুদ্ধনীতি নয়া যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ পদ্ধতির প্রচলন হয়। দস্তরমতো ড্রিলের মাধ্যমে সৈন্যদেরকে সংগঠিত করার পদ্ধতি গৃহীত হয়। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদল মিশিনের ন্যায় আন্দোলিত হতো এবং পুরাতন পদ্ধতিতে শিক্ষিত সেনাদল তাদের মোকাবিলায় তিষ্ঠাতে পারতো না। সৈন্যদের ট্রেনিং সেনাদাল বিভাগ ও যুদ্ধ কৌশলের মধ্যে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয় এবং প্রতিটি যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে এ শিল্পটাকে অনবরত উন্নত করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। অনবরত আবিষ্কারের মাধ্যমে যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। রাইফেল আবিষ্কার হয়। হাল্কা ও দ্রুত বহনকারী মেশিনগান তৈরী করা হয়, কেল্লা ধ্বংসকারী মেশিনগান পূর্বের চাইতে শক্তিশালী করে তৈরি করা হয় এবং সর্বোপরি কার্তুজের আবিষ্কার নয়া বন্দুকের মোকাবিলায় পুরানো পাউডার বন্দুককে একেবারেই অকেজো প্রমাণ করে। এ কারণেই ইউরোপে তুর্কীদেরকে এবং ভারতবর্ষে দেশীয় রাষ্ট্রগুলোকে আধুনিক পদ্ধতিতে সুশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রসম্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর মোকাবিলায় অনবরত পরাজয় বরণ করতে হয় এবং মুসলিম জাহানের কেন্দ্রস্থল হামলা কের নেপোলিয়ান মুষ্টিমেয় সেনানির সাহায্যে মিসর দখল করেন।
সমকালীন ইতিহাসের পাতায় মোটামুটি একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই এ কথা সহজেই পরিষ্ফুট হবে যে, আমাদের এখানে মাত্র কতিপয় ব্যক্তি জাগ্রত হন। এখানে জীবনের কেবলমাত্র একদিকে সামান্য একটু কাজ হয়। কিন্তু সেখানে জীবনের প্রতিটি দিকে হাজার গুণ যেখানে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এখানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পুত্রগণ বিশেষ বিশেষ শাস্ত্রে কতিপয় কিতাব লেখেন। তাদের এ কিতাবগুলো অত্যন্ত সীমিত পরিবেশে পৌছেই আটকে থাকে। আর সেখানে প্রতিটি বিদ্যা-শিল্পের ওপর কিতাব লিখে লাইব্রেরীর পর লাইব্রেরী ভর্তি করা হয়। তাদের কিতাবসমূহ সমগ্র দুনিয়ার পরিব্যাপ্ত হয়। অবশেষে মানুষের মন-মগজের ওপর আধিপত্য, বিস্তার করে। এখানে দর্শন, নৈতিক চরিত্রনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি শাস্ত্রের ভিত্তিতে নয়া বুনিয়াদ স্থাপনের আলোচনা নেহাত প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে। পরবর্তীকালে তার ওপর আর কোনো কাজ হয়নি। আর সেখানে ইত্যবসরে এইসব সমস্যার ওপর পূর্ণাংগ চিন্তাধারা গড়ে ওঠে। এই চিন্তাধারা সমগ্র চিত্র পরিবর্তিত করে। এখানে শরীর -বিদ্যা ও বস্তুশক্তি সম্পর্কিত বিদ্যা পাঁচ শো বছর আগের ন্যায় একই পর্যায়ে অবস্থান করে, আর সেখানে এই ক্ষেত্রে এত বেশী উন্নত সাধিত হয় এবং সেই উন্নতির কারণে পাশ্চাত্যবাসীদের শক্তি এত বেড়ে যায় যে, তাদের মোকাবিলায় পুরাতন যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধোপকরণের জোরো সাফল্য লাভ করা একেবারেই অসম্ভব ছিল।
আশ্চর্যের ব্যাপারে হলো এই যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহর যুগে ইংরেজ বাংলাদেশ বিস্তার লাভ করেছিল এবং এলাহাবাদ পর্যন্ত তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু শাহ সাহেব এই নয়া উদীয়মান শক্তির ব্যাপারে কোনো খোঁজ-খবর নেননি। শাহ আবদুল আজীজের যুগে দিল্লীর বাদশাহ ইংরেজদের নিকট থেকে পেনশন লাভ করতো; আর প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর ইংরেজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মনে কখনো এ প্রশ্ন জাগেনি যে এ জাতিটি কেমন করে এতো অগ্রসর হচ্ছে এবং এই নয়া শক্তির পেছনে কোন শক্তি কার্যকরী আছে?সাইয়েদ সাহেব ও শাহ ঈসমাইল শহীদ কার্যতঃ ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্যে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরা যাবতীয় ব্যবস্থা ও আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু জ্ঞানী ও বিচক্ষণ আলেমদের একটি দলকে ইউরোপে প্রেরণ করতে পারেননি যাঁরা সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান চালাতেন যে, কোন শক্তির জোরে এ জাতিটি তুফানের বেগে অগ্রসর হচ্ছে এবং নয়া উপকরণ নয়া পদ্ধতি ও নয়া জ্ঞন -বিজ্ঞানের সাহায্যে অভিনব শক্তি ও উন্নতি লাভ করছে? এর কারণ কি? তারা নিজেদের দেশে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান কায়েম করেছে? তার কোন ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী? তাদের তমুদ্দুন কিসের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এবং তার মোকাবিলায় আমাদের নিকট কোন জিনিসের অভাব আছে? যখন তারা জেহাদে অবতীর্ণ হন, তখন এ কথা কারুর অবিদিত ছিল না যে, ভারতবর্ষে শিখদের নয় ইংরেজদের শক্তিই হলো আসল শক্তি, আর ইংরেজদের বিরোধিতাই ইসলামী বিপ্লবের পথে সবচাইতে বড় বিরোধিতা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘর্ষে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংগে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার প্রয়োজন ছিল তার মোকাবিলায় নিজের শক্তির পরিমাপ করা এবং নিজের দুর্বলতাসমূহ অনুধাবন করে সেগুলো দূর করার প্রচেষ্ঠা চালানো উচিত ছিল। আমি বুঝতে পারি না, এই বুজর্গদের দূরদূর্শী দৃষ্টি থেকে বিষয়টির এ গুরুত্বপুর্ণ দিকটি প্রচ্ছন্ন রইলো কেমন করে!বলাবাহুল্য, এ ভুলটি যখন তাদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে, তখন এ কার্য -কারণের জগতে এ ধরনের ভুলের ফলাফল থেকে তাঁরা নিস্কৃতি পেতে পারতেন না।
শেষকথা
পাশ্চাত্য জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলামী পুনরুজ্জীবনের এ আন্দোলনটি যে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়, তা থেকে আমরা প্রথমতঃ এ শিক্ষা গ্রহণ করি যে, ইসলামী পুনরুজ্জীবের জন্যে নিছক দ্বীনি এলমকে পুনরুজ্জীবিত ও শরিয়তের প্রাণশক্তিকে সঞ্জিবিত করাই যথেষ্ট নয় বরং একটি ব্যাপক এ বিশ্বজনীন ইসলামি আন্দোলনের প্রয়োজন। এ আন্দোলন সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা, শিল্প, বাণিজ্য তথা জীবনের সকল বিভাগে নিজের প্রভাব পরিব্যাপ্ত করবে এবং সকল সম্ভাব্য শক্তিকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করবে। এ থেকে আমরা দ্বিতীয় শিক্ষা লাভ করি এই যে, বর্তমানে তাজদীদের কাজ করার জন্যে নতুন ইজতিহাদী শক্তি প্রয়োজন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র) ও তাঁর পূর্ববর্তী মুজাদ্দিদ ও মুজতাহিদগণের কর্মকাণ্ডে যে ইজতিহাদী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় বর্তমানকালের সমস্যা সমাধানের জন্যে নিছক ততটুকুই যথেষ্ট হবে না। আধুনিক জাহেলিয়াত বিপুল উপকরণ সহ আবির্ভূত হয়েছে এবং অসংখ্য জীবন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ বা তাঁর পূর্ববর্তীগণের মনে এসব সম্পর্কে কোনো প্রকার ধারণাই ছিল না। একমাত্র সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর প্রদত্ত জ্ঞানের মাধ্যমে নবী করিম (স) এ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কাজেই এ যুগে মিল্লাতের সংস্কারের কাজের জন্যে একমাত্র খোদার কিতাব ও রসূলের সুন্নতের উৎস থেকেই নেতৃত্ব গ্রহণ করা যেতে পারে। আর এই নেতৃত্ব গ্রহন করার পর বর্তমান অবস্থায় বৃহত্তর কর্মপন্থা প্রণয়নের জন্যে এমন স্বতন্ত্র ইজতিহাদী শক্তির প্রয়োজন, যা অবশ্যি মুজতাহিদগণের কারুর জ্ঞান, বিদ্যাবত্তা ও পদ্ধতির অনুগত হবে না, অবশ্যি তাদের প্রত্যেকের ইজতিহাদ থেকে উপকৃত হবে এবং কাউকে উপেক্ষা করবে না।