[দশ]
ন্যায় বিচারঃ অপরাধের খোদায়ী দন্ডবিধি
শরীয়তের ‘হদ্দ’ এবং ‘হক’ বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের সাথে সীমাবদ্ধ নয়, হদ্দের ব্যাপারে সুপারিশ করা হারাম, তা রহিত বা হ্রাস করার জন্য ঘুষদাতা, গ্রহীতা এবং দালাল সবাই অপরাধী গুনাহগার। মহান আল্লাহ্র নির্দেশ-
*******আরবী
“মানুষের কলহ-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা মীমাংসা করার সময় তোমরা ইনসাফের ভিত্তিতে ফায়সালা করবে”। (সূরা নিসাঃ ৮ রুকূ)
মানুষের মধ্যে ফয়সালা করার অর্থ শরীয়তের হদ্দ এবং হকের ব্যাপারে হুকুম দেয়া। হদ্দ এবং হক দু’প্রকার। এর কোন প্রকারই কোন বিশেষ গোত্র, সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। বরং মুসলমান জাতি এ নিরপেক্ষতা দ্বারা উপকৃতই হবে। যেমন চোর, ডাকাত, লুটেরা, ব্যাভিচারী ইত্যাদির উপর হদ্দ বা শরীয়তী দন্ডবিধি জারী করা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সরকারী মাল, ওয়াকফ ও অসিয়তের মাল- এগুলো বিশেষ কোন গোত্র বা সম্প্রদায়ের সাথে নির্দিষ্ট নয়। এসব বিষয়ের প্রতি রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রমুখ সকলের বৈষম্য মুক্ত বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। এ সম্পর্কে হযরত আলী (রা) বলেন-
********আরবী
“ পূর্ণ সৎ কি অসম্পূর্ণ সৎ, পূর্ণ ভাল কি অসম্পূর্ণ ভাল, মানুষের জন্য নেতৃত্ব অপরিহার্য”। জনগণ প্রশ্ন তুললো- হে আমীরুল মুমিনীন! সৎ নেতৃত্বের গুরুত্ব তো বুঝে আসল; কিন্তু অসম্পূর্ণ সত্যের তাৎপর্য কি? জবাবে তিনি বললেন-
*****আরবী
“ যে নেতার দ্বারা হদ্দজারী (অপরাধ দন্ডবিধি) কার্যকর করা হয়, রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, তাঁর নেতৃত্ব শত্রুর সাথে জিহাদ করা যায় এবং তাঁর মাধ্যমে ‘ফাঈ’ তথা যুদ্ধলব্ধ গণীমতের মাল বন্টিত হতে পারে”। অর্থাৎ অন্য দিকে নেতৃত্বের ত্রুটি থাকলেও হদ্দজারীর মতো শক্ত ভূমিকা তার থাকতেই হবে। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এ গুণ নানান কারণে অপরিহার্য।
এ নিয়ে রাষ্ট্রের অধিনায়ক, স্থানীয় প্রশাসক এবং জন প্রতিনিধিগণের আলোচনা পর্যলোচনা অবশ্য কর্তব্য এবং কারো দাবী ছাড়াই সমাজে অপরাধ নির্মূলে হদ্দ কায়েম হতে হবে। শাহাদত তথা সাক্ষ্যেরও একই হুকুম যে, কারো দাবী-দাওয়া ছাড়াই সাক্ষ্য গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। অবশ্য চোরের হাত কাটার হদ্দ জারী করার জন্য যার মাল চুরি করা হয়েছে তার পক্ষ থেকে চুরি যাওয়া মালের দাবী করতে হবে কি হবে না, এ ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আহমদ প্রমুখের মতে কোনো বাদী হয়ে দাবী ব্যতীত হদ্দ জারী করা যাবে না। কিন্তু অন্যান্য সকল ইমামের সর্বসম্মত মত হলো এই, যে ব্যক্তির মাল চুরি হয়েছে তার পক্ষ থেকে দাবী আসুক বা না আসুক ‘হদ্দ’ জারী করতে হবে। কোন কোন আলিম মালের দাবী করার শর্ত এ জন্যে আরোপ করেন, যেন চোরের চুরি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ না থাকে।
এসব হল সে চরিত্রের অপরাধ, যেগুলোতে হদ্দ জারী করা ওয়াজিব। চাই সে সম্ভ্রান্ত হোক অথবা নীচ বংশীয়, বৃহৎ দলের সদস্য হোক কিংবা দল ছাড়া, শক্তিশালী হোক অথবা দুর্বল, সবার ক্ষেত্রেই সমভাবে ‘হদ্দ’ জারী করা ফরয। এক্ষেত্রে কারো সুপারিশ হাদিয়া তোহফা উপহার-উপঢৌকন অথবা অন্য কোন কারণে ‘হদ্দ’ বাতিল করা কিছুতেই জায়েয নয়। প্রয়োগ শক্তি থাকা সত্ত্বেও হদ্দ বাতিলকারীর উপর আল্লাহ্, রাসূল, ফেরেশতা এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। মোটকথা, ‘হদ্দ’ জারী না করার কোন প্রকার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য নয়। বরং সুপারিশকারী ********আরবী (অর্থাৎ “বিচার বিভাগের যেই সংশ্লিষ্ট বিচারক অল্প দামে (অর্থাৎ বৈষয়িক স্বার্থে) আল্লাহ্র আয়াতসমূহ বিক্রয় করে”) ‘হদ্দ’ জারি থেকে বিরত থাকে সে আয়াতের আলোচ্য চরিত্রের লোকদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) এর সূত্রে আবু দাঊদ (রহ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সা) বলেছেন-
*********আরবী
“ যার সুপারিশ আল্লাহ্র কোন হদ্দের বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাড়াঁয়, সে যেন আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচরণ করলো। আর যে ব্যক্তি জ্ঞাতসারে মিথ্যা ও বাতিলের পক্ষে ঝগড়ায় অবতীর্ন হয় অথচ সে জানে যে এটা মিথ্যা, তাহলে ঝগড়া থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত সে ব্যাক্তি আল্লাহ্র অসন্তুষ্টিতে নিপতিত থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে এমন অপবাদ দিল বা দোষারোপ করল যার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে ব্যক্তি ‘রাদগাতুল খিবালে’ আটক থাকবে। সাহাবীগণ আরয করলেন হে রাসূলাল্লাহ, ‘রাদগাতুল খিবাল’ কি জিনিস? তিনি বললেন- জাহান্নামীদের দেহের গলিত রক্ত ও পুঁজ”। (আবু দাঊদ)
নবী করীম (সা) শাসনকর্তা, সাক্ষী এবং বিবাদকারীদের বিশেশভাবে উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, এরাই হল বিচারের মূল স্তম্ভ এবং এদের সততার উপরই সমাজে সংঘটিত বিভিন্ন বিরোধ-মামলা-মোকদ্দমার সঠিক ফয়সাল নির্ভরশীল।
হযরত আয়েশা (রা) সূত্রে সহীহ বুখারী-মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত সুপারিশ সম্পর্কিত ‘বনী মখযূম’ গোত্রীয় মহিলার ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। উক্ত মহিলা জনৈক ব্যক্তির মাল চুরি করেছিল। তার পক্ষে তদবীর করার জন্য কিছু লোক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে এ ব্যাপারে আলাপ করতে চাইল। তাদের মধ্য হতে কেউ বলল এমন সাহস কার যে, এ নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলবে? বলা হলো- এ ব্যাপারে আলাপ করা একমাত্র উসামা ইবনে যায়েদের (রা) পক্ষেই সম্ভব। সুতরাং তিনি সে মহিলার পক্ষ হয়ে নবী করীম (সা)-এর খিদমতে কথা পেশ করলে নবীজি বলেন-
********আরবী
“ তুমি কি আল্লাহ্ নির্ধারিত হদ্দের ব্যাপারে সুপারিশ করতে এসেছে? ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈল নিপাত হওয়ার একমাত্র কারণ হলো যে, তাদের শরীফ লোক চুরি করলে তাকে তারা ছেড়ে দিত। কিন্তু কোন দূর্বল লোক যদি চুরি করতো,তার উপর তারা ‘হদ্দ’ জারি করতো।সেই মহান সত্তার কসম যার ‘কব্জায়’ মুহাম্মদের প্রাণ;মুহাম্মদ তনয়া ফাতিমাও যদি চুরি করতো আমি তাঁর হাতও কেটে দিতাম।”(বুখারী ও মুসলিম)
এটা একটা মহাশিক্ষণীয় ঘটনা। কেননা কুরাইশ গোত্রের দু’টি শাখাই সম্ভ্রান্তরুপে খ্যাত ছিল। (১) বনী মখযূম এবং (২) বনী আবদে মান্নাফ। লক্ষণীয় যে,এই দিনে মখযূম গোত্রীয় মহিলা পর্যন্ত হাত কাটা থাকে নিস্তার পায় নি। অথচ কোন কোন আলিমের মতে ধার নেয়া সামান্য একটি জিনিসের বিনিময়ে হাত কাটা পড়েছিল,আসলে সেটা চুরিই ছিল না। অবশ্য কারো কারো মতে সেটা চুরি ছিল। কাজেই সেক্ষেত্রে অপরের বেলায় তো কোন প্রশ্নই উঠে না। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যায় ছিল তারা অধিক, অতি সম্ভ্রান্ত, তদুপরি মহানবী (সা)-এর প্রিয় খাদিম হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা) সুপারিশ করেছিল। এতসত্ত্বেও এ সুপারিশের ফলে তিনি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে উক্তি করেছিলেনঃ তুমি কি একটি হারাম ও নাজায়েয বিষয় নিয়ে সুপারিশ করতে এসেছো? এটা কি আল্লাহ্ নির্ধারিত হদ্দের ব্যাপারে অন্যায় সুপারিশ নয়? অতঃপর তিনি হযরত ফাতিমা (রা)-এর দৃষ্টান্ত পেশ করে এর গুরুত্ব ব্যক্ত করেন যে, এহেন গর্হিত কাজে অব্যাহতি ঘটতো না।
বর্ণিত আছে- হাত কাটা সে মহিলা তওবা করেছিলেন। অতঃপর সময় সময় নবী করীম (সা)-এর খিদমতে হাজির হলে, তিনি তাঁর অভাব পূরণ করে দিতেন।
আরো বর্ণিত আছে-
**********আরবী
“চোর নিষ্ঠাপূর্ণ তওবা করলে তার সে কর্তিত হাত তাকে বেহেশতে নিয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যদি সে তওবা না করে, তবে সে কর্তিত হাত তাকে জাহান্নামের পথে এগিয়ে নিবে”।
‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে ইমাম মালিক (রহ) রেওয়ায়েত করেছেন, একদল লোক জৈনক চোরকে পাকড়াও করে হযরত উসমান (রা)-এর দরবারে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে হযরত যুবায়ের (রা)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে, তাঁরা তাকে হযরত উসমান (রা)-এর নিকট সুপারিশের অনুরোধ জানায়। তিনি বললেনঃ “হদ্দ সম্পর্কিত মামলা খলীফার দরবারে দায়ের হয়ে যাওয়ার পর সুপারিশকারী এবং যার পক্ষে সুপারিশ করা হয়, এদের উভয়ের উপর আল্লাহ্র লা’নত বা অভিশাপ বর্ষিত হয়”।
হযরত সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া একবার মসজিদে শুয়ে আছেন। জনৈক চোর এসে তাঁর চাদরখানা নিয়ে রওয়ানা দেয়। তিনি তাকে পাকড়াও করে নবী (সা)-এর খিদমতে হাজির করেন। সাফওয়ান (রা) বললেন, আমার একটি মাত্র চাদরের বিনিময়ে এর হাত কাটা পড়বে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। হুযূর (সা) ইরশাদ করলেন-
*******আরবী
“ আমার নিকট উপস্থিত করার পূর্বেই তাকে ক্ষমা করনি কেন? অতঃপর তিনি তার হাত কাটার দণ্ড দিলেন”। (সুনান)
এ দ্বারা নবী করীম (সা)-এর উদ্দেশ্য ছিল, আমার নিকট উপস্থিত করার পূর্বে তোমার ক্ষমা করার সুযোগ ছিল, কিন্তু আমার আদালতে হাজির করার পর হদ্দ বাতিল কিছুতেই সম্ভব নয়। ক্ষমা সুপারিশ কিংবা অর্থ কোন প্রকারেই হদ্দ বাতিল করার ক্ষমতা কারো নেই। আমার জানামতে সর্বস্তরের আলিমগণের সর্বসম্মত ঐক্যমত অনুসারে চোর, ডাকাত, লুটেরা, হাইজাকার ইত্যাকার দুষ্কৃতকারীগণকে বিচারকের নিকট হাযির করার পর তাদের তওবা গ্রহণযোগ্য নয়, তওবা দ্বারা হদ্দের হুকুম রদ হয়ে যাবে না বরং হুকুম বহাল রেখে হদ্দ জারী করা ওয়াজিব। সত্যিই যদি তারা একান্ত নিষ্ঠার সাথে তওবা করে থাকে, তবে এ হদ্দ তাদের জন্য কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর এর উপর স্থির থাকা সম্ভব হলে তাদের তওবা আরো মজবুত ও শক্তিশালী হবে। আর এটা হকদারের হকের পূর্ণ কিসাস বা প্রতিশোধের সমপর্যায়ভুক্ত। মহান আল্লাহ্র এ বাণীতে এর মূল সূত্র লক্ষ্য করা যায়-
*********আরবী
“ যে ব্যক্তি কোন সৎ কাজে সুপারিশ করে, এর প্রতিদানে তার জন্যেও একটা অংশ নির্ধারিত থাকবে, পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন অসৎ কাজে সুপারিশ করবে, এর মন্দ ফলে সেও শরীক থাকবে। আল্লাহ্ পাক সর্ব বিষয়ে পূর্ণ দৃষ্টিমান”। (সূরা নিসাঃ ৮৫)
বস্তুতু সুপারিশের অর্থ হল সাহায্য সহায়তা প্রার্থনা করা। আরবীতে *****আরবী বা ****আরবী ‘দ্বি’ বা দুইকে বলা হয়, যার বিপরীতে বসে **আরবী তথা বেজোড় বা এক। সুতরাং ****আরবী (দুই) ****আরবী (একক) এর সাথে মিলিত হওয়াতে ‘এক’ যেন দুইয়ে পরিণত হল। কাজেই সৎ কাজে সাহায্য করা হলে এটা ******আরবী তথা ‘সৎ কাজে সুপারিশ’ হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু যদি অন্যায় অবিচারে শত্রুতা ও পাপাচারে সাহায্য করা হয়, এটা ****আরবী ‘অসৎ কাজে সুপারিশ’রুপে পরিগণিত হয়। বলাবাহুল্য, মানুষকে নেক ও সৎ কাজে সুপারিশের আদেশ করা হয়েছে আর অসৎ কাজে সুপারিশ দ্বারা সাহায্য করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন, ******আরবী কাজেই, কারো মিথ্যা কাজকর্মকে পুষ্টি সাধন করতে না দেয়াই হলো খোদাই বিধান। আল্লাহ্ বলেছেন- ******আরবী “বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তকে আল্লাহ্ কিছুতেই কার্যকর হতে দেবেন না”। (সূরা ইউসুফঃ ৫২)
মহান আল্লাহ্ আরো ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ এবং যমীনের বুকে বিপর্যয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, তাদের শাস্তি তো হলো, (রাষ্ট্রীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী) তাদের খুঁজে খুঁজে ধরে এনে বিচারের মাধ্যমে প্রাণদন্ড দেবে অথবা শূলীতে চড়াবে কিংবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কর্তন করে দেবে, কিংবা দেশ থেকে তাদের বহিস্কার করে দেবে, এগুলো হল তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা, আর পরকালে রয়েছে তাদের জন্য কঠিন আযাবের ব্যবস্থা। কিন্তু তোমাদের হাতে ধৃত হওয়ার পূর্বেই যদি তারা তওবা করে নেয়, (সঠিক পথে এসে সংশোধিত হয়ে যায়, ) তাদের কথা স্বতন্ত্র। তোমরা জেনে রেখো, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। (সূরা মায়েদাঃ ৩৩-৩৪)
আলোচ্য আয়াতে সেসব লোকদেরকেই উক্ত সাজা থেকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে, যারা ধৃত হয়ে বিচারকের আদলতে নীত হবার পূর্বেই নিষ্ঠার সাথে তওবা করে নেয়। তওবা অনুযায়ী কাজ করে। পক্ষান্তরে আদালতে হাজির করার পর যারা তওবা করবে, আলোচ্য আয়াতের মর্মানুযায়ী তাদের তওবা আইনগত গৃহীত হবে না এবং তাদের উপর হদ্দ জারী করা ওয়াজিব। বলাবাহুল্য, এ নির্দেশ তখনই কার্যকর হবে যখন সাক্ষী এবং উপযুক্ত দলীল প্রমাণ দ্বারা অপরাধ প্রমাণিত হবে অথবা অপরাধী নিজেই তার অপরাধের কথা স্বীকার করে এবং বিচারালয়ে নিজে উপস্থিত হয়ে অপরাধের স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু এরই সাথে সে যদি তওবাও করে নেয় তবে এ ক্ষেত্রে ইমামগণের মধ্যে দ্বিমত লক্ষ্য করা যায়, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-এর যাহেরী রেওয়ায়েত অনুযায়ী এমতাবস্থায় হদ্দ জারী করা যাবে না। কিন্তু সে নিজেই যদি নিজের উপর হদ্দ জারী করার আবেদন জানায়, তবে হদ্দ জারী করা হবে। আর সে যদি হদ্দ জারী করতে আগ্রহী না হয় এবং চলে যা, তবে হদ্দ জারী করা যাবে না। হযরত মাইয ইবনে মালিক (রহ)-এর হাদীস এর প্রতি ইঙ্গিতবহ। মাইযকে যখন রজম করা হয় তখন তাঁর অবস্থা কি ছিল তার বর্ণনা রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীগণের মুখে শোনার পর বলেছিলেন *****আরবী “তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে না কেন?” এছাড়া অন্যান্য হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, ধৃত অবস্থায় হাকিমের নিকট উপস্থিত করার পূর্বে তওবা করে থাকলে, তার উপর হদ্দ জারী করা যাবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর সূত্রে আবু দাউদ ও নাসাঈ (রহ) বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“পরস্পর একে অপরকে তোমরা ক্ষমা করে দাও। কেননা আমার সামনে মামলা দায়ের করা হলে হদ্দ জারী করা ওয়াজিব হয়ে পড়বে”।
হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস নাসাঈ ও ইবনে মাজায় উল্লেখিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
*******আরবী
“যমীনের বুকে হদ্দ জারী করা বিশ্ববাসীদের পক্ষে চল্লিশ দিনের প্রাতকালীন বৃষ্টি বর্ষণ অপেক্ষা অধিক কল্যাণময়”।
আর এটা এজন্য যে, গুনাহ দ্বারা রিযিকের মাত্রা হ্রাস পায় এবং অন্তরে শত্রুভীতি সঞ্চারিত হয়। কুরআন হাদীসের আলোকে এটা প্রমাণিত। বস্তুতঃ হদ্দ জারীতে আল্লাহ্র অবাধ্যতা হ্রাস পেয়ে অপরাধের মাত্রা কমে আসে। কাজেই পাপাচার হ্রাস পাওয়ার ফলে বান্দার রিযিক ও সুখ স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহ্র অফুরন্ত সাহায্য আসতে থাকে।
ব্যাভিচারী, মদখোর, চোর, ডাকাত ছিনতাইকারী কোন অপরাধপ্রবণের কাছ থেকেই অর্থ-সম্পদ নিয়ে হদ্দ রহিত করা, কোন অবস্থাতেই জায়েয নয়। ব্যক্তিগতভাবে কারও জন্যে কিংবা বাইতুল মালে জমা দেওয়ার নামে কোনো অবস্থায়ই এ টাকা গ্রহণ করা জায়েয নয়। হদ্দ রহিত কিংবা বাতিল করার উদ্দেশ্যে গৃহীত অর্থ সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ। বিচারক অথবা শাসক এরূপ কাজ করলে, সে যেন দুটো অবৈধ কাজের সমাবেশ ঘটালো। (১) হারাম অর্থের বিনিময়ে সে হদ্দ বাতিল করে দিল, (২) ওয়াজিব তরক করে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্র বাণী-
********আরবী
“তাদের (আহ্লে কিতাবদের) আলিম ও ধর্মীয় নেতাগণ তাদের অনুসারীদেরকে মিথ্যা বলা এবং হারাম মাল খাওয়া থেকে কেন নিষেধ করেনি? তাদের ধর্মীয় নেতা-বুযুর্গদের এহেন ক্ষমা ও উপেক্ষণীয় কার্যকলাপ কতই না নিন্দনীয় বিষয়”। (সূরা মায়েদাঃ ৬৩)
আল্লাহ্ তায়ালা ইহুদীদের অবস্থা ব্যক্ত করে বলেছেন- *******আরবী
“ তারা মিথ্যা কথার কাসুন্দী ঘেটে বেড়ায় আর হারাম অর্থের মৌজ করে”। (সূরা মায়েদাঃ ৪২)
কারণ, ইহুদীরা সুদ, ঘুষ ইত্যাদি দ্বারা হারাম ও অবৈধ পন্থায় অর্থোপার্জন করত। এমনকি ঘুষকে তারা ‘বরতল’ এবং ‘হাদিয়া’ বলতো।
সুতরাং হাকিম বিচারক হারাম মাল গ্রহণ করলে, মিথ্যা সাক্ষীও তাকে গ্রহণ করতে হবে। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“ঘুষখোর, ঘুশদাতা, আর দু’জনের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী সবাই সমপর্যয়ের গুনাগার”। (আহলে সুনান)
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে- দু’ব্যক্তি মহানবী (সা)-এর খিদমতে মামলা নিয়ে হাজির হলো। একজন বললো, হে রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ্র কিতাবানুসারে আমাদের মামলার ফয়সালা করে দিন, দ্বিতীয়জন একটু হুশিয়ার ছিল, সেও বললো! হাঁ, হে রাসূলুল্লাহ! মিমাংসা আল্লাহ্র কিতাবানুসারেই করা হোক কিন্ত আমি কিছু বলার অনুমতি চাই। হুযূর (সা) বললেন আচ্ছা বল। সে বলতে থাকে, আমার ছেলে এর বাড়িতে মজদুর হিসাবে কাজ করতো। কিন্তু ঘটনাক্রমে এর স্ত্রীর সাথে আমার ছেলে যিনায় লিপ্ত হয়। আর তার পক্ষে ফিদিয়া স্বরূপ আমি একশ (১০০) বকরী দান করেছি, তদুপরি একটি গোলামও আযাদ করেছি। অন্যদের নিকট মাসআলা জিজ্ঞেস করেই আমি এ ব্যবস্থা করেছি। হুযূর (সা) জবাব দিলেন, তোমার পুত্রকে একশত দোররা মারতে হবে এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন দিতে হবে। আর উক্ত মহিলার উপর রজমের হদ্দ জারী করতে হবে”। অতঃপর তিনি ইরশাদ করেন-
******আরবী
“সেই মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আল্লাহ্র বিধানের ভিত্তিতে আমি তোমাদের মামলা ফয়সালা করে দেব। সুতরাং খাদিম ও বকরী তুমি ফিরত নিয়ে যাও। তোমরা ছেলেকে একশ’ কোড়া লাগাতে হবে অধিকন্তু এক বছরের জন্য দেশ ত্যাগ করতে হবে। আর হে উনাইস! ভোর হতেই তুমি সে মহিলার নিকট গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস কর, যদি সে অপরাধ স্বীকার করে, তবে তাকে রজম করে দাও। এই নির্দেশানুযী তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে অপরাধ স্বীকার করে। সুতরাং ‘রজম’ তথা প্রস্তরাঘাতে তার প্রাণ দণ্ড দেওয়া হয়”।
লক্ষণীয় বিষয় যে, সাধারণ মুসলমান, গরীব মিসকীন এবং মুজাহিদগণের হাতে আগত সম্পদ তিনি গ্রহণ করতঃ ‘হদ্দ’ বাতিল করেন নাই। কাজেই আলিমগণের ইজমা তথা সর্বসম্মত ঐক্যমতে হদ্দের বিমিময়ে মাল গ্রহণ করা জায়েয নয়। অধিকন্তু এ ব্যাপারেও সবাই একমত যে, যিনাকার, চোর, মদখোর, রাষ্ট্রবিদ্রোহী, ডাকাত ইত্যাদির নিকট থেকে হদ্দ থেকে বাঁচার জন্যে গৃহীত মাল সম্পূর্ণ হারাম ও অপবিত্র। সাধারণতঃ অধিকাংশ লোকের আচার-আচরণ নৈতিকতা বিরোধী এবং চরিত্র হীনতার শিকার, অর্থ-বিত্ত ও মান-মর্যাদার দোহাই দিয়ে হদ্দের হুকুম বাতিল করে দিতে তৎপর। ফলে শহর-বন্দর, গ্রাম-পল্লী, ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, নেতা-সৈনিক এককথায় গোটা সমাজদেহ কলুষিত হয়ে পড়ে। উপরন্তু এ কারণেই ক্ষমতাশীন শাসক এবং বিচারকের মান মর্যাদা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। ঘুষ খেয়ে হদ্দ বাতিল করার কারণে তাদের আসন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একজনের হদ্দ বাতিল করা হলে অন্যজনের উপর হদ্দ জারী করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, মানসিক শক্তি হারিয়ে বসে।পরিণামে তারা ইহুদী নাসারাদের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে। যেমন হাদীসে আছে-
*******আরবী
“ঘুষ এক দ্বার দিয়ে পরবেশ করলে অপর দরজা দিয়ে আমানত বিশ্বস্ততা বের হয়ে যায়”।
‘তা’দীবাত’-এর নামে রাজত্ব ও কতৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখার উদ্দেশ্যে যে অর্থ আদায় করা হয় তা হারাম। এ পর্যায়ে সেসব এক রোখা গুন্ডা পান্ডা লোকদের আচরণ লক্ষণীয়, তারা নিজের জন্য কিংবা পরের স্বার্থে কোন অঘটন ঘটিয়ে দুষ্কর্ম করে শাসকদের নিকট টাকা-পয়সা, দ্রব্য-সামগ্রী নিয়ে হাজির হয়। এর ফলে এদের লোভ-লালসা, দুঃসাহস আরো বেড়ে যায়। এমনিভাবে তারা ঘুষের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সুনাম সুখ্যাতি ধূলিস্যাৎ করে দেয়। এক শ্রেণীর কৃষকের অবস্থাও তাই। আর (মদ্যপায়ী) শরাবীরতো কথাই নেই। কোন মদখোর ধরা পড়লে টাকা পয়সা দিয়ে রেহাই পেয়ে যায়। শরাবী (মদ্যপায়ী) মাত্রই ধারণা করে, ‘ধরা পড়লে টাকার জোরে মুক্তি পেয়েই যাব’। বলাবাহুল্য ঘুষের টাকা ও অবৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদে কোন বরকত থাকতে পারে না। বরং এতে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়েরই সৃষ্টি হয়। তদ্রূপ কোন বিত্তশালী ও সম্মানী লোক যদি তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায় এবং হদ্দের সাজা থেকে রক্ষা করে যেমন কোন কৃষক বা শ্রমিক অপরাধ করে বাদশাহ অথবা আমীর তথা রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের পিএ, সচিব বা কোনো প্রতিনিধির নিকট হাজির হল, আর সে আল্লাহ ও রাসূলের বিপক্ষে সাহায্যও সুপারিশ দ্বারা তাকে বাঁচিয়ে দিল। এ জাতীয় সাহায্য সুপারিশের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অভিসম্পাত বর্ষিত হয়েছে। হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা)-এর সূত্রে ইমাম মুসলিম (রহ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“ যেসব ব্যক্তি কোন বিদআত সৃষ্টি করে অথবা কোন অপরাধীকে আশ্রয় দেয়, তাদের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের লা’নত বর্ষিত হয়”। (শরীয়তে মনগড়া কোনো নীতি নিয়মের উদ্ভাবনের নাম হচ্ছে বিদআত।) মহানবী (সা) আরো ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“যদি কারো সুপারিশ আল্লাহর কোন হদ্দের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তবে, মূলতঃ এটা আল্লাহ্র নির্দেশ অকার্যকর করার চেষ্টারই নামান্তর”। (মুসলিম)
কাজেই যাদের হাতে হদ্দ কায়েম করার ক্ষমতা ও দায়িত্ব ন্যস্ত, তারা যদি অর্থের বিনিময়ে অপরাধীকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেয়; তাহলে এটা যে কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা সহজেই অনুমেয়। কারো প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়ে কিংবা ঘুষের সীমা অতিক্রমকারীদের সাহায্য করলো। দ্বিতীয়তঃ যে মালের বিনিময়ে ছাড়া হচ্ছে, সেটা হয়তো বাইতুল মালের সম্পদ অথবা শাসন কর্তার। আর ঘুষ কখনো প্রকাশ্যে গ্রহণ করা হয়, কখনো গোপনে, উভয় অবস্থাতেই ঘুষ নিষিদ্ধ ও হারাম। এটিই ইসলামী আইনজ্ঞদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। যেমন কোন মদের দোকানির যামিন হওয়া, নিজের এর জন্য জায়গা দেয়া কিংবা অন্যত্র জায়গায় বন্দোবস্ত করে দেয়া, অথবা অন্য কোন প্রকারে এর সহায়তা করা কিংবা ঘুষ খেয়ে এর অনুমতি দেয়া এসবই একই শ্রেণীর অপরাধ, জোরপূর্বক যিনার ব্যবস্থা করে বিনিময়ে গ্রহণ, গণককে গণনার জন্যে অর্থ প্রদান, কুকুর বিক্রি করে মূল্য গ্রহণ, এসবই যেমন হারাম, ঘুষও তেমনি হারাম। ঘুষ এখানে হারাম আচরণের উদ্দেশ্যে দালালীর পর্যায়ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“ কুকুরের মূল্য অপবিত্র, যিনার বিনিময় অপবিত্র এবং গনকের পারিশ্রমিক অপবিত্র”। (বুখারী)
যিনার বিনিময় ও পারিশ্রমিক, পতিতা নারীর পারিশ্রমিক সম্পূর্ণ হারাম। হিজ্ড়া, কিব্ল চাই গোলাম হোক চাই আযাদ, এদের সাথে কুকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি ও গনক এদের হুকুমও একই। এসব হারাম কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করাও সম্পূর্ণ হারাম।
যে বিচারপতি ও শাসক অপরাধ ও অসৎ কাজ দমন করবে না, হদ্দ জারী করবে না, বরং অর্থের বিনিময়ে অপরাধীকে ছেড়ে দেবে, তাদের অবস্থা হারামকারী ও চোরের সরদারের ন্যায়। তারা অশ্লীলতা ও ব্যভিচারে লিপ্ত দালালের অনুরুপ। যে যিনাকারদের সহায়তা করার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করে থাকে, ঘুষখোররা তারই সমপর্যায়ে। উপরন্তু তাদের অবস্থা হযরত ‘লূত’ (আ)-এর বৃদ্ধা স্ত্রীর ন্যায়, যে সমকামী পাপিষ্ঠদেরকে লূত (আ)-এর বালকবেশী ফেরেশতা মেহমানদের উপস্থিতির খবর দিয়েছিল। যার সম্পর্কে মহান আল্লাহ্র উক্তি হলো-
*********আরবী
“ অতএব আমি লূত এবং তাঁর পরিবার-পরিজনকে নাজাত দিলাম কিন্ত তার স্ত্রী, যে পশ্চাৎগামীদের অন্তর্ভুক্ত রইল (তাকে মুক্তি দেইনি)”। (সূরা আরাফঃ ৮৩)
কুরআনে লূত (আ)-কে লক্ষ্য করে আরো বলা হয়েছে-
*******আরবি
“তুমি নিজ পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতের এক অংশে (শেষ ভাগে) যাত্রা কর, কিন্তু তোমাদের কেউ যেন কোনো দিকে ফিরেও না তাকায়, অবশ্য তোমার স্ত্রী না তাকিয়ে ছাড়বে না। কাজেই এর উপরও একই আযাব আপতিত হবে যা ঐ পাপিষ্ঠদের উপর পতিত হবে”। (সূরা হূদঃ ৮১)
সুতরাং আল্লাহ পাক সে দালাল বৃদ্ধাকে একই আযাবের আওতাভুক্ত করেন, যা পাপাচারী সম্প্রদায়ের উপর নাযিল করেছিলেন। কেননা এসবই হলো সীমালংঘনের অন্তর্ভুক্ত। আর এর জন্য অর্থ গ্রহণ করা অন্যায় সহযোগিতার শামিল। কোন ব্যক্তিকে শাসন ক্ষমতায় এ জন্যই বসানো হয়, সে যেন সৎ কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধের দায়িত্ব যথাযথ পালন করে। শাসন কার্যের মূল উদ্দেশ্য এটাই। সুতরাং খোদ্ শাসক কর্তৃক অর্থ-সম্পদ নিয়ে, ঘুষ খেয়ে সমাজে কোন অসৎ কার্য প্রচার-প্রসারের সুযোগ করে দেয়াটা মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি। এটি এমন যে, কাউকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠানো হলো, আর সেখানে পৌঁছে সে মালিকের বিপক্ষে দুশমনেরই সাহায্যে লেগে গেল। এর আরেকটি উদাহরণ হলো, মাল দেওয়া হয়েছে জিহাদের জন্য কিন্তু বাস্তবে তা ব্যয় করা হচ্ছে মুসলমানদের নিধন করার কাজে।
ভিন্ন অর্থে এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, সৎ ও সঠিক কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের ফলশ্রুতিতেই মানব কল্যাণ সাধিত হয়। কেননা, মানব জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের নিরাপত্তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যেই নিহিত। এ আনুগত্যে মূলতঃ পূর্ণতা লাভ করতে পারে একমাত্র সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মাধ্যমেই। এর ভিত্তিতেই মুসলিম জাতিকে “খায়রা উম্মাহ্” তথা ‘উত্তম জাতি’রুপে ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ তাদেরকে বিশ্ব মানবের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
*******আরবী
“তোমরাই উত্তম জাতি। তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে এজন্য যে, তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের দ্বারা মানব জাতির কল্যাণ সাধন করবে”। (সূরা আলে ইমরানঃ ১১০)
আরো বলা হয়েছে –
*********আরবী
“তোমাদের মধ্য হতে এমন এক দল লোক প্রস্তুত হওয়া দরকার, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ করবে আর মন্দ-গর্হিত কাজে নিষেধ করবে”। (সূরা আলে ইমরানঃ ১০৪)
বনী ইসরাইলের অবস্থা বর্ণনায় বলা হয়েছে-
*********আরবী
“ যে গর্হিত কাজে তারা লিপ্ত ছিল, তা থেকে তারা বিরত থাকত না, অবশ্যই সেগুলো ছিল অতি নিন্দনীয় কাজ, যা তারা করত”। (সূরা মায়েদাঃ ৭৯)
মহান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“সুতরাং অবাধ্যরা তাদের প্রতি কৃত আদেশ উপদেশ ভুলে গেলে, তাদের মধ্য থেকে যারা মন্দ কাজে নিষেধ করত তাদেরকে আমি রক্ষা করেছি, কিন্তু পাপাচারীদেরকে আমি তাদের মন্দ কাজের পরিণামে কঠিন শাস্তিতে নিপতিত করেছি”। (সূরা আরাফঃ ১৬৫)
অত্র আয়াতে আযাব থেকে সেসব লোকদের পরিত্রান লাভের কথা বলা হয়েছে, যারা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকত আর আল্লাহ পাক পাপাচারীদের কঠিন আযাবে নিপতিত করেছেন।
হযরত সাবিত (রা) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) একবার মিম্বরে নববীতে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, মুসলমানগণ! তোমরা এ আয়াত পাঠ কর কিন্ত একে ভুল অর্থে প্রয়োগ করে থাকঃ
**********আরবী
“ হে মুমিনগণ! তোমরা নিজের কল্যাণ চিন্তা কর। তোমরা নিজেরা যদি হিদায়াতের উপর দৃঢ় থাক তবে কারো, পথহারা হওয়াতে তোমাদের কোনই ক্ষতি নেই”। (সূরা মায়েদাঃ ১০৫)
নবী করীম (সা)-কে আমি বলতে শুনেছি-
******আরবী
“ মানুষ যখন মন্দ কাজ দেখেও তা সংশোধনের ব্যবস্থা করে না, তাই অতিসত্বর তাদের উপর ব্যাপকভাবে আল্লাহ্র আযাব পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে”। অন্য এক হাদীসে আছে-
“গোপনে কৃত গুনাহর ক্ষতি কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট গুনাহগারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু যদি তা প্রকাশ্যে করা হয় এবং সংশোধনের ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাতে সাধারণ লোকেরা পর্যন্ত এ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একই বিষয়বস্তু ‘হদূদে এলাহী এবং হুকুকুল্লাহ’র অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ।
বস্তুতঃ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, সত্যবাদিতা, আমানদারী, পিতা মাতার সঙ্গে সদাচরণ, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা, পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীদের সাথে সদব্যবহার ইত্যাদি সৎকর্মসমূহ ‘আমর বিল মা’রুফ’ তথা সৎ কাজের আদেশের অন্তর্ভুক্ত। শাসনকর্তা এবং হাকিম ও প্রশাসন যন্ত্রের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হলো, নিজেদের অধীনস্থ ব্যক্তিদেরকে নামাযের হুকুম করা এবং নামায তরককারীকে শাস্তি দেয়া। এ ব্যাপারে সকল মুসলিম আইন বিশেষজ্ঞ একমত।
দ্বিতীয় সর্বসম্মত ঐক্যমত হলো (মুসলিম পরিচয়ের) বেনামাযী সংঘবদ্ধ দল যারা নামায অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা কর্তব্য। অনুরূপভাবে যাকাত, রোযা বর্জনকারীর বিরুদ্ধেও জিহাদ করার বিধান রয়েছে। হারামের বিরুদ্ধেও জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। যেমন, শরীয়ত নিষিদ্ধ রমণীকে বিবাহ করা এবং সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ইত্যাদির বিরুদ্ধে জিহাদ করাও ফরয। শরীয়তের প্রকাশ্য ও দ্ব্যর্থহীন হুকুমকে অস্বীকারকারী দলের বিরুদ্ধে জিহাদ করাও ফরয, যতক্ষণ না আল্লাহ্র দ্বীন বিজয়ী হয়। এ ব্যাপারে ‘ইসলামী আইনবিদগণ পূর্ণ একমত।
বেনামাযী যদি একক ব্যক্তি হয় তবে বলা হয়েছে তাকে প্রহার করতে হবে, সাজা দিতে হবে এবং নামাযের পাবন্দ না হওয়া পর্যন্ত বন্দী করে রাখতে হবে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, নামায অস্বীকার করলে সরকার তাকে মৃত্যুদন্ড দিবে। অবশ্য এর নিয়ম হল-প্রথমে তাকে তওবা করে নামায শুরু করার নির্দেশ দিতে হবে। যদি সে তওবা করে নামায আরম্ভ করে, তবে তো সেটা উত্তম। অন্যথায় (অর্থাৎ মুরতাদ হয়ে তা) অস্বীকারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এ মৃত্যুদণ্ড কিসের ভিত্তিতে? নামাজ ছাড়াতে সে কাফির হয়ে গিয়েছিল সে কারণে, না কি ফাসেক হওয়ার কারণে? এ ব্যাপারে দু’ধরনের মত রয়েছে। অধিকাংশ ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞের মতে (মুসলিম থেকে) কাফির হয়ে যাওয়া মৃত্যুদণ্ড দানের কারণ। এ মতভেদ তখন যদি নামায ‘ফরজ হওয়া’ তো স্বীকার করে কিন্তু বাস্তবে আমল করে না, কিন্তু যদি নামায ফরজ হওয়াটাই অস্বীকার করে, তবে সর্বসম্মতভাবে এ অস্বীকৃতির কারণে সে কাফির (মুরতাদ) হয়ে যাবে। অন্যান্য সব ফরজ-ওয়াজিব ও হারামের হুকুমও অনুরূপ। অস্বীকৃতির দরুন যার বিপরীত আমল করায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দান অপরিহার্য। এ পরিস্থিতিতে সাজার মূল কারণ হলো ফরজিয়াত বর্জন করা এবং হারামসমূহে লিপ্ত হওয়া। সবার ঐক্যমতে (এরূপ অবাধ্য সংঘবদ্ধ দলের বিরুদ্ধে) উম্মতে মুসলিমার উপর জিহাদ করা ওয়াজিব। কুরআন-হাদীসে এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। আর জিহাদ হলো বান্দার উৎকৃষ্ট আমল। একবার মহানবী (সা)-এর নিকট কেউ এ মর্মে আবেদন করে যে-
*************আরবী
“ হে রাসূলুল্লাহ (সা), আল্লাহ্র পথে জিহাদের সমতুল্য অন্য কোনো আমলের কথা ইরশাদ করুন। তিনি বললেনঃ এ ধরনের আমল করা তোমরা পক্ষে সম্ভব নয়”। সে বললঃ “আমাকে বলে দিন”। হুযূর (সা) বললেনঃ “মুজাহিদ দল আল্লাহ্র পথে রওয়ানার সময় থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে একাধানে রোযা রাখবে, কখনো ইফতার করবে না। আর তুমি রাতব্যাপী নামায পড়বে কখনো ছাড়বে না, এটা কি তোমার পক্ষে সম্ভব? তিনি বললেনঃ এমনটি কার সাধ্যে কুলাবে? অতঃপর তিনি বললেনঃ এ আমলই আল্লাহ্র পথে জিহাদের সমান হতে পারে”। (বুখারী ও মুসলিম)
তিনি আরো ফরমান –
**********আরবী
“জান্নাতে একশ’টি স্তর রয়েছে। এক স্তর থেকে অপর স্তরের ব্যবধান আকাশ পাতাল পরিমাণ। এ বিশাল জান্নাত আল্লাহ পাক তাঁর রাস্তায় জিহাদকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন”। (বুখারী ও মুসলিম)
অধিকন্তু তিনি আরো বলেছেন-
*********আরবী
“ ইসলাম (অর্থাৎ আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণই ) হচ্ছে সকল কাজের মূল। আর নামায এর স্তম্ভ। আর জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ সর্বোৎকৃষ্ট”।
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন-
**********আরবী
“ নিষ্ঠাবান মুমিন একমাত্র তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে। অতঃপর কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করে না এবং জান মাল দিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে, প্রকৃতপক্ষে এরাই যথার্থ সত্যবাদী”। (সূরা হুজরাতঃ ১৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেছেন-
********আরবী
“তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো আর ‘মসজিদুল হারাম’ আবাদ রাখাকে সে ব্যক্তির কাজের সমতুল্য ধরে নিয়েছো, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, তদুপরি আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ করে? (জেনে রেখো মর্যাদায়) আল্লাহ্র নিকট এরা সমপর্যায়ের নয়, আর আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সরল পথ দেখান না। যারা ঈমান আনে, হিজরত করে এবং জান-মাল দিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে, আল্লাহ্র নিকট তারা উচ্চ মর্যাদার অধিকারী আর এরাই সফলকাম। তাদের পালকর্তা তাদেরকে নিজ অনুগ্রহ, সন্তুষ্টি এবং জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছেন, যেখানে তারা চিরন্তন সুখে অনন্ত জীবন যাপন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট সওয়াব ও প্রতিদানের অফুরন্ত ভান্ডার মওজুদ রয়েছে”। (সূরা তওবাঃ ১৯-২২)
[এগার]
ডাকাত-ছিনতাইকারীদের সাজা এবং যুদ্ধকালীন
সময় সামরিক বাহিনীর যেসব কাজ নিষিদ্ধ
ডাকাত-ছিনতাইকারী ও লুণ্ঠনকারীদের সাজা। কাউকে জিহাদে প্রেরণকালে নবী করীম (সা) নসীহত করতেনঃ দুশমনের সাথে লড়াই করবে। কিন্তু সীমা অতিক্রম করবে না। নিজের ওয়াদা ও অঙ্গীকার পূর্ণ করবে, শত্রু পক্ষের কারও কান, নাক কেটে ‘মুছলা’ করবে না। ছোট শিশুদের হত্যা করবে না, নিজ হাতিয়ারসহ যে ব্যক্তি স্বগৃহে নিস্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে, এমন লোকদেরকে হত্যা করবে না। যদি কাফিররা মুসলমানদের ‘মুছলা’ করে তবে মুসলমানদের জন্যেও আগ্রাসীদের সাথে অনুরূপ করার অনুমতি রয়েছে কিন্ত না করাই উত্তম।
ডাকাত, পথিক প্রবাসীদের মালামাল লুণ্ঠন ও ছিনতাইকারী চাই সে পল্লীবাসী গ্রাম্য হোক চাই শহুরে, কৃষক কিংবা চরিত্রহীন সিপাহী, শহুরে যুবক হোক অথবা অন্য কেউ- এদের শাস্তি সম্পর্কে কুরআনের ভাষ্য হলো-
**********আরবী
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং দুনিয়ায় ধ্বাংসাত্মক সন্ত্রাসী কার্য করে বেড়ায়, ইসলামী আদালতে তাদের শাস্তি হলো, তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেবে অথবা শূলে চড়ানো হবে, কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত পা কেটে ফেলা হবে অথবা দেশান্তরিত করা হবে। এটা হল তাদের দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর পরকালে রয়েছে তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি”। (সূরা মায়েদাঃ৩৩)
ডাকাত ও লুটেরা সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেনঃ ইমাম শাফিঈ (রহ) তাঁর সুনান গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন-
************আরবী
“তারা যদি হত্যাসহ মালামাল লুট করে, তবে শাস্তিস্বরূপ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেবে এবং শূলে চড়ানো হবে। আর যদি শুধু হত্যাই করে মালামাল লুট না করে, তাহলে মৃত্যুদণ্ড দেবে, শূলে চড়াতে হবে না। কিন্তু যদি শুধু মালপত্রই নিয়ে যায়, হত্যা করে নাই এমতাবস্থায় বিপরীতভাবে তাদের হাত পা কাটতে হবে। আর যদি মালামাল না নিয়ে কেবল ভীতিপ্রদর্শন করে, তবে তাদেরকে দেশান্তরিত করতে হবে”।
ইমাম শাফিঈ (রহ) ইমাম আহমদ (রহ) সহ অধিকাংশ ইসলামী আইনবিদদের রায় এটাই। অধিকন্তু এ মতটি ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর অভিমতের প্রায় কাছাকাছি।
এদের মধ্যে কোন কোন লোক এমনও হবে যাদের ব্যাপারে প্রধান বিচারক ও আমীরকে ইজতিহাদ করতে হবে এবং বিশেষ বিবেচনা করতে হবে। হত্যা করা বা না করা উভয় অবস্থায় কল্যাণকর দিক সামনে রাখতে হবে। (অপরাধের চরিত্র ও পরিস্থিতি বুঝে) মৃত্যুদণ্ড বা অন্য দন্ড প্রদান করবে।
আর যদিও তারা টাকা কড়ি নেয় নাই, কিন্তু শক্তিশালী ও সাহসী, ইচ্ছা করলে ছিনিয়ে নেয়ার শক্তি তাদের ছিল, এদেরও একই হুকুম। কারো মতে তারা যদি সম্পদ লুট করে তবে তাদের হাত কাটার দণ্ড দেবে শূলে চড়াতে হবে না। অধিকাংশ আলিম প্রথম মত সমর্থনকারী।
কোন ব্যক্তি যদি ডাকাতি করে, সেই সাথে হত্যাও করে এমতাবস্থায় ইমাম, আমীর, বিচারপতি বা হাকিম তার উপর হদ্দ জারী করবেন, মৃত্যুদণ্ড দিবেন। এমন লোককে ক্ষমা করা কোন অবস্থাতেই জায়েয নয়। ইবনুল মুনযিরের মতে, এর উপর ‘ইজমা’ তথা সর্বসম্মত ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণের মতামতের উপর এটা নির্ভরশীল নয়।
পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি পারস্পরিক শত্রুতা, দুশমনী অথবা কোন কারণে কাউকে হত্যা করে, এ ক্ষেত্রে তাকে প্রাণদণ্ড দান, ক্ষমা করা কিংবা রক্তমূল্য গ্রহণের অধিকার নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণের রয়েছে। কেননা বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষ কারণে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
ফকীহ তথা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞগণের ঐক্যমত্য হলো, ডাকাতদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কেননা, এরা মালামাল লুণ্ঠন ও ছিনতাই করেছে। আর চোরের ন্যায় তারাও সমাজের জন্যে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। তাই হদ্দের ভিত্তিতে তাদেরকে প্রাণদণ্ড দিতে হবে।
নিহত ব্যক্তি যদি হত্যকারীর ‘কুফূ’ তথা সমপর্যায়ের না হয় যেমন হত্যাকারী ‘আযাদ’ কিন্তু নিহত ব্যক্তি ভৃত্য বা দাস, হত্যাকারী মুসলমান আর নিহত ব্যক্তি অমুসলিম যিম্মী-অথবা মুসতামান (রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রাপ্ত), এমতাবস্থায় ঘাতক হওয়ার কারণে ‘প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ’- নীতির ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দান অনিবার্য কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে প্রাণদণ্ড দানের পক্ষেই শক্তিশালী মত পরিলক্ষিত হয়। কেননা ব্যাপক বিপর্যয়ের আশংকায় হদ্দের ভিত্তিতে এহেন অপরাধীকে প্রাণদন্ড দানই সমাজের জন্যে কল্যাণকর। যেমন মালামাল লুণ্ঠন বা ছিনতাইর কারণে হাত কাটা হয় এবং অপরের অধিকার বিনষ্ট করার দায়ে কারাদন্ড দেয়া হয়।
প্রতিপক্ষ লড়াইকারী সংঘবদ্ধ দলটি যদি হারমাদ ও চোর চোট্টা ধরনের হয় আর তাদের মধ্য হতে মাত্র একজন হত্যাকাণ্ড ঘটায়, অবশিষ্টরা হয় তার সহযোগী, এমতাবস্থায় বলা হয়েছে, কেবল হত্যাকারীকেই প্রাণদণ্ড দিতে হবে। ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ অধিকাংশের মতে সংখ্যায় তারা যত বেশী হোক না কেন, তাদের সবাইকে হত্যা করতে হবে। খুলাফায়ে রাশেদীনের পক্ষ থেকেও একই মত বর্ণিত হয়েছে। হযরত উমর (রা) শত্রুপক্ষের সহযোগী পর্যবেক্ষণকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ছিলেন। সে একটি উচ্চস্থানে বসে মুসলমানদের গতিবিধি লক্ষ্য করত এবং কাফিরদের নিকট তথ্য সরবরাহে লিপ্ত ছিল। কারণ, এ ধরনের লোকদের দেয়া তথ্য এবং সাহায্য পেয়েই হত্যাকারী হত্যাকাণ্ডে সফল হয়ে থাকে। কাজেই সওয়াব ও শাস্তির বেলায় এরা সম-অংশীদার। যেমন, মুজাহিদগণ সওয়াব ও গণীমতের মালে সবাই সমান অংশীদার হয়ে থাকে। মহানবী (সা) বলেছেন-
**********আরবী
“মুসলমানের রক্ত সব সমমানের, তাদের একজন নগণ্য ব্যক্তির দায় দায়িত্বও পূর্ণ করা হবে। প্রতিপক্ষের তুলনায় এরা একক বাহুতুল্য। আর মুসলমানগণ কর্তৃক প্রেরিত ক্ষুদ্র বাহিনী যুদ্ধ জয়ের পর গণীমতের মাল প্রেরণ করলে তাতে প্রেরণকারী পশ্চাদবর্তী লোকরাও সম-অংশীদার হয়”।
এর সারমর্ম হলো, বিরাট মুসলিম বাহিনী কর্তৃক মুষ্ঠিমেয় সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনী যদি কোথাও প্রেরিত হয়, তবে যুদ্ধ জয়ের পর তাদের অর্জিত গনীমতের মাল প্রেরণকারী পশ্চাদবর্তী গোটা বাহিনীসহ সবাই সমভাবে অংশীদার হবে। কেননা তাদের বলে এবং সহযোগিতায়ই এদের পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য ক্ষুদ্র বাহিনীভুক্ত সৈন্যদেরকে হারাহারি অংশের বাইরে অতিরিক্ত কিছু দান করাটা স্বতন্ত্র কথা। মহানবী (সা) ও “সারিয়্যা” যুদ্ধে ( যে যুদ্ধে হযরত সা. স্বয়ং শরীক হননি) তথা ক্ষুদ্র বাহিনীকে অতিরিক্ত দান করেছেন। প্রথমতঃ তিনি ‘খুমুস’ (এক পঞ্চমাংশ)- এর পরে এক চতুর্থাংশ দিয়েছেন। অতঃপর লোকেরা দেশে ফিরে এলাকা থেকে ‘সারিয়্যা’ প্রেরণ করলে, খুমুসের স্থানে তাদেরকে ছুলূছ অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে সেনাবাহিনী যদি গনীমতের মাল হাসিল করে, তবে সারিয়্যাকেও তাতে শামিল করে নেয়া উচিত! কেননা সারিয়্যাও মুসলমানদেরই সেনাদল। বিশেষ প্রয়োজনে তাদেরকে পাঠানো হয়েছিল। বদর যুদ্ধে যেমন হযরত তালহা (রা) ও হযরত যুবায়ের (রা) কে দেয়া হয়েছিল। কারণ, জাতির কল্যাণে এবং সামরিক প্রয়োজনেই তাঁরা প্রেরিত হয়েছিলেন। কাজেই সাহায্যকারী হিসাবে অন্যান্যদের ন্যায় তারাও সমভাবে এর সুফল ভোগ করার অধিকারী।
বাতিল ও মিথ্যা যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের অবস্থাও একই, যেমন আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, গোত্রীয় দলাদলি এবং জাহিলী যুগের মূর্খতাসুলভ বিষয়কেন্দ্রিক পরস্পর যুদ্ধে অনেকে লিপ্ত হয়ে পড়তো। যেমন ‘কয়েস’ এবং ‘য়ামনী’ গোত্র দু’টি অন্যায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। আর এতে তারা উভয়ই ছিল বাতিলপন্থী। মহানবী (সা) বলেছেন- ******* (আরবী) তলোয়ার নিয়ে দুই মুসলমান যদি পরস্পর খুনাখুনিতে লিপ্ত হয় এমতাবস্থায় হত্যাকারী ও নিহত উভয়েই জাহান্নামী হবে”। ( বুখারী ও মুসলিম)
এতে উভয়পক্ষেই একে অপরকে মনে প্রাণে ধ্বংস করতে প্রয়াস চালিয়েছে। হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি যদিও জানতে না যে, কে মারবে কে মরবে। উভয়পক্কই সাধ্য অনুযায়ী আত্মরক্ষায় সচেষ্ট ছিল; কিন্তু এরি মধ্যে একজন নিহত হয়ে যায়।
কিন্তু যদি হত্যা না করে শুধু ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে, যা (জাহিলী যুগের) আরবদের অধিকাংশের অভ্যাস ছিল, তাহলে প্রত্যেকের ডান হাত বাম পা কেটে দিতে হবে। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ প্রমুখসহ অধিকাংশ ইমাম এ মতের সমর্থনকারী। আর এর পক্ষে কুরআনেরও সমর্থন রয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-********আরবী
“অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত পা কেটে দিতে হবে”। (সূরা মায়েদাঃ ৩৩)
কারণ, হাতের সাহায্যে সে লুণ্ঠন কার্য সম্পন্ন করতো, পায়ের সাহায্যে সে পথে অগ্রসর হতো, তাই (সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও এই অপরাধ প্রবণতা সম্পূর্ণ নির্মূল করার স্বার্থে) এ দুটো অঙ্গ কাটার দণ্ড দিতে হবে। অতঃপর রক্ত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ফুটন্ত যাইতুনের তেল বা অন্য উপায়ে দাগ দিতে হবে।* (টীকা- বর্তমানে রক্ত বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হয়ে থাকে। এ উদ্দেশ্যে তৎকালীন সময় যাইতুনের তেল দ্বারা দাগ দেয়া হত।) যাতে প্রাণে মারা না যায়। চোরের হাতও সে একই নিয়মে কাটতে হবে।
এভাবে হাত পা কাটার মধ্যে প্রাণদণ্ড অপেক্ষা সর্বাধিক ভীতিপ্রদ শাস্তি ও শাসন নিহিত রয়েছে। কেননা সমাজে চলা ফেরার সময় তার প্রতি দৃষ্টি পড়তেই পরস্পরের মধ্যে চর্চা হয়ে থাকে যে, এটা অমুক অপরাধের পরিণতি। তাতে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। কুরআনে বলা হয়েছে- **********আরবী “হে জ্ঞানবানরা! ‘কিসাস’ তথা জানের বদলা জান, হাতের বদলা হাত এভাবে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বদলা অনুরূপ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বদলার শাস্তির মধ্যে রয়েছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। এছাড়া প্রাণদণ্ডের পরিণতি অল্প দিনেই মানুষ ভুলে যেতে পারে। এজন্য কোন কোন লোক হাত পা কাটা পড়ার পরিবর্তে নিহত হওয়া বা মরে যাওয়াকেই অধিক পছন্দ করে থাকে। কাজেই বলা যায়, চোরের এ সাজা সত্যি বড় কার্যকর ও বড় শিক্ষণীয়।
অস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিরা অস্ত্র উন্মুক্ত করেছিল কিন্তু কাউকে আঘাত করেনি, সম্পদ লুণ্ঠন করেনি, বরং তলোয়ার কোষবদ্ধ করে ফেলে অথবা পালিয়ে যায় কিংবা লুটপাট ও সংঘর্ষ এড়িয়ে যায়। এমতাবস্থায় এদেরকে দেশান্তরিত করতে হবে। নির্বাসনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তারা যেন কোন শহর বন্দর নগরের উপকণ্ঠে কিংবা কন বস্তীতে দলবদ্ধভাবে একত্রিত হতে না পারে। আবার নির্বাসনের অর্থ কারো কারো মতে তাদেরকে কারারুদ্ধ করে রাখা। এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে কেউ বলেছেন, ইমাম আমীর বা হাকিম তথা রাষ্ট্রীয় ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষই তা ঠিক করবেন, নির্বাসন, কারারুদ্ধ অথবা অন্য কোন্ পন্থা সঠিক হবে, যেটা জাতির জন্য কল্যাণকর। দেশান্তর বা নির্বাসনের এটাই অর্থ।
শরীয়তের আইনে প্রমাণিত অপরাধীর প্রাণদণ্ড কার্যকর করার নিয়ম হলো তরবারি কিংবা অন্য কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা অপরাধীর প্রাণদণ্ড দান, যা সহজ পন্থা। মানুষের প্রাণদণ্ড এবং জীব জন্তু বধ করার খোদাই বিধান এটাই। সুতরাং মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন, ********আরবী
“ আল্লাহ সকল জীবের প্রতি অনুগ্রহ ও দয়া করা ‘ফরয’ করেছেন। (রাষ্ট্রীয় বিচারে) তোমরা (প্রমাণিত অপরাধী) কে মৃত্যুদণ্ড দান উত্তম পন্থায় তা কর, কোন প্রাণী জবাই করতে উত্তম নিয়মে জবাই কর। নিজেদের ছুরি চাকু শাণিত করে নিবে যাতে জবাইকৃত জীব দ্রুত শান্ত হয়”। (মুসলিম)
তিনি আরো বলেছেন- *******আরবী “ঈমানদারগণই অপরাধীর প্রাণদণ্ড দানে অধিকতর শান্তিদায়ক”। (নিষ্ঠুরতামুক্ত) শূলে চড়ানোর নিয়ম হল উচ্চস্থানে লটকাতে হবে। যেন মানুষ প্রকাশ্যে দেখাতে পায় এবং ব্যাপক হারে প্রচার হয়। ‘জমহূর’ (সর্বস্তরের) ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর তাকে এভাবেই লটকাতে হবে। কারও কারও মতে অপরাধীকে শূলে চড়িয়ে প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে হবে।
কোন কোন আইনজ্ঞ আলিম তরবারি ছাড়া আরও অন্য উপায়েও প্রাণদণ্ড কার্যকর করা জায়েয মনে করেন। হত্যাকৃত ব্যক্তির নাক কান কেটে ‘মুছলা’ করা আদৌ জায়েয নহে। অবশ্য মুসলমানদের সাথে তারা অনুরূপ আচরণ করলে, তারাও তাই করত। তবে এরূপ না করাটাই উত্তম মনে করা হতো। যেমন, মহান আল্লাহ ঈমানদারদের বলেন,
*********আরবী
“শত্রুদের সাথে কঠোরভাবে প্রয়োজন হলে সে পরিমাণ কঠোরতাই কর, যে পরিমাণ তোমাদের সাথে করা হয়েছে। আর যদি তোমরা ধৈর্য্য ধর, তবে ধৈর্য্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম। আর হে নবী ! আপনি সবর করুন, অবশ্য আল্লাহ্র তৌফিক ব্যতীত সবর করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়”। (সূরা নহলঃ ১২৬-১২৭)
বর্ণিত আছে, হযরত হামযা (রা) এবং উহুদের শহীদগণের সাথে কাফিরদের এহেন নৃশংস আচরণের প্রেক্ষিতেই উক্ত আয়াত নাযিল হয়। তাঁদের সাথে কৃত ‘মুছলা’র দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) মর্মাহত হয়ে ইরশাদ করেন-
*******আরবী
“ আল্লাহ যদি আমাকে জয়ী করেন তবে তারা আমাদের সাথে যে আচরণ করেছে এর দ্বিগুণ আমি ‘মুছলা করে ছাড়বো’। অতঃপর যদিও ইতিপূর্বে মক্কায় উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়, তবুও পুনরায় এ আয়াতটি নাযিল হয়।
*******আরবী
“ হে নবী! আপনাকে রূহ-এর রহস্য সম্পর্কে তারা জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলে দিন- এটি আমার প্রতিপালকের একটি নির্দেশ”। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮৫)
যেমন নিম্নের আয়াতটি দু’বার নাযিল হয়েছিল বলে রেওয়ায়াত আছে-
*******আরবী
“ হে রাসূল! সকাল সন্ধ্যা দিনের উভয়াংশে এবং রাতের প্রথমাংশে নামায আদায় করুন। সৎ কাজ অবশ্যই গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়”। (সূরা হূদঃ ১১৪)
তদ্রূপ সূরা নাহলের আয়াতটি প্রথমে মক্কায় এবং পুনরায় মদীনায় নাযিল হয়। অর্থাৎ দু’বার নাযিল হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে জুলুম থেকে বিরত থাকার জন্যে রাসূলুল্লাহ্র নির্দেশাবলী
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর হুযূর (সা) বলেন, ******আরবী “আমরা বরং সবরই করবো”। হযরত বরুদা ইবনুল হাসীব (রা)-এর সূত্রে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেনঃ মহানবী (সা) যখনই কোন ব্যক্তিকে ‘সারিয়্যা’ তথা ছোট বাহিনী কিংবা বিরাট বাহিনীর আমীর (নেতা) নিযুক্ত করে প্রেরণ করতেন, তখন তাঁকে ও সঙ্গীদেরকে বিশেষ নসীহত এবং খোদাভীতির হেদায়েত দানের পর বলতেন-
********আরবী
“আল্লাহ্র নাম নিয়ে জিহাদ কর, আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ কর, যারা আল্লাহ্র সাথে কুফরীবশতঃ ন্যায়-সত্য পথের যাত্রীদের প্রতিরোধ করে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর। তবে সীমা অতিক্রম করবে না, বিশ্বাসঘাতকতা ও ‘মুছলা’ করবে না। আর শিশুদের হত্যা করবে না”।১ (মুসলিম) (১ঃ এই ছিল মহানবীর ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ সমরনীতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য, যার ফলে আরব জাহানসহ অর্ধ শতাব্দীর মত সময়ের এ ক্ষুদ্র পরিসরে অর্ধেক বিশ্ব ইসলামের ছায়াতলে এসে যায়, সর্বত্র ইসলামের পতাকা উড়তে থাকে। তৎকালীন আরবে গোত্রবাদ, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা ইত্যাদি কুসংস্কার প্রথা এত প্রবল ছিল, যা বিশ্বের অন্য কোথাও দৃষ্টিগোচর হত না। প্রত্যেক গোত্রদের দেবতা ছিল স্বতন্ত্র। গোত্রপ্রীতির মুকাবিলায় ন্যায়-নীতি এমনকি মানবতা পর্যন্ত ছিল উপেক্ষিত। স্বগোত্রীয়ের অন্যায় অপরাধ যত মারাত্মকই হোক অন্য গোত্রের মুকাবিলায় কোন অপরাধ হিসেবে গণ্য হত না বা এর কোন শাস্তি কিংবা প্রতিকারও ছিল না। যার ফলে তৎকালীন বৃহৎ শক্তি পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের পক্ষে এখানে স্থায়ী প্রভুত্ব কায়েম করা সম্ভব হয়নি। অপরপক্ষে দেশীয় বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলোকে ঐক্য সূত্রে আবদ্ধ করে কোন একক শক্তির অধীনে রাষ্ট্র গঠন করাও কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। বস্তুত গোত্রবাদের বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণাই ছিল আরবদের ঐক্যের মূলে অন্তরায়। সেই ভয়াবহ গোত্রবাদের একটি চিত্রই পবিত্র কুরআন মহানবী (সা)কে সম্বোধনের মধ্যদিয়ে তুলে ধরেছে।
*******আরবী
ইরশাদ হচ্ছে- “সারা বিশ্বের সকল ধনভাণ্ডার ব্যয় করলেও আপনি তাদের অন্তরে ঐক্য ও সম্প্রীতির ভাব সৃষ্টি করতে পারবেন না, কিন্তু একমাত্র আল্লাহই তাদের হৃদয়ে সৌহার্দনুরাগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি প্রবল পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়”। (সূরা আনফাল)
প্রকৃতপক্ষে সমকালীন বিশ্বে গোত্রবাদী ধ্যান-ধারণা একমাত্র আরব ভূখণ্ডেই আক্ষরিক অর্থে কার্যকর ছিল, যার ফলে এ অঞ্চল কখনো পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যে বিলীন হয়নি। আর হলেও তা ছিল সাময়িক ব্যাপার। তাই কোন বৃহৎ শক্তি এতদঞ্চলে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়নি। অপরপক্ষে তারা নিজেরাও কোন স্বাধীন শক্তিশালী সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারেনি। মহানবী (সা) বাল্যকাল থাকেই জনগণের মধ্যে ‘আল-আমীন’ বিশেষণে খ্যাতিমান ছিলেন। এটা ছিল তাঁকে দেয়া জনগণের সর্বসম্মত উপাধি। সকলের প্রতিই ছিল তাঁর অভিন্ন আচরণ। মদীনায় হিজরতের পর মহান আল্লাহ্র পক্ষ থাকে তাঁর উপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হয়। মাত্র ৪/৫ বছরের ব্যবধানে পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলোকে তিনি ঐক্যের প্রীতিডোরে আবদ্ধ করতে সক্ষম হন এবং তাঁর মহান নেতৃত্বে জাহিলী যুগের গোত্রবাদের অভিশাপ থাকে মুক্ত হয়ে গোটা সমাজ সকল গোত্র এক দেহে এক আত্মায় বিলীন হয়ে যায়। এ ঐক্য-শৃঙ্খলা বলেই রোম পারস্য সাম্রাজ্য ইসলামী আধিপত্যের সামনে লুটিয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
এখানে বিশেষ লক্ষণীয় যে, উহূদের ময়দানে হযরত হামযার শহীদী লাশে কাফিরদের কৃত ‘মুছলার’ লোমহর্ষক দৃশ্য লক্ষ্য করে ব্যথিত প্রাণে মহানবীর যবান মুবারক থেকে বেরিয়ে আসে- “সুযোগ পেলে আমরাও অনুরূপ আচরণ করবো” এরি প্রেক্ষিতে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাঁকে সম্বোধন করে বলা হয়-
*****আরবী
“ হে মুসলমানগণ! শত্রুদের সাথে কঠোরতার প্রয়োজন হলে, সে পরিমাণ কঠোরতাই অবলম্বন কর, যা তোমাদের সাথে করা হয়েছে, কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধর, তবে ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম। আর হে নবী ! আপনি সবর করুন, কিন্তু আল্লাহ্র তৌফিক ব্যতীত সবর করা আপনার পক্ষে সম্ভবই নয়। (সূরা নাহলঃ ১২৬-১২৭) তখন তিনি বলেন- ********আরবী “অবশ্যই আমরা ধৈর্য ধারণ করবো”।
একমাত্র নৈতিক চরিত্রের ভিত্তিতেই তিনি ৪/৫ বছরের মধ্যে গোটা আরব উপদ্বীপ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হন। কিন্তু আল্লাহ্র নির্ধারিত হদ্দের বেলায় তিনি কারো রেয়াত করেননি। তিনি আক্ষরিক অর্থেই আচার ব্যবহারে, বলিষ্ঠ নীতি, সাহসিকতা, দূরদর্শিতা, উদার ও মহৎ প্রাণের পরিচয় দেন। উপরন্তু তিনি অনুগ্রহ ও করুণার বর্ষণে হিংসা-দ্বেষ, বিদ্রোহ ও যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছেন। অত্যাচারের মাত্রা যতই বেড়েছে প্রতিদানে তাঁর অনুগ্রহের হাত অধিক সম্প্রসারিত হয়েছে। কুরআনের উদ্দেশ্য ও মর্ম তিনি বাস্তবায়িত করেছেন পূর্ণ মাত্রায়, পরম নিষ্ঠার সাথে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
***********আরবী
“হে নবী! সৎ-অসৎ ভাল-মন্দ সমান হতে পারে না, উত্তম পন্থায় মন্দের প্রতিকার কর। যদি এরূপ কর তবে, পরম শত্রুও তোমার প্রাণের বন্ধুতে পরিণত হবে। আর ধৈর্যশীলদেরকেই কেবল উত্তমাচরণের সুযোগ দেয়া হয় আর সুযোগ দেয়া হয় সেসব লোককে যারা মহা ভাগ্যবান”। (সূরা হা-মীম আস সাজদাঃ ৩৪-৩৫)
আরো ইরশাদ হয়েছে-
*******আরবী
“এরাই সে লোক, সবরের প্রতিদানে যাদেরকে দ্বিগুন সওয়াব দেয়া হবে, (তাওরাত, কুরআনে ঈমান আনার কারণে) আর যারা সত্যের দ্বারা অসত্যের প্রতিরোধ করে থাকে এবং আমার দেয়া ধন-সম্পদ আমারই পথে ব্যয় করে”। (সূরা কাসাসঃ ৫৪)
মহানবী (সা) এর জীবনাদর্শ প্রণিধানযোগ্য যে, নিজ গোত্র আপনজনেরা তাঁর উপর নানাবিধ নির্যাতন চালাচ্ছে, কষ্ট দিচ্ছে, অন্যায় আক্রমণে পবিত্র দেহ মোবারক রক্তাক্ত করে ফেলেছে কিন্তু ঐ অবস্থায় তাঁর বরকতময় যবান থেকে বদদু’আর পরিবর্তে নেক দু’আ বেরিয়ে আসছে। অকথ্য নির্যাতনের পর তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে-
**********আরবী
“ হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা করুন। কেননা তারা বুঝে না”।
বস্তুতঃ এহেন ভাষায়ই নবীর মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ারযোগ্য। তাই বিবেকবানদের জন্য এতে চিন্তার খোরাক রয়েছে। ‘ইহসান’ তথা মহানুভবতা ও অনুগ্রহের চারটি স্তর রয়েছে যা দ্বারা কওমের অন্যায় অত্যাচারের মুকাবিলা করা যায়। (১) ক্ষমা ও মার্জনা, (২) তাদের জন্য ইসতিগফার তথা তাদের অপরাধ মার্জনার জন্যে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করা, (৩) কওমের অন্যায় অত্যাচারের কারণে আল্লাহ্র নিকট তাঁর ফরিয়াদ- তারা বুঝতে পারেনি বলেই তাদের এই আচরণ, অন্যথায় তারা এরূপ করত না, (৪) কওমের প্রতি তিনি এতই সদয় যে, এই বলে আল্লাহ্র অনুগ্রহ আকর্ষণ করেছেন যে, হে আল্লাহ! এরা আমারই গোত্রীয় স্বজন। কোন ব্যক্তি যেরূপ স্বীয়পুত্র গোলাম কিংবা কোন বন্ধুর পক্ষে বলে থাকে- এ আমার পুত্র, গোলাম অথবা বন্ধু, এর একাজটি করে দিন, আবেদন গ্রহণ করুন। চিন্তার বিষয়, কারো প্রিয়পাত্র যদি তার আপন জনের জন্য এমনি ভাষায় ফরিয়াদ জানায়, তাহলে ওদের ওপর তার কি পরিমাণ প্রভাব পড়বে? এই হল নবীর উন্নত চরিত্র মু’জিযা, নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের নমুনা যা বিশ্বকে অভিভূত ও আলোড়িত করেছে। সকলকে তিনি আপন গুণে মুগ্ধ করেছেন।
অতঃপর পূর্ণ শান-শওকতের সাথেই মক্কা বিজয় হয়। আর বিজয়ীর বেশে তথায় তিনি প্রবেশ করেন। বিজিত কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে সে নবীরই দরবারে পেশ করা হয়, যাদের অত্যাচারে তিনি জর্জরিত, এমনকি দেশ ছাড়া হন।
বন্দীদের মধ্যে সে ব্যক্তিও রয়েছে, যে নামাযে সিজদারত নবীর পিঠে উটের ভুঁড়ি তুলে দিয়েছিল, হিজরত করে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর নিকট আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষ থেকে যেসব কর্মকর্তা আবিসিনিয়া গমন করেছিল, তারাও আজ হাজির। কালিমা তাওহীদের ওয়াজ করার কারণে হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) কে আঘাতের চোটে জখমকারী এবং দারুন্নাদাওয়ার মিলনায়তনে এক পরামর্শ সভায় মহানবীকে (সা) হত্যার প্রস্তাবকারী ও হত্যার চুক্তিনামায় শরীক ব্যক্তি তিনবছর ব্যাপী মহানবীকে (সা) “শাবে আবূ তালিবে” নযরবন্দী করে রাখার নায়করা, প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগে বাধ্যকারী জালিমরা, বদর, উহুদ ও খন্দক যুদ্ধে যোগদানকারী কাফিররা, হযরত হামজার ঘাতক ‘মুছলা’কারী পাপিষ্ঠ, নবীর বিরুদ্ধে আরব গোত্রসমূহকে উস্কানী দানকারী এবং ইসলাম ও নবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের হোতারা মোটকথা হযরতের প্রাণের শত্রুরা আজ বন্দী অবস্থায় মহানবীর দরবারে যুদ্ধ অপরাধী হিসাবে নতশিরে উপস্থিত, অথচ বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করা সত্ত্বে মহানবী (সা)-এর কণ্ঠে এসব হত্যাযোগ্য অপরাধীদের সম্পর্কে তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে-
**********আরবী
“যে ব্যক্তি আবূ সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে ব্যক্তি নিজ গৃহের দরজা বন্ধ করে দিবে এবং যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে এদেরকেও নিরাপত্তা দেয়া হলো”।
অতঃপর কা’বা শরীফের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন-
********আরবী
“আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নাই, তিনি একক, যাঁর কোনো শরীক নাই, নিজের ওয়াদা তিনি সত্যে পরিণত করেছেন, স্বীয় বান্দাকে তিনি সাহায্য করেছেন আর একাই তিনি সকল গোত্রকে পরাজিত করেছেন। হুশিয়ার! সকল রক্তমূল্য অথবা খুন কিংবা দাবীযোগ্য সম্পদ আমার এ দু’পায়ের নীচে (দাবিয়ে দেয়া হল)। তবে বায়তুল্লাহর চাবি রক্ষণ এবং হাজীদের পানি পান করানোর খিদমতের দায়িত্ব সাবেক ব্যক্তিদের কাছেই”।
অতঃপর অতি গম্ভীর স্বরে মক্কার কুরাইশদেরকে সম্বোধন করে মহানবী ঘোষণা করলেন-
*********আরবী
“হে কুরাইশগণ! আমার থেকে তোমরা আজ কি ধরনের ব্যবহার প্রত্যাশা করো?”
জবাবে কুরাইশরা বলল- উত্তম, কারণ আপনি আমাদের দয়ালু ভাই এবং সম্ভ্রান্ত ভ্রাতুষ্পুত্র। তাদের জবাবে মহানবী (সা) তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণায় বললেন- *******আরবী “যাও তোমরা সবাই আজ মুক্ত-স্বাধীন”। তাঁর এ দয়া ও অনুগ্রহ মানব জাতির গৌরবের বিষয়। তাদের সে অতীত দুষ্কর্মের প্রতিশোধ তিনি কিভাবে গ্রহণ করেছেন।
এই হল মহানবীর দয়া অনুগ্রহ, ইসলামী খিলাফতের অগ্রনায়কের খোদাভীতি, যা মানব জাতির জন্য উত্তম আদর্শ ও চিরস্থায়ী মুক্তি সনদ।
*******আরবী )
ধন সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে কাফিররা যদি মুসলিম জনপদ অভিমুখে অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় এগিয়ে আসে তখন তাদেরকে ‘মুহারিব’ তথা যুদ্ধ ঘোষণাকারী আগ্রাসী বলা হবে কিনা? এ সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে। কারো কারো মতে তাদেরকে ‘মুহারিব’ আগ্রাসী বলা যাবে না, বরং তারা সমাজ বিরোধী ডাকাত, গুন্ডা পর্যায়ের লোক। যাদের বিরুদ্ধে সাহায্য চাওয়া হলে নগর-জনপদবাসীরা এমনিতেই দৌড়ে আসে। অধিকাংশের মতে বিরাট জনপদ আর জনশূন্য মরু ময়দানের একই হুকুম। ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদের অধিকাংশ শিষ্য এবং ইমাম আবু হানীফার কোন কোন শিষ্য-শাগরিদ এ মতের সমর্থক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জনশূন্য মাঠ-ময়দানে ডাকাতি লুটপাট করার তুলনায় শহরে বন্দরে এ জাতীয় দুষ্কৃতির কঠোর সাজা হওয়া বাঞ্চনীয়। এজন্য যে, শহরে জনপদ অধিকতর নিরাপদ হয়ে থাকে। পরস্পর একে অপরের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে আসা সহজ। কাজেই এরূপ স্থলে ডাকাতি লুটপাটের পদক্ষেপ নেয়া শক্তিশালী দলের পক্ষেই সম্ভব। আর শতি সাহস আছে বলেই এরা নাগরিকদের বাসগৃহে প্রবেশ করে জোরপূর্বক তাদের ধন-সম্পদ, মালামাল হাতিয়ে নেয়ার দুঃসাহসী প্রয়াস চালায়। পক্ষান্তরে, পথিক মুসাফিরদের সঙ্গে মালামাল অল্পই থাকে। কাজেই সামান্য শক্তিতে এদের প্রতি আঘাত হানা সহজ। এদের সম্পর্কে এ মতই বিশুদ্ধ ও যুক্তিযুক্ত।
এরা যদি লাঠি-সোটা, পাথর দ্বারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তবে এদেকেও ‘মুহারিব’ বলা হবে। এ ব্যাপারে ফকীহদের এ অভিমত বর্ণিত আছে- *******আরবী “সংঘর্ষে কেবল ধারালো অস্ত্র দ্বারাই হতে পারে”। কেউ কেউ এর উপর আলিমগণের ‘ইজমা’ (সর্বসম্মত ঐকমত্য) বর্ণনা করেছেন যে, ধারালো এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সংঘটিত সংঘর্ষকে ‘মুহারাবা’ বলা হয়। অতঃপর এ সম্পর্কে মতভেদ থাকুক, চাই না থাকুক বিশুদ্ধ মত সেটিই, যার উপর মুসলমানদের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। আর তা হলো, যে ব্যক্তি ধন সম্পদ লুণ্ঠন করার উদ্দেশ্যে হত্যা ও লুটপাটের আশ্রয় নেয়, এমতাবস্থায় যেভাবেই ঐ ব্যক্তি সংঘর্ষ বাধাক না কেন, সে ‘মুহারিব’, ডাকাত, লুণ্ঠনকারী ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত হওয়ারযোগ্য। যেমন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফিরকে ‘হরবী’ বলা হয়। এখন সে যেভাবেই যুদ্ধ করুক, তরবারী, বর্শা, পাথর ইত্যাদি যাই সে ব্যবহার করুক না কেন, ‘হরবী’ নামেই তাকে অভিহিত করা হবে আর প্রতিপক্ষ মুসলমানদের বলা হবে ‘আল্লাহ্র পথের মুজাহিদ’। সম্পদ হরণের উদ্দেশ্যে যারা গোপনে হত্যা করে, যেমন পথিপাশের উল্লেখযোগ্য স্থানে দোকান, মুসাফিরখানা, আবাসিক হোটেল ইত্যাদি বানিয়ে তথায় প্রবাসীদের আশ্রয় দেয়। আর কোন পথ যাত্রী (বিদেশী) হাতের নাগালে পেলে তাকে হত্যা করে তার সর্বস্ব লুটে নেয়। আবার কেউ কেউ দর্জি, ডাক্তার, কবিরাজকে ফিস দিয়ে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধোকায় ফেলে হত্যা করে তার সর্বস্ব লুটে নেয়। এভাবে সম্পদ লুণ্ঠন করার পর তাকে ‘মুহারিব’ বলা হবে কি না, তার উপর হদ্দ জারী হবে কিনা? এ সম্পর্কে ফকীহদের দু’ধরনের মত লক্ষ্য করা যায়। (১) সে মুহারিবের অন্তর্ভুক্ত। কেননা প্রকাশ্য বা ধোকায় ফলে উভয় প্রকারের হত্যা একই পর্যায়ভুক্ত। উভয় অবস্থাতেই প্রাণ বাঁচানো দায়। বরং প্রকাশ্য হত্যার তুলনায় ষড়যন্ত্রমূলক হত্যা অধিক বিপদজনক। কেননা প্রকাশ্য হত্যা থেকে আত্মরক্ষা হয়তো সম্ভব কিন্তু গোপন হত্যা থেকে প্রাণ রক্ষা করা অধিকতর কঠিন। (২) প্রকাশ্যে হত্যাকারীই আদতে ‘মুহারিব’। অধিকন্তু ধোকায় ফেলে হত্যাকারীর ব্যাপারটি নিহতের ওয়ারিশদের অধিকারভুক্ত বিষয়। তবে প্রথম মতটি শরীয়তের নীতি মালার সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল। কেননা, মুহারিবের তুলনায় এর মধ্যে ক্ষতির আশংকা অধিক পরিমাণে বিদ্যমান।
কোন ব্যক্তি রাষ্ট্র নায়ক হত্যা করলে তার হুকুম কি? এ বিষয় ফকীহগণের মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। যেমন হযরত উসমান (রা), হযরত আলী (রা) কে শহীদ করা হয়েছে। এখন এদের হত্যাকারী কি মুহারিব? তাদের উপর হদ্দ জারী হবে? নাকি মামলার ভার ওয়ারিশদের হাতে ন্যস্ত করা হবে- এ বিষয় মতভেদ রয়েছে। ইমাম আহমদ থেকে এ বিষয় দু’ধরনের মত বর্ণিত রয়েছে। এক মতে মুহারিব। কারণ, রাষ্ট্রের এ ধরনের শীর্ষ পর্যায়ের লোকের হত্যা সমাজে বিশৃঙ্খলা বিপর্যয়ের প্রবল আশংকা রয়েছে।
[বার]
সরকার বা রাষ্ট্র প্রধান হত্যাকারীদের শাস্তি প্রসঙ্গ
সুলতান বা খলীফাকে হত্যাকারী মুহারিব, তার উপর হদ্দ জারী করা হবে না কি নিস্পত্তির ভার ওয়ারিশদের হাতে ন্যস্ত করা হবে, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কিংবা তাঁর প্রতিনিধি যদি হত্যাকারীকে তলব করে, কিন্তু গোত্রীয় বা দলীয় লোকেরা তার সাহায্যে এগিয়ে আসে আর সংঘর্ষের জন্য তারা প্রস্তুত হতে থাকে, এমতাবস্থায় ইসলামী আইনবিদগণ এ ব্যাপারে একমত যে, হত্যাকারী ও তার সহযোগী পক্ষালম্বঙ্কারীদের পরাজিত ও গ্রেফতার না করা পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করা মুসলমানদের উপর ফরয।
সুলতান, নায়েবে সুলতান, রাষ্ট্রপতি, সরকার প্রধান অথবা হাকিম, রাষ্ট্রপ্রধান হত্যাকারীর উপর ন্যায় নীতির অধীন হদ্দ জারী করার উদ্দেশ্যে তাকে যদি আদালতে তলব করেন, সে সময় হত্যাকারীর সমর্থনকারীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে প্রস্তুতি নিলে, এমতাবস্থায়’ তাদের বিরুদ্ধে (সরকারী বাহিনীর সমর্থনে) জিহাদের ঝাঁপিয়ে পড়া সকল মুসলমানের উপর ফরয। যতক্ষণ পর্যন্ত না এরা পরাস্ত হয়, লড়াই অব্যাহত রাখবে। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের ইসলামী আইনবিদগণ অভিন্ন মত পোষণ করেন। মৃত্যুদণ্ড ছাড়া এরা বশ্যতা স্বীকার না করলে যেভাবে সম্ভব এদেরকে দমন করতেই হবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে হত্যাকারীর সমর্থনকারীগণসহ ব্যাপক হারে এসব বিদ্রোহীকে প্রাণদণ্ড দিতে হবে। কেননা সেটা ছিল হদ্দ জারী করার প্রশ্ন আর এটা হল ইসলামের বিরুদ্ধে মুকাবিল। কাজেই এটা রীতিমত জিহাদ বিধায় এর গুরুত্ব অধিক। সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে দলবদ্ধ হয়ে এরা ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে, ক্ষেতের ফসল ধ্বংস ও প্রাণহানি ঘটিয়ে সমাজ বিধ্বংসী কার্যে এরা লিপ্ত। দ্বীন কায়েম করা কিংবা দেশের খিদমত করা এদের উদ্দেশ্য নয়। এরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত লোকেদেরই সমপর্যায়ের, যারা দুর্গ, শৈলচূড়া কিংবা উপত্যকায় পার্টি করে পথিকদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে, অন্যায় হত্যাকাণ্ড চালায়। বাদশাহ বা হাকিম, শাসনকর্তা অথবা সৈন্যবাহিনী যদি তাদের আনুগত্যের আহ্বান জানায় এবং তওবা করতে, ক্ষমা চাইতে, মুসলমানদের দলভুক্ত হতে ও হদ্দ জারীর উদ্দেশ্যে তাদের বলে, জবাবে তারা যুদ্ধ শুরু করে দেয়। আত্মরক্ষায় পদক্ষেপ নেয়। তাদের অবস্থা হজ্জাযাত্রী এবং পথচারীদের মালামাল লুণ্ঠনকারীদের ন্যায় অথবা পাহাড়ের টিলায় ওৎঁ পেতে বসে থাকা দস্যু-ডাকাতদের অনুরূপ কিংবা ছিনতাইকারী ব্যক্তিদের ন্যায় অপর দেশগামী যাত্রীদের উপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও এদের সাথে মুকাবিলা আর কাফিরদের সাথে মুকাবিলা এক কথা নয়। কেননা এরা কাফির নয়। এরা পরস্ব লুণ্ঠন করার পূর্বে এদের সম্পদ লুট করা বৈধ নয়। আর তারা যদি লুণ্ঠন করেও, তবে তাদের কাছ থেকে সমপরিমাণ ক্ষতি পূরণ আদায় করতে হবে, যদি লুণ্ঠনকারীকে চিহ্নিত করা সম্ভব না হয়। কিন্তু যদি প্রকৃত লুণ্ঠনকারী চিহ্নিত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে লুণ্ঠনকারী ও তার সাহায্যকারী সবাই সমপর্যায়ের অপরাধী যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। সুতরাং লুণ্ঠনকারী নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে লুটকৃত মালের সমপরিমাণ মাল জরিমানাস্বরূপ তার কাছ থেকে আদায় করা হবে। অন্যথায় তার স্বগোত্রীয় বিত্তবানদের উপর তার দায়িত্ব বর্তাবে। কিন্তু তাদের থেকে যদি জরিমানার অর্থ আদায় করা কঠিন হয়, তবে জাতির স্বার্থে তাদের সঙ্গে যুদ্ধরত সৈনিকদের মাসিক বেতন ধার্য করে দিতে হবে। কেননা এ যুদ্ধ ইকামতে হদ্দ এবং সামাজিক বিপর্যয় রোধ করার লক্ষ্যে করা হচ্ছে। ইসলাম ও গণদুশমনদের কেউ গুরুতর জখমী হলে তার চিকিৎসার দায়িত্ব তাদের। মরে তো বিনা ঔষধে মরুক। এরা পালিয়ে গেলে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা না থাকলে পশ্চাদ্ধাবন করার প্রয়োজন নেই। অবশ্য যদি কারো উপর হদ্দ জারী করা ওয়াজিব হয় অথবা জনগণের নিরাপত্তা হুমকীর সম্মুখীন হওয়ার আশংকা দেখা দেয় তবে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা অপরিহার্য।
এদের মধ্যে যারা বন্দী হয়ে আসে, অন্যদের ন্যায় তাদের উপর হদ্দ জারী করতে হবে। কোন কোন ফকীহ্ আরো কঠোর নীতি অবলম্বনের পক্ষপাতী যে, এদের থেকে গনীমতের মাল আদায় করে তা থেকে খুমুস বা পঞ্চমাংশ পৃথক করা বিধেয়। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহ্ এ মতের বিরোধী। কিন্তু তারা যদি ইসলামী রাষ্ট্রের বাইরের অন্য কোন দেশে আশ্রয় নেয় আর সেখানে বসে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সক্রিয় চক্রান্তে অংশ নেয়, তাহলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অপরাধে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
একদল লোক ডাকাতি রাহাজানী তো করে না কিন্তু কাফিলার পাহারাদারী ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিনিময়ে পথচারী মুসাফিরদের কাছ থেকে জনপ্রতি ও উট ইত্যাদি পশুর মাথাপিছু নির্দিষ্ট হারে অর্থ আদায় করে থাকে, এটা শুল্কের পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং তাদেরকে অন্যায় শুল্ক উসূলকারীদের ন্যায় শাস্তি দিতে হবে। এ জাতীয় অপরাধীদের হত্যার ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেননা এরা ডাকাত ও রাহ্যন ছিনতাইকারী নয়, অথচ এদের ছাড়াও রাস্তা যাতায়াত পথ নিরাপদ থাকে। এরা ******আরবী (কিয়ামতের দিন কঠোর সাজা প্রাপ্ত হবে।)
নবী করীম (সা) জনৈকা গামেদিয়া মহিলা সম্পর্কে বলেছেন-
**********আরবী
“ সে এমন তওবাই করেছে যদি জঙ্গী কর আদায়কারীরা এরূপ তওবা করতো তবে তারাও ক্ষমা পেয়ে যেতো”।
আর যাদের মাল-সম্পদ উদ্ধারে মুসলিম বাহিনী মুহারিবদের সাথে যুদ্ধরত তাদের জন্য অর্থ ব্যয় আদৌ করা যাবে না, যতক্ষণ যুদ্ধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“মালের হিফাজতে যে ব্যক্তি নিহত হয় সে শহীদ, যে ব্যক্তি প্রাণ রক্ষার্থে নিহত হয় সে শহীদ, যে ব্যক্তি দ্বীন রক্ষার্থে নিহিত হয় সে শহীদ, আর যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের মান-সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে কতল হয়, সেও শহীদ”।
ফকীহ্গণ এক্ষেত্রে ****আরবী শব্দটি ব্যবহার করেছেন যার অর্থ হলো, তাবীল বা রাষ্ট্রীয় শক্তি ছাড়া জুলুমকারী।
যুদ্ধ ছাড়া এদের দমন করা সম্ভব না হলে অগত্যা যুদ্ধেরই আশ্রয় নিতে হবে। কিন্তু সংঘর্ষে না জড়িয়ে সংশোধনকল্পে কিছু অর্থ ব্যয়ে যদি এদের এই খারাপ পথ থেকে ফেরানো যায়, তবে এটাও জায়েয।
কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য যদি হয় কারো সম্মানে আঘাত করা, কারো মা-বোন, স্ত্রী-কন্যা ইত্যাদির সম্ভ্রম বিনষ্ট করা অথবা কোন মহিলা কিংবা বালকের সাথে কুকর্ম করা, তবে প্রাণ-সম্পদ সব দিয়ে হলেও এদের মুকাবিলা করতে হবে। এমনকি প্রয়োজন হলে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে হবে। অর্থাৎ, কোন অবস্থাতেই এ ধরনের পাপাচারের সুযোগ দেয়া যাবে না। কিন্তু যদি অর্থের বিনিময়ে উদ্দেশ্য সফল করা যায়, তবে সেটা জায়েয। তবুও নিজের কিংবা মহিলাদের সম্ভ্রম নষ্টের বিষয়টি সহ্য করা যাবে না।
আর যদি তার উদ্দেশ্য হয় কাউকে হত্যা করা, তবে তা প্রাণ রক্ষা অবশ্যই জরুরী এবং আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা অত্যাবশক।
এ সম্পর্কে উলামা, ইমাম আহমদ এবং অন্যান্যদের মযহাবে দু’ধরনের মতামত পরিলক্ষিত হয়। এটা দেশের সুলতান বা শাসনকর্তা বিদ্যমান থাকাকালীন সামরিক ব্যবস্থা মাত্র। কিন্তু “আল্লাহ না করুন” যদি দু’জন শাসনকর্তার ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে দেশে বিরাট ফিৎনার সৃষ্টি হয়, এমন অবস্থায় কোনো পক্ষে যোগদান না করে জনগণের উচিত নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা। এ সম্পর্কে ইমাম আহমদসহ অন্যান্য মযহাবে দু’ধরনের মত রয়েছে।
বাদশাহ চোর,গুন্ডা, ডাকাত, লুটেরাদেরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলে লুণ্ঠিত মালামাল এদের থেকে উসূল করে প্রকৃত মালিককে তা ফেরত দিতে হবে এবং এদের উপর হদ্দ জারী করতে হবে। চোরের বেলায়ও একই হুকুম। সঠিক প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনে প্রহার করে সাজা দিয়ে এদের থেকে চোরাই মাল উদ্ধার করে মালিককে ফেরত দেবে এবং এদেরকে জেলখানায় বন্দী করে রাখবে। অতঃপর এরা উকিল দ্বারা লুণ্ঠিত মাল হাজির করবে অথবা মাল কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে সন্ধান দেবে। পাওনাদারদের প্রাপ্য আদায় না করাতে যেরূপ শাস্তি দেয়া হয়, এদের বেলায়ও একই শাস্তি দিতে হবে। অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের হক আদায় করতে অস্বীকার করলে কিংবা স্ত্রী অবাধ্য হলে, শরীয়তে শাস্তির বিধান থাকবে, এক্ষেত্রেও তাই। বরং এরা হকদারের হক আদায় না করার কারণে অধিকতর শাস্তির যোগ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও অপরাধীকে ক্ষমা করার অধিকার মালিকের থাকবে, সুবিধাজনক বিবেচনায় তিনি সাজাও মাফ করে দিতে পারেন। অবশ্য হদ্দের ব্যাপার অন্যরকম। হদ্দ জারী করতে বাধা দেয়া বা ক্ষমার অধিকার কারো নেই। এটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত অকাট্য বিধান।
ইমাম বা হাকিমের কর্তব্য হল চোরাই মাল বিনষ্ট করে ফেললে চোরের নিকট থেকে ক্ষতি পূরণ আদায় করা। যেমন, গোমকারীর নিকট থেকে যেমনিভাবে ক্ষতি পূরণ আদায় করা হয়। ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদ এ মতের সমর্থমকারী। কিন্তু অপারগ অবস্থায় তাকে সময় দিতে হবে। কেউ বলেছেন- জরিমানা ও হাত কাটা একই সাথে দুটো চলতে পারে না। ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর সমর্থক। কারো মতে, জরিমানার হুকুম কেবল আর্থিক সচ্ছলতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইমাম মালিক (রহ) এর সমর্থক। চোর, ডাকাতের মুকাবিলা কিংবা মাল অনুসন্ধান করার খরচ পত্র, বিনিময় ইত্যাদি মালিকের কাছ থেকে আদায় করা সরকারের জন্য জায়েয নয়। সরকারী কর্তৃপক্ষ নিজের অথবা সৈন্যদের জন্য কোনক্রমেই মালিককে বিনিময় আদায়ের জন্য চাপ দেয়া জায়েয নয়। বরং তাদের মুকাবিলা করা জিহাদতুল্য। কাজেই যে খাত থেকে জিহাদের ব্যয় নির্বাহ করা হয়, এক্ষেত্রেও একই খাত থেকে খরচ বহন করতে হবে। মুজাহিদগনকে যদি জমাজমি দেয়া হয়ে থাকে কিংবা সরকার থেকে তাদের বেতন ধার্য করা থাকে তবে তাই যথেষ্ট, নতুবা বায়তুল মাল থেকে তাদের প্রয়োজন মিটানো হবে। কেননা এটাও “জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর” অন্তর্ভুক্ত।
যাকাত অনাদায়কারী কোন মুসাফির যদি ঘটনাচক্রে চোরের সাথে বন্দী হয়ে আসে, তবে তার নিকট থেকে যাকাত আদায় করে আলোচ্য জিহাদে খরচ করতে হবে, যেমন ডাকাতের বিরুদ্ধে সৈন্যদের পিছনে ব্যয় করা হয়।
এরা শক্তিশালী হওয়ার ফলে এদের মন জয়ের উদ্দেশ্যে আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিলে ‘ফাঈ’ এবং যাকাত তহবিল থেকে কেবল সরদারদেরকে এ শর্তে দিতে হবে যে, হয় বাকীদের হাজির করবে, না হয় সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ ছেড়ে দেবে। ইমামের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা করা জায়েয। কেননা এর ফলে তাদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। আর এরা “মুয়াল্লাফাতুল কুলূবের” পর্যায়ভুক্ত হবে। কুরআন, হাদীস, শরীয়তের মূলনীতি, ইমাম আহমদ এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ইমামগণ এর সমর্থনকারী।
চোর,ডাকাত, সন্ত্রাসবাদী এদের মুকাবিলায় দুর্বল, মুসাফির, ব্যবসায়ী এবং ধনী লোকদের প্রেরণ করা উচিত নয়। বরং শাসনকর্তার উচিত হল, বিত্তশালীদের থেকে আর্থিক সাহায্য নেয়া আর শক্তিশালী, সাহসী ও বিশ্বাসী লোকদের এ কাজে পাঠানো। কিন্তু যদি এ ধরনের লোক পাওনা না যায়, তবে অবশ্য বিকল্প চিন্তা করা যেতে পারে।
কোন কোন সরকারী কর্মকর্তা, নেতা, উপনেতা, সরদার, শাসনকর্তা এবং উচ্চ পদস্থ সামরিক অফিসার কি প্রকাশ্যে বা গোপনে সন্ত্রাসবাদী, সমাজ বিরোধী চোর ডাকাতদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সমর্থন পৃষ্ঠপোষকতা করে এদের লুণ্ঠিত মালের একটা অংশ হাতিয়ে নেয়। এরা ফরিয়াদীকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে রাজী করিয়ে নেয়, বাধ্য হয়ে তারাও রাজী হয় যায়। এটা একটা গুরুতর অপরাধ। এরা চোর, ডাকাতের সরদারের চাইতেও মারাত্মক অপরাধী। কেননা, তাদেরকে দমন করা সম্ভব কিন্তু এদের দমন করা কঠিন।
সুতরাং এদের সম্পর্কে বিধান হলো- সমাজ বিরোধীদের সমর্থনের দায়ে এরাও শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী। তাই ডাকাতরা খুন করলে হযরত উমর (রা) এবং অধিকাংশ আলিমের মতে এদেরকেও প্রাণদণ্ড দিতে হবে। আর ডাকাতরা মাল লুট করলে এদেরও ডান হাত-বাম পা কাটা যাবে। যদি তারা খুন এবং লুট উভয় অপরাধে জড়িত থাকে, তবে এদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে শূলীতে চড়াতে হবে। একদল আলিমের মতে এদের হাত-পা কেটে, কতল করে, অতঃপর শূলে ঝুলাতে হবে। কারো মতে কতল অথবা শূলী দুটার যে কোন একতা করার ইখতিয়ার রয়েছে। কেননা কার্যতঃ যদিও এরা লুণ্ঠন বা ডাকাতিতে অংশ নেয়নি কিংবা প্রকাশ্য অনুমিত দেয়নি কিন্তু লুণ্ঠিত মালে ভাগ বসিয়েছে। আর ধৃত হওয়ার পর শরীয়তের বিধান এদের হুকুম বানচাল করে ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্থের লোভে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। অথচ তাদের উপর হদ্দ জারী করা ওয়াজিব ছিল। আর আল্লাহ ও বান্দার হক আদায় করা ফরয। তাদেরকে আশ্রয় দিতে ও আশ্রয় দিয়ে হত্যা ও লুণ্ঠনে এরা সমভাবে শরীক রয়েছে। তাই এরাও অপরাধী যাদের সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূলের অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। সুতরাং হযরত আলী (রা)-এর রেওয়ায়েতক্রমে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে- নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“অপরাধ! গুনাহগার এবং অপরাধকারীর আশ্রয়দাতা, এদের উপর আল্লাহ লানত করেছেন”।
কোন লোক সমাজ বিরোধীকে আশ্রয় দিয়েছে বলে যদি প্রমাণিত হয় তবে অপরাধীকে উপস্থিত করার অথবা তার অবস্থান নির্দেশ করার জন্য আশ্রয়দাতার প্রতি নির্দেশ দিতে হবে। যদি নির্দেশ সে যথাযথ পালন করে, তবে উত্তম নতুবা অপরাধী গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত তাকে আটক রেখে তার অবস্থান জানার জন্য প্রয়োজন সাপেক্ষে প্রহার, দৈহিক নির্যাতন চালানো অবৈধ নয়। উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, এমন লোককে সাজা দেয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই যে ব্যক্তি ওয়াজিব মাল আদায় করতে বাধা দেয় অথবা টালবাহানা করে।
প্রার্থিত ধন কিংবা জনের অবস্থান সম্পর্কে যে ব্যক্তি জ্ঞাত, এ সংবাদ প্রকাশ করে দেয়া তার উপর ওয়াজিব। গোপন রাখা তার জন্য আদৌ জায়েয নয়। কেননা প্রকৃতপক্ষে এটা সৎকাজে সহযোগিতার শামিল আর তাকওয়া ও সৎকাজে সহযোগিতা করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে যদি অন্যায়ভাবে জুলুম অত্যাচারের উদ্দেশ্যে কারো জানমালের তথ্য তালাশ করা হয়, তবে এ সংবাদ প্রকাশ করা আদৌ জায়েয নয় কারণ মূলত এটা হল পাপ ও অসৎকাজে সাহায্য করার নামান্তর। বরং এ সংবাদ গোপন রাখা এবং প্রতিহত করা ওয়াজিব। কারণ মজলুমের সাহায্য করা ওয়াজিব। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“তুমি তোমার জালিম কিংবা মজলুম ভাইয়ের সাহায্য কর। আমি বললামঃ হে রাসূলুল্লাহ (সা)! মজলুম ভাইয়ের সাহায্য তো যথার্থ। কিন্তু জালিমের সাহায্য কিরুপে করব? তিনি বললেনঃ তাকে জুলুম করা থেকে বাধা দাও, এটাই তাকে তোমার সাহায্য করা”। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত বারা ইবনে আযিব (রা) থেকে বুখারী, মুসলিমে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা) আমাকে সাতটি জিনিসের হুকুম করেছেন এবং সাত বিষয়ে নিষেধ করেছেন। আমাকে হুকুম দিয়েছেনঃ রোগীর শুশ্রূষা করতে, জানাযায় শরীক হতে, হাঁচির জবাব দিতে, কসম পূর্ণ করতে, দাওয়াত কবূল করতে এবং মজলুমের সাহায্য করতে। আর স্বর্ণের আংটি ব্যবহার, রুপার পাত্রে পান, মোটা, মিহিন, চিকন তথা যাবতীয় রেশমী কাপড় পরিধান এবং জুয়া খেলতে নিষেধ করেছেন।
মোটকথা, অপরাধীর অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তি সূত্র জানাতে অস্বীকার করলে, তা না জানানো পর্যন্ত তাকে আটক রাখা অথবা অন্য কোন সাজা দেয়া জায়েয। কিন্তু সাজার পূর্বে এটা নিশ্চিতরুপে প্রমাণিত হতে হবে যে, ঠিকানা তার জানা আছে। ‘গভর্ণর’ বিচারপতি এবং সংশ্লিষ্ট সবাই গুরুত্বসহকারে এমনভাবে এ হুকুম পালন করবে যে, এ ধরনের জ্ঞাত ব্যক্তিকে সাজা দেয়ার পূর্বে নিখুঁত তদন্তের মাধ্যমে অবশ্যই প্রমাণ করতে নিতে হবে যে, গোপন তথ্য সে জানে। বিষয়টা এমন নয় যে, জানিয়ে দেয়া কেবল তারই উপর ওয়াজিব ছিল, তোমাদের দায়িত্ব পালন তোমাদের উপর ওয়াজিব ছিল না, অথবা এমন নয় যে, একের সাজা অপরকে দিতে হবে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে-
********আরবী
“কোন গুনাহগার অপরের গুনাহ্র বোঝা বহন করবে না”। (সূরা নজমঃ ৩৮)
মহানবী (সা) বলেছেন- ******আরবী
“জেনে রাখবে, প্রত্যেক গুনাহগার নিজের জন্যই গুনাহ করে থাকে”। অর্থাৎ এর কুফল তার নিজেকেই ভোগ করতে হবে।
এর দৃষ্টান্ত, যেমন এক ব্যক্তি কারো জামিন বা উকিলও হয়নি এবং তার কাছ থেকে আদায় করার মতো এমন কোন মালও নাই, এমন লোকের নিকট টাকা দাবী করা অথবা নিজ আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীর কৃত অপরাধের কারণে কাউকে শাস্তি দেয়া অথচ কোন ওয়াজিব তরকের সে অপরাধী নয়, হারাম কাজও সে করেনি, জালিমের ঠিকানা প্রকৃতই তার জানা নাই। কাজেই তাকে সাজা দেয়া জায়েয নয়। সাজা তারই প্রাপ্য, যে প্রকৃত অপরাধী। অবশ্য জানা থাকলে প্রকাশ করা তার উপর ওয়াজিব। এ সহযোগিতা কুরআন, হাদীস ও ইজমার ভিত্তিতে তার উপর ওয়াজিব। আর সাম্প্রদায়িক, গোত্রবাদী লোকদের ন্যায় সে যদি জালিমের অন্যায় সহযোগিতা, আনুকূল্য তার ভয়ে ঠিকানা প্রকাশ করতে অস্বীকার করে কিংবা বিরত থাকে অথবা মজলুমের সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে তথ্য গোপন করতে, তাহলে এ মর্মে আল্লাহ্র ইরশাদ নিম্নরূপ-
*******আরবী
“কোনো মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ স্পৃহা যেন তোমাদের বেইনসাফীর কারণ না হয়। তোমরা ইনসাফ করবে, কেননা ন্যায়পরায়ণতা তাকওয়া-খোদাভীতির সাথে সম্পৃক্ত”। (সূরা মায়েদাঃ 8)
অথবা এও হতে পারে যে, ইনসাফ কায়েম করতে, ভীরুতাবশত দ্বীনের সহযোগিতা করতে অভিযুক্ত অস্বীকার করছে কিংবা আল্লাহ্র দ্বীনকে হেয় করার উদ্দেশ্যে সে অস্বীকার করছে যেমন ধর্ম বিমুখ লোকেরা করে থাকে। এদেরকে যখন বলা হয়- চল আল্লাহ্র পথে জিহাদ করতে তখন এরা নিস্পৃহ হয়ে মাটিতে বসে যায়। মোটকথা, এমন সব লোক সর্বস্তরের আলিমগণের মতে শাস্তিযোগ্য।
এ পথে সক্রিয় ব্যক্তিরা আল্লাহ্র নির্ধারিত হদ্দ এবং বান্দার হক বিনষ্ট করে। নিজেদের বল শক্তি, শৌর্য-বীর্যে দুর্বল এসব লোক সেই ব্যক্তির ন্যায়, যার নিকট জুলুমবাজ ও ধোকাবাজের মালামাল রয়েছে অথচ দ্বীনি দায়িত্ব পালনরত ন্যায়পরায়ণ হাকিম ও শাসকের হাতে সে তা সোপর্দ করছে না। ফলে এর অসহযোগিতার কারণে তাঁরা তাদের কর্তব্য সম্পাদনে বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। কাজেই এরা শাস্তিযোগ্য অপরাধী। কিন্তু তার সংবাদ না দেয়া বা অপরাধী বা অপহৃত মাল হাজির না করার কারণ এই যে, তলবকারী নিজে তার উপর জুলুম-অত্যাচার চালাবে। অন্যথায় সে একজন জনহিতৈষী ও সৎকর্মশীল ব্যক্তি, তবে এটা চিহ্নিত করা সুকঠিন যে, অবৈধ সহযোগিতা কোনটা আর জুলুম-অত্যাচার থেকে বাঁচার প্রেরনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি কোনটা। সন্দেহ এবং রিপুর তাড়না উভয়টি একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা এখানে বর্তমান। কাজেই সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা হাকিমের কর্তব্য।
গ্রাম্য কিংবা শহুরে বিত্তবানদের মধ্যেই সাধারণতঃ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। আত্মীয় বন্ধু কিংবা কোন আশ্রয় প্রার্থী তাদের সাহায্য কামনা করলেই তাদের অন্তরে এ অন্যায় পক্ষপাতিত্বের আগুন জ্বলে উঠে। তদুপরি সমাজের চরিত্রহীন লোকদের মহলে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি কায়েমের লালসাই তাদেরকে এ অন্যায় কাজে উৎসাহিত করে। কাজেই জালিম মজলূম উভয়ের ন্যায্য অধিকার, বৈধ পাওনা তারা নস্যাৎ করে দেয়। বিশেষতঃ মজলূম যদি তাদের নিজেদের সমকক্ষ কোন বিত্তশালী হয়, তবে আশ্রয় প্রার্থীকে সোপর্দ করা তার নিজের জন্য অপমানকর এবং আত্মসম্মানের পরিপন্থী বলে সে বিবেচনা করে। অথচ এটা মূর্খতাপ্রসূত জাহেলী চিন্তার অবৈধ ফসল। বস্তুতঃ এরাই হল দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টির মূল উৎস। বর্ণিত আছে, জাহেলী যুগের অধিকাংশ যুদ্ধ, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এ কারণেই সংঘটিত হয়েছে। স্বজনপ্রীতি ও গোত্রবাদের প্রেরণাই বনু বকর ও বনু তাগলিব ইতিহাস খ্যাত “হরবুল বসূস” (বসূস যুদ্ধ) নামক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে উৎসাহিত করেছিল।* (টীকাঃ তৎকালীন আরবের বিখ্যাত গোত্র ‘বকর’ ও ‘তাগাল্লুব’-এর মধ্যে ‘হরবুল বসূস’ নামে সংঘটিত যুদ্ধের কারণ ছিল-প্রভাবশালী গোত্রপতি “কুলায়ব ওয়ায়েল ইবনে রবীআ” একদিন স্বীয় উটনীর সাথে অপরিচিত অপর এক উটনিকে চরতে দেখেন, যেটি ছিল ‘তামীম গোত্রীয় “বসূস বিনতে মুনকিয”-এর জনৈক অতিথির। স্বীয় উটনীর সাথে তার চারণভূমিতে অপরের উটনী চরে বেড়াবে, ঘাস খাবে? এটা তাঁর আত্মাভিমানকে বিশেষভাবে আহত করে। সাথে সাথে সে তীরের আঘাতে ঐ উটনীর স্তন জখমী করে এবং সেটিকে তাড়িয়ে দেয়। আহত উটনী বাড়ী ফিরলে তা দেখে বসূস মাথায় হাত দিয়ে ****আরবী ‘হায়… রে অপমান’- বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। সাথে ‘বকর’ গোত্রে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বকর গোত্রীয় জনৈক ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে বর্শার আঘাতে কুলায়বকে হত্যা করে। ফলে উভয় গোত্রে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেধে যায়- যা ৮৯১ খৃষ্টাব্দ দীর্ঘ চল্লিশ বছরব্যাপী অবিরাম চলতে থাকে। পরিণামে দুই তরফের অগণিত প্রাণ, অসংখ্য খান্দান বিরাণ ও বরবাদ হয়ে যায়। অথচ এর মূলে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ঘটনাই ছিল না। নিছক কৃত্রিম জাত্যাভিমান, কুল-গৌরব, অন্যায় বাড়াবাড়ি আর সর্বনাশা প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল এ যুদ্ধের প্রধান কারণ।)
অন্ধযুগীয় গোত্রবাদী চিন্তা ও আত্মাভিমানের অনলশিখা দিয়েই তুর্কী-তাতারী বর্বররা মুসলিম জাহানকে ছারখার করতে সক্ষম হয়েছিল। মাওয়ারা উন্ নহর, খুরাসান ইত্যাদির সুলতান বাদশাহদের উপর একই কারণে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করার পথ সুগম হয়েছিল। একই জায়েলী, গোত্রবাদ, জাত্যাভিমান ও আভিজাত্যের মিথ্যা জৌলুসের অন্তরালে তারা মুসলিম সাম্রাজ্য গ্রাস করে সহস্র বছরে গড়া মুসলিম সভ্যতাকে ধুলিস্যাত করে দিতে সক্ষম হয়।* (টীকাঃ পূর্ব পশ্চিম দিগন্ত ব্যাপী আব্বাসী সাম্রাজ্যের ভিত ধ্বসে পড়ার পিছনে অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে আভিজাত্য ও অন্যায় আত্মাভিমানও বহুলাংশে দায়ী ছিল। আরব অনারব, ইরান, রোম থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিশাল ভূখন্ডে যার সীমানা বিস্তৃত ছিল। ইউরোপ এশিয়া ছিল যার প্রভাব বলয়ে, সেই সম্রাট মনসুর আব্বাসী, হারুনুর রশীদ, মামূনুর রশীদের ন্যায় পরাক্রমশালী সম্রাটগণ মানব সভ্যতার বিকাশ সাধনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার উন্মোক্ত করেছিলেন। বিশ্বকে যারা রাজ্য শাসন পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন, এদের উদার নীতির ফলেই ইউরোপীয়রা জ্ঞানের সন্ধান লাভ করেছিল। সাম্রাজ্যের বিশাল বিস্তৃত পরিধিতে তাঁদের প্রেরণাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ, খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ স্থাপিত হয়েছিল। এক কথায় তাঁদেরকে গোটা বিশ্বের শিক্ষক বললেও অত্যুক্তি হবার কথা নয়। তৎকালীন শক্তি হিসাবে তারা ছিলেন মর্যাদার উত্তুঙ্গ চূড়ায়। কিন্তু দ্বীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে (১০৭ খৃ. পর) জাহেলী গোত্রবাদ, মযহাবী দ্বন্দ্ব, শিয়া-সুন্নীর ঝগড়া ইত্যাদি বিচ্ছিন্নতার স্বীকার হয়ে গোটা জাতি হীন বল ও অথর্ব হয়ে পড়ে, যা মহানবী (সা)-এর সময়কালীন ইহূদী খৃষ্টানদের অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যাদের অবস্থা আমরা অনুধাবন করতে পারি কুরআনের ভাষায় যেমন,
***********আরবী
“আর ইহূদীরা বলত নাসারাদের ধর্ম! এটা কোন ধর্মই নয়। পক্ষান্তরে নাসারা বলত ইহূদীদের ধর্মও মূল্যহীন, অথচ উভয়পক্ষই কিতাব পাঠ করে থাকে”। (সূরা বাকারাঃ ১১৩) যাহোক গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, মসজিদে-মাদ্রাসায় এক কথায় সর্বত্র জনগণ থেকে শুরু করে সৈন্যদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও গোত্রবাদের বীজ ছড়িয়ে পড়ে। এহেন আত্মকলহের পরিণতিতে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। শিয়া সম্প্রদায় নিজস্ব রাষ্ট্র কায়েমের চিন্তা করে। অবশেষে এক পর্যায় তারা সুযোগ পেয়েও যায়। আব্বাসী খেলাফতের শিয়া প্রধানমন্ত্রী ‘আলকামী’ ফিরকাবন্দীর সুবাদে চেঙ্গিস খাঁকে খেলাফতের উপর আক্রমণের আহ্বান জানায়। গোত্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অন্তরালে জাতি পূর্ব থেকেই বিচ্ছিন্নতার জালে আটকা পড়েছিল। তাই এখন আর তাতারী দস্যুদের আটকায় কে? সুতরাং বাগদাদে রক্তের স্রোত বহায়ে দেয়া হল। প্রায় দেড় লক্ষ মুসলমানের পবিত্র খুনে মহানগরী বাগদাদ ভাসতে থাকে, যাদের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিল আলিম, ফাজিল, আমীর, ধনী এবং সেনানায়ক। মোটকথা, আত্মকলহ এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ শত শত বছরের সাধনায় গড়া ইসলামী সভ্যতা নিমিষে ধূলিস্যাত হয়ে যায়। এহেন পরিস্থিতিতেও জাতির হুশ ফিরে আসেনি। খাওয়ারযিম শাহ এবং আব্বাসী খলিফাদের মধ্যে পারস্পরিক মতবিরোধ তখন তুঙ্গে। ঘোর, আফগানিস্তান ও ভারতে তখন ‘ঘোরী’ বংশীয়দের রাজত্ব। সালাহউদ্দীন আয়্যূবীর হাতে মিসরের ফাতেমী বংশ নিধন হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতেই খাওয়ারযিম শাহের সমর্থনপুষ্ট হিংস্র তাতারীরা ইসলামী সাম্রাজ্যে চরম আঘাত হানে। ফলে ইসলামী সাম্রাজ্য, এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ তাতারীদের অধিকারে চলে যায়। এমনিতর সহস্রাধিক বছরের প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়া ইসলামী সভ্যতা ও মুসলিম সাম্রাজ্য আত্মহননের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। তাই ******আরবী চিন্তাকর হে জ্ঞানীজন!
যেই খেলাফতের বুনিয়াদ স্বয়ং মহানবী (সা) রেখেছিলেন মদীনা তাইয়্যেবাতে, হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা), হযরত ফারুক আযম (রা) *******আরবী “আমাদের ধর্মে নেতৃত্বের বিকাশ কেবল সেবা” নীতিতে পরিচালনা করেছিলেন, কুরআন-সুন্নাহ যার মূলনীতি, আসমান থেকে নাযিল হয়েছে যার সংবিধান, যে খেলাফত অর্ধশতাব্দীরও কম সময়ে অর্ধেক দুনিয়া পদানত করেছিল, সারা বিশ্বে যার প্রতিপত্তির দুর্বার গতি বিশ্ব মানবকে শাস্তি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল, যে খেলাফতকে মানব জাতির নিরাপত্তার প্রাণকেন্দ্র মনে করা হতো, যে খেলাফত মানব সমাজে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, সহমর্মিতা, খোদাভীতি, ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিল, যা ছিল মানব জাতির কল্যাণে এক খোদাই অনুগ্রহ, যে খেলাফত ছিল দ্বীন দুনিয়ার সার্বিক সংস্কারের গ্যারান্টিস্বরুপ, আরবের বিবদমান গোত্রগুলোর মিলনকেন্দ্র ছিল যে খেলাফত এবং যার প্রতি তাকিয়ে আকাশের ফেরেশতাগণ পর্যন্ত নীড় বাঁধার কামনা করতো, এমনিভাবে অতীতের গর্ভে তার বাস্তব রুপ বিলীন হয়ে গেল। এভাবে অন্যায়, অত্যাচার, ভোগবিলাস ও পাপাচার ব্যক্তি পরিবার গোত্র তথা জাতিকে সমূলে বিনাশ করে, তদ্রূপ আলস্য, লোভ-লালসা, আভিজাত্য, জাত্যাভিমান জাতির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়। *******আরবী “সুতরাং জ্ঞানীজনদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত”। )ইতিহাসে এর অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্র জন্য নিজেকে হেয় করে, আল্লাহ তাকে মর্যাদাশালী করেন। যে ব্যক্তি ন্যায় বিচার করে, নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান মনে করে; আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন। কেননা খোদাভীরু, মুত্তাকী-পরহেযগাররাই আল্লাহ্র নিকট সম্মানী ও অধিক মর্যাদাবান। কিন্তু যে ব্যক্তি সত্যকে নস্যাৎ, জোর-জুলুম দ্বারা মর্যাদা লাভের প্রয়াস চালায়, সে গুনাহগার-পাপী, আল্লাহ তাকে অপমানিত করেন এবং নিজের কৃত কর্মের দ্বারাই সে লাঞ্ছিত হয়। আল্লাহ বলেন-
*******আরবী
“নিজের সম্মানেরই যে প্রত্যাশী তার জানা উচিত, সম্মান কেবল আল্লাহ্রই জন্য নির্ধারিত”। (সূরা ফাতিরঃ ১০)
মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
**********আরবী
“কপট বিশ্বাসী মুনাফিকরা বলে, আমরা মদীনায় ফিরে গেলে সেখানকার সম্মানী লোকেরা লাঞ্ছিতদের বের করে দেবে, অথচ প্রকৃত সম্মান,আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের জন্য, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না”। (সূরা মুনাফিকূনঃ ৮)
এ জাতীয় চরিত্রের লোকদের সম্পর্কে আরো ইরশাদ হচ্ছে-
*******আরবী
“ হে নবী! কোন কোন লোকের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা আপনার নিকট আকর্ষণীয় মনে হয় আর তারা অন্তরের বাসনা সম্পর্কে আল্লাহকে সাক্ষী বানায়, অথচ আপনার দুশমনদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে মারাত্মক ঝগড়াটে। আর ফিরে যাওয়ার পর তারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে। ক্ষেতের শস্যাদি, মানুষ ও প্রাণীর বংশধারা বিনষ্ট করতে তারা সক্রিয় হয়ে পড়ে, আর আল্লাহ ফেৎনা-ফাসাদ ভালবাসেন না। এরূপ ব্যক্তি যদি বলা হয়, আল্লাহকে ভয় করো, তখন তার অসার অহংকার ও গৌরববোধ তাকে গুনাহে লিপ্ত করে দেয়। সুতরাং এহেন ব্যক্তির জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট, যা অতিশয় মন্দ ও নিকৃষ্ট আবাসস্থল”। (সূরা বাকারাঃ ২০৪-২০৬)
সুতরাং আশ্রয়প্রার্থী যথার্থই মজলূম কিনা এটা যাচাই করে নেয়া আশ্রয়দাতার কর্তব্য। প্রকৃতই যদি সে নির্যাতিত নিপীড়িত হয় তবে তাকে আশ্রয় দেবে। আর শুধু দাবী করলেই মজলূম প্রমাণিত হয় না বরং এর পিছনে সঠিক কারণ ও কার্যকর ভূমিকা থাকতে হবে। কেননা, অনেক সময় দেখা যায়, এক ব্যক্তি নিজেকে নির্যাতিত বলে কাৎরাচ্ছে অথচ নিজেই সে জালিম অত্যাচারী। এজন্য তার পার্শ্ববর্তী লোকদের নিকট কোনো প্রতিপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা জেনে নিতে হবে। যদি সে প্রকৃত জালিম বলে অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়, তবে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে জুলুম থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করবে, বিনম্র ব্যবহার দ্বারা তাকে সৎ পথে আনতে সচেষ্ট হবে, সম্ভব হলে উভয়পক্ষকে ডেকে নিয়ে মীমাংসার উপায় খুঁজবে, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করবে। সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে, তাকে রাষ্ট্রীয় আইনের হাতে সোপর্দ করে দেবে।
অবস্থা যদি এমন হয় যে, পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকেই জালিম আবার মজলূমও যেমনটি নসফের গোলাম ও ভোগবাদীরা সচরাচর হয়ে থাকে, যেমন কায়েস ও ইয়ামনী গোত্রসমূহ, শহর ও পল্লীবাসীদের মধ্যে প্রায়শঃ তা লক্ষ্য করা যায়। অথবা পক্ষদ্বয়ের কেউই জালিম নয় কিন্তু কোন সন্দেহের বশবর্তী কিংবা কোন ভুল ব্যাখ্যাজনিত কারণে তারা পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় বিরোধের মূল সমস্যা মীমাংসার চেষ্টা করবে, এমনকি দরকার হলে সালিশের আশ্রয় নিতে হবে। আল্লাহ বলেছেন-
************আরবী
“ মুমিনদের দু’টি দল যদি পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তাদের বিবাদ মিটিয়ে দাও, আর তাদের এক পক্ষ যদি অপর পক্ষের উপর জুলুম করে, তবে আল্লাহ্র বিধানের প্রতি প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত জালিম দলের বিরুদ্ধে লড়াই কর। অতঃপর যদি তারা ফিরে আসে তবে, সাম্য ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে তাদের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন। মুমিনগণ হচ্ছে পরস্পর ভাই ভাই। তাই নিজের ভাইদের মধ্যে তোমরা মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর, পরিণামে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হবে”। (সূরা হুজুরাতঃ ৯-১০)
আরো ইরশাদ হচ্ছে-
*************আরবী
“ তাদের অধিকাংশ পরামর্শে কোনই কল্যাণ নেই, অবশ্য যে ব্যক্তি দান-খয়রাত, সৎ কর্ম এবং মানুষের মধ্যে কল্যাণধর্মী পরামর্শ দান করে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় এরূপ করবে, তাকে আমি বিরাট সওয়াব দান করব”। (সূরা নিসাঃ ১১৪)
নবী করীম (সা) থেকে আবূ দাঊদে বর্ণিত আছে, তাঁকে প্রশ্ন করা হলোঃ “কোন ব্যক্তিকে সত্যের ব্যাপারে নিজ গোত্রের সাহায্য সহায়তা করা কি অন্ধযুগীয় সাম্প্রদায়িকতা?” তিনি বলেন (***আরবী) না। তিনি আরো বললেন-
*******আরবী
বরং কোন ব্যক্তির অন্যায় কাজে নিজ গোত্রের সাহায্য করাই হলো সাম্প্রদায়িকতা। তিনি বলেন-
********আরবী
“ তোমাদের মদ্ধএ সেই ব্যক্তি উত্তম প্রতিরোধকারী, যে কোনো অপরাধে লিপ্ত না হয়ে নিজ গোত্রের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করে”।
মহানবী (সা) বলেছেন-
*********আরবী
“ যে ব্যক্তি অন্যায় কাজে আপন গোত্রের সাহায্য করে, সে ঐ উটের মতো যে উট কূয়ায় পড়ে লেজ নাড়ে”।
তিনি আরো ফরমান-
*********আরবী
“ যার সম্পর্কে তোমরা শুনতে পাও যে, সে মূর্খতার পতাকা উড়িয়েছে, তখন তাকে মূল থেকে উপড়ে ফেল, যেন সে বাড়তে না পারে”।
মোটকথা, ইসলাম ও কুরআনের দাওয়াতের বিপরীত বংশগত, দেশ ও জাতিগত, ধর্মীয় কিংবা অন্য যে-কোন আবেদন নিবেদন, ডাক-আহ্বান ও ব্যাখ্যা সব জাহিলিয়াত তথা প্রাক ইসলামী যুগের মূর্খতার অন্ধকার। এমনটি যে করবে, সে যেন মূর্খতার ঝান্ডা উড়িয়ে দিল। বরং সে মুহাজির ও আনসার হচ্ছে সেই ব্যক্তিদ্বয়ের অনুরূপ যারা ঘটনাচক্রে পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হলে, মুহাজির চিৎকার দিয়ে উঠল-*******আরবী (হে মুহাজিরগণ!) আর আনসার আর্তনাদ করল- ******আরবী (হে আনসারগণ!) বলে”। তাই সে পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ (সা) কে ইরশাদ করতে হলো- *******আরবী
“তোমরা কি জাহিলিয়াতের নামে ঝাঁপিয়ে পড়লে, অথচ আমি স্বয়ং তোমাদের মধ্যে বর্তমান”।
মোটকথা, তিনি তাদের আচরণে গভীর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।