[এক]
শরীয়তী শাসন কর্তৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য
প্রথম পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু হলোঃ নেতৃত্বের অধিকারী, পৌর কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় প্রশাসকবৃন্দ, বিচারকমন্ডলী, বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, অর্থবিভাগীয় কর্মকর্তাগণ, মন্ত্রীবর্গ, মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ, সাদকা-খয়রাত ও সরকারী যাকাত আদায়কারীগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত আলোচনা।
দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারটি দুই প্রকার। (১) কর্তৃত্ব এবং নেতৃত্ব। মহানবী (সা) যখন মক্কা জয় করেন, তখন তিনি কা’বা শরীফের চাবিসমূহ বনী শাইবা থেকে নিয়ে নিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চাচা আব্বাস (রা) এ সকল চাবি চেয়ে বসলেন যেন হাজীদের পানি পান করানোর ব্যবস্থাপনা এবং একই সাথে কা’বার অভিভাবকত্ব লাভ ও কা’বার খেদমতের দায়িত্ব নিজে পেতে পারেন। কিন্তু তাঁর এই আগ্রহ আল্লাহ্ পছন্দ করেননি। তিনি আয়াত নাযিল করলেন এবং কা’বা শরীফের কার্যসমূহ পূর্ববর্তী খাদেম বনী শাইবার লোকদেরকেই প্রদান করার নির্দেশ দিলেন। অতএব এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, নেতার জন্যে ফরয (কর্তব্য) হচ্ছে মুসলমানদের কোন কাজকে এমন ব্যক্তিদের হাতে সোপর্দ করা, যারা ঐ কাজের জন্যে অধিক যোগ্যতার অধিকারী। যেমন মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন,
*******(আরবী)
“মুসলমানদের কোন কাজে কেউ কর্তৃত্ব লাভ করার পর যদি সে এমন এক ব্যক্তিকে শাসক নির্বাচন করে, যার চাইতে সেই এলাকায় অধিক যোগ্যতর মুসলমান রয়েছে, তাহলে সে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো”।
********(আরবী)
যে (রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা) সেনাবাহিনীতে এমন ব্যক্তিকে নেতা নির্ধারণ করে, যার চাইতে জাতীয় সেনাবাহিনীতে আরও যোগ্যতর ব্যক্তি রয়েছে, সে আল্লাহ্ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকতা করলো মুসলমানদের সাথে। (আল হাকিম তাঁর সহীহ হাদীস সংকলনে এটি রেওয়ায়েত করেছেন।)
কোন কোন আলিম এটিকে হযরত উমরের (রা) বাণী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, হযরত উমর (রা) একথাটি তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন। উমরের (রা) ছেলেই একথার বর্ণনাকারী। হযরত উমর (রা) বলেন,
*********(আরবী)
“যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন ব্যাপারে (নির্বাহীর) দায়িত্ব পেয়ে (যোগ্যতর লোককে বাদ দিয়ে) এমন ব্যক্তিকে কর্মকর্তা নিযুক্ত করে, যার সঙ্গে তার স্নেহের সম্পর্ক আছে কিংবা সে তার স্বজন, তবে সে আল্লাহ্, আল্লাহ্র রাসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো”।
বিষয়টির ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করা শাসনকর্তাদের প্রথম কর্তব্য। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে কোন্ লোক প্রকৃত যোগ্য, শহর ও পৌর এলাকাসমূহে (এবং স্থানীয়) প্রশাসনে কি ধরনের সরকারী প্রতিনিধি বা কর্মকর্তা নিয়োগ বাঞ্ছনীয়, এ ব্যাপারে যাচাই-বাছাই ও পরামর্শ করা অপরিহার্য। কারণ, যারা সেনা ইউনিটের কমান্ড অফিসার হবে, যারা ছোট বড় ইসলামী সেনাদলের নেতৃত্ব দেবে, যারা মুসলমানদের নিকট থেকে নানা প্রকার শুল্ক কর আদায় করবে, যারা জনগণের অর্থ ব্যবস্থার নিয়োজিত থাকবে, তারাই এসবের নিয়ন্ত্রক। সরকারী প্রশাসনিক কাজ কর্মের পরিচালকও তারা। এজন্যে উচ্চ কর্মকর্তা ও প্রধান শাসকের জন্যে একান্ত অপরিহার্য বিষয় হলো, এমন সব লোককে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ দান ক্রা, যারা মুসলমানদের জন্য উত্তম এবং যোগ্য বলে গণ্য। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যোগ্য লোক থাকতে যাতে কোন অযোগ্য ব্যক্তি নিয়োগপত্র পেয়ে না যায়। এ নীতি রাষ্ট্রীয় সকল প্রশাসনিক বিভাগে অবশ্যই পালনীয়। যেমন, নামাযে ইমাম ও মুয়ায্যিন, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক, হজ্জ অনুষ্ঠানে খতীব বা কর্মকর্তা, খাবার পানির ব্যবস্থাপক, (নদ-নদী, খাল) ঝর্ণার তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সংরক্ষক, সেনানিবাসের প্রহরী, সেখানকার অস্ত্রনির্মাতা, অস্ত্রাগারে পাহারাদার, ছোট বড় বিভিন্ন বাহিনীর পরিচালক, বাজারের শূল্ক আদায়কারী, গ্রামীণ তথা স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এদের প্রত্যেকের নিয়োগে সততা ও যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
কেউ মুসলিম সমাজের নেতা ও শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হলে তাঁর দায়িত্ব হলো নিজের অধীনস্থ এমন সব লোককে কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ করা, যারা সৎ বিশস্ত এবং সংশ্লিষ্ট কাজের ব্যাপারে দক্ষ, পারদর্শী। এমন সব ব্যক্তিকে কিছুতেই সামনে এগিয়ে দেয়া উচিত নয়, যারা নিজেরাই কর্তৃত্ব পাবার খাহেশ পোষণ করে কিংবা পদের দাবী করে। বরং যারা পদলোভী, উক্ত পদ পাবার প্রশ্নে তাদের এই লোভই হচ্ছে বড় অযোগ্যতা। সহীহ আল বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে,
******(আরবী)
রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা তাঁর দরবারে কিছু লোক উপস্থিত হয়ে তাঁর পক্ষ থেকে শাসন কর্তৃত্ব প্রাপ্তির অনুরোধ জানালো। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ যারা স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব চায়, আমরা এমন লোককে কোন কিছুর কর্তৃত্ব দেই না। (বুখারী-মুসলিম)
আবদুর রাহমান ইবনে সুমারা কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
*******(আরবী)
“ হে আবদুর রহমান! নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব চেয়ে নিও না। অপ্রার্থিতভাবে যদি তোমার হাতে নেতৃত্ব আসে, তাহলে তুমি দায়িত্ব পালনে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সাহায্য পাবে আর যদি তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নাও, তাহলে সেটার (ভালমন্দের) পুরো দায়িত্ব তোমার উপরই বর্তাবে (এবং তুমি আল্লাহ্র সাহায্য পাবে না”।)
মহানবী (সা) বলেছেন,
*****আরবী
“যে ব্যক্তি বিচরকের পদ চায় আর এজন্য কারুর সাহায্য প্রার্থনা করে, তার উপর সে কাজের (ভালমন্দ) সোপর্দ করা হবে। আর যে বিচারকের পদ দাবী না করে এবং এজন্যে কারুর সাহায্য না চায়, তা হলে আল্লাহ্ তা’আলা তার জন্য একজন ফেরেশতা পাঠান। ঐ ফেরেশতা তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে”। (আহলুস সুন্নাহ)
অতএব প্রধান শাসক যদি দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলেন এবং অধিক সৎ যোগ্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে বন্ধুত্ব, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বদেশীকতা যেমন ইরানী, তুর্কী, রোমী কিংবা অপর কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন, তাহলে সেটা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। ঠিক তেমনিভাবে উৎকোচ অথবা অপর কোন সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন সংকীর্ণ স্বার্থ যদি কারও নিয়োগের কারণ হয় অথবা যোগ্য সৎ ব্যক্তির প্রতি কপটতা ও বৈরিতার কারণে তাকে বাদ দিয়ে অযোগ্য অসাধু ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটাও অবশ্যই আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও সাধারণ মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বৈ কিছু নয়। আল্লাহ্ তা’আলা এহেন বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে নিষেধ করে বলেছেন-
*******আরবী
“হে মুমিনগণ ! জেনে শুনে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করো না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানত সম্পর্কেও না”। (সূরা আনফালঃ ২৭)
অতঃপর আল্লাহ্ ইরশাদ করেন,
******আরবী
‘জেনে রেখো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হচ্ছে একটি ফিৎনা বা পরীক্ষা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র নিকটই রয়েছে বিরাট প্রতিদান।(সূরা আনফালঃ২৮)
মহান আল্লাহ্র একথা বলার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, মানুষ অনেক সময় নিজ সন্তান ও আপনজনদের ভালবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় কোন গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে বসে। অযোগ্যকে ক্ষমতার অধিকারী বানিয়ে দেয়। এটা অবশ্যই আল্লাহ্র আমানতে খেয়ানত ছাড়া কিছু নয়। এমনিভাবে সম্পদের প্রাচুর্য ও অর্থের পাহাড় গড়ে তোলার ব্যাপারে তার আগ্রহের শেষ থাকে না। তার এই সম্পদপ্রীতি তাকে অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে এবং অন্যায়ের প্রবৃত্ত হতে বাধ্য করে। সে অন্যায়, অবৈধ পন্থায় সম্পদ লাভ করতে গিয়ে জনগণকে শোষণ করে। কোন কোন এলাকার আঞ্চলিক শাসক বা বড় সরকারী কর্মকর্তা এমন চরিত্রের হয়ে থাকে যে, সে ঊর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিকে তোষণে পারদর্শী। ফলে তোষামোদী লোকদেরকে অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আপন লোকদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে বসে। এহেন ব্যক্তি নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও আমানতের খেয়ানত করে।
দায়িত্বপূর্ণ সরকারী ব্যক্তি যদি আল্লাহ্কে ভয় করে লোভ সংবরণ করতে পারে এবং নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হয়, তাহলে আল্লাহ্ তাকে ন্যায়নীতির উপর অটল থাকতে সাহায্য করে। তাকে সকল প্রতিকূলতা থেকে হেফাযত করেন।
যে শাসক নিজ প্রবৃত্তির দাস, আল্লাহ্ তাকে শাস্তি দেন। তার উদ্দেশ্য ও আশা আকাংখার স্বপ্নসৌধকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেন। তার সন্তান-সন্ততি ও পরিবার-পরিজনকেও অসম্মানজনক অবস্থায় রাখেন। সে হারায় তার অবৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদসমূহ।
এ সম্পর্কে একটি বিখ্যাত ঘটনা আছে যে, একবার আব্বাসী শাসকদের একজন আলিমদের ডেকে বললেন, আপনারা নিজেদের দেখা কিংবা শোনা কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করুন। একবার উমর ইবনে আবদুল আযীযকে (রহ) আমি দেখেছি, জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললো,” আমীরুল মু’মিনীন! আপনি আপনার সন্তানদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে দূরে রেখেছেন। তাদেরকে ফকীর ও অসহায় অবস্থায় রেখে যাবার পথ করেছেন। তাদের জন্যে আপনি কিছুই রেখে যাচ্ছে না”। উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ) তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তিনি বললেন, ঠিক আছে, সন্তানদেরকে আমার সামনে হাজির করো। তাদের সকলকে সামনে হাজির করা হলো। খলীফার সন্তান সংখ্যা ছিল উর্ধ্বে। তাদের সকলেই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। সন্তানদের দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, বৎসগণ! তোমাদের যা হক ছিল তা আমি তোমাদের পুরোপুরি দিয়ে দিয়েছি-কাউকে বঞ্চিত করিনি। এছাড়া জনসাধারণের কোন সম্পদ আমি তোমাদের দিতে পারবো না। তোমাদের প্রত্যেকের অবস্থা তো এই যে, হয় তোমরা সৎ সাধু ব্যক্তি হবে আর আল্লাহ্ তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী, নয় তোমরা অসৎ ও অসাধু হবে। আমি অসৎ ও অসাধু ব্যক্তিদের জন্যে কিছুই রেখে যেতে চাই না। কারণ ঐ অবস্থায় তারা আল্লাহ্র অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে। *****আরবী “যাও, সকলে এবার আমার নিকট থেকে যেতে পারো, এটুকুনই আমার কথা”।
অতঃপর তিনি বলেন, মহাপ্রাণ উমর ইবনে আবদুল আযীযের সেই সন্তানদেরকেই আমি পরবর্তীকালে দেখেছি, তাদের কেউ কেউ শত শত ঘোড়ার অধিকারী ছিলেন, সেগুলো আল্লাহ্র রাস্তায় দান করেছেন। ইসলামের মুজাহিদগণ সেগুলোর উপর সওয়ার হয়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করতেন।
অতঃপর সেই আব্বাসী খলীফা বললেন, উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ) ছিলেন “খলীফাতুল মুসলিমীন”।
পূর্বে তুর্কীদের দেশ এবং পশ্চিমে মরক্কো ও স্পেন তাঁর শাসনাধীন, সাইপ্রাস দ্বিপ, সিরীয় সীমান্তবর্তী এলাকা, তরসূস ইত্যাদিতে তাঁর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। দক্ষিণে ইয়ামেনের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছিল তাঁর শাসনের। এতদসত্ত্বেও তাঁর সন্তানরা পৈত্রিক উত্তরাধিকার থেকে অতি সামান্য কিছুরই মালিক হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদের পরিমান যা ছিল তা সন্তানদের মাথা পিছু বিশ দেরহামের চাইতেও কম ছিল।১ ( আল্লাহ্ নেক বান্দাদের সাহায্য করেন, যেমন ‘উমর ইবনে ‘আবদুল আযীযের (রহ) সন্তানদের করেছিলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে তারা তেমন কিছু পায় নাই। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের এমন সাহায্যই করেছিলেন যে, প্রত্যেকই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ “আমার অভিভাবক তো আল্লাহ্ যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনিই সৎকর্মপরায়ণদের অভিভাবকত্ব করে থাকেন।(৭:১৯৬)-সম্পাদক ) অথচ ঐ সময়ই আমি খলীফাদের মধ্যে এমন সব শাসকও দেখেছি, যারা এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ রেখে গিয়েছিল যে, তাঁদের মৃত্যুর পর যখন সন্তানরা সেগুলো নিজের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করছে, তখন প্রত্যেকের ভাগে ৬শ’ কোটি পর্যন্ত ‘আশরাফী’ পড়েছে। তারপরও ঐ সকল সন্তানের কেউ কেউ শেষে ভিক্ষা করতো। এ সম্পর্কে অসংখ্য কাহিনী, চাক্ষুষ ঘটনাবলী এবং পূর্ববর্তীদের শ্রুত অনেক অবস্থার কথা বিক্ষিপ্তভাবে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। সেগুলোকে জ্ঞানবানদের জন্য বহু কিছু শিক্ষার আছে।
নবী জীবনের আদর্শ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতাও একটি আমানত, এই আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা ‘ওয়াজিব’।
বিভিন্নভাবে পূর্বাহ্নেই এ বিষয়ে হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। আবু যর গিফারী (রা)-কে মহানবী (সা) নেতৃত্ব সম্পর্কে বলেছেন,
*******আরবী
“ নেতৃত্ব হচ্ছে একটি আমানত। এ নেতৃত্ব (ক্ষেত্র বিশেষে) কিয়ামতের দিন লজ্জা ও অনুতাপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে যিনি ন্যায়-নীতি ভিত্তিক নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন এবং এর হক সঠিকভাবে পালন করেছেন, তার কথা আলাদা”। (মুসলিম)
ইমাম বুখারী (রহ) কর্তৃক সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরায়রার (রা) একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে,
************আরবী
মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন, “আমানত নষ্ট (তথা খেয়ানত) হতে থাকলে তোমরা কিয়ামতের প্রতীক্ষায় থেকো”। বলা হলো, হে আল্লাহ্র রাসূল! “আমানত নষ্ট” বলতে কি বুঝায়? হযরত বললেন, যখন শাসন ক্ষমতা ও নেতৃত্ব কর্তৃত্বের আসনে অযোগ্য ব্যক্তিদের আগমন ঘটে, তখন তোমরা কিয়ামতের প্রতীক্ষায় থেকো। (বুখারী)
আমানতের এই অর্থের প্রেক্ষিতেই এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ্র ‘ইজমা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ইয়াতীমের অভিভাবক বা অসী, ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক এবং কোন দায়িত্বে নিয়োজিত ইনচার্জ বা প্রতিনিধির যদি সংশ্লিষ্ট মালিকের সম্পদ থেকে ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন উত্তম পদ্ধতিতে তা ব্যয় করবে ( অর্থাৎ স্বীকৃত পরিমাণের বেশী ব্যয় করবে না এবং কোনরূপ আত্মসাৎ করবে না।) যেমন আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন ,
********আরবী
“ইয়াতীম বয়োঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্য ছাড়া তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হইও না”।
শাসক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা হচ্ছেন বকরীর রাখালের ন্যায় জনগণের রক্ষক বা তত্ত্বাবধায়ক। যেমন, মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“ তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের রক্ষক। প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যিনি নেতা, তাঁকে তাঁর অধীনস্থ জনগণের কার্যবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের রক্ষক। উক্ত গৃহে যা তার কর্তৃত্বাধীন সে ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সন্তান তার পিতৃ সম্পদের রক্ষক, সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। দাস ভৃত্য তার মনিবের মাল-সম্পদের রক্ষক। তাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। সাবধান! মনে রেখো, তোমাদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জন্য রক্ষক। সকলকে নিজ নিজ অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে”।
মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন যে,
*******আরবী
“ আল্লাহ্ যাদেরকে অপরের উপর রক্ষণা বেক্ষণের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়েছেন, সে যদি তার দায়িত্ব পালনে উদাসীন থেকে মারা যায়, আল্লাহ্ তার জন্যে বেহেশতের গন্ধও হারাম করে দেবেন”। (মুসলিম)
একবার আবু মুসলিম খাওলানী (রহ) হযরত মুআবিয়া (রা) ইবনে আবু সুফিয়ানের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন,
******আরবী
“(হে মজুর! তোমার প্রতি সালাম )”
দরবারে সভাসদগণ বললেন – ‘আইউহাল আজীর’ না বলে **আরবী বলুন। তিনি অতঃপর বললেন, ******আরবী পুনরায় বলা হলো “আইউহাল আমীর” বলুন। কিন্তু আবু মুসলিম খাওলানী একই বাক্যের তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন। উপস্থিত লোকজন বার বার তাঁকে ‘আইউহাল আমীর’ বলতে স্মরণ করিয়ে দেন। অবশেষে আমীর মু’আবিয়া বললেন, আবু মুসলিমকে তোমরা বলতে দাও। তাঁর কথার অর্থ তিনিই ভাল জানেন। অতঃপর আবু মুসলিম বললেন, হে মু’আবিয়া! তুমি একজন মজুর। এই বকরীর দলের দেখা শোনা করার জন্যে তোমাকে বকরীর প্রভু মজুরীর ভিত্তিতে নিয়োগ করেছেন। তুমি যদি চর্ম রোগাক্রান্ত বকরীরসমূহের তত্ত্বাবধান কর এবং রুগ্ন বকরীগুলোর চিকিৎসা করে সেগুলোর রক্ষণা বেক্ষণ কর, তাহলে বকরীর মালিক তোমাকে এর মজুরী দেবেন। আর যদি চর্ম রোগাক্রান্ত বকরীগুলোর খোঁজখবর না নাও, রুগ্ন বকরীসমূহের চিকিৎসা না কর এবং সেগুলোর রক্ষণা বেক্ষণে যথাযথ দায়িত্বের পরিচয় না দাও, তাহলে এগুলোর মালিক তোমাকে শাস্তি দেবেন”।
একজন শাসকের উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণের জন্যে এ ঘটনাটিই যথেষ্ট। কারণ, গোটা মানবজাতিই হচ্ছে আল্লাহ্র বান্দা। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ হচ্ছেন আল্লাহ্র বান্দাদের পরিচালনার জন্যে তাঁরই প্রতিনিধি। জনগণের জানমাল মানসম্ভ্রম সবকিছুর হেফাযতের দায়িত্ব তাঁদের উপর ন্যস্ত।
দেশের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক এবং কৃষি ফসল উৎপাদনদের উৎসভূমি সংক্রান্ত ব্যাপারে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও এসব ব্যাপারে অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য কোন ব্যক্তিকে ঐ পদের নিয়োগ প্রদান করা অবশ্যই খেয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার কাজ। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এমন কাজ করলে তিনি খেয়ানতকারী হবেন। কারণ দেশের অর্থনীতি ও এর প্রাণসত্তা কৃষি শিল্প বাণিজ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ব্যক্তি ব্যবসায়ে পণ্য উপকরণাদি অন্যায্য দামে বিক্রি করে দেবে। ভাল এবং সাধু খরিদদার, যিনি অতিরিক্ত বা ন্যায্য মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও, হুমকি, বন্ধুত্ব ও নিকটাত্মীয়তার দরুন তাকে ন্যায্য মূল্যে পণ্য সামগ্রী না দেওয়া খেয়ানত ছাড়া কিছু নয়। তাতে পণ্য সামগ্রীর মালিক অবশ্যই তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হবেন এবং নিন্দা জ্ঞাপন করবেন।
কাজেই রাষ্ট্রীয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফরয হলো, কোন খেয়ানকারী ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বা শাসন পরিচালক না করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতি কিংবা ভূমি ইত্যাদির ব্যাপারে ভাল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে সরকারী প্রতিনিধি বা শাসক নিয়োগ করা।
[দুই]
ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্বের যোগ্যতা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় হলোঃ যোগ্যতর ব্যক্তিকেই ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্ব দেয়া উচিত। যোগ্যতর ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেও যোগ্য ব্যক্তিকেই ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্ব প্রদান। প্রশাসনিক প্রত্যেক স্তরের বিভিন্ন পদের আদর্শ ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন ও প্রতিনিধি করা। শাসন কর্তৃত্বের জন্যে শক্তি ও বিশ্বস্ততার অপরিহার্য, যেন শরীয়তি বিধানের প্রয়োগ ও জনগণের অধিকার আদায়ের কাজ সহজ হয়। বিচারকের প্রকারভেদ।
উপরোক্ত আলোচনার পর এখন এটা অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, নেতার উপর কি ফরয? সংক্ষেপে বলতে গেলে তা হলো, তিনি এমন সব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, কর্মকর্তা কিংবা দেশের কোন এলাকার শাসক নিযুক্ত করবেন, যারা সৎ ও যোগ্য। তবে কোন কোন সময় এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, কাজের জন্য ইপ্সিত যোগ্যতাসম্পন্ন লোক পাওয়া যায় না। সে সময় নেতার কর্তব্য হলো আপেক্ষিক যোগ্যতার ভিত্তিতে ঐ কাজে লোক নিয়োগ করা। প্রত্যেক পদের জন্য তুলনামূলক বিচারে যে যোগ্য, তাকেই সে পদে বসানো। পূর্ণ নিরপেক্ষতা, সততা ও বিচার বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে যদি নেতা এ কাজটি সমাধা করেন, তাহলে তিনি তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করলেন। আর তখনই তাঁকে ন্যায়পরায়ণ নেতা বলা যাবে। মহান আল্লাহ্র কাছেও তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে বিবেচিত হবেন। অবশ্য তারপরও বিভিন্ন কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা দেবে না, এমনটি জোর দিয়ে বলা যায় না। তবুও এছাড়া আর করারই বা কি থাকবে। আল্লাহ্ তায়ালাও সম্ভাব্য চেষ্ঠার কথাই বলেছেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছেঃ
********আরবী
“ হে মুসলমানগণ! তোমাদের দ্বারা যতটুকুন সম্ভব তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করে চলো”। (সূরা তাগাবুনঃ ১৬)
********আরবী
“ আল্লাহ্ কারুর উপর তার সাধ্যাতীত বোঝা অর্পণ করেন না। (সূরা বাকারাঃ ২৮৬)
জেহাদের নির্দেশ দিতে গিয়ে আল্লাহ্ বলেছেনঃ
****আরবী
“তোমরা আল্লাহ্র পথে দুশমনদের সাথে লড়ো। তোমরা আপন সত্তা ব্যতীত অপর কারুর দায়িত্ব তোমরা উপর নেই। তবে হাঁ, অন্যান্য মুসলমানদেরও এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করো। (সূরা নিসাঃ৮৪)
আল্লাহ্ আরও ইরশাদ করেনঃ
*******আরবী
“ হে মুমিনগণ! তোমরা নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকো। তোমরা সঠিক পথে থাকলে, গোমরাহ্ ব্যক্তিরা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না”। (সূরা মায়েদাঃ ১০৫)
এতএব প্রশাসনিক সকল পর্যায়ে যেই শাসক বা কর্তৃপক্ষ সৎ লোক নিয়োগ সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করবেন না এবং আপন কর্তব্য পালনে পূর্ণ সচেষ্টা হবেন, তাতে ধরে নেয়া যাবে যে, তিনি হেদায়েত বা সঠিক পথের অনুসারী।
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
********আরবী
“ আমি যখন তোমাদের কোন কাজের নির্দেশ দেই, তখন তোমরা তা নিজেদের সাধ্যানুযায়ী করো”। (বুখারী-মুসলিম)
তবে কোন ব্যক্তি যদি শরীয়তের অসমর্থিত অক্ষমতার অজুহাত দেখিয়ে উক্ত কাজে ত্রুটি করে, তাহলে সেটা খেয়ানত হবে। তাকে সেই কর্তব্য অবহেলাজনিত খেয়ানতের শাস্তি প্রদান করা হবে। কাজেই তার কর্তব্য হলো, যোগ্যতর দক্ষ ও কল্যাণকর কোনটি, তা ভালোভাবে জেনে নেয়া এবং প্রত্যেক পদের জন্য যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা। কারণ, কোন কিছুর কর্তৃত্ব-ক্ষমতার দুটি স্তম্ভ রয়েছে, একটি শক্তি, অপরটি আমানত বা বিশস্ততা। যেমন কুরআন মজীদের ইরশাদ হচ্ছে-
*******আরবী
তোমার ভৃত্য হিসাবে সেই-ই অতি উত্তম ব্যক্তি হবে, যে সবল ও বিশস্ত। (সূরা কিসাসঃ২৬)
মিসর সম্রাট হযরত ইউসুফ (আ)-কে বলেছিলেনঃ
*******আরবী
“ আজ থেকে তুমি আমাদের মধ্যে অতি সম্মানিত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব”।
হযরত জিবরাঈল (আ)-এর মর্যাদা ও গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ
******আরবী
“ নিশ্চয় কুরআন মজীদ এক অতি সম্মানিত ফেরেশতা কর্তৃক পৌঁছানো বাণী, যিনি ওহীর গুরুভার বহনে সক্ষম এবং আরশের অধিকারী সত্তার কাছে রয়েছে তাঁর উচ্চ মর্যাদা। তিনি সেখানে গণ্যমান্য সত্তা এবং বিশ্বস্ত। (সূরা তাকভীরঃ ১৯-২১)
প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং শাসন কর্তৃত্বের মূল শক্তি হচ্ছে দেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা। রণাঙ্গনে যুদ্ধ-নেতৃত্বের শক্তি হলো সেনাপতির বীরত্ব ও সাহস। তাকে সকল প্রকার রণকৌশল সম্পর্কে অবগত ও দক্ষ হতে হবে। দুশমনের ধোকাবাজি ও চাল সম্পর্কে তাকে থাকতে হবে সচেতন। কেননা ***আরবী “লড়াইর অপর নাম হচ্ছে প্রতারণ”। যুদ্ধ পরিচালককে রণকৌশল জানতে হবে। সে অনুযায়ী কাজ করার জন্যে তাকে হতে হবে পূর্ণ দক্ষতার অধিকারী। (তৎকালীন সময়) যুদ্ধ পরিচালককে তীর নিক্ষেপ করা ও মারার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হতো, যেন শত্রু বাহিনীকে উপযুক্ত আঘাত হানতে পারে। তাকে হতে হবে দক্ষ ঘোড়সওয়ার।
যেমন আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“মুসলমানগণ! সামরিক শক্তি-উপকরণ সঞ্চয় এবং অধিক পরিমাণে যুদ্ধের ঘোড়া সংগ্রহের মধ্যদিয়ে তোমরা কাফেরদের মোকাবেলায় যথাসাধ্য রণ প্রস্তুতি নিয়ে থাকো। (সূরা আনফালঃ ৬০)
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“ তোমরা তীর চালানো শেখো এবং সওয়ারীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করো। আমার কাছে সওয়ারীর চাইতে তীর চালানো অতি প্রিয়। যে ব্যক্তি তীর চালানো শিক্ষা করে অবহেলা করে তা পরে ভুলে যায়, সে আমার দলভুক্ত নয়”। অপর এক রেওয়ায়েতে আছে, ******আরবী
“ তীর চালানো (তথা সামরিক যোগ্যতা অর্জন) একটি নেয়ামত। যে তা ভুলে গেল সে এই নেয়ামতকে অস্বীকার করলো”। (মুসলিম)
এসব বক্তব্যের মধ্যদিয়ে সমাজে জ্ঞান প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার ও খোদায়ী বিধান প্রতিষ্ঠার অন্তরায়সমূহ দূরীকরণে মুসলমানদের সামরিক যোগ্যতাসহ যাবতীয় শক্তিমত্তার অধিকারী হবার উপরই জোর দেয়া হয়েছে। যার তাগিদ রয়েছে খোদ কুরআন ও সুন্নায়।
১.আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা হচ্ছে খোদাভীতি নির্ভর একটি গুণ।
২.পার্থিব সামান্য সম্পদের বিনিময়ে হক্কুল্লাহকে বিসর্জন দেয়া সঙ্গত নয়।
৩. অন্তর থেকে মানুষের ভয় সম্পূর্ণ বের করে দেবে।
প্রত্যেক শাসনকর্তা, নেতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা এই তিনটি মহৎ গুণ অত্যাবশ্যকীয় করে দিয়েছেন।
কুরআন মজীদে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেনঃ
*******আরবী
“তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো। আমার আয়াতসমূহকে হীন স্বার্থে ব্যবহার করো না। আল্লাহ্র বিধান মুতাবেক যারা জনগণকে শাসন করে না তারাই কাফের (অবাধ্য)১। (সূরা মায়েদাঃ৪৪) ( ১.তার পূর্বে বলেছেন, ফাসিক ও জালিম।)
এর ভিত্তিতে মহানবী (সা) শাসক ও বিচারকদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন। তন্মধ্যে দু’ভাগকেই জাহান্নামী বলেছেন। এক শ্রেণীর বিচারককেই শুধু জান্নাতী বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
*********আরবী
“কাযী শাসক ও বিচারক তিন শ্রেণীর। দু’শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী এবং এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতী। অতএব যেই ব্যক্তি সত্যকে অনুধাবন করে ন্যায় বিচার করবে, সে জান্নাতী হবে”। (আহলুল সুন্নাহ)
বিবদমান দু’দলের মধ্যে যারা ফয়সালা করে দেয়, তাদেরই কাযী বা বিচারক বলা হয়। বিচারক এ দু’পক্ষকে নির্দেশ দিবেন। তাই এদের মধ্যে কেউ খলীফা হোক কি বাদশাহ, কিংবা ওয়ালী ও হাকিম কিংবা এমন কেউ যিনি রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন, এমনকি যিনি শিশুদের লেখাপড়ার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত, সকলেই একই হুকুমের শামিল। মহানবীর সম্মানিত সঙ্গি-সাথীগণ বিষয়টি এভাবেই উল্লেখ করেছেন। তাঁরাও তাই করতেন আর এটাই স্বাভাবিক।
[তিন]
জনদরদি সাহসী নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব
যার চরিত্রে ক্ষমতা ও বিশ্বস্ততা- এ দুটি মহৎ গুণের সমন্বয় ঘটেছে, এমন লোকের সংখ্যা আজকের দুনিয়ায় খুব কমই দেখা যায়। এমন দু’জন ব্যক্তি যাদের একজন বিশ্বস্ত অপরজন শক্তিমান-এ দু’জনের মধ্যে তাকেই কর্তৃত্ব নেতৃত্ব দেয়া উচিত যার দ্বারা দেশ ও জাতি ক্ষতির সম্মুখীন হয় না। ইমাম আহমদ (রহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এমন দু’জন লোক যাদের একজন সাহসী ও রণনিপুণ কিন্তু কাজে পাপাচারী, অপরজন সৎ ও সাধু কিন্তু ভীরু এবং সাহসহীন, কার সাথে থেকে জেহাদ করা বাঞ্ছনীয়? তিনি জবাবে বলেছিলেন, রণনিপুণ সবল ব্যক্তি ‘ফাজের’ হলেও তার সাথে থেকেই জেহাদ করবে। কেননা, তার শক্তি এখানে মুসলমানদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে আর তার পাপ তার নিজের জীবনের জন্যে। সৎ সাধু ব্যক্তির ব্যাপারটি সম্পূর্ণ তার বিপরীত।
শক্তি সাহস ও বিশ্বস্ততা এ দু’টি মহৎ গুণের অধিকারী ব্যক্তির সংখ্যা আজকাল নেহায়েত কম। এ কারণেই হযরত উমর (রা) দু’আ করতেনঃ
*********আরবী
“হে আল্লাহ্! তোমার কাছে পাপাচারীর নিষ্ঠুরতা এবং ভীরুতা অক্ষমতার অভিযোগ জানাচ্ছি। (এ দুয়ের হাত থেকেই রক্ষা করুন”।)
অতএব যে কোন দেশ ভূখণ্ডের জন্যে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা হিসাবে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব অনুসন্ধান করা উচিত। কোন দেশের নেতা যদি শাসনকর্তা বা প্রশাসক নিয়োগের ইচ্ছা করেন, তখন তার কর্তব্য হবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা দেশের সব চাইতে উত্তম ব্যক্তিকে এ দায়িত্ব প্রদান করা আর যদি এমন দু’জন থাকে যাদের একজন বিশ্বস্ত অপরজন শক্তিধর সাহসী, তখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগের ব্যাপারে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কোন অঞ্চল বা রাজ্যের শাসন প্রশাসনে এ গুণদ্বয়ের ভারসাম্যপূর্ণ কর্তৃত্বের দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ জাতির এবং ক্ষতির মাত্রা হ্রাস পাবে।
সুতরাং সমর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকেই মনোনীত করা উচিত যিনি বা যারা শক্তি সাহস ও বীরত্বের অধিকারী। তুলনামূলকভাবে তার আমল কিছুটা কম হলেও দুর্বল সমরনেতৃত্বের চাইতে সাহসী ব্যক্তিকেই যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এমন দু’জন ব্যক্তি আছে উভয়ই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের একজন ‘ফাজের’ তথা পাপাচারী তবে সে অধিক শক্তি সাহসের অধিকারী আর অপরজন সৎ সাধু বটে কিন্তু দুর্বলমনা। এমতাবস্থায় উভয়ের মধ্যে কার নেতৃত্বে লড়াই করা উচিত। তিনি জবাবে বলেন, ফাজেরের বলিষ্ঠতা ও শক্তিমত্তা মুসলমানদের কল্যাণর্থে আর তার ‘ফুজুর’ বা পাপাচার নিজ জীবনের জন্যে। সৎ সাধু ব্যক্তি দুর্বল হলে তার সেই সততা ও সাধুতা তার জন্য নিজের কিন্তু দুর্বল হওয়ার কারণে সে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় দুর্বলতার নিমিত্ত হবে।
অতএব শক্তিধর সমরানায়ক ‘ফাজের’ হলেও তার সাথে থেকেই জিহাদ করা উচিত।
রাসূলুল্লাহ (সা) এর ইরশাদঃ
********আরবী
“আল্লাহ্ তায়ালা ‘ফাজের’ লোক দ্বারাও তাঁর দীনের সাহায্য নেন”। (অপর এক রেওয়ায়েতে ****আরবী এর স্থলে *****আরবী আছে, অর্থাৎ “এমন সব ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে দিয়েও তাঁর দীনের সাহায্য করান, যাদের নেক কাজে অংশ নেই।)
সুতরাং যখন নির্ভীক কোন সমরনায়ক না পাওয়া যায় এবং তার স্থলাভিষিক্ত করার মতো এমন কোন সেনাপতি না মিলে, তখন দীনী দিক থেকে অধিক যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিকেই উক্ত পদে নিয়োজিত করবে। মহানবী (সা) খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে (রা) ইসলামের সেনাধ্যক্ষ করেছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে মহানবী (সা) বলতেন-
******আরবী
“খালিদ এমন এক তরবারী যা আল্লাহ্ মুশরিকদের নিপাত করার জন্যে উন্মুক্ত করেছেন”।
তা সত্ত্বেও হযরত খালিদ (রা) কর্তৃক এমন দু’একটি ঘটনা ঘটেছে যা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অপছন্দনীয় ছিল। যেমন একবার আল্লাহ্র রাসূল (সা) আসমানের দিকে হাত উত্তোলন করে বলেছিলেনঃ
*******আরবী
“ হে আল্লাহ্! খালিদ (যুদ্ধ ক্ষেত্রে) যা কিছু (বাড়াবাড়ি)করে ফেলেছে, আমি এ ব্যাপারে অব্যাহতি চাই”।
মহানবী (সা) এ দোয়াটি তখন উচ্চারণ করেছিলেন, যখন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) জুযায়মা গোত্রের লোকদের ঈমান সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে সেখানকার কিছু লোককে হত্যা করে ফেলেছিলেন আর তাদের অর্থ-সম্পদ ছিনিয়ে এনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ। তাঁর সাথে অপরাপর যেসব সম্মানিত সাহাবী ছিলেন-তাঁরা হযরত খালিদকে তা করতে বারণ করেছিলেন। মহানবী (সা) খোদ গিয়ে জুযায়মা গোত্রের লোকদের কাছে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। রণাঙ্গনে তাদের পরিত্যাক্ত অর্থ-সম্পদ ফেরত দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অথচ এহেন ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) সকল সময় হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদকেই ইসলামী ফৌজের সেনাধ্যক্ষের পদে বহাল রেখেছেন। তা করার একমাত্র কারণ ছিল এই যে, তিনি রণনিপুনতা ও সমর কুশলতায় অন্যান্যের তুলনায় অধিক যোগ্য ছিলেন। ঘটনার সাধারণ মূল্যায়ন তিনি ভুল করে ফেলতেন। পক্ষান্তরে সত্যের সৈনিক আবু যর (রা) ছিলেন সততা ও সাধুতার অধিক যোগ্য। কিন্তু এ সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বলেছেনঃ
*******আরবী
“ হে আবু যর! আমি তোমাকে দুর্বল দেখতে পাচ্ছি। তোমার ব্যাপারে আমি তাই পছন্দ করি, যা আমার নিজের ব্যাপারে পছন্দ করি। তুমি কোন সময় দু’জন ব্যক্তিরও নেতা হয়ো না। ইয়াতীমের মালের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিও না”। (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আবু যরকে নেতৃত্ব এবং অভিভাবকত্ব গ্রহণে নিষেধ করেছেন। অথচ তাঁরই সততা ও সুমহান চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসায় মহানবী (সা) বলেছেনঃ
******আরবী
“ আবু যর সত্যবাদিতার উত্তুঙ্গচূড়ায় সমাসীন ছিলেন। [এখানে ‘খাযরা’ এবং ‘গাবরার’ উপমাসূচক প্রবাদের ব্যবহার ও বিশেষণে নেই।]
হযরত আমর ইবনুল আস (রা)-কে রাসূল (সা) ‘যাতেসালাসিল’-এর যুদ্ধে এজন্যে প্রেরণ করেছিলেন যে, সেখানে তাঁর নিকটাত্মীয়রা বসবাস করতো। তাঁর প্রতি রাসূল (সা) অনুগ্রহসূচক আচরণ করতে চেয়েছেন। তাঁর চাইতে উত্তম লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকেই সেখানে পাঠিয়েছেন অপর কাউকে পাঠাননি।
উসামা ইবনে যায়দকে একবার রাসূলুল্লাহ (সা) সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রধান করেছিলেন।
মোটকথা, বিশেষ জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রেক্ষিতে কোন কোন ব্যক্তিকে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যে তাকে গভর্নর, প্রশাসক বা সেনাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হতো। অথচ ধার্মিকতা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও ঈমানের দিক থেকে হয়তো তাদের চাইতেও যোগ্য লোক বিদ্যমান থাকতো।
এমনিভাবে প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর শাসনামলে যখন ‘মুরতাদ’ ফিৎনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তা দমানোর জন্যে তিনি খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে (রা) সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। ইরাক এবং সিরিয়ার জিহাদেও তাঁকেই সেনানায়ক করে পাঠানো হয়। অথচ হযরত খালিদ (রা) কর্তৃক অনেক সময় অবাঞ্চিত কাণ্ড-কারখানা ঘটতো। কথিত আছে যে, তাঁর এসব কার্যকলাপে অনেক সময় ব্যক্তিগত ঝোঁক প্রবণতা কাজ করতো। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাঁকে সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা হতো না বরং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে হটাৎ ঈষৎ ভর্তসনা করে ছেড়ে দেয়া হতো এবং ‘ক্ষতিকর দিকে’র চাইতে তাঁর ‘কল্যাণকর দিক’কেই প্রাধান্য দেয়া হতো।১ (১.সাহাবীগণ সকলেই ছিলেন ***আরবী ন্যায়পরায়ণ। তাঁদের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল হয়ত হয়ে যেতো, কিন্ত তাতে ব্যক্তিগত স্বার্থের ছোঁয়া ছিল না। খালিদকে হযরত উমর পদচ্যুত করেছিলেন, তা সত্ত্বেও খালিদ সাধারণ সৈনিক হিসাবে জিহাদ করে আনুগত্যের চরম ইসলামী দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। -সম্পাদক ) তাঁর স্থলে অপর কাউকে স্থলাভিষিক্ত করার চিন্তা করা হতো না।
এছাড়া রাষ্ট্রের প্রধান কর্মকর্তা অর্থাৎ খলীফার মধ্যে যদি কঠোরতা কম থাকে,তাঁর স্থলাভিষিক্তের মধ্যে কঠোরতা থাকার দরকার হয় বৈ কি। তেমনি রাষ্ট্রের প্রধান কর্মকর্তা যদি বেশী কঠোর স্বভাবের হন, তাঁর অধীনস্থ প্রতিনিধির নমনীয় স্বভাবের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। খলীফা হবার পূর্বে হযরত ওমর (রা) সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)-কে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করার পক্ষপতি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা)-কে সেনাপতি পদে নিয়োগ করতে। কারণ হযরত খালিদের স্বভাবেও ছিল কঠোরতা। অপরদিকে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর চরিত্রেতো কঠোরতা ছিলই। আবু উবায়দা ছিলেন নরম স্বভাবের মানুষ। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ছিলেন নম্রতার জ্বলন্ত প্রতীক। ঐ সময় আবু বকর যা করেছিলেন তাই সঠিক ছিল। হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ হযরত আবু বকরের যুগে ইসলামী ফৌজের প্রধান ছিলেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে ইসলামী সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ত্বে ছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ। এভাবেই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত থাকে। মহানবী (সা) নিজ ব্যক্তি সত্তার ব্যাপারে বলে গেছেনঃ
********আরবী
“ আমি রহমতের নবী, আমি যুদ্ধবিগ্রহের নবী”। অর্থাৎ প্রয়োজনে আত্মরক্ষার্থে শক্তি প্রয়োগও আমার কর্ম। মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
*******আরবী
“ (ন্যায় সত্য প্রতিষ্ঠায়) আমি সহাস্যবদনে যুদ্ধকারী আর আমার উম্মত হচ্ছে মধ্যমপন্থী”। সাহাবায়ে কেরামের শানে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
**********আরবী
“কাফেরদের মুকাবেলায় তারা বড় কঠোর; কিন্ত পরস্পর সহানুভূতিশীল। তুমি তাদের দেখতে পাবে কখনও রুকূ করছে এবং কখনও সিজদা করছে-আল্লাহ্র দান এবং সন্তুষ্টি কামনায় তারা রত আছে”। (সূরা ফাতাহঃ২৮)
********আরবী
“মুসলমানদের সাথে নরম এবং কাফের তথা আল্লাহ্র অবাধ্যদের প্রতি কড়া”। (সূরা মায়েদাঃ ৫৪)
এ কারণেই হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এবং হযরত উমর ফারুক (রা)-এর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ছিল পরিপূর্ণ। তাঁদের কর্তৃত্ব সুষ্ঠু পন্থায় পরিচালিত হতো এবং তাতে ছিল ভারসাম্য। মহানবী (সা)-এর যুগে এ দুই মহান ব্যক্তিত্ব হযরতের দুই বাহুরুপে বিবেচিত ছিল। একজন ছিলেন নরম দিল নরম স্বভাবের, অপরজন ছিলেন কঠোর হৃদয় এবং কঠোর স্বভাবের। খোদ মহানবী (সা)-এ দু’জন সম্পর্কে ইরশাদ করেছেনঃ
********আরবী
“আমার পরে তোমরা আবু বকর এবং উমরের আনুগত্য করো”।
তাই দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ‘মুরতাদ’দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এমন বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন যে, হযরত উমর (রা) পর্যন্ত বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর (রা) থেকে এরূপ সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা তিনি কখনও প্রত্যাশা করেননি। অন্যান্য সকল সাহাবীও এ ব্যাপারে অনবহিত ছিলেন। তাঁরা বলতেন, শুধু যাকাত অস্বীকারে আপনি কিভাবে তাদের সাথে জিহাদ করবেন?
অতএব ব্যাপার যদি এমন হয় যে, সেখানে সততা সাধুতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি গুণের সাথে সাথে কঠোরতা ও বলিষ্ঠতারও প্রয়োজন, তাহলে সেক্ষেত্রে কঠোর নেতৃত্বকেই এগিয়ে দেবে। যেমন, অর্থ-সম্পদের হেফাযতের প্রশ্নে কঠোর স্বভাব বিশিষ্ট লোকের প্রয়োজন। কেননা, অর্থ-সম্পদ উসূল ও তার সংরক্ষণের জন্যে শক্তি ও বিশ্বস্ততা উভয়েরই প্রয়োজন হয় বৈ কি। এজন্যে সেখানে স্থানীয় প্রশাসক ও কর্মকর্তাকে কঠোর ও শক্তিমান হতে হবে, যেন তার কড়াকড়ির ফলে অর্থ আদায়ে গড়িমসি প্রশ্রয় না পায়। সচিব, কেরানী ও কোষাধ্যক্ষকে যোগ্য ও বিশ্বস্ত হতে হবে। তাদের যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার দ্বারাই অর্থ-সম্পদের যথাযথ হেফাযত হওয়া সম্ভব। যুদ্ধ ক্ষেত্রের নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের প্রশ্নেও একই অবস্থা এবং একই বিধান। প্রাজ্ঞ ও ধার্মিক ব্যক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে যুদ্ধ পরিচালক নিযুক্ত করবে। তাতে উভয় প্রকার যোগ্যতা ও গুণ বৈশিষ্ট্যের প্রতিই লক্ষ্য রাখা হবে। বস্তুতঃ প্রশাসনিক সকল কর্তৃত্ব ও সকল প্রকার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একই দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধানই অনুসরণ যোগ্য।
কোন একক ব্যক্তিত্বের দ্বারা যদি কর্তৃত্ব-নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য ও কল্যাণকারিতা পূর্ণ না হয়, তাহলে দুই, তিন অথবা তারও অধিক ব্যক্তি একই কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। তবে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেবে। একের দ্বারা কাজ না চললে প্রয়োজনে একাধিক গভর্নর ও কর্মকর্তা নিযুক্ত করবে এবং সর্বাবস্থায়ই যোগ্যতর ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেবে।
বিচার কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অধিক জ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ খোদাভীরু, যোগ্য লোককে দেবে। যদি একজন অধিক জ্ঞানী এবং অপরজন অধিক মুত্তাকী ও খোদাভীরু হয় তাহলে লক্ষ্য করতে হবে যে, দ্বিধাদ্বন্দের ক্ষেত্রে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং অধিক মুত্তাকী ব্যক্তির আগ্রহ-আখাঙ্খা সংশ্লিষ্ট বিধান প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে না তো?
কেননা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে,
*********আরবী
“(সিদ্ধান্ত গ্রহণে) দ্বিধা-সন্দেহের মুহূর্তে দূরদর্শী ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারীকে আল্লাহ্ তায়ালা ভালবাসেন, আর ভালবাসেন ঐ বুদ্ধিমত্তাকে যা কোন ব্যাপারে আগ্রহ-আকাঙ্খার প্রাবল্যের মুহূর্তে ভারসাম্য বজায় রাখতে সমর্থ”।
কাযী (বিচারক) কে যুদ্ধবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা, সেনাধ্যক্ষ কিংবা সাধারণ প্রশাসনিক প্রধানের সমর্থনপুষ্ট হওয়া বাঞ্চনীয়, তবে তা জরুরী নয়। বিচারকের নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ শিক্ষা ও জ্ঞান বিষয়ক বৈশিষ্ট্য থাকা এবং ধার্মিকতার গুণকে প্রাধান্য দিতে হবে, যদি জ্ঞান ও ধার্মিকতার মুকাবেলায় শক্তি সামর্থ্যের প্রয়োজন অধিক দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী ও স্বাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেবে।
কোন কোন ‘আলিম তথা ইসলামী জ্ঞান বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, বিচারের ফয়সালার জন্যে কোন যোগ্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না, গেলেও সে ফাসিক আলিম কিংবা জাহিল দ্বীনদার। এ দু’য়ের মধ্যে কাকে প্রাধান্য দিতে হবে? তারা জবাব দিয়েছিলেন, ঐ ব্যক্তির মধ্যে সত্য এবং কল্যাণের পথ থেকে দূরে থাকার ভাব-প্রবণতা অধিক হলে দ্বীনের কাজে ত্রুটি দেখা দেয়া স্বাভাবিক বিধায় দ্বীনদার ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। শাসকদের অবহেলার দরুন দ্বীনের কাজের ত্রুটি হতে থাকলে আলিমকেই সে ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবে। অধিকাংশ আলিম ব্যক্তি দ্বীনদারকেই এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবার পক্ষে মত দিয়েছেন। কারণ, এ ব্যাপারে সকল ইমাম মুজতাহিদ একমত যে, কর্মকর্তা, আমীর এমন ব্যক্তিকে হতে হবে যিনি ন্যায় বিচারক এবং সাক্ষ্যদানের যোগ্য।
‘ইলমের শর্তের বেলায় মত পার্থক্য রয়েছে যে, কি ধরনের আলিমকে কোন ব্যাপারে কর্মকর্তা করা হবে? সে আলিমকে মুজতাহিদ হতে হবে, না মুকাল্লিদ, অথবা যে ধরনের পাওয়া যাবে তাকেই নিয়োগ করা। এ ব্যাপারে অনত্র বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার অবকাশ খুব কম। তবুও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হলো পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিচারপূর্বক আপেক্ষিক কর্মযোগ্য ব্যক্তিকে প্রয়োজনে শাসক-কর্মকর্তা বানানো বৈধ। কারণ, পরিস্থিতি ও পরিবেশের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখাও কর্তব্য যাতে মন্দকে যথাসম্ভব নির্মূল করা যায়। কোনো ব্যক্তি হয়তো জ্ঞান প্রজ্ঞার দিক থেকে অধিকতর যোগ্য কিন্তু কোন বিশেষ এলাকার আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে হয়তো দুর্বল। সে ক্ষেত্রে কম প্রজ্ঞাশীল হলেও শক্ত লোক দরকার।
সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব হচ্ছে জনগণের প্রয়োজনে। সে প্রয়োজন কিভাবে পূরণ হবে তা দেখতে হবে। যেমন, সমাজের অস্বচ্ছল নাগরিকদের গৃহীত নিজ নিজ ঋণের টাকা পরিশোদ করা কর্তব্য। কিন্তু বর্তমানে তার থেকে এ পরিমাণেরই তাগাদা দেয়া উচিত, সে যে পরিমাণ আদায় করতে সক্ষম। যেমন, জিহাদের তৈরির জন্যে শক্তি সঞ্চয় এবং এ জন্যে অধিক ঘোড়ার ব্যবস্থা (তথা সমরোপকরণ জোগাড়) রাখার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু অক্ষমতা ও অসমর্থতার সময় কোনো নাগরিকদের উপর এ হুকুম রহিত হয়ে যায়। তখন তার যদ্দুর সাধ্যে কুলায়, তাই তার জন্য ফরয হয়ে দাঁড়ায়। ফরয আদায় করাটাই তখন তার কর্তব্য। অবশ্য হজ্জ এবং অন্যান্য ইবাদতের কথা ভিন্ন। সেক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। বরং হজ্জ ইত্যাদি পালন তার ওপর ফরয ।
*******আরবী
“যার হজ্জে যাবার ক্ষমতা ও সামর্থ্য রয়েছে”। (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭)
এটা ফরয নয় যে, সে বিশেষভাবে ক্ষমতা ও সামর্থ্য সৃষ্টিতে লেগে যাবে। কেননা, হজ্জ তখনই ফরয হয় যখন তার মধ্যে স্বাভাবিক উপায় সামর্থ্য আসে, এ জন্যে বিশেষ কায়দায় সামর্থ্য সৃষ্টি করা ফরয নয়।