কুরআনের অধিকারী ব্যক্তির মর্যাদা
আরবী***
৩৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে সম্পর্ক রেখেছে ( কিয়ামতের দিন ) তাঁকে বলা হবে, কুরআন পাঠ করো এবং উপরে উঠতে থাকো। তুমি দুনিয়াতে যে গতিতে থেমে থেমে কুরআন পাঠ করেছো- অনুরূপ গতিতে তা পাঠ করতে থাকো। তোমার বাসস্থান হবে সেই সর্বশেষ আয়াত যা তুমি পাঠ করবে। ( আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ ও নাসাঈ )
সাহেবে কুরআন বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যিনি কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন। যেমন আমরা এমন ব্যক্তিকে মুহাদ্দিস বলি যিনি হাদীসের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন এবং এমন ব্যক্তিকে নামাযী বলি যিনি নামাযের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন, কুরআন পাঠ করা এবং তা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় মশগুল থেকেছেন- তিনিই হলেন কুরআনের ধারক ও বাহক। কিয়ামতের দিন তাঁকে বলা হবে, তুমি কুরআন পাঠ করতে থাকো এবং উন্নত স্তরের দিকে উন্নিত হতে থাকো। তুমি যেখানে পৌছে কুরআন পাঠ সমাপ্ত করবে, সেখানেই হবে তোমার মনযীল। অর্থাৎ যে স্থানে পৌছে তুমি কুরআনের সর্বশেষ আয়াত পড়বে, সেখানেই হবে তোমার চিরস্থায়ী বাসস্থান। এ জন্যই বলা হয়েছে, তুমি দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে সুস্থে থেমে থেমে তা পাঠ করো। তাহলে তুমি সর্বোচ্চ মনযিলে পৌছে যেতে পারবে।
যার স্মৃতিপটে কুরআন নেই সে বিরান ঘর সমতুল্য
আরবী***
৩৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ কুরআন যে ব্যক্তিকে আমার যিকির এবং আমার কাছে দোয়া করা থেকে বিরত রেখেছে- আমি দোয়াকারী বা প্রার্থনাকারীদের যা দান করি তাঁর চেয়ে অতি উত্তম জিনিস তাঁকে দান করবো। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কেননা সমস্ত কালামের উপর আল্লাহর কালামের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে- যেভাবে সমস্ত সৃষ্টিকুলের উপর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। ( তিরমিযি, দারেমী, বায়হাকী )
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআনের চর্চায় এতটা মশগুল রয়েছে যে, অন্যান্য উপায়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করার জন্য সে যিকির- আযকার করারও সময় পায় নি, এমনকি তাঁর কাছে দোয়া করারও সুযোগ পায় নি, তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রার্থনাকারীদেরকে আমি যতো বড় জিনিসই দান করি না কেন কুরআন পাঠকারীদের দোয়া করা ছাড়াই কুরআনের বরকতে এর চেয়ে উত্তম জিনিস দান করবো।
এটা হাদীসে কুদসী। হাদীসে কুদসী হচ্ছে- যে হাদীসের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন যে, “আল্লাহ বলেছেন”। হাদীসে কুদসী এবং কুরআনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কুরআনের মতন ও ( মূল পাঠ ) আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে নাযিল হয় এবং এর বিষয়বস্তুও আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব। তা কুরআনের অংশ হিসেবে নাযিল হয়। এ জন্যই জিব্রাঈল ( আঃ ) যখন কুরআন নিয়ে আসতেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে দিতেন যে, এটা কুরআনের আয়াত। এবং তা আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব শব্দে এসেছে। অপরদিকে হাদীসে কুদসির ভাষা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজস্ব, কিন্তু এর ভাব এবং বিষয়বস্তু আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব যা তিনি তাঁর নবীর অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন। কখনো কখনো হাদীসে কুদসীর ভাষাও মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু তা কুরআনের অংশ হিসেবে আসে নি। যেমন, আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। নামাযের মধ্যে যেসব যিকির পড়া হয়, তা সবই আল্লাহ তায়ালার শিখানো। কিন্তু তা কুরআনের অংশ বানানোর জন্য শেখানো হয় নি। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁরই ভাষায় কোন বিষয়বস্তু নাযিল হলে পরিস্কারভাবে বলে দেয়া হতো যে, তা কুরআনের সাথে যোগ করার জন্য নাযিল করা হয়েছে।
এই হাদীসে কুদসীর অংশ “উতিয়াস সায়েলীন” পর্যন্ত শেষ হয়েছে। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বলেছেন, সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপর আল্লাহ তায়ালার যেরূপ মর্যাদা রয়েছে, যাবতীয় কথার উপরে তাঁর কথার অনুরূপ মর্যাদা রয়েছে- কেননা তা আল্লাহ তায়ালার কালাম। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির তুলনায় যতটা শ্রেষ্ঠ, তাঁর কথাও সৃষ্টির কথার চেয়েও ততটা শ্রেষ্ঠ। উপরের কথার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইয়াহি ওয়া সাল্লামের এ কথা যোগ করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, কুরআন ছাড়া অন্য যে কোন দোয়া- দরূদের কথাই বলা হোক না কেন মানুষের তৈরি কালাম, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কালাম নয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মানুষের তৈরি কথা যতই উন্নত মানের ও মর্যাদাসম্পন্ন হোক না কেন তা আল্লাহর কালামের সামনে কিছুই নয়। আল্লাহর সামনে মানুষের যেই মর্যাদা, তাঁর কালামের সামনে তাঁদের রচিত এই কালামেরও ততটুকু মর্যাদা। অতএব, তোমরা সবচেয়ে মর্যাদাবান আল্লাহ তায়ালার এই কালামের পিছনে যতটা সময় ব্যয় করেছো- তা অতীব মূল্যবান কাজে ব্যয় হয়েছে। তোমরা যদি দোয়ার মধ্যে তোমাদের সময় ব্যয় করো তাহলে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান কাজেই তোমাদের সময় ব্যয় করলে। অতএব, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা পরিস্কার বলে দিয়েছেন, যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করার পরিবর্তে কুরআন পাঠেই তাঁর সময় ব্যয় করে তাহলে তাঁকে দোয়াকারীদের তুলনায় উত্তম জিনিস কেন দেয়া হবে।
কুরআনের প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে দশ নেকী
আরবী****
৪০। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করে তাঁর জন্য এর বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। ( কুরআনে এই মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে যে ) প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন সওয়াব রয়েছে। আমি একথা বলছি না যে, ‘আলিফ, লাম, মীম’ একটি হরফ। বরং এলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। ———( তিরমিযি, দারেমী )
অর্থাৎ ‘আলিফ- লাম- মীম’ কয়েকটি হরফের সমন্বয়। প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে এবং প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন পুরস্কার রয়েছে।
কুরআন প্রতিটি যুগের ফিতনা থেকে রক্ষাকারী
আরবী****
৪১। তাবেঈ হযরত হারিস আল-অ’ওয়ার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ( কুফার) মসজিদে বসা লোকদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম লোকেরা- বাজে গল্প-গুজবে মেতে রয়েছে। আমি হযরত আলীর কাছে হাযির হলাম। আমি তাঁকে অবহিত করলাম যে, লোকেরা এভাবে মসজিদে বসে বাজে গল্প-গুজব করছে। তিনি বললেন, বাস্তবিকই লোকেরা তাই করছে? আমি বললাম- হ্যাঁ। তিনি বললেন- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ খবরদার, অচিরেই এমন যুগ আসবে যাতে বিপর্যয় শুরু হবে। আমি আরজ করলামঃ হে আল্লাহর রাসুল, এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় কি? তিনি বললেন- আল্লাহর কিতাব ( এই বিপর্যয় থেকে আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা সম্ভব )। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি সমূহের কি অবস্থা হয়েছিলো তাও এই কিতাবে আছে। তোমাদের পরে আসা লোকদের উপর কি অতিবাহিত হবে তাও এ কিতাবে আছে। তোমাদের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার বিধানও এতে বিবৃত হয়েছে। এই কুরআন হচ্ছে সত্য মিথ্যার- মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কিতাব। এটা কোন হাসি ঠাট্টার বস্তু নয়। যে অহংকারী তা পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাঁকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি এই কুরআন পরিত্যাগ করে অন্যত্র হেদায়াত তালাশ করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি এবং প্রজ্ঞাময় যিকির ও সত্য সরল পথ। তা অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি কখনো বিপথগামী হয় না। তা যবানে উচ্চারন করতে কষ্ট হয় না। জ্ঞানীগণ কখনো এর দ্বারা পরিতৃপ্ত ও বিতৃষ্ণ হয় না। একে যতই পাঠ করে তা পুরাতন হয় না। এর বিস্ময়কর তথ্য সমূহের অন্ত নেই। এটা শুনে জীনেরা স্থির থাকতে পারেনি, এমনকি তারা বলে উঠলো- “আমরা এমন এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি যা সৎ পথের সন্ধান দেয়। অতএব আমরা এর উপরে ঈমান এনেছি”। ( সূরা জীন ; ১, ২ )
যে ব্যক্তি কুরআন মোতাবেক কথা বলে সে সত্য কথা বলে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী কাজ করবে সে পুরস্কার পাবে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী ফায়সালা করবে সে ন্যায়ানুগ ফায়সালা করতে পারবে। যে ব্যক্তি লোকদের এই কুরআন অনুসরনের দিকে ডাকে সে তাঁদের সরল পথেই ডাকে। ( তিরমিযি, দারেমী )
নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম সৌন্দর্য এই বলেছেন যে, কুরআনে এটাও বলা হয়েছে যে, অতীত জাতিসমূহ কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ অনুসরন করার কারনে তাঁদের পরিনাম কিরূপ হয়েছিলো এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে যারা ভ্রান্ত পথে চলেছিল তাঁদেরই বা কি পরিনতি হয়েছিলো। কুরআনে এও বলা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ভ্রান্ত পথের অনুসারীদের কি পরিনতি হবে এবং সঠিক পথের অনুসারীদের ভাগ্যে কি ধরনের কল্যাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। কুরআনে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে এর মীমাংসা কিভাবে হওয়া উচিৎ।
‘হুয়াল ফাসলু’- বাক্যাংশের অর্থও হচ্ছে, কুরআন মাজীদ চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কথা বলে এবং পূর্ণ গাম্ভীর্যের সাথে বলে, এর মধ্যে হাসি-ঠাট্টা ও উপহাস মূলক এমন কোন কথা বলা হয়নি, যা মানা বা না- মানায় কোন পার্থক্য সূচিত হয় না।
অতঃপর বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কুরআন ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথা থীক হেদায়াত লাভের চেষ্টা করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এর অর্থও হচ্ছে- এই কিতাব ছাড়া আর কোথাও থেকে এখন আর হেদায়াত লাভ করা যেতে পারে না। যদি অন্য কোন উৎসের দিকে ধাবিত হয়, তাহলে গোমরাহি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।
আরো বলা হয়েছে- এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি। অর্থাৎ কুরআন হচ্ছে- বান্দাহ এবং তাঁর প্রতিপালকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। যে ব্যক্তি কুরআনকে শক্তভাবে ধারন করবে, খোদার সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে ছেড়ে দিলো, সে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললো।
কুরআনের প্রজ্ঞাময় যিকির হওয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটা এমন এক নসীহত যার গোটাটাই হিকমত, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে পরিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করে।
আরো বলা হয়েছে- কুরআন অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হতে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে- যদি কোন ব্যক্তি কুরআনকে নিজের পথ প্রদর্শক হিসেবে গ্রহন করে, তা থেকে হেদায়াত লাভের চেষ্টা করে এবং তাঁর জীবনে যেসব সমস্যা ও বিষয়াদি উপস্থিত হয় তাঁর সমাধানের জন্যে যদি সে কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্য কোন চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে পারবে না। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি পূর্ব থেকে নিজের চিন্তাধারাকে তাঁর মন-মগজে শক্তভাবে বসিয়ে নেয় এবং কুরআনকেও তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী ঢালাই করতে চায়- তাহলে এই পন্থা তাঁকে তাঁর আকাশ- কুসুম কল্পনা থেকে মুক্ত করতে পারে না। হ্যাঁ, যদি কোন ব্যক্তি কুরআন থেকেই পথনির্দেশ লাভ করতে চায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখানে যা কিছু পাওয়া যাবে তা সে মেনে নিবে এবং যা কিছু এখানে পাওয়া যাবে না তা সে গ্রহন করবে না- তাহলে এমন ব্যক্তিকে তাঁর নিজের কল্পনা বিলাসও পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্যের চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে সক্ষম হবে না।
অতপর বলা হয়েছে, কারো মুখের ভাষা কুরআনের মধ্যে কোনরূপ ভেজাল মেশাতে সক্ষম হবে না। এ ব্যাপারটি একটি সুস্পষ্ট মু’যিযা- আল্লাহ তায়ালা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা এমন সময়ে বলেছেন, যখন এই কুরআন কেবল পেশ করা শুরু হয়েছে। কিন্তু আজ চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়েছে। তারপরও এটা চূড়ান্ত কথা হিসাবে বিরাজ করছে যে, আজ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি এর সাথে কোন কিছু সংমিশ্রণ করতে পারে নি। সে সময় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিল না যে, কুরআনে কোনরূপ মিশ্রন ঘটাতে পারবে না। ভবিষ্যৎ বানী হিসেবে একথা বলা হয়েছিলো। আজ শত শত বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমানিত হয়েছে যে, যা কিছু বলা হয়েছিলো বাস্তবিক অর্থেই তা ছিল হক। এরই নাম মুযিযা।
আরো বলা হয়েছে- আলেমগন তা থেকে কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলেম সে কুরআন তেলাওয়াত, তা অনুধাবন এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় জীবন অতিবাহিত করে দেয় কিন্তু কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। তাঁর কাছে এমন কোন সময় আসবে না যখন সে এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারবে যে, কুরআন থেকে তাঁর যা শেখার ছিল সে তা শিখে নিয়েছে এবং বুঝে নিয়েছে এবং এখন তাঁর আর কোন জ্ঞানের দরকার নেই। আজ পর্যন্ত কোন আলেমই বলতে পারেনি যে, সে কুরআন থেকে পরিতৃপ্ত হয়েছে, তাঁর যা কিছু অর্জন করার ছিল তা সে অর্জন করে নিয়েছে, এখন আর তাঁর অতিরিক্ত কিছু শেখার প্রয়োজন নেই।
অতঃপর বলা হয়েছে, কুরআন যতবারই পাঠ করো না কেন তা কখনো পুরান হবে না। যতো উন্নত মানের কিতাবই হোক- আপনি দুই- চার, দশ-বিশবার তা পড়তেই শেষে বিরক্ত হয়ে যাবেন। তারপর আর তা পড়তে মন চাইবে না। কিন্তু কুরআন হচ্ছে এমন এক অনন্য কিতাব যা জীবনভর পাঠ করা হয়, বারবার পাঠ করা হয় তবুও মন পরিতৃপ্ত হয় না। বিশেষ করে সূরা ফাতিহা তো দিনের মধ্যে কয়েকবার পাঠ করা হয় কিন্তু কখনো বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় না যে, কতদিন ধরে লোক একই জিনিস বারবার পাঠ করছে। এটাও কুরআন মাজীদের এক অনন্য মু’যিযা এবং এর অসাধারন সৌন্দর্যের একটি নিদর্শন।
আরো বলা হয়েছে, কুরআন মাজীদের রহস্য কখনো শেষ হবার নয়। প্রকৃত কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন পারহ, এ নিয়ে চিন্তা- গবেষনা করতে এবং তথানুসন্ধান করতে করতে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর রহস্য কখনো শেষ হয় না। কখনো কখনো এমনও হয় যে, মানুষ একাধারে চল্লিশ পঞ্চাশ- বছর ধরে কুরআনের অধ্যয়নে কাটিয়ে দেয়ার পর কোন একসময় কুরআন খুলে পড়তে থাকে। তখন তাঁর সামনে এমন কোন আয়াত এসে যায় যা পাঠ করে মনে হয় যেন আজই সে এ আয়াতটি প্রথম পাঠ করছে। তা থেকে এমন বিষয়বস্তু তাঁর সামনে বেরিয়ে আসে যা জীবনভর অধ্যয়নেও সে লাভ করতে পারেনি। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এর রহস্য কখনো শেষ হবার নয়।
কুরআন মাজীদের মর্ম বানী শুনে জীনদের ঈমান আনার ঘটনা সূরা জীন এবং সূরা আহকাফে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে জানা গেলো যে, কুরআন এমন প্রভাবশালী বক্তব্য পেশ করে- মানুষ তো মানুষ জীনেরাও যদি একগুঁয়েমি, গোঁড়ামি এবং হঠকারিতা পরিহার করে উন্মুক্ত মন নিয়ে কুরআনের বানী শুনে তাহলে তাদেরও একথা সাক্ষী না দিয়ে উপায় থাকে না যে, কুরআন সঠিক পথের নির্দেশ দান করে এবং এর উপর ঈমান এনে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়।
কুরআন মাজীদের এসব বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অনাগত ভবিষ্যতে যেসব ফিতনা এবং বিপর্যয় দেখা দেবে তা থেকে বাঁচার মাধ্যম এই কুরআন ছাড়া আর কিছুই নয়। একথাও পরিস্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, কুরআন মাজীদে এমন জিনিস রয়েছে যার কারনে তা কিয়ামত পর্যন্ত সব সময় মানব জাতিকে যে কোন ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে।
কুরআন চর্চাকারীর পিতামাতাকে
নূরের টুপি পরিধান করানো হবে
আরবী***
৪২। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে- কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা-মাতাকে নূরের টুপী পরিয়ে দেয়া হবে। সূর্য যদি দুনিয়াতে তোমাদের ঘরে নেমে আসে তাহলে এর যে আলো হবে- ঐ টুপীতে তাঁর চেয়ে সৌন্দর্যময় আলো হবে। অতএব যে ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী যাবতীয় কাজ করে তাঁর প্রতি আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ হতে পারে বলে তোমাদের ধারনা? ( আহমাদ, আবু দাউদ )
এখানে এমন পিতা-মাতার কথা বলা হয় নি যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন অধ্যয়ন করতে বাধা দেয়। এবং কুরআন পাঠকারী ছেলেদেরকে মোল্লা হয়ে গেছে বলে টিটকারি দেয় এবং বলে, এখন সে আর আমাদের কোন কাজে লাগার উপযোগী নয়। এ আর কি পার্থিব কাজ করবে- এতো কুরআন পড়ায় লেগে গেছে। এখানে এমন পিতামাতার কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন পড়িয়েছে। এবং তাঁদের এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে যে, তাঁদের জীবদ্দশায় এবং তাঁদের মৃত্যুর পরও তারা কুরআন পড়তে অভ্যস্ত হয়ে রয়েছে এবং তদানুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিয়েছে। তাঁর এই কুরআন পাঠ শুধু তাঁর জন্যেই পুরস্কার বয়ে নিয়ে আসবে না বরং তাঁর পিতামাতাকেও পুরস্কৃত করা হবে। আর সেই পুরস্কার হচ্ছে কিয়ামতের দিন তাঁদেরকে মর্যাদাপূর্ণ, গৌরবময় ও আলোক উদ্ভাসিত টুপি পরিয়ে দেয়া হবে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, যে ব্যক্তি নিজে এই কুরআন পাঠ করে এবং তদনুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়- তাঁর উপর আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ বর্ষিত হবে এবং সে কতো কি পুরস্কার পাবে।
কুরআনের হেফাজত না করা হলে তা দ্রুত ভুলে যাবে
আরবী****
৪৩। হযরত আবু মুসা আশআরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআন মাজীদকে স্মৃতিপটে ধরে রাখার এবং সংরক্ষণ করার দিকে লক্ষ্য দাও। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন। উট যেভাবে দড়ি ছিড়ে বন্ধন মুক্ত হয়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে- কুরআন সেভাবে এবং তাঁর চেয়েও দ্রুত স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ———( বুখারী ও মুসলিম )
অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করার পর তা স্মরণ শক্তির আধারে ধরে রাখার জন্যে যদি চিন্তা ভাবনা না করে এবং বারবার অধ্যয়ন না করে তাহলে তা মানুষের মন থেকে পলায়ন করে থাকে- যেভাবে উট তাঁর রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে। এর কারন হচ্ছে- মানুষ যতক্ষন সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা স্মৃতিপটে ধরে রাখার চেষ্টা না করে ততক্ষন তাঁর আত্মা কুরআনকে গ্রহন করতে পারে না। যদি এটা না করা হয় তাহলে সে কুরআনকে তাঁর স্মৃতিপট থেকে ঢিলা করে দেয় এবং এর ফলে তা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেননা কুরআন তাঁর উপর যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে- তা থেকে মুক্ত হওয়ার দুর্বলতা তাঁর মধ্যে বর্তমান রয়েছে। কুরআন তাঁর জন্যে যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে সে তা অতিক্রম করতে চায়। যে ব্যক্তি নফসের গোলাম হয়ে যায় এবং নিজের নফসকে আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য বাধ্য করে না সে কখনো কখনো কুরআনের বানী শুনে ঘাবড়িয়ে যায়- না জানি এমন কোন আয়াত এসে যায় যা তাঁকে ভ্রান্ত ও নাজায়েজ কাজ করা থেকে বাঁধা দিয়ে বসে। এ জন্য বলা হয়েছে, কুরআন শরীফ মুখস্থ করার পর তা স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করো। অন্যথায় তা উটের রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার ন্যায় তোমার স্মৃতিপট থেকে পলায়ন করবে।
কুরআন মুখস্থ করে তা ভুলে যাওয়া জঘন্য অপরাধ
আরবী***
৪৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন ব্যক্তির জন্য এটা খুবই খারাপ কথা যে, সে বলে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। ( আসল কথা হচ্ছে তাঁর অবহেলার কারনে ) তাঁকে এটা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কুরআনকে কণ্ঠস্থ রাখার আপ্রান চেষ্টা করো। কেননা তা পলায়নপর উটের চেয়েও দ্রুত মানুষের বক্ষঃস্থল থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। ——-( বুখারী, মুসলিম- মুসলিমের বর্ণনায় আছে, উট তাঁর বন্ধন থেকে যেভাবে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে )।
এখানেও একই কথা ভিন্ন ভংগিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা হয়েছে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করার পর তা ভুলে যাওয়া এবং এই বলা যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি- এটা খুবই খারাপ কথা। মূলত তাঁর ভুলে যাওয়ার অর্থও হচ্ছে- সে কুরআনের কোন পরোয়া করেনি এবং তা মুখস্থ করার পর সে দিকে আর লক্ষ্য দেয় নি। যেহেতু সে আল্লাহ তায়ালার কালামের প্রতি মনোযোগ দেয়নি এ জন্য আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে তা ভুলিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর কালাম এমন ব্যক্তির কাছে রাখা পছন্দ করেন না যে তাঁর সমাদরকারী নয়। এই জন্য বলা হয়েছে, কুরআনকে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করো এবং তা কণ্ঠস্থ করার পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না। অন্যথায় উট বন্ধনমুক্ত হয়ে যেভাবে পালাবার চেষ্টা করে- অনুরূপভাবে কুরআনও বক্ষস্থল থেকে বের হয়ে চলে যায়।
কুরআন মুখস্থকারীর দৃষ্টান্ত
আরবী****
৪৫। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- কুরআন মুখস্থকারী এমন ব্যক্তি সদৃশ যার কাছে বাঁধা উট রয়েছে। যদি সে তাঁর রক্ষনাবেক্ষন করে তাহলে তা তাঁর কাছে থাকবে। আর যদি সে এটাকে আযাদ করে দেয় তাহলে তা ভেগে যাবে। –( বুখারী ও মুসলিম )
হযরত আবু মুসা আশআরী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে তিনটি বর্ণনার একই বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছেন। এ থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে লোকদের মনে একথা বদ্ধমূল করিয়েছেন যে, যার যতটুকু পরিমান কুরআন মুখস্থ আছে সে যেন তা মুখস্ত রাখার চেষ্টা করে। তা যদি স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা না করো এবং বারবার তা পাঠ না করো তাহলে এটা তোমাদের মন থেকে ছুটে যাবে।
আপনি দেখে থাকবেন, যারা কুরআনের হাফেজ তাঁদের সব সময় কুরআন পড়তে হয়। যদি তারা রমযান মাসে কুরআন শুনাতে চায় এ জন্যে তাঁকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। এর কারন হচ্ছে- মানুষ কুরআন মুখস্ত করার পর যদি তা সংরক্ষিত করার চেষ্টা না করে তাহলে তা খুব দ্রুত তাঁর স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে চলে যায়।