চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সমষ্টিকেন্দ্রিক মতবাদ
উদারনৈতিক মতবাদ বা তার বংশের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বা সামাজিক চুক্তিবাদে মানব-জীবন সম্বন্ধে ধারণার কোন বিশেষ প্রভেদ নেই। সর্বত্রই মানুষকে ভাবা হয়েছে এককরুপে। ধনতন্ত্রে সেই মানুষকে কেবল একক ভাবা হয়নি, তাকে স্বভাবতই ভাবা হয়েছে স্বার্থপররূপে। অথচ বিরাট মানব-জীবন এসব মতবাদের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। মানব-জীবন নিয়ে আলোচনা করলেই দেখা যায় মানুষ সব সময়েই যূথচারী জীব৫৯। জীবনের আদিতেই সে অপরের সঙ্গ কামনা করে। কোন দুর্বিপাকে সে সমাজজীবনে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে জীবন তার কাছে হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। সে কেবল অপরের সঙ্গই কামনা করে না, অপরের মঙ্গল কামনাও সে করে। আত্মরক্ষা, আত্মপ্রতিষ্ঠা তার জীবনে প্রধান মনোবৃত্তি হলেও প্রেম, দয়া, মায়া, বাৎসল্য, পরার্থপরতা তার জীবনে বিশেষভাবেই কার্যকর। মানুষের মাঝে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ঠ্য থাকলেও তাদের মধ্যে রয়েছে এক সার্বিক ঐক্য,সে ঐক্যের সুরটি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে ইয়াহূদীদের ধর্মে।
য়াহূদী ধর্ম
য়াহূদীদের ধর্মে মানুষের বৃহত্তর সত্তা বিকাশের জন্য নানাবিধ আদেশ রয়েছে। স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা, অহংবোধ ও পরার্থিতার দ্বন্দের ফলেই আরম্ভ হয় ব্যষ্টিজীবনে দ্বন্দ্ব। ব্যষ্টি ও সমষ্টির স্বার্থের সমতা সাধনের জন্য য়াহূদীয়া অভিনব উপায় গ্রহণ করেছিল। পরলোকগত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড বলেন, “ বোধ হয় অন্য কোনও জাতীয় আইন ও আচার ইসরাইলীদের মত দলীয়৬০ এবং ব্যষ্টিজীবনের সমতা সাধনের চেষ্টা করেনি। তারা ছিল অনুগৃহীত৬১ জাতি তাদের ধর্ম ব্যষ্টিকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও জাতীয়তার ওপর প্রতিষ্ঠিত।…… (সর্বাবস্থায়ই) তারা ব্যক্তিগত অধিকার অক্ষুণ্ন রেখেছে। এ জন্যই মূসার অনুশাসনে বা তাঁর বিভিন্ন ধারায় দাসপ্রথা ও ভীতিপ্রদ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে নানাবিধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রত্যেক সাত বৎসর অন্তর য়াহূদীদের দাসগুলোকে মুক্তি দেওয়া হয়। বন্ধকাবদ্ধ বস্ত্রাদি প্রত্যেক দিন দিবাশেষে ফিরিয়ে দিতে হয়। প্রত্যেক সাত বৎসরের শেষে মাঠগুলো পতিত রাখতে হয়, যাতে সেগুলো সাধারণের সম্পত্তিরূপে গণ্য হতে পারে। জমিতে চাষীর অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ধর্মীয় ও সরকারি বিধান প্রয়োগ করা হয়”।* (Ramsay Macdonal d: Social Development p:21)
অনেকেই মনে করেন য়াহূদী ধর্মে এরূপ সাম্যবাদমূলক নীতি থাকলেও বাস্তব জীবনে তার রুপায়ণ হয়নি। এককালে য়াহূদীদের মত এরূপ শোষক জাতি দুনিয়ার দ্বিতীয় ছিল না। য়াহূদীদের কোন রাষ্ট্রেরও ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই রাজনীতিতে এ মতবাদের পরীক্ষা হয়নি।** ( নবজাত ইসরাইল রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে, তা লক্ষণীয়।)
তবুও মানুষের আদি প্রকৃতিতে সংঘ-চেতনার৬২ দৃষ্টান্ত হিসেবে তার মূল্য রয়েছে যথেষ্ট। হয়ত ব্যষ্টি ও সমষ্টির সংস্থান ব্যবস্থা হিসেবে তাতে কোন ফাঁক থাকার দরুনই তা বাস্তব জীবনে কার্যকরী হতে পারেনি।
প্রাথমিক প্লেটো
মহাপ্রাণ প্লেটোর কালজয়ী দৃষ্টির আলোয় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এ সত্যটি প্রতিভাত হয়েছিল। তাঁর রিপাবলিকে৬৩ তিনি মানবজাতিকে সাধারণ মানব,সৈনিক এবং অভিভাবক-এই তিন ভাগে বিভক্ত করলেও মানুষের মাঝে যে ঐক্য বর্তমান তা তাঁর কাছে ধরা পড়েছিল। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধন করে সমস্ত বিত্ত রাষ্ট্রের করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর ধারণা ছিল, অভিভাবকগণের ছোট ছোট বাড়ি থাকবে এবং তারা মোটা ভাতে জীবন যাপন করবে। শিবিরে যেভাবে মানুষ জীবন যাপন করে, তারা তেমনিভাবে বসবাস করবে, একত্রে আহার করবে-তাদের প্রয়োজনে অতিরিক্ত কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না, সোনা-রুপার প্রচলন নিষিদ্ধ থাকবে। ধনী না হলেও তারা কেন সুখী হতে পারবে না? নগরের উদ্দেশ্য হবে সকল লোকের উন্নতি বিধান,কোন বিশেষ শ্রেণীর সুখসাধন নয়।
এমনকি স্ত্রীলোক ও সন্তানগণও সাধারণ সম্পত্তি পরিগণিত হবে। প্লেটোর রিপাবলিকে যে আদর্শের অনুসরণের জন্য আদেশ করা হয়েছে তাতে মনের পরহিতব্রতের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা হয়েছে এবং তাকে বাস্তবজীবনে রুপায়িত করার সাধনা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবুও ভাবতে হবে মানব মনের স্বাভাবিক অহংবোধ থেকে কিভাবে সে পরাথির্কতার পথে অগ্রসর হবে। প্লেটো সে পদ্ধতি বাতলে দেন নি। তাই তাঁর এই আদর্শ সুখ-রাজ্যের৬৪ সমালোচনায় বলা যায়- “এতে প্রমাণ ও খণ্ডনের কোন প্রশ্নই ওঠে না। এখানে আসল প্রশ্ন হল, এ রকম রাষ্ট্র পছন্দ হয় কিনা। যদি কারো পছন্দ হয়, তা হলে ভাল-যদি না হয়, তা হলে তা খারাপ। যদি অনেক লোকের তা পছন্দ হয় এবং অনেকের তা না হয়-তা হলে যুক্তি নয়, প্রকাশ্যে বা লুক্কায়িত শক্তির জোরেই হবে তার প্রতিষ্ঠা।* (Bertrand Russell: History of Western Philosophical Thoughts.)
এ রাষ্ট্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার কোন অর্থ নেই। কারণ এ রাষ্ট্র জনসাধারণের ইচ্ছা ও সম্মতির উপর গড়ে ওঠে না।
মাজদাক
ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে ইরানে মাজদাকও মানব-প্রকৃতির পরার্থিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এক অভিনব মতবাদ প্রচার করেছিলেন। যাতে দেশের সম্পদ সকলেই সমানভাবে ভোগ করতে পারে, তার জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ করার উদ্দেশ্যে তিনি বিবাহ প্রথা রহিত করার জন্য ঘোষণা করেছিলেন-“ যে ভাবে সকলে বায়ু ও জল উপভোগ করে, সেভাবেই স্ত্রীলোকগণকেও ভোগ করবে* (Mushir Hussain Kidwai-Pan-islamism and Bolshevism p.51)। মাজদাক কেবল যৌন-জীবনেরই যৌথানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন বলে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতে সংঘবদ্ধ জীবনের কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে পারেননি বলে তাঁর এ মতবাদ বেশিদিন টিকে থাকেনি।
কার্ল মার্কস
মার্কস ছিলেন দার্শনিক হেগেলের শিষ্য। জার্মান দার্শনিক হেগেলের নিকট স্বতঃসিদ্ধ৬৫ ছিল যা কিছু সত্য তাই যুক্তিসঙ্গত, আর যা’ যুক্তিসঙ্গত, তা-ই সত্য। তাঁর স্বতঃসিদ্ধের শেষ অর্ধাংশ অনেকেই স্বীকার করতে রাজি নন।
জগতে যা কিছু রয়েছে তাকে অবশ্য বলা চলে যুক্তিসঙ্গত। জগতে যা কিছু বিদ্যমান তার জন্য কোন জ্যামিতিক প্রমাণ দেয়া সম্ভবপর নয়। তবুও তাদের অস্তিত্বের পক্ষে উপযুক্ত কারণ থাকা দরকার। এ দুনিয়ার অস্তিত্বের পক্ষে উপযুক্ত রয়েছে এ দুনিয়ার বুকে। এ মানব সভ্যতার দর্শনবিজ্ঞানে এ নীতি স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এ দুনিয়ায় যদি যুক্তি বা বিচারের কোন সুযোগ না থাকে, তাহলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এক পা’ও অগ্রসর হতে পারে না। কারণ বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আবিস্কার।
তবে যা কিছু যুক্তিসজ্ঞত তাই কেমন করে সত্য হতে পারে? আমাদের তর্ক-শাস্ত্রজাত যুক্তিধারার স্রোতে এমন অনেক অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ সত্তাকে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হই, যার কোন অস্তিত্ব বাস্তব জীবনে কল্পনা করাও আলেয়ার পেছনে ছোটার মত হাস্যকর। তবুও এ সূত্রের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে হেগেল গড়ে তুলেছেন তাঁর দার্শনিক সৌধ।
দুনিয়ার অস্তিত্বে আমরা বিশ্বাস করি না করি, কোন কিছুর ধারণা নিয়েই আমাদের দার্শনিক অন্বেষণ আরম্ভ করতে হয়। দর্শনের ক্ষেত্রে চরম নাস্তিবাদ৬৬ অচল। তাই বিশ্বাসসত্তাকে যদি বলা হয় অস্তিত্ব৬৭ তা’হলে সেই অস্তিত্বকে আমরা অস্তিত্বের৬৮ আলোকেই বুঝতে পারি। অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের দ্বন্দ্বের ফলেই আমাদের মানস এর মধ্যে আশ্রয় নেয়। Becoming- এর মাঝে অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব দুই রয়েছে, অথচ তার মাঝে উভয়ের হচ্ছে সমন্বয়। হেগেল তাঁর সূচনা৬৯ কে বলেছেন অন্বয়৭০ তার প্রতিপক্ষকে ব্যত্যয় এবং তাদের সমন্বয়কে সিন্থেসিস।
মানব-মন অন্বয়,ব্যত্যয় ও সমন্বয়ের ধারায় একেবারে পরম ব্রক্ষে এসে স্বস্তি লাভ করে। পরম ব্রক্ষে আর কোন দ্বন্দ্ব নেই।
এ সকল চিন্তার মাধ্যমকে৭১ হেগেল গ্রহণ করেছেন অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ৭২ বলে। মার্কস হেগেলের শিষ্য হলেও এসব তাঁর কাছে অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ৭৩। অন্বয়,ব্যত্যয় ও সমন্বয়কে ইতিহাসের ব্যাখ্যায় প্রয়োগ করে মার্কস প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, সভ্যতার গতি এ দ্বন্দ্বের ফলেই সম্ভব হচ্ছে।
“গুহামানব৭৪ কিসে পশুচারী৭৫ মানবে পরিণত হল অথবা পশুচারী যাযাবর কি কারণে কৃষিজীবীতে পরিণত হল, সে ইতিহাস আজও নিতান্ত কল্পনার স্তরেই রয়ে গেছে। কল্পনার সুবিধার জন্য বলা হয়ঃ হয়ত নব্য প্রস্তরযুগের৭৬ শেষের দিকে ঘটনাচক্রে কোন পশুচারী যাযাবর পাথর ঘষে লাঙলের মত একটা অস্ত্র তৈরি করে ফেলে। তা দিয়ে সে মাটি খুঁড়ে দেখল তাতে বীজ পড়লে দুদিনেই তর তর করে চারা গজিয়ে ওঠে। তার শুভ ফলে পথচারী সমাজের সকল লোক আর পশু চারণ নিয়ে মশগুল থাকে না, কোন বিশেষ স্থানে গেড়ে বসে মাটি খোঁড়া ও বীজ বোনায় লেগে যায়। বছরের শেষে প্রচুর খাদ্যশস্য পেয়ে তাদের উৎসাহ বেড়ে যায়। তারা আর পথে পথে পশু নিয়ে ঘোরাফেরার কল্পনাও মনে আমল দিতে চায় না। স্থায়ীভাবে বাস করে তাতে ক্ষেতের কাজ করে তারা জীবিকার সংস্থানে অগ্রসর হয়। তাদের এ প্রণালীর সুখ-সুবিধায় মুগ্ধ হয়ে তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠীরা আবার পশুচারণ ত্যাগ করে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয়। অথবা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের ফলানো ফসল লুট করে নিতে চায়। ফলে যুদ্ধ বাধে দুই দলে। বিজেতা ও বিজিত-দুই দলেরই জীবনধারা হয় পরিবর্তিত। একদল এই মিত্র-সমাজের মাঝে পশুচারণের ভার নেয়, অপর দল হাল চলনা করে ফসল ফলায়। এ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয় মানবসমাজ। সে দ্বন্দ্বের যেমন দেখা দিতে পারে একই সমাজের বিভিন্ন মানুষের মাঝে, তেমনি বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যেও দ্বন্দ্ব সম্ভবপর। যেমন পূর্বে উল্লিখিত একই সমাজের পশুচারী ও কৃষিজীবীদের মধ্যেও যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সেরূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন সমাজের দুই জাতির মধ্যেও দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে, যেমন কোন এক কৃষিজীবী সমাজে হটাৎ একদল যাযাবর পশুচারী আপতিত হয়ে তার উৎপাদন ও সমাজ-ব্যবস্থা দুটোকেই লন্ডভন্ড করে দিতে পারে তবে এ দ্বন্দ্বের ফলে পশুচারীই পরিণত হয় কৃষিজীবীতে, কৃষিজীবী আর ফিরে যায় না আদিম ব্যবস্থাতে। জীবিকার উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটলে সমাজের বাস্তব ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। কৃষিজীবী সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ক্ষাত্রশক্তির প্রয়োজন। নানাবিধ যন্ত্রপাতির উৎপাদন অত্যন্ত দরকার। নারী-পুরুষের মধ্যে শ্রমবিভাগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তার জন্য দলপতি,গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে চলে দলাদলি। পরিশেষে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ব্যক্তিই রাজপদে অভিষিক্ত হয়। তিনি তাঁর সমাজকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। তাঁর অধীনে একদল লোক শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে। তাদের আহার যোগানো হয় সমাজের পক্ষে অবশ্য-কর্তব্য। কেবল রাজাই সেই সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে পারেন না- প্রয়োজন হয় পুরোহিত শ্রেণীর। তাঁরা আল্লাহ্র অভিশাপ থেকে মন্ত্রবলে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখে বলে তাদের প্রতিপত্তি সমাজ মেনে নেয়। রাজা তাঁর শাসন অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সামন্ত সর্দারের নানা সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠিত করেন। তার ফলে দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজতন্ত্র বা সামন্ত্রতন্ত্র। যারা সমাজে আহার যোগায় তারা ক্রমশই নিচের দিকে নেমে যায়। সামন্ত প্রভুদের কৃপার পাত্ররূপে তারা তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে ক্রমশ দাস শ্রেণীতে পরিণত হয়।
সামন্ত যুগে এসেও মানুষ স্থির হয়ে বসে থাকে না। অবসর সময়ে সে তার জীবনযাত্রার প্রয়োজনে নানাবিধ যন্ত্রপাতি আবিস্কার করে তাকে উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রয়োগ করে। সেই নতুন ব্যবস্থায় অল্প শ্রমে প্রচুর উৎপাদন হয়। সেই উৎপাদিত দ্রব্যগুলোকে সামন্ত অথবা পুরোহিত শ্রেণীকে আর নবীন যুগের উৎপাদনকারী নজরসালামি দিতে চায় না। তাদেরই একদল লোক উদ্ধৃত্ত দ্রব্য দেশে-বিদেশে রপ্তানি করে তা থেকে দু’পয়সা লাভ করতে চায়। ফলে সামন্ত সর্দারের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ দ্বন্দ্বে সামন্ত সর্দারের অত্যাচারে জর্জরিত দাস শ্রেণী তথা দেশের জনসাধারণ নবোত্থিত বণিক শ্রেণীর সঙ্গে যোগ দেয়। কারণ এ বণিক শ্রেণী আর দাস শ্রেণীর উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল নয় বলে তারা দাস শ্রেণীকে সম্পূর্ণ মুক্তি দিতে হয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সামন্ত শ্রেণীকে পরাজিত করে জয়ের পরে আকাশের চাঁদ সূর্য সবকিছু পেড়ে দেবে বলে বণিক শ্রেণী উৎসাহিত করে। এই দ্বন্দ্বে বণিক শ্রেণীরাই জয়ী হয়। জগতে আবার হয় নতুন সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। বণিক তার কলকারখানার মুক্তিপ্রাপ্ত দাস শ্রেণীকে খাটায়। আবার তাদের পরিশ্রমের দওলতে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে। যতই নতুন শক্তিশালী যন্ত্রপাতির আবিস্কার হয় ততই লাভের অংক বাড়ে। শেষে মূলধন এতো ফেঁপে যায় যে, কোন বিশেষ দেশে তাকে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না; তার জন্য প্রয়োজন হয় দেশ-দেশান্তরে আধিপত্য বিস্তারের, প্রয়োজন হয় সাম্রাজ্য গড়ে তোলার। ধর্মের নামে, অনুন্নত জাতির কল্যাণের হাস্যকর অজুহাতে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশের লোকের রক্তমোক্ষণ চলে পুরাদমে। এইভাবে পুঁজিবাদ দুনিয়ার বুকে জেঁকে বসে।
মূলধন যত ফেঁপে যায় ততই মুষ্টিমেয় লোকের হাতে দেশের সম্পদ এসে জড়ো হয়। মূলধন বাড়তির সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার অপর একদল মানুষ হড় হড় করে নির্বিত্ত শ্রেণীতে পরিণত হয়। এতে আবার নতুনভাবে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পুঁজিবাদী সমাজের পক্ষে নির্বিত্তের শ্রম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তাদের শ্রম ব্যতীত কলকারখানা চলতে পারে না। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করলে তারা শ্রম করতে চায় না। একেবারে আহার যোগানো বন্ধ করলেও তারা মারা যায়। তাই তাদের রাখা হয় জীবন্মৃত অবস্থার মধ্যে। খাওয়া-পরা ও প্রজননের ব্যবস্থা করে দিয়েই মালিক তাঁর কর্তব্যের এ শেষ মনে করেন। অপরদিকে পুঁজিপতির পুঁজির সঙ্গে শ্রম যুক্ত হয়েই এ সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন সম্ভব হয়। উৎপাদনের জন্য তাই দুইয়ের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে,কিন্তু বণ্টনের বেলায় শ্রমিকের কৃতিত্ব করা হয় সম্পূর্ণ অস্বীকার। উৎপাদিত দ্রব্যে শ্রমিকের মালিকানা স্বীকৃত হয় না কিছুইতেই। তার ফলে নির্বিত্ত শ্রমিকেরা কালে সংঘবদ্ধ হয়ে মালিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়,পুঁজিবাদীর বিলাস-সৌধ চূর্ণ করে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের করে প্রতিষ্ঠা।*(মোহাম্মদ আজরফঃ ইতিহাসের ধারা)
সামন্ততন্ত্রকে যদি বলা যায় হেগেলীয় দর্শনের Being, তাহলে ধনতন্ত্রকে বলা যায় Non-being এবং সমাজতন্ত্রকে বলা যায় Becoming। সামন্ততন্ত্রের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের ফলেই সৃষ্টি হয় নির্বিত্ত শ্রেণী। সেই নির্বিত্ত শ্রেণীর কল্যাণের জন্য সমাজতন্ত্রই একমাত্র পন্থা। তার জন্য চাই রক্ত-বিপ্লব। মার্কস ও এঙ্গেলসের সর্বশেষ বাণীঃ সর্বদেশের মজুরশ্রেণী সংঘবদ্ধ হও।** (মার্কস ও এঙ্গেলসঃ কমিউনিষ্ট ম্যানিফেষ্টো।)
সেই সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যষ্টিকে তার অধিকার৭৭ ত্যাগ করতে হবে। এখানে রাষ্ট্রই থাকবে সমস্ত কাজকর্মের নিয়ামক। প্রত্যেক তার যোগ্যতা অনুসারে কাজ করে যাবে এবং তার প্রয়োজন অনুসারে সমস্তই পাবে৭৮। বৃহত্তর মানবতাবোধে উদ্ধুদ্ধ হয়ে যখন মানুষ তার অহংবোধ বা স্বার্থপরতা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে সকল কাজকর্মই নিজের এবং সকলের জন্য করতে শিখবে, তখন রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন থাকবে না, রাষ্ট্র আপ্না-আপনি মিলিয়ে যাবে। তাই মানুষকে পরার্থপর করার সাধনায় সাম্যবাদী আদর্শে রাষ্ট্রকে করতে হয় সর্বেসর্বা। প্রতিক্রিয়ার কোন সুযোগই যাতে এর মধ্যে প্রশ্রয় না পায় সেজন্যেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রসর্বস্ব জীবন-যাপন করার শিক্ষা দেয়া হয়। এসব শিক্ষাধারা সংস্কৃত হলে পর রাষ্ট্রের প্রয়োজন আপ্না-আপনি ফুরিয়ে যায়, মানুষের বৃহত্তর সত্তার প্রকাশের জন্য আর কোন শক্তির প্রয়োজন হয় না।
উদারনৈতিক মতবাদের আলোচনায় আমরা দেখেছি, সভ্যতার এক বিশেষ পর্যায়ে দুনিয়ায় কোন বিশেষ শ্রেণীকে ঐশী ক্ষমতাপ্রাপ্ত বলে ধারণা করার ফলে সাধারণ মানুষের দুর্গতির সীমা থাকে না। সেইজন্যই সর্বসাধারণ মানুষের মুক্তির উদাত্ত আহ্বান নিয়ে দেখা দিল উদারনৈতিক মতবাদ৭৯ , যার মূলমন্ত্র হল ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ৮০ । তার ফলে হল ধনিক ও শ্রমিক শ্রেণীর সৃষ্টি। সমাজতন্ত্রে এই নির্বিত্ত শ্রমিক শ্রেণীই আধিপত্য লাভ করে। তা সত্ত্বেও আর কোন শ্রেণী সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে না। কারণ পুঁজি খাটিয়ে তা থেকে মানুষকে শোষণ করার আর কোন অবকাশ থাকে না। অবশ্য বৃত্তিগত শ্রেণী-বৈষম্য৮১ তাতে থাকতে পারে, কিন্তু তাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণের কোন সুযোগ না থাকায় আর কোন দ্বন্দ্বের সুবিধা হয় না। ধনতন্ত্রী সমাজ থেকে সমাজতন্ত্রী সমাজে পৌঁছতে হলে মানুষকে একটা সন্ধিক্ষণের৮২ ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কারণ ধনতন্ত্রের আদর্শে ও ভাবধারায় প্রতিপালিত মানস নিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভবপর নয়। এই জন্য এই সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রে ব্যাপার ডিরেক্টরের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। তিনি নির্বিত্তকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে পরিচালিত করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
মার্কসের মতবাদে পরস্পরবিরোধী অনেক ভাবধারা সন্নিবেশিত রয়েছেঃ
১. প্রথমত সভ্যতার গতি নির্দেশ করতে যেয়ে মার্কস যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাকে বলা হয় অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদ৮৩ । ঠিক যেভাবে পদার্থ বিজ্ঞানবিদ অণু বা পরমাণুর কার্যকরণ দ্বারা জগতের সমস্ত ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করেন, মার্কসও তেমনি এক কার্যকারণ শৃঙ্খলা দ্বারা জগৎসভ্যতার গতির ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর এ পদ্ধতিকে Positive Science –এর ভাষায় Judgement of facts বলা যেতে পারে। পরক্ষণেই তিনি আবার Normative Judgement দিয়ে বলেছেন, জগৎ-সভ্যতার ধারাই এই এবং মানুষের কাজকর্মের নীতিও এই হওয়া উচিত।
যদি কার্যকারণসূত্রে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই জগৎ- সভ্যতার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে সে ব্যবস্থা এমনি ফলে উঠবে, তার জন্য কারো কোন সাধ্য-সাধনা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সে সভ্যতাকে বা সেই সামাজিক ব্যবস্থাকে রুপায়িত করার জন্য আহ্বান করা হয়েছেনঃ দুনিয়ার মজদুর সব একত্র হও৮৪। যদি একত্র হওয়ার মত স্বাধীনতা মজদুর শ্রেণীর না থাকে, তবে তাদের প্রতি এ আহ্বানের কোন মূল্য আছে কি? যদি ‘স্বাধীনতা’ বলতে তিনি স্পিনোজার মত সম্মতি৮৫ মনে করতেন তাহলেও তার ব্যাখ্যার সঙ্গে স্বাধীনতার সঙ্গতি খুঁজে বের করা যেত। মার্কস কিন্তু সম্মতি অর্থে স্বাধীনতা স্বীকার করেননি। তাঁর মতে ‘স্বাধীনতা’ শব্দের অর্থ নির্বিত্ত শ্রেণীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদের সঙ্গে নির্বিত্তের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোন সুসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
২. দ্বিতীয়ত, মার্কসকে আশাবাদী নিশ্চয়ই বলতে হবে। কারণ, তিনি অনাগত সমাজ ব্যবস্থার রুপায়ণে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাঁর ধারণা ছিল, শ্রেণী-সংগ্রামের ভেতরে দিয়েই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সন্ধিক্ষণে কিন্তু বারবার ব্যষ্টিচৈতন্য৮৬ বা স্বার্থপরতা আবার মাথা তুলে দাড়াঁতে পারে, এই ভয়ে তিনি নির্বিত্তের নেতৃত্বের৮৭ ব্যবস্থা রেখেছেন। এখানেও মানবচরিত্র সম্বন্ধে আশা ও নিরাশার দ্বন্দ্ব তাঁর মনে রয়েছে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি আশাবাদীই রয়ে গেছেন। কারণ তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠিত হবেই হবে। তবে বহুদিনের পুঁজিবাদী সংস্কার মন থেকে নির্মূল করতে হলে রাষ্ট্রের পক্ষে বজ্রকঠোর হস্তে স্বার্থপরতাকে দমন করতে হবে।
তাঁর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সঙ্গে এরূপ আশাবাদ কী করে খাপ কায়? জগতের কার্যকরন ব্যবস্থায় সে আশাবাদের কোন মূল্য আছে কি? এ যাবত হয়তো মার্কস প্রদর্শিত ধারায় সভ্যতা অগ্রসর হচ্ছে, কিন্তু তাই বলে এ পথেই যে সভ্যতা ধেয়ে চলবে, কি করে বলা যায়? তাই বার্ট্রান্ড রাসেল সত্যই বলেছেন, “ মার্কস নিজেকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করতেন, কিন্তু তিনি যে জাগতিক আশাবাদ৮৮ মনে পোষণ করতেন, তা কেবল আস্তিকের পক্ষেই শোভন”। * ( দার্শনিক শ্রেষ্ঠ স্পিনোজার ধারণা ছিল, জগতের প্রত্যেক বস্তুই Substance বা সারবস্তুর Mode বা খণ্ডিত অংশ। সেই Substance- এর অনেকগুলো গুণ(Attribute); মানুষ মাত্র তার দুটো গুণকেই জানতে পারে। কারণ মানব জীবনে সে দুটো গুণ-স্থিতি (Extension) ও মননশীলতা (Thought) বর্তমান। তাঁর এ মতবাদকে সমান্তরালবাদ (parallelism) বলা হয়। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল, মানব জীবনের এ দুটো দিক পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাদের মধ্যে কোন সংযোগ সম্ভবপর নয়। আবার বস্তু জগতে বা ভাব জগতে যা কিছু রয়েছে, তাঁর মূল উৎস সেই সারসত্তা বা Substance. তিনি তার তাঁর দর্শনে এক জায়গায় ঠাট্টা করে বলেছেন-যদি উড্ডীয়মান তীরেরও চেতনা থাকত তা’ হলে সে মনে করত,তার উড়ে যাওয়ার মূল কারণ সে নিজেই। এ মতবাদের আস্থা স্থাপন করলে ইচ্ছশক্তির স্বাধীনতার মূল্য থাকে না। সব কিছুর মূলে সারসত্তা বর্তমান থাকলে আমাদের প্রতি কাজকর্মেও সেই সারবস্তুর কার্যকারিতা বর্তমান। ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতার মূলে এভাবে কুঠারাঘাত করেও স্পিনরাজ্য আবার অন্য অর্থে তাকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে স্বাধীনতার অর্থ বিশ্ব-সত্তা থেকে কিভাবে বিভিন্ন mode বেরিয়ে আসছে, তাই দেখে জ্ঞান লাভ করে ধন্য হওয়া। জ্ঞানেরও সর্বপ্রধান স্তররূপে তিনি স্বজ্ঞা বা Intuition কে স্বীকার করে নিয়েছেন। সেই স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়ায় সম্পত্তি বা acquisance মানবজীবনের এ পর্যায়ে যে রকম জ্ঞান লাভ হয় তার ফলে সে লাভ করে প্রশান্তি (Beatitude) )।
৩. ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর শোষণের ভয়াবহ রূপ দেখে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রতি মার্কস স্বভাবতই ছিলেন বিমুখ। তাঁর ধারণা ছিল, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ থেকেই শোষণের উৎপত্তি। তাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূল উচ্ছেদ করবার জন্য তিনি তাকে পুঁজিবাদের মূল উৎস বলেই ধরে নিয়েছেন। বাস্তবিক পক্ষে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ অনেকস্থলেই শোষণের কারণ হয়ে দাঁড়ালেও সব ক্ষেত্রেই তা হয় না। দুনিয়ার যাঁরা মনীষী, মননধর্মী, যাঁদের গবেষণার ফলে দুনিয়ার প্রগতি হয়েছে সম্ভবপর-তাঁরা ছিলেন আত্মপ্রচারবাদী৮৯ কিন্তু স্বার্থপর ছিলেন না। মননধর্মী মানুষ মাত্রেরই স্রষ্টা৯০ হিসেবে বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাঁরা স্বার্থপর নন। মার্কসের সংস্থায় এদের কোন স্থান নেই, কারণ সমাজতন্ত্রই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সর্বশেষ কথা। অন্য কোন বিশ্বসংস্থার চিন্তা করা প্রতিক্রিয়ারই ছদ্মবেশ।
কাজেই যে শ্রেণীহীন সমাজ-ব্যবস্থার প্রথম সোপানরূপে মার্কস শ্রেণী সংগ্রামের পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন,তাতে অর্থনৈতিক সংগ্রামের নিরসন হতে পারে, তবে তাতেও সমাজ জীবন অন্যভাবে সংগ্রাম দেখা দিতে পারে। মার্কসের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাঁদের অটল বিশ্বাস,মনন রাজ্যে তাঁরাও নতুন নতুন আবিস্কারের দওলতে মার্কসের দার্শনিক মতের বিরোধিতা করতে পারেন। উদাহরণচ্ছলে বলা যায়, আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কেউ যদি জগতের সর্বত্র সাশ্রয়ী অণুর লীলাখেলাই দেখতে পান তাহলে আদর্শ হিসেবে প্রয়োজনীয় বলে গ্রহণ করলেও মার্কসীয় নিশ্চয়তাবাদে তার বিশ্বাস অটল রইবে না। যদিও সমাজ ব্যবস্থার দৃঢ় অস্তিত্বের জন্য তিনি মার্কসবাদকেই দুনিয়ার চূড়ান্ত মতবাদ বলে ব্যবহারিক জীবনে গ্রহণ করেন, তাহলেও তাঁর ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে মননধর্মী জীবনের সংঘাত ও সংঘর্ষ হয়ে পড়বে অনিবার্য।
৪. তখনকার দিনের প্রচলিত বৈজ্ঞানিক মতবাদের উপর ভিত্তি স্থাপন করে মার্কস তাঁর যে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদ প্রচার করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল জড় পদার্থের মধ্যে কার্যকারণ পরম্পরা সূত্রের অমোঘ কার্যকারিতা। আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় সে মতবাদের ভ্রান্তি প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানবিদ পরলোকগত স্যার জেম্স জিনস বলেছেন, “ সাবেকী পদার্থবিদ্যা ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে বলেই মনে হয়। নতুন পদার্থবিদ্যা এ রকম কোন ঝোঁক নেই বরং হাতলের সন্ধান পেলে যে এ দরজা খোলা যায়, এই ভাবধারার উদ্রেক হয়। পুরাতন পদার্থবিদ্যায় আমরা যে জগৎ দেখেছিলাম, তাতে বাস করার পক্ষে উপযুক্ত ঘরের চেয়ে কারাগারের মতই বেশি দেখাত। নতুন পদার্থবিদ্যায় আমরা যে জগতের সন্ধান পাচ্ছি, মনে হয় তা পশুর আবাসস্থল না হয়ে মানবজাতির উপযুক্ত বাসস্থান হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে। এ বাসস্থানে আমাদের ইচ্ছামত ঘটনাগুলোকে গড়ে তুলতে পারার সম্ভাবনা রইবে এবং এখানে আমরা অধ্যবসায়ের দ্বারা অনেক কিছু লাভ করতে পারব”।
৫. মার্কসের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদের মধ্যে আসল কথা অহংবোধ ও পরার্থিতা সম্বন্ধে তাঁর ধারণা। অহংবোধ ও পরার্থিতাকে সাবেক আমলের মনোবিজ্ঞান তখন পর্যন্ত দু’টো পরস্পরবিরোধী গুণ বলেই স্বীকার করেছিল। মার্কস অহংবোধকেই যত অনর্থের মূল ধারণা করেছেন। তাঁর আগেও দুনিয়ার সকল ধর্মপ্রবর্তক স্বার্থপরতাকে পরার্থিকতার চেয়ে নিকৃষ্টতর বৃত্তি বলেই স্বীকার করেছেন। তবে স্বার্থপরতার অহংবোধ হয়। অহংবোধ ও স্বার্থপরতার মধ্যে প্রভেদ রয়েছে। সে অহংবোধের একেবারে নিরসন হয় কিনা, মানুষকে সম্পূর্ণ পরার্থপর করে তোলা যায় কিনা, সে সম্বন্ধে তর্কের অবকাশ রয়েছে প্রচুর।
মার্কসবাদ ও বস্তুবাদী সমাজতন্ত্র
আসল কথা বল এই যে, অতি আধুনিক গোঁড়া মার্কসবাদীরা বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রের সাথে মার্কসবাদীকে অভিন্ন মনে করেই ভুল করেন। মার্কসবাদকে কম্যুনিজমের দৃষ্টিভঙ্গি বা তার কার্যক্রমের মূলে কম্যুনিষ্ট রয়েছে সত্যিই কিন্তু মার্কসবাদ কম্যুনিজম থেকে বৃহত্তর। মার্কসবাদ কেবল কম্যুনিজম নয়, মানব সভ্যতার প্রত্যেকটি বিকাশের ধারাও মার্কসবাদের অন্তর্গত। মার্কসবাদের চূড়ান্ত সত্য বলে কিছুই নেই। মার্কসবাদের পদ্ধতির প্রয়োগেই মার্কবাদের সারসত্ত্ব। এই প্রয়োগের অনুসরণে যদি আমরা প্রবৃত্ত হই, তাহলে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে মার্কসবাদকে উন্নত করা, বিস্তার করা ও পুনঃপরীক্ষা কেবল সঙ্গতেই হবে না-হবে অবশ্যই কর্তব্য।
টলস্টয় বা নব্য খ্রিষ্টবাদ
মানব-মনের অহংবোধ ও পরার্থতার সমন্বয় সাধনাই ছিল মার্কসের পরবর্তী চিন্তানায়ক মহামতি টলষ্টয়ের জীবন-সাধনা। বর্তমান সভ্যতার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে টলষ্টয় দেখতে পেয়েছিলেন এতসব অসঙ্গতির মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং তার পথ সুগম করার জন্য নানাবিধ কলকারখানা প্রতিষ্ঠা। আবার এসবের মূলে রয়েছে খ্রিষ্টের প্রদর্শিত পথ থেকে দূরে সরে পড়া।
তাই, ঊনবিংশ শতাব্দীর মানব-সভ্যতার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতিতে উত্যক্ত হয়ে তিনি আবার খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠাকল্পে ছিলেন উদ্যোগী । আত্মজিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হয়ে টলষ্টয় তাঁর পরিণতিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানাকেই সব অনর্থের মূল বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। কারণ মালিকানা থেকেই দুনিয়ার যত অমঙ্গলের রয়েছে সম্ভবনা। অপূর্ব ভাষায় তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির নীতিকে আক্রমণ করেছেন- ব্যক্তিগত সম্পত্তিই বর্তমানে সব অনর্থের মূল। এ আপদের যারা অধিকারী অথবা অনধিকারী তাদের উভয়ের যন্ত্রণায় মুহ্যমান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অথবা রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বদাই পরস্পরের সঙ্গে এ বিত্তের জন্যই কূটনীতির চালবাজি চলে। এ বিত্তের জন্যই তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ জ্বলে ওঠে। কখনও বা তা আফ্রিকার মাটির জন্য, কখনও বা চীন বা বলকানের বিশাল ভূখণ্ডের জন্য তার সূচনা হয়। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী,উৎপাদনকারী, জমিদার সকলেই বিত্তের জন্য পরিশ্রম করে-বিত্তের জন্যই ফন্দি এঁটে নিজেদের বিপন্ন করে, অপরকে যন্ত্রণা দেয়। সরকারী কর্মচারগণও পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতা করে বঞ্চনার প্রশ্রয় দেয়, নির্যাতন করে, নিজেরাও নির্যাতিত হয়। এ বিত্তের জন্য আমাদের আদালত, আমাদের পুলিশ সকলেই সম্পত্তির সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। শাস্তির উদ্দেশ্যে রক্ষিত আমাদের কারাগার, পাপের জন্য আমাদের বিভীষিকাময় আকস্মিক দমন, সকলেরই একমাত্র লক্ষ্য বিত্তের সংরক্ষণ।
“চোরাই মালের মস্ত বড় আড়তদার আমাদের রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রই বর্তমানে সমস্ত সামাজিক অবিচারকে বুকের তলায় আগলে রাখে। এর মূলে রয়েছে সেই ব্যক্তিগত মালিকান। সেই উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র বর্বরজনোচিত জুলুমের ঘোরজালে দেশকে দেশ ঘিরে ফেলেছে। এর জন্যই আইন-কানুনের সৃষ্টি, এর জন্যই পুলিশের লোক,সৈন্যসামন্তের প্রয়োজন”।
সেই ব্যক্তিগত মালিকানা কিন্তু রাষ্ট্র কর্তৃক কোন আদেশের বলে হটাৎ বিলুপ্ত হবে না অথবা বিপ্লববাদীদের মত তা’ ব্যক্তির হাত থেকে ছিনিয়ে আনা হবে না।
মালিক স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সে বিত্ত আপনিই ত্যাগ করবে, তা হলেই বিত্তশালী ও বিত্তহারার এ ব্যবধান আপনা আপনি নষ্ট হয়ে যাবে, ধনীকে তার সম্পদ, মননশীলকে তার ঔদ্ধত্য ত্যাগ করতে হবে। শিল্পীকে সর্বসাধারণের চিত্র আঁকতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার উপার্জনের ওপর নির্ভর করে জীবন যাপন করতে হবে। জীবনের আদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সে কিছুই গ্রহণ করবে না।
তাঁর বক্তব্যের সারাংশ সোজা কথায় বলা চলে, “ বিত্তবাদীরা যেরুপ দাবী করে-মালিকের নিকট থেকে জোর করে সমস্ত সম্পদ কেড়ে নিলেই সামাজিক অসাম্যের সমাধান হবে, তা মোটেই সত্য নয়। নিচের স্তরে এ সমতা সাধন সম্ভবপর নয়। ধনীদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অধিকার ত্যাগের মাঝেই তার সাফল্য বর্তমান”।
তাঁর এ মতবাদকে ধর্মীয় সমাজতন্ত্র বলা যেতে পারে। কারণ আদি খ্রিষ্ট ধর্মের প্রেরণায় ব্যক্তি যখন তার প্রয়োজনাতিরিক্ত আর কিছুই গ্রহণ করবে না তখনই হবে আদর্শ সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা- তখন মানুষে মানুষে আর কোন দ্বন্দ্ব থাকা সম্ভব নয়-দুনিয়া হয়ে পড়ে সুখরাজ্য।
ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সাম্যবাদের যোগ করার মহৎ ইচ্ছায় টলষ্টয় যে জীবনবাদের অনুসরণের জন্য মানব সমাজকে আহ্বান করেছেন, তার মাঝে রয়েছে মস্ত বড় অসঙ্গতি। ব্যষ্টির যদি আত্ম-নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার থাকে, তাহলে সে কেন সমষ্টির কল্যাণ কামনায় তার স্বার্থ ত্যাগ করবে। তার উত্তর টলষ্টয় বলছেন, তার জীবনে শান্তি ফিরে আসবে এবং সেই জন্যই যীশু খ্রিষ্ট আত্মত্যাগের পথে অগ্রসর হয়ে মানবজাতিকে আহ্বান করেছিলেন। এ ক্ষেত্রেও অহংবোধকে পরার্থিতার অধীন করার জন্য এক অভিনব সাধনার পরিচয় পাওয়া যায়। তবু আমাদের দেখতে হবে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিলে, সম্পত্তির উপর মানুষের অধিকারের নীতিকে স্বীকার করে নিলে এ সমাজতন্ত্র কিসে সম্ভব হতে পারে? যদি ব্যষ্টির মনে আত্মকেন্দ্রিক মনোবৃত্তি প্রবল থাকে, তার দমনের জন্য কোন উপদেশ দিলেই চলবে না, তার অধিকারকে সম্পূর্ণ বিলোপ করে তাকে মাত্র সম্পত্তির রক্ষক হিসেবে পরিণত করা দরকার।
টলষ্টয়ের চিন্তাধারায় দুস্থ মানবতার জন্য অকপট দরদ ফুটে উঠলেও তিনি ব্যষ্টির স্বাধীনতার সঙ্গে তার মতবাদকে সুসামঞ্জস্য করে তুলতে পারেন নি। কোন্ নীতিতে তার জন্মগত অধিকার ত্যাগ করে মানুষ এক আদর্শ সুখরাজ্য গড়ে তুলবে তার পরিস্কার পদ্ধতি টলষ্টয় দিয়ে যাননি।
আমাদের ভুললে চলবে না যে, সমালোচনা করা সহজ কিন্তু গঠনমূলক সৃষ্টি অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার।
“ যে কোন অবস্থায়ই মানুষ তার যুগের বাইরে শূন্যে অবস্থান করতে পারে না। যেখানে বিভিন্ন স্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষ একত্রিত রয়েছে-প্রাত্যহিক জীবনে সেখানে প্রতিভাশালীর সঙ্গে হয় বেতনভোগীর সমাবেশ-সেখানে জীবনযাত্রার সুসম্বন্ধ রীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। যে মুহুর্তে টলষ্টয় রোগের কারণ নির্ণয় থেকে চিকিৎসা বিধানে মনোনিবেশ করেছেন অর্থাৎ সোজা কথায় যখন তিনি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে অস্বীকার বা নিন্দা করা ছেড়ে ভবিষ্যতের উন্নততর সাধারণতন্ত্রের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, তখনই তাঁর চিন্তাধারা নীহারিকাপুঞ্জের মত অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে রূপ ধারণ করেছে”।* ( Grefan Zewig-Tolstoi.)
গান্ধীবাদ
টলষ্টয়ের ভারতীয় শিষ্য মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নিরুপদ্রব প্রতিরোধের মধ্যেও রয়েছে পরস্পরবিরোধী নানা ভাবের সংঘর্ষ। ব্যক্তি-স্বাধীনতার সঙ্গে আদর্শ সাম্যবাদ বা (গান্ধীর ভাষায়) রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠায় গান্ধীজির জীবন দর্শনে এক মস্ত ফাটল দেখা দিয়েছে। মানুষ যদি স্বভাবতই আত্মসর্বস্ব হয়, তাহলে পরহিতে তার সব অধিকার ত্যাগ কোনকালেই সফল হতে পারে না। শুধু আত্মিক শক্তির বলে ইন্দ্রিয় তথা চক্রজয় সব সময় সম্ভবপর হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বার্থপরতা মাথা তুলে দাঁড়ায়। তার ফলে, মুখে সাম্যবাদ প্রচার করলেও মানুষের শোষণের অবসান হয় না।
এক্ষেত্রে অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গান্ধীজির এ মতবাদ মানব-কল্যাণের উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছিল। একথা সর্বতোভাবে সত্য যে, ১৯২১ সালে গান্ধীজি কর্তৃক প্রবর্তিত অসহযোগ আন্দোলনের ফলে এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক প্রবল বিপ্লব দেখা দিয়েছিল। ইংরেজ শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে অহসযোগ নীতি পালন করে, তাদের শাসন ব্যবস্থাকে বান্চাল করে দেওয়াই ছিল গান্ধিজির জীবনের সর্বপ্রধান মন্ত্র। এ মন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টার ফলেই এদেশে ইংরেজ শাসন ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে। তবে এ অসহযোগ নীতির সঙ্গে যুক্তিসঙ্গতভাবেই যুক্ত ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার কীর্তি। এ অসহযোগ নীতিকে কারো ওপর বলপ্রয়োগে চাপানো যায় না। ব্যক্তিমানস স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাকে গ্রহণ করবে। তাই যদি হয় তাহলে স্বাধীনতা লাভের পরে সে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠায় কেন কোন ব্যক্তি অগ্রসর হবে, তার কোন যুক্তি গান্ধিজি প্রদর্শন করেননি। স্বভাবত স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে অভ্যস্ত ব্যক্তির পক্ষে রামরাজ্যের মত আদর্শিক সাম্যবাদমূলক রাষ্ট্র গঠনে প্রবৃত্ত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এজন্য ব্যষ্টি-মানসেও সাম্যবাদের বীজ রয়েছে এবং অনুশীলনের ফলে তা বিকশিল হতে পারে-এ সূত্রটিও গান্ধীজীর প্রদর্শন করা উচিত ছিল।
ব্যষ্টি-চেতনা ও সমষ্টি-চেতনা বা সাম্যবাদের চেতনার মধ্যে যে বিরাট ফাঁক রয়েছে তার যোগসূত্র আবিস্কারের মধ্যেই রয়েছে রাজনীতিতে সফলতার চাবিকাঠি। গান্ধীজি ঐ সূত্রটি আমাদের দিয়ে যাননি।