তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানব জীবনে সম্বন্ধে আমরা নানাবিধ ধারণার সঙ্গে পরিচিত হই। মানুষকে কোথাও ভাবা হয়েছে সম্পূর্ণ একক ও নিঃসঙ্গ হিসেবে, আবার কোথাও ভাবা হয়েছে শ্রেণীবদ্ধ জীব হিসেবে। এ ধারণার সত্যা-সত্যের ওপরই বিভিন্ন মতবাদের সত্যাসত্য নির্ভরশীল।
অন্যদিকে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদেরও কারণ রয়েছে, কোন্ বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন্ বিশেষ মতবাদের উৎপত্তি-তার কারণ নির্ণয় করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-এক সময় পোপের শাসনে সমস্ত ইউরোপ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে, পোপের অধীনে বিভিন্ন দেশে মস্ত মস্ত জমিদারি গড়ে ওঠে, সে সব জমিদারির মালিক সামন্ত সর্দারের দেশের বুকে চালায় অকথ্য নির্যাতন। তাদের অধীন গরিব চাষিরা ভূমিদাসে৪৫ হয় পরিণত। এসব ভূমিদাস সামন্ত সর্দারের কাঠের কাঠুরে ও পানি সরবরাহকারী রূপে তাদের হাতের পুতুল হয়েই বেঁচে থাকে। এসব সামন্ত সর্দার দেশের উৎপাদন শক্তি তাদের হাতের মুঠোয় রেখে উৎপাদিত দ্রব্য যথেচ্ছা ভোগ করতে থাকে। তারা তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত উদ্ধৃত্ত অন্য দেশে বিক্রি করার জন্য অপর একদল লোককে দিতো। ক্রমে সেই বণিকগোষ্ঠী দেখতে পেলো দেশের সমস্ত চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদন করে ভূমিদাসেরা। সামন্ত সর্দারের বসে বসে ভোগ করে অথচ উৎপাদিত দ্রব্যের ওপর তাদেরই মালিকানার দওলতে তারা বণিকদের উদ্ধৃত্তকে যথেচ্ছা চালান দেওয়ার সুবিধা দেয় না। কাজেই এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবিচারমূলক। তার পরিবর্তে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ারূপে দেখা দেয় নতুন দার্শনিক মতবাদ। তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় উদারনৈতিক মতবাদ।
এ মতবাদের সূচনা হয় ইতালীর রেনেসাঁয়। জার্মানির রিফরমেশনে হয় তার বিকাশ এবং ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবে তা পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। ইতালীর রাজনৈতিক চিন্তানায়ক ম্যাকিয়াভেলিই৪৬ সর্বপ্রথম দেশের শাসন ব্যবস্থায় রাজকীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। পোপের আধিপত্য বিনাশের জন্য তার সূচনা হলেও পরবর্তীকালে ধর্মের রাজ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতি গৃহীত হয়। আল্লাহ্ ও মানুষের অন্তর্বর্তী অন্য কোন ব্যক্তি বা শ্রেনীর আধিপত্য অস্বীকার করে মার্টিন লুথার তাঁর প্রটেসট্যান্ট ধর্ম প্রচার করেন এবং ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় রবোসপিয়ারের জীবনে সাম্য,মৈত্রী ও স্বাধীনতা শ্লোগান হয়ে পড়ে।
এ মতবাদের নঞর্থক দিকের বিচার করলে এক সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্রোহ বলা যেতে পারে; রাজকীয় শাসন ও তার উত্তরাধিকারকে অস্বীকার না করলেও তাকে সীমাবদ্ধ করার দিকে উদারনৈতিক মতবাদের ঝোঁক ছিল। তার সদর্থক দিকের আলোচনা করলে বোঝা যায়-মানুষের অবাধ স্বাধীনতার স্বপ্নই ছিল উদারনৈতিক মতবাদের সর্বপ্রথম কাম্য। ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা এ মতবাদ বরদাশ্ত করেনি। এর বক্তব্য হল, মানুষকে স্বাধীনতা দিতে হবে। স্বাধীনতা পেলে সে যেমন উৎপাদন করতে পারবে তেমনি উৎপাদিত দ্রব্যেরও বিলি-ব্যবস্থা করতে পারে-মানুষের মাঝে কোন বিশেষ প্রাণীর আধিপত্য স্বীকার করে নিলে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
এভাবে, সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ারূপেই দেখা দেয় উদারনৈতিক মতবাদ। সেই উদারনৈতিক মতবাদই কালে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ এবং সর্বশেষে ধনতন্ত্রে পরিণত হয়। ধনতন্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠাকালে তার নানাবিধ ত্রুটির ফলে সমাজজীবনে যে অসাম্যের সৃষ্টি হয় তারই নিরসনকল্পে কার্ল মার্কস ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রচার করেন তাঁর বস্তুতান্ত্রিক সমাজবাদ। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অসঙ্গতি তাঁর চোখে ভয়াবহ রূপ নিয়ে দেখা দেয়। তাই তাকে উৎখাত করার মানসে তিনি ইতিহাসের অভিনব ব্যাখ্যা করেন।
কাজেই, এভাবে উৎপত্তির কারণ বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক মতবাদের মূল্য নিরূপণ করা যায়। তবে এতে আপত্তির কারণ আছে। প্রথমত দেখতে হবে, যে কোন পরিবেশের চাপেই তার জন্ম হোক না কেন, যে কোন মতবাদের সত্যাসত্য নির্ভর করে তার অন্তর্নিহিত যুক্তিবত্তার উপর আমাদের বোঝায় সুবিধার জন্য কোন মতবাদের উৎপত্তির কারণ নির্ণয় করতে পারি, তবে এতে মতবাদের ঠিক মূল্য নিরূপণ হয় না। সে মতবাদ গ্রহণের ফলে মানবজীবনের সুষ্ঠু বিকাশ হয় কিনা তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
দ্বিতীয়ত একই পরিবেশে একই অপব্যবস্থায় উত্যক্ত হয়েও দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠতে পারে। পুজিঁবাদী সমাজের পাপাচারে উত্যক্ত হয়ে মার্কস প্রচার করেন বস্তুতান্ত্রিক সমাজবাদ এবং এ পুঁজিবাদের অত্যাচার আরও চরমসীমায় পৌঁছায় পর তার নানাবিধ অকল্যাণে অতিষ্ঠ হয়ে টলষ্টয় প্রচার করেন তাঁর খ্রিষ্টীয় সমাজবাদ। কাজেই পরিবেশ দ্বারা মতবাদের মূল্য নির্ণয় নিতান্তই অবিচারমূলক কাজ। তাই রাজনৈতিক মতবাদের মূল্য নির্ণয়ে আমরা তার গুণাগুণের বিচার করবো। এ পর্যন্ত যত সব রাজনৈতিক মতবাদের উৎপত্তি হয়েছে তাদের মধ্যে সমাজজীবনে আদি সংখ্যা হিসেবে কোথাও ব্যক্তিকে, আবার কোথাও সমষ্টিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক মতবাদগুলোকে তাই অনায়াসেই দু’ভাগ করা যায়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ
উদারনৈতিক মতবাদের ভিত্তিস্বরূপ যে জীবন-দর্শন গড়ে উঠেছে তাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলার অর্থ এই যে, জগতের অতবার মানব-সমাজের আদি উপাদানরূপে এখানে ব্যক্তির সত্তাকেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। মতের বিভিন্নতা সত্ত্বেও লক৪৭ থেকে শুরু করে এ্যাডাম স্মিথ৪৮ পর্যন্ত যে চিন্তাধারার ইতিহাস পাওয়া যায় তার সারসংক্ষেপে এই বলা যায়ঃ মানুষের চিন্তারাজ্যে চলেছে আণবিক মনস্তত্ত্বের খেলা। রাষ্ট্রীয় জীবনে চলছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বা প্রাধান্যের চেষ্টা। মানুষ একক হয়েই জন্মগ্রহন করে; সেই একক মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শ থেকে গড়ে ওঠে তার সমাজ, তার জাতি, তার রাষ্ট্র। মানুষের আদিসত্তায় রয়েছে তার অহংবোধ৪৯ ও স্বার্থপরতা।৫০ এই আদি মানবের চলাফেরায়,ব্যবসা-বাণিজ্য, চিন্তাধারায় অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে-তার কাজ-কর্মে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়েই রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।
প্রশ্ন উঠেঃ মানুষকে যদি এভাবে স্বাধীনতা দেওয়া যায় তা’হলে তো তাদের মধ্যে সবসময়ই মারামারি-কাটাকাটি লেগেই থাকবে। প্রত্যেকে যদি তার সার্থসিদ্ধির জন্যই চেষ্টা করে তাহলে তো একের স্বার্থের সঙ্গে অপরের স্বার্থের সংঘর্ষের ফলে সবসময়ই মানবজীবনে দ্বন্দ্ব-কোলাহলের সৃষ্টি হবে-মানুষ শান্তিতে দুদিন তিষ্ঠাতে পারবে না। তার উত্তরে লক ধারণা করে নিয়েছেন, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ পশুর মত পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত নয়, সেখানেও মানুষের মাঝে শান্তি বিরাজ করছে এবং মানুষ বিচারবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রকৃতির রাজ্যে অরাজকতার কোন স্থান নেই। প্রকৃতির আইনের প্রভাবে মানুষের স্বাভাবিক অধিকার,স্বাধীনতা ও সম্পত্তি ভোগ করার সুযোগ থাকে। তা সত্ত্বেও প্রকৃতির রাজ্যে আইনকে ব্যাখ্যা করার জন্য বা তার প্রয়োগের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান নেই, যদিও সেই আইন-কানুন সকল মানুষের মনেই কার্যকরী। তবুও বুদ্ধির তারতম্যের দরুন এবং স্বার্থের বিভিন্নতার ফলে নানাবিধ দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয়। এর জন্যই সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়। লকের মতে প্রত্যেক ব্যষ্টিই তার জীবন, স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য অপরের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়; তার ফলেই সম্প্রদায়ও গড়ে ওঠে। এ চুক্তির মর্ম মতে ব্যষ্টিকে প্রাকৃতিক-আইন কার্যে পরিণত করার অধিকার ত্যাগ করতে হয় এবং অপরাধের শাস্তি দান করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। ব্যষ্টিকে অবশ্য তার সমস্ত অধিকার ত্যাগ করতে হয় না, কতকগুলো অধিকার সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দিতে হয়। তাও আবার কোন বিশেষ ব্যক্তি বা কোন দলের হাতে সে সেই অধিকারগুলো অর্পণ করে না, গোটা সম্প্রদায়ের হাতে সেগুলো ন্যস্ত করে সে নিশ্চিত হয়।
লক মানুষকে বুদ্ধিপ্রধান জীবরূপেই ধারণা করেছেন। প্রকৃতির বুকে এই বুদ্ধির দওলতেই মানুষ তার অধিকার বজায় রেখে অন্যের সঙ্গে বিরোধ না করেও চলতে পারে; তবে তাতে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয় বলেই মানুষ তার অধিকার সংকুচিত করে তার নিজের মঙ্গলের জন্যই সম্প্রদায়ের হাতে তার প্রাকৃতিক অধিকারগুলো তুলে দেয়।
সামাজিক চুক্তিবাদ
এই সব মতবাদের বিরুদ্ধে ফরাসি দার্শনিক ‘রুশো’ এক নতুন মতের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বড় আক্ষেপ করেই বলেছেন, মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সে সর্বদাই শিকলাবদ্ধ থাকে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের ওপর কোন আদেশ-নিষেধ, আইন-কানুন চাপানো যায় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নানা নীতি, নানা আইন মেনে চলতে এবং তার ফলে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ‘রুশো’ মানুষকে আবার তার স্বাভাবিক ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আহব্বান করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, প্রকৃতির কোলে স্বাভাবিক পরিবেশে মানুষের প্রক্ষোভে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে, অপ্রাকৃত মানব-সৃষ্ট পরিবেশ তা’ হওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতিতে পশু, পাখি, কারো কোন দুঃখ-দৈন্য নেই। তারা অবাধে বিহার করে, তাদের অভাবেরও কোন তাড়না নেই-কারণ অভাবে উৎপত্তি হলেই তার বুদ্ধির নিবৃত্তির উপায় তার পক্ষে সহজলভ্য। মানুষ তার বুদ্ধির প্যাঁচে গড়ে তুলছে তার সমাজ, তার রাষ্ট্র, তার নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠান। এতে মাববজীবনের পরিপূর্ণ স্ফূর্তি লাভ হয় না বলেই জীবনে যতো দুঃখের হয় উৎপত্তি। তার ধারণা ছিল, প্রকৃতি থেকে বিকাশের ধারায় কোন এককালে মানুষকে তার জন্মগত স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয় তার আত্মরক্ষার জন্য; অন্য মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে গড়ে তোলে তার গোত্র, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্র। রুশোর জীবনে তাই সর্বপ্রধান সমস্যা ছিল, অন্যান্য লোকের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্র গঠন করেও ব্যষ্টি কিভাবে তার স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে তার উপায় উদ্ভাবন।
তাঁর এ মতবাদকে বলা হয় সামাজিক চুক্তিবাদ৫১। এ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ব্যষ্টি তার সমস্ত অধিকার সম্প্রদায়ের হাতে ন্যস্ত করে। সকলকে একইভাবে সম্প্রদায়ের হাতে তাদের অধিকার অর্পণ করতে হয় বলে অন্যের পক্ষে পীড়াদায়ক কোন শর্ত আরোপিত হওয়ার সুযোগ পায় না। সামাজিক চুক্তিমতে সম্প্রদায়ই সার্বভৌমত্ব৫২ লাভ করে। কারণ ব্যষ্টি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তার সমস্ত অধিকার সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দেয়। তবুও এই সার্বভৌম সম্প্রদায় ব্যষ্টির পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজ করতে পারে না। কেননা ব্যষ্টির স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অধিকার ত্যাগের ফলেই সম্প্রদায়ের হয় প্রতিষ্ঠা। রুশোর জবানীতেই তাঁর মতবাদ পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে;
আমরা প্রত্যেকেই তার শরীর ও শক্তি সর্বসাধারণের মহান ইচ্ছার অধীনে সমর্পণ করি এবং আমাদের সংঘবদ্ধ অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমাদের সমগ্র সম্প্রদায়ের অবিভাজ্য অংশরূপে গ্রহণ করি। এই সমাবেশের ফলে একটা নৈতিক ও সংঘবদ্ধ সংগঠনের সৃষ্টি হয়-যার নিস্ক্রিয় অবস্থার নাম রাষ্ট্র৫৩ সক্রিয় অবস্থার নাম সার্বভৌমত্ব এবং অনুরুপ কোন সংগঠনের সম্বন্ধে যাকে বলা হয় শক্তি।৫৪* (Rousseau-Social Contract.)
ব্যষ্টি সম্বন্ধে এত উচ্চ ধারণা পোষণ করা সত্ত্বেও রুশো ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণে কোন প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেননি। তিনি পরিস্কার ভাষায় বলেছেনঃ
রাষ্ট্রে সঙ্গে নাগরিকদের সম্বন্ধের ফলে রাষ্ট্রই তার নাগরিকদের সম্পত্তির একমাত্র মালিক।* (Rousseau-Social Contract.)
সূক্ষ্ম বিচারে প্রবৃত্তি হলে দেখা যায়, রুশোর ভাষায় অনেক পরস্পরবিরোধী মতামত সন্নিবেশিত রয়েছে। ব্যষ্টি যদি সম্পুর্ণ স্বাধীন হয় তাহলে সম্প্রদায় বা রাষ্ট্রে হাতে তার সম্পূর্ণ অধিকার তখনই ত্যাগ করতে পারে যদি তার ব্যক্তিগত অধিকার কোন অংশেই ক্ষুণ্ন না হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধিকার তো ক্ষুণ্ন হয়েছেই, অধিকন্তু তাকে সাধারণের ইচ্ছার ওপর তার সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিতে হয়েছে।
মানুষের মনে যদি সর্বসাধারণের হিত করার মত কোন পরার্থপর৫৫ সৎ প্রবৃত্তি না থাকে, তাহলে তার অহংবোধ৫৬ কিছুতেই তাকে এভাবে আত্মসমর্পণ করতে দেবে না। কাজেই ব্যষ্টির স্বাতন্ত্র্য৫৭ বা তার অহংবোধ স্বীকার করে রাষ্ট্র বা তার সার্বভৌমত্তে পৌঁছা রুশোর পক্ষে যুক্তিসম্মত হয়নি।
প্রকৃতপক্ষে রুশো তাঁর মতবাদের সমর্থনে কোন মননশীলতার অবতারণা করেননি। মরিমীবাদীদের মত এক বিশেষ ভাবাবেশ উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর দার্শনিক মতবাদ গড়ে তুলেছেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে নয়, ভাবের আবেশে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে মানব মনে কার্যকর করে তোলাই ছিল রুশোর জীবনের সাধনা। তাঁর জোরালো ভাষার আবেদনে ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লব হয়ত সহজে ঘটতে পেরেছিল কারণ তার পশ্চাতে ছিল দীর্ঘকালের নির্যাতিত মানবতার মুক্তির প্রয়াস। তবুও যুক্তির কষ্টিরপাথরে বিচার করলে তাতে নানা ত্রুটি সহজেই লক্ষ্য করা যায়।
উদারনৈতিক মতবাদ বা সামাজিক চুক্তিবাদের মধ্যে ব্যষ্টি সম্বন্ধে ধারণার বিশেষ কোন প্রভেদ নেই। উভয়ক্ষেত্রেই ব্যষ্টিকে কল্পনা করা হয়েছে একক ও সম্বন্ধহীনভাবে। পূর্বেই বলা হয়েছে, মনোবিজ্ঞানের জগতে যেমন আণবিক মনস্তত্ত্বের সূত্রপাত তেমনি মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন,স্বার্থান্বেষী জীবরূপে গ্রহণ করে এই নব্য ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ দুনিয়ার ইতিহাসে এক অভিনব চিন্তাধারার প্রবর্তন করে।
উদারনৈতিক মতবাদের আলোচনায় আমার দেখেছি কোনও বিশেষ কালে এক শ্রেণীর আধিপত্য বিস্তারের ফলে দেশের উদ্ধৃত্তের হয় অপব্যবহার। সেই বিশেষ শ্রেণী তার নিজের স্বার্থে সে উদ্ধৃত্তকে ব্যবহার করে। তারই ফলে শ্রেণী-সংঘর্ষ হয়ে ওঠে অনিবার্য। তাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমতা সাধন করার জন্য ব্যক্তিকে দিতে হয় অবাধ স্বাধীনতা। সে অবাধ স্বাধীনতার ফলে কোন বিশেষ শ্রেণী আর শোষণের সুযোগ পায় না। তার জন্য মানুষের আসল প্রকৃতির অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে এক নতুন দর্শনের হয় সৃষ্টি। সে দর্শনের মোদ্দা ভাবার্থ এই ঃ মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর। তার উৎপাদনের প্রাথমিক কারণ,অভাবের নিরসন হলেও উদ্ধৃত্ত থেকে সে স্বভাবতই মুনাফা করতে চায়। সে সুযোগে বাধা উপস্থিত হলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষের হয়ে পড়ে অনিবার্য। সেই সংঘর্ষকে এড়াতে হলে মানুষের স্বাধীনতার কোন সীমারেখা টেনে নেয়া সঙ্গত নয়, তাকে দিতে হয় নিজের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের অধিকার। তা’ পেলেই সে তার অভাব নিরসনের জন্য যেমন করবে পর্যাপ্ত উৎপাদন-তেমনি সে উদ্ধৃত্তকেও সে তার নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করবে। এই দার্শনিক মতবাদের নীতি হল ব্যক্তিকে একা থাকতে দাও৫৮।
ধনতন্ত্র
উদারনৈতিক মতবাদই পরিশেষে ধনতন্ত্রে বিকৃত হয়ে পড়ে। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিশেষ করে যে কোন দেশের পুরোহিত ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর সংঘর্ষের অবসানের জন্য উৎপাদন বণ্টন ব্যবস্থার সুসামঞ্জস্যের জন্য এ নতুন মতবাদের সৃষ্টি হলেও তার চরম অভিব্যক্তিতে নয় ধনতন্ত্রের সৃষ্টি। প্রত্যেক ব্যক্তিকে উৎপাদনের অবাধ সুবিধা দেওয়ার ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আবার শুরু হয় সংঘাত ও সংঘর্ষ-আবার শুরু হয় যুদ্ধ। এ মতবাদের কল্যাণে সর্বসাধারণ মানুষ, বিশেষ করে উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে তাদের ইচ্ছামত মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে রাতারাতি দৈত্য-দানোবের মত পা ফেলে অগ্রসর হয়। দুদিনেই দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ তারা নিজেদের কুক্ষিগত করে নেয়। তার রক্ত-রাঙা ইতিহাস পাওয়া যায় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় জাতিগুলোর কর্মসূচিতে। পৃথিবীর নানাদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য উপলক্ষে ছড়িয়ে পড়ে শাসন ও শোষণ করে ইউরোপীয় জাতিগুলো দুনিয়ার বুকের রক্ত শুষে নিয়েছে।
ধনতন্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। বিদেশের লোককে শোষণ করতে হলে স্বদেশের লোকের মধ্যে দলীয় মানসিকতার সৃষ্টি হওয়া দরকার। যতই ব্যষ্টির গুণগান করা হোক না কেন, একাকী কোন ব্যক্তি কোথাও শোষণ করতে পারে না- তার জন্য তার দেশের সর্বসাধারণের সম্মতি ও সহযোগিতার প্রয়োজন।
সেইজন্য পুঁজিবাদের প্রথম সফলতার যুগে দেশের সাহিত্যিকরা জাতীয়তার জয়গান গেয়ে দেশের সর্বসাধারণকে উদ্ধুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন-
Rule Britania, rule the waves
Britain never shall be slaves.
একবারে নিছক কবি-জনোচিত উচ্ছ্বাস নয়। তার মূলে রয়েছে অন্যান্য জাতিকে শোষণ করার জন্য দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করার অভিসন্ধি। এ মনোবৃত্তি বিকশিত হলেই অন্য জাতির প্রতি স্বভাবত বৈরীভাব জন্মে। কারণ, এর মূলে রয়েছে জগৎ গ্রাস করার বাসনা। কাজেই দেখা যায়, পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি থেকেই জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় এবং জাতীয়বাদের উৎপত্তি হলেই পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
ধনতন্র বিকাশের প্রথম পর্যায়ে দেশে বিদেশে মূলধন বিস্তারের ফলে এ মতবাদের উপাসক ধনতান্ত্রিক দেশগুলো ফেঁপে ওঠে। বিশেষত শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপীয় দেশগুলো উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে। কিন্তু জোয়ারের শেষে ভাটার টানে যখন দেশ-বিদেশে মূলধন খাটানোর আর সুবিধা থাকে না, তখনই ধনতন্ত্রবাদী বুঝতে পারে তার অন্তর্নিহিত গলদ। যখন দেশের টাকা বিদেশে খাটিয়ে পরধন আত্মসাৎ করার আর কোন সুবিধা থাকে না-যখন নিজের দেশের মজদুর শ্রেণী বিদ্রোহ ঘোষণা করে- “তখন দেশের সুখ-শান্তি আর সুবিধার নামে করতে হয় পশু শক্তির প্রয়োগ”। তাই ধনতন্রের সংকোচনের যুগে তারই প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল হিসেবে হয় ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি।*(Harlod Lasky, Reflections on the Revolution of our times.)