১৩.
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
মুসলিম লীগ ছিল জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য নূন্যতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী বহু পরস্পরবিরোধী শক্তির একটি জাতীয় ঐক্যমঞ্চ বা জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন। পাকিস্তান অর্জনের পর সদ্য স্বাধীন দেশের পুনর্গঠনে এই দল বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়। লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত মুহাজির পাকিস্তানে আগমনের ফলে সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তীব্র হয়। মুসলিম লীগের মতো একটি অসংগঠিত আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে এই সংকট মুকাবিলা অসম্ভব বিবেচনা করেন জিন্নাহ। তিনি বৃটিশ-ভারতের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাইস রিগাল সিস্টেমের অধীনে গভর্নর জেনারেলের পদ গ্রহণ করেন। এখান থেকেই পাকিস্তানের সিদ্ধান্তগ্রণ পদ্ধতিতে আমলাতন্ত্র সর্বাধিক শক্তিশালী ও স্থায়ী উপাদানরূপে প্রতিষ্ঠা লাভের সূচনা হয়।
দলের সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে জিন্নাহ হলেন গভর্নর জেনারেল। চৌধুরী খালিকুজ্জামানের ‘দুর্বল কাঁধে’ ন্যস্ত হয় সংগঠনের দায়িত্ব। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলের গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলী রচনা করা হয় করাচীতে অনুষ্ঠিত গোপন কাউন্সিল সভায়। গভর্নর জেনারেলের সরকারি ভবন থেকে প্রেসনোট আকারে দলের নীতিনির্ধারণী বক্তব্য প্রচার করা হয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে গঠিত লীগের প্রধান সিদ্ধান্তকারী সংস্থা ‘কনভেনশন’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রতম দশ বছরেও কোন বৈঠকে মিলিত হয়নি। দলের নির্বাচিত নীতিনির্ধারণী সংস্থা কাউন্সিল প্রথম নয় বছরে মাত্র সাতটি বৈঠকে মিলিত হয়। সরকারি অনুমোদন পাবে না এমন কোন প্রস্তাব উত্থাপনের সাহস দলের ওয়ার্কিং কমিটির ছিল না। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য গঠিত ‘কনসেম্বলী’ স্বৈরাচারী উপায়ে বিলুপ্ত হওয়ার আগে চার বছরে মাত্র চারটি অধিবেশনে মিলিত হয়ে প্রচারসর্বম্ব কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের এক বিরাট প্রভাবশালী অংশের পাকিস্তানী এলাকায় কোন নির্বাচনী এলাকা ছিল না। ফলে মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশ থেকে আগত ব্যক্তিগত প্রভাব-নির্ভর এসব ত্যাগী নেতার অনেকেই সাধারণ নির্বাচনের গণ-রাজনীতির চাইতে প্রাসাদ-রাজনীতিতে বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
দলীয় কাউন্সিল ও জিন্নাহর নীতি লংঘন করে একশ্রেণীর নেতা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলিম লীগকে দেশের একক জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপে প্রচার করেন। ‘মুসলিম লীগের বিরোধিতা মানেই পাকিস্তানের বিরোধিতা’ এবং ‘পাকিস্তানের বিরোধিতা মানেই ইসলামের বিরোধিতা’- এমন একটি ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস একশ্রেণীর মুসলিম লীগারের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। মুসলিম লীগের সরকার দল ও দেশবাসীর কাছে দায়িত্বশীল হতে পারেনি। ফলে দলের মাধ্যমে জনগণের দাবি সমর্থিত হওয়ার সুযোগ রহিত হয়। জনগণের সাথে দলের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। ফলে দলীয় কাঠামোর মাধ্যমে জনমত উপলব্ধি করার সুযোগ বন্ধ হয়। সকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা রাষ্ট্রভাষার মতো সংবেদনশীল ইস্যুতেও দায়িত্বহীন অর্বাচীনসুলভ আচরণ করেন।
গরমিলের রাজনীতিঃ স্লোগান বনাম বাস্তবতা
একশ্রেণীর নেতা পূর্ববাংলায় দলের রশীদ বই বগলদাবা করে মুসলিম লীগের দরজা ‘জনগনেল মুখের ওপর’ বন্ধ করে দেন। বস্তুত মুসলিম লীগের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করা হয়। এর ফল হিসেবেই পূর্ববাংলা থেকে শক্তিশালী বিরোধী দলরূপে ১৯৪৯ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ বা জনগণের মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
বিরোধী মতের লোকদের সাথে আচরণে মুসলিম লীগারদের দায়িত্বহীনতা সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মত পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদেরকে ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘বিদেশী চর’ আখ্যা দেওয়া হয়। ফলে দেশের আসল শক্ররা উৎসাহিত হয়। বহু রাজনৈতিক কর্মীকে রাজনৈতিক মত-পার্থক্যের কারণে কম্যুনিস্ট আখ্যা দিয়ে জেলে ঢুকানো হয়। জেলের ভেতর তাঁরা সত্যিকার কম্যুনিস্টদের কাছ থেকে সবক নিয়ে বেরিয়ে আসেন।
দলের ভেতর পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠী-স্বার্থ ও আঞ্চলিক-স্বার্থের সমন্বয় বিধান ও আর্টিকুলেট করতে মুসলিম লীগ নেতাগণ ব্যর্থ হন। বছরে দুই আনা চাঁদা দিয়ে ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে একমত পোষণে’র ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী লাখ লাখ সদস্যকে প্রতিশ্রুত ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের নির্মাতারূপে গড়ে তোলার কোন কর্মসূচিই মুসলিম লীগের ছিল না। মুসলিম জাতীয়তাবাদের স্লোগানের সাথে ইসলামী আদর্শবাদের সমন্বয় না ঘটায় দলের নেতা ও কর্মীদের কথা ও কাজে বিরাট গরমিল দেখা দেয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্র ও ইসলামী জীবনবিধান কায়েম, সংখ্যালঘুদের ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা প্রভৃতি স্লোগানধর্মী কথাবার্তা মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে বারবার উচ্চারণ করা হয়েছে। কিন্তু জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধানে কোন কর্মসূচি তারা পেশ করেনি। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে জনগণকে উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করলেও ইসলামী জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়নের কোন কর্মসূচি কিংবা এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণাও তাদের ছিল না।
পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে একটি কমিটি ১৯২৭ সালেই ভারতের জন্য শাসনতন্ত্রের একটি ব্লুপ্রিন্ট প্রণয়ন করেছিল। অন্যদিকে ‘আল কুরআনই হবে পাকিস্তানের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র’ এই জননন্দিত স্লোগান ছাড়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের কোন নকশা মুসলিম লীগের হাতে ছিল না। শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘হিন্দু-ভারত’ প্রতিষ্ঠার উপযোগী করে ঢেলে সাজানোর জন্য কংগ্রেস বহু আসেই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নেতৃত্বে ‘ওয়ার্ধা স্কীম’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ ও লক্ষ্য অনুসারে ভবিষ্যত নাগরিত সৃষ্টির উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের কোন চিন্তা-ভাবনা মুসলিম লীগ করেছে বলে জানা যায় না। কংগ্রেস নেতৃত্ব স্বাধীনতার আগেই ভারতের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র বছরখানেক আগে লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে গঠিত লক্ষ্য-বঞ্চিত অর্থনৈতিক কমিটি স্বাধীনতার পরও অর্থনৈতিক পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া দূরে থাক, একটি উন্নয়ন কর্মসূচি পর্যন্ত পেশ করতে পারেনি।
পশ্চিম-পাকিস্তানের সামাজিক অবস্থা ও রাজনৈতিক কাঠামোগত কারণে মুসলিম লীগ সকল দুর্বলতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও কিছু বেশি সময় সেখানে রাজনৈতিক প্রাধান্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের পটভূমি ভিন্ন হওয়ার কারণে উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণের মধ্য দিয়ে এখানকার উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাজনৈতিক সচেতনতা ও উচ্চভিলাষে অগ্রসর ছিল। তাদের দাবি সমর্থন ও পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় মুসলিম লীগের সাথে এই শ্রেণীটির সংঘর্ষ অনিবার্য হয়। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই প্রদেশে মুসলিম লীগের নেতৃত্বের অবসান ঘটে। পূর্বাঞ্চলে নির্বাচনী পরাজয় এবং পশ্চিমাঞ্চলে সামন্ত অভিজাতদের দ্বারা ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়। ফলে গভর্নর জেনারেণ গোলাম মোহাম্মদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নাজিমউদ্দীনকে অপসারণ ও আইন পরিষদ বাতিল করা সম্ভব হয়।
স্বাধীনতার পর দলের পনর্গঠন কর্মসূচিকে গুরুত্বদানে ব্যর্থতা এবং সুসংহত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জাতীয়ভিত্তিক ও গণভিত্তিক দলরূপে গড়ে ওঠার ব্যর্থতা স্বাধীনতা আনয়নকারী মুসলিম লীগের সকল কৃতিত্ব স্লান করে দেয়। দলের ভেতরে নিজস্ব আদর্শভিত্তিক সিস্টেম চালূ করতে না পারার দরুন মুসলিম লীগের কর্মী ও নেতরা ডান, বাম, চরম ও নরম ধারায় বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। নেতা হওয়ার লোভে বহু জাঁদরেল কর্মী সেক্যুলার পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েন। নানা রাজনৈতিক উপ সংস্কৃতির ধারক মুসলিম লীগের ভেতর থেকে বহু রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে আদর্শিক বা রাজনৈতিক প্রতিরক্ষার কোন ধারা অনুসৃত না হওয়ায় জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে জাতিসত্তার সুরক্ষায় এবং পরিচর্যা ও বিকাশদানে এই দল ব্যর্থ হয়। তাদের আদর্শিক বিভ্রান্তি ও ব্যর্থতা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ বিলম্বিত করে। ফলে পাকিস্তান বিরোধী প্রচারনার পথ প্রশস্ত হয়। মুসলিম লীগের সামগ্রিক রাজনৈতিক ব্যর্থতাই দেশে সামরিক শাসন ডেকে আনে। স্বৈরাচারের দশক পাড়ি দিয়ে জাতি মুসলিম লীগের ভুলের বোঝা মাথায় নিয়ে দ্রুত বিচ্ছিন্নতার পথে অগ্রসর হয়। সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র সে বিচ্ছিন্নতাকে ত্বরান্বিত করে এবং নিয়মতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তোলে। পাকিস্তান আন্দোলনের মূল শক্তিকেন্দ্র বাংলাদেশ সিকি শতকেরও কম সময়ের ব্যবধানে নয় মাস স্থায়ী রক্তক্ষয়ী জন-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্ব অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানরা পৃথক স্বাধীন দেশ কায়েম করে মুসলিম জাতি-স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক লাহোর প্রস্তাবের মূল কাঠামোতে প্রত্যাবর্তন করে।
রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে হঠকারিতা
পাকিস্তানী শাসকগণ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে দেশের জনগণের ওপর যে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তা ছিল সংখ্যাগরিষ্ট পূর্ববাংলার জনগণের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রাম সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত এক পর্বতপ্রমাণ ভূল। তাদের ভুল সিদ্ধান্ত পূর্ববাংলার জনমানসে এক চরম নেতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি করে।
এই এলাকার জনগণের অস্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য ও অধিকারের সকল সংগ্রামে ভাষার প্রশ্নটি সব সময়ই বিরাট হয়ে দেখা দিয়েছে। যুগে যুগে বিভিন্ন আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী এই এলাকার সমাজ-সভ্যতার বিকাশধারাকে রুদ্ধ করার জন্য জনগণের মুখের ভাষাকে প্রভাবহীন ও বিকল করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এ পটভূমিতে বাংলার মানুষের ভাষার লড়াই তাদের ভাষার ইতিহাসের মতই প্রাচীন। বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষার এই লড়াইকে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তুলনা করেছেন ‘অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যকার রাজনৈতিক লড়াই’য়ের সাথে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছিল ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার গণতন্ত্রী জনগণের বিজয়। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগণ রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নের যে মুর্খতাপ্রসূত রায় দিলেন, তা এ এলাকার জনগণের কাছে গণতন্ত্রের পরাভবরূপে চিহ্নিত হয়।
কুড়ি শতকের সূচনাতে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হলে অঞ্চল নির্বিশেষে সারা ভারতের হিন্দুরা হিন্দির পক্ষে মত দিয়েছিল। অন্যদিকে এক মাত্র বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের মুসলমানরাই ছিল উর্দুর পক্ষে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৮ সালে গান্ধীকে লেখা চিঠিতে ভারতের রাষ্ট্রভাষারূপে হিন্দির পক্ষে তাঁর মত ব্যক্ত করেন। আর একই বছর বিশ্ব-ভারতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর মত ব্যক্ত করেন। তিনি ঘোষণা করেনঃ
“শুধু ভারত কেন সমস্ত এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্তান হবে সর্বোচ্চ। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলাভাষা এশিয়া র ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়”।
উর্দু-হিন্দি-বাংলা ভাষার বিতর্কে কংগ্রেসের সব নেতাই এক বাক্যে হিন্দির পক্ষে রায় দেন। এ পরিস্থিতিতে ১৯২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লিখিতভাবে দাবি উত্থাপন করেন পূর্ববাংলার জননন্দিত নায়ক সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুর। দাবিনামায় তিনি বলেন, “ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলাকে”। এরপর ১৯৩৭ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ বাংলার মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র দৈনিক আজাদের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেনঃ
“সাহিত্যের মধ্যে বাংলা সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার বিবিধ ভাব প্রকাশের উপযোগী শব্দের সংখ্যাই বেশি। অতএব বাংলা সব দিক দিয়াই ভারতের রাষ্ট্রভাষা করিবার প্রস্তাব করিয়াছে বটে, কিন্তু এ বিষয়ে বাংলা ভাষার চেয়ে হিন্দির যোগ্যতা কোন দিক দিয়াই বেশি নহে”।
ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের বাংলা সাহিত্যে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যে নব জাগরণের সৃষ্টি হয় তার মূলেও তাদের নিজস্ব ভাষার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে কলকাতায় ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ ও ঢাকায় ‘পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে’র মাধ্যমে বাংলার মুসলিম সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীগণ সংগঠিত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন। বাংলার মুসলিম জনগণের কাছে রাজনৈতিক স্বাধীনতার চাইতে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার বিষয়টি এতটুকু কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এ কারণে বাংলার জনগণের পাকিস্তান আন্দোলনে সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট ছিল অধিক শক্তিশালী। দীর্ঘদিনের সংগ্রামী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এ এলাকায় মুসলিম সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীগণ মর্মে উপলব্ধি করেছিলেনঃ ‘রাজনৈতিক পাকিস্তানের জন্ম যদি কোন কারণে নাও হয়, সাংস্কৃতিক পাকিস্তানের জন্ম হতেই হবে’।
এ পটভূমিতেই বাংলার মুসলমাননদের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তাদের ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার আদায়ের লড়াই পরস্পর হাত ধরাধরি করে এগিয়েছিল।
এ পটভূমি সামনে রাখলে পাকিস্তানী শাসকগণ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোনরূপ হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূলে বাংলাদেশের অবদান চিল সর্বাধিক। চল্লিশের লাহোর প্রস্তাব ও ছেচল্লিশের দিল্লী প্রস্তাবের উত্থাপনকারীরূপেও গৌরবের হকদার ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল পাকিস্তানী অবকাঠামোর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি জোরদার করারই একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশই ইংরেজদের কাছে প্রথম পদানত হয়েছিল এবং ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের মানুষকে দীর্ঘকাল জড়িত থাকতে হয়েছে। ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুদের সর্বাধিক শোষণের শিকার এ অঞ্চলের মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে মূল চালিকাশক্তিরূপে ভূমিকা পালন করেছে। তারাই ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ। তা সত্ত্বেও এলাকার জনগণের মুখের ভাষার মত স্পর্শকাতর বিষয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে, তা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতির প্রশ্নে এক পর্বতপ্রমাণ ভুলরূপে প্রমাণিত হয়। ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানী শাসকদের চিন্তা শুধু ভুলপ্রসূত ছিল না, তার চেয়ে বেশি ছিল স্থুল মানসিকতা প্রসূত।
তাদের এই স্থুল চিন্তার একটি দিক উন্মোচিত করে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর সংখ্যা ‘কৃষ্টি’ পত্রিকায় ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তা থেকে মনে হয়, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্করূপে উর্দুকে গ্রহণ করার ব্যাপারে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণধারগণ কর্তৃক হিন্দুস্তানী নামক কৃত্রিম হিন্দি ভাষাকে বহুভাষী হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্তেরই অনুকরণ করেন। এর প্রতিবাদে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক লিখেছেনঃ
“কংগ্রেসের অনুকরণে মুলসিল লীগও উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার একটি প্রবল বাসনা পোষণ করিতেছেন বলিয়া মনে করিবার কারণ আছে। যদি এই কারণে পূর্ব-পাকিস্তানে উর্দুকে প্রচলিত করিবার আয়োজন চলিতে থাকে তবে বুঝিতে হইবে আমরা এখনো অপরের দাসত্ব বন্ধন ছিন্ন করিবার উপযুক্ত হই নাই”।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাদের কারো ভাষাই উর্দু ছিল না। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু লিখেতে কিংবা পড়তেও জানতেন না। পাকিস্তানের মাত্র দুই ভাগ লোকের ভাষা উর্দু হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র পাকিস্তানের জন্য লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কারূপে এই ভাষাকে গড়ে তোলার ইচ্ছা ‘জাতীয় সংহতির প্রয়োজনে’ কারো কারো ছিল। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানবাসীরা এটাকে তাদের জীবনীশক্তির ওপর আঘাতরূপে গণ্য করেন।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাষার প্রশ্নে যেকোন হঠকারী সিদ্ধান্তের পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে তমদ্দুন মজলিস প্রচারিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা’ শীর্ষক পুস্তিকায় একটি প্রবন্ধে বলা হয়ঃ
“বর্তমান যদি গায়ের জোরে উর্দকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। তাহলে পূর্ব পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হওয়ার আশঙ্কা আছে। জনমতের দিকে লক্ষ্য রেখে ন্যায়সঙ্গত এবং সমগ্র রাষ্ট্রের উন্নতি সহায়ক নীতি ও ব্যবস্থা অবলম্বন করাই দূরদর্শী রাজনীতিকের কর্তব্য”।
পাকিস্তানী তদানীন্তন শাসকগণও এ ধরনের হুশিয়ারীর প্রতি কর্ণপাত করেননি। উর্দু ভাষার বিকাশে মুসলমানদের ঐতিহাসিক অবদান এবং উর্দু ভাষা ইসলামী উপাদানে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাংলার সাধারণ মানুষের উর্দুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই শ্রদ্ধাশীলতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে শাসকগণ তৎকালীন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের পাশাপাশি শুধু উর্দু ব্যবহারের আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যে কন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইংরেজ সচিব মি. গুডইউন স্বাক্ষরিত একটি সার্কুলার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। তাতে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়সূচিতে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, উর্দু, হিন্দি, এমনকি সংস্কৃত ও ল্যাটিনের মতো মৃত ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। শুধু ছিল না পাকিস্তানের মেজরিটি জনগণের মাতৃভাষা বাংলা। এ ধরনের অবহলোর প্রতিবাদে ভাষার প্রশ্নে বিক্ষোভ দ্রুত ধূমায়িত হয়ে ওঠে। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসকগণ দুই পাকিস্তানের ঐতিহাসিক ও সাংস্কুতিক বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন।
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের বিষয়টি স্মরণ রাখলেও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এরূপ অবাস্তব ও অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ লাহোর প্রস্তাবের বাস্তব দিকটি বুঝতে যেমনি ভুল করেছেন, একইভাবে তাঁরা আরেকটি বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করেছেন। আধুনিক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম জাগরণের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম, ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের উত্তরসুরী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদের উত্তরসুরী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এক অলিখিত আঁতাতে আবদ্ধ ছিল গোড়া থেকেই। দেশ বিভাগের র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মধ্য দিয়েই তার প্রকাশ ঘটেছিল। এই ষড়যন্ত্র মুকাবিলা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও সমুত্থিত দাবির মীমাংসা করার জন্য যে প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও সাবধানতা প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যবশত রাষ্ট্রনায়কোচিত সেসব গুণ শাসকদের ছিল না। অথচ ভাষা আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব এমনকি তৎকালীন সংগ্রামী ছাত্রসমাজও এদিক থেকে অনেক বেশি সজাগ ও সচেতন ছিলেন।
১৯৫১ সালের ৮ সেপ্টেস্বর ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা কর্মপরিষদ’ প্রচারিত ইশতেহারটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। এ ইশতেহারে বলা হয়ঃ
“পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জনের উপর লোক বাংলা ভাষাভাষী। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। উর্দুর সাথে আমাদের কোন বিরোধ নাই। পৃথিবীর কোন রষ্ট্রে যদি দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রভাষা প্রচলন নাও থাকতো, তাও আমরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন করতাম। কারণ পাকিস্তানের উন্নতি, পূর্ণ বিকাশ ও একতার জন্য বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কেবল বাঞ্ছনীয়ই নয়, একান্ত প্রয়োজনীয়। এই আন্দোলনকে সমর্থন করে পাকিস্তানকে সবল করা আজ যুব সমাজের কর্তব্য। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অর্থ জাতিকে দুর্বল করা। আমরা আজ দুর্বল হতে চাই না, চাই সবল হতে। তাই বন্ধুগণ, পাকিস্তানকে সবল করতে হলে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্টিত করুন। আপনারা এই মহৎ কর্তব্যে এগিয়ে আসুন। জনসাধারণকে বুঝিয়ে দিন, বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে পাকিস্তানের অনিষ্ট করা হবে”।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠার দাবি শুধু উপেক্ষাই করা হয়নি, এই আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের কারসাজি বলেও অপব্যাখ্যা করা হয়। অথচ বাংলা ভাষঅর এই আন্দোলন ছিল স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বধর্মপ্রেমপ্রসূত। এ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত উদার ও সহনশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিলঃ
“বাংলাকে উর্দুর সাথে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের অফিস আদালত ও শিক্ষার মাধ্যমে করতে হবে বাংলা ভাষা”। ভাষা আন্দোলনের মূল স্লোগানগুলোর অন্যতম ছিলঃ ‘বাংলা উর্দু ভাই ভাই, উর্দু’র পাশে বাংলা চাই’। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু বাংলায় বিরোধ নাই’।
জনগণের এই উদার ও নমনীয় দাবির ভাষা বুঝতে শাসকগণ ভুল করলেন। যুক্তির ওপর হঠকারিতা প্রাধান্য পেল। ফলে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কালো মেঘ আচ্ছন্ন করল সব কিছুকে। এরপর দাবি উঠল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নইলে বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথ রক্তাক্ত হলো। সেই রক্ত-পিচ্ছিল পথ গিয়ে ঠেকলেো স্বাধীনতায়। বাংলাবাষা বাংলাদেশী জনগণের প্রতিনিধিত্বে ঠাঁই পেল বিশ্বসভায়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বাংলা ভাষার রাজধানীরূপেও গৌরব অর্জন করল।
জাতীয় সংহতির সংকট
জাতীয় সংহতি সংরক্ষণে পাকিস্তানের ব্যর্থতা এশিয়া ও আফ্রিকার নব্য স্বাধীন দেশগুলোর ইতিহাসে একটি চিহ্নিত ঘটনা। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা জাতিগঠনে পাকিস্তানের ব্যর্থতার অনিবার্য পরিণতি। পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির জটিল সমস্যা পাকিস্তানী শাসকদের সামগ্রিক ব্যর্থতার কারণে সমাধানের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অভিন্ন মুসলিম জাতিসত্তার যে অন্তর্গত প্রেরণা হাজার মাইলের দূরত্বে অবস্থিত দু’টি অসংবদ্ধ ও অসমান অঞ্চলের জনগণকে এক পতাকাতলে ঐক্যবন্ধ করেছিল, সে প্রেরণাকে জাতিগঠনের কাজে নিয়োগিক করতে পাকিস্তানের শাসকগণ সক্ষম হননি। একটি জাতীয় ভূখণ্ডগত মনোভাব সৃষ্টি কিংবা কেন্দ্রীয় জাতীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যর্থ হন। ‘এলিট’ ও ‘মাস’ বা সুবিধাভোগীশ্রেণী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দূরত্ব নিরসন এবং নূন্যতম জাতীয় মূল্যবোধ সচেতনার বিকাশ ঘটাতেও তাঁরা পারেননি। সর্বোপরি জার্তী ঐক্যের প্রাতিষ্ঠানিক ও আচরণগত মূল সূত্রগুলোকে তাঁর শুধু সস্তা স্লোগান হিসেবে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। জাতীয় জীবনে সেগুলো প্রয়োগ করেননি। জাতি গঠনের এই মূলনীতিগুলোর প্রায়োগিক ব্যর্থতা পাকিস্তানকে জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে সুসংগতরূপে গড়ে উঠতে দেয়নি।
পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির কারণগুলোকে মোটামুটি নিম্নোক্তভাবে দেখা যেতে পারেঃ
ক. পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে মুসলিম লীগ একক চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিস্তু স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে একমাত্র মুসলিম লীগের সম্পত্তি মনে করার কারণে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল গড়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানের অস্তিত্বের মূলে আঘাত হানা হয়।
খ. সুসংহত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অভাবে দেশের সমগ্র জনগণের সকল স্বার্থের সমন্বয়কারী জাতীয়ভিত্তিক ও গণভিত্তিক সংহত রাজনৈতিক দলের বিকাশ বাধা সৃষ্টি করা হয়।
গ. একটি নবীন রাষ্ট্রের জন্য মৌল ও অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে শাসনতন্ত্র। অতচ স্বাধীনতার পর নয় বছরেও নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র লাভে জাতি ব্যর্থ হয়। পরবর্তী পর্যায়ে একটা শাসনতন্ত্র রচিত হলেও তাকে বাস্তবে স্থিতিশীলতা দান করা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতা জাতীয় সংহতির পক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
ঘ. জাতীয় লক্ষ্য নিরূপণে কালক্ষেপন করা হয়। ফলে আদর্শিক কোন্দল চরম রূপ নেয়। Common set of cultural values বা সমন্বিত সাংস্কৃতিক মনন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অসময়োচিত ও বিভ্রান্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ভূল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করা হয়।
ঙ. পূর্ব থেকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য অবসানের যথার্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভ্রান্ত অর্থনীতির ফলে দেশের পশ্চিম ও পুব অঞ্চলে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পায়।
চ. প্রতিনিধিত্বমূলক উপায়ে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সব অঞ্চলের সর্বস্তরের জনগণের ক্ষমতা বিস্তারের পূর্ণ সুযোগ না দিয়ে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে প্রশাসনের চরম কেন্দ্রীয়করণ করা হয়।দেশের সামাজিক প্রক্রিয়ায় সরকারি ভুমিকার বিস্তার ঘটানো হয়।
ছ. রাষ্ট্রগঠন তৎপরতরা পাশাপাশি জাতিগঠন তথা জাতিসত্তার পরিচর্যা ও বিকাশদানে চরম ব্যার্থতার পরিচয় দেওয়া হয়।
ড. রওনক জাহানের ভাষায় বলা যায়, “The failure to develop adequate nation building policies inspit of success in other sectors, endangered the viability of the state.” (Pakistan: Failure in National Integration.)
গরমিলের রাজনীতির প্রথম দশক
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযদ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘জিয়ারত’ নামক এক দুর্গম স্থানে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর পূর্ববাংলার প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। মোহাজির লিয়াকত আলী খান পাঞ্জাবী আমলাচক্রের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন। ১৯৫১ সালে এই পাঞ্জাবী আমলা চক্রের সহায়তায় আইয়ুব খান কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। তার কিছুদিন পর ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় বক্তৃতাকালে আততায়ীর গুলীতে প্রাণ হারান। লিয়াকত আলীর স্থলাভিষিক্তি হন খাজা নাজিমউদ্দীন। গভর্নর জেনারেল হন গোলাম মোহাম্মদ। গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল খাজা নাজিমউদ্দীনকে পদচ্যুত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী করেন।
১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের প্রাক্কালে শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-আতাহার আলীর নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টি, আওয়ামী মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম পার্টির সমন্বয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট এই নির্বাচনে ‘একুশ দফা’ ভিত্তিক প্রচার-প্রচারণার এক প্রবল তুফান সৃষ্টি করে। হঠকারী মুসলিম লীগ এই নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ৩০৯ আসনের পরিষদে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি ও মুসলিম লীগ মাত্র দশটি আসন পায়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসবা শপথ নেয়। শপথ অনুষ্ঠানের দিনেই আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে গভর্নর হাইসের গেটে স্লোগান দেয়। যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদলগুলোর মধ্যে শুরু থেকেই সমঝোতার পরিবর্তে বিভেদ দানা বেঁধে ওঠে। এই সুযোগে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসবা ভেঙে দিয়ে ৯২-ক ধারার অধীনে গভর্নরের শাসন জারি করেন। একই দিনে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলার গভর্নররূপে প্রবীন মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামানের স্থলাভিষিক্ত হন।
১৯৫৪ সালের ৪ অক্টোবর প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল বগুড়া ও স্যার জাফরউল্লাহ খানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। পথে তিনি লন্ডনের এক হোটেলে বসে পাকিস্তানের ভবিষ্যত রাজনীতির একটি ছক তৈরি করেন, তাতে পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রদেশগুলো ভেঙে দিয়ে এক ইউনিট করে পূর্ব-পাকিস্তানকেও আরেকটি ইউনিট ধরে সংখ্যাসাম্য নীতির পরিকল্পনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে তারা দেশে ফেরার পরই ২৪ অক্টোবর গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আল বগুড়া নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে। জেনারেল আইয়ুব খান ও ইস্কান্দার মীর্জা এই মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দফতের নিযুক্ত হন। এই বছরই ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান ‘সিয়াটোর’ অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরে বছর ‘সেন্টা’ ও বাগদাদ চুক্তির অংশূদাররূপে পাকিস্তান পুরোপুরি মার্কিন সামরিক পরিকল্পনার অধীন হয়ে পড়ে।
ইতোমধ্যে পূর্ববাংলায় যুক্তফ্রন্টের শরিক দল আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির দলাদলি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালের ১৪ নভেম্বর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ঢাকা সফরে এলে বিমানবন্দরে তাকে মাল্যদানের জন্য আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির মধ্যে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা হয়। ১১ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী দেশে ফিরে এসে ২০ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রীরূপে যোগদান করেন। সোহরাওয়ার্দী এ সময় গণপরিষদের পরিবর্তে ‘কনভেনশন’-এর মাধ্যমে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রস্তাব দিলে রাজনৈতিক মহলে তুমুল বাক-বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়। ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্ট সংসদীয় দলের সবায় আওয়ামী লীগ ফজলুল হকের সংসদীয় নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনে। ফলে তীব্র বাদানুবাদ, হৈচৈ এবং দুই দলের আলাদা আলাদা বিজয়ের ঘোষণার মধ্য দিয়ে সভাটি পণ্ড হয়ে যায়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে পারস্পরিক সমঝোতার পরিবর্তে বিভেদমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের এক বিরাট প্রত্যাশাকে কবর দেওয়া হয়। যুক্তফ্রন্টের পার্লামেন্টারি পার্টির এটিই ছিল শেষ যৌথ সভা। এরপর কার্যত যুক্তফ্রন্টের মৃত্যু হলো।
১৯৫৫ সালের ৩ জুন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া ঢাকা এসে সোহরাওয়ার্দী ও হক সাহেবের সাথে আলাপ-আলোচনার পর ৯২-ক ধারা শীঘ্রই প্রত্যাহার এবং ফজলুল হক সাহেবকে মন্ত্রিসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানানোর ঘোষণা করেন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের নতুন পণপরিষদ গঠন করা হলো। ইস্কান্দার মীর্জা গভর্নর জেনারেল এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। পূর্ববাংলায় আবূ হোসেন সরকারের নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টির মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জন করে দলের ‘অসাম্প্রদায়িক’ চরিত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি নতুন গণ পরিষদ শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু করে। ২ মার্চ গভর্নর জেনারেল নতুন শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর করেন এবং ২৩ মার্চ থেকে তা বলবৎ হয়। শাসনতন্ত্রে ‘পূর্ববাংলা’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব-পাকিস্তান’ রাখা হয়। পশ্চিমাঞ্চলের সকল প্রদেশ একীভূত করে এক ইউনিটের ভিত্তিতে ‘পশ্চিম-পাকিস্তান’ নাম রাখা হয়। দুই প্রদেশের মধ্যে সংখ্যাসাম্য নীতি প্রবর্তন করা হয়। বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষারূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হয়।
১৯৫৬ সালের ৯ মার্চ শেরে বাংলা ফজলুল হক পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে পূর্ব-পাকিস্তানে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে খাদ্যের দাবিতে অনুষ্ঠিত ভুখা মিছিলে গুলী চলে। ফলে গভর্নর ফজলুল হক ও তাঁর দলের আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক মিন্ত্রসভা সংকটে পড়ে। ৩০ আগস্ট আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গভর্নর ফজলুল হক ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে পূর্ব-পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা গঠনের আহবান জানান। কেন্দ্রেও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থন ও ইস্কান্দার মীর্জার গোপন হস্তক্ষেপে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করে। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে আওয়ামী লীগের মধ্যকার ডান ও বামপন্হি দুটি গ্রুপের বিরোধ স্পষ্ট আকার লাভ করে। পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে দলের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। সোহরাওয়ার্দী এ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আসেন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন বামপন্হি গ্রুপ সোহরাওয়ার্দীর পশ্চাত্য ও সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। ফলে আওয়ামী লীগে সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর নেতৃত্বাধীন দুই গ্রুপের অন্তবিরোধ তীব্র মারমুখো আকার ধারণ করে। কাগমারী সম্মেলনেই মাওলানা ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রতি তাঁর ইতিহাসখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম উচ্চারণ করেন।
এরপর ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগৈর ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ভাসানী গ্রুপ ও সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের বিরোধ হাতাহাতির রূপ লাভ করে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের ‘তরুণতুর্কিরা’ ভাসানী গ্রপের কয়েকজন সদস্যকে পিটিয়ে আহত করে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করেন। ২৭ জুলাই পুরনো ঢাকার একটি সিনেমা হলে অধিবেশন ডেকে তিনি ‘পূর্ব-পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ গঠন করেন। তাঁর দলে আওয়ামী মুসলিম লীগের টিকেটি নির্বাচিত জনা তিরিশেক পরিষদ সদস্য ছিলেন।
আওয়ামী লীগের দ্বিধাবিভক্তির ফলে কৃষক শ্রমিক পার্টি আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কেন্দ্রে ইসকান্দার মীর্জার নতুন চালে ১৯৫৭ সালের ১০ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন মুসলিম লীগের আই আই চুন্দ্রীগড়। এর মাত্র ৫৯ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর চুন্দ্রীগড়ের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে রিপাবলিকান পার্টির ফিরোজ খান নুনকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ফিরোজ খান নুন ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৫৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।
গরমিলের রাজনীতিঃ দ্বিতীয় দশক
পূর্ব-পাকিস্তান কেএসপি প্রাদেশিক পরিষদে শক্তির ভারসাম্য ফিরে পেয়ে আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার চেষ্টা চালায়। আতাউর রহমান খান গভর্নরকে পরিষদের অধিবেশন মুলতবি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু হোসেন সরকার নিজে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করে সরকার গঠনের যৌক্তিতকতা তুলে ধরেন। ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ গভর্নর ফজলুল হক আওয়ামী লীগের আতাইর রহমান মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করেন। একই তারিখে আবু হোসেন সরকারকে গভর্নর হাইসে শপথ পাঠ করানোর পরপরই প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ফজলুল হককে বরখাস্ত করেন। মাত্র বারো ঘন্টার ব্যবধানে আবূ হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভাকেও বরখাস্ত করা হয়। আতাউর রহমান খান আবার মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
বস্তুত যুক্তফ্রন্টের এই দুই শরিকের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতি এ সময় এক নাজুক অবস্থায় দাঁড়ায়। ১৯৫৮ সালের ১৩ জুন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে সংখ্যালঘু ও ‘ন্যাপ’ দলীয় সদস্যরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। কিন্তু ১৮ জুনের অধিবেশনে ন্যাপ সদস্যগণ ভোটদানে বিরত থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগের সরকার ১২ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। ২০ জুন আবু হোসেন সরকার যখন আবার মুখ্যমন্ত্রীরূপে শপথ নিচ্ছেন, তখন খবর রটে যায় যে, ন্যাপ সদস্যরা পুনরায় আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তিন দিন পর ২৩ জুন পরিষদের পরিষদের অধিবেশনে বসে। আওয়ামী লীগ অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে। ন্যাপ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। ১৪ ভোটের ব্যবধানে তিন দিনের মাথায় আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার আবার পতন ঘটে।
এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট শাসনতন্ত্রের ১৯৩ ধারা প্রয়োগ করে পূর্ব-পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন জারি করেন। গভর্নরকে তিনি সকল দলের পরিষদ সদস্যদের তালিকা কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তখনকার পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া যায় মেজর (অব) এস জি জিলানীর বিবরণীতে। তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের ১৫ জন গভর্নরের এডিসি হিসেবে দীর্ঘ দিন গভর্নর হাইসে দায়িত্ব পালন করেছেন। মেজর জিলানী তাঁর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে লিখেছেনঃ
“আওয়ামী লীগ এবং কে. এস. পি বিতর্কিত সদস্যদের মধ্য থেকে তাদের একেকজনকে তাদের দলের সমর্থক প্রমাণ করারজন্য গভর্নর হাইসে নিয়ে আসতে লাগল। একদিন কেএসপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস মি. আলী নামে একজন সদস্যকে গভর্নর হাউসে নিয়ে আসলেন। মি. আলী নিজেকে কে এস পির সমর্থন বলে ঘোষণা দিলেন এবং বললেন, তার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দাবি সঠিক নয়। সেই দিনই রাত সাড়ে এগারটায় দুটি গাড়ি গভর্নর হাইসের লনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে যিনি সর্বপ্রথম নামলেন, তিনি আওয়ামী লীগৈর জেনারেল সেক্রেপারি শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর একেকজন করে যারা নামল, আমরা বিস্ময়েল সঙ্গে দেখলামম, তাদের মধ্যে পূর্বোক্ত মি, আলীও রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহামন তাকে নিয়ে সোজা গভর্নর সাহেবের স্টাডিরুমে চলে গেলেন। আমরা শুনলাম, আলী সাহেব বলছেন, তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক, কে এস পির নয়”। (বঙ্গভবনের ১৫ গভর্নর, সৌখিন প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ২৬)
কেন্দ্রীয় সরকার দুই মাস পর ১৯৫৮ সালের ২৫ আগস্ট আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা পুনর্বহাল করার আদেশ দেন। প্রাদেশিক পরিষদের পরিবেশন বসে ২০ সেপ্টেম্বর। সেদিনই পরিষদের কে এস পি সমর্থক স্পিকার আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অনাস্থা প্রস্তাব আনে। পরিষদে হৈ চৈ-হাঙ্গামা বেঁধে যায়। দুই দলের পরিষদ সদস্যগণ যক্তির পরিবর্তে হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। এ অবস্থায় ২০ সেপ্টেম্বর অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়। ২৫ সেপ্টেম্বর স্পিকার আবদুল হাকিমের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। দুই দলের বিবাদমান সদস্যগণ প্রথমে হাতাহাতি, ঘুষাঘুষি করতে শুরু করেন। এই ঘটনার এক পর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী চেয়ারের আঘাতে মারাত্মকভাবে যখন হন। দু’দিন পর হাসপাতালে জনাব শাহেদ আলীর মৃত্যু হয়। বস্তুত ১৯৫৮ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতির ইতহিাস এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় সৃষ্টি হয়। রাজনীতিকদের চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীন উচ্ছিংখল আচরণ দেশকে সামরিক শাসনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই অবস্থা যখন চলছে, কেন্দ্রে রিপাবলিকান পার্টি ও আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার অবস্থাও তখন সংকটাপন্ন। রিপাবলিকান পার্টির সাথে মতপার্তক্যের কারণে সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে তাঁর দলের ছয়জন সদস্যকে প্রত্যাহার করেন। মুসলিম লীগের সাথেও রিপাবলিকান পার্টির তীব্র বিরোধ চলছিল। ওয়ান ইউনিট প্রশ্নে ফিরোজ নুনর নিজ দলের অভ্যন্তরেও মতবিরোধ প্রবল হয়ে উঠেছিল।
কেন্দ্র ও প্রদেশের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক এই সংকটজনক পরিস্থতির অজুহাতে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর পাকিস্তান মার্শাল ল’ জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ২৪ অক্টোবর একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। উভয় প্রদেশ থেকে চারজন করে আটজন অরাজনৈতিক বেসামরিক ব্যক্তি এবং চারজন জেনারেল সমেত বারো সদস্যের এই মন্ত্রিসভায় জেনারেল আইয়ুবকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। অক্টোবর মাস শেষ হওয়ার আগেই আইয়ুব খান ইস্কান্দার মীর্জার কাছ থেকে সমস্ত ক্ষমতা দখল করেন। ২৮ অক্টোবর তিনজন জেনারেল পিস্তল উঁচিয়ে পাকিস্তান রাজনীতিতে ‘মুর্শিদাবাদের দুষ্টগ্রহ’ ইস্কান্দার মীর্জার কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফাপত্র আদায় করেন। এরপর তাঁকে প্রথমে কোয়েটা ও পরে লন্ডন পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’- এর প্রধান কুকীর্তি ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পাওয়া ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল ঘোষণা। আইয়ুব খানের দ্বিতীয় কুকীর্তি মৌলিক গণতন্ত্র বা বুনিয়াদী গণতন্ত্র। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মৌলিক গণতন্ত্রীদের আস্থা ভোটে আইয়ুব খান সামরিক খোলস ভেদ করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। আইয়ুব খান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদিরের নেতৃত্বে একটি শাসনতন্ত্র কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন আইয়ুব খানের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে পূর্ণ গণতন্ত্রের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বা তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের সুপারিশ করেন। কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য ১৯৬১ সালের ২৪ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গভর্নরদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান শাসনতন্ত্রের সুপারিশ-এর ব্যপারে তাঁর মন্ত্যব্যে ‘জনগণের ওপর আস্থা রাখা’ এবং ‘জনগণের রায়কে চূড়ান্ত বলে গণ্য করার’ পক্ষে কথা বলার কারণে আইয়ুব খানের বিরাগভাজন হন। ১৯৬৩ সালের ৩ জানুয়ারি করাচীতে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ব্যাপারেও পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর-এর মতামত নেওয়া হয়নি। কিন্তু এই গ্রেফতারীর বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের তীব্র প্রতিক্রিয়ার দায়-দায়িত্ব আজম খানের ওপরই চাপানো হয়। এ অবস্থায় আজম খান পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ইস্তফা দেন।
১৯৬২ সালের ১ মার্চ থেকে দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন প্রবর্তন করা হয়। এ সময় ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলার মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়ে ঢাকাবাসীর অভূতপূর্ব শোক মিছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মাধ্যম-এ পরিণত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে চল্লিশ হাজার করে আশি হাজার বি ডি মেম্বারের ভোটে ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ এবং ৬মে প্রাদেশিক পরিষদসমূহ গঠিত হয়। ৮ জুন জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। মার্শাল ল’ অপসারিত হয়। আইয়ুব খান নতুন করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
২৪ জুন পূর্ব-পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ নয়জন নেতা এক বিবৃতিতে আইয়ুব খানের নব প্রর্তিত শাসনতন্ত্র বাতিল করে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা কয়েমের দাবি জানান। সেই নয় নেতা ছিলেন নুরুল আমীন, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, মাহমুদ আলী, হামিদুল হক চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, পীর মোহসিন উদ্দীন (দুদু মিয়া), ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) এবং সৈয়দ আজিজুর হক (নান্না মিয়া)। এর কয়েক দিন পর পল্টন ময়দানের এক বিরাট জনসভায় এই নয় নেতা শাসনতন্ত্র বাতিল করে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবন, ব্যক্তি ও নাগরিক অধিকার বহাল করা প্রভৃতি দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন।
১৪ জুলাই সকল রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। আইয়ুব খানের ইঙ্গিতে মুসলিম লীগের একাংশ নিয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠন করে আইয়ুব খান তাতে যোগ দেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেপ্টেম্বর মাসে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ‘নয় নেতা’র বিবৃতির প্রতি সমর্থন জানান। তাঁর নেতৃত্বে বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ এ সময় পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে ব্যাপক সফর করেন। ১৯৬২ সালের ৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী ও নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দলীয় জোট ‘ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট’ (এন ডি এফ) গঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দী সারা দেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে এ সময় যে অমানুষিক পরিশ্রম করেন, তার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের এক হোটেলে তাঁর ‘রহস্যজনক’ মৃত্যু হয়। সোহরাওয়ার্দীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল, স্বতন্ত্র দলীয় সাইনবোর্ডের বদলে এন ডি এফ-এর ব্যানারেই গণতান্ত্রিক শক্তিসমুহ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করবে। কিন্তু তার মৃত্যুর অল্প কয়েক দিন পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়।
১৯৬২-৬৩ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা ছিল প্রতিবাদ মুখর। তারা হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। বহু লোক হতাহত হয়।
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি আশি হাজার বি ডি মেম্বারের ভোটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, এন ডি এফ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল (কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টি বা কপ) গঠন করা হয়। জাতীয় ঐক্যের প্রতীকরূপে কায়েদে আযমের বো মিস ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলীয় প্রার্থীরূপে দাঁড় করানো হয়। বি ডি মেম্বারদের সীমিত ভোটের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বিরোধী দলের জন্য অসাধ্য হলেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিরোধী দলের কর্মীগণ এক প্রবল গণজাগরণ সৃষ্টি করতে সমর্থ হন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে লে. কর্নেল এ টি কিউ হকের সেনাপতিত্বে প্রথম বঙ্গশার্দুল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা দেশরক্ষার সংগ্রামে অশ্রতপূর্ব ত্যাগ ও বীরত্বের জন্য খ্যাতি লাভ করেন। বিমান বাহিনীতেও বাঙালি স্কোয়াড্রন লিডার আলম ভারতীয় জঙ্গী বিমান ধ্বংসের ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্ব ও সাহসের স্বাক্ষর রাখেন।
১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে এক সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই সম্মেলনেই শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। ছয় দফার প্রশ্নে শুধু সরকারি মহলে নয়, বিরেোধী দলগুলোর মধ্যেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের ন্যায্যা অধিকারের প্রশ্নে সংগ্রামরত বিভিন্ন দল ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নবাদী উদ্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মাওলানা ভাসানী ছয় দফার তীব্র বিরোধীতা করেন। তিনি ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ১৪ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাল্টা আন্দোলনের ডাক দেন। বামপন্হি নেতা আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ ও মোজাফফর আহমদও ছয় দফার বিরোধীতা করেন। ছয় দফা প্র্রশ্নে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল আতাউর রহমান খানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় কয়েকটি দরের সমন্বয়ে ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট’ (পি ডি এম) গঠিত হয়।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান
১৯৬৭ সালের শেষের দিকে আইয়ূব খানের সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভারতের সহযোগিতায় পূর্ব-পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তে লিপ্ত থাকার অভিযোগ এেন মামলা দায়ের করেন। এ মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অভিহিত হয়। প্রথমে লে কর্নেল মোয়াজ্জম হোসেনকে এ মামলার প্রধান আসামী করা হয়। কয়েক দিন পর শেখ মুজিবুর রহমানকে এই মামলায় জড়িয়ে তাঁকেই এক নম্বর আসামী করা হয়। এই মামলার প্রকাশ্য শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং মামলার পূর্ণ বিবরণ প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে এই মামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। পি ডি এম-এর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা অতিক্রম করে এ সময় ১১ দফার দাবিতে পূর্ব-পাকিস্তানে অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়।
১৮৬৯ সালের ৭ জানুয়ারি পি ডি এম. এর সাথে ছয় দফাপন্হি আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্হি ন্যাপ এবং পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-এর সমন্বয়ে ডেমোক্রাটিক একশন কমিটি বা ‘ডাক’ গঠিত হয়। ডেমোক্র্যাটিক একশন কমিটি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রক্তক্ষয়ী ব্যাপক আন্দোলন ও গণ অভ্যুত্থানের মুখ ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া খান দেশে সামরিক শাসন জারি করেন, শাসনতন্ত্র বাতিল, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বিলোপ এবং গভর্নর ও মন্ত্রীদের অপসারিত করেন। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ কর্তৃক শাসনতন্ত্র প্র্রণয়নের ওয়াদা করেন। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান কয়েকটি শাসনতন্ত্রিক ঘোষণা করেন। যথা-
১. পশ্চিম-পাকিস্তান প্রদেশ বা এক ইউনিট বিলোপ করে প্রদেশগুলো পুনর্বহাল,
২. সংখ্যা সাম্যনীতির বিলোপ করে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ ভিত্তিতে সংখ্যানুপাতে নির্বাচন,
৩. ফেডারেল পার্লামেন্টারি সরকার প্রতিষ্ঠা,
৪. নব নির্বাচিত গণ পরিষদ কর্তৃক প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে একশ কুড়ি দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র রচনা এবং শাসনতন্ত্র রচনার পর গণ-পরিষদকে জাতীয় পরিষদে রূপান্তর,
৫. ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু,
৬. শাসনতন্ত্র রচনার সময় পর্যন্ত সামরিক আইন বহাল এবং
৭. ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন।
এরক ক’দিন পর ইয়াহিয়া খান ‘লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক’ ঘোষণা করেন।
১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। প্রথম থেকেই জাওয়ামী লীগ প্রকাশ্য রাজনীতিতে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে। পি, ডি এম-এর আন্দোলন, ডাক-এর আন্দোলন, এগার দফার আন্দোলন- সকল আন্দোলনের ফসল আত্মসাত করলো এবং অতীতের সংগ্রামসমূহের সহযোদ্ধাদের পথেও পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। ১৮ জানুয়ারি জামায়াত ও ২ ফেব্রুয়ারি পি ডি পি আহুত জনসভায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা হামলা চালিয়ে বানচাল করে দিল। নির্বাচনের পুরো সময়কাল ধরে সারাদেশে এই অবস্থা জারী রাখা হলো। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, সত্তরের নির্বাচনে দেশের আম-জনতাকে আওয়ামী লীগ একথা বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর মাধ্যমেই পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ তাদের তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের দুটি আসন ছাড়া পূর্ব-পাকিস্তানের সকল আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮ টিই আওয়ামী লীগ দখল করে। অন্যদিকে পশ্চিম-পাকিস্তানের অধিকাংশ আসনে ভুট্টোর পিপলস পার্টি জয়ী হয়।
শেখ মুজিববকে ইয়াহইয়া খান ঢাকায় এসে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু তারপরই ষড়যন্ত্রের কালোমেঘ পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশকে অন্ধকারে ছেয়ে ফেলে। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলা-শাসকদের মানসিক প্রস্তুতি ছিল না আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে। ফলে তাদের সমর্থন ও মদদপুষ্ট ভুট্টো আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধীতা করলেন এবং ক্ষমতায় আধাআধি অংশীদারিত্ব দাবি করলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে জাতীয় পরিষদের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশনে মুলতবি করেন। এই সিদ্ধান্ত পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের বিক্ষোভের বারুদে আগুন ধরিয়ে দেয়। সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। গোটা বেসামরিক প্রশাসন শেখ মুজিবের নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। এরপর ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সাথে কয়েক দিন ধরে আলোচনায় মিলিত হন। ভুট্টোও ভবিষ্যত শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা সম্পর্কে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে এই আলোচনার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা থাকে। তারপর পঁচিশে মার্চের রাতে শুরু হয় সামরিক অভিযান।
পঁচিশে মার্চের সামরিক অভিযানের পর দেশের বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিক, ই. পি. আর, পুলিশ, আনসাররা বিভিন্ন স্থানে স্বতস্ফুর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাক বাহিনীর আকস্মিক হামলা, নির্বিচারে হত্যা বর্বরতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্বাধীনতার দাবি রাতারাতি সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু সম্পর্কে মঈদুল হাসান লিখেছেনঃ
“২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮ বি’র বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। এই সব ঘোষনায় বিদ্যুতের মত লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, শেখ মুজিবের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই শুরু করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বেতারের এই সব ঘোষণার পিছনে না ছিল রাজণৈতিক অনুমোদন, না ছিল কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি।…… মেজর জিয়ার ঘোষণা এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর মধ্যে বেতার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে এই স্থানীয় ও খণ্ড-বিখণ্ড বিদ্রোহ দ্রুত সংহত হতে শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত হওয়ার বিষয়টি এদের জন্য মূলত ছিল অপরিকল্পিত, স্বতঃস্ফূর্ত এবং উপস্থিত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে…. বিদ্রোহ ঘোষণার সাথে সাথে পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত পর্যন্ত এমনভাবে এদের তাড়া করে নিয়ে যায় যে, এদের জন্য পাকিস্তানে ফিরে আসার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়। হয় ‘কোর্ট মার্শাল’ নতুবা ‘স্বাধীনতা’ এই দু’টি ছাড়া অপর সকল পথই তাদের জন্য বন্ধ হয়ে পড়ে”।(মঈদুল হাসানঃ ‘মূলধারা ৭১’, পৃষ্ঠা ৫-৭)
মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র কালব্যাপী শেখ মুজিব ছিলেন এ যুদ্ধের এক বিরাট প্রেরণা। কিন্তু শেখ মুজিব মনেপ্রাণে স্বাধীনতা চেয়েছেন কি না, এ ব্যাপারে তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষকদের অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের আওয়ামী লীগ এম পি এম. এ মোহাইমেন এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
“শেখ সাহেবের এভাবে সেদিন রাত্রে (২৫ মার্চ) ধরা দেওয়াকে আমিও কোন দিন মনের সঙ্গে যুক্তি দিয়ে খাপ খাওয়াতে পারিনি। অন্যেরা যে যাই বলুক, আমার নিজের ধারণা, আওয়ামী লীগের নেতারা তাজউদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে এভাবে দেশ স্বাধীন করবে এটা তিনি ভাবতে পারেনি। তাঁর ধারণা ছিল, পাকবাহিনী অল্প কিছু দিনের মধ্যেই অবস্থা আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারবে। বেশ কিছু নেতা ও উপ-নেতাকে হত্যা করবে। দশ-বিশ হাজার কর্মীকেও হত্যা করে সাময়িকভাবে দেশের আন্দোলন স্তব্ধ করে দিলেও শেষ পর্যন্ত রাখতে পারবে না। আগরতলা কেসের সময় তাঁকে যেভাবে দেশের মানুষ আন্দোলন করে জেল থেকে বের করে এনেছিল, সেভাবে দু’তিন বছর পরে তুমুল আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সরকার তাকে মুক্তি দিয়ে ক্ষমতা তাঁর হাতে অর্পণ করতে বাধ্য হবে”। (ঢাকা আগরতলা মুজিব নগর, পৃষ্ঠা ৬৫)
তিনি আরো লিখেছেনঃ
“সশস্ত্র সংগ্রামে তার (শেখ মুজিব) তেমন বিশ্বাস ছিল না। তাঁর বাসায় গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা হলে তাঁকে কখনো উৎসাহিত হতে দেখিনি। তাঁর গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৭)
শেখ মুজিব স্বাধীনতা না চাইলেও ছাত্র লীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ এক শ্রেণীর কম্যুনিস্ট ১৯৬২ সাল থেকেই পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছিল। অলি আহাদ লিখেছেনঃ
“১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আবদুর রহমান সিদ্দিকী ও আবূ সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদি অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন”। (অলি আহাদঃ জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, পৃষ্ঠা ৩৩৩)
এই বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারার একদল লোক একটি বিশেষ চেতনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। তাদের সম্পর্কে মেজর (অবঃ) এম এ জলিল লিখেছেনঃ
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্দিষ্ট রূপ যে ছিল না তা নয়, তবে সে চেতনা সীমাবদ্ধ ছিল একটা মহলবিশেষের মধ্যে এবং তারা হচ্ছেন তৎকালীন ছাত্র সমাজের সচেতন মহলেরও একটা ক্ষুদ্র অংশবিশেষ- বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সেই অংশটি যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরিফ প্রমুখ। এই অংশটির চিন্তা-চেতনায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানকে পাকিস্তানি চক্র থেকে মুক্ত করে এই অঞ্চলকে বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এর বাইরে যারা এই অঞ্চলকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্ত করে স্বাধীন, সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন কম্যুনিস্ট পার্টি (মনিসিংহ), ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ ভাসানীর একটি অংশ, মরহুম সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত কমান্ডার মোয়াজ্জেমসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ”। (অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, পৃষ্ঠা ১৫)
তিনি আরো লিখেছেনঃ
“এর বাইরে যে ছাত্র সমাজ বা রাজনৈতিক সংগঠন ছিল তাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিল গতানুগতিক দেশপ্রেমিকদের দায়িত্ব স্বরূপ, …… নির্দিষ্ট চেতনায় উদ্বদ্ধ হয়ে নয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি মহলের ক্ষেত্রেও এই কথাই প্রযোজ্য। এদের মধ্যে আবার অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে নিতান্ত বাধ্য হয়েই- প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে, কেউ কেউ করেছে সুবিধা অর্জনের লোভ-লালসায়, কেই করেছে পদ-যশ অর্জনের সুযোগ হিসেবে, কেই করেছে তারুণ্যের অন্ধ আবেগ এবং উচ্ছাসে এবং কতিপয় লোক অংশগ্রহণ করেছে ‘এডভ্যানচারইজম’- এর বশে। এ সকল ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, নিষ্ঠা এবং সততারও তীব্র তারতম্য ছিল”। (পূর্বোক্ত)
বস্তুত কৃষিজমির আইল বেয়ে উঠে আসা পূর্ববাংলার সাধারণ কৃষক সন্তানরাই ছিল স্বধীনতা যুদ্ধের মূল শক্তি, যাদের সামনে রাজনৈতিক কোন মতলব বা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না, ভারতের সাথে তাদের কোন যোগসাজসও ছিল না।
“অহযোগ আন্দোলনের সময় সমাজতন্ত্রী, কম্যুনিস্ট যারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে বড় বড় বুলি কপচিয়েছিলেন, ইকবাল হলকে কেন্দ্র করে যারা ৩ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিল, যারা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকৃতই তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। ইকবাল হল-গ্রুপের মুজিব বাহিনী তৈরি হয়ে মাঠে নামার আগেই মুক্তিযুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে যায়”। (আবুল আছাদঃ কালো পঁচিশের আগে ও পরে, পৃষ্ঠা ২৪০-৪১)
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আওয়ামী লীগের দলীয় সংকীর্ণতার কারণে মস্কোপন্হি কম্যুনিস্ট পার্টি ও মো ন্যাপের কর্মীরা অক্টোবরের পূর্ব পর্যন্ত যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়নি। পিকিংপন্হি ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট পার্টির কোন কোন নেতাকে ভারতে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়।
মাওলানা ভাসানীকে ভারতে প্রবেশের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। ভারতের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী (মাওলানার শাগরেদ) মইনুল হক চৌধুরীর সুপারিশ ও বিশেষ অনুরোধ ইন্দিরা গান্ধী মাওলানা ভাসানীর ব্যাপারে রাজি হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের গোটা সময়টা মাওলানা ভাসানীকে ভারতে বন্দীদশায় কাটাতে হয়।
ন্যাপ-এর সেক্রেটারি জেনারেল মশিউরর রহমান যাদু মিয়াকে ভারতে গিয়ে ওয়ারেন্ট-এর তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হয়।
কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনো কলকাতার অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সাথে সাক্ষাত করে বামপন্হিদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন। তাজউদ্দিন তাতে অস্বীকৃতি জানান।
এ প্রসঙ্গে কাজী জাফর আহমদ তাঁর এক সাক্ষাতকারে বলেনঃ
“…………. আমরা মর্মাহত হয়ে ফিরে আসি। দেশে ফিরার পথে জুনের মাঝামাঝি আগরতলায় আমাকে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আটক করে নিয়ে যায় শিলং-এর এক ডাক-বাংলোয়। সেখানে আমাতে সাত দিন রাখা হয়। ….. সাতদিনব্যাপী অবিরাম প্রশ্নের মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়”। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২)
অলি আহাদ উল্লেখ করেছেন যে, তাঁকেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভারত থেকে দেশে পালিয়ে আসতে হয়। (জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, পৃষ্ঠা ৫০৭)
ইসলামপন্হি বলে পরিচিত যেসব রাজনৈতিক নেতা-কর্মী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়েছিল, তারা সেকানে টিকে থাকা দূরে থাক, তাদের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হয়। এরূপ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ এম এ মোহাইমেন তাঁর ‘ঢাকা আগরতলা মুজিব নগর’ বইয়ে তুলে ধরেছেন।
এই অবস্থার মধ্যেই ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্তার নিয়ন্ত্রণে ও আওয়ামী লীগের দলীয়করণের আওতায় মুক্তিযুদ্ধ তার একটির পর একটি মঞ্জিল অতিক্রম করে।
নয় মাস স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ চলে তিনটি চিহ্নিত পর্যায়ে। পঁচিশে মার্চ থেমে মে মাস পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনী দেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী প্রত্যাঘাতের মাধ্যমে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আর তৃতীয় পর্যায়ের শেষের দুই মাস জনসমর্থনহীন পাকবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীর মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ ভারতীয় আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। তবে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের মাটিতে থেকে যুদ্ধ করেন। এই অংশটি দৃঢ়ভাবে মনে করতেন, বিদেশী আশ্রয় ও মদদপুষ্ট হয়ে নয়, যত দীর্ঘ সময়ই লাগুক, মাতৃভূমিতে থেকেই লড়াই করে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তাদের আশঙ্কা ছিল, ভারত বা অন্য কারো মদদ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করা সহজ হবে ঠিক, তবে তাতে জনগণের প্রত্যাশিত মুক্তি আসবে না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আবুল মনসুর আহমদ ‘একটা সামগ্রিক ও সর্বাত্মক জনযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে লিখেছেনঃ
“ এমন অবস্থায় স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত অন্যান্য দেশে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, আমাদের দেশেও তাহাই ঘটিয়াছে। চীনে চিয়াং কাইসেকের তথাকথিত সমর্থকদের প্রায় সবাই যেমন কার্যত মাও সেতুং-এর পক্ষে কাজ করিয়াছিলেন, চিয়াং বাহিনীকে দেওয়া মার্কিন অস্ত্র যেমন মাও বাহিনীর হাতে চলিয়া গিয়াছিল, দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাহায্যে দেওয়া অধিকাংশ অস্ত্র যেমন ভিয়েতকংদের হাতে হস্তান্তরিত হইয়া গিয়াছে, পূর্ব-পাকিস্তানের বেলায়ও ঠিক তাই ঘটিয়াছে”। (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)
পাক বাহিনীর নৃশংসতার মুখে জনগণের আত্মরক্ষামূল ঐক্যবোধ ও প্রতিরোধ সংগ্রাম, প্রাকৃতিক বাধাহীন ২৫৪২ মাইলের দীর্ঘ সীমান্তবর্তী বৃহৎ দেশ ভারতের নিজস্ব স্বার্থ ও প্রতিশোধস্পৃহা-তাড়িত সক্রিয় ভূমিকা, পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যকার হাজার মাইলের ভৌগলিক দূরত্ব মুক্তিযুদ্ধকে দ্রুত একটি চূড়ান্ত পরিণতি দান করে।
যুদ্ধ শেষে পাক বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের এই ঘটনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণী ওসমানীকে দুরে রাখা হয়।
পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাচক্র ও রাজনীতিকদের ভূলের বোঝা মাথায় নিয়ে এক রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘উপমহাদেশের মুসলমানদের আশা- আকাঙ্ক্ষার সবচে শক্তিশালী দুর্গ’ বাংলাদেশ এভাবেই স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে অস্তিত্ব লাভ করে।