১১.
হিন্দু-মুসলিম রাজনীতিঃ মিলমিশেলের চেষ্টা
কংগ্রেসে দাদাভাই নওরেজী ও গোখলের স্থলে বালগঙ্গাধর তিলক, পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায় ও বিপিন পালের মতো উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটল। ফলে এই দলটি হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বেদ-উপনিষদ থেকে উৎসারিত হিন্দু সংস্কৃতিই ছিল তাদের মতে ভারতীয় জাতীয় চেতনার প্রতীক। গণপতি পূজা তাদের জাতীয় অনুষ্ঠান। বন্দে-মাতরম জাতীয় সংগীত। ফলে মুসলমান নেতাগণ শঙ্কিত ছিলেন যে, ভবিষ্যতে স্বাধীন ভারতের গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের শাসনই কায়েম হবে। বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত্র প্রদেশ ও বালুচিস্তান ছাড়া অন্য সব প্রদেশে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। এ অবস্থায় চল্লিশ কোটি মানুষের অখণ্ড ভারতীয় শাসনতন্ত্রে নয় কোটি মুসলমানের অধিকার ও স্বার্থের জন্য একটা রক্ষাকবচ অর্জন করা ছিল মুসলমান নেতদের বিবেচনায় অপরিহার্য। এ জন্যে তাঁরা প্রদেশগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশান, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নূন্যতম ক্ষমতা এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলো মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষঅর নিশ্চয়তা দাবি করেন।
লাখনৌ চুক্তি
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) ও এ, কে, ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) সহ ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দের চেষ্টায় ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে একটি শাসনতান্ত্রিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। ‘লাখনৌ চুক্তি’ নামে পরিচিত এই চুক্তিতে মুসলিম লীগের স্বতন্ত্র নির্বাচনপ্রথা ও আইনসভাগুলোর আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিধান স্বীকৃত হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এই চুক্তির পরিকল্পনার মূল ভিত্তি ছিল। তখন বাংলার লোকসংখ্যার শতকরা ৫৪ জন ছিলেন মুসলমান। সংখ্যালঘিষ্ট প্রদেশের মুসলমানদের অতিরিক্ত আসন দেওয়ার স্বার্থে ফজলুল হকসহ মুসলিম নেতাগণ বাংলাদেশের আইন সভায় মুসলমানদের জন্য মাত্র শতকরা ৪০টি আসন নিতে সম্মত হন। বাকি আসনগুলো বিহার, যুক্ত প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থের জন্য ছেড়ে দেন। পাঞ্জাবে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৫ ভাগ। পাঞ্জাবের মুসলমান নেতাগণ শতকরা ৫০টি আসন রেখে বাকি পাঁচ ভাগ আসন অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ট প্রদেশের মুসলমানদের সুবিধার জন্য ছেড়ে দেন। ভারতের অন্যান্য সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলমানদের স্বার্থে বাংলার মুসলমানদের ত্যাগ ছিল এক নযীরবিহীন ঘটনা।
অসহযোগ আন্দোলন
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার একটি ক্ষেত্র রচিত হয়। রাউলটি বিলের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের এপ্রিলে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে কয়েকশ লোককে গুলী করে হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফজলুল হক, সিআর দাস, মতিলাল নেহেরু ও তাইয়েবজীকে নিয়ে এ উপলক্ষে এক বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সে বছরই মাওলানা আবদুল বারীর নেতৃত্বে লাখনৌয়ে তুরস্কের অখন্ডত্ব ও খলীফার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। ১৪ নভেম্বর দিল্লীতে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত কমিটির প্রথম অধিবেশনে খিলাফত সংক্রান্ত দাবির ভিত্তিতে মুসলমানরা ইংরেজ সরকারের সাথে অসহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে।
১৯২০ সালের জুন মাসে হিন্দু ও মুসলমান নেতাদের এক সভায় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ৩১ আগস্ট মুসলমানরা খিলাফত দিবস পালন করে। সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেস, মসুলিম লীগ, খিলাফত কমিটি ও জমিয়াতে উলামায়ে হিন্দ কলকাতায় এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু অসহযোগ উপলক্ষে গান্ধীর নেতৃত্বে স্কুল-কলেজ বয়কটের যে কর্মসূচির গৃহিত হয়, জিন্নাহ, ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ তার বিরোধিতা করেন। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ মুসলমানরা এর ফলে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফজলুল হক স্পষ্টতহই ঘোষণা করেন যে, আসহযোগের নামে স্কুল-কলেজ বয়কট করলে শিক্ষায় শত বছর দরে এগিয়ে যাওয়া হিন্দুদের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু মুসলমানরা, যারা নতুন করে মাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, তারা আবার অজ্ঞানতার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। ১৯২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সি আর দাস ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে ছাত্রদেরকে স্কুল কলেজ বর্জনের আহ্বান জানান। পরদিনই ফজলুল হক একই ময়দানে সভা করে ছাত্রদেরকে স্কুল-কলেজ বর্জন না করার পরামর্শ দেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোদে আগ্রণী মুসলিম নেতৃবৃন্দও সে সময় উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই ঐক্যবব্ধ আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যেই সূক্ষ্মভাবে মুসলিম জনগণকে দমিয়ে দেওয়ার একটি কারসাজি কাজ করছে।
স্কুল-কলেজ বয়কটের ব্যাপারে কংগ্রেসের সাথে মতান্তরের কারণে ফজলুল হক শেষ পর্যন্ত অসহযোগ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। উগ্রবাদী হিন্দুদের কারণে অসহযোগ আন্দোলে কার্যত মুসলিমবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। নানা স্থানে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ দেখা দেয়। এই সময় হিন্দুদের ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী উত্থান ঘটে। হিন্দুরা ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ শুরু করে। তা ১৯৩১ সাল পর্যন্ত অব্যহত থাকে। অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব গান্ধীর হাত থেকে কার্যত সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যায়। যুক্ত প্রদেশের চৌরিচৌরায় একটি থানা আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগের ফলে ২২ জন পুলিশ মারা যাওয়ার পর গান্ধী হঠাৎ করে অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ ঘোষণা করেন।
জিন্নাহ ও ফজলুল হক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে শুরু থেকে ভিন্ন ধারণা পোষণ করেছেন এবং তাদের মত ছিল যে, এরূপ কর্মসূচি দেশের মুক্তি ত্বরান্বিত না করে বরং বিলম্বিত করবে। তাদের ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়।
বেঙ্গল প্যাক্ট
কংগ্রেসের সাতে মতানৈক্যের কারণে সি আর দাস ১৯২২ সালে সভাপতির পদে ইস্তফা দেন। সি আর দাস ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘স্বরাজ পার্টি’ গঠিত হয়। এই দুই নেতা উপলব্ধি করেন যে, ব্যবস্থাপক পরিষদের হিন্দু-মুসলিম মিলিত সংগ্রাম ছাড়া বাংলার স্বাধিকার অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য তাঁরা দীর্ঘ অবহেলিত মুসলমানদের সঙ্গত অধিকারসমূহের প্রতি কিছু সহানুভূতি দেখানো অপরিহার্য বিবেচনা করেন। এ পটভূমিতেই সি আর দাস তৎকালীন বাংলার অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামক রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সভায় ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এই চুক্তির সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিলঃ
ক. লোকসংখ্যার অনুপাতে ও স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথায় বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকবে।
খ. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোত প্রত্যেক জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় শতকরা ষাট ভাগ আসন পাবে।
গ. সরকারি দফতরে মুসলমানদের জন্য শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ চাকরি সংরক্ষিত থাকবে। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা চাকরিক্ষেত্রে এই পর্যায়ে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত তাদের মধ্য থেকে শতকরা আশি জনকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হবে। উপরিউক্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাদেকে নূন্যতম যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়েঅগ করা হবে। এরপর মুসলমানরা শতকরা ৫৫টি এবং অমুসলমানরা চাকরির শতকরা ৪৫টি পদ পাবে। মধ্যবর্তীকালে হিন্দুদের জন্য শতকরা ২০টি চাকরি বরাদ্দ থাকবে।
ঘ. কোন সম্প্রদায় ধর্মীয় বিষয়ে কোন আইন পাস করতে হলে সেই সম্প্রদায়ের নির্বাচিত তিন চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থন থাকতে হবে।
ঙ. মসজিদের সামনে গান-বাজনা সহকারে মিছিল করা যাবে না এবং গরু জবেহ করার ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
হিন্দ-মুসলিম মিলনের চেষ্টা ব্যর্থ
১৯২৮ সালের নেহেরু-কমিটির রিপোর্টের মাধ্যমে কংগ্রেস লাখনৌ চুক্তিতে স্বীকৃত মুসলমানদের সকল দাবি অস্বীকার করে। কংগ্রেসের এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কেল ভিত্তি ধসে পড়ে। জিন্নাহ এরপর ১৯২৯ সালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য চৌদ্দ দফা দাবি উত্থাপন করেন। কংগ্রেস নেতৃত্ব সে সব দাবি অগ্রাহ্য করেন। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে লন্ডনে তিন দফা গোলটেবিল বৈঠকেও ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হয়নি। এরপরও ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। ১৯৩৫ সালে কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের সাথে তাঁর আলোচনা ব্যর্থ হয়। ১৯৩৭-৩৮ সালে তিনি গান্ধীর সাথে পত্র বিনিময় করেন। গান্ধী মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানরূপে মেনে নিতেই অস্বীকার করেন। জিন্নাহর সাথে পত্রালাপে জওহরলাল নেহেরু হিন্দু-মুসলমান সমস্যা আলোচনায় মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের সমান মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেন। ১৯৩৮ সালে জিন্নাহ কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে পত্র বিনিময় করেও সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন।
এভাবেই হিন্দু-মুসলিম একের পর এক চেষ্টা ব্যর্থ হয়।