পরকালের পাঁচটি প্রশ্ন
বিচার দিবসে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে যে প্রধান কয়টি প্রশ্ন করবেন সে সম্পর্কে তিরমিযি শরীফে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। বর্ণনা করেছেন হযরত ইবনে মাসউদ (রা)। বলা হয়েছেঃ
(আরবী ****************************************************************)
সেদিন মানব সন্তানকে প্রধানত পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে। তার জবাব না দিয়ে তার এক পা অগ্রসর হবার উপায় থাকবে না। প্রশ্নগুলো হচ্ছেঃ
o তার জীবনের সময়গুলো সে কোন কাজে ব্যয় করেছে।
o (বিশেষ করে) তার যৌবনকাল সে কোন কাজে লিপ্ত রেখেছে।
o সে কিভাবে তার অর্থ উপার্জন করেছে।
o তার অর্জিত অর্থ-সম্পদ সে কিভাবে কোন পথে ব্যয় করেছে। সে যে সত্য জ্ঞান লাভ করেছিল, তার কতটা সে তার জীবনে কার্যকর করেছে।
উপরোক্ত পাঁচটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে মানব সন্তানের সমগ্র জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। মানুষ তার জীবন দুই প্রকারে অতিবাহিত করতে পারে। প্রথমত আল্লাহ, রসূল ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসস্থাপনের পর আল্লাহর আনুগত্যের ভিতর দিয়ে জীবনযাপন করা।
দ্বিতীয়ত খোদার আনুগত্যের বিপরীত এক খোদাদ্রোহী ও খোদাবিমুখ জীবনযাপন করা। পাপাচার, অনাচার, অপরের প্রতি অন্যায় অবিচার উৎপীড়ন, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, নর হত্যা প্রভৃতি খোদাদ্রোহী ও খোদাবিমুখ জীবনেরই বহিঃপ্রকাশ। এ দু’টির কোনটি সে করেছে সে প্রশ্নই করা হবে।
উপরে বর্ণিত প্রথম প্রশ্নটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবশ্যি প্রথম প্রশ্নের পর অন্যান্য প্রশ্নের কোন প্রয়োজন করে না। কিন্তু অন্যান্য প্রশ্নগুলোর দ্বারা মানুষের দুর্বলতা কোথায় তার প্রতি অংগুলি নির্দেশে করা হয়েছে।
যৌবনকাল মানব জীবনের এমন সময় যখন তার কর্মশক্তি ও বৃত্তিনিচয়ের পরিপূর্ণ বিকাশ হয়। আর বিকশিত হয় তার যৌন প্রবণতা। কূলে কূলে ভরা যৌনবদীপ্ত নদী সামান্য বায়ুর আঘাতে চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং তার সীমালংঘন করে দুকুল প্লাবিত করে। ঠিক তেমনি মানব জীবনের ভরা নদীতে প্রবৃত্তির দমকা হাওয়ায় তার যৌন তরংগ সীমালংঘন করতে পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। এখন প্রবৃত্তিকে বল্লাহীন করে ছেড়ে দেয়া অথবা তাকে দমিত ও বশীভূত করে রাখা-এর মধ্যেই মানুষের প্রকৃত অগ্নি পরীক্ষা। যৌবনকালে মানুষ তার দৈহিক ক্ষমতার অপব্যবহারও করতে পারে। অথবা সংযম, প্রেম ও ভালোবাসা, ক্ষমা, দয়া-দাক্ষিণ্য প্রভৃতি গুনের দ্বারা মানবতার সেবাও করতে পারে। সে জন্যে এ প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয় ও চতুর্থ প্রশ্নদ্বয় প্রকৃত মানব চরিত্রের পরিচয় দান করে। অর্থ ও ধন-সম্পদ উপার্জন করা মানবের এক স্বাভাবিক চাহিদা। জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনও অত্যধিক।
ধন উপার্জন ও ব্যয়-উভয়ের একটি নীতি নির্ধারিত হওয়া অত্যাবশ্যক। কেননা অর্থ উপার্জন, ব্যয় ও বণ্টনের উপরে গোটা মানব সমাজের সুখ-দুঃখ, উন্নতি-অবনতি নির্ভরশীল।
অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ের বেলায় কোন নীতি অবলম্বন করা যে প্রয়োজন এটা অনেকে স্বীকার করে না। তাদের মতে যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন করা যেতে পারে। সুদ-ঘুষের মাধ্যমে অপরকে শোষণ করে অথবা অশ্লীলতার মাদকতায় বিভ্রান্ত করে সম্পদ উপার্জনের বেলায় যেমন থাকবে অবাধ স্বাধীনতা, ব্যয়ের বেলায়ও ঠিক তেমনই তাদের স্বাধীনতা কাম্য। অর্জিত ধন-সম্পদের একটা অংশ ধনহীনদের মধ্যে বণ্টন না করে অথবা কোন মঙ্গলজনক কাজে ব্যয় না করে নিছক বিলাসিতায় ও ভোগ-সম্ভোগে, অনাচার, পাপাচার ও অশ্লীলতার প্রচার-প্রসার প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা তাদের মতে মোটেই দূষণীয় নয়। অসাধু ও গর্হিত উপায়ে গোটা সমাজের ধন-সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জিভূত করে অন্যান্যকে নগ্ন ও ক্ষুধার্ত রাখাও তাদের চোখে অন্যায় নয়।
আবার এহেন কসম ও অবিচারমুলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিবাদে যারা ধন-সম্পদ, উপার্জন ও ব্যয় বণ্টন নীতি রাষ্ট্রয়ত্ত করে সমগ্র জাতিকে রাজনৈতিক গোলামে পরিনত করা হয়। সে দেশের মানব সন্তানেরা তখন পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে পড়ে। থাকে না তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অথবা মানবিক কোন মর্যাদা। গৃহস্তের গরু-মহিষের মতো তাদেরকে চোখ বুজে মাঠে-ময়দানে কাজ করে ফসল ফলাতে হয়। যার উপরে থাকে না তাদের কোনই অধিকার। এ অবিচারমূলক ব্যবস্থাও অনেকের কাছে দূষণীয় নয়।
কিন্তূ সমগ্র সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা, মালিক ও প্রতিপালক প্রভু আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে, সৎপথে সদুপায়ে যেমন প্রত্যেককে অর্থ উপার্জন করতে হবে, তেমনি সৎপথে ও সদুদ্দেশ্যেই তা ব্যয় করতে হবে। অর্জিত ধন-সম্পদ থেকে দরিদ্র, অক্ষম, অসহায়, অন্ধ, আতুর, উপার্জনহীন আর্ত মানুষকে দান করতে হবে। অর্জিত সম্পদ যেন রক্ষিত সঞ্চয় হিসেবে পড়ে না থাকে অথবা তা ভোগ-বিলাসিতায় ব্যয়িত না হয়, তার জন্যেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এ জন্যেই পরকালে এ দু’টি প্রশ্নের গুরুত্ব অনেক।
পঞ্চম ও শেষ প্রশ্নটি হলো এই যে, মানুষের নিকটে যখন সত্যের আহবান এলো, অথবা যখন সে সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারলো, তখন সে তা গ্রহণ করলো, না বর্জন করলো, অতপর সত্য জ্ঞান লাভ করার পর তদনুযায়ী সে তার চরিত্র গঠন করলো কিনা। সে জ্ঞানের উদ্ভাসিত আলোকে সে জীবনযাত্রা করেছে কিনা। প্রবৃত্তির বশীভূত হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পার্থিব ভোগ বিলাসের জন্যে, অথবা সত্যের দিকে আহবানকারীর প্রতি অন্ধ বিদ্বেষ পোষণ করে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে থাকলে সে কথাও বিচার দিবসে খোদার দরবারে পেশ করতে হবে।
ইহুদী জাতির আলেম সমাজ শেষ নবীর আহবানকে সত্য বলে উপলদ্ধি করার পরও পার্থিব স্বার্থে ও শেষ নবীর প্রতি অন্ধ বিদ্বেষে বিরোধিতায় মেতে উঠেছিল। বর্তমানকালের মুসলিম সমাজের একটা বিরাট অংশ সেই ভুলের স্রোতেই ভেসে চলেছে।
_________________________
আত্না
একটা প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, কবর আযাব হয় কি আত্নার উপরে, না দেহের উপরে। এ সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন শুধু আত্নার উপরে। কেউ বলেন আত্না ও দেহ উভয়ের উপরেই। এতদ প্রসংগে আত্না বস্তূটি কি তারও আলোচনা হওয়া দরকার।
আত্না এক অদৃশ্য সুক্ষ্ম বস্তূ হলেও, এক অনস্বীকার্য সত্তা! তাই এর বিশ্লেষণও বড়ই কঠিন। আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী ******************************************************************)
“যখন আমি তাকে পরিপূর্ণরূপে বানিয়ে ফেলব এবং তার ভেতরে আমার রূহের মধ্য থেকে কিছুটা ফুৎকার করে দেব, তখন তোমরা যেন তার সামনে সেজদারত হও।”-(সূরা আল হিজরঃ ২৯)
উপরের আয়াত থেকে বুঝতে পারা যায় যে, মানুষের দেহে যে আত্না ফুৎকারিত হয়েছিল তা আসলে আল্লাহর গুনাবলীর একটা সুক্ষ্ম আলোকচিত্র। আয়ু, জ্ঞান, শক্তি-ইচ্ছা ও এখতিয়ার প্রভৃতি এবং অন্যান্য সব গুনাবলীর মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, যার সমষ্টির নাম আত্না, তা খোদায়ী গুনাবলীর একটা সুক্ষ্ম প্রতিবিম্ব বা আলোকচিত্র যা মানব দেহে নিক্ষিপ্ত বা ফুৎকারিত করা হয়েছে।
আত্নার সঠিক বিশ্লেষণ যে আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য। তবে আমরা শুধু এতটুকু উপলদ্ধি করতে পারি যে আত্না দেহকে সজীব ও সচল রাখে। তার অনুপস্থিতি মানুষকে নিশ্চল মৃতদেহে পরিনত করে।
আত্না এমন এক বস্তূ যা কখনো দৃশ্য না হলেও স্পষ্ট অনুভব করা যায়। এ এমন রহস্যময় শক্তি যা মানব দেহের সংগে সংযোজিত হওয়ার সাথে সাথেই সে সজীব ও সক্রিয় হয়ে উঠে।
আসলে আত্নাই প্রকৃত মানুষ। দেহ সে মানুষের বাহন বা খোলস মাত্র। আত্না সুক্ষ্ম অদৃশ্য বস্তূ হলেও তার একটা আকৃতি আছে এবং সে আকৃতি অবিকল দেহেরই মতন। আত্নাই আসল। দেহটা নকল। ‘আমি’ বলতে সে আত্নাই মানুষকেই বুঝায়। দুঃখ-বেদনা, আনন্দ সুখ সবই ‘আমার’ (আত্নার) দেহের নয়। মানুষ (আত্না) এবং দেহ দু’টি পৃথক সত্তা হলেও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
সুখ-দুঃখ দেহের মধ্যে অনুভূত হয়। আবার অনেক সময় সুখ-দুঃখ আনন্দ দেহ ছাড়াও হয়। দেহের সম্পর্ক বস্তূজগতের সংগে আত্নার সম্পর্ক অনন্ত অদৃশ্য জগতের সংগে।
কবরে অথবা মৃত্যুর পরজগতে আত্না সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করতে পারবে, এটা ধারণা করা কঠিন নয়। অবশ্যি পূর্বে বলা হয়েছে যে, সে জগতের সঠিক ধারণা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও কল্পনার অতীত। তবে খানিকটা অনুমান করা যায় মাত্র।
ঘুমের ঘোরে যে মানুষটি (আত্না) দেহ পরিত্যাগ করে অন্যত্র বিচরণ করে ভিন্ন দেশে ভিন্ন সমাজে জ্বলে-স্থলে অন্তরীক্ষে তারও সুখ-দুঃখ পূর্ণ অনুভূতি থাকে। তারও পরিপূর্ণ অংগ-প্রত্যংগ বিশিষ্ট একটা অশরীরি দেহ থাকে। আবার সুখ-দুঃখ বলতে তো আত্নারই। তাই দুঃস্বপ্নে কখনো দেহ পরিত্যাগকারী অদৃশ্য মানুষটি ব্যথা-বেদনায় অধীর হয়ে অশ্রু বিসর্জন করে। জাগ্রত হবার পর দেখা যায় শয্যায় শায়িত দেহধারী ব্যক্তিটির অশ্রুতে গণ্ডদেশ সিক্ত হয়েছে। অথচ আত্না মানুষটির অশ্রু বিসর্জন ও তার কারণ সংঘটিত হয়েছে হয়তো বা শত শত হাজার হাজার মাইল দূরবর্তী স্থানে। স্বপ্নে কঠোর পরিশ্রমের পর যে শ্রান্তি অনুভূত হয় তার প্রতিক্রিয়া জাগ্রত হবার পর পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। কলকাতায় থাকাকালীন আমাদের পাড়াতেই একরাতে জনৈক খ্যাতনামা ফুটবল খেলোয়াড় স্বপ্নে বল খেলছিলেন। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে উচ্চস্বরে গোল বলে চীৎকার করে বল কিক করলেন। তার পার্শ্বে শায়িতা স্ত্রীকে তার কিক লাগার ফলে রাতেই ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল।
অদৃশ্য আত্না মানুষটি হয়তো শয্যাস্থল থেকে দূরে বহুদূরে কোথাও বাঘ ভালুক অথবা দস্যু তস্করের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রাণপনে চীৎকার করছে সাহায্যের জন্য। শায়িত দেহটি থেকেও সে চীৎকার ধ্বনী অনেক সময় শুনতে পাওয়া যায়।
পূর্বে বলা হয়েছে, স্বপ্নে যে আত্না মানুষটি অন্যত্র তার ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে তার একটা দেহও থাকে। তার সুখ-দুঃখ স্থুল দেহ বিশিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখের অনুরূপ। যেহেতু স্বপ্নাবস্থায় অথবা জাগ্রতাবস্থায় সুখ-দুঃখ আত্নারই দেহের না, দেহের কোন অংশকে ঐষধ প্রয়োগে অবশ করে দিয়ে আত্নার সংগে তার সম্পর্ক ছিন্ন করে সে অংশটিকে ছুরি দিয়ে কর্তন করুন, তাতে আত্নার কোন অনুভুতিই হবে না। বলা হয়েছে আত্নার সম্পর্ক অদৃশ্য সূক্ষ্ম জগতের সংগে। অদৃশ্য সূক্ষ্ম জগত সীমাহীন এবং স্থুল জগতের বাইরের এক জগত। তাই স্বপ্নে বরযখে অবস্থানকারী মৃত ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত হয়। তার অর্থ এ নয় যে, মৃত ব্যক্তি বা তার আত্না এ স্থুল জগতে প্রত্যর্পণ করে।
স্বল্পকালীন সুখ-দুঃখ আমরা অলিক মনে করে ভুলে যাই জাগ্রত হবার পর। স্বপ্নকে অবাস্তব ও অসত্য মনে করা হয় তা ভেঙে যাবার পর। কিন্তূ স্বপ্ন কোনদিন না ভাঙলেই তা হবে বাস্তব ও সত্য।
মৃত্যুর পর কবরে আত্না মানুষটিরই সুখ-দুঃখ হতে পারে অথবা আমাদের ধারণার বিপরীত কোন পন্থায় নেক বান্দাদের সুখ ও পাপাত্নাদের দুঃখ হবে। সুখ-দুঃখ যখন আত্নারই, দেহের নয়, তখন মৃত্যুর পর সুখ-দুঃখ না হবার কি কারণ হতে পারে?
নিদ্রা ও স্বপ্নের উল্লেখ প্রসংগে আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তাহলো এই নিদ্রা বস্তূটি কি? নিদ্রাকালে আত্না কি দেহের সাথে জড়িত থাকে, না দেহচ্যুত হয়? এ একটা প্রশ্ন বটে।
বিজ্ঞানী ও শরীর তত্ববিদ্গন কি বলবেন জানি না। কারণ তাঁদের কারবার তো বস্তূ বা Matter নিয়ে-অদৃশ্য বিষয় নিয়ে নয়। অবশ্যি অনেক অদৃশ্য বস্তূ অণুবীক্ষণের সাহায্যে ধরা পড়ে। কিন্তূ আত্নার মতো বস্তূ কি কখনো অণুবীক্ষণে ধরা পড়েছে? আত্না কেন, আত্নার যে অনুভূতি সুখ অথবা দুঃখ যন্ত্রণা তাও কি কোন যন্ত্রে দৃশ্যমান হয় কখনো?
তাই প্রশ্ন নিদ্রাকালে আত্না যায় কোথায়? এবং কোথায় বিরাজ করে? মনোবিজ্ঞানীরা হয়তো বা কিছু বলবেন। কিন্তূ সেও তো আন্দাজ অনুমান করে। তার সত্যতার প্রমাণ কি? সত্য বলতে কি, এ এক অতীব দুর্বোধ্য ব্যাপার। সৃষ্টি রহস্যের এ এক উল্লেখ্য দিক সন্দেহ নেই। কুরআন হাকিম বলেছেঃ
(আরবী ***********************************************************************)
“আল্লাহ তায়ালা কবয বা দেহচ্যুত করে নেন ঐসব আত্নাকে তাদের মৃত্যুকালে এবং ঐসব আত্নাকেও যাদের মৃত্যু ঘটেনি নিদ্রাকালে। অতপর ঐসব আত্নাকে তিনি আটক রেখে দেন যাদের সম্পর্কে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট আত্নাকে একটা নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে বহু নিদর্শন আছে।”-(সূরা আয যুমারঃ ৪২)
আল্লাহ আরও বলেনঃ
(আরবী *********************************************************************)
“তিনি রাত্রিবেলা তোমাদের রূহ কবয করেন। আর দিনের বেলা তোমরা যা কিছু কর তা তিনি জানেন। (রূহ কবয করার পর তিনি দ্বিতীয় দিনে) আবার তিনি তোমাদের সেই কর্মজগতে ফিরে পাঠান; যেন জীবনের নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ হতে পারে। কেননা শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকটেই ফিরে যেতে হবে। তোমরা কি কাজ কর? তখন তিনি তোমাদেরকে তা বলে দেবেন।”-(সূরা আল আনয়ামঃ ৬০)
এ দু’টো আয়াতে একথা বলা হয়েছে যে, মৃত্যুকালে আত্মা দেহচ্যুত হয়, এবং ঘুমন্তকালেও। তবে পার্থক্য এই যে, যাদের মৃত্যু সিদ্ধান্ত হয়নি, তাদের আত্মাগুলো নির্দিষ্টকালের জন্যে ফেরৎ পাঠানো হয়।
বুঝা গেলো আত্মাকে দেহচ্যুত করলেই ঘুম আসে। তবে ঘুম সাময়িক। কারণ আত্মাকে আবার পাঠানো হয়। যার আত্মাকে ফেরৎ পাঠানো হয় না; তাকে চূড়ান্ত মৃত ঘোষণা করা হয়।
এতে চিন্তাশীল লোকদের চিন্তার খোরাক আছে তাও বলে দেয়া হয়েছে প্রথম আয়াতটিতে।
অধ্যাপক আর্থার এলিসন কুরআনের আয়াতগুলোর উপর চিন্তা-গবেষণা করে এ সিদ্ধান্ত পৌঁছেন যে, মৃত্যু ও ঘুম একই বস্তু যেখানে আত্মা দেহচুত হয়। তবে ঘুমের বেলায় আত্মা দেহে ফিরে আসে এবং মৃত্যুর বেলায় আসে না- PARA PSYCHOLOGIC অধ্যয়নের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
তবে এই দেহচ্যুতির ধরন আলাদা। যে আত্মা চিরদিনের জন্যে দেহচ্যুত হচ্ছে, তার দেহচ্যুতির সময় মানুষ তা বুঝতে পারে এবং তার জন্যে অসহ্য যন্ত্রণা হয়।
(আরবী*************)
“এবং সত্যি সত্যিই মৃত্যুর যন্ত্রণা বা কাঠিন্য এসে গেল। (এ মৃত্যু এমন এক বস্তু) যার থেকে তুমি পালিয়ে থাকতে চেয়েছিলে।”–(সূরা ক্বাফঃ ১৯)
আবার কদাচিৎ এর ব্যতিক্রমও দেখতে পাওয়া যায়। কোন কোন সুস্থ ব্যক্তি নামায পড়ছে। সেজদারত অবস্থায় তার এবং অন্যান্যের অজ্ঞাতে তার মৃত্যু এসে যাচ্ছে। অথবা রাতে খেয়ে দেয়ে আরামে ঘুমুচ্ছে। কিন্তু সে ঘুম আর ভাঙছে না। এমন ঘটনাও শুনতে পাওয়া যায়। আমার আম্মা সুস্থ ও সবল অবস্থায় সারাদিনের কাজ-কর্মের শেষে রাতের এশার নামাযে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল নামায সেরে খাবেন। কিন্তু সেজদায় থাকাকালীন তাঁর প্রাণবায়ু বহির্গত হয়। আল্লাহ তাকে মাফ করুণ।
মৃত্যুকালে আত্মা দেহচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে দেহের স্পন্দন, রক্ত চলাচল, সজীবতা আর বাকী থাকে না। কিন্তু নিদ্রাকালে এ সবই থাকে। আসলে নিদ্রা ও মৃত্যুকালে এই পার্থক্য তাও নির্ভর করে দেহ ও জীবনের মালিক আল্লাহরই সিদ্ধান্তের উপরে। মৃত্যুর সিদ্ধান্ত হলে দেহের অবস্থা একরূপ হয় এবং সিদ্ধান্ত না হলে দেহের অবস্থা অনেকাংশে স্বাভাবিক থাকে। এও আল্লাহর এক অসীম কুদরত তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ একটা দৃষ্টান্তের সাহায্যে বুঝবার চেষ্টা করা যাক। মনে করুন একটি লোক বাড়ি বদল করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সে তার বাড়ির যাবতীয় আসবাবপত্র ঝাড়ু পাপোষ পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা শূন্য গৃহ মাত্র পড়ে থাকে। কিন্তু সে যখন কিছুক্ষন বা কিছুদিনের জন্যে অন্যত্র বেড়াতে যায় তখন তার বাড়ির আসবাবপত্র আগের মতোই থাকে। থাকেনা শুধু সে। মৃত্যু ঠিক তেমনি শুধু বাড়ি বদলই নয়, ইহলোক থেকে পরলোক বদলি বা স্থানান্তর। তারপর তার গৃহটির মধ্যে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, রক্ত চলাচল, দেহের সজীবতা, জ্ঞান, বিবেক, অনুভূতি শক্তি, প্রভৃতি আসবাবপত্রের কোনটাই সে ফেলে যায় না। কিন্তু নিদ্রাকালে আত্মাটি তার গৃহের সমুদয় আসবাবপত্র রেখেই কিছুকালের জন্যে অন্যত্র চলে যায়।
আশা করি এ দৃষ্টান্তের পর ঘুম ও মৃত্যুর পার্থক্য বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়।
পরকালে শাফায়াত
শাফায়াত সম্পর্কে বিশদ আলোচনা ব্যতীত আখেরাতের আলোচনা পূর্ণাংগ হবে না বলে এখানে শাফায়াতের একটা মোটামুটি অথচ সুস্পষ্ট ধারণা পেশ করা দরকার মনে করি।
আল্লাহ তায়ালা এ বিশ্বজগত ও তন্মধ্যস্থ যাবতীয় সৃষ্টি নিচয়ের স্রষ্টা। তিনি দুনিয়ারও মালিক এবং আখেরাতেরও মালিক। হুকুম শাসনের একচ্ছত্র মালিক যেমন তিনি, তেমনি পরকালে হাশরের মাঠে তাঁর বান্দাহদের আমলের হিসাব-নিকাশ করে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একচ্ছত্র অধিকারও একমাত্র তাঁরই। তিনি বলেনঃ (আরবী************) “সেদিন (কিয়ামতের দিন) বাদশাহী একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। তিনিই মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।” – (সূরা হাজ্জঃ ৫৬)
অর্থাৎ সে দিনের বিচারে কারো সাহায্য গ্রহণ করার, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোন জুরি বেঞ্চ বসাবার অথবা কারো কোন পরামর্শ গ্রহণ করার তাঁর কোনই প্রয়োজন হবে না। তিনি তো নিজেই সর্বজ্ঞ। প্রত্যেকের গোপন ও প্রকাশ্য আমল তাঁর জানা আছে। তদুপরি ন্যায় ও ইনসাফ প্রদর্শনের জন্যে বান্দাহর প্রতিটি গোপন ও প্রকাশ্য আমল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তাঁর ফেরেশতাগণ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে আমলনামা হিসেবে রেকর্ড তৈরী করে রেখেছেন। এ আমলনামা প্রত্যেকের হাতে দেয়া হবে। সে আমলনামা দেখে পাপীগণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলবেঃ (আরবী************)
“বড়োই আশ্চর্যের বিষয় যে এ নামায়ে আমলে ছোট বড় কোন গুনাহই অলিখিত নেই।”–(সূরা কাহাফঃ ৪৯)
নামায়ে আমল ফেরেশতাগণ দ্বারা লিখিত। তাঁদের কোন ভুল হয় না। ভুল ও পাপ করার কোন প্রবণতাই তাঁদের নেই। কিন্তু তাই বলে কি আল্লাহ ফেরেশতা কর্তৃক লিখিত আমলনামার উপরে নির্ভরশীল? কিছুতেই না। ফেরেশতাগণ তো বান্দাহকে যখন যে কাজ করতে দেখেছেন, তখনই তা লিখেছেন। বান্দাহর ভবিষ্যৎ কাজ-কর্ম সম্পর্কে তাঁদের কোন জ্ঞান নেই। করতে দেখলেই তা শুধু লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু আল্লাহর কাছে অতীত ভবিষ্যৎ সবই বর্তমান। বান্দাহর ভবিষ্যৎ কর্মও তাঁর কাছে বর্তমানের রূপ নিয়ে হাজির থাকে। অতএব ফেরেশতাদের লিখিত আমলনামা ব্যতিরেকেই তিনি তাঁর সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। কিন্তু ন্যায় বিচারের দৃষ্টিতে এবং বান্দাহর বিশ্বাসের জন্যে আমলনামা লিখার ব্যবস্থা তিনি করেছেন। অতএব সিদ্ধান্ত গ্রহণের তৃতীয় কোন পক্ষের প্রয়োজন হলে খোদাকে তাঁর মহান মর্যাদা থেকে নীচে নামানো হবে। অন্য কেউ তাঁর উপরে প্রভাব বিস্তার করবে অথবা বান্দাহর আমল আখলাক সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞানদান করবে এ তো একজন মুশরিক চিন্তা করতে পারে। অতএব সেই বিচারের দিন কোন ব্যক্তির পরামর্শ বা সুপারিশ গ্রহণ তাঁর প্রয়োজন নাই। (আরবী****************)
“সেদিন আসার পূর্বে যে দিন না কোন লেন-দেন থাকবে, না কোন দুস্তি-মহব্বত, আর না কোন সুপারিশ।”–(সূরা আল বাকারাঃ ২৫৪)
কিন্তু বড়োই পরিতাপের বিষয় তওহীদ সম্পর্কে অনেকে একটা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে। তাদের ধারণা বরঞ্চ দৃঢ় বিশ্বাস যে, এমন কিছু লোক আছেন, যারা হাশরের মাঠে পাপীদের জন্যে আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সুপারিশ অনুযায়ী তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে বেহেশতে পাঠাবেন।
এ সুপারিশ তারা ও ফলপ্রসূ বলে বিশ্বাস করে। অতএব খোদার বন্দেগী থেকে তারা সুপারিশ বেশী গুরুত্ব দেয়। এ গুরুত্বদানের একটি কারণ এই যে, সুপারিশকারী ব্যক্তিগণকে তারা খোদার অতি প্রিয়পাত্র, অতি নিকট ও অতি প্রভাবশালী মনে করে। এর অনিবার্য ফল এই যে, প্রবৃত্তির মুখে লাগাম লাগিয়ে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস উপেক্ষা করে, ত্যাগ ও কুরবানী করে আল্লাহর হুকুম পালন করার পরিবর্তে তারা ওইসব লোককে তুষ্ট করার জন্যে অতিমাত্রায় অধীর হয়ে পড়ে যাদেরকে তারা সুপারিশকারী হিসেবে বিশ্বাস করে নিয়েছে। অতএব তাঁদের সন্তুষ্টির জন্যে তাদেরকে নযর-নিয়ায দান করা তাদের নামে নযর-নিয়ায মানত করা, তাঁদের কবরে ফুল শির্নি দেয়া, কবরে গোলাপ ছড়ানো, বাতি দেয়া, মৃত বুযর্গানের নামে শির্নি বিতরণ করা প্রভৃতি কাজগুলো তাঁরা অতি উৎসাহে নিজেরা করে এবং অপরকে করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের বিশ্বাস এভাবে তাদেরকে সন্তুষ্ট করা যাবে। সন্তুষ্ট হলে অবশ্যই হাশরের মাঠে তাঁরা তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন। আর এ সুপারিশ কখনও মাঠে মারা যাবে না।
ইসলাম সম্পর্কে বুনিয়াদী ধারণা বিশ্বাসের অভাবেই এরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিছু লোক ইসলামের মূল আকীদাহ মেনে নিয়ে তদানুযায়ী নিজকে গড়ে তুলতে চায় না এবং মুলতঃই তাড়া দুষ্কৃতিকারী। আখেরাত সম্পর্কে সঠিক ধারণা তাদের নেই। কুরআন ও হাদীস এবং নবী পাক (সা) ও সাহাবায়ে কেরামের বাস্তব জীবনের অনুকরণও তাদের কাম্য নয়। তাদের ধারণা আখেরাত যদি হয়ও – তাহলে সেখানে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্য কোন সহজ পন্থা আছে কিনা। জ্বিন ও মানুষ শয়তান তাদের কুমন্ত্রনা দেয় যে, অমুক নামধারী কোন মৃত অলী তাদেরকে সাফায়েতের কাজ করবেন। এ আশায় বুক বেঁধে তারা কোন মুসলমান বুযর্গের মাজারে অথবা কোন কল্পিত মাজারে গিয়ে তাদের উদ্দেশে এমন ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আবেদন-নিবেদন করে – একমাত্র আল্লাহ তায়ালার প্রাপ্য। এসন মাজারে গিয়ে যা কিছু করে তা মৃত ব্যক্তিদের জানারও কোন উপায় থাকে না। আর যখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে একথা জানিয়ে দেবেন, তখন তারা মাজার পূজারীদের প্রতি সন্তুষ্ট না হয়ে তাদের শির্কমূলক আচরনের জন্যে অত্যন্ত ব্যথিত হবেন। আল্লাহকে বাদ দিয়ে যারা মানুষকে খোদা বানাতে চায় অথবা তাদেরকে খোদার শরীক বানায় তাদের জন্যে বদদোয়া ব্যতীত কোন নেকলোকের পক্ষ থেকে দোয়া বা সুপারিশের আশা কিছুতেই করা যায় না।
তারপর দুনিয়ার তথাকথিত কিছু জীবিত অলীর কথা ধরা যাক। তাদের এখানে সমাজের অতি নিকৃষ্ট ধরণের দুষ্কৃতিকারীদেরও ভিড় হয়। তারা এ বিশ্বাসে তাদের নিকট যায় যে, তারা খোদার দরবারে এতো প্রভাবশালী যে, কিয়ামতের দিন অবশ্যই তারা খোদাকে প্রভাবিত করে তাদের নাজাত লাভ করিয়ে দেবেন। এ আশায় তারা উক্ত পীর বা অলীকে নানান রকম মূল্যবান নযর-নিয়ায দিয়ে ভূষিত করে।
এ নেহায়েৎ এক বিবেক সম্মত কথা যে, কিয়ামতে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে শাফায়াত করার মর্যাদা দান করবেন – তাঁরা নিশ্চিতরূপে বেহেশতবাসী হবেন। নতুবা যার নিজেরই নাজাতের কোন আশা নেই, সে এ সৌভাগ্য অর্থাৎ অন্যের সুপারিশ করার সৌভাগ্য লাভ করবে কি করে? আর প্রকৃতপক্ষে কোন পীর অলী যদি সত্যিকার অর্থে নেক হন, তাহলে কি করে পাপাচারী দুষ্কৃতকারীর বন্ধু হতে পারেন? কিয়ামতের দিন পাপাচারীদের কোন বন্ধু ও সুপারিশকারী থাকবে না। (আরবী******************)
“অন্যায় আচরণকারীদের জন্যে কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুও থাকবে না এবং থাকবে না কোন সুপারিশকারী যার কথা শুনা যাবে।” (সূরা আল মুমেনঃ ১৮)
কতিপয় তথাকথিত নামধারী পীর অলী সমাজ বিরোধী পাপাচারী লোকদের নিকট মোটা অংকের নজরানা ও মূল্যবান উপঢৌকন-হাদীয়ার বিনিময়ে তাদের চরিত্রের সংশোধনের পরিবর্তে পাপাচারেই প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, তাদের নিজেদের নাজাতই অনিশ্চিত বরঞ্চ যালেমের সহযোগিতা করার জন্যে তারাও শাস্তির যোগ্য হবে।
এসব লোকের সম্পর্কেই কুরআন বলেঃ (আরবী***********)
“(কিয়ামতের দিন) ঐসব নেতা, যাদের যাদের দুনিয়াতে অনুসরণ করা হয়েছিল, তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্কহীনতার কথাই প্রকাশ করবে- কিন্তু তারা অবশ্যই শাস্তি পাবে এবং তাদের মধ্যকার সকল সম্পর্ক ও যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে। দুনিয়ায় যারা এসব নেতাদের অনুসরণ করেছিল তারা বলবে হায়রে, যদি দুনিয়ায় আমাদেরকে একটা সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে আজ যেভাবে এরা আমাদের প্রতি তাদের অসন্তোষ ও বিরক্তি প্রকাশ করছে, আমরাও তাদের প্রতি আমাদের বিরক্তি দেখিয়ে দিতাম। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে তাদের কৃত ক্রিয়াকর্ম এভাবে উপস্থাপিত করবেন যে, তারা দুঃখ ও অনুশোচনায় অভিভূত হবে। কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে বেরুবার কোন পথ থাকবে না।” -(সূরা আল বাকারাঃ ১৬৬-১৬৭)
পূর্ববর্তী উম্মতের ধর্মীয় নেতাগণ অর্থ উপার্জনের লালসায় এভাবে ধর্মের নামে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতো।
কুরআন বলেঃ (আরবী**************)
“অর্থাৎ (আহলে কিতাবদের) অধিকাংশ আলেম পীর-দরবেশ অবৈধ উপায়ে মানুষের অর্থ-সম্পদ ভক্ষণ করে এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখে।” -(সূরা আত তাওবাঃ ৩৪)
এভাবে পথভ্রষ্ট যালেমগণ তাদের ধর্মীয় মসনদে বসে ফতুয়া বিক্রি করে, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে নযর-নিয়ায লুঠ করে এমন এমন সব ধর্মীয় নিয়ম-পদ্ধতি আবিস্কার করে যার দ্বারা মানুষ তাদের কাছে আখেরাতের নাজাত খরীদ করে তাদেরকে খাইয়ে দাইয়ে তুষ্ট না করে তাদের জীবন মরণ, বিয়ে-শাদী প্রভৃতি হয় না এবং তাদের ভাগ্যের ভাঙা-গড়ার ঠিকাদার তাদেরকে বানিয়ে নেয়। এতোটুকুতেই তারা ক্ষ্যান্ত হয় না, বরঞ্চ আপন স্বার্থের জন্যে এসব পীর-দরবেশ মানুষকে গোমরাহির ফাঁদে আবদ্ধ করে এবং যখন সংস্কার সংশোধনের জন্যে কোন হকের দাওয়াত দেয়া হয় তখন সকলের আগে এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতারণার জাল বিস্তার করে হকের দাওয়াতের পথ রুদ্ধ করার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়।
পূর্ববর্তী উম্মতের আহলে কিতাবদের এ দৃষ্টান্ত পেশ করে আল্লাহ মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই তাদের অনুকরণে কৃত্রিম ধর্মীয় মসনদ জমজমাট করে রেখেছেন।
যারা নিজেরা স্বয়ং ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতে রাজী নয় এবং ধর্মের নামে প্রতারণা করে মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে তারাও নিজেদের নাজাতের জন্যেই পেরেশান থাকবে- অপরের সুপারিশ করার যোগ্যতাই বা তাদের কোথায়?
শাফায়াতে ইসলামী ধারণা
তাই বলে শাফায়াত নামে কোন বস্তু ইসলামী আকায়েদের মধ্যে শামিল নেই কি? হাঁ, নিশ্চয়ই আছে। তবে উপরে বর্ণিত শাফায়াতের মুশরেকী ধারণা কুরআন হাকিম বার বার খণ্ডন করে একটা ইসলাম সম্মত ধারণা পেশ করেছে। কিছু লোক হাশরের মাঠে কিছু লোকের শাফায়াত করবেন।
এ শাফায়াত হবে সম্পূর্ণ পৃথক ধরণের। এতে করে আল্লাহর গুণাবলীর কণামাত্র লাঘব হবে না। না তাঁর প্রভুত্ব কর্তৃত্ব কণামাত্র হ্রাস পাবে। সেদিনের শাফায়াত তাঁরই অনুমতিক্রমে এবং বিশেষ শর্তাধীন এবং সীমিত হবে। শাফায়াত হবে বিশেষ নিয়ম পদ্ধতি অনুযায়ী।
- প্রথমতঃ শাফায়াতের ব্যাপারটি পুরোপুরি আল্লাহর হাতে এবং তাঁর মরযী মোতাবেক হবে।
(আরবী*************)
“বল, শাফায়াত সমগ্র ব্যাপারটি আল্লাহর হাতে।”–(সূরা যুমারঃ ৪৪)
(আরবী**************)
“তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে কে তাঁর কাছে শাফায়াত করবে?”–(সূরা আল বাকারাঃ ২৫৫)
- যার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ কাউকে শাফায়াতের অনুমতি দেবেন, শুধু সেই ব্যক্তির জন্যেই শাফায়াতকারী মুখ খুলতে পারবে।
(আরবী********)
“যাদের উপর আল্লাহ খুশি হয়েছেন তারা ব্যতীত আর কারো জন্যে শাফায়াত করা যাবে না।” –(সূরা আল আম্বিয়াঃ ২৮)
- শাফায়াতকারী শাফায়াতের সময় যা কিছু বলবেন, তা সকল দিক দিয়ে হবে সত্য ও ন্যায়সঙ্গত।
(আরবী************)
“দয়ার সাগর আল্লাহ পাক যাদেরকে অনুমতি দেবেন, তারা ব্যতীত আর কেউ কোন কথা বলতে পারবে না এবং তারা যা কিছু বলবে, তা ঠিক ঠিক বলবে।”–(সূরা নাবাঃ ৩৮)
উপরের শর্ত ও সীমারেখার ভেতরে যে শাফায়াত হবে, তা দুনিয়ার মানুষের দরবারে কোন সুপারিশের মতো নয়। তা হবে নেহায়েৎ বন্দেগীর পদ্ধতিতে অনুনয়-বিনয়, দোয়া ও ক্ষমা ভিক্ষা। তাছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহর সিদ্ধান্ত পাল্টাবার জন্যে নয়, তাঁর জ্ঞান-বৃদ্ধি করার জন্যে নয় এমন কি এরূপ কোন সূক্ষ্মতম ধারণাও শাফায়াতকারীর মনে স্থান পাবে না। আখেরাতের একমাত্র মালিক ও বাদশাহর পরম অনুগ্রহসূচক অনুমতি পাওয়ার পর শাফায়াতকারী খুব দীনতা ও হীনতা সহকারে বলবে, “হে দুনিয়া ও মালিক ও বাদশাহ! তুমি তোমার অমুক বান্দাহর গুনাহ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করে দাও। তাকে তোমার মাগফেরাত ও রহমতের বেষ্টনীর মধ্যে টেনে নাও।”
এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শাফায়াতের অনুমতিদানকারী ও কবুলকারী যেমন আল্লাহ তেমনি শাফায়াতকারীও আসলে আল্লাহ স্বয়ং।
(আরবী********)
“তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত তাদের জন্যে না আর কেউ অলী বা অভিবাবক আছে, আর না কেউ শাফায়াতকারী।”–(সূরা আল আনআমঃ ৫১)
এ শাফায়াতকারী কোন কোন ব্যক্তি হবেন, এবং কাদের জন্যে শাফায়াত করা হবে তা হাদীসসমূহে বলে দেয়া হয়েছে। শাফায়াতকারীগণ হবেন আল্লাহর নেক ও নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ। আর ওইসব লোকের জন্যে করা যাদের ঈমান ও আমল ওজনে এতটুকু কম হবে যে তা ক্ষমার অযোগ্য। ক্ষমার যোগ্যতা লাভে কিছু অভাব রয়ে যাবে। এ অভাবটুকু পূরণের জন্যে আল্লাহ অনুগ্রহ করে তাদের জন্যে শাফায়াত করার অনুমতি দেবেন।
উপরের আলোচনায় একথা পরিষ্কার হলো যে, কারো ইচ্ছা মতো শাফায়াত করার এখতিয়ার কারো নেই। যাদের জন্যে শাফায়াত করা হবে তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে ক্ষমা করে দেয়ার নিয়তেই কাউকে শাফায়াতের অনুমতি দেবেন।
তাহলে স্বভাবতঃই মনের মধ্যে এ প্রশ্ন জাগে যে, তাই যদি হয়, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাই যদি সব করবেন, তাহলে এ শাফায়াত করার হেতুটা কি?
তার জবাব এই যে, আল্লাহ সেই মহাপরীক্ষার দিনে, যে দিনের ভয়ংকরতা দর্শনে সাধারণ মানুষ কেন নবীগণও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন এবং মহান প্রভুর দরবারে কারো কথা বলার শক্তি ও সাহস থাকবে না, সেদিন আল্লাহ্ তাঁর কিছু খাস ও প্রিয় বান্দাদেরকে শাফায়াতের অনুমতি দিয়ে তাঁদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন। এ মর্যাদার সর্বচ্চ স্থান হবে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফার (সা)।
এ বিস্তারিত আলোচনায় একথা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেল যে, শাফায়াত আসলে আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ ক্ষমা পদ্ধতির নাম যা ক্ষমার সাধারণ নিয়ম-কানুন থেকে কিছু পৃথক। একে আমরা ক্ষমা প্রদর্শনের অতিরিক্ত অনুগ্রহের নীতি (Special concessional laws of amnesty) বলতে পারি। এও একটা নীতি পদ্ধতি বটে। এটাও আল্লাহর তাওহীদ, প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, সম্ভ্রম ও জ্ঞান প্রভৃতি গুণাবলীর পুরাপুরি চাহিদা মোতাবেক। এতে করে পুরষ্কার অথবা শাস্তি বিধানের আইন-কানুন মোটেই ক্ষুণ্ণ করা হয় না।
আর একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, আখেরাতের ক্ষমা প্রাপ্তি আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত মোটেই সম্ভব নয়। নবী বলেনঃ (আরবী***************)
“জেনে রেখে দাও যে, তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তিই শুধু তার আমলের বদৌলতে নাজাত আশা করতে পারে না।”- (মুসলিম)
কিন্তু একথা যেমন সত্য তেমনি এও সত্য যে, আল্লাহ্ তায়ালার এ অনুগ্রহ বা ‘ফযল ও করম’একটা নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি কেবলমাত্র ঐসব লোকদেরকে তার ফযল ও করমের ছায়ায় স্থান দেবেন, যারা ঈমান ও আমলের বদৌলতে তার যোগ্য হবে। যে ব্যক্তির ঈমান ও আমল যতো ভালো হবে, সে তার ফযল ও করমের তত হকদার হবে। আর যার ঈমান ও আমলের মূলধন যতো কম হবে সে তার অনুগ্রহ লাভের ততোটা কম হকদার হবে। আবার এমনও অনেক হতভাগ্য হবে যারা মোটেই ক্ষমার যোগ্য হবে না।
মোটকথা মাগফেরাত বাস্তবক্ষেত্রে নির্ভর করে মানুষের ঈমান ও আমলের উপরে। আর এ ব্যাপারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ পাকের।
যা কিছু বলা হলো, তা হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে শাফায়াতের নির্ভুল ধারণা। উপরে বর্ণিত শাফায়াত সম্পর্কে ভ্রান্ত ও মুশরেকী ধারণা মন থেকে মুছে ফেলে দিয়ে ইসলামী ইসলামী ধারণা পোষণ না করলে আখেরাতের উপর ঈমান অর্থহীন হয়ে পড়বে।