১
আল্লাহ
এই পূত পবিত্র নামটি সেই মহান সত্তার পরিচয় বহন করে যাঁর ওপর আমাদের রয়েছে অবিচল ঈমান। তিনিই আমাদের যাবতীয় কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর কাছেই আবার ফিরে যেতে হবে।
কল্যাণময় প্রাচুর্যময় আল্লাহ তাআলাই যাবতীয় প্রশংসা ও সম্মানের উপযুক্ত। তাঁকেই সমীহ করতে হবে এবং তিনি ক্ষমা করার অধিকারী। আমরা তাঁর প্রশংসা ও গুণগান করে শেষ করতে পারি না। তাঁর উপযুক্ত প্রশংসা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাঁর সম্মান ও পবিত্রতা বর্ণনা করার হক আদায় করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে।
ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষও যদি আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে কুফরী ও বিদ্রোহে লিপ্ত হয় –তাতে তাঁর মর্যাদা লেশমাত্রও হ্রাস পাবে না এবং তাঁর রাজত্বেও ঘাটতি দেখা দেবে না। তাঁর আলোক প্রভায় কোনরূপ পার্থক্য সূচিত হবে না। তাঁর শান-শওকত ও মহানত্বের ঔজ্জ্বল্য সমভাবে বিরাজিত থাকবে। তিনি মহা পবিত্র এবং সার্বিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি নিজ সত্তায় ও গুণাবলীতে সুমহান। তাঁর রাজত্ব এতই প্রশস্ত এবং তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা এতই ব্যাপক যে, কোন স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন লোকের বোকামী অথবা কোন নাদান মূর্খের আহাম্মকী এর মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ও অনৈক্য সৃষ্টি করতে পারবে না।
এ যুগের মানুষ যদি আত্মপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, পার্থিব লালসায় ডুবে যায় আখিরাতকে ভুলে যায় এবং নিজের প্রতিপালককে অস্বীকার করে তাহলে পরিণতি তাকেই ভোগ করতে হবে। সে আল্লাহর কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। মহান আল্লহার বাণীঃ
(আরবী********************************************************************)
এমন কিছু লোক রয়েছে যারা না জেনে-শুনে আল্লাহ সম্পর্কে তর্কবিতর্কে লিপ্ত হয় এবং প্রত্যেক উদ্ধত শয়তানের অনুসরণ করে। অথচ তার সম্পর্কে লেখা রয়েছে –যে ব্যক্তিই এটাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে তাকেই সে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে এবং জাহান্নামের পথ দেখাবে। -সূরা হজ্জঃ ৩-৪
আল্লাহর অস্তিত্ব প্রসঙ্গ
আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বের ব্যাপররটা কোন জটিল বিষয় নয়। তা অনুধাবন করার জন্য তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রয়োজন নেই, এটা বোঝা কারো পক্ষে কষ্টকরও নয়। এটা সম্পূর্ণ পরিস্কার ব্যাপার। মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি তা সহজেই অনুধাবন করতে পারে এবং তার স্বভাবই তাকে এ সম্পর্কে পথ দেখায়।
কখনো এরূপও হয়ে থাকে যে, তীক্ষ্ণ আলোকচ্ছটা দর্শনের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আবার কখনো এরূপ হয় যে, কোন জিনিস আমাদের খুবই কাছে কিন্তু চোখ তা দেখতে অক্ষম হয়ে পড়ে। যদি এমনটি না হত তাহলে কোন মুমিন অথবা নাস্তিকের পক্ষে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করা সম্ভব হত না। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
আল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহ? অথচ তিনিই আসমান ও যমীনের স্রষ্টা।
-সূরা ইবরাহীমঃ ১০
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যত নবী-রাসূল এসেছেন, তাঁরা সবাই আল্লাহ তাআলার উলুহিয়াত সম্পর্কে মানব জাতির চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি করার জন্যই এসেছেন। কেননা মানুষ যদিও স্বভাবগতভাবেই আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভ করতে পারে কিন্তু তারা এ পথে অগ্রসর হয়ে ভুলবশত শিরকে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তাদের বুদ্ধি-বিবেক তাঁর সম্পর্কে যথাযথ ও নির্ভুল ধারণা করতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
মহামহিম আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
বস্তুত এটা মানব জাতির জন্য একটি পয়গাম। এর দ্বারা তাদেরকে সাবধান করে দেওয়া হবে। তারা জেনে নেবে যে, উপাস্য কেবল একজনই। বুদ্ধিমান লোকেরা এ ব্যাপারে সচেতন হবে।
-সূরা ইবরাহীমঃ ৫২
(আরবী*******************************************************************************)
অতএব হে নবী! তুমি ভালভাবে জেনে নাও –আল্লাহ ছাড়া ইবাদত পাবার উপযুক্ত আর কেউ নেই। তোমার নিজের অপরাধের জন্য এবং মুমিন পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।
-সূরা মুহাম্মদঃ ১৯
জঘন্য পরিবেশ মানব প্রকৃতির পক্ষে অত্যন্ত আশংকাজনক। এটা তার প্রকৃতিকে কদাকার ও নিঃশেষ করে দেয়। পঙ্কিল পরিবেশ তার স্বভাব-প্রকৃতির মধ্যে এমন সব রোগের জন্ম দেয় যা তার অনুভূতির পবিত্রতা এবং রুচিবোধের সৌন্দর্য সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দেয়। সে তখন নর্দমার পানি পান করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি প্রত্যাখ্যান করে। ডালিম ও আঙুরের পরিবর্তে তিতা ফল পছন্দ করে।
নিগুঢ় কথা হচ্ছে –একদল মানুষ ঈমান ও সংশোধনের পথ পরিহার করে কুফর ও শিরকের পথ বেছে নেয়। অথচ শিরক এমন এক জিনিস যার কোন বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা দার্শনিক ভিত্তি নেই। মানব প্রকৃতির সাথে এর কোন সম্পর্কেও নেই। হাদীসে কুদসীতে রাসূল (স)-এর ভাষায় মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
আমি আমার বান্দাদের সবাইকে তৌহীদের প্রতি একনিষ্ঠ করে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তানের দল এসে তাদেরকে দীনের পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর আমি তাদের জন্য যেসব জিনিস হালাল করেছি, এরা সেগুলো তাদের জন্য হারাম ঘোষণা করে।
-মুসলিমঃ কিতাবুল জান্নাত
যে পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ সারা দুনিয়াকে গ্রাস করে ফেলেছে, তার মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করার কঠিন প্রবণতা রয়েছে। তা দুনিয়ার সমস্ত ধর্মকেই ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। এই সমাজে যদি আল্লাহর কোন স্থান থেকে থাকে তবে তা এমন অবস্থায় যে, ধর্ম একটা কল্পনার গুটি অথবা আফিমের গুটি, যা তাঁর নাম উচ্চারণকারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়।
এতে সন্দেহ নেই যে, আজকের বিশ্বে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা আধ্যাত্মিক দেউলিয়াত্বেরই পরিণাম। আল্লাহর দীন যে মহান মূল্যবোধ নিয়ে এসেছিল, দুনিয়ার মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই মূল্যবোধগুলো কি? সত্য-ন্যায়-ইনসাফ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মনের ঐশ্বর্য। আজকের বিশ্ব যখন পুনরায় এই মূল্যবোধের দিকে ফিরে আসবে তখনই দুনিয়ার মানুষ এই নৈরাজ্য ও দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে। আর পার্থিব জগৎ তার প্রকৃতিকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার জন্য এই মূল্যবোধের দিকে অবশ্যই ফিরে আসবে। যেমন শিশু তার মায়ের পেট থেকে নিজেই নিজের পথ তৈরি করে বেরিয়ে আসে অথবা পাখির ছানা যেভাবে ডিমের খোসা থেকে বেরিয়ে আসে। দুনিয়া যেদিন এই প্রকৃতিগত পথের সন্ধান পেয়ে যাবে তখণ সে সরাসির ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেবে। কেননা ইসলামই হচ্ছে একমাত্র ফিতরাতের ধর্ম। এর সপক্ষে এখানে কিছু দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করা যেতে পারে। তাতে অলস মস্তিঙ্ক ব্যক্তির চিন্তা-দর্শনের বন্ধ জানালাও খুলে যেতে পারে। সে এই জানালার ফাঁক দিয়ে মহাসত্যের উজ্জ্বল আলোকপ্রভা অবলোকন করতে সক্ষম হবে।
এক. মানুষ নিজেই নিজের স্রষ্টা নয়। সে তার সন্তানদেরও সৃষ্টি করেনি। সে যে পৃথিবীর বুকে পদচারণা করছে তাও তার সৃষ্টি নয়। সে বে বিশাল আসমানের শামিয়ানার নিচে বসবাস করছে তাও সে সৃষ্টি করেনি। যুগে যুগে যেসব স্বৈরাচারী নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দাপটে আল্লাহ হওয়ার দাবি করেছে, তারাও এসব কিছুর স্রষ্টা হওয়ার দাবি করার সাহস করেনি। অতএব একথা অকাট্যভাবেই বলা যায়, কোন মানুষই তার নিজের স্রষ্টা নয় এবং সে নিজেকে নাস্তি থেকে অস্তিত্বে নিয়ে আসেনি! আর কোন জীব-জন্তু ও জড় পদার্থের পক্ষে নিজ নিজকে সৃষ্টি করার কোন প্রশ্নই আসে না। অনুরূপভাবে এটাও চূড়ান্ত কথা যে কোন জিনিসই স্বয়ং সৃষ্টি হতে পারেনি। অতএব আল্লাহ ছাড়া আর কেউই বাকি রইল না। কুরআন আমাদের সামনে এই দলিল পেশ করেছেঃ
(আরবী********************************************************************************)
এরা কি কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া নিজেরাই অস্তিত্ব লাভ করেছি? অথবা এরা নিজেরাই কি নিজেদের সৃষ্টিকর্তা? অথবা পৃথিবী ও আকাশসমূহ কি এরাই সৃষ্টি করেছে? বরং এরা কোন কথায়ই দৃঢ় প্রত্যয়ী নয়।
সূরা তূরঃ ৩৫-৩৬
অনুরূপভাবে আরবরা যে সাদামাটা পরিবেশে বসবাস করত, তার মধ্যে সৃষ্টির যে সৌন্দর্য বিরাজিত ছিল, সেদিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************************)
এরা কি উটগুলোকে দেখতে পায় না –কেমন করে তা সৃষ্টি করে তা সৃষ্টি করা হয়েছে, এরা কি আকাশমণ্ডল দেখে না –কিভাবে তা সমুন্নত করা হয়েছে? এরা কি পর্বতমালা দেখে না –কিভাবে তা মজবুতভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে? এরা কি ভূ-পৃষ্ঠ দেখে না –কিভাবে তা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে? –সূরা গাশিয়াঃ ১৭-২০
দুই. কোন ব্যক্তি একটি বাড়িতে প্রবেশ করে এর মধ্যে একটি খাবার ঘর (Dining Room), একটি শোয়ার ঘর (Bed Room), দেখতে পেল। এর প্রতিটি কক্ষের সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় জিনিস নিজ নিজ স্থানে সুবিন্যস্ত অবস্থায় প্রস্তুত রয়েছে। সে এসব দেখে অবশ্যই মন্তব্য করবে –সরাসরি এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে এগুলো অস্তিত্ব লাভ করেনি। অবশ্যই এই আরামদায়ক ঘর কোন পরিকল্পনার ভিত্তিতেই তৈরি করা হয়েছে। কোন মিস্ত্রি তা তৈরি করেছে এবং একজন অভিজ্ঞ লোকের তত্ত্বাবধানে তা তৈরি হয়েছে। সে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই তা তৈরি করিয়েছেন।
এই মহাবিশ্ব এবং এর বিশালতা, জড় পদার্থ এবং এর বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনাকারীর সামনে এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠে যে, এগুলো সুদৃঢ় ও সুশৃঙ্খল নিয়ম-কানুনের অধীন। এসব নিয়ম-কানুনের কিছু কিছু পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদির মাধ্যমে মানব জাতির সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। মানুষও জগৎ থেকে সীমাহীন উপকার লাভ করছে। মহাবিশ্বের গোপন রহস্যের যতটুকু এ পর্যন্ত মানুসের সামনে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তার যাবতীয় সংশয়-সন্দেহ মূলোৎপাটিত হয়ে যায়। সে আর কখনো বলতে প্রস্তুত হবে না যে, এক দুর্ঘটনার ফলেই এই জীবন ও জগৎ অস্তিত্ব লাভ করেছে। এটা মোটেই দুর্ঘটনার ফলশ্রুতি নয়। একটি পরমানুর মধ্যে যে সূক্ষ্ম ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা কার্যকর রয়েছে সেই একই ব্যবস্থাপনা আসমান, এর অগণিত তারকারাজি এবং সীমাহীন বিশালতার মধ্যেও কার্যকর রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
মহান কল্যাণময় সেই সত্তা যিনি আকাশমণ্ডলে বুর্জসমূহ স্থাপন করেছেন এবং তাতে একটি প্রদীপ ও একটি আলোকমণ্ডিত চাঁদ সংস্থাপন করেছেন। তিনিই রাত ও দিনকে পরস্পরের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। যে ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করতে চায় অথবা কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চায় –তার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। -সূরা ফুরকানঃ ৬১-৬২
(আরবী************************************************************************************)
তিনিই তো আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে অনুগত ও নিয়ন্ত্রিত বানিয়েছেন –যেন তাঁর নির্দেশে এর বুকে নৌকা জাহাজ চলাচল করতে পারে এবং তোমরা তাঁর অনুগ্রহের অনুসন্ধান করতে পার এবং আশা করা যায় তোমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনি আসমান ও যমীনের যাবতীয় জিনিস তোমাদের জন্য অধীন ও নিয়ন্ত্রিত করেছেন। সব কিছুই তাঁর নিজের কাছ থেকে। এর মধ্যে চিন্তাশীল লোকদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে। -সূরা জাসিয়াঃ ১২-১৩
কুরআন শরীফে এ ধরনের বহু আয়াত রয়েছে।
তিন. তোমরা কি এই দ্রুতগতিসম্পন্ন তারকাগুলোর দিকে লক্ষ্য করেছ, যেগুলো এ বিশাল মহাশূন্যের মাঝে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিব্রমণ করে বেড়াচ্ছে? শুধু কি তাই? এগুলো সব সময় সমান গতিতে আবর্তন করছে। তার গতিমাত্রায় কখনো হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। উপরন্তু এগুলো প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেখা যায়। কখনো নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে দেখা যায় না।
খেলার মাঠে খেলোয়াড় যখন বলকে লাথি মারে তা দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকে। পুনরায় তা নাচতে নাচতে চলে আসে। কিন্তু এই বিশাল আকারের তারকা-নক্ষত্রগুলো যার মধ্যে রয়েছে গতি, নীরবতা, আলো, অন্ধকার –তা মহাশূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। তা কখনো তো নীচে পড়ে যায় না? অবিরত ঘূর্ণায়মান, কখনো কোথাও থামছে না। তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে এক বিন্দুও দূরে সরে যায় না। অথচ যমীনের বুকে বিচরণকারী মানুষ চাই তারা পায়ে হেঁটে চলুক অথবা যানবাহনে চলুক –একের সাথে অপরের সংঘর্ষ লেগে যায়। অথচ তাদের বুদ্ধি-বিবেক রয়েছে, দৃষ্টিশক্তি রয়েছে। কিন্তু এই যে গ্রহ-নক্ষত্রের দ্বারা মহাশূন্য পরিপূর্ণ হয়ে আছে –এদের মধ্যে তো কখনো সংঘর্ষ বাধে না বা এরা তো কখনো বিপথগামী হয় না। অথব এদেরকে তো মানুষের মত বুদ্ধি-বিবেক দেওয়া হয়নি। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী************************************************************************)
আর সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে। মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহ এটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আর চাঁদের জন্যও আমরা কতগুলো মঞ্জিল নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। তা এই নির্দিষ্ট কক্ষপথসমূহে পরিভ্রমণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত খেজুর গাছের শুকনো শাখার মত হয়ে যায়। চাঁদকে ধরে ফেলার ক্ষমতা সূর্যের নেই, আর রাতও দিনকে অতিক্রম করে অগ্রসর হয়ে যেতে পারে না। সবকিছুই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে। -সূরা ইয়াসীনঃ ৩৮-৪০
কে এই বিশাল ও সীমাহীন রাজ্যের কর্ণধার? কোন সে মহান সত্তা এই সুশৃঙ্খল ও অত্যাশ্চর্য নিয়মের তত্ত্বাবধান করছেন? কে এই বিশাল আয়তনের গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর কার নির্দেশেইবা এগুলো দ্রুতগতিতে মহাশূন্য পরিক্রম করছে? নিঃসন্দেহে এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা মহান আল্লাহর অসীম কুদরতেরই বহিঃপ্রকাশ। এই সব গ্রহ-নক্ষত্র তাঁর দেওয়া বাহুর সাহায্যেই উড়ে বেড়াচ্ছে। মহান স্রষ্টার বাণীঃ
(আরবী**********************************************************************)
প্রকৃত কথা এই যে, আল্লাহ তাআলাই আসমান যমীনকে ধারণ করে আছেন। তাই এগুলো স্থানচ্যুত হতে পারছে না। যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে তাহলে এগুলোকে ধরে রাখার সাধ্য আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। নিঃসন্দেহে তিনি বড়ই ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল।
-সূরা ফাতিরঃ ৪১
এখন বাকি থাকল আকর্ষণ-বিকর্ষণ সম্পর্কিত বিধি-বিধান! বিজ্ঞান এর যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে তা অস্পষ্ট। জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেকের সাথে এই ব্যাখ্যার কোন সম্পর্ক নেই; নিঃসন্দেহে এই বিধান প্রকৃতির এক বিরাট নিদর্শন যা মহান আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু এই কানে খাটো লোকদের একথা কে শুনাবে!
চার. একথা নিঃসন্দেহ যে, আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্ব লাভের একটি সূচনাবিন্দু রয়েছে। তা আমরা সবাই জানি। আমরা জন্মের পূর্বে কিছুই ছিলাম না। আমাদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। আমরা কোন উল্লেখযোগ্য বস্তুই ছিলাম না। মহান স্রস্টার বাণীঃ
(আরবী*******************************************************************)
মানুষের ওপর কি সীমাহীন কালের একটা সময় এমনও অতিবাহিত হয়েছে –যখন তারা উল্লেখযোগ্য কোন জিনিসই ছিল না?
-সূরা দাহরঃ ১
আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করছি তার উপাদানগুলোরও এই একই অবস্থা। এরও একটি সূচনাকাল রয়েছে। ভূ-তত্ত্ববিদগণ (Geologist) এগুলোর একটি অনুমিত সূচনাকাল নির্ধারণ করে থাকেন। সে সময়টা যত দীর্ঘই হোক না কেন, এর পূর্বে ঐ উপাদানের কোন অস্তিত্বই ছিল না।
পূর্বে ধারণা করা হত জড় পদার্থের কোন ক্ষয় নেই। এর ভিত্তিতে একদল লোক দাবি করে বসল –এই দুনিয়া চিরস্থায়ী। অতঃপর এই অনুমিত ধারণার ওপর তারা অনেক ভিত্তিহীন কথার ইমারত গড়েছে। কিন্তু অণুর বিস্ফোরণ সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে কল্পনার এই প্রাসাদ ধ্বসে পড়েছে। যদি অণুর বিস্ফোরণ নাও হত তাহলেও আমরা এই কাল্পনিক দাবি সমর্থন করতাম না। কেননা মহাবিশ্বের ধ্বংস যে দরজা দিয়ে আসবে তার চাবি আল্লাহ তাআলা কখনো বিজ্ঞানীদের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন না।
যে জিনিস পৃথিবীর উপাদানগুলো ধ্বংস হওয়ার কারণ হবে –লোকেরা যদি তা চিনতে না পারে বা আবিস্কার করতে না পারে তবে তার অর্থ এই নয় যে, পৃথিবীর উপাদানসমূহ কখনো ধ্বংস হতে পারে না। এও তো হতে পারে যে, মহাবিশ্বের নিরাপত্তার খাতিরে মহান আল্লাহ এর ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দিয়েছেন। কেননা এই ধ্বংসাত্মক অস্ত্র মানুষের হাতে পড়ে গেলে তারা নিজের হাতেই আত্মহত্যা করে বসবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, আমাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অভিনব। কেননা আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও অনুভূতি আমাদেরকে এই হিদায়াতই দান করে। যে জিনিসের পূর্বে কোন অস্তিত্ব ছির না, তা সরাসরি এবং স্বয়ং অস্তিত্ব লাভ করতে পারে –এ ধরনের বক্তব্য বুদ্ধি-বিবেকের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কোন একটি নতুন জিনিস তৈরি হল। কিন্তু জানা গেল না যে, এর প্রস্তুতকারক কে? –এক্ষেত্রে বলা হয় যে, এর প্রস্তুতকারক অজ্ঞাত। কেউ একথা বলে না যে, এর কোন প্রস্তুতকারক নেই। তাহলে বলা যায়, এই মহাবিশ্বের কোন স্রষ্টা নেই –একতা কেমন করে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে দাবি করা যেতে পারে? আমাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না, পরে আমরা অস্তিত্ব লাভ করেছি। পরিশেষে কে আমাদেরকে এই অস্তিত্ব দান করল?
(আরবী**************************************************************************************)
বলে দাও –আল্লাহ! অতঃপর তাদেরকে তাদের যুক্তিবাদের খেলায় মত্ত হওয়ার জন্য ছেড়ে দাও। -সূরা আনআমঃ ৯১
মহাবিশ্বের সৃষ্টি কি আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল
আমাদের জীবন ও দেহের ক্রমোন্নতি এবং এর স্থিতি এমন সব জটিল নিয়ম-কানুনের ওপর নির্ভরশীল, যেগুলো আকস্মিকভাবে হয়ে যাওয়াটা বুদ্ধি-বিবেকের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যেমন সূর্যের সম্মুখভাবে পৃথিবী নামক এই গ্রহের অবস্থান ….এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে অবস্থান। যদি এই দূরত্ব কম হয়ে যায় এবং পৃথিবী সূর্যের কিছুটা কাছে এসে যায় তাহলে জীবজন্তু গাছপালা ইত্যাদি সমস্ত জীবন্ত প্রাণী জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। যমীনের বুকে কোন কিছুই আর বেঁচে থাকত না।
পক্ষান্তরে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝকানে দূরত্ব যদি নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি হয়ে যেত তাহলে সমস্ত পৃথিবী বরফে ঢেকে যেত। কোথাও সবুজ শ্যামলতা এবং জীবন বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকত না। সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে ঠিক এতটুকু দূরত্ব বজায় রয়েছে যে, তার ফলে প্রয়োজন মাফিক গরমও লাভ করা যাচ্ছে, আলোও পাওয়া যাচ্ছে এবং কোন ক্ষতিও হচ্ছে না। তোমাদের কি মত, এটা কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে গেছে, না কোন দুর্ঘটনার ফল?
তারর চাঁদের যে এই হ্রাস-বৃদ্ধি! এটা কি সম্ভব ছিল না যে, চাঁদ পৃথিবীর আরো কাছে এসে সাতসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালাকে আকর্ষণ করে সমগ্র ভূভাগ পানিতে ভাসিয়ে দেবে? পানি যখন সরে যাবে তখন দেকা যাবে জীবজন্তু আর প্রাণী বলতে কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাহলে কোন সে মহাবিজ্ঞানী চাঁদকে একটা উপযুক্ত পরিমাণ দূরত্বে স্থাপন করেছেন, ফলে তা থেকে আলোও পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু কোন ক্ষতিও হচ্ছে না?
আমরা এই যমীনের বুকে অক্সিজেনের সাহায্যে শ্বাস গ্রহণ করি। অক্সিজেন ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকাটা মোটেই সম্ভব নয়। আহার গ্রহণ করার ফলে আমাদের দেহের অভ্যন্তরে যে কার্বনের সৃষ্টি হচ্ছে আমরা নিশ্বাস ছাড়ার মাধ্যমে তা বাইরে বের করে দেই।
অসংখ্য জীব-জন্তুর শ্বাস গ্রহণ করার ফরে বাতাসের এই মহামূল্যবান উপাদানটি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া কোন অসম্ভব ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তা হয় নি। অহরহ আমাদের অক্সিজেন গ্রহণ করার ফলে কখনো বাতাসে এই অমূল্য উপাদানটির ঘাটতি দেখা দেবে না।
কুদরাতের কি অসীম লীলা! গাছপালা-তরুলতা মানুসের জন্য ক্ষতিকর কার্বনগুলো শোষণ করে ফেলে এবং তাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নির্গত করে। এই আশ্চর্যজনক বিনিময়ের ফলে বাতাসের এই আচ্ছাদনের মধ্যে ভারসাম্য বিরাজ করছে। বাতাসের এই মনোরম পরিবেশে গাছপালা ও জীবজন্তুগুলো বেঁচে রয়েছে। তুমি কি মনে কর এই সুসমঞ্জস পরিবেশ আপনা-আপনিই তৈরি হয়েছে? কখনো কখনো এরূপও হয় যে, আম একটি ফুল দেখছি। ফুলটিতে দশটি রঙের নিপুণ শিল্পকর্ম খচিত হয়েছে। আমার অগোচরে ফুলটিকে আমার হাত স্পর্শ করল। অথচ হাজারো ফুল সেই বাগানে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আমি আমার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলাম –কোন শিল্পীর কলম এই রঙগুলোর মধ্যে এত সুন্দরভাবে সামঞ্জস্য বিধান করেছে? একটিমাত্র রঙ নয়; বরং অসংখ্য রঙের মাঝে এক চিত্তাকর্ষক ও যাদুকরী সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। কোন কোন জায়গায় হালকা রঙ আবার কোন কোন জায়গায় রয়েছে গাঢ় রঙের প্রলেপ। কোথাও রয়েছে ডোরাকাটা আবার কোন জায়গায় আঁকাবাঁকা রেখাচিহ্ন।
পুনরায় আমি আমার দৃষ্টি নিচের দিকে একেবারে ধূলো মাটির ওপর নামিয়ে নিলাম। এই মাটি থেকেই তো এই রঙের ছড়াছড়ি! সত্যিই কি এটা মাটির রঙ-বেরঙের খেলা? রঙের এই বিচ্ছুরণ কি এই মাটিরই চমৎকারিত্ব? তাহলে মাটির মধ্যে এসব রঙ কোথায় লুকিয়ে আছে? এটাও কি তাহলে একটা দুর্ঘটনা? না দুর্ঘটনার তেলেছমাতি কারবার? পরিশেষে এটা কি ধরনের দুর্ঘটনা? যে ব্যক্তি এই দুর্ঘটনার দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু চিন্তা করে সে বড়ই বোকা এবং স্থূল বুদ্ধিসম্পন্ন……। ফুলের এই রঙের খেলা কুতরাতের এক সামান্য প্রকাশ মাত্র। অন্যথায় এই ঘটনাবহুল জীবনের সাথে এই নগণ্য একটি ফুলের কতটুকু সম্পর্ক রয়েছে?
মহাশুন্যের মাঝে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি গ্রহের বুকে জীবনের এই ঢেউখেলা একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনার দাবি রেখে। আমরা যদি ধারণা করে বসি যে, কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়াই ক্ষুদ্র একটি পোকার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং এর পরিপাক যন্ত্র ও সূক্ষ্ম কোষগুলো সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে এটা হবে অবিবেচনাসুলভ এবং গায়ের জোরের কথা। তুমি কি মনে কর, এই সুন্দর ও সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষ কি নিজে নিজেই স্বয়ং সৃষ্টি হতে পেরেছে? তুমি কি বলতে পার, এই বিশাল পৃথিবী স্বয়ং সৃষ্টি হয়ে গেছে?
আমার কাছে এটা কিভাবে আশা করা যেতে পারে যে, আমি যখন উত্তমরূপে সেলাই করা একটি কাপড় দেখতে পাই তখন ধরে নেব যে, সুঁই-এর নাকের মধ্যে সুতাটি আপনা-আপনিই ঢুকে যেতে পেরেছে? অতঃপর কাপড় সেলাই করে চলছে এবং নিজের শক্তিবল ওপরে নিচে উঠানামা করছে? সেলাই মেশিনটি নিজ প্রচেষ্টায় জামার বুক, হাতা, কলার, আচল তৈরি করে ফেলেছে? অবশেষে এটা আমাদেরকে একটি সুন্দর জামা উপহার দিয়েছে? মেশিনের পিছনে একজন কারিগরের নিখুঁত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া কি এ কাজ সম্ভব?
এসব কিছুকে দুর্ঘটনার ফল বলে চালিয়ে দেওয়া বিজ্ঞানের একটি বড় ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। কোন সুষ্ঠু বুদ্ধিসম্পন্ন হুঁশিয়ার লোক একথা কখনো মেনে নিতে পারে না।
ধরা যাক, কোন অফিসে একটি টাইপরাইটার মেশিন রয়েছে। এর কাছেই কাগজের একটি পাতা রয়েছে। এর উপর উমর (আরবী********) নামটি লেখা রয়েছে। এর তাৎপর্য কি? দুটো জিনিস হতে পারে। এর মধ্যে বিবেকের কাছাকাছি কথা হচ্ছে –কোন সাঁটলিপিকার এই নামটা কাগজে মুদ্রণ করেছে। দ্বিতীয়ত বলা যেতে পারে যে, এই নামের মধ্যকার অক্ষরগুলো আপনা-আপনি কাগজের ওপর ক্রমানুযায়ী মুদ্রিত হয়ে গেছে। যদি এই শেষোক্ত কথা মেনে নেওয়া হয় তাহলে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর যে ব্যাখ্যা হতে পারে তা হচ্ছেঃ অচেতন অবস্থায় উদ্দেশ্যহীনভাবে আপনা-আপনি কাগজের ওপর আইন (আরবী*********) অক্ষরটি মুদ্রিত হওয়া এবং অন্যান্য অক্ষর যদি বাড় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ২৮ বারের অধিক নয়। কেননা আরবী বর্ণমালার মোট ২৮টি অক্ষর রয়েছে।
আইন এবং মীম অক্ষর দুটি একসাথে মুদ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বার। যদি তিনটি অক্ষর সম্পর্কেই ধরে নেওয়া হয় যে, এগুলো নিজে নিজেই মুদ্রিত হয়েছে, তাহলে এর সম্ভাবনা রয়েছে বার। অন্যান্য অক্ষরের মধ্যে এর সম্ভাবনা রয়েছে আবার। যে ব্যক্তি একটি যুক্তিসঙ্গত ও সুনিশ্চিত কাঠামো পরিত্যাগ করে এমন একটি কাঠামো অনুমান করে নেয়, যা বিশ হাজার বারে মাত্র একবার ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে –চিন্তার জগতে তার মত অবিবেকী এবং স্থলবুদ্ধিসম্পন্ন আর কেউ নেই। অথৈ সমুদ্রের এক ফোঁটা পানি অথবা সুবিশাল মরুভূমির একটি বালুকণা ঘটনাক্রমে সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার চাইতে কাগজের ওপর একটি নাম লিখিত হয়ে যাওয়া অধিক যুক্তিসংগত। নাস্তিক্যবাদীদের এই কল্পনার সাথে বুদ্ধি-বিবেকের কোন সম্পর্ক নেই। তাদের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে প্রভুত্বের ধারণা
প্রতিটি জিনিসের স্বভাবের মধ্যে আল্লাহ তাআলার পরিচয় বর্তমান রয়েছে। প্রতিটি ভাষার এই প্রিয় নামটি সুপরিচিত। ভাষাগত এবং জাতিগত পার্থক্য এর চিরন্তন সত্তা সম্পর্কে চিন্তার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। এই মহান ও একক সত্তা সম্পর্কে সব জাতির মধ্যেই আবহমানকাল থেকে একটা ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য মানুষ যখন ওহীর সত্তা সম্পর্কে সব জাতির মধ্যেই আবহমানকাল থেকে একটা ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য মানুষ যখন ওহীর উৎস থেকে মহাবিশ্বের প্রতিপালক সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে তখনই তার সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পেরেছে এবং তাদের চিন্তায় ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়েছে। তারা যখন নবীদের ভাষায় তাঁর পরিচয় জানতে পেরেছে তখনই তারা অলিক চিন্তা-ভাবনা, কুসংস্কার ও কুপ্রবৃত্তি থেকে পবিত্র থাকতে পেরেছে।
কিন্তু যেসব লোক পূর্ববর্তী নবীদের যুগ পায়নি অথবা যাদের কাছে কুরআনের পথনির্দেশ পৌঁছেনি তারাও নিজস্বভাবে আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা থেকে অলস থাকেনি। তাদের বিবেক-বুদ্ধি সব সময়ই এ সম্পর্কে আলোচনা ও অনুসন্ধানের মনযিলসমূহ অতিক্রম করতে থাকে।
আল্লাহ সম্পর্কিত দর্শন এ ধরনের আলোচনায় পরিপূর্ণ। স্বয়ং এই বিশ শতকের শেষ ভাগের বিজ্ঞানীগণ বিশ্বপ্রকৃতি, এর রহস্য ও বিধি-বিধান সম্পর্কে একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের পর আল্লাহ সম্পর্কে যে সত্য পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন তা তাঁরা অবিরতভাবে ব্যক্ত করছেন। প্রাচীন দর্শন আল্লাহ তাআলাকে বিশ্বস্রষ্টা, জ্ঞানের আদি উৎস, আবশ্যিক সত্তা, সমস্ত কারণের আদি কারণ ইত্যাদি নামের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে থাকে।
বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা আল্লাহ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তার মধ্যে হক-বাতিলের সংমিশ্রণ রয়েছে। এর বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে। এর কারণ হচ্ছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের ময়দানে নেমে পড়েছে –কিন্তু তার হাতে আসমানী পথনির্দেশের আলোকবর্তিকা নেই। অনুরূপভাবে বুদ্ধিবিবেক আল্লাহকে স্বীকার করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে –কিন্তু তাঁর সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, নিষ্কলুষ পর্যালোচনা ও সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত অনুসন্ধান সঠিক পথ ধরে অগ্রসর হলে তা মানুষকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় এবং সামনে অগ্রসর করে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্বের সামনে তার মাথা নত করে দেয়।
নির্বোধ লোকেরাই এরূপ ধারণা করতে পারে যে, ঈমান হচ্ছে বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার ফল। বিজ্ঞানের অনুসন্ধান ও মানবীয় জ্ঞান যতই ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে ঈমানের ভিত্তিসমূহ ততই নড়বড়ে হয়ে যায় এবং আল্লহার সাথে সম্পর্কও ততই দুর্বল হয়ে পড়ে। যেসব লোক এ ধরনের কথা বলে তারা নিজেদের জ্হানের দেউলিয়াত্ব, বুদ্ধির দৈন্যতা ও প্রতিভার অধঃপতনেরই ঘোষণা দেয়। এটা তাঁদের ভোঁতা ও স্থূল বুদ্ধির পরিচয় বহন করে।
অষ্টাদশ শতকের সুবিখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক স্যার উইলিয়াম হারসল (Sir William Hershel)-[হারসেল নিজেই একজন ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনিই ইউরেনাস গ্রহ আবিস্কার করেন (১৭৮১)। টেলিসকোপও তিনিই আবিস্কার করেন। তিনি সঙ্গীতেরও উস্তাদ ছিলেন। ১৭৩৮ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত ছির তাঁর যুগ।-অনুবাদক] বলেনঃ “জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি যতই বিস্তৃত হচ্ছে –এক মহাবিজ্ঞানী, বিচক্ষণ ও সর্বশক্তিমান সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে পরিস্কার যুক্তি-প্রমাণের স্তূপ গড়ে উঠেছে। ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং অংকশাস্ত্র বিশেষজ্ঞগণ নিজেদের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এমন সব তথ্য উদঘাটন করেছেন, যা এমন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কায়েমের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত শাখা আল্লাহ তাআলার হুকুমের অধীনে কাজ করবে”।
প্লেটো তাঁর শিক্ষক সক্রেটিসের যে চিন্তাধারার উল্লেখ করেছেন তার ওপর একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুনঃ “এই পৃথিবী আমাদের সামনে এমনভাবে আত্মপ্রকাশ করছে যে, তার কোন নিজিসই আকস্মিক দুর্ঘটনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এর প্রতিটি অংশ একটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং এই লক্ষ্য তার চেয়ে উচ্চতর লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলছে। এভাবে এই দুনিয়াও সামনে অগ্রসর হতে থাকবে। অবশেষে তা সেই সর্বশেষ লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছবে যিনি এক এবং অদ্বিতীয়”।
মহাবিশ্বের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এই সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা কিভাবে স্তাপিত হয়? এটাকে আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল বলে চালিয়ে দেওয়া কোক্রমেই সম্ভব নয়। যদি তাই হয়ে থাকে যে, এসব কিছু আপনা-আপনি হয়ে গেছে তাহলে এরূপ বলাতেও কোন দোষ নেই যে, নদীর বুকে ভাসমান নৌকার তক্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি এই দুনিয়ার উপায়-উপাদান এত অসংখ্য যে, মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি তা হিসাব করে শেষ করতে পারবে না। এর সবকিছুই আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করেছে –এরূপ ধারণা করা যেতে পারে না। অতএব এক মহাবিজ্ঞানীর অস্তিত্ব মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। তিনি হলেন সেই মহান ও একক কারিগর আল্লাহ।
এই প্রকৃতির সর্বত্র সেই মহান ও একক কারিগরের নিদর্শন বিরাজ করছে। চিন্তা করার সাথে সাথে তাঁর সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যায়। এর মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার কোন অবকাশ নেই। “তিনি সর্বত্র বিরাজিত এবং বিজয়ী শক্তি হিসেবে ভাস্বর। অর্থাৎ তিনি সর্ববিষয়ে অবগত এবং সবকিছুর ওপরই ক্ষমতাবান। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাঁকে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তাঁর দৃষ্টান্ত সূর্যের মত যা সমস্ত দৃষ্টিশক্তিকে স্পর্শ করে। কিন্তু সূর্য নিজেকে দেখার অধিকার কাউকে দেয় না”।
-তারীখুত-তাসাওউফ, শায়খ মুহাম্মদ আলী আইনী বেগ
অনুরূপভাবে ল্যাপ্লেসও (Laplace)-[ল্যাপ্লেস (Laplace. Pierre Simon, Marquis de) ফরাসি অংকশাস্ত্রবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অংকের অধ্যাপক ছিলেন। তার জীবনকাল ১৭৪৯-১৮২৭।-অনুবাদক] মহাবিশ্বের গতি সম্পর্কিত দলিল প্রমাণগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন –নাস্তিকের পক্ষ থেকে যেসব সন্দেহ সংশয় প্রকাশ করা হয় –এসব প্রমাণের মাধ্যমে তার ভিত্তিমূল কিভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তিনি বলেনঃ
“সৌর জগতে যতগুলো গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে প্রকৃতির লুক্কায়িত মহাশক্তিমান সত্তা এর সবগুলোর আয়তন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, এর কক্ষপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি এগুলোকে ঘূর্ণনের ক্ষেত্রে সহজ-সরল কিন্তু অত্যন্ত বিচক্ষণ নিয়ম-কানুনের অনুগত করে দিয়েছেন। তিনি সূর্যের চারদিকে গ্রহ-নক্ষত্রের পরিভ্রমণের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। আবার এসব গ্রহের চারপাশে উপগ্রহগুলোর আবর্তনের জন্যও এক অতীব সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করেছেন। এই ব্যবস্থার মধ্যে কখনো কোন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় না এবং যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা হবে –এভাবেই এই ব্যবস্থাপনা চলতে থাকবে…..”।
এই সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনা এমন সূক্ষ্ম গাণিতিক হিসাবমতে চলছে যে, মানবীয় জ্ঞান তা বুঝতে অক্ষম। হাজারো, লাখো দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই নির্ভূল ব্যবস্থাপনা এভাবেই চলতে থাকবে। ল্যাপ্লেসেরে মতে, এটাকে কোনক্রমেই আকস্মিক দুর্ঘটনার চমৎকারিত্ব বলা যায় না। যদি কেউ এটাকে দুর্ঘটনার ফল বলতেই চায় তবে এর সম্ভাবনা চার ট্রিলিয়নে (Trillion) মাত্র একবার। চার ট্রিলিয়ন (৪,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০) কি সে সম্পর্কে তোমার কি কোন ধারণা আছে। এটা তো মাত্র দুটি শব্দের সমন্বয়ে একটি সংখ্যা। কিন্তু কেউ যদি তা গণতা করতে চায় তবে তার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। তাকে পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে সারা দিন-রাত অবিরতভাবে গুণে যেতে হবে এবং প্রতি মিনিটে তাকে ১৫০টি সংখ্যা গণনা করতে হবে। অতঃপর সে চার ট্রিলিয়নে পৌঁছতে পারবে।
স্পেনসার (Spencer)-[স্পেনসার (Spencer, Herbert, 1820-1903) বৃটিশ দার্শনিক। তিনি মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের ওপর বই লেখেন।-অনুবাদক] বলেন, “আমরা এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে, এই মহাবিশ্ব আমাদেরকে এমন এক মহাশক্তিমান সত্তার সন্ধান দেয় যাঁকে অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগুলোই সর্বপ্রথম এই সর্বশক্তিমান সত্তাকে মেনে নেয় এবং মানব জাতিকে তাঁর সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। কিন্তু প্রথম দিকে এই ধারণার সাথে অলিক কল্প-কাহিনী মিশ্রিত ছিল”। এই স্পেনসার কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন না।
মূলকথা হচ্ছে সুস্থ বুদ্ধি মহাসত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিত হয়ে যায় অনুসন্ধান ও গবেষণার ক্ষেত্র যতই বিস্তৃত হচ্ছে বুদ্ধি-বিবেকের একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিত হওয়া ততই সহজ হচ্ছে এবং এর সম্ভাবনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঊনিশ শতকের শেষভাগে এসে একদল বিজ্ঞানী যখন বস্তুবাদের পরাজয়ের সাথে সাক্ষাত হল তখন সমস্ত বিজ্ঞানী মহাসত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিত হন। আজ প্রায় সব প্রখ্যাত বিজ্ঞানীই এ ব্যাপারে একমত যে, যেসব প্রাকৃতিক বিধানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনের পরিপুষ্টি ও পরিবৃদ্ধি হচ্ছে তা সবই আমাদের বলে দিচ্ছে যে, এখানে এক মহা শক্তিশালী সত্তার ইচ্ছা, কৌশল, তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনা ক্রিয়াশীল রয়েছে। চিন্তাশীল সুষ্ঠু বুদ্ধি-বিবেকের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া মোটেই সম্ভব নয় যে, জীবনের সূচনা, এর স্থিতি এবং উন্নতি একটা অন্ধ দুর্ঘটনার ফল।
প্রখ্যাত ইংরেজ বিজ্ঞানী কেলভিন (Kelvin)-[Kelvin William Thomson, Lord (1824-1907) প্রখ্যাত ইংরেজ পদার্থ বিজ্ঞানী।-অনুবাদক] অকপটভাবে জনসমক্ষে এই সত্যের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন। যেসব লোক এই রহস্যময় জগতকে দুর্ঘটনার ফল মনে করে –তিনি তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছেন যে, মহাবিশ্বের সুদৃঢ় ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্যেই আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব এবং তাঁর একত্বের অকাট্য প্রমাণ বিরাজ করছে। তিনি বলেন, “একজন স্রষ্টা ও পরিবেষ্টনকারীর অস্তিত্ব মেনে নেওয়া ছাড়া মানুষের পক্ষে এখানে জীবনের সূচনা ও এর টিকে থাকাটা কল্পনাও করা যায় না। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, কতিপয় বিজ্ঞানী জীব সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই অকাট্য প্রাণসমূহ স্বেচ্চায় এবং সজ্ঞানে উপেক্ষা করছেন। আমাদের চারপাশে হাজারো অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত রয়েছে যা এক মহাশক্তিশালী ও কুশলী ব্যবস্থাপকের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। প্রকৃতির মাঝে বর্তমান এসব দলিল আমাদেরকে এক স্বাধীন সার্বভৌম সত্তার সন্ধান দেয়। এই প্রমাণগুলো আমাদের বলে দিচ্ছে –প্রতিটি জীবই এক, অদ্বিতীয় এবং চিরস্থায়ী মহান স্রষ্টার সৃষ্টি”।
কেলভিনের পরে আসছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। তিনি বলেন, “ধর্মীয় জ্ঞানের দাবি হচ্ছে সেই মহান সত্তা, যাঁর সম্পর্কে আমাদের জানার কোন উপায় নেই –তিনি নিশ্চিতই আপন সত্তায় বিরাজমান এবং তিনিই একমাত্র চিরন্তন সত্তা। তিনি তাঁর কর্মকৌশলের নির্দশনাবলী এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত আলোকমালার অন্তরালে সদা প্রতীয়মান। আমি এমন একজন সত্যপন্থী বিজ্ঞানীর কল্পনাও করতে পারি না যিনি একথা জানেন না যে, এই মহাবিশ্বের সুন্দর ও সুশৃঙ্খল নিয়ম-কানুন এমন নিপুণ কৌশলের ওপর ভিত্তিশীল যা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। যে জ্ঞানের সাথে ঈমানের যোগসূত্র নেই তা হচ্ছে একটি খোঁড়া লোকসদৃশ, যে পা হেঁচড়িয়ে হেঁচড়িয়ে চলে। আর যে ঈমানের সাথে জ্ঞানের যোগসূত্র নেই তা হচ্ছে একটি অন্ধ লোকসদৃশ, যে অন্ধকারে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে অগ্রসর হয়”।
চিন্তা করে দেখুন! কুরআন পাকের এই ঘোষণা কত নির্ভুল এবং বাস্তবসম্মতঃ
(আরবী******************************************************************)
প্রকৃত কথা হচ্ছে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানবান লোকেরাই তাঁকে ভয় করে। -সূরা ফাতিরঃ ২৮
এমনও কতিপয় লোক রয়েছে যারা আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে সত্য কিন্তু তারা অনেক ভুল ধারণার শিকার হয়ে যাচ্ছে। কামিল ফলাম্মারিয়ন (Camille Flammarion) তাঁর ‘প্রকৃতির মাঝে আল্লাহ’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ
“আমরা যখন এই দৃশ্যমান জগত পেরিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে পা রাখি তখন আমরা দেখতে পাই মহান আল্লাহ হচ্ছেন এক চিরন্তন সত্তা, যিনি প্রতিটি জিনিসের মাঝে সদা বিরাজমান। তিনি কোন বাদশা নন যে, আসমানী জগতে অবস্থান করে রাজত্ব করছেন। তিনি এমনই এক রহস্যময় ব্যবস্থা যা সমগ্র সৃষ্টি জগতকে পরিবেষ্টন করে আছে। তিনি পূণ্যবান মানুষ ও ফেরেশতাদের বেহেশতে বসবাস করেন না, বরং সত্য কথা এই যে, এই সীশাহীন মহাবিশ্বের একবিন্দু স্থানও তাঁর উপস্থিতি থেকে খালি নয়। অর্থাৎ তিনি সর্বত্রই বিরাজমান। মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশে এবং মহাকালের প্রতিটি মুহুর্তেই তিনি বর্তমান। অধিকতর সত্য কথা এই যে, তিনি হচ্ছেন চিরস্থায়ী ও অনন্ত সত্তা। তিনি স্থান ও কালের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র”।
আমরা এ বক্তব্য কোন অধিভৌতিক ধারণা বিশ্বাস নয়, যার সত্য হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। বরং এ হচ্ছে চূড়ান্ত সত্য কথা যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিবিড় ভিত্তিসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন গতি আপেক্ষিক হওয়া এবং প্রাকৃতিক বিধান আদিম ও চিরন্তন হওয়া। প্রকৃতির ওপর প্রভুত্বকারী বিশ্বজনীন ব্যবস্থা সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান। হিকমত ও কৌশলের নিদর্শনসমূহ –যেমন ভোরের আলো এবং সকাল-সন্ধ্যায় দিকচক্রবালে উদ্ভাসিত লালিমা, বিশেষ করে প্রতিনিয়ত আবর্তন-বিবর্তনের নিয়ম-কানুনের মধ্যে যে ঐক্য বিদ্যমান রয়েছে –তা সবই মহান আল্লাহর সার্বভৌম শক্তির সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাঁর অদৃশ্য হাতই এই মহাবিশ্বের সংরক্ষক। তিনিই এর প্রকৃত ব্যবস্থাপক। তিনিই সমস্ত প্রাকৃতিক বিধানের প্রাণকেন্দ্র। তিনিই প্রকৃতির এই নিদর্শনসমূহের উৎস”।
কামিল ফলাম্মারিয়ন একজন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক। তিনি ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসলামের সাথেও তিনি মোটেই পরিচিত নন। কিন্তু তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলনে এবং বিশ্বপ্রকৃতির পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এক ও অদ্বিতীয় মহান সত্তা আল্লাহকে চিনতে পেরেছেন। এ ধরনের অনেক লোকই পাওয়া যাবে। ইলাহ সম্পর্কে এই বিজ্ঞানীর যে মত ব্যক্ত হয়েছে তাতে সর্বেশ্বরবাদের (ওয়াহদাতুল অজুদ) দর্শন প্রকাশ পেয়েছে।
এটা এমন এক দর্শন, যা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। একদল প্রাচীন হিন্দু দার্শনিকও এই সর্বেশ্বরবাদী দর্শনের প্রবক্তা। এমনকি মুসলমানদের তাসাওউফ শাস্ত্রও এ ভ্রান্ত মতবাদ থেকে বিরত থাকতে পারেনি। ফলে তা সত্যের রাজপথ ও ইসলামের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে।
এসব বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের চিন্তাধারা যদি ওহীর শিক্ষা থেকে আলোক প্রাপ্ত হত এবং ইসলামী শরীআতের নির্দেশিত পথে পরিচালিত হত, তাহলে কুরআন আল্লাহ তাআলার যে গুণাবলী ও মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছে –তাদের চিন্তাধারাও এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হত। এটাইবা কম কি –যদিও তারা সত্যের সাথে পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচিত হতে পারেননি তবুও তাঁদের নযরে হালকাভাবে হলেও যতটুকু সত্য ধরা পড়েছে তা তাঁরা অস্বীকার করেননি, বরং খোলা মনে অকপটে স্বীকার করেছেন। তাঁরা যে সত্যে উপনীত হতে পেরেছেন যদি তাঁরা তা বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, -যদি তাঁদের জন্য সত্যে পৌঁছার যাবথীয় উপায়-উপকরণ সহজলভ্য হত, যদি তাঁরা আল্লাহর বাণীর (ওহী) সাথে পরিচিত হতেন অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে প্রকৃত ইসলামের সাথে পরিচিত হতে পারতেন তাহলেত তাঁরা পূর্ণ ঈমানদার হয়ে যেতেন।
এরই পাশাপাশি মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু যদিও ইলাহ সম্পর্কিত ধারণার পোষকতা করে, বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে এমন অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে যা রাব্বুল আলামীনের দিকে পথ প্রদর্শন করে কিন্তু তা সত্ত্বেও মহাসত্যকে প্রত্যাখ্যানকারী এবং আল্লহার সামনে অবনত হতে অনিচ্ছুক লোকদের থেকে ধরাপৃষ্ঠ কখনো খালি থাকেনি। আমরা এ ধরনের লোকদের যাবতীয় যুক্তি-প্রমাণের মূল্যায়ন করেছি। তাদের যুক্তির মধ্যে একগুঁয়েমি, হঠকারিতা ও বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই পাইনি।
অতীদের বস্তুবাদী বিজ্ঞানীদের অগ্রদূত ইউখানয বলেন, “মহাশূন্যে গ্রহ-নক্ষত্রের অস্তিত্ব, এর বিচরণ ও গতিশীলতাকে প্রকৃতির সহজ-সরল নিয়মের খেলা বলা যেতে পারে। এ অবস্থায় একজন শক্তিমান স্রষ্ঠার অস্তিত্বের ধারণা করা কোন অবকাশ থাকে না”। তিনি আরো বলেন, “মানুষ জড় পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। চিন্তার জগতে তার কোন বিশেষত্ব নেই –আধ্যাত্মবাদীরা যার দাবি করে থাকে”। তিনি আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তির বস্তুবাদী ব্যাখ্যা করে বলেন “যকৃৎ ও মূত্রাশয় থেকে এক প্রকার দৃশ্যমান পদার্থের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এটা কিভাবে গড়ে উঠে তা আমাদের জানা নেই। অপরদিকে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে চিন্তার যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তা আমাদের ইচ্ছা, সংকল্প ও অনুভূতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর মস্তিষ্ক থেকে শক্তির বিকাশ ঘটে, বাহ্যিক পদার্থের নয়”।
উউলিয়াম ব্রুস বুদ্ধি ও আত্মার এই বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সমর্থন করে বলেন, “পরিপাক শক্তির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা খাদ্যদ্রব্যকে যেভাবে মানুষের শিরা-উপশিরায় প্রবহমান রক্তে পরিণত করে দেয়, অনুরূপভাবে স্নায়ুবিক ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে অনুভূতি, বোধশক্তি, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা জাগ্রত করে দেয়”।
একটি চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধের এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ “চিন্তা হচ্ছে একটি যৌগিক। এটা ফরমিক এসিডের সাথে তুল্য। আর চিন্তাশক্তি ফসফরাসের অধীন। বদান্যতা, সত্যবাদিতা, বীরত্ব প্রভৃতি মানব দেহের অভ্যন্তরের বৈদ্যুতিক প্রবাহ ছাড়া আর কিছুই নয়”।
এই হচ্ছে মানবতা ও এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যের চিত্র, যা জড়বাদীরা পেশ করে থাকেন। তারা নিজেদের এই যুক্তির মাধ্যমে অতিবস্তুর অস্বীকৃতি এবং মহামহিম আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে অস্বীকার করেছেন। আমরা যদিও লৌকিকতার খাতিরে এর নাম দিয়েছি যুক্তি, অন্যথায় এই হাস্যস্পদ ও কুশ্রী বক্তব্যের অন্তরালে সত্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় কি? সংশয়, সন্দেহ, অনুমান ও ধারণা-কল্পনাকে কখনো বিবেচনাযোগ্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে একথা সর্বসম্মত যে, নাস্তি কখনো স্বেচ্ছায় অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না এবং তা কোন কিছুকে অস্তিত্বে রূপদান করতেও সক্ষম নয় অর্থাৎ নাস্তি কখনো স্রষ্টা হতে পারে না।
অতএব যখন বলা হয় এই মহাবিশ্ব অস্তিত্বের জন্য এক মহান সত্তার মুখাপেক্ষী এবং এই সৃষ্টিকুলের অস্তিত্বের পেছনেও রয়েছে এক মহান স্রষ্টা –তখন বলা হয় না এ সব কিছুর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করা সম্ভব।
যেকোন শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য একদল পুলিশের প্রয়োজন। অন্যথায় সারা শহ বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থা ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়বে। তাহলে মহাশূন্যের মাঝে যে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ গ্রহ-উপগ্রহ অবিরত সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে –এদের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কি এক সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন নেই?
“এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা একটি দুর্ঘটনা মাত্র” –এটা একটা হাস্যস্পদ কথা, নির্লজ্জের নির্বোধ উক্তি। “বদান্যতা, সৃকৃতি, দুষ্কৃতি ইত্যাদি হচ্ছে দৈহিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক প্রবাহেরই ফল। কেননা তাদের মহে রূহ বা আত্মা বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই”। এটাও একটা বাজে কথা এবং উদ্ভট গালগল্প। কামিল ফলাস্মারিয়ন পরিহাস করে এর জবাবে বলছেন, “শক্তির বিকাশ ও বৃদ্ধির অর্থ কি? মস্তিষ্ক মাইল বা কিলোমিটারের মত বৃদ্ধি হয় না কেন?
ফিল্ড মার্শাল আহমদ ইজ্জাত পাশা বলেন, “রূহ ও বাকশক্তিসম্পন্ন সত্তা বলতে যদি কোন কিছুর অস্তিত্বই না থেকে থাকে তাহলে বুদ্ধি ও অনুভূতির আধার (Brain) যে জিনিটা হৃদয়ঙ্গম করে –তার অনুভূতি কি করে হয়ে থাকে এবং কি করে হতে পারে না? আর এই ‘আমরা শব্দেরই বা হাতলে অর্থ কি, যা তিনি (ইউখানয) ব্যবহার করে থাকেন?”
পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, দার্শনিক তাঁর অজান্তে নিজের মুখ দিয়ে প্রকৃত সত্যকে প্রকাশ করে বসেছেন। একদিকে তিনি ‘আমি’-কে অস্বীকার করছেন, অন্যদিকে তাকে এটা স্বীকারও করতে হচ্ছে।–[অর্থাৎ, তিনি অবচেতনভাবে এখানে রূহ বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিচ্ছেন। স্বয়ং তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে –এখানে এমন কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে যা মস্তিষ্কের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে এবং এ সম্পর্কে নিজের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করছে।-গ্রন্থকার]
এসব লোক আরো বলেন, “শক্তি বা অনুপ্রেরণা বস্তু থেকে পৃথক হতে পারে না”। তাহলে মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত এই শক্তি বা অনুপ্রেরণার জড় পদার্থটা কোথায়? বাস্তব কথা হচ্ছে, যে জড়বাদ ও নাস্তিকতা এসব ‘অতি বুদ্ধিমানদের বেষ্টন করে রেখেছে –সত্য ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
আল্লাহর অস্তিত্ব সন্দেহাতীত
নিউইয়র্কের একটি সংবাদ সংস্থা ‘কলেরিজ’ নাকে একটি বিখ্যাত সাময়িকী প্রকাশ করে থঅকে। তারা এই পত্রিয়ার মাধ্যমে একদল প্রখ্যাত অণুবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী ও অংকশাস্ত্রবিদের কাছে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন। তাঁরা একবাক্যে জোর দিয়ে বলেন যে, তাঁদের কাছে অনেক যুক্তি-প্রমাণ মওজুদ রয়েছে যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, এই মহাবিশ্বের একজন মহান পরিচালক রয়েছেন। তিনি অপরিসীম দরদ ও অনুগ্রহ সহকারে অসীম জ্ঞানের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের তত্ত্বাবধান করছেন।
ডকটর রয়েন (Royen) বলেন, গবেষণাগারে তার অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মানব দেহে একটি আত্মা অথবা আরো একটি দেহ রয়েছে, যা বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না।
অপর এক বিজ্ঞানী বলেছেন, “একথা সন্দেহাতীত যে, এক মহান সত্তার অস্তিত্ব বর্তমান রয়েছে –আসমানী ধর্মগুলো যাঁর নাম দিয়েছে ‘আল্লাহ’! তিনি আণবিক শক্তি, প্রাকৃতিক শক্তি ও মানব-বুদ্ধিকে হতভম্ভকারী এই মহাবিশ্বের যাবতীয় শক্তির নিয়ামক”।
সংবাদ সংস্থার (রিপোর্টার) মাধ্যমে এই খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘আল-মিসরী’ নামক সাময়িকীও এই তথ্য প্রচার করে। অন্যদের মত আমারও তা পাঠ করার সুযোগ হয়েছিল। এই খবর পাঠ করে আমার দেহে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। কারণ যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীরা এই মহান সত্তার নিদর্শনসমূহ, আমি বলছি না তাঁরা চিনতে পেরেছেন, বরং স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরা বস্তুবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আন্তরিক অনুভূতির মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে শুরু করেছেন।
তুমি কি জান নাস্তিকতা কি? নিজেকে বেকুব বানানো, চিন্তার দরজায় তালা লাগানো, চারপাশ থেকে চক্ষু বন্ধ করে রাখা, ভিত্তিহীন কথা বলা, যুক্তি ও সুস্থ চিন্তার সাথে যার কোন স্পর্ক নেই।
যখন কুরআন এল মানুষকে হাত ধরে সত্যের আলোকোজ্জ্বল পথে টেনে নিয়ে এল। সে তাদেরকে কাঠিন্যের মধ্যে নিক্ষেপ করেনি। সে তাদের কাছে কিছুই দাবি করেনি, কেবল নিজেদের চোখ খুলে সুউচ্চ আকাশের দিকে, প্রশস্ত যমীনের বুকে এবং সৃষ্টি জগতের বিশেষত্বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার আহবান জানিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
তাদের বল, আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তা একটু চোখ খুলে দেখ।–সূরা ইউনুসঃ ১০১
(আরবী**********************************************************************************)
এসব লোক কি আসমান ও যমীনের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কখনো চিন্তা করেনি? আল্লাহ যেসব জিনিস সৃষ্টি করেছেন, তারা কি দু’চোখ খুলে তা দেখতে পায়নি? –সূরা আরাফঃ ১৮৫
(আরবী*********************************************************************************)
তারা কি কখনো নিজেদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে দেখেনি? আল্লাহ আসমান-যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যে অবস্থিত সবকিছুই সত্যতা সহকারে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। -সূরা রূমঃ ৮
অতএব মানুষ যখন মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও জীবনের রহস্য উদঘাটনের জন্য নিজের সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তখন সামান্য অগ্রসর হতেই সে উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় মহাসত্যের সন্ধান লাভ করে ফিরে আসে। সেই মহাসত্য সম্পর্কেই নিম্নোক্ত আয়াতে সংক্ষেপে অথচ পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************************************************)
আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি প্রতিটি জিনিসের রক্ষক। আসমান-যমীনের ভাণ্ডারসমূহের চাবি তাঁরই কাছে রক্ষিত। আর যারা আল্লাহ আয়াতসমূহ অমান্য করবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (হে নবী! এই লোকদের) বলঃ হে জাহিল লোকেরা! তাহলে তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ছাড়া অপর কারো ইবাদত করার কথা বলছ?
-সূরা যুমারঃ ৬২-৬৪
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের সমাজের একদল যুবক বিকৃত চিন্তার শিকার হয়ে নাস্তিক্যবাদের পতাকাবাহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের কাছে জ্ঞানের শূন্য ঝুড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা অনুমানে পথ চলে। জ্ঞানবান লোকদের কাছে তাদের এ ধারণা-অনুমানের কোন ওযন নেই। তুমি লক্ষ্য করে থাকবে তারা যখন ইলাহ, দীন, ওহী ইত্যাদি সম্পর্কে মুখ খোলে তখন তাদের বক্তব্যের মধ্যে ধোঁকা, প্রতারণা ও অলিক দাবি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। তাদের বক্তব্যের ধরনটা নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে বিবৃত হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
এমনও কিছু লোক রয়েছে যারা কোনরূপ ইলম, হিদায়াত ও আলোক দানকারী কিতাব ছাড়াই মস্তক উদ্ধত করে আল্লাহর ব্যাপারে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। আল্লাহর পথ থেকে লোকদেরকে বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত করাই হচ্ছে এদের উদ্দেশ্য। -সূরা হজ্জঃ ৮-৯
এই যেসব যুবক মনে করছে যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষকে নাস্তিকতার দিকেই পথ দেখায় –আমরা তাদের সামনে জীবন ও জগতের রহস্য সম্পর্কে তাদের মুরব্বীদের গবেষণালব্ধ তথ্য উপস্তাপন করছি।
অস্বীকার করার কারণ
ইমাম গাযালী (রহ) তাঁর ‘ইহয়া উলুমিদ-দীন’ গ্রন্থে বলেন, এই মহাবিশ্বের সুস্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল বাস্তবতা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব। তাঁর অস্তিত্বের সাথে সর্বপ্রথম পরিচিত হওয়াটাই ছিল একান্ত স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তার সম্পূর্ণ উল্টো। অতএব এর কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা একান্ত জরুরী। আমরা প্রথমেই বলেছি, এ বিশ্বের সুস্পষ্ট এবং সমুজ্জ্বল বাস্তবতা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব। তা একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বোঝা যেতে পারে।
আমরা যখন দেখি, কোন ব্যক্তি কিছু লিখছে অথবা কিছু সেলাই করছে, এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, সে একটি জীবন্ত সত্তা। তার জীবন, তার অবস্থিতি, তার শক্তি-সামর্থ্য এবং তার সেলাই করার ইচ্ছা –এ সব আমাদের কাছে তার বাহ্যিক অথবা অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অধিক সুস্পষ্ট। কেননা তার ভিতরগত অবস্থা যেমন, রোগ-শোক, ক্রোধ, মেজাজ প্রকৃতি, কামনা-বাসনা ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা খুব কমই অবহিত। আর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে কতগুলো সম্পর্কে আমরা অবহিত আর কতগুলো সম্পর্কে সংশয়ী। যেমন সে কতটা লম্বা, তার সারা শরীরের রং একই রকম না ভিন্ন রকম ইত্যাদি।
তার জীবন, তার শক্তি-সামর্থ্য, তার ইচ্ছা-সংকল্প, তার অভিজ্ঞতা এবং তার জীবন্ত থাকা ইত্যাদি ব্যাপার আমাদের কাছে পরিস্কার, যদিও আমরা স্বচক্ষে তার জীবন, শক্তি-সামর্থ্য ও ইচ্ছা-সংকল্প দেখতে পাচ্ছি না। কেননা বৈশিষ্ট্য পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা যায় না। তার জীবন্ত থাকা, তার শক্তি-সামর্থ্য এবং তার ইচ্ছা সম্পর্কে আমরা তার সেলাইকর্ম থেকে অনুমান করতে পারি। তার সেলাইকর্মের ভিত্তিতে আমরা তার জীবন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারি।
অতএব আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষ কি বলতে পারে, যাঁর সপক্ষে রয়েছে অসংখ্য দলিল-প্রমাণ? যে সত্তার মহানত্ব সম্পর্কে প্রতিটি জিনিস সাক্ষ্য দিচ্ছে তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে মানুষ কি বলবে? আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব, তাঁর কুদরত, তাঁর জ্ঞান ও তাঁর যাবতীয় গুণের সপক্ষে প্রতিটি জিনিসই সাক্ষ্য দিচ্ছে, যা আমরা বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে সব সময় প্রত্যক্ষ করছি। এর কতগুলো আমরা বাহ্যিকভাবেই দেখতে পাচ্ছি। আর কতগুলো আমরা ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাহায্যে অনুভব করছি।
যেসব জিনিস আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, চাই তা ইট-পাথর গাছপালা, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু, আসমান-যমীন, চাঁদ-সুরুজ, জলভাগ-স্থলভাগ, আগুন, বাতাস, দেহ-প্রাণ যাই হোক –তা সবই তাঁর গুণাবলীর সাক্ষ্য বহন করছে। সর্বপ্রথমেই আমাদের দেহ-প্রাণ, আমাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য, আমাদের অবস্থার পরিবর্তন, আমাদের হৃদকম্পন এবং আমাদের গতি-স্থিতির সবই তাঁর মহান গুণের সাক্ষ্য বহন করছে।
আমাদের সামনে সবচেয়ে প্রামাণ্য জিনিস হচ্ছে আমাদের নিজেদের সত্তা, অতঃপর যেসব জিনিস আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করতে পারি, অতঃপর যেসব জিনিস সম্পর্কে আমর নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি ও অন্তরদৃষ্টির সাহায্যে জানতে পারি। এই বিশ্বে আমরা যেসব জিনিস দেখতে পাচ্ছি তাকে জানার একটিমাত্র উপায়ই আছে, তার সপক্ষে একটিমাত্র প্রমাণই আছে এবং তার অনুকূলে একমাত্র সাক্ষ্যই আছে। কিন্তু এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার অবস্থা এই যে, এর প্রতিটি জিনিস তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং তাঁর শক্তি ও দয়া-অনুগ্রহের সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর সৃষ্টিজগতের অবস্থা এই যে, তার কোন সীমাসংখ্যা নেই।
অতএব লেখকের জীবন্ত থাকাটা যখন আমাদের সামনে পরিস্কার, অথচ তার প্রমাণমাত্র একটি –তা তার হাতের গতিবিধি –যা আমরা অনুভব করতে পারি, তাহলে সেই মহান সত্তা আমাদের কাছে সুপরিচিত নন কোন দিক থেকে? অথচ মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিস তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য মহন করছে এবং তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও মহিমা ঘোষণা করছে।
আমাদের দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু ঘোষণা করছে যে, তা স্বয়ং অস্তিত্ব লাভ কতে পারেনি এবং ত নিজ নিজ শক্তিবলে নড়াচড়া করছে না। এর পেছনে রয়েছে এক মহান সত্তার কারিগরি। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন, আমাদের হাড়গোড় ও গোশতের বিন্যাস, আমাদের স্নায়বিক ব্যবস্থা, আমাদের চেতনা-অনুভূতি, আমাদের সৌন্দর্য এবং আমাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রতিটি অঙ্গই তাঁর সাক্ষ্য দিচ্ছে।
আমরা জানি যে, এই দৈহিক ব্যবস্থাপনা নিজে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যেমন আমরা জানি যে, লেখকের হাত নিজে নিজে নড়াচড়া করছে না।
কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের আধিক্যের কারণে সেই মহান সত্তার পরিচয় এতটা প্রতিভাত হয়ে আছে যে, জ্ঞান-বুদ্ধি বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়েছে এবং তার পরিচয় লাভে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে।
ইমাম গাযালী (রহ) এই অক্ষমতা ও বিস্ময়ের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমাদের জ্ঞান তাঁকে উপলব্ধি করতে গিয়ে যে অক্ষম হয়ে পড়ল তার দুটি কারণ রয়েছে।
এক –তাঁর সত্তার দৃষ্টিশক্তির অন্তরালে থাকা। এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই।
দুই –তাঁর সীমাতিরিক্ত প্রকাশিত থাকা।
বাদুড় রাতের বেলা দেখতে পায়, দিনের বেলা দেখতে পায় না। কারণ এই নয় যে, দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন। বরং তার কারণ হচ্ছে দিন অত্যধিক পরিমাণে উজ্জ্বল। বাদুড়ের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, দুর্বল। সূর্যের আলোক তার দৃষ্টিশক্তিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়। তার দুর্বল দৃষ্টিশক্তির সাথে যখন সূর্যের প্রখর আলো এসে মিলিত হয়, তখন তা তার দৃষ্টিশক্তিকে অক্ষম করে দেয়। সে তখনই কিছু দেখতে পায় যখন অন্ধকারের সাথে সামান্য আলোও থাকে।
অনুরূপভাবে আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত দুর্বল। আর সেই মহান পবিত্র সত্তার সৌন্দর্য অতি উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান। তা প্রতিটি স্থানে ও প্রতিটি জিনিসের মধ্যে পরিব্যপ্ত। আসমান-যমীনের এই রাজত্বের মধ্যে এমন কোন স্থান খালি নেই যেখানে তাঁর নূরের তাজাল্লী অনুপস্থিত। এভাবে তাঁর প্রতীয়মান হওয়াটা আমাদের জ্ঞান-চক্ষুর সামনে অদৃশ্য থাকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জিনিস সর্বত্র পরিব্যপ্ত, কোথাও তার বৈপরীত্য নেই তা অনুধাবন করা কষ্টকর হয়ে থাকে।
বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে পার্থক্য সহজেই অনুধাবন করা যায়। কিন্তু সব জিনিসই যদি একই প্রকৃতির হয়, তাহলে এর মধ্যে পার্থক্য করাটা কষ্টকর হয় পড়ে।
সূর্যের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। যদি তা সব সময় সর্বত্র উদীয়মান থাকত তাহলে সূর্যকে অস্বীকার করার অনেক লোকই পাওয়া যেত। কিন্তু সূর্যের আলোকের অবস্থাটা তদ্রূপ নয়। আমরা জানি, তা একটি অস্থায়ী জিনিস, পৃথিবীর বুকে তা ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সূর্যাস্তের সাথে সাথে তা অদৃশ্য হয়ে যায়। যদি সূর্য সব সময় উদীয়মান থাকত, কখনো অস্ত না যেত, তাহলে আমরা মনে করতাম –দেহের মধ্যে এই ধরনের রঙই হয়ে থাকে –সাদা কালো বা অন্য কোন রঙ। কালো রঙ-এর মধ্যে অন্ধকার এবং সাদা রংয়ের মধ্যে শুভ্রতা দেখা যায়।
আমরা আলোকে স্বতন্ত্রভাবে অনুভব করতে পারি না। কিন্তু যখন সূর্য অস্ত যায়, অন্ধকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তখন আমরা উভয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারি। আমরা তখন জানতে পারি আলোকের কারণে প্রতিটি জিনিস আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটা সাময়িক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছিল যা সূর্যাস্তের সাথে সাথে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা আলোর অস্তিত্ব তা শেষ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই অনুভব করে থাকি। আলো যদি শেণ না হত তাহলে তা অনুভব করা আমাদের জন্য কষ্টকর হত। কেননা তখন আলো ও আঁধার আমাদের কাছে সমান হয়ে ধরা দিত। এর মধ্যে আমরা কোন পার্থক্য নির্ণন করতে সক্ষম হতাম না।
অনুভবযোগ্য জিনিসের মধ্যে আলো অধিক পরিমাণে প্রতীয়মান হয়ে থাকে। আলোর সাহায্যে যাবতীয় অনুভব যোগ্য জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।
আলো শুধু নিজেই পরিস্ফুট হয় না বরং অন্যান্য জিনিসকেও পরিস্ফুটিত করে তোলে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আলোর অবস্থা এই যে, যদি তার ওপর অন্ধকার ছেয়ে না যেত, তাহলে তা নিজের ঔজ্জ্বল্যের কারণে অজ্ঞাত থেকে যেত।
অনুরূপবাবে আল্লাহ তাআলা বিশ্বচরাচরের মাঝে সবচেয়ে বেশি প্রতীয়মান হয়ে আছেন। গোটা সৃষ্টিজগৎ তাঁর অনুগ্রহেই প্রতিভাত হয়ে আছে। যদি তিনি কখনো অস্তিত্বহীন হয়ে যেতেন অথবা লুকিয়ে যেতেন, তাহলে আসমান-যমীনের এই গোটা ব্যবস্থাপনা বিশৃঙ্খল হয়ে ধ্বংস হয়ে যেত। খোদায়ী ব্যবস্থাপনা বিলীন হয়ে যেত। এ সময় স্রষ্টার অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে সামনে এসে যেত।
যদি এমন হত যে, কতগুলো জিনিস আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন আর কতগুলো জিনিস অন্য কেউ সৃষ্টি করেছে, তাহলেও উভয়ের মাঝে পার্থক্য অনুভব করা যেত। কিন্তু গোটা সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহ তাআলার নূরের তাজাল্লীই বিরাজমান। তিনি চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। নিমেষের জন্যও তাঁর অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে না।
সম্যকভাবে তাঁর বিদ্যমান থাকাটাই তাঁর গোপন থাকার কারণে পরিণত হয়েছে এবং অসংখ্য জ্ঞান তাঁকে অনুভব করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে”।
অনাদিকাল থেকেই আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব বিরাজমান। তাঁর পূর্বে কারো অস্তিত্ব কখনো কল্পনা করা যায় না। তাঁর থেকেই সবকিছু অস্তিত্ব লাভ করেছে। আল্লাহ তাআলা সবকিছুর আগে থেকেই বর্তমান। কোন জিনিস সর্বপ্রথম অস্তিত্ব লাভ করেছে, তা আমরা জানি না। কেননা আমরা জন্মলাভ করার পরই অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছি। উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। মুশরিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে বলল, আপনার প্রভুর বংশ-তালিকা বর্ণনা করুন। তখন নাযিল হলঃ
(আরবী*****************************************************************)
বল, আল্লাহ এক। আল্লাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেউ তাঁর ঔরসজাত নয় এবং তিনিও কারো ঔরসজাত নন। তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই।
-সূরা ইখলাসঃ ১-৪
অর্থাৎ জিনিসই জন্মলাভ করে, তা অচিরেই মৃত্যুবরণ করবে। যে জিনিসই মৃত্যুমুখে পতিত হবে কেউ না কেউ তার উত্তরাধিকারী হবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার মৃত্যু নেই এবং তাঁর ওয়ারিশও নেই। তাঁর সমতুল্যও নেই এবং তাঁর বিকল্পও নেই। আল্লাহর সাথে তুলনীয় হতে পারে এমন কিছুই নেই।
মুশরিকরা আল্লাহ তাআলাকে নিজেদের স্থূল জ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করেছে। তারা তাঁর অস্তিত্বকে নিজেদের সীমিত জীবনের ওপর অনুমান করছে। এভাবে তারা ভ্রান্ত ধারণার শিকার হল যে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বেরও বুঝি তদ্রূপ নয়। নিঃসন্দেহে আমাদের জড়দেহের একটা সূচনাকাল রয়েছে। কেননা আরমা এটা অনুভব করতে পারি এবং নিঃসন্দেহে আমরা তা জানি। অবশ্য আল্লাহর অস্তিত্ব চিরন্তন, তাঁর সূচনাবিন্দু নেই।
কখনো কখনো আমাদের মনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় যে, শেষ পর্যন্ত এই অনন্তকাল কি? এর গূঢ় রহস্য কি? এটা কেমন জিনিস, যা আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি আয়ত্ত করতে পারে না? এটা জ্ঞান ও অনুভূতির বৈশিষ্ট্য যে, তা যে জিনিস বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ে তার নিগূঢ় তত্ত্ব আবিস্কারের জন্য অস্থির তাকে। এতে ঈমানের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোন পার্থক সূচিত হয় না। আবূ হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের একদল সাহাবী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের মনে এমন সব জিনিসের উদয় হয় যে, তা আমাদের যে কেউ মুখের ভাষায় প্রকাশ করাকে বিরাট অপরাধ মনে করে। তিনি বলেনঃ এই তো হচ্ছে ঈমানের প্রত্যক্ষ নিদর্শন। -মুসলিম
অপর এক বর্ণনায় আছেঃ
(আরবী*************************************************************************)
সেই মহান আল্লাহর শপথ, যিনি শয়তানের ষড়যন্ত্রকে কুমন্ত্রণার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। -আবূ দাঊদ
(আরবী***********************************************************************************)
ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কারো মনে এমন কথার উদয় হয় যে, তা মুখে আনার চেয়ে সে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া অথবা আসমান থেকে যমীনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অধিক ভাল মনে করে। নবী করীম (স) বললেনঃ এতো পাক্কা ঈমানের আলামত।
জীবন, বিশ্বচরাচর ও মানব জাতির ইতিহাস শুরু হওয়ার পূর্বে নাস্তির একটা যুগ অতীত হয়েছে। এর সীমা-সংখ্যা কেউ জানে না। মানুষ তার সীমাবদ্ধ পরিসরে অবস্থান করে বর্তমান, নিকট অতীত অথবা নিকট ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা পরিচয় লাভ করতে পারে। তার এই লাভ করা বস্তুর মাধ্যমে কিছুটা জ্ঞান ও দাঁড় করাতে পারে কিন্তু তারপর তার দৃষ্টিশক্তি এক পর্যায়ে স্থির হয়ে যায়, তখন তার নড়াড়া করারও শক্তি থাকে না এবং অবলোকন করারও শক্তি থাকে না। এই বাহ্যিক জগতেই যখন তার শক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার এই করুণ অবস্থা, তখন অদৃশ্যমান জগতের ক্ষেত্রে তা বুদ্ধিবৃত্তির দৈন্যদশা এবং চিন্তার অকৃতকার্যতার কতা বলার অপেক্ষা রাকে না। এই অজড় জগতের ব্যাপারসমূহ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্রে সে একেবারেই অপারগ।
নৌকার আরোহী নৌকার ওপর চক্কর দিতে পারে, কিন্তু সে যদি নিজেকে সমুদ্রের অথৈ জলে নিক্ষেপ করে তাহলে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম। আমাদের সীমিত শক্তির কারণে আমাদের জ্ঞানের অবস্থাও তাই যা আমাদের দৃষ্টিশক্তির অবস্থা। আমাদের দৃষ্টিশক্তিসমূহ দূর পর্যন্ত কিছু পড়তে সক্ষম। কিন্তু এই দূরত্বের পরিমাণ যদি বেড়ে যায় তাহলে তা একটি অক্ষরও চিনতে সক্ষম হবে না। এভাবে জ্ঞানের একটা সীমিত পরিসর আছে। এই পরিসরের সীমার মধ্যেই তা কোন কিছুর পরিচয় লাভ করতে সক্ষম।
(আরবী**************************************************************************)
তোমাদেরকে জ্ঞানের খুব সামান্য অংশই দেওয়া হয়েছে। -সূরা ইসরাঃ ৮৫
এজন্যই আমরা সেই মহান সত্তার অনাদি অনন্ত হওয়ার ওপর ঈমান রাখি। আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় হচ্ছে তিনি অনন্তকাল থেকেই বিরাজমান। এ নিগুঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। অতএব একটি অভিনব সত্তার সাথেই কেবল শুরু ও শেষ কল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু যিনি নিজস্ব সত্তার চির বিরাজমান তাঁর সাথে শুরু ও শেষের কি সম্পর্ক থাকতে পারে? তাঁর আগে অথবা পরে নাস্তির কল্পনা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।
তিনিই অনন্ত
মহান আল্লাহ তাআলা চিরস্থায়ী, চিরঞ্জীব ও অবিলীয়মান। তাঁর কোন দেহ নেই, সুতরাং তাঁর মৃত্যুর প্রশ্নই অবান্তর। তিনি কোন জড় পদার্থও নন, অতএব তাঁর কোন অবচয়ও নেই এবং ক্ষয়ও নেই। তিনি চিরস্থায়ী ও সর্বব্যাপী। প্রতিটি জিনিস তাঁর কাছেই ফিরে যাবে। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী****************************************************************************)
তাঁর সত্তা ছাড়া আর সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব কেবলমাত্র তাঁরই। তোমাদের সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। -সূরা কাসাসঃ ৮৮
(আরবী***************************************************************************)
সেই আল্লাহর ওপরই ভরসা কর যিনি চিরঞ্জীব, কখনই মরবেন না। তাঁর হামদ সহকারে তাঁর তসবীহ করা। তাঁর বান্দাদের গুনাহ সম্পর্কে কেবল তাঁরই ওয়াকিফহাল হওয়া যথেষ্ট। -সূরা ফুরকানঃ ৫৮
তিনি চিরস্থায়ী সত্তা, তাঁর কোন ধ্বংস নেই। তিনি তাঁর নেক বান্দাদের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ বেহেশতে চিরকালের জন্য স্থান দেবেন। আল্লাহর এই নিয়ামতের অর্থ এই নয় যে, কোন মানুষকেও চিরস্থায়ী বলা যাবে। আমরা যেমন পূর্বে বলেছি, মহান আল্লাহ অত্যাবশ্যকীয় সত্তা। তিনি কখনো এক মুহুর্তের জন্যও তাঁর এই চির বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন নন। তিনি ছাড়া এ মহাবিশ্বে যত জিনিস রয়েছে, যদি তাঁর পক্ষ থেকে তা অস্তিত্ববান না করা হতো তাহলে কোথাও এর নামগন্ধ পাওয়া যেত না।
মহাবিশ্ব আল্লাহর মুখাপেক্ষী
আমরা প্রতিনিয়ত দেখে আসছি যে, প্রকৌশলী ও রাজমিস্ত্রী আকাশচুম্বী দালান-কোঠা নির্মাণ করছে, অতঃপর তা থেকে নিজের হাত গুটি নিচ্ছে অথবা মৃত্যুবরণ করছে, আর সেই ইমারত তারপরও দীর্ঘদিন ধরে কালের বুকে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এর দেওয়াল ও খুঁটিগুলো নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে তাকে। এই ইমারত নাস্তি থেকে অস্তিত্ব লাভ করেনি। রাজমিস্ত্রি কেবল ইটের সাথে ইট বসিয়ে তার কাজ শেষ করেছে। সে নতুন কিছু সৃষ্টি করেনি, বরং সৃষ্ট বস্তু কাঠামোতে রদবদল করে এর উপযোগিতা বৃদ্ধি করেছে মাত্র। কিন্তু এই সীমাহীন বিশ্ব, আসমান এবং এর ছাদ, এই সমতল পৃথিবী এবং তার বুকে বসবাসকারী অসংখ্য সৃষ্টির অস্তিত্বের ব্যাপারটি কিন্তু ভিন্ন জিনিস যেগুলোকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বের রূপ দেওয়া হয়েছে।
অতএব এ মহাবিশ্ব যেভাবে নিজের অস্তিত্বের জন্য তার প্রতিপালকের মুখাপেক্ষী, অনুরূপভাবে নিজের স্থায়িত্বের জন্যও তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে আছে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এটা মুহুর্তকালেও টিকে থাকতে পারে না। আসমান ও যমীনের মাঝে এমন কোন জিনিস নেই, যা আপন সত্তায় বিরাজমান এবং কখনো তার মুখাপেক্ষী নয়। পক্ষান্তরে এই যে আমাদের সত্তা, আমাদের দেহ সৌষ্ঠব, এর মাঝে যে গতিশীল বস্তুটি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যখন তার দাতা ইচ্ছা করবেন এটা বিলীন হয়ে যাবে –যেভাবে মানুষ চলে যাওয়ার সাথে সাথে তার ছায়া বিলীন হয়ে যায়।
সূর্যের অস্তিত্ব ছাড়া দিনের কল্পনা করা যায় না এবং আল্লাহর অস্তিত্ব ছাড়া এই বিশ্ব জাহানের অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী***************************************************************)
আর আল্লাহর জন্য সবচেয়ে উত্তম ও উন্নতগুণাবলী শোভনীয়।
-সূরা নহলঃ ৬০
(আরবী*****************************************************************************)
হে লোকেরা! তোমরাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ তো ঐশ্বর্যময় এবং প্রশংসিত। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের অপসারিত করে নতুন কোন সৃষ্টি তোমাদের স্থানে নিয়ে আসবেন। এরূপ করা আল্লাহর জন্য কিছুমাত্র কঠিন নয়। -সূরা ফাতিরঃ ১৫, ১৬, ১৭
জ্ঞানের উৎস এবং তার মদ্যে সৃষ্ট চিন্তা-কল্পনা, অন্তর এবং তার মধ্যে উৎসারিত অনুভূতি, শিরা-উপশিরা এবং এর মধ্যে প্রবহমান রক্তধারা, শরীর এবং এর গতিশীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ –এ সব কিছুই আল্লাহ তাআলার তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠাপোষকতার নিদর্শন বহন করে। এটা কোন একটি ক্ষুদ্র পল্লী অথবা একটি শহর অথবা একটি দেশের কথা নয়, বরং গোটা বিশ্বেরই এই অবস্থা আজ থেকে নয়, বরং সৃষ্টির সূচনা থেকেই তাঁর তত্ত্বাবধান চলে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। আমাদের জানা অজানা সব কিছুই তাঁর দয়ায় অস্তিত্ববান এবং বিরাজমান। তিনি যদি মুহুর্তের জন্যও তাঁর তত্ত্বাবধান উঠিয়ে নিতেন তাহলে আমরা নিমেষেই বিলীন হয়ে যেতাম এবং তা কল্পনা করার অবকাশটুকুও পেতাম না। কেননা আমরা অচিরেই কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
যে যমীনের বুকে তোমরা বিচরণ করছ তা নিজে থেকে তোমাদের পায়ের তলায় স্থির হয়ে নেই। কেননা তোমাদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁর অনুভূতিও নেই। যে ফলমূল ও শস্য দিয়ে তোমরা নিজেদের গোলা ভর্তি করছ তা উৎপাদন করার শক্তিও এর নেই। এর তো নড়াচড়া করার নিজস্ব কোন শক্তি নেই। এর বোধশক্তি বা অনুভূতি শক্তি বলতে কিছুই নেই। এতো এক প্রাণহীন জড় পদার্থমাত্র। সুতরাং তার আবার সৃষ্টি ও আবিস্কারের সাথে কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
নিঃসন্দেহে এটা মহান আল্লাহর তত্ত্বাবধানই ফলশ্রুতি। তাঁর অনুগ্রহেই সমগ্র সৃষ্টিকূল স্বস্থানে বিরাজমান। মুহর্তের জন্যও তিনি আমাদের থেকে অন্যমনস্ক হন না এবং আমাদের ওপর তাঁর অনুগ্রহের ধারাও বন্ধ হয় না। যদি তাই হত তাহলে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতাম এবং বিশ্বের এই সামগ্রিক ব্যবস্থাও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ত। আমাদের অস্তিত্ব এবং মহান আল্লাহর অস্তিত্বের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তিনি নিজ সত্তায় বর্তমান, আর আমাদের অস্তিত্ব তাঁর অনুগ্রহেরই ফল। তিনিই আমাদের অস্তিত্ববান করেছেন, যত দিন তাঁর ইচ্ছা হবে আমরা ততদিনই বর্তমান থাকব এবং তিনি যখন আমাদের অস্তিত্বের এই দান ফেরত নেবেন কোন শক্তিই আমাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। এ থেকেই জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলার অসংখ্য গুণ রয়েছে এবং এর মাধ্যমে তাঁর পূর্ণত্বের বিভিন্ন দিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। এর যৎসামান্যই আমরা এখানে উল্লেখ করছি।
তাঁর অনুরূপ কিছু নেই
মহান আল্লাহর সত্তা সমগ্র সৃষ্টিকূল থেকে স্বতন্ত্র হওয়াটা একটি ব্যাপার। বিবেক-বুদ্ধিরও দাবি হচ্ছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে ব্যবধান থাকা একান্ত প্রয়োজন। এতটা ব্যবধান যার অনুমান করা সম্ভব নয়। স্রষ্টা কখনো সৃষ্টির অনুরূপ হতে পারে না –ব্যক্তিসত্তার দিক থেকেও নয়, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও নয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর অসংখ্য বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এর তাৎপর্য অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা নিজেদের দৈনন্দিন ব্যাপারগুলো যেভাবে সহজে অনুধাবন করতে সক্ষম এভাবে তাঁর গুণবৈশিষ্ট্যের তাৎপর্য অনুধাবন করা শুধু কষ্টসাধ্যই নয় বরং অসম্ভবও। কোন দুর্বল বান্দা কি করে সেই মহান সত্তার নিগূঢ় তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হতে পারে!
একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার পক্ষে কি মানুষের গূঢ় রহস্য আবিস্কার করা সম্ভব? তাহলে মানুষ কি করে এই প্রশস্ত জগতের রহস্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারে, যেখানে তারা বসবাস করছে? একটি শিশু জীবনের প্রাথমিক স্তরে কখনো জানতে পারে না যে, যৌবন কি জিনিস। আর এ বয়সে বুদ্ধি জ্ঞানের ব্যাপকতা ও পরিপক্কতাইবা কতটুকু হয়ে থাকে! বরং মানুষ যে জড় জগতে বাস করছে তার নিগূঢ় রহস্য বুঝতেই সে অক্ষম। সে অদৃশ্য লোকের তথ্য কি করেইবা জানতে পার?
যখন বলা হয়, আল্লাহ তাআলা সবকিছুই শুনতে পান, তখন তার অর্থ এই নয় যে, শুনার জন্য আমাদের মত তাঁরও কান রয়েছে। যখন বলা হয়, তিনি সব কিছুই দেখতে পান, তখন তার অর্থও এই নয় যে, আমাদের মতই তাঁর চোখ রয়েছে। যখন বলা হয়, তিনিই আসমানী জগত তৈরি করেছেন, তখন তার অর্থ এই নয় যে, তিনি আমাদের মত প্রকৌশলী ও রাজমিস্ত্রী ডেকে এনে যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রী একত্র করেছেন। যখন বলা হয়, আমাদের হাতের মতই তাঁর হাত রয়েছে। আমাদের মৌলিক বিশ্বাস এই যে, সৃষ্টির মধ্যে যে গুণ বৈশিষ্ট্য এবং দুর্বলতা বিরাজমান রয়েছে, আল্লাহ তাআলার সাথে সেগুলোকে সম্পৃক্ত করা মোটেই জায়েয নয়। কেননা সেই মহান সত্তা সৃষ্টিগত দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অপূর্ণাঙ্গ বুদ্ধির মধ্যে মহান আল্লাহ সম্পর্কে যে ধারণা বর্তমান রয়েছে, তিনি তার চেয়ে অনেক বড় এবং অসীম।
কুরআন পাকে আল্লাহ তাআলার সম্পর্কে অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে; যেমন –চেহারা, হাত, চোখ, আরশের ওপর অবস্থান করা, আসমানে নেমে আসা, বান্দার নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি। অনেক মুসলমান যুক্তির মাধ্যমে এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে এবং এর নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করতে যতই চেষ্টা করেছে ততই হতবুদ্ধি হয়ে ফিরে এসেছে। এটা কোন দুশ্চিন্তার কথা নয়। কেননা মানুষের কাছে যে সত্য পর্যন্ত পৌঁছার কোন উপায় উপকরণ নেই, তার অনুসন্ধানের মত্ত হওয়াই অনর্থক।
কোন রসায়নবিদ একটি তরল পদার্থ অথবা গ্যাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত। সে এটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লিপ্ত হয় এবং এর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হয়। কিন্তু বান্দার জন্য এটা কি করে বৈধ হতে পারে যে, সে মহান আল্লাহর প্রভুত্ব সম্পর্কে দার্শনিক আলোচনায় লিপ্ত হবে এবং যেটা ইচ্ছা গ্রহণ করবে আর যেটা ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করবে। অথচ মহান আল্লাহর প্রভুত্বের নিগূঢ় তত্ত্বে পৌঁছা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে তাঁর সত্তা এবং গুণবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইরশাদ করেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
সেই মহান আল্লাহ তোমার ওপর কিতাব নাযিল করেছেন। এর মধ্যে দুই প্রকারের আয়াত রয়েছেঃ মুহকাম –এটা কিতাবের মূল ভিত্তি এবং মুতাশাশাবিহাত। যাদের মনে কুটিলতা রয়েছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সব সময়ই মুতাশাবিহাত আয়াতের পেছনে লেগে থাকে এবং এর অর্থ বের করার চেষ্টা করে। অথচ এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না। পক্ষান্তরে যারা জ্ঞান-বুদ্ধির দিক থেকে প্রতিভাবান লোক তারা বলে, আমরা এর ওপর ঈমান আনলাম, এ সবই আমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে এসেছে। আর সত্য কথা এই যে, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোকেরাই কেবল কোন জিনিস থেকে প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে থাকে। -সূরা আলে-ইমরানঃ ৭
এজন্য আল্লাহ তাআলা নিজের যে গুণাবলী উল্লেখ করেছেন এবং নিজের সত্তার দিকে যেসব জিনিসের সম্পর্ক ব্যক্ত করেছেন তার সত্যতা সম্পর্কে যদি আমাদের মনে নিশ্চিন্ততা এসে যায় এবং আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের দ্বারা তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে আমরা চক্ষু বন্ধ করে নতশিরে তা কবুল করব। আমরা এর ব্যাখ্য-বিশ্লেষণে যাব না, তাঁর কোন দৈহিক গঠন বা সাদৃশ্য কল্পনা করব না। এ বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে।
যুগ-যুগান্তরের পরিক্রমায় মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে ভাষা তৈরি করে নিয়েছে। যেমন আমাদের মুখমণ্ডলের উভয় পার্শ্বে শব্দ শোনার জন্য এবং কথা বোঝার জন্য যে দুটি ছিদ্র হয়েছে আমরা (আরবী ভাষায়) তার জন্য (কান) পরিভাষা প্রবর্তন করে নিয়েছি। অন্যান্য ভাষায় এর জন্য ভিন্ন শব্দ প্রবর্তন করা হয়েছে, যা আমাদের পরিভাষাটি থেকে ভিন্নতর। মোটকথা লোকের পরবর্তীকালে এসব শব্দ আবিস্কার করে নিয়েছে। এর সাহায্যে তারা জড় পদার্থ, পরিচিত জিনিস এবং আরো অনেক মৌলিক বস্তুকে বোঝার চেষ্টা করে। অনুরূপভাবে অদৃশ্যমান ও অজড় বস্তুর বর্ণনা দেওয়ার জন্য যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব জিনিসকে মানুষের বোধশক্তির কাছাকাছি নিয়ে আসা। অন্যথায় যেসব জিনিস আমরা অনুভব করতে পারি, তার জন্য এবং জগতের সুপরিচিত জিনিসগুলোর জন্য যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়, তার মাধ্যমে জড় জগতের বাইরে অজড় জগতে এসব কিছুর যে প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে তা তুলে ধরা কখনো সম্ভব নয়।
অতএব আমরা যে ভাষাতেই অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান করি না কেন আল্লাহ তাআলার সত্তা ও তাঁর গুণবৈশিষ্ট্য হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এই সত্যটি আমাদের সামনে রাখতে হবে। যেকোন ভাষায়ই আমরা অধ্যয়ন করি না কেন, সত্যকে আমাদের সীমিত জ্ঞানের কিছুটা নিকটতর করে দেওয়ার জন্যই এই প্রকাশভঙ্গি অবলম্বন করা হয়েছে। ভাষার সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে আল্লাহ তাআলার যতটুকু পরিচয় ফুটে উঠে, তিনি তার চেয়ে অনেক ব্যাপক, অনেক মহান। আমাদের সীমিত জ্ঞান তা আয়ত্ত করতে অক্ষম এবং আমরা তাঁর স্বয়ংসম্পূর্ণতা অনুমান করতেও অক্ষম।
দুনিয়ার মানুষের মধ্যে যতগুলো ভাষা প্রচলিত আছে তা হয়ত মানুষের কথাবার্তার সঠিক অবয়ব হতে পারে অথবা তাদের যাবতীয় আচার-আচরণের পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, কিন্তু তা মহান আল্লাহর সত্তা এবং তাঁর যাবতীয় গুণের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের সব মুসলমান এ ব্যাপারে একমত। অবশ্য তাঁর পবিত্রতা ব্যাখ্যা ও প্রশংসা করার ক্ষেত্রে তাদের পন্থার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
একদল লোক আয়াতের প্রকাশ্য অর্থই গ্রহণ করেছেন। অবশ্য তাঁরা বলেছেন, এসব জিনিসের যে বাহ্যিক অর্থের সাথে আমরা পরিচিত এখানে তা উদ্দেশ্য নয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এখানে শব্দগুলোর বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য প্রায় একই! কুরআন পাকে এসেছে (আরবী*******************) (যেন তুমি আমার তত্ত্বাবধানে তৈরি হতে পারে –ত্বাহাঃ৩৯)। এখানে প্রথম দলটি বলেন, আল্লাহ তাআলা চোখ আছে, কিন্তু তা আমাদের চোখের মত নয়। আর দ্বিতীয় দলের মতে, চোখ বলতে এখানে তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতা বোঝানো হয়েছে। উভয় দলই আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও মহত্ত্ব বর্ণনা করার ব্যাপারে একমত। তাদের কেউই সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সাদৃশ্য স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে তাঁর পবিত্রতা ও মহত্ত্ব বর্ণনার ধরনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
আমাদের প্রাচীন মুসলিম বিশেষজ্ঞরা যদি এই বিষয়ের ওপর আলোচনা ও বিতর্কের যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তপ্ত না করতেন এবং একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গি সূক্ষ্মভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করতেন তাহলে কতইনা ভাল হত। আমি ব্যক্তিগতভাবে পূর্ববর্তীদের মতামতকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। আমি কখনো এটা পছন্দ করি না যে, যেসব জিনিস বস্তুজগতের সীমার বাইরে রয়েছে মুসলমানরা তার অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়ে পড়ুক এবং অকারণ নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে এর পিছনে লাগিয়ে দিয়ে পরিশ্রান্ত করুক। যেসব আয়াত ও হাদীসে আল্লাহ তাআলার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে লিপ্ত না হওয়াই আমার কাছে উত্তম ও পছন্দনীয় মনে নয়। যেভাবে তা বর্ণিত হয়েছে হুবহু সেভাবেই তা মেনে নেওয়া উচিত।
আল্লাহ তাআলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে এটাই হচ্ছে আমার অভিমত। কিন্তু মহান আল্লাহর সত্তা ও তাঁর গুণাবলীর ক্ষেত্রে যেসব লোক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথ অনুসরণ করেছে এবং কুরআনের আয়াত ও হাদীস থেকে প্রত্যক্ষ অর্থ গ্রহণ করার পরিবর্তে পরোক্ষ অর্থ গ্রহণ করেছে তাদেরকে কুফরীর ফতোয়া দেওয়াও আমার উদ্দেশ্য নয়। কেননা যারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথ অনুসরণ করেছে তারা কেবল এই আশংকায় তা করেছে যে, ইহুদী-খৃষ্টানরা যেভাবে আল্লাহর দৈহিক গঠন ও সাদৃশ্য কল্পনা করেছে এবং তাঁর সাথে যে হাস্যকর কথাবার্তা জুড়ে দিয়েছে, মুসলমানদের মধ্যেও যেন এই ভ্রান্তির অনুপ্রবেশ না ঘটে।
বাইবেলের আদি পুস্তকে (তাওরাত) বর্ণিত আছে যে, সদাপ্রভু এবং ইয়াকুবের (জ্যাকব) মধ্যে মল্লযুদ্ধ বেঁধে যায়। সদাপ্রভু ইয়াকুবকে প্রসিদ্ধ উপাধি ‘ইসরাঈল’ উপঢৌকন দিয়ে তার হাত থেকে নিজেকে অতি কষ্টে মুক্ত করে নেন। আল্লাহ সম্পর্কে বাইবেলের নতুন নিয়মের বর্ণনা হচ্ছে –যেন মাতা-পুত্রের সমন্বয়ে একটি পরিবার এবং আল্লাহ হচ্ছেন এই পরিবারের কর্তা বা পৃষ্ঠপোষক।
আমাদের ধারণা মতে এই দৃশ্য যদি সামনে রাখা হয় তাহলে যেসব লোক ভিন্নরূপ ব্যাখ্যার পথ বেছে নিয়েছেন এবং প্রত্যক্ষ বিষয়কে পরোক্ষ হিসেবে গণ্য করেছেন, তাঁদের জন্য একটি বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। অবশ্য আমরা দেখেছি এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার পরিবর্তে কল্পনার পথ বেছে নেওয়ার ঝোঁক সাধারণ মুসলমানদের ঈমানের ক্ষতিসাধণ করেছে। আল্লাহ সম্পর্কে তাদের ধারণা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট রয়ে গেছে যে, তিনি আসমানেও নেই এবং তাঁর কোন অবয়বও নেই। আনন্দিত হওয়া, হাসা, অনুগ্রহ করা, এটা ওটা কোনটাই তার বৈশিষ্ট্য নয়। অথচ এই বৈশিষ্ট্যগুলো তিনি নিজের জন্য বর্ণনা করেছেন।
এক্ষেত্রে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এই যে, শরীআতের যা কিছু এসেছে তা আমরা মেনে নেব এবং যে সূক্ষ্ম বিষয় জানার জন্য আমাদের বাধ্য করা হয়নি তা জানার পণ্ডশ্রম করব না। এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। যেমন-
এক, মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি কোন কিছুর বিদ্যমান থাকাটা অসম্ভব বলে ফয়সালা করল।
দুই, এই জ্ঞানবুদ্ধি কোন জিনিস অনুধাবন করার ক্ষেত্রে নিজের দুর্বলতা, অক্ষশতা ও সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিল।
এই দুটি কথার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বুদ্ধিবিবেক সিদ্ধান্ত নিল যে, দুই বিপরীত জিনিসের একই সময় বিদ্যমান থাকা অসম্ভব। অর্থাৎ একই আলোর বর্তমান থাকা এবং না থাকা অসম্ভব। কিন্তু যে জ্ঞানবুদ্ধি এটাকে অসম্ভব বলেছে সেই জ্ঞানবুদ্ধিই আলোর গূঢ় রহস্য অনুধাবন করতে অক্ষম যে, এই আলোটা কি? এর মধ্যে কি নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত রয়েছে? এমন বিস্ময়কর গতিতে কিভাবে তা এক স্থান থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছে?
মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির এই অক্ষমতার কারণে আলোর বৈশিষ্ট্য, এর তাৎপর্য ও এর অস্তিত্বের ওপর কি কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়? কোন জিনিস সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতার অর্থ তো এই হতে পারে না যে, ‘মূলত তার কোন অস্তিত্বই নেই’। এই বিষয়ের ওপর উস্তাদ আবদুল করীম আল-খতীবের বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তিনি বলেনঃ
“আল্লাহ কোন অস্পষ্ট বা অপরিচিত সত্তা নন। তিনি কোন সীমাবদ্ধ বা দেহসর্বস্ব সত্তাও নন। তিনি এমন এক ‘সত্তা’ যা এমন কোন সত্তার সাথে তুলনীয় নয় –মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি যার অবয়ব কল্পনা করতে পার, অথবা তার চোখ তা অবলোক করতে পারে। কেননা তাঁকে যদি ধারণা কল্পনার আওতায় আনা যায়, তাহলে তো তিনি একটি সীমাবদ্ধ সত্তাই হবেন। মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির সীমা যতই বিস্তৃত হোক না কেন পরিশেষে তা সীমিতই। কিন্তু আল্লাহ এমন এক মহান সত্তা, যাঁর ব্যাপকতা মানুষের বোধশক্তি কল্পনা করতেও অক্ষম এবং তার সীমা নির্দিষ্ট করাও অসম্ভব। কুরআন পাকে আল্লাহ তাআলার জন্য অসংখ্য গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ রয়েছে। যেমন –ইরাদা (ইচ্ছাশক্তি), ইলম (জ্ঞান), কুদরাত (শক্তি) ইত্যাদি। এই গুণাবলী তাঁর পরিপূর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার পূর্ণতার কোন সীমা নেই। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হচ্ছে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু এই দ্বিবিধ ব্যবহারের কোন সীমা নেই। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হচ্ছে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু এই দ্বিবিধ ব্যভহারের মধ্যে আসমান-যমীন পার্থক্য রয়েছে। আল্লাহ তাআলার জন্য তা সীমাহীন ও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা সীমিত ও ক্ষুদ্র অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
কুরআন করীমে এমন অসংখ্য আয়াত রয়েছে যাতে আল্লাহ তাআলার জন্য উল্লিখিত গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে এবং যা এই জগতে কার্যকর রয়েছে। যেমন সর্বপ্রথম নাযিলকৃত ওহীতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************************)
পড় (হে নবী!) তোমার প্রভুর নাম সহকারে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়, তোমার রব বড়ই অনুগ্রহশীল। তিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা সে জানত না। -সূরা আলাকঃ ১-৫
উল্লেখিত আয়াত কটিতে আল্লাহ তাআলার পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, তিনি স্রষ্টা এবং জ্ঞানের আধার। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************)
আল্লাহ তোমাদের কাজ সহজ করে দিতে চান, কোনরূপ কঠোরতা আরোপ করা তাঁর ইচ্ছা নয়।–(সূরা বাকারাঃ ১৮৫
এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, ইরাদা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার একটি গুণ এবং তাঁর ইরাদার সাথে যাবতীয় বিষয় সংশ্লিষ্ট। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************************************)
আল্লাহ প্রতিটি গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভ সম্পর্কে অবহিত। যা কিছু তার গর্ভে জন্ম নেয় এবং যা কিছু তাতে কম-বেশি হয় তা তিনি জানেন। প্রতিটি জিনিসের জন্য তাঁর কাছে একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট রয়েছে। গোপন প্রকাশ্য সবই তাঁর জানা আছে। তিনি মহান ও সর্বোচ্চ।
-সূরা রা’দঃ ৮-৯
উল্লেখিত আয়াত দুটি থেকে জানা যায়, তিনি ইলম (জ্ঞান) রাখেন, তিনি মহান ………. তার কাছে প্রতিটি জিনিসের পরিমাণ নির্ধারিত রয়েছে এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি মহামহিম। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************************************)
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। তিনি যাকে যা দিতে চান তাই দান করেন। তিনি বড়ই ক্ষমতাবান এবং মহাপরাক্রমশালী।
-সূরা শূরাঃ ১৯
এ আয়াত থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু, শক্তিশালী এবং পরাক্রমশালী। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
(আরবী******************************************************************************)
আল্লাহ শুনতে পেয়েছেন সেই মহিলার কথা, যে তার স্বামীর ব্যাপার নিয়ে তোমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করছে এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে। আল্লাহ তোমাদের উভয়ের কথাই শুনেছেন। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। -সূরা মুজাদালাঃ ১
এই আয়াতে পরিস্কার বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলার সত্তা প্রতিটি কথা শুনেন এবং প্রতিটি জিনিস দেখেন। অপর এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************************************)
আসমান-যমীনের কোন জিনিসই আল্লাহর কাছে গোপন নয়। তিনি তোমাদের মায়েদের গর্ভে তোমাদের আকার-আকৃতি নিজের ইচ্ছামত বানিয়ে থাকেন। বাস্তবিকই এই মহান জ্ঞানবুদ্ধির মালিক ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। -সূরা আলে ইমরানঃ ৫-৬
কুরআন মজীদের বিভিন্ন আলোচনা আল্লাহ তাআলার কোন না কোন সিফাতের (গুণ বৈশিষ্ট্য) মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। কোথাও কোথাও দুই দুইটি সিফাতও একত্রে উল্লেখিত হয়েছে। একটি সিফাত ব্যবহারের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ
(আরবী******************************************************************************)
নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে জ্ঞান রাখেন।
-সূরা নিসাঃ ৩২; সূরা আহযাবঃ ৫৪
(আরবী*****************************************************************************)
আল্লাহ প্রতিটি জিনিসকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছেন। -সূরা নিসাঃ ১২৬
একত্রে দুটি সিফাত ব্যবহারের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ
(আরবী*************************************************)
আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী। -সূরা নিসাঃ ৯৬, ৯৯, ১০০, ১৫২; সূরা ফুরকানঃ ৭০; সূরা আহযাব ৫, ৫০, ৫৯, ৭৩; সূরা ফাতাহঃ ১৪
(আরবী*********************************************************)
আল্লাহ বিশাল দৃষ্টিসম্প্ন ও সর্বজ্ঞ। -সূরা বাকারাঃ ২৭৪, ২৬১, ২৬৮; সূরা আলে-ইমরানঃ ৭৩; মায়েদা ৫৪; সূরা নূরঃ ৩২
(আরবী*********************************************************************)
বাস্তবিকই এই মহান বুদ্ধিজ্ঞানের মালিক ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।
-সূরা আলে ইমরানঃ ৬, ১৮
(আরবী*******************************************************************)
তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ওয়াকিফহাল এবং তাদেরকে দেখেন।
-সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৩০, ৯৬
একথা নিঃসন্দেহ যে, ঐ সিফাত বা গুণাবলী যখন উল্লেখিত হয় তার সাথে সাথে এমন সত্তার কথাও উল্লেখ করা হয়, যিনি এই বিশ্বজাহানের নিয়ামক। এই সিফাতগুলো এমনই এক সত্তার সাথে যুক্ত হতে পারে, যিনি তার একান্ত উপযোগী। শুধু তাই নয়, কুরআন মজীদে এরূপ কতক আয়াতও রয়েছে যাতে এই মহান সত্তার এক হাত, এক চোখ এবং দুই হাত, দুই চোখ ইত্যাদি উল্লেখ আছে। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী*********************************************************************)
যেন তুমি আমারই চোখের সামনে লালিত পালিত হতে পারো।–সূরা ত্বাহাঃ ৯
(আরবী*********************************************************************************)
তাদের হাতের উপরে রয়েছে আল্লাহর হাত।–সূরা ফাতহঃ ১০
ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে। বাঁধা রয়েছে তাদেরই হাত। তাদের এসব অশোভন বক্তব্যের কারণে তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। বরং আল্লাহর হাত উদার, উন্মুক্ত। তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন। -সূরা মাইদাঃ ৬৪
(আরবী**********************************************************************************)
আমার চোখের সামনে নৌকা তৈরি কর।–সূরা হুদঃ ৩৭
অনন্তর হাদীসের গ্রন্থসমূহে এ ধরনের অসংখ্য হাদীস হাদীস বর্তমান রয়েছে। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী**************************************************************)
আদমকে মহান দয়ালূ আল্লাহর আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে।–[এ হাদীসটি ‘মুজা’-এ (হাদীসের বিস্তারিত সূচী সম্বলিত গ্রন্থ) খুঁজে পাইনি। তবে প্রায় একই অর্থবোধক হাদীস তিরমিযীর মানবিক অধ্যায়ের ৭৪ অনুচ্ছেদে এবং মুসলিমের যুহদ অধ্যায়ের ৬০ অনুচ্ছেদে বর্তমান আছে।]
(আরবী****************************************************************************************)
জাহান্নাম অবিরত বলতে থাকবে, ‘আরো’ আছে কি? অবশেষে মহান প্রতিপালক আল্লাহ এর মধ্যে নিজের পা রাখবেন। তখন সে বলবে, তোমার সম্মান ও মর্যাদার শপথ! যথেষ্ট হয়েছে। অতঃপর এর বিভিন্ন অংশ সংকুচিত হয়ে যাবে।
-তিরমিযী ও বুখারীঃ সূরা কাফ-এর তফসীর অনুচ্ছেদ
(আরবী**********************************************************************************)
মুমিনের অন্তর মহান দয়ালু আল্লাহর দুই আংগুলের মাঝখানে রয়েছে। তিনি যেভাবে চান উলট-পালট করেন।–[এ হাদীসটিও মু’জামে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অনুরূপ অর্থবোধক হাদীস মুসনাদে আহমেদ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ১৭৩ পৃষ্ঠায় বর্তমান রয়েছে।-অনুবাদক]
উল্লেখিত আয়াত এবং এই ধরনের আরো অসংখ্য আয়াত বর্তমান রযেছে। কোন পাঠক তা পাঠ করবে আর কোন শ্রোতা তা শুনবে এবং তার চিন্তার রাজ্যে উল্লেখিত সিফাগুলোকোন আলোড়ন সৃষ্টি করবে না তা মোটেই সম্ভব নয়। যে সত্তার সাথে এই বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সংশ্লিষ্ট রয়েছে তাঁর সাথে তার সম্পর্কে সৃষ্টি না হওয়াটাও অসম্ভব। আমাদের এ প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলুললাহ (সঃ)-এর হাদীসে আল্লাহর সত্তা ও তাঁর গুণাবলীর যে বর্ণনা এসেছে –তা কি এতটা সুস্পষ্ট যে, এ সম্পর্কে কোন সংময় জাগতে পারে না? আমরা এর জবাবে পরিস্কার বলতে চাই, “হ্যাঁ। কেননা মানুষ যখন আল্লাহকে জানার সঠিক রাস্তা পেয়ে যায়, আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে তাঁকে কবুল করে নেয় এবং নিজের স্বভাব প্রকৃতির মাঝে তাঁর জন্য স্থায়ী আসন করে দেয়, তখন আল্লাহর ধারণা চূড়ান্তভাবে তার সামনে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে। উলুহিয়াতের অর্থ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তা যিনি মানুষকে তাঁর সম্পর্কে উচ্চ থেকে উচ্চতর চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা দান করেন। এই চিন্তার ক্ষেত্র এত ব্যাপক ও এত উচ্চ যে, মানুষ যখনই তাঁর সম্পর্কে চিন্তা করতে একটি স্তরে পৌঁছে যায় তখন এর চেয়েও উন্নত ও ব্যাপক স্তর তার চোখের সামনে হাযর হয়ে যায়। অনবরত এ অস্থাই বিরাজ করছে।
(আরবী*************************************************************)
তাঁরসদৃশের মত কেউ নেই, তিনি সবকিছু শুনেন ও দেখেন। -সূরা শূরাঃ ১১
সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের মন-মগজে এই ধারণাই বদ্ধমূল ছিল। সুতরাং তারা কখনও এই প্রশ্ন তোলেনি যে, আল্লাহর হাত বলতে কি বোঝায়, তাঁর চোখ, শক্তি বা ইলম (জ্ঞান) বলতেইবা আমরা কি বুঝি। তাঁদের স্বভাব-প্রকৃতিই তাঁদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এসব প্রশ্নের কোন জবাব নেই। যদি এর কোন জবাব কোথাও থেকে থাকে তাহলে মুমিন ব্যক্তির অন্তরে তাঁর মহানত্ব ও বুগর্যীর যে বাবধারা ও অনুভূতি বিরাজ করছে –তার মধ্যেই এর জবাব নিহিত রয়েছে। সে দেখতে পায় তার অন্তর এবং তার সমগ্র সত্তা এই মহান রাব্বুল আলামীনের শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব, গৌরব ও মহিমার সামনে অবনত হয়ে আছে। সে এক বাক্যে সাক্ষ্য দেয়, তিনি সবদিক থেকেই পরিপূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের স্বভাব-প্রকৃতি তাদেরকে আরো শিখিয়েছে যে, মানব বুদ্ধি তাঁর কোন আকৃতি নির্ধারণেও সক্ষম নয়। কেননা কোন আকৃতিই তাঁর মাধ্যমের আকৃতি নয়। তিনি হচ্ছেন স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা।
সেই আল্লাহ –যাঁর সাথে মানুষের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং যাঁর দিকে পথ দেখানোর জন্য কুরআন এসেছে এবং একনিষ্ঠভাবে যাঁর ইবাদত করার জন্য কুরআন আহবান জানাচ্ছে –মানুষের চিন্তায় ও মননে তাঁর সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট ধারণা বিরাজিত থাকা জরুরী ছিল। ফলে মানুষ তাঁকে সহজেই চিনতে পারত, তাঁর সাথে পরিচিত হতে পারত এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করার ক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে পারত। এটাও জরুরী ছিল যে, ইসলামী শরীআত মানুষের মনমগজে ‘ইলাহ’ সম্পর্কে একটা ধারণা বদ্ধমূল করে দিত, তাহলে আল্লাহ একটি বাস্তব সত্যেপরিণত হতেন, যাঁর ওপর মানুষ ঈমান এনে থাকে এবং নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। তাহলে কুরআন যে ধারণাটা পেশ করেছে তা কি? তিনি কি জড় না অজড়। তিনি কি সীমাবদ্ধ সত্তা না অসীম সত্তা?
এই নাযুক প্রশ্নে ইসলামের ভূমিকা একটি অন্যতম মহান নিদর্শন এবং একটি অলৌকিক মু’জিযা হয়ে বিরাজ করছে, যা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের রিসালাত ও নবুয়াতের সত্যতার প্রমাণ বহন করে। তা আরো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তিনি মানব জাতির সামনে যে পথনির্দেশ রেখেছেন তা মহান রাব্বুল আলামীন এবং আহকামুল হাকিমীনেরই শেখানো। আমরা এ সম্পর্কে চিন্তা করলে দেকতে পাই এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে নিগূঢ় রহস্য ,পরিপূর্ণ হিকমত ও কৌশল।
এক. ইসলামে আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণা কোন জড়বাদী ধারণা নয়। যদি তাই হত তাহলে আল্লাহ অনুভবযোগ্য দেহসর্বস্ব সত্তা হতেন। তিনি দেহসর্বস্ব হলে সীমতি হতেন এবং সীমিত হলে অনুভূতি ও দৃষ্টির সীমায় এসে যেতেন, অন্যান্য বস্তুর মত একটি বস্তুতে পরিণত হতেন, নির্দিষ্ট একটি জায়গায় তাঁর অবস্থান সীমিত থাকত এবং অবশিষ্ট জায়গায় তাঁর উপস্থিতি থাকত না, কেউ তাঁকে দেখতে পেত এবং কেউ দেখতে পেত না, এতে তাঁর গৌরব ও মহিমা হ্রাস পেতে থাকত, তাঁর সম্মান ও মর্যাদা কমতে থাকত এবং তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি লোপ পেতে থাকত।
আমরা সবচেয়ে বড় যে বস্তুটি চোখে দেখতে পাচ্ছি এবং এই জগতের উপর যার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করছি তা হচ্ছে সূর্য। এ কারণে কোন এক যুগে এটাকে প্রভুদের প্রভু জ্ঞানে পূজা করা হত।
কিন্তু সুস্থ কোন বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক এটা কখনো সমর্থন করতে পারে না যে, আল্লাহর কোন একটি নির্দিষ্ট আশ্রয়স্থল থাকতে হবে, কখনো তিনি সেখানে উপস্থিত থাকবেন এবং কখনো অনুপস্থিত। ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ব্যাপারটিই লক্ষ্য করুন। তিনি একবার তারকারাজির দিকে তাকালেন, অতঃপর চাঁদের দিকে। যখন উভয়টিই অস্তমিত হল তিনি বললেনঃ
(আরবী************************************************************)
(অস্ত যাওয়া জিনিসের প্রতি আমি মোটেই অনুরাগী নই)। অতঃপর তিনি সূর্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। কিন্তু যখন তাও ডুবে গেল, তিনি এসব কিছু বাদ দিয়ে এক মহান সত্তার সন্ধানে লেগে গেলেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
সে যখন সূর্যকে উজ্জ্বল-উদ্ভাসিত দেখতে পেল তখন বলল, এটাই আমার প্রভু। এটা সর্বাপেক্ষা বড়। কিন্তু যখন তাও ডুবে গেল তখন সে বলল, হে আমার স্বজাতি! তোমরা যাদেরকে আল্লহার শরীক বানাচ্ছ –তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি তো একমুখী হয়ে নিজের লক্ষ্য সেই মহান সত্তার দিকে কেন্দ্রীভূত করেছি যিনি যমীন ও আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই। -সূরা আনআমঃ ৭৮,৭৯
দুই. ইসলাম এও পছন্দ করেনি যে, আল্লাহ একটি অজড় বস্তু এবং স্রেফ একটি কল্পনার উস হয়েই থাকবেন, তাঁর কোন গুণবৈশিষ্ট্য থাকবে না এবং সৃষ্টির অন্তরালে তাঁর কোন ভূমিকা থাকবে না, যার মাধ্যমে তাঁর প্রকাশ ঘটতে পারে। বাস্তবিকই যদি তাই হত, তাহলে জ্ঞান-বুদ্ধির কাছে তিনি অনুধাবনযোগ্য হতেন না। কোন অন্তরও তাঁর প্রতি আশ্বস্ত হত না এবং মানুষের অস্তিত্ব ও তার কর্মকাণ্ডে তাঁর কোন প্রভাবও থাকত না।
ইসলামে ইলাহ সম্পর্কিত ধারণা এটাও নয় এবং ওটাও নয়। তিনি জড়ও নন এবং শুধু কল্পনার বস্তুও নন। ইসলাম মানুষের মন-মগজে ইলাহ সম্পর্কে যে ধারণা বদ্ধমূল করতে চায় তা কল্পনার বস্তু হিসেবেও নয় এবং দেহসর্বস্ব সত্তা হিসেবেও নয়। সুতরাং কোন ব্যক্তি কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে চাইলে সে আল্লহার এমন পরিচয় লাভ করবে যে, তিনি সবকিছু শুনেন, সবকিছু দেখেন, তিনি জ্ঞানের আধার, তিনি অসাধারণ শক্তি ও হিকমত ও কৌশলের অধিকারী, সবকিছুই তাঁর ইচ্ছাধীন, তিনি জীবন দান করেন এবং তা হরণ করেন। তিনি যেকোন জিনিসের ওপর শক্তিমান, এই মহাবিশ্বের তিনিই মালিক এবং রাজাধিরাজ, তিনি আরশে আযীমে সমাসীন, আরশের চারপাশে রয়েছে ফেরেশতাদের ভীড়। তারা তাঁর কোন নির্দেশ লংঘন করেন না, যে নির্দেশই তাদের দেওয়া হয়, তাই তারা পালন করে। এই গুণবৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মন-মগজে আল্লাহ তাআলার সত্তা সম্পর্কে একটি প্রতিচ্ছবির জন্ম দেয়।
এই ব্যক্তি পুনরায় যখন কুরআনের ওপর নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে সে দেখতে পাবে যে, তাঁর সদৃশের মত কিছুই নেই ( )। এই জিনিসটি তার চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করবে এবং ইতিপূর্বে তার মনে আল্লাহ সম্পর্কে যে জড়বাদী ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল তা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে বরফ গলার ন্যায় বিগলিত হতে থাকবে। যতদূর আমি অনুধাবন করতে পেরেছি, ইসলাম মানুষের মনে ‘ইলাহ’ সম্পর্কে এ ধারণাই বদ্ধমূল করতে চায়। এই ধারণাটি খুবই জরুরী ছিল যাতে আমরা তাঁকে নিজেদের অন্তরে বসিয়ে দিতে পারি, নিজেদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু বানাতে পারি এবং নিজেদের দোয়া ও ইবাদত তাঁর জন্য নিবেদন করতে পারি।
এই মহান সত্তার রহস্য অনুধাবন করা আমাদের ক্ষমতার অতীত। তিনি এতই সুমহান ও সমুন্নত যে, সে পর্যন্ত আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি পৌঁছতে পারে না। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে ধারণা লাভ করাও অত্যন্ত জরুরী ছিল। তাই কুরআন তাঁর এতটা নিদর্শন প্রকাশ করে দিয়েছে যা আমাদের প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হতে পারে এবং এ পথে আমাদের সাহায্যকারী হতে পারে। কুরআন আমাদের এতটা বলে দিয়েছেন যে, আল্লাহ কোন দেহসর্বষ্ব সত্তা নন। তিনি এমন এক সত্তা, যাঁর মধ্যে শ্রবণ, দর্শন, জ্ঞান, শক্তি, ইচ্ছা ইত্যাদি যাবতীয় বৈশিষ্ট্য বর্তমান রয়েছে। এগুলো রাব্বুল আলামীনের উপযুক্ত সিফাত বা বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ হচ্ছেন একটি সত্তা, কিন্তু তাঁর সত্তার সদৃশ কিছুই নেই।
আমরা কি জানি এবং কি জানি না
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একদিন তাঁর পাঠাগারের নিচের তলায় একটি ছোট আলমিরার কাছে দাঁড়ালেন। অতঃপর বললেন, “অজানার তুলনায় আমার জানার পরিধিটা এতই ক্ষুদ্র যেমন এই বিরাট পাঠাগারের মধ্যে এই ছোট্ট আলমিরাটি”।
আইনস্টাইন তাঁর এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ইনসাফ করেননি। যদি তিনি ইনসাফের সাথে কথা বলতেন তাহলে এভাবে বলতেন, “আমার জ্ঞানের পরিধি এর চেয়েও ক্ষুদ্র”। কেননা আমরা কোন একটি জিনিস সম্পর্কেও সঠিক জানি না যে, তা কি? আমরা এমন এক জগতে বাস করি যা তত্ত্ব ও শক্তিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু আমরা তার কতটুকু জানি? এতো হল এমন এক জগতের কথা, যেখানে আমরা বাস করছি, যাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারছি এবং যেখানে আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম করে যাচ্ছি। কিন্তু যেসব গ্রহ আমাদের নাগালের অনেক দূরে তার সম্পর্কে কি বলা যেতে পারে?
আমরা বলছি এই পৃথিবীর অণুর (Atom) দ্বারা গঠিত এবং অণু নিউট্রন (Neutron) দ্বারা গঠিত। কিন্তু অণু সম্পর্কে প্রায় প্রতি চার বছর অন্তর আমাদের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। আমরা অণু থেকে আণবিক বোমা তৈরি করছি কিন্তু আমাদের জানা নেই অণু কি জিনিস, এর তাৎপর্যইবা কি? আমরা বলে থাকি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই যেকোন জিনিস উপর থেকে নিজের দিকে পতিত হচ্ছে। প্রদীপের আলো বিদ্যুতেরই সমাহার। আমরা বিদ্যুতকে আয়ত্ত করে তার সাহায্যে গরম, ঠাণ্ডা এবং গতির সৃষ্টি করছি। কিন্তু বিদ্যুৎ কি জিনিস? এর রহস্য সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আমরা শুধু এতটুকুই জানি যে, তা কিবাবে ব্যবহার করা যায়।
স্বয়ং জীবন সম্পর্কে আজ পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতে পারিনি। অথচ তা আমাদের নিজেদের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের আশেপাশে যত জিনিসই রয়েছে এর গূঢ় রহস্য আমরা কিছুই জানি না। আমরা কেবল এর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখি। অন্য কথায় আমরা এতো জানি যে, জিনিসটি কি রকম, কিন্তু মূলত তা কি এবং কেন? এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
প্রেম ও ভালবাসা কি জিনিস? সৌন্দর্য কি জিনিস? স্বাধীনতা কি? যত অজড় বস্তু রয়েছে তা কি? এসব জিনিসের রহস্য আমরা কিছুই জানি না। জ্ঞানবুদ্ধির সাহায্যে আমরা কেবল এর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা অবগত হতে পারি। ধর্ম কি? আশা, ভয়, আকাংখা, বীরত্ব, পাপ, পূণ্য কি জিনিস? এগুলো কতগুলো বৈশিষ্ট্যমাত্র।
আমরা জাতি দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। এর ভগ্নাংশ বা এর সমন্বয়ে গঠিত সংখ্যা সম্পর্কেও আমাদের ধারণা আছে। কিন্তু অন্যান্য জিনিসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেই আমরা জানি, মূল জিসিটি সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি এতই দুর্বল এবং সীমিত যে, আমরা কোন বস্তুর নিগূঢ় তত্ত্ব পর্যন্ত পৌঁছতে পারি না।
প্রয়োগবাদে (Pragmatism) বিশ্বাসী লোকদের ঐ কথা অনেকটা ইনসাফের কাছাকাছি যে, মানববুদ্ধি নিগূঢ় রহস্য অনুধাবনে সক্ষম নয়। তা কেবল একটা সীমা পর্যন্ত পৌঁছার জন্য কিছুটা উপায়-উপকরণ খুঁজে বের করতে পারে মাত্র। যাঁরা বিজ্ঞানের গবেষণায় নিয়োজিত আছেন তাঁরা বলেন যে, তাঁরা কতগুলো বিধান প্রবর্তন করে নিয়েছেন, যেমন মাধ্যাকর্ষণবিধি, প্রাকৃতিক বিধান ও অপরসায়ন প্রণালী ইত্যাদি। তাঁরা এই দাবি করছেন না যে, এগুলো বস্তুর অন্তর্নিহিত গূঢ় তত্ত্বের ব্যাখ্যা, বরং তা এর বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাখ্যা। তাও আবার আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা নয়, বরং বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা।
তুবি বলে থাক যে, অমুক ব্যক্তি তোমাকে ভালবাসে এবং অমুক ব্যক্তি তোমাকে অপছন্দ করে। কিন্তু এই পছন্দ ও অপছন্দের রহস্য সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তত্ত্বের চেয়ে বাস্তব প্রয়োগ অনুধাবন করা সহজ। অন্য কথায় বাস্তব প্রয়োগের সাথে পরিচিত হওয়া তত্ত্বের পরিচয় লাভ করার তুলনায় অনেক সহজ। কেননা বাস্তব প্রয়োগের সম্পর্ক রয়েছে কাজের সাথে আর জ্ঞানের সম্পর্ক রয়েছে অনুধাবন শক্তির সাথে। আর আমরা তত্ত্ব অনুধাবন করার তুলনায় বাস্তব ক্ষেত্রে কাজ করার অধিক শক্তি রাখি। এজন্যই জীবন ধারণটা সহজ। কেননা এর সম্পর্কে রয়েছে বাস্তবতার সাথে। কিন্তু তত্ত্ব অনুধাবন করা কঠিন, কেননা তার সম্পর্ক হচ্ছে জ্ঞানের সাথে।
তুমি এটা সহজেই বুঝতে পার যে, তুমি নির্ভুলভাবে রেলগাড়ি তৈরি করতে পারলে তা কোনরূপ সংঘর্ষের সৃষ্টি করবে না, এর চাকাও খসে পড়বে না এবং যতদূর সম্ভব তুমি দুর্ঘটনা থেকেও নিরাপদ থাকতে পারবে। কোন কাজে তুমি যদি সঠিক পন্থা অনুসরণ কর তাহলে তাতে সফলকাম হওয়ার আশা রাখতে পার। কেননা এসব কিছুর সম্পর্ক বাস্তব প্রয়োগের সাথে, তত্ত্বের সাথে নয়। তোমার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেননা তুমি এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে যেতে পার, যা তুমি কখনো ধারণা করনি। রেলগাড়ি কখনো লাইনচ্যুত হয়ে যায়, কখনো এর সামনে মহিষ বা অন্য প্রাণী পড়ে যেতে পারে এবং এর সাথে ধাক্কা লাগতে পারে। কখনো তোমার মোটর গাড়ির এমন জিনিসের সাথে ধাক্কা লাগতে পারে, তুমি যার কল্পনাও করনি। এই অবস্থায় অজানা রহস্য সম্পর্কে আমরা আর কি বলতে পারি।
বাস্তব অবস্থা যখন এই, তখন আমরা কি করে আশা করতে পারি যে, বুদ্ধি, আত্মা, অনুভূতি এবং এ জাতীয় অন্যান্য জিনিসের নিগূঢ় রহস্য আমরা আয়ত্ত করতে পারব? আমরা শুধু এর বাহ্যিক দিকটার উপরই মন্তব্য করতে পারি, এর উৎসমূলে পৌঁছার শক্তি আমাদের নেই। যাঁরা অভিধান লিখেছেন অথবা যাঁরা পরিভাষাসমূহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন, তাঁরা যদি ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কাজ করতেন তাহলে এদিকে অগ্রসর হতেন না। কেননা এসব বিষয়ের গভীরে পৌঁছার শক্তি তাঁদের নেই। তাঁর শুধু নিজেদের ধারণা-কল্পনার চৌহদ্দির মধ্যে ডিগবাজি খাচ্ছেন।
এসব সংজ্ঞার সূক্ষ্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে –শুধু বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এই সংজ্ঞাগুলি নির্ণয় করা হয়েছে, নিগূঢ় রহস্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। অধিকাংশ লোকের জীবনে দেখা যায় ঝোঁকপ্রবণতা অলীক কল্পনাপ্রবণতাই তাদের পরিচালনা করেছে। সেখানে জ্ঞানের আলোকবর্তিকার কোন দখল নেই। সেখানে কুসংস্কার ও অলীক ধারণা অনুমানেরই প্রাধান্য দেখা যায়, বুদ্ধি বিবেকের কোন ভূমিকা নেই। যে জ্ঞান তার সবচেয়ে কাছের পারিপার্শ্বিক খবর রাখতে পারে না, তার কাছে দূরের এবং আরো দূরের খবরের ব্যাপারে আর কি আশা করা যায়! একথা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে মানুষের জ্ঞান কেন আল্লাহ তাআলার প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়? ব্যাপারটাকে ঠিক এভাবে বলা যায়, যে পৃথিবীর বুকে মানুষ বসবাস করছে, তার সম্পর্কেই সে অবহিত নয় অছত সে মঙ্গল গ্রহের অনুসন্দানে উঠে পড়ে লেগেছে। নিজের চোখের সামনে উপস্থিত জিনিসের সাথেই সে পরিচিত নয় অথচ ঊর্ধ্ব জগতের রহস্য সন্ধানে ব্যাকুল।
ইসলাম মানুষকে চিন্তার যে স্বাধীনতা দান করেছে, একদল লোক তার অপব্যবহার করে এর নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করেছে। তারা এই সীমার বাইরে চলে গেছে এবং নিস্ফল ও অর্থহীন বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। চিন্তার ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে কূটতর্কে লিপ্ত হয়েছে এবং প্রশ্ন তুলেছে –তাঁর গুণাবলী তাঁর সত্তার অন্তর্ভুক্ত কি না? ফলে তারা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। আর যে বিষয়টি তাদের চিন্তা ও কল্পনার আওতাবহির্ভূত সে সম্পর্কে তারা কি করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে? এমনি এই বিতর্ক যদি স্বয়ং মানুষের সত্তাকে কেন্দ্র করে হত, তবুও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা কষ্টকর হয়ে যেত। তাহলে আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে বিতর্কে জড়িয়ে পড়াটা কত দুঃসাহসিক ব্যাপার।
যেসব মুসলিম বিশেষজ্ঞ আলেক আকাইদ সম্পর্কে বই-পুস্তক লিখেছেন তাঁরা সৎ উদ্দেশ্যে কলম ধরেছেন। পূর্ববর্তী যুগের আলেমদের মধ্যে কেউই ইসলামের দুর্নাম করার বা নিজেদের মধ্য থেকে ইসলামের প্রভাবকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে আকাইদ শাস্ত্রের আলোচনা করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিতর্ক তাদেরকে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে যে, তারা পরস্পরের উপর মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দেন এবং অত্যন্ত জঘন্য পন্থায় পরস্পরের মস্তক ছিন্ন করেন।
বর্তমান যুগেও এ ধরনের লোকের মোটেই অভাব হয়নি। যারা সাধারণ মুসলমানদের এমন সমস্যায় জড়াতে চায়, যার সমাধান তারা করতে সক্ষম নয়, এর পরিণামে গোটা জাতি বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে পড়ে। অথচ এ সময় প্রয়োজন ছিল সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গেঁথে নিয়ে এবং বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলোকে একত্র করে জড়বাদী সভ্যতার মোকাবেলা করা। কেননা এই সভ্যতা ইসলামের শিকড় কাটতে এবং তৌহীদের সমুন্নত পতাকাকে ভুলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
আমাদের কিছু সংখ্যক লোক যদিও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথ অবলম্বন করেছেন তার অর্থ এই হতে পারে না যে, আমরা তাদেরকে নিজেদের মনগড়া অপবাদ আরোপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করব এবং তাদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে বহিষ্কার করে দেব। এটা নির্বোধের নীতি হতে পারে। আমাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আমরা সঠিক বক্তব্য তুলে ধরব, জনগণকে সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব এবং বিভেদে জড়িয়ে পড়া থেকে দূরে থাকব।
তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ
মহান আল্লাহ সম্পূর্ণ মুখাপেক্ষীহীন। তিন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও ঐশ্বর্যশালী হওয়ার তাত্ত্বিক অর্থ এই নয় যে, তিনি এই বিশ্ব, এই আসমান, এই যমীন এবং এর অভ্যন্তরভাগে লুক্কায়িত মূল্যবান ধাতু ও খনিজ সম্পদের মালিক।
তাঁর পরনির্ভরশীল না হওয়ার কারণ এই নয় যে, তিনি অসংখ্য জিন, ইনসান ও ফেরশতার মালিক। আল্লাহ তাআলার স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার নিগূঢ় রহস্য তা নয়। তিনি এসব কিছুর অনেক ঊর্ধ্বে এবং তিনি সম্মানিত ও গৌরবান্বিত সত্তা।
আমরা কোন ব্যক্তিকে অগাধ সম্পদের মালিক বলে ধারণা করি। কেননা তার মালিকানায় রয়েছে সোনা-রূপার স্তূপ, অথবা সে লাখো জনতার ওপর কর্তৃত্বের লাঠি ঘুরায়। কিন্তু যখন তার হাত থেকে এসব কিছুই চলে যায়, তখন সম্পদশালী হওয়ার কি অর্থ দাঁড়ায়? যে স্তম্ভের ওপর তার ঐশ্বর্যের ভিত্তি স্থাপিত ছিল, তাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
এই, সীমাহীন বিশ্বের সামান্য অংশ সম্পর্কে আমাদের কিছুটা ধারণা আছে, কিন্তু এর বিরাট অংশ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। এটাকেও মহান আল্লাহর ঐশ্বর্য ও স্বয়ংসম্পর্ণতার নিদর্শন বলা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও তার স্বয়ং সম্পূর্ণতার মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসবে না। তিনি পূর্বের মতই বিরাজমান থাকবেন, সৃষ্টিকুলের মুখাপেক্ষী হবেন না, পবিত্রতা ও গৌরবে ভূষিত থাকবেন। তিনি বিজয়ী হয়ে থাকবেন, তাঁর ক্ষমতা বিন্দুমাত্র হ্রাস পাবে না।
আরশ এবং এ ছাড়া যা কিছু আছে –এই মহামহিম সত্তার সামনে এর কোন অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। সৃষ্টির সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত অনুগত বান্দাদের ইবাদত বন্দেগী তসবীহ-তাহলীল ও গুণগান আল্লাহর গৌরব ও মর্যাদা না বৃদ্ধি করতে পেরেছে, আর না কখনো বৃদ্ধি করতে পারবে। অনুরূপভাবে যত পাপাত্মার জন্ম হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে –তাদের বিদ্রোহ ও নাফরমানী তাঁর গৌরব ও মর্যাদা বিন্দু পরিমাণ না কমাতে পেরেছে আর না কমাতে পারবে। হাদীসে কুদসীতে এসেছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এবং পরবর্তীগণ, সমস্ত মানুষ ও জিন যদি তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে আল্লাহভীরু ব্যক্তির মত হয়ে যায় –তাতে আমার রাজত্ব সামান্যও বৃদ্ধি পাবে না। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের যারা এসে গেছে এবং যারা আসবে, সমস্ত মানুষ ও জিন যদি তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় আল্লাহদ্রোহী ব্যক্তির মত হয়ে যায় –তাতে আমার রাজত্ব মোটেই সঙ্কুচিত হবে না।–[সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে হাদীসটি মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থের ৫ম খণ্ডে উল্লেখ আছে।]
ছোটবড় সমস্ত মাখলুক আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহেই টিকে আছে। আর আল্লাহ তাআলা স্বয়ং বিরাজমান, কোন সৃষ্টিরই তিনি মুখাপেক্ষী নন।