ইসলামী আকীদা
মুহাম্মদ আল-গাযালী
অনুবাদ: মুহাম্মদ মূসা
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
প্রকাশকের কথা
প্রখ্যাত মিসরীয় পণ্ডিত ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা শায়খ মুহাম্মদ আল-গাযালী বিরচিত ‘আকীদাতুল মুসলিম’ শীর্ষক গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ ‘ইসলামী আকীদা’। লেখক আলোচ্য গ্রন্থে ইসলামের মৌলিক তিনটি বিষয় নিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। বিষয় তিনটি হলঃ তৌহীদ, রিসালাত ও আখেরাত। ইসলামের যাবতীয় আকীদা সম্পর্কিত ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে এ তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
ইসলামী আকীদা বা বিশ্বাসজনিত বিষয়গুলো অনুধাবন করা সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য গভীর জ্ঞান, উপলব্ধি ও সদাজাগ্রত অনুভূতির প্রয়োজন। তবে আলোচ্য পুস্তকে জনাব গাযালী অতি সহজভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় বিষয়গুলো পাঠকদের সামনে পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম মহলে অমুসলিমদের মনগড়া জড়বাদী দর্শন ও যুক্তিজীবির ইসলাম বিরোধী দর্শন-চর্চার মোকাবেলা করার মত কোন পুস্তক এ যাবত প্রকাশিত হয়নি। এক্ষেত্রে মুহাম্মদ আল-গাযালীর লেখা ‘ইসলামী আকীদা’ গ্রন্থটি একটি অভিনব সংযোজন। গ্রন্থকার জীবিত নেই। আমরা তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে জান্নাত কামনা করি।
বর্তমান যুগ-পরিবেশে এ গ্রন্থখানির ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে পুনঃমুদ্রণ করা হল।
আশা করা যায়, গ্রন্থখানি পাঠক সাধারণের কাছে সমভাবেই সমাদৃত হবে।
-প্রকাশক
অনুবাদকের আরয
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা সায়্যিদিল মুরসালীন। ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি আজমাঈন। ‘ইসলামী আকীদা’ বইটি মূলত মিসরীয় লেখক এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুন-এর অন্যতম নেতৃস্তানীয় ব্যক্তিত্ব মুসলিম ব্যক্তিত্ব আল-গাযালীর লেখা ‘আকীদাতুল মুসলিম’ গ্রন্থের বাংলা রূপান্তর। ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগের উপর এই লেখকের অসংখ্য বই রয়েছে। আরবী ভাষী পাঠকের কাছে তা খুবই সমাদৃত হয়ে আসছে।
‘ইসলামী আকীদা’ গ্রন্থে লেখক ইসলামের তিনটি মৌলিক দিক তৌহিদ, রিসালাত এবং আখেরাত সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। ইসলামের যাবতীয় আকীদা-বিশ্বাস মূলত এ তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। লেখক প্রতিটি বিষয়ের সপক্ষে কুরআন ও হাদীস থেকে যুক্তি পেশ করেছেন। প্রতিটি জটিল বিষয়কে তিনি অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
‘আকদ’ শব্দ থেকেই ‘আকীদা’ এবং ‘ইতিকাদ’ শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি। ‘আকীদা’ বলতে এমন জিনিস বুঝায়, যার উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা যায় অথবা মানুষ যাকে নিজের দীন হিসেবে গ্রহণ করে এবং তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। এ শব্দটিরই বহুবচন হচ্ছে ‘আকাইদ’। ‘ইতিকাদ’ শব্দের অর্থ সত্য বলে মেনে নেয়া, অবিচল বিশ্বাস স্থাপন করা, দীন হিসেবে গ্রহণ করা। ইসলামী আকীদা বলতে এমন জিনিস বুঝায়, যার উপর ঈমান এনে একজন মানুষ মুসলমান হিসেবে পরিগণিত হতে পারে এবং যার উপর থেকে ঈমান প্রত্যাহার করে নিলে একজন মুসলমান ইসলামের গণ্ডি থেকে বাইরে চলে যায়।
আকাইদ শাস্ত্রের উপর আরবী ভাষায় প্রচুর বই-পুস্তক রচিত হলেও বাংলা ভাষায় এর উপর কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ এ পযন্ত রচিত হয়নি। ফলে এ বিষয়ের সাথে বাংলাভাষী পাঠকগণ বলতে গেলে একেবারেই অপরিচিত। মাদরাসাসমূহে এর কিছু সীমিত চর্চা থাকলেও তা নির্ভেজাল ইসলামী আকাইদ হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। তার উপর রয়েছে যুক্তিবাদ, প্লেটোবাদ, গ্রীক দর্শন, বেদান্ত দর্শন ইত্যাদির প্রভাব। তাছাড়া এর সাথে ইসলামী আকাইদের নামে যুক্ত হয়েছে এমন কতকগুলো বিষয়, যা ইসলামী আকীদার অন্তর্ভুক্ত নয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দর্শন বিভাগে এর কিছু চর্চা থাকলেও তা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে না; দর্শনের একটি আনুষঙ্গিক বিষয় হিসেবেই তা পড়ানো হচ্ছে।
আকাইদ শাস্ত্রের এই ত্রুটিপূর্ণ ও সীমিত চর্চার কারণে এ দেশের মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাসেও রয়েছে মারাত্মক ত্রুটি। বিশ্বাসের মধ্যে ত্রুটি থেকে গেলে যাবতীয় কাজের মধ্যে তার ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিফলিত হতে বাধ্য। এ কারণেই এখানকার মুসলমানদের মধ্যে কবর পূজা, পীরপূজা এবং শিরক-বিদআতের মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের বিশ্বাস হচ্ছে, কোন ব্যক্তিবিশেষকে উসিলা (মাধ্যম) না বানালে ঈমান ঠিক হবে না, আখেরাতে পার পাওয়া যাবে না এবং বেহেশতে প্রবেশ অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথচ এই মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎখাতের জন্যই ইসলামের আগমন। ইসলাম ঘোষণা করছেঃ আল্লাহ এবং বান্দার মাঝখানে কোন মধ্যস্বত্বভোগীর স্থান নেই। বান্দা সরাসরি তার প্রভুর কাছে আবেদন জানাবে।
ইমরান ইবনুল ফাসীল (রা) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললাম, সেই সত্তার শপথ যিনি আপনাকে নবুওয়াত দানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। সর্বোত্তম এমন কি জিনিস আছে, বান্দা যাকে মহান আল্লাহহর নৈকট্য লাভের উসিলা বানাতে পারে?” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ “প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশের অনুগত হও, তাঁর নির্দেশ পালন করার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য কর, মিথ্যা পরিত্যাগ কর এবং সত্যের সহায়তা কর” (আল-ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮)। তাদের আরো বিশ্বাস মুসলমানরা যত অপরাধই করুন না কেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের শাফাআত করে বেহেশতে পৌঁছিয়ে দেবেন।
লেখক এ জাতীয় অলীক ধারণা-বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছেন এবং ইসলামের সঠিক আকীদা-বিশ্বাসকে কুরআন ও হাদীসের আলোকে অত্যন্ত বলিষ্ঠ প্রমাণ সহকারে তুলে ধরেছেন। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য এ বইখানি যথেষ্ট উপকারী হবে বলে আমরা আশা রাখি।
মূল গ্রন্থের বাংলা প্রতিলিপি প্রস্তুত করার ব্যাপারে মুহতারাম আবদুল মান্নাত তালিব সাহেব (সম্পাদকঃ মাসিক ‘পৃথিবী’ ও মাসিক ‘কলম’) আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। যেখানে বিষয়বস্তু অত্যন্ত কঠিন মনে হয়েছে –তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করে বিষয়টিকে সহজ করে নিয়েছি। বলতে গেলে অনেক জায়গায় তিনি নিজ হাতে অনুবাদের প্রয়োজনীয় সংশোধনও করে দিয়েছেন। আরবী কবিতাগুলোর বাংলা কবিতারূপ তিনিই দিয়েছেন।
মূল গ্রন্থে হাদীসসমূহের কোন বরাত দেয়া হয়নি। আমি অনেক পরিশ্রম করে তার বরাত সংগ্রহ করেছি। এরপরও যেগুলোর বরাত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, ইনশাআল্লাহ পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে। কুরআনের আয়াতসমূহের তরজমনার ক্ষেত্রে তাফহীমুল কোরআন, মাআরেফুল কোরআন, বায়ানুল কোরআন এবং আল-কুরআনুল করীম (ফাউণ্ডেশন) অনুসরণ করা হয়েছে।
তারিখঃ ২৪ মুহাররম, ১৪০৬
১০ অক্টোবর, ১৯৯৬
মুহাম্মদ মূসা
গ্রামঃ শৌলা, পোঃ কালাইয়া
জেলাঃ পটুয়াখালী
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ জাল্লা শানুহুর জন্য। সালাত ও সালাম সর্বশেষ নভী রহমাতুল্লিল আলামীনের প্রতি। ইসলামের দুইটি দিক –একটি বিশ্বাসগত; অপরটি, ক্রিয়াগত। আকাইদ শাস্ত্র এই বিশ্বাসগত দিক অর্থাৎ ঈমান ও আকীদা নিয়ে আলোচনা করে। এটি বলতে গেলে তাত্ত্বিক, অতি সূক্ষ্ম, নিরস ও জটিল বিষয়। আর ফিকহ শাস্ত্র বিশ্বাসের ব্যবহারিক অর্থাৎ ক্রিয়াগত দিক ও তার বিধান নিয়ে আলোচনা করে। বর্তমান শতকের লেখক শায়খ মুহাম্মদ আল-গাযালী বিয়ষটিকে সরস, সজীব ও সহজবোধ্য করে তুলে ধরে তাঁর পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রধানত তিনটি পর্যায়ে আলোচনা করেছেন –তৌহিদ, রিসালাত ও আখেরাত। লেখক প্রতিটি বিষয়ের আলোচনায় কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি থেকেও যুক্তি পেশ করেছেন।
গ্রন্থখানি প্রথম, প্রকাশিত হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যে মুদ্রিত সকল কপি বিক্রি হয়ে যায়। বিভিন্ন অসুবিধার কারণে গ্রন্থখানি সত্বর পুনর্মুদ্রণ সম্ভব হয়নি। বিলম্বে হলেও ইফাবা কর্তৃপক্ষ গ্রন্থখানি পাঠকদের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছেন। আল্লাহর বান্দাগণ গ্রন্থখানি দ্বারা উপকৃত হলেই আমাদের শ্রম সার্থক হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে উত্তম প্রতিদান দিন। -আমীন।
বিনীত
অনুবাদক
তারিখঃ ঢাকা
জৈষ্ঠ্য, ১৩৯৯
যিলহজ্জ, ১৪১২
জুন, ১৯৯২
ভূমিকা
ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে কিছু কথা পাঠকদের সামনে পেশ করছি। গোটা দীনের ইমারত আকাইদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ আলোচনাটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখ এজন্য যে, আজ পর্যন্ত এই বিষয়কে সঠিক খাতে কমই প্রবাহিত করা হয়েছে। আমাদের ধর্মীয় সাহিত্যের মধ্যে এমন কিতাবের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত, যা বর্তমান যুগের মুসলমানদের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে এবং এদিক থেকে তাদের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আশ্বস্ত করতে পারে। এই অভাব অনুভব করেই আকাইদের দুরূহ আলোচনায় নেমেছি।
আকাইন সম্পর্কে আজ পর্যণ্ত যে ভঙ্গিতে আলোচনা করা হয়েছে তা থে কভিন্নতর ভঙ্গিতে আমরা এই আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করেছি এবং আকাইদের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিসমূহকে ভিন্নতর পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছি। জ্ঞান গবেষণার বাজারে কোন অভিনব সৃষ্টি উপস্থাপন করার আশায় আমি তা করিনি। বরং অতীন অভিজ্ঞতা, ইসলামের ইতিহাস সংঘটিত দুর্ঘটনা এবং কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা ও দলিল-প্রমাণের আলোকেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নাম সর্বস্ব ‘ইলমে কালাম’ অথবা ‘ইলমে তাওহীদের’ মধ্যে যে ব্যক্তিই আকাইদের আলোচনা পড়বে, আলেমগণ যেসব জটিল সমস্যায় ভুগছেন এবং তাদের মধ্যে এ বিষয়কে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক বাহাস চলছে, যে ব্যক্তিই তা অধ্যয়ন করবে, অতঃপর এই বিতর্কের পরিণতিতে যে ফলাফল সামনে এসেছে এবং বিশেষ ও সাধারণ নির্বিশেষে সবার ঈমান ও আমলের উপর যে প্রভাব পড়েছে, যে ব্যক্তিই তা মূল্যায়ন করবে –সেই ব্যক্তি মৌলিকভাবে কয়েকটি ধারণা কায়েম না করে থাকতে পারে না। আমরা কালামশাস্ত্রের যত বই-পুস্তক পাঠ করেছি তার আলোকে কালামশাস্ত্রের ধরণ ও নীতি-পদ্ধতির ব্যাপারে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
এক. বর্তমানে প্রচলিত কালামশাস্ত্রে প্রকাশভঙ্গী সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক। সেখানে কতগুলো বিষয় ঠিক করে তা থেকে কতগুলো নির্দিষ্ট ফলাফল বের করা হয় মাত্র। বর্তমান যুগের গণযন্ত্রের (Calculator) কাজের যে ধরণ, কালামশাস্ত্রের কাজের ধরণও অনেকটা তেমনি। অথবা তার ধরনটাকে পরিমাপযন্ত্রের সাথে তুলনা করা যায়। তা একটি কার্ডের উপর জিনিসের পরিমাণের অংকটা মুদ্রিত করে দেয় এবং কার্ডটি সম্পর্কে দলিল প্রমাণ পেশক রার ধরনটা সম্পূর্ণ তদ্রূপ। নিঃসন্দেহে কালামশাস্ত্রে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের সামনে এসেছে, যার ফলে আমাদের বুদ্ধিবিবেক প্রশান্তি লাভ করতে পারে।
কিন্তু ইসলামের প্রকাশভঙ্গীতার চেয়ে ভিন্নতর। সে কেবল বুদ্ধি-বিবেকেই সম্বোধন করে না। সে আকাইদের পুনর্গঠন করতে গিয়ে বুদ্ধি-বিবেক এবং হৃদয় উভয়কেই সম্বোধন করে। সে চিন্তা ও অনুভূতি উভয়কেই নাড়া দেয়। সে মানসিক শক্তিকে সজাগ করার সাথে সাথে আবেগ-অনুভূতিকেই জাগ্রত করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ইলমে তাওহীদ’ যেভাবে পড়ানো হয় আমি অতি কাছে থেকে তা পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি লক্ষ্য করেছি, এ্যালবাজরার সমাধানের (Algebraic Equation) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার সময় শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা যেরূপ হয়ে থাকে –তাওহীদের পাঠ গ্রহণ করার সশয় তাদের ঠিক তদ্রূপ মানসিক অবস্থা হয়ে থাকে। এ দু’টি বিষয়ের ব্যাখ্যার ধরণ এবং তার প্রভাবের মধ্যে আমি উল্লেখযোগ্য কোন পার্থক্য অনুভব করিনি।
ইলমে তাওহীদ এবং কালামশাস্ত্র নিঃসন্দেহে জ্ঞানকে প্রখর করে, কিন্তু অন্তরের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল ওয়াজুদ) এবং তাঁর চিরন্তনত্বের সপক্ষে ডজন প্রমাণ পেশ করা হয় কিন্তু শিক্ষার্থীদের অন্তর সেই মহান স্রষ্টার মহিমা-গৌরবের অনুভূতি থেকে শূন্য রয়ে যায়। যে মহান সত্তা তাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন, ভাল ও খারাপ কাজের অনুভূতি দান করেছেন –তাঁর জন্য সে নিজের অন্তরে আকর্ষণ ও ভালবাসা অথবা ভয়-ভীতির কোন উত্তাপ অনুভব করে না।
আকাইদ শিক্ষার পদ্ধতি কি এরূপ হওয়া উচিত ছিল? আকাইদ শাস্ত্রের এই স্থবিরতার ফলে লোকেরা তাসাউফের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়। এখানে তারা নিজেদের যে পিপাসা নিবারণ করতে পারেনি, তাসাউফের কাছে তা নিবারণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাসাউফ এমন একটি উপত্যকা যেখানে পদঙ্খলনের আশংকাই অধিক। এখঅনে পথ খুব কমই পাওয়া যায়, বরং পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাসাউফ এমন একটি প্রস্তরময় মরুভূমি, যেখানে পরিভ্রমণকারী সাধারণত নিজের গন্তব্য স্থান সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাসাউফ যে আল্লাহ প্রেমের কিছুটা উত্তাপ সৃষ্টি করে তাতে সন্দেহ নেই। তা অন্তরকে বিশ্ব স্রষ্টার সাথে কিছুটা সংযুক্ত করে বটে, কিন্তু এই পথে পা পিছলে যাওয়ার এত বেশি আশংকা রয়েছে যে, তা চিন্তা করলে শরীর শিউরে উঠে।
আকাইদের যে আলোচনা আজ পর্যন্ত শুষ্ক, নিরানন্দ এবং নিরেট দার্শনিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে কিছুটা উষ্ণতা ও জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমি চেষ্টা করেছি। এজন্য আমি কিতাব ও সুন্নাতকে চলার পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করেছি।
দুই. যে অবস্তা ও পরিবেশের মধ্যে আকাইন শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ ঘটেছে তা এই শাস্ত্রের মেজাজ-প্রকৃতির উপর গভীর এবং খারাপ প্রভাব বিস্তার করেছে। রাজনৈতিক সংঘাত এবং ফেরকাগত বিরোধ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রচলিত বিতর্কে শত্রুতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, অপবাদ ও সমালোচনার এমন ধ্বংসাত্মক বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে যে, কয়েক শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আজ পর্যন্ত আমরা সেই তিক্ত ফল ভোগ করছি। প্রচণ্ড বিরোধ ও সংঘাতময় পরিবেশে প্রকৃত সত্যের সন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ অবস্থার যদি প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভবও হয় তাহলে তাকে উদার মনে গ্রহণ করে নেয়াটা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এরূপ ধারণা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় যে, যদি আমরা মনে করি যে, কোন বিতর্ক অনুষ্ঠানে একত্র হয়ে আকাইদের মূলনীতিসমূহ নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেখানে শব্দের মারপ্যাঁচ, ফেরকাগত স্বার্থে কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা এবং বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা প্রবল থাকে, যেখানে হাতে থাকে এরিস্টটলীয় দর্শনের তীর এবং সেই তীরের আঘাতে নিজের প্রতিপক্ষকে জনসমক্ষে অপদস্থ করার মনোভাব কার্যকর থাকে, সেখানে এরূপ জটিল বিষয়ের সমাধান বের করা মোটেই সম্ভব নয়।
আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তীদের ক্ষমা করুন, এ ধরনের বিতর্কে তাঁরা আগ্রহের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন এবং তাকে আরো মারমুখী করে তোলেন। অথচ এ সময় মুসলিম রাষ্ট্রশক্তিই দুনিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এভাবে তাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং আল্লাহর পথে জিহানের পরিবর্তে বিতর্কের এ ভয়ংকর ময়ধানে পরস্পর মল্লাযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ফলে তাঁরা শত্রুদের প্রতি দৃষ্টি রাখার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকেন। তাঁরা অতীত হয়ে গেলেও এই বিতর্কযুদ্ধ আজ সশরীরে বিরাজমান। তাঁদের অবিনশ্বর দেহ বিলীন হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁদের পারস্পরিক ঝগড়া এখনো বেঁচে আছে। …আর তা মুসলিম মিল্লাতের ঐক্যের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক এবং তার অস্তিত্বের জন্য স্থায়ী বিপদে পরিণত হয়ে আছে।
ইসলামী বিশ্ব জঙ্গী খ্রিষ্ট জগতের সামনে শেষ পর্যন্ত মাথা হেট করে দিয়েছে এ মর্মান্তিক চিত্রও আমরা দেখেছি। ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের চিন্তাগত বিরোধের ফলেই ঘটেছে এই পরাজয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এই পুঁতিগন্ধময় ঐতিহাসিক বিতর্কের ঝড় চলছেই। দুঃখের বিষয়, আজ যারা ইসলামের খেদমতের দাবিদার –তাদের কোন কোন দল নেই ঝগড়াকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
আমি বুঝতে পারছি না –মুসলিম মিল্লাতের মত অন্য কোন মিল্লাতে আজ চিন্তার ঐক্য ও আবেগের একাত্মতার এত বেশি প্রয়োজন আছে কি? অতএব কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দিলে তাকে মিল্লাতের চিন্তাশীল ও মননশীল ব্যক্তিদের গণ্ডী থেকে বের করে এনে জাতীয় পর্যায়ে দাঁড় করানোটা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুসলিম উম্মাতের সাথে প্রকাশ্য দুশমনিরই নামান্তর বলা যায়। বাকযুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে উস্তাদ আহমাদ ইজ্জাত পাশা বলেনঃ
এটা এমন কোন ঝগড়া ছিল না যা বৈঠকে আলোচনা, তর্কশাস্ত্রের পরিধি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের সীমা অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু আমরা এই অর্থহীন বিতর্কের মধ্যে মহামহিম আল্লাহর নামকেও ঢুকিয়ে দিয়েছি।
অতএব আমাদের মধ্যকার প্রতিটি দল প্রতিপক্ষকে কাফের বলে ফতোয়া দেয়ার চেষ্টায় রত হল। এভাবে এই প্রাথমিক বিরোধ মাযহাবী যুদ্ধের রূপ নেয়, যার লেলিহানশিখা নির্বাপিত হচ্ছে না। জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের মধ্যকার বিরোধ মূলত এখান থেকে শুরু হয় যে, একদল বললঃ বান্দা নিজেই তার কাজের স্রষ্টা। তারা কর্তার পরিবর্তে স্রষ্টা শব্দের ব্যবহার করে। তারা বলেঃ বান্দা তার ইচ্ছার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
এই আকীদা সঠিকই হোক অথবা ভ্রান্ত হোক –তা ইলমী বাহাসের বিষয়বস্তু হতে পারে। এতে উভয় দলের সর্বাধিক এতটুকু অধিকার অবশ্যই ছিল যে, একদল অপর দলের মত প্রত্যাখ্যান করতে পারত, তার সমালোচনা করতে পারত এবং তার ভ্রান্তি ও অজ্ঞতা তুলে ধরতে পারত। কিন্তু ব্যাপারটা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকল না।
কাদরিয়া সম্পদ্রায় বললঃ আমাদের আকীদাকে স্বীকার না করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা যদি আখেরাতে কাউকে শাস্তি দেন তাহলে তিনি জুলুমই করবেন।
অপর দল বললঃ তোমরা আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপকতা এবং তাঁর কুদরতের সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করছ। এটা কুফরীরই শামিল।
প্রাথমিক পর্যায়ে এ দরনের মতবিরোধ চলছিল। অতঃপর কালের প্রবাহে তার ক্ষেত্র বিস্তর হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তা থেকে অদ্ভূত ও অযৌক্তিক মতবাদের জন্ম হতে থাকে।
মতবিরোধ এবং বিতর্ক এতটা আকর্ষণ সৃষ্টি করে যে, আকাইদের মধ্যে অনেক হাস্যকর ও যুক্তিহীন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং মুতাযিলা সম্প্রদায় এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মধ্যে এও একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে পড়েছে যে, যাদুর তাৎপর্য কি? মেঘ কিভাবে সৃষ্টি হয়? এই হাস্যস্পদ কথার কি কোন আগামাথা আছে?
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং অপরাপর সাহাবীর মধ্যে খিলাফতের প্রসঙ্গ নিয়ে যে মতবিরোধ হয়েছিল, আজও মুসলমানরা তাতে জড়িত হয়ে নিজেদের ঐক্যকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। এই উম্মাত ছাড়া জমিনের বুকে আর কোন উম্মাত আছে কি, যারা নিজেদের বিস্মৃত অতীতের ইতিহাসের মর্মান্তিক বিবাদকে এভাবে চোষণ করে?
আবার এ ব্যাপারটিকে আমরা কোন আকীদার বিষয়বস্তুর মধ্যে ঢুকাচ্ছি? এটাকে আমরা কেন অন্যাণ্য ঐতিহাসিক ঘটনার মত শুধু ঐতিহাসিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছি না? কেন লোকেরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে? আমরা যদি কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেই যে, অমুক ব্যক্তি ভুল করেছে এবং অমুক ব্যক্তি ঠিক করেছে তাহলে আমাদের এই ফয়সালার সাথে আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমানের কি সম্পর্ক আছে? অথচ আল্লাহ তাআলার পরিস্কার বাণী রয়েছেঃ
তারা ছিল একটি দল যা অতীত হয়ে গেছে। তারা যা কিছু অর্জন করেছে তা তাদের জন্য; আর তোমরা যা কিছু অর্জন করবে তার ফল তোমরাই ভোগ করবে। তারা কি করছিল তা তোমাদের কাছে জিজ্ঞেস করা হবে না। -সূরা আল-বাকারাঃ ১৩৪ এবং ১৪১ আয়াত
আজ যখন আমরা আমাদের দ্বীনী পুস্তিকাসমূহে নামসর্বস্ব সালাফী এবং অ-সালাফীদের বাকবিতণ্ডার প্রতি লক্ষ্য করি তখন দেখতে পাই, তাদের মুখে নিজেদের ভাইদের জন্য কুফরী ও ফাসেকীর শব্দ এমনভাবে উচ্চারিত হচ্ছে যেন পায়ের আঘাতে খেলার বল অহরহ ডিগবাজি খাচ্ছে। এই অবসন্ন জাতির দুর্বল শরীরে ধ্বংসাত্মক ব্যাধি নিজের বাসা বানিয়ে নিয়েছে এবং তা অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং একনিষ্ঠ ও নিঃস্বার্থপ্রাণ পথপ্রদর্শকের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
এই অনর্থক মতবিরোধ উম্মাতের মন-মানসিকতায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তাদের জীবনে এর প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরো দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই মতবিরোধের যে ভাল দিক রয়েছে তাতে তারা হাতও লাগায়নি, কিন্তু ক্ষতিকর দিকটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে।
যদিও আমাদের পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্যে এই মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে, আমলছাড়া ঈমানের অস্তিত্ব সম্ভব কি না? আমলে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য উপাদান, না আনুসঙ্গিক বিষয়? তবুও সাধারণ মুসলমানদের কাছে একথাই গৃহীত হল যে, ঈমানের জন্য আমল জরুরী নয়, আমল ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, শুধু তার রং এবং পালিশ। এভাবে মিল্লাতে ইসলামিয়া এই মতবিরোধকে নিজেদের কর্মবিমুখতার সপক্ষে বাহানা হিসাবে দাঁড় করেছে।
যদিও পূর্ববর্তীদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে, মানুষ সংকল্প এবং কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন, না কোন অদৃশ্য শক্তির অধীন? এ ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে একথা অগ্রাধিকার পেল যে, মানুষ স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতার মালিক নয়, সে সম্পূর্ণরূপে পরাধীন, অসহায়, নিয়ন্ত্রিত এবং হুকুমের দাস। এভাবে মুসলিম সমাজ কাপুরুষতা, হীনমন্যতা ও নিরুৎসাহের শিকার হয়ে পড়ে।
পূর্ববর্তীদের মধ্যে বিতর্ক চলল যে, মুসলমানরা জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তিদের উসীলা ছাড়া আল্লাহর দরবারে হাযির হতে পারে কিনা? তখন মুসলমানদের মধ্যে এই কথাই সাধারণভাবে গৃহীত হল যে, পীর-ওলীগণের মধ্যস্থতার একান্ত প্রয়োজন। যদি কেউ কোন পীরের মধ্যস্থতা ছাড়া আল্লাহর দরবারে পৌঁছার দুঃসাহস করে তাহলে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এর ফলে সমাজে শিরকের ধ্বংসাত্মক বিষ ছড়িয়ে পড়ল এবং আসমান-যমীনের স্রষ্টার সাথে আমাদের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে গেল।
এভাবে মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে পাপের অসংখ্য ব্যাধি জন্ম নেয়, যা উম্মাতের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উম্মাতের পতনের জন্য এগুলোই অনেকাংশে দায়ী।
আমি ইসলামী আকীদার সঠিক চিত্র পেশ করতে গিয়ে এসব বিরোধের কাঁটা থেকে নিজের কাপড় বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। যেখানে এই বিরোধ থেকে দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব ছিল, সেখানে আমি নিজের দৃষ্টিকে বাঁচিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু যেখানে তার প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি, সেখানে তার প্রতিবাদ করেছি এবং যে কথা আমার কাছে অধিকতর সঠিক মনে হয়েছে, তা ব্যক্ত করেছি। কোথাও প্রতিপক্ষের অজ্ঞতাকে চিহ্নিত করতেও হয়েছে –কিন্তু তার উপর কুফরীর ফতোয়া চড়ানো থেকে অবশ্যই বিরত থেকেছি। অজ্ঞতাকেও শুধু এজন্যই চিহ্নিত করেছি যে, আমার মতে এই অজ্ঞতাই অনেক জটিল সমস্যার মূল কারণ। তাই তা চিহ্নিত করা একান্তই প্রয়োজন।
অনেক সময় এ ব্যাপারে আমাকে কোন কোন ব্যক্তির বদমেজাজ ও কর্কশ ব্যবহারের শিকার হতে হয়েছে। আমি তার প্রতিটি কথার জবাব দেওয়ার পরিবর্তে তা উপেক্ষা করে যাওয়াই উত্তম মনে করেছি। তার কারণ এই যে, এমন এক উম্মাতের সাথে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে, যাদের এ সময় ঐক্য ও সংহতি একান্ত প্রয়োজন। অতএব আমাদের নিজেদের স্নায়ুর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে তার মূল্য আদায় করতে হবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমাদের হিসাব নেবেন।
তিন. আকাইদ শাস্ত্রের অবস্থা তো এই, যা আমরা উপরে বর্ণনা করেছি। এখন এই বিষয়ের উপর আমাদের এখানে যেসব বই-পুস্তক পাওয়া যাচ্ছে তা উদ্দেশ্যের দিক থেকে চরমভাবে ব্যর্থ, বাহ্যিক সাজসজ্জা, ছাপা ও বাঁধাইয়ের দিক থেকেও এবং বিষয়বস্তু ও তথ্যের দিক থেকৈও বাহ্যিক দিক থেকে বলতে গেলে কোন জ্ঞান-ভাণ্ডারকেই এভাবে তুলে ধরা হয় না। একদিকে মূল পাঠ, অপরদিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আরেক দিকে টীকা-টিপ্পনী। তা এমন বিক্ষিপ্তভাবে বিন্যস্ত যে, একটি অপরটির সাথে একাকার হয়ে গেছে। তার উপর বিশ্রী ভাষা এবং দুর্বল প্রকাশভঙ্গী।
আমাদের এ যুগে সাহিত্য এত উন্নতি লাভ করেছে যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ লেখক ও সাহিত্যিকগণ ভাষার উপর এতটা দক্ষতা অর্জন করেছে যে, তারা অতি সাধারণ বিষয়কেও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক রীতিতে উপস্থাপন করেন। এভঅবে তারা হাজারো মানুষকে নিজেদের যাদুকরী বর্ণনার প্রভাবে যেদিকে চান সেদিকে টেনে নিয়ে যান। তাহলে আমাদের আকাইদ শাস্ত্র কি অপরাধ করেছে যে, তা মূল পাঠ আর টীকাসহ ক্ষয়িষ্ণু, প্রাণহীন ও দুর্বল ভঙ্গিতে পেশ করা হবে?
আমরা এই বাহ্যিক ত্রুটিগুলো উপেক্ষা করলেও তার অভ্যন্তরীণ ও সৌন্দর্যগত ত্রুটিও কম নয়। আমরা যখন আকাইদ শাস্ত্রের উপর সমালোচনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তখন প্রথম দৃষ্টিতেই অনুভব করতে পারি যে, আল্লাহ তাআলার সত্তা এবং তাঁর গুণাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামী সংস্কৃতির এই শাখাটি গ্রীক, ইহুদী ও অন্যান্য দর্শনের দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বিজাতীয় দর্শনের প্রভাবে ইসলামী আকীদার সাথে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানভাণ্ডার নিজস্ব রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং আকাইন শাস্ত্রের উপর লিখিত বই-পুস্তক দর্শনশাস্ত্রের পরিভাষা, দৃষ্টিভঙ্গী এবং তার চিন্তাধারার জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে।
কত বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, ইসলামী সংস্কৃতির এই বিভাগটির উপর আলোকপাত করতে গিয়ে পূর্ববর্তী যুগের আকাইদ শাস্ত্রবিদগণ গ্রিক দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বারা নিকৃষ্টভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাঁরা ইসলামী সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার মধ্যে এই বিষ মিশ্রিত করে রেখে দিয়েছেন। আমরা তাঁদের এই ভূমিকার রহস্য ও দূরদর্শিতা অনুধাবন করতে অক্ষম। অবশ্য ইসলাম মানুষকে চিন্তার যে স্বাধীনতা দিয়েছে তা থেকে বিষয়টি প্রমাণিত হয়। নিঃসন্দেহে ইসলামের জ্ঞানচর্চা কোন বিশেষ দেশ বা জাতিপ্রীতির সংকীর্ণ পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। বরং সারা দুনিয়াই তার বিচরণভূমি।
কিন্তু এও কম দুঃখজনক ব্যাপার নয় যে, আমাদের পূর্ববর্তী আকাইদ শাস্ত্রবিদদের এই কর্মপন্থার ফলে ইসলামী আকাইদ গ্রীক দর্শনের পরিভাষা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুমান এবং এই দর্শনের প্রবক্তাদের বক্তব্যের মধ্যে হারিয়ে যায়। এখন সম্পূর্ণ নতুন ভঙ্গীতে ইসলামী আকীধার উপর বই-পুস্তক রচনা করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা অবশ্যই ইসলামী আকীদার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল হতে হবে।
এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, অন্তরের অন্তস্থলে ইসলামী আকাইদের শিকড় তখনই মজবুত হতে পারে এবং উম্মাত তার ফল তখনই ভোগ করতে পারে, যখন এ ব্যাপারে ইসলামের অনুসৃত প্রকাশভঙ্গী অনুসরণ করা হবে এবং তাকে ইসলামের অনুসৃত পন্থায় উপস্তাপন করা হবে।
কী আশ্চর্যের ব্যাপার, ইলমে কালামের উপর যেসব মৌলিক গ্রন্থ রয়েছে তা একনাগাড়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ে গেলেও কোথাও কোন আয়াত অথবা হাদীস দেখা যাবে না। যদি কোথাও তার চেহারার সামান্যতম অংশও নযরে পড়ে তাহলে তা অন্ধকার রাতে জোনাকির আলো অথবা মরুভূমির সবুজের সাথে তুলনীয়।
সম্ভবত দর্শনশাস্ত্রের রুচিসম্পন্ন কিছু লোক এসব বইয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। এজন্য আমরা তাদের তিরস্কার করছি না। কিন্তু একে কিবাবে মেনে নেওয়া যেতে পারে যে, ইসলামী আকাইদকে তার মূল উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হবে অথবা তার মূল ভিত্তি থেকে পৃথক করে রাখা হবে?
আল্লাহ সত্য কথাই বলেন এবং তিনিই সঠিক পথ দেখান। -আহযাবঃ ৪
মুহাম্মদ আল-গাযালী