শরীয়াতের বিধি-বিধান
এ সর্বশেষ অধ্যায়ে আমি শরীয়াতের নীতি ও বিশেষ বিশেষ বিধান সমূহের কথা বলব। তা থেকে বুঝতে পারা যাবে, ইসলামী শরীয়াত কিভাবে মানুষের মনকে সুষ্ঠু সুন্দর বিধানের অনুগত করে দেয় এবং সে বিধানগুলো কতটা জ্ঞানগর্ভ।
শরীয়াতের নীতি
প্রত্যেকেই নিজের অবস্থা সম্পর্কেই চিন্তা করলে বুঝতে পারে যে, সে বহুবিধ শক্তি নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে এবং তার ভিতরের প্রতিটি শক্তির দাবী হচ্ছে এই যে, সে তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাবে। তাদের মধ্যে বুদ্ধি বৃত্তি, ইচ্ছা, আকাংখা বাকশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, রসাস্বাদন ক্ষমতা, হাত-পা পরিচালনার ক্ষমতা, ঘৃণা ও ক্রোধ, প্রীতি ও আকর্ষণ, ভীতি ও প্রলোভন রয়েছে কিন্তু এর কিছুই নিরর্থক নয়। তাদের প্রয়োজনের চাহিদা মেটাবার জন্য এসব জিনিস দেয়া হয়েছে। আল্লাহ দুনিয়ার মানুষকে যেসব শক্তিদান করেছেন, মানুষ সঠিকভাবে তার সদ্ব্যবহার করলে তার উপর নির্ভর করবে তাদের দুনিয়ার জীবন ও তার সাফল্য।
আরো দেখতে পাওয়া যাবে যেসব শক্তি মানুষের মধ্যে দেয়া হয়েছে সেই সংগে তা কাজে লাগাবার মাধ্যমও দেয়া হয়েছে। সবার আগে রয়েছে মানুষের দেহ; তার মধ্যে জরুরী যন্ত্রপাতি সবই মওজুদ রয়েছে। তারপর পারিপার্শ্বিক দুনিয়া যাতে প্রত্যেক ধরনের সংখ্যাতীত মাধ্যম আগে থেকেই তৈরী হয়ে আছে। মানুষের সাহায্যের জন্য মওজুদ রয়েছে তার একই জাতীয় মানুষ। তার খেদমতের জন্য রয়েছে জানোয়ার, গাছপালা, খনিজ দ্রব্য, যমীন-পানি, হাওয়া, তাপ আলো, আরো এমন সংখ্যাতীত জিনিস। আল্লাহ এসব কিছু পয়দা করেছেন এ জন্য যে মানুষ তাদেরকে কাজে লাগাবে এবং জীবনযাপন করার জন্য তাদের থেকে সাহায্য গ্রহণ করবে।
এবার আর একটি দিক বিবেচনা করা যাক। যেসব শক্তি মানুষকে দেয়া হয়েছে তাদের কল্যানের জন্য দেয়া হয়েছে, ক্ষতির জন্য নয়। তা কাজে লাগাবার সঠিক পন্থা হবে, তাই, যাতে কেবল কল্যাণই লাভ হবে, কোন ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না। অথবা ক্ষতি হলেও তা যথাসম্ভব কম হবে। যুক্তি অনুসারে অন্যবিধ পন্থায় তা ব্যবহার করলে ভুল হবে। কেউ নিজে যদি এমন কোন কাজ করে যাতে তার নিজেরই ক্ষতি হয়, তা হলে অবশ্যি ভুল। যদি কেউ তার নিজস্ব শক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগায়, যাতে অপরের ক্ষতি হয়, তা হলে তা হবে ভুল। কোন শক্তি অপব্যবহার করে যদি কেউ আল্লাহর দেয়া উপায়-উপাদানের অপচয় করে, তবে তাতেও ভুল করা হবে। প্রত্যেকেই যুক্তি ক্ষমতা এ সাক্ষ্যই দেবে যে, সকল প্রকার ক্ষতিকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং তা স্বীকার করতে হবে তখনই, যখন তাকে এড়িয়ে চলা কোন ক্রমেই সম্ভব হয়না অথবা তার পরিণাম কোন বৃহত্তর কল্যাণের সম্ভাবনা থাকে।
এরপর আরো সামনে এগিয়ে চলা যাক। দুনিয়ায় দু’রকমের লোক দেখা যায়। এক ধরনের লোক ইচ্ছা করে তাদের কোন কোন শক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগায়, যাতে সেই শক্তি তাদের নিজেদের অন্য কোন শক্তির ক্ষতিসাধন করে বা অন্যেরা তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথবা তাদেরকে দেয়া উপায়-উপাদানের অপব্যবহার করে; অথচ সেইসব জিনিস তাদেরকে দেয়া হয়েছিল নিছক কল্যাণের জন্য অপচয়ের জন্য নয়। অপর শ্রেণীর লোকেরা ইচ্ছা করে তেমন করে না, কিন্তু তাদের অজ্ঞতা বশত ভুল হয়ে যায়। প্রথমোক্ত দলের লোকরা হচ্ছে দুস্কৃতিকারী এবং তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য প্রয়োজন হয় আইন ও বিধানের। অপর যে শ্রেণীর লোক জ্ঞতা হেতু ভুল করে, তাদের জন্য প্রয়োজন এমন শিক্ষা ব্যবস্থা, যাতে তারা নিজস্ব শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাবার নির্ভুল পন্থা উপলব্ধি করতে পারে।
আল্লাহ তা’য়ালা যে শরীয়াত তার পয়গাম্বরের মারফতে প্রেরণ করেছেন, তাতে এ প্রয়োজন মিটানো হয়েছে। দুনিয়ার মানুষের কোন ক্ষমতাকে বিনষ্ট করার, কোন স্বাভাবিক আকাংখাকে দমিত করার অথবা মানুষের অনুভুতি ও আবেগকে নিশ্চিহ্ন করার কোন উদ্দেশ্যই তাতে নেই। শরীয়াত মানুষকে কখনো বলে নাঃ দুনিয়াকে বর্জন কর, উপবাস ও বিবস্র হয়ে পাহাড়ে জংগলে জীবন অতিবাহন কর, আত্মার দাবী অস্বীকার করে নিজেকে কষ্ট সাধনায় নিক্ষেপ কর, জীবনের সকল স্বাচ্ছন্দ্য–সকল সুখকে নিজের জন্য হারাম করে দাও। শরীয়াত কখনো এ শিক্ষা দেয় না। এ হচ্ছে আল্লাহর তৈরী শরীয়াত এবং আল্লাহই এ দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন মানুষের স্বাচ্ছন্দের জন্য। কি করে তাঁরে এ কারখানা ধ্বংস করে দিতে চাবেন? মানুষের ভিতরে কোন শক্তিই তিনি নিরর্থক– অপ্রয়োজনে দান করেননি। কোন কাজে লাগানো যাবেনা এমন জিনিস তিনি যমীন আসমানে কোথাও তৈরী করেননি। তিনি তো এ-ই চান যে, দুনিয়ার এ কারখানা পূর্ণ উদ্যমে চলতে থাকবে, মানুষ তার প্রত্যেকটি শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাবে; দুনিয়ার প্রত্যেক জিনিস থেকে পূর্ণ কল্যাণ লাভ করবে এবং যমীন আসমানের যত রকম উপায়-উপকরণ নির্ধারিত হয়ে আছে, তার সবকিছুকে সে সঠিকভাবে ব্যবহার করবে; উপরোক্ত এধরনের অজ্ঞতা ও দুস্কৃতি দ্বারা তারা নিজেদের ও অপরের ক্ষতি সাধন করবে না।
আল্লাহ শরীয়াতে সকল বিধান ও তৈরী করে দিয়েছেন এ উদ্দেশ্যে। যা কিছু মানুষের জন্য অকল্যাণকর শরীয়াতে সেগুলো হচ্ছে হারাম (নিষিদ্ধ) আর যা কিছু কল্যাণকর, তা হচ্ছে হালাল (বৈধ), যে কাজ করে মানুষ নিজের বা অপরের ক্ষতি সাধন করে শরীয়াতে তা নিষিদ্ধ। তার পক্ষে যা কিছু কল্যাণকর এবং যাতে অপরের কোন ক্ষতি নেই, এমনি সবকিছু করার অনুমতি দেয়া হয়েছে শরীয়াতে। তার সকল আইন এ নীতির উপর তৈরী হয়েছে, যাতে দুনিয়ার মানুষ তার সকল আকাংখা ও প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে এবং নিজস্ব কল্যাণ সাধনের জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টার অধিকার লাভ করে; উপরন্তু এ অধিকার থেকে তাকে এমনভাবে কল্যাণ লাভ করতে হবে যাতে অজ্ঞতা বা দুস্কৃতি হেতু সে অপরের অধিকার বিনষ্ট না করে। অধিকন্তু যতটা সম্ভব তাকে অপরের সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হবে। যেসব কাজে একদিকে কল্যাণ ও অপর দিকে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে শরীয়াতের নীতি হচ্ছে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ক্ষুদ্রতর ক্ষতিকে স্বীকার করে নেয়া এবং বৃহত্তর ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য ক্ষুদ্রতর কল্যাণকে বিসর্জন দেয়া।
যেহেতু কোন জিনিস বা কোন কাজ কতটা কল্যাণকর বা অকল্যাণকর সেই সম্পর্কে প্রত্যেক যুগের প্রত্যেকটি মানুষ সমভাবে অবগত হতে পারে না, তাই সৃষ্টির সকল রহস্য জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ মানুষের পরিপূর্ণ জীবনের জন্য দিয়েছেন এক নির্ভুল বিধান। এখান থেকে বহু শতাব্দী আগে এ বিধানের বহুবিধ কল্যাণকর দিক মানুষের উপলব্ধির সীমানায় আসেনি; কিন্তু বর্তমানের শিক্ষার ক্রমোন্নতি সেই সব রহস্যকে অবগুন্ঠনমুক্ত করেছে। তার বহুবিধ কল্যাণকর দিক মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পারছেনা; কিন্তু যতই জ্ঞানের ক্রমোন্নতি হতে থাকবে, ততই সেই রহস্য মানুষের কাছে প্রকাশ হতে থাকবে। যারা নিজস্ব দুর্বল ও অপরিণত জ্ঞান বুদ্ধির উপর নির্ভর করে থাকে, তাঁরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভুল ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত থাকার পর শেষ পর্যন্ত এ শরীয়াতের কোন না কোন বিধানকে মেনে নিতে বাধ্য হয়; কিন্তু যারা আল্লাহর রাসূলের উপর নির্ভর করেছে, তারা জাহেরী ও অজ্ঞতার অনিষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছে, কেননা তার কল্যাণকর দিক সম্পর্কে তার জ্ঞান থাক অথবা না-ই থাক, সকল অবস্থায়ই তারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তিতে রচিত আইনের আনুগত্য করেছে।
চতুর্বিদ অধিকার
ইসলামী শরীয়াতে মানুষের চার রকমের অধিকার নির্ধারিত রয়েছে।
একঃ আল্লাহর অধিকার;
দুইঃ মানুষের নিজস্ব দেহ ও মনের অধিকার;
তিনঃ আল্লাহর অন্যান্য বান্দার অধিকার, এবং
চারঃ যেসব জিনিসকে কাজে লাগাবার ও তা থেকে কল্যাণ লাভ করার জন্য আল্লাহ মানুষের ইখতিয়ার ভুক্ত করে দিয়েছে, তাদের অধিকার।
এ চার রকমের অধিকার বুঝে নেয়া ও তাদেরকে সঠিকভাবে কাজে লাগান সত্যিকার মুসলমানের কর্তব্য। শরীয়াতে এসব অধিকার আলাদা আলাদাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা আদায় করার এমন পদ্ধতি নির্ধারিত করা হয়েছে যাতে একই সাথে সকলের অধিকার আদায় করা যায় এবং যথাসাধ্য কারুর অধিকার বিনষ্ট না হয়।
আল্লাহর অধিকার
আল্লাহর এ অধিকার হচ্ছে যে মানুষ কেবলমাত্র তাকেই ‘ইলাহ’ বলে মানবে এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করবেনা। আগেই বলছি যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার উপর ঈমান আনলেই এ অধিকার আদায় হয়ে যায়।
আল্লাহর দ্বিতীয় অধিকার হচ্ছে, যে হেদায়াত তার কাছ থেকে এসেছে, পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে তা মেনে নেয়া। ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর’ উপর ঈমান আনলেই এ অধিকার আদায় হয়ে যায়। এর বিস্তারিত বিবরণ আমি আগেই দিয়েছি।
আল্লাহর তৃতীয় অধিকার হচ্ছে, তাঁর আদেশের আনুগত্য। আল্লাহর আইন-যা তাঁর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে বিধৃত হয়েছে, তা মেনে চলার ভিতর দিয়েই এ অধিকার আদায় করা যায়। এ সম্পর্কে আমি আগেই ইশারা করেছি।
আল্লাহর চতুর্থ অধিকার, তাঁর ইবাদাত করা। এ অধিকার আদায় করার জন্য মানুষের উপর যে যে কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে, তার বর্ণনা পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে দেয়া হয়েছে। যেহেতু এ অধিকার অন্যবিধ সকল অধিকারের উপরের স্থান লাভ করে, তাই একে আদায় করতে গিয়ে কম বেশী করে অন্যান্য অধিকার কুরবান করতে হয়ঃ যেমন, সালাত, সওম প্রভৃতি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মানুষ নিজস্ব দেহ-মনের বহুবিধ অধিকারকে কুরবান করে থাকে। সালাতের জন্য মানুষ অতি প্রত্যুষে উঠে, ঠান্ডা পানিতে ওযু করে। দিনে রাতে কয়েকবার নিজের জরুরী কাজ ও অবসর বিনোদনের আনন্দ বর্জন করে। রমযানের সারা মাস ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ইন্দ্রিয়পরতা দমিত করার ক্লেশ স্বীকার করে; যাকাত আদায় করতে গিয়ে আল্লাহ প্রেমের সমবর্তী হয়ে অর্থ প্রেমকে কুরবান করে দেয়। হজ্জে তাকে স্বীকার করে নিতে হয় সফরের ক্লেশ ও আর্থিক ত্যাগ। জিহাদে সে কুরবান করে নিজের ধন-প্রাণ। এমনি করে আল্লাহর অধিকার আদায় করতে গিয় কম বেশী অপরের অধিকারও কুরবান করতে হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সালাতের সময় ভৃত্যুকে তার মনিবের কাজ ফেলে রেখে তার প্রকৃত মনিবের ইবাদাতের জন্য চলে যেতে হয়। হজ্জের সময় ব্যক্তি বিশেষকে সবরকম কাজ-কারবার বর্জন করে মক্কা মোয়াযয্মার পথে সফর করতে হয় এবং তার সেই কর্তব্য পালনে আরো বহু লোকের অধিকার জড়িত থাকে। জিহাদে মানুষ একমাত্র আল্লাহর জন্য প্রাণ হরণ করে ও প্রাণ দেয়। আল্লাহর অধিকার আদায়ের জন্য মানুষের ইখতিয়ারভুক্ত বহু জিনিস ত্যাগ করতে হয়, যেমন পশু কুরবানী ও অর্থ ব্যয়।
আল্লাহ তা’য়ালা তার অধিকারের ক্ষেত্রে কতকগুলো সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার ফলে যে অধিকার আদায় করার জন্য অপরের অধিকার থেকে যতটা করবানী জরুরী তার বেশী করার প্রয়াজন হয়না। দৃষ্টান্তরূপ সালাতের প্রশ্নই ধরে নেয়া যাক। আল্লাহ তা’য়ালা যেসব সালাত ফরয করে দিয়েছেন তা আদায় করার সব রকম সুবিধা করে দেয়া হয়েছে। ওযুর পানি যদি না পাওয়া যায় অথবা কেউ যদি পীড়িত থাকে তাহলে তায়াম্মুম করে নিতে পারে। সফরে থাকলে সালাত সংক্ষিপ্ত করে নিতে হয়। অসুস্থ থাকলে বসে অথবা বিছানায় শুয়ে সালাত আদায় করতে পারে, আবার সালাতে যা কিছু পড়তে হয় তাও এমন বেশী নয়, যে এক ওয়াক্তের সালাতে কয়েক মিনিটের বেশী সময় ব্যয় হতে পারে। প্রশান্তির সময়ে মানুষ ইচ্ছা করলে সালাতে সূরা বাকারার মত পূর্ণ একটি সূরা পড়তে পারে; কিন্তু কর্মব্যস্ততার সময়ে লম্বা সালাত আদায় নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। আবার ফরয সালাত ব্যতীত নফল সালাত যদি কোন ব্যক্তি আদায় করতে চায়, তাতে আল্লাহ তার উপর খুশী হন, কিন্তু তিনি চাননা যে কেউ নিজের জন্য রাতের ঘুম ও দিনের আরাম হারাম করে দেয়, অথবা নিজের রুযী রোযগারের সময় কেবল সালাত আদায় করে কাটিয়ে দেয়, অথবা আল্লাহর বান্দাদের অধিকার বিনষ্ট করে সালাত আদায় করতে থাকে।
এমনি করে সওমের ক্ষেত্রে সবরকম সুবিধা দেয়া হয়েছে। সারা বছরে কেবল এক মাসের জন্য সওম ফরয করে দেয়া হয়েছে, তাও সফরের সময়ে অথবা অসুস্থ অবস্থায় কাযা করা যেতে পারে। সওম আদায়কারী যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং প্রাণের ভয় থাকে তাহলে ভেঙ্গে দেয়া যায়। সওমের জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে, তার চেয়ে এক মিনিট বেশী সওম রাখা সংগত নয়।
সেহরীর শেষ সময় পর্যন্ত খানাপিনার অনুমতি রয়েছে। এবং ইফতারের সময় আসা মাত্র অবিলম্বে সওম খুলবার হুকুম দেয়া হয়েছে। ফরয সওম ছাড়া যদি কেউ নফল সওম রাখে, তাতে আল্লাহ অত্যন্ত খুশী হবেন। কিন্তু আল্লাহ চান না যে, কেউ ক্রমাগত সওম রাখতে আর নিজেকে কোন রকম কাজ করতে না পারার মত কমজোর করে ফেলবে।
যাকাতের ক্ষেত্রে ও আল্লাহ তায়ালা নিম্নতম হার নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তা কেবল এমন লোকের জন্য ফরয করে দিয়েছেন, যারা নির্ধারিত নিসাবের সম্পত্তির অধিকারী। যদি কেউ আল্লাহর রাহে তার চেয়ে বেশী সদকা ও খয়রাত করতে থাকে, তাতে আল্লাহর সন্তোষ বিধান করা হয় কিন্তু আল্লাহ চান না যে কেউ নিজের ও স্বজনদের অধিকার কুরবান করে সবকিছু সদকা ও খয়রাতে ব্যয় করে দেবে এবং নিজে নিজে নিস্ব হয়ে বসে থাকবে। দানের ক্ষেত্রে আমাদেরকে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তারপর আসে হজ্জের প্রশ্ন। প্রথমেই তো হজ্জ কেবল তাদের জন্য ফরয হয়েছে, যারা সফরের ব্যয় নির্বাহের ও দৈহিক ক্লেশ স্বীকারে যোগ্য। আবার এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সুবিধা এই দেয়া হয়েছে যে, সারা জীবনে মাত্র একবার সুবিধা মত হজ্জে করতে হবে। যদি পথের মধ্যে কোথাও লড়াই চলতে থাকে, অথবা জীবন বিপন্ন হবার মতো আশংকা থাকে। তা হলে হজ্জের সংকল্প মুলতবী রাখা যেতে পারে। এর সাথে সাথে আবার হজ্জের জন্য বাপ-মার অনুমতি অপরিহার্য বলে ধরা হয়েছে, যেন পুত্রের অনুপস্থিতিতে বুড়ো বাপ মা’র কোন কষ্ট না হয়। এসব বিধান থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নিজস্ব অধিকারের ক্ষেত্রে অপরের অধিকার কত বিবেচনা করেছেন।
আল্লাহর অধিকার আদায়ের জন্য মানুষের অধিকার সবচেয়ে বেশী কুরবানী করতে হয় জিহাদের সময়, কেননা তখন মানুষকে নিজের ধন-প্রাণ আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করে দিতে হয় এবং অপরের ধন প্রাণও কুরবান করতে হয়। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে যে, ইসলামের নীতি হচ্ছে, বৃহত্তর ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ক্ষুদ্রতর ক্ষতি স্বীকার করে নেয়া। এ নীতিকে দৃষ্টির সামনে রেখে বিচার করলে বুঝতে পারা যায় যে, কয়েকশ, কয়েক হাযার অথবা কয়েক লাখ জীবন বিনষ্ট হওয়ার চেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে সত্যের উপর মিথ্যার বিজয়, কুফর, শিরক ও নাস্তিকতার সামনে আল্লাহর দ্বীনের পরাজয়; দুনিয়ার বুকে গুমরাহী ও নীতিহীনতার প্রসার। এ জন্যই এ বড় ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্য আল্লাহ তা’য়ালা মুসলামানদেরকে হুকুম দিয়েছেন তারা যেন জান মালের ক্ষুদ্রতর ক্ষতিকে তাঁর সন্তোষ বিধানের জন্য স্বীকার করে নেয় কিন্তু তার সাথেই এ কথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, যতোটা রক্তাপাত অপরিহার্য; তার বেশী যেন না করা হয়। বৃদ্ধ, শিশু, নারী, আহত ও রুগ্ন মানুষের উপর হাত তোলা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। লড়াই করতে হবে কেবল তাদেরই বিরুদ্ধে, যারা মিথ্যার সহায়তার জন্য তরবারি উত্তোলিত করেছে। দুশমনের দেশে বিনা কারণে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ এবং বিজয় লাভের পর দুশমনের উপর ন্যায়সংগত আচরণ করার বিধান রয়েছে। কোন বিষয় নিয়ে দুশমনের সাথে চুক্তি সম্পাদন করলে তা মেনে চলতে হবে। সত্যের বিরুদ্ধে দুশমনি থেকে তারা যখন বিরত হবে, তখন লড়াই বন্ধ করতে হবে। এসব বিধান থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর অধিকার আদায়ের জন্য মানবীয় অধিকার যতোটা কুরবানী করা অপরিহার্য, তার বেশী কুরবানী করা বৈধ বলে গণ্য করা হয়নি।
নিজস্ব অধিকার
এবার দ্বিতীয় প্রকারের অধিকার অর্থাৎ ব্যক্তির নিজস্ব দেহ ও মনের অধিকার নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সম্ভবত একথায় অনেকেই বিস্মিত হবে যে, মানুষ আর সবাইকে ছেড়ে তার নিজের উপরই যুলুম করে থাকে। কথাটা সত্যি বিস্ময়করই বটে। কেননা প্রকাশ্য ভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিই অনুভব করে যে, সে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে তার নিজের সত্তাকে এবং সম্ভবত একথা কেউ স্বীকার করবেনা যে, সে তার নিজের বিরুদ্ধেই দুশমনি করে; কিন্তু একটুখানি বিবেচনা করে দেখলে বিষয়টির সত্যতা সকলেই উপলব্ধি করতে পারবে।
মানুষের মধ্যে একটি বড় রকমের দুর্বলতা হচ্ছে এই যে, কোনরূপ ইন্দ্রিয়লালসা যখন তার উপর বিজয়ী হয়, তখন সে তার গোলাম বনে যায় এবং ইন্দ্রিয়লালসা চরিতার্থ করার জন্য জেনে অথবা না জেনে নিজেরই অনেক কিছু ক্ষতি করে বসে। দেখা যায়, কোন কোন লোককে শরাবের নেশায় পেয়ে বসে, সে তার পেছনে দেওয়ানা হয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি, অর্থের ক্ষতি, সম্মানহানী, এক কথায় সবকিছুর ক্ষতি সে স্বীকার করে নেয়। অপর এক ব্যক্তি আবার পেটুক, সে সবরকমের খাবার নির্ভাবনায় খেতে থাকে এবং এমনি করে নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। তৃতীয় আর এক ব্যক্তি হয়তো যৌন লালসার দাস হয়ে যায় এবং ক্রমাগত এমনভাবে তার আকাংখা চরিতার্থ করতে থাকে যে, তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয় নিজের ধ্বংস। চতুর্থ আর এক ব্যক্তি চায় আত্মিক উন্নতি, জীবনের সকল চাহিদাকে সে উপেক্ষা করে, অন্তরের সকল আকাংখ্যাকে সে দমিত করে রাখে, দেহের চাহিদা মিটাতে সে অস্বীকার করে, বিবাহ করে না, পানাহার থেকে সংযত হয়ে থাকে, পোশাক ব্যবহারের প্রয়োজনবোদ করে না, এমন কি শ্বাস নিতেও সে রাযী নয়, বন-জংগলে আর পাহাড়ে গিয়ে সে কাটিয়ে দেয় জীবন; ভাবে, এ দুনিয়া তার জন্য তৈরী হয়নি। আমি নেহায়েত দৃষ্টান্তের খাতিরে মানুষের মধ্যে চরমপন্থীদের কয়েকটি নমুনা পেশ করেছি। এমনি চরমপন্থী মনোভাবের সংখ্যাতীত রূপ আমরা রাত দিন আমাদের চারপাশে দেখতে পাচ্ছি।
ইসলামী শরীয়াতের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের কল্যাণ। তাই মানুষকে সে হুঁশিয়ার করে দেয়ঃ () “তোমার উপর তোমার নিজেরই হক রয়েছে।”
যা কিছু মানুষের অনিষ্ট সাধন করে, ইসলামী শরীয়াত তা থেকে মানুষকে বিরত করে, যেমন-শরাব, তাড়ি, আফিম প্রভৃতি সব মাদক দ্রব্য। শরীয়াত শুকরের মাংস, হিংস্র ও বিষাক্ত জানোয়ারের মাংস, নাপাক জীব-জানোয়ার, মৃত জানোয়ার প্রভৃতি মানুষের জন্য নিষিদ্ধ করেছে, কেননা এসব জিনিস মানুষের স্বাস্থ্য, চরিত্র, বুদ্ধবৃত্তির ও আত্মিক শক্তির উপর অত্যাধিক অনিষ্টকর প্রভাব বিস্তার করে। এর পরিবর্তে শরীয়াত মানুষের জন্য পবিত্র ও কল্যাণকর জিনিসমূহ হালাল করে দিয়েছে এবং তাকে নির্দেশ দিয়েছে যে, সে যেন এসব পবিত্র খাদ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে না রাখে, কেননা তার উপর তার দেহের অধিকার রয়েছে।
শরীয়াত তাকে উলংগ থাকায় বিরত করে নির্দেশ দিচ্ছে যে, আল্লাহ তা’য়ালা তার দেহের শোভা বর্ধনের জন্য যে পোশাক নির্দেশ করেছেন, সে যেন তার ব্যবহার করে এবং দেহের যে অংশ খোলা রাখা নির্লজ্জতার শামিল তা যেন সে ঢেকে রাখে।
শরীয়াত তাকে রুযী-রোযগারের হুকুম দিয়েছে এবং তাকে উপদেশ দিয়েছে যে, সে যেন বেকার বসে না থাকে, ভিক্ষা প্রার্থী না হয়, ক্ষুধায় না মরে, আল্লাহ যেসব শক্তি তাকে দান করেছেন সে গুলো যেন কাজে লাগায় এবং তার প্রতিপালন ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য যমীন ও আসমানে যত মাধ্যম সৃষ্টি করে দিয়েছেন, বৈধ উপায়ে তা হাসিল করে।
শরীয়াত মানুষকে তার ইন্দ্রিয়লালসা দমিত করতে বিরত করে হুকুম দিয়েছে যে, সে যেন নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্য বিবাহ করে।
শরীয়াত মানুষকে তার আত্মার দাবী অস্বীকার করতে নিষেধ করেছে এবং নির্দেশ দিয়েছে যে, সে যেন আরাম স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের আস্বাদ নিজের জন্য হারাম করে না দেয়। যদি সে আত্মিক উন্নতি, আল্লাহর সান্নিধ্য ও আখেরাতের নাজাত কামনা করে তাহলে সেই জন্য দুনিয়াকে বর্জন করতে হবে না, বরং দুনিয়ায় পরিপূর্ণ ও পাকা দুনিয়াদার হয়ে সে আল্লাহকে স্মরণ করবে, তাঁর অবাধ্যতা থেকে ভীতি সহকারে দূরে থাকবে এবং তাঁর নির্ধারিত আইন সমূহের আনুগত্য করবে। এ হচ্ছে দুনিয়া ও আখেরাতের পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জনের উপায়।
আত্মার চাহিদা অস্বীকার করা শরীয়াতে হারাম করে দেয়া হয়েছে। তাতে মানুষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে তার ধন-প্রাণ হচ্ছে আল্লারহ সম্পত্তি। এ আমানত তাকে দেয়া হয়েছে এ জন্যে যে, সে আল্লাহর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তা কাজে লাগাবে–তার অপব্যবহার করার জন্য নয়।
বান্দাদের অধিকার
শরীয়াত এক দিকে মানুষের দেহ ও আত্মার অধিকার আদায় করার হুকুম দিয়েছে, অপরদিকে তাতে এক নিয়ন্ত্রণমূলক শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, এসব অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সে এমন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবে না, যাতে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়, কেননা এমনি করে স্বকীয় আকাংখা ও প্রয়োজনের চাহিদা মিটাতে গেলে মানুষের নিজের আত্মাও দুষিত হয় এবং অপরের সর্বপ্রকার ক্ষতি সাধিত হয়। উপরন্তু শরীয়াত চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, প্রতারণা, সুদখোরী, জালিয়াতি, প্রভৃতি দুস্কৃতি হারাম করে দেয়া হয়েছে, কেননা এসব পন্থায় ব্যক্তি বিশেষের কিছুটা লাভ হলেও তা প্রকৃপক্ষে অপরের ক্ষতি করেই হাসিল করে থাকে। মিথ্যা, পরনিন্দা, চোগলখোরী, মিথ্যা দোষারোপ ও হারাম করা হয়েছে; কেননা এসব কাজ অপরের পক্ষে ক্ষতিকর। জুয়া, লটারি প্রভৃতি হারাম করা হয়েছে, কারণ তাতে হাযার হাযার মানুষের ক্ষতির বিনিময়ে ব্যক্তি বিশেষের লাভ হয়। ধোঁকাবাজি, প্রতারণামূলক আদান প্রদানও এ ধরনের ব্যবসাকেও হারাম করা হয়েছে, কারণ তাতে কোন বিশেষ পক্ষের ক্ষতির নিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে। হত্যা ও কলহ বিবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে; কারণ ব্যক্তি বিশেষের লাভ বা আকাংখা অর্জনের জন্য অপরের প্রাণ হরণ অথবা অপরকে ক্লেশদানের অধিকার কারুর নেই; যেনা ব্যাভিচার ও অস্বাভাবিক যৌন সংযোগ হারাম করা হয়েছে, কারণ এসব কাজে একদিকে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও চরিত্রের হানি হয়, অপরদিকে তাতে সমগ্র সমাজ দেহে নির্লজ্জতা ও চরিত্রহীনতা প্রসার লাভ করে, কুৎসিত ব্যাধির উদ্ভব হয়, দেহ সৌষ্ঠবের বিকৃতি ঘটে, কলহ বিবাদের উদ্ভব হয় এবং মানবীয় সম্পর্কের বিকৃতি ঘটে। সর্বোপরি তার ফলে জাতির তাহযীব তামাদ্দুনের সূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মানুষ যাতে তার নিজ ও মনের অধিকার আদায় করতে গিয়ে অপরের অধিকার বিনষ্ট না করে তারই জন্য ইসলামী শরীয়াতে উপরিউক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছে; কিন্তু মানবীয় তামাদ্দুনের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য এমন ব্যবস্থায়ই যথেষ্ট নয়, যাতে ব্যক্তি বিশেষ অপরের ক্ষতি না করতে পারে, বরং তার জন্য জরুরী হচ্ছে লোকদের মধ্যে এমন একটা পারস্পরিক সম্পর্ক কায়েম করা যাতে একে অপরের কল্যাণকর কাজে সহায়ক হতে পারে। এ উদ্দেশ্যে শরীয়াত যেসব আইন তৈরী করে দিয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ মাত্র এখানে তুলে ধরছি।
মানবীয় সম্পর্কের শুর হয় পরিবার থেকে। তাই সবার আগে সেই দিকে নযর দেয়া যাক। পরিবার হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্তরি সমন্বয়ে গঠিত। ইসলামী আচরণ পদ্ধতি অনুসারে জীবিকা অর্জন পারিবারিক চাহিদা মিটানো এবং স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের হেফাযত করার দায়িত্ব থাকে পুরুষদের উপর এবং স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে এই যে, পুরুষ যা রোযগার করে আনে তা দিয়ে সে ঘরের সবরকম ব্যবস্থা করবে, স্বামী ও সন্তান সন্ততির সবচেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে চেষ্টা করবে এবং সন্তান—সন্ততিকে শিক্ষা দান করবে। সন্তান সন্ততির কর্তব্য হচ্ছে, তার মা- বাপের আনুগত্য করবে; ওদের সাথে আদব সহকারে আচরণ করবে এবং তাদের বার্ধক্যে তাঁকে খেদমত করবে। পারিবারিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য ইসলাম বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। এক হচ্ছে এই যে, স্বামী অথবা পিতাকে ঘরে পরিচালক ও প্রধান নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে; কেননা যেমন করে একজন পরিচালক ছাড়া একটি শহরের ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে চলেনা। প্রধান শিক্ষক ছাড়া বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা চলে না তেমনি এক নির্দিষ্ট পরিচালক না থাকলে পারিবারিক ব্যবস্থাপনা ও সুষ্ঠভাবে চলতে পারেনা। যে পরিবারে প্রত্যেকটি লোক আপন ইচ্ছা দ্বারা চালিত হয়, সেখানে বিশৃংখলা ও অব্যবস্থার রাজত্ব চলবেই। সেখানে স্বাচ্ছন্দ্য বা খুশীর অস্তিত্ব থাকতেই পারে না। স্বামী একদিকে গেলে স্ত্রী যাবেন অপরদিকে, আর তাদের সন্তান-সন্ততি যাবে অধঃপাতে। এসব অব্যবস্থা দূর করার জন্য প্রত্যেক পরিবারে একজন পরিচালক থাকা অপরিহার্য এবং এ কাজটি পুরুষের উপর ন্যস্ত হতে পারে। কেননা ঘরের অন্যান্য বাসিন্দার প্রতিপালন ও হেফাযতের যিম্মাদার এ পুরুষ। দ্বিতীয় ব্যবস্থা হচ্ছে এই যে, বাইরের সব কাজের বোঝা পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নারীকে হুকুম দেয়া হয়েছে যে, বিনা প্রয়োজনে সে যেন ঘরের বাইরে না যায়। তাকে বাইরের কার্য থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, যাতে সে প্রশান্তি সহকারে ভিতরের কর্তব্য পালনের ব্যবস্থা ও সন্তান-সন্ততির শিক্ষার ব্যাঘাত না ঘটে। এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, মেয়েদের বাইরে কদম ফেলাই নিষিদ্ধ। প্রয়োজন হলে তাদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে; কিন্তু শরীয়াতের লক্ষ্য এই যে, তাদের কর্তব্যের আসল ক্ষেত্র হবে তাদের গৃহ এবং তাদের সম্পূর্ণ শক্তি গার্হস্থ্য জীবনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করে তোলার কাজেই ব্যয়িত হবে।
রক্তের সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্পর্কের ভিতর দিয়েই পরিবারের প্রসার হয়। পারিবারিক ক্ষেত্রে যেসব লোক পরস্পর সংশ্লিষ্ট থাকে, তাদের ভেতরে সুষ্ঠু সম্পর্ক বজায় রাখার এবং তাদেরকে পরস্পরের সাহায্যকারী করে তোলার উদ্দেশ্যে শরীয়াতের বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থা নির্ধারিত হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি ব্যবস্থার বর্ননা দেয়া যাচ্ছেঃ
একঃ যেসব পুরুষ ও নারীকে স্বাভাবিকভাবে অত্যন্ত নিকট সংযোগে মিলে-মিশে থাকতে হয় তাদের পরস্পরের মধ্যে বিবাহ বন্ধন হারাম করে দেয়া হয়েছে, যেমন মাতা-পুত্র, বাপ-মেয়ে, বিপিতা (Step-Father) ও স্ত্রীর গর্ভে তার পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত কন্যা (Step-Daughter), বিমাতা ও স্বপত্নী- পুত্র, ভ্রাতা-ভগ্নী, চাচা-ভাতুষ্পুত্রী, ফুফু ও ভাতুষ্পুত্র, মামা ও ভাগ্নেয়ী, খালা-ভগ্নীপুত্র, শ্বাশুড়ী ও জামাতা, শ্বশুর ও পুত্রবধু। এসব বৈবাহিক সম্পর্কর নিষিদ্ধ করার অসংখ্য কল্যাণের মধ্যে হচ্ছে এই যে, এসব নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত পবিত্র থাকে এবং অকৃত্রিম স্নেহে বিনা বাঁধায় তারা পরস্পর মেলা-মেশা করতে পারে।
দুইঃ উপরিউক্ত নিষিদ্ধ সম্পর্কের বাইরে সম্পর্কযুক্ত অপর নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বৈধ করে দেয়া হয়েছে, যাতে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরো বলিষ্ঠ হতে পারে। যে লোকেরা পরস্পরের স্বভাব ও চাল-চলনের সাথে পরিচিত থাকে, তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক অধিকতর সাফল্য যুক্ত হয়। অপরিচিত পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের ফলে অনেক ক্ষেত্রে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এ কারণে ইসলামে অপরিচিত পরিবার অপেক্ষা সম্পর্কিত পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
তিনঃ সম্পর্কযুক্ত পরিবারসমূহের মধ্যে গরীব ও ধনী সচ্ছল ও অসচ্ছল-সবরকম লোকই থাকে। ইসলামের বিধান হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির উপর সবচেয়ে বেশী হক রয়েছে তার আত্মীয়-স্বজনের। শরীয়াতের পরিভাষায় এর নাম হচ্ছে ‘ছিলায়ে রেহমী’ এবং এর জন্যে শরীয়াতের বিশেষ তাকীদ রয়েছে। স্বজনদের সাথে বে-ওফায়ী (অকৃতজ্ঞ ব্যবহার ) করাকে বলা হয় ‘কাতয়ে রেহমী’ এবং ইসলামে এটি হচ্ছে কঠিন গুনাহের কাজ। কোন নিকট আত্মীয় গরীব হয়ে পড়লে অথবা কোন বিপদে পড়লে সচ্ছল আত্মীয়ের ফরয হচ্ছে তাকে সাহায্য করা। সদকা ও খয়রাতের বেলাও বিশেষ করে স্বজনদের হক স্বীকৃত হয়েছে।
চারঃ উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন ও এমনভাবে বিধিবদ্ধ হয়েছে, যার ফলে কোন ব্যক্তি কিছু সম্পত্তি রেখে মারা গেলে- সে সম্পত্তি কম হোক আর বেশী হোক-তাকে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হতে দেয়া হয় না বরং তা থেকে তার স্বজনরা কম বেশী করে অংশ লাভ করে। পুত্র, কন্যা, স্ত্রী, স্বামী, মা, বাপ, ভাই, বোন মানুষের সবচেয়ে বেশী নিকট আত্মীয়। তাই উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সবার আগে তাদেরই অংশ নির্ধারিত হয়েছে। তারা না থাকলে তাদের পর যে আত্মীয় নিকটতর, সে অংশ পাবে এবং এমনি করে এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি বহু আত্মীয়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। ইসলামের এ আইন দুনিয়ায় অতুলনীয় এবং বর্তমানে অপর জাতিসমূহ ও তার অনুসরণ করছে; কিন্তু আফসোস মুসলমান নিজস্ব অজ্ঞতা ও নাদানির জন্য অনেক ক্ষেত্রে এ আইনের বিরুদ্ধাচারণ করছে। বিশেষ করে মেয়েদের প্রাপ্য অংশে তাদেরকে বঞ্চিত করার রীতি বাংলাদেশ ও হিন্দুস্তানে খুব বেশী প্রসার লাভ করছে, অথচ এ হচ্ছে একটি বড় রকমের যুলুম এবং কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশের বিরোধী।
পরিবারের পর মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠে তার বন্ধু বান্ধ, প্রতিবেশী, একই শহর বা গ্রামের বাসিন্দা ও মহল্লাবাসীদের সাথে, যাদের সাথে মিলে তার কোন না কোন রকম কাজ-কারবার করতে হয়। ইসলামের বিধান অনুসারে তাদের সবার সাথে সত্য, ন্যায় ও সততার সাথে আচরণ করতে হবে, কাউকে কষ্ট দেয়া চলবেনা, কারুর অন্তরে আঘাত দেয়া যাবে না। অশ্লীলতা ও কুবাক্য থেকে বেঁচে থাকতে হবে। একে অপরের সাহায্য করতে হবে। রুগ্নের শুশ্রূষা করতে হবে, কেউ মারা গেলে তার জানায়ায় শরীক হতে হবে। কারুর বিপদ ঘটলে তাকে দেখাতে হবে সমবেদনা। গরীব প্রার্থী ও অক্ষম লোককে গোপনে সাহায্য করতে হবে। ইয়াতীম বিধবাদের তত্ত্বাবধান করতে হবে। ক্ষুধিতের মুখে তুলে দিতে হবে আহার, বস্ত্রহীনকে দিতে হবে বস্ত্র, বেকার লোককে কর্মসংস্থান করতে সাহায্য করতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা ধন-দৌলত দিয়ে থাকলে তা নিজের আয়েশ-আরামের জন্য উড়িয়ে দেয়া যাবে না। সোনা, রূপার পাত্র ও অলংকার ব্যবহার, রেশমী পোশক পরিধান এবং নিজস্ব অবসর বিনোদন ও নিরর্থক আয়েশ-আরামের জন্য অর্থের অপচয় নিষিদ্ধ করার মূলে রয়েছে, ইসলামের নীতি যে, আল্লাহর হাযার হাযার বান্দাহর রিযেকের ব্যবস্থা হতে পারে যে অর্থ দিয়ে তা যেন কেউ নিছক নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় না করে। যে অর্থ দিয়ে, বহু লোকের উদারের সংস্থান হতে পারতো, তা ব্যক্তি বিশেষের দেহে অলংকার হয়ে ঝুলবে অথবা তার টেবিলের উপর মূল্যবান পাত্র হিসাবে শোভা পাবে, অথবা মূল্যবান গালিচা হিসাবে তার ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে থাকবে, অথবা আগুনে পুড়ে যাবে, এ হচ্ছে এক ধরনের যুলুম। ইসলাম কারুর ধন-দৌলত ছিনিয়ে নিতে চায় না। যা কিছু কেউ অর্জন করে অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে; তার অধিকারী সে নিজেই থাকে। ইসলাম প্রত্যেক কে পূর্ণ অধিকার দিচ্ছে যে, সে তার নিজস্ব দৌলত ভোগ করে যেতে পারে। আল্লাহ যে নিয়ামত দিয়েছেন, তার প্রভাব তার পোশাকে, বাড়ী ঘরে ও বাহিরে পড়বে, ইসলামে তাও জায়েয করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক সহজ সরল ও হিসেবী জীবন যাপন করবে। কেবল তার প্রয়োজনের চাহিদা সীমাহীন করে তুলবেনা এবং নিজের সাথে সাথে বন্ধু বান্ধব প্রিয়জন, প্রতিবেশী, দেশবাসী জাতির অন্যান্য লোক ও জনসাধারনের অধিকারের প্রতি ও খেয়াল রাখবে।
এ ক্ষুদ্রতর ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে এবার বৃহত্তর ক্ষেত্রের দিকে নযর দেয়া যাক। বৃহত্তর ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে তামাম দুনিয়ার মুসলামনকে নিয়ে এ ক্ষেত্রে ইসলাম এমনি সব আইন ও বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছে, যাতে মুসলমান একে অপরের কল্যাণের সহায়ক হতে পারে এবং তাদের মধ্যে অন্যায় সৃষ্টি যাবতীয় পথ যথাসম্ভব রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, এ গুলোর মধ্যে থেকে কয়েকটির প্রতি আমি এখানেই ইংগিত করব।
একঃ জাতীয় চরিত্র সংরক্ষণের জন্য বিধান দেয়া হয়েছে যে, যেসব নারী ও পরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ নয়, তারা যেন স্বাধীনভাবে পরস্পর মেলা-মেশা না করে। মহিলাদের সামাজিক পরিবেশ থাকবে আলাদা এবং পুরুষের থাকবে আলাদা। নারী জাতি গার্হস্থ্য জীবনের কর্তব্য আত্মনিয়োগ করবে সবচেয়ে বেশী। তাদের বাইরে যাবার প্রয়োজন হলে সাজসজ্জা করে বাইরে যাবে না, সাদা পোশাক পরিধান করে সর্বাংগ ভাল করে ঢেকে বেরুবে। মুখ ও হাত অনাবৃত করা অপরিহার্য প্রয়োজনের উদ্ভব হয় তা হলে কেবলমাত্র সেই প্রয়োজন মেটাবার জন্য হাত মুখ অনাবৃত করবে। এর সাথে সাথে পুরুষদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছে যে, অপর নারী দিক থেকে দৃষ্টি সংযত করবে। হঠাৎ কোন নারী নযরে পড়লে নযর ফিরিয়ে নেবে। দ্বিতীয়বার তাকে দেখবার চেষ্ট করা অন্যায় এবং তার সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা অধিকতর অন্যায়। প্রত্যেক পুরুষ ও নারীর কর্তব্য হচ্ছেঃ সে নিজস্ব চরিত্র সংরক্ষণ করবে এবং আল্লাহ তা’য়ালা ইন্দ্রিয়লালসা মিটাবার জন্য যে বিবাহের বিধান দিয়েছেন, তার সীমানার বাইরে পদক্ষেপ করবে না অথবা তেমন কোন আকাংখা অন্তরে পোষণ করবে না।
দুইঃ জাতীয় চরিত্র সংরক্ষণের জন্যই বিধান দেয়া হয়েছে যে, কোন পুরুষ হাটু থেকে নাভীস্থলের মধ্যবর্তী অংশ এবং কোন নারী স্বামী ছাড়া অপর কোন ব্যক্তির সামনে মুখ ও হাত ব্যতীত দেহের অপর কোন অংশ যেন অনাবৃত না করে, সে ব্যক্তি তার যতই নিকট সম্পর্ক যুক্ত হোক। শরীয়াতের পরিভাষায় একে বলা হয় সতর এবং দেহের এ অংশকে আবৃত রাখা পুরুষ ও নারী সকলের জন্য ফরয। ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে লজ্জার মনোভাব সৃষ্টি করা এবং নির্লজ্জতার প্রসার বন্ধ করা যার পরিণামে চরিত্রহীনতা সৃষ্টি হতে পারে।
তিনঃ ইসলাম এমন সব অবসর বিনোদন ও আমোদ-প্রমোদ পছন্দ করে না, যার ফলে চরিত্রের অবনতি ঘটে; অসদাকাংখা জন্মলাভ করে এবং সময়, স্বাস্থ্য ও অর্থের অপচয় ঘটে। অবসর বিনোদন মানুষের মধ্যে জীবনীশক্তি উজ্জীবিত করার ও কর্মপ্রেরণা সঞ্চারের জন্য নিসন্দেহে অপরিহার্য; কিন্তু সেই অবসর বিনোদন হবে এমন যা, আত্মাকে সজীব করে তোলে; অন্তরকে আরো দূষিত ও অধঃপতিত করে না। হযার হাযার মানুষ একত্র হয়ে কাল্পনিক দুস্কৃতিকারীদের দুষ্কর্ম ও নির্লজ্জ আচরণের আলোচনায় বেহুদা সময়ের অপচয় করা আপাতত আনন্দায়ক হলেও তাতে জাতীয় চরিত্র ও স্বভাবের বিকৃতি ঘটে।
চারঃ জাতীয় ঐক্য ও কল্যাণের জন্য মুসলমাদেরকে তাগিদ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদের মধ্যে বিরোধ থেকে আত্মরক্ষা করে, বিভিন্ন দল সৃষ্টি থেকে বিরত থাকে এবং কোন ব্যাপারে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে সাধু সংকল্প সহকারে কুরআন ও হাদীস থেকে তার মীমাংসা করার চেষ্টা করে। তাতেও মীমাংসা না হলে নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে যেন আল্লাহর উপর তার মীমাংসা ন্যস্ত করে দেয়। জাতীয় কল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে সাহায্য করবে, কওমের প্রধান ব্যক্তিদের আনুগত্য করবে, বিরোধ সৃষ্টিকারীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে এবং নিজেদের মধ্যে লড়াই করে নিজস্ব উদ্যমের অপচয় করবে না, জাতীয় কলংক সৃষ্টি করবেনা।
পাঁচঃ অমুসলিম কওমের কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করার ও তার বাস্তব প্রয়োগ শিক্ষা করার পূর্ণ অনুমতি মুসলামানদের রয়েছেঃ কিন্তু জীবন ক্ষেত্রে তাদেরকে অনুকরণ করা নিষিদ্ধ হয়েছে। কোন জাতি কেবল তখনই অপর জাতিকে অনুকরণ করে, যখন সে তার নিজের হীনতা ও দুর্বলতা উপলব্ধি করে। এ হচ্ছে দাসত্বের সর্বনিম্ন স্তর। এ হচ্ছে নিজস্ব অধোগতি ও পরাজয়ের প্রকাশ্য ঘোষণা এবং এর শেষ পরিনণতি হিসেবে অনুকরণকারী কওমের তাহযীব ধ্বংস হয়ে যায়। এ কারণেই হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) অপর জাতির জীবন পদ্ধতির অনুসরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সাধারণ বুদ্ধির লোকও এ কথা বুঝতে পারে যে, কোন কওমের শক্তি তার পোশাক অথবা তার জীবন ধারণ পদ্ধতি থেকে হয়না, তা উদ্ভব হয় তার জ্ঞান, তার শৃংখলা ও তার কর্মোদ্যম থেকে। যদি শক্তি অর্জন করতে হয়, তাহলে অন্যান্য জাতি যা থেকে শক্তি অর্জন করেছে তা গ্রহণ করতে হবে। এমন সব জিনিস গ্রহণ করা যাবে না যার ফলে জাতিসমূহ গোলামী বরণ করে এবং পরিণামে অপর জাতির মধ্যে সমাহিত হয়ে তার নিজস্ব জাতীয় অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে।
অমুসলমানের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে মুসলমানকে অসহিষ্ণুতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টির শিক্ষা দেয়া হয়নি। তাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের নিন্দা ও তাদের ধর্মের অবমাননা করা নিষিদ্ধ হয়েছে। তাদের সাথে নিরর্থক কলহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তারা যদি আমাদের সাথে শান্তিপূর্ণ ও আপোষসূচক সম্পর্ক বজায় রেখে চলে এবং আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে তা হলে আমাদেরকেও সে ক্ষেত্রে তাদের সাথে শান্তিবজায় রাখার, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ও বিচার সংগত আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামী শরাফত আমাদের কাছে এ দাবীই করে যে, আমরা এগিয়ে গিয়ে সবার সাথে মানবীয় সহানুভূতি প্রদর্শন ও সদাচরণ করব। অসদাচরণ, যুলুম ও সংকীর্ণ মানসিকতা মুসলমানদের মর্যাদার পরিপন্থী। দুনিয়ায় মুসলামনকে এ জন্যই পয়দা করা হয়েছে যে, সে হবে সুষ্ঠু সুন্দর চরিত্র শরাফত ও সততার সর্বোত্তম আদর্শ এবং নিজস্বনীতি দ্বারা সে অপর জাতির অন্তর জয় করবে।
আল্লাহর সৃষ্টির অধিকার
এখন সংক্ষেপে চতুর্থ অধিকারের কথা বলবো। আল্লাহ তাঁর বেশুমার সৃষ্টির উপর মানুষকে দান করেছেন ইখতিয়ার। মানুষ নিজস্ব শক্তি দিয়ে তাদের উপর কর্তৃত্ব করেছে, তাদেরকে কাজে লাগাচ্ছে, তা থেকে কল্যাণ লাভ করছে। আল্লাহর সেরা সৃষ্টি হিসেবে তাকে অধিকার দেয়া হয়েছে পূর্ণরূপে। আবার তাদের অধিকার রয়েছে মানুষের উপর এবং তাদের সেই অধিকার হচ্ছে এই যে, মানুষ যেন তাদের নিরর্থক অপব্যবহার না করে, অথবা বিনা প্রয়োজনে তাদের ক্ষতি না করে অথবা আঘাত না দেয়। নিজের কল্যাণের জন্য ঠিক যতটা প্রয়োজন, ততটা ক্ষতিই যেন সে করে এবং তাদের ব্যবহার করে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে।
শরীয়াতে এ সম্পর্কে বহুবিধ বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, জানোয়ার সমূহকে তাদের ক্ষতি থেকে আত্মক্ষার জন্য অথবা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য হত্যা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে; কিন্তু বিনা প্রয়োজনে খেলা বা অবসর বিনোদনের জন্য তাদের প্রাণনাশ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খাদ্যের উদ্দেশ্যে জানোয়ারের প্রাণ নাশ করার জন্য যবেহ করার পদ্ধতি নির্ধারিত হয়েছে। জানোয়ার থেকে উত্তম গোশত পাওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হচ্ছে এই। এ ছাড়া অন্যবিধ পদ্ধতি কষ্টদায়ক হলেও তাতে গোশতের কল্যাণকর উপাদানের অপচয় হয়। এ ছাড়া অন্য যে যে পদ্ধতিতে গোশতের কল্যাণকর উপাদান সংরক্ষিত হতে পারে তা যবেহ পদ্ধতি অপেক্ষা অধিকতর কষ্টদায়ক। ইসলাম এর উভয় পদ্ধতিই এড়িয়ে চলতে চায়। ইসলামে জানোয়ারকে কষ্ট দিয়ে নির্দয়তা সহকারে হত্যা করা অত্যন্ত দোষাবহ (মাকরূহ)। বিষাক্ত ও হিংস্র জানোয়ারকে এজন্য হত্যা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে যে, মানুষের জীবন তাদের জীবন অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান, কিন্তু তাদেরকে কষ্ট দিয়ে হত্যা করা জায়েয রাখা হয়নি।
যেসব জীব-জানোয়ারকে বাহন ও ভারবাহী হিসেবে কাজে লাগানো হয়, তাদেরকে ক্ষুধিত রাখা, তাদের কাছ থেকে অত্যধিক কাজ আদায় করা এবং তাদেরকে নির্দয়ভাবে মারপিট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাখীদেরকে ধরে খাঁচায় বদ্ধ করে রাখাও মাকরূহ বলে গণ্য করা হয়েছে। জানোয়ার তো দূরের কথা, এমনকি বিনা প্রয়োজনে গাছ –গাছড়া কাটাও ইসলামে সমর্থিত হয় না। সকলেই তার ফল-ফুল ভোগ করতে পারে; কিন্তু তাদেরকে বরবাদ করার কোন অধিকার কারো থাকতে পারেনা। গাছ-গাছড়ার ও তো জীবন রয়েছে; ইসলাম প্রাণহীন জড় পদার্থের ও অযথা অপব্যয় করার বিধান দেয়নি। এমনকি অত্যধিক পানি খরচ করাও নিষিদ্ধ হয়েছে।
বিশ্বজনীন ও স্থায়ী বিধান
এ হচ্ছে তামাম দুনিয়ার জন্য ও সর্বকালের জন্য হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর মাধ্যমে আল্লাহ প্রেরিত শরীয়াতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এ শরীয়াতে ধর্মীয় আকীদা ও কর্মসূচী সংক্রান্ত কতিপয় বিষয় ব্যতীত বিভিন্ন মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যেসব মাযহাব ও শরীয়াতে বংশ, দেশ ও বর্ণ বিবেচনায় মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয় তা কখনো বিশ্বজনীন হতে পারে না, কেননা এক বংশের লোক অপর বংশের লোক বলে গণ্য হতে পারে না, সারা দুনিয়ার লোক একটি মাত্র দেশে বসতি স্থাপন করতে পারেনা। তাছাড়া হাবশী দেশের কাল রং চীনা যরদ রং ও ফিরিংগীর সাদা রং বদল করে দেয়া যায় না। এ কারণে এ ধরনের ধর্ম ও সমাজ-বিধান একটি বিশেষ জাতির মধ্যে সীমাবব্ধ থাকতে বাধ্য। এসব ধর্ম ও সমাজ বিধানের মুকাবিলায় ইসলামী শরীয়াত হচ্ছে এক বিশ্বজনীন বিধান। যে কোন মানুষ “লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” কালেমার উপর ঈমান আনলে সর্বপ্রকার অধিকার সহাকরে মুসলিম কওমের মধ্যে দাখিল হতে পারে; সেখানে গোষ্ঠী, ভাষা, দেশ, বর্ণ—কোন কিছুর বৈষম্য থাকবে না।
অধিকন্তু, এ শরীয়াত হচ্ছে একটি চিরন্তন বিধান। এর কানুন সমূহ কোন বিশেষ কওম ও কোন বিশেষ যুগের প্রচলিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর গড়ে ওঠেনি, বরং যে প্রকৃতির ভিত্তিতে মানুষ সৃষ্ট হয়েছে, সেই প্রকৃতির নীতির বুনিয়াদেই গড়ে ওঠেছে এ শরীয়াত। এ স্বভাব-প্রকৃতি যখন সকল যুগে সকল অবস্থায় কায়েম রয়েছে, তখন এরই নীতির বুনিয়াদে গড়া আইনসমূহ ও সর্ব যুগে সর্ব অবস্থায় সমভাবে কায়েম থাকবে।
— সমাপ্ত —