নবুয়াত
আগের অধ্যায় তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছেঃ
প্রথমত, আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্যের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আল্লাহর সত্তা ও গুণরাজি, তাঁর মনোনীত জীবন পদ্ধতি এবং আখেরাতের সুকৃতির প্রতিদান ও দুষ্কৃতির প্রতিফল সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান এবং সে জ্ঞানকে এমন পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নিতে হবে, যেন তার উপর পূর্ণ প্রত্যয় বা ঈমান জন্মে।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে নিজের চেষ্টায় এ জ্ঞান লাভ করার মতো কঠিন পরীক্ষায় ফেলেননি, নিজে মানুষরেই মধ্য থেকে তাঁর মনোনীত বান্দাকে (যাদেরকে বলা হয় পয়গাম্বর) ওহীর মাধ্যমে এ জ্ঞান দান করেছেন এবং তাঁদের হুকুম করেছেন অন্যান্য বান্দার কাছে এ জ্ঞান পৌঁছে দিতে।
তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষের উপর কেবল মাত্র এতটুকু দায়িত্বই রয়েছে যে, সে আল্লাহর সত্যিকার পয়গাম্বর চিনে নেবে। অমুক ব্যক্তি সত্যি সত্যি আল্লাহর পয়গাম্বর, এ সত্য জানা হলেই তার অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে তাঁর প্রদত্ত যে কোন শিক্ষার উপর ঈমান আনা, তাঁর যে কোন নির্দেশ মেনে এবং তাঁরই অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে চলা।
এখন সবার আগে বলবো পয়গাম্বরীর মূলতত্ত্ব এবং পয়গাম্বরকে চিনবার উপায়ই বা কি?
পয়গাম্বরীর মূলতত্ত্ব
দুনিয়ায় মানুষের যেসব জিনিসের প্রয়োজন, আল্লাহ নিজেই তার সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শিশুর যখন জন্ম হচ্ছে, তখন কত জিনিস তার সাথে দিয়ে তাকে দুনিয়ায় পাঠানো হচ্ছে তার হিসেব নেই। দেখবার জন্য চোখ, শুনবার জন্য কান, ঘ্র্রাণ ও শ্বাস টানবার জন্য নাক, অনুভব করবার জন্য সারা গায়ের চামড়ায় স্পর্শ অনুভূতি, চলবার জন্য পা, কাজ করার জন্য হাত, চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক এবং আগে থেকেই সবরকম প্রয়োজনের হিসেব করে আরো বেশুমার জিনিস যুক্ত করে দেয়া হয়েছে তার ছোট্ট দেহটির সাথে। আবার দুনিয়ার পা রেখেই সে দেখতে পায় জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় এত সব সরঞ্জাম-যার হিসেব করে শেষ করা সম্ভব নয়। হাওয়া আছে, আলো আছে, পানি আছে, যমীন আছে, আগে থেকেই মায়ের বুকে সঞ্চিত হয়ে আছে দুধের ধারা, মা-বাপ আপনজন -এমনকি, অপরের অন্তরেও তার জন্য সঞ্চারিত করে দেয়া হয়েছে স্নেহ, ভালোবাসা ও সহানুভূতি-যা দিয়ে সে প্রতিপালিত হচ্ছে। যতই সে বড় হতে থাকে, ততই তার প্রয়োজন মিটাবার জন্য প্রত্যেক রকমের জিনিসই মিলতে থাকে, যেন যমীনও আসমানের সকল শক্তি তারই প্রতিপালন ও খেদমতের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
এরপর আর একটু এগিয়ে যাওয়া যাক। দুনিয়ার কাজ-কারবার চালিয়ে নেয়ার জন্য যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, তার সবকিছুই দেয়া হয়েছে মানুষকে। দৈহিক শক্তি, বুদ্ধি, উপলব্ধি, প্রকাশ-ক্ষমতা এবং এমনি আরো কত রকম যোগ্যতা কম বেশী করে মওজুদ রয়েছে মানুষের মধ্যে। কিন্তু এখানে পাওয়া যায় আল্লাহ তা’য়ালার এক এক বিচিত্র ব্যবস্থাপনার পরিচয়। সকল মানুষকে তিনি ঠিক একই ধরনের যোগ্যতা দান করেননি। তাই যদি হত তা হলে কেউ কারুর মুখাপেক্ষী হতনা, কেউ কারুর একবিন্দু পরোয়া করতো না। এর জন্য আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের সামগ্রিক প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের মধ্যে সব রকম যোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন বটে;তার ধরনটা হচ্ছে এই যে, কোন এক ব্যক্তিকে যেমন এক যোগ্যতা বেশী করে দেয়া হয়েছে, তেমনি অপরকে দেয়া হয়েছে আর কোন যোগ্যতা। কেউ অপর লোকের চেয়ে শারীরিক পরিশ্রমের শক্তি বেশী করে নিয়ে আসে। কোন কোন লোক আবার বিশেষ বিশেষ শিল্পকলা বা বৃত্তির জন্মগত অধিকারী হয়, যা অপরের মধ্যে দেখা যায় না। কোন কোন লোকের মধ্যে প্রতিভা ও বুদ্ধি-বৃত্তিক শক্তি থাকে অপরের চাইতে বেশী। জন্মগত গুণের দিক দিয়ে কেউ হয় সিপাহসালার, কারুর মধ্যে থাকে নেতৃত্বের বিশেষ যোগ্যতা। কেউ জন্মে অসাধারণ বাগ্মিতার শক্তি নিয়ে, আবর কেউ স্বাভাবিক রচনাশৈলীর অধিকারী। এমনও কোন কোন লোক জন্মে, যার মস্তিষ্ক সবচাইতে বেশী ধাবিত হয় গণিত-শাস্ত্রের দিকে এবং অপরের বুদ্ধি যার ধারে কাছেও ঘেষঁতে পারেনা, এমনি সব জটিল প্রশ্নের সামধান সে করে দেয় অনায়াসে। আবার কোন ব্যক্তি জন্মে বহু বিচিত্র নিত্য নতুন জিনিস উদ্ভাবনের শক্তি নিয়ে, যার উদ্ভাবনী শক্তি দেখে দুনিয়া তাকিয়ে থাকে তার দিকে অবাক বিস্ময়ে। কোন কোন ব্যক্তি এমন অতুলীয় আইন জ্ঞান নিয়ে আসে যে, যেসব আইনের জটিল তথ্য উৎঘাটন করার জন্য বছরের পর বছর চেষ্টা করেও অপরের কাছে তা বোধগম্য হয় না। তার দৃষ্টি আপনা থেকেই সেখানে পৌঁছে যায়। এ হচ্ছে আল্লাহর দান। কোন মানুষ নিজের চেষ্টায় আপনার মধ্যে এ যোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারে না। শিক্ষা-দীক্ষার মারফতে ও এসব জিনিস তৈরী হয় না। প্রকৃতপক্ষে এগুলো হচ্ছে জন্মগত যোগ্যতা এবং আল্লাহ তা’য়ালার নিজস্ব জ্ঞান বলে যাকে ইচ্ছা এ যোগ্যতা দান করে থাকেন।
আল্লাহর এ দান সম্পর্কে ও চিন্তা করলে দেখা যাবে মানবীয় সংস্কৃতির বিকাশের জন্য যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন বেশী হয়, মানুষের মধ্যে তা বেশী করেই সৃষ্টি হয়ে থাকে, আবার যার প্রয়োজন যতটা কম মানুষের মধ্যে তা ততোটা কমই সৃষ্টি হয়। সাধারণ সিপাহী দুনিয়ায় বহু জন্মে। চাষী, কুম্ভকার, কর্মকার এবং এমনি আরো নানা রকম কাজের লোক জন্মে অসংখ্য কিন্তু জ্ঞান বিজ্ঞানে অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী রাজনীতি ও সিপাহসালারীর যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ জন্মে কম। কোন বিশেষ কর্মে অসাধারণ যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রতিভার অধিকারী লোকেরা আরো কম জন্মে থাকেন। কেননা তাঁদের কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলী পরবর্তী বহু শতাব্দী ধরে তাঁদের মত সুদ ও প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রয়োজনের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
এখন বিবেচনা করতে হবে যে, মানুষের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার, গণিতশাস্ত্রবিদ, বিজ্ঞানী, আইন বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিশারদ, অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য বিভিন্ন দিকের যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ জন্ম নিলেই তা মানুষের পার্থিব জীবনের সাফল্য বিধানের জন্য যথেষ্ট নয়। এদের সবার চেয়ে বৃহত্তর আর এক শ্রেণীর মানুষের প্রয়োজন রয়েছে, যারা মানুষকে আল্লাহর সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। অন্যান্য লোকেরা তো কেবল জানতে পারে, দুনিয়ার মানুষের জন্য কি কি রয়েছে, আর কি কি পন্থায় তা ব্যবহার করা যেতে পারে;কিন্তু এ কথা বলার লোকের ও তো প্রয়োজন আছে যে, মানুষ নিজে কিসের জন্য সৃষ্টি হলো? দুনিয়ার সব জিনিস-পত্র মানুষকে কে দিয়েছেন? এবং সেই দাতার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য কি? কেননা মানুষ দুনিয়ায় তাঁর ইচ্ছা অনুসারে জীবন যাপন করেই নিশ্চিত ও চিরন্তন সাফল্য অর্জন করতে পারে। এ হচ্ছে মানুষের প্রকৃত ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। মানুষের জ্ঞান এ কথা মেনে নিতে রাযী হতে পারে না যে, যে আল্লাহ আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রয়োজন মিটাবার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন, তিনি আমাদের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন না মিটিয়ে থাকবেন। না কিছুতেই তা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা যেমন করে বিশেষ বিশেষ শিল্পকলা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তেমনি করে এমন মানুষও তিনি সৃষ্টি করেছেন, যাঁদের মধ্যে আলাহকে চিনবার উচ্চতম যোগ্যতা ছিল। নিজের কাজ থেকে তিনি তাঁদেরকে দিয়েছেন আল্লাহর বিধান (দ্বীন, আচরণ (আখলাক)ও জীবন যাপন পদ্ধতি (শরীয়াত)সংক্রান্ত জ্ঞান এবং অপর মানুষকে এসব বিষয়ের শিক্ষা দেয়ার কাজে তাঁদেরকে নিযুক্ত করেছেন। আমাদের ভাষায় এ সব মানুষকেই বলা হয় নবী, রাসূল অথবা পয়গাম্বর।
পয়গাম্বরের পরিচয়
অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-কলার যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ যেমন বিশেষ বিশেষ ধরনের প্রতিভা ও স্বভাব-প্রকৃতি নিয়ে জন্ম লাভ করেন, তেমনি করে পয়গাম্বরও এক বিশেষ ধরনের স্বভাব-প্রকৃতি নিয়ে আসেন।
এক জন্মগত প্রতিভার অধিকারী কবির বাণী শুনেই আমরা বুঝতেপারি যে, তিনি এক বিশেষ যোগ্যতার অধিকার নিয়ে জন্মেছেন, কারণ অপর কোন কোন ব্যক্তি বহু চেষ্টা করেও তেমন কবিতা শুনাতে পারেন না। এমনি করে জন্মগত প্রতিভার অধিকারী বক্তা, সাহিত্যিক, আবিষ্কর্তা, নেতা-সবারই সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের নিজ নিজ কর্মসূচীর ভিতর দিয়ে, কারণ তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ কার্যেক্ষেত্রে এমন অসাধারণ যোগ্যতা প্রকাশ করেন, যা অপরের মধ্যে দেখা যায় না। পয়গাম্বরের অবস্থাও তাই। তাঁর মন এমন সব সমস্যার চিন্তা করতে সক্ষম হয়। অপরের মন যার কাছে ঘেষতে ও পারেনা। তিনি এমন সব কথা বলে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে পারেন, যা অপরের পক্ষে সম্ভব নয়। বহু বছরের চিন্তা ও গবেষণার পরও অপরের নযর যেসব সূক্ষ্ম বিষয়ের গভীরে পৌঁছতে পারে না, তাঁর নযর আপনা থেকেই সেখানে পৌঁছে যায়। তিনি যা কিছু বলেন, আমাদের যুক্তি তা মেনে নেয়, আমাদের অন্তর তার সত্যতা উপলব্ধি করে দুনিয়ার অন্তহীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সৃষ্টির সীমাহীন অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় তার এক একটি বাণীর সত্যতা। অবশ্যি আমরা নিজেরা তেমনি কোন কথা বলতে চেষ্টা করলেও তাতে আমাদের ব্যর্থতা নিশ্চিত। তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি এমন নিষ্কলুষ ও পরিশুদ্ধ হয়ে থাকে যে, প্রত্যেক ব্যাপারে তিনি সত্য, সহজ -সরল ও মহত্বপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেন। কখনো তিনি কোন অসত্য উক্তি করেন না, কোন অসৎ কাজ করেন না। তিনি হামেশা পুণ্য ও সৎকর্মের শিক্ষা দান করেন এবং অপরকে যা কিছু উপদেশ দেন নিজে তার কার্যে পরিণত করে দেখান। তিনি যা বলেন, তার বিপরীত কাজ নিজে করেন এমন কোন দৃষ্টান্ত তাঁর জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর কথায় ও কাজে কোন স্বার্থের স্পর্শ থাকে না, অপরের মঙ্গলের জন্য তিনি নিজে তা স্বীকার করেন;কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্য অপরের ক্ষতি সাধন করেন না। তাঁর সারা জীবন হয়ে উঠে সত্য-ন্যায়ের, মহত্ব, পবিত্রতা, উচ্চ-চিন্তা ও উচ্চাংগের মানবতার আদর্শ এবং বিশেষ অনুসন্ধান করেও তার ভিতরে পাওয়া যায় না কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি। এ ব্যক্তি যে আল্লাহর খাঁটি পয়গাম্বর, তা তাঁর এসব বৈশিষ্ট্য থেকেই পরিস্কার চিনে নেয়া যায়।
পয়গাম্বরের আনুগত্য
কোন বিশেষ ব্যক্তিকে যখনই আল্লাহর খাঁটি পয়গাম্বর বলে চিনে নেয়া যায়, তখন তাঁর কথা মেনে নেয়া তাঁর আনুগত্য স্বীকার করা, তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কোন ব্যক্তি কে পয়গাম্বর বলে স্বীকার করা হবে অথচ তাঁর হুকুম মানা হবেনা এ কথা সম্পূর্ণ যুক্তি বিরোধী। ব্যক্তি বিশেষকে পয়গাম্বর বলে স্বীকার করে নেয়ার মানে, এ কথা মেনে নেয়া যে, তিনি যা কিছু বলেছেন আল্লাহর তরফ থেকে বলেছেন;যা কিছু করেছেন আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী করছেন। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হবে, যা কিছু করা হবে, তা হবে আল্লাহর বিরুদ্ধে। আর যা কিছু আল্লাহর বিরোধী তা কখনো সত্য হতে পারে না। একারণেই কোন ব্যক্তিকে পয়গাম্বর বলে মেনে নেয়ার পর তাঁর কথা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া স্বতঃই অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। তাঁর কথার যৌক্তিকতা ও কল্যাণ বোধগম্য হোক অথবা নাই হোক, তাঁর আদেশ-নিষেধের কাছে মস্তক অবনত করতেই হবে। পয়গাম্বরের কাছে থেকে যে বাণী আসবে, তাকে কেবলমাত্র পয়গাম্বরের বাণী হবার কারণেই সত্য, জ্ঞানগর্ভ ও যুক্তিসংগত বলে মেনে নিতে হবে। তাঁর কোন নির্দেশের যৌক্তিকতা কারো হৃদয়ংগম না হলে ও তার অর্থে এই নয় যে, তার ভিতরে কোন ত্রুটি রয়েছে, বরং তার অর্থ হচ্ছে এই যে, তাঁর উপলব্ধির মধ্যে কিছু না কিছু ভুল রয়েছে।
এটা সুস্পষ্ট যে, কোন ব্যক্তি কোন বিশেষ শিল্পকলা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত না হলে তার সর্বপ্রকার সূক্ষ্মতা তার কাছে ধরা পড়ে না, কিন্তু কোন বিশেষজ্ঞের কথা তার বোধগম্য হচ্ছে না, নিছক এ যুক্তিতে তার কথা মেনে নিতে অঙ্গিকার করলে সে কত বড় নির্বোধ বলে প্রমাণিত হবে। দুনিয়ার যে কোন কাজে প্রয়োজন হয় বিশেষজ্ঞের, বিশেষজ্ঞকে স্বীকার করে নেয়ার পর তার ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে হয়, তার কোন কাজে হস্তক্ষেপ করা চলে না, কারণ সকল লোক সকল কাজে বিশেষজ্ঞ হতে পারেনা। কোন লোকই দুনিয়ার সব জিনিস সমভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। যে কোন উদ্দেশ্যে পূর্ণ জ্ঞান ও সতর্কতা সহকারে একজন বিশেষজ্ঞের সন্ধান করতে হবে এবং যখন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ বলে পূর্ণ প্রতীতি জন্মাবে তখন তাঁর উপর পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়াই হবে একমাত্র কর্তব্য। তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করা এবং তাঁর প্রত্যেকটি কথার ‘আগে আমায় বুঝিয়ে দাও নইলে মানব না’ বলতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বরং সোজাসুজি নির্বোধেরই কাজ। কোন উকিলের উপর মুকদ্দমার ভার ন্যস্ত করার পর এ ধরনের গোলযোগ করতে গেলে তিনি তাকে তাঁর দফ্তর থেকে বের করে দেবেন। ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য গিয়ে তাঁর প্রত্যকটি নির্দেশের সপক্ষে দলীল-প্রমাণ দাবী করলে তিনি চিকিৎসাই ছেড়ে দিবেন। ধর্মের ক্ষেত্রে ও সেই একই ব্যাপার। আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার প্রয়োজন সকলের রয়েছে। সকলেই জানতে চায় আলাহর ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী জীবন যাপন করা যায় কোন পদ্ধতিতে। অথচ কারো নিজের তা জানবার কোন সঠিক উপায় নেই। এখন প্রত্যেকের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর কোন সত্যিকার পয়গাম্বরের সন্ধান করা। এ সন্ধানের কাজে বিশেষ সতর্কতা ও জ্ঞান-বুদ্ধি সহকারে অগ্রসর হতে হবে। কারণ খাঁটি পয়গাম্বর ছাড়া অপর কোন লোককে পয়গাম্বর বলে স্বীকার করে নিলে স্বাভাবিক ভাবেই সে ভুল পথে চালিত করবে; কিন্তু বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যখন বিশ্বাস ও প্রত্যয় জন্মাবে যে, অমুক ব্যক্তি আল্লাহ তা’য়ালার সত্যিকার পয়গাম্বর, তখন তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা এবং তাঁর প্রত্যকটি হুকুমের আনুগত্য করা সকলের জন্য অপরিহার্য।
পয়গাম্বরগণের প্রতি ঈমানের আবশ্যকতা
যখন জানা গেল যে, আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর পয়গাম্বর যে পথের নির্দেশ দেন তাই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সরল পথ, তখন স্বতঃই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, পয়গাম্বরের প্রতি ঈমান আনা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। যে ব্যক্তি পয়গাম্বরের প্রদর্শিত পথ বর্জন করে নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী অন্যবিধ পথ উদ্ভাবন করে সে নিশ্চিতরূপে বিভ্রান্ত।
এ ব্যাপারে মানুষ বহু বিচিত্র ভুলের পথ ধরে চলে। এক শ্রেণীর লোক পয়গাম্বরের সত্যতা স্বীকার করে;কিন্তু তাঁর উপর যেমন ঈমান পোষণ করে না, তেমনি তাঁর হুকুমের আনুগত্য করে না। এরা কেবল কাফের নয়, নির্বোধ ও বটে;কারণ পয়গাম্বরকে সত্যিকার পয়গাম্বর বলে স্বীকার করার পর তাঁর নির্দেশ মেনে না চলার অর্থ হচ্ছে জেনে বুঝে মিথ্যার আনুগত্য করা। এর চাইতে বড় আর কোন নির্বুদ্ধিতা যে হতে পারে না, এট সুস্পষ্ট সত্য।
কেউ কেউ আবার বলেঃ পয়গাম্বরের আনুগত্য করার প্রয়োজন আমাদের নেই। নিজেদের বুদ্ধি দিয়েই আমরা সত্যের পথ জেনে নিতে পারব। এও এক মারাত্মক ভুলের পথ। গণিতশাস্ত্র পাঠ করে নিশ্চিত জানা যায় যে, এক বিন্দু থেকে অপর বিন্দু পর্যন্ত মাত্র একটি সরল রেখাই টানা যেতে পারে। তাছাড়া আর যতো রেখাই টানা যাক, তা হয়তো বাঁকা হবে, নইলে অপর বিন্দু পর্যন্ত পৌঁছবে না। সত্যের পথ যাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘সিরাতে মুসতাকীম’ (সরল সঠিক পথ) বলা হয়। তার বেলায় ও সেই একই নীতি প্রযোজ্য। এ পথ মানুষ থেকে শুরু হয়ে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে এবং গণিতের উপরিউক্ত সূত্র অনুযায়ী তা একটিই হতে পারে। এ ছাড়া আর যেসব পথ রয়েছে, তা হয় বাঁকা, নইলে তা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছবে না। কাজেই যে পথ সহজ-সরল, পয়গাম্বর তার নির্দেশ দিয়েছেন, তাছাড়া আর কোন রাস্তাই ‘সিরাতে মুসতাকিম’ হতে পারে না। পয়গাম্বরের নির্দেশিত পথ ত্যাগ করে যে ব্যক্তি নিজে কোন পথ খুঁজে বেড়ায় তাকে দু’টি বিকল্প পরিণতির যে কোন একটির সম্মুখীন হতে হবে। হয় তার আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছবার কোন পথ মিলবেনা, অথবা মিললেও তা হবে আকাবাঁকা দীর্ঘ পথ। সরল রেখার পরিবর্তে তা হবে বক্র রেখা। প্রথম পরিণতির দিক দিয়ে তো তার ধ্বংস অনিবার্য, দ্বিতীয়, পরিণতির দিক দিয়েও তার নির্বুদ্ধিতা প্রমাণিত হবার ক্ষেত্রে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। কোন নির্বোধ ও জ্ঞানহীন জানোয়ার ও এক স্থান থেকে স্থানান্তরে যাবার জন্য বাঁকা পথ ছেড়ে সোজা পথে চলতে থাকে। এক্ষেত্রে আল্লাহর কোন নেক বান্দাহ যাকে সোজা পথের নির্দেশ দিয়েছেন, সে যদি তাঁকে বলতে থাকে “না, আমি তোমার দেখানো পথে চলবোনা, নিজে বাঁকা পথে হোঁচট খেয়ে খেয়ে আমার গন্তব্যে লক্ষের সন্ধান করে নেবো তাহলে তাকে কি বলা যায়?”
যে কোন ব্যক্তি এ সাধারণ ভুলটি এক নযরে বুঝে নিতে পারে, কিন্তু বিশেষভাবে চিন্তা করে দেখলে আরো বুঝতে পারা যায়, যে ব্যক্তি পয়গাম্বারের উপর ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তার জন্য আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের বাঁকা বা সোজা কোন পথই মিলতে পারে না। তার কারণ, যে খাঁটি ও সত্যনিষ্ট মানুষের কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে, তার মস্তিষ্কে নিশ্চিতরূপে এমন কোন বিকৃতি রয়েছে, যার প্রভাবে সে সত্য পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখছে। তার উপলদ্ধিতে কোন ত্রুটি থাকতে পারে, অথবা তার স্বভাব কোন সত্য ও সৎ বস্তুকে স্বীকার করে নিতে অনিচ্ছুক হওয়ার মতো বিকৃতি সম্পন্ন। হতে পারে সে বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত এবং রীতি হিসেবে যা আগে থেকে চলে এসেছে তার কোন বিরূপ সমালোচনা শুনতে সে রাযী নয়, অথবা সে হয়ে আছে আপন প্রবৃত্তির দাস এবং পয়গাম্বরের শিক্ষা মেনে নিতে সে অস্বীকার করেছে এজন্য যে, তা মেনে নেয়ার পর তার আর কোন পাপাচরণ ও অবৈধ কার্য-কলাপের স্বাধীনতা থাকবে না। এ কারণগুলো এমন যে, এর যে কোন একটি কোন ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে থাকলে তার পক্ষে আল্লাহর পথ খুঁজে পাওয়া হয় অসম্ভব। আবার এর কোন কারণ কোন ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে না থাকলে ও এটা অসম্ভব যে, একজন সত্যানুসারী, নির্দোষ ও সৎলোক একজন সত্যিকার পয়গাম্বরের শিক্ষা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পয়গাম্বর আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত এবং আল্লাহই তাঁর ওপর ঈমান আনার ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। যে ব্যক্তি পয়গাম্বরের প্রতি ঈমান পোষণ করে না সে আল্লাহরই বিদ্রোহাচরণ করে। একজন লোক যে বাদশার প্রজা, তাঁর পক্ষ থেকে যাকেই শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হোক, তার আনুগত্য করতে সে বাধ্য। বাদশার নিযুক্ত শাসনকর্তাকে সে অমান্য করলে তার অর্থ হবে বাদশার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। শাসন কর্তৃপক্ষকে মেনে নেয়া আর তার নিযুক্ত শাসনকর্তাকে না মানা সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী ব্যাপার। আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পয়গাম্বরের ক্ষেত্রে ও এ একই নীতি প্রযোজ্য আল্লাহ সকল মানুষের সত্যিকার বাদশাহ। মানুষের পথনির্দেশের জন্য তিনি যে ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছেন এবং যার আনুগত্য স্বীকার করতে তিনি মানুষকে হুকুম দিয়েছেন, প্রত্যেক মানুষের ফরয তাকে পয়গাম্বর বলে স্বীকার করা ও অপর সবকিছুর আনুগত্য ছেড়ে কেবলমাত্র তাঁরই পথ অনুসরণ করা। তাঁর অনুসরণ থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে নিশ্চিতরূপে কাফের। সে আল্লাহকে মানুক অথবা নাই মানুক, তাতে কিছুই আসে যায় না।
পয়গাম্বরীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মানব জাতির মধ্যে কি করে পয়গাম্বরীর ধারা শুরু হয়েছে এবং কি করে ক্রমে ক্রমে উন্নতির সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়ে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গাম্বরের মাধ্যমে সে ধারার সমাপ্তি ঘটেছে, এখন সেই কথাই বলছি।
এ কথা জানা গেছে যে, আল্লাহ তা’য়ালা সবার আগে তৈরী করেছিলেন একটি মাত্র মানুষ এবং সেই মানুষটি থেকেই তৈরী করেছিলেন তার সংগিনীকে। তারপর কত শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে গেছে। সেই আদি মানুষের বংশধররা ছেয়ে ফেলেছে সারা দুনিয়ার বুক। দুনিয়ায় আজ যতো মানুষ রয়েছে সবই প্রথম সৃষ্ট এক জোড়া মানুষের সন্তান। সকল জাতির ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বিবরণ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, মানব জাতির শুরু হয়েছিল একটি মানুষ থেকে। মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে আলাদা আলাদা মানুষ তৈরী হয়েছিল, বরং অধিকাংশ বিজ্ঞানী অনুমান করেনে যে, দুনিয়ায় সবার আগে একটি মাত্র মানুষই পয়দা হয়েছিলেন এবং আজকের দুনিয়ার যেখানে যতো মানুষই দেখা যাচ্ছে তারা সবাই এ একটি মাত্র মানুষেরই বংশধর।
আমাদের ভাষায় দুনিয়ার এ প্রথম মানুষকে বলা হয় আদম। আদম থেকেই আদমী শব্দের উৎপত্তি এবং এ শব্দটি হচ্ছে ইনসান বা মানুষের সমার্থক!আল্লাহ তা’য়ালা সবার আগে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে নিযুক্ত করেছিলেন তাঁর পয়গাম্বর এবং তাকে তাঁর সন্তান সন্তুতিকে ইসলামের শিক্ষা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন তিনি তাদেরকে বলে দেনঃ তোমাদের ও সারা দুনিয়ার আল্লাহ এক, তোমরা তাঁরই ইবাদাত কর, তাঁরই কাছে মাথা নত কর, তাঁরই কাছে সাহায্য ভিক্ষা কর, তাঁরই ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী দুনিয়ার বুকে সততা ও ইনসাফের সাথে জীবন যাপন কর। এমনি করে জীবন যাপন করলে তোমরা পাবে বাঞ্ছিত পুরস্কার এবং তার আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তোমাদের প্রাপ্য হবে কঠিনতম শাস্তি।
হযরত আদম আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্যে যারা ছিলেন সৎলোক, তারা পিতার নির্দেশিত সহজ পথ অনুসরণ করে চলতে লাগলেন; কিন্তু অসৎ লোকেরা সে পথ ছেড়ে চলে গেল। ধীরে ধীরে সব রকম দুস্কৃতির সৃষ্টি হল, কেউ শুরু করলো চন্দ্র, সূর্য ও তারকার পূজা, কেউ আবার শুরু করলো গাছপালা, জীব-জানোয়ার ও নদী -পর্বতের উপাসনা। কেউ কেউ মনে করলো হাওয়া, পানি, আগুন, ব্যাধি, সুস্থতা ও শক্তি এবং প্রকৃতির অন্যান্য কল্যাণকর উপকরণ ও শক্তির খোদা আলাদা আলাদা এবং তাদের প্রত্যেকেরই পূজা করা প্রয়োজন, যাতে প্রত্যেক খোদা-ই খুশী হয়ে তাদের প্রতি মেহেরবান হয়। এমনি করে মূর্খতার কারণে শির্ক (অংশীবাদ)ও বুতপরস্তির (পৌত্তলিকতা ) নানা রূপ সৃষ্টি হলো এবং তার মাধ্যমে অসংখ্য ধর্মের উদ্ভব হলো। এ হচ্ছে সেই যুগের কথা যখন হযরত আদম আলাইহি সালামের বংশধররা দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।বিভিন্ন জাতির উদ্ভব হয়েছিল সারা দুনিয়ার বুকে। প্রত্যেক জাতি একটি নতুন ধর্ম তৈরী করে নিয়েছে এবং প্রত্যেকের রীতি নীতি হয়ে গিয়েছিল স্বতন্ত্র। হযরত আদম (আ) যে বিধান পেশ করেছিলেন তাঁর বংশধরদের কাছে, আল্লাহকে ভুলার সাথে সাথে মানুষ সেই বিধানকেও গেল ভুলে। মানুষ তখন শুরু করেছে তার প্রবৃত্তির দাসত্ব। সব রকম অন্যায় রীতি -নীতি জন্ম লাভ করেছে এবং সব রকম জাহেলী ধারণা প্রসার লাভ করেছে চারদিকে। ভাল-মন্দ বিবেচনায় মানুষ করছে ভুল। বহু অন্যায়কে তারা ভাল মনে করেছে, আর বহু ভাল কাজকে মনে করেছে খারাপ।
আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক জাতির মধ্যে পাঠাতে শুরু করলেন তাঁর পয়গাম্বর। প্রথমে হযরত আদম (আ) মানুষকে যে শিক্ষা দিয়েছেলেন, অন্যান্য পয়গাম্বর ও মানুষকে সেই শিক্ষাই দিতে লাগলেন। নিজ নিজ জাতিকে তাঁরা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগলেন তাদের ভুলে যাওয়া শিক্ষা। মানুষকে তাঁরা শিখালেন এক আল্লাহর ইবাদাত, তাদেরকে ফিরালেন শির্ক ও বুতপরস্তির পথ থেকে। জাহেলী রীতি ভেঙ্গে দিয়ে তারা আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী জীবন অতিবাহনের পথনির্দেশ করলেন এবং নির্ভুল বিধান বিশ্লেষণ করে তাদেরকে চালিত করলেন তাঁর আনুগত্যের পথে। হিন্দুস্তান, চীন, ইরান, ইরাক, মিসর, আফ্রিকা ও ইউরোপ-সোজা কথায় দুনিয়ায় এমন কোন দেশ নেই, যেখানে আল্লাহর তরফ থেকে কোন পয়গাম্বর আসেননি। তাঁদের সবারই ধর্ম ছিল এক ও অভিন্ন যাকে আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষায় বলি ইসলাম অবশ্যি তাঁদের শিক্ষা পদ্ধতি ও জীবন বিধান কিছুটা ভিন্ন ধরনের ছিল। প্রত্যেক জাতির মধ্যে যে ধরনের জাহেলীয়াত প্রসার লাভ করেছিল তা দূর করার উপরই বেশী করে জোর দেয়া হয়েছিল। যে ধরনের ভুল ধারণা যতোটা প্রচলিত হয়েছিল, তার প্রতিকারের জন্য ততোটা বেশী করে মনোয়োগ দেয়া প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল, তখন তাদের জন্য সহজ শিক্ষা ও সহজ বিধান দেয়া হয়েছিল। ধাপে ধাপে তারা যখন উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে লাগল, তাদের জন্য শিক্ষা ও অনুসরণীয় বিধানের ও ততো বেশী করে প্রসার হতে লাগলো। শিক্ষা ও বিধানের এ বিভিন্নতা কেবল বাইরের রূপেই সীমাবদ্ধছিল, কিন্তু সবারই প্রাণবস্তু ছিল এক অর্থাৎ বিশ্বাসের দিক দিয়ে তাওহীদ, কর্মে সততা ও সুশৃঙখলা এবং আখেরাতের প্রতিফল ও শাস্তির প্রতি প্রত্যয়ের বুনিয়াদই তার প্রাণ-বস্তু।
পয়গাম্বরের প্রতি ও মানুষ করেছে বহু অদ্ভুত আচরণ। মানুষ প্রথমে তাঁদের সাথে করেছে দুর্ব্যবহার, তাঁদের উপদেশ অগ্রাহ্য করেছে, কাউকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, কাউকে বা হত্যা করেছে। সারা জীবন মানুষের কাছে শিক্ষা প্রচার করে কারুর আবার বহু কষ্টে দশ পাঁচ জন অনুগামী জুটেছে। কিন্তু আল্লাহর এ মনোনীত বান্দাগণ বরাবর তাঁদের কর্তব্য করে গেছেন অবিচলিত ভাবে। অবশেষে তাঁদের শিক্ষা মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে এবং বড় বড় কওম তাঁদের আনুগত্য স্বীকার করেছে। এরপর মানুষের ভ্রান্তি প্রবণতা (গুমরাহী) আবার নতুন রূপ পরিগ্রহ করল। পয়গাম্বরদের ওফাতের পর তাঁদের উম্মাতরা ভুলে গেল তাঁদের শিক্ষা। তাঁদের কিতাবে নিজেদের তরফ থেকে সব রকম ধারণা মিশ্রিত করে দিল। ইবাদাতের নতুন নতুন রূপ অবলম্বন করল-কোন কোন শ্রেণী খোদ পয়গাম্বরদের উপাসানা শুরু করে দিল। কেউ তার পয়গাম্বরকে বলতে লাগল আল্লাহর অবতার (অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই মানব রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন) কেউ তার পয়গাম্বরকে বানিয়ে নিল আল্লাহর সাথে শরীক। মোটকথা, মানুষ এমন স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করল যে, যারা মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন সেই পয়গাম্বরগণকেই তারা পরিণত করলো মূর্তিতে। পয়গাম্বর তাঁর উম্মাতদের যে জীবন বিধান (শরীয়াত ) দিয়ে গিয়েছিলেন, ধীরে ধীরে তাকেও তারা বিকৃত করে ফেলল। তার মধ্যে তারা সব রকম মূর্খতা-প্রসূত রীতি মিশিয়ে ফেলল, কতো কাহিনী ও মিথ্যা বর্ণনার সংমিশ্রণ করল এবং মানুষের তৈরী বিধান সমূহকে পয়গাম্বরের প্রদর্শিত বিধানের সাথে চালু করে দিল। ফলে পয়গাম্বরদের প্রকৃত শিক্ষা ও বিধান কি ছিল এবং পরবর্তী লোকেরা তার সাথে কি কি মিশ্রিত করে তাকে বিকৃত রূপ দিয়েছে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে তা বুঝবার আর কোন উপায় থাকলো না। পয়গাম্বরদের নিজেদের জীবন-কাহিনী মিথ্যা ও অলীক বর্ণনা দ্বারা এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলা হয়েছে যে, তাঁদের জীবনের কোন নির্ভরযোগ্য ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে না। তথাপি পয়গাম্বরদের জীবন সাধনার সবটুকুই ব্যর্থ হয়ে যায়নি। সর্বপ্রকার বিকৃতি ও পরিবর্তন সত্ত্বেও সকল জাতির মধ্যে আজো কিছু না কিছু সত্য বেঁচে রয়েছে। আল্লাহর অস্তিত্ব ও আখেরাতের ধারণা কোন না কোন রূপে সকল জাতির মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। সততা, সত্য ও নৈতিক জীবনের কোন কোন নীতি সাধারণভাবে সারা দুনিয়ার স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ সংগে দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির পয়গাম্বরগণ আলাদা আলাদা করে এক এক জাতিকে একটা নির্দিষ্ট পর্যন্ত এমনভাবে তৈরী করে দিয়েছেন, যাতে র্নিবিশেষে সকল মানুষের কাছে গৃহিত হওয়ার মতো এক সাধারণ ধর্মের শিক্ষা দুনিয়ার মানুষের কাছে পেশ করা যেতে পারে।
আগেই বলেছি, গোড়ার দিকে প্রত্যেক জাতির মধ্যে আলাদা আলাদা পয়গাম্বর এসেছিলেন এবং তাঁদের প্রত্যেকের শিক্ষা তাঁর নিজ কওমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর কারণ, তখনকার দিনে সকল কওমই পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের মধ্যে বড় বেশী মেলামেশা ছিল না। বস্তুত প্রত্যেক কওম নিজ নিজ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এমনি অবস্থায় সকল কওমের জন্য এক সাধারণ যৌথ শিক্ষা প্রচার অত্যন্ত দুরূহ ছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন কওমের অবস্থা পরস্পর থেকে ছিল স্বতন্ত্র। তখনকার দিনে জাহেলী ধারণার প্রসার হয়েছিল অত্যধিক। এর ফলে নীতি বোধ ও আচরণের যে বিকৃত রূপ দেখা দিয়েছিল, প্রত্যেক জায়গায়ই তার ধরন ছিল স্বতন্ত্র। এর জন্যই আল্লাহর পয়গাম্বরদের জন্য অপরিহার্য ছিল প্রত্যেক কওমের মধ্যেই আলাদা আলাদা শিক্ষা ও হেদায়াত পেশ করা ধীরে ধীরে বিভ্রান্তিকর ধারণার উচ্ছেদ করে সঠিক ধারণা প্রচারের, ক্রমে ক্রমে জাহেলী জীবন পদ্ধতির বিনাশ সাধন করে শ্রেষ্টতম বিধানের আনুগত্য শিক্ষা দেয়ার এবং শিশুদেরকে যেভাবে শিক্ষিত করে তোলা হয়, তেমনি করে শিক্ষা দেয়ার। এমনি করে দুনিয়ার জাতি-সমূহকে শিক্ষিত করে তুলতে কত হাজার বছর চলে গিয়েছিল, তা আল্লাহ-ই জানেন। অবশেষে সে তার শৈশব অবস্থা অতিক্রম করে পরিণতির স্তরে আসতে শুরু করল। বাণিজ্য, শিল্প ও স্থাপত্যের অগ্রগতি হবার ফলে তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হল। চীন, জাপান থেকে শুরু করে ইউরোপ আফ্রিকায় দূর দূরান্ত পর্যন্ত কায়েম হল জাহাজ চলাচল ও স্থল পথে সফরের ধারা। অধিকাংশ জাতির বর্ণমালা উদ্ভব হল এবং লেখাপড়ার রেওয়ায শুরু হল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার হল এবং জাতিসমূহের মধ্যে চিন্তা ও জ্ঞানের বিনিময় চলতে লাগল। বড় বড় দিগ্ধিজয়ী জন্ম লাভ করল এবং তারা বড় বড় সাম্রাজ্য কায়েম করে বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন জাতিকে এক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে মিলিত করল। এমনি করে মানব জাতির বিভিন্ন কওমের মধ্যে গোড়ার দিকে যে দূরত্ব ও পার্থক্য দেখা যেতো, ক্রমে ক্রমে তা হ্রাস পেতে লাগলো এবং তখন ইসলামের একই শিক্ষা ও একই জীবন বিধান (শরীয়াত )তামাম দুনিয়ার কাছে পেশ করার সম্ভাবনা দেখা দিল। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে মানুষের এতটা উন্নতি হয়েছিল এবং তারা নিজেরাই এক সার্বজনীন জীবন বিধানের প্রয়োজন অনুভব করছিল। বৌদ্ধধর্ম যদিও কোন পূর্ণাঙ্গ ধর্ম -বিধান ছিলনা এবং তাতে কেবল নৈতিক চরিত্র সংক্রান্ত কতিপয় নীতির সমাবেশ হয়েছিল, তথাপি হিন্দুস্তান থেকে বেরিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম একদিকে জাপান ও মংগোলিয়া পর্যন্ত এবং অপর দিকে আফগানিস্তান ও বোখারা পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিল। এ ধর্ম মতের প্রচারকগণ বহু দূর দূরান্তের নানা দেশ পর্যটন করেছিলেন। এর কয়েক শতাব্দীর পর উদ্ভব হল ইসায়ী ধর্মের। যদি ও হযরত ঈসা (আ) ইসলামের শিক্ষা নিয়েই এসেছিলেন, তথাপি তাঁর তিরোধানের পর ঈসায়ী ধর্ম নামে এক বিকৃত ধর্ম তৈরী করে নেয়া হয়েছিল এবং ঈসায়ীরা এ ধর্মকে ইরান থেকে শুরু করে আফ্রিকা ও ইউরোপের দূর-দূরায নানা দেশ ছড়িয়ে দিল। বস্তুত দুনিয়া তখন এক সাধারন মানব ধর্মের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভব করছিল এবং তাঁর জন্য এতটা প্রস্তুত ছিল যে, যখন তেমন কোন পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল জীবন বিধানের সন্ধান পাওয়া গেল না, তখন অপরিণত ও অসম্পূর্ণ ধর্মসমূহকেই বিভিন্ন কওমের মধ্যে প্রচার করতে শুরু করলো।
হযরত মুহাম্মাদ (সা) -এর নবুয়াত
এমন এক সময় এলো, যখন সারা দুনিয়ার ও মানব জাতির সকল কওমের জন্য এক পয়গাম্বর অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে আল্লাহ তা’য়ালা আরব দেশে পয়দা করলেন এবং তাঁকে ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা ও পূর্ণাঙ্গ বিধান দান করে তা সারেজাহানে প্রচার করার মহাকর্তব্যে নিযুক্ত করেন।
দুনিয়ার ভূগোল পর্যালোচনা করলে প্রথম দৃষ্টিতে বুঝতে পারা যায় যে, সারা দুনিয়ার পয়গাম্বরীর জন্য যমীনের বুকে আরবের চেয়ে অধিকতর উপযোগী আর কোন স্থান হতে পারে না। এ দেশটি এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ইউরোপও এখান থেকে অত্যন্ত নিকটবর্তী। বিশেষ করে তখনকার দিনে ইউরোপের সভ্য জাতিসমূহ ইউরোপের দক্ষিণ অংশে বাস করতো এবং সে অংশটি আরব থেকে হিন্দুস্তানের মতই নিকটবর্তী ছিল।
আবার তখনকার দিনের দুনিয়ার ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যাবে যে, এ নবুয়াতের জন্য তখনকার দিনে আরব কওমের চেয়ে উপযোগী আর কোন কওম ছিলনা। আর সব বড় বড় কওম তখন দুনিয়ার বুকে নিজ নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আরবরা ছিল তখনো তাজা তারূণ্যের অধিকারী কওম। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সাথে অন্যান্য কওমের চালচলনে এসে ছিল বহুবিধ বিকৃতি;কিন্তু আরব কওমের উপর তখনো তেমন কোন সভ্যতার প্রভাব পড়েনি, যার ফলে তারা আরাম প্রয়াসী, আয়েশ-প্রিয় ও হীন স্বভাব সম্পন্ন হতে পারে। ঈসায়ী ছয় শতকে আরব ছিল সে যুগের সভ্যতা গর্বিত জাতি সমূহের দুষ্ট প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে জাতির মধ্যে সভ্যতার হাওয়া লাগেনি তার মধ্যে মানবীয় গুণরাজির জৌলুস যতটা থাকা সম্ভব তা আরবদের মধ্যে ছিল। তারা ছিল বীর্যবান, নির্ভীক ও মহৎপ্রাণ;তারা প্রতিশ্রুতি পালন করতো, স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন জীবন ভালবাসতো তারা, অপর কোন জাতির গোলামী তারা স্বীকার করতো না। আপনার ইয্যত বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ বির্সজন দিতে তারা কুন্ঠিত হতো না। তারা অত্যন্ত সরল জীবন যাপন করতো এবং ভোগ-বিলাসের প্রতি তাদের কোন আসক্তি ছিল না। নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে নানা প্রকার দুস্কৃতির অস্তিত্ব ছিল তার বিবরণ পরে জানা যাবে; কিন্তু তাদের সে দুষ্কৃতির কারণ ছিল এই যে, আড়াই হাজার বছরের মধ্যে তাদের দেশে কোন পয়গামম্বরের আবির্ভাব হয়নি, তাদের মধ্যে নৈতিক, সংস্কৃতির সাধন ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা দানের যোগ্যতা নিয়ে কোন সংষ্কারক আসেননি। বহু শতাব্দী ধরে রুক্ষ উষর মরুর বুকে স্বাধীন জীবন যাপনের ফলে তাদের মধ্যে মূর্খতা ও জাহেলী ভাবধারা প্রসার লাভ করেছিল এবং তারা তাদের অজ্ঞতা প্রসূত চালচলনে এতটা কঠোর ও দৃঢ় বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, তাদেরকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এর সাথে সাথে তাদের মধ্যে অবশ্যি এমন এক যোগ্যতা সঞ্চিত ছিল যে, কোন প্রতিভা-দীপ্ত মানুষ তাদের জীবন সংষ্কার সাধনের জন্য এগিয়ে এলে এবং তাদেরকে কোন মহান লক্ষ্যের নির্দেশ দিয়ে প্রবুদ্ধ করলে তারা সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সারা দুনিয়াকে ওলট পালট করতেও পশ্চাৎপদ হতো না। সারেজাহানের পয়গাম্বরের শিক্ষার প্রসার সাধনের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন এক তারুণ্য-দীপ্ত শক্তিশালী কওমের।
এরপর আরবী ভাষাও লক্ষণীয়। আরবী ভাষা পাঠ করলে এবং তার সাহিত্য সম্পদের পরিচয় লাভ করলে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, উচ্চ চিন্তাধারার প্রকাশ এবং আল্লাহর জ্ঞানের মাধুর্য সূক্ষতাপূর্ণ রহস্য বর্ণনা করে মানব-অন্তরকে প্রভাবিত করার জন্য এর চেয়ে উপযোগী আর কোনা ভাষা হতে পারেনা। এ ভাষায় ছোট ছোট সংক্ষিপ্ত কথা বা বাক্যের মাধ্যমে বিরাট বিরাট ভাব প্রকাশ করা যায় এবং তার প্রকাশভংগী এত বলিষ্ঠ যে, তীর বা বর্শার মতো তা মানুষের অন্তরকে বিদ্ধ করে। এ ভাষার মাধুর্য মানব-কর্ণে মধু বর্ষণ করে। তার মধুর সুর-লহরী মানব অন্তরকে অলক্ষে ছন্দ-পাগল করে তোলে কুরআনের মতো মহাগ্রন্থের বাহন হবার জন্য এমনি এক ভাষারই প্রয়োজন ছিল।
এখানেই আল্লাহ তা’য়ালার মহাজ্ঞানের প্রকাশ যে, তিনি তাঁর সর্বশেষ বিশ্বনবীকে প্রেরণের জন্য এ আরব ভুমিকেই মনোনীত করেছিলেন। যে পবিত্র সত্তাকে আল্লাহ তা’য়ালা এ মহত্তম কর্তব্যের জন্য মনোনীত করেছিলেন, তিনি কেমন অতুলনীয় ছিলেন, এখন তারই বর্ণনা পেশ করব।
নবুয়াতে মুহাম্মদীর প্রমাণ
আজ থেকে চৌদ্দ শ’বছর পশ্চাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক। দুনিয়ায় তখন না ছিল তারবার্তায় ব্যবস্থা, না ছিল টেলিফোন না ছিল রেলগাড়ী, না ছিল ছাপাখানা না ছিল পত্র -পত্রিকা না ছিল বই-পত্র, না ছিল বিদেশ সফরের সুযোগ সুবিধা-যা আমরা আজকের দিনে দেখতে পাচ্ছি। এক দেশ থেকে দেশান্তরে যেতে হলে অতিক্রম করতে হতো কয়েক মাসের পথ। এমনি অবস্থায় আরব দেশ ছিল দুনিয়ার আর সব দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। তার আশে পাশে ছিল ইরান, তুরস্ক ও মিসর এবং সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কিছুটা ছিল। কিন্তু প্রকান্ড বালুর সমুদ্র সেসব দেশ থেকে আরবকে আলাদা করে রেখেছিল। আরব সওদাগররা মাসের পর মাস উটের পিঠে পথ চলে সেসব দেশে তেজারতের জন্য যেতো কিন্তু তাদের সে সম্পর্ক কেবল পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আরব ভূমিতে তখনো কোন উচ্চাংগের সভ্যতার অস্তিত্ব ছিলনা সেখানে না ছিল বিদ্যালয় না ছিল গ্রন্থাগার, না ছিল সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে লেখা-পড়ার র্চচা। সারা দেশে গণনা করার মতো স্বল্প সংখ্যক লোক ছিল যারা কিছুটা লেখা-পড়া জানতো, কিন্তু তাও সে যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিচয় লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। কোন সুগঠিত সরকারের অস্তিত্ব ছিল না সেখানে। কোন আইন কানুন ছিলনা। প্রত্যেক গোত্র তার নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাতন্ত্র চালিয়ে যেতো। সারা দেশে স্বাধীনভাবে যথেষ্ট লুট -তরায চলতো। খুন-খারাবী ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল সেখানকার নিত্য প্রচলিত ব্যাপার। মানুষের জীবনের কোন মূল্য ছিল না সেখানে যার উপর যার কোনরূপ আধিপত্য চলতো তাকে হত্যা করে সে তার সম্পতি দখল করে বসতো। তাদের ভিতরে কোন নীতিবোধ বা সভ্যতার সংস্পর্শ ছিল না। দুস্কৃতি, শরাবখোরী ও জুয়া ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার। একে অপরের সামনে নিরাবরণ হতে তাদের দ্বিধা ছিল না। এমন কি আরব -নারীরা উলংগ অবস্থায় কা’বা শরীফ তাওয়াফ করত। হারাম ও হালালের কোন পার্থক্য ছিল না তাদের জীবনে। আরবদের আযাদী এতটা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে, তারা কোন নিয়ম, কোন আইন কোন নৈতিক পদ্ধতি মেনে চলতে তৈরী ছিল না, কোন নেতার আনুগত্য তারা কবুল করতে পারতো না। আরবদের অজ্ঞতা এমন চরম রূপ গ্রহন করেছিল যে তারা পাথরের মূর্তিকে পূজা করত। পথ চলতে কোন সুন্দর পাথর টুকরা পাওয়া গেলে তা তুলে এনে সামনে বসিয়ে তারা পূজা করত। যে শির কারুর কাছে অবনমিত হতে রাযী হতো না সামান্য পাথরের সামনে তা ঝুঁকে পড়তো এবং মনে করা হতো যে সেই পাথরই তাদের সকল মনষ্কামনা পূর্ণ করতে পারে।
এমন অবস্থায় এমন জাতির মধ্যে একটি মানুষের আবির্ভাব হল। শৈশবেই পিতা -মাতা ও পিতা মহের স্নেহের ছায়া থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। অতীতের সেই অবস্থার মধ্যে যেটুকু শিক্ষা লাভ করা সম্ভব ছিল তাও তাঁর ভাগ্যে জুটলো না। বড় হয়ে তিনি আরব–শিশুদের সাথে ছাগল চরাতে লাগলেন। যৌবনে তিনি আত্যনিয়োগ করলেন বাণিজ্যে। তাঁর উঠা-বসা মেলামেশা সব কিছুই হতে লাগলো সেই আরবদের সাথে, যাদের অবস্থা আগেই বলা হয়েছে। শিক্ষার নাম গন্ধ নেই, এমন কি সামান্য পড়াশুনাও তিনি জানেন না, কিন্তু তা সত্তেও তাঁর চালচলন তাঁর স্বভাব-চরিত্র তাঁর চিন্তাধারা ছিল অপর সবার চেয়ে আলাদা। তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না, কারুর সাথে দুর্বাক্য উচ্চারণ করেন না, কঠোর বাক্যের পরিবর্তে মধু বর্ষিত হয় তাঁর মুখ থেকে, আর তার প্রভাবে মানুষ মুগ্ধ হয়ে আসে তাঁর কাছে। কারুর একটি পয়সা ও তিনি অবৈধ ভাবে গ্রহণ করেন না। তাঁর বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ মানুষ তাহাদের বহু মূল্যবান সম্পত্তি রেখে দেয় তাঁর হেফাযতে এবং তিনি প্রত্যেকের সম্পত্তি হেফাযত করে নিজের জীবনের মতো। সমগ্র কওম তাঁর সততায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘আল আমিন’ নামে আখ্যায়িত করে। তাঁর লজ্জাশীলতাবোধ এমন প্রখর যে শৈশব থেকে কেউ তাকে কোনদিন নিরাবরণ দেখেনি। তিনিএমন সদাচারী যে, দূরাচারী ও দুস্কৃতি পরায়ণ জাতির মধ্যে প্রতিপালিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি সর্বাবিধ অসদাচরণ ও অশোভন কার্যকলাপকে ঘৃণা করেন এবং তার প্রত্যেকটি কার্যে পাওয়া যায় পরিচ্ছন্নতার পরিচয়। চিন্তাধারার পবিত্রতার দরুন তিনি নিজ জাতির মধ্যে লুট-তরায খুন খারাবি দেখে অন্তরে গভীর দুঃখ অনুভব করেন এবং লড়াইয়ের সময়ে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তাঁর কোমল অন্তর প্রত্যেক মানুষের দুঃখ-বেদনার শরীক হয়। ইয়াতিম ও বিধবাকে তিনি সাহায্য করেন, ক্ষুধিতের মুখে খাদ্য তুলে দেন, মুসাফিরকে ও সাদরে ঘরে ডেকে নিয়ে খেতে দেন। তিনি কাউকে ও দুঃখ দেন না, নিজে অপরের জন্য দুঃখ বরন করেন। নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী তিনি, মূর্তিপূজারী কওমের মধ্যে থেকেও মূর্তি পূজাকে ঘৃণা করেন। কখনো কোন সৃষ্টির সামনে তাঁর মাথা নত হয় না। তাঁর অন্তর থেকে স্বতঃই আওয়াজ আসে যমীন-আসমানে যা কিছু দেখা যায়, তার মধ্যে কেউ নেই উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। তাঁর দিল আপনা থেকেই বলে ওঠেঃ আল্লাহ তো এজনই মাত্র হতে পারেন এবং তিনি অদ্বিতীয়-একক। এক বর্বর জাতির মধ্যে এ মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হল, যেন এক প্রস্তর স্তুপের মাঝখানে এক দীপ্তমান হীরকখন্ড, যেন ঘনঘোর অন্ধকারের মাঝখানে এক প্রদীপ্ত দীপশিখা।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এমনি পবিত্র পরিচ্ছন্ন উচ্চাংগের মহৎ জীবন যাপনের পর তিনি চারিদিকের ঘনিভূত ঘনঘোর দেখে হাঁপিয়ে ওঠেন, অজ্ঞতা, নীতিহীনতা, পাপাচার, দুর্নীতি, শিরক ও পৌত্তলিকতার ভয়াবহ সমুদ্র বেষ্টন থেকে তাঁর অন্তর চায় মুক্তি, কারণ সেখানকার কোন কিছুই তাঁর মনোভাবের অনুকুল নয়। অবশেষে তিনি জনতা থেকে দূরে এক পর্বতের গুহায় গিয়ে নির্জনতা ও প্রশান্তির দুনিয়ায় কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন। অনাহারে থেকে থেকে তিনি আরো পরিশুদ্ধি করে তোলেন তাঁর আত্মাকে, তাঁর চিত্তকে, তাঁর মস্তিষ্ককে। সেখানে তিনি ভাবেন, চিন্তা ও ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকেন, সন্ধান করেন এক নতুন আলোকের যে আলোর দীপবর্তিকা ধারণ করে তিনি দূর করতে পারেন তাঁর চারিদিকের ঘনীভূত অন্ধাকার। তিনি সন্ধান করেন শক্তির উৎস, যা দিয়ে তিনি ভেঙ্গে চুরমার করে দেবেন এ বিকৃত দুনিয়াকে কায়েম করবেন মানবতার সুরু সুন্দর কাঠামো।
এ ধ্যান-তন্ময়তার মাঝখানে তাঁর জীবনে এলো এক বিপুল আত্মিক পরিবর্তন। তাঁর প্রকৃতি এতকাল ধরে সন্ধান করেছিল যে আলোক, আর অন্তরে অকস্মাৎ আবির্ভুত হল তার দীপ্ত রশ্মি। অকস্মাৎ তাঁর অন্তরে এলো এমন এক শক্তি, যার প্রকাশ তিনি আর কোনদিন অনুভব করেনি। পর্বত গুহার নির্জন পরিবেশ ছেড়ে তিনি বেরিয়ে এলেন বাইরে জনতার সামনে, আপন কওমের কাছে এসে তিনি তাদেরকে জানালেনঃ প্রস্তর মূর্তির কোন শক্তি নেই তার পূজা বর্জন কর। এ চাঁদ, এ সূর্য, এ যমীন ও আসমানের সকল শক্তি এক আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্টি তিনিই তোমাদের সকলের স্রষ্টা, তিনিই রিযকদাতা, জীবন-মৃত্যু সব কিছুই তার নিয়মের অধীন। সবাইকে ছেড়ে একমাত্র তাঁরই উপাসনা কর, তারই কাছে মনোবাসনার সিদ্ধি কামনা কর। চুরি ডাকাতি, লুট-তরায, শরাবখোরী, জুয়া প্রতারণা-যা কিছু করছো তোমরা, এসব পাপ-আল্লাহ ইচ্ছার বিরোধী এসব দুস্কৃতি পরিত্যাগ কর। সত্য কথা বল, ন্যায় বিচার কর, কারুর প্রাণনাশ কর না, কারুর সম্পত্তি হরণ করনা, যা কিছু গ্রহণ কর সত্যের পথে গ্রহণ কর, যা কিছু দান কর সত্য পথে দান কর। তোমরা সবাই মানুষ, সকল মানুষ পরস্পর সমান। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব (শরাফত)তার বংশ মর্যাদার নয়-বর্ণ, রূপ ও সম্পদে নয়। আল্লাহ-পরস্তি, সৎকর্ম ও পবিত্র জীবন যাত্রাই হচ্ছে মানুষের শরাফতের নিদর্শন। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ করে সৎ ও পবিত্র জীবন যাপন করে সেই হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষ। যে ব্যক্তি তার ব্যতিক্রম করে তার কোন গৌরবই নেই। মৃত্যুর পর তোমাদের সবাইকে হাযির হতে হবে স্রষ্টার সামনে চূড়ান্ত বিচার দিনের সেই সত্যিকার ন্যায়বিচারকের সামনে গ্রাহ্য হবেনা কোন সুপারিশ অথবা উৎকোচ। সেখানে প্রশ্ন উঠবেনা কোন বংশ মর্যদার। সেখানে হবে কেবল ঈমান ও সৎকর্মের হিসেব। যার কাছে এসব সম্পদ থাকবে তার বাসভূমি হবে জান্নাত এবং যার কাছে এর কোন কিছুই থাবে না তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে হতাশা ও দোযখের শাস্তি।
তখনকার আরবের জাহেল কওম এ পুণ্যাত্মা মানুষটির উপর দুর্ব্যবহার করে তাঁকে হয়রান করেছে কেবলমাত্র এ অপরাধে যে, তিনি তাদের বাপ-দাদার আমলে প্রচলিত কার্যকলাপের নিন্দা করেছেন এবং পূর্ব পুরুষদের অনুসৃত জীবন পদ্ধতির খেলাফ শিক্ষা দান করেছেন। এ অপরাধে তারা তাঁকে অকথ্য গালি দিতে লাগল, পাথর মেরে মেরে তাঁর জীবন দুর্বিসহ করে তুলল। তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল। একদিন দু’দিন নয়, ক্রমাগত তের বছর ধরে তাঁর উপর চালিয়ে গেল কঠিনতম নির্যাতন, অবশেষে তাঁকে স্বদেশের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে যেতে হল বিদেশে। দেশ ছেড়ে যেখানে তিনি আশ্রয় নিলেন, সেখানেও তাঁকে তারা কয়েক বছর ধরে পেরেশান করতে লাগল।
এত সব দুঃখ কষ্ট ও নির্যাতন তিনি কেন সহ্য করলেন? তার একমাত্র লক্ষ ছিল তার কওমকে সত্যের সহজ সঠিক পথ নির্দেশ করা। তার জাতি তাকে বাদশাহের মর্যাদা দান করতে প্রস্তুত ছিল, তার পায়ের উপর ঢেলে দিতে চেয়েছিল সম্পদের স্তুপ। তারা চাইত কেবল তাকে সত্য প্রচার থেকে বিরত রাখতে। তিনি তাদের সকল প্রলোভনকে অকাতরে উপোকারে আপন লক্ষে অবিচল রইলেন। যে মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য নয়, অপরের কল্যাণ সাধনের জন্য ক্রমাগত দুঃখ কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করে যান, তার চেয়ে বড় মহৎ অন্তঃকরণ ও সততার কল্পনা আর কারুর মধ্যে করা যায় কি? যাদের কল্যাণের জন্য তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারাই তাঁকে পাথর মেরে আহত করছে আর তিনি প্রতিদানে তাদের কল্যাণই কামনা করছেন। মানুষ তো দূরের কথা ফিরেশতা ও এমনি সততার নিদর্শন দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।
বিশেষ করে দেখা দরকার যে, এ মানুষটি যখন পর্বত গুহা থেকে এ সত্যের বাণী নিয়ে বেরিয়ে এলেন মানব সমাজের সামনে, তখন তাঁর মধ্যে ঘটে গেল কত বড় বিপ্লব। যে বাণী তিনি মানুষকে শুনাতে লাগলেন তা এমন স্বচ্ছ-সাবলীল, ভাষা ও সাহিত্যের মানদন্ডে এতই উচ্চাংগের ও অলংকার পূর্ণ যে তার আগে অথবা পরে এমন কথা কেউ কোন দিন বলেনি। কাব্য, বাগ্নিতা ও ভাষার স্বচ্ছতা নিয়ে আরবরা গর্ব করে বেড়াত। আরবের জনগণের সামনে তিনি চ্যালেঞ্জ করলেন কালামে পাকের সূরার মত একটি সূরা পেশ করতে, কিন্তু তাঁর সে চ্যালেঞ্জের সামনে সবারই মাথা নত হয়ে গেল। এ বিশেষ কালামের (কুরআন শরীফ) ভাষা যেমন ছিল, তাঁর সাধারণ আলাপ আলোচনা ও বক্তৃতার ভাষা কিন্তু তেমন উচ্চাংগের ছিল না। আজও যখন আমরা তাঁর নিজস্ব অন্যান্য বাণীর সাথে এ কালামের তুলনা করি, তখন তার মধ্যে ধরা পড়ে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য।
এ মানুষটি-এ আরব মরুর অক্ষরজ্ঞান বর্জিত মানুষটি যে জ্ঞানগর্ভ দার্শনিক বাণী উচ্চারণ করতে শুরু করলেন, তাঁর আগে আর কোন মানুষ এমন কথা বলেনি, তাঁর পরে আজ পর্যন্ত কেউ তেমনি বলতে পারেনি;এমন কি চল্লিশ বছর বয়সের আগে পর্যন্ত তাঁর মুখে কেউ এমন কথা শুনেনি।
এ উম্মী (নিরক্ষর) মানুষটি নৈতিক-জীবন ও সামাজিক- জীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মানব-জীবনের অন্যান্য সকল দিক সম্পর্কে এমন সব বিধান রচনা করে গেছেন যে, বড় বড় বিদ্বান ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা বহু বছরের চিন্তা-গবেষণা ও সারা জীবনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা দ্বারা বহু কষ্টে তার নিগূঢ় তাৎপর্য কিছুটা উপলব্ধি করতে পারে এবং দুনিয়ার মানবীয় অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নীরিক্ষা যত বেশি করে প্রসার লাভ করছে, ততই তার নিগূঢ় তাৎপর্য মানুষের কাছে সুস্পষ্টতর হয়ে উঠছে। তেরশ’বছরের অধিক কাল অতীত হয়ে গেছে;কিন্তু আজো তাঁর রচিত বিধানের মধ্যে কোন সংশোধনের অবকাশ অনুভুত হচ্ছে না। দুনিয়ার মানব-রচিত বিধান ইতিমধ্যে হাজার হাজার বার রচিত হয়েছে ও বাতিল হয়ে গেছে;প্রত্যেক পরীক্ষায় এসব বিধান ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রত্যেক বার তার মধ্যে পরিবর্তন সাধন করতে হয়েছে। কিন্তু এ নিরক্ষর মরুবাসী অপর কোন মানুষের সাহায্য ব্যতিরেকে যে বিধান মানুষের সামনে পেশ করে গেছেন, তার একটি ধারাও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি।
নবুয়াতের ২৩ বছরের মধ্যে তিনি নিজস্ব চরিত্র মাধুর্য, সততা, মহত্ত্ব ও উচ্চাংগের শিক্ষার প্রভাবে দুশমনদেরকে বানিয়েছিলেন দোস্ত এবং প্রতিদ্বন্দ্বিদেরকে পরিণত করেছিলেন সহযোগীতে। বড় বড় শক্তি তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করে তাঁর পায়ে আত্মসমর্পণ করেছে। বিজয়ী হয়েও তিনি কোন দুশমনের উপর তার দুশমনির বদলা নেননি, কারুর প্রতি তিনি কঠোর আচরণ করেননি। যে ব্যক্তি তাঁর আপন চাচাকে হত্যা করে তার কলিজা বের করে চিবিয়েছিল তার উপর বিজয়ী হলেও তিনি তাকে মাফ করেছিলেন, যারা তাঁকে পাথর মেরেছিল, স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল, তাদেরকে হাতে পেয়েও তিনি মার্জনা করেছিলেন। তিনি কারুর সাথে প্রতারণা করেননি, কখনো কোন প্রতিশ্রুতি ভংগ করেননি। লড়াইয়ের মধ্যে ও তিনি কোন নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেননি; তাঁর কঠিনতম দুশমনও কোন দিন তাঁর বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ ও যুলুমের অপবাদ আনতে পারেনি। তাঁর এ অতুলনীয় সততার প্রভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত সারা আরবের অন্তর জয় করেছিলেন। উপরের বর্ণনায় যে আরবদের অবস্থার পরিচয় পাওয়া গেল, নিজস্ব শিক্ষা ও হেদায়াতের প্রভাবে তিনি সেই আরবদেরকে বর্বরতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করে এক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সুসভ্য জাতিতে পরিণত করলেন। যে আরব কোন আইনের আনুগত্য স্বীকার করতে রাযী ছিল না, তাদেরকে তিনি এমন আইনানুগ করে তুললেন যে দুনিয়ার ইতিহাসে এমন আইননুসারী কওম আর দেখা যেত না। যে আরবদের মধ্যে অপরের আনুগত্য প্রবণতা মোটেই ছিলনা, তাদেরকে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের অনুগত করে দিলেন। যে মানুষের গায়ে কোন দিন নীতি বোধের হাওয়া পর্যন্ত লাগেনি তাদেরকেও তিনি এমন নৈতিক-চরিত্রসম্পন্ন করে তুললেন যে, তাদের অবস্থা পর্যালোচনা করে আজ দুনিয়া বিস্ময় বিমুগ্ধ হয়ে যায়। তখনকার দিনে যে আরবরা দুনিয়ার জাতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে হীন মর্যাদা সম্পন্ন ছিল, এ একটি মাত্র মানুষের প্রভাবে তেইশ বছরের মধ্যে তারা এমন প্রবল শক্তিমান হয়ে উঠলো যে, তারা ইরান, রোম ও মিসরের প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাটদের সিংহাসন উলটিয়ে দিল;দুনিয়াকে তারা দিল তাহযিব-তামাদ্দুন, নৈতিক জীবন ও মানবতার শিক্ষা; ইসলামের এক শিক্ষা ও এক শরীয়াত নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়লো এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সুন্দরতম এলাকা পর্যন্ত।
এ’তো গেল আরব কওমের উপর ইসলামের প্রভাব। এর চেয়ে বেশী বিস্ময়করভাবে নিরক্ষর আরব-নবীর প্রভাব পড়েছিল তামাম দুনিয়ার উপর। তিনি সারা দুনিয়ার প্রচলিত চিন্তাধারা, আচরণ-পদ্ধতি ও আইন-কানুনের মধ্যে আনলেন এক অভূতপূর্ব বিপ্লব। যারা তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল, তাদের কথা ছেড়ে দিলেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যারা তার আনুগত্য স্বীকারে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যারা তার বিরোধিতা করেছে তার সাথে দুশমনী করেছে, তারাও তার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়নি। দুনিয়া তাওহীদের শিক্ষা ভুলে গিয়েছিল, তিনি মানুষকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন সেই শিক্ষা। এবং এমন জোরের সাথে সত্যের ভেরী বাজালেন যে, আজ বুতপরস্ত ও মুশরিকদের ধর্ম পর্যন্ত তাওহীদের স্বীকৃতি দান করতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি এমন বলিষ্ঠ নৈতিক শিক্ষা মানুষকে দিয়ে গেছেন যে, তার বিধিবদ্ধ নীতি আজ তামাম দুনিয়ার প্রচলিত নৈতিক শিক্ষায় প্রসার লাভ করেছে ও করছে। আইন, রাজনীতি, সভ্যতা ও সামাজিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে নীতি তিনি নির্ধারণ করে গেছেন, তা এমন সত্যাশ্রিত ও সর্বকালে প্রযোজ্য যে, তার বিরোধী সমালোচকরা পর্যন্ত নীরবে তা থেকে মাল-মশলা সংগ্রত করে নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে।
আগেই বলেছি, এ অসাধারণ মানুষটি জন্ম নিয়েছিলেন এক জাহেল কওমের মধ্যে এক ঘনঘোর তমসাচ্ছন্ন দেশে। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত পশু চারণ ও সওদাগরী ছাড়া আর কোন বৃত্তি তিনি অবলম্বন করেননি। কোন রকম শিক্ষা-দীক্ষা তিনি লাভ করেননি। ভেবে দেখবার বিষয়, চল্লিশ বছর বয়সের পর তাঁর মধ্যে আকস্মিকভাবে এতটা পূর্ণতা এলো কোত্থেকে? কোত্থেকে তার মধ্যে এলো অপূর্ব জ্ঞানসম্ভার? কোত্থেকে তিনি পেলেন এ বিপুল শক্তি? একটিমাত্র মানুষ –কখনো তিনি অসাধারণ সিপাহসালার, কখনো এক অতুলনীয় জ্ঞানসম্পন্ন বিচারপতি, কখনো মহাশক্তিধর বিধানকর্তা, কখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিক, কখনো নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অতুলনীয় সংস্কারক, আবার কখনো বিস্ময়কর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতা!জীবনের বহুমুখী কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও রাত্রিকালে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন আল্লাহ্র ইবাদাতে, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি ও হক আদায় করেন, গরীব ও বিপন্ন মানুষের খেদমত করেন। এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসন-কর্তৃত্ব লাভ করেও ফকীরের মত জীবন যাপন করেন; মাদুরের উপর শয়ন করেন, মোটা কাপড় পরিধান করেন, গরীবের মত খাদ্য গ্রহণ করেন, এমন কি কখনো অনশনে অর্ধাশনে কেটে যায় তার দিন।
এমনি বিস্ময়কর অতি-মানবীয় পূর্ণতার পরিচয় দিয়ে তিনি যদি দাবী করতেন যে, তিনি অতি মানবীয় অস্তিত্বের অধিকারী, তা হলেও কেউ তার সে দাবী অগ্রাহ্য করতে পারতো না, কিন্তু তার বদলে তিনি কি বলেছেন? তার সে পূর্ণতাকে তিনি নিজস্ব কৃতিত্ব বলে দাবী করেননি, বরং তিনি হামেশা বলতেনঃ
আমার কাছে আপনার বলতে কিছুই নেই; এর সবকিছুর মালিক আল্লাহ এবং আল্লাহর তরফ থেকেই এসব আমি পেয়েছি, যে বাণী আমি পেশ করছি এবং যার অনুরূপ বাণী পেশ করতে সকল মানুষ ব্যর্থ হয়েছে, তা আমার নিজস্ব বাণী নয় তা আমার মস্তিষ্ক প্রসূত রচনা নয়। এ হচ্ছে আল্লাহর কালাম এবং এর সবটুকু প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। আমার যা কিছু কার্যকলাপ, তাও আমার নিজস্ব যোগ্যতা দ্বারা সম্পন্ন হয়নি, কেবলমাত্র আল্লাহরই নির্দেশে তা সম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহর কাছ থেকে যে ইংগিত আমি পাই অনুরূপ ভাবেই আমি কাজ করি এবং কথা বলি।
এমনি সত্যনিষ্ঠ মানুষকে আল্লাহর পয়গাম্বর না মেনে পারা যায় কি করে? তিনি এমন পূর্ণতার অধিকারী যে, তামাম দুনিয়ার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তার মত একটি মানুষ ও খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু তার সত্যনিষ্ঠা এমন অসাধারণ যে, সেই পূর্ণতার গর্ব তাঁর ভিতরে মোটেই নেই। সেই পূর্ণতার জন্য তিনি কোন প্রশংসা অর্জন করতে চান না। সকল প্রশংসা সুস্পষ্টভাবে তাঁরই প্রতি আরোপ করেন, যিনি তাঁকে সবকিছু দান করেছেন। কি করে তাঁকে সত্য বলে স্বীকার না করে পারা যায়? তিনি নিজে যখন তাঁর সবটুকু শ্রেষ্ঠত্বকে আল্লাহর বলে স্বীকার করেন, তখন আমরা কেন বলবঃ না, এর সবকিছু তোমার আপন মস্তিষ্কের সৃষ্টি? মিথ্যাচারী মানুষই তো অপরের কৃতিত্বকে আপনার দিকে টেনে নেবার চেষ্টা করে;কিন্তু এ মানুষটি যেসব কৃতিত্বকে সহজেই আপনার বলে দাবী করতে পারতেন যেসব কৃতিত্ব অর্জন করার কারণ কারুর জানা ছিল না। এবং যা প্রদর্শন করে তিনি অতিমানবীয় মর্যাদা দাবী করলে কেউ তা অগ্রাহ্য করত না, সেসব কৃতিত্বকেও তিনি তার আপনার দিকে টেনে নেবার চেষ্টা করেননি। তাহলে তার চেয়ে অধিকতর সত্যাশ্রয়ী মানুষ আর কে হতে পারে?
এ মানুষটি–এ অসাধারণ কৃতিত্বসম্পন্ন মানুষটি ছিলেন আমাদের নেতা তামাম জাহানের পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা)। তার নিজস্ব সত্যনিষ্ঠাই হচ্ছে তার পয়গাম্বরীর অকাট্য প্রমাণ। তার গৌরবময় কার্যকলাপ তাঁর স্বভাব-চরিত্র, তাঁর পবিত্র জীবনের ঘটনা প্রবাহ সব কিছুই ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে। যে ব্যক্তি স্বচ্ছ অন্তকরণে সত্যানুসন্ধিৎসা ও ন্যায়ের মনোভাব সহকারে তাঁর সে বিবরণ পাঠ করবে, তার অন্তর স্বতঃই সাক্ষ্য দান করবে যে, তিনি নিশ্চিত রূপে আল্লাহর পয়াগম্বর। যে বাণী তিনি পেশ করেছিলেন, তা-হচ্ছে কুরআন, তা-ই আমরা পাঠ করে থাকি। যে ব্যক্তি এ অতুলনীয় কিতাব হৃদয়ংগম করে মুক্ত অন্তরে পাঠ করবে তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এ নিশ্চিতরূপে আল্লাহ্র প্রেরিত গ্রন্থ এবং কোন মানুষের মধ্যেই নেই এরূপ গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষমতা।
খতমে নবুয়াত
একথা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, এ যুগে ইসলামের সত্য সহজ ও সঠিক পথের নির্দেশ জানার জন্য হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) এর শিক্ষা ও কুরআন মাজীদ ছাড়া আর কোন মাধ্যম নেই। মুহাম্মাদ (সা) সমগ্র মানব জাতির জন্য আল্লাহর পয়গাম্বর। তাঁর মধ্যেই পয়গাম্বরীর ধারা শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’য়ালা যেভাবে মানুষকে হেদায়াত করতে চান, তার সবকিছুর নির্দেশ তিনি পাঠিয়েছেন তাঁর আখেরী পয়গাম্বরের মাধ্যমে। এখন যে ব্যক্তি সত্যের সন্ধানী ও আল্লাহর মুসলিম বান্দাহ হতে ইচ্ছুক, তাঁর অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর আখেরী পয়গাম্বরের উপর ঈমান আনা, তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা মেনে নেয়া এবং তাঁরই প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলা।
খতমে নবুয়াতের প্রমাণ
পয়গাম্বরীর তাৎপর্য আগেই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেই কথাগুলো বুঝে নিলে এবং তা নিয়ে চিন্তা করলে সহজেই জানা যাবে যে, পয়গাম্বর রোজ পয়দা হয় না, প্রত্যেক কওমের মধ্যে সবসময় পয়গাম্বরের আবির্ভাব হওয়ার প্রয়োজন নেই। পয়গাম্বরের জীবই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াতের জীবন। যতক্ষণ তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াত জীবন্ত থাকে ততক্ষণ তিনি জীবিত থাকেন। পূর্ববর্তী পয়গাম্বরদের মৃত্যু ঘটেছে, কারণ যে শিক্ষা তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন দুনিয়ার মানুষ তা বিকৃত করে ফেলেছে। যেসব গ্রন্থ তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন তার কোনটিই আজ অবিকৃত অবস্থায় নেই। তাঁদের অনুগামীরাই আজ দাবী করতে পারছেনা যে, তাদের পয়গাম্বরের দেয়া আসল কিতাব তাদের কাছে মওজুদ রয়েছে, তারাই ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের পয়গাম্বরের দেখানো পথ!পূর্ববর্তী পয়গাম্বরদের মধ্যে একজনের ও নির্ভুল নির্ভরযোগ্য বিবরণ আজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রত্যয় সহকারে আজ বলা যায় না কোন জামানায় তিনি পয়দা হয়েছিলেন? কি কাজ তিনি করে গেছেন? কিভাবে তিনি জীবন যাপন করেছিলেন? কি কি কাজের শিক্ষা তিনি দিয়েছিলেন এবং কি কি কাজ থেকে মানুষকে বিরত করতে চেয়েছিলেন? এমনি করেই হয়েছে তাঁদের সত্যিকার মৃত্যু।
পক্ষান্তরে, হযরত মুহাম্মাদ (সা) আজো রয়েছেন জীবিত, কারণ তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াত আজো জীবন্ত হয়ে রয়েছে। যে কুরআন তিনি দিয়ে গেছেন, তা আজো তার তার মূল শব্দ-সম্ভার সহ অবিকৃত অবস্থায় মওজুদ রয়েছে তার একটি হরফ, একটি নোকতা, একটি যের যবরের পার্থক্য ও হয়নি কোথাও। তাঁর জীবন-কাহিনী তাঁর উক্তি সমূহ ও কার্যকলাপ সব কিছুই সুরক্ষিত হয়ে আছে। তেরশ বছরের ব্যবধানে আজো ইতিহাসে তাঁর বর্ণনা এমন সুস্পষ্টভাবে আমরা দেখতে পাই, যেন তাঁকে আমরা দেখেছি প্রত্যক্ষভাবে। হযরত (সা) এর ব্যক্তির জীবন-কাহিনী যেমন সুরক্ষিত হয়ে রয়েছে, দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোন ব্যক্তির জীবন-কাহিনী তেমন অবিকৃতভাবে সুরক্ষিত হয়নি। আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতি মুহুর্তে হযরত (সা) এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। তাতেই প্রমাণিত হয় যে হযরত (সা) এর পর আর কোন পয়গাম্বরের প্রয়োজন নেই।
এক পয়গাম্বরের পর অপর কোন পয়গাম্বরের আবির্ভাবের কেবল মাত্র তিনটি কারণ থাকতে পারেঃ
একঃ যখন পূর্ববর্তী পয়গাম্বরের শিক্ষা হেদায়াত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং পুনরায় তা পেশ করার প্রয়োজন হয়, দুইঃ যখন পূর্ববর্তী পয়গাম্বরের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকে এবং তাতে সংশোধন ও সংযোজনের প্রয়োজন হয়, তিনঃ পূর্ববর্তী পয়গাম্বরের শিক্ষা যখন কোন বিশেষ জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং অপর জাতি বা জাতিসমূহের জন্য অপর কোন পয়গাম্বরের প্রয়োজন হয়।
উপরিউক্ত তিনটি কারণের কোনটিই বর্তমানে প্রযুক্ত হতে পারে না, কারণঃ
একঃ হযরত মুহাম্মাদ(সা)এর শিক্ষা ও হেদায়াত আজো জীবন্ত রয়েছে এবং সেসব মাধ্যম এখন পুরোপুরি সংরক্ষিত রয়েছে, যা থেকে প্রতি মুহুর্তে জানা যায়, হযরতের দ্বীন কি ছিল, কোন জীবন পদ্ধতির তিনি প্রচলন করেছিলেন এবং কোন কোন পদ্ধতি মিটিয়ে দেবার ও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। যখন তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াত আজো মিটে যায়নি, তখন আবার তা নতুন করে পেশ করার জন্য কোন নবী আসার প্রয়োজন নেই।
দুইঃ হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর মাধ্যমে দুনিয়াকে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেয়া হয়ে গেছে। এখন তার মধ্যে যেমন কিছু কম-বেশী করার প্রয়োজন নেই, তেমনি তার মধ্যে এমন কোন ঘাটতি নেই, যা পূরণ করার জন্য আর কোন নবী আসার প্রয়োজন হবে। সুতরাং দ্বিতীয় কারণটির কোন অস্তিত্ব নেই।
তিনঃ হযরত মুহাম্মাদ (সা) কোন বিশেষ কওমের জন্য প্রেরিত না হয়ে তামাম দুনিয়ার জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁর শিক্ষা যথেষ্ট। সুতরাং এখন কোন বিশেষ কওমের জন্য স্বতন্ত্র নবী আসার প্রয়োজন নেই। তাই তৃতীয় কারণটিও এ ক্ষেত্রে অচল।
এসব কারণে হযরত মুহাম্মাদ (সা)কে বলা হয়েছে ‘খাতেমুন্নাবীয়্যিন’ অর্থাৎ যাঁর ভিতরে নবুয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন আর দুনিয়ায় নতুন কোন নবীর আবির্ভাবের প্রয়োজন নেই; প্রয়েজন কেবল এমন মানুষের-যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা) -এর পথে নিজেরা চলবেন ও অপরকে চালাবেন; যাঁরা তাঁর শিক্ষাধারাকে উপলব্ধি করবেন, তদনুযায়ী আমল করবেন এবং দুনিয়ায় যে আইন ও বিধান নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সা) তশরিফ এনেছিলেন, সেই আইন ও বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করবেন।