জামায়াতে ইসলামীর ঊনত্রিশ বছর
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
বইটির অডিও শুনুন
জামায়াতে ইসলামীর ঊনত্রিশ বছর
প্রিয় বন্ধুগণ এবং সমবেত ভদ্য মহোদয়গণ! আজ থেকে ঠিক ঊনত্রিশ বছর আগে এ তারিতে এতটি ক্ষুদ্র ঘটনা সংঘটিত হয়। লাহোর নগরীর একটি মহল্লা ইসলামীয়া পার্কে মাওলানা জফর ইকবাল সাহেবের বাড়ীরনিকটে একটি ছোট্ট বাড়ী। সে বাড়ীর একটি কক্ষে এক সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। এতে সমগ্র অবিভক্ত ভারত থেকে পঁচাত্তরজন লোক অংশগ্রহণ করেন এবং তারা জামায়াতে ইসলামী নামে একটি দল গঠন করেন।
মূলত এটা কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটা এমন কোন ঘটনা ও ছিল না যে, কোন ব্যক্তির মনে হঠাৎ একটা দল গঠনের ইচ্ছে গজিয়ে উঠলো আর সে অমনি কিছু লোক সংগ্রহ কওে একটা দল খাড়া কওে ফেললো। প্রকৃতপক্ষে এ ছিল আমার দীর্ঘ বাইশ বছরেরঅবিশ্রন্ত পরীক্ষা, পর্যবেক্ষন, চিন্তা পবেষণা ওঅনুশীলনের ফল যা তখন একটা পরিকল্পার রূপ পরিগ্্রহ কওে এবং সে পরিকল্পনা অনুসারেই জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয় আজ প্রথমবারের মত আমি জামায়াতে ইসলামীর ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করছি যা আজ পর্যন্ত বক্তৃতায় বা রচনায় বর্ণনা করিনি। আমার নিকটতম সাথীদের নিকটও আমি শুধুমাত্র এর ছিটেফোটাই উল্লেখ করেছি, কিন্তু একটি সংঘবদ্ধ ইতিহাসের আকারে এটি পেশ করার কোন সুযোগই এযাবত হয়ে উঠেনি।
পাছে এ ইতিহাস আমার সাথে সাথে কবওে চলে যায়, সে আশঙ্কায় আজ আমি তা বর্ণনা করার প্রয়োজন বোধ করছি। অন্যথায় আমার যে অভিজ্ঞতা ও চিন্তা করছিল, তা জনগণের অজানাই থেকে যেত।
খেলাফত আন্দোলন
আমি যখন কৈশোরে পদার্পন করি তখন পাক ভারত উপমহাদেশে চলছিলএক বিরাট আন্দোলন। একদিকে মুসলমানগণ প্রথম মহাযুদ্ধের অবসানে পুণ্যভূমিসমূহ ও ইসলামী খেলাফতের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জানমাল উৎসর্গ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। তৎকালীন খেলাফত ভালোমন্দ মিলিয়ে যে আকাওে কায়েম ছিল, সে ভাবেই তা রক্ষা করতে হবে এবং পবিত্র স্থানসমূহকে কাফেরদের আধিপত্যমুক্ত করতে হবে, এ ছিল তাদের দুর্দম সংকল্প। এ ছিল একটি পবিত্র ধর্মীয় আবেগ যা সমগ্র মুসলিম জাতিকে উদ্বেলিত ওআন্দোলনমুখর কওে তোলে, অপরদিকে জালিয়া ওয়ালাবাগোর নৃশংস হত্যাকাণ্ড সারা ভারতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সারা ভারত ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার অদ্যম প্রেরণায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে এবং হিন্দু ও মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রাম শুরু করে। মুসলমানদের মনে খেলাফত রক্ষার প্রেরণা প্রাধান্য লাভ করে আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছিল খেলাফত আন্দোলন। হিন্দুদের মনে ছিল স্বাধীনতা অর্জনের আগ্রহ এবং তারা কংগ্রেসেরনেতৃত্বাধীনে তা অর্জনের জন্য ছিল সংগ্রামমুখর। উভয় জাতি গান্ধীজিকে সম্মিলিত ভাবে নেতা মেনে নিয়ে অসহযোগে আন্দোলন শুরু করে এবং মুসলিম জাতির কয়েকজন নেতা ব্যতিত তখন সমস্ত শীর্ষ স্থানীয় মুসলিম নেতাই এ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।
আমি তখন ১৬/১৭ বছরের নবীন যুবক মাত্র। স্বভাবতই আমার মনে নিজ জাতীয় নেতৃবৃন্দের উপর অগাধ আস্থা ছিল এবং তা থাকার কথাও। প্রত্যেক মুসলমানের মত আমারও এজন্য মনে দুঃখ হতো যে মুসলমানদের একটি মাত্র স্বাধীন সাম্রাজ্য অবশিষ্ট ছিল অর্থাৎ তুর্কী সাম্রাজ্য, তাও তখন অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। খেলাফত যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন তা তখনো দুনিয়ার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারতো। অথচ তাও লুপ্ত হতে যাচ্ছিল এবং মুসলমানদের সমস্ত পবিত্র স্থানের স্বাধীনতা বিপন্ন মনে হচ্ছিল। এ সম্পর্কে সমগ্র জাতির যেরূপ মনোভাব ছিল; একজন মুসলমান হিসেবে আমার ও তদ্রুপ ছিল্। তাই আমি ও খেলাফত আন্দোলনে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে যোগদাদন করি। কিন্তু প্রথম থেকেই আমার অভ্যাস ছিল যে, যে বিষয়েরই সংস্পর্শে আমি গিয়েছি বা যে বিষয়ের প্রতি আমার মনোযোগ আকুষ্ট হয়েছে, আমি সে বিষয়ে যথাসম্ভাব অধিক পরিমাণ জ্ঞান ও তথ্য অর্জনের চেষ্টা করেছি যাতে করে বিষয়টি ভালভাবে হৃদয়ংগম করতে পারি। এ অভ্যাসের অনুবর্তী হয়ে আমি খেলাফত সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যায়ন করি এবং এথেকে আমিজানতে পারি যে তুর্কী জাতির মধ্যে যে নেতৃত্ব সক্রিয় ছিল তা তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। আর তুর্কী যুবকরা পাশ্চাত্য জাতি থেকে যে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বহন করে এনেছিল তা দ্বারা এ নেত্রত্বের মেজাজ ও প্রকৃতি সংক্রমিত হয়েছি। । এ অধ্যয়ন থেকে আমিএ কথা ওজানতে পেরেছিলাম যে, ইসলামের শত্রুরা তুর্কি জাতীয়বাদের জাগিয়ে তুলেছিল, যার ফলে প্রথম মহাযুদ্ধে আরব ও তুর্কী মুসলমান সম্মিলিতভাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার পরিবত্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে খুব্ধ হয়েছিল। তুর্কি নেতৃবৃন্দ একদিকে ইসলামী খেলাফতের পরিচালনা অব্যাহত রাখতে চান, অপরদিকে তাকে ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে চালাতে চান। এর চেয়ে নির্বুদ্ধিতা আর কি থাকতে পারে? তুর্কী নেতৃবৃন্দ তাদের সাম্রাজ্যকে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে চালাতে গিয়েও চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেন। কেননা এ সাম্রাজ্য আরব কুর্দ এবং অন্যান্য বহু অতুর্কী মুসলমানর বসবাস করতো যারা ইসলামী খেলাফতের অনুগত হতে পারতো কিন্তু তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে প্রস্তুত হতো না। অন্যদিকে ইহুদীর খৃষ্টানদের প্রবঞ্চনায় পড়ে যে আরব নেতৃবৃন্দ তুর্কী জাতীয়তাবাদের মোকাবেলায় আরব জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলেছিল তারাও অমার্জনীয় বোকামীর পরিচয় দিয়েছিল। এ ইতিহাসে যখন আমি জানতে পারলাম তখন আমার মনে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হলো। ভাবলাম, যে খিলাফতের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভারতের মুসলমারা নিজেদেও যথাসর্বস্ব বিসর্জন দিতে বসেছে তার আদৌ কোন ভিত্তিই নেই। আমাদের গোটা জাতি এমন একটি বৈদেশিক সমস্যা নিঢে সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছে যা আমাদের আয়ত্তের বাইওে। ধর্ম নিরপেক্ষতবাদী তুর্কীরা যদি নিজ হাতেই ইসলামী খেলাফতের অবসান ঘটায় তাহলে আমাদে আন্দোলনের কি দশা হবে কিন্তু এসব প্রশ্ন সত্ত্বে ও যেহেতু আমি একজন তরুণ মাত্র ছিলাম তাই আমার মগজে এরূপ চিন্তা করার মত দুঃসাহস ছিল না যে, আমাদের জাতির বড় বাড় নেতাগন যা বুঝেন না, আমি তা বুঝি। তাই ওসব প্রশ্ন মনের মধ্যে চেপে রেখেই আমি খিলাফত আন্দোলনের কাজ করতে থাকি।
হিন্দু মুসলিম এক্য ও স্বরাজ আন্দোলন
এমনিভাবে যখন হিন্দু মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হলো, কংগ্রেসের সাথে মিলিত হয়ে মুসলমানরা কজ শুরু করলো এবং চারদিক থেকে স্বরাজ এর আওয়াজ উঠতে থাকলো, তখন আমি এ ব্যাপারেও অনেক চিন্তা গবেষণা ও পড়াশুনা করলাম। কংগ্রেসের ইতিহাস পড়লাম তার উদ্দেশ্যে লক্ষ্যেও সাথে পরিচিত হলাম, ভারতে যে পন্থায় গণতন্ত্রের বিকাশ হয়ে আসছিল এবং কংগ্রেস যে পন্তায় তাকে পূর্ণতার রূপ দিতে চাইছিল, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, ইংরেজরা ভারতে এসে নিজ দেশের অনুকরণে এদেশের অধিবসিীদের ও একজাতি মনে করে নিয়েছে। আর সে অনুসারে তারা নিজ দেশের রীতি অনুযায়ী এ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চাচেছ। হিন্দুদের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে লাভজনক ব্যাপার। কেননা তারা ছিল সংখ্যাগুরু। তারা মনে করত যে ভারতের সমস্ত অধিবাসীকে একজাতি ধরে নিয়ে যে গণতন্ত্রিক ব্যবাস্থা প্রতিষ্টিত হবে তাতে তারা একতরফা ফায়দা লুটতে পারবে এবং এতি শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা ও শুধু হিন্দুদের অধীনস্থই হবে না বরং কার্যত এক প্রকারের গোলামে পরিণত হবে। কংগ্রেসের ইতিহাসে অধ্যয়নের পর যখন আমি এ কথা উপলব্ধি করলাম তখন আমার মনে প্রশ্ন দেখা দিল যে, আমাদেও জাতির নেতৃবৃন্দ কিভাবে কংগ্রেসের সাথে ঐক্য স্থাপন করছেন?আমার পক্ষে এটাও বিস্ময়কর ছিল যে, শুধু তখনই নয় বরং তার পরে ও কয়েক বছর পর্যন্ত সমস্ত শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতাগণ উপমহাদেশে মাত্র একটি জাতি বাস করে ধরে নিয়ে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে সম্মত ছিলেন এবং তার মধ্যে মুসলমানদের জন্যে শুধুমাত্র শাসন তান্ত্রিক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা হলেই সন্তষ্ট ছিলেন। মুসলিম অমুসলিম কিভাবে এক জাতি হতে পারে এব তাদেরকে এক জাতি ধরে নিয়ে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাতে মুসলমানদের নিরাপত্তার কি ব্যবস্থা হতে পারে, তা একেবারেই আমার বুদ্ধির অগম্য ছিল। শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচ সম্পর্কে আমি যতই চিন্তা করতাম ততই স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করতাম যে, যদ্দিন ইংরেজদের সরকার বহাল থাকে এবং তারা এ রক্ষাকবচের রক্ষণাবেক্ষণ কওে কেবল তদ্দিনই তা টিকতে পারে কিন্তু যদি কোন দিন ভারত ইংরেজদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পায় তাহলে আর রক্ষকবচের অস্তিত্ব থাকবে না। তখন এমন করুণ দৃশ্য ও দেখতেহবে যে,স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচের দলিল হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর হিন্দুরা যা খুশী তাই করতে থাকবে। তখন হিন্দু সংখ্যাগুরু ও যুলুম থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে এমন কোন শক্তিই মুসলমানদের থাকবে না।
আমার মনে এ প্রশ্নটি বরাবর চাপা পড়ে থাকে। কেননা আমি আগেই বলেছি, একজন যুবকের পক্ষে নিজেন সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন ছিল যে, আমিই জাতির সমস্যাবলী জাতির নেতৃবৃন্দের চেয়ে ভালো বুঝি। তাই উক্ত প্রশ্ন আমার মনে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও আমি তা নিয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের পরিচালিত আজাদীআন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতে থাকি।
১৯২৪সালে আমার মনের সমস্ত চাপা আশঙ্কা হঠাৎ ঘটন্ াহয়ে দেখা দিল। আর সেই সাথে জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি আমার আস্থার বিচলিত হলো। তুরস্কের যে ওসমানী খেলাফতের রক্ষণাবেক্ষনের জন্য সারা ভারতের মুসলমানরা সর্বস্ব পণ করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল খোদা তুর্কী শাসকগণ; ১৯২৪ সালে নাটকীয়ভাবে সে খিলাফতের ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের কথা ঘোষণা করে বসলেন। নিজ দেশের সমস্ত সমস্যাবলিকে অগ্রাহ্যকরে যে খিলাফতের জন্য আমাদেও জার্তি গোটা বিশ্বের সাথে করতে প্রস্তুত হয়েছিল, সে খিলাফতের নিশানবাহীরা নিজেরাই ঘাড়ের ওপর থেকে খিলাফতের গুরুভার দূরে নিক্ষেপ করলো আর ভারতের মুসলমারা তাদের দিকে মূঢ়ের মত তাকিয়ে রইল। এ ঘটনার পরিণতি এ দাড়ালো যে আকস্মিকভাবে মুসলিম জাতির মেরুদণ্ড নিদারুন হতাশায় ভেংগে পড়লো।
অপরদিকে ১৯২৪সালেরই শেষেরদিকে সে হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও খতম হয়ে গেল যার ভিত্তিতে এ যুগান্তকারী আন্দোলান শুরু হয়েছিল। ভারতের স্থানে হিন্দু মুসলিম াদঙ্গার হিড়িক পড়ে গেল এবং এসব াদাঙ্গার গান্ধী থেকে শুরু করে সকল স্তরের হিন্দু নেতাদের নীতি ছিল যে, মুসলামন মযলুম হলে ও তার নিন্দা করা আর স্পষ্টরুপে ধরা পড়েছিল। এ থোকে বুজা গিয়েছিল যে, হিন্দু মুসলিম ঐক্য সম্পূর্ন অর্থহীন ব্যাপারএবং তা কখনো বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নায়।
শুদ্ধি আন্দোলন
এরপর ১৯২৫ সালে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ শুদ্ধি আন্দোলন (মুসলমানদেরকে হিন্দু বানানোর আন্দোলন) শুরু করলেন। এ শ্রদ্ধানন্দকেই হিন্দু মুসলিম ঐক্যের যুগে মুসলমানরা নিজেরাই দিল্লি জামে মসজিদেও মকাব্বারে দাঁড় করিয়ে তাকে দিয়ে বক্তৃতা করিয়েছিলেন।
কেউ কেউ এরুপ ধারনা পোষণ করেন যে শ্রদ্ধনন্দকে মসজিদের মিম্বরের ওপর দাড় করানো হয়েছি। অথচ এ ধারণা ঠিক নয়। আসলে তাকে মুকাব্বরের ওপর দাড় করাানো হয়েছিল। (দিল্লী জামে মসজিদের যে উচু স্থানটায় দাড়িয়ে মুয়াজ্জিন)। আম স্বায়ং তখন জামে মসজিদের সে জনসমাবেশে উপস্থিত ছিলাম। আমি শ্রদ্ধানন্দকে মসজিদের মুকাব্বারের ওপর দাড়িয়ে বক্তৃতা দিতে দেখে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম যে মুসলমানদের কোন পাগলামীতে পেয়ে বসলো যে তার একজন হিন্দুকে ডেকে এনে জামে মসজিদের মুকাব্বারে দাড় করিয়ে বক্তৃতা দেয়াচ্ছে? এর মাত্র দুতিন বছর যেতে না যেতেই এ লোকটি মুসলমানদের এ উদারতার এভাবে প্রতিশোধ নিল যে, প্রকাশ্যে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করে দিল।
যখন শুদ্ধি আন্দোলন শুরু হয় তখন আবার আমি সেটি নিয়ে চিন্তাগবেষণা ও পড়াশুনা শুরুকরি। আমি চিন্তা করতাম যে, এক সময়ে মুসলমানরাই সারা দুনিয়ায় ইসলাম প্রচার করতো আর আজ কিনা অবস্থা এত দুরে গিয়ে পৌছেছে যে, এ উপমহাদেমে এক ব্যক্তি মুসলমানদের কে প্রকাশ্যে হিন্দু বানানোর ধৃস্টতা দেখাচ্ছে। আমি সে যুগে এ বিষয় নিয়ে যতদূর পড়াশুনা করি তা থেকে আমি এ সিদ্ধান্ত উপনীত হয় যে, মুসলমান প্রকৃত পক্ষে একটি মিশনারী জাতির নাম, শুধু একটি জাতির নাম নয়। মুসলমান এমন একটি জাতির নাম যার দুনিয়ার নিজস্ব মিশন রয়েছে। ইসলাম কথনো পেশাদার প্রচারকদের দ্বারা প্রচারিত হয়নি এবং প্রতিটি মুসলমান মুসলামান হিসেবে একজন প্রচারক। তার শুধু নিজের মুসলমান হওয়াই যথেষ্ট নয় বরং নিজের আচার আচরণ, আলাপ ব্যবহার, চালচলন, স্বভাব চরিত্র মোটকথা প্রতিটি বিষয় দ্বারাই তাকে ইসরাম প্রচার করতে হয়। যদ্দিন মুসলমানদের মধ্যে একটি মিশনারীজাতির এসব গুণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যবামান ছিল তদ্দিন তারা তরবারী ছাড়াই নিছক প্রচারের জোরে দেশের পর দেশ জয় করেছে। সমগ্র ইন্দোনেশিয়া এ প্রচারের কারনেই মুসলমান হয়েছে। কোন মুসলমান সেখানে তরবারী নিয়ে যায়নি। মালয়েশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যআফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা এবং আরো কয়েকটি দেশ এমন রয়েছে যে খানে মুসলমানরা নিজ নিজ স্বভাব চরিত্র ও আচার ব্যবহার দ্বারাই মানুষের মন জয় করেছে এবং অসংখ্য জাতিকে মুসলমান বানিয়েছে। এ পাক ভারত উপমহাদেশের কথাই ধরাযাক। এখানে যেকোটি কোটি মুসলমান রয়েছে তাদের সবাইাতো আর দিদেশে থেকে আসেনি। তখানকার মুসলিম সরকারগুলো এবং সম্রাটগুলো কখনো শক্তি প্রয়োগ করে ইসলাম প্রচার করেননি। যারা মুসলমান হয়েছেন সকলেই কেবল দাওয়াত ও প্রচারের ফলেই মুসলামন হযোছেন। আমি চিন্তা করে দিশে পেতাম না কি কারণে ইসলামের প্রচার বন্ধ হয়ো গেল এসব প্রশ্নের সমাধান লাভের জন্য আমি আবার চিন্তা গবেষণা ওপড়াশুনায় আত্ম নিয়োগ করি। অবশেষে আমি উপলব্ধি করি যে, মুসলমান দীর্ঘ দিন ধরে নিজেদের প্রচারক বা মিশনরী জাতি হওয়ার দিকটা বিস্মৃত হযে গেছে এবং শুধু একটা জাতিতে পরিণত হয়ে রয়েছে। এখন তাদের কার্যকলাপ দ্বারা কার্যত একথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, কালেমা পড়লে বা না পড়লে মানুষের জীবনে কোন পার্থক্য। সূচিত হয় না। একজন অমুসলিম যত বড় মিথ্যাবাদি হতে পারে অনেক মুসলমান ও তত বড় মিথ্যাবাদী হতে পারে। একজন অমুসলিম যত খানি দুর্নীতি পরায়ন হতে পারে অনেক মুসলমানর তত খানি দুর্নীতি পরায়ন হতে পারে, মুসলমান ও ব্যভিচার করে অমুসলমানরা ও করে। মুসলমানরা ও ঘুষখোর হতে পারে অমুললমানরা ও হতে পারে। মুসলমানরা যখন নিজেদের এ পরিচয় অন্যান্য জাতির সামনে তুলে ধরে তখন এখানে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কোন উপাই থাকতে পারে না। এর পর হিন্দুদের মনে মুসলমানদের মধ্যে শুদ্ধি আন্দোলন চালানোর সাহস জন্মানো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তারা বলতে পারে যে তোমাদের ও আমাদের পূর্ব পুরুষ হিন্দু ছিল, এখন ধর্ম পরিবর্তন কওে ও যখন তোমাদের জীবন ও চরিত্র বিশেষ কোন পার্থক্য আসেনি,তখন পৈতৃক ধর্মের দিক ফিরে আস।
এ সময়ে আমি আল জমিয়ত পত্রিকায় একটি ধারাবহিক নিবন্ধ লিখি। এ নিবন্ধটি তখন ইসলামে শক্তির উৎস নামে একটি বই এর আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এতে আমি আমার চিন্তা গবেষণা ফল সম্পূণূ রূপে ব্যক্ত করে দিয়েছিলাম। সে সময় থেকে আমার মন মগজ এই বিশ্বাস বদ্ধ মূল হয়ে আছে যে, পুনরায় একটি মিশনারী তথা আন্দোলন মূখর জাতিতে পরিণত হওয়ায় মধ্যেই মুসলমানদের মুক্তি নিহিত রয়েছে। অবিভক্ত ভারতে মুসলমানরা যে জটিল সমস্যায় জর্জরিত ছিল, আমার দুষ্টিতে তা থেকে ও মুক্তি লাভের এ একই পথ ছিল। নচেৎ শুধুমাত্র একটি জাতি হিসেবে বাস করলে এখানে তাদের কল্যাণ নেই।
শ্রদ্ধানন্দ হত্যা
এর পরে ১৯২৬ সালে জনৈক মুসলমান স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে হঠাৎ হত্যা করে বসলো এবং সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ভারতে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবাহ আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু হয়ে গেল। গান্ধীজী পযর্ন্ত চেচিয়ে উঠলেন যে, ইসলাম হচ্ছে তরবারী ও হিসেবে ধর্ম। এ সময়ে আামার মনে এ সংকল্প জন্মে যে আামি ইসলামের জেহাদ নীতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অনুশীলন করে তা বুঝার চেষ্টা করবো এবং এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করবো। (১) আমার এ অধ্যয়ন ও অনুশীনের ফল হচ্ছে আমার গ্রন্থ ‘আল জিহাদ ফিল ইসলাম’। এটি আজ পুস্তকারে বর্তমান। এ অধ্যয়ন ও অনুশীলনকালে আমি বুঝতে পারি যে ইসলাম মূলত এ জন্য দুনিয়ায় আসেনি যে কুফরী ব্যব¯থার অধীনে দেশ শাসিত হবে এবং মুসলমানরা এ বাতিল শাসন ব্যবস্থার পদানত হয়ে থাকবে। ইসলাম এসেছে এ জন্য যে পৃথিবধীতে কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বের চাবিকাঠি মুসলমানদের হাতেই নিবন্ধ থাকবে আর উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে মুসলিম জাতির ন্যায় ইসলামী রাষ্ট্র ও একটি মিশনারী রাষ্ট্র হয়ে থাকে এবং তা ন্যায় নীতি ও সুবিচার, সততা, দরিদ্রের সেবা এবং অন্যান্য সদাচরণের দ্বারা সারা দুনিয়ার সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও ন্যায় নিষ্টতার সাক্ষ্য দেয়। তার আইন আদালত, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ক’টনৈতিক বিভাগ মোটকথা তার প্রতিটি কাজ মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি জাতি ও রাষ্ট্রকে ইসলামকি রঙে রঞ্জিত করেআর কুফরই বা তার কাজ। আর জেহাদের ও প্রকৃত উদ্দেশ্যে হচ্ছে কুফরের উপর ইসলামকে জয়যুক্ত করা। এসত্য সে সময়ই আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল আর তার পরে ও অবিরাম এটি আমাকে অনুপ্রাণিত করতে থাকে।
মুসলমানদের পাশ্চাত্য মুখীনতা
১৯২৪ সালের পর ভারতে মুসলমানদের মধ্যে সাংঘাতিক বিভেদ ও বিশৃংখলা ছগিড়য়ে পড়ে এবং ১৪/১৫ বছর পর্যন্ত সমগ্র জাতি মারাত্মক মানসিক জড়তা ও বিভ্রান্তিতে জর্জরিত থাকে। এ সময়ে ক্রমাগত এমন সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে থাকে যা দেখে আমার মনে হতে লাগলো যে, মুসলমানরা সোজা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এবং সম্পর্কে আমি মাত্র তিন চারটি উদাহরণ পেশ করবো।
এ সময়ে তুরস্কে এবং তুরস্কের দেখাদেখি অন্যান্য মুসলিম দেমে পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণের এক তীব্র প্রবণতা দেখা দেয়। মুসলমানদের জাতীয় পোষাক পরিবত্যন করা হয়, তুরস্ক থেকে আরবী বর্ণমালাকে নির্বাসিত করা হয়। এমনকি মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করা হয়, যা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যেবাদও কোন মুসলিম দেশে করতে সাহসী হয়নি। ভারতের মুসলমানদের উপর ও এসব বিষয়েরর প্রভাব পড়ে। তারাও ভাবতে শুরু করে যে তাদের পাশ্চাত্য পোষাক পরিচ্ছদ গ্রহণ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ করা ইচিত। এমনকি বহু লোক আমাদের বর্ণমালা পর্যন্ত পরিবর্তন করে তপ্রস্তুত হয়ে যায়। ঐ সময় আমি পোষাক সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখি। এ প্রবন্ধ আমি বলেছিলাম যে,পোষাক পরিধান করা বেশী দোষণীয় মনে না হতে পারে কিন্তু মূলত এর পেচনে খুব গভীর কৃষ্টিগত, ঐতিহ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণ ক্রিয়াশীল থাকেএবং পোষাক পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত সুদুরপ্রসারী হয়ে থাকে। এ প্রবন্ধ সর্ব প্রথমে ১৯২৯ সালে মায়ারেফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তা আমার গ্রন্থ তাফহিমাতের অন্তর্ভুক্ত।
এ সময় প্রকাশ্যে মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার প্রচার শুরু হয়ে যায়। মুসলমানদের ঈমান ও প্রত্যয়কে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। এ সময়ে এমন সব পত্রিকাও প্রকাশিত হতে থাকে যা সাহিত্যের নামে মুসলমানদের মধ্যে প্রকাশ্যে চরিত্রহীনতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা ও প্রেম প্রণয়নের বীজ ছড়ানো শুরু করে। এর কিছু নমুনা আমি আমার গ্রন্থ “পর্দায়” উল্লেখ করেছি। এসব পত্র পত্রিকার মাধ্যমে যে ধরনের ন্যাক্কারজনক প্রচারণা চলতে থাকে এবং যে ধরনের সাহিত্য জনগণের মধ্যে পৌছাতে থাকে তা দেখে আমি অনুভব করতাম যে, জাতি হিসেবে আমাদের অস্ত্বিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। কেননা যে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। কেননা যে জাতি সংখ্যাগুরু কাফেরদের মধ্যে বসবাস করে, তার ঈমান ও চরিত্র যদি এভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয় তাহলে সে কি করে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে? সে সময় মুসলমানদের মধ্যে কম্যুনিজমের প্রচারও শুরু হয়। কম্যুনিস্টরা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রচার ঘাটি বানিয়ে দেশের শিক্ষিত জনগণের মধ্যে কম্যুনিজম প্রচার করতে শুরু করে।