দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কুফল
ঐ সময় আমিআরো অনুভব করি যে, মুসলমানদের মধ্যে দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করছে। আধুৃনিক শিক্ষা ব্যবস্থার দরুন লোকেরা ইসলাম থেকে দুরে সরে যাবেই এবং তাদের গোটা মনমানস পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সাহায্যে তৈরি হচ্ছে। আর প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকেরা ধর্মীয় বিদ্যা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল হলে ও দুনিয়ার বিষয়াবলী সম্পর্কে অনবহিত থেকে যাচ্ছে। এ দুটো গোষ্ঠি যে মুসলিম জাতির মধ্যে এক্য ও সংহতির পরিবর্তে দুটো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী চরিত্র ও মন মেজাজ সৃষ্টি করছে,তা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছিল। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও মানসিক দিক দিয়ে ধর্মহীনতার দিক ধাবিত হচ্ছে। অপরদিকে প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিতরা ধর্মপরায়ণতার প্রতি পালন করে যাওয়া সত্ত্বে ও সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যতা অর্জন করছেন না। আমি স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম যে, এ উভয় শ্রেণীর মধ্য দূরত্ব বেড়ে চলেছে এমনকি উভয়ে উভয়ের ভাসা পর্যন্ত বুঝতে অক্ষম। এরূপ পরিস্থিতি দেখে আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হচ্ছিল যে, দূরত্ব খতম না হওয়া পর্যন্ত সংকট মুসলমানদের মুক্তির সম্ভাবনা নেই।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি
এবার সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টিপাত করা যাক। ১৯২৮সাল পর্যন্ত আজাদীর কোন আন্দোলন মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না এরূপ একটি সাধারণ ধারণা সারা ভারতে প্রচলিত ছিল। মুসষমানরা ও এ ভরসার ছিল যে, কংগ্রেস তাদেরকে সাথে না নিয়ে কোন আন্দোলন চালাতে পারবে না কিন্তু ১৯২৯ সাল পর্যন্ত গান্ধী বুঝতে পারলো যে, মুসলমানরা একেবারেই শত বাধা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাদরে মধ্যে নেতৃত্ব বলতে কিছুই নেই এবং কোন শৃংখলা ও নেই। তাই এখন আমি শুধু হিন্দুদের সাথে নিয়ে বৃটিশ সরকারের সাথে সংগ্রাম করে আজাদী হাসিল করতে পারি। ১৯২১ সালে প্রথমবারের মত তিনি মুসলমানদের সম্মোাধন করে বললেন, আমি আজাদীর জন্য সংগ্রাম করবো, আর যদি বিরোধীতা কর তবে বিরোধীতা সত্ত্বে ও করবো। তার ভাষা ছিল, গান্ধী যখন এ কথা বললেন তখনই আমি উপলদ্ধি করলাম যে, এখন আর এদেশে মুসলমানদের কল্যাণ নেই। কেননা তিনি বাস্তবিকই শুধুমাত্র হিন্দুদের সাথে নিয়ে সংগ্রাম করে আজাদী হাসিল করতে সক্ষম ছিলেন এবং মুসলমানরা এমন সাংঘাতিক ভাবে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন যে তারা তার গতিরোধ করতে পারতো না। তিনি মুসলমানদের কে এমন সংকট নিক্ষেপ করলেন যে তারা তিনটিকাজের মধ্যে একটি করতে বাধ্য হলো। হয় তার শর্তহীন ভাবে হিন্দু নেতৃত্ব মেনে নিয়ে হিন্দুরাজ কায়েম করতে প্রস্তুত হবে অথবা নিরব দর্শক হয়ে তার ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার দৃশ্য দেখবে অন্যথায় বিরোধিতা করে বৃটিশ শাসনের তল্পিবহনের অপবাদ মাথায় পেতে নেবে।
দুর্ভাগ্যবশত সে সময় মুসলমানদের তিনটি গোষ্টি এ তিনটি পথই গ্রহণ করলো এবং সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন এক নেতৃত্বের অধীনে এক পথ অবলম্বন করতে পারলো না। আমি সে ভয়াবহ পরিস্থিতি স্বচক্ষ দেখছিলাম এবং তার পরিণতি কি হবে তার বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু তখন এর মোকাবেলায় কিছু করতে পারি এমন অবস্থা আমার ছিল না। নিজের অসহায়তার উপর বিলাপ করা ছাড়া আমার সামনে অন্য কোন পথ খোলা ছিল না।
তরজমানুল কোরআনের প্রকাশ
এ সময় আমি দিল্লী থেকে হায়দারাবাদ স্থানান্তরিত হই। সেখানে মুসলমানদের একটি বিরাট রাজ্য কায়েম ছিল। এ রাজ্য আয়তন, লোকসংখ্যা ও আর্থিক স্বচ্ছলতার দিক দিয়ে দুনিয়ার কোন কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের চাইতেও বৃহৎ ছিল। এর শাসক ছিল মুসলমান। মুসলমানদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ এখানে অবস্থান করতেন। এবং একটি বিরাট সাম্রাজ্যা পরিচালনা করতেন। এর উপায় উপকরণ শুধু হায়দারাবাদের লোকদেরই নয় বরং এর বাইরে ও ভারতীয় মুসলমানদের শক্তির উৎস ছিল। হায়দারাবাদ রাজ্য বিশ্ববিখ্যাত ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কায়েম করে উর্দু ভাষাকে সকল বিষয় উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে বনিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। সেখানে পৌছে মুসলমানরা গৌরব বোধ করত যে, ভারতে এমন একটি ভুখণ্ড রয়েছে যেখানে মুসলমানরা একটি বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করছে। কিন্তু বাহ্যত এচমকপ্রাদ যবনিকার অন্তরালে দৃষ্টি দিয়ে আমি দেখতে পেলাম,নিজামের বিশাল সাম্রাজ্য বালুর সৌধ ছাড়া কিছু নয়। হায়দারাবাদ রাজ্যে মুসলমানদের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ। বাদবাকী ৮৫ ভাগই ছিল হিন্দু। শুধুমাত্র সরকারী চাকরী ওপদসমূহই ছিল মুসলমানদের একমাত্র সহাই। ব্যবসাবাণিজ্য শিল্প কারখানা সবইহিন্দুদের কুক্ষিগত ছিল। গ্রামে মুসলমানদের ছিল। মুসলিম জনসংখ্যা শহরে কেন্দীভুত ছিল। গ্রামে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। ইম বুঝতে পারলাম যে, যে আজাদী আন্দোলন সারা ভারতে চলছে তার স্রোত যকান হায়দারাবাদদে এসে পৌছেবে তখন নিজামের সাম্রাজ্যের এ বিশাল সৌধ মাত্র এক ধাক্কায় ভুমিস্যাৎ হবে। আমি সেখানকার কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ করলাম যে, আপনারা এখানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ইসলাম প্রচারের একটা ব্যবস্থা করুন। কিন্তু আমার মনে হলো যেন নিজামের সরকার একটা নেশার বস্ততে পরিণত হয়েছে এবং তা খেয়ে মুসলমানরা অলসতায় মত্ত হয়ে আছে। তাদের যত চিন্তা কেবল নিজামের সরকারকে কোনমতে খাপটে ধরে বাচানো যায় কিনা তাই নিয়ে। কিন্তু কিভাবে তার ভিত্তি মজবুত হবে সে চিন্তা কারো মগজেই ছিলনা। একমাত্র ইসলাম প্রচার দ্বারা তার মজবুত করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেদিকে কেউ ভ্রুক্ষেপ করল না। এ পরিস্থিতিতেই আমি হায়দারাবাদ থেকে ১৯৩২ সালে মাসিক তরজমানুল কোরআন প্রকাশ করা শুরু করি।
পাশ্চত্য মানসিকতা অবসানের প্রচেষ্টা
সে সময়ে আমি যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম তা হচ্ছে, সর্বপ্রথম মুসলমানদের মেধাবী ও প্রতিভাবান শ্রেণীর মন মগজ থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও চিন্তাধারার প্রভাব ঘুচাতে হবে। ইসলামের যে নিজস্ব জীবন পদ্ধতি কৃষ্টি, সভ্যতা, অর্থীনিতি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, চিন্তাপদ্ধতি ও শিক্ষানীতি রয়েছে এবং তা যে পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়বলীর চাইতে সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এ কথা তাদের মনমগজে বদ্ধমূল করতে হবে। কৃষ্টি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে কারুর কাছ থেকে কোনো ভিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন থাকতে পারে এমন ধারণা তাদের মস্তিস্ক থেকে দুর করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে তোমাদের কাছে তোমাদের নিজস্ব একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা রয়েছে যা দুনিয়ার সকল মত পথ ও জীবন ব্যবস্থার চাইতে শ্রেষ্ঠ। পাশ্চাত্যের যে জীবন ব্যবস্থার রূপ দেখে তাদের চোখ ঝলছে গেছে, তার প্রতিটি দিক কত ত্র“টিপূর্ণ এবং কুৎসিত, তা ব্যাপক সমালোচনা দ্বারা তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এ কাজ সম্পাদান করতে করতে কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। ১৯৩৭সালে আমাকে একবার হায়দরাবাদ থেকে দিল্লী সফর করতে হলো। এ সফরের সময়ে আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে, ভারতের ৬টি প্রদেশে কংগ্রেসের সরকার কায়েম হবার পর থেকে মুসলমানদের মধ্যে সুস্পষ্ট পরাজয়ের মনোভাব ফুটে উঠেছে। দিল্লী থেকে যখন আমি বিখ্যাত হিন্দু নেতা “ডক্টর খারে ” ও সে বগীতেই সফর করছিলেন। ঐ বগীতে বহু মুসলমানও ছিল। আমি লক্ষ্য করলাম যে, একটি পরাধীন জাতির লোকেরা শাসক জাতির লোকদের সাথে যেভাবে কথোপকথন করে ঠিক সেভাবে মুসলমানরা “ডক্টর খারের ” সাথে কথোপকথন করছিল। এ দৃশ্য আমার জন্য ছিল অসহনীয়। বিশ্বাস করুন হায়দরাবাদে পৌছে কয়েক রাত্র পর্যন্ত আমি ঘুমাতে পারিনি। মনে মনে বলতে লাগলাম, হে খোদা এ দেশে মুসলমানদের কি দুর্দশা হতে যাচ্ছে? যাহোক এ অভিজ্ঞতার আলোকে আমি তখন মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকাশ (রাজনৈতিক সংঘাতের কবলে মুসলমান) প্রথম খন্ড রচনা করি।
কংগ্রেসের ভূমিকা
১৯৩৮ সালে আমি লক্ষ্য করলাম যে, কংগ্রেসে ১৯২৯ সালে যে নীতি ঘোষণা করেছিল অর্থাৎ মুসলমানরা আসতে চায় আসুক, নতুবা আমরা নিজেরাই আজাদী সংগ্রাম চালাবো, সে নীতি থেকে সে হঠাৎ এক পা সম্মুখে অগ্রসর হলো। এরপর যে নতুন নীতি গ্রহণ করা হলো তা হচ্ছে মুসলমানদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন করে কংগ্রেসে ভর্তি করতে হবে এবং মুসলমানদের কোন দলের সাথে দলগতভাবে কোনো আলোচনাই করা হবেনা। এ উদ্দেশ্যে মুসলিম গণ সংযোগ (+++++) অভিযান শুরু করা হয়। মুসলিম কম্যুনিস্টরাই ছিল এ অভিযানের আসল কর্মী। পরিতাপের বিয়ষ হচ্ছে যে, একাজে আলেমদের একটি গোষ্ঠি মত ছিল যে, হিন্দু ও মুসলমান মিলে এক জাতি গঠন করতে পারে এবং সে এক জাতি এমন একটা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে হবে। এ অবস্থা দেখে আমি ১৯৩৮সালে মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকাশ দ্বিতীয় খন্ড এবং মাসায়ালায়ে কওমিয়াত (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ) নামক গ্রন্থদ্বয় রচনা করি।
এসময় আমার সর্বপ্রধান লক্ষ্য দাড়িয়েছিল যে, মুসলমানরা যাতে কোনো প্রকারেই তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র বিস্মৃত না হয় এবং অমুসলিম জাতির মধ্যে বিলীন হয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এদেশে যদি ইসলামকে বিজয়ী করে তোলা কারোর লক্ষ্য হয় তাহলে তার সঠিক চিন্তাধারা এ হওয়াই স্বাভাবিক যে, আমার কাছে আগে থেকে যে মূলধন রয়েছে তা যেন নষ্ট না হয়, উপরন্ত আমি যেন অধিক মূলধন অর্জন করতে সচেষ্ট হতে পারি। যারা আগে থেকে কালেমায়ে তাইয়্যেবায় বিশ্বসী এবং নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, তার যেন হাতছাড়া না হয়ে যায় এ চিন্তা আমাদের সর্বাগ্রে করা উচিত। অন্যান্যদেরকে মুসলমান বানাবার কথা আমরা এর পরে চিন্তা করতে পারি। সুতরাং মুসলমানরা যেন অমুসলিম জাতির মধ্যে বিলীন না হয়ে যায়, তাদের মধ্যে যেন স্বতন্ত্র জাতীয়াতার অনুভূতি জাগ্রত থাকে এবং তারা যেন উপলব্ধি করতে পারে যে, তাদের অন্যজাতির সাথে মিলিত হওয়া মোটেই সম্ভব নয়, তজ্জন্য আমি পূর্ণ শক্তি দিয়ে চেষ্টা শুরু করি।
পাকিস্তান প্রস্তাব
এর পর এলো ১৯৩৯সাল ও তার পরবর্তী যুগ। তখন মুসলিম লীগের আন্দোলন অত্যন্ত জোরাদার হয়ে উঠেছিল। এ সময় পাসিস্তান আন্দোলনের সূচনা হতে থাকে এবং ১৯৪০সালে তা পাকিস্তান প্রস্তাবের রূপ পরিগ্রহ করে। এসয় আমার নিকট যে কাজ অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো মুসলমানদেকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলা যে, তারা অন্যান্য জাতির মত নিছক একটি জাতি মাত্র নয় এবং একটি জাতীয় রাষ্ট্র কায়েম করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না বরং তাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা।
মুসলমান হচ্ছে একটি প্রচারক জাতি, একটি মিশনারী জাতি, তাদের মিশন কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মুসলমানদের উচিত এমন একটি রাষ্ট্র কায়েম করা যা দুনিয়ার বুকে আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হবে।
আমি তখন স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলাম যে, মুসলিম জাতি এখন খোদার ফজলে হিন্দু জাতির মধ্যে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে। তার মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তার অনুভূতি এত মজবুত হয়ে গেছে যে, কোনো গান্ধী বা নেহেরুন সাধ্য নেই যে তাকে হিন্দুদের বা হিন্দুস্তানী জাতীয়তার মধ্যে বিলীন করে দিতে পারে। এখন আমার কাছে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিল, তা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র কাকে বলে, তা কয়েম করার জন্য কি ধরনের চরিত্র প্রয়োজন, কি ধরনের আন্দোলন দ্বারা তা কায়েম করা হতে পারে এবং ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে মৌলিক ও কর্যত কি কি পার্থক্য বিদ্যমান সে সম্পর্কে মুসলিম জনগণকে সার্বিকভাবে শিক্ষিত করে তোলা। এ উদ্দেশ্য আমি পুনরায় কতিপয় ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখি যা মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকাশ তৃতীয় খন্ড নামে প্রকশিত হয়। এর অধিকাংশ প্রবন্ধ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪০সালে লিখিত হয়, কয়েকটি প্রবন্ধ ১৯৪১সালেও লিখিত হয়।
আজ আমার এ প্রচেষ্টা সম্পর্কে যার যা খুশী তাই বলুক, আমি এসবের কোনোই পরোয়া করি না। আমি পূর্ণ সততার সাথে এখনো বিশ্বাস করি যে, তখন এটাই আমর দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। শুধুমাত্র জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করাই মুসলমানদের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উচিত বরংএকটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন এবং ইসলামী উপযোগী প্রয়োজনীয় চরিত্র মধ্যে গড়ে তোলা উচিত। এ কথা আমি মুসলমানদেরকে বুঝাবার চেষ্টা না করতাম তাহলে আমার কর্তব্যে অবহেলা করা হতো।
জামায়াতে ইাসলামী প্রতিষ্ঠা
কিন্তু যখন আমি অনুভব করলাম যে, আমাদের সব চেষ্টা অরণ্যে রোদন তুল্য হচ্ছে তখন আমি একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। আমার বিশ্বাস ছিল যে, এ দলে চরিত্রবান লোকদের সমাবেশ ঘটবে এবং তারা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ ও বিভ্রান্তিসমূহের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। বস্তু এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথ আমার সামনে উন্মুক্ত ছিল না। যে সময় পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৪০সালে যখন পাকিস্তান প্রস্তাত পাশ হয় তখনো কেউ দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলতে সক্ষম ছিলনা যে, দেশ নিশ্চয়ই ভাগ হয়ে যাবে এবং পাকিস্তান অবশ্যই কয়েম হবে।
এমনকি ১৯৪৭সালের শুরুতেও পাকিস্তান হবেই এমন ভবিষ্যদ্বাণী কেউ করতে পারেনি। এসময়ে আমার সামনে যে প্রশ্নগুলো সবচেয়ে গুরুত্ববহ ছিল তা হচ্ছে, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছিল তাতে এক অবস্থা এ হতে পারতো যে, পাকিস্তানের জন্য চেষ্টা করে মুসলিম লীগ ব্যর্থ হয়ে যেতে পরতো এবং ইংরেজ জাতি এক জাতিত্বের ভিত্তিতে ভারতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে তাকে হিন্দুদের হাতে সমর্পণ করে চলে যেতে পারতো। যদি তাই হয় তা হলে আমাদের পক্ষে কোন ধরনের কাজ করা উচিত?
দ্বিতীয় অবস্থা হতে পারতো মুসলিম লীগ তার উদ্দেশ্য কামিয়াব হয়ে যেতে পারে এবং দেশ বিভক্ত হতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে যে কোটি কোটি মুসলমান ভারতে থেকে যাবে তাদের কি দশা হবে? আর খোদ পাকিস্তানে ইসলামের কি অবস্থা হবে? যে ধরনের লোকেরা পাকিস্তান আন্দোলনে যোগদান করছিল তাদের দেখে আমি নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যে, এসব লোক একত্রিত হয়ে একটি দেশ গড়তে পারে, একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করতে পারে, কিন্তু তারা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবে এমন আশা কিছুতেই তাদের কাছ থেকে করা যেতনা। এক বা একাধিক ব্যক্তির ব্যতিক্রম থাকায় কিছু আসে যায়না,আসল ব্যাপার হলো যারা এ আন্দোলনে শামিল হচ্ছিল, যারা এতে অগ্রণী ছিল, যারা এ আন্দোলন পরিচালনাকরছিল তাদের চরিত্র তাদের জীবন, তাদের শিক্ষা ধ্যানধারণা ও অন্যসব করছিল জিনিস দেখে তাদের কাছ থেকে এরূপ আশা করা বাতুলতা মাত্র ছিল। এ সব দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তারা একটি দেশ গড়তে পারলেও ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে পারবে না।
তখন মোটের ওপর তিনটি প্রশ্ন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রথমত দেশ বিভক্ত না হলে মুসলমানদেরকে রক্ষা করার জন্য কি করা যেতে পারে? দেশ বিভক্ত হলে যে সব মুসলমান ভারতে থেকে যাবে তাদের জন্য কি ব্যবস্থা করা দরকার? দেশ বিভক্ত হলে যে দেশ মুসলানদের অংশে পড়বে তাকে মুসলমানদের পরিচালিত অনৈসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া থেকে কি করে রক্ষা করা যায় এবং তাকে খাটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসবে গড়ে তোলার জন্য কি পন্থা অবলম্বন করা উচিত?
এসব প্রশ্নের জবাবেই আমি জামায়াতে ইসলামী নামে দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ইতিপূর্বে কয়েক বছর ধরে আমি যে সব মতামত প্রকাশ করে আসছিলাম, তার কারণে যদি বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে গালিও দেয়া হাচ্ছিল কিন্তু বহুলোক সেসব মতামতের সমর্থক ছিল এবং তাকে সঠিক বলে বিশ্বাস করতো। এসব লোকের সমর্থন ও সহযোগিতায় জামায়াত কায়েম করাহয়। আমি আগেই বলেছি যে, এ পরিকল্পনা হঠাৎ আমার মস্তিস্কে ওঠেনি বরংসব সিদ্ধান্তে আমি যে পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বানুসন্ধান করেছিলাম এবং তা থেকে যে সব সিদ্ধান্তে আমি উপনীত হয়েছিলাম তারই ভিত্তিতে জামায়াত গঠিত হয়েছিল। এখন আমি এক এক করে সেসব সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করবো যা আমি আমার অবিশ্রান্ত তত্ত্বনুসান্ধান ও পর্যবেক্ষণ থেকে অর্জন করেছি।
আমি ইতপূর্বেই বলেছি যে, ১৯২৫সাল থেকেই আমি এ বিশ্বাস পোষণ করতাম যে একটি মিশনারী জাতিতে পরিণত হওয়ার মধ্যেই মুসলমানদের মুক্তি নিহিত হয়েছে। মুসলিম জাতি হিসেবে পৃথিবীতে তার একটি মিশন ও লক্ষ্য রয়েছে এবং অন্যান্য জাতির মত মুসলমানরা একটি সাধারণ জাতি মাত্র নয় সে কথা তার বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। এজন্য আমি সর্বপ্রথম ও সংকল্প গ্রহণ করালাম যে, যাদের মধ্যে এরূপ মিশনারী প্রেরণা বিদ্যমান, যারা নিজেদেরকে একটি মিশনারী তথা আন্দোলন মুখী জাতির অংশ বলে মনে করে এবং মুসলিম জাতিকে একটি আন্দোলনমুখী জাতিতে পরিণত করতে সংকল্পবদ্ধ, তাদেরকে সংঘবদ্ধ করবো।
জামায়াতে ইসলামীল লক্ষ্য
আমি একথাও আগে বলেছি যে ১৯২৬সালে যখন আমি স্বীয় গ্রন্থ আল জিহাদ ফিল ইসলাম রচনা সম্পন্ন করি তখন থেকেই আমার মন মস্তিস্কে এ বিশ্বান অত্যন্ত মজবুতভাবে বদ্ধমূল হয়েছিল যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানই মুসলমানদের জীবনের মূল লক্ষ্য। একটি নিছক জাতীয় রাষ্ট্র কায়েম করা তাদের লক্ষ্য নয় বরং দুনিয়ার সামনে আল্লাহর বিধানের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে পারে এমন একটি বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করাই তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা ও নৈতিক পরিবেশ যেখানে ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে, যার আইন আদালত, ফৌজ পুলিশ ও দূতাবাস পৃথিবীর সামনে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরবে, সে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করাই প্রত্যেক মুসলমানের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। এরূপ একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হলে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে কি পার্থক্য এবং ইসলাম সর্ব দিক দিয়ে সকল মানব রচিত সভ্যতা মতবাদের চাইতে কত উচ্চ ও উৎকৃষ্ট তা জগতবাসী সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। মুসলমানদের এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকেই আমরা জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। ইসলামের পরিভাষায় একে বলা হয় ইকামতে দ্বীন বা আল্লাহর বিধানের বাস্তবায়ন। কোরআনে এরশাদ হয়েছেঃ
তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর বিধান বাস্তাবায়িত করো এবং এ ব্যাপারে বিভেদে লিপ্ত হয়ো না।
এসঙ্গে আমি জামায়াত গঠন করার ব্যাপারে যে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখেছি তা হচ্ছে, যেসব লোক জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে তারা যেন শুধু আকিদা বিশ্বাসের ব্যাপারেই নিষ্ঠবান হবে না বরং চরিত্রের দিক দিয়েও নির্ভর যোগ্য হবে। দীর্ঘ ২২বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এ শিক্ষা লাভ করেছিলাম যে, ভালো লোকের সাথে সাথে অবিশ্বস্ত ও অনির্ভর যোগ্য লোক ঢুকে পড়ার করণেই মুসলমানদের বিভিন্ন আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে গেছে।
সাংগঠনিক মজবুতির আবশ্যকতা
খেলাফত আন্দোলনে বহু সচ্চরিত্র জ্ঞানী গুণী ও মহৎ লোকের সমাবেশ ঘটেছিল কিন্তু তার মধ্যে ত্র“টিপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী বিপুল সংখ্যক কর্মীও শামিল হয়ে গিয়েছিল এবং নিজেদের কার্যকলাপ দ্বারা আন্দোলন ও আন্দোলনের মহান নেতৃবৃন্দের অপযশ ঘটিয়েছিল। মুসলমানরা লাখ লাখ টাকার চাদা সংগ্রহ করে এসব মহৎ কাজের জন্য দান করেছিল কিন্তু তার একটি বিরাট অংশ এসব অসাধু কর্মী আত্মসাৎ করে এবং এর ফলে দীর্ঘকাল পর্যন্ত মুসলমানদের কাছে চাদার নাম উচ্চারণ করাই কঠিন হয়ে দাড়ায়। কারণ জনগণের নিকট থেকে চাদা নিয়ে কাজ করা কর্মীদের ওপর তাদের এত অনাস্থা এসে গিয়েছিল যে, নিষ্ঠবান সৎ কর্মীরাও যদি কোনো ভালো কাজের জন্য চাদা চাইতো তাহলেও লোকে ভাবতো, এরা চাদার অর্থ খেয়ে ফেলবে।
এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হইযে, কর্মীরা সংখ্যা বেশী হওয়াটাই বড় কথা নয় বরং নির্ভরযোগ্য চরিত্রের লোকেদেরই প্রবেশাধিকার থাকা উচিত।
আমাদের দলের লোকদের চরিত্র এত নিখুত হওয়া চাই যে তাদের কথা ও কাজে যেন সামঞ্জস্য থাকে এবং বিশ্বাস করতে পারে, তাদের হাতে যেন লোকেরা নিশ্চিন্তে টাকা পয়সা দিতে পারে এবং যে কাজের উদ্দেশ্যে টাকা নেয় হলো সে কাজেই তা ব্যয় হবে, এ ব্যাপারে যেন জনগণের পূর্ণ বিশ্বাস জন্মে।
আমি আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আরো একটি সত্যের সন্ধান পাই তা হচ্ছে, মুসলমানদের আন্দোলনগুলো যে ব্যর্থ হতে দেখা যায় অথবা প্রথমে সফলকাম হয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষায় ব্যর্ত হয়, তার একটি অন্যতম কারণ হলো সাংগঠনিক দৃঢ়তার অভাব। আমি তাই ফয়সালা করলাম যে, জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন অত্যন্ত দৃঢ় ও কঠিন হতে হবে, এতে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য বরদাশত করা চলবেনা, চাই দলের কেউ থাক বা না থাক। সর্বাদিধ প্রিয় ব্যক্তিও যদি দল ত্যাগ করে চলে যায় তা যাক, তবু সংগঠন শিথিলতা আসতে দেয়া যাবে না। কেননা একটি এবড়ো থেবড়ো দল কখনো সুসংগঠিত বাতিল শক্তির মোকবেলা করতে পারে না। পক্ষান্তরে একটি ক্ষুদ্র দল যদি সুসংগঠিত বাতিল শক্তির হয় এবং কর্মকুশলতার সাতে কাজ করে তাহলে তা একটি গোটা জাতিকে বাচিয়ে রাখতে পারে। আপনি লাখ লাখ মানুষ জমা করে ফেলুন, যদি তার মধ্যে অটুট শৃঙ্খলা ও সংগঠন না থাকে তাহলে সে জনসমাবেশ কোনো কাজ সম্পাদন করতে জন্য একটি মানদন্ড নির্ধরণ করি। ইসালামের দৃষ্টিতে সে মানদন্ড হবে মুসলমান হওয়ার ও মুসলমান নূন্যতম শর্ত। আমরা এর মধ্যে মনগড়া বিষয় সংযোজন করিনি। কেবল মুসলমানদের ওপর আল্লহর যে কাজগুলোকে ফরজ হিসাবে বাধ্যতামুলক করে দিয়েছেন আমাদের প্রত্যেক সদস্যকে তা কড়াকড়িভাবে পালন করে চলতে হবে। এ ফরজ কর্তব্যগুলো পালনের ব্যাপারে কোন শিথিলতা বরদাশথ করা হবেনা। অনুরূপভাবে ইসলামে যে বিষয়গুলো হারাম করা হয়েছে, আমাদের সদস্যদের কেউ তার কোনো একটাও লংঘন করতে পারবেন না। আপনি যখন লোকদেরকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে চান, তখন আপনি নিজেই অন্যায় কাজে লিপ্ত হলে আপনার নসিহত কে শুনবে?
অবশ্য জামাযাতের সদস্য ছাড়াও সমাজে বহু লোক রয়েছেন যার আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে পছন্দ করেন এবং আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে চান কিন্তু তারা সদস্যপদের বাধ্যবাধকতা ও জামায়াতের নিয়ম শৃংখলা পুরোপুরিভাবে পালন করতে প্রস্তুত নন, তাদের জন্যও আমরা একটি ব্যবস্থা করেছি। তাদেরকে আমরা মুত্তাফিক (সমর্থন) হিসেবে নিজেদের যতটুকু সহযোগিতাই তারা করতে সক্ষম তা মুত্তাফিক থেকে জামায়াতের সংগঠন ও শৃংখালায় হস্তক্ষেপ না করেই তারা করতে পারেন। এভাবে আমরা জামায়াতের সাথে সংযুক্ত লোকদের দুশ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছি। এ ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্প্রতি আপত্তি তোলা হচ্ছে। বলা হয় এ দলটির সংগঠন এক অদ্ভুত ধরনের, সদস্য মাত্র কয়েকজন আর সবই মুত্তাফিক। অতচ শুধু দাড়ানো দর্শকরাই এ আপত্তি তুলে থাকেন। খোদার রহমতে আমাদের মুত্তাফিকগণ জামায়াতের এ শৃংখলাকেই নির্ভল মনে করেন। আসল ব্যাপার হচ্ছে, কোনো মুত্তাফিকের জন্য আমাদের দলের সদস্য হওয়ার পথ রুদ্ধ নয়। যখনই তারা ইচ্ছে করেন সদস্য শর্তগুলো পূরণ করে এবং জামায়াতের শৃংখালাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত দিতে পারেন।
আমাদের মুত্তাফিকেরা জামায়াতের সদস্যভুক্ত হোন এটা তো আমাদেরই কাম্য। তারা যে সদস্য ও জামায়াতের নিয়ম শৃংখলা পালনের বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করতে নিজেদেরকে অপারগ মনে করছেন সেটা নিজস্ব অসুবিধের কারণেই। এ জন্য তারা কায়িক, আর্থিক ও নৈতিক ইত্যদি সম্ভব্য সকল উপায়ে জামায়াতের সহযোগিতা করে চলেছেন, তাদেরকে মুত্তাফিক বানিয়ে রাখা হলো কেন, এমন অভিযোগ তাদের পক্ষ থেকে কখনো উঠেনি।
জামায়াতে প্রচীন ও আধুনিক শিক্ষিতদের অপূর্ব সমাবেশ
একই সংগঠনের মধ্যে প্রচীন ও আধুনিক শিক্ষিত লোকদের সমন্বয় সাধন করে উভয় শ্রেণীকে মিলিয়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এক দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, এও ছিল জামায়াত গঠনকালে আমাদের চিন্তার আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। পূর্বতন অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বিশ্বাস করতাম যে, শুধুমাত্র আধুনিক শিক্ষিত লোকদের একটি দল, তা সে ইসলামের ব্যাপারে যতই নিষ্ঠাবান হোকনা কেন, ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত ও নির্ভুল জ্ঞানের অভাবে একটি ইসলামী ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হবেনা। অনুরূপভাবে শুধু মাত্র ইসলামী শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেরা যদিও ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানও রাখেন তবু বর্তমান যুুগে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে ধরনের জ্ঞান প্রয়োজন, সে জ্ঞানের অনুপস্থিতিেিত শুধু তাদেরে নিয়ে গঠিত একটি খালেস ধর্মীয় দল ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা অথবা একটি আধুনিক রাষ্ট্রকে ইসলামের ভিত্তিতে পরিচালনা করা, এ দুয়ের কোনটাই করতে সক্ষম নয়। এসব কারণে আমার মতে উক্ত দু গোষ্ঠিকে একত্র করাই অপরিহার্য ছিল।
আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে যারা শুধু আন্তরিকভাবে মুসলমানই নয় বরং ইসলামের হুকুম আহকাম অনুসারে কাজ করতেও কৃতসংকল্প, যাদের মনমগজ এত পাক্কা মুমিন যে কোন বিষয়কে মনে প্রাণে গ্রহণ করার জন্য তারা সে বিষয়ের যুক্তির মানদণ্ডে উর্ত্তীণ হওয়া জরুরী মনে করেনা এবং সেটা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নিদের্শ, এটুকুই তারা চূড়ান্ত দলীল হিসেবে যথেষ্ট বলে মনে করে আর যখন পরিষ্কারভাবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের হুকুম বলে উপলব্ধি করতে পারে তখন তারা নির্বিবাদে তার সামনে মস্তক অবনত করে দেয়। এ ধরনের আধুনিক শিক্ষিত প্রার্থীদের আমরা জামায়াতের সদস্যভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। অনুরূপভাবে দীনদার আলেম সমাজের মধ্যে ফের্কাগত সংকীর্ণতায় নিমগ্ন নন এবং যারা অনুভব করেন যে, এ যুগে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য তাদের আধুনিক শিক্ষিতদের সাথে মিলিত হয়ে কাজ করা উচিত, তাদেরকেও আমরা জামায়াতের সংগঠনে শামিল করে দেই।
মাজহাব ও ফের্কা লক্ষ্য অর্জনের অন্তরায় নয়
প্রত্যেক ফের্কা ও মাজহাবের মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ জামায়াতের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা, কোরআন ও সুন্নাহকে আইনের উৎস বরে স্বীকার করাই যে প্রকৃত ইসলাম তা সুস্পষ্ট। তাই যে ব্যক্তি এদুটিকে আইনের উৎস বলে স্বীকার করে,সেই মুসলমান।
কিন্তু প্রত্যেক বিষয় কোরআন ও সুন্নাহর হুকুম ও ভাষ্যের একটি মাত্র ব্যাখ্যা হতে পারেনা বরং বাস্তবিক পক্ষে বিভিন্ন ব্যাখ্যা করাও হয়েছে যার কারণে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন মাজহাবের সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমাদের উচিত নিজেদের মধ্যে উদার ও মহান মনোভাব গড়ে তোলা। যে মাজহাবের লোকেরা যে ব্যাখ্যা সঠিক মনে করবে, সেটা নিজেরাই পালন করে চলবে এবং অন্য মাজহাবের লোদের উপর নিজের ব্যাখ্যা জবরদস্তি চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করবেনা বরং অন্য মাজহাবের লোকেরা যে ব্যাখ্যা সঠিক মনে করে, সে অনুসারে তার কাজ করার অধিকার স্বীকার করে নেয়। কেবলমাত্র এভাবেই আমাদের একত্রে কাজ করা সম্ভব নতুবা একত্রে কোন কাজ করা এবং সারা দেশে কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ব্যবস্থা কায়েম করার সম্ভাবনা সুদুর পরাহত।
বস্তুত মাজহাবী মতপার্থক্য আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং তার ভিত্তিতে নিজেদেরকে পৃথক পৃথক সংগঠন কায়েম করা উচিত হবে না। জামায়াতে ইসলামী মুসলমানদের প্রত্যেক মাজহাবের লোকেদের উপর জোর দিয়েছ যে, তাদের সর্বপ্রথমে কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা কায়েম করা ও সে উদ্দেশ্যে একই প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আন্দোলন চালানোর ব্যাপারে একমত হতে হবে। এভাে বজামায়াত প্রত্যেক ফের্কা ও মাজহাবের লোকদেরকে দলভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে আহরে হাদিস, বেরলবী, দেওবন্দী প্রভৃতি রয়েছেন। শিয়া মহোদয়দের মধ্যে কেই কখনো সদস্যভুক্ত না হলেও তাদের মধ্যে থেকে বিপুল সংখ্যক মুত্তফিক এতে শামিল রয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী গঠিতই হয়েছে এ নীতির ভিত্তিতে যে, যার যে মাজহাব রয়েছে, সে সেই মাজহাব অনুযায়ী কাজ করে যাবে, তবে অন্যের উপর তা জোর পূর্বক চাপাতে পারবে না। যে কাজকে আপনি সঠিক মনে করেন না অন্যেও তা সঠিক মনে করবে না, এ দাবি আপনি করতে পারবে না। আপনি নিজে তা নিশ্চিন্তে পরিহার করে চলুন। এর পরে আসুন আমরা সবই মিলে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার চেষ্টাই আত্মনিয়োগ করি।
ইসলামী চরিত্র গঠনের অমোঘ পন্থা
এবারে আমি জামায়াতে যোগদানকারীদের ট্রেনিং এর জন্য আমরা কিরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি, তার উপর কিঞ্চিত আলোকপাত করবো। আমরা ট্রেনিং কেন্দ্রও খুলি এবং জামায়াত কর্মীদেরকে ইসলামী পুস্তিকাদিও পড়তে দিই, যাতে করে ইসলামকে তারা ভালভাবে বুঝতে ও জানতে পারেন। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে আসল ট্রেনিং হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর দীনের দিকে দাওয়াত দেয়া এবং মানুষের সামনে আল্লাহর দীনকে তুলে ধরা। এ কাজ যখন কেই করতে আরম্ব করে তখন তার চরিত্রের যে কোন দিকে যদি কোন দুর্বলতা দেখা যায়, তখন মানুষ তার সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে ওঠে, নিজেরন মধ্যে এ দোষ নিয়ে আমাদের নসিহত করতে এসেছে বুঝি? এমন এক ট্রেনিং যা ইসলামের দাওয়াত দানকারী প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতিদিন লাভ করবে। সব দিক থেকে লোকেরা তােিক ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে এবং শেষ পর্যন্ত সে একজন খাটি মুসলমান হবে। এমনিভাবে আত্মশুদ্ধির জন্যও আমাদের একটি বিশেষ নিয়ম রয়েছ। আল্লাহর দ্বীনের কাজ করতে গিয়ে গালি শুনতে হবে কিন্তু কারো গালির জবাবে গালি দেয়া চলবে না। অপরে মিথ্যা অপবাদ রচনা করবে কিন্তু তার জবাবে মিথ্যা অপবাদ রচনা করা যাবে না। নানা রকমের প্রলোভন আসবে কিন্তু কোন প্রলোভনে পড়ে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া চলবে না। আর যত বিপদ মুসিবত ও ক্ষতি লোকসান আসুক তা হাসিমুুখে বরদাস্ত করতে হবে। ভয়াল শক্তিসমূহ ভীতি প্রদর্শন করতে থাকলে ও ভীত হয়ে হেদায়েতের পথ পরিত্যাগ করা চলবে না। এ হচ্ছে আমাদের আত্মশুদ্ধির পদ্ধতি। আমার মনে হয় এর চাইতে কষ্টকর আত্মশুদ্ধির পদ্ধতি আর কিছু হতে পারে না। এ আত্মশুদ্ধির হুজরা ও খানকায় বসে সম্ভব নাএবং সংগ্রামের ময়দানে নেমেই সম্ভব।
আমাদের নিবার্চন পদ্ধতি
সাধারণভাবে আমাদের বিরোধীরা আমাদের উপর অপবাদ আরোপ করে থাকে যে, জামায়াতে ইসলামী নাকি একটি ফ্যাসিবাদী দল এবং এর অভ্যন্তরে নাকি। গণতন্ত্রের নাম নিশানাও নেই অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যতদিন গণতন্ত্র রয়েছ তা সম্ভবত দুনিয়ার কোন দলের মধ্যেই নেই। কিন্তু জামায়াতর মধ্যে যেহেতু অন্যান্য দলেরর মত কর্মকর্তা নির্বাচনের সময় বিভিন্ন প্রার্থী দাড়ানো, পদ নিয়ে টানাটানি, পদ না পাওয়ায় ঝগড়া বিবাদ করে দলত্যাগ কিংবা দলের মধ্যে থেকে কোন্দল পাকানো প্রভৃতির কথা তারা কখনো শুনেনি তাই তারা অবাক হয়ে ভাবে যে, এ আবার কি ধরনের দল। লোকেরা যেহেতু বিভিন্ন দলের মধ্যে এ দৃশ্যই দেখতে অভ্যস্ত অথচ জামায়াতের মধে দেখতে পায় না। তাই অনুমান করতে আরম্ভ করে যে, এতে বোধ হয় কোন সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী পন্থায় পদ বন্টন করা হয়। অথচ বাস্তব ঘটনা এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
জামায়াত শুরু থেকেই তার সংগঠনকে স্বার্থপরতামুক্ত এবং কর্মীদেরকে সৎ ও নিঃস্বার্থ রাখার জন্য কতিপয় স্থায়ী বিধি নির্ধারিত করে রেখেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিধি হচ্ছে, কোন ব্যক্তি কখনো নিজে কোন পদের প্রার্থী হবে না,পদ লাভের জন্য ক্যানভাস অথবা অন্য কোন প্রকার চেষ্টা চালাবে না। এমন কি যদি কারুর মধ্যে বিন্দুমাত্র পদলোভের চিহৃ পরিদৃষ্ট হয় অথবা কোন পদ না পাওয়ায় মর্মাহত বলে মনে হয়, তাহলে তাকে কোন পদের উপযুক্ত তো ধরাই হবে না, অধিকন্তু তার সদস্যপদের যোগ্যতাও সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়বে।
জামায়াতের আমীর থেকে শুরু করে নিম্নতম পদসমূহের সব কটির নির্ধারণের জন্য সদস্যদের নিকট সরাসরি ব্যালট প্রেরণ করা হয় এবং সংশিষ্ট পদের জন্য উক্ত সদস্যদের নিকট যিনি যোগ্যতম প্রার্থী তার নাম লিখে দিতে বলা হয়। এর জন্য কোন ক্যানভাস নেই, কেউ কারুর কাছে গিয়ে ভিাট প্রার্থনা করতে পারে না এবং কেউ কারুর পক্ষে সুপারিশ ও করতে পারে না। যোগ্যতম প্রার্থী বাছাই সম্পূর্ণরূপে ভোটদাতার এখতিয়ার ভুক্ত। সে মনোনীত প্রাথীর নাম লিখে ব্যালট ডাক মারফত পাঠিয়ে দেয় এবং তার পর সংখ্যাগরিষ্ট ভোট কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়। এইরুপ ব্যালটের মাধ্যমেই আমাদের এখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।