শেষ কথা
এ আলোচনা শেষ করার আগে সমালোচক বন্ধুদের প্রতি আমি নিবেদন জানাবো, আমার যুক্তি-প্রমাণ এবং যেসব তত্ত্ব-তথ্যের ওপর যুক্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, এ সব যুক্তি-প্রমাণ থেকে আমি যে ফল আহরন করেছি, তাদের নিকট এ সবই ভুল হলে তাঁরা সানন্দে তা প্রত্যাখ্যান করুন। কিন্তু কেবল প্রত্যাখ্যান করলেই চলবে না। তাদেরকে ইতিবাচক পন্থায় সাফ সাফ বলতে হবেঃ
এক : কুরআন এবং সুন্নার দৃষ্টিতে ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং ইসলামের শাসন নীতি মূলত কি?
দুই : খেলাফতে রাশেদার সত্যিকার বৈশিষ্ট্য কি, যার ভিত্তিতে তাকে খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়াত-নবুয়াতের অনুসরণে খেলাফত-বলে অভিহিত করা হয়?
তিন : এ খেলাফতের পরে মুসলমানদের মধ্যে রাজতন্ত্রের আগমন ঘটেছিল কি-না?
চার : যদি আপনারা দাবী করেন যে, রাজতন্ত্রের আগমন ঘটেনি, তাহলে পরবর্তীকালের রাষ্ট্রে খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়াত-নবুয়াতের অনুসরণে খেলাফতের-বৈশিষ্ট্য বর্তমান ছিল কি?
পাঁচ : আপনারা যদি স্বীকার করেন যে, রাজতন্ত্রের আগমন ঘটেছিল, তবে কি কারণে এবং কিভাবে তা এসেছিল?
ছয় : কোন পর্যায়ে রাজতন্ত্র খেলাফতের স্থান গ্রহণ করেছিল, বলে আপনি বলবেন?
সাত : খেলাফতে রাশেদা এবং সে রাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যের কারণ কি? একের স্থানে অন্যের আগমনের ফলে মূলত কি পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল?
আট : ইসলামের খেলাফত এবং রাজতন্ত্র উভয়ই কি এক রকম? না, তাদের মধ্যে একটি ব্যবস্থা ইসলামের দৃষ্টিতে ঈপ্সিত; আর দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি কেবল তখন বরদাস্ত করার যোগ্য যখন তাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা আরও অধিক বিপর্যের কারণ বলে মনে হয়?
এ হচ্ছে সে সব প্রশ্ন যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা থেকে আজ আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষের মন-মগযকে স্তব্ধ করতে পারেন না, যারা আজ ইসলামের ইতিহাস এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ইসলামী বিভাগে অধ্যয়ন করছে। আমি এ সকল প্রশ্নের ভুল জবাব দিয়ে থাকলে আপনারা সঠিক জবাব দিন। উভয় জবাবের মধ্যে কোনটি যুক্তিপূর্ণ এবং প্রমাণসিদ্ধ সাধারণ বিজ্ঞ মহল নিজেরাই সে ফায়সালা করবেন।
একটি জ্ঞাতব্য বিষয়
আমি বক্ষমান গ্রন্থে এ বিষয়ের প্রতি কঠোর সমতর্কতা অবলম্বন করেছি যাতে রেফারেন্স ব্যতীত কোন বিষয় উল্লেখ করা না হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় ১১১ পৃষ্ঠায় একটি বিষয় কোন রেফারেন্স ছাড়াই উল্লেখিত হয়েছে। বিষয়টি ছিল এই যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি সাহরাহ প্রথমে মোরতাদ হন। মক্কা বিজয়ের সময় হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সুপারিশক্রমে নবী (সঃ) তাঁকে ক্ষমা করেন এবং তাঁর বায়আত কবুল করেন। আবু দাউদ-মোরতাদের বিধান অধ্যায়, নাসায়ী-মোরতাদের অধ্যায়, মুস্তাদরাকে হাকেম, মাগাযী অধ্যায়, তাবাকাতে ইবনে সাআদ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৬-১৪১; সিরাতে ইবনে হিশাম ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫১-৫২ (মিসরীয় সংস্করণ, ১৯৩৬) আল-ইস্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮১ এবং আল-এসাবা, পৃষ্ঠা-৩০৯-এ এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এসব গ্রন্থে ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্তসার এই যে, ইনি প্রথমে মুসলমান হয়ে হিজরত করে মদীনায় আগমন করেন এবং নবী (সঃ) তাকে ওহী লেখকদের অন্তর্ভুক্ত করেন। অতঃপর তিনি মোরতাদ হয়ে মক্কা শরীফ চলে যান এবং অন্যতম ওহী লেখকদের অন্তর্ভুক্ত করেন। অতঃপর তিনি মোরতাদ হয়ে মক্কা শরীফ চলে যান এবং অন্যতম ওহী লেখক ছিলেন-এ মর্যাদা দ্বারা তিনি বিপরীত ফল লাভ করে হুযুরের রেসালাত এবং কুরআন শরীফ সম্পর্কে ভুল ধারণা ছড়াতে থাকেন। এ কারণে মক্কা বিজয়কালে হুজুর (সঃ) যাদের সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন যে, তারা কাবার পর্দায় আত্মগোপন করে থাকলেও তাদেরকে হত্যা করো, ইনিও ছিলেন তাদের অন্যতম। এ ঘোষণার কথা শোনে তিনি তাঁর দুধভাই হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং তিনি তাঁকে লুকিয়ে রাখেন। মক্কায় যখন শান্তি স্থাপিত হয় এবং নবী (সঃ) মক্কাবাসীদের বায়আত গ্রহণ করার জন্য উপস্থিত হন, তখন হযরত ওসমান (রাঃ) তাঁকে নিয়ে হুযুরের সামনে উপস্থিত হন এবং তাঁর অপরাধ ক্ষমা করে বায়আত কবুল করার আবেদন জানান। হুযুর চুপ থাকেন। তিন বার তাঁর আবেদনে চুপ থাকার পর হুযুর (সঃ) তাঁর বায়আত গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরামকে বলেন তোমাদের মধ্যে এমন কোন ভাল লোক ছিল না যে, আমি যখন তার বায়আত কবুল করছিলাম না, তখন সে ওঠে তাকে হত্যা করে দেবে? আরয করা হয় যে, আমরা আপনার ইশারার অপেক্ষায় ছিলাম। হুযুর (সঃ) বলেন, চক্ষু দ্বারা গোপন ইঙ্গিত করা নবীর কাজ নয়।
সন্দেহ নেই যে, অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ সাআ’দ একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান প্রমাণিত হয়েছিলেন। এর পরে তাঁর দ্বারা কোন আপত্তিকর কাজ সংগঠিত হয়নি। এ জন্য হযরত ওমর (রাঃ) তাঁকে প্রথমে হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর অধীনে ্রকেজন সাময়িক অফিসার নিযুক্ত করেন পরে আবার তাঁকে মিসরের সাঈদ অঞ্চলের শাসনকর্তার পদে নিয়োগ করেন। কিন্তু পরে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর আমলে তাঁকে মিসর সহ সমগ্র উত্তর আফ্রিকার গভর্ণর জেনারেল ও সামরিক বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তার অতীত জীবন যেসব লোকের সামনে ছিল তারা যদি তাকে এতবড় পদে অধিষ্ঠিত দেখে এটা অপছন্দ করে তাকে তাহলে সেটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না।
সমাপ্ত