আল্লাহর বিধান
কুরআন-হাদীস থেকে আল্লাহর দেওয়া সকল বিধান জানা যায়। আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিকের বিধানগুলো জানা খুবই জরুরি; যাতে আমরা তা মেনে চলতে পারি। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, ধর্মীয় জীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবন- এসব দিকের ইসলামী বিধান না জানলে মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন কেমন করে সম্ভব হবে।
একটিমাত্র বইয়ে এতসব বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা করা মোটেই সম্ভব নয়। এসব দিকের একেকটির জন্য অনেক বই লেখা হয়েছে। ঐসব বই থেকে অল্প কথায় একেকটি দিকের জন্য যে কয়টি বিধান জানা সবচেয়ে জরুরি মনে করেছি তা-ই এখানে উল্লেখ করছি। বিস্তারিত জানার জন্য যেসব বই পড়া উচিত তা ফুটনোটে লিখে দিচ্ছি।
ব্যক্তিজীবন
মানুষ আল্লাহর বড়ই আদরের সৃষ্টি। আসল মানুষ হলো রূহ। আদমের দেহ তৈরী হওয়ার পর আল্লাহ নিজের রূহ থেকে ফুঁ দিয়ে আদমের দেহে এ রূহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলে কুরআনে ঘোষণা করেছেন। দেহ বা নাফ্সের তাড়না ও শয়তাদের ধোঁকায় পড়ে মানুষ যাতে পশুর মতো না চলে সেজন্য নবীর মাধ্যমে সকল মানুষকে ডেকে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
১. তোমাদেরকে যিনি পয়দা করেছেন শুধু তাঁর হুকুম মেনে চল, কারণ তিনি ছাড়া অন্য কাউকে তিনি তোমাদের হুকুমকর্তা প্রভু বানাননি। দুনিয়ার সকল সৃষ্টিকে তোমাদের খিদমতে লাগিয়ে রেখেছেন। ফেরেশতারাও তোমাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করছে, তোমাদের জন্য দোয়া করছে এবং তোমাদের মনে সুপরামর্শ দিচ্ছে।
২. দুনিয়ার জীবন অতি অল্প দিনের। মৃত্যুর পর আবার তোমাদেরকে জীবিত করা হবে। এ জীবন আল্লাহর মর্জিমতো চললে ঐ জীবনে সুখে থাকবে। পরকালের জীবনের শেষ নেই। তোমাদের আর মৃত্যু হবে না। আর আল্লাহর হুকুম অমান্য করলে চিরকাল শাস্তি ভোগ করবে।
৩. নবীর প্রতি ঈমান আন; তিনিও তোমাদের মতো মানুষ। দেখ তিনি মানুষ হয়েও এত ভালো যে, সবাই তাকে সবচেয়ে ভালো মানুষ বলে স্বীকার করে। তোমরা যদি ভালো মানুষ হতে চাও তাহলে নবীকে মেনে চল।
যে ব্যক্তি এ কয়টি কথা মেনে নিল, সে আল্লাহর কাছে মুমিন হিসেবে গণ্য হয়ে গেল। ব্যক্তিগতভাবে মুমিনকে দুনিয়ায় কীভাবে জীবনযাপন করতে হবে কুরআনে আল্লাহ তাআলা তা জানিয়ে দিয়েছেনঃ
১. আল্লাহর হুকুম ঐভাবে পালন কর, যেভাবে রাসূল সা. পালন করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
২. শয়তানকে দুশমন মনে কর। সে সবসময় আল্লাহর হুকুম অমান্য করার তাগিদ দেয়।
৩. তোমাকে ভালো ও মন্দ চেনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নাফ্স তোমার মনে কু-ভাব জাগিয়ে দেয়। তোমার বিবেক তা সমর্থন করে না। তুমি বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবে না।
৪. তোমার দেহের বা নাফ্সের গোলাম হয়ে যেও না। দেহকে আল্লাহর গোলাম বানাও। এ উদ্দেশ্যেই নামায ও রোযার হুকুম দেওয়া হয়েছে। সত্যিকার নামায মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।
রাসূল সা. বলেছেনঃ
১. তোমার মগজে কী ঢুকছে এবং তোমার পেটে কী ঢুকছে তা পাহারা দাও। মনে শয়তান হাজারো কু-চিন্তা ঢোকানোর চেষ্টা করে। এমনভাবে পাহারা দাও, যাতে কোন কু-ভাব মনে জাগতে না পারে। তোমার পেটে যাতে কোনো হারাম খাবার না ঢোকে। তাই হালাল পথে আয়-রোজগার কর।
২. তোমার হাত ও মুখ দিয়ে কোনো মানুষকে কষ্ট দিও না। যতটুকু পার মানুষের উপকার কর। কারো ক্ষতি করবে না।
৩. যে কাজই কর, এ হিসাব করে করবে যে, আখিরাতে এ কাজের বদলা কী পাওয়া যাবে। শুধু দুনিয়ার নগদ লাভের লোভে কাজ করবে না। আখিরাতে সফল হওয়াই তোমার জীবনের আসল উদ্দেশ্য যেন হয়। মনে রাখবে, তুমি দুনিয়ায় একাই এসেছ। কেউ তোমার সাথে আসেনি। মৃত্যুর পর তোমাকে একাই আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তোমার বিচারও আলাদাভাবেই করা হবে। শাস্তি পেলে তোমাকে একাই তা সহ্য করতে হবে। কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না।
ব্যক্তিগত জীবনে কোনো মানুষ যদি আল্লাহ ও রাসূলের এ ক’টি আদেশ মেনে চলে তাহলে সে দুনিয়াতেও সফল, আখিরাতেও সফল হবে।
পারিবারিক জীবন
দুনিয়ার পয়লা পরিবার আদম-হাওয়ার পরিবার। একজন পুরুষ ও একজন নারী নিয়েই পরিবার। সবচেয়ে ছোট্ট সমাজই হলো পরিবার। পরিবারই মানুষ গড়ার প্রথম কারখানা। ছোট সময় থেকে বাপ-মা সন্তানদেরকে যে রকম গড়তে চায়, তারা সে রকমই গড়ে ওঠে। পশুর বাচ্চাকে গড়ে তোলার জন্য বেশি সময় লাগে না। মানুষের সন্তানকে গড়তে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ বছর লাগে। পরিবার ছাড়া এটা সম্ভবই নয়। স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-ইউনিভার্সিটিও মানুষ গড়ায় বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাই মানুষ গড়ার ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই পারিবারিক জীবনের জন্য আল্লাহ তাআলা বিস্তারিত আইন দিয়েছেন। যেমন-
১. ইসলামের পয়লা নির্দেশ হলো, বিয়ের বয়স হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুবক-যুবতীদের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়া জরুরি; যাতে তাদের মন পবিত্র থাকে, চোখ সংযত হয় এবং সচ্চরিত্র বহাল রাখা সহজ হয়। এতে সমাজের পরিবেশ সুস্থ থাকে।
২. বিয়ের পাত্র ও পাত্রী বাছাই করার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী পয়লা দেখা দরকার যে, বর ও কনে ভালো মুসলমান কি না। বংশ কেমন, দেখতে সুন্দর কি না বা আর্থিক অবস্থা ভালো কি না- এসব দেখা দোষের নয়। দীনের দিক দিয়ে যদি যোগ্য মনে না হয়, তাহলে ঐসব দিক যতই ভালো হোক তা বিবেচনা করা উচিত নয়। দীনের দিক দিয়ে মানমতো হলে এবং ঐসব দিকও ভালো হলে তো কথাই নেই।
৩. বিয়ের অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে হতে হবে, যাতে সমাজের লোকজন জানতে পারে যে, কোন্ ছেলে ও কোন্ মেয়ের মধ্যে বিয়ে হলো। গোপন বিবাহ ইসলামের জায়েয নেই। আমাদের দেশে যারা বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন, তাদেরকে কাযী বলা হয়। কাযীর সামনে বর ও কনে উপস্থিত হলে এবং কমপক্ষে দু’জন লোক সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকলেই বিয়ে হতে পারে।
সাধারণত বিয়ের মজলিসে বর হাজির থাকে, কনে নিজে হাজির হয় না। কনে যে এ বিয়েতে রাজি এর প্রমাণ হিসেবে তিনজন লোক কনের পক্ষ থেকে হাজির থাকতে হবে। তিনজনের একজন কনের উকিল ও অন্য দু’জন সাক্ষী। উকিলকে বলতে হবে যে, কনে তাকে এ বরের সাথে বিয়ে দেওয়ার অনুমতি (এজিন) দিয়েছে এবং সাক্ষী দু’জনকে স্বীকার করতে হবে যে, কনে তাদের সামনেই এজিন দিয়েছে। এ তিনজন কনের এমন নিকটাত্মীয় হতে হবে, যাদের সামনে তাকে পর্দা করতে হয় না এবং যারা কনের আওয়াজও চেনে। কারণ, এজিন দেওয়ার সময় কনে ঘোমটা দিয়ে থাকে। তার চেহারা না দেখেই আওয়াজ থেকে মেয়েকে চিনতে হতে পারে।
আমাদের দেশে শরীআতবিরোধী কু-প্রথা আছে যে, উকিলের দু’জন সাক্ষীর মধ্যে একজন বরপক্ষের হতে হবে। এটা মোটেই জায়েয নয়। কনে উপস্থিত নেই বলে কনের পক্ষ থেকে তিনজন প্রতিনিধি থাকবে। এখানে বরপক্ষের কারো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। বিয়ের মজলিসে কনের উকিল বরকে সম্বোধন করে বলবে, ‘‘আমি অমুক মেয়ের উকিল নিযুক্ত হয়ে এত টাকা মোহর ধার্য করে আপনার নিকট তাকে বিয়ে দিলাম।’’ বর বলবে, ‘‘আমি তাকে স্ত্রী হিসেবে কবুল করলাম’’। এটাকে ‘ইজাব-কবুল’ বলা হয়। এভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান হলেই শরীআতমতো বিয়ে হয়ে গেল।
৪. শরীআতে মোহরানার বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। মোহরানা বিয়ের একটি শর্ত। মোহরানা ছাড়া বিয়ে শুদ্ধ হয় না। মোহরানা স্ত্রীর হক বা অধিকার। সাধারণত বিয়ের পূর্বে কনের সম্পত্তি থাকে না। তার পিতা মারা গেলে পিতার সম্পত্তি থাকলে সে ঐ সম্পত্তির ওয়ারিশ হয়। তার কোনো সম্পত্তি থাকলেও শরীআত তাকে স্বামীর সংসারের খরচ বহন করতে বাধ্য করে না। ইসলাম স্বামীর উপর সংসারের খরচ বহন করার দায়িত্ব দিয়েছে।
স্ত্রীর কোনো সম্পত্তি না থাকলে এবং তার নিজের আয়ের ব্যবস্থা না থাকলেও যাতে স্ত্রী তার নিজের ইচ্ছামতো খরচ করার দরকার মনে করলে স্বামীর বা পিতার কাছে হাত পাততে বাধ্য না হয়, সেজন্যই মোহরানা ফরয করা হয়েছে। স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাই মোহরানার উদ্দেশ্য। স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্মান বজায় রাখার জন্য তার হাতে কিছু টাকা-পয়সা থাকা জরুরি। বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসতে চাইলে তার হাতে কিছুই না থাকলে যাতায়াত খরচের জন্য স্বামীর কাছে হাত পাততে বাধ্য হবে। শরীআত স্ত্রীকে সম্বলহীন অবস্থায় রাখতে চায় না।
শরীআত স্ত্রীকে এমন অধিকারও দিয়েছে যে, সে দাবি করতে পারে ‘‘আমাকে মোহরানার অর্ধেক দেওয়ার পর স্বামীর বাড়িতে যাব।’’ অবশ্য কোনো স্ত্রীই এ দাবি করে না; কিন্তু করার অধিকার তার আছে।
মোহরানা কত ধার্য হবে এ বিষয়ে শরীআতের বিধান হলো কনের মা, খালা, বোন, ফুফুদের মোহরানার চেয়ে যেন কম না হয়। অর্থাৎ কনে যে পরিবারের কন্যা সে পরিবারের মান অনুযায়ী তার মোহরানা ধার্য হওয়া উচিত; যাতে তার মর্যাদা বহাল থাকে। স্বামীর মোহরানা আদায় করার সাধ্য আছে কি না এ ভিত্তিতে মোহরানা ধার্য হওয়া নিয়ম নয়। তবে সবদিক দিয়ে বর পছন্দ হলে কনের পক্ষে মোহরানা বরের সাধ্যের বেশি চাপিয়ে দেয় না। দু’পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে মোহরানা ধার্য হতে পারে।
মোহরানার ব্যাপারে একটা মারাত্মক ভুল ধারণা এদেশে আছে। ইসলাম সম্বন্ধে না জানার কারণে এবং যেটুকু জানে তাও না মানার কু-অভ্যাসের ফলে কতক লোক মোহরানা আদায় করতেই চায় না। এটা আদায় করা না হলে যে আখিরাতে শাস্তি পেতে হবে, সে কথার পরওয়াই নেই। তারা মনে করে যে, মরার সময় স্ত্রীর কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিলেই চলবে। মৃত্যুর সময় স্ত্রী হয়তো আবেগের কারণে মাফ করতে রাজি হতে পারে। কিন্তু এ যুলুম আল্লাহ সহ্য করবেন না। কারণ, সে স্ত্রীর হক না দিয়ে ফাঁকি দিয়েছে।
৫. শরীআতবিরোধী যৌতুকের মারাত্মক কু-প্রথ সম্পর্কে সাবধান হতে হবে। কনের পিতামাতা খুশি হয়ে জামাতাকে যা উপহার হিসেবে দেয় তা যৌতুক নয়। বরের পক্ষ থেকে কনেপক্ষের কাছে কোনো জিনিস বা টাকা-পয়সা দাবি করলে সেটাই যৌতুক। এ রকম দাবি করার কোনো অধিকার বরের নেই। কনের পিতার সম্পদের লোভ করা এবং তা দাবি করা জঘন্য রকমের জুলুম। তাই এটা শরীআতে হারাম।
এ কু-প্রথা মুসলিম সমাজে আগে ছিল না। আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু সমাজে এ প্রথা চালু ছিল। হিন্দু ধর্মে মেয়েরা পিতার সম্পত্তির ওয়ারিশ হয় না। তাই কনের পিতা বিয়ের সময়ই মেয়েকে কিছু সম্পদ দিয়ে বিদায় করে।
যারা যৌতুক দাবি করে, তারা চরম বেহায়া ও ছিনতাইকারী। জোর করে কনের পিতার সম্পত্তি দখল করতে চায়। এর জন্য কনের উপর অত্যাচার চালিয়ে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। এরা পশুর চেয়েও হিংস্র। যারা এ রকম হীন-লোভী তারা স্ত্রীর পাওনা মোহরানা না দিয়ে উল্টা স্ত্রী থেকে ‘মোহরানা’ দাবি করে। শরীআত স্ত্রীকে মোহরানার অধিকার দিয়েছে। অথচ শরীআতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একশ্রেণীর স্বামী যৌতুকের নামে স্ত্রীর কাছে ‘মোহরানা’ চায়। যৌতুক নগদ আদায় করতে হয়। স্ত্রীর মোহরানা বাকির খাতায় থাকে।
আমাদের দেশে যৌতুকবিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও দিন দিন যৌতুক বেড়েই চলেছে। দেশে আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন নেই বলেই যৌতুন বন্ধ হচ্ছে না। সামাজিক রোগ শুধু আইন দিয়ে দূর করা যায় না। যারা আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা মেনে চলে তারা যৌতুকের দাবি করে না। কারণ তারা জানে যে, যৌতুক দাবি করা হারাম।
৬. আল্লাহ তাআলা স্ত্রীকে স্বামীর বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছেন; দাসী বানিয়ে দেননি। সূরা আর্ রূমের ২১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের স্ত্রীদেরকে পয়দা করেছেন; যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব-ভালোবাসা ও দয়া-মায়া দান করেছেন।’’ আল্লাহ স্ত্রীকে স্বামীর জীবনসাথী বানিয়েছেন। স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন ও সুখ-দুঃখের সাথী। দু’জনকে মিলে-মিশে ও পরামর্শ করেই সুখের সংসার গড়তে হয়, সন্তানকে মানুষ করতে হয়। আল্লাহ স্ত্রীকে স্বামীর হুকুমের গোলাম বানাননি। স্বামীর ন্যায়-হুকুম স্ত্রীকে মানতে হবে বটে, কিন্তু স্ত্রী চাকরের মতো নয়। স্বামীর সংসারে স্ত্রী হলো রানী, চাকরানি নয়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে মতের অমিল হতে পারে, তর্ক-বিতর্কও হতে পারে। মতের আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধুর মতোই মীমাংসায় পৌঁছবে। ভালোবাসাই মীমাংসায় পৌঁছিয়ে দেবে। বাড়ির কাজের মানুষ ও সন্তানদের সামনে স্ত্রীকে গাল-মন্দ বলা বা তাকে অপমান করা কোনো বুদ্ধিমান স্বামীর কাজ হতে পারে না। তা করলে তার ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে এবং সে সংসারে রাণীর দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বন্ধু ও ভালোবাসার পাত্রকে কেউ অপমান করে না।
৭. কুরআনে স্বামী-স্ত্রীকে ‘একে অপরের পোশাক’ বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘‘আমি তোমাদের জন্য সাজ-সজ্জা হিসেবে ও লজ্জাস্থান ঢাকার উদ্দেশ্যে পোশাক নাযিল করেছি।’’ তাহলো তারা দু’জন একে অপরের জন্য সজ্জা এবং দু’জনেই যৌন-তৃপ্তি ভোগ করার কারণে বাইরে কোথাও লজ্জাকর কাজ করবে না। এখানে আল্লাহ তাআলা দু’জনকেই সমান মর্যাদা দিয়েছেন।
৮. সংসারের খরচ যোগাড় করার দায়িত্ব স্বামীর, স্ত্রীর নয়। তাই স্ত্রীর জন্য আয়-রোজগারের চেষ্টা করা জরুরি নয়। সংসারে স্ত্রীর বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। সে দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে যদি আয় করার সুযোগ হয় তাহলে স্ত্রী তা করতে পারে; অবশ্য স্বামীর সম্মতি নিতে হবে। স্বামী ও স্ত্রী আপসে সমঝোতা করে সব কিছুই করতে পারে।
৯. আল্লাহ তাআলা একটি বিষয়ে স্বামীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। সে দায়িত্ব হলো পরিচালনার দায়িত্ব। এক দেশে যেমন দুটো সরকার চলতে পারে না, দু’জন হেডমাস্টারের পরিচালনায় কোনো স্কুল চলে না, তেমনি পরিবারও যেহেতু একটি প্রতিষ্ঠান সেহেতু এখানে স্বামী ও স্ত্রীর সমান নেতৃত্ব সম্ভব নয়। পরিবার পরিচালনায় স্বামী অবশ্যই স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করবে। কিন্তু কোনো বিষয়ে দু’জনের অভিমত যদি দু’রকম হয়ে যায় এবং কিছুতেই একমত হওয়া না যায় তাহলে শেষ ফায়সালা কীভাবে হবে- সেক্ষেত্রে স্বামীর নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার জন্য স্ত্রীকে রাজি হওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।
১০. সূরা আর্ রূমের ২১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তিনি দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব-ভালোবাসা ও দয়া-মায়া দান করেছেন। ৬ নং পয়েন্টে বন্ধুত্ব-ভালোবাসা কথাটি আলোচনা করা হয়েছে। এখানে দয়া-মায়ার বিষয়টি আলোচনা করছি।
দু’জনই যখন বুড়ো হয়ে যায়, তখন দু’জনই দু’জনের দয়া-মায়ার কাঙ্গাল হয়ে পড়ে। তখন একজন অপরজনের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। দয়া-মায়ার সম্পর্কটা সারা জীবনেই দরকার। অসুখ-বিসুখে দু’জনই দু’জনের প্রতি দয়াবান না হলে চলতেই পারে না। কিন্তু বুড়া বয়সে এটা সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। তখন উঠতে-বসতে, চলা-ফেরা করতে সবসময় একজন আরেকজনকে সাহায্য করতে হয়।
বিশেষ করে বুড়ার জীবনে বুড়িই সবচেয়ে আপন মনে হয়। ছেলে-পেলে, নাতি-নাতনীরা যার যার কাজে ব্যস্ত। বুড়ার সাথে কিছু সময় বসে কথা বলার ফুরসৎ কারো নেই। একমাত্র সাথী বুড়ি। কথার সাথী হিসেবে এর কোনো তুলনাও নেই, বিকল্পও নেই।
স্বামী যদি আগে মারা যায় তাহলেও বুড়ির এত অসুবিধা হয় না, বৌমা, নাতি-নাতনীদেরকে সাথী হিসেবে পেয়ে যায়। তার খিদমত করার জন্য দরকার হলে সবসময়ের জন্য কাজের মেয়ে রাখা যায়।
কিন্তু বুড়ি আগে মারা গেলে বুড়া একেবারেই ‘ইয়াতীম’ হয়ে পড়ে। স্বামী তখন জীবনসাথীকে হারিয়ে একা হয়ে যায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় যেন আর কেউ নেই। স্ত্রী যে কত বড় নিয়ামত সে কথা তখন প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে। যখন বিছানায়ই খাওয়া-দাওয়া ও পেশাব-পায়খানা করতে হয়, তখন স্ত্রীর দয়া-মায়ার অভাব অন্য কেউ পূরণ করতে পারে না।
১১. রাসূল সা. স্বামী-স্ত্রীকে সবচেয়ে বড় সুসংবাদ দিয়েছেন যে, যদি দু’জনেই দুনিয়ায় নেকভাবে জীবন কাটায় তাহলে তারা বেহেশতেও একসাথে থাকবে। বেহেশতের আটটি শ্রেণী আছে। একজন উপরের শ্রেণী আর অন্যজন যদি নিচের শ্রেণীতে থাকে তাহলে নিচেরজনকে প্রমোশন দিয়ে উপরের শ্রেণীতে নিয়ে তাদেরকে একত্র করা হবে। তাই স্বামী ও স্ত্রী শুধু দুনিয়াতেই জীবনসাথী নয়, আখিরাতেও তারা সাথী হিসেবেই থাকবে এবং একজনের কারণে অন্যজন প্রমোশন পাবে।
পারিবারিক জীবনের যে চমৎকার বিধান ইসলাম দিয়েছে এর চেয়ে সুন্দর, মধুর ও আবেগময় বিধান আর কোথায় পাওয়া যাবে!
তালাক
তালাক অর্থ স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন করা। এ দুজনের মধ্যে মহব্বত ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া বড়ই বেদনার বিষয়। এ সম্পর্ক আখিরাতেও কায়েম থাকুক এটাই আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন।
কিন্তু কতক সঙ্গত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যদি মিলমিশ না হয়, অথবা তারা যদি আলাদা হতেই চায় তাহলে তাদেরকে তালাকের অনুমতিও আল্লাহ দিয়েছেন। রাসূল সা. বলেছেন, ‘সকল জায়েয কাজের মধ্যে তালাক হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ।’
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো পবিত্র সম্পর্ক, রাগের মাথায় হঠাৎ ভেঙ্গে দেওয়ার মতো জিনিস নয়। বিশেষ করে সন্তান থাকলে তালাক তাদের জন্য এক মহাবিপদ। ঠাণ্ডা মাথায় খুব ভেবেচিন্তে তালাকের মতো কঠিন বিষয়ের ফায়সালা করা উচিত। কিছু লোক রাগের মাথায় তালাক দিয়ে ফেলে। যখন হুঁশ ফিরে তখনি স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য হারাম পথ তালাশ করে। এর চাইতে বিশ্রী কাজ আর কিছুই হতে পারে না।
ইসলামে তালাকের নিয়ম
ধীরে সুস্থে খুব ভালো করে সবদিক বিবেচনার করার পর যদি তালাক দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই না থাকে তাহলে ইসলামের দেওয়া নিয়মে তালাক দিতে হবে, যাতে গুনাহ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। নিচে ঐ নিয়মগুলো দেওয়া হলঃ
১. স্বামী ও স্ত্রীর দু’পক্ষের আত্মীয়গণ বৈঠকে বসে আপসে আলোচনা করে তালাকের ফায়সালা করতে পারেন। এ তালাককে খোলা তালাক বলা হয়।
২. স্বামী যদি স্ত্রীকে একতরফা তালাক দিতে চায় তাহলে সাবধান হতে হবে, যেন রাগের মাথায় ও স্ত্রীর হায়েয অবস্থায় তালাক দেওয়া না হয়। স্ত্রী হায়েয থেকে পাক হওয়ার পর প্রথমে এক তালাক দিতে হবে। কেননা একসাথে তিন তালাক দেওয়া নিষেধ।
৩. তালাক দেওয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী এক বাড়িতেই থাকবে। স্বামী ইচ্ছা করলে ৩ হায়েয শেষ হওয়ার আগে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। তিন হায়েয পার হয়ে যাওয়ার পর স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চাইলে আবার বিয়ে পড়াতে হবে।
৪. স্বামী যদি আবার এক তালাক দেয় তাহলে ঐ নিয়মেই স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে।
৫. যদি সে আবার তালাক দিয়ে ফেলে তাহলে স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না। এ তালাকী মহিলাকে আর কেউ বিয়ে করার পর যদি সে স্বামী মারা যায় বা নিজের ইচ্ছায় তাকে তালাক দেয়, তাহলে আগের স্বামী আবার ঐ মহিলাকে বিয়ে করতে পারবে।
৬. বিয়ে রেজিস্ট্রি করার সময় স্বামী কাবিনের নিয়ম অনুযায়ী কতক শর্ত পালনের ওয়াদা করে। ঐ ওয়াদা ভঙ্গ করলে স্ত্রী নিজেও তালাক নিতে পারবে বলে স্বামী তাকে ক্ষমতা দেয়। ঐ ক্ষমতা বলে স্ত্রী কাজী অফিসের মাধ্যমে তালাক নিতে পারে। এ জাতীয় তালাককে তালাকে তাফভীয বলা হয়।
পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক
পরিবার মানে শুধু স্বামী-স্ত্রীই বোঝায় না। অবশ্য পরিবারের মূলই হলো স্বামী-স্ত্রী। স্বামীর পিতা-মাতা থাকলে তাদের সন্তান হিসেবে স্বামীকে পিতা-মাতার খিদমতের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। স্ত্রীকেও মনোযোগ দিয়ে তার শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-যত্ন করতে হবে।
১. পিতা-মাতা যদি বৃদ্ধ হয়, তাহলে তাঁদের খিদমত করে বেহেশত খরিদ করার জযবা স্বামীর দিলে থাকতে হবে। তাঁদের প্রতি কোনো সময় একটু বিরক্ত হওয়া থেকেও সাবধান থাকতে হবে।
পিতা-মাতা জীবিত থাকুক বা মৃত হোক তাঁদের জন্য প্রতি নামাযের পর এবং যখনই মনে হয় আল্লাহর শেখানো দোয়া পড়া উচিতঃ
صَغِيرًا رَبَّيَانِي كَمَا ارْحَمْهُمَا رَّبِّ
‘‘হে আমার রব! আমার পিতা-মাতা ছোট সময়ে আমার উপর যেমন রহম করেছেন, তুমিও তাদের উপর তেমনি রহম কর।’’
ক. সন্তানের ভালো নাম রাখতে হবে। সুন্দর অর্থ হয় এমন নাম রাখাই উচিত। রাসূল সা. বলেছেন, ‘আল্লাহর দাস বা দাসী’ অর্থ হয় এমন নাম সবচেয়ে ভালো।
খ. সন্তান জন্মের সাত দিনের দিন আকীকা করতে পারলে করবে। এটা অবশ্য জরুরি নয়। সাধ্য থাকলে দেবে।
গ. রাসূল সা. বলেছেন, পিতা-মাতা সন্তানকে সবচেয়ে বড় যা দান করতে পারে, তা হলো সুশিক্ষা। শিশুর মুখে কথা ফোটার শুরুতেই মুখে আল্লাহর নাম তুলে দিলে কচি মুখে কতই না সুন্দর শোনায়। দুই থেকে চার বছর বয়সের মধ্যে মুখে মুখে কালেমা তাইয়েবা, বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ সূরা, ছোট ছোট দোয়া শেখানো যায়। তিন বছর বয়স থেকেই আরবী অক্ষর ও বাংলা অক্ষরের সাথে পরিচিত করানো যায়। প্রতি অক্ষরের সাথে ছবিসহ ছড়া ও কবিতার বই পাওয়া যায়। তা থেকে মুখে মুখেই শেখানো সম্ভব। পাঁচ বছর বয়স হলেই স্কুলে বা মাদরাসায় ভর্তি করানো শিক্ষাজীবন শুরু হয়ে যায়। এ বয়স থেকেই আদব-কায়দা শেখাতে হয়।
ঘ. ৭ বছর বয়স হলেই নামাযে অভ্যাস করানো শুরু করতে হবে। স্কুলে পড়ার পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াত শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। মাদরাসায় ভর্তি করালে সেখানেই কুরআন শেখার সুযোগ পেয়ে যায়।
৪. মায়ের সংসারের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার কারণে শিশুদের দুষ্টুমিতে বিরক্ত হয়ে শিশু সন্তানকে চড়-থাপড় দেয়। একা খুবই বদ অভ্যাস। ৪/৫ বছর পর্যন্ত শিশুকে মারলে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই। মেরে সংশোধনের বয়স ওটা নয়। ৬/৭ বছর থেকে শাসনের উদ্দেশ্যে মারলে উপকার হতে পারে। তবে মেরে নয়, সোহাগ করেও শাসন করা যায়। রাগ দেখানোর বদলে আদর দিয়ে সংশোধন করার যোগ্যতা হাসিল করতে হবে। স্নেহের শাসন হলে সন্তান পিতা-মাতাকে ভয়ের বদলে ভালোবাসতে শেখে।
৫. সন্তাদেরকে কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো জিনিস দিলে সবাইকে সমান মানে দিতে হবে। যত্নের দিক দিয়ে ছেলে ও মেয়েকে সমান চোখে দেখতে হবে।
৬. কোনো সময় সন্তানকে ধমক দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে তাকে অন্যদের সামনে নয়, আলাদাভাবে শাসন করতে হবে। বিশেষ করে ছোট ভাই-বোনদের সামনে ধমক দিলে তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান নষ্ট হয়।
৭. সন্তানদের জন্য বেশি করে কুরআনে শেখানে দোয়া করতে থাকা দরকারঃ
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
অর্থাৎ ‘‘হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী (বা স্বামী) ও সন্তানদেরকে এমন বানাও, যাতে তাদেরকে দেখে আমাদের চোখ জুড়ায় এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের মধ্যে অগ্রগামী হওয়ার তাওফীক দাও।’’ (ফুরকানঃ ৭৪)
৮. পরিবারের পরিবেশকে মধুর ও সুন্দর রাখতে হলেঃ
ক. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হলেও তা অন্যদের সামনে যেন না হয়।
খ. স্বামীর ভাইদের সাথে পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে।
গ. স্বামীর কোনো ভাই-এর বিয়ে হলে তাদের সংসার আলাদা ঘরে হতে হবে।
ঘ. পরিবারের বড় ভাইকে উদার হতে হবে, যাতে ছোট ভাইয়েরা তাকে পিতার মতো মানে। রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘পিতার পর বড় ভাইকে পিতার স্থানে মনে করবে।’’
ঙ. পরিবারের মুরব্বি পিতা বা মাতা মারা গেলে তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শরীআতমতো সকল ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। বোনদেরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা মহাপাপ। সম্পত্তির কারণেই মধুর সম্পর্ক নষ্ট হয়। শরীআতকে মানলে সম্পর্ক সুন্দর থাকে।
৯. পিতা যদি এমন বয়সের ছেলে-মেয়ে রেখে মারা যান, যাদেরকে লালন-পালন করা জরুরি, তাহলে পিতার বড় ছেলেকে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। বড় ভাই পিতার মতো বলে রাসূল সা. বলেছেন। বড় ভাই তার ছোট ভাইকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময় পর্যন্ত নিজের ছেলের মতো গড়ে তুলবে। ছোট বোনকে বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত যা কিছু করণীয় তা করবে।
পিতা সম্পত্তি রেখে গেলে বড় ভাই তা থেকে ছোট ভাই-বোনের প্রয়োজন পূরণ করবে। যদি পিতার সম্পত্তি না থাকে তাহলে নিজের সম্পদ থেকেই এ দায়িত্ব পালন করবে। যদি এতে অক্ষম হয় তাহলে বংশের অন্যদের সাহায্য নিয়ে এ দায়িত্ব পালন করবে। আর্থিক সাধ্য না থাকার অজুহাতে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করবে না। আল্লাহর উপর ভরসা করে এ দায়িত্বের বোঝা বহন করতে থাকলে আত্মীয়-স্বজনও সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে। যে আন্তরিকতার সাথে এ মহান দায়িত্ব পালন করে, আল্লাহ তাআলা তার উপর অবশ্যই সন্তুষ্ট হন এবং তাকে তাওফীক দান করেন।
১০. পিতা জীবিত থাকাকালেই তার কোনো ছেলে যদি সন্তান রেখে মারা যায় তাহলে দাদা হিসেবে ঐ সন্তানদের দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। তিনি মারা গেলে ঐ নাতি-নাতনীরা তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে না। তাই শরীআতে অসিয়তের যে বিধান রয়েছে সে নিয়ম মেনে তার সম্পত্তির এ পরিমাণ অংশ ইয়াতীম নাতি-নাতনীদেরকে দেবে, যা তাদের পিতা জীবিত থাকলে ওয়ারিশ হিসেবে পেত।
সাধারণত দেখা যায়, ঐ ইয়াতীমদের চাচারা তাদের পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তির কোনো অংশই দিতে চায় না। তাই তাদের দাদাকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। মৃত ছেলের ইয়াতীম সন্তানদের প্রতি দাদার দরদ অত্যন্ত বেশি হওয়ার কথা। তাই অসিয়তের মাধ্যমে দাদাকেই ইয়াতীম নাতি-নাতনীদের জন্য সুব্যবস্থা করে যেতে হবে। তা না হলে তাদেরকে ভিক্ষা করে খেতে হবে। কোনো দাদারই নিজের নাতি-নাতনীদেরকে ভিক্ষুক বানিয়ে যাওয়া উচিত নয়। চাচাদেরও নিষ্ঠুর হওয়া অপরাধ। আপন বংশের ছেলে-মেয়েদের প্রতি তাদের দরদ থাকা শরীআতেরই দাবি।
ধর্মীয় জীবন
আল্লাহ, রাসূল সা., কুরআন ও আখিরাতে বিশ্বাস ইত্যাদিকে ধর্মীয় বিষয় অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু মুসলমানের জীবনে দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা ঐসব বিশ্বাসের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় বলে তাদের ধর্মীয় জীবন দুনিয়ার অন্যান্য দিক থেকে আলাদা নয়। নামায-রোযা বাস্তব জীবনকে আল্লাহর মর্জিমতো চলার যোগ্য বানায়। নামায-রোযা হিন্দু ধর্মের পূজা ও উপবাসের মতো বাস্তব জীবন থেকে সম্পর্কহীন নয়।
খ্রিস্টানরা ‘গড’কে বিশ্বাস করে, যিশুখ্রিস্টকে গডের পুত্র বলে মনে করে, রবিবারে গির্জায় গিয়ে উপাসনা করে। তাদের এসব ধর্মীয় বিষয়ের সাথে তাদের বাস্তব জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ঐসব ধর্মীয় বিষয়ের কোনো প্রভাব নেই। তাদের ধর্মীয় জীবন তাদের দুনিয়াদারী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
হিন্দুরা ভগবানে বিশ্বাস করে, দেব-দেবীর পূজা করে, মন্দিরে উপাসনা করে। কিন্তু তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশ শাসনের সাথে ঐসব ধর্মীয় কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।
ইসলাম ঐ জাতীয় কোনো ধর্ম নয়। তাই মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের গোটা জীবনকে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী পরিচালনা করার তাগিদ দেয়। তাদের নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত দুনিয়ার জীবনকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যাপন করার অভ্যাস শিক্ষা দেয়।
মুসলিমদের ধর্মীয় জীবনকে বিশেষ যত্নের সাথে উন্নত করা দরকার; যাতে তাদের বাস্তব জীবন তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী চলে এবং নামায-রোযা তাদের দুনিয়ার জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে।
তাই মুসলিমদের ধর্মীয় জীবনকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে যা যা করা উচিত তা উল্লেখ করছিঃ
১. ছোট বয়সেই কুরআন শুদ্ধ উচ্চারণে পড়া শিখতে হবে।
২. মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাআতের সাথে আদায়ের অভ্যাস করতে হবে। বড়রা নামাযে যাওয়ার সময় যেন ছোটদেরকে আদর করে সাথে নিয়ে যায়।
৩. প্রতিদিন ফজরের পর কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে এবং যতটুকু সম্ভব কুরআন বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।
৪. নামাযের পর দোয়া কবুল হয়ে থাকে। তাই অল্প সময় হলেও পিতা-মাতা ও সন্তানদের জন্য দোয়া করতে হবে।
৫. সামান্য লেখাপড়া জানলেও ইসলামী বই সব সময় সাথে রাখতে হবে, যাতে যখনই সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়, ইসলামের জ্ঞান বাড়ানো যায়। আসলে মুসলিমের জীবনে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো ইসলাম সম্পর্কে বেশি বেশি জানা।
৬. কোন্টা করা উচিত, কোন্টা করা উচিত নয়, তা বোঝার যোগ্যতা বিবেকের আছে। তাই বিবেকের বিরুদ্ধে চলবে না- এ ফায়সালা করতে পারলে নিজেকে মন্দ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। রাসূল সা.-কে জিজ্ঞেস করা হলো, পাপ কী? তিনি এ প্রশ্নের জবাব একবার দিলেন এভাবে- ‘‘তোমার বিবেকে যা খট্কা লাগে তা-ই গুনাহ।’’ আরেকজনকে এ প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘তোমার বিবেককে জিজ্ঞেস কর’। তাই বিবেকের শক্তি বাড়াতে হবে। বিবেকের বিরুদ্ধে চলতে থাকলে বিবেক দুর্বল হতে থাকে। আর বিবেকের কথামতো চলতে থাকলে বিবেক শক্তিশালী হয়। বিবেকই রূহ ও আসল মানুষ।
৭. মসজিদের ইমাম ও মাদরাসার আলেম শিক্ষকের সাথে মহব্বতের সম্পর্ক রাখতে হবে। তাহলে দীনের কথা যা জানা নেই, তাদের কাছ থেকে তা জানা সহজ হবে।
৮. আয়-রোজগার হালাল পথে তালাশ করতে হবে। রাসূল সা. বলেছেন, হারাম আয়ের দ্বারা শরীরে যতটুকু রক্ত-মাংস হয় তা দোযখে যাবে। এর মানে হলো হারাম খেলে দোযখে যেতে হবে। এ বিষয়টা মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে হবে।
৯. ঈমান, ইলম ও আমলের চর্চা করে এমন কোনো সংগঠন এলাকায় থাকলে এর সাথে মিলে কাজ করতে হবে। একের বেশি সংগঠন থাকলে ভালো করে যাচাই-বাছাই করে যেটা বেশি ভালো মনে হয় এর সাথেই কাজ করতে হবে। কারণ ইসলামী সংগঠন করা ফরয।
১০. শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস করতে হবে। এর দ্বারা আল্লাহর সাথে মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শেষ রাতের দোয়া বেশি কবুল হয়। শেষ রাতে সবাই যখন ঘুমায় তখন আল্লাহ ডাকতে থাকেন- ‘‘কে আছ আমাকে ডাক, সাড়া দেব; কে আছে গুনাহ মাফ চাও, মাফ করে দেব।’’ এভাবে আল্লাহর সাথে এমন সম্পর্ক হয় যে, সব সময় তাঁরই উপর ভরসা করে ঈমানী শক্তি বাড়ানো যায়।
শেষরাতে আল্লাহর দরবারে ধরনা দেওয়ার সেরা সময় ও সুযোগ রয়েছে। দুনিয়া ও আখিরাতেও সবকিছু শুধু তাঁর কাছেই চাইতে থাকলে অন্য কারো সাহায্যের দরকার হয় না। তাঁর দরবারে মন খুলে সব বলা যায়। শেষরাতে গুনাহ মাফ চেয়ে কাঁদতে যে মজা পাওয়া যায় তা মনে তৃপ্তি দেয়। সূরা ফাতিহায় إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ পড়া হয়। এর মানে ‘‘শুধু তোমারই গোলামি করি, আর শুধু তোমারই সাহায্য চাই।’’ আল্লাহর শেখানো এ কথা অনুযায়ী শুধু তাঁরই নিকট হাত পেতে রাখলে দুনিয়া ও আখিরাতের সব কল্যাণ পাওয়ার আশা করা যায়।
তাওবা
আরবী ‘তাওবা’ শব্দটির অর্থ হলো ফিরে আসা। মানুষ যখন বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তখন সে গুনাহ করে। আর গুনাহ করলে সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়। যে পরিমাণ গুনাহ করা হয় আল্লাহর সাথে সে পরিমাণ দূরত্বই সৃষ্টি হয়।
যেমন- ছেলে পিতার হুকুম অমান্য করলে সে নিজেই টের পায় যে, সে পিতা থেকে দূরে সরে গেছে। তখন সে বাবার সামনে আসতে সাহস পায় না, পালিয়ে থাকার চেষ্টা করে। যদি সে সাহস করে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বা তার পায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে মাফ চায় এবং আর কখনও এমন করবে না বলে ওয়াদা করে, তাহলে ঐ দূরত্ব আর বাকি থাকে না। পিতা তাকে শাস্তি দেওয়ার বদলে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন, তার চোখ মুছে দেন এবং ছেলে অবাধ্য হওয়ায় তার মনে যে রাগ ছিল তা চলে যায়। এমন কি এরপর থেকে অনুতপ্ত ছেলের প্রতি তার স্নেহ আগের চেয়েও বেড়ে যায়।
এ উদাহরণ থেকেই তাওবা’র অর্থ সহজে বোঝা যায়। তাওবা মানে আল্লাহর কাছে ফিরে আসা। তিনটি কাজ মিলে তাওবা পূর্ণ হয়ঃ
১. যখনই কোনো গুনাহের কাজ হয়ে যায় তখন আর দেরি না করে অনুতাপ ও অনুশোচনা করতে হবে। আফসোস করতে হবে (হায় হায়! আমি এটা কী করলাম?) এবং আল্লাহর নিকট লজ্জিত হতে হবে।
২. কাতরভাবে চোখের পানি ফেলে কৃত গুনাহর জন্য মাফ চাইতে হবে।
৩. আর কখনও এমন কাজ করব না বলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আবার গুনাহ হয়ে গেলে আবার তাওবা করতে হবে এবং নিজের উপর কিছু জরিমানাও ধার্য করতে হবে। যেমন- কয়েক রাকাআত নফল নামায, কিছু নফল রোযা ও আল্লাহর পথে কিছু খরচ করা। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে তিনি নিষেধ করেছেন। যত বড় গুনাহ-ই হয়ে যাক, হতাশ না হয়ে অনবরত তাওবা করতে হবে। আল্লাহ মানুষের নিকট এ দাবি করেননি যে, কোনো সময়ই যেন তোমাদের থেকে কোনো গুনাহ না হয়। কারণ, নবী ছাড়া সবারই গুনাহ হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ যা চান তাহলো গুনাহ হওয়ার সাথে সাথেই যেন তাওবা করা হয়। রাসূল সা. স্বয়ং রোজ ৭০ বার গুনাহ মাফ চেয়েছেন। অথচ তাঁর কোনো গুনাহ-ই ছিল না।
সামাজিক জীবন
শহরে হোক আর গ্রামেই হোক, মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে বসবাস করে। এ রকম কতক বাড়ি মিলে কাছাকাছি যারা থাকে, তাদের এলাকাকে শহরে মহল্লা বলে, গ্রামে বলে পাড়া। শহরে কয়েকটি মহল্লা মিলে একটি ওয়ার্ড গঠিত হয়। গ্রামেও কয়েকটি গ্রাম মিলে ইউনিয়নের একেকটি ওয়ার্ড হিসেবে গণ্য হয়।
যারা কাছাকাছি এলাকায় থাকে, চলাফেরা করতে ও হাট-বাজারে যেতে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, এসব পরিচিত মহলকেই সমাজ বলা যায়। মুসলিম সমাজের কেন্দ্র হলো মসজিদ। মুসলমানরা যে এলাকায় বসবাস করে সেখানে জামাআতে নামায আদায় করার জন্য অবশ্যই মসজিদ তৈরি করা হয়। শহরে প্রতি মহল্লায়ই মসজিদ দেখা যায়। বড় গ্রাম হলে এক গ্রামে একাধিক মসজিদও থাকে।
একটি মসজিদে যতটুকু এলাকার লোক জুমুআর নামাযে একত্র হয়, তাদেরকে ঐ মসজিদের ভিত্তিতে একটি সমাজ হিসেবে গণ্য করা যায়। মুসলিম সমাজের কেন্দ্র মসজিদ হওয়াই স্বাভাবিক। মুসলিমদের সমাজজীবনের বিধি-বিধান কেমন তা আলোচনা করছিঃ
১. ঐ সমাজের এলাকায় যারা থাকে তাদের মধ্যে পুরুষদের সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাআতে আদায় করা উচিত। অন্তত জুমুআর নামাযে হাজির হওয়া জরুরি। জুমুআর নামাযে মহিলাদের ব্যবস্থা থাকলে তারা সপ্তাহে একদিন ইসলামের কিছু কথা শিখতে পারবে। সমাজের সবাই সবার সাথে মেলামেশা করলে একে অপরের সাথে আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নামায এ সুযোগই এনে দেয়।
২. যারা নিয়মিত নামাযে আসে তাদের কেউ যদি এক দিন না আসে তাহলে তার খোঁজ নেওয়া উচিত। হয়ত অসুখ হয়েছে। রোগীকে দেখতে যাওয়া ও তাকে সাহস দেওয়া সওয়াবের কাজ বলে রাসূল সা. বলেছেন। মসজিদে রোগীর জন্য দোআ করার নিয়ম চালু থাকা উচিত।
৩. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যে পেট ভরে খায়, আর তার প্রতিবেশী ভুখা থাকে সে ঈমানদার নয়।’’ এর দ্বারা জানা গেল, প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর রাখা ঈমানী দায়িত্ব। গরীবদের সাহায্যের জন্য মসজিদ কমিটি একটা তহবিল গড়ে তুলতে পারে। মসজিদ এলাকার সমাজে তা থেকে সাহায্য দিলে ঐ ঈমানী দায়িত্ব পালন করা সহজ হয়। কুরআনে বারবার ‘‘নামায কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর’’ কথাটি একসাথে বলা হয়েছে। নামাযের সাথে যাকাতের কথা বলার মধ্যে ইশারা পাওয়া যায় যে, মসজিদ কমিটির ঐ তহবিলে যাকাতও নেওয়া যেতে পারে; যাতে গরীবদেরকে সাহায্য করা যায়।
৪. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘তোমরা যদি কাউকে কোনো মন্দ কাজ করতে দেখ, তাহলে ক্ষমতা থাকলে হাত দিয়ে তা বন্ধ কর। এ ক্ষমতা না থাকলে মুখে বলে বুঝিয়ে ঐ কাজ থেকে তাকে ফেরাও। যদি এ ক্ষমতাও না থাকে তাহলে মনে মনে ঐ কাজটিকে বন্ধ করার চিন্তা-ভাবনা কর। এটুকু করা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের প্রমাণ।’’
সমাজে খারাপ কাজ অল্প লোকেই করে। কেউ বাধা না দিলে ঐ কাজ বাড়তে থাকে। সমাজকে মন্দ কাজ থেকে রক্ষা করা সবারই ঈমানী দায়িত্ব। যারা মন্দ কাজ পছন্দ করে না, তারা মন্দ কাজের বিরুদ্ধে একজোট হলে তা সহজেই বন্ধ করা যায়।
মসজিদের ইমাম ও মসজিদ কমিটি মুসল্লীদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে মন্দ কাজ থেকে বাঁচাতে পারে।
৫. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যারা বড়দের সম্মান করে না ও ছোটদের আদর করে না তারা আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।’’ সমাজের পরিবেশকে সুন্দর ও সুস্থ রাখার জন্য এ অভ্যাস সবার মধ্যেই গড়ে তুলতে হবে। যে বয়সে বড় তার সাথে সম্মানজনক ভাষায় কথা বলতে হবে ও তাকে আগে সালাম দিতে হবে। আর যে বয়সে ছোট তার সাথে স্নেহের ভাষায় কথা বলতে হবে। সামাজিক আদব-কায়দা সমাজের সবার মধ্যে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৬. মানুষের দোষ তালাশ করে বেড়ানোর বদ অভ্যাস সমাজকে কলুষিত করে। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করাকে কুরআনের ভাষায় ‘গীবত’ বলে। সূরা আল হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে গীবত বা পরনিন্দাকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ঐ সূরার ১১ নং আয়াতে একে অপরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে ও মন্দ নামে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে। এসব অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এ জাতীয় লোককে এ থেকে বিরত করা জরুরি।
৭. যেকোনো কারণেই হোক, সমাজে ঝগড়া-বিবাদ হতেই পারে। সূরা হুজুরাতের ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা কঠোর হুকুম দিয়েছেন যে, বিবাদ দেখা দিলে এর মীমাংসা করতে হবে। বিবাদ বাড়তে দিলে দু’পক্ষে দু’দল জোটে যেতে পারে। মীমাংসা করতে গিয়ে যদি দেখা যায় যে, একপক্ষ বাড়াবাড়ি করছে, তাহলে জোর করে তাদেরকে থামিয়ে দিতে হবে। এতে বোঝা গেল, সমাজকে সংগঠিত অবস্থায় থাকতে হবে, যাতে বিবাদ লাগলে মীমাংসা করা সম্ভব হয়।
বিভিন্ন কারণে সমাজের কিছু লোককে অন্য সবাই মুরব্বি হিসেবে মানে। তারাই সমাজে বিচার-আচার করে। মসজিদ কমিটিও এ কাজটি করতে পারে। মুরব্বি ধরনের লোকেরা যদি মসজিদে নামাযে যায়, তাহলে তারাই তো কমিটির মধ্যে শামিল থাকবে।
গ্রামাঞ্চলে আজকাল ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত নেতারা বিচার-মীমাংসার দায়িত্ব পালন করেন। ঝগড়া-বিবাদই সমাজের শান্তি বিনষ্ট করে। তাই ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসার সুবন্দোবস্ত থাকা খুবই জরুরি। তাহলে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা অনেক কমে যাবে।
কুরআন ও হাদীস থেকে সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য যে ক’টি বিধি-বিধান উপরে তুলে ধরা হয়েছে, এসব যত মূল্যবানই হোক, এর কোনোটাই আপনা-আপনি সমাজে চালু হতে পারে না। এর জন্য যাদের দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য, তারা হলেন- মসজিদের ইমাম, মসজিদ কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারী ও মেম্বারগণ, মুরব্বি হিসেবে যারা গণ্য এবং ইউনিয়নের নির্বাচিত নেতাগণ।
এসব দায়িত্বশীলের কারো না কারো গোপন সমর্থন ছাড়া সমাজবিরোধী কোনো মন্দ কাজ চালু থাকতে পারে না। তাই সমাজকে সুন্দর শান্তিময় ও সুস্থ রাখতে হলে দায়িত্বশীলদের কেউ যাতে মন্দ কাজের পক্ষ হয়ে না যায়, সেদিকে অন্য দায়িত্বশীলদের কড়া নজর রাখতে হবে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হলে কেউ এর কুফল থেকে বাঁচতে পারবে না। তাই সবাইকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।