মুহাররমের শিক্ষা
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
অনুবাদঃ আবদুল মান্নান তালিব
মহররমের শিক্ষা
প্রতি বছর মহররমের সময় শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে কোটি কোটি মুসলমান হযরত ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনায় আন্তরিক দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ইমাম শুধু তাঁর প্রাণ উৎসর্গ করেই ক্ষান্ত হননি, ছোট ছোট কোলের শিশুদেরকেও কোরবান করেছিলেন, এই সব ব্যাথা পীড়িতদের মধ্যে খুব কম লোকই সেদিকে দৃষ্টিপাত করে থাকে। মজলুমের শাহাদাত প্রাপ্তির পর তাঁর পরিজনবর্গ এবং তাঁদের সাথে প্রেম ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ প্রত্যেক ব্যক্তিই দুঃখ প্রকাশ করবেন, এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ দুঃখ ও বেদনা দুনিয়ার প্রতিটি গোত্র-বংশ এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক যুক্ত ব্যক্তিমাত্রই প্রকাশ করে থাকে। এর নৈতিক মূল্য খুবই সীমিত। কেননা এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে যে, এটি শাহাদাত লাভকারীর ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁর গোত্র-বংশ এবং আত্মীয় স্বজনের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার একটা স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই যে, ইমাম হোসাইনের এমন কি বিশেষত্ব ছিল যার কারণে ১৩৪৫ বছর অভিবাহিত হবার পরও প্রতি বছর তাঁর জন্যে মুসলমানদের হৃদয় দুঃখভারা-ক্রান্ত হয়ে ওঠে? তাঁর শাহাদাতের পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না বলে যদি ধরেই নেয়া হয়, তাহলে কেবল ব্যক্তিগত মুহব্বত ও সম্পর্কের ভিত্তিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাঁর জন্য দুঃখ প্রকাশ করার কোনো কারণ বা অর্থ থাকতে পারে না। এবং স্বয়ং ইমামের দৃষ্টিতেও এই নিছক ব্যক্তিগত প্রীতির কতটুকুই বা মূল্য হতে পারে? তাঁর উদ্দেশ্যের চাইতে ব্যক্তিত্বকে যদি তিনি বড় মনে করতেন, তাহলে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করলেন কেন? তাঁর জীবন কোরবানী তো একথা প্রমাণ করে যে, উদ্দেশ্যেকে তিনি ব্যক্তিত্বের উপর স্থান দিয়েছিলেন।
তাহলে তাঁর উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যখন আমরা কিছু করলাম না, বরং তার বিপরীত কাজই করে যেতে থাকলাম, তখন নিছক তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্যে শোক প্রকাশ এবং তাঁর হত্যাকারীদেরকে গালিগালাজ করে কিয়ামতের দিন আমরা ইমামের নিকট থেকে কোনো বাহবা লাভের ও আশা রাখতে পারিনা। উপরন্তু আমরা এও আশা করতে পারি না যে, তাঁর আল্লাহ্ও আমাদের এ কাজের কোনো মুল্য দিবেন।
শাহাদাত লাভের উদ্দেশ্য
তাহলে এখন সেই উদ্দেশ্য অনুসন্ধানে আমাদের প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। ইমাম হোসাইন (রাঃ) কি রাজ্য ও সিংহাসনের দাবীদার ছিলেন এবং এজন্যেই কি তিনি জান কোরবান করে গেছেন? ইমাম হোসাইনের বংশের উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে যে ব্যক্তি কিছু মাত্র অবগত আছেন, তিনি কখনো এ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে পারেন না যে, তাঁর মতো লোক ব্যক্তিগত কর্ত্তৃত্ব অর্জনের জন্যে কখনো মুসলমানদের মধ্যে খুনখারাবী করতে পারেন। যারা মনে করে যে, তাঁর বংশ মুসলমানদের উপর রাজত্ব ও কর্ত্তৃত্বের দাবীদার ছিল, কিছুক্ষনের জন্যে তাদের মতবাদ নির্ভুল বলে মেনে নিলেও হযরত আবু বকর (রাঃ) থেকে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস এ কথা প্রমাণ করবে যে, কর্ত্তৃত্ব লাভের জন্যে যুদ্ধ বিগ্রহ এবং রক্তপাত ঘটনা কখনো তাঁদের নীতি ছিল না। কাজেই একথা মেনে নিতেই হবে যে, তৎকালে হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর দৃষ্টি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি, প্রাণশক্তি এবং ব্যবস্থার মধ্যে কোনো বিরাট পরিবর্তনের পূর্বাভাস লক্ষ্য করছিল এবং এর গতিরোধের জন্যে সব ধরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তাঁর নিকট অত্যাধিক প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। এমন কি এজন্যে প্রয়োজনবোধে সশস্ত্র জিহাদে অবতীর্ণ হওয়াকেও তিনি শুধু বৈধই নয়, অবশ্য করণীয় বা ফরয বলে মনে করতেন।
বিরাট পরিবর্তন
এই পরিবর্তন কি ছিল? বলাবাহুল্য, জনসাধারণ তাদের দ্বীনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনেনি। শাসকগোষ্ঠী এবং জনসাধারণ সবাই আল্লাহ্, রসূল এবং কোরআনকে ঠিক সেই ভাবেই মানতেন যে ভাবে তারা এর আগে মেনে আসছিলেন। দেশের আইন ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়নি। বনি উমাইয়ার শাসনামলে কোরআন এবং সুন্নাহ ভিত্তিক সমস্ত ব্যাপারের ফয়সালা হচ্ছিল, যেমন তাদের কর্তৃত্ব লাভের পূর্ব থেকে হয়ে আসছিল। বরঞ্চ বলা যেতে পারে যে, খৃষ্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে দুনিয়ার কোনো মুসলিম রাষ্ট্রেও আইন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হয়নি। অনেকে ইয়াযিদের ব্যক্তিগত ভূমিকাকে স্পষ্ট এবং জোরালো ভংগিতে পেশ করে থাকেন, যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে এ ভুল ধারণার প্রসার লাভ করেছে যে, ইমাম যে পরিবর্তনের গতি রোধ করতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তা শুধু এই ছিল যে, একজন দুশ্চরিত্র ব্যক্তি কর্ত্তৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াযিদের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের যে নিকৃষ্টতর ধারনা পেশ করা যেতে পারে তার সবটুকু হুবহু মেনে নেবার পরও একথা স্বীকার্য নয় যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি নির্ভুল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে নিছক কোনো দুশ্চরিত্র ব্যক্তির শাসন ক্ষমতা দখল এমন কোনো ভীতিপ্রদ ব্যাপার ছিল না, যার ফলে ইমাম হোসাইনের (রাঃ) মত বিচক্ষণ এবং শরীয়তে গভীর অন্তরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি বেসবর হয়ে পড়েছিলেন। কাজেই এই ব্যক্তিগত ব্যাপারকে সেই আসল পরিবর্তন বলা যেতে পারে না, যে জন্য ইমাম অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। গভীরভাবে ইতিহাস বিশ্লেষণের পর যে কথা আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়, তাহলো এইঃ ইয়াযিদের যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠা, তারপর সিংহাসনারোহণের ফলে আসলে যে ক্রুটির সূচনা হচ্ছিল, তা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, তার প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্যের পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ফলাফল যদিও তখন পুরোপুরি পরিস্ফুট হয়নি, তবুও কোনো বিচক্ষণ ব্যক্তি গাড়ীর দিক পরিবর্তন দেখেই একথা অনুভব করতে পারেন যে, এবার তার পথ পরিবর্তিত হচ্ছে এবং যে পথে এখন সে অগ্রসর হচ্ছে তা শেষ পর্যন্ত তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। ইমাম হোসাইন (রাঃ) এই দিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেই গাড়ীকে তার সঠিক লাইনে পরিচালিত করার জন্যে নিজের জান কোরবান করে দেবার ফয়সালা করলেন।
কথাটা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করার জন্যে আমাদের দেখা উচিত যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের নেতৃত্বে চল্লিশ বছর পর্যন্ত যে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিশেষত্ব কি ছিল? এবং উত্তরাধিকারসূত্রে ইয়াযিদের কর্তৃত্ব দখলের পর মুসলমানদের মধ্যে যে রাষ্ট্রব্যবস্থার সূত্রপাত হলো তার ফলে বনি উমাইয়া এবং বনি আব্বাসদের শাসনকালে কি বিশেষ উপসর্গের প্রকাশ ঘটলো? এই তুলনামূলক আলোচনার পর আমরা একথা অবগত হবো যে, গাড়ী পূর্বে কোন লাইনে অগ্রসর হচ্ছিল এবং দিক পরিবর্তনের পর সে কোন লাইনে চলতে শুরু করেছে। এ ছাড়াও আমরা বুঝতে পারবো যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) যাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামদের উন্নত পরিবেশে যার শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছিলো, তিনি কেন এই দিক পরিবর্তনের মুখে পৌঁছেই এই নতুন লাইনে গাড়ীর অগ্রগতি রোধের জন্যে পথ আগলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং কেনই বা তিনি এই তীব্র দ্রুতগামী গাড়ীর গতি রোধ করে তাকে স্পষ্ট ও নির্ভুল পথে পরিচালনার দরুন যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হবে তার পরিণতি সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও এই দুঃসাহসিক কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।