শাপে বর
সময়ের আবর্তনকে কল্পনার চোখে একটু পুনরুজ্জীবিত করুন এবং ক্ষণিকের জন্য নিজেকে মদিনার মাসব্যাপী অপবাদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে নিয়ে যান।আপনার সামনে একটা ভয়াবহ ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতি ভেসে ওঠবে।যে আন্দোলন এক একজন করে কর্মী সংগ্রহ করে একটা ক্ষুদ্র বিপ্লবী কাফেলায় রূপান্তরিত হয়েছিল, যে আন্দোলন এক দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র নামে একটা ক্ষুদ্র শান্তির নীড় তৈরী করেছিল, যে আন্দোলন বহু বছরের অশান্তি ও অরাজকতার আগুনে পোড়া বিপন্ন মানবতাকে ঐ শান্তির নীড়ে আশ্রয় দিতে চেয়েছিল, সেই আন্দোলনের একেবারে ভেতর থেকে যদি কোন ধ্বংসাত্মক তান্ডব জন্ম নেয়, তা হলে এর চেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার আর কিছু হতে পারেনা।বিশেষত এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন ঐ ইসলামী রাষ্ট্র চারদিক থেকে শত্রুর আক্রমণের মুখোমুখি ছিল, যে কোন মুহূর্তে তার কোন না কোন দিক থেকে সামরিক আগ্রাসনে পতিত হওয়ার আশংকা ছিল, এবং স্বয়ং নিজেরই অমুসলিম অধিবাসীদের একটা বড় অংশের ক্ষতিকর তৎপরতা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল।
কিন্তু কোরআন তাকে শান্তনা দিল যে, ঘাবড়ানো ও উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। “এই ঘটনাকে নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে কর না, আসলে ওটা তোমাদের কল্যাণের উপকরণ।” (নূর – ১১)
বস্তুত আদর্শবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলনগুলো যখন মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী দুর্যোগ ও হাঙ্গামার কবলে পড়ে, তখন পরিণামের দিক দিয়ে তা অধিকতর কল্যাণ ও অগ্রগতি, সংস্কার ও নির্মাণ এবং শক্তি ও প্রতিঘাত সৃষ্টির কারণ হয়ে দেখা দেয়, চাই ঐ সব দুর্যোগ তার ভেতর থেকেই স্পষ্ট হোক কিংবা বাহির থেকে।উচ্চাভিলাষী সুযোগ্য ব্যক্তিগণের জন্য যেমন নানা রকমের উত্থান পতন, দুর্ঘটনা ও দুর্বিপাক উন্নতির সহায়ক হয়ে থাকে, তদ্রুপ চিন্তা ও কর্মের ক্ষমতাসম্পন্ন আন্দোলনগুলোর জন্য বিরোধিতা ও অরাজকতা পূর্ণ পরিস্থিতি উন্নতি ও স্থিতির পথ সুগম করে থাকে।যে সংগঠন আপন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকে, যার একটা সামষ্টিক মানসিকতা গড়ে ওঠে, যার নৈতিক ও চিন্তাগত মেযাজ পরিপক্কতা লাভ করে, যার নেতৃত্বের চাবিকাঠি থাকে সদা চঞ্চল, সজাগ, বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ লোকদের হাতে, যার কর্মীরা যাবতীয় বৈরী ও নৈরাজ্যবাদী শক্তির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখে, সম্ভাব্য যে কোন বিবাদ ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রাম করতে প্রস্তুত থাকে এবং যার জনমত কোন ইসলাম বিরোধী মতবাদও সংগঠনের অভ্যন্তরে চালু হতে দেয়না, সে সংগঠন প্রত্যেক বৈরী আক্রমন ও বিরোধিতা থেকে কিছুনা কিছু লাভবান হয়ে থাকে।
অপবাদ ও অপপ্রচারের এই নোংরা অভিযান দ্বারাও মদিনার মহান ইসলামী রাষ্ট্র ও সংগঠন একাধিক দিক দিয়ে উপকৃত হয়েছে এবং এর পরিণতিতে তা আগের চেয়েও শক্তিশালী ও সচেতন হয়েছে।
সততা ও ন্যায়পরায়নতার এই আলোকোজ্জ্বল আন্দোলনের নেতা ও কর্মীগন মানবতার এই সব বিপজ্জনক ও সুদুরপ্রসারী দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছে, প্রত্যক্ষ তিক্ত অভিজ্ঞতা দ্বারা।পীরমুরীদীর খানকায় বসে এগুলোর জ্ঞান অর্জন দূরে থাক, সামান্যতম ধারণাও লাভ করা যায়না এবং এর মোকাবিলার জন্যও মানুষকে তৈরী করা যায়না।এই ঘটনার মাধ্যমে সামষ্টিক জীবনের এমন বহু ফাঁকফোকর স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যার ভেতর দিয়ে সমস্ত বিধ্বংসী দোষত্রুটিগুলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।রসূল সাঃ ও তার সাহাবীগণ এর মাধ্যমে চিনে নিয়েছিলেন সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের জনশক্তির মধ্যে কারা মোনাফেকীর ব্যাধিতে আক্রান্ত, কারা দুর্বল ঈমানের অধিকারী, কারা স্থূল জ্ঞান ও আবেগপূর্ণ মেজাযের অধিকারী, কারা সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েও বিপথগামী হয়ে থাকে এবং কারা সরলতার কারণে শত্রুদের ধোকার শিকার হয়ে থাকে।বিশেষত কুচক্রী মোনাফেক নেতা ইসলামী সংগঠনের ভেতরে যে ক্ষুদ্র একটা উপদল সৃষ্টি করে ফেলেছিল, তা কতদূর যেতে পারে, সে কথা সুস্পষ্টভাবে জানা গিয়েছিল।
বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের এই দুর্বল দিকগুলো জেনে নেয়ার পর এমন একটা মানসিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল যাকে কাজে লাগিয়ে একদিকে নতুন নৈতিক নির্দেশনাবলী দিয়ে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হলো, অপরদিকে এমন সামাজিক বিধি চালু করা হলো, যা বিভিন্ন চারিত্রিক দোষ থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম।তৃতীয়ত,নতুন নতুন আইন ও দন্ডবিধি সম্বলিত একটা কঠোর ফরমান জারী করা হলো, যা মানবতার চিরস্থায়ী সামষ্টিক কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করলো।
এ ঘটনা মদিনার ইসলামী সমাজের সমষ্টিক বিবেককে ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে তুললো। তার নৈতিকতাকে জাগ্রত ও তার সামষ্টিক সম্ভ্রমবোধকে সক্রিয় করে তুললো অনুভুতির কশাঘাত হেনে। মোনাফেক শক্তির এই বিব্রতকর আগ্রাসন থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর ঐ সমাজের প্রত্যেক সদস্য আগের চেয়ে সতর্ক ও মজবুত হয়ে গেল।
এই ঘটনার সময় হযরত আয়েশার সাথে সাথে যিনি সবচেয়ে বেশী যুলুমের শিকার হন, তিনি ছিলেন স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু তিনি গাম্ভীর্যপূর্ণ, শান্ত ও আবেগহীন আচরণ দ্বারা যে উদারতা, মহানুভবতা এবং ধৈর্য ও সহিঞ্চুতার পরিচয় দেন, তা মানুষকে বিষ্ময়ে অভিভূত করে। এ ঘটনায় রসূল সা.-এর পর ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের নেতৃত্ব দানকারীদের জন্য একটা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বিশ্বমানবতাকে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা উপহার দেয়ার জন্য তিনি চরম মানসিক নির্যাতন সহ্য করেন। যিনি সকল মানুষের মানসম্ভ্রম রক্ষার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন, সমকালীন সমাজ তাকে এই প্রতিদান দিল যে, তাঁর মান সম্ভ্রমের ওপর মিথ্যা অপবাদের কালিমা লেপন করলো। আর কেউ যদি এমন অবস্থার শিকার হতো, তাহলে হয় বিরোধীদেরকে পিষে ফেলতো, নচেত চরম হাতাশা চরম হতাশা নিয়ে ঘরের কোণে গিয়ে বসতো। কিন্তু তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হয়ে আপন কর্তব্য পালন অব্যাহত রাখলেন।
উস্কানীমূলক তৎপরতা
মদিনার ইহুদীরা একদিকে নিজেদের সুসংহত শক্তির দম্ভে এবং অপর দিকে রাজনৈতিক প্রয়োজনের তাগিদে রসূল সা. এর সাথে একটা সাংবিধানিক চুক্তি সম্পাদন করে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনের আওতায় এসে গিয়েছিল। সম্ভবত তারা এই নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে যথাসময়ে ভালোমত বুঝতে পারেনি। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও তারা আঁচ করতে পারেনি। এই শক্তি যে এত দ্রুত বিকাশ লাভ করবে এবং কতিপয় চালচুলোহীন শরণার্থী ও মদিনার আনসারদের সহযোগিতায় নিছক ঈমান ও চরিত্রের বলে ইতিহাসের গতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিতে পরিণত হবে, তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। তারা ভেবেছিল, গাছের ঝরে যাওয়া শুকনো পাতার মত মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত এই মুসলমানরা সম্ভাব্য দুর্যোগ দুর্বিপাকের প্রথম আঘাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর যদি কোনমতে টিকেও থাকে, তাহলেও তারা কোন শক্তিশালী সমাজ গড়ে তুলতে পারবেনা। কিন্তু কলেমায়ে তাইয়েবার বিপ্লবী প্রাণশক্তির অলৌকিক ক্ষমতার প্রভাবে চরম বৈরী পরিবেশেও এই ক’জন মানুষ একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুললো। শুধু তাই নয়, কয়েক মাসের মধ্যেই ইহুদীরা বুঝতে পারলো, ইসলামী রাষ্ট্র এমন এক উদীয়মান সূর্য যার সামনে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির প্রদীপ টিমটিমে হয়ে যাবে। বিশেষত, বদরযুদ্ধ থেকে মুসলামানদের শুধু নিরাপদে নয়, বরং বিজয় প্রতাকা ওড়াতে ওড়াতে মদিনায় ফিরে আসতে দেখে ইহুদীরা এতই হতবাক হয়ে গিয়েছিল যে, তারা নিশ্চয়ই পুরো বিষয়টা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হয়েছিল।
রসূল সা. এর সাথে সম্পাদিত শান্তি চুক্তি ইহুদীদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের মিত্র ও আইনানুগ নাগরিকে পরিণত করেছিল। কিন্তু তাদের অন্তরে বিদ্রোহ ও হিংসার আগুণ দাউদাউ করে জ্বলছিল।
এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান তাদেরকে শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র ও নৈরাজ্যের পথে পরিচালিত করলো। সুযোগ পেলেই, আর সুযোগ না পেলে সুযোগ সৃষ্টি করে হলেও তারা চেষ্টা করতো যেভাবেই হোক মুসলমানদের সামাজিক ঐক্য বিনষ্ট করে দিতে তাদেরকে উষ্কানী দিতে, কোন না কোন উপায়ে প্রশাসন ও আইনশৃংখলাকে অচল করে দিতে, সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে এবং রসূল সা: এর নেতৃত্বকে দুর্বল করে দিতে। ইহুদীদের তল্পীবাহী লোকেরা মোনাফেকের বেশে ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকতো। তারা আনসারদের মধ্য থেকে দুর্বল ঈমানের লোকদের সাথে নিয়ে ইহুদীদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতো। দুষ্কৃতি প্রবণ এই সব কূচক্রী শক্র শেষ পর্যন্ত একটা কুটিল পস্থা উদ্ভাবন করলো। তারা মুসলিম নারীদের নামে অশ্লীল কবিতা রচনা করতো, শুনিয়ে শুনিয়ে আবৃত্তি করতো ও প্রচার করতো। তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করতো। এই নোংরা কবিতা চর্চার কারণে তাদের মনমগজ এমনভাবে গড়ে উঠে যে, সতীত্বের ন্যায় একটা মৌলিক সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের মনে কোন শ্রদ্ধাবোধই ছিলনা। ইহুদীদের এই নির্লজ্জ মানসিকতা একদিন এভাবে আত্নপ্রকাশ করলো যে, কিছু সংখ্যক ইহুদী যুবক পুরোপুরি গুণ্ডাদের মত আচরণ করে বসলো। বনু কাইনুকা নামক একটা ইহুদী গোত্র মদিনায় বাস করতো। তাদের বাজারে জনৈকা আরব মুসলিম মহিলা কেনাকাটা করতে গেল। দোকানদার তার সাথে প্রথমে ফস্টিনষ্টি করলো, তারপর তাকে প্রকাশ্য বাজারে উলংগ করে দিল। এই অপকর্মটা করার পর সে ও তার সাথীরা লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে তাকে আরো ব্যংগ বিদ্রুপ করতে লাগলো। মহিলা আরবীয় পদ্ধতিতে চিৎকার করলো ও সাহায্য প্রার্থনা করলো। তার চিৎকার শুনে জনৈক আরব যুবকের সম্ভ্রমবোধ সক্রিয় হয়ে উঠেলো এবং সে তীব্র উত্তেজনায় দিশেহারা হয়ে বদমায়েশ ইহুদীটাকে তৎক্ষণাত হত্যা করে ফেললো। কূচক্রীরা যা চেয়েছিল সেটাই হাতে পেয়ে গেল। আরব মুসলমান ও ইহুদীদের মধ্যে দাংগা বেধে যাওয়ার উপক্রম হলো। রসূল সা. খবর পেয়ে কালবিলম্ব না করে ঘটনাস্থলে পৌছে গেলেন। তিনি বনু কাইনুকা গোত্রকে তাদের ঘৃণ্য অপকর্মের জন্য তিরষ্কার করলেন এবং এই বলে হুঁশিয়ারও করলেন যে, “হে ইহুদী জনতা, (বদর যুদ্ধে) কোরায়েশদের যে পরিণতি হয়েছে, তোমাদেরও সেই পরিণতি হবার আগে ভালো হয়ে যাও।”
ইবনে সা’দের বর্ণনা মতে, বনু কাইনুকা গোত্র যেহেতু তীব্র বিদ্বেষ ও হঠকারিতার মনোভাব পোষণ করতো, তাই তারা উত্তেজিত স্বরে জবাব দিল: “হে মুহাম্মদ! কোরায়েশদের ক’টা লোককে মেরে ফেলেছ বলে ধরাকে সরা মনে করোনা। ওরা শক্তিহীন ও যুদ্ধবিদ্যায় অদক্ষ। আল্লাহর কসম, তুমি যদি আমাদের ওপর তলোয়ার ওঠাও, তাহলে বুঝতে পারবে, আমরাই যথার্থ লড়াকু। আমাদের মত লোকের সাথে তোমার ইতিপূর্বে কখনো পরিচয় হয়নি।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড)
মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা এ যাবত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মেধাগত দিক দিয়ে ইহুদীদের চেয়ে অনেক পশ্চাৎপদ ছিল। অথচ ইসলামী আন্দোলন তাদের মধ্যে নতুন জীবনের স্পন্দন সৃষ্টি করেছিল এবং একটা পবিত্র লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার লাগাতার চেষ্টা ও উদ্যম তাদেরকে পরস্পর ও মোহাজেরদের সাথে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। তাদের ভাগ্যের শুভ পরিবর্তন দেখে ইহুদীরা মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। ইহুদীদের এক কুখ্যাত ধড়িবাজ বুড়ো শাস বিন কায়েস পরিস্থিতির এই পরিবর্তনকে খুবই উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করতো। ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে তার বুক হিংসা বিদ্বেষে পরিপূর্ণ থাকতো। একবার সে রসূল সা. এর সাহাবীদের একটা বৈঠকের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখতে পায়। ঐ বৈঠকে আওস ও খাজরাজের কিছু লোক পরস্পর কথাবার্তা বলছিল। তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি সম্প্রীতি ও ইসলামের সৃষ্টি করা একাত্নতা দেখে তার কলিজা যেন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কোথায় জাহেলী যুগের সেই মারামারী হট্টগোল, আর কোথায় একাত্নতার এই মধুর দৃশ্য। ইহুদী বুড়ো মনে মনে বলতে লাগলো, “ওহ্, বুঝেছি। এ শহর এখন তাহলে কায়লার বংশধর (আওস ও খাজরাজ গোত্রের দাদীর নাম কায়লা) মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল! ওরা যদি এভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তো আমাদের পক্ষে স্বস্তিতে জীবন যাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।” অবশেষে তার গোত্রের লোকেরা একটা ষড়যন্ত্র পাকালো এবং জনৈক ইহুদী যুবককে তদনুসারে কাজ করার জন্য ক্রীড়নক বানালো। তারা তাকে শিখিয়ে দিল, তুমি যেয়ে মুসলমানদের বৈঠকাদিতে বসবে এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে বুয়াস যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী সেই সব যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে, যা আওস ও খাজরাজের মধ্যে সংগঠিত হয়েছিল। ইহুদী এজেন্ট তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করলো। একবার এক মজলিসে আওস ও খাজরাজের লোকেরা মিলে মিশে বসেছিল। কথা প্রসংগে জাহেলী যুগের অন্ধকার অধ্যায় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। ক্রমে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সৃষ্টি হলো, পরস্পরকে হেয় করার প্রতিযোগীতা চললো এবং তা উত্তেজনায় রুপান্তরিত হলো। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের উত্তেজিত লড়াকুরা মুখোমুখী হয়ে দাঁড়ালো যেন নতুন করে যুদ্ধ করে প্রমাণ করবে কার কেমন শক্তি। আওয়াজ উঠলো, “অস্ত্র আনো, অস্ত্র!” আওস ও খাজরাজ উভয় গোত্রে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। লড়াইর স্থান ও কাল পর্যন্ত নির্ধারিত হয়ে গেল। উত্তেজিত লোকেরা সব অস্ত্র সজ্জিত হয়ে বেরুচ্ছিল। এই সময় রসূল সা: মোহাজেরদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন। অত:পর নিম্নরুপ ভাষণ দিলেন:
“হে মুসলিম জনতা, আল্লাহকে স্মরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে ইসলামের পথ দেখিয়েছেন, এর মাধ্যমে তোমাদের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন, তোমাদের ঘাড়ের ওপর থেকে জাহেলিয়াতের শেকল ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, তোমাদেরকে কুফরি থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং তোমাদের পারস্পরিক প্রীতি-ভালোবাসার বন্ধনে করেছেন। এর পরও তোমরা আমার উপস্থিতিতেই জাহেলিয়াতের শ্লোগান দিতে শুরু করেছ-এ কেমন কথা?”
এই সংক্ষিপ্ত ভাষণ শুনেই লোকেরা অনুভব করলো যে, এই সব কিছুই আসলে শয়তানের সৃষ্টি করা ফেতনা ও কুটিল ষড়যন্ত্র। ইসলামের শক্ররাই এ সব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তারা অনুতপ্ত হয়ে মাথা নোয়ালো এবং আনুগত্য প্রকাশ করে রসূল. এর সাথে ফিরে এল।
এ ধরনেরই একটা ঘটনা ঘটেছিল বনুল মুসতালিক যুদ্ধে যাওয়ার পথে। ইহুদীদের বশংবদ মোনাফেকরা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর নেতৃত্বে আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যে বিপজ্জনক পর্যায়ের উত্তেজনা সৃষ্টি করে ফেলেছিল। এ ঘটনা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। রাসূল সা. ঐ সময়েও অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা ও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এ ধরণের চক্রান্ত সমূহের মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত কুটিল চক্রান্ত ছিল মসজিদে যেরারের ঘটনা, এই চক্রান্তের আসল হোতা ছিল খাজরাজ গোত্রের আবু আমের নামক এক ভন্ড পীর। রসূল (সা:) মদীনায় আসার আগে সে পূর্বতন আসমানী কিতাব সম্পর্কে নিজের পান্ডিত্য ও দরবেশসুলভ জীবন যাপনের সুবাদে বেশ প্রভাবশালী ছিল। রসূল সা. যখন মদিনায় এসে সর্বশ্রেণীর মানুষের আশ্রয়স্থলে পরিণত হলেন, তখন আবু আমেরের প্রভাব প্রতিপত্তি শূণ্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়ালো। এ কারণে সে মনে মনে ভীষণ খাপ্পা থাকতো। উপরন্তু বদর যুদ্ধের ফলাফল তার সামনে ভবিষ্যতের যে ছবি তুলে ধরলো, তাতে সে উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়লো। সে একদিন মক্কার কোরায়েশ নেতাদেরকে ওহুদ যুদ্ধের জন্য উস্কে দিতে লাগলো, অপরদিকে আরবের অন্যান্য মোশরেক নেতাদের সাথে যোগসাজস করলো, স্বয়ং আনসারদেরকে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্ররোচনা দিল এবং রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে পর্যন্ত মদিনা আক্রমণ করার আমন্ত্রণ জানালো। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৪র্থ খন্ড)
মোনাফেকদেরকে সে এই মর্মে প্ররোচনা দিল যেন রসূল সা. এর মোকাবিলা করার জন্য তারা একটা বিকল্প কেন্দ্র স্থাপন করে। এই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই মসজিদে যেরার নির্মাণ করা হলো। এই ইসলাম বিরোধী তৎপরতার আখড়ার স্থপতিরা রসূল সা. কে নাটকীয় ভংগীতে আবেদন জানালো যে, যে সমস্ত দুর্বল ও অক্ষম লোকেরা নামাজ পড়ার জন্য বেশীদূর যেতে পারেনা, তাদের জন্যই আমরা এ মসজিদ নির্মাণ করেছি। তাছাড়া অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে এবং ঝড় বৃষ্টির সময় আশ পাশের লোকজন সহজেই এখানে সমবেত হতে পারবে। আপনি গিয়ে এর উদ্বোধন করে আসুন এবং বরকত মন্ডিত করুন। রসূল সা. তখন তাবুক রওনা হচ্ছিলেন। তিনি তবুক থেকে ফেরার সময় পর্যন্ত ব্যাপারটাকে মুলতবী করলেন। ফেরার সময় ওহির মাধ্যমে তাঁকে সাবধান করা হলোঃ
“যারা (মুসলমানদের) ক্ষতি সাধন, কুফরি করা, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ছড়ানো, এবং আগে থেকে আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্তদেরকে ওঁৎ পেতে থাকার ঘাঁটি বানিয়ে দেয়ার জন্য মসজিদ নির্মাণ করেছে, এবং কসম খেয়ে বলে যে, আমরা কেবল সদুদ্দেশ্যে কাজ করেছি, আল্লাহ সাক্ষী যে তারা মিথ্যুক। আপনি কখখনো তাদের নির্মিত মসজিদে নামাজ পরবেননা। তবে যে মসজিদের (অর্থাত মসজিদে কোবা) ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই পরহেজগারীর ওপর স্থাপিত হয়েছে, এই মসজিদই আপনার নামাজ পড়ার বেশী উপযুক্ত। পবিত্রতা অর্জন করতে চায় এমন বহু লোক সেখানে রয়েছে। আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনে ইচ্ছুকদেরকে ভালোবাসেন।” (তওবা, ১০৭, ১০৮)
এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় যে, প্রতিহিংসার একটা ক্ষুদ্র বীজ কিভাবে একটা বিশাল বিষবৃক্ষের জন্ম দেয় এবং ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করার জন্য কুফরি শক্তিও কিভাবে একটা মসজিদকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। লক্ষ্য করুন, ইসলামের ক্ষতি সাধনের জন্য যে সব ফেতনার সৃষ্টি করা হয়, তা কিভাবে ধর্ম ও খোদাভীতির লেবেল এঁটে আত্নপ্রকাশ করে। কত দল উপদল, কত খানকাহ, কত মসজিদ, কত মাদ্রাসা, কত প্রকাশনী এবং কত পত্রপত্রিকা আজও আমাদের সামনে এ মসজিদে যেরার মতই অসদুদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত ও লালিত হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। এ সবের স্থপতিদেরও দাবী এটাই যে, “আমরা কেবল সদুদ্দেশ্যে কাজ করছি।”
এই মসজিদ যদি আল্লাহর এবাদতের উদ্দেশ্যেই নির্মিত হতো এবং অক্ষম ও দুর্বল মুসলমানদের জন্য জামায়াতে নামায পড়ার সহজ ব্যবস্থা করাই যদি তার লক্ষ্য হতো, তা হলে এ প্রয়োজনটা রসূল সা. এর বিবেচনার জন্যই পেশ করা হতো। তখন ইসলামী সমাজের নেতাই এ মসজিদ নির্মাণের ফায়সালা করতেন। অন্যান্য মসজিদের ন্যায় এটাও মুসলমানদের সামষ্টিক অংশ গ্রহণের মাধ্যমে নির্মিত হতো, কিন্তু তা না করে কিছু লোক গোপনে গোপনে সলাপরামর্শ করে ইসলামী সংগঠন ও তার নেতার অজান্তে একটা গোপন পরিকল্পনা করে এবং সবার অলক্ষ্যে তাদের জন্য একটা আলাদা মসজিদ বানিয়ে ফেলে। অথচ নিকটেই কোবার মসজিদটি আগে থেকে বিদ্যমান ছিল। এর সুস্পষ্ট অর্থ এই যে, খোদাভীতির পোশাকে আবৃত হয়ে সম্পাদিত এই কাজটার পেছনে কিছুনা কিছু কারচুপি অবশ্যই রয়েছে। ওহি নাযিল হয়ে এই কারচুপি উদঘাটিত করে সমাজের সামনে রেখে দিল। কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কর্মরত একটা সংগঠনের উপস্থিতিতে কিছু লোক যদি তার ভেতরে নিজেদের আলাদা উপদল গড়ার কথা ভাবে এবং সামষ্টিক কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচীর বাইরে নিজেদের আলাদা পরিকল্পনা তৈরী ও বাস্তবায়িত করে, তাহলে তারা তাদের খোদাভীতিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য যতই বাগাড়ম্বর করুকনা কেন এবং যতই নয়নাভিরাম বেশভূষা ধারণ করুক না কেন, তার ফলাফল ইসলামী সমাজের ক্ষতি সাধন, কুফরির প্ররোচনা ও বিভেদ সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু হতে পারেনা।
অবশেষে মসজিদের পবিত্র নামে নির্মিত এই অপবিত্র আখড়াকে রসূল সা. এর নির্দেশে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হলো, যাতে তার সাথে সাথে তার ঘৃণ্য ইতিহাসও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪র্থ খন্ড)
মোটকথা, আল্লাহর হেদায়াতের একচেটিয়া দাবীদার ও নবীরসূলদের উত্তরাধিকারী ইহুদী গোষ্টি উস্কানী সৃষ্টির কোন সুযোগই হাত ছাড়া করেনি। কিন্তু এই সব বিব্রতকর অপতৎপরতার চেয়েও অনেক বেশী ধ্বংসাত্নক ছিল তাদের সেই সব যড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা, যা তারা প্রতিটি যুদ্ধের সময় ইসলামী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি সাধনের জন্য চালাতো। আমরা পরবর্তিতে এ সব অপতৎপরতার বিবরণ দেব।
বিচার ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
যে কোন শাসন ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনা তার দুটো কাজ সূচারুভাবে সম্পন্ন হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। প্রথমত তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত থাকা চাই। দ্বিতীয়ত তার বিচার ব্যবস্থা সুচারুভাবে কাজ করতে থাকা ও তার আইন কানুন বাস্তবায়িত হতে থাকা চাই। প্রথম কাজটা বহিরাক্রমণ থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য এবং দ্বিতীয়টা আভ্যন্তরীণ সমস্যাবলী থেকে নিরাপদ রাখার জন্য। কিন্তু রসূল সা. এর সরকারকে এই উভয় কাজ সম্পাদনে ইহুদী ও মোনাফেকদের পক্ষ থেকে একটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই প্রতিরোধক শক্তিদ্বয় কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় বাধা দিয়েছে এবং বেসামরিক প্রশাসনকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য কী কী কারসাজি করেছে, সেটা এখানে উল্লেখ করতে চাই। একটা নবীন রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রশাসনকে যদি প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগই না দেয়া হয়, তাহলে সে তার আভ্যন্তরীণ সমস্যাবলীকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনা, বাইরের শক্তিগুলোরও মোকাবিলা করতে সমর্থ হয় না। এমতাবস্থায় তার অস্তিত্ব অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয়। ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজীর বিদ্যমান যে, বিজেতা বা বিপ্লবীরা যেখানেই কোন নতুন সরকার কায়েম করেছে, সেখানে প্রথম প্রথম বেসামরিক প্রশাসনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অস্বাভাবিক কঠোরতা ও বল প্রয়োগের সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু রসূল সা. এর সরকার যে নৈতিক মতাদর্শ ও যে বিচার ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাতে অস্বাভাবিক বা বিধি বহির্ভূত কঠোরতার অবকাশ ছিলনা। এ জন্য মদিনার পঞ্চম বাহিনী কিছুটা খলতা ও কপটতার আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল।
মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের যে সাংবিধানিক চুক্তির আওতায় মুসলমান মোহাজের আনসার ও ইহুদী গোত্রগুলো একটা একক রাজনৈতিক সংস্থায় একীভূত হয়েছিল, সেই চুক্তিতে স্বীকার করা হয়েছিল যে, রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা (Final Authority) মুহাম্মদ সা. এর হাতে নিবদ্ধ থাকবে। সেই দলীল আজও সুরক্ষিত আছে এবং তাতে নিম্নলিখিত দুটো স্পষ্ট ধারা বিদ্যমানঃ
(আরবী *******)
এই সাংবিধানিক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর চুক্তিবদ্ধ ইহুদী গোত্রগুলোর ওপর আইনগত, নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় ইসলামী রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থাকে সফল করার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করা এবং রসূল সা. এর নেতৃত্বে পরিচালিত প্রশাসনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা। একটা অসংগঠিত ও বিশৃংখল সমাজকে আইনের শাসনের ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক নাগরিক শৃংখলার আওতায় নিয়ে আসা রসূল সা. এর একটা অসাধারণ ও অমূল্য কীর্তি ছিল এবং অপরাধ ও দুস্কৃতির মূলোৎপাটনের জন্য ইনসাফের স্বাভাবিক ও চিরন্তন মূলনীতিগুলোর বৈষম্যমুক্ত প্রয়োগ একটা অতীব কল্যাণময় পদক্ষেপ ছিল। এ পদক্ষেপের ফলে সুষ্ঠু নির্মল শান্তি ও নিরাপত্তামূলক পরিবেশ অন্যদের ন্যায় ইহুদীদের জন্যও উপকারী ছিল। তাছাড়া আল্লাহর আইন চালু করা ইহুদীদেরও জাতীয় লক্ষ্যবস্তু ছিল। দৃশ্যত ইহুদীরা এই সাংবিধানিক চুক্তির দায়দায়িত্ব স্বেচ্ছায় ও সানন্দে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু যেখানেই তারা অনুভব করতো, ইসলামী রাষ্ট্রের আইন দ্বারা তাদের কোন স্বার্থ ব্যাহত কিংবা তাদের কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে, সেখানেই তারা রাজনৈতিক, আইনগত ও নীতিগতভাবে এবং চুক্তির আলোকে অর্পিত দায়দায়িত্বকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করতো, আর সমাজ ও মানবতার সার্বিক স্বার্থকে একেবারেই উপেক্ষা করতো। একবার জনৈক ইহুদী বিবাহিত পুরুষ অপর এক বিবাহিত ইহুদী মহিলার সাথে ব্যভিচার করলো। ঘটনাটা ইহুদী সরদারদের কানে এল। তারা পরামর্শের জন্য বসলো এবং এক ব্যক্তিকে রসূল সা. এর নিকট এ কথা জানতে পাঠালো যে, এ ধরণের কুকর্মের জন্য কী শাস্তি দেয়া যেতে পারে। তারা ইতিপূর্বে পরামর্শ করে স্থির করেছিল যে, মুহাম্মদ সা. যদি আমাদের সমাজে প্রচলিত ‘তাহমিয়া’র (মুখে কালি মেখে গাধার পিঠে করে এলাকায় ঘোরানো) নির্দেশ দেন, তাহলে মুহাম্মদ সা. কে একজন রাজা হিসেবে মেনে নেয়া হবে এবং তার আদেশ শিরোধার্য করা হবে। কিন্তু যদি আল্লাহর কিতাবের বিধান মোতাবেক ‘রজম’ এর নির্দেশ দেন, তাহলে বুঝতে হবে (সঠিক জ্ঞান, সৎ সাহস এবং আল্লাহর হুকুমের আনুগত্যের দিক দিয়ে) তিনি একজন নবী এবং সে অবস্থায় মুহাম্মদ সা. এর আদেশ মানা যাবেনা। কেননা তাহলে তোমাদের যেটুকু নেতাসূলভ প্রভাব প্রতিপত্তি এখনো অবশিষ্ট আছে তাও শেষ হয়ে যাবে। যাহোক, বার্তাবাহক এসে ইহুদী নেতাদের বার্তা হস্তান্তর করলো। এতে ইহুদী শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে এই মর্মে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল যে, আমরা আপনাকে বিচারক মেনে নিচ্ছি। তাদের এ প্রস্তাব সাংবিধানিক চুক্তির পরিপন্থী ছিল। কারণ ঐ চুক্তি অনুসারে রসূল সা. স্থায়ীভাবেই মদিনার প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সম্ভবত এ কারণেই রসূল সা. উঠলেন এবং সরাসরি ইহুদীদের ধর্মীয় কেন্দ্রে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের আলেমদের ডাকো।’ তৎক্ষণাত আব্দুল্লাহ বিন সুরিয়াকে নিয়ে আসা হলো। কোন কোন বর্ণনা মোতাবেক আব্দুল্লাহর সাথে আবু ইয়াসার বিন আখতা এবং ওহব বিন ইয়াহুদাও এই দলের অন্তভুক্ত ছিল। আলাপ আলোচনার সময় সবাই এক বাক্যে আব্দুল্লাহ বিন সুরিয়াকে তাওরাত সম্পর্কে সবচেয়ে অভিজ্ঞ লোক বলে আখ্যায়িত করলো। রসূল সা. আব্দুল্লাহ বিন সুরিয়াকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে প্রথমে আল্লাহর ভয় দেখালেন এবং বনী ইসরাইলের ইতিহাসের স্বর্ণ যুগকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি কি জান যে, বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে তাওরাতে তাকে ‘রজম’ (পাথর মেরে হত্যা) করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে? সে জওয়াব দিল, ‘‘আল্লাহর কসম হাঁ।’’ ওহির মাধ্যমে যে তথ্য রসূল সা. এর জানা ছিল বিরোধীদের কাছ থেকেও তার পক্ষে সমর্থন গেল। কিন্তু সাধারণ সভায় ইহুদী সরদাররা ও আলেমরা উল্টাপাল্টা তর্ক-বিতর্ক করতে লাগলো। তারা জোর দিয়ে বলতে লাগলো যে, আমাদের শরীয়তের বিধান তাহামিয়াই ব্যভিচারের শাস্তি। এই পরিভাষাটির অর্থ অনুযায়ী ইহুদী ব্যভিচারীদের মুখে কালি মেখে গাধার পিঠে চড়িয়ে জনপদে ঘোরানো হতো। তাওরাতে রজমের (পাথর মেরে হত্যা করার) বিধানকে তারা শিকেয় তুলে রেখেছিল। তাদের ভেতরে যখন ব্যভিচারের ব্যাধি ছড়িয়ে পড়লো এবং তাদের উচ্চস্তরের লোকেরা পর্যন্ত এতে জড়িত হয়ে পড়লো, তখন সমাজ শরিয়তের পক্ষ অবলম্বন করার পরিবর্তে অপরাধীকে সহায়তা করতে লাগলো এবং শাস্তি লঘুতর করলো। মদিনার ইহুদী নেতারা আশংকা বোধ করলো যে তাওরাতের রজমের বিধান যদি পুনরায় চালু হয়ে যায় তাহলে কারো আর ভালাই থাকবেনা। আজ একজনের শাস্তি হবে, কাল হবে আর একজনের। এ জন্যই তারা রজমের শাস্তির বিধান রহিত করাতে চেয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে রসূল সা. প্রকাশ্য জনসমাবেশে তাদের কাছ থেকে তাওরাত চেয়ে পাঠালেন। তাওরাত আনা হলো এবং জনৈক ইহুদী আলেম সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে পড়ে শোনালো। তাওরাতের ঐ কপিটায় রজম সংক্রান্ত আয়াত অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। এ জন্য ঐ দুরাচারী আলেম সংশ্লিষ্ট আয়াতকে হাত দিয়ে ঢেকে রেখে আগের আযাত ও পরের আয়াত পড়ে ফেললো। আব্দুল্লাহ ইবনে ছালাম (খ্যাতনামা ইহুদী আলেম, যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন) লাফ দিয়ে এগিয়ে তার হাত সরিয়ে দিলেন এবং রসূল সা. কে দেখিয়ে বললেন, ‘‘হে রসূল, এই দেখুন রজমের বিধান সংক্রান্ত আয়াত!’’ [ইউহান্না (জন) লিখিত ইনজীলে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, বিবাহিতা ব্যভিচারিণীর জন্য মূল তাওরাতে রজমের বিধানই লিপিবদ্ধ ছিল। জন এর ৮: ৫ আয়াতের এই উক্তিটি দেখুনঃ
‘‘তাওরাতে মূছা আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন যেন এ ধরণের মহিলাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করি।’’ তাওরাতের প্রচলিত সংস্করণগুলোতে ইহুদী মুফাসসির, ফকীহ ও বিকৃতকারীদের মিশ্রণ সত্ত্বেও ব্যভিচারের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে হত্যা ও প্রস্তরাধাতে হত্যার শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। যেমনঃ ‘‘কোন পুরুষ যদি এমন কোন মহিলার সাথে ব্যভিচাররত অবস্থায় ধরা পড়ে, যার স্বামী আছে, তাহলে ঐ দু’জনকেই হত্যা করতে হবে।।’’ (ব্যতিক্রম অধ্যায়, আয়াত ২১-২২)
‘‘কোন কুমারী মেয়ে যদি কারো সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং অন্য কোন ব্যক্তি তাকে শহরে পেয়ে তার সাথে সংগম করে, তাহলে তোমরা ঐ দুজনকেই শহরের উপকণ্ঠে এনে পাথর মেরে হত্যা করবে।’’ (ব্যতিক্রম, অধ্যায় ২২, আয়াত ২৩) ২৬ নং আয়াতেও জোরপূর্বক ধর্ষণকারীর জন্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে।] রসূল সা. এই জালিয়াতির জন্য ঐ ইহুদী আলেমকে কঠোরভাবে তিরস্কার করেন এবং এই বলে সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে তাওরাতে ঘোষিত ‘রজম’ এর শাস্তি প্রদান করেনঃ ‘আমিই সর্ব প্রথম আল্লাহর আইন ও তার কিতাবের বিধান বাস্তবায়নের পুনঃপ্রচলন করছি।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, মুসলিম, ইহুদী জিম্মীদের ওপর রজম কার্যকর করা সংক্রান্ত অধ্যায়, যাদুল মায়াদ, ৩য় খন্ড)
এই ছিল সেকালের ইহুদী আলেমদের কারসাজি। বগলে আল্লাহর আইন চেপে রেখে তারা মনগড়া বাতিল আইন চালু করছিল। আর এহেন চরিত্র নিয়ে তারা আল্লাহর আইনকে আসল ও অবিকৃত অবস্থায় বাস্তবায়ন করতে সংকল্পবদ্ধ রসূল সা. এর পথরোধ করতে চাইছিল। তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই কোরআন বলেছেঃ ‘‘যতক্ষণ তোমরা তাওরাত ও ইঞ্জীলকে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া বিধানকে চালু করে না দেখাবে, ততক্ষণ তোমাদের কোন ভিত্তিই নেই।’’ অর্থাৎ যতক্ষণ তোমাদের বিশ্বাসে ও কাজে এমন মারাত্মক বৈপরিত্য বিদ্যমান, ততক্ষণ তোমরা একটা অর্থহীন ও গুরুত্বহীন জনগোষ্ঠী। ইহুদীদের সর্বব্যাপী বিকৃতির একটা প্রধান লক্ষণ ছিল এই যে, তাদের সমাজ উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীতে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং আইনের চোখে সমতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রভাবশালী লোকদের জন্য ও দুর্বলদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন ছিল। উদাহরণ স্বরূপ বনু নযীর ও বনু কুরায়যার মধ্যে দুর্বলতা ও সবলতার ভেদাভেদের কারণে বৈষম্যপূর্ণ দিয়াত (হত্যার বদলা হিসাব প্রদেয় অর্থ দণ্ড) ব্যবস্থা চালু ছিল। বনু নযীরের কোন লোক বনু কারায়যার কাউকে হত্যা করলে একশো ওয়াসাক পরিমাণ দিয়াত গ্রহণ করা হতো। পক্ষান্তরে বনু কুরায়যার কেউ বনু নযীরের কাউকে হত্যা করলে পঞ্চাশ ওয়াসাক গ্রহণ করা হতো। রসূলের সা. মদিনায় আসা এবং ইসলামী ন্যায়বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বনু নযীরের এক ব্যক্তি বনু কুরায়যার এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে হত্যাকারীর পক্ষ দ্বিগুণ দিয়াত দিতে অস্বীকার করতো এবং সমতা মেনে নেয়ার জন্য চাপ দিল। ইসলামী বিধানের সহায়তা পেয়ে এবার তাদের শক্তি বেড়ে গিয়েছিল। বাদানুবাদে উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে এতদূর গড়ালো যে, উভয গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। অবশেষে উভয় গোত্র তাদের বিরোধকে রসূল সা. এর কাছে নিয়ে যেতে এবং তাঁর মীমাংসা মেনে নিতে সম্মত হয়।
রসূল সা. কোরআনের নির্দেশ অনুসারে দিয়াতের এই বৈষম্যকে চিরতরে রহিত করে সমান করে দিলেন। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ২য় খন্ড, সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড) সেই সাথে কোরআন আল্লাহর সু-বিচার ব্যবস্থা পরিবর্তনকারীদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেয়ঃ
‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধি মোতাবেক বিচার ফায়সালা করেনা, তারা কাফের।’’ (মায়েদা)
ইসলামের সুবিচার ব্যবস্থা ও দণ্ডবিধি (হুদুদ) বাস্তবায়নে যদি শুধু মদিনার ইহুদীরাই অন্তরায় হতো তা হলেও চলতো। আসলে সমস্যা ছিল এই যে, সামগ্রিককভাবে গোটা আরব সমাজেই বৈষম্য বিরাজ করতো। প্রভাবশালী শ্রেণীর জন্য আইন ছিল এক রকম, আর দুর্বল ও সাধারণ লোকদের জন্য অন্য রকম।
মক্কা বিজয়ের সময় বনু মাখযূম গোত্রের ফাতেমা নাম্নী এক মহিলা চুরির দায়ে ধরা পড়লো। সে একটা প্রভাবশালী গোত্রের সদস্য ছিল বলে কোরায়েশের লোকেরা তার ধরা পড়ায় বিচলিত হয়ে পড়লো। তারা এ কথা ভাবতেও পারছিল না যে, এমন এক অভিজাত মহিলার ওপরও আইনের সেই শাস্তিই চালু হবে যা সর্ব সাধারণের জন্য বিধিবদ্ধ। তারা পরামর্শক্রমে স্থির করলো, রসূল সা. কে অনুনয় বিনয় করে তাকে মুক্ত করতে হবে। কিন্তু সমস্য দেখা দিল এই যে, এই অনুনয় বিনয়টা করবে কে? অনেক ভেবে চিন্তে তারা উসামা বিন যায়েদকে সুপারিশ করতে পাঠালো। উসামা বক্তব্য পেশ করতেই রসূল সা. এর মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘‘তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত একটা শাস্তি সম্পর্কে (রহিত করার) সুপারিশ করতে এসেছ?’’ শুধু এই কথাটুকু শুনেই উসামা বুঝে ফেললেন। তিনি ক্ষমা চাইলেন। অবশেষে রসূল সা. সমবেত জনতাকে সম্বোধন করে বললেনঃ
‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার একটা কারণ ছিল এই যে, তাদের মধ্যে কোন সবল লোক অপরাধ করলে তা দেখেও না দেখার ভান করা হতো। আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে আমি তার হাতও কেটে ফেলবো। (সহীহ মুসলিমঃ দণ্ডবিধি প্রয়োগের বিরুদ্ধে সুপারিশ করতে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত অধ্যায়)
উম্মে হারেসা নাম্নী অপর এক মহিলার ক্ষেত্রে অনুরূপ মানসিকতা দেখা দেয়। এই মহিলা একজনের দাঁত ভেংগে দিয়েছিল। মামলা রসূল সা. এর আদালতে নেয়া হলে তিনি কিসাসের (দাঁতের বদলে দাঁত) আদেশ দিলেন। উম্মে রবী (সম্ভবত অপরাধিনীর বোন। কিন্তু এ ব্যাপারে রেওয়ায়াতে অস্পষ্টতা রয়েছে) এ আদেশ শুনে অবাক হয়ে রসূল সা. কে জিজ্ঞাসা করলো, ‘‘ওর কাছ থেকেও কিসাস নেয়া হবে? আল্লাহর কসম, এটা সম্ভব নয়।’’ রসূল সা. বললেন, ‘‘ওহে উম্মে রবী! কিসাস তো আল্লাহর বিধান।’’ কিন্তু ঐ মহিলা তবুও বলতে লাগলো, ‘‘আল্লাহর কসম, তার কাছ থেকে কিসাস নেয়া সম্ভব নয়।’’ তার বুঝেই আসছিলনা যে, এই পর্যায়ের অপরাধিনীর দাঁত কিভাবে ভাঙ্গা যাবে?
ওদিকে কার্যত উভয় পক্ষ দিয়াতের ব্যাপারে সম্মত হয়ে গেল। এভাবে কিসাসের বিধিও (যার ব্যাপারে দিয়াতে অবকাশও ছিল) পালিত হলো, আবার উম্মে রবীর কথাও ঠিক থাকলো। এ জন্য রসূল সা. রসিকতা করে বললেন, ‘‘আল্লাহর এমন বান্দাও আছে, যারা কসম খেলে আল্লাহ নিজেই কসম পূরণ করে দেন।’’ (সহীহ মুসলিমঃ কিসাস সংক্রান্ত অধ্যায়)
ইহুদীরা শুধু ইসলামী বিচার বিভাগের কাজেই বাধা দিতনা। বরং সমগ্র বেসামরিক প্রশাসনের যেখানেই তারা সুযোগ পেত, সেখানেই বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রয়াস পেত। এর একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এই যে, খয়বর বিজয়ের পর যখন খযবরের ইহুদীদের আবেদনক্রমে তাদেরকে তাদের যমীতে অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে ভাগচাষী করে রাখা হলো এবং ইসলামী সরকারের তহশীলদার তাদের কাছ থেকে প্রথমবার সরকারের প্রাপ্য অংশ আদায় করতে গেল, তখন তারা ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করে। দুর্নীতির যে ভয়ংকর রোগে তারা আক্রান্ত ছিল, নতুন প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও তাতে জড়িত করতে তারা সচেষ্ট হলো। এই তহশীলদার ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা। রসূল সা. এর পাঠানো বিশ্বস্ত তহশীলদার খয়বরের ইহুদীদের ধারণার চেয়ে অনেক উর্ধে ছিলেন। তিনি তাদেরকে পরিষ্কার ভাষায় বললেন, ‘‘হে আল্লাহর দুশমনেরা তোমরা কি আমাকে হারাম খাদ্য খাওয়াতে চাও?’’ (সীরাতুন্নবী, শিবলী নুমানী)
তিনি বলেন, ‘‘রসূল সা. আমাকে তোমাদের কাছে এজন্য পাঠাননি যেন আমি তোমাদের সম্পদ আত্মসাৎ করি। বরঞ্চ আমাকে পাঠানো হয়েছে তোমাদের ও মুসলমানদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করার জন্য। তোমরা রাজি থাকলে আমি অনুমান করে অর্ধেক তোমাদেরকে দিয়ে দেই, আর যদি তোমরা চাও, তবে তোমরাই অনুমান করে অর্ধেকটা আমাদেরকে দিয়ে দাও।’’
অতপর ইবনে রওয়াহা মোট ৪০ হাজার ওয়াসাক অনুমান করলেন এবং তা থেকে ২০ হাজার ওায়াসাক মুসলমানদের প্রাপ্য নিয়ে নিলেন। এই ন্যায্য বণ্টনে কিছু সংখ্যক নিচাশয় ইহুদী ক্ষেপে গিয়ে বললো, এটা যুলুম। তবে ইনসাফ প্রিয় জনসাধারণ স্বীকার করলো যে, এটাই ন্যায়সংগত। আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহাই আজীবন এই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। (বুখারী, মুযারায়া ও শিরকাত অধ্যায়)
মোটকথা একটা আধা সংগঠিত সমাজকে একটা নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করায় ও আল্লাহ প্রদত্ত ইনসাফের নীতিমালার বাস্তবায়নে ধর্ম ও সভ্যতার আদি একচেটিয়া দাবীদার ইহুদী জাতি রসূল সা. কে সহযোগিতা করার পরিবর্তে পদে পদে বাধা দিতে থাকে এবং ইসলামী ব্যবস্থার শেকড়কে প্রাথমিক যুগেই উৎখাত করার অমার্জনীয় অপচেষ্টা চালায়।
রসূলের সা. পরিবারে কলহ বাধানোর অপচেষ্টা
মদিনায় বসবাসকারী ইসলামের শত্রুরা রসূলের সা. পরিবারেও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে। তাদের দৃষ্টিতে রসূল সা. এর পরিবার ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সাথীদের মাধ্যে কলহ-কোন্দল বাধানোর জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে মোক্ষম পন্থা। ইসলামী আন্দোলনের নেতাকে ঘরোয়া বিবাদে জড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত সফল হলে তার ফলাফল অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হতে পারতো। মদিনার সাধারণ মহিলারা তো এমনিতেই রসূল সা. এর বাড়ীতে আসা-যাওয়া করতেন। তারপর তারা যা কিছুই দেখতো, নারী জাতির স্বভাবসুলভ মনস্তত্ব অনুযায়ী তা সবার কাছে বলে বেড়াতো। এতে করে মোনাফেক ও দুশ্চরিত্র শ্রেণীর লোকেরা ভালোভাবেই জানতে পারতো যে, রসূল সা. এর পরিবারে কি ধরণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিরাজ করে। রসূল সা. এর স্ত্রীগণ অভিজাত পরিবারের মহিলা ছিলেন এবং তাদের রুচি কারো চেয়ে নিম্নমানের ছিলনা। কিন্তু অপর দিকে এই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা যে পর্যায়ের ছিল, তাতে রসূল সা. আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট থাকলেও তা তাদের মনোপুত সাবেক মানের চেয়ে অনেক নিম্নে ছিল। রসূল সা. এর সাথে তাঁর স্ত্রীগণও এরূপ পরিস্থিতির ওপর ধৈর্য ধারণ করতেন। তারা এটা বিলক্ষণ বুঝতেন যে, নতুন বিশ্বের স্থপতি যে প্রাণান্তকর অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন, তাতে সর্বাংগীন সুখ-শান্তি আশা করা যায় না। কিন্তু তবু মানুষ মানুষই। মানুষ সব সময়ই তার স্বাভাবিক আবেগ অনুভূতি ও আশা-আকাংখা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। রসূল সা. এর স্ত্রীগণ ঈমান ও চরিত্রের দিক দিয়ে উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও একাত্মতার চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত বিশ্বের সামনে পেশ করেছিলেন, তা সত্য। তথাপি একই পরিবারের সদস্যা হওয়ার কারণে তাদের কখনো কখনো পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বীসূলভ মানসিকতা দ্বারা সামান্য পরিমাণে হলেও প্রভাবিত হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিলনা। এ ছাড়া কোরায়েশ বংশীয়া মহিলাদের মধ্যে স্বামীর ভক্ত ও অনুগত থাকার ঐতিহ্য যতটা কঠোরভাবে পালিত হয়ে আসছিল, সেটা মদিনার মহিলাদের মধ্যে ততটা ছিলনা। মদিনার মহিলারা বরং স্বামীর ওপর বেশ খানিকটা তেজস্বিতা দেখাতো। উদাহরণস্বরূপ, হযরত ওমরের ন্যায় দোর্দন্ড প্রতাপশালী পুরুষ একবার মদিনায় থাকাকালে যখন আপন স্ত্রীকে ধমক দিলেন, তখন তিনিও সতেজে পাল্টা জবাব দিলেন। এতে অবাক হয়ে গিয়ে হযরত ওমর বললেন, ‘‘তুমি আমার মুখের ওপর জবাব দিলে?’’
এই সময়ে তিনি অনুভব করতে পারলেন যে, মুসলমানদের দাম্পত্য জীবনে মক্কার ঐতিহ্য ও ভাবধারার ওপর মদিনার পরিবেশ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।
মোনাফেক ও দুশ্চরিত্র লোকদের কাছে এ পরিস্থিতি স্পষ্ট ছিল এবং এর মধ্য দিয়েই তারা চক্রান্ত করার সুযোগ পেয়ে যায়। তারা রসূল সা. এর পরিবারের অভ্যন্তরে বিভেদ ও বিভ্রান্তির আগুন জ্বালানোর জন্য কিছু সংখ্যক মহিলাকে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করে। এ ধরণের জনৈকা মহিলার নাম উম্মে জালদাহ। তাঁর কাজ ছিল রসূলের সা. স্ত্রীদেরকে উস্কে দেয়া। এ ধরনের মহিলা গুপ্তচরদের ষড়যন্ত্রেই হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করা সম্ভব হয়েছিল।
দুশ্চরিত্র লোকদের এ জাতীয় চক্রান্তের ফলে একাদিক্রমে এমন কতগুলো ঘটনা ঘটে, যা খুবই ক্ষতিকর হতে পারতো। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য, রসূল সা. এর চরিত্র, বিশিষ্ট সাহাবীদের সহায়তা ও স্ত্রীগণের সৌজন্যের প্রভাবে যথাসময়ে সমস্যার নিরসন হয়ে যায়।
এ সবের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ঘটনা ছিল ভরণ পোষণ বাবদ বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য স্ত্রীগণের দাবী। এই দাবীর ফলেই ‘ঈলা’ (রসূল কর্তৃক স্ত্রীদের সংশ্রব সাময়িকভাবে পরিত্যাগ) সংঘটিত হয়েছিল। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ছিল যে, হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমর রা. অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে রসূল সা. এর পক্ষ নিয়েছিলেন এবং তাদের কন্যাদ্বয়কে উৎসাহ দেয়ার পরিবর্তে কঠোরভাবে ধমকে দিয়েছিলেন। এদিকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ এলো যেঃ
‘‘হে নবী তোমার স্ত্রীদের বলে দাও, তোমরা যদি দুনিয়ার জীবন ও তার বিলাসব্যসন চাও, তবে (তা এই বাড়ীতে পাওয়া যাবে না) এস, আমি তোমাদের বিদায়ের পোশাক দিয়ে সুন্দরভাবে বিদায় করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল ও আখেরাতের জীবনকে চাও, তাহলে জেনে রেখ, আল্লাহ সৎ কর্মশীলা মহিলাদের জন্য বিরাট পুরস্কার নির্ধারণ করে রেখেছেন।’’ (সূরা আহযাব)
বস্তুত রসূল সা. এর স্ত্রীদের সামনে দুটো পথ খোলা রাখা হয়েছিল। দুটো পথের যে কোন একটা তারা গ্রহণ করতে পারতো। স্ত্রীরা আপন মহত্বের গুণে তৎক্ষণাত সাবধান হয়ে গেলেন। যিনি নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং অসাধারণ মেধা প্রতিভার কারণে এই দাবীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, সেই হযরত আয়েশাকেই রসূল সা. সর্বপ্রথম আল্লাহর এই সিদ্ধান্ত জানালেন। আর হযরত আয়েশাই সর্ব প্রথম ঘোষণা করলেন, আমি আল্লাহ ও রসূল ছাড়া আর কিছু চাইনা। তারপর একে একে অন্য সব স্ত্রীও সর্বান্তকরণে দাবীদাওয়া পরিহার করলেন।
শত্রু পরিবেষ্টিত একটি পরিবারে দুষ্ট লোকদের ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের ফলে এবং নিকৃষ্ট ধরণের গুপ্তচর মহিলাদের অপতৎপরতার কারণে যদি কোন এক পর্যায়ে দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি হয়ে যায়, তবে সেটা বিচিত্র কিছু নয়। বরং এত ষড়যন্ত্রের পরও এই পরিবারটির নিরাপদে টিকে থাকাটাই তার সদস্যদের দৃঢ়তা, একাত্মতা ও মহত্বের লক্ষণ।
এবার বুঝে নিন, রসূল সা. এর চারদিকে কত রকমের ষড়যন্ত্রের জাল পাতা হচ্ছিল।
হত্যার ষড়যন্ত্র
সত্যের আহ্বান যখন আন্দোলনের পরিণত হয়, তখন তার বৈরী শক্তিগুলো অন্যায় বিরোধীতা করতে গিয়ে ক্রমাগত হীনতা ও নীচতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা যখন মূল দাওয়াতে বিরুদ্ধে যুক্তিতেও হেরে যায়, এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও সহিংসতার অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়, তখন তাদের আজন্ম লালিত ঘৃণা বিদ্বেষ, গোয়ার্তুমি ও ইতরামি তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণ খুনী ও ডাকাতসুলভ মানসিকতা সৃষ্টি করে দেয়। এই পর্যায়ে এসে তারা ইসলামী আন্দোলনের নেতাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। এ ধরণের কুচক্রী শত্রুরা যদি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের গদিতে আসীন হয়, তাহলে তারা প্রতিপক্ষের ওপর রাজনৈতিক নির্যাতন চালায় এবং আইনের তরবারী চালিয়ে বিচারের নাটক মঞ্চস্থ করে মানবতার সেবকদের হত্যা করে। আর ক্ষমতা থেকে যারা বঞ্চিত থাকে, তারা সরাসরি হত্যার ষড়যন্ত্রমূলক পথই বেছে নেয়। মক্কার জাহেলী নেতৃত্ব এই শেষোক্ত পথই বেছে নিয়েছিল। আর এবার মদিনার ভণ্ড ধর্মগুরুরাও এই নোংরা পথই বেছে নিল।
হিজরী চতুর্থ সালের কথা। আমর বিন উমাইয়া যামরী আমের গোত্রের দুই ব্যক্তিকে হত্যা করলো। রসূল সা. এই হত্যাকান্ডের দিয়ত আদায় করা ও শান্তি চুক্তির দায়দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বনু নাযীর গোত্রের লোকদের কাছে গেলেন। সেখানকার লোকেরা রসূল সা. কে একটা দেয়ালের ছায়ার নীচে বসালো। তারপর গোপনে সলাপরামর্শ করতে লাগলো যে, একজন উপরে গিয়ে তাঁর মাথার ওপর বিরাটকায় পাথর ফেলে দিয়ে হত্যা করবে। আমর বিন জাহ্হাশ বিন ক’ব এই দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। রসূল সা. তাদের দুরভিসন্ধি টের পেয়ে আগে ভাগেই উঠে চলে এলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড; রাহমাতুল্লিল আলামীনঃ কাযী সুলায়মান মানসুরপুরী; রসূলে আকরাম কী সিয়াসী জিন্দেগীঃ ডক্টর মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ)
কুখ্যাত ইহুদী নেতা ক’ব বিন আশরাফের পিতা ছিল তাই গোত্রের লোক, আর তার মা ছিল বিত্তশালী ইহুদী নেতা আবু রাফে ইবনে আবি হাকীকের কন্যা। এই দ্বিমুখী সম্পর্কের কারণে কা’ব ইবনে আশরাফ আরব ও ইহুদীদের ওপর সমান প্রভাবশালী ছিল। একদিকে সে ছিল ধনাঢ্য, এবং অপরদিকে নামকরা কবি। ইসলামের বিরুদ্ধে তার বুক ছিল বিষে ভর্তি। (ফাতহুল বারীর) অপর এক রেওয়ায়অতে বলা হয়েছে, কা’ব একদিকে রসূল সা. কে দাওয়াত দিয়েছিল। অপর দিকে কিছু লোককে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল যেন রসূল সা. আসা মাত্রই তাকে হত্যা করে। এই রেওয়ায়াত সূত্রের দিক দিয়ে কিছুটা দুর্বল হলেও কা’বের আক্রোশ ও তার সঠিক তৎপরতার আলোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
যে সময় রসূল সা. বনু কুরায়যার সাথে চুক্তি নবায়ন করেন, সে সময় বনু নাযীর রসূল সা. কে খবর পাঠায়, আপনি তিনজন লোক নিয়ে আসবেন। আমরাও তিনজন আলেম উপস্থিত করবো। আপনি এই বৈঠকের সামনে নিজের বক্তব্য পেশ করবেন। আমাদের আলেমরা যদি আপনার বক্তব্য সমর্থন করে, তাহলে আমরা সবাই আপনার প্রতি ঈমান আনবো। রসূল সা. রওনা হলেন। কিন্তু পথিমধ্যে জানতে পারলেন, ইহুদীরা তাঁকে হত্যার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। তাই তিনি ফিরে এলেন।
খয়বর বিজয়
খয়বর যুদ্ধের সময় জনৈকা ইহুদী মহিলা যয়নব বিনতুল হারস (ছালাম বিন মুশকিমের স্ত্রী) একটি বকরীর গোস্ত ভুনে রান্না করে এবং তাতে বিষ মিশিয়ে দেয়। এর পরে সে জিজ্ঞাসা করে, বকরীর কোন অংশ রসূল সা. বেশী ভালোবাসেন। যখন জানতে পারলো যে, সামনের পায়ের গোশত বেশী প্রিয়, তখন তাতে আরো বেশী করে তীব্র ধরণের বিষ মেশালো। তারপর সে সেই গোশত রসূল সা. ও তার সাথীদের জন্য উপঢৌকন হিসাবে পাঠালো। রসূল সা. এক লোকমা গোশত মুখে নিলেন (কিছুটা হয়তো গিলেও ফেলেছিলেন) এবং তৎক্ষণাত থুথু করে ফেলে দিলেন। তারপর বললেন, এই গোশত আমাকে বলছে যে, তার সাথে বিষ মিশ্রিত। তারপর নিজেও খেলেন না, সাহাবীদেরকেও খেতে দিলেন না। পরে ঐ ইহুদী মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে স্বীকারোক্তি করলো। আসলে এই ঘটনার পেছনে ছিল বহু ইহুদীর সম্মিলিত কারসাজি। রসূল সা. যখন সাধারণ জনসমাবেশে তাদের সবাইকে ডেকে কথা বললেন, তখন সবাই স্বীকারোক্তি করলো। কিন্তু তারা সুকৌশলে বললো, আমরা আপনাকে যাচাই করতে চাইছিলাম যে, আপনি সত্য নবী হলে প্রকৃত সত্য জেনে ফেলবেন। নচেত আমরা আপনার কবল থেকে রেহাই পেয়ে যাবো। (সীরাতুন্নবীঃ শিবলী নোমানী, ১ম খন্ড, সূত্রঃ ফাতহুল বারী)
এই ভোজ সভায় সাহাবাদের মধ্যে হযরত বারা ইবনে মা’রুরও ছিলেন। তিনি গ্রাস মুখে নিয়ে বিষের তীব্রতা অনুভব করলেও বেআদবীর আশংকায় গ্রাস ফেললেন না। ঐ এক গ্রাসেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেল। (যাদুল মায়াদঃ ২য় খন্ড; শামায়েলে তিরমিযী; আসাহহুস সিয়ার)
তাবুক থেকে ফেরার পর মুসলমানদের বিজয়ে মোনাফেকদের মন ক্রোধের আগুনে ভাজা ভাজা হয়ে গেল। এই সব গোপন দুশমনের আশা ছিল মুসলমানরা পরাজয় বরণ করুক। কিন্তু সে আশা সফল না হওয়ায় তারা রসূল সা. কে হত্যার ষড়যন্ত্র করলো। এই ষড়যন্ত্রের বারো জন শরীক হয়। তাদের নাম হলোঃ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, সা’দ বিন আবি সারাহ, আবু ফাতের আরাবী, আমের, আবু আমের রাহেব, জাল্লাস বিন সুয়াইদ, মাজমা বিন জারিয়া, মালীহ তায়মী, হাসান বিন নুমায়ের, তুয়াইমা বিন উবাইরিক, আব্দুল্লাহ ইবনে উয়াইনা ও মুররা বিন রবী।
ষড়যন্ত্র সভায় জাল্লাস বললোঃ ‘‘আজ রাতে আমরা মুহাম্মদকে সা. পাহাড়ের ওপর থেকে ফেলে না দিয়ে ছাড়বোনা, চাই মুহাম্মদ সা. ও তার সাথীরা আমাদের চেয়ে ভালোই হোক না কেন। কিন্তু আমরা যেন ছাগল আর ওরা আমাদের রাখাল হয়ে গেছে। আমরা যেন বোকা আর ওরা বুদ্ধিমান হয়ে গেছে।’’
সে আরো বললোঃ ‘‘মুহাম্মাদ সা. যদি সত্যবাদী হয, তাহলে আমরাতো গাধার চেয়েও অধম।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড)
আব্দুল্লাহ বললোঃ ‘‘আজ রাত যদি জাগো, তবে আজীবন শান্তিতে থাকবে। এই লোকটাকে হত্যা করাই আজ তোমাদের একমাত্র কাজ।’’
মুররা বললোঃ ‘‘আমরা যদি শুধু একটা লোককে হত্যা করি তবে সবাই নিরাপদ হয়ে যাবে।’’
এই বারোজনের মধ্যে হাসান বিন নুমায়েরের বড় একটা ‘কৃতিত্ব’ ছিল এই যে, সে দানের সম্পদ ডাকাতি করেছিল।
অপরজন আবু আমের রাহেব দেখতে সুফী, দরবেশ ও সংসার বিরাগী ছিল। কিন্তু সে মসজিদে যেরারের উদ্যোক্তা ছিল। রোম ও গাসসানের শাসকদের সাথে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাতো। তার মুত্তাকী সুলভ পোশাকে ভন্ডামি ও দৃষ্কৃতি প্রতিফলিত হতো।
স্থির হয় যে, রসূল সা. পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে নিচে ফেলে দেয়া হবে। এই পরিকল্পনা অনুসারে এই বারো জন কুচক্রী রসূল সা. এর সাথে সাথে চলতে লাগলো। রসূল সা. যখন পাহাড়ের কাছে পৌঁছলেন, সবাইকে বললেন, যারা সমতল ভূমির প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে যেতে চায় তারা সেখান দিয়ে যেতে পারে। তিনি নিজের পাহাড়ী পথ ধরে চললেন। সাহাবাদের অনেকেই সমতলের পথ ধরে গেলেন। কিন্তু কুচক্রীরা রসূল সা. এর সাথে থাকলো। রসূল সা. এর দৃষ্টি এমনিতে এত সূক্ষ্ণ ছিল যে, অন্তরের অন্তস্থলে পৌঁছে যেত এবং গোপন আবেগ অনুভুতিও বুঝে ফেলতেন। মোনাফেকরা তো রসূল সা. এর সামনেই বেড়ে উঠেছে। তাই মোনাফেকদের তাঁর চেয়ে বেশি আর কে চিনবে? তদুপরি গায়েবী ইশারা দিয়েও আল্লাহ তাকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন। তিনি হুযাইফা বিন ইয়ামান এবং আম্মার বিন ইয়াসার এই দু’জনকে সাথে নিয়ে পাহাড়ী পথে চললেন। আম্মারকে সামনে রসূল সা. এর উটের লাগাম ধরে চলতে বললেন। আর হুযাইফাকে পেছনে পেছনে চলতে বললেন। বিশেষ জায়গাটা এসে গেলে কূচক্রী দলটি লাফাতে লাফাতে এসে গেল। একে অন্ধকার রাত। তদুপরি দৃষ্কৃতিকারীরা ছিল মুখোশপরা। রসূল সা. পায়ের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই সাথীদ্বয়কে নির্দেশ দিলেন, পেছনে যারা আসছে তাদেরকে হটিয়ে দিতে। হযরহ হুযাইফা লাফিয়ে চলে গেলেন। তাদের উট দেখে তার থুতনীতে তীর নিক্ষেপ করলেন। তারা হযরত হুযাইফাকে দেখে ভাবলো, ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। অগত্যা পেছনে পালিয়ে গিয়ে সাধারণ মুসলমানদের সাথে মিশে গেল।
হযরত হুযাইফা যখন ফিরে এলেন, তখন রসূল সা. নির্দেশ দিলেন, ‘এখান থেকে উট জোরে হাঁকিয়ে নিয়ে যাও।’ আর হুযাইফাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ওদের চিনেছ? হুযাইফা বললেন, অমুক অমুকের বাহন চিনেছি। কিন্তু মানুষ চিনিনি। রসূল সা. বললেন, তুমি তাদের মনোভাব বুঝেছ? তিনি নেতিবাচক জবাব দিলেন। এরপর রসূল সা. নিজে তাকে জানালেন, ওরা আমাকে পাহাড়ের ওপর থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিল।
পরদিন সকালে রসূল সা. ঐ বারোজন কূচক্রীকে নাম ধরে ধরে তলব করলেন। প্রত্যেকের মনোভাব ও ষড়যন্ত্র পাকানোর সমাবেশে যে যা বলেছিল, তা তাদের সামনে তুলে ধরে প্রত্যেকের কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন।
তাদের সবার জবাব ছিল কৌতুকপ্রদ। যেমন হাসান বিন নুমায়ের বললো, ‘‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলনা যে, আপনি এসব জানবেন। কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম, আপনি যথার্থই আল্লাহর রসূল। এ যাবত আমি সাচ্চা মুসলমান ছিলাম না। আজ আমি একনিষ্ঠভাবে ইসলাম গ্রহণ করলাম।’’
প্রত্যেকের এ ধরণের ছলছুতো ও ওযর বাহানা পেশ করলো। কেউ কেউ মাফ চাইল। রসূল সা. সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। (আসাহহুশ্ সিয়ার-মাওলানা আব্দুর রউফ দানাপুরী)
অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একাধিক রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, রসূল সা. শুধু হযরত হুযাইফাকে গোপনে এই ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের নাম জানিয়েছিলেন। সাধারণ মুসলমানদের সামনে ফাঁস করেননি। তাছাড়া এই বারো জনের মধ্যে কয়েকজন সম্পর্কে কিছু কিছু মতভেদও রয়েছে। দু’তিন জন সম্পর্কে অনেকে এ কথাও বলে থাকেন যে, তাদের মধ্যে পরবর্তীকালে আর কোন মোনাফেকীর লক্ষণ দেখা যায়নি।
তবে আসল ঘটনা যথাস্থানে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। কোরআনে সেই বিষয়ই বলা হয়েছে যে, “তারা যা করতে চেয়েছিল, তা করতে পারেনি।”
রাসূল সা. এর এই মহানুভবতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানবতার সেবার জন্য বিপ্লব সংগঠিত করলেন। অথচ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আসল নাযুক মুহুর্তে কয়েকজন দুস্কৃতিকারী তাঁর সমগ্র কীর্তির মূলোৎপাটনের জন্য তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাদের সমস্ত অপকর্মের রহস্য ফাঁসও হয়ে যায় এবং তারা স্বীকারোক্তিও করে। অথচ এই মহামানব এত বড় অপরাধকেও নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দেন। রাসূল সা. কে বলাও হয়েছিল যে, “আপনি এই অপরাধীদের প্রত্যেকের গোত্রকে নির্দেশ দিন তারা যেন ওদের মাথা কেটে আপনার কাছে এনে জমা দেয়।” কিন্তু রসূল সা. জবাব দেন, “আমি পছন্দ করিনা যে আরবরা বলাবলি করুক, মুহাম্মদ সা. কতক লোককে সাথে নিয়ে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছে এবং বিজয় লাভ করার পর নিজেই সাথীদেরকেই হত্যা করতে আরম্ভ করেছে।”(তাফসীরে ইবনে কাছীর, ২য় খন্ড) এ কথা দ্বারা রসূল সা. বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, এ রকম প্রতিশোধ গ্রহণ করলে ইসলামী আন্দোলনের আসল শক্তি স্বীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারবেননা। এ জন্য নিজের জীবনের ওপর ঝুঁকি আসুক, এবং নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র ও নাশকতার মোকাবিলা করতে হোক-তাও তিনি সহ্য করতেন। কিন্তু এটা পছন্দ করতেন না যে, পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বল প্রয়োগ করা হোক এবং বিশৃংখলা দেখলেই তা ক্ষমতা ও আইনের জোরে নির্মুল করা হোক। মানব সমাজের শাসন ও ব্যবস্থাপনার কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক প্রজ্ঞা, বিচক্ষনতা ও সুক্ষদর্শিতার পরিচয় দিতে হয়, অনেক স্বার্থ ও সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয় এবং প্রতিকূলতা ও বক্রতা শোধরানোর অনেক কৌশল বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। ইসলামী বিপ্লব যে অন্যান্য বস্তুগত বিপ্লবের চেয়ে কঠিন, তার একটি কারণ হলো, এর অত্যন্ত নাযুক ও স্পর্শকাতর নৈতিক প্রাণসত্তাকে প্রতিমুহূর্তে সংরক্ষণ করতে হয়, যাতে এর স্বচ্ছতা কোন সাধারণ ভুলবুঝাবুঝি ও কোন বিরূপ প্রচারণা দ্বারা কলংকিত হতে না পারে।
রসূল সা. এর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনাবলীর মধ্যে ইহুদীদের পক্ষ থেকে জাদুর আক্রমণও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রকাশ্যে আক্রমণকারীরা শত্রু হলেও তারা বীর হয়ে থাকে। কাউকে হত্যা করার ইচ্ছা থাকলেও তাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার পর আক্রমণ করাই ন্যায় সংগত রীতি। কিন্তু ইহুদীদের মধ্যে সেই বীরত্ব ও সৎসাহস ছিলনা। এ জন্য তারা গোপন ও কুটিল ষড়যন্ত্রের কাপুরুষোচিত ও নারকীয় পথ অবলম্বন করে। কিন্তু এর চেয়েও নিম্নস্তরে নেমে জাদুটোনা, মন্ত্র ও ঝাড়ফুঁকের শক্তি প্রয়োগ করে কারো ওপর আক্রমণ চালানো সেই সব লোকের কাজ যারা কাপুরুষতা ও পাশবিকতার সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যায়। ইহুদী নরপশুরা হিংসা ও ক্রোধের আতিশয্যে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে এই জঘন্যতম কাজও করতে দ্বিধা করেনি।
বনী রুযাইক গোত্রের লাবীদ বিন আসেম নামক এক ব্যক্তি ইহুদীদের মিত্র এবং বর্ণচোরা মুসলমান ছিল। তার হাত দিয়েই জাদুর আক্রমণটা চালানো হয়। একজন ইহুদী কিশোর স্বীয় জন্মগত সৎস্বভাবের কারণে রসূল সা. এর প্রতি আকৃষ্ট ছিল এবং তাঁর খিদমত করতো। কতিপয় ইহুদী তাকে বাধ্য করে রসূল সা. এর মাথার চুল ও চিরুনীর দাঁত আনিয়ে নিল। ঐ চুলের ওপর জাদুমন্ত্র পড়ে ১২টা গিরে দিয়ে যারওয়ান নামক এক কূঁয়ার মধ্যে রাখা হলো।
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়, এই জাদুক্রিয়ার ফলে, রসূল সা. এর মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাবান্তর ঘটে। একটা কাজ না করেও ভাবতেন যে করেছেন। স্ত্রীদের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক আকর্ষণেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ওহির মাধ্যমে তিনি এই জাদুক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত হন। সেই চুল বের করা হয় এবং তিনি স্বাভাবিক হয়ে যান। (তাফহীমুল কুরআন, ২য় খন্ড, টীকা-১১৪)
এ ঘটনা প্রসংগে একটা বিতর্ক চলে আসছে যে, নবীর ওপর জাদু কার্যকর হতে পারে কিনা? একটা অভিমত হলো, মোটেই হতে পারেনা। এই মত প্রয়োগ করে হাদীস অস্বীকারকারী গোষ্ঠী হাদীস শাস্ত্রকেই অনির্ভরযোগ্য আখ্যায়িত করেছে। অথচ একজন নবীর মানবীয় দেহ যেমন রোগ ব্যাধি, আঘাত, বিষ ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়, তেমনি তার মানসিক ক্ষমতাও যাবতীয় গোপনও প্রকাশ্য কার্যকলাপ দ্বারা উপকৃত বা ক্ষতিগ্র্রস্ত হয়ে থাকে। যেমন ফেরাউনের জাদুকরদের জাদু দেখে হযরত মুসার ওপর মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাদের রশীগুলোকে সাপের আকৃতিপ্রাপ্ত হতে দেখে তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেনঃ (আরবী********)
“মূসা নিজের মধ্যে ভীতি অনুভব করলো। (সূরা তোয়াহাঃ ৬৭) তবে নবীদের ওপর জাদুর যে প্রভাবটা হয়না বলা হয়েছে, সেটা হলো, জাদু তাঁর নবীসুলভ তৎপরতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনা। তাঁর মনমস্তিষ্কের ওপর অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা এবং তাঁর ইচ্ছাশক্তির ওপর থেকে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে না।
এই বিতর্কের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেও এটা স্বীকার করতে কোন বাধা নেই যে, ইহুদীরা রসূল সা. এর ওপর জাদুর আক্রমণ সত্যই চালিয়েছিল। তাদের এ অপরাধ অকাট্যভাবে প্রমাণিত একটা বাস্তবতা।
এসব ঘটনা যখন আমাদের সামনে আসে, তখন আমরা বুঝতে পারি কী কারণে মুসলমানরা মাদানী যুগে রসূল সা. এর জীবনাশংকায় উদ্বিগ্ন ও তটস্থ থাকতো? রাতের বেলা তাঁর কখনো বাড়ীর বাইরে যেতে হলে তাঁর সাথীরা প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় লিপ্ত হতেন। এই পরিস্থিতির কারণেই হযরত তালহা বিন বারা তার মৃত্যুপূর্ব অসুস্থায় ওসিয়ত করেন, আমি রাতের বেলায় মারা গেলে কেউ রসূল সা. কে খবর দিওনা। কেননা ইহুদীদের দিক থেকে তাঁর প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে। আল্লাহ না করুন, তিনি যেন আমার জানাযায় আসতে গিয়ে শত্রুদের হাতে কোন আঘাত না পান। কখনো ঘটনা চক্রে রসূল সা. সাহাবীদের চোখের আড়াল হলেই তারা ঘাবড়ে যেতেন এবং তার খোঁজে বের হতেন।
হযরত আবু হুরায়রার একটা প্রসিদ্ধ হাদীস, যাতে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দিলেই বেহেশত প্রপ্তি সুনিশ্চিত বলা হয়েছে, তাতে এই পরিস্থিতির কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে। হযরত আবু হুরায়রা বলেনঃ
“আমরা রসূল সা. এর চারপাশে বসেছিলাম। আমাদের সেই বৈঠকে হযরত আবু বকর এবং হযরত ওমরও ছিলেন। রসূল সা. আমাদের ভেতর থেকে উঠে কোথাও চলে গেলেন এবং অনেক দেরী করলেন। আমরা গভীর উদ্বেগে পড়ে গেলাম যে, রসূল সা. এর সাথে আমরা কেউ না থাকায় তার কোন ক্ষতি না হয়ে যায়। আমরা সবাই অস্থির হয়ে তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। সবার আগে আমিই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাই আমি তার সন্ধানে বেরিয়েই পড়ি।” (মিশকাত, কিতাবুল ঈমান, ৩য় অধ্যায়)
খুঁজতে খুঁজতে হযরত আবু হুরায়রা বনু নাজ্জারের জনৈক আনসারীর বাগানে গিয়ে পৌঁছেন। প্রাচীরের চার পাশে ঘুরে দেখলেন কোথাও কোন দরজা আছে কিনা। কিন্তু প্রাচীরটা হয়তো লম্বা ছিল এবং ভীতি ও তাড়াহুড়োর কারণে কোন নিকটতর পথ খুঁজে পেলেন না। অবশেষে দেখলেন প্রাচীরের নীচ দিয়ে একটা ছোট পানির নালা বেরিয়ে এসেছে। তিনি খুব শুটি গুটি হয়ে (তাঁর নিজের বিবরণ মোতাবেক শৃগালের মত গুটি শুটি হয়ে) নালীর ভেতর দিয়ে প্রাচীরের ভেতরে ঢুকলেন। রসূল সা. কে সেখানে দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হলেন। এরপর তাঁর সাথে আবু হুরায়রার কথা হলো। এই সময়েই রসূল সা. সেই বিখ্যাত সুসংবাদ দেন।
একজন বিশিষ্ট সাহাবীর এই বিবরণ পড়ে বুঝা যায় যে, ইহুদী ও মোনাফেকদের প্রতিনিয়ত হত্যার ষড়যন্ত্রের কারণে মদিনার পরিবেশ কী ধরনের ছিল এবং রসূল সা. এর জীবন কি রকম ঝুঁকির মধ্যে ছিল। কিন্তু সেখানে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশী ছিল যে, একবার এই সব আশংকা ও উৎকন্ঠার কারণে সাহাবায়ে কেরাম রসূল সা. এর চার পাশে প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু রসূল সা. কে যেহেতু আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, (আরবী********)
“আল্লাহ আপনাকে মানুষের কবল থেকে রক্ষা করবেন।” (সূরা মায়িদাঃ ৬৭) তাই তিনি নিজেই তাঁবুর ভেতর থেকে মাথা বের করে প্রহরীদের বললেনঃ
“তোমরা চলে যাও। আল্লাহ নিজেই আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছেন।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ২য় খন্ড)
এই ঈমানই রসূল সা. কে হত্যা করার উদ্দেশ্য এসে গ্রেফতার হওয়া অন্য এক অপরাধীকেও মুক্তি দেয়ার প্রেরণা যোগায়। তিনি বলেছিলেন, “ওকে ছেড়ে দাও। কেননা সে আমাকে হত্যা করতে চাইলেও করতে পারতোনা।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর)
একটু ভেবে দেখুন, মানবতার প্রাসাদের এই মহান স্থপতি কত উদার মনের অধিকারী ছিলেন যে, তার বিরদ্ধে চারদিকে ক্রমাগত হত্যার ষড়যন্ত্র চলতে থাকা সত্বেও তিনি ছিলেন পর্বতের মত স্থির ও অবিচল। মদিনায় কতকগুলো মাকড়সা যেন ক্রমাগত জাল বুনে চলছিল এই দুঃসাহসী শার্দুলকে ধরার জন্য।
ওদিকে মক্কার, আগ্নেয়গিরিও ক্রমেই বিস্ফোরণ্মুখ হয়ে উঠছিল। মক্কার বুকের ভেতরে পাশবিকতা ও হিংস্রতার লাভা ক্রমেই জোরদার হচ্ছিল। হিজরতের প্রাক্কালে রসূল সা. কে হত্যার বিরাট সম্মিলিত ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, সেটা হিজরতের পর বড় বড় আগ্রাসী যুদ্ধের রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু তাদের সেই সব প্রকাশ্য আগ্রাসনের ব্যর্থতা হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র পাকাতে প্ররোচনা দিচ্ছিল।
বদরের যুদ্ধে রসূল সা. এর ক্ষুদ্র মুসলিম দলটি জাহেলিয়াতের সন্তানদের এমন উচিত শিক্ষা দিয়েছিল যে, তার ব্যাথা তারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত ভুলতে পারেনি। মক্কার কোন পরিবারই এমন ছিলনা, যার বাছাই বাছাই জোয়ান কিংবা সরদার এই যুদ্ধে মারা যায়নি। কিন্তু হাতে গনা কয়েকজন সহায় সম্বলহীন বিপ্লবী মুসলমানের হাতে মার খেয়ে তখন উহ্ আহ্ করাটাও অধিকতর লজ্জার কারণ ছিল। তাই কোরায়েশ নেতারা এই মর্মে আদেশ জারী করিয়ে দিয়েছিল যে, বদরের নিহতদের জন্য কোন শোক মা’তম করা যাবেনা। এই লড়াইতে আসওয়াদের তিন ছেলে নিহত হয়েছিল। শোকে তার কলিজা চৌচির হবার উপক্রম হলেও সে মুখে টুশব্দটিও করতে পারছিলনা। একদিন পাশের এক বাড়ী থেকে কান্নার শব্দ শুনে ভৃত্যকে পাঠালো, যাও, কাঁদার অনুমতি দেয়া হয়েছে কিনা জেনে এসো। ভৃত্য খোঁজ খবর নিয়ে এসে জানালো যে, এক মহিলার উট হারিয়ে যাওয়ায় সে কাঁদছে। এই খবর শুনে আসওয়াদ তার আবেগকে আর ধরে রাখতে পারলোনা। সে স্বতস্ফুর্তভাবে একটা কবিতা আবৃত্তি করে ফেললো। এই কবিতাটা আরবী সাহিত্যে বিশেষ কদর লাভ করেছে। এর তিনটে লাইনের অনুবাদ নিম্নরুপঃ
“একটা উট হারিয়ে যাওয়ায় ঐ মহিলা কাঁদছে এবং তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে? উটের জন্য কেঁদনা। কাঁদতে হলে বদরের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য কাঁদো। কাঁদতে হলে আকীলের জন্য কাঁদো। কাঁদতে হলে বীরকেশরী হারেসের জন্য কাঁদো।”
মক্কার এহেন শোকতুর পরিবেশে উমাইর বিন ওহাব ও সাফওয়ান বিন উমাইয়া এক জায়গায় বসে বদরের নিহতদের জন্য কাঁদছিল। সাফওয়ান বললোঃ এখন আর বেঁচে থাকার কোন মজা নেই। উমাইর বললোঃ আমি যদি ঋণগ্রস্ত না থাকতাম এবং আমার ছেলে মেয়ে নিয়ে ভাবনা না থাকতো, তাহলে এক্ষুনি গিয়ে মুহাম্মদকে সা. কে হত্যা করে আসতাম। আমার ছেলেটাও এখনো মদিনায় বন্দী। সাফওয়ান তার ছেলে মেয়ে ও ঋণের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করলো। উমাইর তৎক্ষনাত বাড়ীতে এসে তলোয়ারে বিষ মেখে নিল এবং মদিনা অভিমুখে রওনা হয়ে গেল। মদিনায় পৌঁছার পর তার মুখমন্ডলের হাবভাব দেখে হযরত ওমর তার মনোভাব বুঝে ফেললেন এবং ঘাড় ধরে রসূল সা. এর কাছে নিয়ে এলেন। রসূল সা. ওমরকে বললেন ওকে ছেড়ে দাও। তারপর কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী উদ্দেশ্যে এসেছ? সে বললো, ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছি। জিজ্ঞেস করলেন, তলোয়ার ঝোলানো কেন? উমাইর বললেন, তাতে কী হয়েছে। তলোয়ার বদরে কোন কাজে লেগেছে?
এবার রসূল সা. তার মনের গোপন কথাটা বের করে তার সামনে রেখে দিলেন। তিনি বললেন, “তুমি ও সাফওয়ান একটা কক্ষে বসে আমাকে হ্ত্যার ষড়যন্ত্র করেছ। কিন্তু আল্লাহ্ তোমাদের্ এ ষড়যন্ত্র সফল হতে দেননি।”
কথাটা শুনে উমাইর হতবুদ্ধি হয়ে গেল। সে বললো, “আল্লাহর কসম, আপনি সত্যই নবী। আমি ও সাফওয়ান ছাড়া আর কেউ এ বিষয়টা জানতোনা।”
উমাইর মুসলমান হয়ে মক্কায় ফিরলো। সে সাহসিকতার সাথে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বহু লোককে মুসলমান বানিয়ে ফেললো। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড)
মক্কা বিজয়ের সময় ফুযালা বিন উমাইরও প্রতিশোধ স্পৃহার বশবর্তী হয়ে মনে মনে রসূল সা. কে হত্যা করার সংকল্প নিল। রসূল সা. কা’বা শরীফের তওয়াফ করছিলেন। সহসা ফুযালা আবির্ভুত হলো। কাছে এলে রসূল সা. ডাকলেন, “কে, ফুযালা নাকি?” সে জবাব দিল, “জ্বী, ফুযালা।” রসূল সা. বললেন।“তুমি মনে মনে কী মতলব এঁটেছ? ফুযালা ঘাবড়ে গিয়ে বললো, “কিছুই না, আমি তো আল্লাহকে স্মরণ করছি।”
রসূল সা. তার জবাব শুনে হেসে দিয়ে বললেন, “আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।” এই কথাটা বলার সাথে সাথে তিনি ফুযালার বুকের ওপর হাত রাখলেন। সংগে সংগে তার মন স্বাভাবিক হয়ে গেল। ফুযালা বলেন, রসূল সা. আমার বুকের ওপর থেকে হাত তুলে নেয়ার পর আল্লাহর সৃষ্টি জগতে রসূল সা. এর চেয়ে আর কেউ আমার কাছে প্রিয় ছিল না।” এই মনস্তাত্মিক বিপ্লবের পর ফুযালা বাড়ী ফিরে গেল। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড)
শুধু মক্কা নয়, সমগ্র আরবের বিজেতাকে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে যে এলো, সে নতুন জীবন নিয়ে ফিরে গেল। যেই এসেছিল আঘাত হানতে, সে বরং নিজের ক্ষত স্থান সারানোর মলম নিয়ে চলে গেল।
কোরায়েশ, ইহুদী, মোনাফেক-সবাই নিজ নিজ সাধ্যমত চক্রান্ত চালিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ নিজের ওয়াদা পূর্ণ করলেন এবং তাঁর বান্দা ও রসূলকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করলেন।
এই সব ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য কেবল এক ব্যক্তিকে হত্যা করা ছিলনা, বরং এরা সবাই হত্যা করতে চেয়েছিল গোটা ইসলামী আন্দোলনকে। সত্য ও ন্যায়ের সেই উজ্জ্বল প্রভাতকে তারা বদ্ধভূমিতে পাঠাতে চেয়েছিল, যার আবির্ভাব ছিল অন্ধকারের জন্য মৃত্যুঘন্টা। যে নতুন সমাজ ব্যবস্থা শত শত বছরের শোষিত নির্যাতিত মানুষকে প্রথম বারের মত জীবনের স্পন্দন, সাম্য, স্বাধীনতা ও মান মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চেয়েছিল, সেই নজীরবিহীন চমৎকার সমাজ ব্যবস্থাকে তারা গলা টিপে মারতে চেয়েছিল।