২. জ্ঞান, মূল্যবোধ ও কর্ম
শরীয়তী কাজ ও কর্তব্যের মূল্য উপলব্ধিতে ফিকাহর জ্ঞান সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর আদেশ ও নিষেধের মানদন্ডে এসব কাজ ও কর্তব্যের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই জ্হান বিবিধ ও সাদৃশ্যের মধ্যেকার বিভ্রান্তি প্রতিরোধ করে। জীবনের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের আলোকে ইসলাম প্রতিটি কর্মের মূল্যমান নির্ধারণ করে দিয়েছে।
মুস্তাহাব (প্রশংসনীয়) কাজগুলো না করলে শাস্তি নেই, কিন্তু করলে পুরস্কার আছে। আবার এমন বিষয় আছে যা রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বদা করেছেন, পরিহার করেননি; কিন্তু অন্যকে করার জন্যে সুস্পষ্ট আদেশ দেননি। এগুলো যে বাধ্যতামূলক নয় তা প্রমাণ করার সাহাবায়ে কিরাম এসব কাজের কিছু কিছু করেননি। মাযহাবগুলোর মত অনুযায়ী মুস্তাহাবের আদেশ আছে; কিন্তু সুস্পষ্টভাবে নয়। ফরয দ্বর্থহীনভাবে বাধ্যতামূলক, করলে সওয়াব, উপেক্ষা করলে গুনাহ। আর পালন না করলে ফিস্ক, পাপকার্য। আর বিশ্বাস না করলে কুফরী। ফরয দু’ভাগে বিভক্ত। ফরযে কিফায়াহ (সমষ্টিক কর্তব্য) ও ফরযে আইন (ব্যাক্তিগত কর্তব্য)। ব্যাক্তিগত কর্তব্য প্রত্যেক মুসলমানকে পালন করতে হবে। আর সমষ্টিক কর্তব্য কেউ করলেই চলবে, অন্যরা না করলে গুনাহ নেই। ব্যাক্তিগত কর্তব্যের শ্রেণী বিভাগ আছে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফারাইয যা ঈমানের মৌলিক অঙ্গ, যেমন শাহাদাহ অথাৎ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ মোন্তোফা (সা) তাঁর রাসূল এবং কর্মে প্রতিফলন হচ্ছে সালাত, যাকাত, সিয়াম ও হজ্জের মাধ্যমে। আরো কম গুরুত্বপূর্ণ ফারাইয আছে, কিন্তু এগুলোও বাধ্যতামূলক। ফরযে কিফায়ার চেয়ে ফরযে আইনের গুরুত্ব অধিক। পিতার প্রতি সদাচার ফরযে আইন যা জিহাদের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, জিহাদ ফরযে কিফায়াহ। পিতার অনুমতি ছাড়া পুত্র জিহাদে অংশ নিতে পারবে না। এ সম্পর্কে প্রামাণিক হাদীস আছে। আবার ব্যাক্তিগত অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ফরযে আইনের ওপর সামাজিক অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত ফরযে কিফায়াহ অগ্রাধিকার পাবে। মুসলিম ভূখন্ড আক্রান্ত হলে জিহাদ ফরযে আইন। তখন পিতার অধিকার গৌণ হয়ে যায়। এমনিভাবে ওয়াজিবের ওপর ফরয, সুন্নাতের ওপর ওয়াজিব ও মুস্তাহাবের ওপর সুন্নাতের অগ্রাধিকার রয়েছে। একইভাবে ইসলাম ব্যাক্তিগত আত্মীয়তার ওপর সামাজিক দায়িত্ব এবং এক ব্যাক্তির জন্যে উপকারী কাজের ওপর একাধিক ব্যক্তির উপকার হতে পারে এমন কাজে অগ্রাধিকার দেয়। নফল এবাদত, দান খয়রাতের চেয়ে দু’পক্ষের মধ্যেকার বিরোধ মীমাংসার প্রতিও ইবাদত ইসলাম অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। একজন শাসককে তার নফল ইবাদতের চেয়ে তার সুবিচারের জন্যে বেশি পুরস্কার দেয়া হবে। অবক্ষয়ের যুগে মুসলমানরা যেসব ভুল করেছিলো সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেয়া হলো:
১. তারা উম্মার স্বাসংশ্লিষ্ট বৈজ্হানিক শিল্প ও সামরিক ক্ষেত্রে উদ্ভাবন ও উৎকর্ষ অর্জনের প্রচেষ্ঠা উপেক্ষা করেছে। এছাড়া ইজতিহাদ, আহকাম ও দাওয়া এবং স্বৈরশাসনের বিরোধিতা উপেক্ষা করেছে।
২. তারা ভাল কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের নিষেধের মতো ব্যাক্তিগত কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেনি।
৩.তারা কোনো মৌল বিশ্বাসকে কম গুরুত্ব দিয়ে অপর একটিকে বেশি পালন করেছে। তারা রমযানের নামাযের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে। অজন্যে নামাযীর চেয়ে রোযাদারের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। এদের মধ্যে আবার কেউ কখনো সিজদাই করেনি। অনেকে যাকাতের চেয়েসালাতের বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যদিও আল্লাহ তায়ালা কুরআনে একত্রে বাইশ বার এ দু’টো কাজের আদেশ দিয়েছেন। এজন্যে সাহাবায়ে কিরাম বলতেন, “যাকাত ছাড়া সালাত বাতিল।” আর হযরত আবু বকর (রা) তো যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
৪. পরযসমূহ ও ওয়াজিবাতের চেয়ে নাওয়াফিলের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে সূফীদের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। তারা নানা আচার-অনুষ্ঠান, যিকর ও তাসবীহর ওপর মনোযোগ দিয়েছেন; সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচার প্রতিরোধের মতো সামাজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেননি।
৫. তারা জিহাদ,ফিকাহ, আপোস-মীমাংসা, সৎকর্মে সহযোগিতা ইত্যাদির মতো সামাজিক দায়িত্ব অগ্রাহ করে ব্যাক্তিগত ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত থেকেছেন।
৬. শেষত, অধিকাংশ মানুষ ঈমান, তাওহীদ, নৈতিক উৎকর্ষের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল ইত্যাদি মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে গৌণ বিষয়ে ওপর অযথা গুরুত্ব দিয়েছেন।
নিষিদ্ধ বিষয়গুলোরও শ্রেণীভেদআছে: যেমন, মাকরূহাত (ঘৃণা) কিন্তু গুনাহ নেই। যেগুলো ঘৃণা কিন্তু স্পষ্টবাবে নিষিদ্ধ নয়, এসব হালালের চেয়ে হারামের কাছাকাছি। মুতাশবিহাত (অস্পষ্ট বা নিগূঢ়) সেগুলোই যা অল্প লোকের কাছে জ্ঞাত এবং অজ্ঞতাবশত করে ফেলা হয়। এগুলো হারাম। সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ বিষয়গুলো কুরআন ও সুন্নায় বিস্তারিত বণূনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা কেন খাও না (গোশত) যাতে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়েছে যখন তিনি নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন?” (৬:১১৯)
এই নিষেধাজ্হা দু’ভাগে বিভক্ত: ছোট ও বড়। ছোট বিষয়গুলো অপসৃত হয় সালাত, সিয়াম ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে। কুরআনুল করীম থেকে আমরা জানি, “সুকৃতি দুষ্কৃতিকে অপরিসারিত করে।” (১১:১১৪)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাত থেকে আমরা জানি, নিয়মিত সালাত ও সিয়াম আদায় করলে এরন মাঝখানের ছোট
ছোট গুনাহ মাফ হয়ে যায়। অবশ্য বড় পাপ কেবল খালেস তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে কবীরা গুনাহ হচ্ছে শিরক-আল্লাহর সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করা। এ গুনাহর কখনো মাফ নেই। আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ্ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ মাফ করেন না, এছাড়া অনান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে মাফ করে দেন, যে কেউ আল্লাহ্র সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।” (৪:৪৮)
অতঃপর হাদীসে উল্লেখিত পাপগুলো হচ্ছে: পিতামাতার অবাধ্যতা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, যাদু, খুন, সুদ, এতীমের সম্পদ আত্মসাৎ এবং মিথ্যা সাক্ষ্য করে সতী মুসলিম মহিলাদের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ।
নিম্মোক্ত বিষয়গুলো থেকে ত্রুটি ও বিভ্রান্তি দেখা দেয়:
ক. মানুষের মধ্যে মুহাররামাতের চেয়ে মাকরূহাত ও মুতাশাবিহাতের প্রতি বাধা দেয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে ওয়াজিবাতকে উপেক্ষা করা হয়। সুস্পষ্ট হারামের পরিবর্তে মতভেদের বিষয়গুলো নিয়ে বেশি ব্যগ্রতা।
খ. অনেক লোক ভাগ্য গণনা, যাদু, মাযারকে নামাযের স্থান হিসেবে ব্যবহার, মৃতদের উদ্দেশ্য পশু উৎসর্গ, মৃতদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা ইত্যাদি কবীরা গুনাহর পরিবর্তে ছগীরা গুনাহ প্রতিরোধে বেশি ব্যস্ত। অথচ কবীরা গুনাহগুলো তাওহীদী চেতনাকে দূষিত করে।
একইভাবে বিভিন্ন মুসলমানের আচরণও বিভিন্ন। কোনো কোনো ধার্মিক যুবক জ্ঞান, ঈমান ও শক্তির ব্যাপারে অন্য সকলকে এমন চোখে দেখে যেন তারা সবাই সমান। সুতরাং তারা সাধারণ ও জ্ঞানী-গুণী মানুষের মধ্যেও পার্থক্য করতে পারে না। এছাড়া পুরানো মুসলমান ও ন্ওমুসলিম এবং প্রাকৃতিক ভিন্নতার দিকে লক্ষ্য রেখেই শ্রমসাধ্য ও সহজবোধ্য, ফারাইয ও নাওয়াফিল, বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক অধিকারী করলাম আমার বান্দদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরবে আমি মনোনীত করেছি; তবে তাদের মধ্যে কেউ নিজের ওপর যুলুম করে, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী। এটাই মহাঅনুগ্রহ।” (৩৫: ৩২)
এ প্রসঙ্গে ‘যে ব্যাক্তি ভুল করেছে’ বলতে ‘যে নিষিদ্ধ কাজ এড়িয়ে গেছে এবং ‘যার ফরয কর্তব্য পালন অসম্পূর্ণ’ বোঝানো হয়েছে। ‘যে ব্যক্তি মধ্যমপন্থা অনুসরণ করে’ বলতে ‘যে কেবল অবশ্য পালনীয় কাজ সম্পন্ন করে এবং নিষেধাজ্ঞা পরিহার করে’ এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যে ব্যক্তি সৎকর্মে অত্যন্ত অগ্রণী বলতে ‘যে ব্যক্তি বাধ্যতামূলক ্ও অনুমোদিত কর্তব্য পালন করে এবং নিষিদ্ধ কাজ’ কেবল পরিহার করে না সকল ধরনের বাজে ও নিন্দনীয় কাজ থেকে বিনত থাকে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। উপরিউক্ত ধরনের সকল লোকই ইসলামী উম্মাহর অর্ন্তভুক্ত যাদেরকে আল্লাহ্ কিতাব দিয়েছেন। এই দৃষ্টিতে কেউ ভুল করলেই তাকে ফিসকের অভিযোগে অভিযুক্ত করা ঠিক হবে না অথবা মতভেদ আছে এমন আমল দেখলেই তাকে হারাম ফতোয়া দেয়াও যুক্তিযুক্ত নয়। যেসব তরুণ মুসলমান এরূপ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে, কুরআন স্পষ্টভাবে ছোট ও বড় গুনাহর পার্থক্য রেখা টেনে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহর। যারা খারাপ কাজ করে তাদেকে তিনি দেন মন্দ ফল আর যারা ভাল কাজ করে তাদেরকে দেন উত্তমপুরস্কার, তারাই বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে, ছোটখাট অপরাধ করলেও। তোমার প্রতিপালকের ক্ষমা অপরিসীম।” (৫৩:৩১-৩২)
ছোটখাট ত্রুটির প্রতি সহনীয় দৃষ্টভঙ্গির ব্যাখ্যা একটি আরবী শব্দ ‘লামাম’-এ (ছোট ত্রুটি) পাওয়া যায়। লামামের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে।্আল-হাফিজ ইবনে কাছির (র) সূরা আন-নিসার ২৫৫-২৫৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন: ‘আলমুহসিমুনন’ শব্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে যারা কবীরা গুনাহ ও লজ্জাকর কাজ পরিহার করে অথাৎ বড় বড় নিষিদ্ধ কাজ পরিত্যাগ করে। এরূপ লোক যদি ছোটখাট ভুল করে বসে, আল্লাহ্ তাকে মাফ করবেন এবং রক্ষা করবেন; যেমন তিনি আরেকটি আয়াতে ওয়াদা করেছেন:
“তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্রে যা গুরুতর তা হতে বিরত খাকলে তোমাদের লঘু পাপগুলো মোচন করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে দাখিল করব।” (৪:৩১)
তিনি আরো বলেন, “…যারা কবীরা গুনাহ ও লজ্জাকর কাজ পরিহার করে, কেবল ছোটখাট ভুল (করে)” এখানে ছোটখাট ত্রুটিকে (লামাম) সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছে, কেননা এগুলো ছগীরা গুনাহ ও লজ্জাকর কাজের উপ-শ্রেণীভুক্ত।
ইবনে কাছির (র)-এর পরে বলেছেন: ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আবু হুরায়রাহ (রা) থেকে নিম্মোক্ত হাদীস শোনার পরেই কেবল লামেমের (ছোট খাট ত্রুটি) বিষয়টি আমি উপলব্ধি করেছি: ‘আল্লাহ্ পাক আদমের পুত্রের (মানুষ) জন্যে ব্যভিচারের অংশ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন যা সে অনিবার্যভাবেই করবে। চোখের যিনা হচ্ছে একদৃষ্টে সেই বস্তু দেখা যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে; জিহবার যিনা হচ্ছে উচ্চারণ; অন্তরে কামনা-বাসনার উদ্ভব এবং গোপন অংগের মাধ্যমে যার আস্বাদন অথবা প্রত্যাখ্যান।”
তাই আবু মাসউদ (রা) ও আবু হুরায়রাহ (রা) বলেন, “লামামমের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে: ‘স্থির দৃষ্টিতে তাকানো, চোখের ইশারা, চুম্বন এবং প্রকৃতপক্ষে ব্যভিচার করা ছাড়াই যৌন সঙ্গমের নিকটবতর্তী হওয়া।”
লামামের অন্য ব্যাখ্যাও ইবনে আব্বাস (রা) দিয়েছেন: লজ্জাকর কাজ বটে কিন্তু এর জন্যে অনুতপ্ত হয়। তিনি পদ্যাকারে একটি হাদীসের উদ্ধৃত দেন যার রূপান্তর করলে দাঁড়ায়, “হে আল্লাহ, আপনার ক্ষমা সীমাহীন, কেননা আপনার বান্দাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে ছোটখাট ভুল করে না।” (ইবনে কাছির)
আবু হুরায়রাহ (রা) ও আল হাসান (রা) যুক্তি দেখান: গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা না করেই যে ভুল করা হয় তাই লামাম এবং যা ঘন ঘন করা হয় না। উপরিউক্ত আলোচনার তাৎপর্য দাঁড়ায়: যারা নিয়মিত কবীরা গুনাহ করে না তাদের জন্যে ইসলামের অঙ্গন বিস্তৃত; কেননা যারা অনুতপ্ত তাদের জন্যে আল্লাহর দয়া প্রশস্ত।
যারা নিয়মিত ফরয কাজ আদায় করে, তাদের নগণ্য ভুলগুলোকে উপেক্ষা করা যায় কিভাবে, তার একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টন্ত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাওয়া যায়। বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) যখন মিসরে ছিলেন তখন তার কাছে কিছু লোক গিয়ে বললো, অনেকেই আলকুরআনের শিক্ষা মেনে চলছে না এবং তারা এ ব্যাপারে খলীফা উমর (রা) তখন তাদেরকে মদীনায় উমর (রা)-এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং সফরের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। উমর (রা) তখন ঐ লোকেদের সাথে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে বললেন। বৈঠকে তার নিকটতম লোকটিকে উমর (রা) ব/ররেন, “সত্যি করে বলো, তুমি কি গোটা কুরআন পড়েছে?” লোকটি ইতিবাচক জবাব দিল। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি নিজে কি এর শিক্ষা কড়াকড়িভাবে মেনে চলো যেন তোমার হৃদয় ও কাজকর্ম পরিশুদ্ধ হয়?” লোকটি প্রতিটির জবাবে নেতিবাচক জবাব দিলো। উমর (রা) তখন বললেন, “তুমি কি (নিষিদ্ধ বিষয় ও বস্তুর) দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকানোর ব্যাপারে, মুখে উচ্চারণ ও বস্তুর জীবনের আচরণে এ রশিক্ষাগুলো কড়াকড়িভাবে মেনে চলেছ?” লোকটি প্রতিটির জবাবে নেতিবাচক জবাব দিলো। উমর (রা) তখন গ্রুপের প্রত্যেকলোককে এই প্রশ্ন করলে প্রত্যেকে নেতিবাচক জবাব দিল।
এরপর উমর (রা) বললেন, “তাহলে তোমরা কি করে খলীফার কাছে দাবী করতে পার যে, তোমরা যেভাবে আল্লাহর কিতাবকে বুঝেছ তাই মানুষকে মানতে বাধ্য করি যা তোমরা নিজেরাই করতে ব্যর্থ হয়েছ বলে স্বীকার করলে? আমাদের প্রভু জানেন যে, আমরা প্রত্যেকে কিছু না কিছু খারাপ কাজ করে ফেলি।” অতঃপর তিনি কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেন, “তোমরা যদি জঘন্যতম কাজগুলো থেকে বিরত থাকো তাহলে আমি তোমাদের সকল খারাপ কাজকে বিদূরিত করবো এবং মহান মর্যাদার তোরণে তোমাদের প্রবেশ করাবো।” (৪:৩১)
লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে উমর (রা) বললেন, “মদীনার বাসিন্দারা কি জানে তোমরা কি জন্যে একানে এসেছ?” তারা নেতিবাচক জবাব দিলে তিনি বললেন, “তারা যদি জানত তাহলে তোমাদেরকে আমি (শাস্তি দিয়ে) দৃষ্টান্ত বানাতাম।” (ইবনে কাছীর)
কুরআনুল করীমের গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উমর (রা) তাৎক্ষণিকভাবে সরেজমিনে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে দিলেন এবং এভাবে অহঙ্কারও গোঁড়ামির গোড়া কেটে দিলেন। এ ব্যাপারে তিনি যদি এতোটুকু দুর্বলতা দেখাতেন তাহলে সুদূরপ্রসারী মারাত্মক ফিতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিলো।