পৃথিবী কোন্ জাতীয়তাবাদের অভিশাপে নিপতিত?
সন্দেহ নেই যে, বর্তমান যুগে স্বাধীনতা উন্নতি-অগ্রগতি এবং মান-মর্যাদা লাভের একটা পরীক্ষিত উপায়ই বিশ্ববাসীর জানা আছে। আর তা হলো এই জাতীয়তাবাদের ব্যবস্থাপত্র। এরই ফলে উন্নতি-অগ্রগতি প্রত্যাশী জাতিমাত্রই এদিকেই ছুটে যায়। অন্যদেরকে যে দিকে ছুটে যেতে দেখে আমরাও সেদিকে ছুটে যাওয়ার আগে আমাদেরকে ভেবে দেখা উচিত যে, আজ দুনিয়ার এ অবস্থা কেন হয়েছে। আজ বিশ্ব এ অবস্থায় নিপতিত কেবল এজন্য যে, ব্যক্তি এবং ব্যষ্টির আশা-আকাঙ্খাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো শক্তি, আশা-আকাঙ্খা আর উৎসাহ-উদ্দীপনাকে বৈধ সীমার মধ্যে রাখার কোনো মতা, চেষ্টা-সাধনার শক্তিকে সরল পথ প্রদর্শন করার মতো কোনো শক্তি, স্বাধীনতা, উন্নতি-অগ্রগতি এবং সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করার মতো কোনো সঠিক ও নির্ভুল পথ ও পন্থা নির্দেশ করার মতো যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষা এবং কোনো নৈতিক জ্ঞান আজ বিশ্বের নিকট নেই। এ শক্তি আর নীতিমালার অভাবেই আজ বিশ্বের নানা জাতি বিপথগামী হয়ে পড়েছে। এ নীতি-নৈতিকতার অভাবেই আজ নানা জাতিকে অজ্ঞতা-কূপমণ্ডুকতা এবং জুলুম-অবিচারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্বয়ং আমাদের দেশের হিন্দু, সিক, পারসিক, ইত্যাদি জাতি আজ যে কারণে পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করছে তা এই যে, তারাও এ ব্যাপারে সঠিক পথ নির্দেশ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এ বিপদের চিকিৎসা আর এ বিভ্রান্তির সংস্কার যদি কোথাও থাকতে পারে তা কেবল আল্লাহর বিধান। আর বিশ্বে কেবল মুসলমানরা-ই সেই দল, যারা আল্লাহর শরীয়তের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং সম্মুখে অগ্রসর হয়ে সেই অজ্ঞতাপ্রসূত ধ্যাণ-ধারণার শিকড় কর্তন করা যা দাবানলের মতো গোটা বিশ্বকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের কর্তব্য হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীকে উদ্ধাত্ত কন্ঠে একথা জানিয়ে দেয়া যে, তোমাদের জন্য কেবল স্বাধীনতা উন্নতি-অগ্রগতি এবং মান-মার্যাদারই নয়, বরং তার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি-নিরাপত্তার এবং সত্যিকার সমৃদ্ধি ও আগ্রগতির পথ কেবল তা-ই যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল নিয়ে এসেছেন। শয়তানের পক্ষ থেকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের ইমাম তোমাদেরকে যে পথ দেখাচ্ছে, তা সত্যিকার মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথ নয়।
কিন্তু বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় ট্রাডেজি তথা বিয়োগান্ত ঘটনা এই যে, বিশ্বকে ধ্বংস ও বিভ্রান্তি-বিপথগামিতা থেকে রা করতে পারে যে মুসলিম দলটি, বিশ্বের বুকে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের মিশন প্রতিষ্ঠা আর প্রসারের দায়িত্ব দিয়ে আলাহ যাদেরকে প্রেরণ করেছেন তারা আজ নিজেদের সে দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হয়ে বসে আছে। হিদায়াতের মশাল নিয়ে অন্ধকারে হাবুডুবু বিশ্বকে আলোকিত করার পরিবর্তে আজ তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর পিছু পিছু ছুটার জন্য উদ্যত হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই যে, এ হাসপাতালে একজন মাত্র চিকিৎসক ছিলেন, এখন সে চিকিৎসকও রোগাক্রান্তদের অন্তর্ভূক্ত হতে চলেছেন!
কবি কি চমৎকার কথা বলেছেন : “মৃত্যুর জন্য সুসংবাদ, ঈসাতো নিজেই পীড়িত।”
জাতীয়তাবাদ ও ভারতবর্ষ
পূর্ববর্তী নীতিগত আলোচনা দ্বারা আমরা প্রমাণ করেছি যে, সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আঞ্চলিক জাতীয়তা ইসলামী আদর্শবাদের সাথে সাংঘর্ষিক এবং সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অতএব মুসলিম বলতে যদি এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যার জীবনের সকল ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিকোণ রয়েছে, মুসলিম বলতে এটা ছাড়া যদি অন্য কিছু না-ই বুঝায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, সে আঞ্চলিক জাতীয়তার বিরোধীতা করবেই-বিরোধীতা করাই তার একান্ত কর্তব্য্য। তাহলে কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলে দেশভিত্তিক বা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদীর ব্যাপারে মুসলমানের ভূমিকা কি হবে-কি হতে পারে-তা নিয়ে বিশেষ কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু এটা সত্ত্বেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ (কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ) সমর্থন করার জন্য যখন আমাদের নিকট বারবার দাবী উত্থাপন হচ্ছে, তখন এ (অবিভক্ত) ভারতের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে জাতীয়তাবাদের পরিণাম কি হতে পারে এবং তা দ্বারা ভারতের-তথা ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তিলাভের কোনো সম্ভাবনা আছে কি-না, তা বিচার-বিশেষণ করে দেখা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
জাতীয়তাবাদের মৌল উপাদান
কোনো দেশে এক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠার জন্য সেখানে পূর্ব থেকেই এক জাতীয়তা বর্তমান থাকা-আর তা না হলে তার অস্তিত্ব লাভের সম্ভাবনা বর্তমান থাকা-একান্তই আবশ্যক। কেননা যেখানে মূলতই জাতীয়তা বর্তমান নেই, সেখানে জনগণের মধ্যে জাতি পূজার ভাবধারা সৃষ্টি হওয়া সম্ভবপর নয়। জাতীয়তাবাদের অপর নাম-ই হচ্ছে জাতিপূজার ভাবধারা। মূল স্ফুলিঙ্গই যখন নেই, তখন তা থেকে আগুন জ্বলে উঠা কিরূপে সম্ভবপর হবে? কিন্তু জাতীয়তাবাদী ভাবধারার আগুন জ্বলে উঠার জন্য কি ধরণের জাতীয়তা বর্তমান থাকা আবশ্যক ?
এক প্রকারের জাতীয়তা হয় রাজনীতির দৃষ্টিতে, তাহলো রাজনৈতিক জাতীয়তা (Political Nationalism)। অর্থাত যারা একটিমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীন বসবাস করে তাদেরকে শুধু রাজনৈতিক ঐক্যের দিক দিয়ে ‘একজাতি’ মনে করা যেতে পারে। এ ধরণের জাতীয়তার জন্য তাকে শরীক সব মানুষের ভাবাবেগ, অনুভূতি, চিন্তা-বিশ্বাস, মতাদর্শ, তাদের নৈতিক মূল্যমান ও দৃষ্টিকোণ, তাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস, তাদের ভাষা, সাহিত্য ও জীবন যাপন পদ্ধতি এবং ধারার এক অভিন্ন হওয়া কিছুমাত্র জরূরী নয়। এসব দিক দিয়ে সেই লোকদের বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এক রাজনৈতিক জাতীয়তা বর্তমান রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। আর তারা যতোদিন রাজনৈতিক ও শাসনের দিক দিয়ে এক থাকবে এ জাতীয়তার আয়ুও ঠিক ততোদিন-ই টিকে থাকবে। কিন্তু তাদের বিভিন্ন সমাজ যদি বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধীও হয়ে যায়-এমনকি তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও জাতীয় প্রেরণাও যদি পরস্পর সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে এবং সেই কারণে পরস্পরের বিরুদ্ধে বাস্তব চেষ্টা চালানো হয়, তাহলেও তাদের রাজনৈতিক জাতীয়তা এক-ই থাকবে। এধরণের জাতীয়তাকে যদিও একটা জাতীয়তা নামে অভিহিত করা যায়; কিন্তু ঠিক একজাতীয়তা সৃষ্টির জন্য যে ভাবধারা ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক তা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত-ই মনে করতে হবে।
জাতীয়তার অপর একটি রকম হলো সাংস্কৃতিক জাতীয়তা (Cultural Nationalism) এ জাতীয়তা কেবলমাত্র সেই লোকদের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে, যাদের ধর্ম এক, চিন্তা ও মতাদর্শ, আবেগ-অনুভূতি, মূল্যবোধ এক, যাদের মধ্যে একই ধরণের নৈতিক গুণাবলী পাওয়া যাবে, যারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে একই ধরণের দরদ ও দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে এবং তার প্রভাবে জীবনের সাংস্কৃতিক ও সামষ্টিক ক্ষেত্রে একই ভাবধারা প্রকাশিত হবে। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, হারাম-হালাল ও পবিত্র-অপবিত্র প্রভৃতি নির্ধারণের মানদণ্ড একই রকম। এরা পরস্পরের অনুভূতি গভীরভাবে অনুধাবন করে, পরস্পরের স্বভাব-অভ্যাস, চরিত্র ও আগ্রহ-ঔৎসুক্যের সাথে সুপরিচিত। একজনের আনন্দে অন্যেরা আনন্দ এবং একজনের দুঃখ ও বিপদে অন্যেরা সমান দুঃখ ও বিপদ মনে করে। তাদের সমাজে রক্ত ও মনের সম্পর্ক ব্যাপক ও গভীরভাবে গড়ে উঠে। তারা একই প্রকারের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়। মোটকথা, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও সামষ্টিক দিক দিয়ে তারা একদল, একসমাজ এবং এক ও অবিভাজ্য সমাজে পরিণত হয়। লোকদের মধ্যে কেবলমাত্র এরূপ ভাবধারার দিক দিয়েই জাতীয় প্রেরণা ও উদ্বোধণ সৃষ্টি হতে পারে এবং এটাই হতে পারে জাতীয়তার ভিত্তি। কেবলমাত্র এ সমাজে একটা জাতীয় রূপ, ধরণ ও এক অভিন্ন জাতীয় আদর্শবাদ লালিত-পালিত ও ক্রমবিকশিত হতে পারে। এটাই উত্তরকালে একজাতীয়তা সৃষ্টি করে ও জাতীয়তার সমচেতনা (National self) জাগিয়ে তোলে। আঞ্চলিক বা দেশ-ভিত্তিক একজাতীয়তা এহেন ভাবধারার জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদে কিভাবে মুক্তি আসতে পারে ?
উল্লেখিত বিশ্লেষণ সামনে রেখে ভারতবর্ষের পরিস্থিতি যাচাই করলেই জাতীয়তাবাদের উল্লেখিত ভিত্তি এখানে বর্তমান আছে কি-না, তা নিশ্চিতরূপে বুঝতে পারা যাবে। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক জাতীয়তা নিশ্চয়ই বর্তমান রয়েছে, কারণ এ দেশের অধিবাসীগণ একই শাসনব্যবস্থার অধীন জীবন যাপন করছে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উপর একই প্রকার আইন চালু রয়েছে এবং তাদের সকলকেই একটি মাত্র লৌহশক্তি কঠিন বাঁধনে বন্দী করে রেখেছে। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, নিছক রাজনৈতিক জাতীয়তা, জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়। এরূপ জাতীয়তা অস্ট্রেলিয়া, হাঙ্গেরী, বৃটেন, আয়ারল্যাণ্ড এবং আরো অনেক সাম্রাজ্যেও বর্তমান ছিল। এখনো অনেক দেশে তা বর্তমান রয়েছে। কিন্তু তা কোনো দেশে ‘জাতীয়তাবাদের’ সৃষ্টি করেনি। স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে মিলিত হওয়া কিংবা দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসীবতে সমভাগী হওয়ার কারণেও জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করতে পারে। আর প্রত্যেক চাক্ষুষ্মান ব্যক্তিই এক দৃষ্টিতে বুঝতে পারে যে, ভারতবর্ষের অধিবাসীদের মধ্যে কোনো প্রকার সাংস্কৃতিক জাতীয়তার অস্তিত্ব আদৌ বর্তমান নেই।
প্রকৃত ব্যাপার যখন এটাই, তখন জাতীয়তাবাদের উল্লেখ করে লাভ কি ? যেখানে মা’র কোনো অস্তিত্ব নেই, সেখানে সন্তানের উল্লেখ নিবৃর্দ্ধিতা ভিন্ন আর কি হতে পারে! আর এতদসত্ত্বেও যারা এ দেশে জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছে, তাদের একথা ভাল করেই জেনে নেয়া আবশ্যক যে, সাংস্কৃতিক জাতীয়তার গর্ভেই এ ‘সন্তানে’র জন্ম হতে পারে। এবং তার জন্মের পূর্বে তার মায়ের জন্ম হওয়া একান্ত আবশ্যক। এ তত্ত্ব জেনে নেয়ার পর তাদের দাবী পরিবর্তন করা অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং ভারতবর্ষে এ জাতীয়তার নাম নেয়ার পূর্বেই তাদেরকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তা সৃষ্টির জন্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় ভারতীয় জাতীয়তার জন্ম কিছুতেই সম্ভব নয়।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কিরূপে সৃষ্টি হতে পারে ?
অতপর ভারতবর্ষে এক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা অত্যন্ত জরূরী।
বস্তুত যে দেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতীয়তা রয়েছে, তথায় এক জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মাত্র দুটি উপায়ই হতে পারে : এক : একজাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি অন্যান্য সকল জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতিকে গ্রাস করবে। অথবা দুই : সকলের পারস্পারিক নিবিড় মিলন ও সংমিশ্রণের সাহায্যে এক সর্বজাতীয় ও সম্মিলিত সভ্যতার সৃষ্টি করা হবে।
প্রথম উপায়টি সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা অনাবশ্যক। কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নেতৃবৃন্দ সেরূপ করাকে নিজেদের লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করেননি। তবে যারা ‘হিন্দু জাতীয়তা’ কিংবা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’১ সৃষ্টি করতে চান, তারা এ উপায় অবলম্বন করতে পারেন। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদীগণ কেবলমাত্র দ্বিতীয় উপায়ই অবলম্বন করতে পারেন। এজন্য এ দেশের বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে এক নবতর জাতীয়তা সৃষ্টির জন্য তারা প্রায়ই আলোচনা করে থাকেন। কিন্তু তাদের বালকোচিত কথাবার্তা শুনে মনে হয়, তারা সাংস্কৃতিক জাতীয়তার প্রকৃত অর্থ মাত্রই বুঝতে পারেননি। এই প্রকার জাতীয়তাসমূহের সংমিশ্রণ কোন্ নিয়মনীতি অনুসারে হতে পারে, সেই সম্পর্কেও তারা মাত্রই অবহিত নন। আর এরূপ সংমিশ্রণ সাধনের ফলে কোন ধরণের জাতীয়তা রূপ লাভ করতে পারে, সে বিষয়েও তাদের ধারণা নেই। এ কাজকে তারা ‘ছেলে খেলা’ মনে করেন, আর নিতান্ত ছেলেদের মতোই এ ক্রীড়া তারা খেলতে চান।
বস্তুত একটি জাতির বুদ্ধি, প্রকৃতি ও নৈতিক ব্যবস্থারই নাম হচ্ছে সাংস্কৃতিক জাতীয়তা। আর এরূপ জাতীয়তা এক-দুদিনে কখনই রূপ লাভ করতে পারে না। কয়েক শতাব্দীকাল ধরে ক্রমাগতভাবে তার বিকাশ ঘটে থাকে। কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত কিছুসংখ্যক লোক যখন বংশানুক্রমিকভাবে একই প্রকার ধারণা, বিশ্বাস, প্রথা ও রীতিনীতির অধীন জীবনযাপন করে, তখনি তাদের মধ্যে এক মিলিত ও সর্বসম্মত ভাবধারার সৃষ্টি হয়, সম্মিলিত নৈতিক গুণাগুণ সুদৃঢ় হয়, এক বিশিষ্ট বৃদ্ধি-প্রকৃতি গড়ে উঠে। যেসব ঐতিহ্যের সাথে তাদের মনের আবেগ-উচ্ছাস (sentiments) সংযোজিত থাকে, তাই অত্যন্ত গভীর হয়ে বসে। তাদের মন ও মস্তিষ্কের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবধারা ফুটে ওঠে তাদের সাহিত্যে। তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও মানসিক ঐক্যরূপে গড়ে উঠে। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পারিক বন্ধুতা ও সমঝোতার (Mutual Intelligibility) সৃষ্টি হয়। এসব গভীর ও সুদৃঢ় প্রভাবের দরুন যখন কোনো দলে স্বতন্ত্র জাতীয়তা গড়ে ওঠে- অন্যথায় তার নৈতিক ও বুদ্ধিগত প্রকৃতি যখন সুদৃঢ় হয়, তখন অন্য কোনো দলের সাথে সংমিশ্রিত হয়ে অন্য কোনো জাতীয়তায় রূপান্তরিত হওয়া তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এ দল শত শত বছর কাল পর্যন্ত একই আবহাওয়ায়, পরিবেশে ও একই ভূ-খণ্ডে পাশাপাশি বসবাস করে; কিন্তু তবুও এদের কোনোরূপ সংমিশ্রণের সৃষ্টি হয় না। ইউরোপে জার্মান, মগিয়ার, পোল, চেক, ইহুদী, সালাফী এবং এ প্রকারের অন্যান্য অনেক জাতি দীর্ঘকাল ধরে একই স্থানে জীবন যাপন করছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনো প্রকার মিলন সৃষ্টি হয়নি। ইংরেজ ও আইরিশ যুগ-যুগান্তকাল একই সাথে বসবাস করছে; কিন্তু মধ্যে তাদের কোনো প্রকার মিলন সৃষ্টি হয়নি। কোনো কোনো দেশে এ প্রকার জাতিসমূহের ভাষা এক হলেও তাদের মন ও হৃদয়ে কোনো দিক দিয়েই সাদৃশ্যের সৃষ্টি হয়নি। শব্দ এক হতে পারে, কিন্তু তা প্রত্যেক জাতির হৃদয়-মনে স্বতন্ত্র ভাবধারা ও মতবাদের প্রবাহ জাগায় যা সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের নৈতিক বিধান ও বুদ্ধি-প্রকৃতির মধ্যে যদি বিরাট কোনো পার্থক্য না থাকে, বরং তা যদি পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্র বিশিষ্ট্য হয়, তবে তখনই একত্রে বসবাস ও দীর্ঘকাল পর্যন্ত পারস্পারিক সংমিশ্রণের ফলে এ ধরণের দলগুলোর পরস্পর মিলিত একটি খাঁটি, পরিপূর্ণ ও যুক্ত জাতীয়তার সৃষ্টি করা সম্ভব। এ অবস্থায় তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা নিঃশেষে মিলে যায়। তখন এক সর্বদলীয় নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু এ কাজ নিমেষ মাত্র সময়ের মধ্যে হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। দীর্ঘকাল ধরে বহু ভাঙা-গড়া ও ঘাত-প্রতিঘাতের পরই বিভিন্ন অংশের পরস্পর মিলিত হওয়ার ফলে এক স্বতন্ত্র প্রকৃতি জেগে ওঠে। ইংল্যাণ্ডে ব্রাইটন, হেকসন ও নারীমণ্ডী জাতিসমূহের এক জাতিতে পরিণত হতে শত শত বছর অতিবাহিত হয়েছে। ফ্রান্সে দশ শতাব্দী থেকে এ কাজ চলছে। কিন্তু এখনও জাতীয়তার উৎসমূলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। যেসব বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে ইটালীয় জাতীয়তার রূপায়ন হয়েছে, নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে তারা পরস্পর বিরোধী না হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তথায় জাতীয় ভাবধারার সৃষ্টি হতে পারেনি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কেবল তাদের নিয়েই ‘একজাতি’ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে, যারা প্রায় সকল দিক দিয়েই সামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্র সম্পন্ন এবং যারা স্বার্থের সামান্য দ্বন্দ্ব পরিহার করে অনতিবিলম্বে ‘একজাতি’ হতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এ কাজ সম্পন্ন হতে দু-তিন শতাব্দীকাল অতীত হয়েছে।
একই প্রকার চরিত্র সমন্বিত জাতিসমূহের সংমিশ্রণে একটি বিশিষ্ট ও উৎকৃষ্ট জাতীয়তার সৃষ্টি কেবল এজন্যই সম্ভব হয়ে থাকে যে, এ সংমিশ্রণ কার্য সম্পন্ন করার সময় তাদেরকে নিজেদের মতবাদ, বিশ্বাস ও নৈতিক মানদণ্ড পরিহার করা এবং নিজেদের উচ্চ ও উন্নত নৈতিক গুণাবলীর মূলোৎপাটন করার কোনোই আবশ্যক হয় না। বরং এসব জিনিসই তাদের মধ্যে বহু পূর্ব থেকেই বর্তমান থাকে। কেবল ঐতিহ্য-ইতিহাসের রদ-বদল এবং আবেগ, উচ্ছাস, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পুনঃ প্রতিষ্ঠা (Readjustment) দ্বারাই তাদের এ নবতম জাতীয়তা স্থাপিত হতে পারে। পক্ষান্তরে, যেখানে বিভিন্ন প্রকার নৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট জাতিসমূহের মধ্যে কোনো প্রকার কৃত্রিম চাপ, কোনো প্রকার অস্বাভাবিক প্রচেষ্টা এবং কোনো সাধারণ কারণে এ সংমিশ্রণ সাধিত হয়, সেখানে সর্বাপেক্ষা হীন ও নিকৃষ্ট জাতীয়তাই গড়ে ওঠে। কারণ, এমতাবস্থায় তাদের মতবাদের ভিত্তিমূল শিথিল হয়ে যায়। তাদের উন্নত নৈতিক চরিত্র-যার স্বাতন্ত্রমূলক বৈশিষ্ট্যের দরুন আজ পর্যন্ত সংমিশ্রণ হয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায়। তাদের জাতীয় সত্তার অনুভূতি-যার ভিত্তিতে তার জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-খতম হয়ে যায়। তাদের প্রত্যেক জাতিই নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতার মানদণ্ড পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের নতুন জাতীয়তা তাদের প্রত্যেকেরই নৈতিক পংকিলতার একটি সমষ্টিতে পরিণত হয়। এ ধরণের সংমিশ্রণে সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের নৈতিক চরিত্রের মেরুদণ্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। অতপর নবতর নৈতিক চরিত্র গড়ে উঠতে দীর্ঘ সময়ের আবশ্যক হয়। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে তাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়, নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি হওয়ার জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়। নিজ নিজ জাতীয় ধরণকে তারা নিজেরাই চুরমার করে-কিন্তু নতুন জাতীয় ধরণ তৈরি করতে বহুকাল অবকাশের আবশ্যক হয়।
যারা এরূপ মারাত্মক পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত হবে, তাদের প্রকৃতি কখনই মযবুত হতে পারে না, তারা হবে হীন চরিত্র, সংকীর্ণমনা, উদ্দীপনাহীন ও নীতিহীন। যে পবিত্র বৃন্তচ্যুত হয়ে মাটিতে ঝরে পড়েছে, তার যেমন কোনোরূপ স্থিতি নেই-বায়ুর প্রত্যেকটি প্রবাহে তা একস্থান থেকে অন্য স্থানে গড়াতে থাকে, ঐসব জাতির প্রকৃত অবস্থা সেরূপই হয়ে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে বিভিন্ন চরিত্র বৈশিষ্ট্য জাতিসমূহের পারস্পারিক সংমিশ্রণের পরিণতি যারা দেখেছে, তারা প্রত্যেকেই একবাক্যে সাক্ষ্য দেয় যে, এর ফলে সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের নৈতিক সৌন্দর্য একেবারেই খতম হয়ে গেছে এবং এর দরুন সেই দেশের অধঃস্তন পুরুষ জ্ঞান-বুদ্ধি, নৈতিক চরিত্র ও দেহ-সংস্থার দিক দিয়ে একেবারে নিকৃষ্ট হয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক স্বার্থপরতার উর্ধ্বে থেকে প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে স্বাধীন মত প্রকাশে সমক্ষ কোনো ব্যক্তিই পাক-ভারতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতিসমূহকে সামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্র বিশিষ্ট বলে মনে করতে পারে না। কারণ, ইউরোপের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতীয়তার মধ্যে যতোখানি বৈষম্য রয়েছে, পাক-ভারতের বর্তমান জাতিসমূহের মধ্যে বিশ্বাসের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে উদয়-তোরণ ও অস্ত-গগনের দূরত্ব রয়েছে। এদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলনীতিসমূহ পরস্পর বিরোধী, ঐতিহ্যসমূহের উৎসমূল সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন। অভ্যন্তরীণ হৃদয়াবেগ ও ভাবধারা পরস্পর বিরোধী। একটি জাতির জাতীয় ধরণের সাথে অন্য জাতির জাতীয় ধরণের বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য নেই। নিছক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য এ বিভিন্ন জাতীয়তাকে নির্মূল করে একটি যুক্ত জাতীয়তা সৃষ্টি করার পরিণাম পূর্ব বর্ণিত কারণে মারাত্মক হবে। দুর্ভাগ্যবশত দেড় শতাব্দী কালের বৃটিশ প্রভুত্ব ভারতের জাতিসমূহকে পূর্ব থেকেই নৈতিক চরিত্রহীনতার গভীরতর পংকে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। দাসত্বের খুন তাদের মনুষ্যত্ববোধকে অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে। তাদের নৈতিক চরিত্রের ভয়ানক পতন ঘটেছে। অধঃস্তন পুরুষের মধ্যে এ মারাত্মক পতন সর্বগ্রাসী কুফল এনে দিয়েছে। এ সংকট মুহূর্তে নতুন জাতিগঠনের কাজ শুরু করার জন্য তাদের ধ্বংসাবশিষ্ট সংস্কৃতির ভিত্তিতে আঘাত হানলে সমগ্র দেশের নৈতিক-বাঁধন আকস্মিকভাবে ছিন্নভিন্ন হবে এবং তার পরিণাম খুবই ভয়াবহ!
পাক-ভারতের কোনো কল্যাণকামীই কি একজাতীয়তা সমর্থন করতে পারে ?
এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে, বৈদেশিক শক্তির গোলামীর নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ করার জন্য এ দেশে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। আর জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির প্রয়োজন একজাতীয়তা। কাজেই বর্তমানের সকল জাতীয়তাকে নির্মূল করে এক সর্বদলীয় জাতীয়তা গঠন করা আবশ্যক। অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের এ চিন্তা একেবারেই অমূলক। তাদের মধ্যে যদি নির্ভূল অর্ন্তদৃষ্টি বর্তমান থাকতো এবং পাশ্চাত্যেও মানসিক গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে যদি তারা চিন্তা করতে চেষ্টা করতেন, তবে তারা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারতেন যে, একজাতীয়তার পথে পাক-ভারতের বিন্দুমাত্র মুক্তি নেই-আছে মারাত্মক ধ্বংস ও বিলুপ্তি।
প্রথমত, এ পথে জাতীয়তা লাভ করতে দীর্ঘকাল সময় লাগবে। শত-সহস্র বছরের ঐতিহ্যের ভিত্তিতে যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তা গড়ে উঠেছে, তা নির্মূল করে তদস্থলে এক নবতর জাতীয়তা গড়ে তোলা এবং এ নতুন জাতীয়তা মযবুত ও সক্রিয় হয়ে এক জাতীয়তা পর্যন্ত উপনীত হওয়া মাত্রই সহজসাধ্য নয়। সে জন্য দীর্ঘকালের দরকার হবে। দ্বিতীয়ত এ পথে জাতীয়তা লাভ হলেও শেষ পর্যন্ত সমগ্র দেশের চরম নৈতিক চরিত্রহীনতা নিম্নতম পংকে নিমজ্জিত হওয়ার নিশ্চিত আশংকা রয়েছে। তৃতীয়ত যেসব জাতি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার পক্ষপাতী, তারা এ ধরণের একজাতীয়তা সৃষ্টির বিরুদ্ধে প্রাণপন চেষ্টা করবে এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে আযাদী যুদ্ধের জন্য কোনো যুক্ত প্রচেষ্টা গড়ে ওঠা সম্ভব হবে না। ফলে বৈদেশিক শাসন-নিগড় থেকে মুক্তিলাভও সুদূরপরাহত হবে। এমনকি, এ পথে চেষ্টা করলে রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরতরে ম্লান হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
কাজেই পাশ্চাত্য জাতিদের অনুকরণে যারা জাতীয়তাবাদকেই স্বাধীনতা লাভের একমাত্র অস্ত্র বলে মনে করে, আমার মতে-তারা নির্বোধ ও অজ্ঞ। আমি পূর্বেও বলেছি, এখনো বলছি : ভারতের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভের জন্য বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের মূলত-ই কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। যে দেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতীয়তা বর্তমান রয়েছে, সেখানে একজাতীয়তার জন্য চেষ্টা করা কেবল বাহুল্য মাত্রই নয়, নীতি হিসাবে তা মারাত্মক ভুলও বটে। উপরন্তু পরিণামের দিক দিয়ে তা কিছুমাত্র কল্যাণকর না হয়ে বিরাট অকল্যাণেরই সৃষ্টি করবে, সন্দেহ নেই।
ফিরিংগী পোশাক
মাওলানা সিন্ধী ভাষণের শেষাংষে মুসলমানদেরকে হাফপ্যান্ট, কোট-পাতলুন ও হ্যাট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। এ আলোচনার শেষভাগে আমি এ সম্পর্কেও আলোচনা করতে চাই।
প্রাচ্যের এ জাতীয়তাবাদীরা এক আশ্চর্য ধরণের জীব। একদিকে তারা জাতীয়তাবাদের প্রবল প্রচার চালাচ্ছে, অন্যদিকে ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন দেশের পোশাক ও তামাদ্দুনিক রীতিনীতি গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করছে না। শুধু তাই নয়, ভিন্ন জাতির পোশাক ও তামাদ্দুনিক রীতিনীতিকে নিজেদের জাতির মধ্যে প্রচলিত করার উদ্দেশ্যে তাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক অনিবার্য কার্যসূচী হিসেবেই গ্রহণ করার জন্যও তারা চেষ্টা করছে। এমনকি, যেখানে শক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব, সেখানে বলপূর্বক এটা দেশবাসীর মাথার ওপর চাপাতে চেষ্টা করছে। ভারতবর্ষ, ইরান, মিশর, তুরস্ক-সর্বত্রই জাতীয়তাবাদীদের এ একই অবস্থা। অথচ জাতীয়তাবাদ-এ শব্দে জাতীয় সম্মানবোধের ভাব কিছুমাত্রও যতি বর্তমান থেকে থাকে, তবে প্রত্যেক জাতিরই নিজ জাতীয় পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সভ্যতা তামাদ্দুনের ওপর সুদৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ও তাতেই আত্মমর্যাদা অনুভব করা এবং তা নিয়ে গৌরব করাই কর্তব্য। আর যেখানে জাতীয় সত্তার বিন্দুমাত্র অনুভূতি বর্তমান নেই সেখানে জাতীয়তাবাদ সুস্পষ্টরূপে পরস্পর বিরোধী। কিন্তু আমাদের প্রাচ্য দেশীয় জাতীয়তা-বাদীগণ এ পরস্পর বিরোধী ভাবধারার সংমিশ্রণ সাধনে সিদ্ধহস্ত। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, চিন্তা ও কাজের বৈষম্য ও বিরোধ থেকে বাঁচার জন্য অনাবিল সুস্থ মানসিকতা এবং সংস্কারমুক্ত উদার উচ্চ দৃষ্টি আবশ্যক। আর এটাই যদি কেউ লাভ করতে পারে, তবে প্রকৃতির সহজ-সরল পথ পরিত্যাগ করে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তাই তার হবে না।
সর্বপরি তাদের এ নীতির প্রতি ইসলামের বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সহজ-সরল, ঋজু, আড়ম্বরহীন অকৃত্রিম পন্থারই নাম হচ্ছে ইসলাম। জাতীয়তার সীমালংঘনকারী বাড়াবাড়ি যেমন ইসলামের মনঃপূত নয়, তেমনি জাতীয়তার সংগত ও স্বাভাবিক সীমাভংগকারী, জাতিসমূহের স্বাতন্ত্র (Individuality) ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ নিশ্চিহ্নকারী এবং তাদের মধ্যে পংকিল কলুষ চরিত্র সৃষ্টিকারী কোনো জিনিসকেও ইসলাম মাত্রই বরদাশত করতে পারে না।
কুরআন শরীফ ঘোষণা করেছে : মানুষ যদিও একই মূল থেকে উদ্ভুত, কিন্তু তবুও আল্লাহ তা’য়ালা তাদের মধ্যে মাত্র দু’প্রকারের পার্থক্য সৃষ্টি করার অবকাশ রেখেছেন। প্রথম স্ত্রী ও পুরুষের পার্থক্য এবং দ্বিতীয় বংশ, গোত্র ও জাতীয়তার পার্থক্য। يَايُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقنَاكُمْ من ذَكَرٍ وَّاُنْثَى وَجَعَلناكُم شُعُوْبًا وَّقَابَائــــلَ لِتَعَارِفُوا ط – (الحجرات : ১৩) “হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে একই স্ত্রী-পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করে দিয়েছি-শুধু এজন্য যে, যেন তোমরা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পারো।” -সূরা আল হুজুরাত : ১৩ وَاِنَّهً خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالاُنْثَى – (النجم : ৪৫) “এবং আল্লাহ তা’য়ালা পুরুষ ও স্ত্রী এ দুটি লিঙ্গ বিশিষ্ট্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন।” -সূরা আন নাজম : ৪৫
বস্তুত এ উভয় প্রকার পার্থক্য সৃষ্টিই মানব সভ্যতা ও সামাজিক জীবন ধারার মূলভিত্তি। অতএব একে যথযথভাবে বজায় রাখায় হলো আল্লাহর সৃষ্ট বিশ্বপ্রকৃতির স্বাভাবিক দাবী। স্ত্রী ও পুরুষের পারস্পারিক মনের টান ও আকর্ষণ-শক্তি জাগ্রত করার জন্যই এদের মধ্যে লিঙ্গগত পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই সমাজ ও বিশাল তামাদ্দুনের ক্ষেত্রে উভয়েরই স্বাভাবিক গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংরক্ষিত হওয়া একান্তই অপরিহার্য। অপরদিকে মানুষের পরস্পরের মধ্যে তামাদ্দুনিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা সৃষ্টির জন্য তাদের এক একটি সামাজিক পরিবেষ্টনী ও ক্ষেত্র তৈরি অত্যন্ত আবশ্যকীয় বিধায় জাতিসমূহের পারস্পারিক পার্থক্য রা করা দরকার। এজন্যই প্রত্যেক মানব দল বা সমাজ ও তামাদ্দুনিক পরিবেষ্টনীর কিছু না কিছু পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ হওয়া অপরিহার্য। এর ফলে একই ভালবাসার সৃষ্টি হতে পারবে, পরস্পরকে অনুধাবন করতে পারবে। আর অন্যান্য পরিবেষ্টনীর মানুষ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রা করতে পারেব। অতএব এতে আর কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না যে, ভাষা, পোশাক, জীবন যাত্রার ধারা ও তামাদ্দুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পার্থক্য দরকারী উপাদান। এদের যথাযথ সংরক্ষণ প্রকৃত স্বভাব-নীতিরই দাবী।
ঠিক এ কারণেই ইসলামে ‘তাশাব্বুহ’ (تَشَبُّه অর্থাৎ পরের সাথে নিজেকে পুরোপুরি মিলিয়ে দেয়া বা নিজেকে অপরের বাহ্যিক বেশে সজ্জিত করা)-কে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে : পুরুষের পোশাক পরিধানকারিণী স্ত্রীলোক এবং স্ত্রীলোকের পোশাক পরিধানকারী পুরুষের ওপর নবী করীম (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। অপর একটি হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে : স্ত্রীলোকের বেশ ধারণকারী পুরুষদেরকে এবং পুরুষদের বেশ ধারণকারিণী স্ত্রীলোকদেরেক নবী করীম (সা.) অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করেছেন। এর একমাত্র কারণ এই যে, স্ত্রী ও পুরুষের পরস্পরের মধ্যে আল্লাহ তা’য়ালা মনের যে টান ও আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন, পরস্পরের বেশ পরিবর্তনের ফলে অনিবার্যরূপে তা নিভে যায়। আর ইসলাম তা স্বয়ং মানবতার সংরক্ষণের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অনুরূপভাবে জাতিসমূহের পারস্পারিক পোশাক, তামাদ্দুন ও প্রধান লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্যসমূহ নিশ্চিহ্ন করা বা পরস্পর অদল-বদল করে কোনো মিশ্র সংস্কৃতি সৃষ্টি করা সামাজিক শান্তি, স্থৈর্য, স্বার্থ ও কল্যাণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এজন্যই ইসলামও তার বিরোধীতা করে। জাতীয় স্বকীয়তাকে তার স্বাভাবিক সীমালংঘন করে জাতীয়তাবাদ বা জাতি পূজায় পরিণত করলেই ইসলাম তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। কারণ, তার ফলেই জাহেলী অহমিকা, অত্যাচারমূলক হিংসা-দ্বেষ ও সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইসলামের শত্রুতা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ (Nationalism) বা জাতিপূজার বিরুদ্ধে-জাতীয়তার (Nationality) বিরুদ্ধে নয়। ইসলাম জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে জাতীয়তাকে রক্ষা করতে চায় এবং তাকে ধ্বংস করার ততোদূরই বিরোধীতা করে, যতোদূর বিরোধীতা করে তার স্বাভাবিক সীমালংঘন করে যাওয়া। এজন্য ইসলাম যে মধ্যম ও ভারসাম্যমূলক পন্থা গ্রহণ করেছে, তা অনুধাবন করার জন্য নিম্মলিখিত নির্দেশসমূহ লক্ষণীয়:
এক : একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, স্বজাতি পূজা বা জাতি-বিদ্বেষ কাকে বলে? নিজ জাতিকে ভালবাসাও কি জাতি বিদ্বেষ? উত্তরে নবী করীম (সা.) বললেন-‘না, জুলুমের কাজেও নিজ জাতির সহযোগিতা করার নামই হচ্ছে স্বজাতি পূজা। -ইবনে মাজাহ্
দুই : রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি যে জাতির বেশ ধারণ করবে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। -আবু দাউদ।
তিন : হযরত ওমর ফারুক (রা.) আজারবাইজানের গভর্ণর উতবা বিন ফরকদকে লিখেছিলেন : “সাধারণ মুশরিক (অর্থাত আজারবাইজানের অধিবাসীদের) পোশাক পরিধান করবে না। -কিতাবুল লিবাস ওয়ায যীনাহ
চার : হযরত ওমর (রা.) রাজ্যের সমস্ত অমুসলিম অধিবাসীকে আরবদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও বেশ-ভূষা গ্রহণ থেকে বিরত রাখার জন্য তার সকল গভর্ণরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি, কোনো কোনো এলাকার বাসিন্দাদের সাথে সন্ধি করার সময় “তোমরা আমাদের পোশাক পরিধান করবে না” বলে একটি স্বতন্ত্র শর্তই যথারীতি চুক্তিপত্রে লিখিত হতো। -কিতাবুল খারাজ : ইমাম আবু ইফসুফ।
পাঁচ : যেসব আরববাসী সামরিক কি রাষ্ট্রীয় কার্যোপলক্ষে ইরাক ইরান প্রভৃতি দেশে মোতায়েন ছিলেন, হযরত ওমর (রা.) ও হযরত আলী (রা.) তাদেরকে নিজেদের ভাষা ও কথা বলার ভাব-ভঙ্গী সংরক্ষণ করতে এবং অনারবের ভাষা ও ভঙ্গী গ্রহণ না করতে বারবার নির্দেশ পাঠাতেন। -বায়হাকী
এ নির্দেশ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম যে ধরণের আন্তর্জাতিক ধারক, তা জাতিসমূহের স্বকীয় পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিশ্চিহ্ন করে একটি জগাখিচুড়ী সৃষ্টির পক্ষপাতি নয়। বরং তা জাতিসমূহকে তাদের জাতীয়তা ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সহকারে স্থায়ী রেখে তাদের মধ্যে সভ্যতা, কৃষ্টি, সৌজন্য, নৈতিক-চরিত্র ও মতবাদ-চিন্তাধারার এমন একটি সুদৃঢ় বন্ধনের সৃষ্টি করতে চায়, যার দরুন আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম, টানাহেচড়া, স্নায়ুযুদ্ধ, প্রতিবন্ধকতা, অত্যাচার ও হিংসা-দ্বেষ দূর হয়ে যাবে এবং তাদের মধ্যে পরস্পর সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের নির্মল ভাবধারা পরিস্ফুটিত হবে। ‘তাশাব্বুহ’ বা পরানুকরণের আরো একটি দিক রয়েছে, যে জন্য ইসলাম তার প্রচণ্ড বিরোধী। একটি জাতি নিজ জাতীয় বৈশিষ্ট্য কেবল তখতি ত্যাগ করতে পারে, যখন তাদের মধ্যে কোনো মানসিক দুর্বলতা ও নৈতিক শিথিলতা দেখা দেয়। পরের প্রভাবে যে ব্যক্তি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করে এবং পরের রঙে নিজেকে রঞ্জিত করে, তার মধ্যে নীচতা-হীনতা, বহুরূপী ভাব, খুব শীঘ্র প্রভাবিত হওয়ার দুর্বলতা ও দায়িত্বহীন কার্যকলাপের মারাত্মক রোগ অনিবার্যরূপে বর্তমান থাকবেই; আর সাথে সাথেই এ রোগের চিকিৎসা করা না হলেই তা বৃদ্ধি পাবে ও সংক্রমিত হবে। আর বহু সংখ্যক লোকের মধ্যে এ রোগ সংক্রমিত হলে গোটা জাতিই মানসিক দুর্বলতায় নিমজ্জিত হবে। তার নৈতিক চরিত্রে দৃঢ়তা ও বীর্যবত্তা বলতে কিছুই থাকবে না। তার মনের ওপর নৈতিক চরিত্রের কোনো সুদৃঢ় ভিত্তিই স্থাপিত হতে পারবে না। কাজেই ইসলাম কোনো জাতিকেই নিজের মধ্যে এরূপ মানসিক দুর্বলতা সৃষ্টি করার অনুমতি দেয়নি। কেবল মুসলমানদেরই নয়, তার ক্ষমতায় হলে অমুসলমানদেরও এ মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। কারণ ইসলাম কোনো মানুষের মধ্যেই নৈতিক দুর্বলতা দেখতে মাত্রই প্রস্তুত নয়।
বিশেষ করে বিজিত ও অধিকৃত লোকদের মধ্যে এ রোগ খুব তীব্র হয়ে দেখা দিয়ে থাকে। কেবল নৈতিক দুর্বলতাই নয়, তাদের মধ্যে এমন মারত্মক মনোভাবও দেখা দেয়, যার ফলে তারা নিজেদেরকেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত বলে মনে করতে থাকে, সকল দিক দিয়েই নিজেদেরকে হীন ধারণা করতে থাকে, সকল দিক দিয়েই নিজেদেরকে হীন ধারণা করতে শুরু করে এবং শাসকগোষ্ঠীর অন্ধ অনুকরণ করেই সম্মান ও মান-মর্যাদা লাভ করতে চায়। কারণ, ইয্যত,মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, শরাফত, সভ্যতা-সংস্কৃতি-প্রত্যেকটিরই আদর্শ নমুনা তারা তাদের শাসকদের মধ্যেই দেখতে পায়। দাসত্ব তাদের মনুষ্যত্বকেই ধ্বংস করে, অতপর অপমান, লাঞ্ছনা, হীনতা ও নীচতার শরীরি বিজ্ঞাপন থেকেও তাদের বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ হয় না; বরং তাতে লজ্জার পরিবর্তে গৌরবই বোধ করে। ইসলাম মানুষকে সকল প্রকার নীচতা-হীনতার গভীর পংক থেকে উদ্ধার করে মনুষত্বের উচ্চতম শিখরে নিয়ে যেতে চায়; কাজেই কোনো মানবগোষ্ঠীকেই তা অধঃপতনের দিকে ধাবিত হতে দেখতে মাত্রই প্রস্তুত নয়। হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকালে বহু অনারব জাতি যখন ইসলামী হুকুমাতের অধীন হতে লাগলো, তখন তিনি তাদেরকে আরবদের অনুকরণ করতে তীব্রভাবে নিষেধ করে দিলেন। এ জাতিগুলোর মধ্যে দাসত্বসূলভ মনোবৃত্তি জাগ্রত হলে ইসলামী জিহাদের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যেতো। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জাতিসমূহের মনিব-প্রভূ সাজার জন্য আরবদের হাতে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেননি।
এসব কারণেই একটি জাতির অন্য জাতির হুবহু নকল করে চলার এবং তার পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনযাপন পদ্ধতি অনুকরণ করার প্রচেষ্টাকে ইসলাম মাত্রই সমর্থন করেনি। তবে তাহযীব-তামাদ্দুনের পারস্পারিক লেনদেনের-পারস্পারিক সম্পর্ক-সংশ্রব রাখার দরুন বিভিন্ন জাতির মধ্যে যা হওয়া অনিবার্য-ইসলাম মাত্রই তার বিরোধী নয়-বরং এর উৎকর্ষ সাধনই তার লক্ষ্য। নিজেদের তামাদ্দুনের মধ্যে অন্য জাতির কিছুই গ্রহণ করবো না-এরূপ হিংসা-বিদ্বেষভাব সৃষ্টি করে জাতিসমূহের পরস্পরের মধ্যে বিরাট প্রাচীর খাড়া করা ইসলামের অভিপ্রেত নয়। নবী করীম (সা.) সিরিয়া দেশের ‘জুব্বা’ (Overcoat) পরিধান করেছেন-অথচ তা ইহুদীদের পোশাকের একটি অংশ। হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে : فَتَوَضَّأَ وَعَلَيْهِ جُبُّةٌ شِامِيَةٌ “নবী করীম (সা.) অযু করলেন এবং তাঁর গায়ে সিরিয়া দেশের একটি জুব্বা ছিল।” তিনি সংকীর্ণ হাতাওয়ালা রোম দেশীয় জুব্বাও ব্যবহার করেছেন। অথচ এটা রোমান ক্যাথলিক খৃস্টানরাই পরতো। নওশেরাওয়ানী ‘ক্বাবাও’ তিনি ব্যবহার করেছেন। হাদীসে তা جُبُّةٌ طَيَا لَسَةٍ كِسْرَوانِيَةٌ নামে উল্লেখ হয়েছে। হযরত ওমর (রা.) ‘ব্রবুরনুস’ নামী এক প্রকার উচু টুপী পরিধান করেছেন-এটা খৃস্টান দরবেশের পোশাকেরই একটি অংশ ছিল। এ থেকে অকাট্যরূপে প্রমাণিত হয় যে, এ ধরণের বিভিন্ন বংশগত পোশাক ব্যবহার করলে তাতে ‘তাশাব্বুহ’ হয় না। মূলত ব্যক্তির সমগ্র বেশভূষা ভিন্ন জাতির অনুরূপ হলেই এবং তাকে দেখে তার জাতীয়তা সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা করা কঠিন হলেই তখন ‘তাশাব্বুহ’ হয় এবং তা-ই ইসলামে নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে পারস্পারিক লেনদেন সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। একটি জাতি অন্য জাতির কোনো ভাল কিংবা অবস্থানুকূল ‘জিনিস’ নিয়ে নিজের বেশভূষার মধ্যে গণ্য করলে তাতে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। কারণ তাতে তার জাতীয় বেশভূষা সমষ্টিগতভাবেই বর্তমান থাকে। -তরজামানুল কুরআন : ১৯৩৯ ইং