ইসলামের মিলনবাণী
(এটা গ্রন্থকারের একটি বক্তৃতা)
মুসলিম জনসাধারণ যেখানে পরস্পর মিলিত হয়- এক আল্লাহর আদেশানুগামী ও এক রাসূলের উম্মাত হওয়ার কারণে যেখানে সমবেত হয়, সে স্থানের দৃশ্য যে কত মনোরম ও চিত্তাকর্ষক হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালাও এ প্রকারের দৃশ্য খুবই পছন্দ করে থাকেনঃ
اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِيْنَ يقاتلون فى سبيله صَفُّا كانَّهُم بُنْيَانٌ مَّرْصُوْصٌ – (الصَّف : ৪)
“আল্লাহর পথে যারা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সূদৃঢ়ভাবে সারিবদ্ধ হয়ে জিহাদ করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।” -সূরা আস্ সফঃ ৪
আল্লাহর ভালবাসা কেবল যুদ্ধের জন্যে সারিবদ্ধ হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সালাতে আল্লাহর ইবাদতের জন্যে সারিবদ্ধ হলেও আলাহর ভালবাসা লাভ করা যেতে পারে। এজন্যেই আলাহ তা’য়ালা সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেনঃ
اذا نُودى للصَّلوة من يَّومِ الجُمُعَةِ فاسعَوا الى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا البَيْعَ ط – (الجمعة : ৯)
“জুমুয়ার দিন সালাতের জন্যে ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই তোমরা কাজকর্ম ও ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ করে আল্লাহর স্মরণ-সালাতের জন্যে দ্রুত অগ্রসর হও।”-সূরা জুমুআঃ ৯
এখানেই শেষ নয়, সুদূর প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের সীমান্ত পর্যন্ত মুসলমানদের যে অখণ্ড সংহতি বিদ্যমান, এটাও আলাহরই অপার অনুগ্রহের সুস্পষ্ট নিদর্শন সন্দেহ নেই।
আল্লাহ তা’য়ালা নিজেই বলেছেনঃ وَاذكُرُوا نِعمِةَ اللهِ عليكم اِذ كنتم اعداءً فَالَّفَ بَيْنَ قُلُبِكم فَاصْبحتُم بِنِِعمته اِخْوَانَا ج وَكنتم على شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَانْقَذَكم مِنْهَا ط – (ال عِمران : ১০৩)
“তোমাদের উপর আলাহর অপার অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর-তোমরা যখন পরস্পরের শত্রু“তায় লিপ্ত হয়েছিলে, আলাহ তখন তোমাদের হৃদয়ে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ফলে তোমরা পরস্পরের ভাই হয়েছিলে। মূলত তোমরা এক অগ্নি গহ্বরের তীরে অবস্থিত ছিলে, আল্লাহ তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন।”-সূরা আলে ইমরানঃ ১০৩
মুসলমানদেরকে একটি সুদৃঢ় প্রাচীরের ন্যায় অখণ্ড সত্তা হিসাবে কিরূপে গঠন করা যেতে পারে, তা বিশেষভাবে ভাবার বিষয়। মুসলমানদের প্রত্যেক ব্যক্তির সত্তা সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের দেহ স্বতন্ত্র, স্বতন্ত্র তার জীবন-প্রাণ। নিজস্ব স্বভাব প্রকৃতির দিক দিয়েও কারো সাথে কারো সামঞ্জস্য নেই। প্রত্যেকের চিন্তাধারা ও মানসিকতা পরস্পর বিভিন্ন। কিন্তু এক বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও মুসলমানদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিগণকে একটি মাত্র সম্পর্কের বাঁধন পরস্পরকে নিকটতর এবং গভীর বন্ধনে বেঁধে দিয়েছে। এ সম্পর্ক তাদেরকে কখনো মসজিদে সমবেত করে-যেখানে ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকলে একই কাতারে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে দণ্ডায়মান হয়। এ সম্পর্কই কোনো এক সময় মুসলমানদেরকে যুদ্ধের ময়দান সমবেত করে দেয়-যেখানে তারা একটি মাত্র মূল লক্ষ্য ও কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য লাভ করার জন্যে পরস্পর মিলিত হয়ে সাধনা করে-সংগ্রাম করে। এ সম্পর্কের দরুন তাদের পরস্পরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। এরই কারণে মুসলমানদের পরস্পরকে পরস্পরের প্রতি দরদী ও সহানুভূতিশীল করে দেয় এবং এটাই তাদেরকে অন্যান্য জাতি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করে। কিন্তু এটা কোনো জড় ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নয়, বস্তুত এটা একটি ‘বাণী’ (কালেমা) মাত্র। এ বাণী অসংখ্য মানুষকে একই সূত্রে গ্রথিত করে বলেই অমি একে মিলন বাণী বলে অভিহিত করেছি।
বলা বাহুল্য, এখানে বানী কতকগুলো শব্দকেই বুঝায় না। অর্থ ও অন্তর্নিহিত ভাবধারাই লক্ষ্যণীয়। মতবাদ ও চিন্তাধার শদ্বের পোশাক পরিধান করে যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন তাকেও বাণী বলা হয়। এজন্যই যে চিন্তা-মতবাদ অসংখ্য মানুষকে একই সূত্রে গ্রথিত করে একটি জাতিকে পরিণত করে, তাই মিলনবাণী বলে পরিচিত হতে পারে। তুর্কি বংশোদ্ভূত লোকদেরকে যে মতের ভিত্তিতে এক জাতি রূপে গঠন করা হয়েছে, তা-ও একটি মিলনবাণী বটে, অস্ট্রিয়া ও জার্মানীর অধিবাসীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যে যে চিন্তা বা মতাদর্শ কাজ করছে, তা-ও এক মিলনবাণী। এক ভাষাভাণী লোকদেরকে কিংবা একই বংশ বা গোত্র থেকে উদ্ভূত লোকদেরকে অথবা এক দেশের অধিবাসীদেরকে ‘এক জাতিতে’ পরিণত করার জন্য যতো চিন্তা এবং মত কাজ করছে, তা সবই মিলনবাণী সন্দেহ নেই। কিন্তু এ মিলনবাণীসমূহ অতীব সীমাবদ্ধ; নদী, সমুদ্র, পর্বত, ভাষা ও গোত্র প্রভৃতি বাঁধাসমূহ এর এক একটিকে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ গণ্ডিবদ্ধ করে দিয়েছে। এর কোনো একটিও সমগ্র বিশ্বমানবের মিলন সৃষ্টি করতে সমর্থ নয় বলে তার কোনোটিই সমগ্র দুনিয়ার মিলনবাণী হতে পারে না।
বস্তুত উল্লিখিত মিলনবাণীসমূহের মধ্যে থেকে কোনো একটি মুসলমানকে সম্মিলিত করতে পারে না। মুসলমান কেবলমাত্র এক দেশের অধিবাসী হওয়ার কারণেই তারা পরস্পর মিলিত হয় না। নির্দিষ্ট কোনো এক ভাষায় কথা বলার কারণেও তারা পরস্পর ভাই হয় না। নিছক রক্তের ঐক্যও তাদেরকে সুদৃঢ় প্রাচীরে পরিণত করে না। রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থের ঐক্যও তাদেরকে একজাতিতে পরিণত করেনি। আরবী ভাষাভাষী কোনো আরব এবং পশতু ভাষাভাষী আফগানও-মুসলমানদের একই সমাজের অর্ন্তভূক্ত, আলাদা নয়। আবিসিনিয়ার নিগ্রো এবং পোল্যাণ্ডের ফিরিংগী ইসলামী সমাজের আর্ন্তভূক্ত হলে তাদেরকে কেউই বহিস্কৃত করতে পারে না। এটা থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুসলমানগণ যাকে ‘মিলনাবাণী’ বলে বিশ্বোস করে, পর্বত- নদী-সমুদ্র, বংশ, গোত্র এবং ভাষা কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থ-এর কোনো একটিও তাকে কোথাও সীমাবদ্ধ করতে পারে না এবং যে ‘বাণী’ বিশ্বে সমগ্র মানবতাকে একই ‘মিলন-কেন্দ্রে’ সমবেত সম্মিলিত করতে সমর্থ মুসলমানদের নিকট একমাত্র এটাই ‘মিলনবাণীরূপে’ পরিগৃহীত হতে পারে। এ ‘মিলনবাণী’ বিস্তৃতি ও সর্বাত্মক ব্যাপকতা লাভ করার পথে কোনো পার্থিব বা বৈষয়িক বস্তুই প্রতিবন্ধক হতে পারে না। এর নিকট কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, পীতাঙ্গ কিংবা শ্যামাঙ্গ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল মানুষই সর্ম্পূরূপে সমান মর্যাদার অধিকারী। মুসলমানদের বাণীর অন্তর্নিহিত প্রশস্ততার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই; নিখিল বিশ্বের সমস্ত মানুষকেই এটা একটি মিলন কেন্দ্রে একত্রিত করতে পারে বলে প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে মিলনবাণী। ইসলামের আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে যাঁচাই করলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে যে, মুসলমানদের মিলনবাণীর ন্যায় অন্তহীন বিশালতা ও ব্যাপকতার গুণসম্পন্ন অন্য কোনো বানীই পৃথিবীতে বর্তমান নেই।
বিষয়টির সুস্পষ্ট বিধানের জন্য এখন একটি বিরাট প্রাসাদের উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে, যার সুদৃঢ় প্রাচীর এবং দণ্ডায়মান স্তম্ভ সমূহের প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র সত্তা বিদ্যমান। অন্যদিকে তার ছাদ ও মেঝেও সম্পূর্ণ ভিন্ন। অসংখ্য বস্তু ও দ্রব্য এদের পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান ও বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একটি জিনিস এদের সকলের মধ্যে পূর্ণ সমন্বয় সাধন করেছে-তা এই যে, উল্লেখিত প্রত্যেকটি বস্তুই একই প্রাসাদের বিভিন্ন অংশমাত্র। একই উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য এগুলোকে তৈরি করা হয়েছে এবং একজন ইঞ্জিনিয়ারের সুপরিকল্পিত রচনায় এটা নির্মিত হয়েছে। অতএব এ একটি মাত্র বিষয়ই এ অসংখ্য বিভিন্ন বস্তুকে সম্মিলিত সংযুক্ত এবং সংঘবদ্ধ করে তুলতে পারে। এছাড়া অন্যান্য যাবতীয় বস্তুই বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টির ভিত্তি। তদ্রুপ দুনিয়ার বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন গোত্র এবং বিভিন্ন জন্মভূমি সম্পন্ন অসংখ্য জাতি যদি ‘এক জাতি’তে পরিণত হতে চায় তবে তার একটি মাত্র উপায়ই হতে পারে এবং তা এই যে, তারা সকলে মিলে এক বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তার গ্রন্থাবলী, তাঁর প্রেরিত আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং সেই আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করার বাধ্যবাধকতার প্রতি সন্দেহাতীত ঈমান আনয়ন করবে ও বিশ্বাস স্থাপন করবে।
আবার সেই প্রাচীরের উদাহরণটাই খানিকটা বিশ্লেষণ করা যাক। প্রকৃতপক্ষে তার রং সাদা; পাণ্ডুরোগ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি তাকে হরিতবর্ণ বলতে পারে কিংবা অন্য যে কোনো বর্ণের চশমা পরে সে তাকে সেই রঙের বলে অভিহিত করতে পারে। অথবা কোনো ব্যক্তি জিদের বশবর্তী হয়ে তাকে কৃষ্ণ কিংবা নীল বর্ণেরও বলতে পারে। এভাবে তার প্রকৃত বর্ণকে উপেক্ষা করে দুনিয়ার জন্য যে কোনো বর্ণ বলে প্রচার করা যেতে পারে। কিন্তু এ সকল প্রচার ও উক্তি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা হবে-দুনিয়ার দর্শক সম্মিলিতভাবে তা কিছুতেই স্বীকার বা সমর্থন করবে না। এজন্য যে মিথ্যার ভিত্তিতে কোনো দিনই ঐক্য স্থাপিত হতে পারে না; ঐক্য এবং সংহতি একমাত্র সত্য ও সততার উপরই স্থাপিত হতে পারে। অতএব সমগ্র বিশ্ববাসী একবাক্যে উক্ত প্রাচীরের শ্বেতবর্ণকে স্বীকার করবে। তদ্রুপ বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্বপালক সম্পর্কেও ধারণা হতে পারে-হয়েছেও। খোদা দু’জন, তিনজন, কিংবা খোদা লক্ষ্য-কোটি সত্তায় বিভক্ত হয়েছে। এরূপ অনেক ধারণাই মানব সমাজে পরমাণু একবাক্যে এ সাক্ষ্যই দিচ্ছে যে, বিশ্বস্রষ্টা মাত্র একজন। অতএব উপরোক্ত উদাহরণ অনুসারে বিশ্বমানুষের মিলন ও ঐক্য একমাত্র একথা-এ বাণীর ভিত্তিতেই হতে পারে। এছাড়া আর যতো কথা, যতো ধারণা বা মতবাদ ও বাণী রয়েছে, তার প্রত্যেকটি বিচ্ছেদকারী ও বিভেদ সৃষ্টিকারী-মিলন, ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করার তাদের কোনো একটিরও সাধ্য নেই। ফেরেশতাদের সম্পর্কেও কোনো ধারণার প্রচলন রয়েছে। কেউ তাদের দেবতা মনে করেছে, কেউ সুপারিশকারী, কেউ খোদায়ী কাজের অংশীদার বলেও মত প্রকাশ করছে। এ সকল প্রকার উক্তি ও ধারণার মধ্যে ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর খাদেম এবং আল্লাহর নিদের্শের একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত জাতি বলে ধারণা করাই হচ্ছে একমাত্র সত্য ধারণা। দুনিয়ায় ঐক্য স্থাপন একমাত্র এ সত্য বিশ্বাসের ভিত্তিতেই সম্ভব। এছাড়া অন্যান্য সব ধারণা-বিশ্বাসই বিভেদ সৃষ্টিকারী, তাতে সন্দেহ নেই।
দুনিয়ায় আল্লাহ প্রেরিত আম্বিয়ায়ে কিরাম ও গ্রন্থাবলী সম্পর্কেও একথাই সত্য। প্রত্যেক জাতি নিজ নিজ জাতীয় ‘নেতা’ এবং জাতীয় ধর্মগ্রন্থ নিয়ে স্বতন্ত্র্যের ঘোষণা করতে পারে এবং নিজ নিজ নেতার সত্যতা ও অপর নেতার মিথ্যা হওয়ার দাবীও করতে পারে। কিন্তু এরূপ বিভিন্ন উক্তি দুনিয়ার জাতিসমূহকে একই কেন্দ্রে মিলিত করতে পারে না। সকল জাতিকে যুক্ত করে একটি মাত্র জাতি গঠনের ভিত্তিবাণী কেবলমাত্র এ হতে পারে যে, আল্লাহ তা’য়ালার যতো নবী-পয়গম্বর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতির নিকট প্রেরিত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই সত্য; আল্লাহর যতো কিতাবই মানুষের প্রতি নাযিল হয়েছে, তা সবই সত্য ও সত্যের শিক্ষাদাতা।
সৃষ্টিজগতের লয় ও মানবজাতির পরিসমাপ্তি সম্পর্কেও বিভিন্ন ধারণা পোষণ করা যেতে পারে। কিন্তু সত্যাশ্রয়ী মন কেবল একথাই মেনে নিতে পারে যে, নিখিল মানুষকে একদিন ‘শেষ জবাবের’ জন্য সৃষ্টিকর্তার সামনে হাজির হতে হবে এবং নিজ নিজ জীবনব্যাপী কাজকর্মের পুংখানুপুংখ হিসেব পেশ করতে হবে।
অতএব বিশ্বব্যাপী ঐক্য ও সংহতি স্থাপন একমাত্র চূড়ান্ত কথা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতেই সম্ভব। এছাড়া আর যত মত ও পথ রয়েছে, তা সবই ভুল-সবই বিচ্ছেদ ও বিভেদ সৃষ্টিকারী, এটা নিঃসন্দেহ। বস্তুত এ পাঁচটি বিষয়ের প্রতি সংশয়ের লেশহীন বিশ্বাস স্থাপনের নামই হচ্ছে ‘মিলনবাণীঃ
امَنَ الرَّسُزْلُ بِمَا اُنْزِلَ اليه من رَّبِّهِ والمؤمِنُونَ ط كُلٌّ اَمَنَ بالله والملائكــتِهِ وَكتبهِ وَرُسُولهِ قف لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ اَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ ط وَقَالُوا سمعنا وِاطَعنا غُفرانَكَ رَبَّنَا وَاِلَيْكَ المَصِيْرُ – (البقرة : ২৮৫)
“রাসূলের প্রতি তাঁর আল্লাহর নিকট থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তার প্রতি তিনি ঈমান এনেছেন। অন্যান্য মু’মিনগণও তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। সকলেই আল্লাহ, ফেরেশতা, গ্রন্থাবলী এবং তাঁর নবীদের প্রতি ঈমান এনেছে এবং বলেছে যে, আমরা তাঁর নবীদের পরস্পরের মধ্যে কোনোরূপ বৈষম্যের সৃষ্টি করি না। আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি, আমাদের সকলকে তোমার নিকট ফিরে যেতে হবে।” -সূরা আল বাকারাঃ ২৮৫
এ পাঁচটি বুনিয়াদী সত্য কথা প্রকাশ করেছেন আল্লাহ তা’য়ালা। দুনিয়ার মানুষের নিকট তা প্রচার করেছেন আল্লাহর রাসূল। এজন্য এসব বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনাকে এ একটি মাত্র কালেমা –‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর’ মধ্যে একত্রীভূত করে দিয়েছেন। আল্লাহর একত্বের সাথে সাথে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুওয়াতের কথা স্বীকার করার অর্থ এই যে, এ কালেমা যিনি পাঠ করলেন, তিনি হযরতের প্রচারিত সমগ্র সত্যের প্রতি ঈমান এনেছেন।…… এ কালেমাকেই খুব ভারী এবং বিরাট জিনিস বলে অভিহিত করা হয়েছেঃ
اِنَّا سَنُلقِىْ عَلَيْكَ قَوْلاً ثَقِيْلاَ – (المزمل : ৫)
“আমরা তোমার উপর এক দুর্বহ কালাম নাযিল করবো।” -সূরা মুযাম্মিলঃ ৫
এ বাণী কোনো ছিন্নপত্র বা কাগজের টুকরার মতো গুরুত্বহীন নয়-যাকে কোনো দমকা হাওয়া উড়িয়ে দিতে পারে। যার একস্থানে কোনো স্থিতি নেই, যা প্রত্যেক নতুন আবিষ্কার ও দৃষ্টিকোণের প্রবল ধাক্কায় পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। বস্তুত ‘কালেমায়ে তাইয়্যেবা’ এরূপ কোনো বাণী নয়। মূলত এটা পর্বতের ন্যায় বিরাট, গম্ভীর ও সুদৃঢ়। ঝড়-তুফানের কোনো আঘাত-কোনো মহাপ্লাবণও এটাকে কিছুমাত্র টলাতে পারে না। এ অটল-অনড় বিপ্লবী ‘মিলনবাণী’ সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
الم تر كيف ضرب الله مثلاً كلمة طَّيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَّيِّبَةٍ اَصلهَا ثابِتٌ وَّفرها فى السَّماء – تُؤتِىَ اُكْلُهَا كُلَّ حِيْنٍ بِاِذنِ رَبِّهَا ط وَيَضرِبُ اللهُ الامثال للنَّاس لعلَّهُم يَتَذَكَّرُونَ – وَمَثَلُ الكلمة خَبِيْثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِيْثَةٍ نِ اجتُثَّتْ من فَوقِ الارضِ ما لَهَا مِنْ قَرَارٍ – يُثَبِّتُ اللهُ الَّذِيْنَ اَمَنُوا بالقَوْلِ الثَّابِتِ فِىْ الحيَوة الدُّنيا وفى الاخرة ج وَيُضِلُّ اللهُ الظَّلِمِيْنَ لا وَيَفْعَلُ اللهُ مَا يَشَــاءُ – (২৭-২৪)
“আল্লাহ তা’য়ালা ভাল কালেমার কিরূপ উদাহরণ দিয়েছেন, তা ভেবে দেখেছ কি? বস্তুত তা এমন একটি একটি সৎ জাতের বৃক্ষের ন্যায়, যার শিকড় মাটির গভীর তলদেশে খুব দৃঢ় হয়ে আছে এবং যার শাখা-প্রশাখা উর্দ্ধাকাশে বিস্তৃতি। এটা সবসময় তার আল্লাহর অনুমতি ও নির্দেশক্রমে ফল দান করে। আল্লাহ তা’য়ালা মানুষের সামনে এরূপ উদাহরণ এজন্য পেশ করেছেন যে, তারা যেন এটা হতে শিক্ষা লাভ করতে পারে। পক্ষান্তরে নাপাক কালেমার তুলনা করা হয়েছে একটি নিকৃষ্ট জাতের গাছের সাথে। একে মাটির উপরিভাগ থেকেই উৎপাটিত করে নিক্ষেপ করা হয়। মূলত তার বিন্দুমাত্র স্থিতি নেই। আল্লাহ তা’য়ালা ঈমানদার লোকদেরকে এ সুপ্রমাণিত সত্য বাণীর দৌলতে স্থিতি দান করবেন-দুনিয়া এবং পরকালে সর্বত্র। যেসব জালেম এ ‘সত্যবাণী’ অস্বীকার করবে, তারা পথভ্রষ্ঠ হবে। মূলত আল্লাহ তা’য়ালার যা ইচ্ছা হয়, তাই তিনি করেন।”-সূরা ইবরাহীমঃ ২৪-২৭
কুরআনে উল্লিখিত এ উদাহরণ আলোচ্য বিষয়টিকে খুবই সুস্পষ্ট করে তুলেছে। একমাত্র ‘পাক ও পবিত্র এবং সর্বাত্মক বাণীই পৃথিবীর বুকে স্থিতি, নিরাপত্তা ও বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। এছাড়া অন্যান্য সব ভ্রান্ত, অসৎ ও কদর্যপূর্ণ বাণীর পক্ষে স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি লাভ করা সম্ভব নয়। তা মূল্যহীন পরগাছার সমতুল্য; একদিকে অসংখ্য জমিতে থাকে অন্যদিকে তা নানাভাবে নতুন চারাগাছ উদগম করে এবং অতীতের সমস্ত চারাগছকে উৎপাটিত করে ফেলে। এসব চারাগাছের ফুলে-ফলে সুশোভিত হওয়ার কোনো শক্তি বা যোগ্যতাই বর্তমান নেই; আর কোনোটিতে যদি কখনো ফল ধরেও তবুও তা অত্যন্ত তিক্ত ও কটু না হয়ে পারে না। বস্তুত এ ধরণের আগাছা-পরগাছার মারাত্মক ফলের কারণেই বর্তমান মানব সমাজ জর্জরিত। এজন্যই আজ কোনো দেশেই মিথ্যা প্রচারণার প্রবল তুফানের সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বিষাক্ত গ্যাস, আর কোথাও প্রলয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও এর কারণে হিংসা-দ্বেষ, আক্রোস ও প্রতিহিংসার বীজ উপ্ত হয়েছে।
পৃথিবীর অন্যান্য জাতির কথা এখানে আলোচ্য নয়-যাদের অদৃষ্টে আল্লাহর কঠোর শাস্তি লিখিত রয়েছে, তাদের কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তারা তাদের এসব বিষাক্তও মারাত্মক ‘পরগাছা’ নিয়ে পরিতৃপ্তি ও আত্মশ্লাঘা লাভ করলেও করতে পারে। কিন্তু মুসলমানদের পক্ষে এসব থেকে অনেক দূরে অবস্থান করা বাঞ্ছনীয়। তাদের নিকট মহান পবিত্র ও সৎকাজের ‘বৃক্ষ’ বর্তমান রয়েছে, যা আদমের আগমন সময় থেকে আজ পর্যন্ত কখনো উতপাটিত হয়নি, আর কখনো তা ফুলে-ফলে সুশোভিত হতেও ত্রু“টি করেনি; এর মূল শিকড়ও গভীর মাটিতে সুদৃঢ়রূপে প্রোথিত এবং অর্ন্তহীন উর্দ্ধালোকে এর শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত; এ ‘বৃক্ষ’ থেকে আর চিরদিন ও সর্বত্রই কেবল শান্তি ও নিঃসঙ্ক নিরাপত্তার ‘ফল’ পাওয়া গেছে। এ বৃক্ষ তার শীতল ছায়ার শান্তিময় ক্রোড়ে আশ্রয় নিতে এবং তার ‘ফল; থেকে উপকৃত হতে কোনোদিনই বাঁধা দেয়নি। মানুষের গোত্র-বংশ ভাষা এবং জন্মভূমির কোনো বৈষম্য বা সে সম্পর্কে কোনো কৌতুহলই এর নেই। পরন্তু যে মানুষই এর আশ্রয় গ্রহণ করেছে সে বংশ-গৌরব, ভাষার পার্থক্য বর্ণের বৈষম্য এবং জন্মভূমির বিরোধ চিরতরে ভুলে গেছে-নিখিল বিশ্ব তারদৃষ্টিতে একেবারে সমান ও একাকার হয়ে গেছে; বস্তুত এটাই হলো এ ‘বৃক্ষের’ অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য। নিন্মোক্ত শিক্ষাই তার মূল ভাবধারাঃ
مُحَمَّدُ الرَّسُولُ اللهِ ط وَالَّذِيْن َمَعَهُ اَشِدَّءُ على الكُفَّارِ رُحُمَاءُ بَيْنَهُم تَرَاهُم رُكَّعَا سُجَّدَّا يَبتغُوْنَ فَضْلاً مِنَ اللهِ وَرِضْوَانَا ز – (الفتح : ২৯)
“আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ ‘কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং পরস্পর পরস্পরের প্রতি নম্র ও বিনয়ী। তোমরা তাদেরকে রুকু ও সিজদায় কিংবা আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ প্রাথী ও সন্তোষের সন্ধানে আত্ম-নিমগ্ন দেখতে পাবে।”-সূরা আল ফাতহঃ ২৯
বস্তুতঃ সমগ্র বিশ্বমানবকে এক মহান সত্যের বিশাল কেন্দ্রে সমাবেত করার জন্যে এবং অসংখ্য আর্থিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধ সত্ত্বেও এক সর্বসম্মত বিষয়ে নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে মিলিত করার জন্যে-অন্য কথায় সকল আদম সন্তানকে ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এ ‘বাণী’ মানুষের সামনে পেশ করা হয়েছিল। ইসলামে ঈমানের বিষয়সমূহে এজন্যই এতো ব্যাপকতা ও বিশালতার অবকাশ রক্ষিত হয়েছে। এটা সমগ্র মানব জাতিকে নিজের ক্রোড়ে চিরন্তন আশ্রয় দিতে সক্ষম। এজন্যই এ ‘বাণী’ প্রচারককে উদাত্তকন্ঠে ঘোষণা করতে বলা হয়েছেঃ
يَاَيُّهَا النَّاسُ اِنِّىْ رَسُلُ اللهِ اِلِيْكُم جَمِيْعًا – (الاعراف : ১৫৮)
“হে মানুষ! আমিই তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।”
এজন্যই বলা হয়েছে-এ ‘বাণী’ যে গ্রহণ করবে তার রক্ত ও সম্মান সম্পূর্ণ ‘হারাম’। তাকে হত্যাকারী জাহান্নামের চিরন্তন আযাবে নিমজ্জিত হবে এবং তার সম্মানের হানীকারী ‘ফাসেক’। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এ বিরাট ও অতুলনীয় ‘মিলনবাণী’কে আমরা খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়েছি। আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রাসূল এবং পরকালে যারা বিশ্বাস স্থাপন করবে-আল্লাহর ফরমান অনুযায়ী তারা মুসলিম। কিন্তু আমরা এসব জিনিসকে উপেক্ষা করে স্বকপোলকল্পিত বহু অকেজো জিনিসকে ঈমান ও কুফরের ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করেছি। এমনকি এ পাঁচটি বিষয়ে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের মধ্যেও ‘কুফরের’ অভিশাপ দ্বিধাহীন চিত্তে বন্টন করা হয়েছে। এ সর্বাত্মক ‘মিলনবাণী’ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আমরা এমনভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছি যে, আমাদের মূল ‘দ্বীন’ই যেন বিভিন্ন হয়ে গেছে। জাতীয়তা, মসজিদ, সালাত-সবকিছুই পৃথক পৃথক ও আলাদা করে নিয়েছি; নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও আমরা ছিন্ন করেছি এবং ‘সকল ঈমানদার ভাই ভাই’ বলে আমাদের মধ্যে যে অটুট ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করা হয়েছিল, আমরা তা-ও চূর্ণ করেছি। অতপর আমরা একটি কঠিন বিপদের সম্মুখীন হলাম। আমাদের জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্বের প্রকৃত মূলনীতি পরিহার করে অন্যান্য জাতির নিকট থেকে আঞ্চলিত ও বংশীয় জাতীয়তার নতুন শিক্ষা গ্রহণ করেছি-অথচ এটা মূলতঃ ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। জাহেলী যুগের যেসব হিংসা-দ্বেষ, অন্ধত্ব, স্বজনপ্রীতি ও পরিস্পারিক বিরোধ নির্মূল করতে এসেছিল ইসলাম-এক এক করে তা সবই আমাদের মধ্যে জন্মলাভ করেছে। কেউ ‘প্যান তুরাবিয়ানের’ আন্দোলন শুরু করেছেন, কেউ ‘প্যান আরবের’ ঝাণ্ডা উড্ডীন করেছেন-কেউ আর্যবংশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে নিযুক্ত, কেউ আঞ্চলিক ও জন্মভূমি ভিত্তিক জাতীয়তার আত্মবিলীন করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এক কথায় বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দল ইসলামের এ অতুলনীয় ‘মহামিলনবাণী’ চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্য নিজেদের সমগ্র শক্তি নিয়োগ করছে। অথচ এসব বিবিধ দল ও বিভেদেও বাণীকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই ‘মিলনবাণী’ প্রচার করা হয়েছিল।
ছোট-বড় সকল প্রকার মতবিরোধ ও বৈষম্য-পার্থক্যই যে এ ‘মিলনবাণী’ নিশ্চিহ্ন করবে, এমন কথা আমি বলছি না-বিরোধ ও বৈষম্য মূলত স্বাভাবিক জিনিস; এটা নিশ্চিহ্ন হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। বর্ণ গোত্র ভাষা ও জন্মভূমি-এর কোনো একটির বৈচিত্রও নিঃশেষে মিটে যেতে পারে না। চিন্তাশক্তি ও স্বাভাবিক প্রকৃতির বিরোধ দূর করাও সম্ভব নয়। অতএব এসব বিরোধ ও বৈষম্য মানুষের বিভিন্ন দলের মত ও বিশ্বাস এবং স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে প্রকট থাকবে, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু ইসলামের ‘মিলনবাণী’ প্রেরণের মূলে এসব বৈষয়িক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মতবিরোধের পরস্পরের মধ্যে এক বৈজ্ঞানিক নৈতিক এবং তামাদ্দুনিক সামঞ্জস্য ও সমন্বয় সাধন করাই উদ্দেশ্য ছিল-যেন সকল মানুষ নির্বিশেষে ও অকুন্ঠচিত্তে তা গ্রহণ করতে পারে এবং তা কবুল করে সকলেই নিজের ভৌগোলিক, গোত্রীয়, অর্থনৈতিক, বর্ণ ও ভাষাগত বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও একমাত্র এরই ভিত্তিকে এক জাতিতে পরিণত হতে পারে। এজন্যই এক ‘মিলনবাণী’ পেশ করার সাথে সাথে তা গ্রহণকারীদের জন্যে জামায়াতবদ্ধ হয়ে সালাত আদায় করার তাকীদ করা হয়েছে। সমগ্র পৃথিবীর জন্যে একটি মাত্র ‘কেবলা’ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সাওম এবং হজ্জ ইত্যাদিও সামাজিক ও জাতিগত অন্যান্য সকল প্রকার বিরোধ ও পার্থক্য নির্মূল করা হয়েছে। সমগ্র দুনিয়ার নিখিল মুসলেমীনকে সমান আইনগত মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এবং সকলকে একই সর্বাত্মক ও বিশ্বব্যাপী সভ্যতার অর্ন্তভুক্ত করে দেয়া হয়েছে। দ্বীন ইসলামের ঐক্যর ভিত্তিতে ছোটখাট অন্যান্য যাবতীয় বিরোধ-ব্যবধান দূরীভূত করে দেয়াই এবং সমগ্র বিশ্বমানবকে এক অভিনব জাতীয়তার অর্ন্তভূক্ত করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু মুসলমানগণ তাদের প্রতি আল্লাহর এ বিরাট অনুগ্রহকে সর্বসাধারণ বিশ্বমানবের মধ্যে বিস্তারিত করার পরিবর্তে তারা নিজেরাই আঞ্চলিক, ভাষাগত, গোত্রীয় এবং অর্থনৈতিক জাতীয়তার সম্পূর্ণ অনৈসলামিক ভাবধারা গ্রহণ করেছে। অথচ আধুনিক যুগের ঘটনাসমূহ নিঃসন্দেহে সাক্ষ্য দেয় যে, বর্তমান পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদ, ডিকটেঁরবাদ, স্বৈরতন্ত্র এবং যুদ্ধ-সংগ্রাম প্রভৃতি মানবতা বিধ্বংসী বিপর্যয়সমূহ-যা দুনিয়ার শান্তি ও সভ্যতা ধ্বংস করছে এবং ধরিত্রী বুকে মযলুমের তাজা রক্তের বন্যা প্রবাহিত করছে-এ আধুনিক মত ও দৃষ্টিভঙ্গীরই সৃষ্টি।
কোনো শহর ও জনপদের অদূরে যদি নদীর প্লাবণ রোধকারী কোনো বাঁধ থাকে-তবে বাঁধটির সুদৃঢ় ও নিশ্চিদ্র হওয়ার উপরই এ লোকালয়ের নিরাপত্তা নির্ভর করে, এতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু তাতে গভীর ফাঁটল থাকার সংবাদই যদি লোকেরা শুনতে পায়, তবে তারা যে সেই ফাঁটল বন্ধ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু মানব সমাজে চরম ভাঙ্গন ও বিপর্যয়, হিংসা-দ্বেষ ও পারস্পারিক শত্রু“তার সর্বগ্রাসী সয়লাব-স্রোতকে যে বাঁধ রুখে দাঁড়িয়ে আছে-যার দৃঢ়তা ও মযবুতীর উপর নিখিল বিশ্বের নিরাপত্তা নির্ভর করে-তাতে আজ কঠিন ফাঁটল ধরেছে। কিন্তু বিষ্ময়ের বিষয় এই যে, মানুষ-বিশেষ করে মুসলমান সেদিকে মাত্রই ভ্রুক্ষেপ করছে না-সেজন্য কিছু চিন্তা করছে না-সে জন্য কিছুমাত্র মাথাব্যাথাও দেখা যাচ্ছে না। অথচ সত্য কথা এই যে, এ বিরাট মহান বাঁধ সংরক্ষণের জন্য যদি মস্তিষ্কও দান করতে হয়, তবুও তাতে কুন্ঠিত হওয়া উচিত নয়। -তরজামানুল কুরআনঃ জুলাই, ১৯৩৪ ইং।