যাকাত-কর্মচারী হওয়ার শর্ত
যাকাতের কাজে কর্মচারীরূপে নিযুক্ত পাওয়ার জন্যে নিম্নলিখিত শর্তাবলী লক্ষণীয়ঃ
১. তাকে মুসলিম হতে হবে। কেননা এই কাজটা মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি করার পর্যায়ের। অতএব ইসলামে বিশ্বসী হওয়া জরুরী শর্তরূপে গণ- অপরাপর সব প্রতিনিধিত্বের মতই। তবে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে এ শর্ত নেই। যেমন পাহারাদার, দারওয়ান, গাড়ি চালক ইত্যাদি। ইমাম আহমাদ এর একটি বর্ণনায় যাকাতের কর্মচারী অমুসলিমও হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা কুরআনী ঘোষণা নিঃশর্তে উল্লিখিত হয়েছে। মুসলিম ও অমুসলিম-কাফির উভয়ই এর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। উপরন্তু কর্মচারী যা পাবে, তা হচ্ছে তার শ্রম বা কাজের মজুরী মাত্র। তাই অন্যান্য কাজের মজুরী গ্রহণে যেমন এ ধরনের কোন শর্ত নেই, এখানেও তাই।
২. আসলে এটা ইসলামের পরম উদারতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা যেহেতু একটি ইসলামী ফরয কাজ, তাই এ কাজে অমুসলিম লো নিয়োগ না করাই উত্তম।
ইবনে কুদামাহ বলেছেনঃ যেহেতু এ কাজের জন্যে আমানতদারী ও পরম বিশ্বস্ততা থাকা জরুরী শর্ত বিশেষ, তাই কর্মচারীরও মুসলিম হওয়া জরুরী। সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে যেমন এই শর্ত রয়েছে। এটা মুসলমানদের একটা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বও বটে। তাই কোন কাফিরকে এ কাজে নিযুক্ত করা জায়েয হবে না। তা ছাড়া যে লোক নিজে যাকাত ফরয হয় এমন লোকদের মধ্যে গণ্য নয়, তাকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া উচিত নয়। কাফির ব্যক্তি আমানতদার গণ্য হতে পারে না। এ কারণে হযরত উমর (রা) বলেছেনঃ ‘এই লোকদের তোমরা আমানতদার বানিও না। কেননা তারা নিজেরাই আল্লাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে’।
হযরত উমর (রা) হযরত আবূ মুসা আশআরীর দফতরে কেরানীপদে একজন খৃস্টানকে নিয়োগ করাকে পসন্দ বা সমর্থন করেন নি। আর যাকাত হচ্ছে ইসলামের একটা ফরয। তাতে এই নীতি অব্যশই বাধ্যতামূলক হবে। [(আরবী***********)]
২. পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে।
৩. বিশ্বস্ত ও আমানতদার হতে হবে। কেননা মুসলিম জনগণের আমানত তার নিকট রাখা হবে। তাই কোন ফাসিক ও খিয়ানতকারীকে এ কাজে লাগানো যেতে পারে না। কেননা এই পরিচিতির লোকদের আমানতদারী বিশ্বাস্য নয়। তারা লালসার বশবর্তী হয়ে কাফীর-মিসকীনের অধিকার হরণ করতে পারে, উপস্থিত স্বার্থ লোভের বশবর্তী হয়ে যেতে পারে, এই ভয় বা আশংকা থেকেই যায়।
৪. যাকাতের বিধান সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা।
ফিকাহবিদদের আরোপিত আর একটি শর্ত হচ্ছে যাকাত সংক্রান্ত শরীয়াতী হুকুম আহকাম ও আইন বিধান সম্পর্কে অবহিত ও ওয়াকিফহাল হওয়া, যদি সে সাধারণ কর্যাবলীর দায়িত্বশীল হয়। কেননা সে এসব বিষয়ে অজ্ঞ হলে সে সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না, তার ভুল বেশি হবে সঠিক কাজের তুলনায়। [১১১১] কেননা কি তাকে গ্রহণ করতে হবে, আর কি গ্রহণ করা চলবে না, তাও তার জানা থাকা আবশ্যক। এজন্যে তার আংশিক ইজতিহাদ করার প্রয়োজনও দেখা দেবে যাকাত সংক্রান্ত নিত্য সৃষ্ট মাসলা-মাসায়েল ও হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে।
তবে তার কাজই যদি হয় আংশিক, সুনির্দিষ্ট একটা বিশেষ পরিধির মধ্যে, তাহলে অন্তত তার কাজের পরিমাণটুকু সম্পর্কে তার জানা থাকতে হবে।
৫. কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে।
যে কাজের দাযিত্ব অর্পিত হবে, নিয়োগকৃত কর্মচারীর মধ্যে সে কাজটুকু আঞ্জাম দেয়ার মত কর্মক্ষমতা থাকতে হবে, তার যোগ্য হতে হবে। কেননা শুধু বিশ্বস্ততাত ও আমানতদারীর গুণ প্রয়োজনীয় কর্মক্ষমতার বিকল্প বা স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী************)
তুমি যাকে কাজে নিযুক্ত করবে, সেজন্যে শক্তিসম্পন্ন ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিই উত্তম। (সূরা কাসাসঃ ২৬)
এ কারণে হযরত ইউসূফ (আ) বলেছিলেন বাদশাহকেঃ
(আরবী*****************)
আমাকে পৃথিবীর ধন-ভান্ডারের ওপর দয়িত্বশীল নিযুক্ত করুন। আমি নিঃসন্দেহে সংরক্ষণকারী সুবিজ্ঞ। (সূরা ইউসূফঃ ৫৫)
তাই সংরক্ষণ অর্থাৎ আমানতদারী এবং ইলম অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কাজ উত্তমভাবে ও যথেষ্ট মাত্রায় করা জ্ঞান ও যোগ্যতা থাকতে হবে কর্মচারীর মধ্যে। বস্তুত প্রত্যেক সফল কাজের এ দুটোই হচ্ছে ভিত্তি।
৬. নিকটাত্মীয় নিয়োগ করা কি জায়েয?
অনেকে এও শর্ত করেছেন যে, নবী করীম (স) এর নিকটাত্মীয় বনু হাশেমের লোক এই কাজে নিযুক্ত না হওয়া উচিত। কেননা ফযল ইবনে আব্বাস ও মতলব ইবনে রবীয়া দুই ব্যক্তি নবী করীম (স) এর নিকট যাকাত সংক্রান্ত কাজে বিনিয়োগের প্রার্থনা করেছিলেন। একজন বললেন, ‘ হে রাসূল! আমরা আপনার নিকট এসেছি এই উদ্দেশ্যে যে, আপনি আমাদেরকে যাকাত সংক্রান্ত এই কাজে নিযুক্ত করবেন। তাহলে অন্যান্য লোকের ন্যায় আমরাও এ থেকে সুবিধা ও মুনাফা লাভ করতে পারব। লোকেরা যেমন আদায় করে দেয় আপনার নিকট, আমরাও তেমনিভাবে আদায় করে দেব।’ তখন তিনি বললেন, যাকাত (সংক্রান্ত কাজ) মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশাবলীর পক্ষে শোভন নয়। তা তো আসলে মানুষের আবর্জনা বিশেষ।’ হাদীসটি আহমাদ ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। অপর একটি বর্ণার ভাষা হচ্ছেঃ যাকাত মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের বংশাবলীর জন্যে হালাল নয়।’। [(আরবী*******)]
হাদীসটি মুহাম্মাদ (স) এর বংশধরদের যাকাতের মালের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও নিষেধ করছে। তা থেকে উপকৃত হওয়াও অনুরূপ নিষিদ্ধ। কথাটির শেষ দিক তুলনামূলক। যাকাত হচ্ছে লোকদের ধন-মাল ও মন মানসিকতার পরিচ্ছন্নতা বিধানের মাধ্যম। আল্লাহ বলেছেন, তুমি তাদের পবিত্র করবে, পরিশুদ্ধ করবে এই যাকাত দ্বারা, এ কারণে তাকে আবর্জনা (Dirt-filth) বলা হয়েছে।
বস্তুত যাকাতের মাল সাধরণ জনগণের মাল। অতএব তা কোন রূপ অধিকার ছাড়া পাওয়া যেতে পারে না। সেরূপ পাওয়া ইসলমী শরীয়াতের দৃষ্টিতে অতি বড় গুনাহ। নবী করীম (স) এ মাল থেকে তার নিকটাত্মীয়দের দূরে রাখার ও ভীত করার জন্যে একটা দৃষ্টান্ত দিতে চেয়েছিলেন মাত্র। তিনি এ বিষয়ে লোকদের সাবধান করেছেন তার খোঁজ-খবর লওয়ার আগ্রহ থেকে, তা বেশি পরিমাণে পাওয়ার লোভ থেকে।
আহলি বাইত-এর ফিকাহবিদ নাসের মনে করেছেন, বনু হাশিমের লোকদের কাজে নিযুক্ত করে যাকাত থেকে বৃত্তিদান না মাসিক বেতন দান জায়েয। ইমাম শাফেয়ী এবং আহমদেরও তা-ই মত। কাযী আবূ ইয়ালা যাকাত সংক্রান্ত কাজে বনু হাশিমের লোকদের নিয়োগ করা পর্যায়ে বলেছেনঃ যারা পক্ষে যাকাত-সাদকা গ্রহণ করা হারাম রাসূলের নিকটাত্মীয়দের ক্রীতদাসদের মধ্যে থেকে, তাকে এই কাজে কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত করা জায়েয। কেননা সে যা পাচ্ছে তা তার পারিশ্রমিক, যাকাত নয়। এই কারণে তার কাজ অনুপাতে তার প্রাপ্যও নির্ধারিত হবে। আর খারকী বলেছেন, বনু হাশিম, কাফির ও গোলামকে যাকাত দেয়া যাবে না। তবে তারা যদি এই কাজের কর্মচারী নিযুক্ত হয়ে থাকে, তা হলে তাদের কাজ অনুপাত তাদের দেয়া যাবে। [(আরবী*******)]
অন্য কথায় হাদীসটির তাৎপর্য হচ্ছে, এই পর্যায়ের কাজ পেতে চাওয়া থেকে বনু হাশিমের লোকদের দূরে সরিয়ে রাখা-এ বিষয়ে তাদের মনে বিতৃষ্ণা ও অনীহা জাগিয়ে তোলা- তা হারাম করে দেয়া হয়নি তাদের জন্যে।
হাদীসটি দ্বারা বনু হাশিমের লোকদের জন্যে এই কাজ হারাম করা হয়েছে বলে যারা মনে করেছেন, তাদের মত হচ্ছে, রাসূলের নিকটাত্মীয়দের যাকাত থেকে বেতন বা মজুরী গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তারা যদি এ কাজে নিযুক্ত কর্মচারী হয়ে যাকাত ছাড়া অন্য ফাণ্ড থেকে বেতন গ্রহণ করে, তাহলে তা সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে। হযরত আলী (রা) বনু আব্ববাস লোকদের যাকাত সংক্রান্ত কাজে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। [(আরবী*************)]
৭. পুরুষ হওয়া কি শর্ত?
অনেকে শর্ত আরোপ করেছেন যে, যাকাত সংক্রান্ত কাজে পুরুষ লোকদেরকে কর্মচারী নিযুক্ত করতে হবে, মহিলাদের এ কাজে নিযুক্ত করা তাঁদের মতে জায়েয হবে না কেননা এই কাজটি হচ্ছে যাকাত-সাদকার ওপর কর্তৃত্বকরণ। কিন্তু এই মতের সমর্থনে নবী করীম (স) এর একটি কথাই শুধু দলীল হিসেবে পেশ করা সম্ভব হয়েছে। সে কথাটি হলোঃ
(আরবী******************)
যে জাতি তাদের সামষ্টিক কার্যাবলীতে স্ত্রীলোকদের কর্তৃত্বশীল বানায়, সে জাতি কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারে না। (বুখারী)
কিন্তু এই হাদীসটি তে সাধারণ জাতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেখানে মহিলাকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বে আদেশ ও নিষধকরণের কাজে নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু সাধারণ চাকরী-বাকরীর ক্ষেত্রে যাকাত সংক্রান্ত কর্মচারী তন্মধ্যেই গণ্য- এই হাদীসটি প্রযোজ্য নয়।
অনেকে যুক্তি দেখিয়েছেন, যাকাত সংক্রান্ত কাজে কোন মহিলাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তার কোন নজীর নেই। আগের কালের লোকেরাও তা করেন নি, শেষের দিকের লোকেরাও নয়। অতএব নিছক এ ব্যাপারই প্রমাণ করে যে, তা জায়েয নয়।
কিন্তু এটা কোন দলীল হল না। ইসলামের স্বর্ণযুগে মহিলারা অর্থনৈতিক ও সামষ্টিক কাজে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিল না। কিন্তু কার্যত তাদেরকে নিয়োগ না করা একথা প্রমাণ করে না যে, তা হারাম।
কেউ কেউ বলেছেন আল্লাহর ব্যবহৃত শব্দ (আরবী*********) মহিলাদের শামিল করে না। কেননা এটা পুংলিঙ্গের শব্দ।[(আরবী************)] এই দলীলটি মোটেই যথার্থ নয়। কেননা তাই যদি গৃহীত হত তাহলে ফকীর, মিসকীন, গারেমীন ইত্যাদি শব্দও পুংলিঙ্গ, মহিলাদেরকে তাতেও শামিল করা যাবে না। কিন্তু তা তো ইজমার পরিপন্থী। কেননা এসব ক্ষেত্রেই মহিলারা পুরুষদের অধীন অনুষঙ্গ হিসেবে শামিল রয়েছে। সম্বোধন ও ব্যবহৃত শব্দসমূহ বাহ্যত পুরুষদের জন্যে হলেও তাতে কোন ক্ষতি নেই। সত্যি কথা হচ্ছে এ পর্যায়ে যাকাত সংক্রান্ত কাজে মাহিলাদের নিয়োগ করা নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে বিশেষ কোন দলীলই নেই। তবে সাধরণ নিয়ম-কানুন হচ্ছে মহিলাদেরকে পুরুষদের ভিড় ও অবাধ মেলামেশার স্থান ও কেন্দ্র থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। বিনা প্রয়োজনে এসব ক্ষেত্রে মহিলাদের যাওয়াই অনুচিত। এ কারণেই এ কাজে মহিলাদের অপেক্ষা পুরুষদেরই নিযুক্ত করা উচিত। তবে সীমিত পরিবেষ্টনীতে মহিলাদেরও এ কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন বিধবা ও অক্ষম মহিলাদের নিকট যাকাতের মাল পৌছে দেয়ার কাজ তারা করতে পারে। অন্তত পক্ষে এ কাজে মহিলারা যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন। অনুপাতে তারা মজুরীও পেতে পারবে। মহান উদার শরীয়াতে এ ধরনের সুযোগ না দেয়ার মত কোন সংকীর্ণতা নেই।
৮. অনেকে শর্ত আরোপ করেছেন, কর্মচারী হিসেবে স্বাধীন মুক্ত নাগরিককেই নিয়োগ করতে হবে, ক্রতদাস নয়। কিন্তু অন্যরা এই মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা দলীল হিসেবে আহমাদ ও বুখারী বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**********)
তোমরা শোন, আনুগত্য কর, তোমাদের ওপর চেপটা মাথার কোন ক্রিতদাসকে প্রশাসক বানিয়ে দেয়া হলেও।
আর যেহেতু ক্রিতদাস হলেও তার দ্বারা কাজ সুসম্পন্ন করানো যেতে পারে, তাই সেও ঠিক মুক্ত স্বাধীন নাগরিকদের মতই।
কর্মচারীকে কত দেয়া হবে
কর্মচারী মাসিক বেতনভুক্ত। কাজেই তাকে একটা পরিমাণ বেতন বা ভাতা দিতে হবে যা তার প্রয়োজন পুরণে যথেষ্ট হবে। এটা তার মজুরী মাত্র। তা তার সামাজিক মর্যাদার দৃষ্টিতে নিম্নমানের হওয়া উচিত নয় যেমন, তেমনি খুব বেশি বাড়াতিও হওয়া উচিত নয়। ইমাম শাফেয়ী থেকে বর্ণিত, যাকাত ফাণ্ড থেকে কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্য অনুপাতে দেয়া উচিত। তার এই মতটি বিভিন্ন প্রকারের দ্রব্যমূল্যে সমতা বিধানের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের বেতন যদি দ্রব্যমূল্যের তুলনায় অধিক দিতে হয় তা হলে তা যাকাত ছাড়া অন্য ফাণ্ড থেকে দেবে।
জমহুর ফিকাহবিদগণ মনে করেন, যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের বেতন যাকাত থেকেই দিতে হবে। কুরআনের কথা থেকে তাই মনে হয়। তারা যাকাত থেকেই পেতে পারে, দ্রব্যমূল্যের তুলনায় অধিক হলেও।
ইমাম শাফেয়ী থেকে প্রাপ্ত বর্ণাও তাই বলে। তবে তাঁর এ মতটি যুক্তিভিত্তিক কেননা তাতে ফকীর ও যাকাত যাওয়ার যোগ্য অন্যান্য লোকদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কর’ সংক্রান্ত হাদীসের সাথেও তার মিল রয়েছে। তাতে সংগ্রহ-ব্যয়ে মধ্যম নীতি অবলম্বন করাকে ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে।
নিযুক্ত কর্মচারী ধনী হলেও তাকে তার ভাতা বা বেতন দিতে হবে। কেননা সে তো তার কাজের মজুরী গ্রহণ করছে তার প্রয়োজনে, কনোরূপ সাহায্য বাবদ নয়। আবূ দাউদ নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
যাকাত পাঁচ জন লোক ছাড়া অপর কোন ধনী ব্যক্তির জন্যে জায়েয নয়। আল্লাহর পথে যুদ্ধকারী, তার কর্মচারী, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, কেউ যদি তা স্বীয় মালের বিনিময়ে ক্রয় করে নেয়, অথবা এমন ব্যক্তি যার প্রতিবেশী মিসকীন ছিল, সে অপর এক মিসকীনকে দান করল। এই মিসকীন ব্যক্তি কোন ধনী ব্যক্তিকে হাদিয়া হিসেবে দিল-এই হচ্ছে পাঁচ জন।[ইমাম নববী তাঁর المجموع গ্রন্থে লিখেছেনঃ এ হাদীসটি হাসান বা সহীহ। আবূ দাউদ এটি দুইটি সুত্রে বর্ণনা করেছেন।]
যাকাতের মালের প্রতি লোভের ওপর রাসূলের কঠোরতা
কোন কর্মচারী যদি যাকাত সংক্রান্ত কাজে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল বেতনভুক্ত হয়, তাহলে তাকে যাকাত সংগ্রহের কাজ নির্দেশমতই করে যেতে হবে। তা ব্যয় ও বণ্টনও করতে হবে বিধান অনুযায়ী। যাকাতের কোন মাল স্বীয় মুনাফা বা সুবিধা অর্জনের কাজে ব্যবহার করতে পারবে না, করা জায়েয হবে না। যা সংগৃহীত হয়েছে তার থেকে কম কি বেশি- কোন পরিমাণের মালই সে গোপন করতে পারবে না। কেননা তা জনগণের মাল। তার ওপর কারুর লোভ হওয়া বা বিনা অধিকার তা থেকে কিছু গ্রহণ করা জায়েয হতে পারে না। এ পার্যায়ে যেসব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে তা পড়লে কলিজা ফেঁপে উঠে, পরিণামের ভয়ে শরীর শিউরে উঠে। যে মালে কারুর হক নেই তার প্রতি তার কোন রূপ লোভ হওয়াটা কঠিন আযাবের কারণ হবে।
হযরত আদী ইবনে উমাইরাতা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, “আমি রাসূলে করীম (স) কে বলতে শুনেছিঃ
(আরবী******************)
আমরা যাকে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করেছি, সে যদি একটি সুচও বা তার চাইতেও বড় জিনিস গোপন করে রাখে, তাহলে তা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। কিয়ামতের দিন তা অবশ্যই ফেরত দিতে হবে।
এ কথা শুনে আনসার বংশের এক কালো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আমি তার প্রতি তাকিয়েছিলাম- বললেনঃ হে রাসূল! আপনি আপনার কাজ আমার নিকট থেকে ফেরত নিয়ে নিন। রাসূল (স) বললেনঃ কেন, তোমার কি হয়েছে? লোকটি বললেন, আমি শুনলাম, আপনি এই এই বলেছেন। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমি এখনই বলেছি; আমরা তোমাদের মধ্য থেকে যাকেই কোন কাজে নিযুক্ত করেছি, সে যেন তার সামান্য বা বেশি –সবই সুসম্পন্ন করে মালসমূহ নিয়ে আসে। তাকে যা দেয়া হবে, সেতাই নেবে, আর যা নিতে নিষেধ করা হবে, তা থেকে সে বিরত থাকবে।’ (মুসলিম, আবূ দাউদ)
আবূ রাফে’ থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি রাসূলে করীমের সঙ্গে ’জান্নাতুল বাকি তে চলছিলেন। নবী করীম (স) সহসা বলে উঠলেনঃ তোমার জন্যে দুঃখ, তোমার প্রতি ঘৃণা। আবূ রাফে বলেনঃ আমি মনে করলাম, রাসূলে করীম (স) আমাকে লক্ষ্য করেই বুঝি এরূপ উক্তি করলেন। তাই আমার পক্ষে এই উক্তি খুবই ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আমি চলার গতিতে একটু মন্থরতা অবলম্বন করলাম। রাসূলে করীম (স) আমার এরূপ অবস্থা দেখে বললেনঃ কি হয়েছে তোমার বল। আমি বললামঃ আপনি কি কোন কথা বলেছেন? বললেনঃ তাতে তোমার কি? বললামঃ আপনি আমার জন্যে দুঃখ আরোপ করেছেন। বললেনঃ না তোমাকে নয়। অমুক ব্যক্তিকে অমুক গোত্রের যাকাত আদায়ের জন্যে আদায়কারী নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলাম। সে যাকাতের মাল থেকে একটা সুতির কাজ করা পশমী চাদর চুরী করেছে। ফলে সে ঐ রকমেরই একটা আগুনের চাদর পরিধান করেছে।’ নাসায়ী ও ইবনে খুজাইমা নিজ নিজ সহীহ সংকলনে এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।
উবাদাহ ইবনে সামেত থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) তাঁকে যাকাত সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করে পাঠিয়েছিলেন। তখন বলে দিলেনঃ হে আবূ অলীদ! আল্লাহকে ভয় কর, তুমি কিয়ামতের দিন এমন উট নিয়ে আসতে পারবে না, যা উটের আওয়াজ দিতে থাকবে, কিংবা এমন গাভী যার হাম্বা রব হবে অথবা এমন ছাগী যার মি, মি আওয়াজ হবে। বললেনঃ হে রাসূল! সত্যই কি তাই হবে নাকি? বললেনঃ হ্যাঁ, যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম করে বলছি। একথা শুনে উবাদাহ বললেনঃ যে আল্লাহ আপনাকে পরম সত্যতা সহকারে পাঠিয়েছেন তাঁর নামে শপথ করে বলছি, আপনার কোন কাজ করব না। বর্ণনাটি তাবারানী তার আল-কাবীর, গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদ সহীহ।
উবাদাহ এরূপ ঘোষণা দিলেন কেন, তিনি তো একজন মুসলিম? বলেছেন, তাঁর নিজের দ্বীনী সালামতী রক্ষার জন্যে, বিপদের আশংকা থেকে আত্মরক্ষা করা জন্যে, খারাপ পরিণতির ভয়ে- তিনি হয়ত তার মধ্যে পড়ে যাবেন, অথচ তিনি টেরও পাবেন না এই আতংকে।
বেতবভুক্ত কর্মচারীদের জন্যে দেয়া উপঢৌকন ঘুষ
যাকাত কার্যে নিয়োজিত বেতনভুক্ত কর্মচারীদের জন্যে যেমন যাকাতের এক বিন্দু জিনিস লুকিয়ে রাখা বা হস্তগত করা জায়েয নয়,- তা একটি সুঁচই হোক না-কেন, অনুরূপভাবে মালদার লোকদের প্রদত্ত কোন উপঢৌকন গ্রহণ করাও তাদের পক্ষে জায়েয হতে পারে না, তা ব্যক্তিগতভাবে তাকেই দেয়া হলেও। কেননা এটা ঘুষ গণ্য হবে, যদিও নাম হবে হাদিয়া বা তোহফা- উপঢৌকন। যেহেতু সে তো তার কাজের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে বেতন-মজুরী গ্রহণ করছে সরকারের নিকট থেকে। অতএব যাকাতদাতাদের কাছ থেকে তার অতিরিক্ত একবিন্দু জিনিসও গ্রহণ করতে পারবে না। গ্রহণ করলে কুরআনে নিষিদ্ধ বাতিল উপায়ে লোকদের মাল ভক্ষণ করা হবে। উপরন্তু মালদারদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণে সে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তাতে ফকীর-মিসকীনের হক নষ্ট হবে। সেই সাথে সে খারাপ দোষের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। আর যে লোক নিজেকে সন্দেহের অবস্থায় ফেলে দেয় তার প্রতি লোকদের ধারণা খারাপ হয়ে যাওয়ার দরুন তিরষ্কৃত ও ভৎসিত হতে হবে তাকে।
আবূ হুমাইদ সায়েদী থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) আজদ গোত্রের ইবনে লাতবিয়া নামের এক ব্যক্তিকে যাকাত সংক্রান্ত কাজে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। সে যখন কর্মস্থল থেকে ফিরে এলো, তখন কিছু ধন-মাল দিয়ে বললেঃ এগুলো আমাকে উপঢৌকন দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে নবী করীম (স) দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। শুরুতে যথারীতি হামদ ও সানা পড়লেন। পরে বললেনঃ অতপর কথা হচ্ছে, আমি তোমাদের একজনকে একটা কাজের জন্যে নিযুক্ত করি সেই অধিকারের বলে যা আল্লাহ আমার ওপর অর্পণ করেছেন। লোকটি কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে বলেঃ এ মাল তোমাদের জন্যে আর এ মাল আমাকে তোহফা-হাদিয়া দেয়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাস করি, তার এ কথা সত্য হলে তার পিতামাতার ঘরে তার বসে থাকার পরও তার নিকট হাদিয়া তোহফা আসতে থাকা উচিত। (কিন্তু তা তো হবার নয়।) আল্লাহর শপথ, তোমাদের কেউই তার হক ছাড়া কিছু গ্রহণ করলে কিয়ামতের দিন তাকে সেই জিনিস বহন করে নিয়ে এসে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াতে হবে। আমি সেই লোককে নিশ্চয়ই চিনব না যে আল্লাহর সম্মুখে উট বহন করে নিয়ে আসবে। আর উট চিৎকার করতে থাকবে। কেউ গাভী বহন করে নিয়ে আসবে, তা হাম্বা রব করতে থাকবে। অথবা কেউ একটা ছাগী নিয়ে আসবে, সেটিও মি, মি, করতে থাকবে। তারপর তিনি দুই হাত উপরে তুললেন এমনভাবে যে, তার দুই বগলের শ্বেত দৃশ্যমান হয়ে পড়ল। তিনি বলছিলেনঃ হে আমাদের আল্লাহ! আমি কি পৌছিয়েছি? বুখারী, মুসলিম ও আবূ দাউদ হদীসটি নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন।
যাকাত সংগ্রহকারীদের প্রতি নবী করীমের উপদেশ
যাকাত আদায়ে নিযুক্ত লোকদের প্রতি নবী করীম (স) বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা সহকারে উপদেশ দিতেন, লোকদের প্রতি নম্র ব্যবহার, দয়া প্রদর্শন ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করার জন্যে তাগিদ সহকারে বলতেন। ওদিকে তিনি তাঁর সাহাবীদের মধ্য থেকে বাছাই করা উত্তম লোকদেরই এই কাজে নিযুক্ত করতেন। কৃষি ফসল ও ফলের যাকাত সংগ্রহের জন্যে তিনি সাহাবীদের মধ্য থেকে সেই লোকদের নিযুক্ত করতেন যারা ফল বা ফসলের যাকাত-পরিমাণ অনুমান করে বলতে পারতেন অর্থাৎ ফল ও ফসল কাটাই মাড়াইর পূর্বেই আনুমানিকভাবে বলে দিতেন এতে এতটা ফসল হবে এবং তার যাকাত-পরিমাণ আনুমানিক এত। ইবনে আবদুল বার-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী এরূপ আগাম আনুমানিক পরিমাণ নির্ধারণের বড় ফায়দা হত, মালের মালিকের পক্ষ থেকে তার ওপর কোনরূপ যাকাত-বিরোধী হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা। অনুমাণ করার পর তার চাইতে যদি কম হয় তাহলে সে কমতির দাবি অকাট্য প্রমাণ ব্যতিরেকে গ্রহণ করা হবে না। এতে করে ফকীর-মিসকীনের পাওনাটা নিশ্চিত হতে পারবে এবং যাকাত আদায়কারী দাবি থাকবে পরিমিত পরিমাণের মধ্যে।
ফল ফাকড়ার পরিমাণ অনুমান পর্যায়ে আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। নবী করীম (স) ফলের পরিমাণ অনুমান করা জন্যে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। তাদের বলেছিলেনঃ পরিমাণটা কম করে ধর, কেননা ধন-মালের ক্ষেত্রে ওসিয়ত থাকে, ধার উদ্ধার থাকে, পড়ে যায় অনেক, পাখ-পাখালীরা অনেক খেয়ে যায়, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার ব্যাপার ঘটে। বস্তুত এটা হত নবী করীমের সাবধান ও সতর্কবাণী, যাকাতদাতাদের অনুগ্রহের দৃষ্টি রাখার জন্যে যাকাত আদায়কারীদের প্রতি এটা ছিল তাঁর শুভ আচরণ গ্রহণের আহ্বান। তাদের এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হত যে, ধন-মালের ওপর যাকাত ছাড়া আরও অনেক দাবি দাওয়া থাকে। মানুষ তা অস্বীকার করতে পারে না, এর মধ্যে কোন কোন দাবি ব্যক্তি নিজের জন্যে বাধ্যতামূলক বানিয়ে নেয়। কতগুলো স্বাভাবিক অবস্থার পরিণতিতে হয়ে থাকে।
মালের মালিকদের জন্যে দোয়া
বস্তুত যাকাত ধন-মালের মালিকরা দেয় স্বীয় আন্তরিক ইচ্ছা ও প্রেরণায়। সে তা দিয়ে মহান আল্লাহর নিকট তা কবুল হোক, এটাই চায়। ঠিক এ কারণেই ফরয যাকাত ও সাধারণ কর এবং খাজনা-ট্যাক্স ইত্যাদির মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য হয়ে থাকে। যাকাত সংগ্রহকারীরা যাকাতদাতার জন্যে দোয়া করা জন্যে নির্দেশিত। কুরআনের আয়াতেই বলা হয়েছেঃ ’তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধতা দিয়ে এবং তাদের জন্যে দোআ কর। কেননা তোমার এই দোয়া তাদের জন্যে বিরাট সান্ত্বনার কারণ।’
আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা থেকে বর্ণিত, তাঁর পিতা রাসূলে করীম (স) এর নিকট তাঁর নিজের ধনমালের যাকাত নিয়ে উপস্থিত হল। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ হে আল্লাহ! আবূ আওফার বংশধরদের প্রতি পূর্ণ মাত্রায় রহমত নাযিল কর। [আহমাদ, বুখারী, মুসলিম]
মুসলিম জনকল্যাণমুলক কাজে ব্যতিব্যস্ত লোকদের কি যাকাত কাজের কর্মচারী মনে করা হবে
ইবনে রুশদ উল্লেখ করেছেন, ফিকাহবিদগণ যাকাত সংক্রান্ত কর্মচারীদের জন্যে তা থেকেই বেতন ভাতা গ্রহণ করা জায়েয; তারা ধনী হলেও সেই সাথে বিচারক এবং যাদের দ্বারা সাধারণ মুসলিম জনগণের কল্যাণ সাধিত হচ্ছে, তাদের সকলের জন্যে যাকাত ফাণ্ড থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জায়েয বলেছেন। [বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, ২৮৬ পৃঃ]
আবাজিয়া ফিকাহর কিতাব আন নাইল এবং তার শারহে গ্রন্থ উদ্ধৃত হয়েছে যাকাত দেয়া যাবে তার কাজে নিযুক্ত কর্মচারী এবং এই ধরনের অন্যান্য লোকদেরও যেমন বিচারক, প্রশাসক, মুফতি ও অন্যান্য যারা সামষ্টিক কাজে ব্যস্ত থাকে। এই মাসলাটার রায় ঠিক করা হয়েছে কর্মচারীদের ওপর কিয়াস করে। অতএব তাদের দায়-দায়িত্ব, ব্যস্ততা ও ইসলামের দিক দিয়ে তাদের কাজের কল্যাণকামিতা অনুপাতে- তারা যদি ধনী লোক হয় তবুও। কেননা মুসলিম জনগণের কাজে একান্তভাবে ব্যস্ত থাকার কারণে তারা নিজেদের জন্যে আয় করার কাজে মনোনিবেশ করতে পারেনি। [আরবী************)]
কিন্তু সাধারণ ফিকাহবিদগণ এই লোকদিগকে যাকাত ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রীয় আয় যা ফাই, বা খারাজ ইত্যাদি নামে অভিহিত- থেকে বেতন দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তবে যাকাতের অন্যতম ব্যয় ক্ষেত্র ফী সবীলিল্লাহ এর পরিধি অধিকতর বিশাল ও বিস্তীর্ণ করে ধরে নেয়া হলে সেটা সম্ভব। তাতে প্রতিটি কল্যাণমূলক কাজই অন্তর্ভুক্ত হবে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তরিত আলোচনা করা হবে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যাদের মন সন্তুষ্ট করা প্রয়োজন
এই পার্যায়ে সেই লোক গণ্য যাদের মন ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্যে, কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে অথবা যাদের দুষ্কৃতি থেকে মুসলিম জনগণকে রক্ষা করার জন্যে বা তাদের থেকে রক্ষা পাওয়ার কাজে তাদের অনুকূল্য লাভের আশায় অথবা মুসলমানদের শত্রুদের ওপর কোনরূপ বিজয় লাভের উদ্দেশ্যে তাদের সাহায্য প্রয়োজনীয় বলে এদের জন্যে যে অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হবে, যাকাত ফাণ্ড থেকে তা করা যাবে।
এই খাতটির ফায়দা
এই খাতটি পর্বে বলা কথাকে অধিকতর স্পষ্ট করে আমাদের জানিয়ে দেয় যে, যাকাত কোন ব্যক্তিগত দয়া-অনুগ্রহের ব্যাপারে নয়। নিছক ইবাদতও নয় তা, যা শুধু ব্যক্তিগতভাবেই আদায় করলে চলবে। কেননা এই খাতটি সাধারণত ব্যক্তিগতভাবে পালন পর্যায়ে নয়। আসলে তা রাষ্ট্রপ্রধানের কিংবা তার প্রতিনিধির করণীয় কিংবা জাতির কর্তৃত্বসম্পন্ন অপর কোন ব্যক্তির পালনের ব্যাপারে। এই লোকেরাই বুঝতে পারে, কোন লোকদের মন সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন কিংবা কাদের তা করতে হবে না। কাদের মন সন্তুষ্ট করতে হবে এবং সেজন্যে অর্থব্যয় করতে হবে ইসলামের অগ্রাগতি ও মুসলিম জনগণের কল্যাণের জন্যে, তাদের গুণ-পরিচয় নির্ধারণ করাও তাদেরই করণীয়।
এই লোকদের কয়েকটি ভাগ
এ পার্যায়ের লোক যেমন কাফির সমাজের মধ্যে থাকবে, তেমনি থাকতে পারে মুসলিম নামে পরিচিত লোকদের মধ্যেওঃ
ক. যাকে অর্থ দিলে সে বা তার গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়, তারা এই পর্যায়ে গণ্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন নবী করীম (স) সাফওয়ান ইবনে ইমাইয়্যাকে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন এবং তার দাবি অনুযায়ী তার ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণের জন্যে চারটি মাস সময় নির্ধারণ করেছিলেন। পরে সে নিরুদ্ধেশ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হুনাইন যুদ্ধকালে উপস্থিত হয়ে সে মুসলমানদের সাথে যোগদান করে, অথচ তখন পর্যন্ত সে ইসলাম কবুল করেনি। নবী করীম (স) এই যুদ্ধে যাত্রা করার পূর্বে তার অস্ত্রশস্ত্র ধান নিয়েছিলেন এবং তিনি তাকে বিপুল সংখ্যক উট দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেনঃ এটা সেই দান যা পাওয়ার পর দারিদ্র্য সম্পর্কে কোন ভয় থাকে না। মুসলিম ও তিরমিযী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব সুত্রে বর্ণনা করেছেন, সাফওয়ান বলেছে, নবী করীম (স) পূর্বে আমার নিকট সর্বাধিক ঘৃণ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তিনি আমাকে ক্রমাগতভাবে দান করেছিলেন। তাঁর নিকট থেকে এই অব্যাহত দান পেয়ে পেয়ে এমন অবস্থা হলে যে, তিনিই হয়ে গেলেন আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। [(আরবী*************)]
এই লোকটি পরে ইসলাম কবুল করে খুবই ভাল মুসলমান হয়েছিল।
ইমাম আহমাদ সহীহ সনদে হযরত আনাস সূত্রে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) এর নিকট ইসলামের নামে যা কিছু প্রার্থনা করা হত, তিনি তা অবশ্যই দান করতেন। এ ব্যক্তি এসে তাই প্রার্থনা করেছিল। নবী করীম (স) তাকে বহু সংখ্যক ছাগল দিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। এগুলো যাকাত নিজের গোত্রের লোকদের নিকট উপস্থিত হল, বললঃ হে লোকেরা, তোমরা ইসলাম কবুল কর। কেননা মুহাম্মাদ (স) লোকদের এত বেশি দান করেন যে, অতপর আর দরিদ্র বা অনশনের ভয় করতে হয় না।’ [(আরবী*************)] এ দানও এই পর্যায়ে শামিল।
খ. যে লোকের দুষ্কৃতির ভয় করা হয়, তাকে টাকা-পয়সা দিলে তার দুষ্কৃতি এবং তার সাথে সাথে অন্যদের ক্ষতিকর কার্যকলাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়, তাকেও এই যাকাত থেকে দেয়া যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে, কতগুলো লোক নবী করীম (স) এর নিকট বারে বারে আসত। তিনি যদি যাকাতের সম্পদ থেকে কিছু দিতেন, তাহলে তারা ইসলামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হত। বলত, এ উত্তম দ্বীন। আর কিছু না দিলে তারা দোষ গেয়ে বেড়াত ও গালমন্দ বলতে শুরু করত। এই ধরনের লোকদেরও যাকাত ফাণ্ড থেকে দেয়া যায়। [(আরবী*************)]
গ. নতুন ইসলাম গ্রহণকারী লোকেরা (অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখিন হয় বলে) তাদের আর্থিক সাহায্য করতে হয়। তবেই তারা ইসলামের স্থির ও অটল হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়।
আল-মুয়াল্লাফতু কুলুবুহুম- শব্দদ্বয়ের ব্যাখ্যা ইমাম জুহরীর নিকট জানতে চাওয়া হয়েছিল জবাবে তিনি বললেন, যে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবে, সেই এর মধ্য গণ্য। জিজ্ঞেস করা হল, সে যদি ধনী লোক হয়? বললেন, সে যদি ধনী লোক হয়, তবুও তাকে এই ফাণ্ড থেকে সাহায্য দেয়া যাবে। [(আরবী*************)] হাসান বলেছেন, যারা (নতুনভাবে) ইসরাম কবুল করবে, তারা সকলেই সাহায্য পাওয়ার অধিকরী। [(আরবী*************)]
কেননা নতুন ইসলাম গ্রহনকারী ব্যক্তি তার পূর্বতন ধর্ম ত্যাগ করেছে, তার পিতামাতা ও বংশ-পরিবারের নিকট তার প্রাপ্য ধন-মালের দাবিও প্রত্যাহার করেছে।
তার বংশের বহু লোকই তার সাথে শত্রুতা করতে শুরু করে দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে তার জীবিকার সব পথ ও উপায় বন্ধ বা বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরূপ দুনিয়ার স্বার্থ ত্যাগকারী ও আল্লাহর জন্যে নিজেকে বিক্রয়কারী ব্যক্তি ইসলাম ও মুসলিম সমাজের নিকট থেকে বিপুল উৎসাহ ও সাহায্য-সহযোগীতা পাওয়ার অধিকারী, তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
ঘ. মুসলিম সমাজের নেতৃস্থানীয় ও কর্তা ব্যক্তিদের পক্ষে অনেক কাজের লোকদের সাথে সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা এবং চিন্তার আদান-প্রদান করার সুযোগ ঘটে। অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারে। এই সময় তারা যদি তাদের কিছু দান করে, তাতে তারা ইসলামের প্রতি খুবই আশাবাদী হয়ে উঠতে পারে। হযরত আবূ বকর (রা) আদী ইবনে হাতেম ও জারকার ইবনে বদরকে অনেক দান-উপঢৌকনে ধন্য করে দিয়েছিলেন। তাদের নিজ জাতির লোকদের নিকট তাদের উচ্চতর মর্যাদার কারণে ইসলামের প্রতি তাদের আচরণ খুবই উত্তম ছিল। [(আরবী*************)]
ঙ. দুর্বল ঈমানের নেতৃস্থানীয় মুসলমানরাও এই শ্রেণীভুক্ত। তারা জনগণের নিকট অনুসৃত, তাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তাদেরকে অর্থদান করা হলে তারা ইসরামে স্থিত থাকবে, তাদের ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদ তাদের নিকট থেকে মূল্যবান আনুকূল্য পাওয়া যাবে বলে খুবই আশা করা যায়। নবী করীম (স) সমাজের এই শ্রেণীর লোকদিগকে হাওয়াজিন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের মাল থেকে বিপুল পরিমাণ দান করেছিলেন। এরাই মক্কার সেসব লোক ছিল, যাদেরকে নবী করীম (স) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। পরে তারা খুবই পাক্কা মুসলিম হয়ে গিয়েছিল, যদিও পূর্বে তারা হয় মুনাফিক, না হয় দুর্বল ঈমানের লোক ছিল। পরবর্তীকালে ইসলামী আদর্শ পালনে তাদের দৃঢ়তা আদর্শস্থানীয় হয়েছিলে। [(আরবী*************)]
চ. অনেক মুসলামন শত্রুদেশের সীমান্তে একেবারে মুখের কাছে অবস্থিত থাকে। শত্রুদের আক্রমণ হলে তারা প্রতিরক্ষামূলক কাজ করে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারে। এদেরকেও যাকাত ফাণ্ড থেকে সাহায্য দেয়া যেতে পারে।
ছ. অনেক মুসলমান সমাজে এমন প্রভাবশালী হয়ে থাকে যে, তাদের বাস্তাব সহযোগীতা না হলে- তারা প্রভাব বিস্তার না করলে ও চাপ সৃষ্টি না করলে যাকাত সংগ্রহ করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অন্যথায় সেজন্যে যুদ্ধ করার প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে। এই কারণে তাদেরকে সন্তুষ্ট রেখে তাদেরকে সরকারের সহযোগী ও সাহায্যকারী বানিয়ে রেখে কাজ করা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তা করা দুটো মারাত্মক কাজের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর কাজ, দুটো কল্যাণমূলক কাজের মধ্যে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য কল্যাণ পথ। এই কাজটি আংশিক হলেও অনেক সময় সাধারণের জন্যে অধিক কল্যাণের কারণ হতে পারে। [(আরবী*************)]
এই সকল পর্যায়ের লোকেরা (আরবী***********) এর অন্তর্ভুক্ত তারা কাফির হোক, কি মুসলিম।
ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, যারা ইসলামে দাখিল হল তারাই এর মধ্যে গণ্য হবে। কোন মুশরিক ব্যক্তির হৃদয় ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাকে যাকাত ফাণ্ড থেকে দেয়া যাবে না। কেউ যদি বলে যে, খোদ নবী করীম (স) হুনাইন যুদ্ধের বছর কোন কোন মুশরিকের হৃদয় সন্তুষ্ট করার জন্যে দান করেছেন, তাহলে আমি বলব হ্যাঁ, তা দেয়া হয়েছিল ফই সম্পদ থেকে, বিশেষভাবে নবী করীম (স) এর জন্যে নির্দিষ্ট অংশ থেকে, যাকাত থেকে নয়।
ইমাম শাফেয়ী এই বলে দলীলের ব্যাখ্যা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের যাকাত তাদের মধ্যেই বণ্টন করে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কার্যকর করেছেন, দ্বীনের বিরুদ্ধবাদীদের দেয়ার কোন ব্যবস্থা করেন নি। [১১১১] তিনি হযরত মুয়ায বর্ণিত হাদীসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যাতে বলা হয়েছেঃ যাকাত মুসলামনদের ধনী লোকদের নিকট থেকে নেয়া হবে এবং তাদের মধ্যকার ফকীরদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।
ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে ওয়াহিদী থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করে লিখেছেন, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের হৃদয় সন্তুষ্ট বা আকৃষ্ট করার কাজ থেকে মুসলমানকে রক্ষা করেছেন। মুসলিম রাষ্ট্রনেতা যদি মনে করেন, কোন কল্যাণের জন্যে- যার ফায়দাটা মুসলমানরাই পাবে- যেমন তারা যদি মুসলিম হয়ে যায়, তা হলে যাকাত ফাণ্ড থেকে কাফির মুশরিকদের অর্থ সাহায্য দেয়া যাবে। কিন্তু কোন মুশরিকের জন্যে যাকাতের মাল ব্যয় করার দরকার হলে তা ফাই সম্পদ থেকে করতে হবে, যাকাত থেকে নয়।
শেষে তিনি লিখেছেন, ওয়াহিদীর এই কথা- আল্লাহ মুশরিকদের হৃদয় সস্তুষ্ট করার ঝামেলা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেছেন- এই ভিত্তিতে বলা যায় যে, নবী করীম (স) যাকাতেরই একটা অংশ মুশরিকদের দিয়েছেন। কিন্তু তা কখনই প্রমাণ করা যাবে না। আয়াতটিতেও এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে না যা থেকে বোঝা যাবে যে, আল-মুয়াল্লাফতু কুলুবুহুম বলে বুঝি মুশরিকদেরই বুঝিয়েছেন। বরং এ কথার মধ্যে সাধারণভাবেই মুসলিম-অমুসলিম সব শ্রেণীর লোকই শামিল রয়েছে।
কাতাহাহ থেকে বর্ণনা পাওয়া গেছে, মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহম’ কথাটি এক শ্রেণীর মরু বেদুঈন লোক বোঝায়। সেই সাথে তাদের ছাড়াও লোকজন ছিল, যাদের হৃদয় নবী করীম (স) সন্তুষ্ট করেছেন দানের সাহায্যে, যেন পরবর্তীকালে তারা ইসলাম কবুল করে।
হযরত আনাস বর্ণিত হাদীস থেকে জানা গেছে, নবী করীম (স) যে ব্যক্তিকে যাকাত বাবদ আদয়কৃত ছাগল দিয়েছিলেন, সেই লোকটি নিজের গোত্রের লোকদের সম্বাধন করে বলেছিলেন, হে লোকেরা! ইসলাম কবুল কর! কেননা মুহাম্মাদ (স) এমন দান করেন যে, তারপর আর অভুক্ত থাকার কোন আশংকাই থাকে না। এ থেকে মনে হয়, দান পাওয়ার সময় সে মুসলিম ছিল না।
বস্তুত কোন কাফির ব্যক্তির অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার বা তার অন্তরে ইসলামের প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের দেয়া যাকাত থেকে কাফিরকে দান করা খুব একটা বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। কেননা ইমাম কুরতুবী যেমন বলেছেন- এটাও এক প্রকারের জিহাদ। কেননা মুশরিকরা তিন প্রকারের। এক প্রকারের মুশরিক লোক অকাট্য যুক্তি প্রমাণ পেয়ে শিরক ত্যাগ করে ইসলাম কবুল করতে পারে। আর এক প্রকারের মুশরিক বল প্রয়োগ ও শক্তি বিনিয়োগের ফলে ইসলাম কবুল করবে। আর এক প্রকারের মুশরিক দান ও অনুগ্রহের বশবর্তী হয়ে ইসলাম কবুল করতে পারে। আর ইসলাম রাষ্ট্রকর্তা সচেতন থেকে সর্বাদিকে নজর রেখে এসব শ্রেণীর মুশরিকদের ওপর অর্থ ব্যয় করতে পারবে, যার পরিণতিতে তারা কুফরী ও শিরক থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং এই অর্থ ব্যয়ই তার কারণ হবে। [(আরবী*********)]
রাসূলের ইন্তেকালের পর এই খাতটি কি পরিত্যক্ত
ইমাম আহমাদ এবং তাঁর সঙ্গিগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, যাকাত ব্যয়ের কুরআন নির্দেশিত এই খাত – আল মুল্লাফাতু কুলুবুহুম- যথাপূর্ব কার্যকর আছে, তা বাতিল বা মনসূখ হয়ে যায়নি, তাতে কোনরূপ পরিবর্তনও আনা হয়নি। ইমাম জুহরী এবং আবূ জাফর আল-বাকেরও এই মতই প্রকাশ করেছেন। এই শেষোক্ত মতটি জাফরী ও জায়দীয়া মাযহাবের। [(আরবী*********)]
ইউনূস বলেছেন, ইমাম জুহরীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ এটা মনসূখ হওয়ার কোন কথাই আমার জানা নেই।
আবূ জাফর আন-নুহাম বলেছেন, তার অর্থ, এই খাতটি পুরোপুরি সক্রিয় এবং কার্যকর রয়েছে। একালেও কারুর মন সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন দেখা দিলে এবং তার থেকে মুসলমানদের কোন ক্ষতি বা বিপদ হওয়ার আশংকা থাকলে অথবা উত্তরকালে তার ভাল মুসলিম হওয়ার আশা করা গেলে তাকে এই ফাণ্ড থেকে দেয়া যাবে।
কুরতুবী মালিকী মাযহাবের কাযী আবদুল ওহাবের এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ কোন কোন সময় প্রয়োজন দেখা দিলে তোমরা তা দাও।’
কাযী ইবনুল আরাবী বলেছেন, আমার মত হচ্ছে, ইসলাম শক্তিশালী হলে এই খাতে আর অর্থ ব্যয় করা যাবে না। তবে এই খাতে ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দিলে তা দেয়া যাবে, যেমন নবী করীম (স) নিজে তা দিতেন। কেননা সহীহ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, ইসলাম অপরিচিত অবস্থায় শুরু হয়েছে, আবার অপরিচিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যাবে- যেমন শুরু হয়েছিল।’
নাইল কিতাবে এবং তার শরাহে গ্রন্থে আবাজীয়া ফিকাহর মত লিখিত হয়েছেঃ আমাদের মতে এই খাতটি পরিত্যক্ত থাকবে যদ্দিন ইসলামী রাষ্ট্রকর্তা শক্তিশালী থাকবে ও এই লোকদের কিছু দেয়ার প্রয়োজন থাকবে না—— প্রয়োজনে এই খাতেব্যয় করার অনুমতি রয়েছে, মুসলিম সমাজকে তাদের শত্রুভাবপন্ন লোকদের দুষ্কৃতি থেকে রক্ষা করার জন্যে, কিংবা কোন সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্য।
তাহাবী হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, এ কালে এমন কেউ নেই, যার হৃদয় সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন হতে পারে।[১১১১] আমের আশ-শা’বী বলেছেন, মুয়াল্লাফতু কুলুবুহুম’ কার্যকর ছিল রাসূলে করীম (স) এর সময়ে। পরে যখন হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা হল তখন এই ঘুষের ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে গেল। [২২২২২]
ইমাম নববী ইমাম শাফেয়ীর মত উদ্ধৃত করেছেন তা হলো কাফিরদের মনস্তুষ্টির জন্যে অর্থ ব্যয় করার অনুমতি হলেও তা করা হবে ফাই (রাষ্ট্রের অন্যান্য আয়ের) সম্পদ থেকে কল্যাণের কাজের জন্যে, যাকাত থেকে দেয়া যাবে না। কেননা যাকাতে কাফিরদের কোন অধিকার বা হক স্বীকার করা হয়নি।
আর মুসলমানদের মধ্যে যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন দেখা দেবে, তাদেরকে নবী করীম (স) এর দেয়ার ব্যাপারে তাঁর দুটো কথা রয়েছে। প্রথম কথা দেয়া যাবে না। কেননা, আল্লাহ তাআলা দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী বানিয়ে দিয়েছেন বলে টাকা পয়সা দিয়ে লোকদের মন জয় করার প্রয়োজন থাকেনি। এবং দ্বিতীয় কথা দেয়া যাবে। কেননা যে ধরনের লোকদের আগে দেয়া হয়েছে, নবী করীম (স) এর পরও সেই ধরনের লোক থাকতে পারে। যদি দেয়া হয়, তাহলে কোথেকে কোন ফাণ্ড থেকে দেয়া হবে?
এখানেও তাঁর দুটো মত জানা গেছে। একটি মতে বলা হয়েছে, যাকাতের ফাণ্ড থেকে দেয়া হবে। কেননা কুরআনের আয়অতে তাই রয়েছে। আর দ্বিতীয় মত, ‘ফাই’ সম্পদের কল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে দিতে হবে। কেননা এরূপ অবস্থায় তাদের জন্যে অর্থ ব্যয় করা গোটা মুসলিম সমাজেরই কল্যাণ সাধন। [(আরবী*********)]
মালিকী মাযহাবের দুটো মত জানা গেছে। একটি মত, এই খাতটাই ছিন্ন হয়ে গেছে ইসলামের শক্তিশালী হওয়া ও পূর্ণত্ব প্রকাশ পাওয়ার দরুন। আর অপর মত অনুযায়ী, এই খাতটি অবশিষ্ট আছে। কাযী আবদুল ওহাব ও কাযী ইবনূল আরাবীল মত ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। [(আরবী*********)]
‘খলীল’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই খাতটি কার্যকর আছে, এটি মনসূখ হয়ে যায়নি। কেননা যাকাত দেয়অর উদ্দেশ্য হল, তাদরেকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা, তাদের কোন সাহায্য লাভ করা নয়। শেষ পর্যন্ত ইসলাম বিস্তীর্ণ হয়ে পড়লে তখন তা শেষ হয়ে যাবে। মতের এ পার্থক্য হচ্ছে এই কথায় যে, যার সন্তুষ্টির জন্যে টাকা দেয়া হবে সে লোকটির কাফির। তাকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী বানাবার উদ্দেশ্যে দেয়া হবে। ইবন হুবাইবও এই মত দিয়েছেন। দ্বিতীয় কথা, সে ব্যক্তি মুসলিম হবে। খুব অল্প সময় হয়েছে, সে ইসলাম কবুল করেছে। তাকে যাকাত দেয়া যাবে, যেন সে ইসলামের ওপর দৃঢ় ও অীবচল হয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় এ খাতটি অবশ্যই কার্যকর মনে করতে হবে। তাতে কোন দ্বিমতের স্থান নেই। [(আরবী*********)]
জমহুর হানাফী ফিকাহ্বিদদের বক্তব্য হল, এ খাতের অংশটি মনসূখ হয়ে গেছে, বাতিল হয়ে গেছে। নবী করীম (স)-এর পর এ পর্যায়ে কোন জিনিসই দেয়া হয়নি, এখনও এ পর্যায়ে কোন কিছুই দেয়া যাবে না।
বাদায়ে-ওয়াস-সানায়ে’ গ্রন্থে এ মতটিকে সহীহ্ বলা হয়েছে। যেহেতু হযরত আবূ বকর (রা) ও উমর (রা) ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম’ খাতে যাকাত থেকে কাউকে কিছু দেন নি। কোন সাহাবীও তাঁদের এই না দেয়ার কাজের প্রতিবাদ করেন নি। বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স)-এর ইন্তিকালের পর এই শ্রেণীর লোকেরা হযরত আবূ বকরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের অংশ চাইলে তিনি একখানি সরকারী পত্র লিখে দিলেন তাদেরকে তাদের প্রাপ্য দেয়ার জন্যে। পরে তারাই হযরত উমরের নিকট এসে সেই পত্র দেখিয়ে তাদের প্রাপ্য চাইলে তিনি তাদের নিকট থেকে পত্রটি নিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেললেন। বললেন: রাসূলে করীম (স) তোমাদের দিতেন তোমাদরে হৃদয় ইসলামের দিকে আকৃষ্ট ও আগ্রী বানানোর জন্যে। কিন্তু এক্ষণে আল্লাহ্ তা’আলা দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী করে দিয়েছন। এখন তোমরা যদি ইসলামে স্থিত থাক তো ভাল নতুবা তোমাদের ও আমাদের মধ্যে তরবারিই মীমাংসা করে দেবে, তারা আবার হযরত আবূ বকরের নিকট ফিরে গিয়ে বললো, ‘ খলিফাতুল মুসলিমীন’ আপনি, না উমর? …… বললেন, হ্যাঁ সেও হবে আল্লাহ্ চাইলে, তিনি তাদের কথার প্রতিবাদ করলেন না, পরে সাধারণ সাহাবীদের মধ্যে কথাটি প্রচারিত হয়ে পড়ে। তারাও এ ব্যাপারে কোন উচ্চ-বাচ্য করলেন না। তাহলে দেখা গেল, এ খাতিটর অকেজো হয়ে পড়ার ব্যপারে সমস্ত সাহাবীই একমত এবং এ মতেই ইজ্মা হয়ে গেছে, মনে করতে হবে।
তাছাড়া এ কথা তো সর্বসম্মত যে, নবী করীম (স) তাদেরকে দিতেন ইসলামের ব্যপারে তাদের মন তুষ্ট করার জন্যে। আল্লাহ্ এজন্যেই নাম দিয়েছেন ‘আল-মুয়াল্লাফাতুল কুলুব’। তখনকার সময়ে ইসলাম শক্তিশালী ছিল না। মুসলমানদের সংখ্যাও ছিল অনেক কম। আর ওরা ছিল সংখ্যায় বিপুল এবং শক্তিশালী। আল্লাহ্র শোকর, আজকের দিনে ইসলাম অনেক শক্তিশালী। তাদের সংখ্যাও অনেক। তাদের শক্তি-সামর্থ্যও কম নয়- ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত। মুশরিকরা বরং অনেক হীন ও লাঞ্ছিত। এই বিধানটি যখন বিশেষ অর্থে যুক্তিসঙ্গত, তখন সেই বিশেষ অর্থ নিঃশেষ হয়ে গেলে বিধানটিও থাকতে পারে না। [(আরবী*********)]
বাদায়ে-ওয়াস-সানায়ে গ্রন্থে যা কিছু বলা হয়েছে, তার সার হচ্ছে দুটি কথা।
একটি এই যে, বিধানটি মনসূখ হয়ে গেছে। সাহাবীদের ইজমাই এটিকে মনসূখ করেছে।
দ্বিতীয়টি এই যে, সন্তুষ্টির জন্যে অর্থ ব্যয়ের নির্দেশটি ছিল একটি বিশেষ অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। আর তা হচ্ছে এরূপ কাজের প্রয়োজন ও অপরিহার্যতা। কিন্তু ইসলামের ব্যাপক প্রসারতা ও প্রাধান্য লাভের দরুন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তার অর্থ, একটা কারণের দরুন একটা কাজের হুকুম দেয়া হলে সেই কারণটি যখন থাকবে না, তখন হুকুমটিও বাতিল হয়ে যাবে। তাই যে কারণে এই লোকদের যাকাতের অর্থ দেয়া হত, সেই কারণটি যখন থাকল না- দেয়ার বিধান করা হয়েছিল দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী বানানোর জন্যে, এক্ষণে তা অর্জিত হয়েছে। কাজেই তখন সেই হুকুম অবশিষ্ট থাকতে পারে না।
মুনসূখ হওয়ার দাবি অগ্রহণযোগ্য
সত্য কথা, উপরিউক্ত দুটো কথাই অসত্য। কেননা একে তো আয়াতটি মনসূখ হয়নি এবং দ্বিতীয়ত মনস্তুষ্টি সাধনের প্রয়োজন কিছুমাত্র ফূরিযে যায়নি।
হযরত উমরের উপরিউক্ত কথার ভিত্তিতে এ কথা মনে করা মুয়াল্লাফাতুল কুলুব খাতটি বুঝি সম্পূর্ণ মনসূখ হয়ে গেছে, আদৌ ঠিক নয়। কেননা সেটা কোন দলীল নয়। তিনি তাঁর কথার দ্বারা নবী করীম (স) এর সময়ে এক শ্রেণীর লোকদের যাকাত দিয়ে সন্তুষ্ট রাখার হত, তাদের প্রতি এই খাতটি নিষিদ্ধ ও অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করেছেন মাত্র। তিনি মনে করেছেন, এদেরকে যাকাত দিয়ে সন্তুষ্ট রাখার আর কোন প্রয়োজন নেই। কেননা এক্ষনে আল্লাহ ইসলামকে শক্তিশালী করে দিয়েছেন। এদের ওপর নির্ভরশীলতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিনি যা বলেছেন, তাতে তিনি প্রকৃত সত্যকে একবিন্দু অতিক্রম করে যান নি। কেননা সন্তুষ্ট রাখার কাজটি কোন সদাসক্রিয়, প্রতিষ্ঠিত ও অপরিবর্তনীয় ব্যাপার নয়। এককালে যাদের এ খাত থেকে টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা হত, চিরদিন তাদের সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকবে এমন কোন কথা নেই। সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্ধারণ করা সাম্প্রতিক রাষ্ট্র পরিচালকের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং ইসলামের উন্নতি ও মুসলমানদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে তার পরিমান নির্ধারণও তারই কাজ।
ফিকাহর মৌল নীতি বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, বিশেষ একটা হুকুমকে এমন একটা গুণের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দয়া যা অপর একটি অবস্থা থেকে নিঃসৃত, যা ঐ নিঃসৃতির কারণের সাথে জড়িত। এখানে যাকাত ব্যয়ের কাজটি জড়িতে করা হয়েছে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব এর সাথে। তা থেকে বোঝা গেল যে, মনতুষ্টি সাধন কারণ বা ইল্লাত হচ্ছে যাকাত ব্যয়ের। তাই এ কারণটি যখন পাওয়া যাবে- সে কারণ হল মন সন্তুষ্ট রাখার মত লোক থাকা- তখন তাদের অবশ্যই তা দেয়া হবে। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহলে দেয়া হবে না।
কারুর মন সন্তুষ্ট রাখার জন্য যাকাতের অর্থ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার কার? প্রথমত তা মুসলিম রাষ্ট্রকর্তার। কেননা সেই মুসলমানদের পক্ষ থেকে কাজ করার অধিকারী এবং দায়িত্বশীল। কাউকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য টাকা দেয়া- পূর্ববর্তী শাসকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেয়া হত, পরে তা বন্ধ করা- এসব কিছুর ইখতিয়ার তারই। কোন শাসকের আমলে এ রকমের লোক থাকার দুরন একবার দেয়ার সিদ্ধান্ত করা, আবার যখন সে রকমের লোক থাকবে না বা তার প্রয়োজনও হবে না, তখন তা না দেয়া তার ইচ্ছাধীন। কেননা এগুলো ইজতিহাদী ব্যাপার, যা কাল, স্থান ও অবস্থার তারতম্যের কারণে বিভিন্ন রকম হতে পারে। হযরত উমর যখন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন তিনি কুরআনের অকাট্য দলিলকে অকেজো করে দেন নি, শরীয়াতের কোন বিধানকে মনসূখও করেন নি। কেননা যাকাত আল্লাহর নির্দেশ ও বিধান অনুযায়ী আটটি খাতে বণ্টন করা হবে যখন প্রত্যেকটি খাত পাওয়া যাবে। যখন যে খাতের লোক পাওয়া যাবে না, তখন তার অংশ মুলতবি হয়ে গেছে মনে করতে হবে। কিন্তু তখন এ কথা বলা যাবে না যে, এ অংশটি রহিত করে আল্লাহর কিতাবের বিধানকে অকেজো করে দেয়া হয়েছে কিংবা বলা যাবে না যে, তা মনসূখ করা হয়ে গেছে।
যাকাতের জন্য কিযুক্ত কর্মচারী একটা খাত। ইসলামী হুকুমত না থাকলে এ খাতটিও থাকবে না। কেননা যাকাতের জন্যে কর্মচারী নিযুক্ত করা ইসলামী হুকুমতের কাজ ও দায়িত্ব। তাই যখন তা পাওয়া যাবে না, তখন যাকাত জমাও করা হবে এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বণ্টনও করা হবে। এ কাজে যারা দায়িত্বশীল হবে, তাদেরও মাসিক বেতন দেয়া হবে। কিন্তু ঠিক العاملين عليها বলে যে খাতটির উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অংশ প্রত্যাহার করা হবে।
যেমন فى الرقاب বলে যাকাত ব্যায়ের যে খাতের কথা বলা হয়েছে, যদি তা না পাওয়া যায় যেমন বর্তমান কালে দাস প্রথার অস্তিত্ব নেই- তা হলে এ খাতটি মুলতবী মনে করতে হবে। এ মুলতবী করার অর্থ নিশ্চয়ই এই হবে না যে, কুরআনের আয়াত মনসূখ করা হয়েছে কিংবা একটা বিধানকে অকেজো করে দেয়া হয়েছে। [এ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, সমসাময়িক কালের যেসব লোক বলেন যে, কুরআনের বিধান অকেজো করা এবং প্রয়োজন দেখা দিলে তা বিরোধিতা করা জায়েয এবং হযরত উমরের মুয়াল্লাফাতুল কুলুব সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত করা সম্পূর্ণরূপে বাতিল ও অগ্রণযোগ্য। সাবহী মাখমাবানী তার فلسفة التشريع গ্রন্থে ১৭৮ পৃষ্ঠায় দাবি করেছেন যে, শরীয়াতী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বা মুসলিম জনগণের কল্যাণ চিন্তায় কুরআনের অকট্য দলিলের বিরোধিতা করতে হযরত উমর দ্বিধা করেন নি- একটু বিলম্বও করেন নি। আর তার দলিল হিসেবে তিনি মুয়াল্লাফাতুল কুলুব সংক্রান্ত পদক্ষেপের উল্লেখ করেছেন। তার এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। উস্তাদ মাহমুদ আল-লাবাবিদী রিসালাতুল ইসলাম’ নামক কায়রো থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় (আরবী************) শীর্ষক এক প্রবন্ধে দাবি করেছেন যে, জাতি তার সার্বভৌমত্ব নিঃসৃত শূরার প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে কুরআনের কোন কোন অকাট্য দলীলকে অকেজো করে রাখা বা তার বিরোধিতা করার অধিকারী যদি তারা তাতেই কল্যাণ নিহিত বলে মনে করে। এবং এই মতের স্বপক্ষে হযরত উমরের কথিত পদক্ষেপকে দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এটাও সম্পূর্ণ ভুল কথা জামে আজহারের আলিমগণ এই মতের প্রতিবাদ করেছেন। মরহুম শেয়খ মুহাম্মাদুল মাদানীও তার এক রচনায় উপরিউক্ত মতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।]
এ থেকে স্পষ্ট হল যে, হযরত উমর যা করেছেন, তা মুয়াল্লাফাতুল কুলুব কে যাকাত দেয়ার নির্দেশকে কোন না কোন কারণ দর্শিয়ে বাতিল বা মনসূখ করে দয়ার কাজ নয়, তার ওপর ইজমা অনুষ্ঠিত হওয়া তো অনেক দূরের কথা। হাসান, শা’বী প্রমুখ ফিকাহবিদও বলেছেন, আজকের দিনে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব নেই। কোন অবস্থায়ই কুরআনের হুকুম মনসূখ করার কথা বলা হয়নি; বরং সেকালের প্রকৃত অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে মাত্র।
মনসূখ করা কাকে বলে? আল্লাহর শরীয়াতের কোন বিধানকে যদি বাতিল করা হয় বলা হয় এই কাজটা করা হবে না, তাহলে মনসূখ করা বোঝায়। আর যে সত্তা বা সংস্থা আইন প্রণয়ন করে, সেই তা মনসূখ বা বাতিল করতে পারে, অন্য কেউ তা পারে না। ইসলামে আইন প্রণয়নকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনি রাসূলের প্রতি অহী নযিল করার পন্থায় এই কাজটি করেছেন। কাজেই কোন বিধান মনসূখ হতে পারে রাসূলে করীমের জীবদ্দশায় ও অহী নাযিল হওয়া কালে। আর তা আসল আইন প্রণয়নকারীর নিজের ঘোষণা থেকেই জানা যেতে হবে। অথবা দুটো কুরআনী বিধানের মধ্যে যদি চূড়ান্ত মাত্রায় পারস্পরিক বিরোধিতা বা বৈপরীত্য দেখা দেয় এবং একটিকে অপরটির ওপর অগ্রাধিকার দেয়ার মত অবস্থাও না থাকে- দুটো বিধানের ইতিহাসও যদি জানা থাকে, ঠিক তখনই বলা যাবে যে, শেষের হুকুমটি আগের হুকুমটিকে মনসূখ করে দিয়েছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়ে কি সেই অবস্থা দেখা দিয়েছে? এখানে কুরআনের বা সুন্নাতের কোন বিধান কি মুয়াল্লাকাতুল কুলুব বিধানটির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাড়িয়েছে? না, তা হয়নি। শুধু তা-ই নয়। এখানে মনসূখ হওয়ার কোন দলিল আদৌ নেই। উপরিউক্ত প্রশ্নের জবাবে এই দৃঢ় নেতিবাচক কথাই বলা যেতে পারে।তাহলে আল্লাহর কিতাবের একটি সুস্পষ্ট আয়াত প্রদত্ত হুকুম মনসূখ হয়ে গেছে বলে কি করে দাবি করা যেতে পারে? রিসালাতের আমলে তো এই নীতি অনুযায়ী কাজ হয়েছে। সেই আমল নিঃশেষে অতীত হয়ে যাওয়ার পর এখন মনসূখ হওয়ার কথা কোনক্রমেই বলা যেতে পারেনা।
এ অবস্থাকে সামনে রেখেই ইমাম শাতেবী বলেছেনঃ শরীয়াত পালনে বাধ্য ব্যক্তির শরীয়াতের আইন কার্যকর হওয়ার পর উহার মনসূখ হয়ে যাওয়ার দাবি কেবলমাত্র প্রমাণিত দালিলের ভিত্তিতেই করা যেতে পারে। কেননা তা আগেই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং শরীয়াত পালনকারী তা পালনও করেছে। কাজেই প্রমাণিত ও কার্যকর হওয়ার কথা জেনে নেয়ার পর তা প্রত্যাহৃত হওয়ার কথা অনুরূপ জ্ঞানের ভিত্তিতেই মেনে নেয়া যেতে পারে। এ কারণে বিশেষজ্ঞগণ একমত হয়ে বলেছেন, খবরে ওয়াহিদ (হাদীস) কুরআনকে মনসূখ করতে পারে না, পারে না মুতাওয়াতির হাদীস তা মনসূখ করতে। কেননা তা পারলে নিছক অনুমানভিত্তিক কথার বলে অকাট্য নিশ্চিত কথা কে প্রত্যাহার করা শামিল হবে। [(আরবী***********)]
খবরে ওয়াহিদ’ যখন কুরআনকে মনসূখ করতে পারে না- যদিও তা রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত, তখন একজন সাহাবীর কথা বা আমলের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কুরআনের আয়াত মনসূখ হওয়ার কথা আমরা কি করে বলতে পারি?…….. একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, হযরত উমরের উপরিউক্ত কথাকে মনসূখ করার অর্থে কোনক্রমেই গ্রহণ করা যেতে পারে না। শাতেবীর পূর্বে ইবনে হাজম বলেছেন, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য কুরআন ও সুন্নাহর কোন বিষয় সম্পর্কে তা মনসূখ হয়ে গেছে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ছাড়া দাবি করা আদৌ হালাল বা জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেনঃ (আরবী**************)
আল্লাহর অনুমতিক্রমে আনুগত্য ও অনুসরণ করা হবে-এ উদ্দেশ্যেই আমরা রাসূল পাঠিয়েছি। [(আরবী************)]
বলেছেনঃ (আরবী**************)
তোমরা মেনে চল তা, যা তোমাদের আল্লাহর নিকট থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। [(আরবী************)]
অর্থাৎ আল্লাহ কুরআনে কিংবা নবীর জবানীতে যা কিছুই নাযিল করেছেন, তা সবই মেনে চলা ফরয। কেউ যদি তার কোন জিনিস মনসূখ হয়েছে বলে দাবি করে, তাহলে সে সেই বিধান না মানাকে নিজের জন্যে বাধ্যতামূলক করে নিচ্ছে, তা পালনের বাধ্যবাধকতাকে সে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করছে। বস্তুত এটাই হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানী ও সুস্পষ্ট আল্লাহদ্রোহীতা। তবে কেউ যদি তার এ ধরনের কথা যথার্থতা প্রমাণের পক্ষে অকাট্য দলিল পেশ করতে পারে, তবে তার কথা নিশ্চয়ই বিবেচ্য হবে। অন্যথায় সে অহংকারী দাম্ভিক ও বাতিলপন্থী প্রমাণিত হবে। এই যা কিছু বলা হল তার বিপরীত কথা যদি কেউ নিয়ে আসে, তাহলে তার কথার তাৎপর্য হবে আল্লাহ প্রদত্ত সমগ্র শরীয়াতকে অকেজো করে দেয়া। কেননা কোন আয়াত বা হাদীস মনসূখ হয়েছে বলে কারুর দবি করা ও অপর ব্যক্তির অপর কোন আয়াত বা হাদীস মনসূখ হয়েছে বলে দাবি করার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। কারণ, এ রূপ অবস্থায় কুরআন ও সুন্নাহর কোন বিধানই সহীহ অবস্থায় থাকতে পারবে না। আর তাকেই বলা হয় ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া। উপরন্তু যা দৃঢ় প্রত্যয়ের ভিত্তিতে প্রমাণিত তা অনুমানের সাহায্যে বাতিল করা যেতে পারে না। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন তার মনসূখ হওয়ার কথা দৃঢ় প্রত্যয়ের ভিত্তিতে প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত- যাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ থাকবে না- সেই নির্দেশ প্রত্যাহার করা যেতে পারে না। [(আরবী************)]
তাহলে এক্ষনে যথার্থ সহীহ কথা হচ্ছে, যাকাত বণ্টনের খাত হিসেবে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব খাতটি যথাযথভাবে বর্তমানে এবং কার্যকর রয়েছে। তা মনসূখ হয়ে যায়নি, অকেজো করেও রাখা হয়নি। সূরা তওবার আয়াত তা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে।
আর কুরআনের সর্বশেষ সূরাই হচ্ছে এই সূরাটি। আবূ উবাইদ বলেছেন, এতদসংক্রান্ত আয়াতটি সুদৃঢ়। তার মনসূখ হওয়া সম্পর্কে কোন কথাই কুরআন-সুন্নাহ থেকে জানা যায়নি।
তাই কোন জাতির লোকজনের অবস্থা যদি এই হয়- ইসলামে কোন আল্লাহ নেই শুধু কিছু পাওয়ার লোভ ছাড়া, আর তাদের মুরতাদ হয়ে যাওয়া ও তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরিণামে যদি ইসলামের ক্ষতি হওয়ার আশংকা দেখা দেয়- যদি তাদের দরুন ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি হয় ও প্রতিরোধ মজবুত হয় এবং রাষ্ট্রনেতা তাদেরকে যাকাত ফাণ্ডের কিছু অর্থ বা সামগ্রী দেয়া ভালো মনে করে, তাহলে তার পক্ষে তা করা সম্পূর্ণ জায়েয হবে তিনটি কারণেঃ
একটি, তাতে কিতাব ও সুন্নাত অনুযায়ী আমল হবে।
দ্বিতীয়, মুসলমানের স্থিতি লাভ হবে। এবং
তৃতীয়, তাদের প্রতি কোন নৈরাশ্য দেখা দেবে না, তারা ইসলামে দাঁড়িয়ে থাকলে ইসলামের উপলব্ধি অর্জন করতে পারবে ও ইসলামের প্রতি তাদের উত্তম আগ্রহও হবে। [(আরবী************)]
ইবনে কুদামাহ আল মুগনী গ্রন্থে যাকাত ব্যয়ের অনতম খাত হিসেবে এই খাতটির স্থায়ী, অপরিবর্তিত ও কার্যকর থাকার হাম্বলী মাযহাবের মত সমর্থন প্রসঙ্গে বলেছেনঃ আমাদের দলীল হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাত। আল্লাহ যাদের জন্যে যাকাত নির্ধারণ করেছেন তাদের মধ্যেই মুয়াল্লাফাতুল কুলুব দের কথাও বলেছেন। নবী করীম (স) বলেছেন, আল্লাহই যাকাত পর্যায়ে বিধান দিয়েছেন, তার আটটি অংশ নির্দিষ্ট করেছেন।’ বহু কয়টি সর্জনবিদিত হাদীসে আল মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে। রাসূলে করীম (স) এর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত তা পুরোমাত্রায় কার্যকর ছিল। আর আল্লাহ ও রাসূলের কোন বিধান মনসূখ না হওয়া পর্যন্ত তা পালন ত্যাগ করা যেতে পারে না। সম্ভব্যতার ভিত্তিতে কোন কিছুর মনসূখ হওয়া কোনক্রমেই প্রমাণিত হতে পারেনা।
উপরন্তু শরীয়াতের কোন কিছুর মনসুখ হওয়া সম্ভব ছিল নবী করীম (স) এর জীবদ্দশায়। কেননা সে জন্যে অকট্য দলীলের প্রয়োজন। কিন্তু নবীর ইন্তেকালের পর এ ধরনের অকাট্য দলীল কোথাও পাওয়া যেতে পারে না। অহীর নাযিলকাল শেষ হওয়ার পর সে দলীল কোথেকে আসবে? তাছাড়া কুরআনের আয়াত কুরআন দ্বারাই মনসূখ হতে পারে। কিন্তু কুরআনের উক্ত আয়াতটির মনসুখ হওয়ার কোন কথা নেই। হাদীসেও কিছু নেই। তা হলে শুধু কিছু লোকের মত, জোর-জবরদস্তি কিংবা কোন সাহাবীর কথার দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহর বিধান কেমন করে তরক করা যেতে পারে? সাহাবীদের কথা এমন দলিলও নয় যাদ্বারা কিয়াস পরিহার করা যেতে পারে। তাহলে এই লোকেরা কুরআন ও সুন্নাহ কেমন করে পরিহার করতে পারে একজন সাহাবীর কথার ভিত্তিতে?
ইমাম জুহরী বলেছেন, মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম মনসূখ হওয়ার কোন কথাই আমার জানা নেই। [আল-মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ বিধানটি মনসূখ হয়েছে অথচ তা অকাট্য কুরআনী দলীল দ্বারা প্রমাণিত- হানাফীদের এই মতে এক মনসূখ করল, তাই নিয়ে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ রয়েছে। তাদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, এ বিষয়ে ইজমা হয়েছে। হযরত উমর তার আমলে এই খাতটি অকেজো করেছিলেন এবং সাহাবীদের কেউ তার প্রতিবাদ করেননি, এটিকেই ইজমা বলে মনে করেছেন। কিন্তু এ যে কত অন্তঃসারশূন্য কথা, তা আমরা আগেই জানতে ও বুঝতে পেরেছি। কেউ কেউ ইজমাকে সনদযুক্ত প্রমাণ করে তাকেই মনসূখকারী বলে ধরে নিয়েছেন। পরে আবার তার সনদযুক্ত হওয়ার নির্ধারণে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। ইবনে নজীম (আরবী*****) গ্রন্থে সূরা কাহাফের আয়াতঃ (আরবী*************) টিকে হযরত উমর আল মুয়াল্লাফাতু আয়াতের মুকাবিলায় দাড় করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে আবেদীন বলেছেনঃ ইজমা কে উক্ত আয়াতের নাসেখ মনে করা হয়নি। কেননা তা সহীহ নয়। মনসূখ হওয়া তো সম্ভব ছিল রাসূলের জীবদ্দশায়। আর ইজমা হতে পারে রাসূলের ইন্তেকালের পর। কেউ কেউ হযরত মুয়াযকে ইয়েমেনে প্রেরণ সংক্রান্ত হাদীসকে নাসেখ গণ্য করেছেন। দেখঃ (আরবী**************) সত্য কথা হচ্ছে এই ধরনের ঘটনা দ্বারা কোন অকাট্য আয়াত মনসুখ হতে পারে না। সূরা কাহাফের যে আয়াতটি উল্লেখ করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে মক্কী সূরা। তার দ্বারা কি করে মদীনায় অবতীর্ণ একটি সর্বশেষকালের আয়াত মনসূখ হতে পারে- প্রথমটির দীর্ঘ কয়েক বছর পরে নাযিল হয়েছে।
তাছাড়া আয়াত দুটোর মধ্যে কোন পারস্পারিক বৈপরীত্যও নেই। তাই একটির দ্বারা অন্যটিকে মনসুখ করারও কোন প্রয়োজন দেখা দেয়নি। হযরত মুয়ায সংক্রান্ত হাদীসও তাই। তাতে শুধু এই টুকু কথা বলা হয়েছে যে, যাকাত জনগণের নিকট থেকে নিয়ে জনগণের মধ্যেই বণ্টন করতে হবে। তা পূর্ববর্তী রাজা-বাদশাহদের ধার্য করা কর বা খাজনার মত নয়। তা তো গরীবদের নিকট থেকে নিয়ে ধনীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। উক্ত হাদীসে শুধু ফুকারা গরীব লোকদের মধ্যে বণ্টনের কথা বলার দরুন মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম এর খাত মুছে যায়নি। তাহলে তো অন্যান্য তার জন্যে নিয়োজিত কর্মচারী, ঋণগ্রস্ত, দাস প্রভৃতির অংশও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত হয়। কিন্তু তাতো হয়নি, কেউই সে মত দেন নি।
এজন্যে হানাফী মতের ফিকাহ্বিদ আলাউদ্দিন ইবনে আবদুল আজীজ বলেছেন, উত্তম হচ্ছে এরূপ বলাঃ এ হচ্ছে নবী যুগের কর্মপদ্ধতির প্রতিবেদন তাৎপর্যগতভাবে। মূয়াল্লাফাতুল কুলুব দের যাকাতের অংশ দেয়ার মূলে লক্ষ্য ছিল ইসলামকে শক্তি দান করা, কেননা তখন তা দুর্বল ছিল, তখন কুফর ছিল প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী। কিন্তু পরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, ইসলাম বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন না দেয়াতই ইসলামের শক্তি ও মর্যাদা রক্ষিত হয়। সেকালে দেয়া ও একালে না দেয়া উভয়ই দ্বীন-ইসলামকে শক্তিসম্পন্ন করার একটা উপায় ছিল। আর তাই ছিল লক্ষ্য। তা সর্বাবস্থায়ই হতে পারে। কাজেই মনসূখ হয়ে যায়নি।……. বলেছেন, এ ব্যাপারটি গোটা গোত্রের ওপর খুনের দিয়েত দায়িত্ব চাপানের মত। কেননা নবী করীম (স) এর যুগে গোটা কবীলার ওপর ওয়াজিব ছিল। পরবর্তীকালে তা আহলি দিওয়ানের ওপর বর্তায়। কেননা দিয়েত দেয়ার দায়িত্ব গোত্রের ওপর চাপানোর উদ্দেশ্য ছিল সকলের সাহায্য গ্রহণ। এ সাহায্য কর্মে নবীযুগে গোত্রই এগিয়ে আসত। পরবর্তীকালে আহলি দিওয়ানের সঙ্গে জুড়িয়ে দেয়া হয়। তার অর্থ এই নয় যে, পূর্বরটি মনসুখ হয়েগেছে বরং সেই তৎপর্যকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যার দরুন দিয়েত ওয়াজিব করা হয়েছিল।
আর তা হচ্ছে সাহয্য চাওয়া। নিহায়া গ্রন্থ এই ব্যাখ্যাকে পসন্দ ও সমর্থন করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণের সারকথা হল, ইসলাম যদি কখনও দুর্বল অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়- যেমন আমাদের এই যুগে তাহলে যাকাত থেকে মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম দের অংশ দিয়ে তাকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা পাওয়া উচিত। তবে হানাফী মতে এটা জায়েয নয়। এই কারণে ইবনুল হুম্মাম তাদের সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, হানাফীরা যেমন বলেন, তা আসলে মনসূখ হয়ে যায়নি। কেননা তাদের দেয়াটা শরীয়াতের বিধান, সুপ্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত। পরে তার প্রয়োজন থাকে না। (তাফসীর রুহুল মায়ানী- আ-লুসী, ৩য় খণ্ড, ৩২৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)]
তবে যে তাৎপর্যের কথা ফিকাহবিদগণ বরেছেন, তা এবং কিতাব ও সুন্নাতের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা তাদের প্রতি মুখাপেক্ষিতা এই হুকুমটির মুলতবী হওয়া জরুরী করে না। আর কেবলমাত্র এখনই এই খাতে দেয়া বন্ধ করা যেতে পারে, যখন তাদের প্রতি মুখাপেক্ষিতা দূর হয়ে যাবে। অতএব যখনই তাদেরকে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে, তাদের দিতে হবে। যাকাতের অন্যান্য খাত সম্পর্কেও এই কথা। সে কয়টির মধ্যে কোন একটি খাতের প্রয়োজন কোন সময় ফুরিয়ে গেলে ঠিক সেই সময়ের জন্যে এই খাতটি মুলতবি থাকবে। আবার যখন প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন আবার তা দিতে শুরু করতে হবে। [(আরবী*********)]
মন তুষ্ট করার প্রয়োজন কখনই ফুরায় না
যাঁরা বলেন, ইসলামের ব্যাপক প্রচার সাধিত হওয়ার কারণে ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম’ খাতে যাকাতের অংশ ব্যয়ের ও এ পর্যায়ের লোকদের তা দেয়া প্রয়োজন নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং এক্ষণে ইসলাম দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মের ওপর প্রাধান্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের এই কথা তিনটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়ঃ
১. মালিকী মাযহাবের কোন কোন ফিকাহবিদ যেমন বলেছেন, মুয়াল্লাফ বা সন্তুষ্ট করার জন্যে যাকাতের অংশ দেয়ার কারণ আমাদের জন্যে তাদের সাহায্য করা নয়। কাজেই তা ইসলামের বিস্তৃতি ও আধিপত্য লাভের দরুন বাতিল হয়ে যাবে না। বরং এই দেয়ার উদ্দেশ্য হল তাদের মনে ইসলামের প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ জাগিয়ে তোলা। আর তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দান।
এই মতে মনে করা হয়েছে, এ খাতটি কার্যকর থাকলে তা ইসলামী দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়ার একটা উপায় হতে পারে যা কোন কোন লোকের নিকট পাওয়া যেতে পারে এবং তার দ্বারা তাদেরকে ইসলামের নিকটে আনা ও কুফর থেকে তাদেরকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। আর যে কোন উপায়ে গণমানুষকে হেদায়াত দান দুনিয়ায় তাদেরকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে এবং পরকালের জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচানো সম্ভব, তা বাস্তবে প্রয়োগ করা- এই ধরনের উপায়কে অকেজো করে না রাখা মুসলমানদের জন্যে অবশ্য কর্তব্য। একথা সত্য যে, বৈষয়িক স্বর্থের জন্যেও কেউ ইসলামে প্রবেশ করতে পারে; কিন্তু এওতো সম্ভব যে, ইসলাম এসে সে পাক্কা ও প্রকৃত মুসলিম হয়ে যাবে। হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে আবূ ইয়ালা বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি যদি এমনও হত যে, রাসূলে করীম (স) এর নিকট এসে কোন বৈষয়িক স্বার্থের জন্যে সালাম করত, কেবল তাকেই সালাম দিত, তাহলে পরে এমন অবস্থা দেখা দিত যে, ইসলাম তার নিকট দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়ে গেছে। অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি নবী করীম (স) এ নিকট বৈষয়িক জিনিস চাইত, তাহলে তিনি তাকে তা দিতেন…….. পরবর্তী কথা উক্তরূপ। কোন কাফির ব্যক্তিকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী বানাবার জন্যে দেয়া হলে তাবেই এই কথা বলা যাবে। কিন্তু এ পর্যায়ের সব লোকই সেরকম নয়। এমন অনেক লোকই আছে, যাদের মন সন্তুষ্ট করা হয়েছে, তারা তাদের প্রাচীন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম কবুল করেছে। তখন সে তার পরিবারবর্গ ও সেই ধর্মের লোকদের পক্ষ থেকে চরম বিরোধিতা, শত্রুতা, নির্যাতন ও বঞ্চনার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এরূপ অবস্থায় তাকে যাকাতের অত্র অংশ দিয়ে সাহায্য করা, সাহসী বানানো ও বিপদমুক্ত করা একান্তই কর্তব্য, যেন সে ইসলামে শক্ত হয়ে টিকে থাকতে পারে, ইসলামে তার কদম দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. কারুর মন সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন হয় ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্বলতার কারণে- এই মত যারা পোষণ করেন, তাদের এই মতের ওপর ভিত্তি করেই এই খাতটির মনসুখ হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপর লোকদের মত হল, যার মন সন্তুষ্ট করার জন্যে যাকাতের অংশ দেয়া হবে, তাকে অবশ্যই ফকীর ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি হতে হবে- এটা শর্ত। অথচ এসব বলে বিনা দলিলে আল্লাহর সেই কথাকে শর্ত সম্পন্ন বানিয়ে দেয়া হয়, যার ওপর তিনি নিজে কোন শর্ত আরোপ করেন নি। এতে করে বিনা কারণে শরীয়াতের একটা কর্মনীতির বিরোধিতা করা হয়। আমাদের এই যুগে আমরা দেখছি, বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্র ক্ষদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র বা জাতিকে সন্তুষ্ট করা বা স্বপক্ষে দিচ্ছে, দিচ্ছে উন্নতিশীল বহু প্রাচ্য অঞ্চলের রাষ্ট্রকে। রাশিয়া দিচ্ছে বহু দুর্বল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে। ইমাম হাবারী এ পর্যায়ে যা বলেছেন তা খুবই সুন্দর। কথাটি হচ্ছেঃ
আল্লাহ তায়ালা দুটো মহাসত্যের প্রেক্ষিতে যাকাতের ব্যবস্থা কার্যকর করেছেনঃ
একটা হচ্ছে, মুসলিম জনগণের দারিদ্র্য বিদূকরণ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইসলামকে সহায়তা দান এবং তাকে শক্তিশালী করা। যাকাতের যে অংশ ইসলামের সহায়তা এবং তার কার্যকারণসমুহকে শক্তিশালী করে তোলার কাজে নিয়োজিত হবে তা দেয়া যাবে ধনী, গরীব নির্বিশেষে। কেননা তা তো ইসলামেরই প্রয়োজনে দেয়া হবে তাকে। দ্বীনের সহায়তার জন্যেই দেয়া হবে তা। এই দোয়াটা ঠিক তেমনি, যেমন আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে দেয়া হয়। তা দেয়া হয় সে ব্যক্তি ধনী হোক কি দরিদ্র। দেয়া হয় যেন সে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে, দারিদ্র্য মুক্তির উদ্দেশ্যে নয়। মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম খাতে যাকাত দানের ব্যাপারটি ঠিক তেমনি। তা দেয়া যাবে তারা পারিভাষিক অর্থে ধনী হলেও। এ দেয়াটা ইসলামের স্বার্থে, তাকে শক্তিশালী করে তোলার উদ্দেশ্য, সহায়তার জন্যে।
নবী করীম (স) বহু যুদ্ধে বিজয় লাভের পরও এই দেয়ার কাজ চালু রেখেছেন। অথচ তাখন ইসলাম ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল, মুসলিম জাতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কাজেই যদি কেউ বলে যে, আজ ইসলামের জন্যে কারুর মন সন্তুষ্ট করা যাবে না- তা চাওয়ার লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন তা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে, তবে তার এই কথার যৌক্তিকতা স্বীকার্য হবে না। কেননা নবী করীম (স) বর্তমানের এই গুণের অধিকারী লোকদেরকেই তা দিয়েছেন।[(আরবী*********)]
৩. অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে, দুনিয়া তার পৃষ্ঠকে মুসলিমদের প্রতি ঘুরিয়ে দিয়েছে, তারা পূর্বের ন্যায় দুনিয়ার নেতৃত্ব লাভ করতে পারেনি। বরং ইসলাম আবার অপরিচিত হয়ে পড়েছে, যেমন শুরুতে ছিল। দুনিয়া জাতিসমূহ মুসলিমদের ওপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যেমন করে হিংস্র দানব সন্ত্রস্ত শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হৃদয় মনে একটা কঠিন ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহই সব ব্যাপারের পরিণতির মালিক। ইসলাম ও মুসলিমের চরম দুর্বলতার দিন আবার ফিরে এসেছে। এসেই দুর্বলতা যা মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম খাতে যাকাত ব্যয়ে ইল্লাত বা কারণ হতে পারে এবং তা দেয়া সঙ্গত বিবেচিত হতে পারে। যাকাতের অংশ মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম কে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। দেয়া জায়েয যেমন ইবনুল আরাবী প্রমুখ বলেছেন। [তাবে হানাফীরা নিজেরাই বলেছেন, মন সন্তুষ্টকরণ একটা কারণের ভিত্তিতে হবে, কারণ দর্শনোও নিঃশেষ হয়ে গেছে, এই কথা কোন কারণভিত্তিক নির্দেশ বন্ধ করার দলীল হতে পারে না। কেননা কোন কারণের ভিত্তিতে দেয়া হুকুম তার স্থায়ীত্বের জন্যে সেই কারণের স্থায়িত্বের মুখাপেক্ষী নয়। কেননা অতপর সে হুকুমটি কারণের প্রয়োজনীয়তামুক্ত হয়ে গেছে। যেমন দুসপ্রথা, ইহরামের কাপড় পরার ধরন ও রমল করার নিয়ম। তাই শর্তাধীন বিধিবদ্ধ করা কোন হুকুমের স্থায়িত্ব সেই কারণের স্থিতিরে ওপর নির্ভশীল হওয়ার জন্যে একটা দলিলের প্রয়োজন। তাঁরা আরও বলেছেন, এই ব্যাপারটিকে ইজমার ক্ষেত্রে স্থাপনের কোন প্রয়োজন নেই। দলিল প্রমাণিত হলে আমরা তার ভিত্তিতে হুকুম প্রকাশ করতে পারি। যদিও তা আমাদের জন্যে প্রাকশমান নয়। (রদ্দুল মুহতার, ২য় খণ্ড, ৮২-৮৩ পৃ.) তা সত্ত্বেও হানাফীরা তাদের মতের দুর্বলতা থেকে নিষ্কৃতি পায়নি।]
মন সন্তুষ্টকরণ ও মুয়াল্লাফাতুর জন্যে যাকাত ব্যয়ের অধিকার কার
আমি বলব, মন সন্তুষ্টকরণ এবং তার প্রয়োজন নির্ধারণ ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে মুসলিম রাষ্ট্রনেতার ওপর অর্পিত। এ কারণে নবী করীম (স) নিজে এবং খুলাফায়ে রাশেদুন নিজেরাই এ কাজটি আঞ্জাম দিতেন। ব্যাপারটির প্রকৃতির সাথে এই নীতিই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা এ ব্যাপারটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক নীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সেই সাথে দ্বীন-ইসলাম ও মুসলিম জাতির কল্যাণ চিন্তাও বিশেষভাবে বিবেচ্য থাকবে। [شرح الازهار ১ম খণ্ড ৫১৩ পৃষ্ঠায় লিখিত হয়েছে, সন্তুষ্টকরণের কাজটি কেবলমাত্র রাষ্ট্রনেতারই করণীয় দ্বীনী কল্যাণের দৃষ্টিতে, অপর কারুর পক্ষে তা জায়েয নয়। জায়দীয়া ফিকাহর ভিন্নমত রয়েছে।] আর একালে যেমন, রাস্ট্র যদি যাকাত সংগ্রহ বণ্টন এবং সাধারণভাবে ইসলামী বিধান সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে ইসলামী সামষ্টিক সংস্থাসমূহ রাষ্ট্রের এ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
রাষ্ট্র বা সামাজিক সংস্থা কোনটিই যদি এই দায়িত্ব পালন না করে এবং কোন ব্যক্তি মুসলিমের নিকট যাকাতের মাল অতিরিক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তার পক্ষে এই খাতে যাকাত ব্যয় করা জায়েয হবে কিনা, এ একটা শক্ত প্রশ্ন।
এই গ্রন্থকারের মতে তা জায়েয নয়। তবে অন্য কোন ব্যয় ক্ষেত্র যদি পাওয়াই না যায়, তাহলে অবশ্য জায়েয হবে। যেমন যে সব মুসলমান অনৈসলামী রাষ্ট্রে বাস করে এবং তথায় যাকাত পাওয়ার যোগ্য কোন মুসলমান পাওয়া না যায় এবং দেখতে পায় যে, এমন কাফির লোক রয়েছে যাদের এ টাকা দিলে তাদের মন ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়বে, মুসলিমদের প্রতি বন্ধুত্বসম্পন্ন হবে, তাহলে ঠিক এরূপ অবস্থায় প্রয়োজনের কারণে তা দেয়া যেতে পারে, যদিও এরূপ অবস্থায় ইসলামের প্রচার কার্যে যাকাতের টাকা ব্যয় হওয়া উত্তম যদি তা কোন ইসলামী রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভবপর না হয়।
এ যুগে ‘মুয়াল্লাফাতু’ খাতের টাকা কোথায় ব্যয় করা হবেঃ
‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ খাতটি বাতিল হয়নি এবং যাকাতের অংশ এই খাতে ব্যয় করার অবকাশ এখনও আছে। তাই প্রশ্ন, উঠে, বর্তমান যুগে এই খাতের টাকা কোন কাজে ব্যয় করা হবে?
এই প্রশ্নের জবাব আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শরীয়াতের বিধানদাতা যে উদ্দেশ্যে এ খাতটি রেখেছেন, ঠিক সেই উদ্দেশ্য এ যুগেও তা ব্যয়িত হবে। আর তা হচ্ছে, লোকদের মন ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা এবং ইসলামে প্রতিষ্ঠিত ও দৃঢ় করে রাখার কাজে এই টাকা ব্যয় করা অথবা ইসলামে যারা দুর্বল অবস্থায়, রয়েছে, তাদের শক্তিশালী করার জন্যে ব্যয় করা। ইসলামের সাহায্যকারী লোক সংগ্রহ কিংবা ইসলামী দাওয়াতী আন্দোলন ও ইসলামী রাষ্ট্রের শত্রুদের অনিষ্ট প্রতিরোধ করার কাজেও ব্যয়িত হতে পারবে। কোন কোন সময়ে কোন অনৈসলামী রাষ্ট্রকে মুসলমানদের স্বপক্ষে রাখার জন্যেও তা ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, কোন কোন সংস্থা, গোত্র বা দল কিংবা শ্রেণীকে ইসলামের সহায়তা করার দিকে উৎসাহী বানানো বা রাখার জন্যেও তা ব্যয় করার দরকার হতে পারে। ইসলামের প্রতিরক্ষার কাজে কোন কোন লেখনী বা মুখপাত্র নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে এবং সেজন্যেও এই খাতটি ব্যবহার হতে পারে। ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণাকারীদের মুখ বন্ধ করার জন্যে এবং তাদের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্যেও তা লাগানো যেতে পারে।
যেমন প্রতিবছর লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করে, কিন্তু কোন ইসলামী রাষ্ট্রের নিকট থেকে তারা কোনরূপ সাহায্য-সহযোগিতা পায় না, তাদেরকে একবিন্দু উৎসাহিতও করা হয় না। তাদেরকে এই খাত থেকে সাহায্য দেয়া একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে। তা হলে তাদের কোমর শক্ত হবে, তারা ইসলামে অবিচল হয়ে থাকবে। ইমাম জুহরী ও হাসান বসরী বর্ণিত, খৃষ্টান মিশনারীরা এই ব্যবস্থা নিয়েছে যে, যে লোকই খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করবে তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন এবং বস্তুগত ও সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অনুকূল্য দেয়ার দায়িত্ব তারাই গ্রহণ করে। এসব মিশনারী তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা-পায়সা দিয়েও সাহায্য করে। এভাবে প্রতিবছর বহু সংখ্যক খৃষ্টান মিশনারী প্রতিষ্ঠান সাহায্য দানের কাজ করে যাচ্ছে। দ্বীন ইসলামের ন্যায় তাদের মধ্যে যাকাতের মত কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের পক্ষেই এটা সম্ভব যে, আমরাই যাকাতের একটা বড় অংশ লোকেদের মন সন্তুষ্ট রাখা ও ইসলামের ওপর অবিচল রাখার জন্যে ব্যয় করতে পারি।
বস্তুত ইসলামে সুস্থ প্রকৃতি ও সুষ্ঠু বিবেক-বুদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যসম্পন্ন সুস্পষ্ট ভাবধারা রয়েছে। তাই তা স্বতই দুনিয়ার বিভিন্ন দিকে প্রচারিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু যারাই ইসলাম গ্রহণ করেছে তারা এমন কোন বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা পায় না, যারা ফলে তারা দ্বীন-ইসলামে গভীর অন্তদৃষ্টি ও পাণ্ডিত্য লাভ করতে পারে না। যার দরুণ তারা এর হেদায়েতে সত্যিকারভাবে উপকৃত হতে পারছে না। তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার কিছুরও প্রতিবিধান করা হচ্ছে না কিংবা তার প্রতিপক্ষ বা অত্যাচারী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসা কঠিন নির্যাতন সে ভোগ করতে বাধ্য হয়েছে, তা থেকে কিছুমাত্র নিস্কৃতি দেয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না।
বিভিন্ন দেশে অবশ্য এমন বহু সংস্থা আছে, যেগুলো এই সুবিধাসমূহ দুর করার জন্যে নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে; কিন্তু সেগুলো প্রয়োজন পরিমাণ সাহায্য-সহযোগীতা পাচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখের কথা।
আফ্রিকা মহাদেশে ভায়বহ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নিত্যকার ঘটনা –দুর্ঘটনা হয়ে রয়েছে। তথায় বিভিন্ন শক্তি, গোত্রপতি, রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। একদিকে মিশরানী সাম্রাজ্যবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী মিশনারীরা চেষ্টায় লেগে আছে, অপরদিকে দিয়ে ইসরাইলী ইয়াহুদী সাম্রাজ্যবাদ সর্বাত্মক শক্তি এই উদ্দেশ্য নিয়োজিত করে রেখেছে। আর তৃতীয় দিক দিয়ে মার্কসীয় কমিউনিষ্ট সাম্রাজ্যবাদও ওৎ পেতে আছে। প্রত্যেকেই আফ্রিকা দখল করে স্বীয় রঙে রঙীন করে তোলার চেষ্টায় রত আছে।
এসব আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ইসলাম নির্বাক, নিষ্ক্রিয় ও নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে মুসলিম জাতিকে অনুমতি দেয়না। তাই এ সময় এমন একটি রাষ্ট্র থাকা একান্তই জরুরী, যা তার এই দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে, দ্বীন-ইসলামের দাওয়াত প্রচার করবে এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করবে।
ইসলাম একদিন আক্রমণাত্মক বা সম্প্রসারণের ভূমিকায় ছিল। আর বর্তমানে তা প্রতিরক্ষার ভূমিকায় চলে গেছে। চারদিক থেকে তা আক্রমণের সম্মখীন, তার নিজের ঘর রক্ষার দায়িত্বের ব্যতিব্যস্ত।
অতএব আজকের দিনেও লোকদের মনস্তুষ্টি সাধনের চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া অধিক কর্তব্য। সাইয়েদ রশীদ রিজা লিখেছেন- কাফিররা মুসলমানদের মনতুষ্টি সাধন করে তাদের স্বপক্ষে কিংবা তাদের ধর্মে শামিল করে নিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত মুসলমানকে দাস বা গোলাম বানাবার চেষ্টায় রত আছে সাম্রাজীবাদী রাষ্ট্রসমূহ। সেই সাথে বিপুল সংখ্যক মুসলমানের মনস্তুষ্টি সাধনের কাজে অপরিমেয় ধনসম্পদ ও কলাকৌশল ব্যয় ও প্রয়োগ করে যাচ্ছে। কেউ কেউ মুসলমানদের ইসলামের সীমার মধ্য থেকে বহিষ্কৃত করে তাদের সাহায্য লাগানোর উদ্দেশ্য তাদের মনস্তুষ্টি সাধনের কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সমর্থনে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এই কাজ করছে অনেকগুলো সংস্থা। মুসলিমদের ঐক্য ও ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ ধ্বংস করাই তাদের চরম লক্ষ্য। এরূপ অবস্থায় মুসলমানদের কি উচিত নয় তাদের সঠিক দায়িত্ব পালনে নেমে যাওয়া। [(আবরী**************)]
যাকাতের মাল ছাড়াও এ কাজ করা জায়েয
উপরের এই দীর্ঘ আলোচনার পরও আমরা বলে রাখতে চাই যে, প্রয়োজনীয় মনস্তুষ্টি সাধনের এ কাজটি কেবলমাত্র যাকাত দ্বারাই করতে হবে, অন্য কোন উপায়ে করা যাবে না, এমন কথাও নয়। বায়তুল মালের যাকাত সহ অন্যান্য আয় দ্বারাও এই কাজ করা যাবে। এজন্য একটা স্বতন্ত্র ফাণ্ডও গঠন করা যাবে। বেশী অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে কিংবা তাদের সংখ্যা যদি অনেক বেশী হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা করা ছাড়া উপায় থাকে না। ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য ফিকাহবিদ এ মত দিয়েছেন। তার অর্থ জনকল্যাণমূলক ফাণ্ড দ্বারা ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ খাতে কাজ করা। আসলে আদর্শবাদী সুবিচারক রাষ্ট্রকর্তার অভিমতের ওপরই তা একান্তভাবে নির্ভর করে। পরিমাণটা উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিতব্য। শুরা সদস্যদের পরামর্শক্রমেই এ কাজটি সুষ্ঠূভাবে আঞ্জাম পেতে পারে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ফির-রিকার-দাসমুক্তি
কুরআনে খাত নির্ধারণে অক্ষর প্রয়োগের পার্থক্য
পর্বে উদ্ধৃত হয়েছে, কুরআনের আয়াতে যাকাত ব্যয়ের আটটি খাত নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইতিপূর্বেই চারটি বিষয়ের আলোচনা উপস্থাপিত করা হয়েছেঃ ফকীর, মিসকীন, যাকাত কার্যে নিয়োজিত কর্মচারী এবং মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম- ইসলামের জন্যে যাদের মনস্তুষ্টি সাধনের প্রয়োজন। এখনও চারটি খাতের আলোচনা অবিশিষ্ট রয়ে গেছে। তা হচ্ছে
১. ফির-রিকার- দাসমুক্তি, আটটির মধ্যে পঞ্চম খাত।
২. আল-গারেমীন- ঋণগস্ত লোক, আটটির মধ্যে ষষ্ট খাত।
৩. ফী সাবীলিল্লাহ- আল্লাহর পথে, আটটির মধ্যে সপ্তম খাত।
৪. ইবনুস সাবীল- নিঃস্ব পথিক, আটটির মধ্যে অষ্টম ও সর্বশেষ খাত।
কুরআনের উক্ত আয়াতটি যাকাত ব্যয় ক্ষেত্রকে আটটি খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। প্রথমে চারটি এবং শেষে চারটি। প্রথম চারটি খাতের কথা বলেছে এ ভাষায়ঃ
(আবরী******************)
সাদকা-যাকাত কেবলমাত্র ফকীর, মিসকীন, যাকাত সংক্রান্ত কর্মচারী ও যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করা দরকার এদের জন্যে।
আর শেষের চারটি খাতকে বলা হয়েছে এই ভাষায়ঃ
(আরবী***************)
দাসমুক্তি ও ঋণগ্রস্তদের কাজে এবং আল্লাহর পথে ও নিঃস্ব পথিকের কাজে।
পূর্বে বলার ধরনে ও এ পার্যায়ের বলার ধরনে এই পার্থক্য কেন? প্রথম চারটির গুরুত্ব ل লাম অক্ষরটি লাগানো হয়েছে, যা মুলত تمليك বা মলিক বানানো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর শেষের চারটির পূর্বে فى বসানো হয়েছে যা পাত্র বা ক্ষেত্র বোঝায়। এরূপ বলার মূলে কি তাৎপর্য নিহিত আছে?
কুরআন নিশ্চয়ই একটি অক্ষরের স্থলে অপর একটি অক্ষর ব্যবহার করে না। একাধিক ব্যাখ্যার মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্য দেখতেও দ্বিধা করে না। বরং তার অলৌকিক কালামের সাহায্যে তাতে নিহিত যৌক্তিকতা সম্পর্কে অবহিত করে দেয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কেবল বিদ্বজ্জনেরাই বুঝতে পারে। তাহলে সেই প্রশ্নই থেকে যায়- এখানে সেই যৌক্তিকতাটি কি?
প্রখ্যাত কুরআন ব্যাখ্যাকারী যামাখশারী এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, শেষের চারজন যাকাত প্রাপকদের ক্ষেত্রে ل এর পরিবর্তে فى ব্যবহার করা হয়েছে একথা বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে যে, যাকাত পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম চারজনের তুলনায় শেষোক্ত চারজনের অধিকার অত্যধিক দৃঢ়। কেননা فى পাত্র বোঝায়। এ দিয়ে জানানো হয়েছে যে, তাদের ক্ষেত্রে যাকাত স্থাপন অধিকক প্রয়োজন, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি অধিকারী-এদিকে দিয়ে যে, যাকাত তাদের মধ্যেই রাখা ও বণ্টন করা হবে, যেন তারাই তার ক্ষেত্র ও প্রাপক। [(আরবী*******************)]
ইবনুল মুনীর তাঁর الانتصاف নামের গ্রন্থে যামাখশারীর উপরিউক্ত বক্তব্যের ওপর সমালোচনা করে অধিকতর সূক্ষ্ম ও গভীর তত্ত্ব উদঘাটিত করেছেন। বলেছেন, এখানে আরও একটি তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। তা যেমন অধিক প্রকাশমান, তেমনি অধিকতর নিকটবর্তী। আর তা হচ্ছে, প্রথমোক্ত চার প্রকারের ব্যয়ক্ষেত্র প্রাপ্ত যাকাতের মালিক। তারা তা মলিকানার অধিকারে পেয়েও গ্রহণ করে থাকে। একথা বোঝাবার জন্যে শুরুতে ل অক্ষরটির ব্যবহারই যথাযথ। কিন্তু শেষোক্ত চারজন প্রাপ্ত যাকাতের মালিক হয় না- তাদের জন্য ব্যয় নাও হতে পারে। তবে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কল্যাণমূলক কাজে তা ব্যয় হবে। যে মাল দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্য ব্যয়িত হবে, তা পাবে তার মালিক, তার বিক্রেতা বা চুক্তিকারী মালিক পক্ষ। ফলে তাদের ভাগের যাকাত অংশ তারা নিজেরাও নিজেদের হাতে পেল না। এই কারণে তাদের কথা বলতে গিয়ে ل অক্ষরটি ব্যবহৃত হয়নি। কেননা তা তাদের মালিক হওয়া বোঝায় সেই জিনিসের, যা তাদের জন্যে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে এই শেষোক্ত চারজন হল যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র, তাদের কল্যাণে তা ব্যয়িত হবে। তবে তার মালিক হবে না।
ঋণগ্রস্ত লোকেরাও অনুরূপ। তাদের প্রাপ্য যাকাত দেয়া হবে তাদের নিকট যারা পাওনাদার, তাদেরকে, তাদের ঋণ শোধ করার জন্যে। তা ঠিক তাদেরকে দেয়া হবে না। আর আল্লাহর পথে- এ ব্যাপারটি তো এদিক দিয়ে খুবই স্পষ্ট।
ইবনুল সাবীল- নিঃস্ব পথিক- যেন ঠিক আল্লাহর পথে নিয়োজিত। এই কথাটি এ বচনে বলা হয়েছে তার বিশেষ বিশেষত্বের কারণে। এর ওপর ل বা فى কোনটিই ব্যবহৃত হয়নি। বরং ل এর পরবর্তী শব্দ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু তা অধিক নিকটবর্তী। [(আরবী******************)]
এই গ্রন্থকারের বক্তব্য হচ্ছে, নিঃস্ব পথিকের জন্যে যা ব্যয় করা হবে, তাকে তার মালিক বানিয়ে দেয়া হবে না। তা তার কল্যাণে ব্যয়িত হবে মাত্র। তা দিয়ে তার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সফরের ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। তা দিয়ে যানবাহনের ভাড়া দেয়া যাবে, যাতে চড়ে সে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌছতে পারবে। যানবাহন নৌকা, বাস, রেল-গাড়ি বা উড়োজাহাজ, সামুদ্রিক জাহাজ- যাই ই হোক না কেন।
ইমাম ফখরুদ্দিন আর-রাযীও এ ধরনের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। বলেছেনঃ
আল্লাহ তাআলা যাকাতকে প্রথমোক্ত চার প্রকারের প্রাপকদের জন্যে নির্দিষ্ট করেছেন ل অক্ষর দিয়ে, যা মালিক বানিয়ে দেয়া বোঝায়। যেমন বলা হয়েছে। (আরবী**************)
কিন্তু فى الرقاب দাসমুক্তির কথা বলতে গিয়ে ل এর পরিবর্তে فى বসিয়েছেন। এই পার্থক্যকরণে একটা সফলতা নিশ্চয়ই রয়েছে। আর সে সুফলতা হচ্ছে, প্রথমোক্ত চার প্রকারের প্রাপকদের হাতে তাদের প্রাপ্য অংশ দিয়ে দেয়া হবে। তারা যেভাবে ইচ্ছা তা ব্যয় এবং ব্যবহার করবে। কিন্তু দাসমুক্তির ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য অংশ তাদের দাসত্ব শৃংখলা থেকে মুক্তকরণের কাজে ব্যয় করা হবে। তা তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে না। তারা তা নিজেদের ইচ্চামত কাজে লাগাতে বা ব্যয়-ব্যবহার করতেও পারবে না। তাদের পক্ষ থেকে তা দিয়ে তাদের মুক্ত করা হবে।
ঋণগ্রস্ত লোকদের পর্যায়ের এই কথা। তাদের ঋণ শোধের কাজে তা ব্যয় করা হবে। আর যোদ্ধাদের যুদ্ধ কাজে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহে তা ব্যয় করা হবে। পথিকের ব্যাপারটিও এমনি।
সার কথা হচ্ছে, প্রথম চার প্রকারের প্রাপকদের প্রাপ্য তাদের হাতেই তুলে দেয়া হবে। তারা ইচ্ছামত তা ব্যয় ও ব্যবহার করতে পারবে। আর শেষোক্ত চারজনকে তাদের প্রাপ্য দেয়া হবে না, যে কারণে তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য প্রমাণিত হয়েছে, সে কারণটা দূর বা পূরণ করার কাজে তা ব্যয় করা হবে। [(আরবী***********)]
তাফসীরে খাজেনেও এ কথাই বলা হয়েছে। [(আরবী**************)]
যাকাত পাওয়ার আটটি খাত বর্ণনায় এই যে পার্থক্য করা হয়েছে, تفسير المنار এর লেখক তা দুই ভাগে দুটি পরিবৃত্তে বিভিক্ত করেছেন। [(আরবী**************)] শায়খ শালতুত তা সমর্থন করেছেন। [(আরবী**************)]
বলেছেন, এরা হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তি এবং কয়েকটি কল্যাণমূলক কাজ। কতিপয় ব্যক্তি হচ্ছে প্রথমোক্ত চারজন- ঋণগ্রস্ত লোক ও পথিকসহ। আর কল্যাণময় কাজের দুটো ক্ষেত্রঃ দাসমুক্তি ও নিঃস্ব পথিক। এই দুটো ক্ষেত্রের পূর্বস্থানে فى বসানো হয়েছে। ঋণগ্রস্ত লোক ও নিঃস্ব পথিক এই দুইজনকে অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে গণ্য করা হয়নি। বরং এই দুটোর বর্ণনা গুণবাচক যা প্রথম পর্যায়ের লোকদের রয়েছে, যাদের পূর্বে ل বসানো হয়েছে। এটা হয়েছে এজন্যে যে, ছয়টি ক্ষেত্রের মধ্যে গুণগত সাদৃশ্য রয়েছে। এরা বিশেষ গুণের দিক দিয়ে যাকাত পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়েছে। ফকীররাও দারিদ্র গুণে যাকাত পাওয়ার অধিকারী আর ঋণগ্রস্ত লোকেরা ঋণগ্রস্ততার গুণে। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, প্রতিটি প্রকারকে তার নিকটস্থ প্রতিবেশীর সঙ্গে যুক্ত করে বলা দুরবর্তীর সাতে যুক্ত করে বলার তুলনায় অনেক উত্তম। কুরআনের ভাষালংকারের দৃষ্টিতে অধিক উপযুক্ত বর্ণনাভংগী হচ্ছে, যে যে প্রকারের লোকদের যাকাত দিয়ে দেয়া হবে, সে সে প্রকারের লোকদের উল্লেখ এক সাথে পর পর করা বাঞ্ছনীয়। আর যে যে দিকে যাকাত বিতরণ বা ব্যয় করা হবে, সেগুলোর উল্লেখ পাশাপাশি হওয়া উচিত। জামাখশারী, ইবনুল মুনীর, রাযী প্রমুখ বিশেষজ্ঞ এরূপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন।
ইমাম রাযী প্রথম চার প্রকার ও শেষের চার প্রকার যাকাত পাওয়ার লোকদের মধ্যে পার্থক্য বোঝাবার জন্য যা বলেছেন আল মুগনী প্রণেতা তা সমর্থন করেছেন। [(আরবী**************)] বলেছেন এভাবেঃ
চার প্রকারের লোক যাকাত গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে। দেয়ার পর তারা তা নিয়ে করে, তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হয়না। তারা হচ্ছে, ফকীর, মিসকীন, কর্মচারী ও মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম। তারা যখনই যাকাত গ্রহণ করলো, তারা তখনই মালিক হয়ে বসল স্থায়ী ও চিরকালীন মালিক হিসেবে। ফিরিয়ে দেয়া কোন অবস্থায়ই তাদের কর্তব্য হবে না। আর অন্যান্য চারজন- ঋণগ্রস্ত লোক, দাসমুক্তি, পথিক ও আল্লাহর পথে- যাকাত গ্রহণ করে বিশেষ প্রয়োজন পূরণের জন্য। যদি যে কারণে তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয়েছে, সেই কাজে তা ব্যয় করে, তবে তারা তা যথার্থভাবেই গ্রহণ করল। নতুবা তা তাদের নিকট থেকে ফেরত নেয়া হবে।
এই কয় প্রকার প্রাপক ও পূর্ববর্তী কয় প্রকারের প্রাপকের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই শেষোক্ত লোকেরা যাকাত গ্রহন করেছে এমন এক লক্ষ্যে যা যাকাত গ্রহণের সাথে সাথেই অর্জিত হয়ে যায়নি। অথচ প্রথম প্রকারের প্রাপকদের লক্ষ্য যাকাত গ্রহণ করাতেই অর্জিত হয়ে গেছে। আর তাহচ্ছে ফকীর মিসকীনদের স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন, যাদের মন সন্তুষ্ট করার তাদের মন সন্তুষ্টকরণ, এবং যারা এজন্যে কাজ করেছে তাদের পারিশ্রমিক দান। কিন্তু শেষাক্ত চার ধরনের লোকদের প্রয়োজন পূরণ হওয়ার পর যাকাতের মাল তাদের নিকট উদ্ধত্ত হয়ে থাকলে ওসব ব্যয় হয়ে না গেলে যা অবশিষ্ট রয়েছে তা ফিরয়ে দিতে হবে। অবশ্য মুজাহিদকে তা দিতে হবেনা। তার নিকট কিছু উদ্ধৃত্ত থাকলে তা তারিই হয়ে যাবে। তাতে অবশ্য সে সব জিনিস গণ্য নয় যা যুদ্ধের পরও স্থায়ীভাবে থেকে যাবে। যেমন অস্ত্র-শস্ত্র, ঘোড়া ইত্যাদি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এ পর্যায়ের উদ্ধৃত্ত জিনিসসমূহ বায়তুল মালে ফিরিয়ে দিতে হবে।
আল মুগনী গ্রন্থকার ইবনে কুদামাহ দুই পর্যায়ের প্রাপকদের মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শনস্বরূপ যা বলেছেন, তা যথার্থ, সহীহ। আর আসলে তাই সমর্থনযোগ্য। কেননা কুরআন মজীদই এই দুই পর্যায়ের লোকদের মধ্যে বর্ণনা ভঙ্গীর মাধ্যমে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে হাম্বলী আলিম (আরবী***********) গ্রন্থের ব্যাখ্যা লেখক এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেছেন। [(আরবী**************)]
ফির-রিকাব- এর তাৎপর্য
الرقاب বহুবচনের শব্দ। একবচনে رقبة কুরআনের পরিভাষায় তার অর্থ দাস বা দাসী। তা বলা হয় তাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টকালে। কুরআন মজীদ এই শব্দটি বলে পরোক্ষভাবে একথাই বোঝাতে চেয়েছে যে, মানুষের জন্যে দাসত্ব গলায় বাঁধা শৃংখলের মত অথবা বলদের ঘাড়ে বাঁধা জোয়ালের মত। আর দাসকে এই শৃংখল থেকে মুক্ত করা যেন গলায় বাঁধা রশি খুলে ফেলা। মানুষ যে জোয়ালের তলায় পড়ে, থাকে, তা থেকে তা সরিয়ে দুর করে দেয়া। যাকাত- ব্যয়ের ক্ষেত্র বলতে আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী**************) তার অর্থ, মানুষের গলা মুক্তকরণের কাজে যাকাত ব্যয় করা হবে। আর এই কথা দাস দাসীকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তকরণ বোঝাবার জন্যে যথেষ্ট। এ কাজটি দুভাবে হতে পারেঃ
১. যে দাস বা দাসী মনিবের সাথে চুক্তি করেছে যে, সে তাকে এত টাকা দিয়ে দিলে সে তাকে মুক্ত করে দেবে, যাকাত দিয়ে তার এই চুক্তি পূরণে সাহায্য করা হবে। তাই এ টাকা দেয়া হলেই সে তার ঘাড়কে মুক্ত করে নিতে পারল, সে স্বাধীনতা পেল।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম জনগণকে তাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারাই এরূপে বিনিময় দানের শর্তে চুক্তি করতে ইচ্ছুক, তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা নিজেদের জন্যে যা বাধ্যতামূলক বানিয়ে নিয়েছে তা পরিপূরণে পূর্ণাঙ্গ সাহায্য দান করতেও বলেছেন, যেন মালিক মনিবরা তাদের মুক্তিপথ সহজ করে দেয়, তাদের দেয় পরিমাণ হ্রাস করে। গোটা মুসলিম সমাজই যেন দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্তি লাভের এই চেষ্টায় তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে। এ পর্যায়ে আল্লাহর কথা হচ্ছেঃ
(আরবী**************)
তোমাদের মালিকানাভুক্ত যেসব ক্রিতদাস বা দাসী চুক্তিবদ্ধ হতে ইচ্ছা করে, তোমরা তাদের সাথে লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হও যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ জানতে পার……… এবং তাদেরকে আল্লাহর সেই মাল থেকে দাও যা তিনি তোমাদের দান করেছেন। (সূরা নূরঃ ৩৩)
অতঃপর যাকাতের একটা অংশ তাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী অর্থ দিয়ে দাসত্বমুক্তির এই চেষ্টায় তাদের সাহায্য করা হবে। এটাই নির্ধারণের লক্ষ্য।
দাসত্ব মুক্তির এই পদ্ধতির পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন ইমাম আবূ হানীফা, শাফেয়ী এবং তাঁদের সঙ্গিগণ। লাইস ইবনে সায়াদও এ মত সমর্থন করেছেন।
তাঁরা দলিল হিসেবে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস উল্লখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ তাআলা وفى الرقاب বলে মুক্তির জন্য চুক্তিবদ্ধ ক্রীতদাস বা দাসী বুঝিয়েছেন। আর তা আরও দৃঢ় হয়েছে আল্লাহর কথা শেষাংশ (আরবী**************) দিয়ে। [(আরবী**************)] (এবং তাদের দাও আল্লাহর সেই মাল থেকে যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন।)
২. ধনবান ব্যক্তি তার মালের যাকাত- সম্পদ দিয়ে একজন দাস বা দাসীকে ক্রয় করবে এবং পরে তাকে মুক্ত করে দেবে।
অথবা আরও কয়েকজন একত্রিত হয়ে এই ক্রয় ও মুক্তি দানের কাজ করবে। রাষ্ট্রকর্তাও সংগৃহীত যাকাত সম্পদ দিয়ে দাস বা দাসী ক্রয় করে মুক্ত করে দেবে- এটাও সম্ভব। ইমাম মালিকের এই মতটি প্রখ্যাত। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক এ মতই প্রকাশ করেছেন। ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ বস্তুত এটাই যথার্থ ও সঠিক পদ্ধতি। তার সমর্থনে তিনি কুরআনের বাহ্যিক বাচন-ভঙ্গীকেই দলিল হিসেবে তুলে ধরেছেন। কেননা আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে দাসত্বের উল্লেখ করেছেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে মুক্তিদান। যদি চুক্তিবদ্ধ দাসদাসীর সাহায্যেই লক্ষ্য হত, তাহলে তিনি তাদের এই বিশেষ নাম সহকারেই উল্লেখ করতেন। তা না বলে যখন الرقبة বলেছেন, তখন বোঝা গেল, তিনি মুক্তিদানই বোঝাতে চেয়েছেন। আর তাৎপর্যগত কথা হচ্ছে, চুক্তিবদ্ধ লোকেরা আসলে ঋণগ্রস্ত লোকদের গোষ্ঠীর মধ্যে শামিল হয়ে গেছে। এখন তাদের ওপর এটা একটা ঋণ বিশেষ। কাজেই তারা فى الرقاب পর্যায়ে গণ্য হবে না। আর সাধারণভাবে চুক্তিবদ্ধ দাস দাসীও এর মধ্যে গণ্য ধরা হয় বটে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের মুক্তই করা হবে। [(আরবী**************)]
আসলে সত্য কথা হচ্ছে, চুক্তিবদ্ধ দাস-দাসীর সাহায্যকরণ ও ক্রয় করে দাস মুক্তকরণ উভয় কাজই আয়াতটির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ইবরাহীম নাখয়ী ও সায়ীদ ইবনে জুবাইর তাবেয়ী ফিকাহবিদ থেকে বর্ণিত, তাঁরা দুজনই যাকাতের টাকা দিয়ে দাস ক্রয় করে মুক্তকরণ অপসন্দ করতেন। কেননা তাতে যাকাতদাতার ব্যক্তিগত স্বর্থ জড়িত থাকে। তা হচ্ছে ইসলামের বিধান অনুযায়ী মুক্তকারীর নিকট দাসের এক ধরনের সম্পর্ক যুক্ত থাকা এবং মুক্তকারীর কোন উত্তরাধীকারী না থাকলে মুক্ত দাস مولى তার উত্তরাধিকারী হতে পারে- এই সুবিধা। এ দৃষ্টিতেই ইমাম মালিক থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে লোক তার মালের যাকাত দিয়ে দাস মুক্ত করবে, তার মুক্তকরণ সম্পর্ক ও উত্তরাধিকার সমস্ত মুসলিম জনগনেল জন্যে হবে অর্থাৎ বায়তুলমালের সম্পদ হবে। [(আরবী**************)]
কিন্তু আবূ উবাইদ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা উদ্ধত করেছেন, কোন মুসলিম তার মালের যাকাত দিয়ে কোন দাসকে মুক্ত করবে তাতে তিনি কোন দোষ দেখতে পান নি। নখয়ীও ইবনে জুবাইরের মত উদ্ধৃত করার পর বলেছেনঃ এ পর্যায়ে আমাদের নিকট এ পর্যন্ত যত মতই পৌছেছে, তন্মধ্যে ইবনে আব্বাসের মতই সর্বোত্তম। তিনি খুব বেশি অনুসরণীয়, কুরআনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা ও মর্মোদ্ধারের কাজেও তিনি অধিক পারদর্শী। হাসান বসরীও এ ব্যাপারে তাঁর সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। অধিক সংখ্যক বিশেষজ্ঞও এ মতেই রয়েছেন। [(আরবী**************)]
তিনি আরও বলেছেন, এ মতটি আরও বলিষ্ঠতা পায় এ দিক দিয়ে যে, মুক্তকারীর যদি ভয় থাকে যে, তার মীরাস মুক্তকরণ সম্পর্কের দরুণ الوالاء মুক্ত দাসই পেয়ে যাবে, তাহলে তার এ-ও ভয় থাকতে পারে যে, সে এমন কোন ফৌজদারী অপরাধ করে বসবে যার রক্তমূল্য বা ক্ষতিপূরণ দেয়া তার বা তার গোত্রের লোকদের জন্যে কর্তব্য হয়ে পড়বে। আর তাহলে তারা দুজন পারস্পরিক সম্পর্কিত হয়ে গেল। [(আরবী**************)]
এসব কথাই সে অবস্থায় প্রযোজ্য, যখন যাকাত বণ্টনের কাজ ব্যক্তিগতভাবে বা সম্পদ মালিকের প্রতিনিধির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। কিন্তু এ কাজ যদি মুসলিম শাসক বা ইসলামী সরকার কর্তৃক সম্পন্ন হয়- যাকাতের মৌল ব্যবস্থাপনাই তাই তাহলে আর এ সব মতপার্থক্যের কোন কারণ থাকবে না। অতএব এ ব্যক্তি তার মালের যাকাতে যতটা কুলাস দাস ক্রয় করে মুক্ত করতে পারে যাকাত ব্যয়ের অপরাপর ক্ষেত্রকে লংঘন করা ছাড়াই। (ইমাম শাফেয়ী অবশ্য যাকাত পাওয়ার যোগ্য আট প্রকারের লোকদের মধ্যে সমান পরিমাণে বণ্টন করা ওয়াজিব মনে করেন। তা হলে আট ভাগের এক ভাগে নেহায়েত কম পড়বে না।) উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে, রাষ্ট্রকর্তা দুটি ব্যাপারকে একত্রিত করবে। চুক্তিবদ্ধ দাসদের সাহায্য করবে এবং দাস-দাসী ক্রয় করেও মুক্ত করবে। ইমাম জুহরী খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজকে তা-ই লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, দাস মুক্তকরণের অংশটি দুই ভাগে বিভক্ত হবে, অর্ধেক ব্যয়েত হবে মুসলিম চুক্তিকারী দাসদের সাহায্যার্থে। আর অপর অর্থেক দিয়ে ইসলাম গ্রহণকারী ও নামায-রোযা পালনকারী দাসদের ক্রয় করে মুক্ত করার কাজে। তা হলে এই উভয় প্রকারের দাস-দাসীই যাকাতের সাহায্যে মুক্তি লাভ করবে। [(আরবী**************)]
কিন্তু কোন ইসলামী রাষ্ট্রকর্তা অর্ধেক বা অপর কোন হার মেনে চলতে বাধ্য এ কথা আমরা মনে করি না। সে যেভাবেই ভাল মনে করবে সেভাবেই তা করতে পারবে। অবশ্য পরামর্শদাতাদের নিকট থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে ইসলামের পরামর্শ গ্রহণ নীতি অনুযায়ী।
দাসপ্রথা বিলুপ্তকারণে ইসলামের অগ্রবর্তিতা
এ কথা বলা যায়, ব্যক্তিদের দাসকরণের প্রথা দুনিয়া থেকে এখন বিলুপ্ত প্রায়। এই প্রেক্ষিতে একথা ঘোষণা করার আমাদের পূর্ণ অধিকার আছে যে, দাসপ্রথা বিলুপ্তকরণ এবং ক্রমশ তা নিঃশেষে উৎখাত করার জন্যে ইসলামই সর্বপ্রথম সর্বাত্মক, চেষ্টা চালিয়েছে ও সর্বপ্রকারের কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বণ করেছে।
দুনিয়ায় দাস প্রথা চালু হওয়ার বহু পথ ও পন্থা ছিল। ইসলাম তন্মধ্যে কতগুলো প্রশস্ত দ্বার চিরদিনের তরে রুদ্ধ করে দিয়েছে। স্বাধীন মুক্ত মানুষকে হাইজ্যাক করে নিয়ে তাকে দাস বানানোকে কঠিন ও কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। মানুষ ছোট শিশু হোক, কি বড় ও পূর্ণ বয়স্ক। মানুষকে কোন অবস্থায়ই বিক্রয় করা জায়েয নয়। কেউ নিজেকে বা নিজের সন্তান বা স্ত্রীকে বিক্রয় করার অধিকার রাখে না। কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণের বিনিময়ে- যদি সে ঋণ শোধ করতে অক্ষম হয়- দাস বানিয়ে রাখার কোন বিধান নেই। কোন অপরাধীকে তার অপরাধের শাস্তিস্বরূপও দাস বানানো যেতে পারে না। এই আদর্শ যেমন পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানসমূহের, প্রচীন অন্ধকার যুগের গোত্র বা জাতিসমূহের পক্ষেও বৈধ ছিল না অপর গোত্র বা জাতিকে দাস বানিয়ে রাখা শত্রুতা বা বিদ্রোহের প্রতিবিধানস্বরূপ। [(আরবী**************)]
দাসপ্রথা প্রচলিত পওয়ার যেসব কারণের সাথে বিশ্বমানব পরিচিত তার কোন একটিও অবশিষ্ট ছিল না। কেবলমাত্র একটি পন্থা বা কারণই ছিল চূড়ান্তভাবে ও একান্তরূপে। এই পথে দাস বানানো জায়েয বরং ইচ্ছাদীন ছিল, আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলক নয়। আর তা হচ্ছে, শরীয়াতসম্মত ইসলামী যুদ্ধে বন্দীদের দাস বানানো হত। এই পন্থাটিরও অবশ্য ইসলাম কর্তৃক সূচিত হয়নি সীমলংঘন করা দরুন। এটা ইসলামে সম্ভব হতে পারে যদি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ততেই উম্মত ও মিল্লাতের সার্বিক কল্যাণ নিহিত বলে মনে করে ও পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাও তখন যখন শত্রুপক্ষ মুসলিম বন্দীদের দাস বানিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত করে। এরূপ অবস্থায় সমতাপূর্ণ নীতি গ্রহণেই কল্যাণ নিহিত বলে মনে করতে হয়। তবে ইসলামী রাষ্ট্রের সুবিচারক প্রধান যদি কোনরূপ বিনিময় নিয়ে ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে তবে তাও করার অধিকার রয়েছে। সে বিনিময় কোন বস্তুগত জিনিস হতে পারে, হতে পারে কোন তাৎপর্যগত বা বস্তু ঊর্ধ্ব জিনিস। মুশরিক শত্রু পক্ষ মুসলিম বন্দীদের ছেড়ে দিলে তার বিনিময়ে কাফির বন্দীদের ছেড়ে দেয়া যায়। যুদ্ধরত কাফির বন্দীদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে এ কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছেঃ
(আরবী**************)
শেষ পর্যন্ত তোমরা তাদের চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে, তখন বন্দীদেরকে শক্ত করে বাঁধবে। অতপর তোমাদের ইচ্ছা অনুগ্রহ প্রদর্শনপূর্বক তাদের ছেড়ে দেবে কিংবা বিনিময়ের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করবে।
ইসলাম যেমন দাসপ্রথার একটা সংকীর্ণ দ্বার জায়েযরূপে উন্মুক্ত রেখেছে, তেমনি তাদের মুক্ত ও আযাদকরণের বহু কয়টি প্রশস্ত দ্বারও খুলে দিয়েছে। দাস মুক্তকরণের প্রথা উন্মুক্তকরণ তো কেবলমাত্র ইসলামেরই অবদান। কিন্তু দাস বানানোর কোন নতুন পথ ইসলাম খুলে দেয়নি।
ইসলাম দাস মুক্তকরণের আহবান জানিয়েছে। সেজন্যে বিপুল উৎসাহ দান করেছে, তাকে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম পন্থারূপে চিহ্নিত করেছে। উপরন্তু মুসলিমের ব্যক্তিগত বহু সংখ্যক মানবিক ভুলতুটি বা গুনাহের কাফ্ফারারূপে দাসমুক্তকরণকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। যেমন কিড়া-কসম করে তা ভঙ্গ করলে, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ‘জিহার’ হলে, রমযান মাসে দিনের বেলা স্ত্রী-সহবাসকরা হলে এবং ভুলবশত নরহত্যা করা হলে দাসমুক্তি দানই তার কাফ্ফারা। কোন মনিব যদি তার ক্রীতদাসকে অন্যায়ভাবে মারধোর করে, তাহলে তাকে মুক্ত করাই হয় তার এই অপরাধের কাফ্ফারা।
তাছাড়া মনিবদের নির্দেশদেয়া হয়েছে, দাসদের মধ্যে কোন কল্যাণ দেখতে বা জানতে পারলে তাদের সাথে মুক্তির চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। আর তা সম্ভব হয়, যদি তাকে মুক্তভাবে উপার্জন করর অবাধ সুযোগ দেয়া হয় এবং যদি ইসলামী সমাজ সমষ্টি তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। কুরআনের সুদৃঢ় স্পষ্ট ঘোষণায় যেমন আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী**********)
তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যেসব কৃতদাসের মালিক হয়েছে, তাদের কেউ যদি তোমাদের সাথে মুক্তির চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায়, তা হলে তোমরা নে চুক্তি অবশ্য সম্পাদন করবে- যদি তোমরা তাদের মধ্যে কোন কল্যাণের কথা জানতে বুঝতে পার। আর তাদের আল্লাহ্র সেই মাল থেকে দাও যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন। (সূরা নূর: ৩৩)
এসব বলার অধিক অতিরিক্ত ব্যবস্থারূপ দাসমুক্ত ও আযাদকরণকে যাকাতের মালের একটা ব্যয়ক্ষেত্ররূপেও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যাকাত এমন একটা ‘কর’ বিশেষ যা বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনতা দিয়ে থাকে। আর ইসলামী বায়তুলমালের জন্যে তা একটা স্থায়ী আয়-ব্যবস্থা। তাতেই রক্ষিত হয়েছে দাস মুক্তকরণের অংশ। [দাস-দাসীদের বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা বৃদ্ধি, উন্নতকরণ এবং তাদের সত্যিকার অর্থে সম্মানা্হ মানুষ বানাবার- বরঞ্চ মনিবের ভাই বানিয়ে দেয়ার জন্যে এ ছাড়াও আরও অনেক কার্যকর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মালিক ও দাসের খাওয়া-পরার মান অভিন্ন রেখেছেন। সাধ্যের অতীত কোন কাজের জন্যে তাদের বাধ্য করা, তাদের মারধর করা, তাদের কষ্ট-পীড়ন দেয়া- ‘আমার দাস, আমার দাসী’ বলে তাদের মনে কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ রূপে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আলোচ্য মুক্তি পথ খুলে দেয়া এসবের বাইরের ব্যবস্থা।]
এই বার্ষিক আবর্তনশীল আমদানী থেকে দাসমুক্তির জন্যে একটা অংশ স্থায়ীও চিরকালের তরে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু তা নিশ্চয়ই কোন সহজসাধ্য কাজ ছিল না। যাকাতলব্ধ জিনিসের মূল্য কখনও বিপুল হয়, কখনও সামান্য। অনেক সময় অবশ্য অন্যান্য খাতে ব্যয়ের প্রয়োজন না থাকার দরুন সমস্ত যাকাত সম্পদই এ খাতে ব্যয় হতে পারে। হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের সময়ে ঠিক তাই হয়েছিল।
ইয়াহ্ইয়া ইবনে সায়ীদ বলেছেন, উমর ইবনে আবদুল আজীজ আমাকে আফ্রিকায় যাকাত আদায়ের জন্য পাঠিয়েছিলেন। আমি সে যাকাত যথারীতি আদায় ও সংগ্রহ করার পর তা বন্টন করে দেয়ার জন্য ফকীর-মিসকীনদের সন্ধান করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন ফকীরও পেলাম না। এমন একজনকেও পেলাম না, যে যাকাত গ্রহণ করতে রাজী হতে পারে। আসলে উমর ইবনে আবদুল আজীজ জনগণকে বিপুলভাবে সচ্ছল ও অর্থশালী বানিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমি তা দিয়ে ক্রীতদাস ক্রয় করে তাদের মুক্ত করে দিয়েছিলাম। [(আরবী ************)]
বস্তুত মুসলমানগণ যদি উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ইসলামকে বাস্তবায়িত করত এবং সৎপন্থী সুবিচারক প্রশাসক ব্যবস্থা কার্যকর করে রাখত দীর্ঘকাল পর্যন্ত, তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দাস প্রথার উৎখাত হয়ে যেত, দুনিয়ার কোথাও তার অস্তিত্ব থাকত না।
মুসলিম বন্দীকে দাসমুক্তির অংশ দিয়ে মুক্ত করা যাবে
কুরআনের ব্যবহৃত শব্দ (*****) কেবলমাত্র ক্রীতদাসকেই বোঝায়। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, এ শব্দটির সাধারণ প্রয়োগে মুসলিমবন্দীদেরকে শামিল করা ও তাদের মুক্তির জন্যে এই অংশের যাকাত ব্যয় করা যাবে কিনা…. যাদের ওপর কাফির শত্রুরা ঠিক সেভাবেই প্রভুত্ব করে যেমন করে মনিব-মালিক তার ক্রীতদাসের ওপর? আসলে এই মুসলিম বন্দীরা ঠিক ক্রীতদাসদের মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যেই নিপতিত হয়ে থাকে।
ইমাম আহমাদের মতের বর্ণনানুযায়ী তা করা সম্পূর্ণ জায়েয। মুসলিম বন্দীকে যাকাতের টাকা দিয়ে মুক্ত করা অবশ্যই শরীয়াতসম্মত কাজ হবে। কেননা তাতেও তো ‘ঘাড়’কে বন্দীদশা থেকে মুক্তই করা হয়।
কাযী ইবনুল আরাবী মালিকী বলেছেন, যাকাতের টাকা দিয়ে বন্দী মুক্তকরণ পর্যায়ে আলিমগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। আতবাগ বলেছেন, তা জায়েয হবে না। ইবনে হুবাইব বলেছেন, অবশ্যই জায়েয হবে। মুসলিমদাসকে যখন একজন মুসলমানের নিকট থেকেই যাকাতের অর্থ দিয়ে মুক্ত করা ইবাদতের পর্যায়ের কাজ এবং জায়েয, তখন মুসলিম বন্দীকে কাফিরের দাসত্ব শৃংখল ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ দিয়ে মুক্ত করা ইবাদতের পর্যায়ের কাজ এবং জায়েয, তখন মুসলিমবন্দীকে কাফিরের দাসত্ব শৃংখল ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনী। [(আরবী ************)] দাসপ্রথা পরিত্যক্ত হয়েছে বটে কিন্তু যুদ্ধ বিগ্রহ তো চিরকালের জন্যেই লেগে আছে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ কোন দিনই সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে না এবং তাতে বহু মুসলমান কাফির শক্তির হাতে বন্দীও হতে পারে। কাজেই মুসলমান বন্দীকে যাকাতের এ অংশ থেকে বিনিময় মূল্য দিয়ে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে উদার হস্তে ও প্রশেস্তভাবে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীন জাতিসমূহকে কি যাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে
সাইয়্যেদ রশীদ রিজা তাঁর তাফসীর ‘আল-মানার’-এ লিখেছেন, ‘ফির-রিকাব’ বলে যাকাতের যে ব্যয়-খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্তকরণের কাজে ব্যবহার করা যাবে- যখন ব্যক্তিদের মুক্তকরণে তা ব্যয় করা হবে না। [(আরবী ************)] প্রধান শিক্ষাবিদ শায়খ মাহ্মুদ শালতুত তাগিদ করে বলেছেন, ব্যক্তি দাসের মুক্তিকরণের সুযোগ যখন নিঃশেষ হয়ে গেছে- আমি যা মনে করি- এ ব্যয়ের ক্ষেত্রটি নতুনভাবে নির্ধারিত হয়েছে জাতি ও গোত্রসমূহকে সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনতাপাশথেকে মুক্তির সংগ্রামে সাহায্যকরণ। কেননা এই অবস্থাটি মানবতার পক্ষে অধিকতর কঠিন, দুঃসহ ও বিপজ্জনক। এক্ষেত্রে মানুষদাস হয় চিন্তা-বিশ্বাস, ধন-মাল ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বে। তাদের গোটা দেশের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না। আগের কালে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দাসত্বের প্রথা চালু ছিল। সে ব্যক্তির মৃত্যুতে দাসত্বেরও মৃত্যু ঘটত। যতটা দুনিয়ার অন্যান্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের থাকত। কিন্তু এখনকার দাসত্ব হচ্ছে গোটা জাতির। জাতির জন্মই হয় দাসত্বের অবস্থায় তাদের বাপ-দাদার মতই। এ দাসত্ব সাধারণ ও স্থায়ী। একটি অন্ধ জুলুমকারী শক্তি তাদের দাসত্ব শৃংখলে বন্দী করে নেয় ও রাখে। এই দাসত্বের মুকাবিলা-প্রতিরোধ এবং তা থেকে মুক্তিলাভের জন্যে চেষ্টা ও সংগ্রাম করা ও লাঞ্ছনা গঞ্জনা তাদের ওপর থেকে অপসারণ করার জন্যে যাকাতের এ অংশ ব্যয় করা অধিকতর বাঞ্ছনীয়। তা কেবল যাকাত সাদকার দ্বারাই নয়, সমস্ত ধন-মাল ও প্রাণ দিয়েই তা করতে হবে।
এ থেকে আমরা এ-ও বুঝতে পারি, এ পর্যায়ের ইসলামী জাতিসমূহকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে দুনিয়ার ধনী মুসলিমদের বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। [(আরবী ************)]
সাইয়্যেদ রশীদ রিজা ও মাহ্মুদ শালতুত এই যা কিছু বলেছেন, তা বলেছেন (****) শব্দের ব্যাপক তাৎপর্য স্বরূপ। তাতে ব্যক্তি ক্রীতদাসের পর্যায়ে এসে গেছে জাতি বা গোত্র ক্রীতদাস। মূল্যের দিক দিয়ে উভয়ের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই।
তবে আমার কথা হচ্ছে, যে বাক্য বা শব্দের তাৎপর্যে এ ব্যাপকতা নেই, তাতে কৃত্রিমভাবে ব্যাপকতা নিয়ে আসার কোন প্রয়োজনই আমাদের নেই। আমরা তো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোলামী থেকে মুক্তি লাভের সংগ্রামে আর্থিক সাহায্য দানের ব্যবস্থা যাকাতের বন্টন ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি- তা হচ্ছে: (*****)-এর অংশ। যদিও রাষ্ট্রের অপরাপর আয়ও এ কাজে ব্যয় হতে পারে। বরং এজন্যে সমস্ত মুসলিম জনতা ও রাষ্ট্রের প্রধানগণ এগিয়ে আসা একান্তভাবেই কর্তব্য।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
‘আল গারেমূন’ –ঋণগ্রস্ত লোকগণ
কুরআনের আয়াত অনুযায়ী যাকাতের ষষঠ ব্যয়-ক্ষেত্র হচ্ছে, আল-গারেমূন-ঋণগ্রস্ত লোকগণ।কিন্তু ‘গারেমূন’ বলতে কোন্ সব লোক বোঝায়?
‘গারেমূন’ কারা
‘গারেমূন’ বহুবচন। একবচনে ‘গারেম’ (***) ঋনগড়্রস্ত ব্যক্তিকে ‘গারেম’ বলা হয়। [ইবনুল হুম্মাম উল্লেখ করেছেন, ‘গারেমূন’ হচ্ছে সেই লোক যার উপর ঋণ চেপেছে অথবালোকদের নিকট যার পাওনা রয়েছে, কিন্তু তা আদায় করতে পারছে না, তাকেও ‘গারেম’ বলার প্রচলন রয়েছে। এই লোকের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই বলে তার ওপর যাকাত ফরয হয় না।কিন্তু এই কথাটিতে আপত্তি আছে। কেননা আভিধানিকভাবে ‘গারেম’ কেবল তাকেই বলা হয়, যার ওপর ঋণ চেপেছে। সম্ভবত ‘গারেম’ ও গারীম’-একই শব্দে দুটি তার বিভ্রান্তি ঘটেছে। কেননা ‘গরীম’ বলতে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়কেই বোঝায়। মানুষ তো, ভুলের ঊর্ধ্বে কেবলমাত্র আল্লাহ। তবে (****) গ্রন্থে এ রূপটি উল্লেখকরা হয়েছে,তা সেই ব্যক্তিকে বোঝায় যার পাওনা রয়েছে লোকদের নিকট…. তাকেও যাকাত দেয়া জায়েয। কেননা সে কার্যত ফকীর- নিঃস্ব পথিক। সে ঋণগ্রস্ত….. তাকেও যাকাত দেয়া জায়েয। কেননা সে কার্যত ফকীর- নিঃস্ব পথিক। সে ঋণগ্রস্ত বলে নয়। দেখুন: (আরবী ************)] তবে ‘গরীম’ বলা হয় ঋণ গ্রহীতাকে, যদিও ঋণদাতাকে বোঝারবার জন্যেও এই শব্দটির ব্যবহার হয়ে থাকে। আর (****) শব্দের আসল অর্থ অপরিহার্যতা, লেগে যাওয়া। জাহান্নাম সম্পর্কে আল্লাহ্র কথা: (আরবী ************) ‘নিশ্চয়ই জাহান্নামের আযাব অবশ্যম্ভবাবী“ এ থেকেই ‘গারেম’ নাম দেয়া হয়েছে। কেননা ঋণ তার উপর চেপে বসেছে, অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে (তা ফিরিয়ে দেয়া)। আর ‘গারীম’ বলা হয় এজন্যে যে, ঋণদাতারসাথে তার ঋণের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে।
ইমাম আবূ হানীফার মতে (***) ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিৎ।’-যার ওপর ঋণ চেপেছে, ঋণ পরিমাণ সম্পদের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়।[(আরবী ************)] (তাই সে যাকাত পেতে পারে।) ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আহমদের মতে, ‘গারেমূন’ দুই শ্রেণীর লোক। এক শ্রেণীর লোক তারা, যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে ঋণ গ্রহণ করেছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক হচ্ছে সমাজ সমষ্টির কল্যাণে ঋণ গ্রহণকারী। এই উভয় শ্রেণীর লোকদের জন্যে আলাদা-আলাদা আইন-বিধান রয়েছে।
নিজের প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারী লোক
প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে যেসব লোক যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্যে অর্থ ঋণ করে থাকে। ঘরের প্রয়োজন, কাপড়-চোপড় খরিদ, বিবাহ অনুষ্ঠান, কিংবা রোগের চিকিৎসা, ঘর-বাড়ি নির্মাণ, ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী বা সাজ-সরঞ্জাম ক্রয়, কিংবা সন্তানের বিবাহ দান প্রভৃতি কাজে অথবা ভুলবশত অপরের কোন জিনিসনষ্ট করে দেয়া ইত্যাদি কারণে ঋণ করেছে। তাফসীর লেখক ইমাম তাবারী আবূ জাফর কাতাদাহ প্রমুখথেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: ‘গারেম’-ঋণকারী অপচয়কারী নয়- রাষ্ট্রপ্রধানের উচিত তার এই ঋণটা বায়তুলমাল থেকে পরিশোধ করে দেয়া। [(আরবী ************)]
আকস্মিক বিপদগ্রস্তরা এই পর্যায়ে গণ্য
এ গুণটির বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায় যেসব লোকের মধ্যে যারা আকস্মিকভাবে জীবনের কঠিনতম বিপদে নিপতিত হয়েছে। তারা এমন সব আঘাত পেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে যে, তাদের ধন-মালেসবই নিঃশেষে শোষিত হয়েছে। তখন তারা প্রয়োজনবশতই নিজেদের পরিবারবর্গের জন্যে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, তিনজন লোক ‘ঋণগ্রস্ত’ ‘গারেম’রূপে গণ্য: একজন, যার ধন-মাল ফসল-ফল বন্যায় ভেসে গেছে। দ্বিতীয জন যার সব কিছু জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে আর তৃতীয, যার বহু সন্তান ও পরিজন কিন্তু তার ধন-মাল বলতে কিছুই নেই। সে ঋণ নিয়ে পরেবারবর্গের জন্যে ব্যয় করতে বাধ্য হয়। [(আরবী ************)]
কুবাইচাতা ইবনুল মাখারিকের-আহমাদ ও মুসলিম উদ্ধৃত হাদীস-এ বলা হয়েছে, যে লোক বিপদগ্রস্ত হয়ে সব ধন-মাল খুইয়েছে, রাষ্ট্র-সরকারের নিকট যাকাত ফাণ্ড থেকে তার হক্ পাওয়ার জন্যে দাবি করা সম্পূর্ণ জায়েয ও মুবাহ, যেন সে জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রয়োজন পরিমাণ লাভ করতে পারে। (‘গারেমীন’ সম্পর্কিত দ্বিতীয পর্যায়ের আলোচনায় আমরা এ প্রসঙ্গ সম্পূর্ণভাবে উল্লেখ করব।)
এভাবে যাতে বিপদ মুকাবিলার লক্ষ্যে সামষ্টিক নিরাপত্তা দানের (Social Security) দায়িত্ব পালন করে। আকস্মিকভাবে বিপদে পড়া লোকেরা নিজেদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা লাভ করতে পারে যাকাত ব্যবস্থার দরুন। বিশ্ব-সমাজ এর পূর্বে এ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তার সাথে কিছুমাত্র পরিচিত ছিল না। জীবনবীমা ব্যবস্থার প্রচলন নিতান্তই এ কালের ব্যাপার।
তবে ইসলাম যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে তার লোকদের জন্যে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা অধিকতর উন্নত, পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর-জীবন বীমার তুলনায়। পাশ্চাত্য জগত আধুনিককালে পর্যায়ক্রমে এই বীমার ব্যবস্থা খাড়া করেছে বটে, কিন্তু পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে কেবলমাত্র সেসব লোক, যারা কার্যত তার পলিসি ক্রয় করে নির্দিষ্ট পরিমাণে বীমা কোম্পানীর কিস্তি আদায় করতে সমর্থ হয়। আর বিনিময় দেয়ার সময় বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঠিক ততটা পরিমাণই দেবে, যার সে বীমা করেছে। কিন্তু যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছে বা যা তার প্রয়োজন, সে পরিমাণ অর্থ তাকে কখনও দেবে না। ফলে যে লোক বিরাট পরিমাণ টাকার বীমা ক্রয় করেছে, বড় বড় কিস্তি দিয়েছে, সে বড় পরিমাণ বিনিময় লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে লোক সামান্য পরিমাণের পলিসি করেছে, সে সেই দৃষ্টিতে সামান্যই পরিমাণই পাবে- তার বিপদটা যত বড় প্রয়োজন যত বেশিই হোক না কেন। আর কম আয়ের লোকেরা যে খুব সামান্য পরিমাণেরই বীমা পলিসি করতে পারে, তা তো জানা কথাই। এরূপ অবস্থায় তার বিপদ যত বড়ই হোক, প্রাপ্য হবে খুবই কিঞ্চিৎ। তার কারণ হচ্ছে, পাশ্চাত্য বীমা ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ব্যবসায়িক এবং বীমাকারী লোকদের দেয়া টাকার মধ্য দিয়ে মালিক পক্ষের বিপুল পরিমাণে মুনাফা কামাই করে নেয়ার নীতির ওপর সংস্থাপিত।
কিন্তু ইসলামী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পূর্বে প্রদত্ত কিস্তির শর্তের ওপর স্থাপিত নয়। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সেখানে দেয়া হবে তার প্রয়োজন পরিমাণ, ক্ষতির পরিমাণ অনুপাতে, যেন তার অসুবিধাটা দূর হয়ে যায়।
ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারীকে সাহায্য দেয়ার শর্ত
এই প্রকারের ঋণগ্রস্তকে ঋণ-শোধ পরিমাণে দেয়া হবে। তবে সে-জন্যে নিম্নোক্ত শর্তসমূহ অবশ্যই রক্ষা করতে হবে:
প্রথম শর্ত: তার প্রয়োজটা হবে ঋণ শোধ করার। সে যদি ধনী হয় নগদ টাকা বা তার নিজের জিনিসপত্র দিয়ে তা শোধ করতে সমর্থ হয়, তাহলে তাকে যাকাত থেকে দেয়া যাবে না। [ইমাম শাফেয়ীর কথা হচ্ছে, তার স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্ত্বেও তাকে দেয়া যাবে। কেননা সে ঋণগ্রস্ত সে নিজস্ব প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারী। দেখুন (আরবী ************)] তার নিকট যদি ঋণের কিছু অংশ শোধ করার মত অর্থ থাকে, তাহলে অবশিষ্ট পরিমাণ শোধ করার জন্যে যাকাত দেয়া যাবে। আর যদি তার কোন জিনিসই না থেকে থাকে, সে ম্রম করে উপার্জন করে ঋণ শোধ করতে সক্ষমহয় তাহলেও তাকে যাকাত দেয়া যাবে। কেননা সে যদি তা কামাই-রোজগার করে শোধ করতে পারেও, তবু তা সে পারবে দীর্ঘদিন পর। এই সময়ের মধ্যে উণ শোধের প্রতিবন্ধকও কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু ফকীরের অবস্থা ভিন্নতর। সে তো বর্তমানেই উপার্জন করে তার প্রয়োজন পূরণ সমর্থ তবুও তাকে যাকাত দেয়া যাবে।
ঋণগ্রস্তের ঋণ-শোধ পরিমাণ প্রয়োজনের শর্ত করা অর্থ এই নয় যে, তাকে একেবারে শূন্য হাত-কিছুরই মালিক নয়, এমন হতে হবে।
বিশেষজ্ঞগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দারিদ্র্য বিচারে বসবসস্থল- ঘর-বাড়ি, কাপড়-চোপড়, বিছানা, তৈজসপত্র ইত্যাদি গণ্র করা হবে না। এমন কি, অবস্থার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় খাদেম ও যানবাহন থাকলেও তা গণ্য করা যাবে না। এসবের মালিক হলেও ঋণগ্রস্তের ঋণ শোধ করা যাবে যাকাতের টাকা দিয়ে।
ঋণগ্রস্তের যদি এতটা পরিমাণ মাল-সম্পদ থাকে, যা দিয়ে ঋণ শোধ করা হলে সে মাল-সম্পদ তার জীবিকা নির্বাহের জন্যে যথেষ্ট হবে না, তাহলে তার জন্যে যথেষ্ট হয় এমন পরিমাণ মাল রেখে দিতে হবে, অবশিষ্ট পরিমাণ ঋণ শোধ করার জন্যে যাকাত থেকে দেয়া হবে।
‘যথেষ্ট পরিমাণ’ বলতে- শাফেয়ী আলিমদের মতে- পূর্বে বিশ্লেষণ করা ‘যথেষ্ট পরিমাণ’ বোঝানো হয়েছে। তা হচ্ছে, বাহ্যত যতদূর বোঝা যায়, বেশির ভাগ জীবনের জন্যে যথেষ্টভাবে প্রয়েঅজন-পূরণকারী পরিমাণ। অতঃপর কোন জিনিস অতিরিক্ত হলে তা তার ঋণ শোধে ব্যয় করা হবে। যা অপূরণ থাকবে, তা যাকাত ফাণ্ড থেকে দিতে হবে।
দ্বিতীয় শর্ত: লোকটি ঋণ গ্রহণ করেছে আল্লাহ্র বন্দেগী পালন বা কোন মুবাহ পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করার জন্যে-এরূপ হতে হবে। যদি কোন নাফরমানীর কাজ করার জন্যে ঋণ করে থাকে- মদ্যাপান, ব্যভিচার, জুয়া বা হাস্য-কৌতুক, চিত্ত-বিনোদন প্রভৃতি বিচিত্র ধরনের কোন হারাম কাজ করার জন্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকে, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। অনুরূপভাবে নিজের ও পরিবারবর্গের জন্যে অপব্যয়-অপচয়ের জন্যে ঋণ করে থাকলেও দেয়া যাবে না- তা মুবাহ পর্যায়ের কাজ হলেও। কেননা মুবাহ কাজের জন্যে ঋণ হওয়ার পরিমাণ ব্যয় করা মুসলিম ব্যক্তিমাত্রের জন্যেই হারাম। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী ************)
হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সমুদয় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান কর এবং তোমরা খাও, পান কর; কিন্তু অপচয় করো না। কেননা আল্লাহ্ অপচয়কারীদের পসন্দ করেন না। (সূরা আ’রাফ: ৩১)
ঋণ করে মুবাহ কাজ করা ইসরাফ বা বেহুদা খরচ পর্যায়ে গণ্য। আয়াতে তাই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।
পাপ কাজে ব্যয় করার জন্যে ঋণ গ্রহণকারীদের যাকাত দেয়া যাবে না এ কারণে যে, তা দিলে আল্লাহ্র নাফরমানীর কাজে তাকে সাহায্য ও সহায়তা করা হবে। তার এই পাপ কাজে তার অনুসরণ করতে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করা হবে। তবে সে যদি তওবা করে, তাহলে সে যাকাত থেকে ঋণ শোধ করতে পারে। তওবা করলেই সে তা পাবে। কেননা তওবা অতীতের পাপ ধুয়ে মুছে ফেলে। পাপের কাজ থেকে তওবাকারী পাপমুক্ত ব্যক্তির মতই।
কোন কোন ফিকাহ্বিদ অবশ্য শর্ত করেছেন, পাপ কাজ থেকে তওবা করার ও তা প্রকাশ করার পর এমন একটা সময় অতিবাহিত হওয়া উচিত, যার মধ্যে তার অবস্থা সংশোধন হওয়ার ও তওবার ওপর স্থির থাকার কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে। অন্যরা বলেছেন, তার তওবা সত্যতা ও যথার্থতার ওপর একটা সাধারণ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা গেলেই যাকাত দেযা যাবে, মেয়াদ তার যত স্বল্পই হোক-না-কেন।
তৃতীয় শর্ত: ঋণটা সাম্প্রতিক হতে হবে। ঋণ যদি বিলম্বিত হয়, দীর্ঘমেয়াদী হয়, তাহলে তা শোধের জন্যে যাকাত দেয়া যাবে কিনা, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, দেয়া যাবে। কেননা সে তো ‘গারেম’ ঋণগ্রস্ত। কুরআনের সাধারণ ঘোষণার অর্তর্ভুক্ত। আবার কেউ কেউ বলেছেন, দেয়া যাবে না। কেননাসে এক্ষণে তার জন্যে ঠেকা নয়। আবার অন্যরা বলেছেন, যদি সেই মেয়াদটা সেই বছরই শুরু হয়, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে, অন্যথায় সেই বছরের যাকাত থেকে তাকে দেয়া যাবে না। [এসব শর্তের উল্লেখ হয়েছে: (আরবী ************)]
এই গ্রন্থকারের মতে গ্রহণীয় কথা হচ্ছে, উপরিউক্ত কোন একটি মত অনুযায়ী কাজ করার পূর্বে যাকাতলব্ধ সম্পদের পরিমাণ ও সর্বশ্রেণীর প্রাপকদের সংখ্যা ও তাদের প্রয়োজনের পরিমাণ দেখা আবশ্যক। যদি লব্ধ সম্পদের পরিমাণ বিরাট ও তাদের প্রয়োজনের পরিমাণ দেখা আবশ্যক। যদি লব্ধ সম্পদের পরিমাণ বিরাট হয় এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম হয়, তাহলে প্রথমোক্ত মতটি গ্রহণ ও অনুসরণ করতে হবে এবং যাকাত দেয়া তাকে দেয়া যাবে- তার ঋণ সাময়িক দেয় হোক কি দীর্ঘ মেয়াদী। যদি ব্যাপারটি এর বিপরীত হয়, তাহলে দ্বিতীয মত অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তখন দীর্ঘমেয়াদী ঋণ গ্রহীতার ওপর অন্যান্য শ্রেণীর প্রাপকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর যদি ব্যাপার মধ্যম ধরনের হয়, তাহলে তৃতীয় মতটি গ্রহণীয় হবে (প্রকৃত কথা আল্লাহ্ই ভালো জানেন)।
যাকাতদাতা যদি ব্যক্তিগতভাবেই যাকাত বন্টন করে, তাহলে সে তার বিবেচনায় অধিক প্রয়োজনশীল অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে কম প্রয়োজনশীলের ওপর অগ্রাধিকার দেবে।
চতুর্থ শর্ত: ঋণটা এমন হতে হবে যেজন্যে ঋণ গ্রহীতাকে কয়েদ করা যেতে পারে। সন্তানের ঋণও তার পিতার ওপর বর্তাতে পারে। কম আয়ের লোকের ঋণও হতে পারে। তবে কাফ্ফাপরা ও যকাত দেয়ার দরুন গৃহীত ঋণ এর অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা যে ঋণের দরুন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে কয়েদ করা যেতে পারে, তা হচ্ছে মানুষের নিকট থেকে গ্রহণ করা ঋণ। আর কাফ্ফাপরা ও যাকাত পর্যায়ের কাজগুলো হচ্ছে আল্লাহ্র জন্য। [দেখুন: (আরবী ************)]
এই যা বলা হল, তা মালিকী মাযহাবের মত। সব ফিকাহ্বিদই এই শর্তগুলো আরোপ করেন নি। হানাফী ফিকাহ্বিদগণ যাকাতকে সেসব ঋণের মধ্যে গণ্য করেন, যার দাবি জনগণের পক্ষথেকে করা হয় অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান করে।
ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহীতাকে কত দেয়া হবে
ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যে লোক ঋণ গ্রহণ করেছে, তার প্রয়োজন পরিমাণ দিতে হবে। আর এখনকার প্রয়োজন হচ্ছে তার ঋণ শোধ করা। তাকে যদি সামান্য পরিমাণ দেয়া হয়, তাহলে সে ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না তার দ্বারা। বরং তখন ঋণদাতা তাকে হয় ক্ষমা করেদেবে, কিংবা তার পক্ষথেকে অন্যরা তা দিয়ে দেবে কিংবাসে যাকাত চাড়া অন্য মাল দ্বারা শোধ করবে, যথার্থ কাজ হবে তার নিকট থেকে তা ফিরিয়ে নেয়া হলে। কেননা তার সে পরিমাণের প্রয়োজন নেই। [(আরবী ************)] ঋণের পরিমাণ কম হোক কি বেশি, তা শোধ করাই কাম্য এবং তাকে এই দায়িত্বের ঝুঁকি থেকে নিষ্কৃতি দানই আসল লক্ষ্য।
ঋণগ্রস্তদের প্রতি ইসলামের ভীতি প্রদর্শন
ঋণগ্রস্ত ও ঋণগ্রহণকারী লোকদের ব্যাপারে সাধারণভাবে দ্বীন ইসলামের ভূমিকা ভীতিপূর্ণ ও অনন্য।
ক. ইসলাম প্রথম মুসরিম জনগণকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মধ্যম ও ভারসাম্যপূর্ণ ইনসাফভিত্তিক নীতি গ্রহণের শিক্ষা দেয়, যেন কোন কারণেই তারা ঋণ গ্রহণের মুখাপেক্ষী হয়ে না পড়ে।
খ. মুসলিম ব্যক্তি যদি জীবন-জীবিকার জন্যে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তবে তার কর্তব্য হচ্ছে, যত শিগ্গির সম্ভব সে ঋণ ফেরত দেয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা। তাহলে সে তার ঋণশোধের ব্যাপারে আল্ল্হ্র সাহায্য পাবে, সহযোগিতা পাবে- তার নিয়ত অনুযায়ী। ‘যে লোক জনগণের মাল-সম্পদ নেবে তা ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ত সহকারে, আল্লাহ্ই তা তার পক্ষথেকে আদায় করে দেবেন (আদায়ের সাহায্য করবেন)। আর যে লোক তা নেবে তা ধ্বংস বা নষ্ট করার নিয়বে, আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করবেন। [বুখারী, আহমাদ, ইবনে মাজাহ, আবূ হুরায়রা বর্ণিত (কাঞ্জুল, ৬ষ্ঠ খণড-১১৪পৃ.)।
গ. ঋণ আদায়ের দৃঢ় সংকল্প ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ তার সব বা আংশিক ঋণ আদায়ে অক্ষম থেকে যা্য়, তাহলে রাষ্ট্র তাকে পিঠ চূর্ণকারী ও মানুষের মক্তক অবনতকারী এই ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করার জন্যে এগিয়ে আসবে। এজন্যেই বলা হয়েছে।
(আরবী ************)
ঋণ রাত্রিকালের দুশ্চিন্তা এবং দিনের আলোয় অপমানকারী।
নবীকরীম (স) সব সময়ই এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মহান আল্লাহ্র নিকট পানা চাইতেন। বলতেন:
(আরবী ************)
হে আমাদের আল্লাহ! আমি তোমার নিকট পানা চাই ঋণের প্রচণ্ডতা, শত্রুর দাপট ও শত্রুদের তিরস্কার থেকে। [হাফেয-মুহাদ্দিস ‘মুলুগুল মারাম’ গ্রন্থে বলেছেন (৩১৩ পৃ.) হাদীসটি নাসায়ী আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে রাসূল (স)-এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হাকেম এটিকে সহীহ বলেছেন।]
ঋণ কেবলমাত্র ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব ও মনের প্রশান্তির ওপর কঠিন বিপদ নিয়ে আসে তাই নয়, তার চরিত্র ও নৈতিকতার ওপর তা বড় আঘাতও বটে। তাঁর আচার-আচরণকেও প্রভাবিত করে সাংঘাতিকভাবে। বুখারী বর্ণিত একটি হাদীস এই বিষয়ে আমাদের সাবধান করেছে। নবী করীম(স) আল্লাহ্র নিকট খুব বেশি- বেশি পানা চাইতেন ঋণগ্রস্ততা থেকে। সাহাবিগণ এর গভীর নিহিত কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কোন্ কারণে তা থেকে এত বেশি বেশি পানাহ চাইছেন? ঋণ থেকে পানা চাওয়ার সাথে সাথে কবর আযাব থেকেও পানা চাইতেন, খুব দীর্ঘজীবন ও মরণের ফেত্না, মসীহ দাজ্জালের ঈমান নষ্টকপারী বিপদ থেকেও রক্ষা পেতে চাচ্ছেন কেন? তাদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন: ‘ব্যক্তি যখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তার খেলাফ করে।’ –(এটাই সাধারণ নিয়ম) বুখারী (আরবী ************) এটা নবীকরীম(স) –এর প্রসঙ্গক্রমে বলা একটি অতীব সত্য কথা। এ থেকে মানুষের নৈতিকতা ও আচার-আচরণের ওপর অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক প্রভাবের কথা অকাট্যভাবে জানতে পারে যায় এবং এ কথাটি সত্যই অনস্বীকার্য। তবে মানব চরিত্রের ওপর কেবল অর্থনীতিই একক প্রভাবশালী শক্তি বলে যারা মনে করে, তাদের এই মতকে আমরা সম্পূর্ণ অসত্য বলে বিশ্বাস করি।
নবী করীম (স) সাহাবায়ে কিরামের মনে ঋণ গ্রহণের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক করার উদ্দেশ্যে অনেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, তার সাহাবীদের মধ্যে কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে মরলে ও তা আদা করার ব্যবস্থা রেখে না গিয়ে থাকলে তার জানাযা নামাযই তিনি পড়তেন না। আর এটা ছিল ঋণগ্রস্ততা থেকে সাহাবীদেরকে বিরত রাখার জন্যে তার প্রচণ্ড একটা ধাক্কা। কেননা তাঁদের প্রত্যেকেই চূড়ান্তভাবে বাসনা পোষণ করতেন মৃত্যুর পর নবীকরীম (স)-ই যেন তাঁর জানাযা নামায পড়ান, যেন তিনি তার জন্যে দো’আ করেন। আর তা না হলে কঠিন আযাবে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভয় তাদেরকে কাতর করে ফেলত। তাঁরা মনে করতেন, এটা একটা অপূরণীয় ভয়াবহ ক্ষতি বিশেষ।
উত্তরকালে আল্লাহ তা’আলা যখন তাকে বিপুল বিজয় ও ধন-দৌলত দিলেন, বায়তুলমালের আয় যখন ব্যাপপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে গেল, তখন তিনি নিজেই মুসলমানদের ঋণ শোধের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) এই পর্যায়ে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স)-এর সম্মুকে যখন কোন লাশ নিয়ে আসা হত জানাযা নামাযের জন্যে, যার ওপর ঋণ চেপে আছে, তখন তিনি জিজ্ঞাসাপ করতেন, ঋণ শোধ করার মত সম্পদ রেখে গেছে কিনা? যদি বলা হত যে, ঋণ শোধের ব্যবস্থা করে গেছে, তাহলে তিনি তার নামায পড়তেন। অন্যথায় তিনি বলতেন, ‘তোমরাই তোমাদের সঙ্গীর জানাযা নামায পড়।’ অতঃপর যখন তাকে ব্যাপক বিজয় দান করলেন আল্লাহ তা’আলা, তখন তিনি বললেন:
(আরবী ************)
মুমিনদের জন্যে তাদের নিজেদের তুলনায়ও অধিক উত্তম। যে লোক ঋণের বোঝা নিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হবে, তা শোধ করার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তাবে।
ঋণগ্রস্ত লোকদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্যে এই হাদীসে বিপুলভাবে উৎসাহ দান করা হয়েছে। এতেই ভ্রাতৃত্বের অধিকার আদায়ের ব্যবস্থা নিহিত। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার এটাই বাস্তব পন্থা। আর আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ লাভের এ একটা মহৎ উপায়। হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম (স)-এর যুগে এক ব্যক্তি ফলের ব্যবসায়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে তা বিক্রয় করে দেয়; কিন্তু তার ঋণের পরিমাণ বিপুল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে হয়ে যায় নিতান্ত গরীব। তখন রাসূলে করীম (স) বললেন: তোমরা সকলে লোকটিকে সাহায্য কর। লোকেরা তার প্রতি দান-সাহায্য করল। কিন্তু তাতে তার ঋণ শোধ হওয়ার পরিমাণ সম্পদ পাওয়া গেল না। তখন নবী করীম (স) পাওনাদারদের বললেন: ‘যা পাও নিয়ে নাও। তোমরা এ ছাড়া আর কিছু পেতে পার না।’ [(আরবী ************)]
লোকদের যাকাতরে মালে ‘গারেমূন’ –এর জন্যে যে অংশটি কুরআন মজীদে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তা পাওনাদারদের ঋণের এই বোঝা খতম করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ্র নির্ধারণ বিশেষ।
ইসলামে আইন প্রণয়নের মৌল ভাবধাদরা ও পদ্ধতি এটাই। ইসলাম ঋণগ্রস্তদের গলদেশ ঋণের শৃংখল থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে- তলিয়ে যাওয়ার গভীর গহ্বরের মুখ থেকে তাকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে এই বাস্তব ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছে। ঋণের কারণে কাউকে নির্যাতিত ও নিঃস্ব হয়ে যেতে এবং দরিদ্র্যের চরম প্রকাশ ঘটাতে ইসলাম নারাজ। ইসলাম ভিন্ন দুনিয়ার অপর কোন সমাজ-বিধান ঋণগ্রস্ত নাগরিকদের ঋণের বোঝার কঠিন দুঃখের চাপ থেকে মুক্তকরণের লক্ষ্যে এরূপ কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায় না। এটা কেবলমাপত্র মহান আল্লাহ্রই নির্ধারণ।
ইসলাম যাকাতের মাল থেকে সৎকাজের দরুন ঋণী হওয়া লোকদের ঋণ মুক্তির এই ব্যবস্থা করেছে দুটি বিরাট লক্ষ্যে:
প্রথম: তার সম্পর্ক সেই ঋণগ্রস্তের সাথে, যার ওপর ঋণ চেপে বসেছে। তদ্দরুন সেদিনের লজ্জায় ও রাতের দুশ্চিান্তায় ভয়ানকভাবে কাতর হয়ে পড়েছে। ঋণ ফেতর দেয়ার দাবি ও চাপে এক চরম অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। পাওনাদারদের মামলায় কারাগমনের কারণ ঘটে গেছে। এ ছাড়া নানারূপ নির্যাতন-নিষ্পেষণের অবস্থাও দেখা দিয়েছে। ইসলাম এই ব্যক্তির ঋণ আদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং যে জিনিস তাকে চিন্তায় ভারাক্রান্ত করে তুলেছে, তা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে।
দ্বিতীয়: তার সম্পর্ক ঋণদাতার সাথে যে ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দিয়েছে, তার শরীয়াতসম্মত কাজে তার সহায়তা করেছে। এরূপ অবস্থায় ইসলাম যেমন তার প্রাপ্য ফেরত দেয়ার ব্যাপারে তার সহায়তা করেছে, তেমনি সমাজ-সমষ্টির লোকদেরকে সহানুভূতিপূর্ণ আচার-আচরণ, সহযোগিতা ও বিনা সুদে ঋণ দিতেও যথেষ্টভাবে উৎসাহ দান করেছে। এদিক দিয়ে বলা চলে, যাকাত সুদী কারবারের প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। বস্তুত ইসলামী শরীযাত কঠিন বিপদে পড়া এসব ঋণ গ্রহীতাদের হস্ত মজবুতভাবে ধারণ করেছে। তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও আসবাবপত্র বিক্রয় করে ঋণ শোধ করতে তাদের বাধ্য করা হয়নি। কেননা তাহলে তো প্রতিটি মানুষ ও পরিবার জীবনের মৌল উপকরণ-উপাদানাদি থেকেই বঞ্চিত হয়ে যাবে। সব সুখ-শান্তি-সুবিধার সরঞ্জামাদি থেকেই বঞ্চিত হয়ে যেতে বাধ্য হবে। না, ইসলাম তা চায় না, তা হতে দিতে পারে না। হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ তাঁর খিলাফত আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের প্রতি লিখিত নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন, ‘তোমরা ঋণগ্রস্ত লোকদের ঋণ পরিশোধ করে দাও।’ একজন শাসনকর্তা জবাবে লিখেছিলেন, আমরা তো দেখতে পাচ্ছি, এক ব্যক্তির ঘর-বাড়ি আছে, খাদেম-সেবক, অশ্বযান ও ঘরের আসবাবপত্র সবই আছে, তা সত্ত্বেও সে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত। এরূপ অবস্থায় কি করা যাবে? হযরত দ্বিতীয় উমর লিখে পাঠালেন, ‘জেনে রাখ, মুসলিম নাগরিক মাত্রের জন্যেই বসবাসের ঘর-বাড়ি, কষ্টের কাজে সাহায্যকারী খাদেম এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধ-জিহাদ করার জন্যে অশ্ববাহন একান্তই জরুরী। সেই সাথে তার ঘরে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও থাকতে হবে। হ্যাঁ, তা সত্ত্বেও তার ঋণ শোধ কর। কেননা সে (কুরআনী পরিভাষানুযায়ী) ‘গারেম’। [(আরবী**********)]
এটাই ইসলামী শরয়াতের অবদান। তা চৌদ্দশ’ বছর থেকেই মানুষের প্রতি সুবিচার, ন্যায়পরতা ও দয়া-অনুগ্রহের এই অবদান নিয়ে বিশ্বের জনসমক্ষে সমুপস্থিত।
এর তুলনায় মানব রচিত মতবাদ ও আইন-বিধান মানবতাকে কি দিয়েছে? অথচ তাকেই সভ্যতা ও আধুনিক সংস্কৃতির উচ্চতর দৃষ্টান্ত মনে করা হচ্ছে? কিন্তু তাই ঋণগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দারিদ্রের ঘোষণা দেয়ার, তাদের ব্যবসায় সমস্যার জটিলতা বিধানের এবং পরিমাণে তাদের ঘরবাড়ি সর্বস্বান্ত ও উজাড় করে দিতে বাধ্য করেছে। এতদ্সত্ত্বেও সমাজ বা সরকার তাদের ঋণমুক্তির কোন কার্যকর ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না!
রোমান আইনই বা ন্যায়বাদী দয়াশীল ইসলামী শরীযাতের মুকাবিলায় কোন্ অবদান রেখেছে? দুস্থ মানবতার বিপদমুক্তির ক্ষেত্রে কি ভূমিকা রয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে? রোমান আইন তো ঋণদাতাকে এই অধিকার দিয়েছে যে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ শোধ দিতে অক্ষম হলে তাকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখবে। ‘বারো পর্যায়ের আইন’ নামক রোমান আইন বলা হয়েছে, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ শোধ করতে অক্ষম হলে তাকে ক্রীতদাস বানানোর নির্দেশ দেয়া হবে- যদি সে স্বাধীন নাগরিক হয়ে থাকে। আর সে ক্রীতদাস হলে তাকে কয়েদ করর বা হত্যা করার হুকুম হবে। [এই কথা গ্রন্থকার (আরবী**********) ৩২৮ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।]
জাহিলিয়াতের যুগে আরব সমাজেও এই বিধানই পরিচিত ও ব্যাপকভাবে কার্যকর ছিল। ঋণে জর্জরিত ব্যক্তিকে ধরে ক্রীতদাস বানিয়ে বিক্রয় করা হত এবং এভাবেই ঋণদাতার প্রাপ্য আদায় করে নেয়া হত। কারো কারো বর্ণনা মতে ইসলামের প্রথম যুগেও এটা চালু ছিল। পরে অবশ্য তা বাতিল হয়ে যায়। অতঃপর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে দাস বানানোর কোন উপায়ই থাকেনি ঋণদাতার পক্ষে। [আরবী**********)] আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন।
(আরবী**********)
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অর্থশূন্য দরিদ্র হয়ে যায়, তাহলে তার পক্ষে দেয়া সম্ভব এমন অবকাশ অবশ্যই দিতে হবে। আর তোমরা যদি পাওনাটা সাদ্কা করে দাও, তাহলে তো তোমাদের জন্যে খুবই উত্তম- যদি তোমরা জান।
দ্বিতীয় প্রকার: অন্য লোকের কল্যাণে ঋণগ্রস্ত হওয়া
ঋণগ্রস্ত লোকদের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে দানশীল উদার হস্ত লোক সমষ্টি। তাদের আত্মা অনেক বড় ও উচ্চ। তা ইসলামী ও আরব সমাজেই কেবল সুপরিচিত, সুলভ। এরা পারস্পরিক অবস্থার সংশোধন ও উন্নয়নের কাজে নেমে অনেক সময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তটা এরূপ হতে পারে যে, একটা বিরাট জনসমষ্টি- দুটি গোত্র বা দুটি জনবসতি- হত্যাকাণ্ড ধনসম্পত্তির জন্য পারস্পরিক বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সে কারণে পারস্পরিক শত্রুতা ও হিংসার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে যায়। তখন কেউ অগ্রসর হয়ে এই বিবাদমান জনসমষ্টির মধ্যে সন্ধি করিয়ে দিতে চেষ্টা চালায়। তখন হয়ত সে পারস্পরিক বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু কোন ধন-সম্পদের দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে তুলে নেয়- বিবাদের জ্বলন্ত আগুনের নিভানোর উদ্দেশ্যে। এটা একটা ব্যাপক প্রচলিত প্রথা। এরূপ অবস্থায় দায়িত্ব বোঝাটা যাকাতের ‘গারেমুন’-এর জন্য নির্দিষ্ট অংশ থেকে বহন করা যাবে যেন সমাজের সংশোধন প্রয়াসী কল্যাণকামী নেতৃবৃন্দ নিজেদের ওপর এই বোঝা চাপিয়ে নিয়ে নিষ্পিষ্ট হতে বাধ্য না হন কিংবা তদ্দরুন তাদের সংশোধন-সংকল্পও ব্যাহত ও পর্যুদস্ত হয়ে না পড়ে অথবা তার প্রতি অনীহা ও অনুৎসাহের সঞ্চার না হয়। এ কারণে ইসলামী শরীযাতে ব্যাপারটিকে এভাবে সমাধান করার ব্যবস্থা দিয়েছে। এদের জন্যে যাকাতের একটা অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। [(আরবী**********)]
আমাদের আলিম সমাজ যদি এই সিদ্ধান্ত দেন যে, পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার দরুন কেঋ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার এই ঋণ শোধের জন্যে তাকে যাকাতের অংশ দেয়া হবে। এই মীমাংসার ব্যাপারটা যিম্মীদের দুই দলের মধ্যকার বিবাদের ক্ষেত্রে হলেও তা করা যাবে। [দেখুন: (আরবী**********)] তা হলে খুবই ভাল হয়।
জনসমষ্টির পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার পর্যায়ে সেই লোকেরাও পড়ে যারা কোন সামষ্টিক শরীযাতসম্মত ভালোকাজের জন্যে দায়িত্ব সহকারে কাজ করবে। যেমন ইয়াতীমদের কোন প্রতিষ্ঠান, গরীবদের চিকিৎসায় নিয়োজিত কোন হাসপাতাল, নামাযের জন্যে কায়েম করা কোন মসজিদ, মুসলিমদের শিক্ষাদানের জন্যে প্রতিষ্ঠিত কোন মাদ্রাসা- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-কিংবা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোন কল্যাণময় বা সামষ্টিক খেদমতের কাজ প্রভৃতি। এসবের মাধ্যমে সমাজের সাধারণ কল্যাণ সাধনের জন্যে সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। কাজেই সাধারণ ধন-সম্পদ থেকেই তার সাথে সহযোগিতা করতে হবে। ‘গারেমীন’ শব্দ দ্বারা কেবলমাত্র পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসাকারী লোকদেরই বুঝতে হবে, অন্য কেউ তার মধ্যে শামিল হতে পারবে না, এমন কথা শরীয়াত থেকে জানা যায় না। ওরা যদি গারেমীন-এর শব্দে গণ্য নাও হয়, তবু ‘কিয়াস’-এর সাহায্যে এই বিধান অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
তার অর্থ, যে লোক উক্তরূপ সামষ্টিক কল্যাণকর কাজ-কর্মের দরুন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তাকে যাকাত ফাণ্ড থেকে তার ঋণশোধ পরিমাণ অর্থ অবশ্যই দিতে হবে- সে নিজে ধনশালী হলেও। কোন কোন শাফেয়ী ফিকাহ্বিদ একথা বলিষ্ঠভাবে বলেছেন। [কোন কোন শাফেয়ী ফিকাহ্বিদ বলেছেন, কেউ যদি ইমারত নির্মাণ বা বন্দীমুক্তিকরণ কিংবা মেহ্মানদারী প্রভৃতির জন্যে ঋণগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে যাকাত থেকে দেয়া যাবে- যদি সে ধনীও হয় এবং তার এই ধনশীলতা যদি জমি-জায়গা থেকেহয়, নগদ অর্থের কারণে না হয়। দেখুন: (আরবী**********) রমলীবলেছেন, এই কথার ভিত্তিতে যদি বলা যায় যে, নগদ টাকায় ধনী হলেও কোন তারতম্য হবে না। কেননা এটা আল্লাহ্র এক সাধারণ কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, তা হলে তা অস্বাভাবিক কথা হবে না। দেখুন: (আরবী**********)]
প্রথম প্রকারের লোকেরা যখন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণগ্রস্ত হয়েছে এবংতা সত্ত্বেও তাদের সাহায্য করার বৈধতা স্বীকৃত হয়েছে, তাহলে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা তো সামষ্টিক কল্যাণে ঋণগ্রস্ত হয়েছে, তারা তো অধিক উত্তমভাবে সাহায্য পাওয়ার অধিকারী। প্রথম শ্রেণীর লোকদের যদি দলবদ্ধতা ছাড়া দেয়া না হয়, তাহলে এই শ্রেণীর লোকদের দেয়া হবে তাদের দানশীরতা থাকা সত্ত্বেও। [এটা হবে তখন, যদি তারা নিজেরা নিজেদের মাল থেকে তা কার্যত না দিয়ে থাকে। কেননা সে অবস্থায় তারা নিজেরা ঋণগ্রস্ত হয়নি। আলিমগণ তাই বলেছেন।]
ইতিপূর্বে ‘যাকাত সংস্থার কর্মচারী’ পর্যায়ের আলোচনায় আমরা একটা হাদীস উদ্ধৃত করে এসেছি। তাতে বলা হয়েছে, ‘পাঁচজন ছাড়া অন্যদের জন্যে যাকাত হালাল নয়।’ তারা হচ্ছে: মহান আল্লাহ্র পথে যুদ্ধকারী কিংবা যাকাত সংস্থার কর্মচারী অথবা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি…..
কুবাইচা ইবনে মাখারিক আল-হিলালী বলেছেন, আমি একটা বিপদের ঝুঁকি গ্রহণ করলাম। পরে আমি রাসূলে করীম(স)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে সে ব্যাপারে কিছু সাহায্য পাওয়ার জন্যে প্রার্থনা করলাম। তখন তিনি বললেন, দাঁড়াও, আমাদের কাছে যাকাতের মাল আসুক, তখন আমি তোমাকে তা থেকে দেয়ার জন্যে আদেশ করব।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘হে কুবাইচা, তিনজনের যে-কোন একজন ছাড়া অন্যদের জন্যে ভিক্ষা চাওয়া হালাল নয়। তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে কোন বিপদের ঝুঁকি গ্রহণ করেছে। সেজন্যে ভিক্ষা চাওয়া তার পক্ষে জায়েয-যতক্ষণ না সে তা পায় ও শেষ পর্যন্ত তা থেকে বিরত হয়ে যায় অর্থাৎ ভিক্ষা পরিহার করা। দ্বিতীয সেই ব্যক্তি যার কোন বিপদ ঘটেছে, যার দরুন তার সমস্ত ধন-মাল নিঃশেষ হয়ে গেছে। তখন তার পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া জায়েয, যেন সে জীবনের প্রয়োজনীয় সম্বল অর্জন করতে পারে (কিংবা বলেছেন, জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারে)। আর তৃতীয সে, যে অবুক্ত রয়েছে। এমন কি তার নিকটবর্তী যে কোন তিনজন লোক বলতে শুরু করেছে, অমুক ব্যক্তি অবুক্ত রয়েছে। তখন তার পক্ষে ভিক্ষা করা জায়েয, যেন জীবনে বেঁচে থাকার সম্বল সে পেতে পারে। অথবা বলেছে- জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারে। এদের ছাড়া- হে কুবাইচা- অন্য কেউ ভিক্ষা করলে তা ঘুষ হবে এবং সে ঘুষের ন্যায় হারাম খাবে। [হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আহমাদ, মুসলিম, নাসায়ী, আবূ দাউদ নাইলুন আওতার ৪র্থ খণ্ড-১৬৮ পৃ.]
হাদীসের কথা ‘বিপদের ঝুঁকি গ্রহণ’ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সে লোক ব্যক্তিগতভাবে ধনী। কেননা ফকীরের জন্যে তো জীবিকার উপকরণ সংগ্রহ প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার কোন প্রশ্ন ওঠে না। [(আরবী**********) এই গ্রন্থকার লিখিত: ২২১-২২২পৃ]
বস্তুত পারস্পরিক সম্পর্কের সুস্থতা বিধান, শান্তি-সম্প্রীতি স্থাপন বা রক্ষা করার জন্যে ঋণগ্রস্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে অর্থ দিয়ে সাহায্যকরণ ইসলামের একটা বিশেষ অবদান। বিপদগ্রস্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত লোকদেরকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করা এবংতাদের হাত এমন দৃঢ়ভাবে ধারণ করা- যেন তার পতিত অবস্থা থেকে সে উপরে উঠতে পারে। সন্দেহ নেই, এটা কেবলমাত্র ইসলামেরই এক বিশেষ অবদান। বিশ্বে যখন জিনিসপত্র, পণ্যদ্রব্য, জীবন ইত্যাদির ওপর দুর্ঘটনা ও বিপদাপদের ক্ষেত্রে সীমা ব্যবস্থা চালু হয়নি- বিশ্ব মানব তার সাথে কিছু মাত্র পরিচিতও ছিল না, ঠিক তখনই এ সবের বহু পূর্বের ইসলাম বাস্তবভাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। অতএব যে দরিদ্র ব্যক্তির অনশন অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেশীর অন্তত তিনজন লোক সাক্ষাৎ দেবে, তারই জন্যে দয়া ভরা দুটি বাহু বিস্তীর্ণ করে দেয়ার শিক্ষা মানুষকেই ইসলাম দিয়েছে। অবশ্য একজন লোক অভুক্ত থাকলেই এবং দরিদ্র্যের দাবি করলেই তা করতে হবে এমন কথা নয়।
ইসলামের এই অবদানের ওপর আরও বড় অবদান হচ্ছে, যাকাত দেয়ার চরম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে জীবিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে দেয়া। সুখী জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণকরণ- যার ফলে সে সত্যিই নিশ্চিত ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে। কেবল দুই চার মুঠি খাবার দিয়ে তার মেরুদণ্ড খাড়া রাখাই তার উদ্দেশ্য নয়। [(আরবী **********)]
মৃতের ঋণ শোধে যাকাত ব্যবহার
এখানে একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে, তা হচ্ছে, যাকাত দ্বারা যেমন জীবিত ব্যক্তির ঋণ শোধ করা যায়, তেমনি মৃত ব্যক্তির ঋণও কি শোধ করা যাবে? ইমাম নববী এ পর্যায়ে শাফেয়ী মাযহাবের দুটি মতের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে জায়েযন। বলা হয়েছে সাইমারী, নখরী, আবূ হানীফা ও আহমাদ এই মতই পোষণ করতেন।
আর দ্বিতীয়, তা জায়েয। কেননা আয়াতে সাধারণভাবেই ঋণগ্রস্তের কথা বলা হয়েছে। অতএব মৃতকে জীবিতের ন্যায় মনে করেই তার ঋণও শোধ করা যাবে। আবূ সওর এ মতই দিয়েছেন। [(আরবী **********)]
অনুরূপ ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, মৃতের ঋণ শোধে যাকাতের টাকা দেয়া জায়েয নয়। কেননা এ অবস্থায় ঋণগ্রস্ত ব্যকিত্ মৃত। তাকে তো দেয়ার উপর নেই। আর যদি ঋণদাতাকে দেয়া হয়, তাহলে তা দেয়া হবে ঋণদাতাকে, ঋণগ্রস্তকে নয়। [(আরবী **********)]
দ্বিতীয কথা হচ্ছে, মৃতের ঋণ শোধে যাকাত জায়েয। কেননা আয়াত সাধারণ অর্থবোধক। তা সর্ব প্রকারের ও স্বাবস্থার ঋণগ্রস্ত পরিব্যাপ্ত; সে জীবিত হোক, কি মৃত। তাছাড়া মৃত ব্যক্তির ঋণ শোধ দিয়ে তার প্রতি একটা বাদান্যতা দেখানোও সম্ভব এবং এটা সঠিক কাজ। মালিক ও আবূ সওরও এই কথা বলেছেন। [দেখুন (আরবী **********)]
খলীলের মূল রচনার ওপর টীকা লিখতে গিয়ে খরশী বলেছেন: ঋণগ্রস্তের ক্ষেত্রে জীবিত ও মৃতের মধ্যে কোন পার্থক্য করা যাবে না। রাষ্ট্রকর্তা যাকাত ফাণ্ড থেকে নিয়ে মৃতের ঋণ শোধ করে দেবে। বরং অন্যরা বলেছেন, মৃতের ঋণ বাবদ যাকাত প্রদান জীবিতের ঋণের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বসম্পন্ন যেহেতু তার ঋণ শোধ হওয়ার আর কোন আশা নেই। কিন্তু জীবিতের ঋণ সে রকম নয়। [দেখুন (আরবী **********)]
ইমাম কুরতুবী লিখেছেন, [(আরবী **********)] আমাদের আলিম ও অন্যরা বলেছেন, যাকাতের অর্থ দিয়ে মৃতের ঋণ শোধ করা যাবে। কেননা সেও ‘গারেমীন’ ‘ঋণগ্রস্ত’ লোকদের মধ্যে গণ্য। নবী করীম (স) বলেছেন:
(আরবী **********)
প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির জন্যে আমি তার নিজের থেকে অধিক আপন যে লোক ধন-মাল রেখে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। আর যে লোক ঋণ অথবা (বলেছেন) অসহায় সন্তানাদি রেখে যাবে তা আমার ওপর ন্যস্ত হবে। [হাদীসের শব্দ (****) বলতে ছোট ছোট শিশু সন্তান বোঝানো হয়েছে, যারা দারিদ্র্যের চাপে অসহায় বলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। হাদীসটি বুখারী মুসলিম উদ্ধৃত।]
শিয়া জাফরী ফিকাহ্রও এই মত [(আরবী **********)]
এই গ্রন্থকার একটি মতকে অগ্রাধিকার দিতে চান। শরীয়াতের অকাট্য দলীলসমূহ ও তার অন্তর্নিহিত ভাবধারা যাকাত থেকে মৃতের ঋণ শোধ করতে কোন বাধা দিচ্ছে না, নিষেধও করছে না। কেননা আল্লাহ্ যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র দুই প্রকারের নির্ধারণ করেছেন। এক প্রকারের হল তারা তাদের পাওয়ার অধিকার রয়েছে, তাদের উল্লেখ করা হয়েছে। দিয়ে অর্থাৎ মালিক বানানো। তারা হচ্ছে, ফকীর, মিসকীন, যাকাত কাজে নিযুক্ত কর্মচারী এবং মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম। এরা যাকাত পেয়ে তার মালিক হয়ে যায়। আর অপর ভাগের লোকদের উল্লেখ করেছেন (***) এর অধীন। তারা অবশিষ্ট চার শ্রেণীর লোক- দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত লোক, আল্লাহ্র পথে ও নিঃস্ব পথিক অর্থাৎ তিনি যেন বলেছেন, যাকাত ‘গারেম’ দের মধ্যে ব্যয় হবে, গারেমদের জন্যে বলেন নি। অতেএব গারেমকে যাকাতরে মালিক বানানোর প্রশ্ন নেই। ফলে তাদের ঋণ শোধ করাসম্পূর্ণ জায়েয। ইমাম ইবনে তাইমিয়া এই মত পসন্দ ও গ্রহণ করেছেন, তার পক্ষে ফতোয়াও দিয়েছেন। [(আরবী **********)] উপরিউক্ত হাদীসও এই মতের সমর্থক।
যাকাত থেকে ‘করযে হাসানা’ দেয়া
এই পর্যায়ের আলোচনা পূর্ণাঙ্গ করার জন্যে আরও একটি বিষয়ে কথা বলতে হবে। তা হচ্ছে, যাকাতের টাকা ‘করযে হাসানা’ স্বরূপ দেয়ার বিষয়… তা কি জায়েয হবে- যদি ঋণগ্রস্তদের মতই মনে করা যায় ‘কযে হাসানা প্রার্থীদেরকে?… না আমরা আক্ষরিকভাবেই তাকে ধরে নেবও তা জায়েয নয় মনে করব? এই কথা ধরে নিয়ে যে, ‘গারেম’ হচ্ছে শুধু সেসব লোক,যারা কার্যত ঋণ গ্রহণ করেছে?
আমি মনে করি, যাকাত পর্যায়ের সহীহ্ কিয়াস ও ইসলামের সাধারণ লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে ‘গারেম’দের জন্যে নির্দিষ্ট যাকাত অংশ থেকে ঠেকায় পড়া লোকদেরকে ‘করয’ দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয। তবে সেজন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে ও একটি নির্দিষ্ট ফাণ্ড গড়ে তুলতে হবে। সুদী কারবার প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থাস্বরূপ যাকাতকে এভাবে বন্টন করা বাঞ্ছনীয়। ‘করযে হাসানা’ দান সুদী কারবার রীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আবূ জুহ্রা, খাল্লাফ ও হাসান- একালের ইসলামী চিন্তাবিদগণ যাকাত সম্পর্কে উপরিউক্ত রূপ মত প্রকাশ করেছেন। তার কারণ ধরা যায় এই যে, ভালো কাজের জন্যে গৃহীত ঋণ যদি যাকাত থেকে আদায় করা যায়, তা হলে সুদমুক্ত ঋণ- ‘করযে হাসানা’ –তা থেকে দেয়া যাবে আরও অধিক উত্তমভাবে। …. তা তো শেষ পর্যন্ত বায়তুলমালেই প্রত্যাবর্তিত হবে। [(আরবী **********)] চিন্তাবিদগণ এই কথা বলেছেন উপরিউক্তি কিয়াসের ভিত্তিতে। উপমহাদেশীয় প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ডঃ হামিদুল্লাহ হায়দারাবাদীই (ইস্তাম্বুল, প্যারিস প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)-ও এই মতই প্রকাশ করেছেন। [এই গ্রন্থটির আরবী অনুবাদ প্রকাশ করেছেন (আরবী **********) সিরিজ হিসেবে।] তিনি ‘সুদবিহীন ঋণ ও ব্যাংক’ শীর্ষক আলোচনায় এই কথাটির বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি এই পর্যায়ে যুক্তি প্রদর্শনরূপ বলেছেন, কুরআন যাকাতের পরিকল্পনায় ‘গারেমীন’ –ঋণগ্রস্ত লোকদের জন্যে একটি অংশ নির্দিষ্ট করেছে। এই ঋণ ভারাক্রান্ত লোকেরা দুই প্রকারের হয়ে থাকে- তা সকলেই জানেন:
১. প্রতি মুহূর্ত প্রতিঘাতকারী দারিদ্র্য ও উপায়-উপকরণহীন হওয়ার কারণে যারা নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ ফেরত দিতে সমর্থ হচ্ছে না।
২. এমন সব লোক, যাদের রয়েছে সাময়িক প্রয়োজন, অবশ্য তাদের উপায়-উপকরণও রয়েছে, যদ্দারা একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সে সাহায্য সহযোগিতা লাভ করতে পারে, যা তারা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। [দেখুন পূর্বোক্ত সূত্রের ৮-৯ পৃ.]
উপরিউক্ত চিন্তাবিদ এই প্রকারের ঋণ প্রার্থীদেরকে কুরআনে বর্ণিত ‘গারেমীন’ পর্যায়ে গণ্য করেছেন। কিন্তু তা কি করে হয়? ‘করয’ গ্রহণের পূর্বে তো সে ‘গারেম’ ছিল না? কাজেই আবূ জুহ্রা প্রমুখ উপরিউক্ত তিন জন ফিকাহ্বিদ যে মত দিয়েছেন তাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তারা উত্তম কিয়াসের ভিত্তিতেই এ কথা বলেছিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ফী-সাবীলিল্লাহ্- আল্লাহ্রপথে
কুরআন মজীদ সপ্তম পর্যায়ে যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র বাখাত হিসাবে উল্লেখকরেছে (****) এবং আল্লাহ্র পথে…। এই খাতটির প্রকৃত লক্ষ্যকি? আয়াতে কোন্সব লোকদের সাহায্যের জন্যে বলাহয়েছে?
বাক্যটির প্রকৃত আভিধানিক অর্থ সুস্পষ্ট। ‘সাবীল’ অর্থ পথ। আর ‘সাবীলিল্লাহ্’ অর্থ আকীদা-বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় যেপথ, তা।
‘আল্লামা ইবনুল আসীর বলেছেন: ‘সাবীল’ অর্থ পথ। আর সাবীলিল্লাহ্ সাধারণ অর্থবোধক এমন যে কোন কার্যক্রমই বোঝায়, যা খালেসনিয়তে করা হবে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে, তা করা যাবে ফরয, নফল ও বিভিন্ন ধরনের ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টিমূলক কাজ-কর্মের মাধ্যমে, আর এই কথাটি যখন বাস্তবে প্রয়োগ করা হবে, তখন প্রধানত তা ব্যবহৃত হবে ‘জিহাদ’ অর্থে। ব্যাপক ও বেশি বেশি ব্যবহারের দরুন এক্ষণে যেন ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ বলতে এই জিহাদকেই বোঝাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বাক্যটির যেন এ ছাড়া অন্য কোন অর্থই নেই। [আরবী *********]
ইবনুল আসীর কর্তৃক ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ বাক্যের উপরিউক্ত তাফসীর থেকে আমাদের সম্মুখে নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে:
১. বাক্যটির আসল আভিধানিক অর্থ: এমন সব খালেস আমল যা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করিয়ে দেয়। সর্বপ্রকারের নেক আমলিই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হোক, কি সামষ্টিক।
২. বাক্যটির অর্থ সাধারণভাবে ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে যা মনে করা হয়, তা হচ্ছে জিহাদ। এই অর্থে বেশি ব্যবহারের দরুন কেবল এটার মধ্যেই সীমিত হয়ে গেছে বাক্যটির সমস্ত তাৎপর্য।
উপরিউক্ত দুটি অর্থের দ্বন্দ্বে যাকাত ব্যয়ের এ খাতটির সঠিক তাৎপর্য নির্ধারণে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টির কারণহয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণেই এ দ্বিতীয় অর্থটি ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্যের অন্তর্ভুক্ত ধরে নেয়া হয়েছে ফিকাহ্বিদদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
কিন্তু অন্য একটি ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। তা হচ্ছে, ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’- এর অর্থ কি শুধু জিহাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ- যেমন ব্যবহারিকতায় সাধারণভাবেই তা বোঝা যায় অথবা তা অগ্রসর হয়ে তার আসল আভিধানিক অর্থটিকেও শামিল করে নেবে? …. তখন তা কেবল জিহাদের সীমার কাছে এসে থেমে যাবে না, এবং সর্বপ্রকারের কল্যাণময় নেকের কাজই শামিল হবে, কোন একটিও এর বাইরে পড়ে থাকবে না।
আমরা এখানে ফিকাহ্বিদদের মতামত ও এই খাতের শরীয়াতসম্মত তাৎপর্য নির্ধারণে তাঁদের মতবৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে বিশদ আলোচনা উপস্থাপিত করছি। আমাদের বিবেচনায় যেটি সত্যতা-যথার্থতার নিকটবর্তী হবে, আমরা সেই মতটিকে অগ্রাধিকার দেব। তাওফীক আল্লাহ্ই দেবেন।
হানাফী মাযহাব
হানাফী ফিকাহ্বিদগণ ‘সাবীলিল্লাহ্’ –এর বিশ্লেষণেবলেছেন: ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলে- ইমাম আবূ ইউসুফের মতে- মুজাহিদদের সাথে শামিল হয়ে ইসলামী জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি যেসব লোক তাদের দারিদ্র্যে কারণে- সম্বলবা যানবাহন প্রভতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বা না থাকার কারণে, তাদের সাহায্য দেয়াই এর উদ্দেশ্য। তারা নিজেরা উপার্জনকারী হলেও তাদের জন্যে যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে। কেননা উপার্জনে মশগুল থাকলে তারা জিহাদে শরীক হতে পারবে না।
ইমাম মুহাম্মাদের মত হচ্ছে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলে সেসব হাজীদের বোঝানো হয়েছে, যারা কোন কারণে হজ্জ কার্যকরতে সমর্থ হচ্ছে না। কেননা বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি তার একটি উট ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ দিয়ে দিল। তখন নবী করীম(স) তাকে নির্দেশদিলেন উটটিকে হাজী বহন করে নেয়ার কাজে লাগানোর জন্যে। তাহলে বোঝা গেল যে, হজ্জ্ও আল্লাহ্র পথ। আরও এজন্যে যে, ‘আল্লাহ্পর পথে’ বলতে আল্লাহ্র আদেশ পালন ও তাঁর আনুগত্য করা বোঝায়, আল্লাহ্র দুশমন নফ্সবা কুপ্রবৃত্তি দমন এর অন্তর্বুক্ত।
বলা হয়েছে, ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলে দ্বীনি ইলম শিক্ষার্থীদের বোঝানোহয়েছে। ‘ফতোয়ায়ে জহীরীয়া’ গ্রন্থে কেবলমাত্র এই অর্থটিই গৃহীত হয়েছে। কিন্তু অনেকে এ অর্থটি অবাস্তব মনে করেন। কেননা আয়াত যখন নাযিল হয়েছিল,তখন সে সমাজে ‘দ্বীনি ইল্ম শিক্ষার্থী’ বলতে কোন লোক-সমষ্টির অস্তিত্ব ছিল না। এর জবাবে বলা হয়েছে, দ্বীনি ইলম শিক্ষা হচ্ছে শরীয়াতের বিধান শিখে উপকৃত হওয়া। নবী করীম(স)-এর সঙ্গে লেগে থেকে যারা ইসলামী বিধান শিক্ষা লাভ করেছিলেন, কোন ‘তালেবে ইলম’ই কি তাঁদের মর্যাদায় পৗঁছাতে পারে?… আসহাবে সুফফার সমান মর্যাদার লোক আছে কি দুনিয়ায়?
আল্লামা কাসানী তাঁর (********) গ্রন্থে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলতে আল্লাহ্র নৈকট্য ও ইবাদতমূরকসমস্ত কাজই’ মনে করেছেন। আর কাব্যটির আসল তাৎপর্যও তাই। ফলে আল্লাহ্র কাজে চেষ্টাকারী ও সর্বপ্রকার কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত লোকগণই এর অন্তর্ভুক্ত হবে- যদি তারা অভাবগ্রস্ত হয়।
ইবনে নজীম ‘বাহ্রুর’ রায়েক’ গ্রন্থে বলেছেন, দারিদ্র্যের শর্ত লাগানোহলেতার সর্বদিক দিয়েই দারিদ্র্য থাকতে হবে। [দেখুন : আরবী********)]
‘আল-মানার তাফসীর লেখক’ বাহরুর-রায়েক’ গ্রন্থকারের উপরিউক্ত মতের সমালোচনা করে বলেছেন: [আরবী ********]: দরিদ্র্যের শর্ত করার ফলে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ খাতটি স্বতন্ত্র খাত হওয়ার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়। কেননা তাহলে তারা তো প্রথমখাত (****)-এর মধ্যেই গণ্য হতে পারে।
[হানাফী আলিমগণ এরূপ আপত্তি তুলেছেন। তারা যা জবাব দিয়েছন তা সন্তোষজনকনয়। ‘বাহ্র’ গ্রন্থে ‘আন-নিহায়া’ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, বলেছেন, জিহাদকারী ও হাজীদের পেছনে থেকে যাওয়া লোকদের নিজেদের দেশে কোন ধন-মাল না থাকলে তারা ফকীর শ্রেণীভুক্ত। অন্যথায় তারা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ খাতে সাহায্য পাবে। আমিবলব, সে ফকীর, তবে আল্লাহ্র ইবাদতে একান্তভাবে মশগুল হয়ে আছে, এটা অতিরিক্ত। ফলে সে সাধারণ ফকীর থেকে ভিন্ন অবস্থার হয়ে গেল। তখন এই শর্ত থেকে মুক্ত হল। (দেখুন: (আরবী*******)
আমি বলব, অবস্থা যা-ই হোক, ফকীর শ্রেণীর পর্যায় বাইরে আসতে পারেনি। আলূসী তাঁর তাফসীরে (৩য় খণ্ড ৩২৮ পৃ.) ফিকাহ্বিদদের মত উদ্ধৃত করেছেন: যুক্তিপূর্ণ কথা যা আল-যাসসাস উল্লেখ করেছেন, তা হল যে লোক তার নিজের দেশে ও শহরে ধনী, যার খাদেম ও যানবাহন ঘোড়া আছে এবং অতিরিক্ত অর্থ আছে, এমন যে, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ হালাল হয় না, সেযদি জিহাদের সফরে গিয়ে প্রস্তুতি ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে পড়ে- নিজ বাড়িতে যদিও সে সেজন্যে অভাবগ্রস্ত নয়- তাকে যাকাত দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয, সে নিজ দেশে ধনী হলেও।]
হানাফী ফিকাহ্র আলিম ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্য নির্ধারণে বিভিন্ন মত দিয়ে থাকলেও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র মধ্যে গণ্য হওয়া সব লোকের জন্যেই গরীবও অভাবগ্রস্ত হওয়া জরুরী শর্ত বিশেষ- সে ইসলামী যোদ্ধা হোক, কি হাজী, তালেবে-ইলম হোক, কি কল্যাণময়কাজসমূহে চেষ্টা-প্রচেষ্টাকারী। এজন্যেই তাঁরাবলেছেন, মতপার্থক্যটা আসলে শব্দগত, যখন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ মতৈক্য রয়েছে যে, যাকাত পেতে পারে এমন সব পর্যায়ের লোকদেরকে তা দেয়া যাবে। তবে যাকাত কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের ব্যাপারে এই শর্ত নেই।
আমরা জানি, অভাবগ্রস্ত ফকীরের জন্যে যাকাতের একটা নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে, যদিও এসব গুণের কোন একটিরও তারা অধিকারী বা এই গুণে বিশেষিত নয়।
তাহলে এ ক্ষেত্র ব্যাখ্যাটি আলাদাভাবে উল্লিখিত হয়ে কোন্ ভূমিকাটা পালন করেছে? কুরআন তাকে আলাদা একটি খাতরূপে চিহ্নিতই বা করল কেন?
যেমন হানাফী আলিমগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, যাকাতকে একজনের মালিকানাভুক্ত করে দিতে হবে। কাজেই তা মসজিদ, পুল, পানশালা নির্মাণও রাস্তাঘাট মেরামতের কাজে ব্যয় হতে পারে না। খাল কাটা, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদির কাজেও তা লাগতে পারে না, কেননা এসব ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে যাকাতের মালিক বানিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না। মৃতের কাফন ও তার ঋণ শোধ দেয়ার ব্যাপারেও এই কথা সত্য। [(আরবী**********)]
মালিকী মাযহাবের মত
কাযী ইবনুল আরাবী ‘আহকামুল কুরআন’ গ্রন্থে ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’-এর ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে ইমাম মালিকের এই মত উদ্ধৃত করেছেন: আল্লাহ্র পথ বলতে অনেক কিছুই বোঝায়। কিন্তু এখানে ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্য যে ইসলামী যুদ্ধ- আল্লাহ্র বহু পথের একটি, তাতে কোন মতবিরোধ আছে বলে আমার জানা নেই। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল হেকাম বলেছেন, পানি পান করানো অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রপাতি বা জিনিসপত্র ক্রয়ের কাজে যাকাত ব্রয় হতে পারবে। শত্রুপক্ষকে অবস্থান গ্রহণ থেকে বিরত রাখার কাজেই তাই। কেননা এসবই যুদ্ধ ও তার পক্ষের কার্যাবলী। নবী করীম (স) সহল ইবনে আবূ হাস্মা কর্তৃক সৃষ্ট বিপজ্জনক অবস্থায় বিদ্রোহের আগুন নিভাবেনার জন্য একশত উট যাকাত ফাণ্ড থেকে দিয়েছিলেন। [ (আরবী **********)]
খলীলের মূল আলোচনায় দর্দীর রচিত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মুজাহিদ, পাহারাদার এবং এই দুইজনের কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতি সংগ্রহে যাকাতের টাকা দেয়া যাবে। এই টাকা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করা যাবে, চলাচলের জন্যে ঘোড়াও খরিদ করা যাবে। মুজাহিদ নিজে ধনী হলেও সে যাকাত নিতে পারবে। কেননা তার এই যাকাত গ্রহণ জিহাদের জন্যে- জিহাদের কারণে, দারিদ্র্যের কারণে নয়। গুপ্তচর পাঠিয়ে শত্রু সম্পর্কিত খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্যেও যাকাত ব্যয় করা যাবে। সে কাফির হয়েও যদি খবর এনে দেয় তা হলেও। কিন্তু খলীলের মত অনুযায়ী শহর-নগরের চতুর্দিকে কাফিরদের আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রাচীর নির্মাণের জন্যে যাকাত ব্যয় করা জায়েয হবে না। যে যানবাহনে চড়ে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তা ক্রয় করার কাজেও তা ব্যয় হবে না।
দসূকী তাঁর টীকায় উল্লেখ করেছেন, প্রাচীর নির্মাণ ও যুদ্ধের যানবাহন নির্মাণে যাকাত ব্যয় না করর এই মতটি ইবনে বশীরের; অন্যদের নিকট এই কথাটি পরিচিত নয়। ইবনে আবদুল হেকাম তার বিপরীত কথা বলেছেন। লখ্মী প্রমুখ তার উল্লেখ করেন নি। ‘তাওজীহ’ গ্রন্থে তা প্রকাশ করা হয়েছে। ইবনে আবদুস সালাম এই মতটিকে সহীহ্ বলে অভিহিত করেছেন। [দেখুন : (আরবী **********)]
মালিকী মযাহাবের মতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
১. তাঁরা সকলে একমত এ ব্যাপারে যে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ কথাটির সম্পর্ক যুদ্ধ-জিহাদ ও এই অর্থের পাহারাদারী ইত্যাদি কাজের সাথে। কিন্তু হানাফী মতের আলিমগণ জিহাদ, হজ্জ, ইল্ম শিক্ষা ও অন্যান্য আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কার্যাবলীর মধ্যকার পার্থক্যের ব্যাপারে বিভিন্ন মত পোষণ করেন।
২. তাঁরা জিহাদকারী ও পাহারাদারীর কাজে নিযুক্ত লোককে ধনী হলেও যাকাত দেয়া জায়েয মনে করেন। হানাফীরা ভিন্ন মত দিয়েছেন। তাঁদের এ বিষয় সংক্রান্ত মতটি কুরআনের বাহ্যিক অর্থের সাথে সংগতিপূর্ণ। কেননা কুরআনে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’কে ফকীর মিসকীন উভয় খাত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি খাতরূপে চিহ্নিত করেছে। উক্ত মত হাদীসের সাথে নৈকট্যসম্পন্ন, কেননা হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে: পাঁচজন লোক ছাড়া অন্যদের জন্যে যাকাত হালাল নয়। এই পাঁচজনের মধ্যে ‘আল্লাহ্র পথে যুদ্ধকারী’ও উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে ‘গারেমীন’ পর্যায়ের আলোচনায় বিশদভাবে কথা বলা হয়েছে। হানাফীরা যোদ্ধার জন্যে গরীব হওয়ার যে শর্ত করেছেন, ইবনুল আরাবীর মতে তা অত্যন্ত দুর্বল কথা। বলেছেন, এটা কুরআনের কথার ওপর অতিরিক্ত। আর তাঁদের মতে মূল দলিলের ওপর অতিরিক্ত বলা হলে সেই কথাকে মনসূখ করা হয়, অথচ কুরআনের কোন কিছু মনসূখ হতে পারে কেবল অনুরূপ কুরআনের দ্বারা অথবা ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস দ্বারা মাত্র। [দেখুন: (আরবী**********)]
৩. জমহুর ফিকাহ্বিদগণ যুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয মাল-মসলা, অস্ত্রশস্ত্র, অশ্ব বা যানবাহন, প্রাচীর, যুদ্ধজাহাজ প্রভৃতি সবকিছু যাকাতের টাকা দিয়ে ক্রয় বা নির্মাণ করা সম্পূর্ণ জায়েয বলে মনে করেন। তাঁরা যাকাতকে কেবলমাত্র জিহাদকারীদের জন্যে ব্যয় করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে রাজী নন। তা হচ্ছে হানাফীদের মত। কেননা তারা তো একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে যাকাতের মালিক বানিয়ে দেয়াও ওয়াজিব বলে মনে করেন। কিন্তু জিহাদে বিনিয়োগে তা সম্ভব নয়।
সত্য কথা হচ্ছে, মালিকীদের উপরিউক্তি মত কুরআনের ব্যাখ্যারসাথে অধিক সাযুজ্যপূর্ণ। কেননা কুরআনের এই বাক্যটি (***) দিয়ে বলা হয়েছে: (***) দিয়ে নয়, (***) দিলেই মালিক করানো বোঝা যেত। বাহ্যত এরূপ বর্ণনার দরুন যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজে যাকাত ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্তি মুজাহিদদের জন্যে ব্যয় করার পূর্বেই অনুভূত হয়।
শাফেয়ী মত
শাফেয়ী মাযহাবের বক্তব্য হল, ‘সাবীলিল্লাহ’ বলতে তাদের বোঝায়, যারা যুদ্ধ করছে সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে, এজন্যে সরকারের নিকট থেকে কোন মাসিক বেতনের দাবি করে না। ইমাম নববীর লিখিত ‘আল-মিনহাজ’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার আল হাইসী রচিত তার ব্যাখ্যায় এ কথা উদ্ধৃত হয়েছে। অথবা ইবনে হাজারের কথানুযায়ী রিযিকপাওয়ার লোকদের তালিকায় তাদের জন্যে অংশ নির্দিষ্ট নেই। বরং তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করে যখন তারা নিজেরাই উৎসাহী হয়। অন্যথায় তারা নিজেদের পেশা ব্যবসায় ও শিল্পকর্মে লিপ্ত থাকে। বলেছেন, ‘সাবীলিল্লাহ’ বিষয়গতভাবে সেই পথ যা আল্লাহ্র নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। পরে শব্দটি জিহাদ বোঝাবার জন্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা জিহাদে শরীক হওয়ার পরই মানুষসেই শাহাদাত বরণ করার সুযোগ পেতে পারে যা আল্লাহ্র নিকটবর্তী করে দেয়। অতঃপর উক্ত লোকদের বোঝানো হচ্ছে। কেননাপ তারা কোনরূপ বিনিময় না নিয়েই জিহাদ করছে। ফলে তারা যাকাত পাওয়ার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় উত্তম অধিকারী হয়ে দাঁড়ায়। [দেখুন (আরবী ************) এবং ] তাদের যুদ্ধকাজে সাহায্যকারী ও প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়করে দেয়া যাবে- তারা নিজেরা ধনী হলেও।
ইমাম শাফেয়ী তাঁর (****) গ্রন্থে অকাট্যভাবে লিখেছেন ‘সাবীলিল্লাহ’র ভাগ থেকে যোদ্ধাদের যাকাত দেয়া যাবে, সে গরীব হোক কি ধনী। তা থেকে অন্যদের দেয়া যাবে না। তবে দেয়া একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়লে দেয়া যাবে তাকে যে যাকাতের প্রতিবেশী হয়ে কাফিরদের আক্রমণের মুকাবিলায় প্রতিরক্ষার কাজ করে। [(আরবী ************)] (যাকাতের প্রতিবেশী অর্থ: যে অঞ্চল থেকে যাকাত সংগৃহীত হয়েছে, সেখানকার অধিবাসী হওয়া)।
যাকাত প্রতিবেশী হওয়ার শর্ত করা হয়েছে এজন্যে যে, যেখানে যাকাত পাওয়া গেল সেখান থেকে তা স্থানান্তরিত করা জায়েয নয়।
ইমাম নববী তাঁর (****) গ্রন্থে লিখেছেন:
‘গাযী-ইসলামী যোদ্ধাকে তার যাতায়াতকালীন যাবতীয় ব্যয় ও পোশাক দেয়া হবে, বিদেশে অবস্থানকালেও, তা যত দীর্ঘই হোক। তবে সমস্ত শ্রমমূল্য দেয়া হবে, না বিদেশ যাত্রার দরুন যা অতিরিক্ত হবে শুধু ততটুকু দেয়া হবে, এ পর্যায়ে দুটি দিক রয়েছে:
‘অশ্ব ক্রয়ের টাকা দেয়া হবে যদি সে অশ্বারোহী হয়ে যুদ্ধ করে। অস্ত্র ও যুদ্ধ সংক্রান্ত অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যও ক্রয় করার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে এবং তা সবই তার মালিকানাভুক্ত হবে। অবশ্য অস্ত্রও যানবাহন ভাড়ায়ও নেয়া যেতে পারে। সম্পদের প্রাচুর্য বা স্বল্পতার দৃষ্টিতে তা বিভিন্ন হবে। আর পায়ে হেটে যুদ্ধ করলে তাকে অশ্বক্রয়ের জন্যে যাকাত দেয়া হবে না।’
ইমাম নববী আরও বলেছেন, ‘আল-মিফতাহ্’ গ্রন্থের কোন কোন শরাহ গ্রন্থে লিখিত রয়েছে, গাযীকে তার নিজের এবং তার পরিবারবর্গের খরচপত্র দেযা হবে যুদ্ধযাত্রা, অবস্থান গ্রহণ ও প্রত্যাবর্তনকালীন সমস্ত সময়ের জন্যে। তবে জম্হুর ফিকাহ্বিদগণ যোদ্ধার পরিবারবর্গের ব্যয়ভার বহন পর্যায়েকিছু বলেন নি। কিন্তু তা দেয়াও অকল্পনীয় নয়, অস্বাভাবিকও নয়। বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান এ ব্যাপারে ইচ্ছাধিকারী। ইচ্ছা করলে ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র সবকিছুরই তাকে মালিক বানিয়েও দিতে পারে। আর ইচ্ছা করলেতার জন্যে একটা বাহানও ভাড়া করতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে যাকাতের এই অংশথেকে একটা ঘোড়া ক্রয় করে তা আল্লাহ্র পথে ওয়াক্ফও করে দিতে পারে।তখন সে তার ওপর প্রয়োজন মত আরোহণ করবে ও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তা ফেরত দেবে। [(আরবী ************)]
যদি রাষ্ট্রীয় অর্থ ভাণ্ডার থেকে ‘ফাই’ নিঃশেষিত হয়ে যায়, রাষ্ট্রের হাতে এমন সম্পদ না থাকে যা দিয়ে যাদের রিযিক দেয়ার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে তাদের তা দেয়া সম্ভব হতে পারে এবং মুসলিমসমাজ যদি কাফির শত্রুদের দুষ্কৃতি থেকে সংরক্ষিত থাকার জন্যে কোন লোক নিয়োগের প্রয়েঅজনবোধ করে, তাহলেতাদেরকে যাকাতের ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ অংশ থেকে দেয়া যাবে কি না, এ একটি জরুরী প্রশ্ন। এ পর্যায়ে শাফেয়ী ফকীহ্গণ আলোচনা করেছেন। ইমাম নববী বলেছেন, এ পর্যায়ে দু’টি কথা। তন্মধ্যে অধিক স্পষ্ট কথা হচ্ছে, দেয়া যাবে না। তবে মুসলিম ধনী লোকদের দিয়েতার সাহায্য করাতে হবে। [(আরবী *********)]
ধনী লোকেরা যদি অস্বীকার করে; কিংবাতাদের নিকট অতিরিক্ত ধন-মাল না থাকে এবং রাষ্ট্রপ্রধান ‘ফাই’ পাওয়ার যোগ্য লোকদের ছাড়া অন্য কাউকেনা পায়, তাহলেতাদের জন্যে যাকাত থেকে প্রয়োজনমত গ্রহণ করা কি জায়েয হবে?
ইবনুলহাজার জোর করে বলেছেন, হ্যাঁ, তা তাদের জন্যে হালাল হবে। [(আরবী ************)]
এ পর্যায়ে আমাদের বিবেচনা হচ্ছে:
‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র খাতটিকে কেবলমাত্র জিহাদ ও মুজাহিদদের মধ্যে সীমিতকরণে শাফেয়ী ও মালিকী মাযহাব ঐকমত্য পোষণকরে।আর মুজাহিদকেতার জিহাদের সাহায্যকারী জিনিসপত্র দেয়ার ব্যাপারে- সে ধনী ব্যক্তি হলেও জায়েয এবং মুজাহিদের জন্যে জরুরী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে যাকাত ব্যয় করার অনুমতি প্রদানের ব্যাপারেও কোন মতপার্থক্য দেখা যায় না।
কিন্তু শাফেয়ীরা এ পর্যায়ে দুটি ব্যাপার হাম্বলীদের থেকে ভিন্নমত পোষণকরেন:
১. তাঁরা শর্ত করেছেন, মুজাহিদকে নফল জিহাদকারী হতে হবে, যার জন্যে যাকাতের কোন অংশ বা সরকারী ভাণ্ডারে কোন বেতন নির্দিষ্ট নেই।
২. এই অংশ ফকীর-মিসকীনের জন্যে নির্দিষ্ট অংশদ্বয়ের তুলনায় অধিক ব্যয় করা জায়েয মনে করেন না।– কেননা ইমাম শাফেয়ীর কথা হচ্ছে, আটটি খাতের মধ্যে সমান পরিমাণ ব্যয় করা ওয়াজিব।…
হাম্বীল মত
শাফেয়ী মাযহাবের ন্যায় হাম্বলী মাযহাবের বক্তব্য হল, যাকাতের ‘সাবীলিল্লাহ’ খাত থেকে অংশ দেয়া হবে সেই মুজাহিদদের যারা নফল হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করেছে, যাদের জন্যে কোন বেতন নির্দিষ্ট নেই বা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম সম্বল রয়েছে। এরূপ অবস্থায় মুজাহিদকে তার যুদ্ধ কাজের জন্যে প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণদেয়া হবে- সে ধনী ব্যক্তি হলেও। সে যদি কার্যত যুদ্ধ না করে তাহলে সেযা নিয়েছে তা ফেরত দেবে। এদের নিকট এটাই ঠিকযে, ঘাঁটিসমূহে পাহারাদারীকরাও কার্যত যুদ্ধের মতই কাজ এবং উভয়ই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ রূপে গণ্য।
‘গায়াতুল মুন্তাহা’ গ্রন্থ এবংতার শরাহ্ পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রপ্রধান যাকাতের মাল দিয়ে অম্ব খরিদ করে তা এমন ব্যক্তিকে দিতে পারে- দেয়া জায়েয- যে তার ওপর সওয়ার হয়ে যুদ্ধ করবে। সেই যোদ্ধা নিজে যাকাতদাতা হলেও কোন দোষনেই। কেননা সে নিজের যাকাত বায়তুলমালে জমা দেয়ার পর তা থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে যাকাতের টাকা দিয়ে যুদ্ধজাহাজও ক্রয় করতে পারে। কেননা তা যোদ্ধা ও তার সুবিধার জন্যে একান্ত প্রয়োজনীয়। আর মুসলিম জনগণের কল্যাণের জন্যে যে কোন কাজ করা- যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করাই রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা তিনি অন্যদের তুলনায় সাধারণ জনকল্যাণ বিষয়ে অধিক অবহিত উদার দৃষ্টিসম্পন্ন অবশ্যই হবেন।কিনতউ ধন-মালের মালিক ব্যক্তির নিজের পক্ষে তা করা জায়েয হবে না। সে নিজের যাকাতের টাকা দিয়ে ঘোড়া ক্রয় করে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ নিয়োজিত করে দিতে পারে না। কোন জমি ক্রয় করে যোদ্ধার জন্যে ওয়াক্ফ করে দিতে পারে না। কেননা সে যে কাজ করতে নির্দেশিত হয়েছিলতা সে করিনি। [দেখুন (আরবী *********)]
তবে হজ্জ সম্পর্কে ইমাম আহমাদ থেকে দুটি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে: একটি হচ্ছে তা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ কাজ। তাই যাকাত কোন ফকীরকে দেয়া হলে তা দিয়ে সে যদি ইসলামী নিয়ামানুযায়ী হজ্জ করে কিংবা এই কাজে যে সাহায্য দান করে, তবে তা জায়েয হবে। কেননা উম্মে মাকাল আল-আসাদিয়া থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর স্বামী একটা নব্য বয়সের উটকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আর তিনি নিজে উমরা করার ইচ্ছা করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর স্বামীর নিকট সে উটটি চাইলেন, কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করলেন। পরে তিনি নবী করীম (স)-এর উপস্থিত হয়ে এই বিষয়টির উল্লেখ করলেন। নবী করীম (স) স্বামীকে নির্দেশ দিলেন তাকে উটটি দেয়ার জন্যে এবং বললেন: হজ্জ ও উম্রা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ আল্লাহ্র পথে অর্থাৎ আল্লাহ্র পথের কাজ। [হাদীসটি আহমাদ ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি যয়ীফ। কেননা এর সনদে একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি রয়েছে। একজন বর্ণনাকারী সম্পর্কে আপত্তি তোলা হয়েছে, তা ছাড়া এতে এলোমেলো অবস্থা (****) রয়েছে। আবূ দাউদ অপর এক সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সে সনদে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রয়েছে। সে সনদে তালাশ করে দেখুন। (আরবী ****)
এই বর্ণনাটি হযরত ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমর (রা) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইসহাকের কথাও তাই।
দ্বিতীয়ত, যাকাত হজ্জের কাজে ব্যয় করা যাবে না। জমহুর ফিকাহ্বিদদের বক্তব্যও তাই। ইবনে কুদামাহ তাঁর ‘আল-মুগ্নী’ গ্রন্থে বলেছেন: এই কথাটি অধিকতর সহীহ্। কেননা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর উল্লেখ হয়েছে, সেখানেই তার অর্থ ‘জিহাদ’ করা হয়েছে- দু-একটি ছাড়া। অতএব আয়াতটিকে তার যথার্থ অর্থেই গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা বাহ্যত তাই আল্লাহ্র বক্তব্য মনে করতে হবে। উপরন্তু যাকাত দু’জনার যে-কোন একজনের জন্য ব্যয় করতে হবে: যে তার মুখাপেক্ষী তার জন্যে- যেমন ফকীর, মিসকীন ও দাসমুক্তি। আর গারেমীনদের জন্যে তাদের ঋণ শোধে অথবা মুসলমান যার মুখাপেক্ষী তার জন্যে ব্যয় করা যাবে, যেমন যাকাত কার্যে নিযুক্ত কর্মচারী, যোদ্ধা, মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম এবং ‘গারেম’- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তাদিয়ে নিজের অবস্থা সংশোধন করে নেবে। কিন্তু কোন ফকীর ব্যক্তির হজ্জ আদায়ে মুসলিম জনগণের কোন কল্যাণ হওয়ার কথা নেই, মুসলমানদের জন্যে তার প্রয়োজনীয়তাও তেমন কিছু নেই, সেই ফকীর ব্যক্তির পক্ষেও তা আদায় করার আদৌ কোন প্রশ্নই ওঠে না। তা নিজের ওপর ওয়অজিব করে নিলেও তাতে কোন কল্যাণ নিহিত নেই। তার ওপর হজ্জ আদায়ের কর্তব্য চাপিয়েদিলে তাকে এমন একটা কষ্টে নিক্ষেপ করা হবে যা আল্লাহ তার ওপর থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তার কর্তব্যের বোঝা হালকা করে দিয়েছেন। ফকীরকে হজ্জ করার জন্যেযাকাত না দিয়ে বরং অন্যান্য সব প্রাপকদের মধ্য থেকে অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রাপ্য পরিমাণটা বাড়িয়ে দিয়ে মুসলমানদের সাধারণ কল্যাণমূলককাজে তা ব্যয় করা হলে তা অধিক উত্তম কাজ হবে।(আরবী *********)
এটা বিশ্লেষণটা অতীব গভীর ও আলোকমণ্ডিত। তার ওপর নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন করে না।
ইমাম আহমাদ থেকে অপর যে বর্ণনায় প্রাপ্ত হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে, তার সনদ যয়ীফ। হাদীসটিকে সহীহ্ বলে মেনে নিলেও কোন কোন শাফেয়ী ফিকাহ্বিদ উক্ত কথার জবাব দিয়েছেন এই বলে যে, ‘হজ্জ ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ের কাজ’ –এই কথা বলতে আমরা নিষেধ করছি না। তবে (*****) বলে যে আয়াতটির সূচনা, তার এক স্থানে যে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বাক্য এসেছে তার তাৎপর্য কি, তাই নিয়েই তো দ্বন্দ্ব। সেই সাথে (*****) বলে যে হাদীসটির শুরু তাতে যে (*****) যোদ্ধা আল্লাহ্র পথের উল্লেখ করা হয়েছে, তা তো উক্ত আয়াতের সাথে তাৎপর্যগতভাবে সাযুজ্যপূর্ণ। তবে এই হাদীসটি আসল দাবির সমর্থন করে কিনা, সেবিষয়ে বক্তব্য রয়েছে। কেননা যে হাদীসটিতে উটকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ সাদ্কা দেয়ার কথাবলা হয়েছে; কিংবা যেটি সম্পর্কে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ দৃষ্টিতে অসীয়ত করা হয়েছে- যেমন অপর একটি বর্ণনায় হজ্জ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে তা দেয়ার জন্যে নির্দেশকরা হয়েছে- এক্ষণে আমরা যদি ধরে নিই যে, সেটি যাকাতের উট ছিল, তাহলে সম্ভবত যাকে সেটি দেয়া হয়েছিল সে ফকীর ছিল, তার পক্ষেতা ব্যবহার করে ফায়দা গ্রহণ জায়েয ছিল অথবা তাকে তার মালিক না বানিয়েই তার ওপর সওয়াব করানো হয়েছিল এবং তার ওপর তার মালিকত্ব ছিল না। [দেখুন: (আরবী *********)]
আলোচ্য বিষয়ে চারটি মাযহাবের ঐকমত্য
উপরে চারটি মাযহাবের মত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা লক্ষ্য করছি যে, আলোচ্য বিষয়ে তিনটি ব্যাপারে এই মাযহাব চতুষ্টয়ের ঐকমত্য রয়েছে:
১. জিহাদ নিশ্চিত ও নিঃসন্দেহভাবেই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ ভুক্ত।
২. যাকাতের অর্থ মুজাহিদ ব্যক্তিদে জন্যে ব্যয় করা শরীয়াতসম্মত হলেও জিহাদের প্রস্তুতি ও সুবিধা বিধানের জন্য যাকাত ব্যয় পর্যায়ে মাযহাবের চতুষ্টয়ের মধ্যে ঐকমত্য হয়নি।
৩. বাধ, পুল, মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ, রাস্তাঘাট মেরামত ও মৃতের দাফন-কাফন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সাধারণ জনকল্যাণ ও সওয়াবমূলক কাজে যাকাত ব্যয় করা জায়েয নয়। এসব কাজে সম্পন্ন করা হবে বায়তুলমালের অপরাপর-ফাই-খারাজ ইত্যাদি আয় থেকে।
এসব কাজে যাকাত ব্যয় করা জায়েয না হওয়ার কারণ হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে যাকাতের মালিক বানানোর সুযোগ নেই। এটা হানাফীদের কথা অথবা তা করা যাবে না এজন্যে যে, যাকাতের নির্দিষ্ট আটটি খাতের কোন একটিতে এগুলো পড়ে না। অন্যান্যরা এটাই বলেছেন।
‘বাদায়ে-ওয়াস-সানায়ে’ গ্রন্থ থেকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র তাফসীর প্রসঙ্গে ‘সর্বপ্রকারের ইবাদত ও আল্লাহ্র নৈকট্যমূলককাজকে এ পর্যায়ে গণ্য করার কথা উদ্ধৃত হয়েছে বটে; কিন্তু তাতে যাকাতকে এক ব্যক্তির মালিকানায় দেয়ার শর্ত করা হয়েছে। অতএব তা সাধারণে ও নির্বিশেষে বন্টন করা বা ব্যয় করা যায়না। যেমন ব্যক্তির ফকীর হওয়ারও শর্ত করা হয়েছে। ফলে এই মতটি ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র সংকীর্ণ তাৎপর্য গ্রহণের আওতার বাইরে আসতে পারেনি।
ইমাম আবূ হানীফা মুজাহিদ ব্যক্তির ফকীর হওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন। বলেছেন, তবেই তাকে যাকাত দেয়া যেতে পারে। এই মত কেবলমাত্র তাঁর একার। অপর দিকে ইমাম আহমাদ হাজী ও উমরাকারীর জন্যে যাকাত ব্যয় করা জায়েয বলে যে মত দিয়েছেন, তাঁর এই মত অপর কেউই গ্রহণ করেন নি।
শাফেয়ী ও হানাফী উভয়ই এই শর্ত আরোপে একমত যে, সেসব মুজাহিদই যাকাত গ্রহণ করতে পারবে, যারা স্বেচ্ছামূরক কাজ হিসেবে জিহাদে শরীক হচ্ছে, যাদের জন্যে কোন মাসিক বেতন সরকারী দফতরে নির্দিষ্ট করা হয়নি।
হানাফীরা ছাড়া অন্যরা সর্বাধিকভাবে জিহাদের সর্বপ্রকার কল্যাণমূলক কাজে যাকাত ব্যয় করা শরীয়াতসম্মত হওয়ার ব্যপারে একমত হয়েছেন।
যাঁরা ‘সাবীলিল্লাহ্’র তাৎপর্য ব্যাপক মনে করেন
প্রাচীন ও আধুনিককালে বিপুল সংখ্যক আলিম ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর ব্যাপক তাৎপর্য গ্রহণ করেছেন।তাঁরা কেবল জিহাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট কাজের মধ্যেই তার তাৎপর্য সীমিত বলে মনে করেন না। বরং তাঁদের তাফসীরে সর্বপ্রকার কল্যাণমূরক, আল্লাহ্র নৈকট্যবিধায়ক ও নেক কাজকে এর মধ্যে শামিল করেছেন। কেননা বাক্যটির আসল তাৎপর্য সেই রকমই। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তাঁরা এই মত দিয়েছেন।
কতিপয় ফিকাহ্বিদের মত
ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে এ পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন (***) এই কথাটির বাহ্যিক তাৎপর্য অনুযায়ী তা থেকে কেবল যোদ্ধাদের বোঝানোই কোন ওয়াজিব কাজ নয়। পরে বলেছেন, এর অর্থের দৃষ্টিতে কিফাল তাঁর তাফসীর গ্রন্থে কোন কোন ফিকাহ্বিদের মত উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা যাকাতকে সর্বপ্রকারের কল্যাণমূরক কাজে ব্যয়করা জায়েয বলে মত দিয়েছেন। তার মধ্যে মৃতের লাশ কাফন-দাফন, কেল্লা ও মসজিদ নির্মাণ শামিল করেন। কেননা আল্লাহ্র কথা (*****) সর্বব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। [আরবী ************]
কিন্তু সেই ফিকাহ্বিদ কারা তা আমাদেরকে তিনি বলেন নি। তবে বিশেষজ্ঞগণ ‘ফকীহ’ গুণবাচক নামটি কেবল ‘মুজতাহিদ’ বোঝাবার জন্যেই ব্যহার করেন। যেমন ইমাম রাযী কিফালের কথার উদ্ধৃতি দেয়ার পর তার ওপর কোন মন্তব্য করেন নি। ফলে তা থেকেতাঁর মনে ঝোঁকটাও বোঝা যাচ্ছে না।
আনাস ও হাসান সম্পর্কে বলা কথা
ইবনে কুদামাহ তাঁর ‘আল্-মুগনী’ গ্রন্থে আনাস ইবনে মালিক ও হাসান বসরী- এই দুজনের মত উল্লেখ করেছেন্ তাঁরা দুজন বলেরেছন- যাকাতের যে অংশ পুল ও রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছ, তা চলমান সাদ্কা বা সাধারণ দান বিশেষ। [***২]
এই কথাটি থেকে বোঝা যায় যে, পুল বানানো, রাস্তা নির্মাণ ও তা মেরামত করার কাজে যাকাত ব্যয় করা জায়েয। তা একটি প্রবাহমান, জায়েয ও গ্রহণীয় সাদ্কা বিশেষ।
কিন্তু আবূ উবাইদ উক্ত দুজন থেকে উক্ত কথাটি উদ্ধৃত করেছেন, যা ভিন্ন এক অর্থ বোঝায়। উল্লেখ করেছেন, মুসলিম ব্যক্তি যদি তার যাকাত শুল্ক আদায়কারীর নিকট নিয়ে যায় এবং সে যদি তার যাকাতের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে অথচ এই ওশর গ্রহণকারী সরকার কর্তৃক যাকাত গ্রহণকারীরূপে নিয়োজিত ছিল- তারা যদি পুলবা রাস্তার ওপ দাঁড়িয়ে থেকে আশ্রয় গ্রহণকারী যুধ্যমান ও যিম্মী ব্যবসায়ী প্রভৃতি লোকদের নিকট থেকে এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর ধার্য ব্যবসায়ী কর আদায় করে, তাহলে তারা সম্ভবত সীমানার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে এবং শুল্ককর আদায় করছে। আবূ উবাইদ কয়েজকজন তাবেয়ী ও তৎপরবর্তীকালের ফিকাহ্বিদদের মত উদ্ধৃত করেছেন। তারা হচ্ছেন ইবরাহীম, শাবী, আবূ জা’ফর, বাকের, মুহাম্মদ ইবনে আলী প্রমুখ। তাদের মত উপরিউক্ত অর্থটিকে তাকীদ করে। আর তা হচ্ছে, শুধু আদায়কারী যা গ্রহণ করেছে, তাকে যাকাত হিসেবে গণ্য করা হবে। এই কথা হাসান নিজেই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন বলে উদ্ধৃত হয়েছে। যদিও সে মত এই পর্যায়ে মাইমুন ইবনে মাহ্রানের কথার সাথে সমঞ্জস্য নয়। তিনি তাঁর মালের যাকাত দেন; কিন্তু কি বাবদ তা নেয়া হল তার বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু আবূ উবাইদ বলেন: আমাদের মতে ব্যাপারটি তাই যা আনাস, হাসান, ইবরাহীম, শা’বী ও মুহাম্মাদ ইবনে আলী বলেছেন এবং সব লোকই এই মত পোষণ করেন। [(আরবী *************)]
ইবনে আবূ শাইবাও এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। [(আরবী *************) বর্ণনাটির ভাষা হচ্ছে: ****] তাঁদের দুজন থেকে ‘যে বলেছে, শুল্ক আদায়কারী যা গ্রহণ করেছে, তা অবশ্যই গণ্য করা হবে’ শীর্ষক অধ্যায়ে তা উদ্ধৃত হয়েছে, আবূ উবাইদও তাই করেছেন। এই দৃষ্টিতে বলা যায়, ইবনে কুদামাহ, আনাস ও হাসান (রা)-এর নামে যে উক্তির উল্লেখ করেছেন। তা বোধ হয় টিক নয়, দৃঢ়ভিত্তিক নয়।
জাফরী ইমামিয়া ফিকাহ্র মত
‘ইমামিয়া জাফরিয়া’ ফিকাহ্র কিতাব (*****) গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, বলেছেন, (***) বলতে সর্বপ্রকার এমন কাজ বোঝায়, যা আল্লাহ্ নেকট্যবিধান করে, যা সার্বিক কল্যাণমূলক- যেমন হজ্জ, জিহাদ ও পুল নির্মাণ ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেছেন, তা শুধু জিহাদ অর্থে ব্যবহৃত।[(আরবী *************)] (********)-জাফরী ফিকাহ্র একখানি বিশ্বকোষবত বিরাট গ্রন্থ। তাতে বলা হয়েছে: পুল, মুসজিদ নির্মাণ, হজ্জ ও সমস্ত কল্যাণময় ভালোকাজ ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ে গণ্য। শেষের দিকে সর্বসাধারণ ফিকাহ্বিদ এই মতই পোষণ করেন। এটাই শব্দের মৌল ভাবধারা বলে উক্ত মতের সমর্থন দেয়া হয়েছে। কেননা ‘সাবীল’ অর্থ পথ। বলা হয়েছে ‘সাবীলিল্লাহ’ এমন সব কিছুই বোঝায় যা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন ও সওয়াব পাওয়ার মাধ্যম বা কারণ হতে পারে। এই কারণে জিহাদও তার মধ্যে গণ্য। [দেখুন (আরবী *************)]
জায়দীয়া ফিকাহ্র মত
ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [জায়দীয়া ফিকাহ্র মত
ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [জায়দীয়া ফিকাহ্র মত
ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [ (আরবী ************)]
এই আলোচনা থেকে প্রমাণিত হল যে, ‘বাহ্র’[ ও ‘আর-রওজ’ এই গ্রন্থ দুটির লেখকদ্বয় ‘সাবীলিল্লাহ’র খুব ব্যাপক অর্থ গ্রহণের পক্ষপাতী। (******) গ্রন্থ বলা হয়েছে, কুরআন নির্ধারিত এই খাতের অতিরিক্ত ও উদ্ধৃত যাকাতের অর্থ সাধারণ মুসলিম জনগণের কল্যাণ ব্যয় হতে হতে পারে। আল-ইমামুল হাদী এই কথা বলিষ্ঠ ভাষায় বলেছেন। আবূ তালিব বলেছেন: হ্যাঁ, এ সব কল্যাণময় কাজে যাকাত ব্যয় করা যাবে দরিদ্র জনগণকে সচ্ছল বানানোর পর। সেখানে যদি কোন ফকীর এখন অভাবগ্রস্ত থেকে থাকে, তাহলে সে-ই যাকাত পাওয়ার অধিকারী। তাঁদের অন্যরা মনে করেন, এই শর্তটি ‘মুস্তাহাব’ বা উত্তম বলে ধরা যায়। অন্যথায় ফকীর-মিসকীন থাকা সত্ত্বেও এসব কল্যাণকর কাজে যাকাত ব্যয় করা হলে তা নিশ্চয়ই জায়েয হবে।
‘আল-আজহা’র গ্রন্থের টীকায় ‘আল্-বাহর; গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, ‘সাবীলিল্লাহ’ খাতে ব্যয় করার পর যা উদ্ধৃত থাকবে তা-ই শুধু কল্যাণময় কাজে ব্যয় করা যাবে, এমন কথা নয়। বরং আটটি খাতে ব্যয় করার পর যা উদ্ধৃত থাকবে, তা-ই সাধারণ কল্যাণে ব্যয় করা যাবে, যেমন কল্যাণময় কাজের জন্যে নির্দিষ্ট অর্থ ফকীর-মিসকীনদের জন্যে ব্যয় করা সঙ্গত। [দেখুন: জায়দীয়া ফিকাহ্র মত
ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [****১]]
(*******)-এর লেখকের অভিমত
সাইয়েদ সিদ্দিক হাসান খান লিখিত (******) গ্রন্থের বক্তব্য এখানে তুলে দেয়া হচ্ছে। স্বতন্ত্র ধরনের আহলি হাদীস লোকদের মত এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বলেছেন, ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্য এখানে হচ্ছে, ‘আল্লাহ্র নিকট পৌঁছার পথ।’ ‘জিহাদ’ যদিও আল্লাহ্র নিকট পৌঁছার বহু সংখ্যক পথের মধ্যে অনেক বিরাট ও উচ্চ পথ, তা সত্ত্বেও কেবল এই একটি অর্থেই তা বিশেষভাবে ব্যবহৃত মনে করার কোন প্রমাণ নেই। বরং তা মহান আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার যে-কোন কাজে তা ব্যয়করা যথার্থ ও সহীহ্ হবে। এ হচ্ছে আয়াতটির আভিধানিক অর্থ। আর এই আভিধানিক অর্থের ওপর স্থিতি গ্রহণই কর্তব্য। তার স্থানান্তরকরণ এখানে শরীয়াতের দৃষ্টিতে সঠিক হতে পারে না। পরে বলেছৈন, ‘সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ের একটি বড় ব্যয় হল দ্বীনদার মুসলিম জনগণের সার্বিক কল্যাণের কাজে আত্মনিয়োগকারী আলিমগণের জন্যে ব্যয় করা।
কেননা আল্লাহ্র ধন-মালে তাদের অংশ রয়েছে, তারা ধনী হোক, কি দরিদ্র। বরঞ্চ এই প্রয়োজনে ব্যয় করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোন সন্দেহ নেই। কেননা আলিমগণ হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। দ্বীনের ধারক ও বাহক হচ্ছেন তাঁরা। ইসলামের মৌল আকীদা ও সার সংরক্ষণ তাদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। মুহাম্মাদ (স)-এর উপস্থাপিত শরীযাত তাঁদের চেষ্টা-প্রচেষ্টায়ই জারি আছে। [(আরবী ************)]
মুহাদ্দিসমণ্ডলীর মত-আল কাসেমী
শায়খ জামালুদ্দিন আল কাসেমী (র) তাঁর তাফসীরে তাই লিখেছেন, যার উল্লেখ করেছেন ইমাম ফখরুদ্দীন আর-রাযী। তা হল বাহ্যত বাক্যটিথেকে কেবল যোদ্ধাদেরই বুঝাতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কেফাল এ পর্যায়ে কোন কোন ফিকাহ্বিদদের মতামত উদ্ধৃত করেছেন। পরে ‘তাজ’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন: ‘এমন প্রত্যেক পথই আল্লাহ্র পথ যার মূল লক্ষ্য হচ্ছেন আল্লাহ্’ –তাই কল্যাণময়, পূণ্যময়। [(আরবী ************)]….. এবং উপরের উদ্ধৃতিসমূহের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্যও করেন নি।
রশীদ রিজা ও শালাতুতের অভিমত
‘আল-মানার’ তাফসীর প্রণেতা সাইয়্যেদ রশদি রিজা (র) যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র সংক্রান্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এই পর্যায়ে ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলতে বোঝায় মুসলিম জনগণের কল্যাণময় যাবতীয কাজ, যার দৌলতে ব্যক্তির পরিবর্তে দ্বীন ও সমষ্টি তথা রাষ্ট্রের স্থিতি সম্ভব। ব্যক্তিগণের হজ্জ এ পর্যায়ে গণ্য নয়। কেননা হজ্জ তো সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ওপর ফরয, অন্যদের ওপর নয়। তা হচ্ছে আইন ফরয, তার শর্তগুলো নামায-রোযার মতই। তা দ্বীনি সামষ্টিক কল্যাণময় কাজের মধ্যে গণ্য নয়। তবে হজ্জ অনুষ্ঠান ও উম্মতের প্রতিষ্ঠা সেই পর্যায়ে গণ্য। তাই হজ্জের পথের নিরাপত্তা বিধান, পানি ও খাদ্যের প্রাচুর্যের ব্যবস্থা এবং হাজীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণে যাকাতের এই ভাগের টাকা ব্যয় হতে পারে- যদি তার জন্য অপর কোন ব্যয়ের ক্ষেত্র না থাকে। [(আরবী ************)]
এর একটু পরেই উক্ত তাফসীরকার লিখেছেন: ‘সাবীলিল্লাহ্ বলতে সর্বসাধারণের কল্যাণময় শরীয়াতসম্মত কার্যাবলী বোঝায়, যাতে দ্বীন ও জাতি বা রাষ্ট্রের কল্যাণ নিহিত। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য হচ্ছে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও যোগ্যতা অর্জন, অস্ত্র ক্রয়, সেনাবাহিনীর খাদ্য, যানবাহন ও যোদ্ধাদের সজ্জিতকরণ ইত্যাদি কাজ (এই কথা ইসলামী যুদ্ধ ও ইসলামী সেনাবাহিনীর দৃষ্টিতে বিবেচ্য, যারা কেবলমাত্র আল্লাহ্র কলেমা প্রচারের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করবে)। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল হেকামও এই মত দিয়েছেন, যা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে; তবে যেসব জিনিস দিয়ে যোদ্ধাকে সুসজ্জিত করা হবে, তা যুদ্ধের পর বায়তুলমালে ফেরত নিতে হবে- যদি তা অবশিষ্ট থাকে। যেমন অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া ইত্যাদি যানবাহন। কেননা যোদ্ধা এগুলো যুদ্ধকালে ব্যবহার করলেও সে তার স্থায়ী মালিক হয়ে যায়নি। সে তো তা আল্লাহ্র পথে ব্যবহার করবে মাত্র। আল্লাহ্র পথের যোদ্ধা হওয়ার সেই অবস্থা শেষ হয়ে গেলে তা থেকে যাবে। এই সাধারণ প্রয়োগের মধ্যে সামরিক হাসপাতালও অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য সাধারণ কল্যাণময় কাজও শামিল এর মধ্যে। নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পুরাতনের মেরামত, রেল লাইন ব্যারেজ, সামরিক এয়ারপোর্ট, দুর্গ ও পরিখা খনন ইত্যাদি। আমাদের এই যুগে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ খাতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইসলামের দিকে আহ্বানকারী লোক তৈয়ার ও সংগঠন করা, তাদেরকে কাফিরদের দেশে প্রেরণ করা, সুসংগঠিত বড় বড় সংগঠনের পক্ষ থেকে, যা তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণ পাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে। কাফিরদের মিশনারী প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন করছে। আমরা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এই বিরাট কল্যাণময় কাজের বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরছি। [আলে ইমরান, ১০৪ আয়াত]
(আরবী ************)
তোমাদের মধ্যে কল্যাণময় কাজের দিকে আহ্বানকারী একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে।
শায়খ মাহমুদ শালতুত (র) ‘সাবীলিল্লাহ্র’ ব্যাখ্যায় অনুরূপ কথাই বলেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘যে সাধারণ কল্যাণময় কাজের কোন ব্যক্তি মালিক নয়, যার কল্যাণ কোন ব্যক্তি বিশেষের সাথে সংশ্লিষ্টও নয়, তার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্ তা’আলা, তার কল্রাণ আল্লাহর সৃষ্টিকুলের জন্য। যে সামরিক প্রস্তুতি ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা জাতি বিদ্রোহ দমন করে, মান-মর্যাদা রক্ষা করে, মানবীয় আবিষ্কার ও নবোদ্ভাবনসমূহের প্রস্তুতি ও সংরক্ষণ পরিচালনা করে, তা সবই এর মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। সামরিক ও সামষ্টিক হাসপাতালসমূহ এর মধ্যে পড়ে। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামতকরণ, রেল লাইন বিছানো প্রভৃতিও এর মধ্যে শামিল। কেননা এগুলো যোদ্ধাদের জন্যে প্রয়োজনীয়। শক্তিশালী পরিপক্ক ইসলাম প্রচারক দল প্রস্তুতকরণ- যারা ইসলামের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম বর্ণনা করবে, তার যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা করবে, তার বিধানসমূহ লোকদের জানিয়ে দেবে, শত্রুপক্ষের সব আক্রমণের মুকাবিলা করবে- যেন যার ফলে তাদের ষড়যন্ত্র তাদেরই বিরুদ্ধে যায়- প্রভৃতি খুবই জরুরী কাজ।
অনুরূপভাবে যেসব উপায়-উপকরণ দ্বারা কুরআন হেফ্কারীদের স্থায়ী সংরক্ষণ সম্ভব- যারা ক্রমাগতভাবে কুরআন তার নাযিল হওয়ার সময় থেকে এ পর্যন্ত রক্ষা করে নিয়ে এসেছে- কিয়ামত পর্যন্ত নিয়ে যাবে ইন্শাআল্লাহ্- সে সবের ব্যবস্থা করাও এর মধ্যে গণ্য। [(আরবী ************)]
এই আলোচনা ‘আল-মানার’ তাফসীর লেখকের মতেরই সমর্থন করছে। মসজিদ নির্মাণে যাকাত ব্যয় করা যায় কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে এরই ভিত্তিতে ফতোয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে:
‘যে মসজিদ নির্মাণ বা মেরামত করার ইচ্ছা করা হয়েছে, তা যদি তথায় একমাত্র মসজিদ হয়েথাকে, অপর একটি মসজিদ থাকলেও তাতে নামাযীদের সংকুলান হয় না- যদি এমন হয় এবং আর একটি মসজিদের প্রয়োজন তীব্র হয়ে দেখা দেয়, তাহলে এই সমজিদের নির্মাণবা মেরামতে যাকাতের টাকা ব্যয় করা শরীয়াতসম্মত ও সহীহ্ কাজ হবে। আর এরূপ অবস্থায় মসজিদের জন্য ব্যয় সেই খাত থেকে করা হবে, যা সূরা তওবার আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যাকাত ব্যয়ের খাত প্রসঙ্গে।
এ কথার ভিত্তি হচ্ছে এই অবলম্বন যে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলতে সাধারণ জনকল্যাণমূরক কাজই বোঝায়, যাতে তাবৎ মুসলিম জনগণ উপকৃত হতে পারে, কোন বিশেষ এক ব্যক্তি বিশেষভাবে উপকৃত হবে না এমন হবে। তাহলে তাতে মসজিদ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইস্পাত কারখানা, গুদাম ও তৎসংশ্লিষ্ট সব কিছু তার মধ্যে গণ্য। কেননা এগুলোর কল্যাণ লোকসমষ্টি পায়। এখানে একথাও বলার প্রয়োজন মনে করি যে, বিষয়টি নিয়ে আলিমগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। (এর পর ইমাম রাযী কিফাল থেকে সর্বপ্রকার কল্যাণময় কাজে যাকাত ব্যয় করা প্রসঙ্গে যা লিখেছেন, তাই উদ্ধৃত করেছেন) শেষ পর্যন্ত বলেছেন: আমি এই কথা পসন্দ করি, এতে মনের নিশ্চন্ততা পাই এবং এরই অনুকূলে ফতোয়া দিচ্ছি। কিন্তু মসজিদ প্রসঙ্গে যে শর্তের উল্লেখ করেছি, সে মসজিদটি এমন যে, তা ছাড়া চলে না। নতুবা মসজিদ ছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যয় করাই উত্তম ও বেশি অধিকারসম্পন্ন। [দেখুন: (আরবী ************)]
মাখলুফের ফতোয়া
শায়খ হুসাইন মাখলুফ (মিশরের প্রাক্তন মুফতী)-কে ইসলামী জনকল্যাণমূলক সংস্থাসমূহকে যাকাত দেয়া জায়েয কিনা- প্রশ্ন করা হলে তিনি ফতোয়া দিলেন যে, হ্যাঁ, তা জায়েয। ইমাম রাযী কিফাল প্রমুখ থেকে ‘সাবীলিল্লাহ্’র অর্থ তাৎপর্য পর্যায়ে যা কিছু উল্লেখ করেছেন তাই ছিল তাঁর বড় দলিল। [দেখুন: (আরবী ************)]
তুলনা ও অগ্রাধিকার দান
উপরের চারটি মাযহাবের মতই উল্লেখ করা হয়েছে, যার অধিকাংশরই মত হচ্ছে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলতে জিহাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট কার্যাদি বোঝায়। তার পরে আমরা প্রাচীনকালীন ফিকাহ্বিদ ও মুহাদ্দিসগণের অভিমতও উদ্ধৃত করেছি। তাতে দেখা গেছে যে, এরা সকলেই ‘সাবীলিল্লাহ্’র ব্যপক অর্থ গ্রহণ করার পক্ষপাতী। এক্ষণে এ দুটি মতের কোন্টি অধিকতর সত্যানুগ ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য, তা চিহ্নিত করা আমাদের জন্যে একান্তই কর্তব্য হয়ে পড়েছে।
যারা সাবীলিল্লাহ্’-এর ব্যপক অর্থ গ্রহণ করেছেন, তাঁদের ভিত্তি স্থাপিত একটা সুস্পষ্ট দলিলের ওপর। আর তা হচ্ছে ‘সাবীলিল্লাহ্’ কথাটির আসল ও মূলগত অর্থ। তা বাস্তবিকই সর্বপ্রকারের কল্যাণের কাজে শামিল করে। যেসব কাজের ফায়দা সার্বিকভাবে মুসলিম জনগণ পেতে পার, তা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। ফলে ধরা যায় যে, তাঁরা মসজিদ নির্মাণ, মাদ্রাসা ও হাসপাতাল চালানো এবং সর্বপ্রকারের কল্যাণমূলক কাজেই যাকাত ব্যয় করা জায়েয বলে মনে করেছেন।
কিন্তু চারটি মাযহাবের জম্হুর ফিকাহ্ডবিদগণই এই মত সমর্থন করেন নি। উক্ত কার্যাদিতে যাকাত ব্যয় করতে তাঁরা নিষেধ করেছেন। তাঁরা দুটি দলিলের ভিত্তিতে এই মত গ্রহণ করেছেন:
প্রথম হচ্ছে, হানাফী মাযহাবের সেই গোঁড়ামী (***) যে, প্রাপককে যাকাতের মালিক বানিয়ে দেয়া যাকাতের একটা রুকন্ বিশেষ- যা না হলে যাকাত আদায় করা হয় না। অথচ মালিকবিহীন কল্যাণমূলক কার্যাদিতে এটা অনুপস্থিত, সেখানে তা অকল্পনীয়। মালিক বানিয়ে দেয়াকে রুক্ন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, আল্লাহ্ একে সাদ্কা নামে অভিহিত করেছেন। আর ‘সাদ্কা’র তত্ত্বকথা হচ্ছে কোন ফকীর মালের (****) মালিক বানিয়ে দেয়া। [(আরবী ************)]
দ্বিতীয়: মসজিদ, মাদ্রাসা, পানি পানের ব্যবস্থা প্রভৃতি যেসব কাজের উল্লেখ এই পর্যায়ে করা হয়, তার কোনটিই যাকাত ব্যয়ের ঘোষিত আটটি খাতের মধ্যে কোন খাতেও পড়ে না। কুরআন মজীদই এই খাতসমূহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। বলেছে:
(আরবী ************) সাদ্কা-যাকাত- কেবলমাত্র ফকীর…. ইত্যাদির জন্যে।
(****) শব্দটি দ্বারা এই খাতসমূহকে সীমাবদ্ধ ও সুচিহ্নিত করে দেযা হয়েছে। তা উল্লিখিত বিষয়গুলোকে প্রমাণিত করে এবং তাছাড়া অন্যগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেয়। সেই সাথে হাদীসও রয়েছে:
(আরবী ************)
তার প্রারম্ভিক কথা হল, আল্লাহ্ তা’আলা যাকাতের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দিয়েছেন, তিনি নিজেই তাকে আটটি অংশে বিভক্ত করে দিয়েছেন…. ইত্যাদি…
ইবনে কুদামাহ তাঁর ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থেও এই হাদীসটিকেই ভিত্তি করেছেন। [(আরবী ************)]
প্রথমোক্ত দলিলটি সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে। পূর্বে অবশ্য বলা হয়েছে, কুরআন যেসব খাতের উল্লেখ করেছে (***) দিয়ে তাতে, (****) ‘মালিক বানিয়ে দেয়া’র শর্ত নেই। যেসব ফিকাহ্বিদ যাকাতের টাকা দিয়ে দাসমুক্তকরণ ও মৃতের ঋণ শোধ করা জায়েয বলে ফতোয়া দিয়েছেন- যদিও তাতে মালিক বানানোর সুযোগ নেই- তাঁরই উক্তরূপ ফতোয়া প্রচার করেছেন। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে যাকাত জমা করা হলেই তো রাষ্ট্রপ্রধানকে তার মালিক বানিয়ে দেয়া হল সব ফকীর মিসকীনের প্রতিনিধিরূপে। ফকীরের হাতে যাকাত দিয়ে তাকে মালিক বানিয়ে দেয়া তো জরুরী নয়, তাছাড়া অন্য কোনভাবে মালিক বানানো যায় না এমনও তো নয়। তাই রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধি যখন যাকাত গ্রহণ করলেন, তখন তো তিনি উপরিউক্ত কার্যাবলীতে যাকাত ব্যয় করতে পারেন। কেননা তিনি তো যাকাত পাওয়ার লোকদের পক্ষথেকে তার মালিক হয়েছেন তা গ্রহণ করে।
আর দ্বিতীয় দলিল- যাকাত ব্যয়ের খাত আটটির মধ্যে সীমিত- এই মতের ওপর ভিত্তিশীল। এমতাবস্থায় যারা সাবীলিল্লাহ্র ব্যাপক অর্থ গ্রহণের পক্ষপাতী তাদের জবাব দেয়ার জন্য একথা যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা বলবেন যে, মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণ ‘সাবীলিল্লাহ্’র মধ্যকার কাজ। কেননা তা বলা হলে আল্লাহ্র কথায় সীমিত ও নির্ধারিত আটটি খাতের বাইরে তো যাওয়া হল না। কিন্তু এই মতের লোকদের জন্যে সঠিক জবাব হতে পারে ‘সাবীলিল্লাহ্’র তাৎপর্য স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হলে তা কি শুধু যুদ্ধ ও মারামারির অর্থে বিশেষভাবে ব্যবহৃত- যেমন জমহুর ফিকাহ্বিদগণ মত দিয়েছেন, না তা সর্বপ্রকারের কল্যাণ ও আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কার্যাবলীও সাধারণভাবে শামিল করে? এই মতের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আর শব্দের সাধারণ তাৎপর্যের দিক দিয়েও তা বোঝা যায়।
এই শব্দের তাৎপর্য সূক্ষ্মভাবে নির্ধারণের জন্যে কুরআনের যেসব স্থানে এই শব্দ উল্লিখিত হয়েছে তার সব কয়টির একত্রে উল্লেখ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আমাদের পক্ষে। তাহলেই কোথায় তার কি অর্থ করা হয়েছে তা বোঝা যাবে। আর কুরআনের উত্তম তাফসীর তো কুরআন দিয়েই হতে পারে।
কুরআনে ‘সাবীলিল্লাহ্’
কুরআন মজীদের ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ পূর্বে ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ অক্ষরটি ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন আলোচ্য যাকাতের খাত সংক্রান্ত আয়াতে রয়েছে এবং এটাই অধিক মাত্রায় ব্যবহৃত। কখনও তার পূর্বে (****) রয়েছে। এরূপ ব্যবহার কুরআনে প্রায় তেইশটি আয়াতে রয়েছে।
এসব আয়াতে তার পূর্বে (***) বিরত রাখা) ব্যবহৃত হয়েছে- যেমন:
(আরবী ************)
যেসব লোক কুফরী করে ও (লোকদের) আল্লাহ্র পথ থেকে বিরত রাখে, তারা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। -সূরা নিসা: ১৮৭
(আরবী ************)
যারা কুফরী গ্রহণ করে তারা (লোকদের) আল্লাহ্র পথ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাদের ধন-মাল ব্যয করে। -সূরা আনফাল ৩৬)
কোন কোন আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’র পূর্বে (***) ‘গুমরাহ করা’ শব্দটি এসেছে। যেমন:
(আরবী ************)
এমন লোকও আছে, যারা খেল-তামাশার কথা ক্রয় করে (লোকদেরকে) আল্লাহ্র পথ থেকে গুম্রাহ্ করে নেয়ার উদ্দেশ্যে। -(সূরা লোকমান: ৬)
২. যে যে আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’ শব্দটির পূর্বে (*****) এসেছে-আর এই ধরনের আয়াতের সংখ্যাই অধিক- সেখানে হয় (****) ‘ব্যয় করা’ শব্দটি তার পূর্বে এসেছে। যেমন:
(আরবী ************) তোমরা আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয় কর।
অথবা ‘হিজরাত’ শব্দটি এসেছে। যেমন:
(আরবী ************) আর যারা হিজরাত করেছে আল্লাহ্র পথে…
কিংবা (****) (যুদ্ধ) বা (***) (হত্যা) শব্দটি এসেছে। যেমন:
(আরবী ************) তারা সশস্ত্র যুদ্ধ করে আল্লাহ্র পথে, তাতে তারা হত্যাও করে আর নিজেরাও নিহত হয়।
যেমন: (আরবী ************)
যারা আল্লাহ্র পথে নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না।
অথবা তার পূর্বে জিহাদ শব্দ ব্যবহার হয়েছে।
যেমন: (আরবী ************)
এবংতোমরা জিহাদ কর আল্লাহ্র পথে।
কিংবা দুর্ভিক্ষ বা মার বা অনুরূপ কোন শব্দ এসেছে। এসব ক্ষেত্রে ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ শব্দের কি অর্থ বা তাৎপর্য গ্রহণ করা হবে?
আভিধানিক অর্থে ‘সাবীল’ অর্থ পথ। আর ‘সাবীলিল্লাহ্’ অর্থ ‘আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও প্রতিফল পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়ার পথ।’ আর আল্লাহ তা’আলা নবিগণকে পাঠিয়েছেন গোটা সৃষ্টিলোককে সেই দিকের পথ-প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এবংতাঁর শেষ নবীকে সেই দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে:
(আরবী *********) আহ্বান কর তোমার আল্লাহ্র পথে সুদৃঢ় যৌক্তিকতা ও উত্তম উপদেশ সহকারে। -সূরা নহল: ১২৫
লোকদের মধ্যে এই কথা ঘোষণা করারও নির্দেশ দিয়েছেন:
(আরবী *********)
এটাই আমার পথ। আমি আল্লাহ্র পথে আহ্বান জানাই বুঝে শুনে ও অন্তর্দৃষ্টি সহকারে- আমি এবং আমার অনুসারী লোকেরা। -সূরা ইউসুফ
এখানে আরও একটা পথ রয়েছে। কিন্তু তা উক্তপথের বিপরীত। তা হচ্ছে তাগুতের পথ। ইবলিশ শয়তান এবং তার চেলা-চামণ্ডরা সেই পথে লোকদের আহ্বান জানায়। সে পথটি তার পথিককে জাহান্নাম ও আল্লাহ্র ক্রোধ-অসন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়। এ দুটো পথের ও এই পথ-দ্বয়ের পথিকদের মধ্যে তুলনাস্বরূপ আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী *********)
ঈমানদার লোকেরা যুদ্ধ করে আল্লাহ্র পথে এবং কাফিররা যুদ্ধ করে তাগুতের পথে। -সূরা নিসা: ৭৬
‘সাবীলিল্লাহ্’-‘আল্লাহ্র পথের আহ্বানকারী স্বল্পসংখ্যক এবং তার শত্রুপক্ষ-এই পথ থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট লোকের সংখ্যা বিপুল। আল্লাহ্র ঘোষণা: ‘তারা তাদের ধন-মাল ব্যয় করে এই উদ্দেশ্যে যে, তারা আল্লাহ্র পথ থেকে লোকদের বিরত রাখবে।’ ‘লোকদের মধ্যে এমনও আছে যারা খেলা-তামাশার বস্তু ক্রয় করে লোকদের আল্লাহ্র পথ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে।’ বলেছেন, ‘তুমি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের আনুগত্য অনুসরণ কর, তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহ্র পথ থেকে গুমরাহ করে দেবে।’ …. এ সব কারণে যে, এ পথে অনিবার্য কষ্ট ও দায়দায়িত্ব মানব-মন ও কামনা-বাসনাকে এই পথের বিরোধী ও রোধকারী বানিয়ে দেয়। এই কারণে মনের কামনা-বাসনা অনুসরণের পরিণতি সম্পর্কে হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে কুরআন মজীদে:
(আরবী **********) তুমি মনের কামনা-বাসনা অনুসরণ করো না। তা করলে তোমাকে আল্লাহ্র পথ থেকে গুমরাহ করে দেবে।
আল্লাহ্র দুশমনরা যখন তাদের চেষ্টা-সাধনা ও অর্থশক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহ্র পথে চলায় বাধা দান করার কাজে নিয়োজিত করেছে, তখন আল্লাহ্র সাহায্যকারী মুমিন লোকদের কর্তব্য হচ্ছে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থবল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করা, আর ইসলাম তা ফরযও করে দিয়েছে। তাই এই কাজটিকে ফরয যাকাতের একটা অংশরূপে নির্দিষ্ট করেছে ‘আল্লাহ্র পথে’র এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়খাতে ব্যয় করার জন্যে- যেমন করে মুমিনদেরকে সাধারণভাবেতাদের ধন-মাল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করার জন্যে উৎসাহ দান করেছে।
ব্যয় করার কথাটির পার্শ্বে ‘সাবীলিল্লাহ’র অর্থ কি?
কুরআনে যেখানে ব্যয় করার কথাটির পাশে ‘সাবীলিল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তথায় এই শব্দের দুটি অর্থ হতে পারে:
১. সাধারণ অর্থ- যেমন শব্দটির আসল তাৎপর্য হয়- সর্ব প্রকারের নেক কাজ, আল্লাহ্র আনুগত্য ও জনকল্যাণমূলক কাজ। তার দৃষ্টান্ত আল্লাহ্র এই কথাটি:
(আরবী *********)
যারা তাদের ধন-মাল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে তাদের দৃষ্টান্ত-একটি দানার মত, যা সাতটি ছড়া উৎপাদন করে, প্রতিটি ছড়ায় একশ’টি করে দানা থাকে।… আল্লাহ যাকে চান এর চাইতেও কয়েকগুণ বেশি করে দেন।
বলেছেন: (আরবী *********)
যেসব লোক তাদেরধন-মাল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে, পরে তার কারণে নিজেদের অনুগ্রহের বোঝা চাপায় না বা কোনরূপ পীড়ন করে না, তাদের জন্য তাদের আল্লাহ্র কাছে বড় শুভ ফল রয়েছে; তাদের কোন ভয় নেই, তাদের দুশ্চিন্তারও কোন কারণ নেই।
এ সব আয়াত থেকে কোন লোকই এ কথা বুঝেন নি যে, এসব কথা কেবলমাত্র যুদ্ধ ও তৎসংক্রান্ত বিষয়াদির মধ্যেই বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ থাকবে। ‘অনুগ্রহের বোঝা চাপানো’ ও ‘পীড়ন করা’ সম্পর্কিত কথার দরুন তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। কেননা এ দুটো ব্যাপর গটতে পারে যদি ফকীর, মিসকীন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্যে অর্থ ব্যয় করা হয়। বিশেষ করে কষ্ট দানের ব্যাপারটি। আল্লাহ্র এ কথাটিও এ পর্যায়েই পড়ে:
যেসব লোক স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহ্রন পথে ব্যয় করে না, তাদের পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।
এ সব আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’র সাধারণ অর্থই গ্রহণীয়। হাফেয ইবনে হাজার এ কথাই লিখেছেন। [(আরবী *********)] এসব কথা কেবলমাত্র যুদ্ধ সম্পর্কেই নয় নতুবা যেসব লোক ফকীর-মিসকীন, দরিদ্র-ইয়াতীমও নিঃস্ব পথিক প্রভৃতি অ-যুদ্ধ পর্যায়ের কাজে অর্থ ব্যয় করবে, তারা এই আয়াত অনুযায়ীই সঞ্চয়কারী ও আযাবের সুসংবাদ প্রাপ্তির উপযুক্ত লোকদের মধ্যে গণ্য হবে।
এ কালের কোন কোন চিন্তাবিদ মনে করেছেন: ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বাক্যটি যদি ইনফাক বা ব্যয় করার কথাটির পার্শ্বে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তার অর্থ নিশ্চিতরূপে জিহাদ হবে। তা ছাড়া অন্য অর্থই বোঝা যাবে না। [(আরবী *********)] কিন্তু এ কথা কুরআন মজীদে বাক্যটির ব্যবহারকৃত সব কয়টি আয়াত একত্রিত করে তাৎপর্য অনুধাবনের সর্বাত্মক চেষ্টা না করেই বলা হয়েছে। সূরা আল-বাকারা ও সূরা তওবার পূর্বোদ্ধৃত আয়াতদ্বয় তো উক্ত কথার স্পষ্ট প্রতিবাদ করে।
২. ‘সাবীলিল্লাহ্’র বাক্যটির দ্বিতীয় অর্থ বিশেষভাবে নির্দিষ্ট হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্য, তাঁর শত্রুদের সাথে মুকাবিলাকরণ এবং পৃথিবীতে আল্লাহ্র বাণীর প্রচারকার্যের জন্যে যেন কোন ফিতনা- আল্লাহ্র বিধানের শাসনহীন অবস্থা অবস্থিতনা থাকে এবং প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে এক আল্লাহ্তে স্থাপিত হয়। বাক্যটির পূর্বে কথাই পূর্বোক্ত সাধারণ অর্থ থেকে এই বিশেষ অর্থকে আলাদা করে বিশিষ্ট মর্যাদা দানে ভূষিত করেছে। আর এই বিশেষ অর্থই গ্রহণ করতে হবে, যেখানে যুদ্ধ ও জিহাদের উল্লেখের পর তার উল্লেখ হয়েছে। যেমন: (আরবী *********)
তোমরা যুদ্ধ কর আল্লাহ্র পথে।
(আরবী *********) তোমরা জিহাদ কর আল্লাহ্র পথে।
সূরা আল-বাকরায় ‘কিতাল’ বাযুদ্ধসংক্রান্ত কথার পর যা বলা হয়েছে তাও এই অর্থেই গ্রহণীয়। যথা:
(আরবী *********)
এবং তোমরা আল্লাহ্র পথে (ধন-মাল) ব্যয় কর এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না এবং খুব দয়ার্দ্র আচরণ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা দয়ার্দ্র আচরণকারীদের ভালোবাসেন। -সূরা বাকারা: ১৯৫
এই আয়াতে যে ‘ইনফাক’ ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে, তা নিশ্চয়ই ইসলামের সাহায্য এবং যুধ্যমান ও তাঁর বাধাদানকারী আল্লাহ্র শত্রুদের মধ্যে আল্লাহ্র বাণীর প্রচার কার্যে ব্যয় করার অর্থে।
সূরা আল-হাদীসে আল্লাহ্র বলা এ কথাটিও এ পর্যায়ের:
(আরবী *********)
আর তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করো না? ….. অথচ আকাশমণ্ডলও পৃথিবীর উত্তরাধিকার আল্লাহ্রই জন্যে। তোমাদের যারা (মক্কা) জয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে- তারা অন্যদের সমান নয়, তাদের মর্যাদা অনেক বড়- তাদের তুলনায়, যারা (বিজয়ের) পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। এ সবই আল্লাহ্র উত্তম ওয়াদা বিশেষ। -সূরা হাদীদ: ১০
পূর্বোদ্ধৃত আয়াতসমূহে বলাব্যয়ের সমপর্যায়ভুক্ত।
সূরা আল-আনফাল-এ আল্লাহ্র এই ইরশাদটি উদ্ধৃত হয়েছে:
(আরবী *********)
তোমরা শত্রুদের মুকাবিলায় শক্তি সঞ্চয় কর যতদূর তোমাদের সাধ্যে কুলায়- ঘোড়ার পাহারাদারিও, তার দ্বারা তোমরা আল্লাহ্র শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত্র করবে, তোমাদের শত্রুকেও, তাদের ছাড়া অন্যান্য আরও যেসব রয়েছে তাদেরও যাদের কথা তোমরা জান না, আল্লাহ্ই তাদের জানেন আর তোমরা আল্লাহ্র পথে যা কিছুই ব্যয় কর, তা তোমাদের প্রতি পূর্ণ মাত্রায় ফিরিয়ে দেয়া হবে- তোমরা নিশ্চয়ই অত্যাচারিত হবে না। -সূরা আনফাল: ৬০
এ আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’ যেখানে উদ্ধৃত হয়েছে, তাই স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, এখানে ‘সাবীলিল্লাহ’ বলে আল্লাহ্র দুশমনদের সাথে সংগ্রাম করার এবং আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সহীহ্ হাদীসে ঠিক এই কথাটিই স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে:
(আরবী *********)
যে লোক আল্লাহ্র কালেমাকে শ্রেস্ঠ ও প্রভাবশালী বানাবার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করল,তার এই যুদ্ধই ‘আল্লাহ্র পথে’ হল। [বুখারী, মুসলিম, আবূ মূসা আল-আশআরী বর্ণিত]
এই বিশেষ অর্থ বোঝাবার জন্যে কখনও কখনও ‘জিহাদ’ ‘গজওয়া’- যুদ্ধ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর আমরা এর ব্যাখ্যা করেছি‘ইসলামের সাহায্য’ বলে এবংতা খুবই উত্তম। অন্যথায় আল্লাহ্র কথা (*****)-এর অর্থ ‘জিহাদের মধ্যে জিহাদ কর’ করতে হয়। কিন্তু তা খুবই হাস্যকর।
যাকাত ব্যয়ক্ষেত্রে ‘সাবীলিল্লাহ্’র অর্থ
‘ইনফাক’ (ব্যয়) করার পর ‘সাবীলিল্লাহ্’র উল্লেখ হলে তার এই সাধারণ ও বিশেষ- এ দুটো অর্থই গ্রহণকরতে হয়- যেমন ইতিপূর্বে বিস্তারিত বলা হয়েছে- তখন যাকাত-ব্যয় সংক্রান্ত আয়াতে উল্লিখিত ‘সাবীলিল্লাহ্’র কি অর্থ হবে? …. এখানেও ব্যয় করার তাৎপর্যটি বিদ্যমান, যদিও শাব্দিকভাবে তার উল্লেখ হয়নি।
এই গ্রন্থকারের দৃষ্টিতে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য এই কথা যে, ‘সাবীলিল্লাহ’ বাক্যের সাধারণ অর্থটি এখানে শোভন হয় না। কেননা এইসাধারণ অর্থেঅনেকগুলো দিক এসে যায়, যার প্রকারগুলো সীমিত করা সম্ভব নয়, তার ব্যক্তিগুলোকে চিহ্নিত করা তো দূরের কথা। আর তা যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবেআটটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখারও পরিপন্থী হবে। আয়াতটির বাহ্যিক বিবেচনা থেকে তাই প্রকাশিত হয়। নবী করীম(স) থেকে এ পর্যায়ে বর্ণিত হয়েছে:
আল্লাহ্ তা’আলা যাকাতের ক্ষেত্রে নবী বা অন্যকারোর হুকুমে কিছু ফরয করেন নি। তিনিনিজেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত বিধান দিয়েছেন এবং তাকে আটটি ভাগে বিভক্ত করেছেন।
যেমন ‘সাবীলিল্লাহ’ তার সাধারণ অর্থের দিক দিয়ে ফকীর-মিসকীন ও সাত প্রকারের লোকদের দান করাকেও শামিল করে। কেননা এ সব কাজই ভালো, পুণ্যময়ও আল্লাহ্র আনুগত্যমূলক।তাহলে এই ব্যয়ক্ষেত্রটিও তার পূর্বের ও পরের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
মনে রাখা আবশ্যক, আল্লাহ্র কালাম অতিশয় উচ্চমানের, মানব সাধ্যের ঊর্ধ্বের, তা নিশ্চয়ই অর্থহীন পুনরাবৃত্তির দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। অতএব এখানে তার এমন একটা বিশেষ অর্থ গ্রহণ করতে হবে যা সেটিকে অপরাপর ব্যয় ক্ষেত্র থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় চিহ্নিত ও ভূষিত করবে। প্রাচীনকাল থেকে তাফসীরকার ও ফিকাহ্বিদগণ এই কথাই বুঝেছেন। ফলে তাঁরা ‘সাবীলিল্লাহ্র অর্থ করেছেন ‘জিহাদ’ এবং তাঁরা বলেছেন, ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ নিঃশর্তভাবে ব্যবহৃত হলে তাই তার অর্থ হবে। এ কারণে ইবনুল আসীর লিখেছেন: এই বাক্যটি এই অর্থে খুব বেশি ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে ধারণা জন্মেছে যে, এর এটাই একমাত্র অর্থ। এ অধ্যায়ের প্রথম ভাগে আমরা এ পর্যায়ে সব কথাই উদ্ধৃত করেছি।
ইবনুল-আসীরের কথার সমর্থন পাওয়া যায় তাবারানী বর্ণিত একটি কথায়। তা হল সাহাবায়ে কিরাম একদা রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা সকলে একজন শক্ত-সমর্থ যুবককে দেখতে পেলেন। তাঁরা বললেন, ‘যুবকটির যৌবন ও শক্তি-সামর্থ্য যদি আল্লাহ্র পথে নিয়োজিত হত! অর্থাৎ যদি তা জিহাদ ও ইসলামের সাহায্য কাজে নিয়োজিত হত! (তাহলে কতই না ভালো হত!)
রাসূলে করীম (স) ও সাহাবয়ে কিরাম (রা) থেকে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বাক্যটি থেকে সহজেই যে কথাটি বোঝা যায়- মনে জেগে ওঠে- তা হচ্ছে জিহাদ। যেমন হযরত উমরের একটি কথা সহীহ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে:
(আরবী *********) আমি ঘোড়ার পিঠে আল্লাহর পথে নীত হয়েছি অর্থাৎ জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃতহাদীস হচ্ছে:
(আরবী *********) আল্লাহ্র পথে একটি সকাল কিংবা একটি বিকাল অতিবাহিত করা দুনিয়াও দুনিয়ার যা কিছু আছে সবকিছু অপেক্ষা অধিক উত্তম।
বুখারীতে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে:
(আরবী *********)
যেলোক একটি ঘোড়া আল্লাহ্র পথে বেঁধে রাখবে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান সহকারে ও তাঁর ওয়াদাকে সত্য ধরে নিয়ে, তার পেট পুরে খাওয়া, তার তৃষ্ণা নিবৃত্তি, তার পেশা-পায়খানা সবই কিয়ামতের দিন ওজন বা মূল্য পাবে।
অর্থাৎ এসবই নেক কাজের মধ্যে গণ্য হবে। বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃত হাদীস:
(আরবী *********)
যে বান্দাই আল্লাহ্র পথে একটি দিন রোযা রাখে, আল্লাহ এই দিনটির বিনিময়ে তার সত্তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তরটি অধ্যায়ের বছর দূরে রাখবেন।
নাসায়ী ও তিরমিযী বর্ণিত ও উত্তম বলে ঘোষিথ হাদীস:
(আরবী *********) যে লোক আল্লাহ্র পথে কিছু পরিমাণ ব্যয় করবে, তার সাত শত গুণ বেশি তার জন্যে লিখত হবে।
বুখারী উদ্ধৃত হাদীস: (আরবী *********)
যে বান্দাহর দুই পা আল্লাহ্র পথে ধূলি-মলিন হবে তা জাহান্নাম কখনই স্পর্শ করবেনা।
প্রভৃতি বিপুল সংখ্যক হাদীস রয়েছে; কিন্তু এই সবে উদ্ধৃত ‘সাবীলিল্লাহ’ বাক্য দ্বারা ‘জিহাদ’ ছাড়া অন্য কোন অর্থ কেউই বুঝেন নি বা গ্রহণ করেন নি।
এ সব দলির-প্রমাণ ও লক্ষণাদি এ কথা বলার জন্যে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য যে, যাকাত বন্টন সংক্রান্ত আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ’র অর্থ হিসেবে ‘জিহাদ’ই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। জমহুর আলিমগণ তাই বলেছৈন। তার আসল আভিধানিক অর্থ, গ্রহণীয় নয়। আর এই হাদীসটি থেকেও এ কথাই প্রমাণিত হবে যাতে বলা হয়েছে: ‘যাকাত কোন ধনীর জন্যে হালাল নয় এই পাঁচজন ছাড়া’… তাদের মধ্যে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ও আল্লাহ্র পথে যোদ্ধাকে গণ্য করা হয়েছে।
অতএব ‘সাবীলিল্লাহ’ বাক্যের অর্থে এখানে কোন ব্যাপকতাকে প্রাধান্য দেয়া যায় না। তাই সর্বপ্রকারের কল্যাণময় ও আল্লাহ্র নৈকট্যমূলককাজগুলোকে এর মধ্যে শামিল করা যাবে না। অনুরূপ তার অর্থে এতটা সংকীর্ণতাকেও প্রশ্রয় দিতে চাই না, যার ফলে ‘জিহাদ’ বলতে কেবল সামরিক পদক্ষেপই মনে করতে হবে।
জিহাদের এ সকল প্রকার ও রূপই সাহায্য ও অর্থব্যয়ের মুখাপেক্ষী।
গুরুত্বপূর্ণবিষয় হল, এ ক্ষেত্রে মৌলিক শর্ত হিসেবে একথা স্পষ্ট ও প্রকাশমান হতে হবে যে, তা ‘আল্লাহ্র পথে… অর্থাৎ ইসলামের সাহায্য ও পৃথিবীতে আল্লাহ্র কালেমা প্রচারে নিয়োজিত। প্রতিটি জিহাদেরই লক্ষ্য হতে হবে: আল্লাহ্র কালেমা উচ্চতর করা। অতএব তা সবই আল্লাহ্র পথে, তা যে-কোন ধরনের ও রূপের এবং অস্ত্রের হোক না কেন।
ইমাম তাবারী তাঁর তাফসীরে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’র ব্যাখ্যায় লিখেছেন: ‘অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যে ব্যয়ে।’ আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহ্দের জন্যে যে শরীয়াতের বিধান দিয়েছেন, সেই পথে তাঁর দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে এবং তা-ই কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই।
প্রধান তাফসীরকারের উক্ত কথার প্রথম অংশটি স্পষ্ট এবং গ্রহনীয়। তাতে ইসলামের সাহায্যে ও তার শরীয়াতের সমর্থনে সর্বপ্রকার ব্যয়ই শামিল হবে।তবে আল্লাহ্র দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই দ্বীনের সাহায্য প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা বৈ তো নয়।
আল্লাহ্র দ্বীনের, তাঁর পন্থা ও শরীয়াতের সাহায্য কর্ম কোন কোন অবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধ ও লড়াই দ্বারা বাস্তবায়িত হয়। বরঞ্চ কোন সময় ও স্থানে আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্যরূপে এটাই একমাত্র পন্থারূপে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও এমন একটা সময় আসে- যেমন আজকেরসময় চিন্তা, মতবাদ ও মানসিক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, বিপদ দূরকারী ও গভীর প্রভাবশালী হয়ে পড়ে বস্তুগত সামরিক যুদ্ধের তুলনায়।
প্রাচীন চারটি মায্হাবের জমহুর ফিকাহ্বিদগণ যখন যাকাতের এ অংশটিকে যোদ্ধা ও অগ্রবর্তী বাহিনীকে সজ্জিতকরণ এবং তাদের প্রয়োজনীয় ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন ক্রয়ে সাহায্য করার কাজে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, আমরা এ কালের প্রয়োজনে এক ভিন্ন ধরনের যোদ্ধা ও অগ্রবর্তী বাহিনীকে তার সাথে শামিল করছি। তারা হচ্ছে সেসব লোক, যারা ইসলামের শিক্ষাদানে, জনগণে বিবেক-বুদ্ধিকে ইসলামের দিকে নিয়ে আসার জন্যে কাজ করছে। এরা ইসলামের দাওয়াতদাতা লোক, এরা তাদের চেষ্টা-সাধনা, মুখের কথা, ভাষা-সাহিত্য দিয়ে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও ইসলামী বিধানে সংরক্ষণও প্রতিরক্ষার কাজে সদা নিয়োজিত।
জিহাদের তাৎপর্যে আমরা এই যে ব্যাপকতা ও প্রশস্ততা নিয়ে আসছি, তার দলিলও আমাদের নিকট রয়েছে। তা এই:
প্রথম: ইসলামের জিহাদ কেবলমাত্র সামরিক তৎপরতা ও সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নবী করীম(স) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন্ জিহাদ উত্তম? তিনি বললেন: (আরবী *********)
অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে স্পষ্ট সত্যকথা বলা। [আহমাদ, নাসায়ী ও বায়হাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন জিয়া মাকদাসী তারেক ইবনে শিহাব থেকে।মুনযেরী বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ্। (আরবী *********)]
ইমাম মুসলিমতাঁর সহীহ্ গ্রন্থে ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন- নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন: আমার পূর্বে আল্লাহ তা’আলা যে নবীই কোন উম্মতের প্রতি পাঠিয়েছেন তার উম্মতের মধ্যেতাঁর বহু সংখ্যক ‘হাওয়ারী’ ও সাহাবী (সঙ্গী-সাথী) বানিয়ে দিয়েছেন, যারা তাঁর সুন্নাতকে ধারণ করে এবং তাঁর আদেশ যথাযথভাবে পালন করে। পরে তাদের উত্তরাধিকারীরা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তারা বলে এমন এসব কথা যা তারা বাস্তবে করে না এবং করে সেসব কাজ, যার নির্দেশ তাদেরকে দেয়া হয়নি। এরূপ অবস্থায় যে লোক তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে নিজের হস্ত (শক্তি) দ্বারা, সে মুমিন, যে যুদ্ধ করবে তাদের বিরুদ্ধে নিজের মুখের কথা-ভাষা দ্বারা সে-ও মুমিন। আর যে যুদ্ধ করবে তাদের বিরুদ্ধে তার অন্তর দ্বারা সে-ও মুমিন। এর পরে আর কারোর একদানা পরিমাণ ঈমানও নেই বলে মনে করতে হবে।’
রাসূলে করীম (স) বলেছেন:
(আরবী *********) তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর তোমাদের ধন-মাল দিয়ে, তোমাদের মনদ্বারা ও তোমাদের মুখের (ভাষা) দ্বারা। [হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন ইমাম আহমাদ, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে হাব্বান ও হাকেম আনাস থেকে এবং বলেছেন, হাদীসটি সহীহ্। তাঁরা এটিকে স্বীকার করে নিয়েছেন: (আরবী *********)]
দ্বিতীয়, উপরে জিহাদের যে বিভিন্ন বস্তু ও ইসলামী তৎপরতার উল্লেখ করেছি, তা যদি জিহাদের অর্থের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকে অকাট্য দলিলের অভাবে, তাহলে তা কিয়াসের সাহায্যে অবশ্যই তার অন্তর্বুক্ত হবে। কেননা এ উভয় পর্যায়ের কাজই ইসলামের সাহায্যে নিবেদিত, তার প্রতিরক্ষাই লক্ষ্য এবং তার সাহায্যে ইসলামের শত্রুদের মুকাবিলা করা হয়, আল্লাহ্র জমিনে তাঁরই কালেমা প্রচার করা হয়।
মুসলমানদের মধ্যে এমন ফিকাহ্বিদও আমরা পাচ্ছি, যাঁরা যাকাত সংস্থার কর্মচারীরূপে গণ্য করেন এমন সমস্ত লোককে, যারা সাধারণ মুসলিম জনগণের পক্ষে কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত। ইবনে রুশ্দ বলেছেন: যাঁরা কর্মচারীদের জন্য- তারা ধনী হলেও- যাকাত জায়েয বলেছেন, বিচারকমণ্ডলী এবং এই ধরনের কাজে নিয়েঅজিত লোকদের জন্যে তা জায়েয বলে ঘোষণা করেছেন। কেননা তাদের সকলের দ্বারা সাধারণ মুসলিম উপকৃত হয়ে থাকে। [(আরবী *********)] যেমন হানাফী মাযহাবের এমন ফিকাহ্বিদ আমরা দেখতে পাই, যারা ইবনুস-সাবীল-নিঃস্ব পথিক পর্যায়ে’ গণ্য করেছেন এমন সমস্ত লোককে, যারা নিজেদের ধন-মাল থেকে অনুপস্থিত, তা ব্যয়-ব্যবহার করতে অক্ষম, যদিও তারা নিজেদের ঘর-বাড়ি ও গ্রাম-শহরে অবস্থান করছে।কেননা এক্ষেত্রে আসলকারণ হচ্ছে প্রয়োজন বা অভাব- আর তা এখানে পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। এই প্রেক্ষিতে আমরা যদি জিহাদ অর্থাৎসশস্ত্র যুদ্ধের সাথে এমন সব কাজকেও শামিল মনে করি যা তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করে এবং কথা বা কাজ দ্বারা এই কাজের সহায়তা করে, তা হলে তাতে বিস্ময়ের কোন কারণ থাকতে পারে না। কেননা ‘কারণ’ বা ‘ইল্লাত’টা এখানে অভিন্ন। আর তা হচ্ছে ইসলামের সাহায্য।
এর পূর্বে আমরা দেখেছি, যাকাত অধ্যায়ে ‘কিয়াস’-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এমন কোন মাযহাব নেই, যা কোন-না কোন-ভাবে ও কোন-না-কোন অবস্থায় তার প্রয়োজন মনে করেন নি।
এই ‘সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ে আমরা যে মতটি গ্রহণ করেছি, তার যৌক্তিকতা এই প্রেক্ষিতেই অনুধাবনীয়। আর তা হচ্ছে, তার অর্থে সামান্য প্রশস্ততার ভাবধারা সহকারে জনমতের গুরুত্ব।
এই পর্যায়ে আমি এ ব্যাপারটিও জানিয়ে দিতে চাই যে কোন কোন কাজ ও প্রকল্প কোন-না-কোন সময়ে কোন-না কোন স্থানে ও অবস্থায় ‘আল্লাহ্র পথে জিহাদরূপে গণ্য হয়ে যায়, হয়ত তা অপর সময়েও অপর স্থানে ও অবস্থায় ‘জিহাদ’রূপে গণ্য হয় না।
সাধারণভাবে একটা দ্বীনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা নেক কাজ ও প্রশংসনীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টারূপে গণ্য হয়, যা দ্বীন-ইসলামের বিরাট কল্যাণ করে; কিন্তু তা ‘জিহাদ’রূপ গণ্য হয় না। কিন্তু যেখানে গোটা শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে খৃস্টান মিশনারী বা কমিউনিস্ট অথবা ধর্মহীন-নিরপেক্ষতাবাদীদের একচেটিয়া কর্তৃত্বে চলে গেছে,সেখানে একটা খালেস দ্বীনী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান কায়েমসও চালু করা এবং রাখাও বিরাট জিহাদরূপে অবশ্যই গণ্য হবে, যা মুসলমান সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষাদানের কাজ করবে এবং চিন্তা-বিশ্বাসের বিপর্যয় থেকে তাদের রক্ষা করবে, জীবন-ধারা, লেখাপড়া, শিক্ষকদের বিবেক-বুদ্ধি ও সাধারণ জন-মানুষের মৌল ভাবধারায় যে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, তা থেকে তাদের বাঁচাবে।
বিপর্যয়কারী বই-পুস্তকের মুকাবিলায় ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশ ও পাঠাগার গড়ে তোলাও এ পর্যায়েরই কাজ বলে গণ্য হবে।
মুসলমানদের চিকিৎসার জন্যে একটা চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা এবং খৃস্টান মিশনারীদের নৈতিক ও আকীদা-বিশ্বাসে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী চিকিৎসা থেকে তাদের রক্ষা করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ- যদিও চিন্তা-বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিকতর বিপদ সৃষ্টিকারী ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবশালী হয়ে থাকে।
একালে ‘সাবীলিল্লাহ’র অংশ কোথায় ব্যয় করা হবে?
পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি, চারটি মাযহাবের প্রখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে: ‘সাবীলিল্লাহ’-এর অর্থ হচ্ছে সামরিক ও সশস্ত্রতার অর্থে জিহাদ ও যুদ্ধ। অন্য কথায়, ‘সাবীলিল্লাহ’ হচ্ছে ইসলামী যুদ্ধ। যেমন সাহাবায়ে কিরাম ও মহান তাবেয়িগণ যুদ্ধ করেছেন। তাঁরা তাঁর সূচনা করেছেন আল্লাহ্র নামে, কুরআনের ঝাণ্ডার তলে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল মানুষকে সৃষ্টিকুলের বন্দেগী ও দাসত্বের শৃংখল থেকেমুক্ত করে কেবলমাত্র এক আল্লাহ্র বান্দাহ বানিয়ে দেয়া, জীবনের সংকীর্ণতা-কাঠিন্য থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে জীবনের প্রশস্ততা-উদারতার মধ্যে নিয়ে আসা, ধর্মের নামে অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে বের করে ইসলামের সুবিচার ও ন্যায়-নিষ্ঠা নিয়ে আসার জন্যে।
কেউ কেউ মনে করেন, আজকের দিনে এ ধরনের যুদ্ধের আর কোন অস্তিত্ববা অবকাশ নেই, দীর্ঘকাল পর্যন্তই তার অস্তিত্ব ছিলও না। যেসব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এ কালের মুসলিম দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং কিছুকাল ধরে চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই ইসলামী যুদ্ধ নয়। মুসলমান তাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়ছে না। সেগুলো হচ্ছে জাতীয় বা স্বদেশিক পর্যায়ের যুদ্ধ, তা একটি জাতি করে তাদের বিরুদ্ধে, যারা তাদের দেশ বা জাতির বিদ্রোহী হয়েছে অথবা অন্যায়ভাবে দখলকরে নিয়েছে। এগুলো আসলে নেহায়েত বৈষয়িক যুদ্ধ, দ্বীনের সাথে তার দূরতম সম্পর্কও নেই। অতএব এসব যুদ্ধ কখনই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ বলে গণ্য হতে পারে না। আর এজন্যেই এসব যুদ্ধে যাকাত ব্যয় করা কোন মুসলমানের পক্ষেই জায়েয নয়।
কোন কোন মুসলমান এরূপ ধারণা করেন, বলেনও। কিন্তু এ কথাটি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ, তত্ত্বানুসন্ধান আবশ্যক, যেন তার ভুলও শুদ্ধ দিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ইসলামী যুদ্ধ বা ইসলামী জিহাদ কেবলমাত্র সেসব রূপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, যা সাহাবায়ে কিরামের যুগে পরিচিত ছিল। বিদ্রোহী স্বৈরাচারী শক্তিসমূহ দমন বা উৎখাতের উদ্দেশ্যে যেসব যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে- যার ফলে মুসলমানকে ইসলাম থেকে বলপূর্বক দূরে সরিয়ে নেয়া হয় এবং ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনকে ইসলাম থেকে বলপূর্বক দূরে সরিয়ে নেয়া হয় এবং ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনকে শক্তিবলে নেস্তানাবুদ করা হয়, ইসলামের আন্দোলনকারীদের অত্যাচার-নিপীড়ন সহকারে হত্যা করা হয়, এ ধরনের যুদ্ধ- তার লক্ষ্য ও নিয়ম-নীতিসহ ইতিহাসে কখনই পরিচিত বা পরিচালিত ছিল না। এসব যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাবের কোন দৃষ্টান্ত অতীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে এগুলো ছিল বিদ্রোহীদের কর্তৃত্ব থেকে জাতিসমূহকে মুক্তকরণের উদ্দেশ্যে, তারা আল্লাহ্র বান্দাহদেরকে নিজেদের দাসানুদাস বানাবার উদ্দেশ্যেই এসব যুদ্ধ চালিয়েছে।
সন্দেহ নেই, এ অবস্থা ইসলামী যুদ্ধ এবং ইসলামী জিহাদের পক্ষে খুব ভয়াবহ, কিন্তু তা-ই একমাত্র অবস্থা নয়। ইসলামের ইতিহাসে এমন এমন যুদ্ধও সংঘটিত হতে দেখাগেছে, যাতে ইসলাম ও ইসলামপন্থীরা নিজেদের সত্তা, মান-মর্যাদা, ইজ্জত-আবরু, দেশ বা জন্মভূমি ও পবিত্রতম প্রতিষ্ঠানসমূহ রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইসলামের জন্যেই তারা ইসলামের দুশমনদের সাথে যুদ্ধ করেছে যার পবিত্রতা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুদ্ধের তুলনায় কিছুমাত্র সামান্য নয়। এসব যুদ্ধের ইতিহাসের ইমাদুদ্দীন জংগী, নুরুদ্দীন মাহমুদ, সালাহুদ্দীন আইয়ুবী, কুতজ ও জাহির বেবিরস প্রমুখের নাম আজও জ্বলজ্বল করছে। এগুলো হিত্তীন, বাইতুল মাকদিস ও জানুত-কূপের যুদ্ধ। ইসলামী দেশকে তাতার ও ক্রুস যোদ্ধাদের কবল থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
সাহাবী ও তাবেয়ীনের যুদ্ধ যখন ইসলামীদাওয়াত সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল, তখন নূরুদ্দীন, সালাহুদ্দীন ও কুতুজের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের দেশ ও ভূমি রক্ষার উদ্দেশ্যে। আর জিহাদ যেমন ফরয হয়েছে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস রক্ষার্তে- তার সমর্থনে, তেমনি ফরয হয়েছে ইসলামী দেশ রক্ষার জন্যেও। কেননা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ইসলামী দেশের মতই। এ দুটোরই পূর্ণ সংরক্ষণ এবং আক্রমণকারীদের দাঁত ভেঙ্গে দেয়া একান্ত আবশ্যক।
দেশ বা জমিনের এরূপ গুরুত্ব এবং তার সংরক্ষণ প্রতিরক্ষা একটা ইবাদত ও পবিত্র কর্তব্যরূপে গণ্য হওয়ার কারণ হচ্ছে তা দারুল-ইসলাম- ইসলামের আবাসস্থল, ইসলামের অবস্থানক্ষেত্র, ইসলামের পরিবেশ। পিতৃভূমিবা মাতৃভূমি অথবা বাপ-দাদার দেশ বলে নয়। কেননা মুসলমান অনেক সময় এই বাপ-দাদার দেশ থেকেও হিজরত করে ইসলামেরই ভালোবাসায়- ইসলামের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক রক্ষার্থে অন্য দেশে- সম্পূর্ণ বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে যেতেও প্রস্তুত হয়- যদি পূর্বের স্থানে ও দেশে ইসলাম পালন করা সম্পূর্ণ অবসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, ইসলামের কথা শুনতে একটি কর্ণও প্রস্তুত না থাকে। রাসূলে করীম(স) এবংতাঁর সাহাবিগণ ঠিক এ কারণেও এরূপ অবস্থায়ই মক্কা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। তখন তাঁরা হয়েছিলেন ‘মুহাজির ফী-সাবীলিল্লাহ’। এরূপ অবস্থা আজও হতে পারে শুধু তাই নয়, রাত-দিন হতে দেখা যাচ্ছে।
কাফিরী শাসনথেকে ইসলামের দেশ মুক্তকরণ
কোন সন্দেহ নেই, এ কালেও জিহাদ শব্দের বাস্তব প্রয়োগ হতে পারে জোরপূর্বক দখলকারী কাফিরদের প্রশাসন থেকে ইসলামী দেশ মুক্তকরণের সংগ্রামের ওপর। কেননা তারা তথায় আল্লাহ্র বিধান উচ্ছেদ করে কাফিরী শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই কাফির ইয়াহুদী হোক, খৃস্টান হোক বা মূর্তিপূজারী অথবা নাস্তিক কমিউনিস্ট বা পাশ্চাত্যানুসারী- এরা কেউ ই আল্লাহ্র দ্বীন মেনে চলে না। আর কুফর- তার রূপ যাই হোক- এক অভিন্ন শক্তি, ইসলামের দুশমন।
পুঁজিবাদী ও কমিউনিস্টপন্থী, পাশ্চাত্যবাদী বা প্রাচ্যবাদী, আহ্লি কিতাব কিংবা ধর্মহীন- ইসলামের দৃষ্টিতে সকল ইসমান। এই সবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরয- যদি তারা বল প্রয়োগ করে কোন ইসলামী দেশ বা তার কোন অংশ দখল করে নেয়। কোন অংশ দখল করে নিলেও তা গোটা দেশের সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই কর্তব্য কাজে শরীকহওয়ার বাধ্যবাধকতা নৈকট্যের দৃষ্টিতে বিচার্য। যারা অতি নিকটে, তাদের কর্তব্য সর্বাগ্রে। শেষ পর্যন্ত এই কর্তব্য গোটা মুসলিম জাতির ওপর বর্তে। কেউই এ কর্তব্য পালন থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। অবশ্য সকলের যোগদানের পরিবর্তে কিছু লোকের অংশ গ্রহণে যদি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহলে ভিন্ন কথা।
তবে একালে অনেক কয়টি মুসলিম দেশ কাফির শক্তি কর্তৃক দখলকৃত বাঅধিকৃত, আক্রান্ত হওয়ার দরুন এখানকার গোটা মুসলিম জাতির ওপরই এক কঠিন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে- যা ইতিপূর্বে কখনইদেখা যায়নি। এ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম উল্লেখ্যহ হচ্ছে ফিলিস্তিন। দুনিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থানকারী ইয়াহুদীরা এ দেশটি দখল করে নিয়েছে। কাশ্মীরের প্রধান প্রধান অংশ দখল করে নিয়েছে হিন্দু মুশরিকরা। এরিটেরিয়া, আবিসিনিয়া, চাদ, পশ্চিম সোমালিয়া ও কবরুচ বা ক্রীট-ষড়যন্ত্রকারী হিংসুক খৃস্টান বা কমিউনিস্ট শক্তি এসব দেশ দখল করে নিয়েছে। আর সমরখন্দ, বোখারা, তাসখন্দ, উজবেকিস্তান ও আলবেনিয়া প্রভৃতি ইসলামী দেশ নাস্তিকখোদা বিদ্রোহী কমিউনিস্টরা শক্তি প্রয়োগ করে দখল করে নিয়েছে। এখনকার মত শেষ শিকার হচ্ছে আফগানিস্তান। রাশিয়া নিতান্ত গায়ের জোরেই তা দখল করে রেখেছে।
এসব দেশ পুনরুদ্ধার করা ও কুফরী শাসন থেকে মুক্ত করা- কুফরী আইন-বিধান সম্পূর্ণ উৎখাত করা সামষ্টিকভাবে গোটা মুসলিম জাতিরই একান্ত কর্তব্য। এসব শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা একটা বড় ইসলামী ফরয বিশেষ।
এ উদ্দেশ্যে এসব দেশের যে কোন অংশে কোন যুদ্ধ শুরু হলে গেলে তা নিঃসন্দেহে ‘জিহাদ ফী-সাবীলিল্লাহ’ হবে। অবশ্য লক্ষ্য হতে হবে কুফরী শাসন ও কাফিরী কর্তৃত্ব থেকে মুক্তকরণ। এ যুদ্ধে ধন-মাল ব্যয় করা ও কার্যত সাহায্য-সহায়তা করা অবশ্যই ফরয হবে। আর এজন্যে যাকাতের একটা অংশ দেয়াও একান্ত উচিত হবে। সে অংশের পরিমাণ কমও হতেও পারে, বেশিও হতে পারে- যাকাত বাবদ সঞ্চিত সম্পদের হার অনুপাতেই তা হবে একদিক দিয়ে। আর জিহাদের প্রয়োজনের দৃষ্টিতেও তা কম বা বেশি হতে পারে অপর দিকের বিচারে। আর অন্যান্য সর্ববিধ প্রয়োজনীয় ব্যয়ের তীব্রতা ও দুর্বলতার দৃষ্টিতেও তার বিবেচনা হতে পারে। এ সবই নির্ভর করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিবেচনাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর। মুসলিম পরামর্শদাতা বা উপদেষ্টগণ যেরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সেরূপই হবে।
সব যুদ্ধই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ ন?য়
এ পর্যায়ে একটি বিষয়ে খুব সতর্কতার প্রয়োজন। কোন কোন মুসলমান মনে করেন, মুসলিম নামধারী লোকদের যে কোন উদ্দেশ্যে অস্ত্রধারণই ‘আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ’ বলে বিবেচিত হবে, তার লক্ষ্যও উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তার আচার-বিধি ও ভঙ্গি-দৃষ্টিকোণ যেরূপই হোক না কেন। সে যুদ্ধ আল্লাহ্র নামে শুরু করা হোক কিংবা অপর কারোর নামে। যে ঝাণ্ডার তলে সমবেত হয়ে যুদ্ধ করাহবে, তা ইসলামীঝাণ্ডা হোক, কি কাফিরী ঝাণ্ডা অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে ইসলামী যুদ্ধ বা জাতীয়তা কিংবা দেশমাতৃক বা শ্রেণীভিত্তিক- সব যুদ্ধই মুসলমানদের জন্যে কর্তব্য।
আমরা তাকীদ সহকারে বলতে চাই, যুদ্ধ কেবল তখনই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ –আল্লাহ্র পথে’ গণ্য হতে পারে, যদি তা ইসলামী লক্ষ্যে ও ইসলামী রীতি নীতি অনুযায়ী হয়। অন্য কথায় যুদ্ধ হতে হবে দ্বীন ইসলামের সাহায্যার্থে, আল্লাহ্র কালেমার প্রচার উদ্দেশ্যে, ইসলামের আবসক্ষেত্রের সংরক্ষণ ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষার্থে। আর এ জিনিসই ইসলামী যুদ্ধকে অন্যান্য সর্বপ্রকার যুদ্ধ থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন মর্যাদায় অভিসিক্ত করতে পারে। কোন যুদ্ধ এসব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবধারাশূন্য হলেতা নিতান্তেই বৈষয়িক যুদ্ধ হবে। আর এ ধরনের যুদ্ধ সাধারণত নাস্তিক ধর্মহীন লোকেরাই করে থাকে।
এ ধরনের যুদ্ধ কোথাও শুরু হলে- যাতে মহান আল্লাহ্র বা তাঁর দ্বীনের, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের কোন স্থান বা স্বীকৃতি নেই- তাতে যাকাতের একটি পয়সা ব্যয় করাও সম্পূর্ণ না-জায়েয হবে- তাকে যতই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ মনে করা হোক না কেন।
মনে করা যেতে পারে, আলবেনীয় বা উজবেকিস্তানী কোন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী যদি তাদের দেশ- যা মূলত ইসলামী দেশ ছিল- রুশীয় কমিউনিস্টটদের কর্তৃত্ব-আধিপত্য থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তৎপরতা শুরু করে ও সেজন্যে যুদ্ধের সূচনাকরে, তাহলে এই যুদ্ধটিকে কি ‘জিহাদ ফী-সাবীলিল্লাহ্’ গণ্য করা যাবে?… তাতে কি জায়েয হবে যাকাতের টাকা ব্যয় করা? কেননা বলা যেতে পারে, একটি ইসলামী দেশকে বিদেশীয়- রুশীয় কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই যুদ্ধ করা হচ্ছে।
এর উত্তর অকাট্যভাবে নেতিবাচক, কেননা উজবেকী কমিউনিস্ট ও রুশীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে ইসলামের দৃষ্টিতে কোন পার্থক্য নেই। এ যুদ্ধের ফলে হয়ত কমিউনিস্ট আধিপত্য থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হবে; কিন্তু তার পরিণতিতে অপর এক কমিউনিস্ট আধিপত্যের অধীনতা ছাড়া আর তো কিছুই হবার নয়। ইসলামে কেবল জাতীয়তা বা স্বাদেশিকতার পার্থক্যের কোনই মূল্য নেই।– কেননা এরা সকলেই খোদা-দ্রোহী- তাগুত; কিংবা তাগুতের চেলামুণ্ডা মাত্র। তবে মুসলমানরাই এ যুদ্ধের সূচনা করে কাফিরী শাসন খতম করে ইসলামী শাসন প্রশাসন- প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এবং তারা যদি জাহিলীয়াতের পতাকা পরিহার করে ইসলামী তওহীদী পতাকা উড্ডীন করে তবেই তা ‘ইসলামী জিহাদ’ নামে অভিহিত হতে পারে।
ইসলাম নিছক ‘জিহাদ’ নামের মারামারি ও হত্যাকাণ্ড মাত্রকেই পবিত্র বলে গ্রহণ করতে রাজী নয়। হ্যাঁ, যদি এ জিহাদ ও নরহত্যা আল্লাহ্র পথে হয়, তবেই তা ইসলামের দৃস্টিতে গুরুত্ব পেতে পারে। সে অবস্থায় সমস্ত মানুষই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, শত্রুদের হত্যা করবে, এ কাজে তারা ধন-মাল ও মনপ্রাণ বিনিয়োগ করবে। নিজেদেরও রক্ষা করবে, নিজেদের ইজ্জত-আবরু ও স্বদেশও রক্ষা করবে। এ কাজে ফাসিক-ফাজের, দ্বীন-ধর্মহীন লোকেরাও অনেক বীরত্ব দেখাবে, অনেক কুরবানী দেবে, রক্ষা করবে নিজেদের দেশ ও ঘর-বাড়ি, জাতি ও জনতাকে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা-সাধনা আল্লাহ্র নিকট কোন মূল্যই পাবে না।
এ সব যুদ্ধে মুমিনরা যোদ্ধা ও জিহাদকারী হয়েও অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্য পেতে পারে শুধু এ দিক দিয়ে যে, তারা জিহাদ করছে আল্লাহ্র পথে, অস্ত্র চালনা করছে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব এবং তাই তাদের চরম লক্ষ্য।
এ মহান লক্ষ্যই তাদের জিহাদ ও যুদ্ধকে পবিত্র ও মহান বানিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের মাধ্যম ও বিরাট ইবাদতের পর্যায়ে গণ্য হওয়ার যোগ্য বানিয়েছে।
মুসলিম ব্যক্তি যখন কোন ভূ-খণ্ড মুক্তকরণের লক্ষ্যে অস্ত্র চালনা করে, তখন তারা একটি জাতিকে উৎখাত করে অনুরূপ অপর একটি জাতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করে না। একটি শ্রেণীর স্থানে অপর একটি শ্রেণীকে প্রাধান্য বানিয়ে দেয়াও তাদের লক্ষ্য হয় না। তারা যুদ্ধ করে গায়রুল্লাহ্র শাসন খতম করে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বভিত্তিক শাসন-বিধান প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। তথায় আল্লাহ্র শরীযাতের প্রাধান্য হবে, আল্লাহ্র কালেমা বুলন্দ হবে, এই উদ্দেশ্যে।
এ তাৎপর্য বহন না করলে কোন যুদ্ধই ইসলামের সাথে সম্পরিা্কত হতে পারে না। তা হয়ে যাবে নিছক বৈষয়িক উদ্দেশ্যে করা যুদ্ধ, মাটির জন্যে যুদ্ধ- দ্বীনের জন্যে নয়। এ দুই ধরনের যুদ্ধের মাঝে যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে, তা সকলেরই অনুধাবনীয়।
এই ধরনের যুদ্ধকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ নামে অভিহিত করার কোন জ্ঞানী দ্বীনপন্থী মুসলিমের পক্ষেই সম্ভবপর নয়। তাতে ফরয যাকাতের কোন অংশ ব্যয় করার জন্যে মুসলমানদের বলতেও পারে না কেউ। অনেক সময় দেখা যায়, এ সব যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে এমন সব লোক যারা প্রকৃত কাফিরদের অপেক্ষাও ইসলামের কট্টর দুশমন।
হাফেয আবূ মুহাম্মাদ আবদুল গনী তাঁর সনদে আবদুর রহমান ইবনে আবূ নায়অম থেকে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন: আমি একদা আবদুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট বসা ছিলাম। তখন একজন স্ত্রীলোক এসে তাঁকে বললো: হে আবূ আবদুর রহমান, আমার স্বামী তাঁর সমস্ত ধন-মাল ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ দেয়ার অসীয়ত করে গেছেন। ইবনে উমর বললেন: তাহলে তা তাতেই উৎসর্গিত হবে- আল্লাহর পথে। ইবনে আবূ নায়াম বললেন: এই কথা বলেতো আপনি স্ত্রীলোকটির চিন্তা-ভাবনা বৃদ্ধি করেই দিলেন (অর্থাৎ স্ত্রীলোকটি প্রশ্ন করে যে সমস্যার সমাধান চেয়েছিল, এই জবাবে তা সে পায়নি)। ইবনে উমর বললেন: তাহলে তুমি আমাকে কি বলতে বল, হে ইবনে আবূ নায়াম?… আমি কি তা সেসব সৈন্য-সামন্তকে দিতে বলব, যারা দুনিয়ায় সীমা লংঘনের জন্যে বে’র হয় এবং পথে পথে ডাকাতি করে বেড়ায়? আমিবললাম: তাহলে আপনি মেয়েলোকটিকে কি করতে বললেন? জবাবে তিনি বললেন: ‘আমি তাকে নির্দেশ দিচ্ছি, এই ওয়াক্ফকৃত ধন-মাল নেক লোকদের মধ্যে ও আল্লাহ্র ঘরের হজ্জ যাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করতে। এরাই হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতিনিধি, এরাই আল্লাহ্র প্রতিনিধি, এরাই আল্লাহ্র প্রতিনিধি।’ [তাফসীরে কুরতুবী ৮ম খণ্ড, ১৮৫পৃ.। মনে হচ্ছে, আসল ঘটনাটিই হযরত ইবনে উমর থেকে বর্ণিত যে, হজ্জ আল্লাহ্র পথের ব্যাপার। কুরতুবীর বর্ণনা প্রসংগ থেকে তাই বোঝা যায়। ইবনে উমরের কথা থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, ‘সাবীলিল্লাহ’ কথাটি নিঃশর্তবাবে বলা হলে তা থেকে জিহাদ বুঝা যাবে। কিন্তু এই প্রাথমিক ও সহজ ধারণা থেকে ভিন্ন অর্থে নেয়া হয়েছে যখন দেখা গেছে জিহাদকারীদের আদর্শচ্যুতি ও বিভ্রান্তি বিপর্যয়।]
হযরত ইবনে উমর (রা) তাঁর সময়কাল সৈন্য-সামন্তদের কর্মতৎপরতা আল্লাহ্র পথে হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান হয়েচিলেন অথচ সেকালের সৈন্যদের অনৈসলামী ঝাণ্ডা বাইসলাম-বিরোধী তেমন কোন কার্যকলাপ ছিল না। এমন কি খারেজী সৈন্যদের সম্পর্কেও এ কথা চলে। তাহলে এ যুগের সৈন্য-সামন্তদের সম্পর্কে কি বলা যায়?
আজকের সৈন্যদের যদি তিনি দেখতে পেতেন, এরা আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে না, ইসলামেরও নাম জানে না, বলে না। সৈন্যবাহিনীর মধ্যে নামায কায়েমের বা আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগীর কোন ব্যবস্থা নেই… যদি তিনি দেখতে পেতেন, সেনাধ্যক্ষদের অবস্থা, তারা তাসখেলা ও মদ্যপান ছাড়া আর কিছু জানে না, যদি দেখতে পেতেন, একালের সেব সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রীতি ও পন্থায় পরিচালিত হচ্ছে, তথায় আল্লাহ্-রাসূল বা আল্লাহ্র দ্বীন ও কিতাবের কোন স্থান নেই, তাদের বৈশিষ্ট্যও বিশেষত্ব ইসলাম-বিরোধী জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়, কাফির ও কুফরের প্রাধান্য বিস্তার করেছে মাত্র, দ্বীন ইসলাম ও তার ধারক-বাহকদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে দিন-রাত, দ্বীনের গুরুত্ব কিছুমাত্র স্বীকার করে না- তার নাম যদি কখনও নেয় তো শুধু প্রাণ-শক্তির বৃদ্ধি ও উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগানোর উদ্দেশ্যে….. তাহলে তিনি কি বলতেন?
আমরা আবার বলছি, আজকেরদিনের সব যুদ্ধই সংঘটিত হচ্ছে গায়র-ইসলামী ঝাণ্ডার নীচে, ইসলামের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নয়, ইসলামের মর্যাদা রক্ষার্থেও নয়। তাই এসব যুদ্ধই গায়র-ইসলামী। এই যুদ্ধকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলা দ্বীনের সাথ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ পর্যায়ে আমাদের দলিল হচ্ছে অনেক কয়জন হাদীসগ্রন্থ প্রণেতার উদ্ধৃত হাদীস, হযরত আবূ মূসা থেকে বর্ণিত, বলেছেন, রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হল এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে, যে খুব বীরত্ব সহকারে লড়াই করেছিল, আর এক ব্যক্তি সম্পর্কে যে যুদ্ধ করছিল অন্ধ আত্মম্ভতিা ভরে, অপর এক ব্যক্তি লড়ছিল লোক দেখানো ছলে, এদের মধ্যে কার যুদ্ধ আল্লাহ্র পথে হচ্ছে? রাসূলে করীম(স) বললেন: যে লোক যুদ্ধ করলে আল্লাহ্র কালেমা বুলন্দ করার লক্ষ্যে, সেটাই আল্লাহ্র পথে হচ্ছে মনে করতে হবে। [(*****) গ্রন্থে। দেখুন: (আরবী **********)]
বস্তুত ইসলামী জিহাদ ও জাহিলী যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে এটাই হচ্ছে মৌলিক ও নৈতিক পার্থক্য- আল্লাহ্র পথ ও তাগুতের পথের মধ্যকার লক্ষণীয় তারতম্য। যে লোক আল্লাহ্র কালেমার প্রাধান্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে লড়াই করছে, কেবল তাই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ –অন্য কিছু নয়। [পূর্বোদ্ধৃত সূত্র।]
তবে লোকদের অন্তর দীর্ণ করে ভিতরকার অবস্থা দেখার জন্যে মুসলিমদের বাধা করা হয়নি।স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের অবস্থা ও সমষ্টির বাহ্যিক অবস্থা্ই লক্ষণীয় স্বাভাবিক অবস্থা বুঝবার জন্যে, তাদের সাধারণ মতি-গতি দৃষ্টি ভঙ্গী অনুধাবনের জন্য, তাদের লক্ষ্য ও চরিত্র মূল্যায়নের লক্ষ্যে। যা তারা প্রকাশ্যভাবে বলছে, তা-ই ধরা যেতে পারে। মনের গোপন গহনে কার কি মানসিকতা ও প্রেরণার উৎস, কোন্ ব্যক্তির কি, সেব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র নিকট সমর্পিত।
এ দীর্ঘ আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, এ কালের সব যুদ্ধই ইসলামী নয়, নয় আল্লাহ্র পথে- কেননাপ তা সাহাবায়ে কিরামের যুদ্ধের মত নয়- এরূপ বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বিশেষ ধরনের স্পর্ধাও বটে! ঠিক যেমন একথা বলাও অযৌক্তিক যে, এ কালের মুসলমানের যে কোন যুদ্ধ বা সামরিক পদক্ষেপ- উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তার যা-ই হোক, ভঙ্গী ও দৃষ্টিকোণ যা-ই হোক, চিন্তা-বিশ্বাস যা-ই হোক- আল্লাহ্র পথের যুদ্ধ। এরূপ বলাও একটা বড় ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়।
তাই একালের আলিমগণের কর্তব্য, ফতোয়া দানের সময় যেন তারা মহান আল্লাহ্কে ভয় করেন এবং প্রকৃত সত্য যা জানতে ও অনুধাবন করতে চেষ্টা করেন যেন যেসব লোক গোপনে বা প্রকাশ্যে ইসলামের সাথে শত্রুতা করছে তাদের জন্যে মুসলমানদের ধন-মাল ব্যয় করা না হয়, যেন মুসলমানদের সমর্থন পেয়ে এই শ্রেণীর লোকেরা বর্বরতা ও পাশবিকতা দেখাবার সুযোগ না পায়, ইসলামকে ‘সেকেলে’ বলে অভিহিত করতে না পারে, যেমন এ কালে ইসলামের ধারক-বাহকদের বলা হয় পশ্চাদপদ ও প্রক্রিয়াশীল। এ শ্রেণীর লোকদের অনেক সময় মুসলিম ধরনের বটে; কিন্তু কার্যত তারা ইয়াহুদ-খৃস্টান-কমিউনিস্টদের চাইতেও অধিক ক্ষতিকর ও মারাত্মক হয়ে যাবে দ্বীন-ইসলাম ও মুসলিম জনতার পক্ষে।
ইসলামী শাসন পুনপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা আল্লাহ্রন পথের জিহাদ
এ কালে যাকাতের ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ অংশের ধন-সম্পদ সেই কাজে ব্যয় করা বাঞ্ছনীয়, যার উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত সংস্কারক মনীষী আল্লামা সাইয়েদ রশীদ রিজা (রা)। তিনি মুসলিমদের মধ্যে যারা দ্বীন ও দ্বীনী মর্যাদাসম্পন্ন লোক রয়েছেন, তাঁদের নিকেট একটা সংস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছেন। এ সংস্থাটি যাকাত সংক্রান্ত যাবতীয ব্যাপার সুসংগঠিত করবে, সংগ্রহ ও বন্টন করবে এবং সর্বাগ্রে তা ব্যয় করবে এই সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কল্যাণময় কাজে, অন্যত্র নয়। বলেছেন: এ সংস্থাটির সংগঠনেরন এটা লক্ষ্য রাখা আবশ্যক যে যাকাতের ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ খাতটির একটা ব্যয়ক্ষেত্র রয়েছে ইসলামী শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টায় বর্তমান। অবস্থায় কাফিরদের আগ্রাসন থেকে ইসলামকে সংরক্ষণের জন্যে জিহাদ করার তুলনায় এটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে দাওয়াতী কাজও তার একটা ব্যয়ক্ষেত্র, মুখের বক্তৃতা ও ভাষা-সাহিত্য রচনার সাহায্যে তার প্রতিরক্ষা জরুরী। কেননা এখানে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরক্ষা করা অধিক কঠিন বরং অসম্ভব ব্যাপার। [(আরবী **********)]
এ মূল্যবান প্রস্তাব গভীর অনুধাবন শক্তির পরিচায়ক। মনে হচ্ছে, তিনি সূক্ষ্মভাবে পরিস্থিতি বিবেচনা করেছেন ইসলামের জন্যে- জীবনের সব কিছুর জন্যে। ইসলামের আহ্বান-আন্দোলনকারীদের উচিত এই প্রস্তাবটি শক্ত করে ধারণ করা, বোঝা ও বাস্তবায়ন করা। কেননা দ্বীনদার লোকদের ধন-মাল নিয়ে নাস্তিক, চরিত্রহীন, আদর্শহীন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের জন্যে তা ব্যয় করার মত নির্বুদ্ধিতা আর কিছু হতে পারে না।
হ্যাঁ, প্রথমও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণকাজ ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ খাতে ইসলামী জীবনবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো, যেখানে ইসলামী আইন বিধান বাস্তবায়িত হবে, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, শরীয়াত, চরিত্র ইত্যাদি সবকিছু পুরামাত্রায় কার্যকর হবে।
সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা বলতে আমরা বুঝি সামষ্টিক সুসংগঠিত ও লক্ষ্যভিত্তিক কাজ এবং তা হল ইসলামী জীবন বিধান বাস্তবায়নের জন্যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আর তা হল ইসলামী খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মুসলিম উম্মতের পুনর্জাগরণ, ইসলামী সভ্যতার পুনরাভ্যুদয়।
এ ক্ষেত্রটিই প্রকৃতপক্ষেএমন যে, মুসলিম দানশীল লোকদের পক্ষেতাদের যাকাতরে মাল ও অপরাপর সাধারণ সাদ্কা এই কাজে বিনিয়োগ করাই অধিক উত্তম ও কর্তব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয, বহু মুসলমানই এ ক্ষেত্রটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছন, মাল ও মনন শক্তির দ্বারা এই কাজের সমর্থন দানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারেন নি। সর্বশক্তি দিয়ে এ ব্যাপারে চেষ্টা চালাতে মনে-প্রাণে প্রস্তুত হন নি। অথচ অবস্থা এই যে, যাকাত ও যাকাত-বহির্ভূত আর্থিক সাহায্য দিলে যাকাত ব্যয়ের অন্য খাতসমূহ নিঃশেষ হয়ে যায় না।
একালে ইসলামী জিহাদের বিচিত্র রূপ
আমরা এক্ষণে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি যে, ইসলামীজিহাদের কাজটি কেবলমাত্র বৈষয়িক বস্তুগত সামরিক পদক্ষেপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এ পথে জিহাদের আরও বহু প্রশস্ত ও ক্ষেত্র রয়েছে। সম্ভবত এ কালের মুসলিমগণ সেই অন্যান্য প্রকারের জিহাদের মুখাপেক্ষী তুলনামূলকভাবে বেশি। বস্তুত এ কালে আমরা ঘোষিত ইসলামী জিহাদের আরও কতিপয় পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারি।
সে পদ্ধতি ও দৃষ্টান্তসমূহ পেশ করার পূর্বে এ বিষয়টির নিগূঢ় তত্ত্ব এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।
সে নিগুঢ় তত্ত্ব হচ্ছে এই: সুসংগঠিত সেনাবহিনী সজ্জিতকরণ, তাকে সশস্ত্র বানানো এবং তার জন্যে অর্থ ব্যয়ের সমস্ত দায়-দায়িত্ব- ইসলামের সূচনাকাল থেকেই ইসলামী রাষ্ট্রের সাধারণ অর্থ ভাণ্ডারের ওপর অর্পিত ছিল। কেবল যাকাতের টাকা দিয়েই এ কাজটি হত না। সেজন্যে ‘ফাই’ ‘খারাজ’ প্রভৃতি বাবদ সংগৃহীত অর্থ সেনাবাহিনী, অস্ত্র ক্রয় ও যুদ্ধকাজে ব্রয় করা হত। যাকাতের অর্থ ব্যয় করা হত কতিপূ পরিপূরক কাজে।যেমন নফল হিসেবে যুদ্ধে যোগদানকারীদের খরচ বহন ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে আমরা দেখছি, সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষার যাবতীয় খরচের সামষ্টিক বোঝা সাধারণ বাজেটের কাঁধের ওপা চাপানো হয়ে থাকে। কেননা সে বাবদ একটা বিরাট ও ভয়াবহ ব্যয়ভারের দাবি করা হয়, যা কেবলমাত্র যাকাত সম্পদই বহন করতে সক্ষম হয় না। এরূপ ব্যয়ভার যদি যাকাত ফাণ্ডকেই বহন করতে হয়, তাহলে যাকাত বাবদ অর্জিত সমস্ত সম্পদ নিঃশেষ ব্যয় হয়েও তার প্রয়োজন পূরণ সম্ভব হবে না।
এ কারণে আমরা মনে করি, যাকাত খাতের সমস্ত আয় সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণমূলক ও প্রচরধর্মী কার্যাবলীতে ব্যয় করাই একালে উত্তম। তবে শর্ত এই যে, সে জিহাদটি ইসলামী হতে হবে সর্বতোভাবে, খালেস এবং যথার্থ ইসলামীতা কখনো জাতীয়তা বা স্বাদেশিকতাবাদী ভাবধারায় কলুষিত হবে না। পাশ্চাত্য বা প্রাচ্য উপাদান সম্পন্ন ইসলামী ঝাণ্ডাধারীও হবে না তা। কেননা তাতে বিশেষ ধর্মমত বা বিশেষ ব্যবস্থা কিংবা শহর বা দেশ, শ্রেণী অথবা ব্যক্তির খেদমতই লক্ষ্য হয়ে থাকে। যেহেতু আমরা লক্ষ্যকরছি, ইসলাম অনেক সময় এমন সব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার শিরোনাম হয়ে দাঁড়ায়, যার অভ্যন্তরীণ ভাবধারা পুরাপুরি ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মহীন হয়ে থাকে। অতএব এক্ষণে ইসলামকেই ভিত্তি ও মৌল উৎসরূপে গৃহীত হতে হবে, তা-ই হতে হবে চরম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অনুপ্রেরক ও পথ প্রদর্শক হতে হবে তাকে। তাহলেই এ সব প্রতিষ্ঠান আল্লাহ্র নামের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মর্যাদা লাভের উপযুক্ত হতে পারবে। আর সে কাজটাই ‘আল্লাহ্র পথের জিহাদ’ নামে অভিহিত হতে পারবে।
আমরা এ পর্যায়ে এমন বহু কাজের দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতে পারি, যাও ওপরে এ কালে ইসলামী দায়িত্ব পালন অনেক মাত্রায় নির্ভর করে। তাও ‘আল্লাহ্র পথের জিহাদ’ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য হতে পারে।
সঠিক ইসলামী দাওয়াত প্রচারের কেন্দ্র স্থাপন এবং অমুসলিম লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন একালে সব কয়টি মহাদেশেই একান্ত কর্তব্য। কেননা একালে বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলছে। এ কাজও ‘জিহাদ-ফী-সাবীলিল্লাহ’ রূপে গণ্য হতে পারে।
খোদ ইসলামী দেশসমূহের অভ্যন্তরে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং মুসলিম যুব সমাজকে এ কাজেনিয়োজিত ও প্রতিপালন করা একান্ত আবশ্যক। এ সব কেন্দ্র যথার্থ ইসলামী আদর্শ প্রচার করে সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। রক্ষা করতে পারে তাদেরকে সকল প্রকার নাস্তিক্যবাদী মতবাদের কু-প্রভাব থেকে, চিন্তা-বিশ্বাসের কঠিন বিপর্যয় থেকে, আচার-আচরণের বিচ্যুতি থেকে। এ কাজও ইসলামের সাহায্যরূপে চিহ্নিত হতে পারে, তাই ইসলামের দুশমনদের প্রতিহত করার এ-ও একটা কাজ এবং তাও ইসলামী জিহাদ।
খালেস ইসলামী মতবাদ ও চিন্তাধারামূলক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা প্রচার করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তা প্রতিহত করবে বিধ্বংসী ও বিভ্রান্তিকর চিন্তা-বিশ্বাসের ধারক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকার যাবতীয় কারসাজি। তার ফলেই আল্লাহ্র কালেমা প্রাধান্য লাভ করতে পারে এবং সত্য সঠিক চিন্তা সর্বত্র প্রচারিত হতে পারে। সম্ভব হতে পারে ইসলামের প্রতিরক্ষা। কেননা এ কালে ইসলামের ওপর বহু মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা আরোপ করা হচ্ছে। জনমনে বহু সংশয় ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে দিচ্ছে। এই বই ও পত্রিকা ইসলামকে সর্বপ্রকার বাহুল্য ও বাড়াবাড়ি মুক্ত করে তার আসল রূপে উপস্থাপিত করবে। এ কাজও আল্লাহ্র পথে জিহাদ। মৌলিক ইসলামী গ্রন্থাদি প্রকাশ করা- ইসলামের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করা, তার অন্তর্নিহিত পবিত্র ভাবধারাসমূহ বিকশিত করা ইসলামী আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব, সমস্যার সমাধানে তার সর্বধিক যোগ্যতা ও ক্ষমতা জনগণের সম্মুখে উপস্থাপিত করা একটা বিরাট কাজ। তা ইসলামের দুশমনদের সৃষ্ট সব বিভ্রান্তি ও সন্দেহের ধূম্রজাল ছিন্নভিন্ন করে দেবে। এ ধরনের বই-পুস্তক ব্যাপক ও সাধারণভাবে প্রচার করা একটা ইসলামী জিহাদ সন্দেহ নেই।
শক্তিমান বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান লোকদের পূর্বোক্ত কার্য ক্ষেত্রসমূহে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োগ করা, তাদের দৃঢ় সংকল্প ও মর্যাদাবোধ সহকারে সুস্পষ্ট রূপরেখা সম্মুখে নিয়ে এই দ্বীনের খেদমত করার সুযোগ করে দেয়া- বিশ্বের চারদিকে ইসলামের নির্মল জ্যোতির কিরণ ছড়ানো, ওঁৎ পেতে থাকা শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র জাল ছিন্ন করা আর ঘুমন্ত মুসিলম জনগণকে জাগ্রত করা এবং খৃস্টান মিশনারী ও নাস্তিকতার প্রচারকদের মুকাবিলা করা নিশ্চয়ই ইসলামী ‘জিহাদ ফী-সাবীলিল্লাহ্’।
প্রকৃত ইসলাম প্রচারকদের সাহায্য করাও কর্তব্য।কেননা তাদের ওপর বাইরের জগতের ইসলামের দুশশনদের প্রচার প্রচণ্ড চাপ পড়ে। অভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহদ্রোহী ও মুর্তাদ লোকদের কাছ থেকে তারা পাচ্ছে সর্বাত্মক অসহযোগিতা ও বিরোধিতা। তাদের ওপর আসে আঘাতের পর আঘাত প্রচণ্ডভাবে। নানা ধরনের আযাবে তারা হয় নিত্য জর্জরিত, তাদের হত্যা করা হয়, নিপীড়ন করা হয় মর্মান্তিকভাবে, তাদের পানাহার বন্ধ করে দিয়ে কষ্ট দেয়া হয়, মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। কুফর ও আল্লাহদ্রোহিতার এ প্রচণ্ড চাপের মুখে ঈমানের ওপর অবিচল থাকার কাজে তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র পথে অতি বড় জিহাদ।
এ ধরনের বহুবিধ বিচিত্র ক্ষেত্র এমন রয়েছে, যেখানে একালে যাকাতের সম্পদ ব্যয় করা মুসলমানদের জন্যে খুবই কল্যাণকর হতে পারে। যাকাতের ওপরও- আল্লাহ্র পরে ইসলামের ধারক-বাহকগণের প্রয়োজন পূরণের গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষ করে ইসলামের বর্তমান দুর্দিনে তো আর গুরুত্ব কোন অংশেই কম হওয়া উচিত নয়।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ইবনুস-সাবীল- নিঃস্ব পথিক
‘ইবনুস-সাবীল’ কে?
জমহুর আলিমগণের মতে ‘ইবনুস-সাবীল’ বলে বোঝানো হয়েছে সেই পথিক- মুসাফিরকে, যে এক শহ্র থেকে অন্য শহরে- একদেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায়। ‘সাবীল’ অর্থ পথ।পথিকদের ‘ইবনুস-সাবীল বলা হয় এজন্যে যে, পথিকের জন্যে পথই অবিচ্ছিন্ন সাথী। যেমন কবি বলেছেন:
(আরবী *******)
আমি সমর সন্তান, তা-ই আমায় জন্মকাল থেকে লালিত করেছে- শেষ পর্যন্ত আমি যৌবন লাভ করেছি এবং বৃদ্ধ হয়েছি জটিল সমস্যার মধ্যে পড়ে….
আরবরা তা-ই করে। সেযে জিনিসের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে, নিজেকে সে জিনিসেরই সন্তান বলে ঘোষণা করে।বলে…. তাঁর পুত্র। [আরবী *******]
তাবারী মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন, বলেছেন, ইবনুস-সাবী- পথিক ব্যক্তির একটা হক্ য়েছে যাকাত সম্পদে, সে যদি ধনী হয়তবুও- যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইবনে জায়দ বলেছেন: ‘‘ইবনুস-সাবীল’’ মানে মুসাফির, পথিক-সে ধনী হোক, কি গরীব উভয় অবস্থায়ই, যদি সে স্বীয় প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ব্যাপারে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, সম্পদ হারিয়ে ফেলে অথবা অন্য কোন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে অথবা তার হাতে যদি কোন সম্পদই না থাকে, তাহলে তার এই হক অবশ্যই প্রাপ্য। [ঐ]
(এ কারণে বাংলায় আমরা ইবনুস-সাবীল-এর অনুবাদ করেছি এক শব্দে ‘নিঃস্ব পথিক’ বলে –অনুবাদক)
‘ইবনুস-সাবীল’-এর প্রতি কুরআনের বদান্যতা
কুরআন মজীদ ‘ইবনুস-সাবীল’ শব্দটি দয়ার পাত্রহিসেবে- সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকারীরূপে- আটবার উল্লেখ করেছে। কুরআনের মক্কী অংশেরসূরা আল-ইসরায় আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
(আরবী *******)
এবং নিকটাত্মীয়কে দাও তার হক্ এবং মিসকীন, নিঃস্বপথিককেওএবং তুমি অপব্যয় করবে না। [সূরা বনী ইসরাঈল: ২৬আয়াত]
সূরা ‘আর-রূম’-এ বলা হয়েছে:
(আরবী *********)
‘অতএব দাও নিকটাত্মীয়কে তার হক্ এবং মিসকীন ও নিঃস্ব পথিককেও। এ কাজ অতবি কল্যাণময় সেসব লোকের জন্যে, যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি চায়। [সূরা রূম: ৩৮ আয়াত]
কুরআনের মাদানী সূরাসমূহে ‘ইবনুস-সাবীল’কে ফরয কিংবা নফল অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন:
(আরবী *********)
লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কি এবং কোথায় ব্যয় করবে? বল, তোমরা যে- ধন-মালই ব্যয় কর না কেন, তা আল্লাহ্র জন্যে, পিতামাতার জন্যে, নিকাটাত্মীয়দের জন্যে, ইয়াতীম মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকদের জন্যে। [সূরা বাকারা: ২১৫]
দশটি অধিকার সংক্রান্ত আয়াতে ‘ইবনুস-সাবীল’-এর প্রতি দয়া অনুগ্রহ করার আদেশ করা হয়েছে। আয়াতটি এই:
(আরবী *********)
তোমরা সকলে আল্লাহ্র বন্দেগী কবুল কর, তাঁর সাথে কোন কিছুই শরীক করোনা, পিতামাতার সাথে উত্তম দয়ার্দ্র ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, পার্শ্ববর্তীসঙ্গী, নিঃস্ব পথিক এবং তোমাদের দক্ষিণ হস্তের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। [সূরা নিসা: ৬৩]
বায়তুলমালেগনীমতের এক-পঞ্চমাংশ জমাহলে তাতেও নিঃস্ব পথিকের জন্যে একটা অংশ নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে:
(আরবী *********)
তোমরা জেনে রাখ, যে জিনিসই তোমরা গনীমত হিসেবে পাও, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলের জন্যে, নিকটাত্মীয়ের জন্যে, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্য নির্দিষ্ট। -আনফাল: ৪১
‘ফাই সম্পদেও তার জন্যে অংশ নির্দিষ্ট রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে:
(আরবী *********)
আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে নগরবাসীদের নিকট থেকে ‘ফাই’ সম্পদ পাইয়ে দেন, তা আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলেরজন্যে, নিকটাত্মীয়ের জন্যে এবং ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে যেন ধন-সম্পদ কেবলমাত্র তোমাদের ধনী লোকদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। -সূরা হাশর: ৭
অনুরূপভাবে কুরআন যাকাতেরও একটা অংশ নিঃস্ব পথিকের জন্যে নির্দিস্ট করেছে। তা এখনকার আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে। যার সূচনা হয়েছে এভাবে: (****) যাকাত আদায় করর পরও ব্যক্তিদের নিকটযে মাল-সম্পদ সঞ্চিত থাকে, তাতেও তার জন্যে অংশ নির্দিষ্ট হয়েছে। এরূপ অবস্থায় এই দান আল্লাহ্ভীতি ও পরম পুণ্যময় কাজের অন্তর্ভুক্ত। আয়াতটি হচ্ছে:
(আরবী *********)
এবং দেয় মাল-সম্পদ আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার দরুন নিকটাত্মীয়কে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিঃস্ব পথিক, প্রার্থী, দাসত্ব-শৃংখলে বন্দী লোকদেরকে এবং নামায কায়েযম করেও যাকাত দেয়। -সূরা বাকারা: ১৭৭
ইবনুস-সাবীল-এর প্রতি গুরুত্ব দানের যৌক্তিকতা
নিঃস্ব-পথিকের ব্যাপারে কুরআনের এতটা গুরুত্ব দানের মূলে নিহিত কারণ ও যৌক্তিকতা হচ্ছে, দ্বীন-ইসলাম মানুষকে দেশ ভ্রমণ ও বিদেশ গমনের উপদেশ দিয়েছে নানাভাবে ও বিবিধ কারণে। দুনিয়ার ঘুরে-পরিব্রমণ করে দেখার ও উৎসাহ দানের মূলে কতগুলো কারণ নিহিত রয়েছে:
ক. এক ধরনের পরিভ্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে রিযিক সন্ধানের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ বলেছেন:
(আরবী *********) তাই চল তোমরা পৃথিবীর কন্দরে কন্দুরে এবং তার কাছে থেকে পাওয়া রিযিক আহার কর। -সূরা মূলক: ১৫
বলেছেন: (আরবী *********)
অন্যরা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, সন্ধান করে আল্লাহ্র অনুগ্রহ (রিযিক) এবং আরও অন্যরা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করে। -সূরা মুযাম্মিল: ২০
নবী করীম (স) বলেছৈন: (*****) তোমরা পরিভ্রমণ কর, পরিণামে ধনী হয়ে যাও। [মুনযেরীহাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন: (****) গ্রন্থে। ২য়খণ্ড কিতাবুস সাওম বলেছেন, তাবারানী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছে (****) গ্রন্থে, এর বর্ণনাকারিগণ নির্ভরযোগ্য।]
খ. আর এক প্রকারের পরিভ্রমণের জন্যে ইসলাম উদ্বুদ্ধ করেছে। তা হচ্ছে জ্ঞান-শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ। বিশ্বের অবস্থা অবলোকন এবং সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা আল্লাহ্র নিদর্শনাবলী দেখে উপদেশ গ্রহণের লক্ষ্যে। সাধারণভাবে সৃষ্টিকর্মে আল্লাহ্র অনুসৃত নীতিসমূহ দেখার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে মানব সমাজের মধ্যে নিহিত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্যে।তিনি বলেছেন:
(আরবী *********)
বল, তোমরা পরিভ্রমণ কর পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এবং দেখ কিভাবে সৃষ্টিকর্ম সূচিত করেছিলাম। -সূরা আনকাবুত: ২০
এ আয়াতের ভূ-তত্ত্ব (Geology) ও জীবনের ইতিহাস এবং তৎসংশ্লিষ্ট অপরাপর তত্ত্ব আলোচনা-পর্যালোচনা ও অধ্যয়নের নির্দেশ নিহিত রয়েছে।
আল্লাহ বলেছেন: (আরবী *********)
তোমাদের পূর্বে বহু যুদ-কাল অতিবাহিত হয়ে গেছে অতএব তোমরা পৃথিবী পরিভ্রমণ কর এবং পর্যবেক্ষণকর আল্লাহতে অবিশ্বাসীদের পরিণতি কি হয়েছে। -সূরা আলে-ইমরান: ১৩৭
বলেছৈন: (আরবী *********)
এ লোকেরা কি পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করেনি? করলে তারা এমন হৃদয় লাভ করতে পারত যদ্দারা তারা প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে সক্ষম হত; কিংবা এমন শ্রবণেন্দ্রিয় পেতে পারত যদ্দ্বারা তারা অনেক তত্ত্ব জানতে পারত। কেননা প্রকৃত অন্তুদৃষ্টি কখনও অন্ধ হয় না; অন্ধ হয় হৃদয়- যা বুকের মধ্যে অবস্থিত। -সূরা হজ্জ: ৪৬
সেই বক্ষে নিহিত অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করার লক্ষ্যে এই ভূ-পর্যটনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাসূলে করীম(স) বলেছেন: ‘যে লোক ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ্ তার জন্যে জান্নাতের পথে চলা সহজ করে দেবেন। [মুনযেরী, মুসলিম কিতাবুল ইলম] আর যে লোক ইলম সন্ধান করার উদ্দেশ্যে বের হল, সে আল্লাহ্র পথেই রয়েছে যতক্ষণ না সে ফিরে আসে।’ (তিরমিযী)
প্রাথমিককালের আলিমগণ একটা দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। দৃষ্টান্তটি খুব উচ্চমানের। তা ইলম সন্ধানের পথে দৃষ্টিহীন পরিভ্রমণের কাহিনী। এ কালের আলিম ও পাশ্চাত্য-প্রাচ্যের ঐতিহাসিকগণ খুব বিস্ময় ও শ্রদ্ধা সহকারে তার উল্লেখ করেছেন।
গ. ইসলাম অপর এক প্রকারের ভ্রমণের আহ্বান জানায়। তা হচ্ছে আল্লাহ্র পথে জিহাদের জন্যে সফর। সর্বপ্রকার বিদেশী বিজাতীয় দখলদারী থেকে দেশের স্বাধীনতার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্ত করা, ইসলামী দাওয়াতের কাজের নিরাপত্তা বিধান, দুর্বল লোকদের নিষ্কৃতি সাধান ও ওয়াদা ভঙ্গকারীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান প্রভৃতিই হচ্ছে আল্লাহ্র পথ।
আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী *********)
তোমরা বের হয়ে পড় হালকাভাবে ও ভারী হয়ে এবং জিহাদ কর তোমার ধন-মাল ও জান-প্রাণ দিয়ে আল্লাহ্র পথে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণময়, যদি তোমরা জান। -সূরা তওবা: ৪১
এরপর মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
(আরবী *********)
হে নবী! যদি সহজলভ্য স্বার্থ হত এবং সফরও হত কষ্টবিহীন, তা হলে ওরা নিশ্চয়ই তোমার পেচনে চলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যেত। কিন্তু তাদের জন্য এই পথ তো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এক্ষণে তারা আল্লাহ্র নামে শপথ করে করে বলবে, আমরা যদি চলতে পারতাম তা হলে নিশ্চয়ই তোমাদের সঙ্গে যেতাম। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। আল্লাহ্ তো বালো করেই জানেন যে, ওরা মিথ্যাবাদী। -সূরা তওবা: ৪২
মুজাহিদদের সওয়াব দানের কথা বলার পর আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:
(আরবী *********)
‘অনুরূপভাবে এটাও কখনই হবে না যে, (আল্লাহ্র পথে) অল্প বা বেশি কিছু খরচ তারা বহন করবে এবং (জিহাদী চেষ্টা-প্রচেষ্টায়) কোন উপত্যকা তারা অতিক্রম করবে এবং তাদের পক্ষে তা লিখে না নেয়া হবে, উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ্ তাদের এই ভালো কীর্তির পারিশ্রমিক তাদের দান করবেন। [(আরবী *********)]
নবী করীম (স) বলেছেন: আল্লাহ্র পথে একটা সকাল কিংবা একটা বিকাল অতিবাহিত করা সারা দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা আছে সেসব কিছু থেকে উত্তম। [বুখারী, কিতাবুল জিহাদ]
চ. আর এক প্রকারের সফরের প্রতি ইসলাম আহ্বান জানিয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহ্র একটা সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ইবাদত- হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্র ঘর পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে। তা ইসলামের একটা অন্যতম ‘রুকন’।
আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী *********)
‘আল্লাহ্র জন্যে কা’বায় হজ্জ করা লোকদের জন্যে ফরয- যারা সে পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থবান হবে। -সূরা আলে-ইমরান: ৯৭
(আরবী *********)
এবং লোকদেরকে হজ্জের জন্যে সাধারণ অনুমতি দিয়ে দাও, তারা তোমার নিকট সব দূরান্তরের স্থান থেকে পায়ে হেঁটে এবং উটের ওপর সওয়ার হয়ে আসবে। যেন তারা সেই সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণ দেখতে পারে যা এখানে তাদের জন্যে রক্ষিত হয়েছে এবং কতিপয় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র নাম নেবে….। –সূরা হজ্জ: ২৭-২৮
দেশ-বিদেশ ভ্রমণ ও ঘোরাফেরার এ হচ্ছে বিভিন্ন ও বিচিত্র ধরন। ইসলাম এ সব সফরের জন্য আহ্বান জানিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। পৃথিবীতে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্যে এ সব পরিভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করেছে মুসলমানদের। ইসলামের মহান শিক্ষার বাস্তবায়ন এভাবেই সম্ভবপর হতে পারে। এ ছাড়া আরও কয়েক ধরনের বিশ্বপরিভ্রমণ রয়েছে। আর দ্বীন ইসলামের বৈশিষ্ট্যই এখানে যে, এ সব সফরে গমনকারী লোকদের প্রতি তা খুব বেশি ও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। আরও বিশেষ করে তাদের প্রতি, যারা এইসফরে বের হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে এবং তার আপন লোকজন ও ধন-মাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইসলাম সাধারণভাবেই এ সবের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করার নির্দেশ দিয়েছে এবং বিশেষ করে যাকাতের অংশ- জনগণের দেয়া সম্পদ থেকে তাদের প্রয়োজন পরিমাণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। আর তা করে বিদেশ ভ্রমণের পক্ষে ইসলামের উৎসাহ দানকে শক্তিশালী করেছে, শরীয়াত সম্মত উদ্দেশ্যে বিশেধ ভ্রমণের কাজটিকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। ভ্রমণকারীদের অপরচিত পরিমণ্ডলে সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী বানিয়েছে। মুসলিম সমাজের সকল অংশই যে পরস্পর সম্পৃক্ত- দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ তার বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপিত করেছে। এ সমাজের লোকেরা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলে, একের বিপদ বা অসুবিধায় অপর লোক বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে দেয়। সে ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের কোন পার্থক্যের প্রতি আদৌ কোন ভ্রূক্ষেপ করা হয় না। আর দেশী-বিদেশীদের মধ্যে ইসলামে কোন পার্থক্যই করা যেতে পারে না।
© Bangladesh Jamaat-e-Islami