ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
মানবিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য
জেনে রেখো, বীরত্ব ও অন্যান্য নৈতিক কল্যাণ সব মানুষের এক হয় না। তাতে মানুষে মানুষে বিভিন্নতা দেখা দেয়। কোন কোন মানুষের ভেতরে তো বীরত্ব গুণ একেবারেই অনুপস্থিত। হয়ত এমন কোন প্রতিকূল পরিবেশ তার অভ্যন্তরে বিরাজ করছে যার ফলে তার কাছ থেকে বীরত্ব আশাই করা যায় না। যেমন, নপুংসক কিংবা অত্যন্ত দুর্বল চিত্তের লোক বীরত্ব গুণ থেকে বঞ্চিত। কিছু লোক এমন আছে যে, সাধারণত তারা বীর নয়, কিন্তু সাহস সৃষ্টির কাজ, কথা ও সাহসী নেতৃত্বের আনুগত্য তাকে বীর বানায়। বীর নেতা ও সহকর্মীদের দৃষ্টান্ত, কথা ও কাজ তাকে বীরত্বপূর্ণ কাজে পা বাড়াতে উৎসাহিত করে।
মূলতঃ বেশ কিছু লোক এমন রয়েছে যাদের ভেতরে সুপ্ত যোগ্যতা বিদ্যমান। তবে শুরুতে তা দেখাতে গিয়ে স্বভাতই ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে। তখন যদি তাকে থামিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তার উৎসাহ দমে যায় ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপ হয়ে যায়। তখন যদি কেউ তার জন্মগত সুপ্ত প্রতিভার অনুরূপ কোন নির্দেশ দেয় তা তখন গন্ধ্রকে আগুন লাগার মতই জ্বলে ওঠে।
কিছু লোক এমন রয়েছে যার ভেতরে বিশেষ কোন যোগ্যতা পূর্ণ মাত্রায়ই দেয়া হয়েছে। সে কখনও চুপ থাকতে পারবে না, তার জাগ্রত গুণ তাকে চাংগা করে সামনে এগিয়ে নেবে। সে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই ছুটে চলবে। কোন কাপুরুষ তাকে হাজার ডেকেও ফেরাতে পারবেনা। এমন কি সমাজের কোন রীতি-নীতির প্রতিকূলতা কিংবা অনুকূলতার তোয়াক্কা না করেই সে তার বিশেষ গুণের সহজ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে চলে। এ ধরনের ব্যক্তিই উক্ত গুণের লোকদের নেতৃত্ব দেয়। তার কোন নেতা বা প্রশিক্ষকের প্রয়োজন দেখা দেয় না। যারা এ যোগ্যতায় তার চেয়ে পেছনে, তাদের জন্য জরুরী হল তার পদ্ধতি, রীতি-নীতি, কার্যধারা অনুসরণ করা ও তার ঘটনাবলী স্মরণ করা! তাহলেই তার গুণ, কৃতিত্ব ও যোগ্যতার ততটুকু সে অর্জন করতে পারবে যতটুকু তার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে।
এভাবে মানুষের যোগ্যতার তারতম্যের প্রকৃতি ও পরিবেশগত অবস্থাও সক্রিয় থাকে, যেমন, খিযির (আঃ) যে ছেলেটিকে হত্যা করেছিলেন সে প্রকৃতিগতভাবেই কাফির ছিল।
যেমন আল্লাহ বলেন, ‘সে বধির, বোবা ও অন্ধ তাই পথে আসবে না’।
কিছু লোক এমন রয়েছে, যার গুণ ও যোগ্যতা প্রকাশ না পেলেও সংস্কারের মাধ্যমে তা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। তবে সে জন্যে তার কঠোর সাধনা প্রয়োজন। তেমনি প্রয়োজন ক্রমাগত আমল করা। স্থায়ী আমলের প্রভাবে প্রবৃত্তি প্রভাবিক হয়। এ ধরনের লোকদের প্রয়োজন আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রেরণাদায়ক দাওয়াত ও সংশোধন পদ্ধতি। এ ধরণের লোকই সর্বাধিক। আম্বিয়ায়ে কেরামের মিশনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এদের দিকেই।
একদল লোক এমন রয়েছে, যাদের ভেতর চারিত্রিক গুণাবলীর মৌল ভিত্তি প্রদত্ত হয়েছে। তাই তার কাজে ক্রটি-বিচ্যুতিও দেখা দেয়। কারণ, মূল গুণকে শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে দিয়ে সকল কাজকর্ম সঠিকভাবে করার জন্য তার পথপ্রদর্শক ‘গুরু’ প্রয়োজন। এদের দিকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ এরশাদ করে, “অচিরেই তাদের প্রদীপ জ্বলে উঠবে যদিও তাতে এখনও আগুন লাগানো হয়নি”। এদের লা হয় সাব্বাক!
মানব জাতির একটি স্তর হল আম্বিয়ায়ে কেরামের। যাদের ভেতর মানবিক গুণাবলীর পূর্ণতা ঘটেছে। তাদের এ পূর্ণতা যথাযথভাবে অনুসরণ কর, অনর্জিত গুণ অর্জন করা, অর্জিত গুণ বহাল রাখা ও অপূর্ণকে পূর্ণতার তালিম দেয়ার ব্যাপারে তাদের জন্য কোন পথ প্রদর্শক দরকার হয়না, এমন কি তাদের কারো কিছু বলতেও হয় না। তারা স্বভাব সুলভ ভাবে যা কিছু করেন তা অন্যদের জন্য অনুসরণযোগ্য বিধান ও পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়। অন্য সব মানুষ তা স্মৃতিস্থ করে নিজেদের কর্মধারায় পরিণত করে। যখন কোন কর্মকার, ব্যবসায়ী ও তাদের মত অন্যান্য পেশাদার নিজেদের পেশা চালাতে গিয়ে পূর্বপুরুষ থেকে তা শিখে নিতে হয়, তখনসেই উচ্চাংগের নৈতিক উৎকর্ষ অর্জন কি করে উৎকৃষ্ট ও পূর্ণাঙ্গের চরিত্রের মহাপুরুষদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া সম্ভব হতে পারে? অথচ তা শুধু চেষ্টায়ও হয় না, আল্লাহ পাকের তওফীক অর্জন ছাড়া।
এ ব্যাপারটি এখন সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আম্বিয়ায়ে কেরামের মুখাপেক্ষী হওয়ার একান্তই অপরিহার্য। তাঁদের অনুসরণ করা ও তাঁদের বাণী অনুশীলন করা অত্যন্ত জরুরী। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
বৈশিষ্ট্য অর্জনে মানবের বিভিন্ন পদ্ধতি
জেনে রেখো, বৈশিষ্ট্য দু’ভাবে অর্জিত হয়। একটি পদ্ধতি হল, জৈব শক্তিকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলা। সে জন্যে এমন সব উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা হয়, যাতে ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সে সবের তৎপরতা শেষ হয়ে যায়, সেগুলোর জ্ঞান ও দহন উধাও হয়ে যায়। সার্বক্ষণিকভাবে দেহ ও মন সর্বশক্তিমানের দিকে নিবিষ্ট হয়। আত্মা সেই সব জ্ঞানই গ্রহন করে যা স্থান ও কালের সাথে কোনই সম্পর্ক রাখে না। যে সব বস্তুতে কোনই স্বাদ নেই তার ভেতরে সেই সব বস্তুর আকাঙ্ক্ষা জাগে। এমনকি সে লোকজনের সাথে মেলামেশা ছেড়ে দেয়। তাদের আকর্ষণের বস্তুগলো তার ভেতর বিকর্ষণ সৃষ্টি করে। তাদের ভয় পাবার জিনিসগুলোকে সে আদৌ ভয়ের চোখে দেখে না। জনমানব থেকে সে বিচ্চিন্নতা অবলম্বন করে। বিজ্ঞ, আলোকপ্রাপ্ত ও সুফী দরবেশগণ এই স্তরে পৌঁছার জন্য সচেষ্ট থাকেন। তবে তার ভেতরে খুব কম লোকই এ স্তরে পৌঁছতে পারেন। অন্যান্য সবাই সেটার আকাঙ্ক্ষা থাকে ও সর্বক্ষণ সেদিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে। তারপর কৃত্রিমভাবে সেরূপ হাবভাব প্রদর্শন করে।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে জৈবিক শক্তিকে বিচ্ছিন্ন না করে তাকে পরিশুদ্ধ করা হয়। তার বক্রতা দূর করা হয়। কিন্তু তার মূল শক্তি বহাল থাকে। তখন অবস্থাটা এই দাঁড়ায় যে, কোন এক বোবা লোক যেভাবে বাকসম্পন্ন লোকদের বলার ভংগীকে নকল করে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে, ঠিক সেভাবেই জৈবিক শক্তিটি আত্মিক শক্তির কথা ও কাজকে অনুকরণ করে থাকে। যেমন, কোন চিত্রকর কোন ব্যক্তির মনের অবস্থা যেমন ভীতি, লজ্জা ইত্যাদি এমন ভাবে চিত্রিত করেন যা দেখামাত্র বুঝা যায়, এও ঠিক তেমনি ব্যাপার। যেমন, কোন সন্তানহারা জননী তার সন্তানের শোকে ইনিয়ে-বিনিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় যা কিছুই প্রকাশ করে তাতেই মানুষের ভেতর জননীর শোকটি রেখাপাত করে। এও ঠিক তেমনি ব্যাপার।
যখন আল্লাহ পাকের ব্যবস্থাপনা এ সিদ্ধান্ত নেয় যে, দুনিয়ার ব্যবস্থাপনার সব চাইতে প্রিয় ও সবচাইতে সহজ পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হবে, গোটা মানব জাতির সংস্কার ও তাদের সকল ব্যাপার পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের ইহ ও পরকালের সামগ্রিক কল্যাণ দান করা হবে, তাহলে পয়লা তিনি উপরোক্ত দ্বিতীয় পদ্ধটিটি কায়েমের ব্যবস্থা নেন। তখন সেদিকে মানুষকে ডাকার ও উদ্ধুদ্ধ করার জন্য দুনিয়ায় নবী-রাসূলদের পাঠান। তারপর পয়লা পদ্ধতিটির দিকে শুধুমাত্র প্রাসংগিক ইংগিত-ইশারা করে ছেড়ে দেন! পরিপূর্ণ দলীল-প্রমাণ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত।
খোলাসা কথা এই যে, পয়লা পদ্ধতিটি শুধু তাদের জন্যে যাদের ভেতরে ‘লাহুতী” আকর্ষণ সর্বাধিক! এ ধরনের লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এ পদ্ধতিটি পথ দেখান তারাই যারা সংসার জীবন ত্যাগ করে এবং দুনিয়ায় তাদের দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব থাকে না! অবশ্য এ পদ্ধতির পরিপূর্ণতা কখনও দ্বিতীয় পদ্ধীতর সামগ্রিক ব্যাপারটি সামনে না রেখে অর্জিত হয় না। তাছঅড়া এ পদ্ধতিতে কোন না কোন মানবিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়। হয় তাব থেকে দুনিয়ার কোন সংস্কার সাধিত হবেনা, হয়তো পরকলের জন্যে তার আত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটবে না। যদি সবাই সে পথ ধরে তাহলে পৃথিবী বিরান হয়ে যাবে। যদি তা করার জন্যে লোকদের নির্দেশ দেয়া হয়, তাহলে অসাধ্য সাধনের নির্দেশ দেয়া হয়। কারণ, কল্যাণকর ব্যবস্থাপনা মানবের স্বভাবজাত ব্যাপার বই নয়। তাই সমঝদার ও সংস্কারবাদী লোক দ্বিতীয় পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তারাই দ্বীন দুনিয়ার নেতৃত্ব লাভ করেন। তাদের পদ্ধীতই কবুল হয় আর তাদের পদ্ধতিই অনুসৃত হয়। তাদেরই পদ্ধতির মাধ্যমে পূর্বসূরী পুণ্যাত্মাবৃন্দ ডান হাতে আমলনামা প্রাপকগণের সাফল্য অর্জন হয়েছে। এ শ্রেণীর লোকই দুনিয়ায় সর্বাধিক। এ পদ্ধতি মেধাবী, নির্বোধ, ব্যস্ত ও অবকাশ প্রাপ্ত সবারই অনুসরণযোগ্য। এতে কোন অসাধ্যতা ও কষ্ট নেই। আখেরাতের মুক্তির জন্যে নিজেকে যতখানি পরিশুদ্ধ ও সজ্জিত করা প্রয়োজন তা এতে রয়েছে। কারণ, এতে যে সব পুণ্য কাজে নির্ধারিত রয়েছে পারলৌকিক শান্তির জন্যে তা যথেষ্ট। এখন থাকে নিঃসঙ্গ থাকার বিধান। তা করবে, গেলে পাওয়া যাবে, যদিও স্বভাবতই সে সময়টি কারো জানা নেই। তাই কবি বলেন-
সে দিন তোমার আসছে ধেয়ে
যে দিনটিকে জানতে না
প্রস্তুতি যার রাখতেনা।।
মোটকথা মানবিক কল্যাণ ও সৌভাগ্যের সব পদ্ধতি পূর্ণভাবে আয়ত্ত করা অধিকাংশ লোকের পক্ষে প্রায় সাধ্যাতীত ব্যাপার! তাই সে সব ব্যাপারে অজ্ঞতায় ক্ষতির কিছু নেই।
পরিচ্ছেদঃ বত্রিশ
বৈশিষ্ট্যের দ্বিতীয় পদ্ধতি অর্জনের নীতিমালা
জেনে রেখো, দ্বিতীয় স্তরের কল্যাণ অর্জনের অসংখ্য পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ পাক অনুগ্রহ করে আমাকে বুঝিয়েছেন যে, সেগুলো এমন চারটি স্বভাবে সীমিত যা জৈবিক শক্তি মেনে নেয়। যখন মানুষ তার জৈবিক শক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং সেটাকে সে সঠিক অবস্থার অনুকূল হতে বাধ্য করে নেয়, তখন সর্বাবস্থায় সে অবস্থা সর্বোচ্চ পরিষদের সদস্যদের গুণাবলীর সাথে অনকেটা একাকার হয়ে যায়। সে গুণাবলীর কারণে মানুষ সর্বোচ্চ পরিষদের সাথে মেলামেশার ও তাদের দলভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
আল্লাহ পাক আমাকে বুঝিয়েছেন, এ শিক্ষা ও প্রেরণা প্রদানের জন্যে আল্লাহ পাক আম্বিয়ায়ে কেরামকে প্রেরণ করেছেন। সমগ্র শরীঅতের বিধি-বিধান সেই পদ্ধতিরই বিশ্লেষণ মাত্র। সব কিছুর লক্ষ্য হচ্ছে দ্বিতীয় পদ্ধতি। তার ভেতরে একটি স্বভাব বা গুণ হল পবিত্রতা। তার তাৎপর্য এই যে, যখন মানুষ বিবেকবান হয় ও তার মন-মেজাজ সুস্থ থাকে, তখন তার থেকে মুক্ত হয়। তাই এরূপ অবস্থায় যখনই সে অপবিত্র কিছুর সংস্পর্শে আসে আর তাকে জৈবিক প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হয়, যেমন পায়খানা-প্রস্রাব বা স্ত্রী মিলন ইত্যাদি, তখন তার মন অস্বস্তি বোধ করে থাকে। তার চেহারায় অন্তর্জ্বালা ও বেদনাক্লিষ্টতার ছাপ পড়ে যায়। সে নিজকে খুব হেয় অবস্থায় দেখতে পায়। তারপর যখন উভয় ধরনের অপবিত্রতা দূর হয় এবং নিজের অংগ-প্রত্যংগ ধৌত করে ও গোসল করে, আর ভাল কাপড়-চোপড় পরে, খোশবু লাগায়, তখন তার সেই ক্লিষ্টতা দূর হয়ে যায়। তখন কার অন্তর তৃপ্ত ও প্রশস্ত হয়ে যায়। এটা কোন লোক দেখানো বা রুসম-রেওয়াজ পালনের জন্যে নয়; বরং মানুষ হিসেবে তার মানবিক চেতনা থেকেই এটা করতে থাকে।
এক্ষণে উপরোক্ত দু’অবস্থার পয়লাটিকে অপবিত্রতা ও দ্বিতীয়টিকে পবিত্র বলা হয়। যে লোক মেধাবী তার কাছে বিধি-বিধানের যথার্থতা সুস্পষ্ট। তার মেধা অবস্থানুপাতে বিধান সম্পর্কিত ব্যাপারটি সহজেই বুঝতে পায়। সে উক্ত উভয় অবস্থার পার্থক্য উপলব্ধি করে এবং একটি অবস্থাকে অপছন্দ ও অপর অবস্থাটিকে পছন্দ করবে। তবে নির্বোধ লোকও যদি জৈবিক শক্তি দুর্বল হয়, আর নিষ্ঠার সাথে পবিত্রতা অবলম্বন করে চলে এবং যদি দু’অবস্থা নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ পায় তা হলে সেও এই দুটোর তারতম্য বুঝতে পায়।
জৈবিক দেহের অপবিত্রতাকে ওযু ও গোছলের মাধ্যমে পবিত্র করে মানুষ নিজকে একদিকে যেমন তৃপ্তির আনন্দে উদ্বেল হয়, অন্যদিকে তেমনি সর্বোচ্চ পরিষদের পরিমণ্ডলের সাথে নিজের সাযুজ্য খুঁজে পায়। এ কারণেই পবিত্রতা মানবিক কল্যাণের ক্ষেত্রে পূর্ণতা অর্জনের কার্যকলাপে মানুষকে যথেষ্ট শক্তি জোগায়।
পক্ষান্তরে অপবিত্রতা যখন একাধারে চলতে থাকে আর তা কোন মানুষকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রাখে, তখন তার ভেতরে শয়তানের কুমন্ত্রণা গ্রহণের, তাদের এমনকি সামনা-সামনি দেখার, ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের তিমিরে আচ্ছন্ন থাকার ও ভয়ংকর জীব-জানোয়ারের মূর্তি চোখের সামনে মূর্ত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ যখন পবিত্রতা অবলম্বন করে এবং একাধারে তা নিষ্ঠা সহকারে চলতে থাকে, তখন তার ভেতর ফেরেশতার ইলহাম গ্রহণের, তাদের দেখার, ভাল ভাল স্বপ্ন দেখে আনন্দ লাভের, ভাল ভাল বস্তু, সুন্দর সুন্দর আকৃতিতে দেখার এবং অত্যন্ত পবিত্র ও মহান জিনিস দেখার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় স্বভাব বা গুণটি হল আল্লাহপাকের সামনে বিনীত থাকা। তার তাৎপর্য এই যে, যখন কাউকে আল্লাহপাকের বাণী ও গুণাবলী উল্লেখ করে কিছু বুঝানো হয়, তখন সে সতর্ক হয়ে যায় ও তার দেহ ও মন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তা গ্রহণ করে। কারণ, সে অস্থির হয়ে যায় আল্লাহপাককে পাবার জন্যে।
সাধারণ লোক মহা প্রতাপান্বিত বাদশার দরবারে হাজির হলে তার সে অবস্থা দেখা দেয় তার করুণা ও বখশিশ পাবার জন্যে সেরূপ বিনয় ও স্তুতির আশ্রয় নেয়। আল্লাহর দরবারেও মানুষের সে অবস্থাই সৃষ্টি হবে। কারণ, তাঁর অসীম প্রতাপ ও অশেষ মহত্ত্বের সামনে নিজেকে অসহায়ভাবে বিলীন করার মাধ্যমে সে সর্বোচ্চ পরিষদের সদস্যদের সর্বাধিক সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে পারে। তার এ অবস্থাটিকে তাকে মন মগজে আল্লাহর পরিচয় চিত্রিত করে কল্যাণের ক্ষেত্রে পূর্ণতা অর্জনের এবং এক অবর্ণনীয় উত্তম অবস্থায় তার দরবারে উপস্থিত হবার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করবে।
তৃতীয় স্বভাবটি হল, ঔদার্য্য। অর্থাৎ, পৌরুষ ও বদান্যতা। তার তাৎপর্য এই যে, জৈবিক বাসনা-কামনার কাছে নতি স্বীকার না করা, তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা এবং মন-মানসিকতায় তার ছাপ পড়তে না দেয়া।
মূলত মন যখন জীবিকার ধাধাঁয় নিমগ্ন হয়, নারী সম্ভোগের চিন্তায় বিভোর হয়, স্বাদ-আহ্লাদে অভ্যস্ত ও ভাল ভাল খাওয়ার আকাংক্ষী হয় তখন তা অর্জনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে উদ্দেশ্য সফল করতে ব্যস্ত থাকে। তেমনি যখন কোন ব্যাপারে জিদ সৃষ্টি হয়, কিংবা লালসা দেখা দেয়, তখন তাতে সাফল্য অর্জনের জন্য সর্বশক্তি নিয়ে আত্মনিয়োগ করে। এরূপ ক্ষেত্রে স্বভাবতঃই সে অন্য কিছুর দিকে চোখ তুলে তাকাবার সুযোগ পায় না। তারপর যখন এ অবস্থা দূর হয়, তখন তার ভেতর যদি মনোবল বিদ্যমান থাকে, তাহলে তা থেকে এরূপ দূরে সরে আসে, যেন কোনদিনই সেসব কাজে লিপ্ত ছিল না। কিন্তু যদি মনোবল শূন্য হয়, তাহলে উক্ত অবস্থাগুলো তার মনে সেভাবে দানাবেঁধে অবস্থান করে যেভাবে মোমের উপর মহর অংকিত হয়ে থাকে। পৌরুষ দীপ্ত প্রশস্ত অন্তরের লোক যখন জৈবিক বাসনা-কামনা থেকে মুক্ত হয়ে ও নিজের আসল অবস্থার দিকে প্রত্যাবর্তন করে তখন দুনিয়ার কোন লোক তার ভেতর ফেরেশতা স্বভাবের পরিপন্থী কোন কাজই দেখতে পায় না। এ কারণেই পরিণামে সে প্রীতিময়তা ও সফলতার অধিকারী হবে।
পক্ষান্তরে, লোভ-লালসায় ডুবে থাকা দুর্বল চিত্তের লোকের অন্তরে সীল পড়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যায়, কোন পৌরুষদীপ্ত দানশীল লোকের কোন মূল্যবান জিনিস চুরি হলেও সে তার পরোয়া করে না। কিন্তু সংকীর্ণমনা ব্যক্তি সেরূপ ক্ষেত্রে পাগলের মত হয়ে যায়। তার চোখে শুধু সে বস্তুটিই জুড়ে থাকে!
ঔদার্য্য ও সংকীর্ণতার এ বিপরীতমুখী অবস্থা দুটোর অনেক পরিভাষা রয়েছে। যদি তা সম্পদের বেলায় হয়, তাহলে বলা হয় বদান্যতা ও কৃপণতা তেমনি যদি যৌনতৃপ্তি ও উদরপূর্তির ব্যাপার হয়, তাহলে বলা হয় রক্ষণশীলতা ও কামনা শক্তি। যদি শ্রমলব্ধ ও আয়াস সাধ্য ব্যাপার হয়, তাহলে বলা হয় ধৈর্যশীল ও অধৈর্য। যদি দ্বীনি বিধি-বিধান সম্পর্কিত ব্যাপারে হয়, তাহলে বলা হয় পুণ্যবান ও পাপী।
মানুষের ভেতর যখন এ সাহস ও ঔদার্য্য দানা বাঁধে তখন তার মন জৈবিক বাসনা-কামনা থেকে মুক্ত হতে পারে ও তার ভেতরে উন্নত পর্যায়ের নিঃসঙ্গতার আনন্দ লাভের যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। সৎসাহস ও ঔদার্য্য এমন এক মানসিক অবস্থঅ যা মানুষকে পূর্ণতা অর্জনের শিক্ষা ও কাজ অনুসরণের সকল অন্তরায় দূর করে।
চতুর্থ স্বভাব বা গুণ হল ন্যায়পরায়ণতা। এটা এমন এক আত্মিক যোগ্যতা, যার দৌলতে দেশ ও জাতির সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান সম্ভব হয়। ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজগুলো তার স্বভাবগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এর রহস্য এই যে, জৈবিক প্রভাবমুক্ত আত্মার সাথে ফেরেশতার সম্পর্ক কায়েম হয়। আর ফেরেশতা ও পুণ্যাত্মা লোকদের ইচ্ছানুযায়ী আল্লাহপাকের ইচ্ছা সক্রিয় হয় এবং পার্থিব ব্যবস্থাপনায় আল্লাহপাক ন্যায়ানুগ পরিবর্তনের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে দেন। মূলত এ স্বভাবতটি কেবল জৈবিক প্রভাবমুক্ত সুস্থ আত্মায়ই দেখা দেয়। সে আত্মাই শুধু পক্ষপাতহীন হক ইনসাফের কাজে আনন্দ পেয়ে থাকে। পার্থিব স্বার্থান্ধরা তা পেতে পারে না। তাই জৈবিক জ্ঞান স্বভাবতঃই এসব কাজে সংকুচিত ও বিমর্ষ হয়ে থাকে। মানুষ যখন এ ধরনের স্বার্থান্ধ হয়, তখন তা দূর করে ইনসাফ কায়েমের পরিমণ্ডল সৃষ্টির জন্য আল্লাহ পাক নবী-রাসূলদের পাঠিয়ে থাকেন।
এ কারণেই যে ব্যক্তি ইসলাম কায়েমের জন্যে অগ্রসর হয় এবং জনগনের ভেতরে তা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে, সে আল্লাহর রহমত পাবার যোগ্য হয়ে যায়। মানুষের ভেতর যখন ন্যায়পরায়ণতার স্বভাব স্থায়ী হয়ে যায়, তখন তাদের সাথেও আরশবাহী নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের সাথে সম্পর্ক কায়েম হয়ে যায়। ফলে তা আল্লাহ পাকের রহমত ও বখশিশের উপলক্ষ হয়ে যায়। তখন তাদের ও ফেরেশতাদের মাঝে পুণ্য প্রভাবের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এ স্বভাবের ওসিলায় ফেরেশতারা তাদের মদদগার হয়। তাদের অন্তরে ফেরেশতাদের ইলহাম নাযিল হয়। তারাও সে ব্যাপারে জানার জন্য উৎসাহী থাকে।
যখন এ চারটি স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের তাৎপর্য পরিস্কার হয়ে যাবে, তখন কি ভাবে ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে পূর্ণতা হাসিল হয়, তাও জেনে নিতে হবে। এও জানতে হবে যে, কি করে এ স্বভাববিশিষ্ট লোকদের সাথে ফেরেশতাদের সম্পর্ক কায়েম হয়। এটাও ভালভাবে জানতে পাবে যে, উক্ত গুণাবলীর দ্বারা কিভাবে সর্ব যুগে যুগোপযোগী খোদায়ী বিধান প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা যায়।
শেষ কথা, তখন তুমি অনেক মংগল ও কল্যাণ প্রাপ্ত হবে এবং দ্বীনের আইন প্রণেতা হয়ে যাবে। তুমি তাদের ভেতর গণ্য হবে, যাদের জন্য আল্লাহ কল্যাণ মঞ্জুর করেছেন। উক্ত চারগুণ দ্বারা যে অবস্থা সৃষ্টি হয়, তাকেই বলা হয় প্রকৃতি বা মানবিক স্বভাব। এ স্বভাব অর্জনের কয়েকটি উপায় রয়েছে। তার কোন কোনটি হচ্ছে বিদ্যাগত এবং কোন কোনটি হচ্ছে কর্মগত। তারপর এমন কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা মানুষকে স্বভাবের উদ্দেশ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে। সে প্রতিবন্ধকতা দূর করার বাহানাও রয়েছে। আমি চাই তোমরা সে ব্যাপারগুলো সম্পর্কে অবহিত হবে।
সে জন্যে আল্লাহর তাওফিক অনুযায়ী আমি যা কিছু বলি তা তোমরা মোনযোগ দিয়ে শোন। আল্লাহই সর্বশক্তিমান।
পরিচ্ছেদঃ তেত্রিশ
স্বভাব চতুষ্টয় অর্জন, অপূর্ণত্ব পূর্ণ করা ও হৃতবস্তু উদ্ধার করার পদ্ধতি
জেনে রেখো, উক্ত চারটি স্বভাব হাসিলের দুটি ব্যবস্থা রয়েছে। একটি জ্ঞানগত ও অপরটি কর্মগত। জ্ঞানগত পদ্ধতি এজন্যে যে, স্বভাব প্রকৃতি জ্ঞান শক্তির অনুগত ও অনুসারী হয়। তাই তুমি দেখতে পাবে যে, যখন মানুষের অন্তরে লজ্জা ও ভীতি সৃষ্টিমূলক কথা বলা হয়, তখন তার কামনার ও নারী সম্ভোগের স্পৃহা স্তিমিত হয়ে আসে। তারপর যখন তার অন্তর স্বভাবের অনুকূল জ্ঞানে পূর্ণ হয়ে যায়, তখন সে জ্ঞান ব্যাপারগুলো তার অন্তরে মজবুত ভাবে বসে যায়। আরতা এভাবে হয় যে, সে এ কথা বিশ্বাস করে যে, আমার আল্লাহ সকল মানবিক দুর্বলতা ও ত্রুটি থেকে মুক্ত পবিত্র। তাঁর কাছে আসমান ও যমীনের বিন্দু-বিসর্গও গোপন থাকে না। যখনই তিন জন মানুষ গোপন পরামর্শ করে, তখন তিনি সেখানে চতুর্থ ব্যক্তি হয়ে সেখানে বিরাজ করেন। তেমনি যেখানে পাঁচজন মিলে শরা-পরামর্শ করে, সেখানে ষষ্ঠ হয়ে বিরাজ করেন। তিনি যা চান তা-ই করেন এবং যাকে চান নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা কারো নেই। ক্ষমতা নেই কারো ঠেকিয়ে রাখারও। নিজ অনুগ্রহে তিনি সব কিছুরই অস্তিত্ব দান করেন। তিনিই সেসব বস্তুকে দৈহিক ও আত্মিক নিয়ামতরাজি দান করেন। বান্দাকে তিনি কর্ম অনুসারে ফল দান করেন। সে যদি ভাল কাজ করে, তাহলে তিনি ভাল ফল দেন আর খারাপ কাজ করলে খারাপ ফল দেন। স্বয়ং আল্লাহ বলেনঃ “আমার এই যে বান্দা পাপ করে সে জানে, আমার এক প্রভু আছেন যিনি পাপের জন্য পাকড়াও করেন, আবার ক্ষমাও করবেন। তাই আমি তাকে ক্ষমতা করে দিলাম”।
মোটকথা, সে এরূপ দৃঢ় মনোভাব পোষন করে যে, তার অন্তরে অত্যধিক আল্লাহভীতি ও আল্লাহর মর্যাদাবোধের ফলে তাতে সর্বদা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর তিলমাত্র ভয় বা মর্যাদাবোধ অবশিষ্ট থাকে না। সে খুব মজবুত ভাবেই এ ধারণা পোষণ করে যে, মানুষের মূল কৃতিত্ব আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট চিত্তে রুজু হয়ে তাঁর গোলামী করার ভেতরেই রয়েছে। আর মানুষের সর্বোত্তম অবস্থা হল ফেরেশতাদের মত হয়ে আল্লাহর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করা। আল্লাহ পাক বান্দার কাছ থেকে এটাই চান আর বান্দার ওপর আল্লাহর এটা দাবী যে, তারা অবশ্যই সব কিছু যথা সময়ে করবে।
সারকথা হল, মানুষের কল্যাণ উক্ত ব্যাপারগুরো বাস্তবায়নের ভেতরেই রয়েছে এবং তা বর্জনের ভেতরে রয়েছে চরম অকল্যাণ। বিশেষতঃ পাশব প্রবৃত্তিকে সতর্ক ও শায়েস্তা করার জন্যে শক্ত চাবুক দরকার যা দিয়ে তার খারাপ ইচ্ছেগুলো স্তদ্ধ করা যায়। উক্ত বিদ্যাগত ও বিশ্বাসগত অবস্থা সৃষ্টির জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। তার ভেতরে সর্বোত্তম পদ্ধতি আল্লাহপাক ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে নাযিল করেছেন। তা হচ্ছে এই, মানুষকে আল্লাহর সুস্পষ্ট নিদর্শন দ্বারা, তাঁর সর্বোচ্চ গুণাবলী দ্বারা, তাঁর প্রদত্ত আত্মিক ও দৈহিক নিদর্শন দ্বারা, তাঁর সর্বোচ্চ গুণাবলী দ্বারা, তাঁর প্রদত্ত আত্মিক ও দৈহিক নেয়ামতরাজি দ্বারা বুঝানো যাতে তার কাছে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহপাকের জন্যে পার্থিব সকল সুখ-শান্তি বিসর্জন দেয়ার সকল যোগ্যতা তাঁর রয়েছে। তাই সকল ভাবনার ওপর তাঁর ভাবনা ঠাঁই পাবে এবং তাঁকে সর্বাধিক ভালবাসবে ও তাঁর ইবাদতের জন্যে সার্বিকভাবে যত্নবান হবে।
মুসা (আঃ) এসব পন্থার সাথে তাঁর ভীতি সৃষ্টির পথও অনুসরণ করেছেন। তিনি এ ভাবে আল্লাহর কঠোরতা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি অনুগত ও অবাধ্যদের দুনিয়ার বুকেও পুরস্কার ও শাস্তি দিয়ে থাকেন এবং নিয়ামতকে কখনও শাস্তিতে রূপায়িত করেন। উদ্দেশ্য হল, মানুষের অন্তর থেকে যেন পাপাসক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায় ও আনুগত্যের স্পৃহা যেন মন-মগজে শিকড় গেড়ে বসে।
আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম উপরোক্ত ব্যবস্থাদির সাথে কবর ও হাশরের অবস্থা সম্পর্কিত সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ শোনান ও সতর্ক করেন। তিনি পাপ-পুণ্যের প্রকৃতি বর্ণনা করেন। সেগুলো শুধু জেনে নেয়াই যথেষ্ট নয়; বরং সর্বদা তার আলোচনা ও অধ্যয়ন প্রয়োজন। ব্যাপারগুলো যেন অহরহ চোখেরসামনে ভাসতে থাকে। ফলে যেন সে সম্পর্কিত জ্ঞান পূর্ণ হয়ে যায়। তার সব বাণী স্মরণ করা, আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করা ও রোজ হাশরের ঘটনাবলী স্মরণ করার তিন বিদ্যা স্মৃতিস্থ হতে হবে। তার সাথে আরও দু’বিদ্যা যথা হালাল-হারামের বিধান ও কাফেরের সাথে দ্বন্দ্ব-বিরোধের বিধি-বিধান জানতে হবে। এ পাঁচ বিদ্যাকেই কোরআনের উত্তম শিক্ষা বলে গণ্য করা হয়।
এক্ষণে কর্মগত ব্যবস্থার উত্তম পদ্ধতি হল এই, মানুষ চাল-চলন কাজকর্ম ও ব্যাপারাদি অবলম্বন করবে যা ইপ্সিত গুণাবলী স্মরণ করে দেয় ও মনকে সদা সতর্ক রাখে! পরন্তু উক্ত গুণাবলীর দিকে উৎসাহিত করে। এটা এ কারণেও হতে পারে যে, সে কার্যাবলী ও উদ্দিষ্ট গুণাবলী পরস্পর সম্পৃক্ত। অথবা সে কাজগুলো স্বভাবতঃই উক্ত গুণাবলী অর্জনের ধারণাকে জোরদার ও বিজয়ী করে দেয়। তার উদাহরণ এই, মানুষ চায় যে, সে নিজকে উত্তেজিত করবে তখন সে প্রতিপক্ষ যেসব বকাবকি করেছে ও দুর্ণাম বদনাম রটিয়েছে তা স্মরণ করে থাকে। এ ধরনের বহু উদাহরণ রয়েছে। পুরো ব্যাপারটি সে আয়ত্ত করতে চায়। তার সামনে সেগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে।
এ ভাবে উক্ত গুণাভলী বা স্বভাব অর্জনের বিভিন্ন উপায় উপকরণ রয়েছে। সেগুলোর সাহায্যে তা হাসিল করা যায়। প্রথমতঃ সেগুলোর পরিচিতি লাভের জন্য মার্জিত রুচি ও সুস্থ বুদ্ধি অপরিহার্য। যেমন অপবিত্রতার কারণসমূহ দেখা দিলে সংকুচিত হওয়া এবং যেমন যৌন তৃপ্তি মেটাবার জন্যে স্ত্রী সহবাস করা ও হাওয়া নির্গমনে সংকুচিত হওয়া, শরীর ময়লামুক্ত হওয়া, কফ, থুথু ও সর্দী বের হওয়া, নাভিল নিম্নভাগ ও বগলের কেশ বড় হওয়া, শরীর কিংবা কাপড়ে নাপাক বস্তু লাগা ইত্যাদি।
তাছাড়া নিম্নস্তরের খেয়াল ও আলোচনা যাতে জঘন্য মনোবৃত্তি সৃষ্টি হয়। যেমন, নোংরা মুখরোচক কথাবার্তা, লজ্জাস্থান দেখা, পশুদের সঙ্গম মনোযোগ দিয়ে দেখা, ফেরেশতা কিংবা নেককার লোকদের গালমন্দ বা সমালোচনা করা, মানুষকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করা ইত্যাদি। সেসব জিনিসই অবলম্বন করতে হবে যা স্বভাবতঃই পবিত্রতার সহায়ক হয়। যেমন, গোছল করা, ওযু করা, পরিস্কার পোশাক পরা, খোশবু ব্যবহার করা ইত্যাদি। কেননা এসব জিনিস ব্যবহার করলে মন পবিত্রতার দিকে আকৃষ্ট হয়।
তেমনি বিনয় সৃষ্টির উপায় হচ্ছে আল্লাহপাকের তাযীমের সর্বোচ্চ অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা। যেমন, তাঁর সামনে আনত শিরে দাঁড়ানো, সিজদা করা। এমন সব শব্দ ব্যবহার করা যা দিয়ে প্রার্থনা, বিনয় ও প্রয়োজনীয় বস্তু কামনা করা হয়। কারণ, এসবের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশের উঁচু স্তর অর্জিত হয়।
তেমনি ঔদার্য সৃষ্টির উপায়সমূহের ভেতর দান-দক্ষিণায় অভ্যস্ত হওয়া, উৎপীড়ককে ক্ষমা করা, কঠিন অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করা ইত্যাদি রয়েছে।
তেমনি আদালত বা ন্যায়নীতির স্বভাব সৃষ্টির উপায় হচ্ছে খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শে ন্যায়নীতির রীতি-নীতির সব কিছু সবিস্তারে জেনে তা সংরক্ষণ ও অনুসরণ করা। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
পরিচ্ছেদঃ চৌত্রিশ
মানবিকতা বিকাশের অন্তরায়
জেনে রেখ, মানবিক বৈশিষ্ট্য বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায় তিনটি। প্রকৃতিগত অন্তরায়, রীতিগত অন্তরায় ও বুদ্ধিগত অন্তরায়।
এ অন্তরায়গুলোর মূলে রয়েছে মানুষের খাওয়া-পরা ও কামনা-বাসনা চরিতার্থের দৈনন্দিন চিন্তা ও প্রয়াস। মানুষের অন্তর প্রকৃতির আবেগ ও ইচ্ছার বাহন। আর এ ভাব বহন করতে গিয়ে তাকে খুশী, অসুখী ও রাগ-ভয় ইত্যাদির শিকার হতে হয়। ফলে মানুষের মন সর্বদা তাতেই ডুবে থাকে। উদ্দিষ্ট বস্তু অর্জনের উপায়-উপকরণ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। বিবেক-বুদ্ধিকে যথোপযোগী বস্তু হাসিলের জন্য কাজে লাগাতে হয়। এসব কারণেই মন এসব বস্তুগত সমস্যায় ব্যস্ত থাকে। পরিণামে অন্যসব ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায়। তাই মানবিক চরিত্র বিকাশের ভাবনা তার আদৌ থাকে না।
বহুলোক অনুরূপ মনের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চোরাবালিতে ধসে গেছে। তারপর সারা জীবনও সেখান থেকে উঠে আসার সৌভাগ্য হয়নি।
তেমনি অনকে লোক আছে, যাদের ভেতরে জৈব প্রবৃত্তি প্রাধান্য পেয়েছে। তারা রীতি-নীতি ও বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে বেপরোয়া হয়েছে। এটাকেই বলা হয় প্রবৃত্তিগত অন্তরায়।
পক্ষান্তরে যার ভেতর বিবেক-বুদ্ধি চাংগা রয়েছে আর তার বিবেক-বুদ্ধি পূর্ণতা অর্জন করেছে সে ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে নেয়, প্রবৃত্তির তাড়া পেয়েও সংযত থাকে এবং নিজের মনকেও অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে। ফলে তার মন প্রবৃত্তির চাহিদা ছেড়ে বিবেক-বুদ্ধির প্রভাবে চলার যোগ্যতা অর্জন করে। তখন সে বুদ্ধি ও কর্মক্ষমতার সংযোগে মানবতার ক্ষেত্রে পূর্ণতা অর্জনের জন্যে উৎসাহী হয়। তার এ সচেতনতাই তাকে স্বজাতির আচার-আচরণ, লেবাস-পোশাক, মান-মর্যাদা, গর্ব ঐতিহ্য ইত্যাদি অধ্যয়ন ও অনুশীলনে যত্নবান করে। কারণ, সেসব তার মন-মগজে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ফলে তার তা অর্জনের জন্য দৃঢ় ইচ্ছা ও বলিষ্ঠ সাহস সৃষ্টি হয়। এটাই হল রীতিগত প্রতিবন্ধক। এটাই হল পার্থিব উন্নতির উৎস। বহু লোক সর্বদা এতেই মত্ত থাকে। এমনকি এর জন্য জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেয়।
মূলতঃ এ কৃতিত্ব ও সাফল্য অস্থায়ী এবং আসে আর যায়। কারো সাথে স্থায়ী থাকে না। কারণ, এর সম্পর্ক জড়জীবনের সাথে এবং পার্থিব উপায়-উপকরণ নির্ভর। তাই মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে এ সাফল্য তার বিপক্ষে চলে যায়। এটা তো সেই বাগানের মত যা আগুনে ভস্মীভূত হয় আর তার ছাইগুলো হাওয়ায় উড়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি যদি যথার্থই সচেতন ও বিচক্ষণ হয়, তাহলে সে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে কিংবা অনুমান-আন্দাজ করে অথবা ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুসরণ করে অবশ্যই বিশ্বাস করে যে, তার একজন পালনকর্তা রয়েছে। তিনি তাঁর সকল বান্দার ওপর প্রভুত্বব বিস্তার করে আছেন। তাদের সকল উপায়-উপকরণ তিনিই সরবরাহ করেন। তাদের তিনি অজস্র অবদানে ধন্য করেছেন। এর ফলে তার অন্তর সেই পালনকর্তা প্রভুর দিকে ঝুঁকে যায় ও তাঁর প্রেমে পূর্ণ হয়। এমনকি সে প্রভুর নৈকট্য লাভের জন্য আগ্রহী হয় এবং যেসব কাজ করলে তা অর্জিত হয় তা-ই সে খুঁজে বেড়ায়। তখন সে তাঁর দরবারে কান্নাকাটি করে। সেরূপ ক্ষেত্রে কেউ তাঁকে পায়, কেউ বা ব্যর্থ হয়।
ব্যর্থতার কারণ দুটো। এক, স্রষ্টার ভেতর সৃষ্টির গুণ খেয়াল করা। দুই, সৃষ্টির ভেতর স্রষ্টার গুণ বিশ্বাস করা। পয়লা অবস্থাটি হল উপমাগত ভ্রান্তি। তার তাৎপর্য এই যে, অদৃশ্যকে দৃশ্য বস্তুর সাদৃশ্য ভাবা। দ্বিতীয় অবস্থাটি শির্ক। তার তাৎপর্য এই যে, সৃষ্টির ভেতরে অলৌকিক কাজ দেখে সেটাকে তারই কৃতিত্ব ভাবা।
আমি যা কিছু বললাম তার সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য তোমরা গোটা মানব জাতির প্রতিটি মানুষকে পরীক্ষা করে দেখতে পার, কোথাও তার ব্যতায় দেখবেনা। তখন অবশ্যই দেখতে পাবে যে, একদল প্রকৃতির তাড়নার শিকার হয়ে বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দেয়ায় তাদের মানবতার বিকাশ ঘটছে না। আরেকজন লোক প্রচলিত রীতি-নীতির বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে নিজেদের যথার্থ স্বভাবের বিকাশ ঘটাতে পারছে না। সমাজে কে কি বলছে না বলছে এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। গায়েবী প্রত্যাদেশেও তাঁর জীবন ব্যবস্থার দিকে তাদের কান দেবার অবসর হয় না।
পরিচ্ছেদঃ পঁয়ত্রিশ
অন্তরায় দূর করার পথ
জেনে রাখুন, প্রকৃতিজাত প্রতিবন্ধক দূর করার দুটি ব্যবস্থা রয়েছে! এক, তার ওপর হুকুম চালান, তাকে উৎসাহ জোগানো ও তাকে উদ্যোগী করা। দুই, সে চাক বা না চাক পয়লা ব্যবস্থার ব্যাপারগুলো তার থেকে জোর করে আদায় করা এবং সে সব ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করা। এখানে পয়লা পদ্ধতিটি হল সেই সাধনা যদ্বারা জৈব প্রকৃতিকে দুর্বল ও অনুগত করা হয়। যেমন রোযা রাখা ও রাত জাগা ইত্যাদি। কিছু লোক তো এ সব ক্ষেত্রে এত বাড়াবাড়ি করেছে যে, আল্লাহর সৃষ্টি বিগড়ে দিয়েছে। যেমন পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা, অতি অনশনে হাত-পা শুকিয়ে অবশ করা। এ সব চরম ধৃষ্টতা। মধ্যম পন্থাই উত্তম পন্থা। আর সেটা রোযা রাখঅ ও রাত জাগাই এর অব্যর্থ ব্যবস্থা। তাও প্রয়োজন মতে হওয়া উচিত।
দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, রিপুতাড়িত পথচ্যুতদের প্রতি বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা সৃষ্টি করা। তাদের সে সব ব্যবস্থা প্রদান করা উচিত যা থেকে সে প্রবৃত্তির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে। এ জন্যে কাউকে খুব বেশী কষ্ট দেয়া ঠিক নয়। তবে কেউ অন্যায় করবে না বললেই যথেষ্ট মনে করা উচিত নয়। তাকে বেত্রদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া চাই। অবশ্য মারপিট সেসব অপরাধ করা উচিত যে সব অপরাধ সংক্রামক। যেমন ব্যভিচার ইত্যাদি।
প্রথাগত প্রতিবন্ধকতা উচ্ছেদের উপায় হল এই, প্রতিটি কাজে আল্লাহকে স্মরণ রাখা। তিনি কি কি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন আর কোন কাজের কি সীমা-শর্ত নির্ধারণ করেছেন সর্বদা তা খেয়াল রাখা। দ্বিতীয়ত, সকল ইবাদতকে প্রথা বানিয়ে নেবে আর তা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পালন করবে। যারা তা বর্জন করবে তাদের নিন্দা করবে। যদি কখনও তা বর্জন হয়ে যায় সে জন্যে নিজকে সুখ-শান্তি ও আনন্দদায়ক কাজ থেকে বিরত রাখবে। এর ফলে প্রচলিত পদ্ধতির সংস্কার মন থেকে দূর হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর ইবাদতে মন লাগলেই তা সহজ হয়ে যাবে।
আল্লাহকে পাবার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা দেখা দেয়ার যে দুটো কারণ (তাশবীহ ও শিরক) রয়েছে তা থেকে বাঁচার উপায় হল এই যে, আল্লাহ যেহেতু মানবীয় জৈব স্বভাব ও কাজ থেকে পবিত্র তাই তাঁকে তার সাথে তুলনা করা এবং কোন মানুষকে তাঁর গুণ ও কাজের কোন কিছুর যোগ্য মনে না করা। পরন্তু সাধারণ মানুষের সামনে এমন প্রসংগ না আনা যা তাদের বোধগম্য হবার নয়।
এর তাৎপর্য হল এই যে, এমন কোন উপস্থিত, অনুপস্থিত, শরীরী অশরীরী বস্তু নেই যার সাথে মানুষের জ্ঞান জড়িত হয় না। হয় স সশরীরে কিছু দেখে সে সম্পর্কে জানে, অথবা উপস্থিত বস্তুর ওপর অনুমান ও কেয়াস করে অনুপস্থিত জিনিস সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি করে। এ ভাবে না থাকা বস্তু এমনকি অজ্ঞাত বস্তু সম্পর্কেও ধারণা নিয়ে থাকে। তার পদ্ধতি এই যে, পয়লাসে অস্তিত্বমান বস্তুর অর্থ জেনে নিয়ে অনস্তিত্ব বস্তুকে তার আলোকে বুঝে নেয়। তেমনি অজ্ঞাত বস্তুর নাম ও অর্থ জেনে নিয়ে তার সাথে জ্ঞাত বস্তু মিলিয়ে সেটা সম্পর্কে একটা কল্পিত যৌগিক ধারণা সৃষ্টি করে থাকে। হয়তো সেটা বস্তুর অর্থ জেনে নিয়ে অনস্তিত্ব বস্তুকে তার আলোকে বুঝে নেয়। তেমনি অজ্ঞাত বস্তুর নাম ও অর্থ জেনে নিয়ে তার সাথে জ্ঞাত বস্তু মিলিয়ে সেটা সম্পর্কে একটা কল্পিত যৌগিক ধারণা সৃষ্টি করে থাকে! হয়ত সেটা বস্তু জগতে তো নেইই, কল্পনার জগতেও তার অস্তিত্ব অনুপস্থিত। যেমন, মানুষ কোন খেয়ালী বস্তু কল্পনা করে নিজের বুদ্ধিমতে তার আকৃতি-প্রকৃতি ঠিক করে সেই কল্পিত বস্তুটিকে বাস্তব রূপ দেয়। এটা সম্পূর্ণই তার খেয়ালী বস্তু হয়।
আল্লাহ পাক সম্পর্কে মানুষকে এ কথাই বলতে হবে যে, আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্ব আছে কিন্তু তা আমাদের মত নয়। মোটকথা আল্লাহ তা’আলার এমন গুণাবলী চিন্তা করা উচিত যা দৃশ্যমান, প্রশংসনীয় গুণাবলীর উৎস মনে করা হয় এবং সে ক্ষেত্রে তিনটি তাৎপর্যের প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আমরা প্রকাশ্যে যা কিছু দেখছি তার তিন অবস্থা। এক, এমন বস্তু যা প্রশংসার যোগ্য এবং তাতে প্রশংসার নিদর্শনও রয়েছে। দুই, এমন বস্তু রয়েছে যা না বর্তমানে প্রশংসনীয়, না ভবিষ্যতে তার প্রশংসনীয় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তিন, এমন বস্তু যার আপাততঃ গুণ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তা প্রশংসার যোগ্য। যেমন জীবিত পাথর কিংবা মৃত।
আল্লাহ তা’আলার ক্ষেত্রে গুণ নির্ণয় করা হয় তবে নিদর্শনের আলোকে। তাই উক্ত তাশবীহ বা উপমাজনিত ভ্রান্তি এভাবে দূর করা যায় যে, তিনি আমাদের মত নন। আল্লাহকে না বুঝার ও তাঁর ব্যাপারে পাপমূলক ধারণা সৃষ্টির কারণ এই যে, দৃশ্যমান বস্তুর সৌন্দর্য ও স্বাদ সর্বদা দৃষ্টিতে থাকার ও জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলো অহরহ তাতে ভরপুর থাকার মন স্বভাবতই তাতে প্রভাবিত থাকে। পক্ষান্তরে আল্লাহর যথার্থ গুণাবলী সম্পর্কে কোন ধারণা বা খেয়াল থাকে না। এর প্রতিকার হচ্ছে কঠিন ও কষ্টকর আত্মিক সাধনা। তাছাড়া এমন সব আমল অনুসরণ করা, যার ফলে উঁচুস্তরের তাজাল্লী বা নূর ধারণের ক্ষমতা অর্জিত হয়। যদিও তার প্রকাশ আখেরাতেই ঘটবে। এ জন্যে এ’তেকাফ করা চাই। আর যথাসম্ভব পার্থিব আকর্ষণীয় দৃশ্যাবলী থেকে দূরে থাকা চাই। যেমন, রাসূল (সঃ) চিত্রাংকিত পর্দা ও জরী-বুটিদার চাদর ছিঁড়ে ও ছুঁড়ে ফেলেছিলেন।
পরিচ্ছেদঃ ছত্রিশ
পাপ-পুণ্যের বিবরণ
পাপ-পুণ্যের তাৎপর্যঃ পুরস্কার ও শাস্তির বর্ণনা যখন আমরা শেষ করে এলাম আর মানুষের যে সব প্রকৃতিগত বিভিন্ন সমস্যাদি পর্যালোচনা শেষ করলাম, যার বাইরে মানুষের অস্তিত্ব থাকতে পারে না, তখন আমরা মানুষের বিভিন্ন স্তর ও তা অর্জনের পথ নির্দেশ করেছি। এক্ষণে আমরা মানুষের পাপ-পুণ্য বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করতে যাচ্ছি।
মানুষ সর্বোচ্চ পরিষদের আনুগত্য প্রদর্শনের জন্যে আল্লাহর ইশারা-ইংগীত সর্বতোভাবে মেনে নিয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে যে কাজ করে তাকেই বলা হয় পুণ্য। তাছাড়া মানুষের যে কাজ তার প্রকৃতিগত ব্যবস্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যশীল সেটাও পুণ্য। পরন্তু যে কাজ আনুগত্যের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে তার অন্তরায়গুলো দূর করে সেটাও পুণ্য। তেমনি যে কাজের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতে পুরস্কৃত করা হয়, সেটাকেই পুণ্য বলে।
পক্ষান্তরে মানুষ শয়তানের আনুগত্য প্রদর্শন ও তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে যে কাজ করে তাকে বলা হয় পাপ। তাই যে কাজের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি দেয়া হবে সেটাও পাপ। তেমনি যে কাজ মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করে সেটাই পাপ। পরন্তু যে কাজ স্রষ্টার আনুগত্যের পরিপন্থী পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে ও তাঁর কাজের অন্তরায়গুলো দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে সেটাও পাপ।
যে ভাবে জ্ঞানীসমাজ বস্তুজগতের নিয়ম-শৃঙ্খলার জন্যে আইন-কানুন র জন্যে আইন-কানুন প্রণয়ন করে চলে এবং পর্যায়ক্রমে দুনিয়ার সর্বত্র দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ তাতে একমত হয়ে নিজ এলাকায় অনুসরণ করে থাকে, পুণ্য প্রচলনের পদ্ধতিও ঠিক তাই।
আল্লাহ পাক যাদের অন্তরে ফেরেশতাসুলভ নূরের অস্তিত্ব পয়দা করার জন্য ইলহাম করেছেন, তারা তা করে চলে ও তার ওপরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। অতঃপর তারা মানুষকে তা শিক্ষা দেয় ও তা করার জন্য প্রেরণা যোগায়। ফলে তারা তার অনুসারী হয়। আস্তে আস্তে সকল ধর্মপ্রাণ লোকেরা স্বভাবগত সাযুজ্যের কারণে ও জাতিগত প্রয়োজনের খাতিরে তার প্রচারিত নীতিমালার ওপরে একমত হয়। এভাবেই মানব সমাজে পুণ্য কাজের প্রচলন হয়। মধুমক্ষিকা যেভাবে আল্লাহ দত্ত ইলহামের মাধ্যমে নিজেদের সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবন জীবিকার বিধিব্যবস্তা চালু করেছে, মানব সমাজেও সেভাবে তা চালু হয়ে থাকে।
বলাবাহুল্য, পুণ্য কাজের এ গ্রহণযোগ্যতা দেশ বা ধর্মের দূরত্বও ঠেকাতে পারে না। মানুষ যখন কোন মূলনীতিতে একমত হয়ে যায়, তখন তার শাখা-প্রশাখার পার্থক্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না। তেমনি গোত্র বা গোষ্ঠীবিশেষ তা না মানলেও কিছু আসে যায় না। কারণ, সূক্ষ্মদৃষ্টি সম্পন্ন লোক এটা সুস্পষ্টই দেখতে পায় যে, সে লোকদের প্রকৃতিই মানব-জাতির সহজাত প্রকৃতির পরিপন্থী। তাই সে মানবের স্বভাবতগত বিধি-বিধানও মানতে পারছে না। এ লোকগুলো হল কোন মানব দেহের ব্যতিক্রম ধর্মী বাড়তি অংশের মত যা থাকার চেয়ে না থাকাই উত্তম ও শোভন।
পুণ্য প্রচলন পদ্ধতিগুলোর বিবিধ বড় বড় উপায় ও ব্যবস্থা রয়েছে। আল্লাহর ওহী প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যে পদ্ধতিগুলো দৃঢ়-ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, তাদের ওপর আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ বর্ষিত হোক –তারা মানব জাতির স্থায়ী কল্যাণ সাধণ করে গেছেন। এখন আমি আপনাদের সামনে তাদের সেই সর্ববাদীসম্মত নীতিমালা তুলে ধরতে চাই, যার ওপরে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের বড় বড় দল, অভিজাত সম্প্রদায়, রাষ্ট্রনায়কবৃন্দ, জ্ঞানী গুণীকুল, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক, আরব-অনারব, ইয়াহুদী, হিন্দু, মাজুসী প্রভৃতি একমত হয়েছে। অতঃপর আমি সে নীতিমালা সৃষ্টি হওয়ার পটভূমি ও ব্যাখ্যা করব যা জৈব প্রবৃত্তির আত্মিক শক্তির আনুগত্যের মাধ্যমে জন্ম হয়। তারপর তার কল্যাণকারিতার সেসব দিকও তুলে ধরব যা আমি ব্যক্তি জীবনের বারংবার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করেছি এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি যা নির্দেশ করে থাকে।
পরিচ্ছেদঃ সাইত্রিশ
তাওহীদ
সকল পুণ্যের উৎস হল তাওহীদ বা একত্ববাদ। সকল শ্রেণীর পুণ্যের ভেতর এটাই সর্বোত্তম। কারণ, নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালককের সামনে একাগ্রভাবে সবিনয়ে আত্মনিবেদন করার কাজটি সর্বতোভাবে এর ওপর নির্ভরশীল। মানবিক মৌলিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের এটাই নৈতিক ভিত্তি। এটাই সেই জ্ঞানগত ব্যবস্থা যা উভয় ব্যবস্থাপনার ভেতর সর্বাধিক কল্যাণপ্রদ। এর মাধ্যমে মানুষ অদৃশ্য জগতের দিকে পূর্ণ মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়। তার আত্মা এক পবিত্র বন্ধনের সাহায্যে অদৃশ্য শক্তির সাথে সংযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাওহীদের বিরাট মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি এটাকে সকল পুণ্যের আত্মা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আত্মা যদি ঠিক থাকে তাহলে যেমন গোটা দেহ ঠিক থাকে, আর আত্মা যদি বেঠিক হয় তো সারা দেহ বেঠিক হয়ে যায়, এও তেমনি ব্যাপার।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মারা গেল এবং আল্লাহর সাথে শিরক করল না, সে জান্নাতে গেল। তিনি আরও বলেন –তার ওপর দোযখের আগুন হারাম। তিনি আরও বলেনঃ কোন বস্তুই তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না। তিনি আল্লাহ পাকের বাণী উদ্ধৃত করে বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার সামনে এক পৃথিবী পাপ নিয়ে এল এবং আল্লাহর সাথে শিরক না করা অবস্থায় এল, আমি তার সাথে এক পৃথিবী ক্ষমা নিয়ে মিলিত হব।
মনে রাখবেন, তাওহীদের চারটি প্রাণ সত্তাঃ
১। ওয়াজিবুল ওজুদ বা অপরিহার্য সত্তা হবার গুণ একমাত্র আল্লাহ তা’আলার। আল্লাহ ব্যতীত কারো অস্তিত্বই স্থায়িত্ব পাবে না।
২। আরশ, আকাশ, পৃথিবী ও সকল মৌলিক বস্তুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ।
মূলত কোন ঐশী গ্রন্থই উপরোক্ত দু’ব্যাপারে দ্বিমত দেখায়নি। আরবের মুশরিকরাও উক্ত ব্যাপারে একমত। ইয়াহুদী নাসারাও তা অস্বীকার করেনা। কুরআন বলছে, উক্ত ব্যাপারে সবাই একমত।
৩। আসমান ও যমীন এবং ততে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন।
৪। একমাত্র আল্লাহই ইবাদত বা উপাসনা লাভের যোগ্য। কারণ ইবাদত তো একমাত্র মাবুদের অবিচ্ছেদ্য ভূষণ! ইবাদত ছাড়া কোন মা’বুদ চিন্তা করা যায় না। এ কারণেই দুনিয়ায় ইবাদত ও মা’বুদ নিয়েই যত মতান্তর দেখা দিয়েছে। এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধর্মগোষ্ঠী, তার ভেতরে তিন সম্প্রদায় বড়।
১. নক্ষত্র পূজকঃ তারা মনে করে, নক্ষত্রমণ্ডলীই উপাসনা লাভের যোগ্য। নক্ষত্র পূজা থেকেই পার্থিব কল্যাণ আসে। তার সামনে কিছু প্রার্থনা করাই সঠিক কাজ। তারা বলে, আমরা গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পেরেছি যে পৃথিবীতে দৈনন্দিন যা ঘটে, মানুষের যা কিছু সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য তাদের সুস্থতা ও রুগ্নতা সব কিছুর ব্যাপারেই নক্ষত্রের হাত রয়েছে। নক্ষত্রের আত্মা আছে যা তাদের গতিবিধি থেকেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই সেগুলো তাদের উপাসনায় সাড়া দেয় ও তাদের ব্যাপারে উদাসীন নয়। এ কারণেই তারা তারকার জন্য উপাসানয় তৈরী করেছে। তাতে তারা সেগুলোর উপাসনা করছে।
২. অংশীবাদীঃ এ সম্প্রদায়টি মূল স্রষ্টার ব্যাপারে আমাদের সাথে একমত। এমন কি বড় বড় কাজগুলো যে সেই স্রষ্টার তাতেও তারা দ্বিমত পোষণ করে না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যে আল্লাহর হাতে তাও তারা মানে, কিন্তু অন্যান্য ব্যাপারে তারা ভিন্ন মত পোষন করে। তাদের ধারণা, পূর্ববর্তী যেসব নেককার বুযুর্গ আল্লাহর নৈকট্য পেয়ে গেছেন, তাদেরকেও আল্লাহ তাঁর কার্যকলাপের কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন। তাই আল্লাহর তারা সৃষ্টিজীব হলেও ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। যেমন, কোন বাদশাহকে কেউ বহু খেদমত করে খুশী করে থাকে এবং বাদশাহ তাকে পুরস্কার স্বরূপ বিশেষ খেতাব দিয়ে কোন এলাকার দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। তখন সে এলাকার লোকের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় তার আনুগত্য করা! এ যুক্তির ভিত্তিতেই মুশরিকরা বলে থাকে, সেই বুযুর্গদের ইবাদত না করলে আল্লাহর ইবাদত কবুল হবে না। কারণ, আল্লাহ অনেক বিরাট ব্যাপার ও তিনি অনকে ঊর্ধ্বে রয়েছেন। তাঁর কাছে নৈকট্য প্রাপ্ত বুযুর্গদের ইবাদত করে তাদের মাধ্যমে সেখানে পৌঁছতে হবে। অংশীবাদীরা বলে, মৃত বুযুর্গরা সব শুনতে ও দেখতে পান এবং নিজ নিজ উপাসকদের কাজ দেখাশোনা করেন ও তাদের সাহায্য করেন। বস্তুতঃ তারা সে বুযুর্গদের পাথরের মূর্তি বানিয়ে নিয়েছে। তারপর সে মূর্তির সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে মূলত আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করত। পরবর্তী স্তরে যারা এল তারা সে বুতগুরোকেই আল্লাহ ভেবে প্রার্থনা জানাত এবং বুত ও আল্লাহর মাঝে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করত না।
তাই মুশরিকদের সতর্ক করতে গিয়ে আল্লাহ পাক কোথাও বলেছেন, রাষ্ট্র ও তার বিধি-বিধান একমাত্র আল্লাহর। কোথাও বলেছেন, এগুলো তো নিছক পাথর মাত্র। তারপর বলেছেন, তাদের কি পা আছে, যে চলবে, তাদের কি হাত আছে, যে ধরবে, তাদের কি চোখ আছে, যে দেখবে এবং তাদের কি কান আছে, যে শুনবে?
৩। নাসারাদের ধারণা, ঈসা মসীহ (আঃ) আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত সত্তা, তিনি অতি মানব। তাই তাঁকে বান্দা বলা যাবে না। তাহলে তিনি অন্যান্যদের পর্যায়ে নেমে যাবেন। সেটা হবে তাঁর বেআদবী ও তাঁর সাথে আল্লাহর ঘনিষ্ঠতার অবমূল্যায়ন। তাদের একদল তাঁকে এ বৈশিষ্ট্য প্রদান করল যে, তিনি আল্লাহর পুত্র। এ কারণে যে পিতা-পুত্রের ওপর সর্বাধিক সদয় থাকেন এবং নিজ তত্ত্বাবধানে তার শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করেন। পুত্রের মর্যাদা স্বভাবতঃই ভৃত্যদের ওপর। তাই তাঁর আল্লাহর পুত্রবৎ হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
তাদের একদল তো তাঁকে স্বয়ং আল্লাহই বানিয়ে ফেলেছে। কারণ, তিনি তো আল্লাহরই অংশ। তাই তাঁর ভেতর অপরিহার্য সত্তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাই তাঁর থেকে এমন সব কাজ প্রকাশ পেয়েছে, যা সাধারণ লোক থেকে প্রকাশ পেতে পারে না। যেমন, মৃতকে জীবিত করা ও মাটি দিয়ে পাখী বানিয়ে জীবে পরিণত করা। সুতরাং তাঁর বাণীই আল্লাহর বাণী ও তাঁর ইবাদত করাই আল্লাহর ইবাদত করা।
পরবর্তী স্তরের নাসারা সমাজ ঈসা মসীহকে আল্লাহর প্রকৃতি পুত্র বলে ঘোষণা করল। তাই আল্লাহ পাক এ ধারণা বাতিল করে কোথাও বলেন, পৃথিবী শূন্যাবস্থা থেকে সৃষ্টি করেন। তারপর বলেন, তিনিই একক সত্তা ও নির্দেশ শুধু তাঁরই চলে। যখন তিনি কিছু সৃষ্টি করতে চান, তখন বলেন “হয়ে যাও” অমনি হয়ে যায়।
বলাবাহুল্য, উপরোক্ত তিন সম্প্রদায়ে বহুবিধ ধ্যান-ধারণা ও অশোভন কথাবার্তা রয়েছে যা চিন্তাশীল গবেষকদের অজানা নয়। কুরআনে শেষোক্ত দু’দলের ওপর আলোচনা রয়েছে এবং তার সাথে অবিশ্বাসীদের সংশয়াদি নিরসন ঘটানো হয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ আটত্রিশ
শিরকের হাকীকত
স্মরণ রাখবে, ইবাদত বলতে পরম বিনয় ও কাকুতি-মিনতি বুঝায়। আর কারো সামনে বিনয়ী হওয়ার দুটো পদ্ধতি রয়েছে।
দুই-আন্তরিক বিনয় বা বিনয়ের নিয়তঃ যেমন, কেউ মনে-প্রাণে কারো জন্যে সম্ভ্রম বোধ সাঞ্চিত করল! এ বোধ থেকেই বান্দা তার প্রভুকে, প্রজা তার রাজাকে ও শিষ্য তার গুরুকে সম্মান দেখিয়ে থাকে।
বিনয় ও সম্ভ্রম দেখাবার তৃতীয় কোন পথ নাই। এক্ষণে ফেরেশতারা যে আদম (আঃ)-কে সিজদা করেছেন কিংবা ইউসুফ (আঃ)-কে যে তার ভায়েরা সিজদা করেছে তা ছিল সম্মান প্রদর্শনের সিজদা। যদিও তা সম্মান প্রদর্শনের সর্বোচ্চ রূপ, তথাপি তা যেহেতু ইবাদতের নিয়তে ছিল না, তাই তা ইবাদত নয়। এতেই জানা যায় যে, ইবাদতের বিষয়ে নিয়ত অপরিহার্য।
কথাটা আরও স্পষ্ট হওয়া দরকার। যেমন, প্রভু শব্দটি কয়েক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে যেখানে উপাস্য প্রভু বুঝবে সেখানে সিজদা দ্বারা ইবাদত বুঝাবে। এর ব্যাখ্যা এভাবে হবে যে, বিনয়ের দাবী হচ্ছে, বিনয় প্রকাশকের চেয়ে বিনয়প্রাপ্ত বড় ও সরল এবং বিনয় প্রকাশক অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ছোট। তাই সবল দুর্বলের কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের অধিকারী। মানুষ চিন্তা-ভাবনা করলে অবশ্যই দেখতে পাবে, তাদের ভেতরেও শক্তি, মর্যাদা, কর্তৃত্বের অস্তিত্ব রয়েছে। সেটাকেই বলা হয় কামালিয়াত তথা পরিপূর্ণতা। এটা দু’ধরনেরঃ একটি স্তর হল নিজের ও নিজের সমস্তরের! দ্বিতীয় স্তর হল হওয়া না হওয়ার যাবতীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে সত্তা। স্তরটিতে দ্বিতীয় স্তর থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য প্রদত্ত হয়ে থাকে।
ইলমে গায়েবের দু’টি স্তর।
একঃ স্বপ্ন কিংবা বিশেষ ব্যবস্থা বা সাধনার মাধ্যমে প্রাপ্ত ইলমে গায়েব।
দুইঃ –ইলহাম প্রাপ্ত ইলমে গায়েব। সেটা ব্যক্তিগত কামালিয়াতের মাধ্যমে সরাসরি বিনা চেষ্টায় পাওয়া যায়।
তেমনি প্রভাব সৃষ্টি, প্রশাসন ব্যবস্থা ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও দুটি স্তর থাকে। এক, অংগ-প্রত্যংগ ও বুদ্ধি-কৌশল খাটিয়ে তা অর্জন করতে হয়। তা আবার পরিবেশ ও পরিমণ্ডলগত অবস্থা কাজে লাগিয়ে তা করতে হয়। দুই, আপনা থেকেই কোন কিছুর সাহায্য ছাড়াই সরাসরি অর্জিত হয়। আল্লাহ পাকের নিম্নের বাণী তার প্রমাণঃ-
অর্থাৎ আল্লাহ যখন কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা করেন, তখন শুধু বলেন, “হয়ে যাও” অমনি হয়ে যায়।
তেমনি প্রভাব-প্রতিপত্তি, মর্যাদা ও ক্ষমতার দুটো স্তর রয়েছে। এক প্রজা-পুঞ্জের ওপর বাদশাহর প্রভাব-প্রতিপত্তি। কারণ, তার আমীর ওমারা, সেনা সামন্ত, ধন-সম্পদ প্রচুর থাকে। তেমনি দুর্বলের ওপর শক্তির প্রাধান্যের জন্য সবলের ও শিষ্যের ওপর জ্ঞানের প্রাধান্যের জন্য গুরুর প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখা দেয়। কারণ যাই হোক, প্রভাব-প্রতিপত্তির মূল রূপ সব ক্ষেত্রেই সমান! দুই-এ স্তরের শ্রেষ্ঠত্ব অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের হয়ে থাকে। এর রহস্য আপনাদের সামনে ততক্ষণ পর্যন্ত অনুদঘাটিত থাকবে, যতক্ষণ আপনাদের এ প্রত্যয় না হবে যে, সমস্ত নশ্বর বস্তুই এক অবিনশ্বর সত্তায় গিয়ে শেষ হয় এবং সেই অবিনশ্বর সত্তার অসীম প্রভাব-প্রতিপত্তির মৌল অংশটি তাঁর থাকে ও তাঁর নৈকট্যের প্রভাবে অপর নশ্বর সত্তাও প্রভাবশালী হয়। থাই যেসব শব্দ এরূপ হয় যা উভয়ের জন্যে প্রযুক্ত ও ব্যবহৃত হয়, তার তাৎপর্যও খুবই কাছাকাছি হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রটি খুবই সূক্ষ্ম ও নাজুক ক্ষেত্র। এখানেই পদস্খলনের ব্যাপারটি সর্বাধিক সংঘটিত হয়। অনেক সময় আল্লাহর রীতি-নীতির প্রয়োগ স্বাভাবিক ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে অস্বাভাবিক ক্ষেত্রে ঘটানো হয়। ফলে মানুষ তার স্বঝাতি কিংবা ফেরেশতা অথবা অন্য কোন সৃষ্টি হতে এমন কিছু প্রকাশ পেতে দেখে, যা তার সকল অনুভূতি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। এ থেকেই উক্ত ব্যক্তি বা সৃষ্টি তাদের ওপর খোদায়ী প্রভাব বিস্তার করে থাকে এবং তারা আল্লাহর কুদরত ও মানুষের প্রভাবের মধ্যে তারতম্য খুঁজে পায় না।
অবশ্য আল্লাহর কুদরত বুঝার শক্তি সকলের সমান নয়। কেউ নিজের অভ্যন্তরে সৃষ্ট নূরের বদৌলতে এ ধরনের ঐশী শক্তির ব্যাপকতা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিতে পারেন। অনেকের আবার সে ক্ষমতা থাকে না। তাই মানুষকে যার যার ক্ষমতা অনুসারে জবাবদিহি করা হবে এবং সে অনুসারেই প্রত্যেকের ওপর দায়িত্ব চাপানো হয়। নবী করীম (সঃ)-এর একটি বর্ণনায় এ ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। তিনি বলেন- “আল্লাহ পাক সেই লোকটিকে মুক্তি দিয়েছেন যে ব্যক্তি নিজ পরিবারবর্গকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, মৃত্যুর পর আমাকে জ্বালিয়ে ফেলবে ও আমার ছাই হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে। কারণ, তার ভয় ছিল যে, আল্লাহ তাকে আবার জীবিত করে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেবেন। সে আল্লাহর কুদরতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু তার ধারণা ছিল যে, তার সম্ভাব্য সকল ব্যাপারই রয়েছে বটে, তবে অসম্ভব ব্যাপারে তা নেই। তাই সে ভাবল, সর্বত্র বিক্ষিপ্ত ছাইগুলো জমা করে তাকে পুনরায় জীবিত করা এক অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, তার অর্ধেক দরিয়ায় ভাসানো হবে ও অর্ধেক হাওয়ায় উড়ানো হবে। তার এ অসম্পূর্ণ ধারণায় আল্লাহর অস্তিত্বের বিশ্বাসে কোন ক্ষতি দেখা দেয় না। তার জ্ঞান মোতাবেক সে আল্লাহর মর্যাদা দেয়ায় যে শিরক জন্ম নেয় সেটাই তাশবীহ। মানুষের ভেতর এটা পুরুষানুক্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে। প্রত্যেক নবীকেই এ সম্প্রদায়ের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং তাদের জন্য অপরিহার্য করে দেয়া হেয়ছে শিরকের আসল রূপ বুঝিয়ে দেয়া। তাদের কাজ ছিল কুদরত ও কারামতের মধ্যকার তারতম্য বুঝিয়ে দেয়া এবং মহান কুদরতের সম্পর্ক শুধুমাত্র আল্লাহ পাকের সাথে সংযুক্ত করা। অবশ্য দু’টো স্তরেরর পরিভাষার তাৎপর্যই খুব কাছাকাছি বটে। যেমন, রাসূল (সঃ) এক ডাক্তারকে বললেন; তুমি তো শুধুমাত্র চিকিৎসক, নিরাময়কারী তো স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা! তিনি আরও বলেনঃ সর্দার তো কেবল আল্লাহ পাক। হাদীসের এ দু’জায়গায় তিনি পরিভাষাদ্বয়ের মূল অর্থ গ্রহণ করেছেন।
অতঃপর যখন রাসূলের (সঃ) সহচর দ্বীনের ধারক-বাহকগণ বিদায় নিলেন এবং তারপর সে সব লোকের আগমন ঘটল যারা নামাজ তরক করল ও বাসনা-কামনা চরিতার্থের পেছনে লেগে গেল, তারা এ ধরনের দ্ব্যর্থবোধক পরিভাষা ব্যবহার করল, যেমন আল্লাহ পাক তাঁর বিধানে তাঁর বন্ধুত্ব ও শিক্ষা খাতকে খাস বান্দাদের ভেতরে সীমিত করে দিয়েছেন। কিন্তু এসব লোক তা যত্রতত্র ব্যবহার করে গেছে। যেমন অলৌকিক ঘটনা। কাশফ ও তাজাল্লীর ক্ষমতা তারই ভাবা হয় যার থেকে তা প্রকাশ পায়। সে অসাধারণ জ্ঞান ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে গেছে। অথব সত্য ও সঠিক এই যে, এ সবকিছুরই উৎস হল আত্মিক শক্তি ও সে সব সাধনা লব্ধ আধ্যাত্মিক ঐশী কুদরতের নগণ্য প্রতিফলন মাত্র। এটা কোন সৃষ্টির নিজস্ব কৃতিত্ব নয়। তাছাড়া আল্লাহ পাকের খাস কুদরতের সাথে এর সম্পর্ক নেই।
শিরক কয়েক প্রকারের। একদল মুশরিক তো আল্লাহ পাককে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে গায়রুল্লাহকে উপাসনা করে ও তাদের সামনে সব কিছু প্রার্থনা করে। তারা আল্লাহকে নিয়ে আদৌ ভাবে না। অথচ তারাও যুক্তি-বুদ্ধি ও দলীল-প্রমাণ দ্বারা বুঝতে পারে যে, সব কিছুই আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে!
অপর দলের বিশ্বাস, আল্লাহই মূল কর্তা ও সকল কার্যকারণের উৎস। কিন্তু কখনও তিনি কোন বান্দাকে মর্যাদা ও কর্তৃত্ব দান করেন এবং তার ওপর বিশেষ বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। এমনকি বান্দাদের ব্যাপারে আল্লাহর দরবারে তার সুপারিশ কবুল হয়। যেমন, কোন শাহানশাহ বিভিন্ন এলাকায় একেকজন শাসক পাঠিয়ে কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্ণ দায়িত্ব তাদের অর্পণ করেন, এও ঠিক তেমনি ব্যাপার। তাই এ ধরনের লোককে তারা আল্লাহর বান্দা বলতেও সাহসী হয় না। তাহলে সে হয়ত অন্যান্যদের পর্যায়ে থেকে যাবে। তাই তারা তাকে আল্লাহর পুত্র ও তার বন্ধু বলে আখ্যায়িত করে থাকে এবং নিজের নামের মাধ্যমে নিজকে তার বান্দা বলে প্রকাশ করে। যেমন, আবদুল মসীহ, আবদুল উম্মা ইত্যাদি। এ ধরনের শিরকে ইয়াহুদী, নাসারা ও মুশরিকরা সবাই একাকার। এমনকি এ যুগে আমাদের মুসলমানদের ভেতরেও এ ধরনের বাড়াবাড়ি ও মুনাফিকী দেখা দিয়েছে।
যেহেতু শরীয়তের বুনিয়াদী কথাই হচ্ছে আসল শিরকের মতই শিরকের আশংকাযুক্ত কাজও সমান পরিত্যাজা, তাই সেসব ব্যাপারকেও কুফর বলা হয়েছে, যাতে শিরকের সম্ভাবনা থাকে। যেমন, প্রতিমাকে সিজদা দেয়া, তার নামে উৎসর্গ করা, তার নামে শপথ নেয়া ইত্যাদি। এই ইলম আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে তখনই যখন আমার সামনে এমন একটা সম্প্রদায় হাজির হল যারা ক্ষুদ্র এক বিষাক্ত মৌমাছিকে সিজদা করত এবং সেটা সর্বদা নিশ্বাস নিত ও পাখা-পা দোলাতে থাকত। তখন আমার অন্তর বলে উঠল, তুমি কি এর ভেতর শিরকের আঁধার দেখতে পাচ্ছ? আমি বললাম, আমি তো এর ভেতর শিরকের আঁধার দেখতে পাচ্ছি না। কারণ, মক্ষিকাকে সে শুধু সিজদার কিবলা স্থির করেছে, কিন্তু বিনয়ের সাথে সে মর্যাদাকে মিলায়নি। অমনি আওয়াজ এল, তুমি রহস্যের দ্বারোদঘাটন করেছ। ঠিকসেই মুহুর্ত থেকে আমার অন্তর তওহীদের জ্ঞানে পরিপূর্ণ হল। এ ক্ষেত্রে আমার দূরদৃষ্টি অর্জিত হল যে, তওহীদ ও শিরককে শরীয়ত ও ঈমানের ভিত বলে নির্ধারণ করেছে তা ভালোভাবেই জানতে পেলাম। আর ইবাদতের সাথে কাজের কি সম্পর্ক তাও বুঝতে পেলাম। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।