রূপালি চাঁদ রাখাল রাজা
ছেলেটি ছায়ার মত শান্ত।
শান্ত এবং স্থির।
সরলতাটুকু জোছনার মত লেপ্টে থাকে তার সমস্ত চেহারায়।
সরল। কিন্তু আবার চরিত্রের দিক দিয়ে উহুদ পর্বতেরমত দৃঢ়। এতটুকুও টলে না তার হৃদয়। টলে না কোনো মোহে কিংবা স্বার্থের হাতছানিতে।
চোখ দুটো হরিণের চোখের মত তীক্ষ্ণ। ভঅলো-মন্দের পার্থক্যটা ততোদিনে বুঝে গেছেন আলো আঁধারের মত। আর আমানতের দিক থেকে সে আবার এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
খুব কম বয়স।
বয়সে কিশোর তবু বিবেকের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ কয়ার মত ভরপুর।
উকাবার ছাগল চরান কিশোরটি।
ছাগলের পাল নিয়ে তিন বেরিয়ে যান ভোর-সকালে।
সারাটি দিন কেটে যায় তার মাথার উপর দিয়ে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালু, পাথরের নুড়ি আর মরুঝড়ের সাথে তার বন্ধুত্ব। আর ভঅলোবাসা যত, সে কেবল উকাবার আমানত- ছাগলের পাল।
আজও ছাগল চরাচ্ছেন তিনি।
পশুগুলো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে তাদের ক্ষুধার খাদ্য। আর পরিতৃপ্তির সাথে সেই দিকে তাকিয়ে আছেন কিশোর বালক। ভাবছেন, আহ কী চমৎকার দৃশ্য!
এই মরুভূমিতেও কোন্ সেই মহান স্রষ্টা আহার্ রেখে দিয়েছেন এইসব অবুঝ প্রাণীর জন্য?
ভাবছেন আর মাঝে মাঝে ুদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন ধু-ধু মরুভূীম, দিগন্ত বালিরেখা, আর বৃষ্টিহীন, মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশ।
দূর থেকে, বহু দূর থেকে কারা যেন এগিয়ে আসছেন তার দিকে।
খুব ভঅলেঅ করে দেখা যাচ্ছে না তাদের চেহারা।
কারা আসছেন গনগনে বালির তরঙ্গ ভেঙে।
খুব উৎসাহের সাথে সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় আছেন কিশোর বালক।
অপেক্ষার পালা শেষ।
ধুলো উড়িয়ে এক সময় তার খুব কাছাকাছি চলে এলেন দু’জন আগন্তুক।
তাঁদের চেহারায় রয়ে গেছে আত্মমর্যাদার গোলাপি শোভা।
কিন্তু বোঝাই যায়, তারা বড় ক্লান্ত। ক্লান্ত এবং পিপাসার্ত।
সন্দেহ নেই, তারা এসেছেন বহু কষ্টের মরুপথ পাড়ি দিয়ে।
তাদের ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কণ্ঠও চুপসে গেছে শুকনো বেলুনের মত।
খুব কষ্টে কেবল উচ্চারণ করলেন:
আমরা তৃষ্ণার্ত। পিপাসায় কলিজাটা শুকিয়ে গেছে। আর পারছি না। তুমি কি আমাদেরকে একটু সাহায্য করবে?
-কিভাবে? কিশোর জিজ্ঞেস করলেন।
-কেন, তোমার এই ছাগলের পাল থেকে কিছু দুধ দুইয়ে আমাদেরকে পান করতে দাও।দেখছি তো, কত ছাগীর ওলান ভরে আছে দুধে। তা থেকে কিছুটা দিলেই আমরা আমাদের কষ্টদায়ক পিপাসা মেটাতে পারি।
-অসম্ভব! এটা কিছুতেই সম্ভব নয় হে সম্মানিত মেহমানবৃন্দ! আপনাদের কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। এই দুঃসময়ে আপনাদের খেদমত করতে পারলে আমি নিজেকেও ধন্য মনে করতাম। কিন্তু সেটা যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়! আমি তো নিজেই নিতান্ত নিরুপায়।
-নিরুপায়! তার মানে? এই তো কত ছাগল চরে বেড়াচ্ছে আমাদের সামনে।তবু তুমি এমন কথা বলছো কেন?
-বলছি এই কারণে যে, এই ছাগলগুলোর একটিও আমার নয়। আমি এগুলোর রাখাল। এর আমানতদার মাত্র। আর এজন্যই আমার পক্ষে সম্ভব নয়, সম্ভব নয় মালিকের হুকুম ছাড়া কোনো ছাগীর বাট থেকে দুধ দুইয়ে আনাদের পিপাসা মেটানো।
কিশোরটির কথায় এতটুকুও রেগে গেলেন না তাঁরা। বরং কী এক আনন্দ আর খুশির রেখা ফুটে উঠলো তাঁদের চোখে-মুখে।
দু’জনের মধ্যেই একটি অবাক বিস্ময় আর কৌতুহল কেবলই দুলে দুলে উঠছে।
খুব ভালো করে তাকালেন কিশোরটির দিকে। দেখলে বয়সে ছোট হলেও দীপ্তি ঝলমলছেলেটির অন্য এক সুদৃঢ় অবয়ব। মরুর রুক্ষ লুহাওয়ার সাধ্য নেই কিশোরটির মুখ থেকে সেই দীপ্তির ঝলক কেড়ে নেবার।
দারুণ খুশি হলেন তাঁরা।
কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন রাখালটির দিকে। তারপর তাদের থেকে একজন হেসে বললেন:
-ঠিক আছে। যেসব ছাগীর বাটে দুধ আছে, সেগুলোর তো তুমিই আমানতদার। কিন্তু যে ছাগীর বাটে এখনও দুধ আসেনি, সেগুলো?
-সেগুলো? অবাক কণ্ঠে রাখালের। যে ছাগীর এখনও বাচ্চাই হয়নি তার বাটে দুধ আসবে কী করে? আর এমন ছাগী দিয়েই বা কী হবে?
আবারও হাসলেন তিনি। বললেন:
-হ্যা, সেই রকম একটি ছোট ছাগী হলেই চলবে। যার এখনও বাচ্চাই হয়নি।
তাঁর কথার মধ্যে এমন এক ধরনের আকর্ষণ ও মাধুর্য ছিল, যা কেবল শুনতেই ইচ্ছা করে।
তাঁর মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিশোর রাখাল। যতই দেখেন, ততোই মুগ্ধ হন।
-কী হলো, দেবে? একটি ছোট ছাগী দিলেই হবে।
তাঁর এই উচ্চারণে রাখাল ইশারা করলেন সামনের দিকে।
রাখঅলের অনুমতি পেয়ে বিশাল পাল থেকে তিনি ধরে আনলেন তেমনি একটি ছোট ছাগী, যার এখনও বাচ্চা হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়।
এবার রাখালের কেবল দেখার পালা। তিনি কী করেন এই ছাগীটি নিয়ে।
কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন সেই অবাক পুরুষটির দিকে।
আর তিনি, সেই অবাক পুরুষ- ছোট্ট ছাগীটির বাটে হাত রেখে উচ্চারণ করলেন:
‘বিসমিল্লাহহির রাহমানির রাহিম।’
আর কী আশ্চর্য!
তাঁর হাতের স্পর্শেই সাথে সাথে দুধে ফুলে উঠলো সেই ছোট্ট ছাগীটির বাট।
নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না রাখাল।
ভাবছেন, এও কি সম্ভব? এই ছোট্ট ছাগী, যার কোনো বাচ্চাই হয়নি, তার বাটে দুধ? কী করে বিশ্বাস করা যায়?
বিশ্বাস না করেও তো উপায় নেই। কারণ সত্যটা যে সামনেই। শুধু সামনেই নয়, নিজের হাতের নাগালে। এমন সত্য অস্বীকার করবে কে? সেই এক অবাক পুরুষ!
তিনি ছাগীটির বাটে হাত রাখছেন আর ঝর্ণনাধারার মত ঝরঝরে করে গড়িয়ে পড়ছে কেবল ধবধবে সাদা সুস্বাদু ঘন দুধ।
দ্বিতীয়জন একটি পাত্র ধরে আছেন বাটের নিচে।
দুধ ঝরছে একাধারে।
ঝরতে ঝরতে মুহূর্তেই ভরে উঠলো পাত্রটি।
প্রথমে তাঁরা দু’জনই তৃপ্তিসহকারে, যতটুকু প্রয়োজন ছিল, ততোটুকু পান করলেন। তারপর সেই দুধ পানের জন্য আহবান জানালেন রাখালটিকে।
তাঁর আহবানে রাখালও পান করলেন সেউ দুধ পেট ভরে।
পান করলেন বটে, কিন্তু তার সারা শরীরে তখনও পিল পিল করে হেঁটে যাচ্ছে বিস্ময়ের পিঁপড়ার ঝাঁক। ভাবছেন, এটা কিভাবে সম্ভব!
সবাই যখন দুধপানে পরিতৃপ্ত, তখন সেই জ্যোতির্ময়ী পুরুষ- এবার তিনি সেই ছাগীর বাট লক্ষ্য করে বললেন: ‘চুপসে যাও।’
এবং বিস্ময়ের ব্যাপার।
এই কথার সাথে সাথেই ছাগীর বাটটি আবার আগেরমত চুপসে গেল।
রাখালটি তাঁকে অনুরোধ করলেন:
আপনি যে কথাগুলি উচ্চারণ করলেণ, তা কি আমাকে শিখিয়ে দেবেন?
‘তুমি তো শিক্ষাপ্রাপ্ত বালক।’
শিক্ষাপ্রাপ্ত বালক?
চমকে উঠলেন রাখাল।
তার বিস্ময়ের চমকে আলোকিত হয়ে উঠলো চারপাশ।
কেনই বা হবে না!
যিনি তাকে এই সার্টিফিকেট দিলেন, তিনি তো আর কেউ নন- স্বয়ং রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সাথে যিনি আছেন তিনি হযরত আবু বকর। আর যার সম্পর্কে রাসূল (সা) এই কথাটি উচ্চারণ করলেন- তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ।
ইসলামের প্রথম দিক।
কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাসূল (সা)। তাই হযরত আবু বকরকে (রা) সাথে নিয়ে কুরাইশদের অত্যাচার আর উৎপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার জন্য নির্জন গিরিপথে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি।
এইভাবেই আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ দেখা পেলেন রাসুলের (সা)।
রাসূল (সা) এবং আবু বকরকে (রা) দেখা মাত্রই খুব ভাল লেগে গেল তার।
আবার তাকে দেখামাত্রই রাসূলেও (সা) ভালো লাগলো। তিনি মুগ্ধ হলেন এমন একটি কিশোর রাখালের সততা, নিষ্ঠা এবং আমানতদারিতে।
সেইতো শুরু।
তারপরই ইসলাম গ্রহণ করলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ। আর কালে কালে তিনিই তো হয়ে উঠলেন রাসূলের পরশে এক আলোকি সোনার মানু।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ছিলেন একজন রাখাল।
ইসলাম গ্রহণের পর, সেই কিশোর বয়সেই তিনি এবার নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন ইসলামের খেদমতে, রাসূলের (সা) কাছে।
রাসূলও (সা) তাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করলেন খাদেম হিসেবে।
সেইদিন থেকে এই সৌভাগ্যবান শিক্ষাপ্রাপ্ত বালকটি ছাগলের রাখাল থেকে পরিণত হলেন সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠতম রাসূলের (সা) খাদেম।
রাসূলের (সা) খেদমতের জন্য আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাঁর সাথে থাকতেন ছায়ার মত।
রাসূলের (সা) সফরে, ইকামতে, বাড়ির ভেতরে, বা বাইরে- সকল সময় তিনি রাসূলের (সা) সাথে থাকতেন। রাসূল (সা) ঘুময়ে গেলে সময় মত জাগিয়ে দিতেন। তাঁর গোসলের সময় পর্দা করতেন। বাইরে যাবার সময় জুতা পরিয়ে দিতেন। আবার ঘরে ফিরলে জুতা খুলে দিতেন। রাসূলের (সা) মেসওয়াক এবং লাঠিও তিনি বহন করতেন।
রাসূল (সা) যখন একান্তে বিশ্রাম করতেন, তখনও তিনি সেখানে যাতায়াত করতেন।
রাসূল এ ধরনের অবাধ যাতায়াতের অধিকারও দিয়েছিলেন তাকে।
রাসূলের (সা) সংস্পর্শে থাকার কারণে এবং নবীর (সা) গৃহে প্রতিপালিত হবার কারণে তিনি নবীর (সা) শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। নবীর (সা) আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-এসবই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ খোদ রাসূলের (সা) শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। এ কারণে তাকে বলা হতো:
হিদায়াতপ্রাপ্ত, আচার-আচরণ ও চারিত্রিক বেশিষ্ট্যের দিকে দিয়ে তিনিই হচ্ছেন রাসূলের (সা) নিকটতম ব্যক্তি।
রাসূলের (সা) সাহাবীদের মধ্যে কুরআনের যারা সবচেয়ে ভালো পাঠক, তার ভাব ও অর্থের সবচেয়ে বেশি সমঝদার এবং আল্লাহর আইন ও বিধি-বিধানের সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ, তিনি ছিলেন তাদের একজন, অন্যতম।
রাসূল (সা) নিজেই বলতেন:
যে ব্যক্তি বিশুদ্ধভাবে কুরআন পাঠ করে আনন্দ পেতে চায়, যেমন তা অবতীর্ণ হয়েছে- সে যেন ইবন উম্মুল আবদের [আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ] পাঠের অনসরণে পাঠ করে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদও বলতেন:
যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, সেই আল্লাহর কসম! আল্লাহর কিতাবের এমন কোনো একটি আয়াতও নাজিল হয়নি যে সম্পর্কে আমি জানি না যে, তা কোথায় নাজিল হয়েছে এবং কী সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে আমার থেকে অধিক পারদর্শী কোনো ব্যক্তির কথা আমি যদি জানতে পারি এবং তার কাছে পৌঁছা সম্ভব হয়, তাহলে আমি তার কাছে উপস্থিত হই।
এই আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদই আবার সাহসের দিক থেকে ছিলেন অসাধারণ। রাসূলের (সা) সাহাবীরা একদিন মক্কায় একত্রিত হলেন। তারা সংখ্যায় খুবই অল্প। নিজেরা বলাবলি করছেন, আল্লাহর শপথ। প্রকাশ্যে কুরআন তিলাওয়াত করে কুরাইশদেরকে কখনও শুনো হয়নি। তাদেরকে কুরআন শোনাতে পারে এমন কে আছে?
তাদের মধ্য থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন একজন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ। বললেন, আমি-আমিই কুরাইশদেরকে কুরআন শোনাতে চাই।
-তুমি? তোমার ব্যাপারে আমাদের ভয় হচ্ছে। যদি ওরা তোমাকে শাস্তি দেয়? আমরা এমন একজনকে চাইছি, যার লোকজন আছে, যার ওপর কুরাইশরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না।
-না, আমাকেই অনুমতি দিন। আল্লাহ আমাকে হিফাজত করবেন। একথা বলে তিনি মাকামে ইবরাহীমের কাছে দাঁড়িয়ে জোরো জোরো তিলাওয়াত শুরু করলেন:
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আররাহমান আল্লামাল কুরআন, খালাকাল ইনসানা আল্লামা হুল বায়ান।’……
থমকে গেল কুরাইশরা।
একি! এ যে মুহাম্মাদ যা পাঠ করে, তাই!
কুরাইশরা মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর। তারপর তার মুখের ওপর আঘাত করতে শুরু করলো। সে কী মার!
রক্তাক্ত হয়ে ফিরে এলেন তিনি সঙ্গীদের মাঝে।
সঙ্গীরা বললেন, আমরা এটাই আশঙ্কা করেছিলাম।
সহজ ভঙ্গিতে জবাব দিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ:
আল্লাহর কসম! আল্লাহর শত্রুরা এখন আমার কাছে আজ এত তুচ্ছ, যা আগে ছিল না। আপনারা চাইলে আমি আগামী কালও এমনটি করতে পারি।
-না, তার আর দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে। তাদের অপছন্দনীয় কথা এই প্রথম তুমিই তাদেরকে শুনিয়েছে।
শুধু একবার নয়। এভাবে বহুবারই তিনি কুরাইশদের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। হয়েছেন রক্তাক্ত এবং ক্ষত-বিক্ষত।
কিন্তু না, এতটুকুও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। কিংবা এতটুকু চিড় ধরেনি তার সাহসে।
বরং বাধা এবং অত্যাচার যিই কঠিন হয়েছে, ততোই দৃঢ় হয়েছে তার সাহস আর ঈমানের শক্তি।
রাসূলে (সা) সাথে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধেই অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এবং অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন।
হুনাইনের যুদ্ধের সময়।
কাফিরদের অতর্কিত আক্রমণে মুসলিম বাহিনীর দশ হাজার সৈন্য বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
মাত্র আশিজন যোদ্ধা জীবনবাজি রেখে রাসূলকে (সা) ঘিরে রাখেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। এই যুদ্ধে রাসূল যে একমুঠো ধূলি নিয়ে নিক্ষেপ করেন কাফিরদের দিকে, সেউ ধূলি রাসূলের (সা) হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই দুঃসাহসী যোদ্ধা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ।
কী অসাধারণ এক সৌভাগ্যবান পুরুষ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ!
বৈরী বাতাসে সাঁতার
দু’জনেই বেড়ে উঠছেন একই সাথে।
দু’জনের বয়স প্রায় একই।
তবুও একজন চলেছেন আলোকিত সূর্যের পথে।
আর অপর জনের পথটি ভয়ানক পিচ্ছিল্ চারপাশ থকথক করছে এক দুর্বিসহ গাঢ় অন্ধকার।
দু’জন পরম আত্মীয়।
সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা।
কিন্তু তখনও দু’জনের পথ বয়ে গেছে দুই দিকে। একজন- প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)।
আর অপরজন- আব্বাস ইবনুল মুত্তালিব।
ইসলামের দাওয়াত তখন চলছে প্রকাশ্যভাবে।
রাসূল (সা) সবাইকে ডাকছেন- আল্লাহর পথে। ইসলামের পথে। সত্যের পথে।
তাঁর আহবানে একে একে ভারী হয়ে উঠছে মুসলমানদের সংখ্যা।
অন্ধকার থেকে ফিরে আসছে তারা আলোর পথে। বুকটা জুড়িয়ে নিচ্ছে ঈমানের শীতল পানিতে।
আহ্ কী আরাম!
বহুকালের তৃষিত হৃদয় তাদের মুহূর্তেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
চাচা আব্বাস।–
তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন ভাতিজা মুহাম্মদকে (সা)।
কিন্তু তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই বলে মক্কার অন্যান্য হিংস্রদের মত তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়েও আসেননি। কোনোদিন বার করেননি তার ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের নখর।
আশর্যের কথাই বটে!
নিজে ইসলাম গ্রহণ না করেও তিনি সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন রাসূলকে (সা)।
বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন ইসলামের দাওয়াত চারপাশে ছড়িয়ে দেবার জন্য।
তার সাহায্য-সহযোগিতার সেই দৃষ্টান্তও ছিল বিস্ময়কর।
হজ্বের মৌসুম।
মদীনা থেকে বাহাত্তর জন আনসার মক্কায় এলেন। তারা একত্রিত হয়েছেন মিনার একটি গোপন শিবিরে।
সবাই রাসূলের (সা) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে আহ্বান জানালেন:
হে দয়ার নবীজী! মক্কাবাসীরা আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। চলুন, আপনি আমাদের সাথে মদীনায় চলুন। আমরা আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি।
আব্বাস তখনও মুসলমান হননি।
কিন্তু অবাক কাণ্ড!
তিনিও উপস্থিত ছিলেন এই গোপন শিবিরে।
আনসারদের আহ্বান খুব মন দিয়ে শুনরেন আব্বাস। তারপর তাদেরকে বললেন:
“হে খাযরাজ কওমের লোকেরা!
আপনাদের জানা আছে, মুহাম্মদ (সা) স্বীয় গোত্রের মধ্যে সম্মান ও মর্যাদার সাথেই আছেন। শত্রুর মুকাবেলায় সর্বক্ষণ নামরা তাঁকে হেফাজত করেছি। এখন তিনি আপনাদের কাছে যেতে চান। যদি আপনারা জীবনবাজি রেখে তাঁকে সহায়তা করতে পারেন তাহলে খুবই ভাল কথা অন্যধায় এখনই সাফ সাফ বলে দিন।”
থামলেন আব্বাস।
তার কথাটা গুরুত্বের সাথে ভাবলেন তারা। তারপর বললেন, হ্যাঁ! আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিচ্ছি। রাসূল (সা) আমাদের কাছে পূর্ণ হিফাজতেই থাকবেন। আমরা তো আছিই তাঁর চারপাশে।
তাদের আশ্বাসের মধ্যে ছিল না কোনো খাঁদ। ছিল না কোনো ফঅঁকি বা চালাকিও।
এর কিছুদিন পরই নবী (সা) হিজরতের অনুমতি পেলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে। দয়ার নবীজী মক্কা ছেড়ে চলে গেলেন মদীনায়।
নবীজী মদীনায় আছেন।
ইতোমধ্যে বদর যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে।
আব্বাস তখন মক্কায়।
কী নির্মম পরিহাস!
মক্কার কুরাইশদের অবর্ণনীয় চাপের মুখে আব্বাসকেও রাসূলের (সা) প্রতিপক্ষ লড়াই করতে যেতে হলো বদর প্রান্তরে।
কী নিষ্ঠুর দৃশ্য!
প্রাণপ্রিয় ভাতিজার বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতে হচ্ছে চাচা আব্বাসকে!
কিছুতেই তিনি এটা মেনে নিতে পারছেন না।
পরিস্থিতি এমনই যে তিনি অন্য কিছু করতেও পারছেন না। সেই এক কঠিনতম অবস্থা!
বদর মানেই তো কঠিন পরীক্ষার ক্ষেত্র।
যুদ্ধ চলছে তুমুল গতিতে।
যুদ্ধ চলছে মুসলিম আর মুশরিকদের মধ্যে।
কিন্তু আল্লাহর রহমতে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে বিজয়ী হলেন- সত্যের সৈনিক মুসলিম বাহিনী।
বদরে মুশরিকের সাথে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আব্বাস কেন যোগ দিয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণ জানতেন দয়ার নবীজী। এজন্য তিনি আগেই বলে রেখেছিলেণ তাঁর সাথীদেরকে- “যুদ্ধের সময় আব্বাস বা বনু হাশিমের কেউ সামনে পড়লে তাদেরকে হত্যা করবে না।’ কারণ, জোরপূর্বক তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনা হয়েছে।”
যুদ্ধ শেষ।
মুসলমানদের হাতে বন্দী হলেণ মুশরিকদের সাথে আব্বাস, আকীল ও নাওফিল ইবনে হারিস।
নিয়ম অনুযায়ী সকল বন্দীকেই বেঁধে রাখা হয়েছে। তার ভেতরে আছেন আব্বাসও।
কিন্তু অন্যদের চেয়ে আব্বাসের বাঁধনটি ছিল অনেক বেশি শক্ত। এত শক্তভাবে তাকে বাঁধা হয়েছিল যে তিনি বেদনায় কেবলই কঁকিয়ে উঠছিলেন।
রাতে ঘুমিয়ে আছেন নবী মুহাম্মদ (সা)!
হঠাৎ এক কাতর কণ্ঠের আর্তচিৎকারে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
সাহাবারা রাসূলের (সা) ঘুমের ব্যাঘাতের কথা ভেবে আব্বাসের বাঁধনটা ঢিলা করে দিলেন।
থেমে গেল তার যন্ত্রণাদায়ক কঁকানি।
রাসুল জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপর! আর কোনো কাতর কণ্ঠস্বর শুনছি না কেন?
তারা বললেন, বাঁধন ঢিলা করে দিয়েছি।
রাসূল (সা) সাথে সাথে নির্দেশ দিলেন: “সকল বন্দীর বাঁধনই ঢিলা করে দাও।”
ইনসাফ আর ইহসান কাকে চলে? রাসূলই (সা) তার উত্তম নিদর্শন।
বদর যুদ্ধে বন্দীদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত হলো।
আব্বাসের আম্বা ছিলেন মদীনার আনসার গোত্র খাযরাজের কন্যা। এই কারণে খাযরাজ গোত্রের সবাই রাসূলের (সা) কাছে অনুরোধ করলো:
“আব্বাস তো আমাদেরই ভাগ্নে। আমরা তার মুক্তিপণ মাফ করে দিচ্ছি।”
তাদের প্রস্তাব একবাক্যে নাকচ করে দিলেন রাসুল। বললেন, না! তা কখনই হতে পারে না। কারণ এটা সাম্যের খেলাফ। বরং তিনি আব্বাসে মুক্তিপণের পরিমাণটা একটু বেশিই করে দিলেন। কারণ তিনি জানতেন, সেই অর্থ পরিশোধ করার ক্ষমতা তার আছে।
এত অর্থ?
বিস্মিত হয়ে আব্বাস অনুনয়-বিনয়ের সাথে তার অক্ষমতা প্রকাশ করলেন, “আমি তো অন্তর থেকে আগেই মুসলমান হয়েছিলাম। মুশরিকরা আমাকে বাধ্য করেছে এই যুদ্ধে অংশ নিতে।”
আব্বাসের কথা শুনে রাসুল (সা) বলরেণ:
“অন্তরের অবস্থা আল্লাহপাকই ভাল জানেন। আপনার দাবি সত্য হলে আল্লাহই তার প্রতিদান দেবেন। তবে বাহ্যিক অবস্থার বিচারে আপনাকে কোনো প্রকার সুবিধা দেয়া যাবে না। আর মুক্তিপণ আদায়ে আপনার অক্ষমতাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আমি জানি মক্কার উম্মুল ফজলের কাছে আপনি মোটা অংকের অর্থ রেখে এসেছেন।”
রাসূলের একথা শুনে আব্বাস বিস্ময়ের সাথে বললেন, “আল্লহর কসম! আমি ও উম্মুল ফজল ছাড়া আর কেউ এই অর্থের কথা জানে না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, আপনি আল্লাহর রাসূল।”
সত্যি সত্য্ তিনি নিজের, ভাতুষউত্র আকীল এবং নাওফিল ইবনে হারিসের পক্ষ থেকে মোটা অংকের মক্তিপণ আদায় করে বন্দিদগশা থেকে মুক্তি লাভ করলেন।
মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে হযরত আব্বাস সপরিবারে মদীনায় হিজরত করলেন।
রাসূলের (সা) খেদমতে হাজির হয়ে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের ঘোষণা দিলেন। সেই সাথে তিনি মদীনায় স্থায়ীভাবে বসবাসও শুরু করলেন।
হযরত আব্বাস।–
সেই আব্বাস এখন বদলে গেছেন সম্পূর্ণ।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার পুরো জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছেন ইসলামের খেদমতে।
মক্কা বিজয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।
হুনাইনের অভিযানে রাসূলের (সা) সাথে একই বাহনে আরোহী ছিলেন তিনি।
কী বৌভাগ্য তার!
বাহনের পিঠে বসেই তিনি বললেন:
“এ যুদ্ধে কাফেরদের জয় হলো এবং মুসলিম মুজাহিদরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো।”
রাসূল (সা) বললেন: “আব্বাস! তীরন্দাজদের আওয়াজ দাও।”
আব্বাস আওয়াজ দিলেন জোর গলায়: ‘তীরন্দাজরা কোথায়?’…
কী আশ্চর্য!
আব্বাসের এই তীব্র আওয়াজের সাথে সাথেই ঘুরে গেল যুদ্ধের মোড়।
শুধু হুনাইন নয়।
তায়েফ অবরোধ, তাবুক অভিযান এবং বিদায় হজেও অংশ নিয়েছিলেন দুঃসাহসী আব্বাস।
দুঃসাহসী, কিন্তু তিনিই আবা সত্যের পক্ষে কোমল। কোমল এবং বিনয়ী। আব্বাস ছিলেন অত্যন্ত দানশীল, অতিথিপরায়ংণ ও দয়ালু এক অসামান্য সোনার মানুষ।
তার সম্পর্কে হযরত দা’দও বলেছৈন:
“আব্বাস হলেন আল্লাহর রাসূলের চাচা, কুরাইশদের মধ্যে সর্বাধিক দরাজ দিল এবং আত্ময়িস্বজনের প্রতি অধিক মনোযোগী। তিনি ছিলেন কোমল অন্তরবিশিষ্ট। দুআর জন্য হাত উঠালেই তার দুই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তো কেবল অশ্রুর বন্যা। এই কারণে তার দুআর একটি বিশেষ আছরও লক্ষ্য করা যেত।”
আর মর্যাদার দিকে দিয়ে?
মর্যাদার দিক দিয়ে আব্বাস ছিলেন অসাধারণ।
স্বয়ং রাসূলে কারীমও চাচা আব্বাসকে খুব সম্মান করতেন। তার সামান্য কষ্টকেও দুঃখ পেতেন দয়ার নবীজী (সা)।
একবার কুরাইশদের একটি রূঢ় আচরণ সম্পর্কে রাসূলের কাছে আব্বাস অভিযোগ করলে রাসূল ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন:
“সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন! যে ব্যীক্ত আল্লাহ ও রাসূলের জন্য আপনাদের ভালোবাসেন না, তার অন্তরে ঈমানের নূর থাকবে না।”
হযরত আব্বাসকে এমনই ভালোবাসতেন আর শ্রদ্ধা করতেন রাসল (সা)। কী অতুলনীয় রাসূলের সেই ভালোবাসা আর সম্মানের নিদর্শন!
একবার রাসুল (সা) একটি বৈঠকে কথা বলছেন হযরত আবু বকর এবং উমরের (রা) সাথে।
এমন সময় সেখান উপস্থিত হলেন হযরত আব্বাস।
চাচাকে দেখেই রাসূল (সা) তাকে নিজের ও আবু বকরের মাঝখানে বসালেন। আর তখনই রাসুল (সা) তাঁর কণ্ঠস্বর একটু নিচু করে কথা বলা শুরু করলেন।
আব্বাস চলে গেলেন।
আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, “হে রাসূল! এমনটি করলেন কেন?”
রাসূল (সা) বললেন:
জিব্রাঈল আমাকে বলেছেন, “আব্বাস উপস্থিত হলে আমি যেন আমার কণ্ঠস্বর নিচু করে, যেমন আমার সামনে তোমাদের কণ্ঠস্বর নিচু করার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন।”
রাসূলে কারীমের (সা) পর, পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেধীন ও হযরত আব্বাসের মর্যাদা এবং সম্মানের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক।
হযরত উমর এবং হযরত উসমান (রা) ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার সম্মানার্থে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তেন। বলতেন, “ইনি হচ্ছেন রাসূলের (সা) চাচা।”
হযরত আবু বকর একমাত্র আব্বাসকেই নিজের আসন থেকে সরে গিয়ে স্থান করে দিতেন।
হযরত আব্বাস!-
সাগর সমান এই মর্যাদা আর সম্মান কি তার এমনিতেই এসেছে?
এই মর্যাদা অর্জন করতে গিয়ে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ঈমানের বিশাল দরিয়া। আর টপকাতে হয়েছে তার একের পর এক আগুন এবং ধৈর্যের উপত্যক।
বৈরী বাতাসে সাঁতার কেটেই তো এক সময় এভাবে পৌঁছানো যায় প্রশান্ত এবং আলোকিত এক নির্ভরতার উপকূলে!
আলোর মানুষ ফুলের অধিক
যেমন গাছ, তেমন ফল- কথাটা সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়।
যেমন বিশাল বটবৃক্ষের ফল হয় খুব ছোট এবং মানুষের জন্য অখাদ্য। আবার একটি ছোট কাঠাল কিংবা আঙ্গুর গাছেও যেসব ফল হয়- তা যেমনি সুস্বাদু, তেমনি স্বাস্থ্যকর।
কিন্তু তাই বলে মানুষের ক্ষেত্রেও যে এমনটি ঘটবে, তার কোনো মানে নেই। বরং এর উল্টোটাই হয়ে থাকে প্রায় ক্ষেত্রে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেমন পিতা, তেমন তার পুত্র হয়ে থাকে। ব্যতিক্রম যে আদৌ নেই, তা নয়।
কিন্তু সাঈদ বলে কথা।
হযরত সাঈদ ইবন যাইয়দ (রা)। তিনি তো ছিলেন সেই সৌভাগ্যবান বিরল পুরুষ, যিনি হযরত উমরের (রা) বেন ফাতিমার স্বামী ছিলেন এবং দু’জনই ইসলাম গ্রহণ করেন উমরের (রা) আগে। যখন রাসূল (সা) সবেমাত্র ইসলামের দাওয়াতে দেয়া শুরু করেছেন। সেই ইসলামের প্রথম ভাগেই।
কী খোষ নসীব।
সাঈদ এবং স্ত্রী ফাতিমা ইসলাম কবুল করেছন।
তাদের চোখ থেকে জমাট অন্ধকার সরে গিয়ে সূর্যের সোনালী রোদ্দুর চিকচিক করছে।
বুক ভরে নিচ্ছেন তারা ঈমানের শীলত বাতাস।
চারপাশ ঘিরে আছে কেবল কল্যাণের নিয়ামত।
কিন্তু অন্যদের মতো, ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদের ওপরও নেমে এলো নির্যাতনের স্টিম রোলার।
দলিত মথিত হন তারা। শরীরে নেমে আসে ব্যথাভার অবসাত।
কিন্তু মনসাগরে দোলা দিয়ে যায় তখনও অন্য এক সাহসের ঢেউ।
প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও অনুভব করেন তারা হৃদয়ের এক অপার্থিব আরাম।
সেই প্রশান্তি, সেই আরাম, আর সেই সাহসের নাম- ঈমান।
হযরত উমর (রা)-
তখনও তিনি স্পর্শ করেননি আলোকিত পর্বত।
তখনও তিনি বঞ্চিত জোছনার দ্যুতি থেকে। তখনও তিনি দূরে, বুহুদূরে প্রশান্তির বৃষ্টি থেকে।
বরং তখনও তিনি ঠা ঠা রেদের ভেতর কেবলই ছুটে বেড়াচ্ছেন তৃষ্ণার পানির খোঁজে।
সেই পরিস্থিতিতে, উমরের জীবনে কী বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে গেল মুহূর্তেই। ঐ ভগ্নিপতি সাঈদ আর বোন ফাতিমার কারণে তিনিও গোসল করে নিলেন ঈমানের পূতপবিত্র ঝর্ণাধারায়।
ঈমান গ্রহণের পর আগের সেই উমর (রা) কোন্ উমরে পরিণত হয়েছিলেন, সে কথা তো লেখা আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত সাঈদের বদলে গেল জীবন মিশন।
তার যৌবনের সকল শক্তি সকল ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা তিনি নিয়োগ করলেন কেবল ইসলামের খেদমতে।
সেখানে কোনো অলসতা ছিল না।
ছিল না কোনো ক্লান্তির ছাপ। কেবল কাজ আর কাজ।
কেবল চেষ্টার পর চেষ্টা।
ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য তার জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন একমাত্র আল্লাহর রাস্তায়।
রাসূলকৈ (সা) ভালোবেসে তিনি পূর্ণ করেছিলেন তার হদয়। দ্বিধাহীন, শঙ্কাহীন।
তিনি রাসূলেল (সা) সামনে পেশ করে দিয়েছিলেন নিজেকে, নিজের জীবনকে। এটাই ছিল তার ভালোবাসার উত্তম নজরানা।
হযরত সাঈদ!
রাসূলের (সা) নির্দেশে সিরিয়া থাকার কারণে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেননি বদর যু্দ্ধে।
কিন্তু এছাড়া আর প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি ছিলেন অন্যতম সাহসী মুজাহিদ। পারস্যের কিসরা ও রোমের কাইসারের সিংহাসন পদানত করার ব্যাপারে হযরত সাঈদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
মুসলমানদের সাথে তাদের যতগুলো যুদ্ধ হয়েছিল, তার প্রত্যেকটিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়।
তার সেইসব অবদানের কথা স্মারণীয় হয়ে আছে আজও।
সাঈদ (রা) নিজেই বলেছেন:
‘ইয়ারমুকের যুদ্ধে আমরা ছিলাম ছাব্বিশ হাজার বা তার কাছাকাছি।’
অন্যদিকে রোমান বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল এক লাখ বিশ হাজার।
তারা অত্যন্ত দৃঢ়পদক্ষেপ পর্বতের মত অটল ভঙ্গিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। তাদের অগ্রভাগে বিশপ ও পাদ্রি-পুরোহিতদের একটি বিশাল দল।
হাতে তাদের ক্রুশখচিত পতাকা। মুখে প্রার্থনাসঙ্গীত। পেছন থেকে তাদের সাথে সুর মিলাচ্ছিল বিশাল শক্তিশালী বাহিনী।
তাদের সেই সম্মিলিতি কণ্ঠস্বর তখন মেঘের গর্জনের মত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল।
রেমান বাহিনীর এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখছেন মুসলিম বাহিন।
রোমান বাহিনীর সংখ্যা বিপুল।
এই দৃশ্য দেখে মুসলিম বাহিনী কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।
সেনাপতি আবু উবাইদা।
তিনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন।
সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন এবং মুসলিম বাহিনীকে উজ্জীবিত করার জন্যে বললেন:
“হে আল্লাহর বান্দারা!
ধৈর্য ধারণ কর। ধৈর্য হলো কুফরী থেকে মুক্তির পথ। ধৈর্য হলো আল্লাহর রিজামন্দি হাসিলের পথ এবং যাবতীয় লজ্জা এবং অপমান প্রতিরোধক। তোমরা তীর বর্শা শানিত করে ঢাল হাতে প্রস্তুত হও। হৃদয়ে আল্লাহর জিকির ছাড়া অন্য সকল চিন্তা থেকে বিরত থাকো। সময় হলে আমি তোমাদের যুদ্ধের জন্য নির্দেশ দেব ইনশাআল্লাহ।”
মুসলিম বাহিনীর ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে আবু উবাইদাকে বললেন:
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মুহর্তে আমি কুরবানী করবো আমার জীবনকে। রাসূলেল (সা) কাছে পৌঁছে দিতে হবে এমন কোনো বাণী কি আপনার আছে?”
আবু উবাইদা বললেন:
“হ্যাঁ আছে। রাসূলকে (সা) আমার ও মুসলিম বাহিনীর সালাম পৌঁছে দিয়ে বলবে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের রব আমাদের সাথে যে অঙ্গীকার করেছন, তা আমরা সত্যিই পেয়েছি।”
সাঈদ বলেন,
‘আমি তার কথা শুনা মাত্রই দেখতে পেলাম সে তার তরবারি কোষমুক্ত করে আল্লাহর শত্রুদের সাথে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হচ্ছে।
এই অবস্থায় আমি দ্রুত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাঁটুতে ভর দয়ে অগ্রসর হলাম এবং আমার বর্শা হাতে প্রস্তুত হলাম।
শত্রুপক্ষের প্রথম যে ঘোড় সওয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো, আমি তাকে আঘাত করলাম।
তারপর-
তারপর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রুবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
আল্লাহ পাক আমার অন্তর থেকে সকল প্রকার ভয়ভীতি একেবারেই দূর করে দিলেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর সরবাত্মক আক্রমণ চালালো। এবং তাদেরকে পরাজিত করলো।”
দিমাশক অভিযানেও অংশগ্রহণ করেন সাঈদ।
দিমাশক বিজয়ের পর আবু উবাইদা তাকে দেমাশকের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন।
তিনিই হলেন দিমাশকের প্রথম মুসলিম ওয়ালী।
কিন্তু হযরত সাঈদ জিহাদের চেয়ে তিনি এই উচ্চ পদকে মোটেও সম্মানজনক মনে করলেন না।
তিনি কাজ করেন। প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। আর মনটা পড়ে থাকে তার জিহাদের ময়দানে।
তিনি আবু উবাইদাকে জানালেন হৃদয়ের সকল আকুতি। লিখলেন:
“আপনারা জিহাদ করবেন আর আমি বঞ্চিত হরো, এমন আত্মত্যাগ আর কুরবানী আমি করতে পারিনে। আমি শিগগিরই আপনার কাছে পৌঁছে যাচ্ছি।”
আবু উবাইদা বাধ্য হয়ে ইয়াযিদ ইবনে আবু সুফিয়ানকে দিমাশকের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন এবং জিহাদের ময়দানে ফিরিয়ে আনলেন হযরত সাঈদকে।
এই হলেণ হযরত সাঈদ। যিনি ছিলেন সাহসে ও সংগ্রামের এক জ্বলন্ত বারুদ।
কেন নয়!
তার পিতা যায়িদও যে ছিলেন একজন সাহসী, সত্যানিষ্ঠপুরুষ। তিনি যে তারই সন্তান!
যায়িদের সৌভাগ্য হয়নি রাসূলের (সা) খেদমতে নিজেকে পেশ করার। কারণ, তখনও নবী মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হননি।
কিন্তু যায়িদ, সেই জাহেলি যুগেও ছিলেন কলুষমুক্ত। ছিলেন রুচিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান এবং সাহসী এক পুরুষ।
ইসলাম আগমনের আগেই তিনি নিজেকে দূরে রাখেন শিরক থেকে। কুফরী থেকে। পৌত্তলিকতা থেকে আর যত পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে।
নবওয়াত প্রাপ্তির আগে, ‘বালদাহ’ উপত্যকায় একবার রাসূলের (সা) সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।
রাসূলের (সা) সামনে খাবার আনা হলে তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানালেন। যায়িদকে অনুরোধ করাহলে তিনিও অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন:
“তোমাদের দেব-দেবীর নামে যবেহকৃত পশুর গোশত আমি খাইনে।”
এটা সেই জাহেলি যুগের কথা।
যখন আরবে কন্যা সন্তান হলে জীবিত কবর দেয়া হতো।
যায়িদ খোঁজ খবর নিতেন, কোথায় সন্তান ভূমিষ্ট হচ্ছে। কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হবার খবর পেলেই তিনি সেখানে ছুটে যেতেন এবং সেই কন্যা সন্তানকে নিজের দায়িত্বে নিয়ে যেতেন। তারপর সে বড় হলে তাকি নিয়ে যেতেন তার অভিভাবকের কাছে। বলতেন, “এখন একে নিজের দায়িত্বে রাখতেও পারো, অথবা আমার দায়িত্বেও ছেড়ে দিতে পারো।”
যায়িদ সারাজীবন সত্য দীনকে অনুসন্ধান করে ফিরছেন। এই সত্য দীনকে খুঁজতে তিনি কত জায়গায়ই না গিয়েছেন। একবার তিনি শামে (সিরিয়া) গিয়ে একজনের সন্ধান পেলেন। যিনি আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ। তার কাচে তিনি মনের বাসনার কথা খুলে বললেন। তিনি যায়িদকে বললেন:
-হে মক্কাবাসী ভাই! আমার মনে হচ্ছে আপনি দীনে ইব্রাহীম অনুসন্ধান করছেন?
-হ্যাঁ, তাই।
তিনি বললেন:
“আপনি যে দীনের অনুসন্ধান করছেন, আজকের দিনে তো তা আর পাওয়া যায় না তবে সত্য আছে তো আপনার শহরেই। আপনার কওমের মধ্য থেকে আল্লাহ এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি দীনে ইব্রাহীম পুনরুজ্জীবিত করবেন। আপনি যদি তাঁকে পান তাহল তাঁরই অনুসরণ করবেন।”
রাহিবের একথা শুনার পর যায়িদ আবার মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন।
কোথায় সেই নবী?
কে সেই ভাগ্যবান মহাপুরুষ?
খুঁজতে হবে তাঁকে।
যায়িদ দ্রুত হাঁটছেন।
মক্কার দিকে।
মক্কা থেকে বেশ কিছু দূরে যায়িদ।
তখনই মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন।
কিন্তু আফসোস!
যায়িদ রাসূলের (সা) সাক্ষাৎ পেলেন না।
কারণ, মক্কায় পৌঁছার পূর্বেই একদল বেদুইন ডাকাত তাকে আক্রমণ করলো। শুধু আক্রমণ নয়, শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যাও করলো।
ইন্তেকাল করলেন যায়িদ।
তিনি বঞ্চিত হলেন রাসূলের (সা) দর্শন, হিদায়াত এবং ইসলামের খেদমত থেকে।
অপূর্ণ রয়ে গেল তার হৃদয়ের বাসনা।
মৃত্যুর আগে তিন আকাশের দিকে তাকিয়ে দুআ করলেন। বললেন:
“হে আল্লাহ! যদিও এই কল্যাণ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে আপনি মাহরুম করবেন না।”
মহান রাব্বুল আলামীন কবুল করেছিলেন পিতা যায়িদের সেই দুআ।
সত্যি সত্যিই তার পুত্র সাঈদ কল্যাণ লাভ করেছিলেন রাসূলের (সা) ভালোবাসা আর আল্লাহর দীনের পথে সার্বিক ত্যাগের মাধ্যমে।
যেমন পিতা, তেমনি তার পুত্র।
হযরত সাঈদ!
কী অসাধারণ এক বেহেশতের আবাবিল!
বেহেশতের আবাবিল, কিংবা তার চেয়েও বড়- আলোর মানুষ, ফুলের অধিক।
আঁধার লুটায় পায়ের নিচে
বিশাল হৃদয়ের এক মানুষ আবদুর রহমান ইবনে আউফ।
যেমন তার ঈমানী দৃঢ়তা, তেমনি তার সাহস। কোমলতা, দানশীলতা আর মহানুভবতায় তিনি ছিলেন এক বিরল দৃষ্টন্তের অধিকারী।
কী অসাদারণ ছিল তার সেই হৃদয় উজাড় করা দানে মহিমা!
আত্মত্যাগের এক অনুপম স্বাক্ষর রেখে গেছেন আবদুর রহমান।
রেখে গেছেন ইসলামের জন্য ব্যাকুল হৃদয়ের সোনালি পশরা।
রাসূল (সা) পেয়ে গেছেন তখন মহান পুরস্কা- নবুওয়াত।
তিনি তখন তাওয়াদ দিচ্ছেন আশপাশে। পরিচিত মহলে।
চুপে চুপে ইসলাম গ্রহণ করছেন কেউ কেউ।
সেই প্রাথমিক পর্যায়ে যে ক’জন রাসূলের (সা) আহ্বান সাড়া দিয়েছিলেন, আবদুর রহমান ছিলেন তাদেরই একজন।
সেই তো প্রথম।
সেই তো প্রথম আত্মসমপর্পণ করা আল্লাহর কাছে।
ইসলামের কাছে।
রাসূলের (সা) ভালোবাসার কাছে। না, আর একবারের জন্যেও পেছন ফিরে তাকাননি তিনি।
সেই তো পথ চলা শুরু।
পথ চলা কেবলই আলোর দিকে।
কল্যাণের দিকে।
সত্যের দিকে।
সেই চলার ছিল না কোনো বিশ্রাম। ছিল না কোনো ক্লান্তি।
আবদুর রহমান।
শেষ জীবনেও তিনি ছিলেন বিশাল সম্পদশালী। সম্পদশালী ছিলেন ঈমান এবং অর্থের দিক থেকেও।
কিন্তু প্রথম দিকে তিনি ছিলেন অতিশয় নিঃস্ব এবং দরিদ্র। অভাবের সাথে পাঞ্জা লড়তেন প্রায় প্রতিনই। একেবারেই খালি হাতে তিনি হিজরত করে পৌঁছেছিলেন মদীনায়।
কী দুঃসহ জীবনটাই না ছিল তখন! তবুও হতাশ নন আবদুর রহমান। বরং কঠিন প্রত্যয় এবং শ্রমের মাধ্যমে সেই তিনি- যিনি মদীনায় শুরু করে ছিলেন ঘি ও পনির বেচা-কেনার সামান্য ব্যবসা- কালে কালে তিনিই হয়ে উঠলেন তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর একজন সেরা ব্যবসায়ী এবং বিশাল সম্পদশালী ব্যক্তি।
চেষ্টা, সাধনা, পরিশ্রম আর আল্লাহর ওপর অপরিসীম আস্থা থাকলে কি- না হয়! আবদুর রহমানই তার সাক্ষী।
কিন্তু কিভাবে এমনটি হলো?
সেও এক আলোকিত অধ্যায় বটে।
সম্পদশালী, কিন্তু বখিল কিংবা কৃপণ ছিলেন না আবদুর রহমান।
তার সম্পদ দু’হাতে তিনি দান করেন আল্লাহর রাস্তায়। তার সম্পদ দ্বারা সমূহ উপকৃত হয় ইসলাম।
আল্লাহর রাসূল (সা) জানেন এসব।
জানবেন না কেন!
তিনিই তো নিজ চোখে দেখেন আবদুর রহমানের দানের কারিশমা। দয়ার নবীজী (সা) খুশি হন প্রিয় সাহাবীর এই অনুণ্ঠ উদারতায়। তিনি দোয়া করেন তার জন্য। হাত তুলে দোয়া করেন মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে। তার সম্পদ বৃদ্ধির জন্য।
রাসূলের (সা) দোয়া বলে কথা!
বৃথা যাবে কেমন করে?
মহান রাব্বুল আলামীন কবুল করলেন রাসূলের (সা) দোয়া।
দয়ার নবীজীর (সা) দোয়ার বরকতে আল্লাহর রহমতে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হলেন আবদুর রহমান।
এত অর্থ! এত সম্পদ!
কিন্তু না, এসবের প্রতি সামান্যতম আকর্ষণও ছিল না তার। এই বিপুল সম্পদ তিনি দান করেছন একমাত্র আল্লাহর রাস্তায়। সত্যের পথে। রাসূলের (সা) ভালোবাসার নজরানায়। মানুষ ও মানবতার কাজে।
একজার রাসূল (সা) ডাকলেন তার প্রিয় সাথীদের। বললেন,
“আমি একটি অভিযানে সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছা করছি। তোমরা সাহায্য করো।”
রাসূলের (সা) কথা শেষ হতেই এক দৌড়ে বাড়িতে এলেন আবদুর রহমান। তারপর দ্রুত, খুব দ্রুত ফিরে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে এই চার হাজার দীনার আছে। এর থেকে দু’হাজার করজে হাসানা দিলাম আমার রবকে। আর বাকি দু’হাজার রেখে দিলাম আমার পরিবার-পরিজনের জন্য।
রাসূল (সা) খুব খুশি হলেন। বললেন,
“তুমি যা দান করেছ এবং যা রেখে দিয়েছ, তার সব কিছুতেই আল্লাহ তা’আলা বরকত দান করুন।”
বিরাট শোরগোল পড়ে গেল মদীনায়। সবাই কানাকানি করছে, সিরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে একটি বাণিজ্য কাফেলা উপস্থিত হয়েছে। শুধু উট আর উট।
জিজ্ঞেস করলেন হযরত আয়েশা (রা),
“এই সম্পদে বহর নিয়ে কে এলো? এই বাণিজ্য কাফেলাটি কার?”
উপস্থিত সকলেই জবাব দিল,
“কার আবার! আবদুর রহমানের।”
হযরত আয়েশা (রা) বললেন, “আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি, ‘আবদুর রহমানকে আমি যেন সরাতের ওপর একবার হেলে গিয়ে আবার সোজা হয়ে উঠতে দেখলাম।”
আমি শুনেছি। রাসূল (সা) বলতেন,
“আবদুর রহমান হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
হযরত আয়েশার (রা) কথাটি সময়মত কানে গেল আবদুর রহমানের। তিনি আহত হলেন কিছুটা। দৃঢ়তার সাথে বললেন,
“ইনশাআল্লাহ আমাকে সোজা হয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে হবে।”
এই আত্মবিশ্বাসের বাণী উচ্চারণের সাথে সাথেই তিনি তার উপার্জিত সকল বাণিজ্য-সম্পদ সাদকা করে দিলেন আল্লাহর রাস্তায়।
কী পরিমাণ ছিল সেই সম্পদ?
কেউ বলেন, পাঁচশো, কেউ বলেন সাত শো উটের পিঠে বোঝাই ছিল যত সম্পদ- তার সবই তিনি সাদকা করে দেন।
আবার কেউবা বলেন, শুধু সম্পদ নয়, সেই সাথে ঐ পরিমাণ উটের বহরকেও দান করে দিয়েছিলেন।
একবার তিনি চল্লিশ হাজার দীনারে বিক্রি করলেন তার কিছু জমি। বিক্রয়লব্ধ সম্পূর্ণ অর্থই তিনি বন্টন করে দিলেন বনু যুহরা, মুসলমান, ফকির মিসকিন, মুহাজির ও আযওয়ায়ে মুতাহহারাতের মধ্যে।
তিনি মোট তিরিশ হাজার দাস মুক্ত করে দিয়েছেন। এটাও এক বিরল দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে।
আবদুর রহমান ছিলেন রাসূলের (সা) ভালোবাসায় সিক্ত এক অনন্য অসাধাণ মানুষ।
বিশাল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি জীবন যাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। আল্লাহর সন্তুষ্টি, রাসূলের মহব্বত ছিল তার একমাত্র আরাধ্য বিষয়।
তিনি ছিলেন তাকওয়ার এক উজ্জ্ব নমুনা। মক্কায় গেলে তিনি তার আগের বাড়ির দিকে ফিরেও তাকাতেন না। কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন,
“ওগুলি তো আম আমার আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছি। ওদিকে তাকাব কেন?”
একবার তিনি দাওয়াত দিলেন বন্ধুদেরকে।
সময়মত সবাই হাজির হলেন তার বাড়িতে।
তিনিও বসে আছেন তাদের মধ্যে। ইতোমধ্যে খাবার এলো ভেতর থেকে। কত ভাল খাবার! এতসব আয়োজন কেবল বন্ধুদের জন্য। এত খাবার সামনে এলেই তিনি কান্না শুরু করলেন। ডুকরে কাঁদছেন আবদুর রহমান।
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলেন,
“কাদছো কেন? কী হয়েছে?”
তিনি সেই কাঁদো স্বরেই জবাব দিনে, “রাসূল (সা) বিদায় নিয়েছেন। তিনি নিজের ঘরে যবের রুটিও পেট ভরে খেতে পাননি।”
আর একদিন। তিনি রোযা ছিলেন। ইফতারের পর তার সামনে খাবার হাজির করলে তিনি অত্যন্ত ব্যাথাভরা কণ্ঠে বললেন,
“মুসয়াব ইবনে উমায়ের ছিলেন নামার থেকেও ভালো এবং উত্তম মানুষ। কিন্তু সেই সোনার মানুষটি হলে তার জন্য মাত্র ছোট্ট একখানা কাফনের কাপড় পাওয়া গিয়েছিল। সেই কাপড়টি ছিল এতই ছোট যে তার দিয়ে মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যাচ্ছিল, আবার পা ঢাকতে গেলে মাথা আলগা হচ্ছিল। তারপর মহান আল্লাহ আমাদের জন্য দুনিয়ার এইসব প্রাচুর্য দান করলেন। আমার ভয় হয়, না জানি আল্লাহ পাক আমাদের বদলা দুনিয়াতেই দিয়ে দেন।”
কথাগুলি বলতে গিয়েতিনি হাউমাউ করে শিশুদের মতহ জোরে কেঁদে ফেললেন।
কাঁদছেন আবদুর রহমান।
কাঁদছেন আল্লাহর ভয়ে।
আখিরাতের ভয়ে।
কিন্তু তিনি কেন কাঁদছেন
তিনি তো সেই ব্যীক্ত- যিনি নবম হিজরিতে, তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূলের (সা) হাতে তুলে দেন আট হাজার দীনার। আর এই অঢেল অর্থ দান করা দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করলো, এটা বাড়াবাড়ি। কেবল লোক দেখানোর জন্য। সে একজন রিয়াকার।
তাদের জবাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আত্তাওবার ৭১ নং আয়াতে বললেন,
“এতো সেই ব্যক্তি, যার ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হতে থাকবে।”
তার এই দানের হর দেখে রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “আবদুর রহমান, তোমার পরিবারের জন্য কিছু রেখেছ কি?”
তিনি জবাবে বললেন, “হ্যাঁ, রেখেছি হে দয়ার নবী (সা)! আমি যান দান করেছি, তার চেয়েও বেশ ও উৎকৃষ্ট জিনিস তাদের জন্য রেখে এসেছি।”
রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত’?
আবদুর রহমান বললেন, “আমার পরিবারের জন্য রেখে এসেছি তাই, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) যে রিজিক, কল্যাণ ও প্রতিদানের অঙ্গীকার করেছেন।”
সত্যের প্রতি ছিলেন পর্বতের মত সুদৃঢ়।
কোমল ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেল (সা) প্রতি।
কিনতু তিনিই আবার ভীষণ ভয়ঙ্কর ছিলেন মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ছিলেন বৈশাখী ঝড়ের চেয়েও দুর্দম আর সমুদ্রের তুফানের চেয়েও ভয়ানক।
রাসূলের (সা) জীবদ্দশায় সংঘটিত বদর, উহুদ, খন্দকসহ প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
তার তলোয়ারের ধার দিয় ঝরে পড়তো কেবল সাহসের ফুলকি।
উহুদের যুদ্ধে তার শরীরে জমে গিয়েছিল একত্রিশটি আঘাতের হিহ্ন।
তারপরও তিনি ছিলেন বারুদস্ফুলিঙ্গ, কঠিন পর্বতশৃঙ্গ।
কেন নয়?
তিনি তো পান করেছিলেন রাসূলের (সা) হাত থেকে সেই এক সাহসের পানি, যে পানিতে ছিল কেবল আল্লাহর করুণার স্পর্শ।
ভয়ের কালিমা তাকে ছুঁয়ে যাবে, তা কেমন করে হয়!
বস্তুত, এমন সাহসী মানুষের পায়ের নিচেই তো হুমড়ি খেয়ে গড়াগড়ি যায় যত কুৎসিৎ আঁধার। আধারের ঢল।