কাযা নামায পড়ার বিবরণ
কোন ফরয অথবা ওয়াজেব নামায সময় মতো যদি পড়া না হয় এবং সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পড়া হলে তাকে কাযা পড়া বলে। ওয়াক্তের ভেতরেই পড়লে তাকে আদা’ বলে।
কাযা নামাযের হুকুম
১. ফরয নামাযের কাযা ফরয এবং ওয়াজেব নামাযের (বেতর) কাযা ওয়াজেব।
২. মানত করা নামাযের কাযাও ওয়াজেব।
৩. নফল নামায শুরু করার পর ওয়াজেব হয়ে যায়। কোন কারণে নফল নামায নষ্ট হলে অথবা শুরু করার পর কোন কারণে যদি ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে তার কাযা করা ওয়াজেব হবে।
৪. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং নফলের কাযা নেই। অবশ্য ফজরের সুন্নাত যেহেতু খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং হাদীসে তার খুব তাকীদ রয়েছে সে জন্যে যদি ফজরের ফরয এবং সুন্নত উভয়ই কাযা হয়ে যায় তাহলে দুপুরের আগে উভয়েরই কাযা পড়তে হবে। তারপর হলে শুধু ফরয কাযা পড়তে হবে। সুন্নাতের কাযা পড়তে হবে না। আর যদি ফজরের ফরয ওয়াক্তের মধ্যে পড়া হয় এবং সুন্নাত রয়ে যায় তাহলে বেলা উঠার পর থেকে দুপুরের আগে পর্যন্ত পড়া যায়। বেলা গড়ার পরে নয়। এছাড়া অন্য কোন সুন্নাত বা নফল ওয়াক্তের মধ্যে পড়তে না পারলে তার কাযা ওয়াজেব হবে না।
৫. যোহরের ফরযের আগে যে চার রাকায়অত সুন্নাত তা যদি কোন কারণে পড়া না হয় তাহলে ফরযের পর পড়া যায়। ফরযের পর যে দু’রাকায়াত যোহরের সুন্নাত আছে তার আগেও পড়া যায় এবং পরেও পড়া যায়। তবে যোহরের ওয়াক্ত চলে গেলে কাযা ওয়াজেব হবে না।
কাযা নামাযের মাসয়ালা ও হেদায়াত
১. বিনা কারণ ও ওযরে নামায কাযা করা বড় গুনাহ। তার জন্যে হাদীসে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যদি অবহেলার জন্যে এমন ভুল হয় তাহলে খাঁটি দেলে তওবা করা উচিত এবং ভবিষ্যতে সংশোধনের জন্যে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
২. কোন ন্যায় সংগত ওযর বা অক্ষমতার জন্যে নামায কাযা হলে তার গাড়িমসি করা ঠিক নয়্ যতো শীঘ্র সম্ভব কাযা আদায় করা উচিত। বিনা করণে বিলম্ব করা গুনাহ। তারপর জীবনেরও তো কোন ভরসা নেই, সুযোগ নাও মিলতে পারে এবং এমন অবস্থায় মানুষ আল্লাহ কাছে হাযির হবে যে, সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সে বিলম্ব করে কাযা নামায পড়তে পারেনি।
৩. যদি কোন সমযে কয়েকজনের নামায কাযা হয়ে যায় যেমন এক সাথে সফর করার সময় ওয়াক্তের মধ্যে নামায আদায় করা যায় নি, অথবা কোন মহল্লায় কোন দুর্ঘটনা হওয়ার কারণে সকলের নামায কাযা হয়ে গেল অথবা কয়েকজন ঘুমিয়ে রইলো এবং সকলের নামায কাযা হলো, এ অবস্থায় জামায়াতের সাথে আদায় করতে হবে। যদি সেররী নামায কাযা হয় তো কাযা জামাতের সেররী কেরায়াত করতে হবে। জাহরী হলে জাহরী কেরায়াত। ****১
৪. কোন ব্যক্তির নামায যদি কখনো কাযা হয়, তাহলে চুপে চুপে ঘরে কাযা পড়ে নেয়া ভালে। যদি অবহেলায় এ কাযা হয়ে থাকে তাহলে এ গুনাহ লোকের মধ্যে প্রকাশ করাও গুনাহ। কোন অক্ষমতায় কাযা হয়ে গেলেও তা মানুষের কাছে প্রকাশ করা দোষণীয় এবং মাকরুহ। যদি মসজিদেও কাযা পড়া হয় তবুও মানুষকে জানতে দেয়া ঠিক নয়।
৫. কাযা নামায পড়ার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনই স্মরণ হবে এবং সুযোগ হবে পড়ে নিতে হবে। তবে নিষিদ্ধ সময়গুলোতে মনে পড়লে অপেক্ষা করতে হবে। সে সময় উত্তীর্ণ হলে পড়তে হবে।
****১ [একবার নবী (স) এর কাফেলা সফরে রাত ভর চললো এবং শেষ রাতে এক স্থানে তাবু গাড়লো। তারপর সকলে এমন ঘুমিয়ে পড়লেন যে, ফজরের নামাযের সময় চলে গেল, তবুও সকলে ঘুমিয়ে রইলেন। তারপর বেলা উঠলে রোদের গরমে সকলের ঘুম ভাঙলো। নবী (স) তৎক্ষণাত আযান দেওয়ালেন এবং জামায়াতে ফজরের নামায আদায় করলেন।]
৬. এক সাথে কয়েক ওয়াক্তের নামায কাযা হয়, তাহলে কাযা আদায় করতে বিলম্ব করা উচিত নয়। যত শীঘ্র কাযা পড়ে নিতে হবে। সম্ভব হলে একই ওয়াক্তে সমস্ত কাযা পড়ে নিতে হবে। এটা জরুরী নয় যে, যোহরের কাযা যোহারের সময় আসরের কাযা আসরের সময় বরং একই সময় সব কাযা পড়ে নেয়া উচিত।
৭. কেহ অবহেলা করে দীর্ঘ দিন নামায পড়েনি। এভাবে মাসের পর মাস বছরের পর বছর নামায পড়ে কাটিয়েদিয়েছে। তারপর আল্লাহ তাকে তওবা করার সুযোগ দিলেন। তখন ঐ সমস্ত নামাযের কাযা তার উপর ওয়াজেব হবে। তওবা করলে আশা করা যায় না নামায না পড়ার গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু যে নামায পড়া হয়নি তা মাফ ক হবে না। সে জন্যে সব কাযা পড়তে হবে।
৮. কারো যদি কয়েক মাস এবং বছর নামায কাযা হয়ে যায়, তাহলে তার উচিত কাযা নামায একটা অনুমান করে নিয়ে কাযা পড়া শুরু করবে। এ অবস্থায় কাযা নামায পড়ার নিয়ম এই যে, সে যে ওয়াক্তের কাযা পড়তে চাইবে সে ওয়াক্তের নাম নিয়ে বলবে যে, অমুক ওয়াক্তের সবচেয়ে প্রথম বা শেষ নামায পড়ছি। যেমন কাযা হওয়া নামাযের মধ্যে ফজরের নামাযের কাযা পড়তে চায়। তাহলে বলবে, ফজরের সবচেয়ে প্রথম অথবা শেষ নামায পড়ছি। এভাবে পড়তে থাকবে যাতে সকল কাযা নামায পুরা হয়ে যায়।
৯. সফরে যে নামায কাযা হবে তা মুকীম হয়ে পড়তে গেলে কসর পড়বে। তেমনি মুকীম অবস্থায় কাযা হলে সফরে তা পুরা পড়তে হবে।
১০. শুধু বেতের নামায কাযা হয়েছে এবং আর কোন কাযা নেই। তাহলে বেতরের কাযা পড়া ব্যতীত ফজরের নামায পড়া ঠিক হবে না। যদি বেতরের কাযা স্মরণ রাখা সত্ত্বেও প্রথমে ফজরের নামায পড়ে তারপর বেতর পড়ে তাহলে বেতরের পুর পুনরায় ফজরের নামায পড়তে হবে।
১১. যদি কোন রোগ শয্যায় ইশারা করে নামায পড়া যেতো কিন্তু কিছু নামায কাযা হয়ে গেল। তাহলে এমন ব্যক্তির উচিত হবে যে, সে যেন তার ওয়ারিশদেরকে অসিয়ত করে যায় তার এক তৃতীয়ংশ মাল থেকে কাযা নামাযের ফিদিয়া আদায় করে। এক কাযা নামাযের ফিদিয়া সোয়া সের গম অথবা আড়াই সের যব। এ সবের মূল্য দিলেও হবে।
১২. কোন রোগী যদি এতটা দুর্বল হয়ে পড়ে যে, ইশারায় নামায পড়ারও শক্তি নেই অথবা বেহুশ হয়ে পড়লো এবং এভাবে ছয় ওয়াক্ত নামায কাযা হয়ে গেল। তাহলে তার কাযা পুরা করা ওয়াজেব হবে না। তবে পাঁচ ওয়াক্তের পর যদি হুঁশ হয় তাহলে সব নামায কাযা পড়তে হবে।
১৩. যারা অজ্ঞাত কারণে জীবনের একটা অংশ অবহেলায় কাটিয়েছে এবং অসংখ্য নামায কাযা হয়েছে। তারপ যদি তওবার তৌফিক হয় তাহলে তার ছুটে যাওয়া নামাযগুলোর কাযা পড়ার সহজ পন্থা এই যে, পাঁচ ওয়াক্তের নামাযের ফরয আদায় করার সাথে সুন্নত নফলের নিয়তে পড়ার পরিবর্তে ছুটে যাওয়া ফরয নামাযের কাযা হিসেবে পড়তে থাকবে। যতোক্ষণ না তার এ প্রবল ধারণা জন্মে যে, সব নামাযের কাযা পড়া হয়েছে ততোদি পড়তে থাকবে। এটা খুব ভাল যে, মানুষ পাঁচ ওয়াক্তের আদা ফরযের সাথে সুন্নাত নফল পড়বে কিন্তু ছুটে যাওয়া নামাযের কাযা করা অবহেল করবে। ছুটে যাওয়া নামায কর্জের ন্যায়। এটা একেবারে অর্থহীন যে, কর্জ পরিশোধ করার কথা নেই। এদিকে দান খায়রাত চলছে। তবে ছুটে যাওয়া ফরয নামাযের কাযা পড়ার পুরোপুরি ব্যবস্থার সাথে সাথে যদি পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে সুন্নাত-নফল পড়ে, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন।
১৪. জুমা নামাযের কাযা নেই। জুমা পড়তে না পারলে চার রাকায়াত যোহার কাযা পড়তে হবে।
১৫. কোন ব্যক্তি ঈদের নামাযে ইমামের সাথে শরীক হলো। তারপর কোন কারণে তার নামায নষ্ট হয়ে গেল। এখন সে আর ঐ নামাযের কাযা পড়তে পারে না। কারণ ঈদে নামাযের কাযা নেই। [আহলে হাদীসের মতে একাও ঈদের নামায পড়া যায়। ঈদগাহে যদি জামায়াত পাওয়া না যায় অথবা রোগী ঈদগহে যেতে না পারে- তাহলে একা পড়তে পারে।] ওয়াক্তের মধ্যে একাও আদায় করতে পারে না। এ জন্যে যে, ঈদের নামাযের জন্যে জামায়াত শর্ত।
১৬. যদি ঈদুল ফেরে এবং ঈদুল আযহার নামায কোন কারণে প্রথম দিন পড়তে পারা না যায়, তাহলে ঈদুল ফেতেরের নামায পর দিন এবং ঈদুল আযহার নামায বারো তারিখ পর্যন্ত কাযা পড়া যায়।
সাহেবে তরতীব এবং তার কাযা নামায
বালেগ হওয়ার পর যে মুমেন বান্দাহর কোন নামায কাযা হয়নি, অথব জীবনে প্রথমএক বা দু’নামায কাযা হয়েছে, ক্রমাগত হোক অথা মাঝে মাঝে হোক, অথবা প্রথমে কাযা হয়ে থাকলে তার কাযা পড়া হয়েছে এবং এখন তার এক দুই বা উর্ধে পাঁ নামায কাযা হয়েছে, এমন ব্যক্তিকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘সাহেবে তরতীব’ বলে। সাহেবে তরতীবের কাযা পড়ার ব্যাপারে দু’টি বিষয়ের লক্ষ্য রাখা জরুরী।
প্রথম এই যে, যতোক্ষণ পর্যন্ত ছুটে যাওয়া নামাযের কাযা না পড়বে, সামনের ওয়াক্তের আদা নামায পড়তে পারবে না। যেমন কারো ফজর, যোহর, আসর, মাগরেব এবং এশা অর্থাৎ একদিন রাতের নামায কাযা হলো। এখন যতোক্ষণ না সে এ পাঁচ ওয়াক্তের কাযা পড়বে, ততোক্ষণ সামনের দিনের ফজর নামায পড়া তার জন্যে দুরস্ত হবে না। যদি জেনে বুজেও পড়ে ফেলে, তাহলে তা আদায় হবে না, কাযা নামায আদায়ের পর ফজরের নামায তাকে পড়তে হবে। তবে যদি সাহেবে তরতীবের কাযা নামায পড়তে মনে না থঅকে এবং ওয়াক্তের নামায পড়ে ফেলে সে তাহলে নামায পুনরায় পড়ার দরকার হবে না। বেতরের কাযারও তাই হুকুম অন্যান্য নামাযের মতো।
দ্বিতীয় কথা এই যে, কাযা হওয়া নামাযগুলো ক্রম অনুসারে পড়তে হবে। অর্থাৎ প্রথমে ফজরের নাময, তারপর যোহরের, তারপর আসরের, তারপর মাগরেবের এবং এরপর এশার। যদি সে ফজরের নামাযের আগে যোহর পড়ে ফেলে, তাহলে ফজরের নামায পড়ার পর যোহরের কাযা আবার পড়তে হবে। এমনি যোহারের নামাযের কাযা পড়ার আগে যদি আসর বা মাগরেবের কাযা পড়া হয়, তাহলে যোহরের কাযা পড়ার পর আবার আসর মাগরেব ড়তে হবে।
যার পাঁচ ওয়াক্তের বেশী নামায কাযা হয়, সে সাহেবে তরতীত নয়। কাযা নামায পড়ার জন্যে তার ক্রম অনুসারে পড়া ওয়াজেব হবে না। যখন সুযোগ পাবে এবং যে ওয়াক্তে নামায কাযা পড়তে চাইবে তা পড়তে পারবে। কাযা নামায পড়ার আগে আদা নামায পড়াও জায়েয।ক্রম অনুসারে পড়ার বাধ্যবাধকতা শুধু সাহেবে তরতীবের জন্যে।