চতুর্থ পরিচ্ছেদ
জ্ঞান ইসলামীকরণের পদ্ধতি
ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতে জ্ঞানের ইসলামীকরণের পদ্ধতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা:১০
ক. মুসলিম উম্মাহর চিরাচরিত পদ্ধতি (Traditional Methodology)
খ. কাঙ্খিত ইসলামিক পদ্ধতি ( Islmic Methodology)
মুসলিম উম্মাহর চিরাচরিত পদ্ধতি:
জ্ঞানের ইসলামীকরণের চিরাচরিত পদ্ধতিটি ত্রুটিযুক্ত। ষষ্ঠ ও সপ্তম হিজরী শতাব্দিতে অমুসলিমরা উম্মাহর উপর গুরুতর আঘাত হানার ফলে মুসলিম নেতারা তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। প্রাচ্য থেকে উম্মাহর উপর হামলা চালায় এবং পাশ্চাত্য থেকে খৃস্টান ক্রুসেডরা। মুসলমানরা তাদের ধ্বংসোমুখ অবস্থা দেখে অতিরিক্ত রক্ষণশীল হয়ে পড়ে এবং তাদের পরিচয়ের স্বাক্ষর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ইসলামকে রক্ষার জন্য যে কোন পরিবর্তনের চিন্তা পরিহার করে এবং অক্ষরে অক্ষরে শরীয়াতের নির্দেশ মেনে চলার প্রতি অটল থাকে। এরপর তারা আইনের সৃজনশীলতার প্রধান উতস অর্থাত ইজতিহাদকে পরিত্যাগ করে তারা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ বলে ঘোষণা করে। তাদের অভিমত হলো পূর্ব পুরুষদের কাজের মধ্য দিয়েই শরীয়াতের কাজ শেষ হয়ে গেছে। শরীয়াত থেকে নতুন প্রথা প্রবর্তন করাকে শরীয়াতের খেলাফ বলে ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন মাযহাবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরীয়া একটা গতিহীন সত্তায় পরিণত হলো। বলা হলো, শরীয়াতের কাজ হবে ইসলামকে টিকিয়া রাখা। ইসলাম টিকে থাকলো, এমনকি ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দিতে রুশ, বলকান অঞ্চল মধ্য ও দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত মুসলিম বিজয় ও সম্প্রসারণ সত্ত্বেও রক্ষণশীল প্রথা ও ব্যবস্থা খতম হয়নি। মুসলমানরা ব্যাপকভাবে তাসাউফ ও তার তরিকাগুলো গ্রহণ করার ফলে সৃজনশীলতার উতস হিসাবে ইজতিহাদের অভাবে সৃষ্ট অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। সুতরাং আধুনিককাল পর্যন্ত শরীয়া স্থবির হয়ে যায়। ফলে আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরী জ্ঞান পাশ্চাত্যকে মুসলমানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা দান করে এবং তাদেরকে পরাভূত করে।
- ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী, জ্ঞান: ইসলামী রূপায়ন, বঙ্গানু. মুহা. সানাউল্লাহ আখুঞ্জী. পৃ. ৩৫-৫৭।
ক. ফিকহ ও ফকীহ ইজতিহাদ ও মুজতাহিদু
ফিকহ শব্দের অর্থ হচ্ছে পাণ্ডিত্য বা শরীয়াতের জ্ঞান। ফকীহ হচ্ছে, এই জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ। সাধারণ ফিকহ বলতে বুঝায় ইসলামের সকল মাযহাবে শরীয়াতের জ্ঞান। প্রাথমিক যুগের প্রকৃতপক্ষে এক-একজন এনসাইক্লোপেডিয়া ছিলেন। আজকের ফকীহদের জ্ঞান বা প্রজ্ঞা কোন অবস্থাতেই সেই মানের নয়। বর্তমান তাকলীদ পন্থী মুজতাহিদরা মাযহাবের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। এই চৌহদ্দির বাইরে তারা তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে অক্ষম। এখন পরিস্থিতির দাবী হচ্ছে উসূল অর্থাত ইসলামী জ্ঞানের উতস অনুধাবনের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা।
খ. ওহী ও আকলের পরস্পর বিচ্ছিন্নতা:
কোন কোন মুসলমানের উপর গ্রীক যুক্তিবিদ্যার প্রভাবের দরুণ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা ইসলামের সত্য রূপের প্রতি অমুসলমানদের আকৃষ্ট করার জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।
গ. কর্ম থেকে চিন্তার বিচ্ছিন্নকরণ:
ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের নেতারা ছিলেন চিন্তাবিদ এবং চিন্তাবিদরাই ছিলেন নেতা। পরবর্তীতে শাসকরা বিদ্বান ব্যক্তিদের পরামর্শ ছাড়াই শাসনকার্য চালাতে থাকেন। চিন্তার দৈন্য তাদেরকে নানাবিধ সংকটের আবর্তে নিক্ষেপ করে। শাসক ও শাসিতের মধ্যে দুরত্বের সৃষ্টি হয়। মুসলিম চিন্তাবিদরা তাসাউফ চর্চা করে নিজেদের সমাজ সংসার থেকে দূরে রাখতে থাকে। প্রাথমিক যুগে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক বিষয়ের মধ্যে যে ভারসাম্য ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়।
ঘ. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দ্বৈততা:
ইসলামের প্রাথমিক যুগে সিরাতুল মুস্তাকীমের বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলমানদের চিন্তা ও কর্মের জগতকে একটি অভিন্ন কাঠামোর সুসংহত করা। কিন্তু অবসয়ের যুগে এই সংহতরূপ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়-পার্থিব জগত ও পুন্যের জগত। পুন্যের জগতে সুফী চর্চার মাধ্যমে এমনসব ধ্যান ধারণার জন্ম দেয় যা খোদ ইসলামের পরিপন্থী। পক্ষান্তরে বৈষয়িক জগত একটা নৈতিকতাহীন ব্যবসা হিসেবে গড়ে উঠে। এক সময় উপনিবেশ শক্তি নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতি চালু করে। তখন মুসলমানরা স্রেফ নিন্দা করার মধ্য দিয়েই এর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছিল। সামগ্রিক জেহাদ ঘোষণার ক্ষমতা তাদের ছিল না।
কাঙ্খিত ইসলামী পদ্ধতি:
ইসলামী চেতনার আলোকে জ্ঞানের ইসলামীকরণ করতে চাইলে কতিপয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার তত্ব ও পদ্ধতি, নীতিমালা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত মৌলিক বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
১. আল্লাহর একত্ব
ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের প্রথম নীতি হচ্ছে আল্লাহ পাকের একত্ব বা তাওহীদ। আল্লাহ তায়ালাই সকল ক্রিয়ার তাতক্ষণিক চরম কারণ ও উদ্দেশ্য। এর বাইরে সকল কল্পনা, জ্ঞান অথবা মূল্যায়ন অস্তিত্বহীন, মিথ্যা, মূল্যহীন ও বিকৃত।
২. সৃষ্টির ঐক্য
ক. মহা জাগতিক শৃঙ্খলা:
বস্তুত মহাজগতে সংগতিপূর্ণ শৃঙ্খলা বিরাজমান বলেই আমরা পদার্থের অস্তিত্ব এবং ঘটনা প্রবাহের আবর্তনের কার্যকরণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। মহাজাগতিক শৃঙ্খলা ছাড়া কার্যকরণ ও কর্মফলের প্রশ্ন উঠতো না।
খ. সৃষ্টি জগত
আল্লাহ পাক সবকিছু সুনির্দিষ্ট পরিমাপ সহ সৃষ্টি করেছেন। জগতের সব সত্তা চূড়ান্ত ভাবে বা উপায় ও লক্ষ্য হিসাবে পারস্পরিক কার্যকরণসূত্র আবদ্ধ। মুসলমানরা সৃষ্টিকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসাবেই জানে এবং এর প্রতিটি অংশ প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে কোন না কোন ভাবে কোন উদ্দেশ্য সাধন করে চলছে-যা সবটা মানুষের জানার বিষয় নয়। কিন্তু এই জ্ঞান তাদের ঈমানেরই ফলশ্রুতি।
গ. তাসখীর ( সৃষ্টি মানুষের জন্য)
আল্লাহ তাআলা গোটা জগতকে মানুষের জন্য একটি অস্থায়ী উপঢৌকন ও কর্মশালা হিসাব প্রদান করেছেন। সকল বস্তুকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন।
৩. সত্য ও জ্ঞানের ঐক্য:
ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞান তত্ত্বের প্রকৃত রূপ সত্যের ঐক্যের মধ্যেই নিহিত। এই ঐক্য মহান আল্লাহর একত্বের ধারণা থেকেই উতসারিত। আল্লাহ পাকের অপর নাম হচ্ছে আল হাক্ব বা সত্য।
প্রথমত: সত্যের ঐক্য এই নির্দেশ করে যে, বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন কোন বিষয়কে ওহীর আলোকে ব্যাখ্যা দেয়া চলবে না।
দ্বিতীয়ত: সত্যের ঐক্যে সূত্র অর্থাত স্রস্টার সৃষ্টিরীতির সাথে প্রাকৃতির বিধানের সুসংগতি এই শিক্ষাই দেয় যে সৃষ্টির ধারা বা এর কোন অংশ সম্পর্কে কোন সমীক্ষা শেষ ও চূড়ান্ত নয়।
যে যত বড় জ্ঞানীই হোক না কেন তার প্রায় নিশ্চিত সিদ্ধান্তের পরেও তাকে সব সময় এ কথা অবশ্যই বলতে হবে যে প্রকৃত সত্য আল্লাহই ভাল জানেন।
৪. জীবনের ঐক্য
ক. ঐশী আমানত
আল্লাহপাক দেয়া আমানত একমাত্র মানুষই বহন করেছে। আর আল্লাহ পাক জীন- মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁরই ইবাদতের ( একমাত্র আল্লাহর) জন্য। ফেরেশতাদের আল্লাহ পাক মানুষের সামনে সেজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মানুষের মর্যাদা অতি উচ্চে। মানুষ ইচ্ছে করলেই ভাল মন্দ কাজ করতে পারে। মানুষই নৈতিকতার দাবী অনুযায়ী সকল পাপাচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারে বলেই উন্নততর মূল্যবোধের গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত আমানতের মর্যাদা রাখতে হবে।
খ. খলিফা:
মানুষের ঐ আমানত বহনের দায়িত্ব নিয়েছে বলেই সে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষের পরিচয় সে আল্লাহর দাস ও আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষ যে আল্লাহর খলিফা এ কথা স্মরণ রাখতে হবে।
গ. ব্যাপকতা:
মানব জীবনের প্রতিটি দিক ইসলামের সাথে সাযুজপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই ব্যাপক। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সাযুজ্যের সংজ্ঞা ও প্রায়োগিকতা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব মুসলিম চিন্তাবিদদের উপর অর্পিত হয়ে আছে।
৫. মানবতার ঐক্য:
আল্লাহ পাকের বাণী- হে মানব মণ্ডলী আমি তোমাদেরকে এক জোড়া পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পার।( ৪৯: ১৩) সকল মানুষের কল্যাণের বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। ইসলামী পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞানের ইসলামীকরণের কাজ চালাতে হবে।