একঃ প্রভুত্ব কার?
সর্বপ্রথম আমরা দেখব ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রভুত্ব বা হাকেমীয়াতের (Sovereignty) মর্যাদা কাকে দান করে- কাকে প্রভুশক্তি বা Sovereign Power বলে স্বীকার করে?
এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও অকাট্য জবাব কুরআন মজীদ হতে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামে হাকেমীয়াত বা প্রভুত্ব ক্ষমতা সকল দিক দিয়ে এবং সকল অর্থে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্যই সংরক্ষিত। কারণ, বস্তুতপক্ষে তিনিই প্রকৃত প্রভু, অতএব, তাঁরই অধিকার এই যে, একমাত্র ও প্রধান প্রভু হিসেবে কেবল তাকেই স্বীকার করা হবে। এ বিষয়টি আরো একটু গভীর ও ব্যাপকভাবে হৃদয়ংগম করার জন্য সর্বপ্রকার ‘হাকেমীয়াত’ বা প্রভুত্বের অর্থ এবং এই ধারণাটিকে খুব ভাল ও পরিষ্কারভাবে বুঝে নেয়া আবশ্যক। অতএব আপনাদেরকেও সেই পরামর্শ দিব।
প্রভুত্ব বা হাকেমীয়াতের অর্থ
রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই শব্দটি উচ্চতর ক্ষমতা এবং নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একজন ব্যক্তির বা ব্যক্তি সমষ্টির কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানের ‘প্রভুত্বের অধিকারী’ হওয়ার অর্থ এই যে, তারই নির্দেশ সর্বসাধারণের জন্য আইন। এই আইন রাষ্ট্রের সমগ্র ব্যক্তিদের উপর জারী করার সর্বময় কর্তৃত্ব এবং অবিচল ও অপরিহার্য অধিকার তারই। ব্যক্তিগণ তার শর্তহীন আনুগত্য করতে বাধ্য- তা ইচ্ছায় সাগ্রহে হোক কিংবা বাধ্য হয়ে- ঠেকিয়ে তা করা হোক……। তার নিজের ইচ্ছা ছাড়া বাইরের এমন কোন শক্তি কোথায়ও নেই তার শাসনক্ষমতা ও প্রভুত্ব অধিকারকে বিন্দুমাত্র সীমাবদ্ধ বা সংকোচিত করতে পারে। তার বিরোধিতা করার কোন অধিকার নেই। যে ব্যক্তি যে অধিকার পেয়েছে তা সবই একমাত্র তাঁরই দান। কাজেই যে অধিকার সে হরণ করবে তা আপনা আপনিই লুপ্ত হয়ে যায়। সংবিধাতা (Law Giver) যখন কারো অধিকার স্বীকার করে, তখনি তা আইনগত অধিকার বলে স্বীকৃত হয়। কাজেই ‘আইনদাতা’ই যখন সেই অধিকার হরণ করে নিবে, তখন মূলত তার কোন অধিকার বাকী থাকবে না। অতএব তার দাবী করারও কোন অবকাশ থাকতে পারে না। ‘প্রভু সত্তার’ ইচ্ছায়ই আইন অস্তিত্ব লাভ করে, এবং তা ব্যক্তিদেরকে আনুগত্যের রজ্জুতে বেঁধে নেয়। কিন্তু স্বয়ং ‘প্রভু’ সত্তাকে বাধ্য করার মত কোন আইন কোথায়ও নেই। ‘প্রভু’ তার নিজ সত্তার দিক দিয়ে নিরংকুশ প্রভুত্ব ও সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক। তার প্রদত্ত বিধি-বিধানকে ভাল বা মন্দ, বিশুদ্ধ বা ভ্রান্ত প্রভৃতি কোন কিছুই বলে অভিহিত করা যায় না,- এ ধরনের কোন প্রশ্নই সে সম্পর্কে উত্থাপিত হতে পারে না। সে যা কিছু করবে, তা-ই ভাল—তা-ই মংগলময়। তার কোন অধীন ব্যক্তির পক্ষে সেটাকে ‘মন্দ’ বা ‘ভাল নয়’ বলে বাতিল করে দেয়ার কোনই অধিকার থাকতে পারে না। সে যাকিছুই করবে, তা-ই ঠিক- তা-ই নির্ভুল। তার অধীনস্থ কেউই সেটাকে ‘ভ্রান্ত’ বলে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। কাজেই এমন ‘প্রভু সত্তা’কে ‘মহান পবিত্র, দোষ-ত্রুটি বিমুক্ত এবং সবল প্রকার কলংকের উর্ধে’ মনে করে মেনে নিবে। তবে প্রকৃতপক্ষে সে এই গুণের অধিকারী হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন স্বতন্ত্র।
উপরে যা বলা হলো ‘আইনগত প্রভুত্ব’ বলতে এটাই বুঝায়, একজন আইনবিদহ (ফকীব বা Jurist) ব্যক্তি তার অর্থস্বরূপ এটাই পেশ করেন। আর ‘প্রভুত্ব’ বলতে এর কম আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু এই হাকেমীয়াত একেবারে অসম্ভবই থেকে যায় যদি না এর পশ্চাতে কোন বস্তুর প্রভুত্ব- কিংবা রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পরিভাষা অনুসারে “রাজনৈতিক প্রভুত্ব” (Political Sovereignty) বর্তমান থাকে। অর্থাৎ কার্যত সেই প্রভুত্বের মালিক যিনি, তিনিই এই আইনগত প্রভুত্বকে বাস্তবে প্রয়োগ করবেন। অন্যথায় প্রভুত্বের বাস্তব মূল্য কিছুই থাকতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে প্রভুত্ব কার
এখন প্রথম প্রশ্ন এই উত্থাপিত হয় যে, উক্তরূপ কোন প্রভুত্ব বস্তুতপক্ষেই কি মানুষের পরিসীমায় কোথায়ও বর্তমান আছে? যদি থেকে থাকে, তবে তা কোথায়? এরূপ প্রভুত্বের মালিক কাকে বলা যেতে পারে?
রাজতন্ত্রে কোন বাদশাহ কি এরূপ প্রভুত্বের মালিক হতে পারে? তেমন কোন বাদশাহ বা সম্রাট দুনিয়াতে কখনো পাওয়া গিয়েছে কি? সর্বশ্রেষ্ঠ, নিরংকুশ ক্ষমতা ও অধিকারের মালিক যে কোন বাদশাহর বা শাসনকর্তার কথাই ভেবে দেখুন, তার প্রভুত্ব ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারের যাচাই করে দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন- কত দিক দিয়েই না সে বাঁধা এবং কতভাবেই না সে অসহায়। অসংখ্য বহিঃশক্তি তার ইচ্ছা ও মর্জীর বিরুদ্ধেই তাকে সীমাবদ্ধ, সংকোচিত ও নিয়ন্ত্রিত করছে- তাকে অক্ষম করে দিচ্ছে।
তারপর কোন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কোন একস্থানেও অংগুলি নির্দেশ করে তথায় “প্রকৃত প্রভুত্ব” আছে বলে বলা যায় কি? যাকেই এই প্রভুত্বের মালিক মনে করা হবে, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচে যে, তার বাহ্যিক নিরংকুশ ক্ষমতার অন্তরালে প্রচ্ছন্নভাবে কতগুলো ভিন্ন শক্তি তার টুঁটি ধারণ করে আছে, তার প্রভুত্বের ক্ষমতাকে ব্যাহত করেছে।
ঠিক এ কারণেই রাষ্ট্র বিজ্ঞান পারদর্শীগণ যখন প্রভুত্বের এরূপ সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে মানবসমাজে তার প্রকৃত ধারকের সন্ধান করেন, তখন তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রভুত্বের এই ধারণা বাহ্যজগতের কোন শক্তির উপর এবং মানবসমাজের কারো উপরই খাপ খায় না। কারণ মানবতার পরিসীমায়- আর সত্য কথা এই যে, সমগ্র সৃষ্টিজগতের কোথাও প্রভুত্বের উক্তরূপ ধারণার প্রকৃত ধারক একেবারেই বর্তমান নেই। কুরআন মজীদ এ জন্যই বার বার বলেছে: প্রকৃত প্রভুত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া এই প্রভুত্বের ধারক বা অধিকারী আর কেউই হতে পারে না, তিনি নিরংকুশ ক্ষমতার মালিক (আরবী ******) তিনি কারো কাছে দায়ী নন, কারো সামনে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না (আরবী ********) সমগ্র ক্ষমতা এখতিয়ার ও কর্তৃত্বের একচ্ছত্র অধিপতি তিনি (*****) তিনি এমন এক সত্তা, যার ক্ষমতা-এখতিয়ার ও অধিকার বা কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ সংকোচিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারে এমন কোন শক্তিই কোথাও নেই (*****) একমাত্র তাঁর সত্তাই সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি ও অপরাধ-বিচ্যুতি হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র (আরবী *****)
প্রভুত্ব কার
এখানে দ্বিতীয় প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, প্রকৃত ব্যাপার যাই হোক না কেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য ‘কাউকে’ও যদি এরূপ প্রভুত্বের মালিক মনে করা হয়- এরূপ একচ্ছত্র নিরংকুশ প্রভু হওয়ার মর্যাদা যদি কাউকে দেয়া হয়, তবে বাস্তবিকই কি তার হুকুম ‘আইন’ বলে বিবেচিত হবে? তাকে ছাড়া এই অধিকার কি অন্য কারো হবে না? এবং তার কি শর্তহীন আনুগত্য করা যেতে পারে? এমন কি, তার হুকুম ও নির্দেশ সম্পর্কে ভাল-মন্দ, ভুল ও নির্ভুল হওয়ার প্রশ্ন কি আদৌ উত্থাপিত হতে পারে না?
আল্লাহকে ছাড়া এই অধিকার কোন ব্যক্তিকে দেয়া হোক, কোন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হোক, কিংবা দেশবাসীর সংখ্যাগুরুকেই এই অধিকার দেয়া হোক, সেই সম্পর্কে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতে হবে যে, কি কারণে সে এই অধিকার লাভ করলো? এবং কোন্ যুক্তির ভিত্তিতে জনগণের উপর এরূপ নিরংকুশ প্রভু হয়ে দাঁড়াবার অধিকার লাভ করলো? কিন্তু এরূপ প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার জবাব কি দেয়া যেতে পারে? উত্তরে খুব বেশী বললেও শুধু এতটুকুই বলা যেতে পারে যে, জনগণের ইচ্ছা বা সমর্থনই তার এই প্রভুত্বকে যুক্তিযুক্ত করেছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করি, কোন ব্যক্তি যদি নিজেকে স্বেচ্ছায় অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে, তবে বিক্রেতার উপর ক্রেতার সংগত মালিকানা অধিকার সত্যই স্থাপিত হবে কি? এরূপ ইচ্ছাকৃত আত্মবিক্রয় যদি ক্রেতাকে সংগত মালিকানা না দেয়, তাহলে জনগণের নিছক ইচ্ছা প্রকাশ- শুধু রাযী হওয়াই কারো রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বকে কিরূপে সংগত প্রমাণ করতে পারে? কুরআন মজীদ এ রহস্যেরও দ্বারোদঘাটন করেছে- এই সমস্যার সমাধান করেছে। কুরআন বলেছে: আল্লাহর ‘মখলুকে’র (সৃষ্ট জীব-জন্তু ও বস্তুর) উপর অন্য কোন সৃষ্টির প্রভুত্ব কায়েম করার এবং হুকুম চালাবার কোন অধিকার নেই। এই অধিকার একমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর এই অধিকারও শুধু এই জন্য যে, তিনি নিখিল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা। (আরবী ******) “সাবধান! সৃষ্টি তাঁরই, এর উপর প্রভুত্ব চালাবার- এটাকে ‘শাসন’ করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।” এটা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ কথা, জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধিসম্মত সিদ্ধান্ত এটা। অন্তত আল্লাহকে সযারা সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করে, তারা তো একথা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারে না।
প্রভুত্ব কার হওয়া উচিত
তৃতীয় প্রশ্ন উঠে, হক ও বাতিলের কথা না তুলেও প্রভুত্বের এই পদাধিকার কোন মানবশক্তিকে যদি দেয়া হয় তবুও তাতে মানুষের প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে কি? মানুষ- সে ব্যক্তি হোক, শ্রেণী হোক কিংবা কোন জাতি-সমষ্টিই হোক- প্রভুত্বের এত বিরাট ক্ষমতা সামলানোই তার পক্ষে অসম্ভব। জনগণের উপর আইন চালাবার সীমাহীন অধিকার তার থাকবে, তার প্রতিরোধ করার মত ক্ষমতা অন্য কারো থাকবে না এবং তার সকল ফায়সালা-সিদ্ধান্তকেই নির্ভুল মনে করে শিরধার্য করে নেয়া হবে- এরূপ অধিকার ও কর্তৃত্ব যদি কোন মানবীয় শক্তি লাভ করতে পারে, তবে সেখানে যুলুম, নিপীড়ন ও নির্যাতন হওয়া একেবারে অনিবার্য ব্যাপার। তখন সেখানে সমাজের মধ্যেও যুলুম হবে সমাজের বাইরে অন্যান্য প্রতিবেশী সমাজের উপরও তা অনুষ্ঠিত হবে। এরূপ ব্যবস্থার মূল প্রকৃতিতেই ভাঙন ও বিপর্যয়ের বীজ নিহিত রয়েছে, মানুষ যখনই জীবনের এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, তখনিই ভাঙন, বিপর্যয় ও অশান্তি সর্বগ্রাসী হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, যে মূলতই প্রভুত্বের মালিক নয়, আর যার প্রভুত্বের কোন অধিকারও নেই, তাকেই যদি কৃত্রিমরূপে অধিকার ও কর্তৃত্বদান করা হয়,তসে সে কিছুকেই এই পদমর্যাদা রক্ষা করতে এবং এই পদের যাবতীয় ক্ষমতা-ইখতিয়ারকে সঠিক ও ন্যায় পরায়ণতার সাথে ব্যবহার করতে পারে না। কুরআন মজীদ একথাই ঘোষণা করে নিম্নলিখিতভাবে:
(আরবী***************)
“আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী যারা শাসন পরিচালনা করে না, আইন রচনা করে না, তারা যালেম।” –(সূরা আল মায়েদা: ৪৫)
আল্লাহর আইনগত প্রভুত্ব
উল্লেখিত কারণে ইসলাম চিরকালের তরে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে যে, আইনগত প্রভুত্ব তারই স্বীকার করতে হবে যার প্রভুতব বাস্তবিক পক্ষেই স্থাপিত হয়ে আছে সমগ্র বিশ্ব নিখিলের উপর এবং গোটা মানবজাতির উপরও যার শরীকহীন প্রভুত্বের অধিকার রয়েছে। একথাটি কুরআন মজীদে এতবেশী বলা হয়েছে যে, তার গণনা করা কঠিন ব্যাপর এবং তা এত বলিষ্ঠভাবে ব্যক্ত হয়েছে যে, কোন কথা বলার জন্য উহা অপেক্ষা জোরালো ভাষা আর হতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নলিখিত আয়াতসমূহ পেশ করা যেতে পারে:
প্রথম : (আরবী ****************)
“হুকুম দেয়ার ও প্রভুত্ব ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। তিনি আদেশ করেছেন যে, একমাত্র তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্য কর; বস্তুত পক্ষে মানব জীবনের জন্য এটাই একমাত্র সুষ্ঠু, মজবুত এবং সঠিক পন্থা।– (সূরা ইউসুফ: ৪০)
দ্বিতীয়: (আরবী ****************)
“—একমাত্র সেই আইন বিধান অনুসরণ কর এবং মেনে চল, যা তোমাদের জন্য তোমাদের ‘প্রভুর’ নিকট হতে নাযিল হয়েছে। আর তাঁকে পরিত্যাগ করে অন্য কোন পৃষ্ঠপোষক বা নেতার অনুসণ করো না।” –(সূরা আল আরাফ: ৩)
তৃতীয় আয়াতে আল্লাহর এই আইনগত প্রভুত্বকে অমান্য করাকে পরিষ্কার কুফরী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যথা : (আরবী ****************)
এই আয়াত হতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, আল্লাহ তায়ালার আইনগত প্রভুত্ব স্বীকার করারই নাম ঈমান ও ইসলাম এবং এটাকে অস্বীকার করারই নাম হচ্ছে পরিষ্কার কুফর।
রাসূলের পদমর্যাদা
দুনিয়াতে আল্লাহর এই আইনগত প্রভুত্বের প্রতিনিধি হচ্ছেন আল্লাহ প্রেরিত নবীগণ। অন্য কথায় আমাদের আইন রচয়িতা ও সংবিধানদাতা (Law Giver) আমাদের জন্য কি আইন এবং কি নির্দেশ দিয়েছেন তা জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে আম্বিয়ায়ে কেরাম। আর ইসলামে এই জন্যই আল্লাহর অনুমতিক্রমে দ্বিধা-সংকোচহীন মনোভাব নিয়ে তাঁদের অনুসরণ করার স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন শরীফে পরিষ্কার দেখা যায় আল্লাহর প্রেরিত প্রত্যেক নবীই উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন: (আরবী **********) “আল্লাহকে ভয় কর এবং আমাকে অনুসরণ কর ও আমাকে মেনে চল।” আর কুরআন মজীদ সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী নিয়ম হিসেবেই ঘোষণা করেছে:
(আরবী ************)
“আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাঁকে আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর অনুসরণ করার জন্যই পাঠিয়েছি। -(সূরা আন নিসা: ৬৪)
(আরবী ************)
“যে ব্যক্তি রাসূলের অনুসরণ করবে, সে মূলত আল্লাহরই অনুসরণ করলো।” –(সূরা আন নিসা: ৮০)
এমনকি বিতর্কমূলক ও মতবিরোধ সংকুল বিষয়ে রাসূলকে যারা “সর্বশেষ মীমাংসাকারী” বলে সমর্থন করে না কুরআন মজীদ তাদেরকে ‘মুসলমান’ গণ্য করতেই সুস্পষ্টরূপে অস্বীকার করেছে।
(আরবী ************)
“নয়, তোমার রব-এর শপথ, তারা কখনো ঈমানদার হতে পারে না, যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক বিতর্ক ও বিরোধমূলক বিষয়সমূহে –হে নবী তোমাকেই ‘সর্বশেষ বিচারক’ মানবে এবং তুমি যা কিছু মীমাংসা করে দিবে তা পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করে নিবে। আর তা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ ও শিরধার্য করে নিতে হৃদয় মনে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ তারা বোধ করবে না।” –(সূরা আন নিসা: ৬৫)
তারপর আবার বলছে: (আরবী ************)
“আল্লাহর রাসূল যখন কোন ব্যাপারে কোন ফায়ালা করেন, তখন মু’মিন পুরুষ এবং মু’মিন স্ত্রীর পক্ষে সেই সম্পর্কে নূতন করে কোন ফায়সালা করার কোন এখতিয়ার পাওয়ার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের অমান্য করে সে সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত।” –(সূরা আল আহযাব: ৩৬)
এই আয়াতসমূহ হতে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ইসলামে আইনগত প্রভুত্ব খালেছ, পরিপূর্ণ ও নিরংকুশভাবে একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট; এই সম্পর্কে শোবাহ-সন্দেহ করার অতপর আর একবিন্দু অবকাশ থাকে না।
রাজনৈতিক প্রভুত্বও একমাত্র আল্লাহর
প্রভুত্বের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে ফায়সালা হয়ে যাওয়ার পর আর একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আইনগত প্রভুত্ব যখন নিরংকুশভাবে আল্লাহর জন্য, তখন রাজনৈতিক প্রভুত্বে (Political Sovereignty) কার? নিরূপায়ভাবে এর উত্তর একটি এবং একটি উত্তরই এর হতে পারে। তা এই যে, ‘রাজনৈতিক প্রভুত্ব’ও একমাত্র আল্লাহর। কারণ আর্লাহ তায়ালার আইনগত প্রভুত্বকে মানব সমাজে রাজশক্তি বলে জারী এবং চালু (Force) করার জন্য যে এজেন্সীই প্রতিষ্ঠিত হবে, আইন ও রাজনীতির পরিভাষায় তাকে প্রভুত্বের মালিক কিছুতেই বলা যায় না। যে শক্তির কোন আইনগত প্রভুত্ব নেই এবং যার ক্ষমতা ও এখতিয়ার এক উচ্চতর আইন পূর্বেই সংকোচিত ও সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে এবং যার পরিবর্তন করার কোন ক্ষমতা তার নেই, সে যে কোন প্রকার প্রবুত্বের ধারক হতে পারে না এটাতে সুস্পষ্ট কথা। এখন প্রকৃত পদমর্যাদা কোন্ শব্দ দ্বারা বুঝানো যেতে পারে? কুরআন মজীদই এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। কুরআন মজীদ এই ‘এজেন্সী’কে ‘খিলাফত’ বলে অভিহিত করেছে। অর্থাৎ এই ‘এজেন্সী’ নিজে ‘উচ্চতর প্রভু’ নয়, বরং এটা ‘প্রকৃত ও উচ্চতর প্রভু’র প্রতিনিধি মাত্র।
সার্বজনীন খিলাফত
আল্লাহর প্রতিনিধি শব্দটি শুনার সংগে সংগেই ‘জিল্লুল্লাহ’ –আল্লাহর ছায়া, পোপবাদ এবং বাদশাহদের খোদায়ী অধিকার (Divine right of the Kings) প্রভৃতির কথা মনে জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলাম যে প্রতিনিধিত্বের কথা বলেছে, তাতে ঐ সবের কোন স্থান নেই। কুরআনের সিদ্ধান্ত এই যে, আল্লাহর এই প্রতিনিধিত্বের অধিকার বিশেষ কোন ব্যক্তি, পরিবার কিংবা বিশেষ কোন শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট হবে না। বস্তুতপক্ষে আল্লাহর সার্বভৌম প্রভুত্বের সমর্থক এবং রাসূলের মারফতে প্রাপ্ত আল্লাহর বিধানকে উচ্চতর ও চূড়ান্ত আইন মান্যকারী সকল মানুষই আল্লাহর দেয়া এই প্রতিনিধিত্বের সমান অধিকারী।
(আরবী ************)
“আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন যে, তিনি পৃথিবীতে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদের তাঁর প্রতিনিধি বা খলীপা নিযুক্ত করবেন।”
এই সার্বজনীনতার ভাবই ইসলামী খিলাফতকে রাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, পোপবাদ এবং পাশ্চাত্য ধারণা ভিত্তিক ধর্মরাষ্ট্র (Theocracy) প্রভৃতির পংকলিতা হতে পবিত্র রাখে এবং এক নিখুঁত ও পূর্ণ গণতন্ত্রে পরিণত করে। কিন্তু এটা পাশ্চাত্য গণতন্ত্র হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। পাশ্চাত্য গণতন্ত্র যেখানে জনগণকেই সার্বভৌম প্রভুত্বের ‘মালিক’ বলে মনে কর, যেখানে ইসলাম ‘মুসলিম’ জগণকে কেবল খিলাফতেরই অধিকার বলে অভিহিত করে, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনের জন্য পাশ্চাত্য গণতন্ত্রেও সর্বসাধারণ দেশবাসীর ভোট গ্রহণ করা এবং গণমতের শক্তিতেই এক একটি সরকার চলে; ইসলামী গণতন্ত্রও অনুরূপভাবে মুসলিম জনগণের নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণের পক্ষপাপতী। কিন্তু পার্থক্য এই যে, পাশ্চাত্য ধারণায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিরংকুশ, স্বেচ্ছাচারী এবং সীমাহীন শক্তির মালিক। পক্ষান্তরে ইসলামের ধারণা অনুসারে সার্বজনীন খিলাফত আল্লাহ তায়ালার আইনের অনুসরণকারী মাত্র।
দুই: রাষ্ট্রের কর্মসীমা
খিলাফতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা হতেই ইসলামী শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রের সীমার কথাটিও সুস্পষ্টরূপে জানতে পারা যায়। ইসলামী রাষ্ট্র যখন আল্লাহর খিলাফত, এখানে যখন একমাত্র আল্লাহরই আইনগত প্রভুত্ব স্বীকৃত, তখন এর ক্ষমতা ও এখতিয়ার অনিবার্যরূপেই আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যেই আবদ্ধ হতে পারে। শাসনতন্ত্রের দিক দিয়ে সেই সীমালংঘন করার কোন অধিকারই তার নেই। আল্লাহর আইনগত প্রভুত্বের নীতি হতেই একথা কেবল যুক্তি হিসেবেই যে বের হচ্ছে তা নয়, কুরআন মজদি নিজেও এটা সুস্পষ্টরূপে বলেছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে নানারূপে বিধি-নিষেধ উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে:
(আরবী ************) “এটা আল্লাহর নির্ধাতি সীমা, (ইহা লংঘন করা তো দূরের কথা) এর নিকটেও যেও না।”
(আরবী ************) “এটা আল্লাহর নির্ধাতি সীমা, এটা লংঘন করো না।”
(আরবী ************) “আল্লাহর নির্ধারিত সীমা যারা লংগন করে, তারা যালেম।”
অতপর কুরআন একটি স্থায়ী মূলনীতি হিসেবে এই হুকুম জারী করেছে:
(আরবী ************)
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর অনুগত হয়ে থাক, আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্য হতে (নির্বাচিত)রাষ্ট্রকর্তাকে মেনে চল। কোন বিষয়ে যদি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ হয়; তবে তা আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, অবশ্য যদি তোমরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাক।” (সূরা আন নিসা: ৫৯)
এই আয়াত অনুসারে রাষ্ট্রের আনুগত্য অনিবার্যরূপে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের অধীন হবে, নিরংকুশভাবে স্বাধীন হবে না। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা হতে মুক্ত হয়ে জনগণের নিকট আনুগত্যের দাবী করার কোন অধিকার রাষ্ট্রের নেই। এই নিগূঢ় তত্ত্বকথা নবী করীম (সা) এরূপ বলেছেন:” (আরবী ************) “আল্লাহর নাফরমানী বা আল্লাহদ্রোহিতা যে করবে, তার আনুগত্য কিছুতেই করা যাবে না।”
(আরবী ************) “সৃষ্টিকর্তার নাফরমানী করে সৃষ্টির আনুগত্য কিছুতেই করা যেতে পারে না।”
এ নীতিটির সাথে সাথে আর একটি মূলনীতিও এ আয়াত হতে নির্ধারিত হয়। তা এই যে, মুসলিমসমাজে যে কোন প্রকার মতবিরোধই হোক না কেন- ব্যক্তিগণের পরস্পরের মধ্যে হোক, বিভিন্ন দলের মধ্যে হোক, কিংবা রাষ্ট্র ও প্রজাসাধারণের মধ্যে হোক, অথবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যেই হোক, এর মীমাংসা করার জন্য আল্লাহ ও রাসূল প্রদত্ত চূড়ান্ত বিধানের দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ নীতিটির স্বকীয় স্বরূপ অনুসারেই রাষ্ট্রে মতদ্বৈততামূরক বিষয়সমূহের চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত অনুসারে একটি ব্যবস্থা স্থাপিত হওয়া একান্তই অপরিহার্য।
তিন: রাষ্ট্রের বিভাগসমূহের কর্মসীমা এবং এদের পারস্পরিক সম্পর্ক
রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ ও বিভাগের (Organs of the States) ক্ষমতা অধিকার ও এখতিয়ার প্রয়োগের সীমাও উপরোক্ত আলোচনা হতে পরিষ্কার রূপে জানা যেতে পারে।
আইন পরিষদের সীমা
আইন পরিষদ (Lagislature)-কে মুসলিম সমাজের প্রাচীন পরিভাষায় বলা হয় “আহলুল হাল্লে-অল-আক্দ” (আইন বিধিবদ্ধকারীগণ)। যে রাষ্ট্র আল্লাহ ও রাসূলের আইনগত প্রভুত্ব স্বীকৃতির ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে এর আইন পরিষদও যে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ মতৈক্যের বলেও কোন আইন পাশ করতে পারে না, তা একেবারে সুস্পষ্ট কথা। একটু আগেই আপনাদেরকে কুরআনের এই ফায়সালা শুনিয়েছি যে, “আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল যে বিষয়ে চূড়ান্তভাবে মীমাংসা করে দিয়েছেন সেই সম্পর্কে নূতন করে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার কোন ঈমানদার পুরুষ বা স্ত্রীর নেই।” এবং “যারা আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।” এসব সুস্পষ্ট নির্দেশের পরিষ্কার অর্থ এই যে, আল্লাহ এবং রাসূলের বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে কোন প্রকার আইন রচনা করার আইন পরিষদের কোনই অধিকারনেই। এবং বিধান পরিষদ এ ধরনের কোন আইন পাশ করিয়ে দিলেও তা নিশ্চিতরূপে শাসনতন্ত্রের সীমা বহির্ভূত (Ultra Vires of the Constitution) বলে অভিহিত হবে।
প্রসংগত এই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, এমতাবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্রে আইন পরিষদের করণীয় কি হবে? এর উত্তর এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে আইন পরিষদকে নিম্নলিখিতরূপে অনেক কাজই করতে হবে।
এক: যেসব ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসূলের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ এবং সিদ্ধান্ত রয়েছে, আইন পষিদ যদিও তাতে কোনরূপ রদ-বদল করতে পারে না, কিন্তু সেই বিধান ও নির্দেশসমূহকে কার্যকরী ও বাস্তবায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন ও পন্থা-প্রণালী (Rules and Regulations) নির্ধারণ করাও আইন পরিষদেরই কর্তব্য।
দুই: যেসব ব্যাপারে কুরআন হাদীসের একাধিক ব্যাখ্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার মধ্যে কোন্ ব্যাখ্যাটিকে আইন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, তা নির্দিষ্ট করা বিধান পরিষদেরই কাজ। এজন্য আইন পরিষদে অনিবার্যরূপে এমন সব লোক থাকতে হবে, আল্লাহর বিধানের ব্যাখ্রা ও বিশ্লেষণের দক্ষতা এবং যোগ্যতা যাদের আছে। অন্যথায় ওসব বিধানের ভুল ব্যাখ্যা ইসলামী শরীয়াতকে বিকৃত ও পরিবর্তিত করে দিতে পারে। কিন্তু মূলত এ প্রশ্নটি ভোট দাতাদের নির্বাচনী দৃষ্টিভংগী ও যোগ্যতার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। নীতিগতভাবে একথা স্বীকার করতে হবে যে, আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে একটিকে গ্রহণ করা ও উহাকে বিধিবদ্ধ করে নেয়ার অধিকার আইন পরিষদের থাকবে। ফলে আইন পরিষদের গৃহীত ব্যাখ্যাই আইন হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে আইন পরিষদ আল্লাহর বিধানের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যেন এটাকে আমূল পরিবর্তন করে দিতে উদ্ধত না হয় সেদিকে বিশেষ সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে।
তিন: যেসব ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসূলের কোনই নির্দেশ বা বিধান নেই, সেসব ব্যাপারে ইসলামের সাধারণ নীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে নূতন আইন রচনা করা অথবা সেই সম্পর্কে ‘ফিকাহ’র কিতাবসমূহে পূর্ব হতেই প্রণীত কোন আইন বর্তমান থাকলে তার মধ্যহতে কোন একটিকে গ্রহণ করাই তথায় আইন পরিষদের কাজ।
চার: যেসব ব্যাপারে নীতিগত কোন নির্দেশও পাওয়া যায় না, সেই সম্পর্কে মনে করতে হবে যে, এ বিষয়ে আইন রচনার অধিকার আল্লাহ তায়ালা আমাদের দিয়েছেন। কাজেই এসব ব্যাপারে আইন পরিষদ যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু তাতেও এই শর্ত মনে রাখতে হবে যে, এ আইন যেন শরীয়াতের কোন হুকুম বা নীতির বিরোধী বা তার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। এ সম্পর্কে “যা নিষিদ্ধ নয়, তা মোবাহ” কথাটি মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
এই চারটি নিয়ম রাসূলের সুন্নাত, খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা এবং মুজতাহিদদের অভিমত হতে আমরা নিসন্দেহে জানতে পারি। এমন কি, প্রয়োজন হলে এর প্রত্যেকটি নিয়মের উৎস কি তাও বলতে পারি। কিন্তু আমার মনে হয়, ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ কেউ ভাল করে হৃদয়ংগম করে নিলে পর তার সাধারণ জ্ঞানও (Common Sense) তাকে বলে দিবে যে, এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন পরিষদের কর্মসীমা উক্তরূপ হওয়া শুধু বাঞ্ছনীয়ই নয়- অবশ্যম্ভাবীও।
শাসন বিভাগের কর্মসীমা
অতপর শাসন বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করব। একটি ইসলামী রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের (Executive) আসল কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর বিধি-নিষেধ জারী ও কার্যকরী করা এবং তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য অনুকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। বস্তুপক্ষে এই বিশিষ্টতাই তাকে একটি অমুসলিম রাষ্ট্র হতে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিষিক্ত ও উদ্ভাসিত করে। তা না হলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং একটি কাফের রাষ্ট্রে কোন পার্থক্য থাকে না। ‘শাসন বিভাগ’ সম্পর্কে কুরআন মজীদ ‘উলিল আম’ এবং হাদীস শরীফে ‘ওমারা’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। কুরআন ও হাদীস উভয়েই এদের ‘আদেশ শোনা এবং মানার (Obedience) সম্পর্কে জোর আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, তারা যতক্ষণ আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের অনুসরণ করবে এবং তা লংঘন করে নাফরমানী, বিদয়াত এবং দ্বীন ইসলামে তার সম্পূর্ণ বিরোধী নীতির প্রচলন করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ না করবে ঠিক ততক্ষণই তাদের আনুগত্য করা যাবে। কুরআন মজীদ এই সম্পর্কে অতি সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে:
(আরবী ********)
“কখনো এমন কোন ব্যক্তির আনুগত্য করবে না। যার অন্তরে আমার (আল্লাহর) স্মরণ নেই এবং যে নিজের নফসের খাহেশ-লালসা ও বাসনা চরিতার্থ করার পথই অবলম্বন করেছে আর সীমালংঘন করাই যার অভ্যাস।” –(সূরা আল কাহাফ: ২৮)
(আরবী ********)
“যারা আল্লাহ নির্ধারিত সীমালংঘন করে, তারাই পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে- শান্তি, সংগঠন ও স্থৈর্য বিধানের কোন কাজই করে না, তোমরা তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মাত্রই স্বীকার করো না।”
নবী করীম (সা) আরো সুস্পষ্টভাবে একথাটি বলেছেন:
(আরবী ********)
“তোমাদের উপর যদি কোন নাক কাটা ক্রীতদাসকেও আমীর বা ‘রাষ্ট্র পরিচালক’ নিযুক্ত করা হয় এবং সে যদি আল্লাহর বিধান অনুসারে তোমাদের নেতৃত্ব ও শাসনকার্য পরিচালনা করে, তবে তোমরা তার ‘কথা’ শোন এবং মান।” –(মুসলিম)
(আরবী ********)
“মুসলিম ব্যক্তিকে সবসময় আদেশ পালন ও বিধান অনুসরণ করেই চলতে হবে, চাই সাগ্রহেই করুক, কিংবা বাধ্য হয়ে- যতক্ষণ না তাকে কোন পাপ কাজের আদেশ করা হবে। কিন্তু কোন পাপ কাজের হুকুম দেয়া হলে তা শোনা এবং মানা যেতে পারে না।” –(বুখারী, মুসলিম)
(আরবী ********)
“পাপ ও নাফরমানীর কাজে আনুগত্য করতে হয় না। কেবল ন্যায় ও যুক্তিসংগত কাজেই আনুগত্য করতে হয়।” –(বুখারী, মুসলিম)
(আরবী ********)
“আমাদের উপস্থাপিত ইসলামী জীবনব্যবস্থায় যে কোন নূতন নিয়ম-পদ্ধতি বা মতবাদের প্রচলন করবে- যা তার সামগ্রিক প্রকৃতির সংগে কিছুমাত্র খাপ খায় না, তা অবশ্যই প্রত্যাহৃত হবে।” –(বুখারী, মুসলিম)
(আরবী ********)
“কোন বেদয়াতী- ইসলামী জীবনব্যবস্থায় কোন অনৈসলামিক রীতি পদ্ধতির উদ্ভাবনকারীকে যে সম্মান প্রদর্শন করবে সে ইসলামকে মূলোৎপাটনে সাহায্য করলো। -(বুখারী)
এসব সুস্পষ্ট উক্তি ও আলোচনার পর এই সম্পর্কে আর এক বিন্দু শোবাহ-সন্দেহ বা অস্পষ্টতাও অজ্ঞতা থাকতে পারে না। শাসনকর্তৃপক্ষ এবং তার শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা কার্যের সীমা ইসলামে যে কি নির্ধারিত করা হয়েছে তা কুরআন ও হাদীসের উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ হতে স্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়।
বিচার বিভাগের কর্মসীমা
অতপর বিচার বিভাগের (Judiciary) কথা। ইসলামী ঐতিহ্যের প্রাচীন পরিভাষায় এটা প্রায় ‘কাজা’র (****) সমার্থবোধক। বিচার বিভাগের এখতিয়ার ও কর্মসীমাও আল্লাহ সার্বভৌম প্রভুত্বের নীতি মেনে নেয়ার পর আপনা আপনিই নির্ধারিত হয়। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে যখনি কোন রাষ্ট্র কায়েম হয়, স্বয়ং নবীগণই তার সর্বপ্রথম বিচারপতি হয়ে থাকেন। আল্লাহর আইন অনুযায়ী জনগণের মধ্যে বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার প্রতিষ্ঠা করাই তাঁদের কাজ হয়। নবীদের পরে যাঁরা এ দায়িত্বে অভিষিক্ত হবেন, তাঁরাও নিজেদের বিচারকার্যের ভিত্তি আল্লাহ ও রাসূল হতে প্রাপ্ত আইনের উপর স্থাপিত করতে বাধ্য হবেন- কারণ তাছাড়া আর কোনই উপায় হতে পারে না। কুরআন মজীদের ‘সূরায়ে মায়েদা’র দুই রুকূ’ ব্যাপী এ বিষয়েরই আলোচনা হয়েছে। তাতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আমি তাওরাত নাযিল করেছি- তাতে হেদায়াত ও উজ্জল আলোকচ্ছটা ছিল। এবং বনী ইসরাঈলের সকল নবীই আর তাঁদের পর সকল রব্বানী (আল্লাহওয়ালা) ও পণ্ডিতগণ সেই অনুসারেই ইহুদীদের পারস্পরিক ব্যাপারসমূহের মীমাংসা করতেন।… তাদের পরে আমি ঈসা বিন মারইয়ামকে প্রেরণ করেছি এবং তাঁকে হেদায়াত ও উজ্জল আলোক বিশিষ্ট ইঞ্জীল কিতাব দিয়েছি, অতএব ইঞ্জিল কিতাবধারীদের কর্তব্য আল্লাহ প্রদত্ত ইঞ্জীলের হেদায়াত অনুসারে ফায়সালা করা।”
এই ঐতিহাসিক বিবরণ দানের পর আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (সা)-কে সম্বোধন করে বলছেন- আমি এ কিতাব কুরআন মজীদ ঠিক ঠিকভাবে ও পরম সত্যতা সহকারে তোমাদের প্রতি নাযিল করেছি।
(আরবী ********)
“অতএব তুমি জনগণের মধ্যে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে বিচার ফায়সালা কর। এবং তোমাদের নিকটস্থ এই মহান সত্যকে উপেক্ষা করে মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা ও মানব বুদ্ধিতে রচিত বিধানের অনুসরণ করো না।” –(সূরা আল মায়েদা: ৪৮)
সামনে আরো অনেক কিছু বলার পর নিম্নলিখিত আয়াত দ্বারা এই প্রসংগ সমাপ্ত করেন:
“মানুষ কি এর পরিবর্তে জাহেলী যুগের বিচার-ব্যবস্থা দাবী করে? অথচ আল্লাহর প্রতি যাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে, তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া উত্তম বিচারক আর কে হতে পারে?” –(সূরা আল মায়েদা: ৫০)
এই দীর্ঘ আলোচনা প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা তিনবার বলেছেন- যারা আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে বিচার-ফয়সালা করে না তারাই কাফের… তারাই যালেম…. তারাই ফাসেক।
আল্লাহ তায়ালার এই কঠোর শাসনবাণী উল্লেখের পর ইসলামী রাষ্ট্রের আদালতসমূহের কর্তব্য সম্পর্কে- উহা আল্লাহর আইন জারী করার জন্য কায়েম হয়, না এর বিপরীত ফায়সালা করার জন্য- সে সম্পর্কে আর কিছুই বলার আবশ্যক হবে না আশা করি’।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্ক
এখন ইসলামী রাষ্ট্রের উল্লিখিত তিনটি বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্ক কি হবে এই প্রশ্নটিই আলোচিতব্য থেকে যায়। কিন্তু এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের নির্দেশ কিছুই পাওয়া যায় না; অবশ্য নবী করীম(সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের Convention হতে আমরা পরিপূর্ণ আলো ও পথনির্দেশ লাভ করতে পারি। এই উৎস হতে আমরা এ তথ্য লাভ করতে পারি যে, রাষ্ট্রপতি শুধু রাষ্ট্রপতি হওয়ার কারণেই এ তিন বিভাগেরই উপর প্রাধান্য লাভ করবেন। নবী করীম(সা) এই মর্যাদায়ই অভিষিক্ত ছিলেন; খোলাফায়ে রাশেদীনও তখন এ মর্যাদাই পেয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পরে সেকালেও এ তিনটি বিভাগই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল। তখনকার যুগে ‘আহলুল হাল্লে-অল-আকদ” সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। খিলাফতে রাশেদার যুগে তাঁদের পরামর্শে শাসন সম্পর্কীয় ব্যাপার পরিচালিত হতো এবং আইন সম্পর্কীয় ব্যাপারসমূহের ফায়সালাও তাদের পরামর্শক্রমে সম্পন্ন হতো। শাসন শৃংখলা স্থাপনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ আলাদা ছিলেন, আদালতের বিচার কার্যে তাঁদের হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার ছিল না। পক্ষান্তরে কাজী (জজ ও ম্যাজিসেস্ট্রেট) স্বতন্ত্র ছিলেন, শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে তাদের উপর কোন দায়িত্ব ছিল না।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ কিংবা শাসন শৃংখলা ও আইন সংক্রান্ত ব্যাপারসমূহের সুষ্ঠু সমাধান করার যখনি প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত, খোলাফায়ে রাশেদীন “আহলুল হাল্লে-অল-আকদ” ডেকেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ চাইতেন। এবং পরামর্শ গ্রহণ কার্য সম্পন্ন হয়ে গেলে তাদের দায়িত্বও পূর্ণ হয়ে যেত।
শাসনকার্য পরিচালনের দায়িত্ব সম্পন্ন অফিসারগণ খলীফার অধীন ছিলেন। খলীফাই তাঁদেরকে নিযুক্ত করতেন এবং তাঁরই নির্দেশ অনুসারে তাঁরা শাসনকার্য পরিচালিত করতেন।
কাজীদেরকেও (বিচারক) খলীফাই নিযুক্ত করতেন; কিন্তু একবার কাজী নিযুক্ত হওয়ার পা তাঁর বিচার ও রায়দানকে কোনরূপ প্রভাবান্বিত করার কোন অধিকারই খলিফার ছিল না। এমনকি, খলিফার ব্যক্তিগত ব্যাপারেই হোক কিংবা শাসন বিভাগের প্রধান হওয়ার হিসেবেই হোক, তাঁর বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ হলেও তাঁকেও ‘কাজীদের’ সামনে জবাবদিহি করার জন্য সাধারণ প্রজার মতই উপস্থিত হতে হতো।
একই সময় একজন ব্যক্তি শাসক হয়েছেন আর বিচারকও হয়েছেন এমন কোন উদাহরণ ইসলামের এই স্বর্ণ যুগে দেখতে পাওয়া যায় না। অথবা কোন সরকারী পদস্থ কর্মচারী বা গভর্নর, কিংবা স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান কোন ‘কাজীর’ আদালতী ফায়সালার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছেন বলেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অনুরূপভাবে দেওয়ানী ফৌজদারী মামলা মোকদ্দমায় জবাবদিহি করতে অথবা আদালতে হাজীর হওয়ার বাধ্যবাধকতা হতে কোন বড় ও প্রধান ব্যক্তিকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে বলেও কোন উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে না।
ইসলামী হুকুমাতের বিচার নীতি এই অতীত উদাহরণের ভিত্তিতে বর্তমানকালে প্রয়োজনানুসারে বিস্তারিত বিধি-ব্যবস্থা তৈয়ার করার ব্যাপারে কিছুটা রদবদল করা যেতে পারে। কিন্তু এর মূলনীতি যথাযথভাবে বর্তমানও অপরিবর্তিত থাকবে। তাতে যে ধরনের আংশিক ও খুটিনাটি ব্যাপারে সামান্য রদবদল করা যেতে পারে, তা এরূপ- যথা: রাষ্ট্রপ্রধানের শাসনতন্ত্র ও আদালত সম্পর্কীয় ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে খোলাফায়ে রাশেদীন যতখানি বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাভাজন ছিলেন, তদনুরূপ রাষ্ট্রপ্রধান বর্তমান যুগে খুবই দুর্লভ সন্দেহ নেই। এজন্য এ যুগে আমরা রাষ্ট্রপ্রধানের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার উপর অনেক বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারি। অন্যথায় তাঁর ডিক্টেটর হওয়ার অবকাশ থেকে যায়। তদনুরূপ, মামলা মোকদ্দমাও সরাসরি তাঁর সামনে পেশ না করা এবং সেই সম্পর্কে তাঁকে কোন রায়দানের সুযোগ না দেয়াও বর্তমান সময় সংগত হতে পারে। তা করলে রাষ্ট্রপ্রধান কোনরূপ অবিচার করার সুযোগ পাবে না।
[একথা বলার পরই নেতৃবৃন্দের মধ্য হতে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন যে, আপনার এ মতের প্রমাণ বা উৎস কি? এর উত্তরে মাওলানা মওদূদী বলেন:]
আমার একথার দলীল এই যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন ছিল। আর রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যক্তিত্বে এই উভয় ক্ষেত্রের ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে সে যুগে শরীয়াতের বিশেষ কোন দলীল-প্রমাণের বলে সমন্বিত করা হয়েছিল না; বরং তাঁদের প্রতি জনগণের এত গভীর আস্থা ও ঐকান্তিক বিশ্বাস ছিল যে, তারা নিসন্দেহে মনে করতো যে, এরা বিচারক হিসেবে বিচারালয়ে আসীন হয়ে নিজেদের শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারসমূহকে কিছুমাত্র প্রভাবশীল হতে দিবেন না। উপরন্তু খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রতি সেকালের জনগণের এতদূর আস্থা ছিল যে, তারা নিজেদের খলীফাকেই “চূড়ান্ত মীমাংসাকারী” হিসেবে পাবার দাবী করতো, যেন অন্য কোথায়ও বিচার না লেও তার নিকট অবশ্যম্ভাবীরূপে সুবিচার পেতে পারে। বর্তমান যুগে এরূপ অনাবীল ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি যদি আমরা লাভ করতে না পারি তবুও রাষ্ট্রপ্রধানকেই প্রধান বিচারপতি ও শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ এখতিয়ার সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী মর্যাদা সম্পন্ন মনে করতে হবে, ইসলামী শাসনতন্ত্রের কোন ধারাই আমাদেরকে সেই জন্য কিছু মাত্র বাধ্য করে না।
অনুরূপভাবে এ ব্যাপারে আমরা যেসব পরিবর্তন করতে পারি তা এই যে, আহলুল হাল্লে-অল-আকদের (আরবী *******) বা পার্লামেন্টের নির্বাচন নীতি এবং তাদের মজলিসী নিয়ম-কানুন আমরা এ যুগের প্রয়োজন অনুসারে প্রণয়ন করতে পারি। আদালতে বিভিন্ন শ্রেণী বিশেষ ক্ষমতা এবং শুনানীর সীমা কর্মসীমাসহকারে নির্দিষ্ট করে দিতে পারি। এরূপে আরো অনেক ব্যাপারে আংশিক পরিবর্তন করা যেতে পারে।
এখানে আরো দু’টি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এদের জবাব দেয়াও অপরিহার্য। প্রথম এই যে, বিচার বিভাগ “আহলুল হাল্লে-অল-আকদের” বা পার্লামেন্টের গৃহীত কোন আইনকে কুরআন ও সুন্নাতের খেলাফ হওয়ার কারণে বাতিল করতে পারে কি? এর উত্তর প্রসংগে আমাকে বলতে হবে যে, এ সম্পর্কে শরীয়াতের কোন নির্দেশ আছে বলে আমার জানা নেই। খিলাফতে রাশেদার যুগে বিচার বিভাগের এরূপ কোন অধিকার বা ক্ষমতা ছিল না। কিংবা কোন কাজী এরূপ করেছে এমন কোন নজীর পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার মতে এর কারণ শুধু এই যে, সেকালের (আহলুল হাল্লে-অল-আকদ বা) পরামর্শ সভার লোকগণ কুরআন-হাদীসে গ ভীর ব্যুৎপত্তি রাখতেন। সর্বোপরি স্বয়ং খোলাফায়ে রাশেদীন সম্পর্কে জনগণের এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁদের বর্তমান থাকাকালে কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত কোন কাজই হতে পারবে না। বর্তমান যুগেও কোন আইন পরিষদ কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত কোন আইন পাশ করবে না বলে যদি নিশ্চিন্ত ও নিশ্চিত হওয়ার কোন ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে করা সম্ভব হয় তবে আজও বিচার বিভাগকে আইন পরিষদের সকল ফায়সালা মানতে বাধ্য করা যেতে পারে। কিন্তু তদ্রূপ নির্ভরযোগ্য কোন ব্যবস্থা বর্তমানে যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে নিরুপায় হয়েই বিচার বিভাগকে আইন পরিষদের গৃহীত কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত আইনসমূহ বাতিল ঘোষণা করার অধিকার দিতেই হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, ইসলামে আইন পরিষদের প্রকৃত মর্যাদা ও সঠিক স্থান কি? এটা কি রাষ্ট্রপ্রধানের নিছক মন্ত্রণা সভা, রাষ্ট্রপ্রধান যার পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বর্জন করার স্বেচ্ছামূলক অধিকারে অধিকারী? না রাষ্ট্রপ্রধান আইন পরিষদের সংখ্যাগুরু কিংবা সর্বমসম্মতিক্রমে গৃহীত ফায়সালাসমূহ গ্রহণ করতে অবশ্যই বাধ্য থাকবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর প্রসংগে কুরআন মজীদ শুধু এটাই বলছে যে, মুসলমানদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। যথা (আরবী ***********) “তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।” এবং নবী করীম(সা)-কে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই সম্বোধন করে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন:
(আরবী ***********)
“সামগ্রিক ব্যাপারসমূহে তাদের সাথে পরামর্শ কর। (পরামর্শের পর) যখন তুমি কোন কাজের সংকল্প করবে তখন আল্লাহর উপর ভরসা করেই কাজ শুরু কর।” –(সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)
এ দু’টি আয়াতই সামগ্রিক ব্যাপারসমূহে পরামর্শ করাকে অপরিহার্য করে দিয়েছে। এতে রাষ্ট্রপ্রধানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পরামর্শের ফলে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছলে পর আল্লাহর উপর ভরসা করেই তদানুযায়ী কাজ শুরু করে দেয়া অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আমাদের মূল প্রশ্নের কোন জবাব ইহা হতে পাওয়া যাচ্ছে না। হাদীস হতেও এর নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত কোন জবাব পাওয়া যায় না। অবশ্য খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা হতে ইসলামী আইনজ্ঞগণ সাধারণত এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, রাষ্ট্রপ্রধানই গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য মূলগতভাবে দায়ী এবং পরামর্শ সভার সাথে পরামর্শ করতে সে বাধ্য বটে, কিন্তু এর সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুর কিংবা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে রাষ্ট্রপ্রধান (সবসময়) বাধ্য থাকবেন না। অন্য কথায়, রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘ভেটো’ প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এরূপ অস্পষ্টভাবে একথাটি বললে বড়ই ভ্রান্তিবোধের আশংকা থেকে যায়। কারণ, যে ধরনের পরিবেশ সামনে রেখে আজ এ মতটি প্রকাশ করা হচ্ছে, লোকেরা সেই পরিবেশকে সামনে রেখে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করে না বরং বর্তমান পরিবেশেই এর সামঞ্জস্য দেখতে চায় ফলে কথাটি সম্যকরূপে হৃদয়ংগম করতে অসমর্থ হয়ে নানারূপ সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করে। খিলাফতে রাশেদার যুগে যাদেরকে “আহলুল হাল্লে-অল-আকদে” বা পরামর্শ সভার সদস্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, তারা ভিন্ন ভিন্ন পার্টি বা দলে বিভক্ত ও পার্টিনীতিতে সংগঠিত ছিল না। বর্তমান যুগের আইন পরিষদসমূহ যেসব পার্লামেন্টারী নিয়ম-কানুননে শক্ত বাঁধা হয়ে থাকে, সেকালের পরামর্শ সভা সেরূপ ছিল না। তারা প্রথমে আলাদা আলাদাভাবে নীতি নির্ধারণ করে,কার্যসূচী নির্দিষ্ট করে এবং পার্টি মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মজলীসে শুরা বা পার্লামেন্টে আসতো না। পরামর্শস্থলে এসে বসতো। খলিফা স্বয়ং তাদের মজলিসে উপস্থিত থাকতেন। আলোচ্য বিষয় তথায় পেশ করা হতো, স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে সকল দিক দিয়েই স্বাধীনভঅবে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হতে পারতো। তারপর উভয় পক্ষের যুক্তি-প্রমাণ তুলনা করে খলীপা নিজের প্রমাণসহ নিজ সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিতেন। সাধারণত খলীপার এ মত সমগ্র মজলিসেই দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিত। কোন কোন সময় কিছুসংখ্যক লোককে খলীফার মতকে সম্পূর্ণ ভুল বা “সমর্থনঅযোগ্য” বলে কেউ মনে করতো না, বরং এটাকে আপেক্ষিকভাবে কম গরুত্বপূর্ণ (আরবী ***) মনে করতো। এবং ফায়সালা একটি হয়ে যাওয়ার পর কাজ অন্তত সেই অনুসারেই সকলে করতো। পরামর্শ সভায় ভোট গণনা অপরিহার্য হয়েছে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কোন নজীরই খোলাফায়ে রাশেদীনের পূর্ণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। পরামর্শদাতাদের মধ্যে কোন বিষয়েই এবং কখনইতেমন মতবিরোধের সৃষ্টি হয়নি। পক্ষান্তরে, খলীফা পরমার্শ সভায় প্রায় সম্মিলিত ঐকমত্যের বিরুদ্ধে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, খিলাফাতে রাশেদার ইতিহাসে তেমন ঘটনাও মাত্র দু’বার ঘটেছিল। একবার উসামা বাহিনী প্রেরণের ব্যাপারে। এবং দ্বিতীয়বার মুর্তাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার ব্যাপারে কিন্তু উভয় ঘটনাতেই সাহাবায়ে কিরাম খলীফার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন এবং এ কারণে নয় যে, ইসলামী শাসনতন্ত্র খলীফাকে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করার অধিকার দিয়েছিল আর শাসনতান্ত্রিক কারণে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁরা খলীফা সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য ছিলেন। বরং প্রকৃত ব্যাপার এই যে, খলীফা আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর রাজনতি জ্ঞান, দূরদর্শীতা িএবং ধর্মভিত্তিক অন্তর্দৃষ্টির প্রতি সাহাবায়ে কিরামের পূর্ণ আস্থা বিদ্যমান ছিল। তাঁরা যখন দেখলেন যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা) তাঁর নিজের মতের সত্যতা সম্পর্কে পূর্ণ নিসংশয় ও দৃঢ় বিশ্বাসশীল এবং দ্বীন ইসলামের কল্যাণ দৃষ্টিতেই এ মতের প্রতি তিনি এতবেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তখন তাঁরা উদারচিত্তে তাঁর মতের স্বপক্ষে নিজের মত প্রত্যাহার করলেন। এমনকি, পরে তাঁর মতের সত্যতা ও সুষ্ঠতার প্রকাশ্যভাবে প্রশংসা পর্যন্ত করছিলেন। তাঁরা স্পষ্টভাষায় স্বীকারও করেছেন যে, এই সংকট মুহূর্তে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) যদি দৃঢ়তা ও স্থৈর্যের পরাকাষ্ঠা না দেখাতেন, তবে ইসলামেরই চিরতরে সমাপ্তি ঘটে যেতো, তাতে সন্দেহ নেই। মুর্তাদদের সম্পর্কে হযরত উমর ফারুক (রা) যিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর মতের সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠভাবে বিরোধিতা করেছেন- উদাত্ত কণ্ঠে বলে বেড়াতেন যে, আল্লাহ তায়ালা আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর হৃদয় এ কাজের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং আমি জানতে পেরেছি যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) যে ফায়সালা করেছিলেন তাই তার প্রকৃত সত্য।
ইসলামে ‘ভেটো’ প্রয়োগের এই ধারণা মূলত কোন পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য থাকার জরুন দৃষ্টি হয়েছে, তা উপরোক্ত বিশ্লেষণ হতে নিসন্দেহে জানা যায়। শু’রা কর্মনীতি ও এর অন্তর্নিহিত ভাবধারা এবং শু’রা সদস্যদের মনোবৃদ্ধি ও স্বভাব পৃকতি খিলাফতে রাশেদার অনুরূপ যদি সত্যিই হয়, তবে উক্তরূপ কর্মনীতি অপেক্ষা উত্তম ও উন্নত কর্মপন্থা আর কিছুই হতে পারে না। এই কর্মপন্থাকে যদি এর অনিবার্য পরিণতি ও শেষ মনজিল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়, তবে খুব বেশী বললেও এটাই বলা যায় যে, এ ধরনের মজলিসে শু’রায় রাষ্ট্রপ্রধান ও পরিষদ সদস্যগণ যদি নিজ নিজ মত অন্যের স্বপক্ষে প্রত্যাহার করতে প্রস্তুত না হয় বরং নিজের মতের উপর যদি জিদ ধরে বসে তাহলে তখন গণভোট (Referendum) গ্রহণ করা যাবে। তারপর যার মতকে জনমত বাতিল করে দিবে তাকে ইস্তফা দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেইরূপ মনোবৃত্তি ও আভ্যন্তরীন ভাবধারা সৃষ্টি করতে এবং সেই ধরনের মজলিসে শু’রা গঠন করা যতদিন না সম্ভব হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত শাসন বিভাগকে আইন পরিষদের সংখ্যাগুরুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।
চার: রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
এখন আমরা আলোচনা করে দেখব যে, ইসলাম কোন্ সব মূলগত উদ্দেশ্য (Objections) সামনে রেখে ইসলামী রাষ্ট্রকে কাজ করতে বলে। কুরআন মজীদ ও সুন্নাতে রাসূলে এই উদ্দেশ্যসমূহের নিম্নলিখিতরূপে বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছে: (আরবী **********)
“আমি আমার রাসূলগণকে উজ্জল যুক্তি-প্রমাণ সহকারে পাঠিয়েছি। সেই সংগে কিতাব ও ‘মীজান’ নাযিল করেছি- যেন মানুষ ইনসাফ ও সুবিচার কায়েম করতে পারে।” –(সূরা আল হাদীদ: ২৫)
অন্যত্র বলা হয়েছে: (আরবী **********)
“(যেসব মুসলমানকে আজ কাফেরদের সাথে সংগ্রাম করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে) এদেরকে যদি আমি পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান করি, তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ হতে লোকদের বিরত রাখবে।” –(সূরা আল হাজ্জ: ৪১)
হযরত নবী করীম (সা) বলেন: (আরবী **********)
“আল্লাহ তায়ালা রাষ্ট্র ক্ষমতার সাহায্যে এমন কাজের পথ রুদ্ধ করেন যা কুরআনের দ্বারা বন্ধ করেন না।” –(তাফসীরে ইবনে কাসীর)
অর্থাৎ যেসব অনুচার ও পাপপ্রথা মাত্র কুরআনের উপদেশ ও যুক্তি বিন্যাসে বন্ধ হয়ে যায় না, তা নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করা অপরিহার্য।
ইহা হতে জানা গেল যে, মানবতার কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ইসলাম যেসব কল্যাণমূলক কার্যসূচী উপস্থাপিত করেছে, রাষ্ট্রের সমগ্র উপায়-উপাদান ও উপকরণের সাহায্যে তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করাই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য। নিছক শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিছক রাজ্যের সীমান্ত রক্ষার ব্যবস্থা এবং কেবল জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হতে পারে না। ইসলাম মানবতাকে যেসব মংগল ব্যবস্থায় সুসংগঠিত ও সমৃদ্ধ করে তুলতে চায় সেগুলোর উন্নতি বিধান করা এবং ইসলাম মানবতাকে যেসব অন্যায় ব্যবস্থা ও পাপ প্রথা হতে পবিত্র করতে চায় তাকে নির্মূল করতে- নিস্তেজ ও দুর্বল করতে সকল শক্তি নিয়োজিত করাই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিস্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্যই ইসলামী রাষ্ট্রকে একটি অমুসলিম রাষ্ট্র হতে সর্ম্পূণ স্বতন্ত্র ও পৃথক করে দেয়।
পাঁচ: সরকার কিভাবে গঠন করতে হবে
এই মৌলিক গুরুত্ব সম্পন্ন বিষয়গুলোর বিশ্লেষণের পর আমাদের সামনে একটি পঞ্চম প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। উরোল্লিখিত মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাকে পরিচালিত করার জন্যসরকার গঠন কিভাবে সম্পন্ন হবে? এ প্রসংগে রাষ্ট্র প্রধানের (Head of the State) –ইসলামী পরিভাষা অনুসারে ইমাম, আমীর বা খলীফা নিয়োগের ব্যাপারটি সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্ব সম্পন্ন। এ বিষয়ে ইসলামের নির্ধারিত নীতি হৃদয়ংগম করার জন্য ইসলামের প্রাথমিককালে ইতিহাস পর্যালোচনা করা আমাদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র প্রধানের নির্বাচন
আমাদের বর্তমান ইসলামী সমাজের সূচনা মক্কা নগরীর কাফেরী সমাচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে হয়েছিল একথা কারো অবিদিত নয় এবং এই প্রতিকূল পরিবেশের সাথে প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে ইসলামী সমাজ সর্বপ্রথম প্রতিষ্টিঠত করেছিনে হযরত মুহাম্মাদ (সা) তাও সর্বজনবিদিত। এই ইসলামী সমাজ যখন আভ্যন্তরীন সংগঠন ও রাজনৈতিক স্বাধীনতায় উন্নতি লাভ করে একটি রাষ্ট্র রূপে বাস্তবায়িত হওয়ার মঞ্জিল পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল, তখন এর প্রথম ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ও তিনিই ছিলেন। কিন্তু তিনি কারো কর্তৃক নির্বাচিত হননি, সরাসরিভাবে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক এ কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
দীর্ঘ দশ বছর কাল পর্যন্ত নবী করীম (সা) এই রাষ্ট্রের নেতৃত্বদানের কর্তব্য যথাযথরূপে পালন করার পর তাঁর ‘শ্রেষ্ঠতম বন্ধুর’ (আল্লাহর) সাতে মিলিত হলেন। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট, নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট কোন নির্দেশ দিয়ে যাননি। তাঁর এই নৈঃশব্দে এবং কুরআন মজীদের বাণী: (আরবী **********) (তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শে সম্পন্ন হয়) অনুসারে সাহাবায়ে কিরাম বুঝতে পারলেন যে, নবী করীম (সা)-এর পর রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের দায়িত্ব মুসলমানদের নিজস্ব নির্বাচনের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এবং এই নির্বাচন মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমেই সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। [মুসলমানদের মধ্যে শীয়া মতাবলম্বীগণ মনে করেন যে, নবীদের ন্যায় ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব পদে নিযুক্তিও আল্লহর তরফ হতে হয়ে থাকে। কিন্তু এই মতবিরোধ সম্প্রতি শেষ হয়ে গিয়েছে। তারা এই ভাবে যে, শীয়াদের মতে দ্বাদশ ইমামের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর তাঁর পুনরাবিভাব পর্যন্ত ইমামের পদ শূন্য রয়েছে। কাজেই বর্তমানে মুসলমানদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ একজন আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত নয় এমন ব্যক্তির হাতেই ন্যাস্ত থাকবে।] তাই প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিকের নির্বাচন প্রকাশ্য জনসম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
অতপর তাঁর অন্তিম সময় যখন উপস্থিত হলো, তখন তাঁর দৃষ্টিতে খিলাফতের জন্য সর্বাপেক্ষা যোগ্যতম ব্যক্তি যদিও হযরত উমর ছিলেন, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীকে তিনি নিযুক্ত করলেন না। তিনি প্রধান সাহাবাদের এক একজনকে ডেকে তাঁর মত গ্রহণ করলেন। তারপর হযরত উমর (রা)-এর স্বপক্ষে তাঁর নিজের শেষ উপদেশ লিখে দিলেন। রোগাক্রান্ত অবস্থায়ই তিনি মসজিদ সংলগ্ন কুঠরীর দুয়ার হতে মুসলমানদের সম্মেলনকে সম্বোধন করে বক্তৃতা করলেন। তিনি বললেন:
(আরবী **********)
“জনমণ্ডলী! আমি যাকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনীত করবো, তোমরা কি তাকে সমর্থন করবে? আল্লাহর শপথ, চিন্তু ও গবেষণা করে মত নির্ধারণে আমি বিন্দু মাত্র কসুর করিনি। আমি আমার কোন আত্মীয় ব্যক্তিকেও নিযুক্ত করছি না। আমি উমর বিন খাত্তাবকেই উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করছি। অতএব তোমরা তাঁর কথা শুন এবং মেনে চল।”
বিরাট জনসম্মেলন হতে আওয়াজ উঠল: (আরবী **********)
“আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম।”
এবারে মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় খলীফার নিয়োগ কার্যও মনোনয়নের দ্বারা সম্পন্ন হয়নি, বরং তদানীন্তন খলীফা মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করে এক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেন এবং সমবেত জনগণের সামনে তা পেশ করে মঞ্জুর করে নিয়েছিলেন।
অতপর হযরত উমর (রা)-এর অন্তিমকাল উপস্থিত হয়। তখনি নবী করীম (সা)-এর সর্বাপেক্ষা অধিক বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সংগী-সাথীদের মধ্যে ছয়জন লোক এমন ছিলেন, খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণের ব্যাপারে যাঁদের উপর মুসলমানদের প্রথম দৃষ্টি নিপতিত হতে পারে। হযরত উমর এই ছয়জনের সমষ্টিতেই একটি মজলিসে শু’রা নিযুক্ত করেন এবং পারস্পরিক পরামর্শ ক্রমে একজনকে খলীফা নিযুক্ত করার দায়িত্ব তাঁদের উপর অর্পণ করেন; সেই সংগে তিনি ঘোষণা করলেন:
(আরবী **********)
“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ না করেই আমীর বা রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে বসে তবে তোমরা সকলে মিলে তাকে হত্যা কর।”
হযরত উমর (রা)-এর নির্ধারিত এই মজলিসে খলীফা নির্বাচনের কাজ শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতভাবে হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা)-এর উপর অর্পণ করেন। তিনি মদীনার অলিগলি ঘুরে জনগণের মত জেনেছেন, ঘরে ঘরে পৌঁছে পুরবাসিনীদের নিকট পর্যন্ত এই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। স্কুল-মাদ্রাসা- তথা প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকেও মতামত জানতে চেষ্টা করেছেন। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল হতে হজ্জ উপলক্ষ্যে আগত লোক- যারা মদীনা হতে নিজ নিজ দেশে রওয়ানা করেছিলেন, তাদের কাছ থেকেও মত জেনে নিলেন। এরূপ অবিশ্রান্ত ও সর্বাত্মক অনুসন্ধানের ফলে তিনি নিসন্দেহে জানতে পারলেন যে, গোটা জাতির সর্বাপেক্ষা অধিক আস্থাভাজন বর্তমানে দু’জন। হযরত উসমান (রা) ও হযরত আলী (রা) এবং এদের মধ্যে হযরত উসমানের দিকে আবার অধিক সংখ্যক লোকের ঝোঁক ও আন্তরিক সর্মন রয়েছে, সর্বশেষে হযরত উসমান (রা)-এর স্বপক্ষেই তাঁর ফায়সালা হয় এবং প্রকাশ্য সম্মেলনে তাঁর হাতে ‘বায়াত’ (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করা হয়।
এরপর হযরত উসমান (রা)-এর শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। ফলে মিল্লাতে ইসলামীয়ার মধ্যে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। এ সময় কয়েকজন সাহাবী হযরত আলী (রা)-এর ঘরে একত্রিত হন এবং তাঁকে বলেন: এই সংকট মুহূর্তে উম্মাতের নেতৃত্বের যোগ্যতম ব্যক্তি আপনি ছাড়া আর কেউ নেই, অতএব আপনিই এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করুন। হযরত আলী (রা) যদিও তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন, কিন্তু তবুও তাঁরা তাঁকে বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন। অতপর হযরত আলী (রা) বললেন- আপনারা যদি বাস্তবিকই এটা চান, তবে মসজিদে সমবেত হোন। কারণ:
(আরবী *********)
“আমার আনুগত্যের শপথ (বায়াত) গ্রহণ কার্য গোপনে অনুষ্ঠিত হতে পারবে না এবং মুসলমানদের সাধারণ অভিমত ছাড়া তা সম্পন্নও হতে পারে না।”
অতপর তাঁরা মসজিদে নববীতে চলে গেলেন। আনসার এবং মুহাজিরগণও তথায় সমবেত হলেন। আর, সকলের না হলেও- অন্তত অধিকাংশ লোকের সমর্থনে হযরত আলী (রা) খলীফা নির্বাচিত হন এবং তাঁর হাতে (বায়াত) গ্রহণ করা হয়।
হযরত আলী (রা)-এর উপর যখন ঘাতকের আক্রমণ হয় এবং তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হন, তখন জনগণ তাঁর নিকট জিজ্ঞেস করলো- আপনার পরে আমরা আপনার পুত্র হযরত হাসান (রা)-কেই কি খলীফা নিযুক্ত করবো এবং তাঁর হাতেই কি ‘বায়াত’ করবো? উত্তরে হযরত আলী (রা) শুধু এটাই বলেছিলেন:
(আরবী *********)
“আমি এজন্য তোমাদের কোন হুকুম দিচ্ছি না, কোন কিছু করতে তোমাদের নিষেধও করছি না। তোমরা নিজেরাই খুব ভাল করে বিচার-বিবেচনা করতে পার।”
এটাই হচ্ছে রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনের ব্যাপারে খিলাফতে রাশেদার ঐতিহ্য এবং সাহাবায়ে কিরামের সর্বসম্মতিমূলক কর্মনীতি। খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে নবী করীম (সা)-এর নৈঃশব্দ এবং “সকল সামগ্রিক ব্যাপার তাদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমেই আঞ্জাম পেয়ে থাকে” –আল্লাহর এই বাণীর উপর তাঁদের কর্মনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। এই প্রামাণিক শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য হতে অকাট্য ও নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচন সাধারণ লোকদের সমর্থনের উপর নির্ভর করে। কোন ব্যক্তিই নিজে জোর করে রাষ্ট্র প্রধান হয়ে বসার অধিকার পেতে পারে না। [অনেক লোকের মনে এই প্রশ্ন জেগে থাকে যে, ইসলামের প্রকৃত নিয়ম যদি এটাই হবে, তাহলে রাজতন্ত্রের যুগে নাম করা আলেমগণ জোরপূর্বক রাজতখ্ত দখলকারী লোকদের খিলাফত(?) ও নেতৃত্ব কিরূপে স্বীকার করে নিয়েছিলেন? উত্তরে বলা যেতে পারে যে, মূলত এখানে দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিষয়কে পরস্পর মিলিত করে গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করা হচ্ছে। একটি বিষয় হচ্ছে ইসলামে খলীফা বা শাসনকর্তা নির্বাচনের সঠিক ও নির্ভুল পন্থা কি হতে পারে তা, আর অন্যটি হচ্ছে- কখনো ভুল পন্থায় কোন ব্যক্তি যদি খিলাফত বা এমারতের গদী দখল করে বসে তবে তখন কি করা আবশ্যক। প্রথম বিষয়ে আলেমসমাজের সর্বসম্মত মত এই যে, মুসলিম জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে নির্বাচনই হচ্ছে সঠিক কর্মনীতি।
দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, এরূপ পরিস্থিতিতে যেসব আলেম অধিকতর নরম পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তাঁরাও শুধু এতটুকুই বলেছেন যে, শান্তি-শৃংখলা এবং মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার খাতিরেই এরূপ ‘খলীফা’কে বরদাশত করে নিতে হবে। কিন্তু বিশেষ সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এরূপ জোরর্পূবক শাসনতন্ত্র দখলকারী ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের মূলবিধন ও ভিত্তিকে যেন চূর্ণ না করে। এরূপ পরিস্থিতিতেও উক্ত শর্ত যদি বহাল পাওয়া যায়, তবে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করা এরা পসন্দ করেন না। কারণ, তাদের তা করলে সমগ্র দেশে অশান্তি ও ভাঙ্গন বিপর্যয় দেখা দিবে। অতএব এরূপ মত ও মনোবৃত্তি ছিল বলেই জোরর্পূবক শক্তি দখল করাকে সুষ্ঠু ইসলামী পন্থা বলে তাঁরা মনে করতেন- এমন কোন কথা কিছুতেই বলা যেতে পারে না।] বিশেষ কোন পরিবার কিংবা শ্রেণীরও এর উপর একাধিপত্য স্থাপিত হতে পারে না।
পরন্তু এই নির্বাচন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, জোর-যুলুম ও ধমকহীন এবং মুসলমানদের সম্পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশ অবাধ সুযোগের উন্মুক্ত পরিবেশ সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মুসলমানদের স্বাধীন ইচ্ছা এবং মনোভাব কিভাবে বা কি উপায়ে জানা যাবে?… এ ব্রাপারে ইসলাম নির্দিষ্ট ও বাঁধা ধরা কোন পন্থা ঠিক করে দেয়নি। অবস্থা এবং প্রয়োজনের দৃষ্টিতে বিভিন্ন কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু বিশেষ শর্ত এই যে, যে পন্থাই গ্রহণ করা হোক না কেন, –সমগ্র জাতির আস্থাভাজন ব্যক্তিকে, তা যেন তা দ্বারা সন্দেহাতীত রূপে জানতে পারা যায়।
মজলিসে শু’রার গঠন পদ্ধতি
রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের পর মজলিসে শু’রা (বা পার্লামেন্টের সদস্য) নির্বাচনের ব্যাপারটি আমাদের সামনে একটি অধিকতর জটিল প্রশ্ন। এই মজলিস কিভাবে গঠিত হবে, এর সদস্য কিভাবে নির্বাচন করা হবে এবং কারাইবা তাদেরকে নির্বাচিত করবে ইত্যাদি প্রশ্নসমূহ মানুষের মনে বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। স্থুল ধারণা ও অপূর্ণ তথ্যজ্ঞানের ভিত্তিতে লোকেরা একটি মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েছে খিলাফতে রাশেদার যুগে সাধারণ নির্বাচন (General Election)-এর মারফতে শু’রা সদস্যগণ নির্বাচিত হয়েছিলেন না বলে লোকদের ধারণা হয়েছে যে, ইসলামে জনমত জানার জন্য মূলতই কোন নিয়ম নেই; বরং সমসাময়িক খলীফার নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনার উপর সবকিছুই নির্ভর করা হয়েছে। যার নিকট হতেই তার ইচ্ছা হোক পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এই ধারণাটি মূলত ভুল এবং সেকালের কথাকে একালের পরিবেশে রেখে বুঝার চেষ্টা করাই এই ভুল ধারণা সৃষ্টির মূল কারণ। অথচ প্রকৃত ব্যাপার বুঝার জন্য সেকালের প্রত্যেকটি কথাকে সেকালের পরিবেশে রেখেই পরীক্ষা করা এবং এর বাস্তব খুঁটিনাটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই সেই নীতিসমূহের যাঁচাই করা বাঞ্ছনীয়।
ইসলাম মক্কা নগরে একটি আন্দোলন হিসেবেই প্রচারিত হয়েছিল। দুনিয়ার আন্দোলনসমূহের একটি বিশেষ প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, সর্বপ্রথম যারাই এ আন্দোলনে যোগদান করে, আন্দোলনের অগ্র নেতার তারাই হয় বন্ধু, সংগী, সহকারী, পরামর্শদাতা এবং সাহায্যদারী। এ জন্য ইসলামে যাঁরা প্রথম আগত’ ছিলেন, তাঁরা অতি স্বাভাবিকভাবেই নবী করীম (সা)-এর বন্ধু ও পরামর্শদাতা হয়েছিলেন। আল্লাহর নিকট হতে যেসব ব্যাপারে কোন স্পষ্ট নির্দেশ নাযিল হতো না, নবী করীম (সা) সেসব বিষয়ে তাঁদের সাথে পরামর্শ করতেন। উত্তরকালে এই আন্দোলনে যখন নূতন নূতন লোক অংশগ্রহণ করতে শুরু করলো এবং বিরোধী শক্তিসমূহের সাথে এর দ্বন্দ্ব সংগ্রাম ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠলো, তখন যেসব লোক নিজেদের ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমত, নিঃস্বার্থ কর্মধারা, অকলংক আত্মদান, অনাবিল জ্ঞানবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির দিক দিয়ে গোটা জামায়াতের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন, তাঁরাই সকলের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন। ভোট দ্বারা তাঁদেরকে নির্বাচিত করা হয়নি, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও দুঃসহ অগ্নি পরীক্ষার মারফতেই তাঁরা লোকদের সামনে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। এবং মূলত সাধারণ ইলেকশন অপেক্ষা এটাই হচ্ছে অধিকতর বিশুদ্ধ এবং স্বাভাবিক নির্বাচন পদ্ধতি। এভাবে মক্কা হতে হিজরাতের পূর্বেই দুই প্রকারের লোক হযরতের মজলিসে শু’রার সদস্য হয়েছিলেন। প্রথম সর্বপ্রথম আগত ও সর্বাগ্রগণ মুসলমান- ‘সাবেকুনাল আউয়ালুন’। দ্বিতীয়ত, পরবর্তকালে যেসব সুশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ আসহাবগণ জামায়াতের মধ্যে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছেন তাঁরা। এই উভয় প্রকার আসহাবদের প্রতি ঠিক নবী (সা)-এর মতই সর্বসাধারণ মুসলমানের আস্থা ও বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল।
এরপর হিজরাতের ন্যায় এক বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। হিজরাত সূচনার ইতিহাসও কৌতুহলপূর্ণ। দেড় দু’ বছর পূর্বে মদীনার কয়েকজন প্রভাবশালী লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁদের প্রভাব ও প্রচেষ্টায় আওস ও খায্রাজ নামী গোত্রদ্বয়ের ঘরে ঘরে ইসলামের বিপ্লবী বাণী পৌঁছেছিল। এদেরই আমন্ত্রণক্রমে নবী করীম (সা) এবং অন্যান্য মুহাজিরীন নিজ নিজ ঘর-বাড়ী, বিত্ত-সম্পত্তি পরিত্যাগ করে মদীনায় চলে যান। এখানে ইসলামের আন্দোলন এক বাস্তব রাষ্ট্রব্যবস্থাএবং এক রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। এখন যাদের প্রভাব ও প্রচেষ্টায় ইতিপূর্বে মদীনায় ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল, এই নূতন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অতি স্বাভাবিকভাবে তাঁরাই স্থানীয় নেতা হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছিলেন। আর তারাই নবী করীম (সা)-এর মজলিসে শু’রায় প্রথমাগত ও অগ্রবর্তী এবং সুশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ মুহাজিরীনদের সংগে তৃতীয় দল হিসেবে শামিল হওয়ার অধিকারী হয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে এরাও অতি স্বাভাবিক বাছাই নীতিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে তাঁরা এতদূর আস্থাভাজন ছিলেন যে, তখন আধুনিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলেও একমাত্র এসব লোকই নির্বাচিত হতেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
এরপর মদীনার সমাজে আরো দু’ প্রকারের লোক অগ্রবর্তী হতে লাগলেন। প্রথমত, যারা দীর্ঘ আট দশ বছরকালের রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রচার প্রসংগে কঠিন কার্যসমূহ আঞ্জাম দিয়েছেন তাঁরা। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁদের প্রতি লোকদের দৃষ্টি উত্তোলিত হতে লাগলো। দ্বিতীয় তাঁরা- যারা কুরআন মজীদের জ্ঞান, সমঝ, দ্বীন ইসলামের সূক্ষ্ম জ্ঞান ও শাস্ত্রানুভূতির দিক দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ফলে দ্বীন ইসলামের তথ্য ও তত্তবজ্ঞানের দিক দিয়ে জনগণ নবী করীম(সা)-এর পর তাঁদেরকেই অগ্রগণ্য ও নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতো। এছাড়া নবী করীম (সা) নিজেই নিজের জীবদ্দশায় এসব সাহাবীর নিকট কুরআন শিখার এবং বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করার সাধারণ নির্দেশ দিয়ে এদের যোগ্যতা ও প্রামাণিকতাকে অধিকতর বলিষ্ঠ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই দু’ প্রকারের লোকও অতি সাধারণ নির্বাচন নিয়মেই মজলিসে শু’রায় স্থান লাভ করেছিলেন। এদের মধ্যেও কাউকেও সদস্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ভোট গ্রহণের কোনই প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। আর ভোট যদি বাস্তবিকই নেয়া হতো, তবুও ইসলামীসমাজের সমগ্র জনতার প্রথম দৃষ্টি যে এদেরই উপর পড়ত, তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ থাকতে পারে না।
এভাবে নবী করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় যে মজলিসে শু’রা গঠিত হয়েছিল, উত্তরকালে তাই খোলাফায়ে রাশেদীনেরও মন্ত্রণা পরিষদ বলে বিবেচিত হতো। ফলে এই নিয়মটি একটি শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য হিসেবে দৃঢ়তা লাভ করে এবং পরবর্তীকালে এমন সব লোক এই নিয়ম অনুসারে মজলিসে শু’রায় প্রবেশ করতে লাগলেন যারা নিজেদের অনাবিল জনকল্যাণমূলক কর্মধারা এবং উন্নত ও উচ্চতর নৈতিক ও মানসিক যোগ্যতার কারণে জনসমাজে মর্যাদা লাভ করে এই মজলিসে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলেন। এই লোকদেরকেই আরবী পরিভাষায় “আহলুল হাল্লে-অল-আকদ” বা “বাঁধার এবং খুলার ভারপ্রাপ্ত লোকগণ” বলা হতো। বাস্তব ক্ষেত্রেও এদের সাথে পরামর্শ না করে খোলাফায়ে রাশেদীন কোন গুরুতর বিষয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না, এদের নিয়মতান্ত্রিক মর্যাদা একটি ঘটনা হতে আরো অধিকতর সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। হযরত উসমান (রা) এর শাহাদাতের পর কয়েকজন সাহাবী হযরত আলী (রা)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাকে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন, তখন হযরত আলী (রা) বললেন:
(আরবী *********)
“এটা তোমাদের ফায়সালা করার বিষয় নয়। শু’রার সদস্য এবং বদর জিহাদে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণই এ সম্পর্কে শেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। বস্তুত শু’রার সদস্য এবং বদরে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণই যাঁকে মনোনীত করবেন, তিনিই খলীফা নিযুক্ত হবেন। অতএব এখানে আমরা সমবেত হবো এবং এ বিষয়ে বিবেচনা করবো।”
একথা হতে পরিষ্কাররূপে জানা যায় যে, মজলিসে শু’রার সদস্যগণ সে যুগে নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট ছিলেন এবং তাঁরা বহু পূর্ব হতেই এই মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। আর জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহের চূড়ান্ত মীমাংসা করার ভার তাঁদের উপরই ন্যস্ত ছিল। কাজেই, খলীফা পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য ছিলেন না- ইচ্ছামত কারো সাথে পরামর্শ করতেন হয়ত না-ই করতেন, আর করলেও জাতির গুরুতর বিষয়সমূহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকারী কারা ছিল তা মোটেই জানা যেত না- একথা কিছুতেই বলা যেতে পারে না। হযরত আলী (রা)-এর উক্ত বাণী হতেই এরূপ কথার ভিত্তিহীনতা সপ্রমাণিত হয়েছে। [এখানে আরো একটি প্রশ্ন জাগে। হযরতের এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের এই পরামর্শ কাজে কেবল মদীনার লোকগণই কেন শরীক হতো দেশের অন্যান্য এলাকা হতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি আহ্বান করা হয়নি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর এই যে, তা না করার মূলে দু’টি গুরুতর কারণ বিদ্যমান ছিল:
প্রথম এই যে, আরব দেশের এই ইসলামী রাষ্ট্র কোন জাতীয় রাষ্ট্র ছিল না, এটা সম্পূর্ণ আলাদা পন্থায় অস্তিত্ব লাভ করেছিল। প্রথমে একটি মতাদর্শের ব্যাপক প্রচার লোকদের মধ্যে মানসিক ও নৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। তারপর এই বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ একটি ইসলামী আদর্শবাদী সমাজ দানা বেঁধে উঠেছিল, তারপর এই আদর্শবাদী সমাজ একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করলো। এই রাষ্ট্রের স্বভাবতই কেন্দ্রীয় আস্থাভাজন ব্যক্তি তিনিই ছিলেন যিনি এই বিপ্লবের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তারপর সেইসব লোকই এই বিপ্লবী সমাজের আস্থা-কেন্দ্র হয়েছিলেন, যাঁরা এই বিপ্লব সৃষ্টি করার ব্যাপারে দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। এদের নেতৃত্ব ছিল অতি স্বাভাবিক এবং যুক্তিসংগত, এই সমাজে তাদের ছাড়া অন্য কেউই নির্ভরযোগ্য ও ভারপ্রাপ্ত হতে পারতো না। ইসলামী সমাজের সমালোচনার অবাধ অধিকার ও পূর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেবল এ কারণেই তাঁদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এবং “কেবল মদীনার লোকেরাই কেন পরামর্শদানের অধিকার ভোগ করছে” বলে ‘টু শব্দ’ সেকালেরসারা আরব দেশের কোথাও ধ্বনিত হয়নি।
দ্বিতীয় কথা এই যে, সেকালের তামাদ্দুনিক অবস্থায় আফগানিস্তান হতে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট রাজ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া মোটেই সম্ভবপর ছিল না। এবং মজলিসে শু’রার প্রত্যেক আঞ্চলিক সদস্যের পক্ষে সাধারণ এবং জরুরী অধিবেশনসমূহে এসে যোগদান করাও বড়ই অসম্ভব কাজ ছিল।]
খিলাফতে রাশেদার এই কর্মপ্রণালী- বরং স্বয়ং নবী করীম (সা)-এর জীবনাদর্শ হতে এ সম্পর্কে একটি স্থায়ী মূলনীতি নির্ধারিত হচ্ছে। রাষ্ট্র প্রধান গুরুতর রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্মে অবশ্যই পরামর্শ করবেন, কিন্তু সে পরামর্শ যারতার নিকট হতে কিংবা নিজের ইচ্ছামত মনোনীত লোকদের কাছ থেকে নিতে পারবেন না। তা হতে হসে সর্বসাধারণ মুসলমানদের আস্থাভাজন লোকদের কাছ থেকে- যাদের স্বার্থহীনতা, নিষ্ঠাপূর্ণ কল্যাণ কামনা এবং যোগ্যতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে জনগণের কোনই দ্বিধা-সন্দেহ বর্তমান নেই- রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্মে সরকারের সিদ্ধান্তসমূহে যাদের সমর্থন এর প্রতি গোটা জাতির সমর্থন আছে বলে প্রমাণ করে তাদের কাছেই পরামর্শ নিতে হবে। আর জনগণের বিশ্বাস ও আস্থাভাজন এবং নির্ভরযোগ্য লোক কে কে, তা জানার যে উপায় ইসলামের প্রথম অধ্যায়ের বিশেষ পরিস্থিতিতে কার্যকরী ছিল, আজ তা কোথাও পাওয়া যেতে পারে না। আর সেকালের তামাদ্দুনিক অবস্থায় যেসব প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা ছিল আজ তাও বর্তমান নেই। কাজেই বর্তমান যুগের অবস্থার দৃষ্টিতে ও আজকের প্রয়োজনের অনুপাতে গণ-জাতির আস্থাভাজন ব্যক্তিদেরকে সঠিকভাবে নির্বাচিত করার জন্য আধুনিক উদ্ভাবিত সংগত ও নির্দোষ পন্থাসমূহও গ্রহণ করা যেতে পারে। বর্তমান যুগের ইলেকশনও এই সংগত পন্থাসমূহের অন্যতম; এই পন্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। কিনতউ এতে যেসব দুর্নীতি ও অসদুপায় অবলম্বনের অবাধ সুযোগ গণতন্ত্রকে একটি বিদ্রূপে পরিণত করেছে, সেইসব কলংকময় ও অবাঞ্ছিত পন্থা কিছুতেই বরদাশত করা যেতে পারে না।
সরকারের আকৃতি ও স্বরূপ
ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার গঠনের আকৃতি ও স্বরূপ কি হবে তা আমাদের তৃতীয় সমস্যা। এজন্য খিলাফতে রাশেদার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি যে, আমিরুল মু’মিনীনই (ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি) হতেন সেকালের প্রকৃত ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আনুগত্য ও অনুসরণ করে চলার শপথ তাঁর কাছেই গ্রহণ করা হতো। সমাজের সর্বাপেক্ষা প্রধান আস্থাভাজন বলে জনসাধারণ তাদের সামগ্রিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহ, সরকারী কাজের সর্বময় দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব তাঁরই উপর ন্যস্ত করতো। আমিরুল মু’মিনীনের মর্যাদা ইংলণ্ডের রাজা বা সম্রাট, ফ্রান্স ও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি, বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং রাশিয়ার স্ট্যালিনের মর্যাদার অনুরূপ ছিল না। এদের প্রত্যেকের মর্যাদা হতে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তিনি নিছক ‘রাষ্ট্র প্রধানই’ ছিলেন না, মন্ত্রীমণ্ডলির প্রধানও তিনিই ছিলেন, পার্লামেন্টের সভাপতিত্বও তিনিই করতেন। প্রত্যেক আলোচনা ও বিতর্কে তিনি সরাসরিভাবে অংশগ্রহণ করতেন। নিজ সরকারের সকল কা-কর্মের জবাবদিহিও তিনি নিজেই করতেন, নিজের হিসাব নিজেই পেশ করতেন। তাঁর পার্লামেন্টে ‘সরকারী দল’ আর ‘বিরোধী দল’ বলতেও কিছু ছিল না, সমগ্র পার্লামেন্টই তাঁর বিরোধী হয়ে যেত, যদি তিনি ভুল বা বাতিলের দিকে অগ্রসর হতে চাইতেন। পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যই স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন ছিলেন, যে বিষয়ে তাঁর মতৈক্য হতো তার প্রকাশ্যভাবে সমর্থন করতেন, আবার যে ব্যাপারে তাঁর মতবিরোধ হতো প্রকাশ্যভাবে তারও বিরোধিতা করতেন। খলীফার নিজের মন্ত্রীমণ্ডল পর্যন্ত পার্লামেন্টে তাঁর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেন। কিন্তু তবুও ‘রাষ্ট্রপতিত্ব’ এবং মন্ত্রীত্বের মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান থাকতো। কোন পক্ষেরই ইস্তফা দিতে হতো না, তার কোন প্রশ্নও উঠতো না। খলীফা কেবল পার্লামেন্টের সামনেই দায়ী হতেন না, সমগ্র জাতির সামনেই তিনি প্রত্যেক কাজের- এমনকি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কাজ-কর্ম সম্পর্কেও জবাবদিহি করতে বাধ্যহতেন। তিনি দিনরাত্রে পাঁচটি সময় মসজিদে জনগণের সম্মুখীন হতেন, প্রত্যেক জুময়ার দিনে তিনি জনগণের সামনে বক্তৃতা করতেন। জনসাধারণ নিজেদেরই শহরে অলি-গলীতে প্রত্যেক দিন তাঁকে চলাফেরা করতে দেখতে পেত এবং যে কোন ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করতে বা সমালোচনা করতে পারতো। প্রত্যেক নাগরিক সকল সময়ই তাঁর ‘চাদর’ ধরে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে পারতো। জন সম্মেলনে প্রত্যেকেই তাঁর কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারতো। তাঁর কাছে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হলে সেখানে বর্তমানের ধরাবান্ধা স্থানে পার্লামেন্টারী প্রথার অনুসরণ করতে হতো না। তাঁর সাধারণ ঘোষণা ছিল:
(আরবী **********)
“আমি যদি সঠিক কাজ করি, তবে তোমরা সকলে আমার সাহায্য করবে, আর আমি যদি অসদাচরণ করি, তাহলে আমাকে ‘সোজা’ করে দিবে। আমি যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অনুসরণ করতে থাকবো, তোমরা ততদিনই আমার আনুগত্য ও অনুসরণ করো। আর আমি যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করি, তাহলে আমার আনুগত্য করা তোমাদেরই মোটেই কর্তব্য হবে না।”
এরূপ শাসন প্রণালীর সাথে বর্তমান যুগের অসংখ্য রাজনৈতিক পরিভাষার মধ্যে একটি পরিভাষারও সামঞ্জস্য হয় না, কিন্তু তবুও এ ধরনের শাসনপদ্ধতির সাথে ইসলামের পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে, অতএব এটাই আমাদের আদর্শ। কিন্তু এটা ঠিক তখনি বাস্তবায়িত হতে পারে, যখন গোটা সমাজ ইসলামের বিপ্লবী মতবাদ অনুসারে পূর্ণরূপে গঠিত হয়ে উঠবে। এ কারণেই মুসলিম সমাজে যখনই ভাঙ্গন এবং পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন এরূপ শাসন পদ্ধতির সাথে এর সামঞ্জস্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে গেল। এখনো আমরা যদি এ চিরন্তন ও শাশ্বত আদর্শের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে চাই, তাহলে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে তা হতে চারটি মূলনীতি আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে চেষ্টানুবর্তী হতে হবে।
প্রথম এই যে, রাষ্ট্র সরকারের প্রকৃত দায়িত্ব যাঁর উপরই ন্যস্ত করা হবে, তিনি কেবল গণপ্রতিনিধিদেরই নয় জনগণেরও সম্মুখীন হতে বাধ্য থাকবেন এবং নিজের যাবতীয় কাজ-কর্ম শুধু পরামর্শ নিয়েই করলে চলবে না। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের জন্যও তাঁকেই দায়ী হতে হবে।
দ্বিতীয় এই যে, বর্তমান প্রচলিত পার্টি পদ্ধতি (দলবাদ) জগদ্দল পাথর হতে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে। কারণ এটা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই অর্থহীন ও অকারণ হিংসাদ্বেষেরবিষে জর্জরিত করে। এই প্রথার সুযোগেই বর্তমন সময় যে কোন ক্ষমতা লিপ্সু ও সুযোগ সন্ধানী দল গদী দখল করে জনসাধারণের প্রদত্ত অর্থের দ্বারা তাদেরকেই নিজেদের স্থায়ী সমর্থকরূপে প্রস্তুত করে নিতে পারে। ফলে অজস্র মানুষের হাজার চিৎকারকেও উপেক্ষা করে সেই ‘স্থায়ী সমর্থক দলের’ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বেচ্ছাচারমূলক শাসন চালিয়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বর্তমানের ন্যায় অত্যন্ত জটিল ও কূটিল নিয়ম-বিধির জালে জড়িয়ে দেয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ এতে কর্মচারীদের পক্ষে কাজ করা, হিসাব গ্রহণকারীদের পক্ষে হিসাব গ্রহণ করা এবং বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিকে নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সর্বশেষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এই যে, রাষ্ট্রপ্রধান ও পার্লামেন্টের সদস্য পদে এমন সব লোককে নিযুক্ত করতে হবে, যাদের মধ্যে ইসলামের অপরিহার্য বলে ঘোষিত গুণাবলী সর্বাপেক্ষা বেশী বর্তমান পাওয়া যায়।