সংস্কৃতি
সংস্কৃতির গোড়ার কথা
জীবনের কুল-কিনারাহীন মহাসমুদ্রে মানুষের অস্তিত্ব এক ক্ষুদ্র তৃণখণ্ড সদৃশ মনে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত বৈচিত্র্য ও সামাজিক উত্তরাধিকারের পার্থক্যের দৃষ্টিতে বহুতর মহাসমুদ্রের ব্যাপকতা ও বিশালতা রয়েছে মানুষের সত্তায়। মানুষ শুধু নিজের আকার-আকৃতি ও সামাজিক উত্তরাধিকার বৈচিত্র্যেরই প্রতীক নয়, বরং ভাষা-সাহিত্য, বিশ্বাস-প্রত্যয়, চিন্তা-পদ্ধতি ও জ্ঞান-বুদ্ধির রকমারি শাখা-প্রশাখারও প্রতিচ্ছবি এই মানুষ। স্পষ্টত মনে হয়, এ বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতাই মাটি-পানির এই জগতের সৌন্দর্য-শোভা। জীবনের স্থিতি ও দৃঢ়তা এ বৈচিত্র্যেরই ফসল।
মানুষের সমাজ-জীবনের ইতিহাস-পূর্বকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যেসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং জীবনযাত্রা পদ্ধতি যে বিকাশমান পর্যায়সমূহকে অতিক্রম করে এসেছে, তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত মানুষের নিকটই ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। আজও তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি মানুষের সামনে; বরং অস্পষ্টতার এক ছায়াঘন আবরণ তাকে আচ্ছন্ন ও প্রচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমরা যা কিছু জানতে পেরেছি, তা শুধু আন্দাজ-অনুমান বই আর কিছু নয়।
মানুষ এক বিশেষ ধরণের পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে। সে পরিবেশ বিশেষ ধরণের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। জন্ম মুহূর্ত থেকেই নানারূপ জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা ও মিষ্টি-মধুর ভাষা তার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হয়; তার চোখ দেখতে পায় বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি এবং অসংখ্য সক্রিয় প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতা। সে প্রতি মুহূর্তেই পরিবেশ থেকে প্রেরণা লাভ করছে, প্রভাব মেনে নিচ্ছে, প্রভাবান্বিত হচ্ছে এবং অবচেতনভাবে তার ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিত্ব ও মন-মানস এক বিশেষ ধরণের ছাঁচে ঢেলে গঠিত হচ্ছে। পরিবেশ থেকে গৃহীত এসব প্রভাব তার ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও প্রতিভা এবং উত্তরাধিকারলব্ধ প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে তাকে এক বিশেষ ধরণের ব্যক্তিসত্তায় পরিবর্তিত ও পরিণত করে দেয়। পরিভাষায় একেই বলা হয় সংস্কৃতিবান তথা সভ্য মানুষ (Cultured man)।
মানবতার বিরাট মর্যাদাপূর্ণ প্রাসাদ অবশ্য পাশবিকতার ভিত্তির ওপরই গড়ে ওঠে। অর্থাৎ মানুষ নিশ্নশ্রেণীর পাশবিক গুণ-বৈশিষ্ঠ্যে উৎকর্ষ ও উন্নতি লাভ করে উচ্চতর মানবীয় মূল্যমানে ভূষিত হয়। কেননা বিশ্বস্রষ্টা তাকে বিবেক-বুদ্ধি এবং মন-মানস দিয়ে ধন্য করেছেন। যদিও মানুষের বুদ্ধি-বিবেক (Reason) ও মননশক্তি (mind) খোদার বিশেষ দান, না মানুষ নিজেরই চেষ্টা-শ্রম ও সাধনার ফলে তা অর্জন করে নিয়েছে, এ বিষয়ে একটা বিতর্ক রয়েছে; কিন্তু সে বিতর্ক বাদ দিলেও আমাদের একথা অনস্বীকার্য সত্য।
মানুষ সম্পর্কে দুনিয়ার নানা চিন্তাবিদ নানা মত প্রকাশ করেছেন। ডারউইন (Darwin) তার ক্রমবিকাশ তত্ত্ব দ্বারা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, জীবতাত্ত্বিক দিক দিয়ে মানুষ সাধারণ পর্যায়েরই একটি জীব বিশেষ। তার শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থা, হজম-রীতি এবং রক্তের প্রবাহও জীব-জন্তুর এসব দিকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন কি জন্ম-মুহূর্তে মানুষ জীব-জন্তুর মতোই বাক্শক্তিহীন হয়ে থাকে। উত্তরকালে দীর্ঘ সময়-কাল অতিক্রম করার পর তার পরিবেশ থেকে সে বাকশক্তি অর্জন করে। ডারউইন তার বক্তব্য বলিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে একটি আরণ্যক মেয়ের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। মেয়েটিকে ১৭৩১ সনে ফ্রান্সের ক্যালন (CHALON) নামক স্থানে পাওয়া গিয়েছিল। সে কথা বলার পরিবর্তে শুধু চিৎকার করতো। ১৯৫৬ সনে মধ্য-ভারতেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটে। রামু নামে নেকড়ের একটি বাচ্চা (Ramu the Wolf boy) জঙ্গলে পাওয়া যায়। সেটি ঘাস খেতো এবং জন্তুর মতোই খুব জোরে চিৎকার করতো। বাচ্চাটিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রেখে তার পশুসুলভ আদত-অভ্যাসের গভীর ও সূক্ষ্ণ পযর্বেক্ষণ করে তার মধ্যে মানবীয় আদত-অভ্যাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হল। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হলনা। বস্তুত সব জীব-জন্তুই আঙ্গিকের দিক দিয়ে পরস্পর সদৃশ্য। অতএব বুদ্ধি-বিবেক, মন-মানস, চিন্তাশক্তি সবই ক্রমবিকাশের ফসল আর তা নিছক শ্রমলব্ধ ও অজির্ত গুণ-বিশেষ।
কিন্তু ডিকার্টে (Descartes) এ থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, মানুষের মন ও মনন আল্লাহর এক বিশেষ অবদান। এ শক্তি আল্লাহ তা’আলা কেবল মানুষকেই দিয়েছেন; সৃষ্টির মাঝে এ গুণ তিনি আর কাউকেই দেননি। তবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সাহায্যে তাকে অধিক তীক্ষ্ণ ও শাণিত করে তোলা যেতে পারে; তাকে উত্তম পন্থায় প্রয়োগ ও ব্যবহার করা যেতে পারে। মানুষের মন সম্পর্কে চিন্তাবিদ মিল (Mill)-এর অভিমত হল এই যে, তার চিন্তা, গবেষণা ও অনুভূতি অত্যন্ত জটিল এবং ঐন্দ্রজালিক ব্যাপার। মোটকথা, এদের মতে যতই বিভিন্নতা থাকুক না কেন, মানুষের-সে পুরুষই হোক কি নারী- বুদ্ধি-বিবেক ও মন-মানসই হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতার বিশেষ সম্পদ। এর বদৌলতে মানুষ যেমন দুনিয়ার অন্যান্য সৃষ্টি থেকে পৃথক, তেমনি সে বিশিষ্ট ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। অবশ্য ডারউইন এ বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, সহজাত প্রবৃত্তি (Instinct)-র বিশেষত্বই হল এই যে, তা জ্ঞান-বুদ্ধির প্রভাব থেকে মুক্ত থেকেই কাজ করে। জীব-জন্তুর মধ্যে চেতনা তেমন উন্নত ও উৎকর্ষলব্ধ নয়, অথচ মানুষের চেতনা দীঘর্কাল যাবতই উন্নতমানের রয়েছে। মানুষের মগজ (Cerebral cortex) নিত্য-নব অভিজ্ঞতা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে বহুকাল থেকেই; যদিও তার স্নায়ুবিক পদ্ধতি (Nervous system) শুরুতেই নিভুর্লভাবে পৃথককরণ এবং স্মরণ রাখার ব্যাপারে এতো তীক্ষ্ণ শক্তির অধিকারী ছিল না। এ থেকে ডারউইনের ক্রমবিকাশ তত্ত্ব দেহ-কেন্দ্রিক হওয়ার বদলে মন-কেন্দ্রিক হওয়ার দিকে ঘুরছে বলে মনে হয়। যান্ত্রিক অস্ত্রশস্ত্র, বই-পুস্তক, সাহিত্য, চিত্রকলা, ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস, সুন্দর-সুরম্য প্রাসাদ, সুনীতি ও সুষ্ঠুতা, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক জ্ঞান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধি-বিধান, এই পর্যায়ের সব প্রতিষ্ঠানাদি এবং আধুনিক ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছুই মানব মনের চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধি-প্রতিভারই বিস্ময়কর ফসল। এগুলো মানুষ নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা-গবেষণা ও অভ্যাস-অনুশীলনের সাহায্যে বতর্মান পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে। মানুষের নতুন বংশধরেরা এ উত্তরাধিকারকে, যার নাম সংস্কৃতি, হারাতেও পারে, এর সমৃদ্ধি সাধনও করতে পারে-পারে ভালোভাবে এর সংরক্ষণ করতে।
একেবারে প্রাথমিক কালের অবস্থা লক্ষ্য করলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ সেদিন নিজের পরিবেশে যথেষ্ট পরিবর্তন সূচিত করে পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূল বানিয়ে নিয়েছিল-পরিবেশের সাথে স্থাপন করে নিয়েছিল পূর্ণ সামঞ্জস্য। চক্মকির ব্যবহার, গুহা-প্রাচীরের গায়ে (স্পেন ও ফ্রান্সে) চিত্র অঙ্কন ও পাথরের অস্ত্র মানব সমাজে শত-সহস্র বছর পূর্বে প্রচলিত ছিল। পরবতর্তীকালে পশু শিকার-নির্ভর এ আরণ্যক জীবন পরিহার করে মানুষ স্থিতিশীল সামাজিক জীবন যাপন শুরু করে।
মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা ও মননশীলতায় যতোই উৎকর্ষ দেখা দিল, মানুষ ততোই আদিম ও আরণ্যক জীবন থেকে দূরে সরে গেল। কিন্তু এসব হল কিভাবে? এ পর্যায়ে কেবল ধারণা –অনুমানই করা চলে, কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণ-নির্ভর জ্ঞান লাভ করা যায়না।
অবশ্য ক্ষেতে ফসল বোনা, ফসল আহরণ, সূতা কাটা, কাপড় বোনা এবং তামা ইত্যাদি ধাতব দ্রব্যকে ব্যবহারাধীন করে নেয়ার খবর পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে লেখার পদ্ধতি চালু হয়। এর ফলে মানব জীবনে এক মহাবিপ্লব সূচিত হয়। এসব আবিষ্কার-উদ্ভাবনী মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। ক্রমবিকাশমান সংস্কৃতি এরই মাধ্যমে সভ্যতায় পরিণত হয়। আরো পরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামরিক কার্যক্রমের সাহায্যে তাকে ব্যাপকতর সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়।
আবিষ্কার-উদ্ভাবনীকে এক আকস্মিক ব্যাপারই বলা যায় আর তা হচ্ছে ত্যাগ-তিতিক্ষা, অধ্যবসায় ও অনুসন্ধিৎসার ফসল। তা যখন লোকদের নিকট সমাদৃত হয়, তখন তা-ই সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে; সমাজ-মানুষের চিন্তায়-মননে এবং আদত-অভ্যাসে তার গভীর প্রতিফলন ঘটে। চিন্তা করা যেতে পারে, মানুষ আজ যদি আগুনের ব্যবহার না জানত, কথা বলতে না পারত, খাদ্য ও পোশাকের কোন ব্যবস্থা না হতো, তাহলে মানুষের জীবন কি গভীর শূণ্যতায় ভরে যেত না? এ দুনিয়ায় যত ব্যক্তিসত্তাই জন্ম নেয়, তারা প্রত্যেকেই নিজকে এক বিশেষ প্রাকৃতিক ছাঁচে ঢেলে তৈরী করে নেয় আর এ ছাঁচের গড়নেও দীর্ঘকালের সাধনার প্রয়োজন। তার অভ্যাস, প্রবণতা, মনোভাব, বিশ্বাস, প্রচলন প্রভৃতি সবকিছুই হয় আবিষ্কার-উদ্ভাবনীর মাধ্যম। এটা না হলে ব্যক্তিদের অসভ্য মনে করা যেত। এজন্যে তারা বাধ্য হয়েই উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ মতাদর্শ ও চিন্তা-বিশ্বাসকে মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করে; বরং বলা যায়, তার নিজের বাছাই করে কোন একটাকে গ্রহণ করার পূর্বেই এগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়।
বস্তুত সংস্কৃতির বিকাশ ও ফলন দৈহিক বর্ধনশীলতা ও বিরাট আকৃতির সাথে অনেকটা জড়িত। পরিবেশ ও পরিবেষ্টনীর প্রভাব, ভালো-মন্দের পার্থক্যবোধ এবং নৈতিক মূল্যমানের আনুকূল্য, দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা ও প্রস্তুতির ওপর নির্ভরশীল। দৈহিক আকৃতির তৎপরতা ও সুক্রিয়াশীলতার সাথে কথা বলার গুরুত্বও অপরিসীম। তার জন্যে চিন্তা-ভাবনা, অনুসন্ধান, সমীক্ষণ এবং সচেতন পরিকল্পনা রচনা করা হয়। এসব চিন্তা-ভাবনা ও তত্ত্ব-তথ্যের মাঝে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তা কখনো ছিন্নভিন্ন হতে পারেনা। কর্মের ওপর শব্দ তার প্রাসাদ নির্মাণ করে এবং প্রাচীনকালে ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল হু, হ্যাঁ ইত্যাদি ধ্বনি থেকেই। আর লেখার উৎপত্তি হতে এসব ঘটনা ও ক্রিয়াকাণ্ডের চিত্র অঙ্কন করতে বহু কষ্ট স্বীকারের প্রয়োজন হয়েছিল অবশ্যই। মিশরীয় শিলালিপি, চিত্রলেখা এবং তার পরিবর্তনগুলোকে ধ্বনি-কেন্দ্রিক নিদর্শনই প্রকাশ করে থাকে। এ থেকেই বর্ণের উৎপত্তি আর এ পর্যায় অতিক্রান্ত হয়েছিল আজ থেকে পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে। এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, শব্দ মূলতই কাজ ও কর্ম মাত্র আর তার শক্তি সর্বজনবিদিত।
সংস্কৃতির আবেগ ও উচ্ছ্বাসমূলক দিকটি শব্দের সাথে সম্পর্কিত আর বুদ্ধি ও মন হচ্ছে কর্ম, শুধু মাধ্যমেই নয়। কেননা সক্রিয় ও প্রভাবশালী চিন্তা-ভাবনার দ্বারা সংস্কৃতি দানা বেঁধে ওঠে আর চিন্তা, মনোভাব, গবেষণা ও মননশীলতার সাথে শব্দের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এজন্যে নাম ও শব্দের পরস্পর সম্পর্কিত হওয়া আবশ্যক। ধ্বনি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে অনুভূত হয়, যেন কোন একটা জিনিস উপস্থিত করে দেয়া হয়েছে। এভাবে তা বস্তুনিচয়ের সাথে একাত্মতার সৃষ্টি করে। এভাবে এই চেতনা পর্যায়ক্রমিক বিকাশধারায় নিজের জন্যে উপযুক্ত শব্দ ও ভাষার উপাদান সংগ্রহ করতে থাকে। ফলে অস্তিত্ব লাভ করে এক সম্পদশালী ভাষা।
মানব সমাজে ভাষার বিভিন্নতা ও পার্থক্য কেন? তার কারণ এই যে, স্নায়ুবিক প্রক্রিয়া ও জ্ঞানগত ধারণা বিভিন্ন অবস্থা ও ধ্বনির সাথে সম্পৃক্ত। ধ্বনি ও বিশেষ শব্দের পশ্চাদপটের অবস্থা ও পরিস্থিতির মুকাবিলা করার জন্যে যে হাতিয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে, তা দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায়। সাধারণ উন্নতি ও ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যাপারসমূহের সাথে সাথে আত্মপ্রকাশ করে। এ কারণে ভাষা যে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অস্পষ্ট ও চুপচাপ কথাবার্তা চিন্তার মতোই নিঃশব্দ। যদি শব্দই না থাকে, তাহলে চিন্তা, গবেষণা ও সমীক্ষণও থাকেনা। মানুষ কেবল সজাগ থেকেই চিন্তা করে না, ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায়ও তার চিন্তাকর্ম অব্যাহত থাকে। প্রাচীনকালে মানুষের জন্যে এ দৃষ্টিভ্রম বা অস্পষ্টতা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জাতিসমূহের আকীদা বিশ্বাস, রসম-রেওয়াজ ও নীতি-পদ্ধতির সাথে তাদের স্বপ্নের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এ জিনিস এমন কারণসমূহের অন্যতম, যার দরুণ সভ্যতার প্রাসাদ উন্নতশির হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত সামগ্রিক, ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক শক্তিসমূহের শুভ সংমিশ্রনেরই অপর নাম হচ্ছে ‘সংস্কৃতি’।
সংস্কৃতির মৌল উপাদান
মানুষের প্রয়োজন-তা আত্মিক হোক কি দৈহিক, রাজনৈতিক হোক কি নৈতিক, ব্যক্তিগত হোক কি সমষ্টিগত, তা সমাজবদ্ধতা ও সংস্থা-সংগঠনের মাধ্যমেই পূর্ণ হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক মানুষের (Man of Nature) কোন অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারেনা। তার প্রতিরক্ষা, খাদ্য, গ্রহণ, স্থানান্তর ও গতিবিধি সবই সামগ্রিক সহযোগিতামূলক কাজের ওপর নির্ভরশীল। এ সামাজিক দলবদ্ধতা এমন লোকদের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে, যারা স্থানীয়, দেশীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত। তা ছাড়া অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্ম-তৎপরতার দিক দিয়েও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর হয়েই থাকে। এসব সম্পর্কের ভিত্তিতে তাদের সকলেরই মনজিল এক এবং অভিন্ন। চলার পথও সমান। এ জীবনপথে চলার ব্যাপারে তাদের আচরণও বিশেষ রীতিনীতি ও আইন-বিধানানুগ আর সেগুলোর মৌল উৎস হচ্ছে ধর্মীয় নৈতিক বিধান।
মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণাবলীর মধ্যে নীতিবাদিতা, মানসিক আবেগ এবং আল্লাহর ভয় এমন কার্যকারণ, যা বিশেষ অবস্থায় বিশেষ ধরণের আচরণ সৃষ্টির নিমিত্ত হয়ে থাকে। সর্বসমর্থিত মূল্যমান মানুষের আচরণকে প্রভাবান্বিত করে আর তার নির্ভুল ও পূর্ণ বিন্যাস হতে পারে এক বিশেষ ধরণের সংস্কৃতিতে। মনের ইচ্ছা-বাসনা ও আবেগ-উচ্ছ্বাসের পারস্পরিক সংযোজন হতে পারে এসব ব্যবস্থাপনার অধীন। জাতি, সরকার, জাতীয় পতাকা ইত্যাদির পশ্চাতেও অন্তর্নিহিত থাকে জীবন্ত সংস্কৃতির মহাসত্য আর নতুন বংশধরদের মাঝে তার মোটামুটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব জৈবজীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে রূপ পরিগ্রহ করে।
ক্রমবিকাশমূলক চিন্তায় বিশ্বাসী লোকদের মতে সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও ক্রমবৃদ্ধি স্বতঃস্ফূর্ত (Spontaneous) পরিবর্তন ধারার পরিণতি। তা সুসংবদ্ধ মৌল নীতিসমূহের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হয়। তাকে একটির পর একটি পর্যায় ও স্তর অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হয়। অগ্নির অস্তিত্ব লাভ, তৈজসপত্র নির্মাণ, অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার এবং তার বিভিন্ন ‘ডিজাইন’, ‘প্যাটার্ন’ ও অর্থনৈতিক উন্নতি একথার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত।
এসব পর্যায় ও স্তরের পরিব্যপ্তি ও সম্প্রসারণশীলতার (Diffusion) সূচনা কি করে হল, কি করে ও কিভাবে তা ক্রমোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে অগ্রসর হল এবং তার কোথায় কোথায় ও কতখানি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার সন্ধানের ওপর ঐতিহাসিক চিন্তাবাদের ভিত্তি সংস্থাপিত। সংস্কৃতিকে এভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। এজন্যে গোত্র-ভিত্তিক জীবন-ধারা, ধর্মীয় সংঘবদ্ধতা, বস্তুগত ও বৈষয়িক উন্নতি, সামাজিক মূল্যমান ও সামষ্টিক প্রতিষ্ঠানাদি ইত্যাকার বিশেষত্বকে সামনে রেখেই সংস্কৃতিকে বিবেচনা করা হয়। এ সবের বিস্তার যে একই নিয়মে সংঘটিত হতে পারেনি, তা সুস্পষ্ট। বিভিন্ন অঞ্চলে একই ধরণের বিশেষত্ব পাওয়া যেতে পারে বটে; কিন্তু তা সত্ত্বেও বাইরের তথা বৈদেশিক সভ্যতা-সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাবও তার ওপর প্রতিফলিত হতে পারে। মানুষের নিজস্ব প্রয়োজনাবলী পরিপূরণে আদত-অভ্যাসের বৈচিত্র্যও বিশেষ ধরণের পটভূমির অধিকারী। ছড়ি বা লাঠি অন্ধকার যুগে মাটি খোদাইর কাজে ব্যবহৃত হতো। কালের অতিক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তার দ্বারা চালনা-দণ্ডের কাজও করা হয়েছে। উত্তরকালে তা আবার ভ্রমণ-ছড়ি রূপেও ব্যবহৃত হয়েছে। আধুনিক যুগে এই ছড়িই উচ্চতর মান-মর্যাদার নিদর্শন। আবার শিক্ষাঙ্গনে তা দৈহিক পীড়নের উপকরণ। এককথায় ছড়ির সঙ্গে যেসব ধারণা ও চিন্তা-বিশ্বাস জড়িত, তা সমাজে প্রচলিত মূল্যমান দ্বারা প্রভাবিত। সোরাহীকে এক কালে পানির সঞ্চয় রক্ষা ও তা শীতল করার কাজে ব্যবহার করা হতো। পরিবর্তিত চিন্তা-বিশ্বাস ও ধারণা-মতবাদ তার ব্যবহারের ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে সেই সোরাহীই শিল্পীর উচ্চমানের শিল্পকর্মের নিদর্শন হয়ে ড্রয়িং রুমের শো-কেসে স্থান লাভ করেছে এবং লোকদের সৌন্দর্য-পিপাসু মন-মানসের স্পৃহা চরিতার্থ করছে। নৌকার গঠন-প্রকৃতি, তার সংগঠন পরিপক্কতা এবং তাকে কর্মোপযোগী বানানোর কাজে যুগ যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে হাজার রকমের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নৌকা বা জাহাজ নির্মাণ কৌশলে দক্ষতা নৌ-পরিচালনা বিদ্যা ও পদ্ধতি সব কিছুই তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। অবশেষে বর্তমান যুগে এসে তা একা সর্বাত্মক সৌন্দর্য ও ব্যবহারিক যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
জমির ওপর লাঙ্গল চালানো, বীজ বপন করা ও ফসল তোলা- এই সব কিছুই একটা নিয়ম ও শৃংখলার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এসব তৎপরতা বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন দেশ-পরিবেশে বিভিন্ন ধরণের পন্থা-পদ্ধতি ও হাতিয়ার অবলম্বন করেছে। এভাবে মানবীয় প্রয়োজন যথার্থভাবে ও পূর্ণ মাত্রায় পূরণ করার একটা বিশেষ ভঙ্গি অস্তিত্ব লাভ করেছে। এগুলোর পারস্পরিক সংমিশ্রণ ও সংযোজন কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের (Traits) পরিণতি নয়; বরং তা সে সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের (Institutions) অবদান যেসব সংস্থা নিজেদের সুসংবদ্ধ ও সুসংহত চেষ্টা-প্রচেষ্টার দরুন এ পর্যায়গুলো অত্যন্ত সাফল্যের সাথে অতিক্রম করেছে। একটি জিনিসের ব্যবহারের সাংস্কৃতিক পটভূমি (Cultural Context), চিন্তা-ভাবনা, প্রচলন এবং আনুষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা (Attachment) অনিবার্য- তা কোন ব্যক্তির দ্বারাই ব্যবহৃত হোক, কি কোন সমাজ সমষ্টি কর্তৃক। ছড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ, তার ওপর নানা রূপ নকশা অংকন ও চাকচিক্য বৃদ্ধিতে একটি সাংস্কৃতিক, আনুষ্ঠানিক, ঐতিহ্যিক ও ধর্মীয় সম্পৃক্ততা বলিষ্ঠভাবে বর্তমান আর তা-ই তার মৌলিক ব্যবহারের ওপর পরিব্যাপ্ত।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেদের তৎপরতাকে বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের কাজে ব্যবহার করে থাকে আর এই উদ্দেশ্য লাভের জন্যেই সে সব সংগঠন গড়ে তোলা হয়। তাতে জীবন-জীবিকা, বংশানুক্রম, প্রতিরক্ষা ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকার গুরুত্ব সর্বাগ্রগণ্য। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে ধনসম্পদ বিনিয়োগ, উপায়-উপকরণের ব্যবহার, হাট-বাজার, যোগাযোগ ও নিয়ম-নীতি-পদ্ধতি গড়ে ওঠে আর নিত্যকার ব্যস্ততার মধ্যে মাছ-ধরা, বাগান রচনা, পশু পালন, বন্য পশু শিকার ও চাষাবাদ এর মধ্যে শামিল। এসবের সাহায্যেই আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ় হয়ে থাকে।
পরিবার সংস্থা
বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে একটি পারিবারিক বা ঘরোয়া পরিবেষ্টনীর একান্ত প্রয়োজন। পরিবার পরিবেষ্টনী একটি সংক্ষিপ্ত একক (Unit)। আইনগত ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও বংশানুক্রমিক মূল্যমানের (values) ওপর এই পরিবার পরিবেষ্টনীর ভিত্তি সংস্থাপিত। পরিবার পরিবেষ্টনী একটি ক্ষুদ্রায়তন সংস্থা। প্রচার ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা এই পরিবার পরিবেষ্টনীর ওপরই নির্ভরশীল।
বিভিন্ন ভঙ্গি, প্রয়োগ পদ্ধতি, ধরন-ধারণ, দ্বীনী চিন্তা-চেতনা, নৈতিক মূল্যমান, দাম্পত্য জীবন, সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ উত্তরাধিকার নিয়মে এক বংশ থেকে আর এক বংশে উত্তরিত হয়। এর সংরক্ষণের জন্যে নিম্নোদ্ধৃত পদক্ষেপসমূহ জরুরীঃ
১. ব্যভিচার বা বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধকরণ।
২. পারিবারিক দায়িত্বসমূহের মান-সম্ভ্রম রক্ষা ও সামাজিক কর্তব্য পালন।
৩. পারিবারিক আইন-বিধান ও নিয়ন্ত্রণ পূর্ণ মাত্রায় প্রতিফলন।
ব্যভিচার তথা অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে একদিকে বংশগত পবিত্রতা বিনষ্ট হয়, অপরদিকে গোটা সমাজ-পরিবেশে নোংরামী, পংকিলতা, নগ্নতা, নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা ও পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ, শত্রুতা, নরহত্যা ও রক্তপাত ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়। পারিবারিক ও বংশীয় একত্ব ও ঐতিহ্য চূর্ণ হয়ে বংশের ধারা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। আত্মীয়তা এবং তার মান-সম্ভ্রম ক্ষুণ্ন ও বিলীন হয়। যে সমাজে ব্যভিচার সমর্থন পায়, তা অনিবার্যভাবে উন্নত মানবীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যমান থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। সেখানে ব্যক্তিদের মধ্যে স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবেশ জেগে ওঠে; ফলে সামাজিক উন্নতি ও বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়।
পাশ্চাত্য দেশসমূহে প্রেমাভিসার বা কোর্টশিপ (Court Ship) প্রচলনের মূল উদ্দেশ্য যা-ই থাকনা কেন, বর্তমান যুগে ও পরিস্থিতিতে সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে এবং এখন তা নিতান্তই কাম-লিপ্সা ও যৌন-স্পৃহা চরিতার্থ করার একটা প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ফলে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা ও সম্ভ্রম এবং মানসিক স্থৈর্য ও শান্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। ব্যভিচারের এই ব্যাপকতা দৈহিক রোগ-ব্যাধির মারাত্মক প্রকোপ সৃষ্টি করেছে [পাশ্চাত্যের তথাকথিত উদার ও যৌন–শিথিল সমাজে ব্যভিচারের প্রাবল্য একদিকে পরিবার–ব্যবেস্থাকে প্রায় অকার্যকর করে দিয়েছে অপরদিকে এইডস (AIDS) এর ন্যায় ভয়াবহ যৌন–ব্যাধি মানব জাতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। এ কারণে সেখানকার চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এখন এইডস–এর প্রতিরোধের জন্যে পরিবার ব্যবস্থার সুরক্ষা ও যৌন পবিত্রতা সংরক্ষণের উপর সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করছেন।– সম্পাদক] এবং আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিচারে চরম অধঃপতন ঘটিয়েছে।
পারিবারিক পরিবেষ্টনীকে পবিত্র, সুশৃংখল ও নির্ঝঞ্ঝাট রাখার জন্যে স্বামী-স্ত্রীকে নিজেদের কর্তব্য পালনে পূর্ণমাত্রায় আন্তরিক ও সদাতৎপর হতে হবে। নরনারীর দায়িত্বহীন সম্পর্ক সমাজে নানারূপ জটিল নৈতিক মানবিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে দায়িত্বানুভূতি তিক্ত ও বিষাক্ত মুহূর্তগুলিতে উৎকট মানসিক অবস্থা বিদূরণে সফল সঞ্জীবনীর কাজ করে। এর অনুপস্থিতি জীবনকে একটা স্থায়ী অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে দেয়।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মতানৈক্য বা ভুল বোঝাবুঝি অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদ, মনোমালিন্য ও ঝগড়া-ঝাটি নিতান্তই অবাঞ্ছনীয়। এরূপ অবস্থা দেখা দিয়ে তার প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানমূলক আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের উপস্থিতি অপরিহার্য। তার সুষ্ঠু প্রয়োগে স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ কার্যকরভাবে রোধ করা এবং পরিবারের লোকদের মধ্যে পূর্ণ মিলমিশ ও মতৈক্য অক্ষুণ্ন রাখা ও কোনরূপ বিভেদ সৃষ্টি হতে না দেয়া সম্ভবপর। লোকদের পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও চেষ্টা-প্রচেষ্টামূলক ভাবধারা জাগিয়ে রাখা একান্তই জরুরী আর তা সম্ভবপর কেবল তখন, যখন ব্যক্তিগত সামষ্টিক স্বার্থের তাগিদে ব্যক্তিগত স্বার্থ কুরবানী দিতে প্রস্তুত হবে-যখন সামাজিক নিয়মবিধির প্রতি সদাজাগ্রত থাকবে অবিচল সম্ভ্রমবোধ। মূল্যমানের (Values) যথার্থ প্রয়োগ একটি প্রাত্যহিক প্রয়োজন আর সম্মিলিত সামাজিক ব্যতিব্যস্ততা ও আমোদ-প্রমোদমূলক অনুষ্ঠানাদিতে নিয়ম-শৃংখলা রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষা-প্রশিক্ষণের সাহায্যে লোকদের মধ্যে সভ্যতা-ভব্যতা, শালীনতা, সুষ্ঠুতা ও আদব-কায়দা সংরক্ষণ-প্রবণতার সৃষ্টি করতে হবে। এমনিভাবেই ঐতিহ্যের সাহায্যে সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে আর এজন্যে অক্ষর বা বর্ণমালাই প্রথম অবলম্বন।
ভাষা-ধ্বনি ও ভঙ্গির ধারক। সাংস্কৃতির অভিজ্ঞতা সেখানে সুপ্রকট। প্রাচীন মানুষের মধ্যে মৌখিক বর্ণনা-ধারার সাধারণ প্রচলন ছিল। কিন্তু উন্নত সংস্কৃতিতে লেখন শিল্পকেও শামিল করা হয়েছে। এক কথায়, সংস্কৃতির উজ্জীবনে অর্থনৈতিক সংগঠন সংস্থা, আইন-বিধান ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ বরাবরই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
ধর্ম–বিশ্বাস
জীবনকে সহজ ও সুন্দর করার জন্যে মানুষের মন-মানস তথা বুদ্ধি-বিবেক, চিন্তা-বিবেচনা ও গবেষণা-শক্তি বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে-লাভ করেছে সুদীর্ঘ ও সুব্যাপক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্মুখবর্তী অবস্থা, পরিস্থিতি ও নিত্য-সংঘটিত ঘটনাবলী মানুষকে বিব্রত, দিশেহারা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। তখন সে হয়ে যায় অসহায় –নিরূপায়। তার অনেক বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-শক্তি ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সে দিশা করতে পারে না, এখন তার কি করা উচিত!
মানুষ মহাসমুদ্রে চলাচল করার উদ্দেশ্যে বড় বড় জাহাজ নির্মাণ করেছে। এই জাহাজ চালানো জন্যে সে বাতাসের গতির ওপর নির্ভরশীল থাকেনি। সে আপন শক্তি বলেই সমুদ্রের বুকে যে দিকে ইচ্ছা জাহাজ চালিয়ে দিতে সক্ষম। জাহাজের গতি ও স্থিতি পূর্ণমাত্রায় তার নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু হঠাৎ উত্থিত প্রচণ্ড ঝড় ও উত্যুঙ্গ তরঙ্গমালার সম্মুখে সে নিতান্তই অসহায় হয়ে পড়ে। সে সময় তার সব শক্তিমত্তা ও জ্ঞান-বুদ্ধির অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতাকে সে মর্মে মর্মে অনুভব করে- স্বীকার করে। যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি অত্যাধুনিক ও শত্রু হননকারী দূরপাল্লার শক্তিশালী অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে উপস্থিত হয়। তার নিজের বীরত্ব, সাহসিকতা ও যুদ্ধ-কৌশলের ওপর সে পুরোপুরি আস্থাবান। তার সৈন্যসংখ্যা শত্রুপক্ষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তাকেই হতে হয় পরাজিত। কিন্তু এটা কেন? এর নির্ভুল জবাব সে সন্ধান করেও জানতে পারে না। তার বিবেক-বুদ্ধি তাকে এ ব্যাপারে কোনই সান্ত্বনা দিতে সক্ষম নয়। কৃষক ক্ষেত্রে-খামারে সোনালী ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে প্রাণ-পণ চেষ্টা করে, নিঃশেষে শ্রম প্রয়োগ করে। হাল হালিয়ে, কোদাল মেরে মাটির বক্ষ সে বিদীর্ণ ও ওলট-পালট করে দেয়। এজন্যে নিজের দেহের রক্ত পানি করে দিতে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হয়না। চেষ্টা ও শ্রমেও সে একবিন্দু ত্রুটি থাকতে দেয়না। ফলে সুন্দর শ্যামল ও সতেজ অংকুর ফুটে বের হয়, গাঢ় সবুজে মাঠ একদিক থেকে অন্যদিকে ভরে যায়। সে মনোরম দৃশ্য দেখে কৃষকের চোখ জুড়িয়ে যায়, কলিজা শীতল হয়। কিন্তু সহসাই ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা এসে মাথা তুলে উঁচু হয়ে ওঠা ফসলের চারাগুলো জাপটে ধরে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সবগুলো খেয়ে ফেলে। মাঠের সবুজ-শ্যামল শোভা অন্তর্হিত হয়ে পান্ডুবর্ণ ধারণ করে, গাছগুলো নিঃশেষে মরে পঁচে যায়।
অনুরূপভাবে সহসা উদ্বেলিত হয়ে আসা বন্যা-প্লাবনের স্রোতে ক্ষেতের ফসল ভেসে যায়। বৃষ্টি কম বা বেশী হলেও এর পরিণতি অত্যন্ত খারাপ করে দেয়। এটা দেখে কৃষক নৈরাশ্য ও হতাশায় ভেঙে পড়ে। এ সময় তার মনে দুঃখ ও দুশ্চিন্তার মেঘপুঞ্জ জমে ওঠে। তা দূর করার কি উপায় থাকতে পারে? এ এমন দুঃখ যা মানব জীবনের তিক্ত বাস্তব ও তার আশাব্যঞ্জক প্ল্যান-প্রোগ্রামের মাঝে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের ফলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মৃত্যুর অবিচল মহাসত্য মানুষের সমস্ত রঙীন স্বপ্ন, শক্তি ও পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়। ঘটনাবলীর মৌল উপাদানসমূহের এই বিশ্লিষ্টতা এবং মৃত্যুর এই অমোঘ আক্রমণ দেখে সে বিদ্রোহ করতে উদ্ধত হয়; এমনকি কখনো-সখনো হতাশায় তার আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে। এই সময় একটি বিশ্বাসই তাকে আশ্রয় ও সান্ত্বনা দেয়। তা হচ্ছে মহান স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই তার সম্মুখে জমাটবাঁধা পুঞ্জীভূত অন্ধকারের মাঝে উজ্জ্বল আলোক-বর্তিকা হয়ে পথ দেখায়-আশার প্রতীক হয়ে তাকে সম্মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বস্তুত এই বিশ্বাসই মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল অবস্থায় সব রকমের প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম। তাই মানুষের জীবন ধারাকে নৈতিক ও ধর্মীয় বিধি-বন্ধনের ছাঁচে ঢেলে তৈরী করা অপরিহার্য। খোদার প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও তাঁর আনুগত্য করে চলার মানসিক প্রস্তুতিই তার এই প্রয়োজন পূরণ করে-জীবনকে সুন্দর, সুসংবদ্ধ ও সুশংখল করে তোলে। এই বিশ্বাসই তার জীবনে এনে দেয় কাংক্ষিত গতিময়তা, অপরিসীম শক্তি-সাহস। এভাবেই সংস্কৃতিতে খোদা-বিশ্বাস, অন্যকথায় ধর্মবোধ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে বসেছে। কেননা যে জ্ঞান-বিদ্যা মানুষকে দূরদর্শীতা ও আলো দান করে, নিয়তির উপরিউক্ত জটিল আবর্তে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন এই বোধ ও বিশ্বাসই হয় তার একমাত্র অবলম্বন। তার কারণ হল, যে সব পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক-সম্বন্ধ সারা জীবন ধরে সুদৃঢ় হয়ে রয়েছে তা মানব মনে একটা আবেগ ও উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে আর এই আবেগ-উচ্ছ্বাসই তাকে এসব ব্যর্থতার বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। মানুষের এসব প্রয়োজনের দরুণই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ধর্মের একটা উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব স্বীকৃত। ধর্মের ভিত্তিতে সংস্কৃতি যেমন পায় দৃঢ়তা ও পরিপক্কতা, তেমনি লাভ করে নতুন জীবন-প্রেরণা ও শক্তিমত্তা।
খেলা–ধূলা ও আনন্দোৎসব
আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ভালোবাসা বংশীয় আনুগত্যের প্রাণ-কেন্দ্র। স্থাপিত সহানুভূতি ও কল্যাণ-কামনামূলক আবেগ-উচ্ছ্বাস, ভ্রাতৃত্ববোধ ও বংশীয় সম্পর্ক-সম্বন্ধের ওপর সংস্কৃতি-প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপিত। এ সবের সমন্বয়ে সৃষ্ট রকমারি ব্যস্ততা ও উৎসব-অনুষ্ঠান চিত্তবিনোদনের উৎস। লোকদের স্নায়ুবিক শ্রান্তি বিদূরণের সুসংগঠিত পন্থা হচ্ছে প্রতিদিনকার খেলা-ধূলা ও শিল্প-কলা সংক্রান্ত নৈপুণ্য ও দক্ষতা। এগুলো প্রাত্যহিক চিন্তা-ভাবনা ও ব্যতিব্যস্ততার ঝঞ্ঝাট থেকে মানুষকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদের মনে এনে দেয় গভীর প্রশান্তি, স্থিতি ও চিরসতেজতা। শিশু তার কণ্ঠে ধ্বনি তুলে আপন পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও বংশ-পরিবারের অন্যান্য লোকদের সাথে নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। তার জীবনের বিভিন্ন স্তরে তার খেলা-ধূলাও হয়ে যায় বিভিন্ন ধরণের। অন্য কথায়, তার খেলা-ধূলায় নিত্য পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। এই সময়-কালেই শিশুর মধ্যে নৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়, ধীরে ধীরে চরিত্রের সুস্পষ্ট বিশেষত্ব ও গুণাবলীও প্রকাশ পেতে থাকে। অন্যদিকে পারস্পরিক বন্ধুতা ও ভালবাসার সম্পর্কও গড়ে উঠতে শুরু করে অনেকের সাথে। নিজেদের মধ্যে গোপন বন্ধুতা এবং বয়স্ক সহচরদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বিশালতা লাভ করে। শিশুরা যখন যৌবনে পদার্পণ করে, তখন তাদের মেজাজ-প্রকৃতি অনেকখানি বদলে যায়। তখন সামান্য বিষয়াদি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া হয়। অভিনয় ও নৃত্যের অনুশীলন কিংবা কোন শৈল্পিক দক্ষতাজনিত ব্যস্ততা, তা সাজসজ্জামূলক অলংকরণ হোক কি চাক্চিক্যপূর্ণ ছবিই হোক-তাতে একটা সৃজনশীল ও চিত্তবিনোদনমূলক ভাবধারা নিহিত থাকে। এ ভাবধারা স্বভাবতঃই পূর্ণতা ও ক্রমন্নোয়নের দাবি রাখে আর এ সবের মাধ্যমে সামাজিক ঘনিষ্ঠতা পরিপক্কতা ও জাতীয় চরিত্র রূপ পরিগ্রহ করে।
শিল্প সাধনা
সমগ্র সাংস্কৃতিক তৎপরতায় শিল্পসাধনা আন্তর্জাতিক ও আন্ত-বংশীয় মূল্যায়নের সর্বাগ্রগণ্য। গান-বাজনা এ সমস্ত শিল্প সাধনায় একটা বিমূর্ত ও পরিচ্ছন্ন শিল্প রূপে গণ্য। তাতে প্রযুক্তিবিদ্যা ও কলা-কৌশলগত ব্যাপারের বিশেষ কোন সংমিশ্রণ নেই। তাতে সুর ও তাল বা ধ্বনির উত্থান-পতনের দিকেই লক্ষ্য আরোপ করা হয়। নৃত্যে এই ভাবধারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতিময়তা ও হাত-পা সঞ্চালনের দ্বারাই প্রকাশ পায়।
অবয়ব ও মুখাকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সুসজ্জায়নে বিভিন্ন রং-এর প্রয়োগ ও নানা রকমের নিপুণ অংকন, পোশাক-পরিচ্ছদের নানা স্টাইল, দ্রব্যাদির নানা রং ও বর্ণময় ছবি, মিনা রচনা ও কারুকার্যখচিত আলপনা ইত্যাদির সমন্বয় ঘটে। ভাস্কর্য, কাঠের ওপর কারুকার্য সংক্রান্ত সমস্ত কাজে সৌন্দর্য ও রুচিশীলতাই প্রকট। কবিতা রচনা, কবিতা আবৃত্তি, ভাষার সচলতা ও নাটকীয় শৈল্পিক অভিব্যক্তি উন্নতমানে সম্ভবত সমান ব্যাপকতা লাভ করেনি; কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে বিলীনও হয়ে যায়নি। এসব শিল্প-কুশলতার বহিঃপ্রকাশ ইন্দ্রিয়নিচয়কে প্রভাবিত করে। সৌন্দর্য বিষয়ক রুচিশীলতা এখান থেকেই পায় প্রাণ-স্পর্শ। নানা ধরণের সুগন্ধিময় ও সুস্বাদু উপাদেয় খাদ্য-পানীয়ও এ পর্যায়ে গণ্য।
একজন দক্ষ শিল্পী ও কারিগর যেসব জিনিস তৈরী করে, তাতে সমাজের লোকদের বিশেষ আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক। একারণেই শিল্পীদের উচ্চ মান-মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। শিল্পীর নৈপুণ্যের দরুণ এসব দ্রব্যের অর্থনৈতিক মূলমানও বৃদ্ধি পায়। সৌন্দর্য-স্পৃহা ও রুচিশীলতার চরিতার্থতা বিধানের দরুন সামাজিক সন্তোষ ও পৃষ্ঠপোষকতা অর্জিত হয় এবং ক্রমশ এসব দ্রব্য জনগণের সৌন্দর্যবোধ এবং অথনৈতিক ও প্রকৌশলী মানদণ্ড প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। দুর্লভ কারুকার্যখচিত শাল, কার্পেট, কম্বল, চাটাই ও পিতল নির্মিত তৈজসপত্র ও মিনা-করা থালা-বাসনও এর মধ্যে শামিল।
ধর্ম–বোধ ও শিল্প–কলা
অতি-প্রাকৃতিক (Super natural) সত্তায় মানুষের রয়েছে দৃঢ় প্রত্যয়। এ প্রত্যয় অতি সুপ্রাচীন। মূর্তি, ছবি, প্রতিমূর্তি (Statue), কারুকার্য, নকশা, সাধারণ অনুষ্ঠানাদি, মৃত্যু সম্পর্কিত কার্যাদি, কুরবানী বা বলিদান ইত্যাকার কাজগুলো তাকে এসব অতি-প্রাকৃতিক সত্তাসমূহের নৈকট্য লাভে সাহায্য করে; তার হৃয়াবেগকে উদ্বেলিত করে। মৃতের জন্য বিলাপ করা, গীত গাওয়া ও শোক-গাথা গাওয়ার ফলে লাশটি অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে পরজগতে স্থানান্তরিত হয় বলে মনে করা হয়। প্রাচীন মিশরে মমির চতুঃপাশে নানা রূপ আলপনা ও মাঙ্গল্য চিত্র অংকন করা হতো। আর এভাবেই এক জগত থেকে অপর জগত পর্যন্তকার পথ অতিক্রম করা হতো। অন্যদিকে বড় বড় জন-সম্মেলনে নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে ধর্মপ্রচারের কাজ সম্পন্ন করানো হতো। এখনো খৃষ্টানদের গীর্জায় গীত গাওয়া হয়, হিন্দুদের পূজা-মন্দিরে দেবমূতির্র সম্মুখে আরতি করা হয়। শিখ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতেও অনুরূপ কাজই করা হয়। গান-বাজনা তাদের ধর্মানুষ্ঠান ও পূজা-পার্বন অনুষ্ঠানের অপরিহার্য অংশরূপে গণ্য। আর এসব শৈল্পিক দক্ষতাপূর্ণ অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন শ্রেণীর লোক সমবেত হয়ে সমস্ত কাজ-কর্ম একত্রে সম্পন্ন করে।
জ্ঞান–বিজ্ঞান ও শিল্প–কলা
জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সাহিত্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সেই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পযর্বেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাও অপরিহার্য। শিল্প-কলা পরিবেশ পযর্বেক্ষণ ও অধ্যয়নের আগ্রহ ও উৎসুক্যের সৃষ্টি করে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বিশ্লেষণে শিল্প-কলারই সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। ফলে বৈজ্ঞানিক উপায় ও পদ্ধতির উৎকর্ষ লাভে পরোক্ষভাবে শিল্প-কলারও উৎকষের্র একটা পথ তৈরী হয়ে যায়। অনুরূপভাবে উপকথা ও গল্প-উপাখ্যান, শিল্প ও বিজ্ঞানের সংমিশ্রণ আর এই সব সাংস্কৃতিক সুসংবদ্ধতা কোন বিশেষ জিনিস সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করার জন্যে বতর্মান থাকা জরুরী।
এক কথায় সংস্কৃতি একটি অত্যন্ত কল্যাণময় সত্য ও বাস্তবতা। মানুষের প্রয়োজন পরিপূরণে তার প্রয়োগ অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সংস্কৃতি মানুষকে একটি আপেক্ষিক ও দৈহিক বিস্তৃতি ও বিশালতা দান করে। তার ফলে ব্যক্তিসত্তা লাভ করে সংরক্ষণ ও প্রতিরক্ষার অনুভূতি। পরন্তু ব্যক্তিত্বের সে বিস্তৃতিতে রয়েছে গতিময়তা। তা মানুষকে এমন অবস্থায় সাহায্য করে যখন তার অন্তঃসারশূণ্য ও রিক্ত দেহ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়।
সংস্কৃতি মানুষের সামষ্টিক সৃষ্টি। তা ব্যক্তি মানুষের কর্মক্ষেত্র ও কর্মশক্তি ব্যাপকতর করে দেয়; চিন্তাশক্তিকে দেয় গাম্ভীর্য ও গভীরতা, দৃষ্টিকে করে সম্প্রসারিত। দুনিয়ার অন্যান্য জীব-জন্তুর মধ্যে তার উপস্থিতি কল্পনাতীত। কেননা এই সব কিছুর উৎস হচ্ছে ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার সামষ্টিক রূপ এবং পারস্পরিক চিন্তা ও কর্মশক্তির সমন্বয়।
এ কারণে সংস্কৃতি ব্যক্তি সত্তাকে সুসংগঠিত রূপে ঢেলে গঠন করে এবং এসব জনগোষ্ঠীকে এক অন্তহীন ধারাবাহিক জীবন দান করে। মানুষের কার্যাবলীর পারস্পরিক সামঞ্জস্য তার দৈহিক ও স্বভাবগত চরিত্রের কারণে ঘটে, মানুষ এ অর্থে কোন সামষ্টিক সত্তা নয়।
সংগঠন ও সামষ্টিক কর্মপদ্ধতি ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্নতা ও অক্ষুন্নতার ফসল। তা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। সংস্কৃতি মানুষের স্বভাবগত চরিত্রে বহুবিধ তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করে। আর তা এভাবে মানুষের ওপর কেবল অনুগ্রহই বর্ষণ করে না, তার ওপর নানাবিধ দায়িত্বও আরোপ করে এবং তাকে বহু প্রকার ব্যক্তি-স্বাধীনতা পরিহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর অনিবার্য পরিণতি সামষ্টিক কল্যাণ।
নিয়ম-শৃংখলা মেনে চলা এবং আইন ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা মানুষের কর্তব্য। কর্তব্য পালন ও বলন-কথনকে একটা বিশেষ ছাচে ঢেলে গড়ে নিতে হয় তাকে। তাকে এমন সব কাজ নিষ্পন্ন করতে হয়, যার কল্যাণ লাভ করে অন্যান্য বহু লোক। পক্ষান্তরে তার নিজের জরুরী কার্যাবলী সুসম্পন্ন করার ব্যাপারে তাকে অনুগৃহীত হতে হয় অন্য লোকদের।
সংক্ষেপে বলা যায়, মানুষের পর্যবেক্ষণ শক্তি ও দূরদর্শিতা এমন সব কামনা-বাসনার সৃষ্টি করে, যে সবের চরিতার্থতা ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস, জ্ঞান-চর্চা পদ্ধতি এবং সাহিত্য ও শিল্পের উৎকর্ষ সাধন করে।
সংস্কৃতি মানব প্রকৃতির অন্তর্গত চাহিদার পরিতৃপ্তি ও চরিতার্থতারই ফসল। তা মানুষকে নিছক পশুর স্তর থেকে উন্নীত করে ভিন্নতর এক সত্তা দান করে। ফলে মানুষের নিতান্ত জৈবিক কামনা-বাসনা ও তার পরিতৃপ্তির ক্ষেত্র ও পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
যন্ত্র নির্মাণকারী ও কর্মীসত্তা হিসেবে মানুষের প্রয়োজন বিপুল ও ব্যাপক। তার ব্যক্তিত্বের কয়েকটি দিক সুস্পষ্টঃ
একজন ব্যক্তি (Individual) হিসেবে সে এমন একটি সমাজের সদস্য, যার লোকেরা পরস্পর মিল-মিশ ও কথা-বার্তার সূত্রে পরস্পর সংযুক্ত-সম্পর্কশীল। এহেন এক সহযোগিতা-ভিত্তিক শ্রমজীবি এককের (Unit)সদস্য হিসেবে মানুষ ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা সংরক্ষণের যিম্মাদার। অতীতের স্মৃতি তার মানসপটে চির-জাগ্রত। এ স্মৃতির সাথে রয়েছে তার মায়ার সম্পর্ক। কিন্তু তার সামনে অনাগত ভবিষ্যত। তারই ওপর নিবদ্ধ তার সমস্ত সত্তার লক্ষ্য-দৃষ্টি। এই ভবিষ্যতই তার হৃদয়-মনে আশা-আকাংক্ষার নির্মল আলো বিকীরণ করে।
শ্রমবণ্টন ও ভবিতব্যের সীমাহীন সম্ভাবনা এমন সব সুযোগ মানুষের সম্মুখে নিয়ে আসে, যার রূপ-সৌন্দর্য, চাক্চিক্য ও সুর-ঝংকারে তার হৃদয়-মন পরম উল্লাসে হয় চিরনৃত্যশীল।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার পার্থক্য
ব্যক্তির সার্বিক সুস্থতা ও ক্রমপ্রবৃদ্ধির জন্যে তার দেহ ও প্রাণ বা আত্মার ভারসাম্যপূর্ণ উৎকর্ষ একান্তই জরুরী। এ যেমন সত্য, তেমনি একটি জাতির উন্নতি তখনি সম্ভব, যখন তার সংস্কৃতি ও সভ্যতা পুরোপুরি সংরক্ষিত হবে। কেননা সংস্কৃতি হচ্ছে প্রাণ আর সভ্যতা হচ্ছে দেহ।
অর্থাৎ মানব জীবন দুটি দিক সমন্বিতঃ একটি বস্তুনির্ভর, অপরটি আত্মিক বা আধ্যাত্মিক। এ দুটিরই রয়েছে বিশেষ বিশেষ চাহিদা ও দাবি-দাওয়। সে চাহিদা পরিপূরণে মানুষ প্রতিমুহূর্ত থাকে গভীরভাবে মগ্ন ও ব্যতিব্যস্ত। একদিকে যদি দৈহিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন তাকে টানে এবং জীবিকার সন্ধানে সে হয় নির্লিপ্ত, তাহলে তার আত্মার দাবি পরিপূরণ ও চরিতার্থতার জন্যে তার মন ও মগজ হয় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
তাই মানুষের বস্তুনিষ্ঠ বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণের জন্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তার সহায়তা করে। আর ধর্ম-বিশ্বাস, শিল্প-কলা, সৌন্দর্যবোধ ও দর্শন নিবৃত্ত করে তার আত্মার পিপাসা। অন্যকথায়, ব্যক্তিদের সূক্ষ্ণ ও সুকোমল আবেগ-অনুভূতি এবং হৃদয় আত্মার দাবি ও প্রবণতা পূর্ণ করে যেসব উপায়-উপকরণ, তা-ই হচ্ছে সংস্কৃতি। সঙ্গীত, কবিতা, ছবি অংকন, ভাস্কর্য, সাহিত্য, ধর্মবিশ্বাস, দার্শনিক চিন্তা প্রভৃতি এক-একটা জাতির সংস্কৃতির প্রকাশ-মাধ্যম এবং দর্পণ। কোন বাহ্যিক ও বৈষয়িক উদ্দেশ্য লাভের জন্যে এসব তৎপরতা সংঘটিত হয় না। আত্মিক চাহিদা পূরণই এগুলোর আসল লক্ষ্য। এসব সৃজনধর্মী কাজেই অর্জিত হয় মন ও হৃদয়ের সুখানুভূতি-আনন্দ ও উৎফুল্লতা। একজন দার্শনিকের চিন্তা ও মতাদর্শ, কবির কাব্য ও কবিতা, সুরকার ও বাদ্যকারের সুর-ঝংকার-এসবই ব্যক্তির হৃদয়-বৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। এসবের মাধ্যমেই তার মন ও আত্মা সুখ-আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করে। এসব মূল্যমান, মূল্যবোধ, হৃদয়ানুভূতি ও আবেগ-উচ্ছ্বাস থেকেই হয় সংস্কৃতির রূপায়ন। কিন্তু সভ্যতার রূপ এ থেকে ভিন্নতর। এখানে সংস্কৃতি ও সভ্যতার একটা তুলনামূলক পরিচয় দেয়া যাচ্ছেঃ
১. বস্তুনিষ্ঠ জীবনের প্রয়োজন পূরণ ও সাবলীলতা বিধানে যা কিছু সাহায্যকারী তা সভ্যতা নামে অভিহিত।
কিন্তু মন-মানস ও আত্মার কামনা-বাসনা ও সূক্ষ্ণ আবেগ-অনুভূতির চরিতাথর্তার উপায়-উপকরণকেই বলা হয় সংস্কৃতি।
২. বস্তুনিষ্ঠ জীবনের রূঢ় বাস্তব ও প্রকৃত উন্নতির স্তর ও পর্যায়সমষ্টি হচ্ছে সভ্যতা। বিশেষ-নির্বিশেষ সকলের পক্ষেই তার মূল্য ও মান হৃদয়ঙ্গম করা সহজ ও সম্ভব।
কিন্তু সংস্কৃতি অদৃশ্য ধারণা ও মূল্যমান সমষ্টি; তার মূল্যায়ন অতীব দুরূহ কাজ।
৩. সভ্যতা ক্রম-বিকাশমান, প্রতি মুহূর্ত উন্নতিশীল। প্রাচীন মতাদর্শের সাথে তার দূরত্ব ক্রম-বর্ধমান। তা নিত্য-নতুন দিগন্তের সন্ধানী।
কিন্তু সংস্কৃতি প্রাচীনপন্থী। প্রাচীনতম দৃষ্টিকোণ ও মতাদর্শ থেকে নিঃসম্পর্ক হওয়া তার পক্ষে কঠিন।
৪. সভ্যতা দেশের সীমা-বন্ধনমুক্ত- বিশ্বজনীন ভাবধারাসম্পন্ন। প্রায় সব চিন্তা-বিশ্বাসের লোকদের পক্ষেই তা গ্রহণযোগ্য।
কিন্তু সংস্কৃতির ওপর পরিবেশ ও ভৌগোলিক বিশেষত্বের ব্যাপক প্রভাব প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ সংস্কৃতি আঞ্চলিক ও ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বহুলাংশে বন্দী; কেবলমাত্র সমমতের লোকদের পক্ষেই তা গ্রহণযোগ্য হয়। যেমন মুসলমান, হিন্দু, খৃস্টান ও বৌদ্ধদের সাংস্কৃতিক মেজাজ-প্রকৃতির ওপর তাদের বিশেষ ধমের্র সর্বাত্মক প্রভাব বিরাজিত। সেই সঙ্গে উপমহাদেশের একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও সংস্কৃতির দিক দিয়ে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মুসলমানদের থেকে বহুলাংশে ভিন্নতর।
৫. সভ্যতা স্থিতিশীল ও দৃঢ়তাপ্রবণ। তার প্রভাব সহজে নিশ্চিহ্ন হবার নয়।
কিন্তু সংস্কৃতি প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্তই অস্থায়িত্ব ও ক্ষণভঙ্গুরতার ঝুঁকির সম্মুখীন।
৬. সভ্যতা মানুষের বাহ্যিক জীবন নিয়ে আলোচনা করে। বস্তুগত প্রয়োজনাবলীই তার লীলাক্ষেত্র। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবনী ও বিভিন্ন শৈল্পিক দুর্লভ উপকরণ ও প্রতিষ্ঠানাদি (সভ্যতার মহাকীর্তি) এক দেশ ও জাতি থেকে ভিন্নদেশ ও জাতির মধ্যে চলে যেতে পারে। অনুন্নত জাতিগুলোও তা থেকে উপকৃত হতে পারে। স্বভাব-প্রকৃতিগত পার্থক্য তার পথে বাধা হতে পারেনা। প্রত্যেক ব্যক্তিই তা ব্যবহার করে কল্যাণ লাভ করতে পারে। তার কল্যাণ লাভে কোন প্রতিবন্ধকতাই নেই। বাছাই-প্রক্রিয়াও এখানে অচল।
কিন্তু সংস্কৃতি সাধারণত এক বংশ থেকে তারই অধঃস্তন বংশে উত্তরিত হয়। তা সম্যকভাবে অর্জিত হয় না। বাছাই-প্রক্রিয়া এখানে পুরোপুরি কার্যকর। কেবলমাত্র বিশেষ পরিমণ্ডলের লোকদের পক্ষেই তার কল্যাণ লাভ করা সম্ভব। দার্শনিকসুলভ চিন্তা-গবেষণা ও কবিসুলভ উচ্চমার্গতার অনুভূতি যার-তার পক্ষে আয়ত্তযোগ্য নয়।
৭. সভ্যতা অর্জন করা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। সেখানে তেমন কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়না। জাপান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে আপন করে নিয়েছে; কিন্তু এ কার্যক্রমের ফলে তার সাংস্কৃতিক কাঠামো খুব শীগ্গীর প্রভাবিত হতে পারেনি। উপমহাদেশের জনগণের ওপর ইংরেজের শাসনকার্যের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবে এখানকার সভ্যতা উপকৃত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানকার সংস্কৃতি তার আসল চরিত্র বা রূপরেখা হারায়নি।
কেননা সংস্কৃতি আভ্যন্তরীণ জীবন-কেন্দ্রিক। অন্তর্নিহিত জীবনই সংস্কৃতির লীলাক্ষেত্র। এই জীবনের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের মাধ্যম হচ্ছে সংস্কৃতি। অর্থাৎ সংস্কৃতি হচ্ছে মন ও মগজ-কেন্দ্রিক- আবর্তন-বিবর্তনের স্বতঃস্ফূর্ত ও উন্মুক্ত বহিঃপ্রকাশ। এই কারণে সংস্কৃতি স্বাধীন-মুক্ত সমাজ-পরিবেশেই যথার্থ উৎকর্ষ লাভ করতে পারে।
মোটকথা, আমরা যা ভাবি, চিন্তা করি, বিশ্বাস করি, তা-ই সংস্কৃতি। হৃদয়ানুভূতি, চিত্তবৃত্তি, আবেগ-উচ্ছ্বাস ও মানসিক ঝোঁক-প্রবণতার সাথে তার নিবিঢ় সম্পর্ক। কেননা এগুলো মানুষের মধ্যে স্বভাবগত ও প্রকৃতিকগতভাবেই বতর্মান। মানব-প্রকৃতি তার সাথে নিঃসম্পর্ক হতে পারে না কখনই। সভ্যতায় রয়েছে মানুষের সামাজিক ও অনৈতিক প্রয়োজনাবলীর প্রশ্ন। মানব জীবন যদি শিল্প-কারখানা ছাড়াই অবাধে চলতে পারে, এবং তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা হতে থাকে, তাহলে তার জন্যে সামান্যতম কাতর হওয়ারও কোন প্রয়োজন বোধ হবে না কারোর।
সভ্যতা ও সংস্কৃতি অনেক ক্ষেত্রে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়; কিন্তু ঢালাওভাবে এটা ঠিক নয়। তবে এ দুটির মাঝে মূল্যমানের সাদৃশ্য অনস্বীকার্য। মোটরগাড়ি সভ্যতার উৎপাদন। সংস্কৃতি তাতে সৌন্দর্য, শোভনতা ও চিত্ত-বিনোদনমলূলক কারুকাজ ও সূক্ষ্ণ উপকরণাদি বৃ্দ্ধি করেছে। সভ্যতা আকাশচুম্বী প্রাসাদ নির্মাণ করেছে; সংস্কৃতি সে প্রাসাদকে সুদৃশ্য, মহিমামণ্ডিত এবং বিস্ময়কর প্যাটার্নে সুশোভিত করে দিয়েছে। বস্তুত সভ্যতা ও সংষ্কৃতি দুটিই মানব জীবনের মৌল প্রয়োজন। যে জাতির জীবনে একসঙ্গে এ দুটিরই সমন্বয় ঘটেনি, তার উন্নতি অসম্ভব। সভ্যতা একটা জাতিকে বস্তুনিষ্ঠ শক্তিতে মহিমাময় করে আর সংস্কৃতি তাকে গতিবান করে নিভুর্ল পথে। মানব সভ্যতার আধুনিক পর্যায়ে এ দুটির মাঝে গভীর একাত্মতা প্রকট। তাই সভ্যতার অর্থে সংস্কৃতি বা সংস্কৃতি অর্থে সভ্যতাকে গ্রহণ করা কিছুমাত্র অশোভন নয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ এভাবেই পূর্ণ পরিণতি পযর্ন্ত পৌঁছে গেছে বললেও কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না।