আমাদের শিক্ষা সমস্যা
সাধারণ মানবিক দৃষ্টিতে এবং বিশেষভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি-প্রতিভার স্ফুরণ, ক্রমবিকাশ দান এবং সূক্ষ্ণ মানবীয় ভাবধারা- আবেগ উচ্ছাসের- সুষ্ঠুতা ও পরিচ্ছন্নতা বিধানের একমাত্র উপায় শিক্ষা। মানুষ তার বাহ্যিক আকার-আকৃতি ও স্বভাবগত শক্তি-প্রতিভার দিক দিয়ে নিতান্ত পাশবতার পর্যায়ে অবস্থিত। তাকে মনুষ্যত্ব ও মানবতার উন্নত মর্যাদায় তুলে আনতে হলে শিক্ষা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় তার করায়ত্ত নয়। মানুষ যতক্ষণ জানতে ও হৃদয়ঙ্গম করতে না পারবে যে সে মানুষ- মানুষ হিসেবে তার মাঝে অমুক অমুক মানবীয় গুণের সমাবেশ ঘটা আবশ্যক এবং তাকে অমুক অমুক দায়িত্ব পালন করতে হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে সত্যিকারভাবে মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারবে না- পারবেনা মানুষের মতো আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্র গ্রহণ করতে। তাই মানব সভ্যতার শুরু থেকেই শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, শিক্ষাকে মানুষের জন্যে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়েছে এবং এ অপরিহার্যতা সম্পর্কে মনাবসমাজ চিরকালই ঐকমত্য পোষণ করে এসেছে। বস্তুত শিক্ষা দুনিয়ার মানব সমাজের জন্যে একটি মৌলিক ব্যাপার। শিক্ষা সমস্যা তাই দুনিয়ার সকল জাতির পক্ষেই সর্বাধিক জটিল সমস্যা। এ সমস্যার আশু সমাধান হওয়া প্রতিটি জাতির জন্যেই একান্ত জরুরী। কেননা এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় জীবনের অন্য কোন সমস্যারই একবিন্দু সমাধান লাভ করা সম্ভব নয়। তবে আমার দৃষ্টিতে শিক্ষার সাধারণ মৌল সমস্যাই সর্বপ্রথম বিবেচ্য।
শিক্ষার মৌল সমস্যা
শিক্ষার সাধারণ ও মৌল সমস্যা হল শিক্ষাদর্শনের সমস্যা। কেননা মূলগতভাবে শিক্ষা ও জীবন পরস্পর-বিজড়িত-অবিচ্ছিন্ন। কোন জনসমষ্টির শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতি সেই জনসমষ্টিরই জীবন-দর্শন ও জীবন পদ্ধতিরই নামান্তর। অন্য কথায়, জীবন-দর্শন ও শিক্ষাদর্শ মৌলিকভাবেই এক। শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রে দুনিয়ার চিন্তাবিদদের মাঝে যে মতবিরোধ, তা আসলে জীবন-দর্শন পর্যায়ের মতবিরোধেরই বহিঃপ্রকাশ। প্রত্যেক জাতিই তার বংশধরদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সেই পন্থা ও পদ্ধতিতেই দিয়ে থাকে, যা তার জীবন-লক্ষ্য অর্জনে এবং তার পূর্ণতা বিধানে পুরোপুরি কার্যকর; যে পথে চললে শিক্ষার্থীর জীবনকে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ থেকে সাফল্যমণ্ডিত বলা যাবে। যে জাতির জীবন-উদ্দেশই হচ্ছে নিছক বস্তুগত, ক্ষণস্থায়ী এবং নশ্বর, তার চলমান জীবনের সামগ্রী সংগ্রহ ও উন্নতি বিধান, তার শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচী, বই-পুস্তক, শিক্ষক-প্রশিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তার গোটা পরিবেশই হবে ক্ষয়িষ্ণু ও সীমাবদ্ধ জীবন-দৃষ্টির তৃপ্তি বিধানকারী।
পক্ষান্তরে কোন জাতির দৃষ্টিতে এ ক্ষয়িষ্ণু জীবন যদি শুধু একটি ‘চলার পথ’- একটা ‘অসীলা’ মাত্র হয় আর চিরন্তন ও শাশ্বত জীবনের সাফল্যই যদি হয় মনযিলে মক্সুদ, তাহলে তার গোটা শিক্ষা-ব্যবস্থার একটি সামান্য অনুষ্ঠানই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দেবে যে, এর পেছনে পরকালেরর প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস এবং পরকালীন কল্যাণ লাভই এর চরমতম লক্ষ্য। অনুরূপভাবে কোন জাতির লক্ষ্য যদি নিছক দৈহিক ও মানসিক শক্তির স্ফূরণ ও বিকাশদান হয়, তাহলে তার শিক্ষা ব্যবস্থাও হবে তারই প্রতীক। বস্তুত জাতীয়তাবাদী, স্বাদেশিকাতাবাদী, বস্তুবাদী কিংবা বৈরাগ্যবাদী নির্বিশেষে সকল সমাজ ও জাতি সত্তাই নিজস্ব আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয় তাদের নিজস্ব জীবন-দর্শন, জীবন-লক্ষ্য ও দৃষ্টিকোণ। সেই সঙ্গে তাদের জীবন-দর্শনের ভালো-মন্দ, ভুল-নির্ভুল এবং পূর্ণ-অপূর্ণ হওয়া সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্য বিষয় এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ-পদ্ধতি দেখেই। এক কথায়, মানুষের স্বভাব-চরিত্র, জীবন-ধারা এবং তার ইচ্ছামূলক কার্যাদির পথ নির্ধারিত হয় তার জীবন-লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই।
জীবন–লক্ষ্যের তাৎপর্য ও গুরুত্ব
শিক্ষা হল আসলে জীবন-গঠনের প্রস্তুতি। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদগণ সম্পূর্ণ একমত। মতভেদ দেখা দিয়েছে শুধু জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণের ব্যাপারে। মানব জীবনের এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হচ্ছে একটি স্থায়ী ও দৃঢ় বিশ্বাসের ব্যাপার; মানুষের অন্তর্নিহিত প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির লালন-পালন এবং চিন্তা-বিশ্বাসের ক্রমবিকাশ লাভ একে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। পরে এই ইচ্ছা-বাসনা, অন্তর্নিহিত ভাবধারা ও আবেগ-উচ্ছাস থেকেই বাস্তব চরিত্রের নির্ঝর উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষিতে একথা বলায় কোন ভুল নেই যে, এই মানসিক ভাবধারাই হচ্ছে মানুষের সব চিন্তা-বিশ্বাস ও আবেগ-উচ্ছাসের মূল উৎস; তার যাবতীয় কাজকর্ম, তৎপরতা ও ব্যতিব্যস্ততা পরিচালিত হয় এ জিনিসকে কেন্দ্র করেই।
মানুষের বাহ্যিক নৈতিকতায় তার অন্তর্নিহিত ধারণা ও বিশ্বাসগত ভাবধারারা অমোঘ প্রভাব এবং সেসবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদরাও স্বীকার করেন। কেননা এ জিনিসই মানুষের সমস্ত কর্মক্ষমতার নিয়ামক। মানুষের গোটা মানসিক ও শারীরিক শক্তিই একান্তভাবে এ জিনিসের পরিপূরক ও বাস্তবায়নে নিয়োজিত হয়; মানুষ এজন্যে নিজের প্রাণ ও জীবন পর্যন্ত কুরবান করতেও কুণ্ঠিত হয় না। দুনিয়ার সব দৃঢ়তম সংগঠন ও সংস্থার পিছনে এহেন চুম্বক শক্তিই কাজ করছে। তাই এ জিনিসটি যাতে সঠিকভাবে গড়ে ওঠে এবং জাতীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্য মুতাবেক কাজ করে, তার ব্যবস্থা করা প্রতিটি জাতি ও জাতীয় সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব রূপে গণ্য।
এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মজবুত যে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে, সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানব জীবনের চরমতম বস্তুগত লক্ষ্য ও বৈষয়িক উন্নতি লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। কেবল বৈষয়িক উদ্দেশ্যই নয়, যে কোন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন করতে চান আপনি, আপনার শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনুরপ ফলদায়ক করে গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোন উপায়ই আপনার থাকতে পারে না।
আমরা যেহেতু আমাদের শিক্ষাগত সমস্যা সম্পর্কেই আলোচনা করতে চাচ্ছি তাই বলবোঃ আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থাকেও অনুরূপ প্রস্তুতির ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে; তা না হলে স্বাধীনতার তাৎপর্য এবং আমাদের জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কোনক্রমেই অর্জিত হতে পারে না। আমরা যদি কলা গাছ রোপন করে আম ফল পেতে চাই, তাহলে হবে চরম নির্বুদ্ধিতা। বিগত বছরগুলোতে আমরা সেই নির্বদ্ধিতাই করে আসছি- করে যাচ্ছি নির্লিপ্তভাবে। আমরা ভেবেও দেখিনা- দেখতে চাই না যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি; আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদেরকে আমরা ভাসিয়ে দিচ্ছি কোন্ গড্ডালিকা প্রবাহে।
আমাদের শিক্ষাদর্শন কি হবে
আমাদের শিক্ষাদর্শন কি হবে? এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব এ-ই হতে পারে যে, আমাদের শিক্ষাদর্শন হবে তা-ই যা এখানকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন-দর্শন এবং রাষ্ট্রীয় দর্শন। আর এতদাঞ্চলের বৃহত্তর জনগনের জীবন-দর্শন ও রাষ্ট্রদর্শন কি, এ পর্যায়ে কোন কোন মহল বিতর্ক তুলতে চাইলেও একথাই চূড়ান্ত- এবং এছাড়া অন্য কোন কথাই হতে পারেনা – যে, ইসলামই হচ্ছে এখানকার জীবনদর্শন এবং রাষ্ট্রদর্শন।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস
১৯৪৭ সনের প্রথম স্বাধীনতা লাভের পর এতদাঞ্চলের জাতি ও রাষ্ট্র যেসব গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, তন্মধ্যে এখানকার শিক্ষা-ব্যবস্থাই ছিল প্রধান- যার মৌলিক সমাধান হওয়া অপরিহার্য ছিল সর্বপ্রথম। কেননা একটা আদর্শবাদী দেশ ও রাষ্ট্রের পক্ষে শিক্ষা সমস্যাই হয় জীবন মরণের সমস্যা। বিশেষ করে এ কারনে যে, উত্তরাধিকার সূত্রে এতদাঞ্চলের জনগণ যে শিক্ষা ব্যবস্থা লাভ করেছিল, তার প্রতিষ্ঠাতা ও রূপকার ছিল তাদেরই প্রাক্তন প্রভু সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ। তারা এ দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল তার স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করার জন্যে তিনটি কথা মৌলিকভাবে মনে রাখতে হবে। একটি হল এই যে, ইংরেজ ছিল তখন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার অগ্রণী। একটি বস্তুবাদী সাম্রাজ্যবাদী জাতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই বস্তুবাদী চিন্তা ও দর্শনমূলক হবে; নিতান্ত বৈষয়িক ও উপস্থিত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ এবং নীতিহীন ভোগবাদ ও স্বার্থবাদই হবে সে শিক্ষাব্যবস্থার মৌল দৃষ্টিকোণ। এটি খুবই স্বাভাবিক কথা- এর ব্যতিক্রম ধারণামাত্র করা যেতে পারেনা। আর দ্বিতীয় কথা হল, ইংরেজ ছিল এদেশের বিজয়ী প্রভু, মালিক-মুখ্তার। সেই প্রভুরা এতদঞ্চলের অধিবাসীদের জন্যে যে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরী করেছিল, তারা ছিল তাদের বিজিত গোলাম। গোলাম জাতির জন্যে এমন শিক্ষাব্যবস্থা তারা স্বভাবতই চালু করতে পারে না, যা এ গোলামদেরকে প্রভু বানিয়ে দিতে পারে কিংবা প্রভু হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারে। অন্য কথায়, গোলাম জাতিকে আরো গোলাম বানানোর উপযোগী শিক্ষাই তারা দিতে চেয়েছে, প্রভু বা স্বাধীন জাতির উপযোগী শিক্ষা নিশ্চয়ই দিতে চায়নি। আর তৃতীয়ত, একথাও উপেক্ষণীয় নয় যে, ইংরেজরা ছিল কট্টর খৃস্টান; তারা এই বিশাল অঞ্চলের রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল মুসলমানদের কাছ থেকে। আর এ রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেবার সময় তারা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল কেবলমাত্র মুসলামানদের তরফ থেকেই। এ কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষী এবং মুসলমানদের ঘোরতর দুশমন। তারা স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিল, মুসলমানদের জিহাদী শক্তির উৎস যে জীবন-দর্শন ও যে শিক্ষা ব্যবস্থা, তাকে নিঃশেষে খতম না করা পর্যন্ত এই লোকদের ওপর ইংরেজ শাসনের মজবুত বুনিয়াদ কায়েম হতে পারে না।
তাই একথা পরিষ্কার যে, ইংরেজের প্রবর্তিত সে শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাধীন দেশ ও জনগণের জন্যে কোন দিক দিয়েই উপযুক্ত ছিল না, দেশ-বিভাগের পর তা এখানে একদিনের তরেও চালু থাকা উচিত ছিল না; বরং অনিতিবিলম্বে সে শিক্ষা ব্যবস্থা বদল করে এদেশের জনগণের উপযোগী একটি আদর্শ-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা একান্ত কর্তব্য ছিল। কিন্তু এ জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, এদেশে তা করা হয়নি। পাকিস্তান উত্তর কালে শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা নিশ্চিত ও নিষ্কণ্টক করার জন্যেই দিনরাত ব্যতিব্যস্ত ছিল। মুসলিম জাতির আদর্শিক ভবিষ্যত নির্মাণের জন্যে অপরিহার্য ছিল যে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন, তার প্রতি একবিন্দু দৃষ্টি নিক্ষেপের ফুরসতও তাদের হয়নি কিংবা বলা যায়, ইংরেজের নিকট থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার কোন পরিবর্তন সাধনেরই প্রয়োজন বোধ করেননি তারা এবং তা করতেও চাননি। প্রয়োজন মেনে করেননি এ কারণে যে, শাসনযন্ত্রের সাথে জড়িত সব লোকই ছিল ইংরেজের অনুরূপ জীবন-দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট ও আস্থাবান। ফলে স্বাধীন দেশ ও জনগণের বেলায় যে তার ব্যতিক্রম কিছু হওয়া দরকার, তার চেতনাটুকু তাদের মনে জাগেনি। তারা একাজ করতে চাননি এজন্যে যে, তারা স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম নাগরিকদের উপযোগী এবং তাদের আদর্শিক চেতনার অনুরূপ শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে চালু করা হলে তা শাসকদেরই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলবে। এ কারণে একথা বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, তারা ইচ্ছে করেই এ দেশের মুসলিম জনগণকে গোলাম বানানোরে উপযোগী, অধিকতর গোলামী চেতনা সৃষ্টিকারী এবং ইসলামের প্রতি চরম অবিশ্বাস সঞ্চারকারী সম্পূর্ণ গায়র-ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাই বলবত করে রেখেছিলেন। তাই বলতে চাই, এ জাতির ভাগ্য বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছিল সেই প্রথম দিনই, যেদিন এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তিত করার অপরিহার্য প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তা করা হয়নি।
পাকিস্তান–উত্তরকালে শিক্ষা–সংস্কার প্রচেষ্টা
পাকিস্তান-উত্তর যুগে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্যে যে কোন চেষ্টাই হয়নি, তা অবশ্য বলা হচ্ছেনা। এ পর্যায়ে যা চেষ্টা হয়েছে, সংক্ষেপে তা এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে। ১৯৪৭ সনের নভেম্বর মাসে সর্বপ্রথম একটি নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান কায়েমের চার বছর পর ১৯৫১ সনের ডিসেম্বর মাসে নিখিল পাকিস্তান-ভিত্তিক এ শিক্ষা-পরিকল্পনা রচনার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই সময় এ্যাড্ভাইজারী বোর্ড, কাউন্সিল অব টেকনিকাল এডুকেশন এবং ইন্টার ইউনিভার্সিটি বোর্ড-এর এক যুক্ত অধিবেশন হয়। এরপর ’৫২ সনের জানুয়ারী মাসে কমার্শিয়াল এডুকেশন কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয়। ’৫৫ সনে প্রথম রচিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিক্ষা সম্পর্কেও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ’৫৬ সনে লাহোরে সেকেণ্ডারী এডুকেশন বোর্ড একটি কমিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষার সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবাদি পেশ করে। ’৫৭ সনের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন পূর্বপাক (বর্তমান বাংলাদেশ) সরকার শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠন করেন ও তার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ’৫৯ সনে তৎকালীন সামরিক সরকার সমগ্র দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনা করে দেশ ও জাতির প্রয়োজনের দৃষ্টিতে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা রচনার লক্ষ্যে একটি ‘শিক্ষা কমিশন’ নিয়োগ করেন। এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এসব চেষ্টা-প্রচেষ্টা সম্পর্কে একটি কথা বলাই যথেষ্ট এবং তা এই যে, ১৯৪৭ সনের স্বাধীনতা-উত্তর যুগের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় গতানুগতিকতার প্রবল প্রাধান্য অপরিবর্তিতই রয়েছে। ইংরেজের স্থলাভিষিক্ত শাসকরা কেবল বিদেশী প্রভুদের পদাংকই অনুসরণ করেছে হরফে হরফে। একবিন্দু এদিক ওদিক তাকানোকেও তারা বিদেশী প্রভুর আনুগত্য ও অন্ধ অনুসরণের ব্যতিক্রম বলে ধরে নিয়েছে। বস্তুত এরূপ কূপমণ্ডুকতা নিতান্ত গোলামদের পক্ষেই সম্ভবপর হয়ে থাকে।
এ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষানীতি যা কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট থেকে প্রমাণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট কথা এই যে, তা পূর্বাপেক্ষা অধিক মারাত্মক রূপে দেখা দিয়েছে এ জাতির পক্ষে। দ্বীন-ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের দৃষ্টিতে এ রিপোর্ট হচ্ছে চরম কলঙ্কজনক ও নৈরাশ্যব্যঞ্জক। মুসলিম জাতির নিষ্পাপ শিশু-সন্তানদেরকে ইসলামী ঈমান-আকীদার প্রতি অবিশ্বাসী, ইসলামী আমল ও আখলাকের প্রতি বিদ্রোহী এবং তাদের জীবনকে উৎকট ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির ধারক-বাহক বানিয়ে দেবার জন্যে এর মতো বড় হাতিয়ার স্বয়ং বিদেশী ইংরেজও প্রয়োগ করেনি- প্রয়োগ করতে সাহস পায়নি, যা করেছে আমাদের এই স্বজাতীয় লোকেরা। যেখানে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই ইসলামী জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করার দায়িত্ব ছিল, সেখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা ঘোষণা করেই দাবি করা হল যে, আদর্শ জাতি গঠনই এ সরকারের লক্ষ্য। অথচ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা-ও আদৌ যথার্থ নয়। তার পরিবর্তে বরং নাচ-গান শিক্ষা করাকেই কার্যত অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর মতো ধোঁকাবাজি ইতিহাসে কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
প্রচলিত শিক্ষা–ব্যবস্থার মৌল সমস্যা
যতদূর চিন্তা করতে পেরেছি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌল সমস্যাই হচ্ছে তার আদর্শবাদের সমস্যা- তার দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। স্বাধীন বাংলাদেশের বিশেষ অবস্থান এবং স্বাধীনতা অর্জনকারী জনগণ দাবী করে যে, এদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ইসলামের জীবন-দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হবে, যেন এখানে আদর্শবাদী নাগরিক গড়ে উঠতে পারে, সাধারণভাবে জাতির জনগণ এবং বিশেষভাবে শাসক, পরিচালক ও কর্মকর্তারা যেন ইসলামী চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গির ধারক হতে পারেন, যেন এই দেশ আদর্শ ও বাস্তব তথা কথা ও কাজ- উভয় দিক দিয়েই পুরোপুরি ইসলামী হয়ে ওঠে। দেশবাসীর এটা শুধু কামনা নয়, বরং একথা নিশ্চিত যে, এরূপ শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন শিক্ষা ব্যবস্থাকে তারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে রাজী নয়। এ কারণেই পাকিস্তান আমলের তেইশ বছরে দেখা গেছে, দেশের শাসকগণ সম্পূর্ণ ইসলাম-বিরোধী কাজ করতে গিয়েও ইসলামেরই দোহাই দিয়েছেন- অন্তত বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, এ কাজ ইসলাম বিরোধী নয়। [এ ব্যাপারে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ক্ষমতাভোগী শাসকদের স্ব–বিরোধী আচরণও বিশেষ তাৎপর্যবহ। তাঁরা শাসন–প্রশাসনে ধর্মহীন ভূমিকা গ্রহণ করলেও বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে নিজেদেরকে ধার্মিকরূপে জাহির করতে চেষ্টার কোন ত্রুটিই করেননি।– সম্পাদক]
অতএব আমাদের শিক্ষার এ মৌল সমস্যার সমাধান হতে হবে সর্বাগ্রে- সর্বপ্রথম। এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কোন সমস্যারই সমাধান হতে পারে না। একথা আমরা- দেশের শাসন কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দেশবাসী- যতো তাড়াতাড়ি বুঝতে পারব, ততই মঙ্গল।
শিক্ষার মাধ্যম সমস্যা
শিক্ষার ব্যাপারে দ্বিতীয় যে বিষয়টিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে গণ্য করতে হবে তা হল শিক্ষার মাধ্যম (Medium of Instruction) সমস্যা। শিক্ষা পর্যায়ে দুটো প্রশ্ন মৌলিক এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। একটি হল, কি শেখান হবে? আর দ্বিতীয়টি হল, কোন্ ভাষায় শেখান হবে? কি শেখানো হবে। এ পর্যায়ে আমরা এ দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে যা বলতে চেয়েছি, তা হলঃ শেখান হবে স্বাধীন দেশের সেই সব জ্ঞান-বিজ্ঞান, যা উন্নত, সুসভ্য ও আধুনিক মানুষ হিসেবে বসবাস করার জন্যে একান্ত জরুরী; কিন্তু তা সবই শেখান হবে ইসলামী জীবন-দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থার ভিত্তিতে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে আমার বক্তব্য হলঃ জনগণকে এ জ্ঞান শেখাতে হবে জনগণেরই নিজস্ব ভাষায়- আমরা যাকে বলি মাতৃভাষা। মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষায় চিন্তা করে- করে মত-বিনিময় ও চিন্তার আদান-প্রদান, তাকেই হতে হবে তার শিক্ষার মাধ্যম; তাকে জ্ঞান ও বিজ্ঞান শেখাতে হবে সেই ভাষায়। অন্যথায় তা আর যা-ই হোক প্রকৃত শিক্ষা হবে না। তা এমন শিক্ষা কিছুতেই হতে পারেনা, যা শিক্ষার্থীদের অন্তর্নিহিত প্রতিভা ও চিন্তাশক্তিকে বিকশিত করবে, যা তাদের মাঝে আত্মসচেতন ব্যক্তিত্বের সৃস্টি করবে। আর শিক্ষা যদি তা-ই করতে না পারল তাহলে তা গলায় উচ্চতর ডিগ্রীর তকমা ঝোলাতে পারে বটে; কিন্তু ‘শিক্ষিত মানুষ’ গড়তে পারে না। দুনিয়ায় এমন কোন সভ্য দেশের কথা আমার জানা নেই, যেখানে জাতির সন্তান-সন্ততিকে তার মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়া হয়না; শিক্ষা দেয়া হয় বিদেশী- বিজাতীয় ভাষায়। বর্তমানে দুনিয়ায় যত উন্নত জাতি রয়েছে, তাদের সবক’টি সম্পর্কেই একথা বলা যায় যে, তাদের উন্নতির মূলে রয়েছে জাতীয় আদর্শমূলক শিক্ষা এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় শিক্ষা দেয়ার রেওয়াজ কেবল সে জাতির মধ্যেই হতে পারে- হয়ে থাকে, যে জাতি অপর কোন জাতির গোলাম। যেমন, বৃটিশ ভারতের প্রভু-জাতি তাদের নিজস্ব ভাষায়ই শিক্ষা দিয়েছে এ গোলাম দেশের শিক্ষার্থীদেরকে, বাধ্য করেছে ইংরেজীর মাধ্যমে শিক্ষালাভ করতে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আজো কি ইংরেজ এ দেশের প্রভূ?… তা অবশ্য নয়। কিন্তু তা না হলে কি হবে, ইংরেজের গোলামদের কুক্ষিগত হয়ে আছে এদেশের শাসন ব্যবস্থা ও শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটার সুদীর্ঘ কাল পরও এ জাতির মাথার ওপর সওয়ার হয়ে আছে ইংরেজের প্রেতাত্মা। তাই এ জাতি যতোই কামনা করুক না কেন মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া করতে, ইংরেজের এ গোলামরা এবং তাদের প্রেতাত্মারা ইংরেজী ভাষার গোলামী ছাড়তে রাজী নয় একবিন্দুও। মনে হচ্ছে, ইংরেজের এ প্রেতাত্মারা যদ্দিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন এ দেশবাসীর বুকের ওপর থেকে সরে যাবে না বিজাতীয় শিক্ষা-দর্শন ও শিক্ষার বৈদেশিক মাধ্যমের এ জগদ্দল পাথর। [বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যাপারে অনেক গালভরা বুলি কপচানো হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে কোন সরকারই আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসেনি। তার ফলে স্বাধীনতার দুই যুগ পরেও বিষয়টি এখন পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়েছে। শুধু তাই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষার প্রচারকে অব্যাহত রাখারই প্রয়াস চলছে সর্বপ্রযত্নে।– সম্পাদক]
দুর্ভাগ্য কেবল এখানেই নয়, দুর্ভাগ্য এখানেও যে, এ দেশের মাদ্রাসাগুলোতে- বিশেষত দেওবন্দ ধারার মাদ্রাসাগুলোতে প্রায় প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হল উর্দু। [ইদানীং এ অবস্থায় কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটছে এবং বাংলাকে মাধ্যম রূপে গ্রহণ করার একটা নীরব প্রয়াস চলছে।– সম্পাদক] অথচ উর্দু এখানকার লোকদের মাতৃভাষা নয়। তার ফলে আরবী কিতাবকে উর্দুতে তরজমা করে শিক্ষা দেয়া হয় এ মাদ্রাসাগুলোতে। এভাবে প্রতি বছর এসব মাদ্রাসা থেকে শত শত লোক সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে বের হয়েও আসে; কিন্তু সত্যি কথা এই যে, প্রকৃত জ্ঞান এবং শিক্ষা নিয়ে খুব কম লোকই বের হতে পারছে; খুব কম লোকের জ্ঞানই এ দেশবাসীর কোন কাজে লাগছে। ফলে এক-একজন হয়তো ‘বিদ্যার জাহাজ’ হয়ে আছেন, কিন্তু সে জাহাজ মাল খালাস করার বন্দর খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও; সে মাল বিলি-বন্টন করার স্থানীয় মাধ্যমও নেই কারোর হাতে। এভাবে ব্যর্থতায় গুমরে মরছে এ জাতির সব শিক্ষা- কুরআন-হাদীসের ইলমা। গুদামের মাল গুদামেই পচে যাচ্ছে।
ইংরেজের এ দেশী গোলামদের মুখে প্রায়শ শোনা যায়, ইংরেজীকে মাধ্যম না বানালে জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষাদানের কাজই সমাধা হতে পারেনা। তারা বোধ হয় মনে করে, দুনিয়ার সব উন্নত দেশেই বুঝি শিক্ষার মাধ্যম রূপে ইংরেজীকেই চালু করা হয়েছে; ইংরেজী ছাড়া অন্য কোন ভাষার মাধ্যমে বুঝি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান কিছুই শেখা বা শেখানো যায়না। কিন্তু এটা যে চরম নির্বুদ্ধিতা ও নিকৃষ্ট গোলামী মনোবৃত্তির লজ্জাকর অভিব্যক্তি তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারেনা। রাশিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে কি ইংরেজীর মাধ্যমেই লেখাপড়া ও বিজ্ঞান চর্চা করা হচ্ছে? না এসব দেশ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইংরেজের চেয়ে কোন অংশেই পিছনে রয়েছে? বস্তুত চীন ও জাপান যে কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের ফলেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও বৈষয়িক দিক দিয়ে দুনিয়ার সর্বোন্নত জাতিগুলোর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তা কি ইংরেজের এ দেশীয় গোলামদের জানা নেই? …. এ পর্যায়ে চূড়ান্ত কথা এই যে, আমাদের দেশের সমগ্র শিক্ষাই যদ্দিন মাতৃভাষার মাধ্যমে দেবার ব্যবস্থা চালু না হবে, তদ্দিন এদেশের কোন প্রকৃত উন্নতির ধারণাই করা যায়না। যদি কিছু হয়ও তবে তা হবে কৃত্রিম- তা হবে ভাসাভাসা ও ভিত্তিহীন। আর ভাসাভাসা ও ভিত্তিহীন উন্নতি কোন জাতিকেই যথার্থভাবে উন্নত করতে পারেনা। কাজেই শিক্ষার মাধ্যম হল এমন একটি সমস্যা, যার আশু সমাধান হওয়া একান্তই প্রয়োজন।
শিক্ষার পরিবেশ
শিক্ষার ব্যাপারে সবচাইতে কার্যকর ও প্রভাবশালী হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। শিক্ষার পরিবেশ বলতে বুঝায় শিক্ষণীয় বিষয়, শিক্ষাদানের পদ্দতি, শিক্ষকের শিক্ষাদান এবং শিক্ষার্থীর শিক্ষালাভের মূলে কার্যকর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং ছাত্র-শিক্ষক ও ছাত্রদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি। এদেশের ‘জাতীয় শিক্ষা’ (National Education) ব্যবস্থার মাধ্যমে যে বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়া হয়, তা কোন একটির সাথেও এদেশের শিক্ষার্থীদের মনে সংযোগ বা অন্তরের গভীরতর সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। কেননা তার সবই ইসলামের বিপরীত-ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন; ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সাথেও তার নেই কোন সামঞ্জস্য। ফলে মুসলিম যুব-সমাজকে এ শিক্ষা দেয়া এক ধরণের গোপন ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে নিঃশব্দ ‘নরহত্যা’। হত্যাকাণ্ডে দেহ ধ্বংস হয় আর শিক্ষায় ঘটে মানব-মন তথা মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু। অতএব এ কাজ নরহত্যার চাইতেও মারাত্মক। মানুষের আত্মা ও তার অন্তর্নিহিত নির্মল ভাবধারা এ শিক্ষা থেকে কোন রস আহরণ করতে পারে না। এ শিক্ষায় জাগে না তাদের মন-মগজ ও স্বভাব-প্রকৃতিতে আনন্দ-শিহরণ, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আবেগের উত্তাল তরঙ্গ। বরং এ শিক্ষা মানুষের অপমৃত্যু ঘটায়, যেমন ঘটায় বিষাক্ত সাপের ছোবল। আর মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটার পরিণাম হল মানব দেহে এক হিংস্র পশুকে জাগিয়ে তোলা ফলে শিক্ষাগার নামক কারখানা থেকে যারা দলে দলে বের হয়ে আসে তারা শিক্ষিত মানুষ নয়, ডিগ্রীর তক্মাধারী একশ্রেণীর জীব। বতর্মান শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয় নির্বাচনকালে আদৌ চিন্তা করা হয়না যে, এ শিক্ষা মানুষের জন্যে, মানুষকে মনুষ্যত্ব শিক্ষা দেবার জন্যে, পশু বানাবার জন্যে নয়। ফলে পাশবিক শক্তিরই বিকাশ সম্ভব হয় এর মাধ্যমে।
দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে বলা যায়, সেখানে কুরআন ও হাদীস ছাড়া আর যা কিছুই পড়ানো হয়, তাকে এক কথায় ‘বস্তা পঁচা জিনিস’ বললেও অত্যুক্তি হবেনা। সেখানে কুরআন-হাদীস পড়ানো হয় ইসলামী জীবন-দশর্ন ও জীবন-ব্যবস্থার উৎস হিসেবে নয়; পড়ানো হয় এভাবে, যেন এসব প্রাচীনকালের আরবী সাহিত্য গ্রন্থ। এ শিক্ষার সবচাইতে বড় ত্রুটি হল, এখানে প্রাচীন কালের লেখা বড় বড় দুর্বোধ্য কিতাব পড়ানো হয়, কোন বিষয়ের জ্ঞান শেখান হয়না। কেননা বিষয়-ভিত্তিক জ্ঞানের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই এখানকার শিক্ষক সাহেবানদের।
শিক্ষার মূলে নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমানে যারাই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতে আসে তাদের সামনে জ্ঞান শেখার চাইতেও বড় লক্ষ্য থাকে ডিগ্রী লাভ। এ জন্যে সারা বছর ধরে ছাত্রদের এক দিকে নজর থাকে ক্লাশে প্রয়োজনীয় পরিমাণ উপস্থিতির দিকে, অন্যদিকে নজর থাকে মোটামুটিভাবে পাশ করার দিকে- যাতে পাশ করা সহজ এবং নিশ্চিত হয়, এমন কি সেজন্যে কোন হীনতম পন্থা গ্রহণেও কুণ্ঠাবোধ করা হয়না। মেধাবী ও বৃত্তিধারীরাও সহজে পাশ করার লোভে পরীক্ষার হলে নকল করে, একথা শুনলে আজকের দিনে কারোর বিস্ময়ের উদ্রেক হয়না। আর শিক্ষকদের মনেও জাতির ভবিষ্যত এই শিক্ষার্থীদেরকে সত্যিকার জ্ঞান শেখানোর দিকে কোন লক্ষ্যই থাকেনা বলা চলে।
নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে মাসান্তর বেতন গুণে নেয়ার দিকেই সাধারণত তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে ঠিক তেমনি, যেমন মাছ শিকারী বক্ তীক্ষ্ণভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে মাছের গতিবিধির ওপর। এক কথায় শিক্ষার নামে এখানকার সবই হচ্ছে নিতান্ত অর্থনৈতিক ব্যাপার। এখানে উচ্চ ডিগ্রী লাভের লক্ষ্যঃ বাজারে চড়াদামে বিক্রি হওয়ার ‘যোগ্য পণ্য’ রূপে নিজকে গড়ে তোলা, যেন বিপুল টাকা-পয়সা লাভ করে দুনিয়ার সুখভোগ করা যায় স্বচ্ছন্দে। তার ফলে আজ সমাজে সত্যিকার বিদ্বান ও জ্ঞানবান ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় নেই বলা যায়। আর কিছু থাকলেও তা দিন দিনই ফুরিয়ে যাচ্ছে। যে সব বিদ্যান ব্যক্তি দুনিয়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন, তাদের শূণ্য স্থান পূরণ হতে দেখা যাচ্ছেনা। তার পরিবর্তে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ডিগ্রীধারী লোকদের প্রাচুর্য। এরই ফলে দেশে শিক্ষিত বেকার সমস্যা পর্বত-প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সাধারণ ও নিম্নমানের পদের চাকুরীর জন্যে জমে ওঠে উচ্চ ডিগ্রীধারী অসংখ্য প্রার্থীর ভিড়।
শিক্ষক–ছাত্রের সম্পর্ক
শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে যথোপযোগী সম্পর্ক গড়ে ওঠার ওপর চিরদিনই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্ক সঠিক এবং সুষ্ঠু না হলে সত্যিকার জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ সম্ভব নয়। তাদের মাঝে বর্তমানে যেহেতু শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ডিগ্রী লাভ এবং শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মাসান্তর টাকা গোণা, তাই শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে বলতে গেলে লেন-দেনের সম্পর্কই হচ্ছে প্রবল। তাদের সেই সম্পর্ক গড়ে উঠছেনা, যা সত্যিকার জ্ঞান লাভের জন্যে অপরিহার্য। তাই আজ পরীক্ষার ফলের ব্যাপারে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রকে তৃতীয় শ্রেণীতে ঠেলে দিতে শিক্ষকরা এবং প্রত্যাশিত ফলের জন্যে শিক্ষকেরা মাথা ভেঙে দিতে ছাত্ররা কোন অন্যায় বোধ করছে না।
অধিকন্তু ছাত্রদের পারস্পরিক সম্পর্ক যেখানে হওয়া উচিত পবিত্র, আন্তরিক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এবং সহানুভূতিসম্পন্ন- একই জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণকারী বন্ধু ও সারথী হওয়ার মতো, সেখানে পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ, দলাদলি ও চরম প্রতিদ্বন্দ্বীতার অমানবিক ভাবধারাই প্রবল ও প্রকট হতে দেখা যায়। এ কারণে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে ছাত্রাবাস দখলের জন্যে ইদানীং ছাত্রে ছাত্রে মারামারি ও খুনখারাবী হওয়া এক নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক অশান্তি, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজমান থাকে, তাতে আর যা-ই হোক জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়।
সহশিক্ষা
দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে সহশিক্ষার ব্যবস্থা চালু রয়েছে, এর মতো মারাত্মক জিনিস বোধহয় আর কিছু নেই। মুসলমানরা নৈতিক চেতনাসম্পন্ন একটি জনগোষ্ঠী। তাদের সমাজে সহশিক্ষার প্রচলন যে কেমন করে সম্ভব হচ্ছে, তা কিছুতেই বোধগম্য নয়। সহশিক্ষা মানে, ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই একই বিষয় একই কক্ষে পাশাপাশি বসিয়ে শেখানো হচ্ছে। এ পর্যায়ে প্রথম কথা হলঃ ছেলে মেয়ে জন্মগতভাবেই স্বতন্ত্র দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা এবং ভাবধারার ধারক হয়ে থাকে। জীবনের পরিণত স্তরে স্বাভাবিক দায়িত্ব বোধের তাগিদেই তারা স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্র গ্রহণে বাধ্য হয়। এ ব্যাপারে কোন মিলই থাকে না ছেলে ও মেয়ের জীবনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উভয়কে ঠিক একই বিষয় একই ধারায় শিক্ষা দেয়ার পরিণাম যে কত ভয়াবহ, তা ভাষায় প্রকাশ করা চলেনা। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, গার্হস্থ বিদ্যা- এ ধরনের সব বিষয়েই যে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্যেই শিক্ষনীয় জিনিস রয়েছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সে শিক্ষায় ছেলে ও মেয়ের স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি একরূপ হয়না কখনো। কাজেই একই কক্ষে বসিয়ে, একই ভঙ্গিতে একই বই পড়ানো ও একই দৃষ্টিকোণ দিয়ে একই বিষয় ছেলে ও মেয়েকে শিক্ষা দেয়ার মানে হল ছেলে ও মেয়েকে মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন করে তোলা। আর এটা যে স্বভাব ও প্রকৃতির শুধু বিপরীতই নয়, মানবতার পক্ষে মারাত্মকও, তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারেনা। [তাজ্জবের ব্যাপার যে, ইদানীং কিছু কিছু মাদ্রাসায়ও সহশিক্ষা চালু করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড যে কর্তৃপক্ষীয় ইঙ্গিতেই করা হচ্ছে, তা বুঝতে কারো বেগ পেতে হয় না। কিন্তু পরিণাম কত ভয়াবহ, সময় থাকতেই তা সংশ্লিষ্ট সকলের ভেবে দেখা উচিত।– সম্পাদক] এর ফলে যে ছেলেরা মেয়েলী স্বভাব-প্রকৃতির ধারক হবে- পৌরুষ হারিয়ে ফেলবে আর মেয়েরা পুরুষোচিত মন-মেজাজ লাভ করবে, হারিয়ে ফেলবে নারীসুলভ কমনীয়তা- তা বর্তমানের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও অনায়াসে বোঝা যায়। বলা বাহুল্য যে, শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বর্তমান উচ্ছৃংখলতার মূলে প্রধানত এ কারণই নিহিত।
দ্বিতীয়ত ছেলে ও মেয়েকে একই কক্ষে বসিয়ে শেখানোর পরিণাম হল, হয় ছেলে ও মেয়েদের স্বাভাবিক যৌনবোধকে চিরতরে নির্মূল করে দেয়া এবং মানব সমাজে ক্লীব লিঙ্গের প্রাদুর্ভাব ঘটানো, না হয় যৌনবোধের উস্কানি সৃষ্টির মাধ্যমে যৌনচর্চা ও যৌন পরিতৃপ্তির এক অশ্লীল প্রবাহ সৃষ্টি-যার ফলে নৈতিকতার সব বাঁধনই ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে যাবে। আর মানবাকৃতির এ জীবগুলো এক নতুন পশু শ্রেণীর রূপ ধরে সমাজে পাশবিকতার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে। মনে রাখতে হবে, এ সহশিক্ষা নীতি মুসলিম জাতি কোনদিনই গ্রহণ করেনি, তারা তা চালুও করেনি। আমাদের নীতিহীন ও চরিত্রহীন ইংরেজ প্রভুরাই এ গোলাম জাতির চরিত্র ধ্বংস করার কুমতলবে এবং আমাদের ভবিষ্যত বংশধরকে সম্পূর্ণ চরিত্রহীন রূপে গড়ে তোলার চক্রান্ত হিসেবে এ দেশে এ সহশিক্ষার প্রচলন করেছিল। আর সে বিদেশী প্রভুদের অন্ধ গোলামরা মুসলিম জাতির মাথার ওপর এ অভিশাপ চাপিয়ে রেখেছে নিজেদেরই চরিত্রহীনতার কারণে; নিজেদের বিকৃত যৌন পরিতৃপ্তির অবাধ সুযোগের দ্বার চির-উন্মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে। বস্তুত এ সহশিক্ষা নীতিতে সত্যিকার জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হচ্ছেনা কিছুই, বরং সমাজের যুবক-যুবতীদের পশুত্বের নিম্নতম পংকে ডুবে যাবার উৎসাহই দেয়া হচ্ছে সর্বতোভাবে। মোমবাতির অগ্রভাগের সূতায় দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে অগ্নিসংযোগ করলে মোমবাতি গলে গলে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিংশেষ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। যে পজিটিভ ও নেগেটিভ দুটি তার এক নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হয়ে সুইজের সাহায্যে আলোর বন্যা সৃষ্টি করে, সেই তার দুটিই মাঝ পথে আবরণমুক্ত হয়ে পরস্পর মিলিত হলে সর্বধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি করে দেয়। সহশিক্ষা তেমনি আমাদের সমাজে ও পরিবারে গুরুতর ভাঙন ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা হয়ত তা-ই চান। অন্যথায় ইংরেজের চাপিয়ে দেয়া পাশ্চাত্য নোংরামীর এ অভিশাপকে এখনো এ স্বাধীন মুসলিম জাতির মাথার ওপর চাপিয়ে রাখার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণই থাকতে পারে কি?
বড় লোকের শিক্ষা
বর্তমানে শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা গরীব লোকদের আর্থিক সামর্থের সম্পূর্ণ বাইরে-অনেক দূরে চলে গেছে। এখনকার পাঠ্য-পুস্তক, কাগজ-কালি-কলম ইত্যাদির মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার অনেক ঊর্ধ্বে। তদুপরি মাসিক ছাত্র বেতনের পরিমাণও আকাশ-ছোঁয়া। কাজেই আমি বলব, এখনকার শিক্ষা একান্তভাবে নির্দিষ্ট হয়েছে বড় লোকদের ছেলেমেয়ের জন্যে। গরীবদের ছেলেমেয়ের জন্যে শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষার দুয়ার তাদের সামনে চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্তাব্যক্তিদের বোধহয় তা-ই কাম্য। বেশী লোক লেখাপড়া জানলে কর্ম-সংস্থান তথা চাকুরী দেবার দায়িত্ব বাড়বে আর এ শিক্ষিত যুবকদের চাকুরী দিতে না পারলে সরকার বিরোধী আন্দোলন ও বিক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠবে। সর্বোপরি তাতে এখনকার শাসকদের তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সস্তা মূল্যের শ্রমিক-মজুরের অনটন দেখা দেবে, কল-কারখানার চাকা ঘুরবেনা এবং দেশী-বিদেশী পুঁজিদারদের শোষণের মাত্রা কমে যাবে। কাজেই শিক্ষাকে এতো বেশী ব্যয়-সাপেক্ষ করে দেয়া হয়েছে যেন গরীবরা লেখাপড়ার কথা চিন্তাই করতে সাহস না পায়। তারা এসব বাজে চিন্তা (?) না করে বরং নিম্নতম মজুরীর আত্ম-বিক্রয়ে বাধ্য হয়ে যেন সোজা মজুর মার্কেটে উপস্থিত হয়- মনে হচ্ছে কর্তাদের এই হল শিক্ষা নীতি। সরকার দেশে যে অসংখ্য পাবলিক স্কুল কায়েম করেছেন, তা আদৌ পাবলিক নয়; কারণ সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। তবু এইসব স্কুলকে পাবলিক স্কুল নাম দেয়ার উদ্দেশ্য জনগণকে ধোঁকা দেয়া ছাড়া আর কি হতে পারে?
মিশনারী শিক্ষার মারাত্মক পরিণাম
এই পর্যায়ে দেশে জালের মতো ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক খৃস্টান মিশনারী স্কুল-কলেজগুলোর উল্লেখ করাও অপরিহার্য। মিশনারী শিক্ষা হল এই মুসলমান দেশের মুসলমানদের পিতামাতার ছেলে-মেয়েকে তাদেরই বাপ-মা’র টাকায় এবং সরকারী ঔদাসীন্যের সুযোগে খৃস্টান বানিয়ে দেয়ার শিক্ষা। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছুই নেই। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে উটপাখির ভূমিকা অবলম্বন করেছেন। বাইরে প্রবল ঝড় উঠেছে, সব ঘরবাড়ি সংসার মিস্মার করে দিচ্ছে; কিন্তু মহামান্য উটপাখি সাহেব বালির পাহাড়ে মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে আরামে নিদ্রা যাচ্ছে- মনে করছেন কোথাও কিছু হচ্ছে না, সর্বত্রই শান্তি বিরাজিত। কিন্তু আমি বলতে চাই, এ মিশনারী শিক্ষা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুনিয়ার মুসলিম জাতিগুলোকে খৃস্টান সভ্যতা ও সংস্কৃতির খপ্পরে ঠেলে দিচ্ছে এবং সমাজে মুসলিম-খৃস্টান দ্বন্দ্বের পথ উন্মুক্ত করছে। [পৃথিবীর বৃহত্তর মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া ও সুদানের সাম্প্রতিক মুসলিম–খৃস্টান সংঘাত এ ভয়াবহ বিপদেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ বহন করছে।– সম্পাদক] আফ্রিকা ও এশিয়ার কতকগুলো মুসলিম দেশকে তা-ই আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। এদেশেও যে একদিন অনুরূপ কোন অঘটন ঘটবেনা, তা শুধু মূর্খ আর পাগলই মনে করতে পারে, কোন সচেতন মুসলমানই এ ব্যাপারে একবিন্দু গাফিলতিতে পড়ে থাকতে পারেনা। কিন্তু দেশের কর্তাদের নিকট বোধহয় এ ব্যাপারটির কোনই গুরুত্ব নেই। তাঁরা বোধহয় দেশের ক্ষতি হতে দিতে রাজী, কিন্তু রাজী নয় পাশ্চাত্য প্রভূদের বিরাগভাজন হতে। তাই মিশনারীদের অবাধে তৎপরতা চালানোর সুযোগই শুধু দেয়া হয়নি, জমি জায়গা, দালান-প্রসাদ এবং বিপুল অর্থও উদার হস্তে দেয়া হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানকে। এসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পদ পদে ইসলামকে অপমান করা হচ্ছে, ঈমান আকীদার প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হচ্ছে এবং ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত খৃস্টানী আকীদা-বিশ্বাস মুসলমান ছেলেমেয়েদের মন-মগজে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখানে ইসলামী আচার-আচরণ ও সভ্যতা-সংস্কৃতি আদৌ বরদাশত করা হয়না। এক কথায় মুসলিম বংশধরদের এখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ কর্তাদের চোখে এর মারাত্মক কুফল আদৌ ধরা পড়ছেনা। বোধহয় চূড়ান্ত ধ্বংসের আগে এদের নাকে ও কানে পানি ঢুকবেনা। তাই এ ব্যাপারে দেশের মুসলিম জনগণের কর্তব্য হচ্ছে তাদের করণীয় নির্ধারণ করা। অন্যথায় এ জাতির ভবিষ্যত অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়। [সম্প্রতি এর সাথে নতুন উপসর্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে উপ–আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারের নামে পাশ্চাত্য মদদপুষ্ট কিছু কিছু এনজিও’র স্বাধীন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে শিক্ষা বিস্তার বলতে তেমন কিছুই হচ্ছেনা। তবে গ্রামের কোমলমতি ছেলেমেয়েদেরকে ইসলাম বিমুখ করার একটা সচেতন প্রয়াস এতে সুস্পষ্টতই লক্ষ্যনীয়।– সম্পাদক]
সমস্যার সমাধান
এ দীর্ঘ আলোচনায় এদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান মাত্র কয়েকটি বড় বড় সমস্যার শুধু উল্লেখ এবং সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পেশ করা হয়েছে। রচনার কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় প্রতিটি বিষয়েরই বিস্তারিত আলোচনা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। এসব সমস্যার বিস্তৃত সমাধানও পেশ করা যায়নি। তা পেশ করতে হলে এর আলোচনা আরো দীর্ঘ হবে। সে কারণে সমাধান পর্যায়ে অতি সংক্ষেপে আমার বক্তব্য পেশ করে এ আলোচনার ইতি টানতে চাই।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যেসব সমস্যার কথা এখানে বলা হয়, সেগুলোর একমাত্র সমাধান এই যে, বর্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ইসলামী জীবন-দর্শন ও শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে নতুন করে ঢেলে একটি পূর্ণাঙ্গ ও এককেন্দ্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থা তৈরী করতে হবে, যেখানে ইসলামী আদর্শবাদের দৃষ্টিতে দুনিয়ার সকল প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। সেখান থেকে তৈরী হবে যেমন দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানসম্পন্ন পারদর্শী ব্যক্তিগণ, তেমনি বের হবে ইসলামী আদর্শবাদী ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, শিক্ষাবিদ, রসায়নবিদ, ভূগোলবিদ, খগোলবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, রাষ্ট্রনীতিবিদ, বিচারপতি, আইনবিদ, আদর্শ শাসক, চরিত্রবান প্রশাসক, সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী। আর তা-ই হবে দেশের জাতীয় শিক্ষা। এই একই ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে উঠবে এক অখণ্ড ইসলামী জাতি। বর্তমানে দেশে মৌলিকভাবে দুই ধরনের শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু রয়েছেঃ একটি হচ্ছে দ্বীনী শিক্ষা আর অপরটি বৈষয়িক শিক্ষা। ফলে সমাজে দু ধরণের লোক তৈরী হচ্ছেঃ এক শ্রেণীকে বলা হয় ‘মোল্লা’- যারা হয়তবা শরী’আতী বিদ্যা মোটামুটি জানে; কিন্তু জানেনা বৈষয়িক কোন জ্ঞান। আধুনিক চিন্তা-মতবাদের সাথে তাদের নেই কোন পরিচয়। তারা বুঝেনা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যাবলী ও সেগুলোর সমাধান। দুনিয়ার কোন খবরই রাখেনা তারা, অথচ নিজেদের তারা মনে করে ধর্মবিদ, ধার্মিক এবং অন্যদের মনে করে দুনিয়াদার-ফাসিক। আর দ্বিতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী। তারা দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানেনা। ফলে দ্বীন ও ধর্মের প্রতি তাদের মনে থাকে অজ্ঞতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ। ফলে সাধারণভাবেই তারা ইসলামী আদর্শবাদী জীবন যাপনে হয় অক্ষম। একটা জাতির শিক্ষিত জনগণের এরূপ দুই বিপরীত ভাবধারায় গড়ে ওঠা জাতির ঐক্যের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক। বর্তমানে আমাদের এ-ও একটি অতি বড় সমস্যা। এর আশু সমাধান একান্ত জরুরী আর এ সমস্যার সঠিক সমাধান হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষার পরিবর্তে এ যুগে ইসলামী জীবন, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়বার উপযোগী এক পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন ও তার প্রবর্তন। কিন্তু এ কাজ বড়োই দুরূহ- বড়োই কষ্টসাধ্য এ কাজ যার-তার দ্বারা সম্ভব হবে না। এরূপ শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী ও চালু করার জন্যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সর্বপ্রথম প্রয়োজন।
এরূপ শিক্ষা কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই ফলপ্রদ হতে পারে; তাহলেই সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। এ শিক্ষাব্যবস্থায় মূলগতভাবে একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েকে একই মৌল শিক্ষা দেয়া হলেও তাদের পরবর্তী দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরপ্রেক্ষিতে নিশ্চয়ই প্রত্যেকের জন্যে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাতে সহশিক্ষার কোন ধারণা পর্যন্ত থাকবেনা। সেখানে শিক্ষার বিষয়বস্তু যেমন ছেলে ও মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা হবে, তেমনি আলাদা হবে শিক্ষার পরিবেশ, টেকনিক ও পদ্ধতি। আলাদা হবে শিক্ষক ও শিক্ষায়তন। এ শিক্ষা যাতে করে সমাজের সব পুরুষ ও নারী সহজেই পেতে পারে, তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের। সমাজের কেউই মৌল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না- কোন কারণেই না। গরীব ও ধনীর মাঝে এক্ষেত্রে কোন পার্থক্যই হতে দেয়া চলবেনা। সর্বোপরি, এ রাষ্ট্রের কোন অংশেই এ আদর্শ শিক্ষার বিপরীত কোন শিক্ষাই চালু থাকতে পারবে না। খৃস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যে তাদের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুযায়ী শিক্ষা লাভের সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকবে বটে; কিন্তু থাকবেনা মুসলিম ছেলেমেয়েদের হিন্দু, খৃস্টান, বৌদ্ধ ও কমিউনিস্ট বা ধর্মনিরপেক্ষ বানাবার শিক্ষা দেয়ার কোন সুযোগ। এরূপ করা সম্ভব হলেই শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান যাবতীয় সমস্যার সমাধান হতে পারবে। এ শিক্ষা হবে অত্যন্ত পবিত্র; এরূপ শিক্ষালাভ হবে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। জ্ঞান-অর্জনের লক্ষ্য হবে আত্মিক উন্নয়ন, কেবল বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্যে কেউ জ্ঞান শিখবেনা, শেখাবার কাজ করবেনা। তাই এখানে যেমন ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে অতীব পবিত্র, তেমনি মধুর হবে ছাত্রদের পারস্পরিক সম্পর্কও।
কিন্তু দেশে এরূপ শিক্ষাব্যবস্থা কি করে প্রতিষ্ঠিত এবং কার্যকর হতে পারে? হতে পারে কি ভাবে তা বুঝবার জন্যে আমাদের এবং আপনাদের লক্ষ্য দিতে হবে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান বর্তমান সমস্যাবলীর মূল কারণের দিকে; কেন এ সমস্যার সৃষ্টি হল এবং কেমন করে হল তা বুঝতে হবে সর্বাগ্রে। আমার মতে এ সমস্যা সৃষ্টির মৌল কারণ একটিই। মুসলমানদের ওপর ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, ইসলামের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনকারী এবং পাশ্চাত্য জীবন-দর্শন ও বস্তুবাদী কৃষ্টি সভ্যতার প্রতি অন্ধ বিশ্বাসী ও অনুগত এক গায়র-ইসলামী নেতৃত্বের চেপে বসাই হল এসব সমস্যার মূল কারণ। এ কারণেই এসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছে আর এ কারণ যদ্দিন বর্তমান থাকবে, তদ্দিন শুধু শিক্ষার কেন, কোন সমস্যারই একবিন্দু সমাধান হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এ সমস্যাগুলোর সমাধান বর্তমান সেকুলার নেতৃত্ব দ্বারা সম্ভব হবে বলে যারা মনে করে, আমার মতে তারা ‘আহাম্মকের স্বর্গে’ বাস করে। আমি বলবো, আমার দৃষ্টিতে দেশের সর্বপ্রকার সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকর সমাধান সম্ভব হবে সেদিন, যেদিন বর্তমান ফাসিক নেতৃত্বের অবসান হবে এবং কায়েম হবে এক ইসলামী আদর্শবাদী যোগ্য নেতৃত্ব। তাই যারাই শিক্ষা-সমস্যা সহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান পেতে ইচ্ছুক, তাদের সামনে দেশে ইসলামী নেতৃত্ব কায়েমের জন্যে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। আর সেজন্যে এ দেশের মুসলিম জনগণের মনে ইসলামী শিক্ষার দর্শন এবং তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ জাগাতে হবে- তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ইসলামী আদর্শবাদ ও ইসলামী আদর্শে গণ-সংগঠনের সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে। এজন্যে কাজ করতে হবে আমাদের- আপনাদের, দেশের সাধারণ মানুষের এবং শিক্ষক ও ছাত্রসহ সব নাগরিকদের। আমি অন্তর দিয়ে কামনা করছি এরূপ এক গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার।
শিক্ষায় ধর্মের ভূমিকা
শিক্ষায় ধর্মের ভূমিকা কি? ধর্মের আদৌ কোন ভূমিকা আছে কিনা এবং বাস্তবিকই কোন ভূমিকা থাকতে হবে কিনা, এসব প্রশ্নের জবাব নির্ভর করে এই কথার ওপর যে, ‘শিক্ষা’ এবং ‘ধর্ম’ বলতে আমরা কি বুঝি। ‘শিক্ষা’ ও ‘ধর্ম’ সম্পর্কে বর্তমানে এমন কিছু ধারণা দুনিয়ার এক শ্রেণীর লোকদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গেছে, যার দৃষ্টিতে এই ধরণের কোন ভূমিকার প্রশ্নই ওঠেনা। সত্যি কথা হচ্ছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মের এরূপ কোন ভূমিকা থাকার অপরিহার্যতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার এবং যতটুকু ভূমিকা এখনও রয়েছে তাকেও সম্পূর্ণ নিঃশেষ ও নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই শিক্ষা ও ধর্ম সম্পর্কে এরূপ ধারণা বিশেষভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই ধারণাকে যথার্থ ও বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ করার জন্যে প্রাণপন চেষ্টা করা হচ্ছে এবং যুক্তির পর যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই শ্রেণীর লোকদের মনোভাব হচ্ছে, শিক্ষার অঙ্গন থেকে ধর্মকে সর্ম্পূর্ণ বিতাড়িত করতে হবে, ধর্মের গোঁড়ামী বা কুসংস্কারের জঞ্জাল থেকে শিক্ষাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হবে, শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ ধর্মবিবর্জিত; কেননা তাদের মতে ধর্মমত শিক্ষাকে একদেশদর্শী, সংকীর্ণচেতা সেকেলে এবং অলৌকিক ও অতি-প্রাকৃত (Super Natural) জগত সংক্রান্ত বিষয়াদি দ্বারা ভারাক্রান্ত করে দেয়। অথচ শিক্ষাকে হতে হবে সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ, ব্যবহারিক এবং লৌকিক জীবনের সার্বিক উন্নয়ন ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিধানে সহায়ক। অলৌকিক বা অতি-প্রাকৃত বিষয়াদির জ্ঞান নিত্য-নিমিত্তিক জীবন সমস্যার সমাধানে মানুষকে কিছুমাত্র পথ দেখাতে পারেনা। কিভাবে মাটির গভীর তলা খুঁড়ে তেল, কয়লা, গ্যাস কিংবা অন্যান্য খনিজ সম্পদ আবিষ্কার ও উত্তোলন করতে হবে, কিভাবে সমুদ্র গর্ভে ডুব দিয়ে মণিমুক্তা আহরণ করতে হবে, কেমন করে চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে গমণের রকেট নির্মাণ করতে হবে, কেমন করে আণবিক বোমা তৈরী করতে হবে এবং শক্তিশালী শত্রু পক্ষকে দমন বা খতম করার জন্যে নতুন নতুন মারণাস্ত্র নির্মাণ করতে হবে, ধর্ম তা মানুষকে শিখাতে পারেনা; বরং অনেক সময় ধর্মমত মানুষকে এইসব কাজ থেকে বিরতই রাখতে চায়। তাহলে ধর্মকে শিক্ষার ক্ষেত্রে টেনে আনাই ভুল; টেনে আনা হলে বরং জীবনের বিকাশ, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে চরম পশ্চাদপদতাকেই মেনে নিতে হবে। অথচ মানব জীবন বিকাশমান, ক্রম-উন্নয়নমুখী ও প্রচণ্ড গতিশীল। ধর্মের প্রভাবমুক্ত শিক্ষাই এই জীবনের সাথে সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে। পক্ষান্তরে ধর্ম প্রভাবিত শিক্ষা মানুষকে নিতান্তই কূপমণ্ডুক বানিয়ে দেয়। আধুনিক গতিশীল জগতে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হওয়া তো দূরের কথা, জীবনে বেঁচে থাকা ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাও তা সম্পূর্ণ অসম্ভব করে তোলে। এইরূপ অবস্থা স্বীকার করে নেয়া কোন বুদ্ধিমান জাতির পক্ষেই সমীচীন নয়।
বস্তুত শিক্ষা ও ধর্ম-সম্পর্কিত এই ধারণাই বর্তমান দুনিয়ায় প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা এরূপ ধারণা ও মনোভাবের ওপরই গড়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা থাকার কথাই হাস্যকর। একারণেই বর্তমান দুনিযার মুসলিম জাতিকে এই বলে উপহাস করা হয় যে, দুনিয়া কোথা থেকে কোথায় চলে গেল আর এরা এখনও ‘ধর্ম ধর্ম’ করে চিৎকার করে বেড়াচ্ছে। এরা বর্তমান দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলারই অযোগ্য। আজ হোক আর কাল হোক এরা দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এক কথায় বলা চলে, এই যা কিছু বললাম তা পুরোপুরি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরই কথা। বর্তমান দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ এই বস্তুবাদেই বিশ্বাসী। তারা শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের কোন ক্ষেত্রেই ধর্মকে বরদাশ্ত করতে প্রস্তুত নয়। অবশ্য বস্তুবাদী এই দৃষ্টিকোণ ও মনোভঙ্গি আজকের নতুন ব্যাপার নয়। প্রায় ৮-৯ শত বৎসর পূর্বেই এই দৃষ্টিকোণ জেগে উঠেছে এবং বিগত শতাব্দীসমূহের মধ্যে সারা বিশ্বাব্যাপী এর ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। বর্তমান কালের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূলে রয়েছে এই দৃষ্টিকোণ। কাজেই শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মের কোন ভূমিকা থাকা উচিত কিনা, সে বিষয় বিচার-বিবেচনার পূর্বে এই মৌল দৃষ্টিকোণটির পর্যালোচনা এবং সুস্থ চিন্তার মানদণ্ডে এর যাচাই-পরখ হওয়া একান্তই আবশ্যক। এই বিচার-বিবেচনা ও যাচাই-পরখে যদি এ দৃষ্টিকোণ ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলেই শিক্ষা তথা জীবন-পরিসরে ধর্মের ভূমিকা কি হওয়া উচিত তা সুস্পষ্ট করে বলা সম্ভব হতে পারে।
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণের পর্যালেচনা
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণের মর্মমূলে নিহিত রয়েছে বিশ্বলোক ও মানুষ সম্পর্কিত বস্তুবাদী ধারণা। দুনিয়ার মানুষের জেগে ওঠা সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশ্বলোক কি স্বয়ম্ভূ, না এর কোন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে? এরই আনুসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিশ্বলোক কি কোন স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত না আপনা-আপনি চলমান? মানুষ কি ‘বস্তুর’ই ক্রমবিকাশের ফসল, না তার সৃষ্টিকর্তা কেউ আছেন এবং মানুষ তাঁর আনুগত্য করে চলতে বাধ্য?
বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নের দু’রকম জবাব দেয়া হয়েছে। একটি জবাবে আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়েছে। তাতে আল্লাহর প্রয়োজনীয়তাকেই উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, বস্তুর ক্রমবিকাশের ফসলই এই বিশ্ব-চরাচর এবং এর মধ্যকার সব সৃষ্টবস্তু উদ্ভিদ, জীব-জন্তু, প্রাণীকুল ও মানুষ স্বতঃই অস্তিত্বমান হয়ে উঠেছে। এই বিশ্বলোকের পরিচালক কেউ নেই-কাউকে তেমন থাকতে হবে, তাও নিষ্প্রয়োজন। কাজেই মানুষকে এখানে স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে। কোন স্রষ্টা নেই বলে কাউকে মেনে চলারও কোন প্রশ্ন ওঠেনা। মানুষের পরিণতি বলতে বুঝায় তার জীবন অবসান অর্থাৎ মৃত্যু। মৃত্যুর পর আর কিছু নেই। অতএব এই জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও উন্নতি-সমৃদ্ধি অর্জনই দুনিয়ায় মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পূর্ণ সাফল্যের সাথে উত্তরণ যে শিক্ষার সহায়তায় সম্ভব, এখানে মানুষের জন্য তা-ই হতে পারে একমাত্র কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা।
শিক্ষা সম্পর্কে এই সিদ্ধান্ত বস্তুবাদী দর্শনের যৌক্তিক পরিণতি; কিন্তু অনাবিল দৃষ্টিভঙ্গি ও নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক মানদণ্ডে বিচার করলে এই দর্শনটাই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়।
আধুনিক বিজ্ঞান ‘বস্তু’র যে বিশ্লেষণ দিয়েছে, তাতে সে তার ‘বস্তুত্ব’ই হারিয়ে ফেলেছে। এ কালে বস্তুর প্রাক্কালীন রূপ হচ্ছে ‘শক্তি (Energy)। আর এই ‘শক্তি’র যে পরিচিতি সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে জানা গেছে, তা হচ্ছে এমন শক্তি, যার সঠিক পরিচয় কুরআন মাজীদে দেয়া হয়েছে মহান আল্লাহর নামে। তাই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়েই বলতে চাই, আল্লাহতে অবিশ্বাসীরাও নিজেদেরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়েছে আল্লাহর শক্তিকে স্বীকার করে নিতে। বস্তুত এই বিশ্বলোক যে স্বয়ম্ভূ নয়, আল্লাহর সৃষ্টি, তারই নিয়ন্ত্রণাধীন এবং মানুষ মহান স্রষ্টার এক বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি- এখানে তাঁরই আনুগত্য করে চলাই তার একমাত্র কর্তব্য, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে এই সত্য ভাস্বর হয়ে উঠেছে। তাতে কুরআনের এ ঘোষণারই বাস্তবতা প্রমাণিত হয়েছেঃ ‘‘আর আসমান ও যমিনে যাকিছু আছে, তারা সবাই তাঁরই আনুগত্য করে চলেছে’’। যদিও এদের মন-মগজ থেকে আল্লাহ-অস্বীকৃতির ভাবধারা এবং আল্লাহর প্রতি বিদ্বেষ এখনও একবিন্দু কমে যায়নি।
এই সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, শুধু শিক্ষাই নয়, মানব জীবনের কোন একটি ব্যাপারেই আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে না। আর আল্লাহকে স্বীকার করে নেয়ার পর যে শিক্ষা-দর্শন তৈরী করা যেতে পারে তা হল সেই শিক্ষা, যার মাধ্যমে গভীর, সূক্ষ্ণ ও বিস্তারিতভাবে অনুধাবন করা যাবে মহান আল্লাহর সীমাহীন কুদরত, কুরআনে বিধৃত তাঁর সুমহান গুণাবলীর বাস্তব রূপ, তাঁর মৌলিক সৃষ্টি-উদ্দেশ্য, তার সৃষ্টি বস্তু ও মানুষের জীবন-লক্ষ্য, দায়-দায়িত্ব ও ব্যবহারিক গুণাবলী; সেই সঙ্গে জানা যাবে কোন্ ধরণের জীবন যাপনে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও অকল্যাণ নিহিত। যে শিক্ষা আদতেই মানুষকে মৌলিক বিষয়ে সুশিক্ষিত ও পুরোপুরি ওযাকিফহাল বানায় না, সে শিক্ষা জন্তুর জন্যে গ্রহণীয় হলেও মানুষের জন্যে নয় কিংবা সে শিক্ষা জন্তু বানানোর জন্যে উপযোগী হলেও মানুষ বানানোর জন্যে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা স্রষ্টার সৃষ্টি-কৌশলের দরুণ জন্তু ও মানুষ একই প্রজাতিভুক্ত নয়; একই রকমের জীবন-লক্ষ্য, দায়-দায়িত্ব ও পরিণাম-পরিণতিও নয় উভয়ের। এই দুই সৃষ্টির শিক্ষা দশর্ন ও শিক্ষণীয় বিষয় কখনও এক ও অভিন্ন হতে পারে না। অথচ মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মনুষ্যত্ব রক্ষার জন্যে শিক্ষা একান্তই অপরিহার্য এবং সে শিক্ষা তাকে বাইরে থেকেই অর্জন করতে হবে। বতর্মান কালে মানুষের জন্যে যে শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তাতে মানুষকে একটা জীবমাত্র ধরে নেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র জীব হিসেবে সফল জীবন যাপনের উপযুক্ত বানানোই বতর্মান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রচলিত শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্য। [Huxley: Man in The Modern World দ্রষ্টব্য]
মানব–মনের মৌল জিজ্ঞাসা
কিন্তু মানুষ প্রথমত জীব হলেও মানুষ ও জীবন মূলত এক ও অভিন্ন নয়। বস্তুগত দিক দিয়ে এক হলেও মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্নতর সৃষ্টি-সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা। মানুষের ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন প্রকট, জীব-জন্তুর ক্ষেত্রে সেসব প্রশ্ন শুধু অবান্তরই নয়, হাস্যকরও বটে।
মানুষের মনে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তিনটি মৌলিক প্রশ্ন জেগে ওঠে। প্রথম প্রশ্নঃ আমি যে বিশাল বিশ্বলোকে জন্ম নিয়েছি ও বেঁচে আছি, এর স্রষ্টা কে? কি উদ্দেশ্যে তিনি এই বিশ্বলোক ও এর মধ্যকার এই অসংখ্য জীব-জন্তু ও মানুষকে সৃষ্টি করেছেন? কেননা উদ্দেশ্যহীন কোন কাজই সম্পন্ন হতে পারে না। মহান স্রষ্টার এই মহতী সৃষ্টিকর্ম কোনরূপ উদ্দেশ্য ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে, একথা কল্পনাও করা অসম্ভব।
মানব মনের দ্বিতীয় পশ্নঃ এই বিশ্বলোকে আমার ‘অবস্থানটা’ কি? আমি নিজের ইচ্ছা বা চেষ্টায় এখানে জন্মাইনি। স্রষ্টাই নিজ ইচ্ছা ও শক্তিকে আমাকে এখানে সৃষ্টি করেছেন? স্রষ্টার সাথে আমার সম্পর্ক কি? তাঁর প্রতি আমার কর্তব্য কি? পৃথিবীতে আমারই মতো আরও যে অসংখ্য মানুষ বাস করছে, তাদের সঙ্গেই বা আমার সম্পর্ক কি? তাদের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি? প্রতিনিয়ত-প্রতিমুহূর্ত অসংখ্য বস্তু-সামগ্রীকে আমি আমার প্রয়োজন পূরণে ব্যবহার করছি; কিন্তু কি মনোভাব নিয়ে, কি পন্থা ও পদ্ধতিতে এবং কি উদ্দেশ্যে আমি এসব ব্যবহার করব? এই দুনিয়ায় সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্যে আমার প্রয়োজন একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের। সেই জীবন বিধান আমাকে কে দেবে? তা কি আমি নিজেই রচনা করব, না দুনিয়ার অন্য কোন মানুষ তা আমাকে রচনা করে দিবে? না দিবেন সেই মহান স্রষ্টা, যিনি নিজ ইচ্ছা ও অনুগ্রহে আমাকে এখানে জীবন যাপন করার ও এইসব দ্রব্য-সামগ্রী ভোগ-ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছেন?
আর তৃতীয় প্রশ্ন হল, মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি কি? মানুষ মরে গেলেই কি তার জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়, না তার পরও জীবনের কোন পর্যায় রয়েছে? থাকলে সেই পর্যায়ে আমার মঙ্গল-অমঙ্গলের সাথে আমার এই জীবনের কি সম্পর্ক?
এ তিন-তিনটি প্রশ্নই অত্যন্ত মৌলিক। এ প্রশ্নত্রয়ের সুস্পষ্ট জবাবের ওপরই এ দুনিয়ায় মানুষের সুষ্ঠু এই জীবন নির্ভরশীল। এগুলোর জবাব ছাড়া মানুষের জীবন সম্পর্কে কোনরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়। ইতিবাচক হোক কি নেতিবাচক, অস্পষ্ট হোক কি সুস্পষ্ট, সর্বপ্রথম এই প্রশ্নগুলোর জবাব ঠিক করেই সম্মুখে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। আর সত্যি কথা হচ্ছে, এ প্রশ্নগুলোর নির্ভুল জবাব দিতে পারে একমাত্র ধর্মই। অতএব শিক্ষার ব্যাপারে ধর্মের ভূমিকা আছে শুধু তা-ই নয়, ধর্মকে বাদ দিয়ে কোন যথার্থ শিক্ষার কল্পনাই করা যেতে পারেনা।
বস্তুবাদ মানব-মনের উপরোক্ত তিনটি মৌলিক প্রশ্নের কোনটিরই সঠিক ও নির্ভুল জবাব দিতে পারেনি। তবে প্রশ্নত্রয়ের মধ্যে শুধু দ্বিতীয় প্রশ্ন নিয়েই সে মাথা ঘামিয়েছে এবং অন্য দুটি প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাবে বস্তুবাদ মানুষের মন-মগজ তৈরী করতে চেয়েছে আল্লাহকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে। উপস্থিত যা যে রকম রয়েছে, তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে মানুষের মানস-প্রবণতাকে এবং একান্তভাবে নির্ভর করেছে মানুষের নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি চিন্তাশক্তির ওপর। মানুষ এই দুনিয়ায় আছে এবং দুনিয়ার এসব দ্রব্য-সামগ্রী, শক্তি-সামর্থ্য ও উপকরণাদি ব্যবহার করতে পারছে, বস্তুবাদী দৃষ্টিতে এটাই যথেষ্ট। কিন্তু সে নিজে কোত্থেকে, কিভাবে, কার অনুগ্রহে এবং কেন এই দুনিয়ায় এসেছে, দুনিয়ার বস্তুসমূহ ভোগ-ব্যবহার করার এই সুযোগ কে দিয়েছে, কেন দিয়েছে আর এর চূড়ান্ত লক্ষ্যই বা কি? বস্তুবাদ এসব প্রশ্ন সম্পর্কে মানুষকে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার মধ্যে রাখতে চেয়েছে। এসব বিষয়ে নির্ভুল ধারণা দেয়ার কোন প্রয়োজনীয়তাই সে বোধ করেনি। ফলে এই শিক্ষাকে ‘শিক্ষা’ না বলে চরম মূর্খতা বলাই সমীচীন।
মানুষের বৈশিষ্ট্য
আধুনিক শিক্ষা মানুষকে নিতান্ত একটি জীব হিসেবেই গড়ে তুলতে চাইছে। আর জীব-জন্তুর বেলায় কোন নৈতিকতার প্রশ্ন ওঠতে পারেনা বিধায় মানবীয় শিক্ষাকেও সম্পূর্ণ নৈতিকতা-বিবর্জিত করে রাখা হয়েছে। অথচ মানুষ সম্পর্কে পরম সত্য হচ্ছে, মানুষ নৈতিক জীব- নৈতিকতাই তার আসল সম্পদ। নৈতিক জীব বলেই মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا –تَفْضِيلًا
‘‘নিশ্চয়ই আমরা মানব সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমরা তাকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদেরকে উত্তম জীবন-উপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’’ (সূরা বনী–ইসরাঈলঃ ৭০)
মানব-সত্তা এক সঙ্গে বস্তুগত ও নির্বস্তুক শক্তির সমন্বয়। একটি ছাড়া অন্যটির বাস্তবতা অসম্ভব-অকল্পণীয়। বস্তুগত দিক দিয়ে মানুষ ও পশুর মধ্যে আকার-আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ভিন্ন আর কোনই পার্থক্য নেই। বস্তুগত বিচারে অন্যান্য জীবের ওপর অধিক কোন মর্যাদাও তার নেই। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। সর্বোপরি তার মধ্যে রয়েছে নির্বস্তুক শক্তি ‘রুহ’। এদিক দিয়েই সে মানুষ আর এখানেই মানুষের নৈতিকতার প্রশ্ন। অতএব মানুষের এই নৈতিকতাকে বাদ দিয়ে তার জন্যে কোন শিক্ষা ব্যবস্থাই রচনা করা যেতে পারে না। মানব সত্তায় বস্তু জগতের প্রতিনিধিত্ব করে তার দেহ এবং বস্তু শক্তির প্রতিনিধি হচ্ছে তার মন। এই কারণে শিক্ষাদর্শনে মানসবৃত্তির পরিচ্ছন্নতা ও উৎকর্ষ সাধনের প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর (Plato) মতেঃ শিক্ষার উদ্দেশ্য হল, সুস্থ শরীরে একটি সুস্থ মনকে (A sound mind in a sound body) বিকশিত করে তোলা। প্লেটোর মতে, ‘মনে জ্ঞানের সঞ্চার করাই শুধু শিক্ষার কাজ নয়। মনের মধ্যে সুপ্ত যে গুণগুলো আছে, তার বিকাশ সাধন করাই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য।’ অ্যারিস্টটল (Aristotole)- এর মতেঃ শিক্ষার অর্থ মানুষের সহজ বৃত্তিকে, বিশেষ করে তার মনকে বিকশিত করে তোলা, যাতে সে মহত ও সুন্দরের ধারণাকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং এর মধ্যেই তার পূর্ণ সুখ নিহিত। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে মানব প্রকৃতির যে আদর্শ, তারই ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে শিক্ষাকে। [(Bertrand Russell: On Education, P-19)] এই প্রেক্ষিতেই উল্লেখ করতে হয় যে, নিতান্ত বস্তুবাদী শিক্ষা-দার্শনিকরা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেনঃ
‘‘Man is more than a hardworker or a skillful artisan; what is more he has wide duties to discharge and higher aspiration to fullfill.’’ [P, Gisbert; Fundamentals of Sociology, P-220]
‘‘মানুষ একজন পরিশ্রমী কর্মী বা একজন দক্ষ কারিগরের চেয়েও অনেক বেশী। এর থেকে বড় কথা তাকে বৃহত্তর কর্তব্য সম্পাদন করতে এবং উচ্চতর আশাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে।’’
দার্শনিক ডিউই (Dewey) সেই সব কর্মীদের মনোভাবকে ‘অনুদার ও নৈতিকতা-বিরোধী; (Illiberal and Immortal) বলে অভিহিত করেছেন, যারা কেবলমাত্র জৈবিক প্রয়োজন পূরণে রোজগার করে। তিনি বলেছেন, জীবনের বৃহত্তর অর্থ উদ্দেশ্যকে বিস্মৃত হওয়া হীন দাসত্বের লক্ষণ।
দার্শনিকদের এসব উক্তিতে যে ‘মনে’র কথা বলা হয়েছে, তাঁরা তার যে অর্থই করুন, সেই মনই যে মানব-সত্তার সার নির্যাস এবং সেই মনের খোরাক জোগানোর জন্যেই যে ধর্মের অপরিহার্য প্রয়োজন, তা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যেতে পারেনা। মনের মধ্যে সুপ্ত গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধন যে নিছক বস্তুনিষ্ঠ শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভবপর নয় তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কারিগরিত্বের চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে মানব সত্তা, তা এই ধর্ম-বিশ্বাসী মানুষ। নৈতিক আদর্শ তথা ধার্মিক জীবন যাপন করাই তার বৃহত্তর কর্তব্য। মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদিত করা এবং পরকালে তাঁর সন্তুষ্টি লাভই যে তার উচ্চতর আশা এবং এ উদ্দেশ্য পূরণার্থে নিজের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করাই যে সে আশা পরিপূরণের একমাত্র উপায় তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
বস্তুত মানব মনের পিপাসা অপরিসীম। তার প্রসারতা বিপুল, ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। মহাশক্তিমান আল্লাহর প্রতি গভীরতর ও ঐকান্তিক বিশ্বাসমূলক ভাবধারায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকে মানুষেরই মন। তিনি হচ্ছেন এমন সত্তা, যাঁর নিকট নিজেকে পুরোপুরি সোপর্দ করে দিয়েই মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারে এবং মানবজীবনের চরম ও পরম সাফল্য কেবলমাত্র এই উপায়েই অর্জিত হতে পারে। আর এ জন্যেই মানবীয় শিক্ষায় ধর্মের বিশেষ ভূমিকা অনিবার্যভাবে থাকতে হবে। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার মৌল প্রেরণা ও উৎসও হতে হবে এই ধর্মকে। ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মমতের ভিত্তিতেই গড়তে হবে শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা।
কিন্তু এটি কোন ধর্ম? যে ধর্ম মানুষের কেবলমাত্র ব্যক্তিজীবনের ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ পরিসরে গ্রহণ করা হচ্ছে, যে ধর্ম মানুষ ও স্রষ্টার মধ্যে একটা নামমাত্র সম্পর্ক স্থাপন করে এবং ব্যক্তিগতভাবে কিছু পূজা-পাঠের আয়োজন করেই কর্তব্য সমাধা করে, যে ধর্মকে লেনিন ‘আফিম’ বলে উপহাস করেছে, সেই ধর্ম আমাদের সামনে নেই। সে ধর্মের কথা আমরা এখানে বলছিনা। কেননা সে ধর্মের সাথে শিক্ষার দূরতম সম্পর্কও থাকার কথা নয়। এ ধরণের ধর্মে ‘পাঠ’ থাকতে পারে; কিন্তু ‘শিক্ষা’ থাকবার কোন প্রয়োজন পড়েনা। এই ধরণের ধর্ম মানব মনের মৌল জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব দিতে পারেনা। এখানে বলা হচ্ছে সেই ‘ধর্মের’ কথা, যা একদিকে স্রষ্টার সঙ্গে এবং অপরদিকে সমগ্র সৃষ্টিলোকের সঙ্গে যুগপৎ মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং সেই সম্পর্ককে বাস্তবভাবে রক্ষা ও লালন করার জন্যে মহান স্রষ্টা সুস্পষ্ট ও অকাট্য বিধান দিয়েছেন। তাঁর (আল্লাহর) নাযিল করা দ্বীন-ইসলামই সেই ধর্ম। এই ধর্মই মানব মনের প্রকৃতি-নিহিত ও উপরোদ্ধৃত প্রশ্নত্রয়ের সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে। আমরা বলব, এই ধর্মের ভিত্তিতেই গড়তে হবে মানবীয় শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা। এরূপ শিক্ষা ব্যতিরেকে মানুষ ধার্মিক হতে পারে না আর এহেন ধর্মের বাস্তব অনুসারী না হলে মানুষ পারেনা নিছক জীবত্বের পর্যায় থেকে মনুষ্যত্বের পর্যায়ে উন্নীত হতে। তাই যে মানুষ মনুষ্যত্বই পেলনা, তার সম্পর্কে শিক্ষার কথা বলে কোন লাভই হতে পারেনা।
ধর্মের প্রকৃত রূপ
বস্তুত শিক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে সেই ধর্ম যা মানব-মনের উপরোদ্ধৃত প্রশ্নত্রয়ের সুস্পষ্ট ও অকাট্য জবাব দিতে এবং সেই জবাবের মৌল ভিত্তির ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান রচনা করতে সক্ষম; সেই সঙ্গে বাস্তবভাবে গড়ে তুলতে পারে মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন- জীবনের সবদিক ও বিভাগ আর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের প্রতিটি সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারে উক্ত জবাবের ভিত্তিতে। সর্বোপরি সেই একই জবাবের বলিষ্ঠ ভাবধারা জীবনের সর্বদিকে সংক্রমিত করতে পারে। আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তা ও দর্শন এই সামগ্রিকতা হারিয়ে ফেলেছে। সেখানে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে মারাত্মক ধরণের একদেশদর্শিতা। এরই ফলে উদ্ভব হয়েছে অসংখ্য বিশেষজ্ঞের (Specialist); এক-একজন বিশেষজ্ঞ এক-একটি বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে তারই ভিত্তিতে গোটা জীবন-প্রাসাদ রচনা করতে চেয়েছে। ফলে জীবনে দেখা দিয়েছে চরম ভারসাম্যহীনতা। এসব বিশেষজ্ঞ মানব-জীবনের এক একটি দিকই শুধু দেখেছে; জীবনের অন্যান্য সব দিক রয়ে গেছে তাদের চোখের আড়ালে। এক-একজন বিশেষজ্ঞ কেবল নিজের বিষয়টিকেই আবশ্যকীয় জ্ঞান ও শিক্ষণীয় বিষয় বলে অভিহিত করেছে এবং সেই একটি দিক দিয়েই সমগ্র জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে দাবি করেছে। ফলে জীবনের সব কিছুই হয়ে গেছে আপেক্ষিক। এক্ষণে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা, ধর্ম-বিশ্বাস, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সবকিছুই আপেক্ষিক। এ আপেক্ষিক তত্ত্ব-ভিত্তিক সমাজ দর্শন মানুষের জীবনে কোন কল্যাণই আনতে পারেনি; বরং তা জীবনের ভারসাম্যই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। অথচ মানবজীবনে যে মতাদর্শ বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা হচ্ছে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ-দর্শন, যাতে বিশ্ব-দর্শন থেকে শুরু করে মানব-প্রকৃতি, নৈতিকতা, সমাজ-জীবন, রাজনীতি, অর্থনীতি, মন-মানস সব কিছু সম্পর্কেই সুস্পষ্ট ধারণা থাকবে। মানুষের জীবনকে একটা অবিভক্ত ও অবিভাজ্য একক হিসেবে গ্রহণ করা ও বিবেচনা করা হবে। বিংশ শতকে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম সাধারণ জনমনে স্থান পেয়েছিল শুধু এই কারণে যে, সে নিজেকে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজদর্শন ও জীবনব্যবস্থা হিসেবেই পেশ করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার আবেদন দূর্বল ও আবেগহীন হয়ে পড়েছে শুধু এই কারণে যে, এই সময়ের মধ্যে তার অন্তর্নিহিত, জিঘাংসা সাধারণ্যে ব্যক্ত হয়ে পড়েছে এবং প্রমাণিত হয়েছে যে, তা ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ-দর্শন নয় আদপেই। কেননা তা মানব-মনের প্রকৃতিনিহিত প্রশ্নত্রয়ের জবাবটি নিতান্ত এলামেল করে নেতিবাচকভাবে দিয়েছে। মানব-প্রকৃতি সে জবাবে কিছুমাত্র পরিতৃপ্ত হতে পারেনি। তাতে মহান স্রষ্টা আল্লাহকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ প্রখ্যাত ইতিহাস-দার্শনিক টয়েনবি’র মতেঃ The greatest need of our times is a rebirth of the belief in the super-natural- অর্থাৎ ‘আমাদের একালের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো অতি-প্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাসের পুনর্জীবন’। আধুনিক ইউরোপ ও আমেরিকা যে কঠিন মনস্তাত্ত্বিক রোগে আক্রান্ত ও জর্জরিত তার অধিকাংশই হচ্ছে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি থেকে উদ্ভূত। আধুনিক বিশ্ব চরমভাবে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দেউলিয়াপনায় নিমজ্জিত। এই অবস্থায় একালের বিশ্বামানবের জন্যে একটি বিপ্লবী বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসভিত্তিক জীবন-বিধানের একান্তই আবশ্যক। তাই এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর দেয়া জীবন-বিধান দ্বীন-ইসলামের পুনরুজ্জীবন অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী Jung বলেছেনঃ
‘আমি হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছি। সকলের মধ্যেই আমি আল্লাহ ও ধর্মবিশ্বাসের আকুল পিপাসা লক্ষ্য করেছি।’
এই কারণে তিনি যে বই লিখেছেন তার নাম দিয়েছেন Modern Man is Search of Soul- ‘আধুনিক মানুষ তার আত্মার সন্ধানে আকুল’। একজন দুজন নয়, শত শত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী আজ একই কথা বলছেন। তাই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের মানুষকে, যদি মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করবার সুযোগ নিতে হয়, মুসলমানকে যদি বাস করতে হয় প্রকৃত মুসলিম হিসেবে, তাহলে মানুষকে সেই শিক্ষাই দিতে হবে, যার মাধ্যমে তারা তাদের আত্মাকে ফিরে পাবে। সেই সঙ্গে মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস অর্জিত হবে, মানুষ জানতে পারবে মহান আল্লাহ সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্যে কি বিধান দিয়েছেন এবং সেই বিধান পুরামাত্রায় পালন করার ও সামষ্টিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবল তাগিদও তা থেকে লাভ করতে সক্ষম হবে।
কিন্তু এরূপ শিক্ষা কে দিতে পারে? বর্তমান দুনিয়ায় ‘ধর্ম’ নামে পরিচিত খৃস্টান ইয়াহুদী বা হিন্দুধর্ম তা পারেনা; তা দিতে পারে একমাত্র দ্বীন-ইসলাম। এই দ্বীন ভিত্তিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত আজকের মানুষ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শুধু হাহাকার করে বেড়াচ্ছে। তারা এর সন্ধান পাচ্ছে না। এই সন্ধান দেয়ার দায়িত্ব ইসলামের বিশ্বাসী জন-সমাজ ও রাষ্ট্রসমূহের। দূর অতীতে এরাই যেমন একদিন বিশ্বের মানুষকে এইরূপ জ্ঞান-আলোকে ধন্য করেছিল, মূর্খতা ও অজ্ঞানতার পুঞ্জীভূত অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়েছিল তদানীন্তন ইউরোপকে, তেমনি আজকের মানুষকেও বিরাজমান দুরবস্থা থেকে মুক্তি দেয়া তাদের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু আফসোস! আজকের মুসলিম সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রসমূহ দুনিয়াকে সেই জ্ঞান-আলোকে উদ্ভাসিত করার পরিবর্তে এক্ষণে নিজেরাই শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হয়ে পাশ্চাত্য জাহিলিয়াতের অন্ধকারে হাতড়ে মরছে।
বিশ্ব–মুসলিমের বর্তমান অবস্থা
পূর্বেই বলেছি, বর্তমান দুনিয়ার মুসলমান দ্বীন-ইসলাম-ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাদের বিপূল অংশ নিছক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আনুষ্ঠানিক ধর্মশিক্ষা লাভ করছে বটে, কিন্তু জীবনের সামগ্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে। তারা জানতে পারছেনা ইসলামের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতির মূল সূত্রগুলো। দ্বীন-ইসলাম আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসা ও জীবন-সমস্যার কি সমাধান দেয় ও কিভাবে সমাধান করতে চায়, সে বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও মূর্খ থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে যে সব দেশ বৃটেন, ফ্রান্স বা এই ধরণের কোন খৃস্টান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোলামী থেকে মুক্তিলাভ করে সম্প্রতি স্বাধীন হয়েছে, সে সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও গোলামদের উপযোগী রয়ে গেছে, যেমন ছিল তাদের গোলামী যুগে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সে সব দেশে সম্পূর্ণ গায়র-ইসলামী শিক্ষা চালু করেছিল। সে শিক্ষা মানুষকে হয় খৃস্টান বানিয়েছে, না হয় ইসলামের প্রতি অবিশ্বাসী ও নৈতিক চেতনাহীন বানিয়েছে। এখনও তা-ই চলছে।
অপরদিকে বহু মুসলিমে দেশ ও জাতি এই আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষাকেও সম্পূর্ণ পরিহার করেছে এবং তারা ইউরোপের নাস্তিক্যবাদী ও ধর্মবিবর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্বিত চর্বন করছে। এভাবে তারা ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠছে অবিশ্বাসী ধর্মত্যাগী ও নৈতিক চরিত্রহীন। এহেন নৈতিকতা-বিবর্জিত বহু মুসলিম দেশ ইউরোপীয় পদ্ধতিতে দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার অপচয় করতে বাধ্য হচ্ছে এই কারণে যে, যেসব দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ওপর উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব অর্পিত, চরিত্রহীন ও দুর্নীতিপরায়ন বলে তারাই বরাদ্দকৃত অর্থের শতকরা ৮০ ভাগই আত্মসাত করছে। এর ফলে শুধু যে উন্নয়ন প্রকল্পই ব্যর্থ হচ্ছে তা-ই নয় গোটা জাতিই দুর্নীতির গভীর পংকে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় সংস্কৃতির নির্বিচার অনুসরণ করতে গিয়ে তারা নিজেদের ধর্মশিক্ষা বিবর্জিত প্রতিষ্ঠানসমূহে যুবক-যুবতীদের জন্যে সহশিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে এবং তার ফলে এসব দেশের ভবিষ্যত বংশধররা চরম নৈতিক কদর্যতায় লিপ্ত হয়ে চরিত্রহীনতার ব্যাপক প্রসার ঘটাচ্ছে। অথচ এই সাধারণ বোধটুকুও তাদের হচ্ছে না যে, বিদ্যুৎবাহী তার বাল্বের সংযোগস্থলের বাইরে কোন এক স্থানে আবরণমুক্ত হলে ঘরকে আলোকোজ্জ্বল করার পরিবর্তে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেবে ও সবকিছু ভষ্ম করে ফেলবে। এটা যেমন বিজ্ঞানসম্মত কথা, তেমনি এ-ও অকাট্য যুক্তির কথা যে, বিবাহিত জীবনের বাইরে নারী-পুরুষ বা যুবক-যুবতীর অবাধ মিলনের সুযোগ থাকলে তা গোটা সমাজ ও জাতিকেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তা ছাড়া এসব দেশে ছেলে ও মেয়েদের একই রকমের শিক্ষা দেয় হচ্ছে। ফলে নারী ও পুরুষ তাদের প্রকৃতিগত পার্থক্যের কথা ভুলে যাচ্ছে। মেয়েরা সেখানে পুরুষালী স্বভাব-চরিত্রের ধারক হয়ে নারীসুলভ কোমলতা হারাচ্ছে। [অধুনা কলেজ–ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে অনেক ছাত্রীকেই ছেলেদের মতো জীনসের প্যান্ট–শার্ট পরে এবং মাথার চুল ছোট করে কেটে যত্র–তত্র ঘুরাফিরা করতে দেখা যায়। এ থেকেই সহশিক্ষার পরিণতিটা সহজে উপলব্ধি করা যায়। অথচ রাসূলে করীম সা. এ ধরণের অনুকরণকে তীব্রভাষায় নিন্দা করেছেন।– সম্পাদক] এর ফলে পারিবারিক জীবনে চরম ভাঙন ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ নারী ও পুরুষ জন্মগতভাবেই ভিন্ন ধরণের প্রকৃতি ও যোগ্যতা এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের উপযোগী হয়ে জন্মলাভ করে। কিন্তু তাদেরকে সেই স্বভাবগত কাজের উপযুক্ত বানাবার মতো শিক্ষা দেয়া হয়না। ফলে একই ধরণের কর্মক্ষেত্রে তথা অফিস-কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষকে একত্রে নিযুক্ত করে নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যার ফলে এসব দেশের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বহু সংখ্যক মুসলিম দেশেই আজ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় অত্যন্ত প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কুরআন বিজ্ঞানের মৌল উদ্বোধক
একালের মুসলমানদের মধ্যে এই মারাত্মক ভুল ধারণা প্রবল হয়ে আছে যে, কুরআন ও সুন্নাহ নিতান্তই সংকীর্ণ ধর্মীয় শিক্ষার বাহন মাত্র; তা পড়লে ‘মোল্লা’ হওয়া যায়, বিজ্ঞানী হওয়া যায়না। এ ধারণা যে কতবড় ভুল তা একথা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, হার্বার্ট স্পেন্সার-এর ন্যায় বিজ্ঞানী-দার্শনিকও বলেছেনঃ ‘ধর্মই মূলত মানুষকে বস্তুবিজ্ঞান বা প্রকৃতিবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে’। আর কুরআন মজীদ তো প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা ও অনুধাবনের খোলাখুলি নির্দেশ দিয়েছে। কাজেই কুরআনকে যদি নির্ভুলভাবে ও উপযুক্ত পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে লব্ধজ্ঞানের বদৌলতে বহু দার্শনিক ও বিজ্ঞানী তৈরী হতে পারে। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা তানতাবীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী কুরআনের আয়াতঃ
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ أَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ ثَمَرَاتٍ مُّخْتَلِفًا أَلْوَانُهَا ۚ وَمِنَ الْجِبَالِ جُدَدٌ بِيضٌ وَحُمْرٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهَا وَغَرَابِيبُ سُود – وَمِنَ النَّاسِ وَالدَّوَابِّ وَالْأَنْعَامِ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ كَذَٰلِكٌَ
‘‘তুমি কি দেখছ না যে, আল্লাহ উর্ধ্বলোক থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার সাহায্যে আমরা নানা বর্ণের ফল-মূল উৎপাদন করছিঃ পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে সাদা, লাল ও গাঢ় কালো বর্ণ। অনুরূপভাবে মানুষ, জীব-জন্তু ও গৃহপালিত পশুগুলোর বর্ণও নানা রকমের।’’ (সূরা ফাতিরঃ ২৭–২৮)
এর পরই বলা হয়েছেঃ
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
‘‘আসল কথা হচ্ছে, আল্লাহর বান্দাহদের মধ্য থেকে কেবল জ্ঞানবান লোকেরাই আল্লাহকে ভয় করে।’’ (সূরা ফাতিরঃ ২৮)
বস্তুত প্রকৃতি-জ্ঞানই মানুষকে সত্যিকার বিজ্ঞানী বানায়। এই প্রকৃতি জ্ঞানই মানুষকে পানি, গাছ-পালা, লতা-গুল্ম, ফুল-ফল, পাহাড়, চন্দ্র, সূর্য ও বিভিন্ন বর্ণ ও রঙ সম্পর্কে গভীর ও সূক্ষ্ণভাবে চিন্তা-গবেষণা করার যোগ্য বানায়। আর দ্রব্যগুলো সম্পর্কিত জ্ঞানই মানুষকে আল্লাহর অসীম কুদরত সম্পর্কে সম্যক অবহিত করতে পারে। স্পেন্সর যে বলেছেন, ‘প্রকৃতিজ্ঞান ও বিজ্ঞান ইবাদত-বিশেষ’ তা একবিন্দু মিথ্যা নয়। এই দ্রব্য-গুণ পরিচিতি লাভ করেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠতে বাধ্য হয়ঃ
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘‘হে আমাদের রব্ব! তুমি এগুলোর কিছুই নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করনি। তুমি উদ্দেশ্যহীন কাজের বাতুলতা থেকে পবিত্র। অতএব তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর।’’ (আলে ইমরানঃ ১৯১)
এই প্রেক্ষিতেই নবী করীম সা. বলেছেনঃ
‘‘(আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে) এক ঘন্টা চিন্তা গবেষণা করা এক বছর বন্দেগী করার চেয়ে উত্তম।’’
একদা তিনি ইরশাদ করেনঃ
‘‘আজ রাত্রে আমার প্রতি এমন একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যে লোক সে আয়াতটি পড়লো কিন্তু তাতে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করলোনা, সে প্রকৃত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল। সে আয়াতটি হচ্ছেঃ
‘‘আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি, রাত্র-দিনের আবর্তন এবং জনকল্যাণমূলক দ্রব্যাদিসহ নদী-সমুদ্রে চলমান নৌকা-জাহাজ (এই সবের মধ্যে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের প্রমাণ নিহিত)।’’
হার্বার্ট স্পেন্সরের এই কথাও সত্য যে, ‘বিজ্ঞান ধর্মকে শক্তিশালী করে এবং ধর্ম শক্তিশালী করে বিজ্ঞানকে’।
ইমাম গাজ্জালী বলেছেনঃ ধর্ম হচ্ছে সব রোগের ঐষধ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান হচ্ছে খাদ্য। ওষুধ খাদ্য অ-নির্ভর নয়, খাদ্যও নয় ওষুধ অ-নির্ভর।’
কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী ‘হিকমাহ’ শিক্ষা দেয়াও রাসূলে করীমের সা. এর দাযিত্ব। ইরশাদ হয়েছেঃ
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
‘‘আল্লাহ মুমিন লোকদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন এভাবে যে, তিনি তাদের মধ্য থেকেই তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের নিকট আল্লাহর নিদর্শনাদি একের পর এক পেশ করছে এবং তাদেরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করছে আর সেই সঙ্গে তাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে কিতাব এবং গভীর ও সূক্ষ্ণ জ্ঞান-যদিও পূর্বে এরা সকলেই সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’’ (সূরা আলে–ইমরানঃ ১৬৪)
ইমাম রাগেব লিখেছেনঃ
‘‘হিকমত অর্থ বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞানের সাহায্যে প্রকৃত সত্যকে সঠিকভাবে জানা। অতএব আল্লাহর হিকমত বলতে বুঝায় বস্তু সংক্রান্ত সঠিক জ্ঞান ও পরম সুষ্ঠুভাবে দ্রব্যাদির উদ্ভাবন ও উৎপাদন করা। আর মানুষের হিকমত অর্থ, বিশ্বলোকে বিরাজমান দ্রব্যাদি সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান অর্জন এবং সেসবকে কল্যাণময় কাজে প্রয়োগ।’’
মুসলমানদের দায়িত্ব
মানুষের প্রাথমিক জ্ঞান-উৎস পঞ্চেন্দ্রিয়। মানুষের মধ্যে আল্লাহর সৃষ্ট মনই এই ইন্দ্রিয়নিচয়ের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানসমূহকে পরস্পর সুসজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করে, তারপর এই জ্ঞানসম্পদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে এবং সেসবের সীমা নির্ধারণ ও পরিচিতি প্রকাশ করে, অতঃপর সেগুলোকে বিভিন্ন পর্যায়ে সাজিয়ে রাখে। তারপর এগুলোর কারণ ‘সন্ধান’ করে। অতঃপর এসবের কার্যকরতার সাদৃশ্য অনুসন্ধান করে। শেষ পর্যায়ে যে জ্ঞান মানুষের সামনে প্রতিভাত হয়, তা-ই হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এই পদ্ধতি হল জ্ঞান-বিজ্ঞান; কিন্তু এই জ্ঞান-মাধ্যমও সর্বোতভাবে নির্ভুল হয়না-নির্ভুল হয়না এর মাধ্যমে পাওয়া বিজ্ঞান-তত্ত্ব। কেবল মহান আল্লাহর দেয়া জ্ঞানই হতে পারে এই জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ভুল-নির্ভুল পরখের মানদণ্ড। দুঃখের বিষয় সেই মানদণ্ড থেকে আজকের মানুষ বঞ্চিত। দুনিয়ার মুসলমানদের নিকট এই মানদণ্ড যথাযথভাবে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তারা এটিকে উপেক্ষা করে অকেজো করে রেখেছে। নিজেদের নিকট সংরক্ষিত এই মহামূল্য সম্পদকে তারা এক কানা কড়িও মূল্য দেয় না। ফলে তারাও মূল্য-জ্ঞান (Sense of values) হারিয়ে ফেলেছে। এই মূল্য-জ্ঞান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মুসলিম সমাজও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবেনা। তাই আজকের মুসলমানদের নিকট এই প্রশ্ন নয় যে, তাদের শিক্ষায় ধর্মের কোন ভূমিকা আছে কিনা বা থাকবে কিনা। তাদের নিকট আজ একটি মাত্র কথা, তাদের ধর্মের ভিত্তিতে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত না করা হলে এই দুনিয়ায় তাদের টিকে থাকাই সম্পূর্ণ অসম্ভব হবে। যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও শূণ্যতা দেখে দুনিয়ার মানুষ, বিশেষত চিন্তাশীল মুসলমানরা হাহাকার করে উঠছে, তার পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা কেবলমাত্র দ্বীন-ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এই শিক্ষা হতে হবে একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ পর্যায় অবধি। কেননা ছোট বয়স থেকেই দ্বীন-ভিত্তিক শিক্ষা না দিলে বড় হয়ে দ্বীন-ভিত্তিক শিক্ষার কোন গুরুত্বই শিক্ষার্থীর অনুধাবন করবে না। বস্তুত আমরা যদি চাই আমাদের পরবর্তী বংশধররাও দ্বীনদার হোক, দ্বীনী যিন্দেগী যাপনকারী মুসলিম রূপে গড়ে ওঠা অব্যাহত থাকুক, তাহলে এ ছাড়া কোন উপায় হতে পারেনা।
অতএব মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে দ্বীন-ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বিশেষভাবে নিজেদের জনগণকে এবং সাধারণভাবে দুনিয়ার মানুষকে আসন্ন ধ্বংস থেকে রক্ষা করা।
সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও নৈতিকতাকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ও পরস্পর-বিরোধী জিনিস মনে করা হয়। বলা হয়, নৈতিকতা মানুষের আচার-আচরণকে উন্নত করতে পারে বটে; কিন্তু এ্যাটম (আণবিক) বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা বানাতে পারেনা। বর্তমান এ্যাটমিক (আণবিক) যুগে এ্যাটম বোমার প্রয়োজন, নৈতিকতার নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে বোমা বর্ষণকারী বিমানের প্রয়োজন। নৈতিকতা তার প্রতিরোধ করতে পারেনা।
কিন্তু এ ধারণা ভিত্তিহীন। এ্যাটম যদি শক্তি হয়, তা হলে নৈতিকতাও একটি শক্তি। তবে এর মধ্যে কোন্টি অধিক প্রভাবশালী, তা নির্ভর করে একথার ওপর যে, এ দুটির মাঝে কোনটি স্থায়ী মূল্যমানের অধিকারী আর কোন্টি ক্ষয়িষ্ণু, ক্ষণস্থায়ী ও পরিবেশসৃষ্ট। আণবিক বোমার কথা শুনলেই ভয়ের সঞ্চার হয়; কিন্তু নৈতিকতার শক্তিকে অনুভব ও পরিমাপ করা হয়না। আসলে নৈতিকতাই এ্যাটম বোমা নির্মাণকারী ও বিস্ফোরণকারীদেরকে বদলে দিতে পারে। যে হিংস্র মনোভাব হাইড্রোজেন বোমা তৈরী করে, নৈতিকতা সেই মনোভাবকেই নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের মনোভাব বদলে দাও- এ্যাটম বোমা ও হাইড্রোজেন বোমার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, অন্তত তা মানব-বিধ্বংসী কর্মে ব্যবহত হবে না। বস্তুত নাস্তিকতা ও অনৈতিকতাই বিজ্ঞানের এই উন্নতি সাধন করে দেয়নি, এ্যাটমিক বোমাও বানিয়ে দেয়নি, বিজ্ঞানের এই উন্নতি ও অগ্রগতি মূলত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বাভাবিক গতিরই পরিণতি। তবে বিজ্ঞানকে মানব বিধ্বংসী কাজে ব্যবহার একান্তই ধর্মহীন ও নৈতিকতাহীন বিজ্ঞান চর্চার অনিবার্য পরিণতি।
নৈতিকতা এ্যাটম বোমা বানাতে পারে কিনা, প্রশ্ন তা নয়। আসল প্রশ্ন হচ্ছে, নৈতিক শিক্ষা এ্যাটম বোমা নির্মাণকারীদের আল্লাহ্নুগত বানাতে পারে কিনা? নৈতিক শিক্ষা পরিত্যক্ত হওয়ার কারণেই মানব-বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ সম্ভব হয়েছে, এতে কি কোন সন্দেহ আছে? [নৈতিক শিক্ষা ছাড়া এ্যাটম বোমা তৈরী করা কিংবা আণবিক শক্তির অধিকারী হওয়ার পরিণাম কত ভয়াবহ, ১৯৪৫ সনে জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় মার্কিনীদের আণবিক ধ্বংসলীলাই তার অকাট্য প্রমাণ।– সম্পাদক] এ্যাটম বোমা আদৌ নির্মাণ করা হবে কিনা সে প্রশ্ন না তুলে আমি বলব, এ্যাটমও বিশপ্রকৃতি নিহিত একটি শক্তি। তা মানুষের কল্যাণ ও জীবন-মান উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে না কেন? যদি তা করতে হয়, তাহলে নৈতিক চেতনা-উদ্বোধক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। বস্তুগত ও প্রকৃতি-নিহিত শক্তিসমূহকে বানাতে হবে আল্লাহর বান্দাহ ও অনুগত। শরী’আতের কানুন (Ethical law) হচ্ছে আল্লাহর কথা আর প্রাকৃতিক বিধান (Natural law) আল্লাহর কাজ। আমরা মুসলমানরা যদি আল্লাহর কথাকে গ্রহণ করে থাকি, তাহলে আল্লাহর ‘কাজ’টাকে গ্রহণ করতে আমরা কুণ্ঠিত হবো কেন? যারা আল্লাহর কথাকে বুঝেছে, তাদেরই তো উচিত আল্লাহর কাজকেও অনুধাবন করা আর তা কার্যত সম্ভবপর হতে পারে দ্বীন-ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে। তারই ফলে সম্ভব হবে আল্লাহর দেয়া যাবতীয় শক্তি ও সম্পদকে সার্বিকভাবে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা। কাজেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হতে হবে, যার ফলে তৈরী হবে দ্বীন-বিশ্বাসী দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ইঞ্জনিয়ার, ডাক্তার চিকিৎসাবিদ, রাষ্ট্রনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিল্পোক্তা, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কবি, লেখক তথা জাতীয় জীবনের সর্বদিকে প্রয়োজনীয় ও আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। দ্বীন-ভিত্তিক ব্যাপক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে অবিলম্বে এ ধরনের লোক তৈরীর কাজ শুরু না করা হলে আমার খুবই আশংকা হচ্ছে, সেদিন দূরে নয়, যখন আধুনিক মানুষ ইসলামকে সম্পূর্ণ পরিহার করে ধ্বংসের পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে।
এ একটি কঠিন ও দূরূহ কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সঠিক পন্থায় গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এই কাজে অগ্রসর হলে এবং সব কটি ইসলামী দেশে ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রবর্তন করা হলে ব্যর্থতার কোন আশংকা আছে বলে আমি মনে করিনা।