সংস্কৃতি ও নৈতিকতা
ইসলামী সংস্কৃতির দৃষ্টিতে নৈতিকতা গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণভাবেও নৈতিকতার এ গুরুত্ব সর্বকালে ও সর্ব সমাজে স্বীকৃত। সুদূর অতীত কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সকল চিন্তাবিদ ও দার্শনিকই নৈতিকতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর দুনিয়ার তাবৎ ধর্মসমূহের ভিত্তিই রচিত হয়েছে এই নৈতিকতার ওপর এবং সে কারণে প্রত্যেক ধর্মই তার অনুসারীদের জন্যে অলংঘনীয় নৈতিক নিয়ম-বিধান পেশ করেছে। কেননা ধর্মের দৃষ্টিতে মানবজীবনের সাফল্য এই নৈতিকতার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। উপরন্তু দুনিয়ার শান্তি, স্বস্তি, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য, প্রগতি ইত্যাদি নির্বিঘ্নতা, নিরাপত্তা ও নৈতিকতা ছাড়া আদৌ সম্ভবপর নয়। এটা অস্বীকার করার সাধ্য কারোর নেই। যে ব্যক্তি বা জাতি উত্তম ও নির্মল চরিত্রগুণে গুণান্বিত সে-ই সর্বপ্রকার কল্যাণ ও খোদায়ী রহমত ও বরকত লাভের অধিকারী। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বা জাতি তা থেকে বঞ্চিত তার পক্ষে কল্যাণ লাভ তো দূরের কথা, কালের ঘাত-প্রতিঘাতে টিকে থাকাই অসম্ভব; কেননা সামাজিক ও তামাদ্দুনিক শঙখলা কেবলমাত্র উত্তম নৈতিকতার দরুণই সংরক্ষিত হতে পারে আর তা না থাকলে সে শৃঙ্খলা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়ে গোটা সমাজের উচ্ছৃংখলতা ও অরাজকতার অতল গহ্বরে নিপতিত হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। সমাজতত্ত্ববিদ ও ইতিহাস-দার্শনিক আল্লামা ইবনে খালদুনের দৃষ্টিতে জাতিসমূহের উত্থান ও পতনের মূলে নিহিত আসল নিয়ামক হচ্ছে এই নৈতিকতা। তিনি লিখেছেনঃ
‘‘আল্লাহ তা’আলা যখন কোন জাতি, বংশ-গোষ্ঠী বা দলকে দেশ-নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র-কর্তৃত্ব দিয়ে মহিমান্বিত করতে চান, তখন সর্বপ্রথম তার নৈতিক অবস্থার সংশোধন করে নেন আর তারপরই এই মর্যাদা তাকে দান করেন। অনুরূপভাবে কোন জাতি, গোষ্ঠী বা দলের হাত থেকে এই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব যদি কেড়ে নেবার সিদ্ধান্ত করেন, তাহলে পূর্বেই তাকে চরিত্রহীনতা ও দুরাচারে উদ্বুদ্ধ করে দেন। তার মধ্যে এনে দেন সব রকমের দুষ্কৃতি, অশ্লীলতা ও উচ্ছৃংখলতা আর অন্যায় ও খারাপের পথে তাকে বানিয়ে দেন দ্রুত অগ্রসরমান। এরই ফলে সে নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও প্রশাসনিক যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তার শাসন-দণ্ড শক্তিহীন হয়ে ক্রমশ তার হস্তচ্যুত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত আসল শাসন ক্ষমতাই তার হাতে থেকে চলে যায় আর তার স্থানে অন্যরা ক্ষমতাসীন হয়ে বসে (মুকাদ্দমা)।’’
দুনিয়ার প্রতিটি ব্যক্তিই তার জীবনে সাফল্য লাভের অভিলাষী। এই অভিলাষ কেবল মাত্র দুটি জিনিসের সাহায্যেই সাফল্যমণ্ডিত হতে পার। একটি হল আল্লাহর প্রতি দুঢ় ঈমান আর দ্বিতীয়টি হল সদাচার ও শুভ কর্ম। অন্যকথায়, জীবন ও জগত সংক্রান্ত মৌলনীতি ও বিশ্বাসসমূহের প্রতি অবিচল প্রত্যয়েরই অপর নাম ঈমান আর তদনুযায়ী বাস্তব কাজই হল শুভ কর্ম, সদাচার বা নেক আমল। জীবনের সাফল্যের জন্যে এ দুটির সমন্বয় অপরিহার্য। ইসলাম মানুষের মুক্তি এ দুটি জিনিসের ওপর ভিত্তিশীল করে দিয়ে এ তত্ত্বেরই বাস্তবায়ন চেয়েছে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে এ দুটি অবিচ্ছেদ্য-ওতপ্রোত জড়িত। তবে ঈমান হল ভিত্তি আর নেক আমল হল তার ওপর গড়ে ওঠা প্রাসাদ। ঈমান হল বীজ আর নেক আমল হল সেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত বিরাট মহীরুহ। ‘নেক আমল’ এক বিরাট ও বিশাল তাৎপর্যমণ্ডিত বিশেষ পরিভাষা। মানব জীবনের সব রকমের কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও একে দুটি ভাগে বিভক্ত করা চলে। একটি ভাগের সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে আর অপর ভাগটির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক হচ্ছে মানুষ তথা সৃষ্টিকুলের সঙ্গে। প্রথমটির প্রচলিত নাম ‘ইবাদত’ আর দ্বিতীয়টিকে বলা যায় ‘মুআমিলাত’। দ্বিতীয়টিকেও দু’ভাবে ভাগ করা যেতে পারে। তার কতকগুলো হচ্ছে মানবীয় কর্তব্য বিশেষ, যাকে বলা হয় আখলাক বা নৈতিকতা আর অন্যগুলো আইনগত দায়িত্ব পর্যায়ের। সাধারণত একেই বলা হয় মু’আমিলাত।
এই ইবাদাত ও নৈতিকতার সমন্বয়েই ইসলামী জীবন বিধান গঠিত। এ দুটি বিষয় ইসলামী জীবন বিধানের দুটি বাহু বিশেষ। তাই এর কোনটিরই গুরুত্বকে কিছুমাত্র হালকা করে দেখা যেতে পারে না। নিছক ইবাদত মানুষকে পূর্ণ মুসলমান বানাতে পারে না যেমন, তেমনি এককভবে শুধু নৈতিকতাও তা সম্পাদন করতে অক্ষম। কুরআন মজীদ এ সত্যকে যথার্থ মর্যাদা দিয়েছে। তাতে যেখানেই ইবাদতের কথা বলা হয়েছে, সেখানেই বলা হয়েছে শুভ কর্ম ও সদাচার তথা নৈতিকতা অবলম্বনের কথা-বলা হয়েছে সমান গুরুত্ব সহকারে। নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটি লক্ষ্যনীয়ঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘‘হে ঈমানদার লোকেরা! ঈমান আন, রুকূ দাও, সিজদা করো এবং তোমাদের রব্ব-এর দাসত্ব ও বন্দেগী করো আর যাবতীয় ভালো ভালো কাজ সুসম্পন্ন কর; তা হলেই তোমাদের কল্যাণ লাভ সম্ভব।’’ (সূরা হজ্বঃ ৭৭)
বিশ্বনবীর এ দুনিয়ায় আগমণের উদ্দেশ্য ছিল মানব জাতিকে নৈতিক বিধান, কর্মনীতি ও আদর্শবাদিতা শিক্ষা দেয়া এবং এই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আদর্শ মানুষ তৈরী করা, চরিত্রবান মানুষকে খোদানুগত-খোদার বন্ধু বানিয়ে দেয়। নবী করীম সা.-এর আগমণের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
‘‘সেই মহান আল্লাহ্ই নিরক্ষর লোকদের ভেতর তাদের মধ্য থেকেই একজনকে রাসূল রূপে পাঠিয়েছেন। সে রাসূল তাদের সামনে আল্লাহর নিদর্শন ও বাণীসমূহ তুলে ধরবে, তাদেরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও সুষ্ঠু জ্ঞান-বু্দ্ধি শিক্ষা দিবে।’’ (সূরা জুম’আঃ ২)
কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে এখানে ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে চরিত্র বা নৈতিকতা। ইসলাম চরিত্রের গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা নিম্নোদ্দৃত আয়াত থেকে আরও সুস্ষ্টভাবে বুঝতে পারা যায়।
সূরা আহযাবে বলা হয়েছেঃ
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
‘‘আল্লাহর রাসূলে মধ্যে তোমাদের জন্যে অতীব উত্তম আদর্শ রয়েছে, এতে কোনই সন্দেহ নেই।’’ (আয়াত ২১)
সূরা ক্বালামে বলা হয়েছেঃ
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
‘‘নিশ্চয়ই তুমি চরিত্রের অতীব উচ্চ মানে অভিষিক্ত।’’ (আয়াত ৪)
স্বয়ং রাসূলে করীম সা. ও ইরশাদ করেছেনঃ
‘‘অতীব সুন্দর ও নির্মল চরিত্রকে পূর্ণ পরিণত করার উদ্দেশ্যেই আমি প্রেরিত হয়েছি।’’
তিনি আরো বলেনঃ
‘‘উত্তম গুণাবলীকে পূর্ণত্ব দানের উদ্দেশ্যেই আমাকে পাঠানো হয়েছে।’’
রাসূলে করীম সা.-এর এই সব উক্তি থেকে স্পষ্টতঃ প্রমাণিত হয় যে, চরিত্রেরই অপর নাম হচ্ছে ইসলাম আর দ্বীন-ইসলামের সমগ্র বিষয়ই হচ্ছে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীর উৎস।
এ পর্যায়ে রাসূলে করীম সা.-এর আরও কয়েকটি বাণী উদ্ধৃত করা হচ্ছেঃ
১. তোমাদের মাঝে ঈমানের বিচারে পূর্ণ মুমিন সে, চরিত্রের বিচারে তোমাদের মাঝে যে উত্তম ব্যক্তি।
২. তোমাদের মাঝে সৎ সেই ব্যক্তি, যে চরিত্রের দিক দিয়ে তোমাদের সকলের তুলনায় ভাল।
৩. কিয়ামতের দিন মুমিন বান্দাহর পাল্লায় উত্তম ও ভাল চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী জিনিস আর কিছু হবে না।
৪. জান্নাতের উচ্চ পর্যায়ে একখানি ঘর তাকে দেয়ার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করেছি, যে নিজের চরিত্রকে উত্তম ও নিষ্কলুষ বানাবে।
৫. কিয়ামতের দিন তোমাদের মাঝে আমার প্রিয়তর ও নিকটতর হবে সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মাঝে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে। আর আমার অপসন্দনীয় ও কিয়ামতের দিন আমার থেকে দূরবতীয় হবে সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মাঝে খারাপ চরিত্রের অধিকারী।
৬. একবার নবী করীম সা.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলঃ জান্নাতে কোন্ জিনিসটি সবচেয়ে বেশী প্রবেশ করবে? জবাবে নবী করীম সা. বললেনঃ তাকওয়া ও উত্তম চরিত্র।
৭. আমানত রক্ষাকারী ও সত্যনিষ্ঠ মুসলমান কিয়ামতের দিন শহীদদের সঙ্গী হবে।
৮. মানুষ উত্তম চরিত্রগুণে এমন মর্যাদা লাভ করতে পারে যা সারাদিন রোযা রেখে ও সারা রাত ইবাদত করেই লাভ করতে পারে।
৯. উত্তম চরিত্রেরই অপর নাম হচ্ছে দ্বীন।
১০. শুভ চরিত্র ইবাদতের অপূর্ণতা ও অপর্যাপ্ততার ক্ষতিপূরণ করে। কিন্তু চারিত্রিক দুর্বলতার ক্ষতি ইবাদত দ্বারা পূরণ হয় না। মানুষ তার শুভ চরিত্রের বলে জান্নাতের উচ্চতর ও উন্নততম মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারে যদিও সে একজন ‘আবেদ’ নামে পরিচিত হয় না। আর নিজের চরিত্রহীনতার কারণে দোজখের সর্বনিম্ন অংশে পৌঁছে যায়, যদিও সে একজন ইবাদতকারী ব্যক্তি রূপে পরিচিত।
১১. প্রতিটি জিনিসেরই একটা ভিত্তি থাকে আর ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে শুভ চরিত্র। [ইবনে আব্বাস রা.]
১২. লোকদের সাথে ভাল চরিত্র নিয়ে মেলামেশা কর এবং (খারাপ) কাজের দরুনই তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হও। [হযরত উমার রা.]
১৩. চরিত্রের বিশালতা ও উদারতায়ই নিহিত রয়েছে জীবিকার সম্ভার।
১৪. চারটি জিনিস মানুষকে উচ্চতর মর্যাদায় পৌঁছে দেয়-যদিও তার আমল ও জ্ঞান-বিদ্যা কম আর তা হলঃ ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, বিনয়, দানশীলতা ও শুভ চরিত্র। (হযরত জুনাইদ বাগদাদী)
১৫. চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য মানুষের স্বভাবগত গুণাবলীকে পূর্ণমাত্রায় উৎকর্ষ দান করে, লোকদের অন্তরে মমতা ও ভালবাসার বীজ বপন করে এবং আল্লাহ তা’আলার নিকটতর করে দেয়। (ইমাম গাজ্জালী)
চরিত্র ও ঈমান
মুসলমান হওয়ার প্রথম ও মৌল শর্ত হল ঈমান। কিন্তু ঈমান মন-মানস ও হৃদয়-মনের একটা বিশেষ অবস্থা ও ভাবধারা এবং প্রচ্ছন্ন অন্তর্নিহিত ব্যাপার। আল্লাহ্ ছাড়া তার অস্তিত্ব ও অবস্থা সম্পর্কে কেউই অবহিত হতে পারেনা। এই কারণে আল্লাহ তা’আলা সৎ ও নিষ্কলঙ্ক চরিত্রকে মুমিনের ঈমানের মানদণ্ড রূপে নির্ধারিত করেছেন। ইমাম গাজ্জালীর মতে ইসলামের ঈমানের সাথে চরিত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও নিবিড়। মানব-মনে হীন, নীচ ও অসৎ ভাবধারা লালিত-পালিত হয় বিধায় তার ক্ষতি ও অনিষ্ঠকারিতা প্রবৃদ্ধি লাভ করে। ফলে এমন একটা অবস্থা দেখা দেয়, যখন মানুষ দ্বীনকেই পরিত্যাগ করে বসে। তখন সে কার্যত নিজেকে লোকদের মানসে উলঙ্গ করে দেয়। এরূপ অবস্থায় তার ঈমানের দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সূরা ‘আল-মুমিনূন’-এ ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রকে ঈমানদার লোকদের জরুরী গুণপনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ দুটির ওপরই মানুষষের সার্বিক কল্যাণ ও সাফল্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ – الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ – إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ – فَمَنِ ابْتَغَىٰ وَرَاءَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ –
‘‘এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, সেসব মুমিনরাই প্রকৃত সাফল্য লাভ করেছে যারা নিজেদের নামাযে ভীত-সন্ত্রস্ত অন্তরে দণ্ডায়মান হয়, যারা অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন কাজকর্ম থেকে বিরত থাকে, যারা নিরন্তর নিজেদের পবিত্র ও পরিচ্ছন্নকরণ প্রচেষ্টায় নিরত থাকে, যারা নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহকে (হারাম ব্যবহার থেকে) রক্ষা করে, যারা আমানতসমূহ ও ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি সংরক্ষণ করে আর যারা নিজেদের নামাযসমূহকে সংরক্ষণ করতে থাকে…..।’’ (সূরা মুমিনূনঃ ১–৯)
স্বয়ং নবী করীম সা. বহু সংখ্যক হাদীসে বহু সংখ্যক গুণ-বৈশিষ্ট্যকে ঈমানদার লোকদের অপরিহার্য বিশেষত্ব রূপে গণ্য করেছেন। সেসব গুণ-বৈশিষ্ট্যে যতটা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে, ঈমানের অবস্থায়ই সেই অনুপাতে তারতম্য ঘটবে। তার অর্থ এই যে, আমাদের বাহ্যিক চরিত্র ও আচার-আচরণ আমাদের অন্তর্নিহিত ঈমানী অবস্থার মাপকাঠি বা পরিমাপ যন্ত্র। কোন লোকের ঈমানী অবস্থা বাস্তবিকপক্ষে কি তা এর দ্বারাই প্রমাণিত হয়। নবী করীম সা. ইরশাদ করেছেনঃ
১. ঈমানের সত্তরটির অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তার একটি হচ্ছে লজ্জা।
২. ঈমানের বহু শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তওহীদের ঘোষণা আর সবচাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লোক চলাচলের পথ থেকে পীড়াদায়ক জিনিসের অপসারণ।
৩. তিনটি কথা ঈমানের অংশ। দরিদ্রাবস্থায়ও আল্লাহর পথে ব্যয় করা, দুনিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তার প্রসারতা বিধান এবং স্বয়ং নিজের বিরুদ্ধেও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা।
৪. মুসলমান সে, যার হাত ও মুখ থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকবে আর মুমিন সে যার ওপর এতটা বিশ্বাস ও আস্থা হবে যে তার নিকট নিজের জান ও মালও আমানতরূপে অক্ষুণ্ন থাকবে।
৫. মুমিন সে, যে অন্যকে ভালবাসে। যে লোক অন্যকে ভালবাসেনা এবং তাকেও কেউ ভালবাসে না তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।
৬. মুমিন কারোর ওপর অভিসম্পাত করেনা, কাউকে বদদো’আ দেয় না, কাউকে গালাগাল করেনা এবং কারোর সাথে মুখ খারাপও করেনা।
৭. মুমিন সে, যাকে লোকেরা বিশ্বস্ত ও বিশ্বাসভাজন মনে করবে। মুসলিম সে যার মুখ ও হাত থেকে লোকেরা নিরাপদ থাকবে।
৮. তিনটি জিনিস দ্বারাই বেঈমান ও মুনাফিকের পরিচিতি পাওয়া যা। তাহল, যখন কথা বলবে মিথ্যা বলবে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করবে এবং তার কাছে আমানত রাখা হলে সে তা বিনষ্ট করবে।
৯. নিকৃষ্টতম ব্যক্তি সে যাকে লোকেরা তার খারাপ মুখের দরুণ পরিত্যাগ করেছে।
১০. মানুষকে যা কিছুই দেয়া হয়েছে, তাতে উত্তম জিনিস হয় সৎ বা শুভ চরিত্র।
১১. ইসলামে অশ্লীল কথাবার্তা বলার কোন স্থান নেই। উত্তম মুসলমান সে, যে চরত্রের দিক দিয়ে অতীব উচ্চ মর্যাদাবান।
চরিত্র ও আল্লাহ প্রেম
ভালবাসা মানুষের প্রতি আল্লাহ তা’আলার একটি মূল্যবান অবদান। বিশেষ করে আল্লাহর ভালবাসা একটি অতিবড় সম্পদ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই মহামূল্য সম্পদ অর্জনের উপায় কি?
যে সব উপায়ে এই মহামূল্য সম্পদ লাভ করা যেতে পারে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হল শুভ চরিত্র। আর যেসব কারণে এই মহামূল্য সম্পদ অপহৃত হয় তন্মধ্যে চরিত্রহীনতা ও অসদাচরণ অন্যতম।
কুরআনের দৃষ্টিতে নিম্নোদ্দৃত নৈতিক গুণাবলীর মাধ্যমে আল্লাহর প্রেম ও ভালবাসা অর্জিত হতে পারেঃ
১. দয়া ও অনুগ্রহ। বলা হয়েছেঃ
‘‘দয়া-অনুগ্রহকারীদেরকে আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন।’’
২. সুবিচার ও ন্যায়পরতাঃ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচার ও ইনসাফকারী লোকদেরকে ভালবাসেন।’’
৩. নৈতিক ও দৈহিক পবিত্রতা বা নিষ্কলুষতাঃ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্রতা রক্ষাকারী ও পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনকারী লোকদেরকে ভালবাসেন।’’
নিম্নোদ্ধৃত বিষয়গুলো আল্লাহর ভালবাসা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করেঃ
১. আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘনঃ
‘‘আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।’’
২. বিশ্বাসঘাতকতা ও আমানতে খিয়ানত করাঃ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ খিয়ানতকারীদেরকে ভালবাসেন না।’’
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা এমন ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে বেশী খিয়ানতকারী ও পাপিষ্ঠ।
৩. বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টি করাঃ
‘‘অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন না।’’
৪. উচ্ছৃংখলতা, অপব্যয় ও বাড়াবাড়ি করাঃ
‘‘আল্লাহ বাড়াবাড়ি, উচ্ছৃংখলতা ও অপব্যয়কারীদেরকে পসন্দ করেন না।’’
৫. অহংকার ও আত্মম্ভরিতাঃ
‘‘কোন অহংকারী ও দাম্ভিক লোককে আল্লাহ ভালবাসেন না।
আল্লাহর গুণাবলী ও চরিত্র
বস্তুত ইসলাম উত্তম ও শুভ চরিত্রের একটি অতীব উন্নত মান ও চিন্তা-চেতনা উপস্থাপন করেছে আর তাহল উত্তম শুভ চরিত্র। এটি মূলত খোদায়ী গুণাবলীর ছায়া এবং তারই সামান্য প্রতিফলন মাত্র। রাসূলে করীম সা. বলেছেনঃ
‘‘শুভ চরিত্র আসলে আল্লাহ তা’আলার মহান ও সুউচ্চ চরিত্রেরই প্রতিফলন মাত্র।’’
আমাদের দৃষ্টিতে উত্তম চরিত্র তা-ই যা আল্লাহর মহান গুণাবলীর প্রতিবিম্ব আর খারাপ চরিত্র বলতে আমরা বুঝি সেই সবকে, যা আল্লাহর গুণাবলীর পরিপন্থী। ইসলাম মানুষের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ও উৎকর্ষ লাভের উপায় রূপে নির্দিষ্ট করেছে চরিত্রকে। তার কারণ হল, চরিত্র খোদায়ী গুণাবলীর জ্যোতিমালা থেকে গৃহীত ও নিঃসৃত। এই গ্রহণ ও অর্জনে আমরা যতটা অগ্রগতি লাভ করব, আমাদের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ততই বেশী নিশ্চিত হবে এবং তার ধারাবাহিকতা থাকবে অব্যাহত।
চরিত্র ও ইবাদত
ইসলামী আদর্শে গুরুত্বের দিক দিয়ে চরিত্রের স্থান যদিও তৃতীয়; কিন্তু তা সত্ত্বেও ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিবেচনা করলে জানতে পারা যাবে যে, ইবাদতসমূহ মূলত মানুষকে আদর্শ চরিত্রবান বানাবারই উপায় মাত্র। মানুষ সত্যনিষ্ঠ, সততাবাদী ও নিষ্কলুষ চরিত্রগুণের অধিকারী হয়ে গড়ে উঠুক, এক মহান নৈতিক গুণাবলী আয়ত্ত ও আত্মস্থ করে মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের যোগ্যতা অর্জন করুক, সেই সঙ্গে নিজের অধিকার ও কর্তব্য যথাযথভাবে আঞ্জাম দিক-ইবাদতসমূহের এই তো পরম ও চরম উদ্দেশ্য আর এরই অপর নাম হল চরিত্র।
বস্তুত মানব-মনের নৈতিক প্রশিক্ষণের একটা কার্যকর মাধ্যম রূপেই ইবাদতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এরই সহায়তায় মানুষ নিজের হৃদয়াবেগ ও কামনা-বাসনা সংযত করতে সক্ষম হতে পারে। আল্লাহকে স্মরণ করা ও তাঁর সামনে মস্তক অবনত করার অর্থ হচ্ছে, আমরা একটি আধ্যাত্মিক লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে মন-মানস ও কামনা-বাসনার স্বাধীনতাকে ত্যাগ করেছি। ইবাদতের সময় এই অনুভূতি না জাগলে এবং নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন, বিমুক্ত ও স্বেচ্ছাচারী মনে করলে ইবাদতের কোন শুভফল অর্জিত হতে পারে না। কেননা ইবাদতের মর্মই হল, মহান আল্লাহই আমাদের একমাত্র মা’বুদ এবং আমরা একান্তভাবে তাঁরই দাসানুদাস। তাই তাঁর মুকাবিলায় আমাদের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই-কিছু থাকতে পারে না। আমাদের কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনাবলী আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক লক্ষ্যানুগ ও তারই অধীন। কুরআনের একটি আয়াতে নামায তরক করা ও লালসা-বাসনার অনুসরণ করার কথা এক সঙ্গে উল্লেখ করে একথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কামনা-বাসনা-লালসার আনুগত্য ও অনুসরণ সম্ভব ও সহজ হয়ে ওঠে ইবাদত ত্যাগ করলে। ইবাদত যথাযথ পালন করা হলে তা হতে পারে না।
সাধারণত লোকদের ধারণা হল, ঈমানের পরই নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ এই চারটি স্তম্ভের ওপরই ইসলামের সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মিত। নৈতিক চরিত্রের কোন গুরুত্ব এতে আছে বলে মনে করা হয় না। অথচ আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং নৈতিক চরিত্রের গুরুত্বকে কিছুমাত্র উপেক্ষা করেন নি। তাই যেখানেই কোন ইবাদত ফরয হওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানেই স্বষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, মানুষের উত্তম ও উন্নত চরিত্র গড়ে তোলা ও তার পূর্ণত্ব বিধানই মানুষের চরমতম লক্ষ্য। নামায ফরয হওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তা মানুষকে সর্বপ্রকার অন্যায়, পাপাচার ও নির্লজ্জতা থেকে বিরত রাখে। রোযা ফরয করেই বলে দেয়া হয়েছে, তা মানুষের মধ্যে তাকওয়া বা খোদাভীতির সৃষ্টি করে। যাকাত বিত্তবানদেরকে মহানুভবতা ও সহৃদয়তার শিক্ষা দেয় এবং হজ্জও বিভিন্নভাবে মানুষের নৈতিক সংশোধন ও উৎকর্ষ বিধানের কাজ করে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
নামায সম্পর্কে রাসূলে করীম সা. ইরশাদ করেছেনঃ যার নামায তাকে অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে না, তার নামায তাকে আল্লাহর নিকট থেকে আরও দূরে নিয়ে যায়।
রোযা সম্পর্কে একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ রোযা রেখেও যে লোক মিথ্যা ও প্রতারণা পরিহার করেনি, নিজের পানাহার সে বন্ধ রাখুক- তাতে খোদার কোন প্রয়োজনই নেই।
একটি হাদীসের কথা হল, মুমিন তার উত্তম ও শুভ চরিত্রের বলে (নফল) রোযাদার ও (নফল) নামাযীর মর্যাদা লাভ করতে পারে।
যাকাত ও হজ্জ ফরয হওয়ার বিষয় বিবেচনা করলে বুঝতে পারা যাবে যে, নিজের বংশ ও পরিবার-পরিজনের মৌল অধিকার যথাযথ আদায় না হওয়া পর্যন্ত কারোর ওপর তা ফরযই হয় না। অন্য কথায়, আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাহ্র ওপর নিজের অধিকার ততক্ষণ পর্যন্ত ওয়াজিব করেন না, যতক্ষণ সে বান্দাহ্দের অধিকারসমূহ আদায় না করছে।
আল্লাহর হক্ব ও বান্দাহর হক্ব
ইবাদত ও চরিত্রকে যথাক্রমে আল্লাহর হক্ব ও বান্দাহর হক্ব বলে চিহ্নিত করা যায়। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ, লেনদেন ও আদান-প্রদানেরই অপর নাম চরিত্র। আর ইবাদত হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ফরয রূপে ধার্য কর্তব্য। একটু গভীর ও সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে বুঝতে পারা যাবে যে, চরিত্রের গুরুত্ব ইবাদতের তুলনায়ও অনেক বেশী। শিরক ও কুফর একান্তভাবে আল্লাহর অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপার। এ ছাড়া আল্লাহর অধিকারের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য গুনাহ ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু মানুষের অধিকার অনাদায় থাকলে তা ক্ষমার অযোগ্য। আল্লাহ নিজে তা ক্ষমা করে দেবেন না; তা ক্ষমা করার অধিকার ঠিক সেই মানুষের হাতেই রাখা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর নিকট থেকে যে দয়া-অনুগ্রহ পাওয়ার আশা করা যায়, তাতো আর মানুষের কাছ থেকে পাওয়ার আশা করা যায় না। তাই নবী করীম স. ইরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির ওপর (যে তার ভাই) জুলুম করেছে সেই জালিম (ভাই)-র কর্তব্য হল, এই দুনিয়ায়ই সেই মজলুম ভাইর নিকট থেকে জুলুমের ক্ষমা চেয়ে নেয়া। অন্যথায় কিয়ামতে তার ক্ষতিপূরণ করার জন্যে কারোর নিকট কোন টাকা-পয়সা (দিরহাম ও দীনার) থাকবে না- থাকবে শুধু আমল। জালিমের নেক আমলসমূহ মজলুম পেয়ে যাবে। নেক আমল না থাকলে মজলুমের পাপসমূহ জালিমের আমল-নামায় লিখে দেয়া হবে।
নৈতিক চরিত্র ও আইন
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যেই তাকে বাস করতে হয়। সমাজ ছাড়া মানুষের জীবন অচল। বহু সংখ্যক মানুষ যখন একত্রে জীবন যাপন করে তখন তাদের মধ্যে কোন-না-কোন বিষয়ে মত-বৈষম্য, দ্বন্দ্ব-কলহ ও বিবাদ-বিসম্বাদের সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়-নয় কিছুমাত্র অস্বাভাবিক। এই সমাজে একজনের অধিকার অপরজন কর্তৃক অপহৃত হওয়ার ঘটনা মোটেই বিরল নয়। শক্তিশালী এখানে দুর্বলের ওপর অন্যায় ও বাড়াবাড়ি করতে পারে- পারে তাকে পর্যুদস্ত করবার চেষ্টা করতে। ধনী নির্ধনের ওপর অন্যায় আচরণ ও শোষণ চালাতে পারে। এই সব কিছুর মুকাবিলা করে প্রতিটি ব্যক্তির জীবন, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মানের নিরাপত্তা দিয়ে শান্তি ও শৃংখলাপূর্ণ সমাজ গঠন করা মানুষের সুখী জীবনের জন্য অপরিহার্য। এ জন্যে যে আইন ও বিধান রচিত হয়েছে, তার একটা অংশ নৈতিক এবং তা অনুসরণ করা বা না-করা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল; সেজন্য কাউকে জোরপূর্বক বাধ্য করা যেতে পারে না। অবশ্য এমন কিছু নিয়ম-বিধি রচিত হয়েছে, যা পালন করা প্রত্যেক ব্যক্তিরই কর্তব্য। এই নিয়ম-বিধিকেই পরিভাষায় বলা হয় আইন। এই আইন ও নৈতিকতার মূল লক্ষ্য যদিও এক ও অভিন্ন; কিন্তু তা লাভ করার পথ ভিন্ন ভিন্ন। এককভাবে এর কোনটিই প্রয়োজন পূরণে সক্ষম নয়- সব ক’টি দিককে পরিব্যাপ্ত করতে পারে না। তাই এর একটির অসম্পূর্ণতা অন্যটির দ্বারা পূর্ণত্ব লাভ করে। আইন অন্যায় ও পাপ কাজকে বন্ধ করতে পারে বটে; কিন্তু মানব মনে তার প্রতি ঘৃণা জাগাতে পারে না। ফলে আইনের বাঁধন যখনই শিথিল হবে বা আইন রক্ষাকারীরা চোখের আড়াল হবে, তখনই পাপ ও অন্যায় সংঘটিত হবে; তখন তা ঠেকিয়ে রাখা আর সম্ভব হবে না। কিন্তু নৈতিক চরিত্রের সাহায্যে যে পাপ ও অন্যায় দূর হয়, তা স্থায়িত্ব লাভ করে। তার পুনরাবৃত্তি হয় না বললেই চলে। কেননা চরিত্র ও নৈতিকতা মানবমনে অন্যায় ও পাপের প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা জাগিয়ে দেয়। অর্থাৎ প্রথমটির পাহারাদারী কখনো সার্বক্ষণিক হতে পারে না। সার্বক্ষণিক পাহারাদারী হতে পারে দ্বিতীয়টির; কেননা তা মানুষের অভ্যন্তরে অবস্থিত। সুতরাং তা-ই হতে পারে মানুষের দ্বীন ও ঈমানের অতন্দ্র প্রহরী, প্রতিরোধকারী। উপরন্তু আইন শুধু মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ ও জীবন ধারাকে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের মন-মানস ও চিন্তা-বিশ্বাসের মর্মমূলে তার কোন ছায়াপাত ঘটেনা। কিন্তু চারিত্রিক প্রতিরোধের অবস্থান মানুষের অন্তরে। মানুষের মন-মানস ও হৃদয়-বৃত্তির সাথে তার গভীর ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক; বরং তার উৎসই হচ্ছে এই মন-মানস ও হৃদয়-বৃত্তি। তাই মানুষের হৃদয়-মন যতক্ষণ জাগ্রত ও সচেতন থাকে ততক্ষণ তার দ্বারা পাপ ও অন্যায় কাজ সম্ভব হতে পারে না।
একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়, আইনের তুলনায় নৈতিকতাই অধিক গুরুত্বের অধিকারী। চরিত্র আসলে আইনেরই সংরক্ষক; বরং একথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, আইনের ভিত্তিই হচ্ছে চরিত্র। একটি জাতির ও একটি সমাজের নৈতিক অবস্থারই দর্পন হচ্ছে আইন। যে জাতির চরিত্র উত্তম, তার আইন-কানুনও নমনীয়। আর জাতীয় চরিত্র যদি হয় খারাপ, তাহলে তার জন্যে কঠোর আইন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। জনগণ যতি স্বতঃই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তৎপর হয়, তাহলে রাষ্ট্র-সরকারকে কঠোর উৎপীড়কের আইন রচনা করতে কখনো বাধ্য হতে হবে না।
ইসলাম মানব প্রকৃতি ও মানবীয় মনস্তত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে চরিত্র ও আইন উভয়কেই প্রয়োগ করেছে। যে সব অন্যায় ও পাপের প্রতিক্রিয়া অন্যদের প্রভাবিত করে কিংবা বলা যায়, যে সব অন্যায় ও পাপ সমগ্র সমাজ ও জাতির সাথে সংশ্লিষ্ট তাকে আইনের অধীন নিয়ে নেয়া হয়েছে। হত্যা, চুরি, ডাকাতি ও অন্যায় কাজের দোষারোপ প্রভৃতি এই পর্যায়ে গণ্য। আর যে সব বিষয় ও ব্যাপারে ব্যক্তির আত্মার সাথে সম্পর্কিত- যেমন মিথ্যা না বলা, দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শন, গরীবদের সাহায্য প্রভৃতি- এগুলোকে নৈতিক চরিত্রের ব্যাপার বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আমরা অতি সহজেই বলতে পারি যে, দ্বীন-ইসলাম তথা হযরত মুহাম্মাদ সা. প্রবর্তিত শরী’আত হচ্ছে আইন ও নৈতিক চরিত্রের সমন্বয়।
ইসলাম নৈতিকতাকে প্রতিটি ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়েছে- যদিও তার একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে-আর আইনকে অর্পন করেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের হাতে। আইনের ভিত্তির ওপর সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। তাকে সরিয়ে দিলে রাষ্ট্র-সংস্থা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য। তখন কারও জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু সংরক্ষিত থাকবেনা বরং থাকার সম্ভবনাই শেষ হয়ে যাবে। তাই সংস্কৃতির দোহাই পেড়ে বা সংস্কৃতির নামে চরিত্র বিনষ্টকারী কোন অনুষ্ঠানকেই বরদাশত করা যেতে পারেনা। ইসলামের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি মানব চরিত্রকে উন্নত ও নির্মল করবে। পক্ষান্তরে যে সংস্কৃতিই মানব চরিত্রকে বরবাদ করে তা-সংস্কৃতি নয়- দুষ্কৃতি মাত্র।
বিমূর্ত শিল্প ও জাতীয় চরিত্র
বর্তমান দুনিয়ায় এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট (Abstract art) বা বিমূর্ত শিল্পের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রচলন লক্ষণীয়। বিশ্বের পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এই শিল্পের ব্যাপক প্রসারের লক্ষ্যে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দিক থেকে এ ব্যাপারে একটি প্রশ্ন প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তা হচ্ছে, এই এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট কি বাস্তবিকই আমাদের জনগণের রুচিসম্মত, আমাদের দ্বীনী আকিদা-বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? তা কি বাস্তবিকই এখানকার জনগণের শিল্প? অথবা তা মূলত বাইরের জিনিস, আমাদের জনগণের ওপর তা বিশেষ উদ্দেশ্যে ও পরিকল্পিতভাবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং একটি মারাত্মক ধরণের ষড়যন্ত্র হিসেবেই এটিকে আমাদের সমাজে প্রচলিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে?
পরন্তু, তা যদি বিদেশ ও ভিন্নতর সমাজ থেকে নিয়ে এসে আমাদের সমাজে চালু করার একটা অপচেষ্টা বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে কারা- কোন্ শ্রেণীর ও কোন্ মতাদর্শের লোকেরা তা করছে? এই বিষয়গুলো একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট অনুধাবনের জন্যে অবশ্য ওয়াসিলি কাণ্ডিনিস্কির সময়ে অধ্যয়ন আবশ্যক। কেননা এই কাণ্ডিনিস্কিই আমেরিকায় আর্টের এই নবতর আন্দোলনকে সুপরিচিতি ও সুসংগঠিত করেছেন। নিউিইয়র্কে তিনিই একটি আর্ট মিউজিয়াম স্থাপন করেছেন, যার নাম হচ্ছে ‘দি মিউজিয়াম অফ মডার্ণ আর্ট’। যারা মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতি (Psycho-politics)-এর ইতিহাসে অভিজ্ঞ, তারা ভালো করেই জানেন যে, এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর এই আন্দোলন সর্বপ্রথম রাশিয়ায় ‘অক্টোবর বিপ্লবের’ পর শুরু হয়েছিল। যান্ত্রিক মানুষের স্রষ্টা এ, কে, গুস্তাফ এবং তার অনুসারীরা এক ধরণের এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট উদ্ভাবন করেছিলেন, যাকে বলা হয় ‘কন্স্ট্রাকটিভ সিমবলিক রিপ্রেজেন্টেশনাল আর্ট’ বা গঠনমূলক প্রতীকধর্মী প্রতিনিধিত্বশীল শিল্প। এ শিল্পকলা সম্পর্কে যাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে, তিনি সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, আজকের এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট মূলত রাশিয়ার প্রাথমিক বিপ্লবকালীন সময়ের আর্টের ফসল হিসেবেই অস্তিত্বলাভ করেছে। এ আর্টের মূলে যে তত্ত্ব নিহিত তা হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক সিস্টেমের অভিন্নতা ও সংহতি চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্যে তাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সংহতি বিরোধী ভাবধারা ও উপকরণাদি প্রবিষ্ট করিয়ে দিতে হবে। এই তথাকথিত গঠনমূলক নীতির অনুসারী আর্টের লক্ষ্যই হচ্ছে প্রাচীন ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মূল্যমান ও সাংস্কৃতিক জীবনে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করা।
রুশ বিপ্লবের প্রাথমিক কালে বলশেভিকবাদের দর্শন কয়েকটি দিক দিয়ে ব্যাপক হয়ে উঠেছিল- যেমন মেকানিক, কাব্য ও সঙ্গীত, যান্ত্রিক থিয়েটার, যান্ত্রিক প্রতিমূর্তি নির্মাণ এবং সবশেষে যান্ত্রিক মানুষ। আর্টের এই বিভিন্ন মাধ্যমের (Media) লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহে বিপর্যয় সৃষ্টি করা। কান্ডিনিস্কী ‘আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থা’র সদস্য ছিলেন। এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টকে জনপ্রিয় করে তোলার দায়িত্ব দিয়ে তাকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। কান্ডিনিস্কী নিউইয়র্ক শহরে আধুনিক শিল্পের যাদুঘর ‘মিউজিয়াম অফ মডার্ণ আর্ট’ স্থাপন করতে সাফল্য অর্জন করেন। এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর সৌভাগ্যই বলতে হবে, হিটলার এই শিল্পের শিল্পীদেরকে এই সময় জার্মানী থেকে বহিষ্কৃত করেছিলেন। এ বহিষ্কৃত শিল্পীরাই আমেরিকায় গিয়ে বসবাস গ্রহণ করলেন। ফলে আমেরিকা এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর লীলাভূমিতে পরিণত হয়ে গেল। এভাবে এ আর্টের সাহায্যে আমেরিকান জনগণের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় (Personality Fragmentation) সৃষ্টির বীজ বপনে সাফল্য লাভ করার পর স্বয়ং রাশিয়া এক্ষণে বাস্তববাদী শিল্পে (Realistic art) প্রত্যাবর্তন করেছে।
পূর্বেই বলেছি, এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের ভাঙন ও বিপর্যস্তকরণ। যে সব উপায়ে এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট গড়ে ওঠে, তা হচ্ছে বিশ্লিষ্টতা ও আকৃতিসমূহের বিকৃতি (Distortion), চিন্তার বিশৃঙ্খলা, নির্বীর্যতা। আর মূলত পরাজিত আত্মা ও ব্যর্থকাম মন-মানসিকতার অনিবার্য পরিণতিই হচ্ছে এই চৈন্তিক অরাজকতা। এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর পক্ষে যেসব সাহিত্যিক লেখনী চালনা করেছেন, তারাও এই চৈন্তিক উচ্ছৃঙ্খলতা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতায় চরমভাবে আক্রান্ত। তাঁরা তাদের রচনাবলীতে এই বিপর্যয় ও বিশ্লিষ্টতাময় শব্দাবলী বাছাই (Fragmental Fregiology) ও ব্যবহার করে পাঠকদের মনে-মগজেও অনুরূপ বিপর্যয় বিশ্লিষ্টতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর একজন পূজারী জনৈক এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টিস্ট সম্পর্কে লিখেছেনঃ যে জিনিসটির ঝুলন্ত বা সাঁতার কাটা অবস্থায় থাকা আবশ্যক, তাকে কাঁচা হাতে ও কঠোরতার সাথে অবিকল রূপ দান করা এই এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টিস্ট রীতিমত ঘৃণা করে। জিনিসগুলিকে তার আসল স্বাভাবিক রূপে উপস্থাপনকে সে অর্থহীনভাবে প্রত্যাখান করেছে। এই সত্য অনুধাবনে অক্ষম হওয়ার কারণে বেশ কিছু লোক পলায়নী আচরণ অবলম্বন করেছে। এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর তত্ত্ব সম্পর্কে অনবহিত ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় ঘৃণার। সে বড়জোর এই প্রতিক্রিয়াকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে; কিন্তু রুচিহীনতা যা বিকৃতরুচি লুকোতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থকাম হয়। নগরস্থ প্রখ্যাত ড্রয়িং-রুমসমূহের সাজ-সজ্জা-সামগ্রী পর্যায়ে এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর উল্লেখ হলেই কোন কোন লোক ঘৃণায় নাক সিঁটকাতে শুরু করে এবং তাদের বিশ্বাসঘাতক ওষ্ঠে একটি কৃত্রিম বক্র হাসি খেলে যায়। কেউ কেউ আবার প্রথম শ্রেণীর নির্বোধ লোকদের ন্যায় পূর্ণমাত্রার আস্থা সহকারে কথা বলে।
এটা এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট ভক্তদের চিন্তার বৈসাদৃশ্য ও বিশ্লিষ্টতার একটা ক্ষুদ্র নিদর্শন মাত্র।
একটা বিপর্যস্ত ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমন সব জনসংস্থা গড়ে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক-অনেক সময় তা অপ্রাসঙ্গিকও হয়ে থাকে। কিছু লোক মানসিক পূর্ণতা ও সামাজিক পরিপক্কতা লাভ করতে পারে না, এমনটা হয়ে থাকে। তার প্রমাণ হচ্ছে, যেসব লোকের কারণে তারা ক্ষুদ্রত্বের অনুভূতি বা হীনমন্যতা রোগে (Inferiority Complex) ভোগে তাদের প্রতি বিদ্রুপবান নিক্ষেপ করার একটা প্রবণতা তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। লোকদের যখন দেখা যায়, বাইরের লোকদের সাফল্যের প্রশংসা করছে, কিন্তু নিজেদের সমাজের লোকদের স্মরণযোগ্য অবদানের মূল্যও স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত হচ্ছে, তখন মনে দুঃখানুভূতি জেগে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই।
একটি জাতি বা জনসমষ্টিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করার অনেকগুলো পন্থা থাকতে পারে। অনুরূপভাবে মানবীয় মান ও মগজকে দাসত্বের নিগঢ়ে বন্দী করার পন্থাও হতে পারে বহুবিধ। তবে মানব-মনকে পরাভূত করার আধুনিকতম পন্থা হচ্ছে, তাদের সম্মুখে এমন সব নিদর্শন পেশ করতে এবং তাদের চতুঃষ্পার্শ্বে এমন পরিবেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে, যার ফলে তারা বন্দী থেকেই নিয়ম-শৃঙ্খলা পালনের গৌরব বোধ করতে পারে। বিগত শতাব্দীতে দেশবিজয়ী জাতিগুলো তাদের বিজিত জনগোষ্ঠীর ওপর যে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও পাশবিকতা চালিয়েছে এ পন্থায় অবশ্য সে সবের আশ্রয় নেয়ার কোন প্রয়োজন দেখা দেয় না; বরং বর্তমান কালের বিজয়ীরা বিজিতদের সম্মুখে অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন ও দুর্বোধ্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের নিদর্শন পেশ করা ও তাতে তাদের মুগ্ধবিমোহিত করে তুলতে পারাকেই যথেষ্ট মনে করে। বস্তুত কোন একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীকে নৈরাশ্য ও হতাশাগ্রস্থ করে দেয়ার জন্যে অর্থহীন ও লক্ষ্যহীন ক্রিয়াকাণ্ডে মশগুল করে দেয়া একটা অত্যন্ত শানিত ও কার্যকর হাতিয়ার। অস্পষ্টতা ও লক্ষ্যহীনতাই এই কাজকে সার্থক ও সচল করে দিতে পারে। একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীকে মানসিক অধঃপতনের নিম্নতম স্তরে পৌঁছে দেয়ার জন্যে রাজনৈতিক মনস্তত্ব বিশারদরা যে ক’টি সাংস্কৃতিক উপায়-উপাদান প্রয়োগ করে থাকে ‘এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট’ তন্মধ্যে অন্যতম।
বঞ্চনার অনুভূতির তীব্রতা অনেক সময় ব্যক্তিত্বের বিশ্লিষ্টতায় প্রকট হয়ে ওঠে। অনুভূতির এ তীব্রতা অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতা ও উদ্দেশ্যহীনতাকে খুঁজে নেয় আর এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর ভক্তদের সুস্পষ্ট বিশেষত্ব এটাই। এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট মানবীয় আচরণের এমন পন্থা ও বঞ্চনানুভূতি ও বিশ্লিষ্টতার এমন সব নিদর্শন উপস্থাপন করে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত হৃদয়াবেগ ও উচ্ছ্বাস সব সুস্থতা ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর লক্ষ্য কি? শিল্পী তার মাধ্যমে কি পয়গাম তুলে ধরে দর্শকদের নিকট? প্রভাব বিস্তারকারী শিল্পী (Impressionist) নানা রঙের ওপর আলোর বিচ্ছুরণ দেখায়। প্রকাশপন্থী (Expressionist) চেষ্টা চালায় বস্তু নিচয়ে অন্তর্নিহিত সত্যকে যতটা সম্ভব ব্যক্ত করে দিতে। আর ইঙ্গিতধর্মী চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির অনুসারী (কিউবিস্ট) বস্তুসমূহে জ্যামিতিক মৌল রূপরেখার সন্ধান করে-মহাজাগতিক (সিওরিলিস্ট) অবচেতনকে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়। একজন সমালোচক তে বলেই ফেলেছেন যে, এ্যাবস্ট্রাক্ট রেখাসমূহ আসলে অত্যন্ত পবিত্র এবং খোদায়ী গুণাবলীকে অধিকতর পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রকাশ করে। কেননা তা বস্তুগত খোলস, দেহের ভার ও মুখাবয়বের স্পষ্টতা ছাড়াই অস্তিত্ববান হয়েছে। আর বস্তুগুলোকে পূর্ণাঙ্গরূপে অভিব্যক্তি না করেই সে সবের অন্তর্নিহিত ও অর্ধোস্ফূট কলিসমূহের দ্বারা বিশ্বপ্রাণ পর্যন্ত পৌঁছাবার চেষ্টায় পরিণতি হচ্ছে সেই আর্ট, যাকে আমরা অদ্বৈতবাদী দৃষ্টিকোণে ধর্মীয় বলতে পারে।
ইসলামী দৃষ্টিকোণে আর্ট
ইসলামের দৃষ্টিতে আর্টের লক্ষ্য বুঝবার জন্যে দেখতে হবে তার নিকট জীবনের লক্ষ্য কি? কুরআনের দৃষ্টিতে মানবজীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা বিধান, যা সৃষ্টিধর্মী পথে মানবতার জন্যে কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। ব্যক্তিত্বের পূর্ণত্ব বিধানের একটি দিক হচ্ছে, সে লক্ষ্যে মানবীয় আবেগ-উচ্ছ্বাসকে সৃষ্টিধর্মী কার্যাবলীতে নিয়োগ করা।
বস্তুত সৃষ্টিধর্মী ও সৃজনশীল গুণাবলী বা যোগ্যতাসমূহ মানুষের জন্যে মহান আল্লাহর এক বিরাট নিয়ামত। আসলে তা মানুষের ক্ষেত্রে আল্লাহর ছায়া বিশেষ। সৃষ্টিধর্মী কার্যাবলী চিরস্থায়িত্বের ধারক। আর প্রতিটি সৃষ্টিধর্মী কাজ মানবীয় ব্যক্তিত্ব নির্মাণ ও পুনর্গঠনের মৌল উপকরণ বিশেষ।
মানুষের স্বভাবগত সৃজনশীলতার গুণ স্বতঃই প্রমাণ করে যে, মানুষ অন্যান্য মানুষের জন্যে সহমর্মিতার প্রবল ভাবধারার অধিকারী-একটা সুস্পষ্ট ধারণা ও কল্পনার মালিক। বিপন্ন মানবতাকে উদ্ধার করা ও তার শান্তি ও স্থিতির ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য মানুষকে কল্যাণময় জ্ঞানের আলো দ্বারা সমুদ্ভাসিত করাই তার নিরন্তর চেষ্টা ও সাধনা। এখানে ‘কল্যাণময় জ্ঞান’ এর কথাটি সচেতনভাবেই বলা হয়েছে; কেননা নবী করীম সা. দো’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমাকে ‘অকল্যাণকর জ্ঞান’ থেকে রক্ষা করো। আর ‘অকল্যাণকর জ্ঞান’ হচ্ছে তা-ই যা মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ বা ক্ষতি সাধন করে।
মানব প্রকৃতিতে নিহিত সৃষ্টিধর্মী গুণাবলী হারিয়ে ফেললে তার অর্থ এই দাঁড়াবে যে, মানুষ স্বার্থপরতা ও প্রতিহিংসার ধারক হয়ে বসেছে; ফলে কোন মানুষই অপর মানুষের একবিন্দু কল্যাণ সাধনেও কিছুমাত্র সক্ষম হবে না। অথচ মানবতার কল্যাণ সাধনই হচ্ছে এমন একটা লক্ষ্য যা মানব মনে সুখানুভূতি লাভের বিশেষ সহায়ক। তাছাড়া অন্যান্য লক্ষ্যসমূহ মানুষকে ব্যর্থতা ও বঞ্চনার দিকে পরিচালিত করে।
জীবন-লক্ষ্য সম্পর্কিত এই বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অগ্রগতি ও উৎকর্ষ সাধনে সহায়তা দানকেই শিল্পের লক্ষ্য রূপে নির্ধারিত করেছে ইসলাম। অতীব উত্তম মানের রূপরেখা তৈরী করে কলাশিল্প শিল্পব্যবসায়ের অনেক উৎকর্ষ সাধন করেতে পারে এবং দেশের জনকল্যাণমূলক শিল্পায়নে বিরাট অবদান রাখতেও সক্ষম। নির্মাণশিল্প, বস্তশিল্প, মৎস্যশিল্প, ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র শৈল্পিক উপকরণ, শিল্পসম্মত উপায়ে কাঁচা মাল থেকে নানা দ্রব্য উৎপাদন, কাপড়ের চিত্তাকর্ষক, উন্নত ও সূক্ষ্ণ শিল্প-নৈপুণ্য বিশিষ্ট রূপরেখা তৈরী করা- এই সব কাজ ভাষা বা শব্দের পরিবর্তে রেখাঙ্কনের সাহায্যে অতি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। [এ পর্যায়ে চারুকলার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। অধুনা আমাদের দেশে এই শিল্প–মাধ্যমটির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। এক দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিয়োজিত না করে ব্যবহার করা হচ্ছে পৌত্তলিক সংস্কৃতির চর্চা ও অনুশীলনে। ফলে এর পিছনে জাতীয় মেধা ও অর্থের ব্যবহার একটি বিরাট অপচয় রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। –সম্পাদক]
বস্তুত শিল্পের লক্ষ্য হচ্ছে বাহ্যিক ও বাস্তব শিক্ষাদান। রৈখিক অভিব্যক্তির যতগুলো উপায় রয়েছে, তা সবই অন্তর্নিহিত ব্যথা-বেদনা ও অনুভূতিরই প্রকাশ মাধ্যম। আর এ সবই শিল্পের আওতামুক্ত। তা চেতনা, মেধা-প্রতিভা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তির কার্যকরতার ওপর নির্ভরশীল। এ শিক্ষাকে বাদ দিলে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভারসাম্যহীন ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার আশংকা প্রবল। সৌভাগ্যবশত এই মর্মান্তিক পরিণতি থেকে বেঁচে গেলেও চিন্তা ও কর্মের বিচারে অপরিপক্ক ও অপরিণত থেকে যাওয়া অবধারিত। ফলে একটা যান্ত্রিক জীবন প্রণালীর নির্বিকার অধীনতা ও দাসত্ব করে যাওয়া তার সারা জীবনের ভাগ্যলিপি হয়ে পড়া কিছুমাত্র অসম্ভব নয়।
শিল্প একটা আত্মিক সত্য; আত্মার সাথে তার সম্পর্ক নিবিড়, গভীর। তা ধর্মবিশ্বাসের রক্তে সিক্ত মানবতাকে সেই সব যান্ত্রিক বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে, যা আমাদের বর্তমান জীবনকে দুঃখজনকভাবে বেঁধে রেখেছে। শিল্প মানবাত্মার মুক্তির নিয়ামত হতে পারে যদি তাকে ইসলাম নির্ধারিত জীবন-লক্ষ্যের অনুকূলে প্রয়োগ করা হয়। আর তাহলেই এ শিল্প একটি কল্যাণকর মাধ্যম হতে পারে- পরিগণিত হতে পারে জনগণের শিল্পে। অন্যথায় তা-ই আবার মানব আত্মাকে নতুন করে দাসত্বের নিগড়ে বাঁধতে পারে, যা থেকে মুক্তি লাভ চিরকালই অসম্ভব থেকে যাবে।
যাকিছু বাইরের তা-ই পরিত্যাজ্য বা অগ্রহণযোগ্য, এই মনোভাব ছাড়াও একটি বিশেষ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তির মনের প্রশ্ন হচ্ছে, বাইরে থেকে যা আমদানী করা হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে তা আমাদের সমাজ-মানসের অনুকূল বা কল্যাণকর কিনা? বস্তুত শিল্প বাইরে থেকে আমদানী করা হোক কিংবা ঘরেই নির্মিত হোক, তা যদি আমাদের সুস্থ মানসিকতায় বিকৃতির বাহন হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে অত্যাধুনিকতার দোহাই পেড়ে তার প্রচলন করার অধিকার কারোরই থাকতে পারেনা। উদারতার নামে উদরে নিশ্চয়ই পচা আবর্জনা ভর্তি করা কোন বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবেনা।
— সমাপ্ত —