তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
শিরোনামে ‘ভূমিকা শব্দটি দেখে কুরআন মজীদের ভূমিকা লিখতে বসে গেছি বলে ভুল ধারণা করার কোন কারণ নেই। এটা কুরআনের নয় বরং তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা। দু’টি উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমি এ ভূমিকা লেখায় হাত দিয়েছি।
একঃ কুরআন অধ্যয়নের আগে একজন সাধারন পাঠককে এমন কিছু কথা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে যেগুলো শুরুতেই জেনে নিলে তার পক্ষে কুরআনের বক্তব্য অনুধাবন করা সহজ হয়ে যায়। নয়তো কুরআন অধ্যয়নের মাঝখানে বারবার একথাগুলো তার মনে সন্দেহ সঞ্চার করতে পারে। অনেক সময় শুধুমাত্র এগুলো না বুঝার কারণে মানুষ কুরআনের অন্তর্নিহিত অর্থের কেবলমাত্র উপরিভাগে আসতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। ভেতরে প্রবেশ করার আর কোন পথই খুঁজে পায় না।
দুই: কুরআন বুঝার চেষ্টা করার সময় মানুষের মনে যে প্রশ্নগুলো উদয় হয় সর্বপ্রথম সেগুলোর জবাব দেবো যে গুলোর প্রথম প্রথম আমার মনে জেগেছিল অথবা পরে আমার সামনে আসে।
কুরআন পাঠকের সংকট
সাধারণত আমরা যেসব বই পড়ে থাকি তাতে থাকে একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু। একটি বিশেষ রচনাশৈলীর আওতায় এ বিষয়বস্তুর ওপর ধারাবাহিকভাবে তথ্য সরবরাহ করা হয় এবং বিভিন্ন মতামত ও যুক্তির অবতারণা করা হয়। এ জন্য কুরআনের সাথে এখনো পরিচয় হয়নি এমন কোন ব্যক্তি যখন প্রথমবার এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করতে যান তখন তিনি একটি চিরাচরিত আশা নিয়েই এগিয়ে যান। তিনি মনে করেন, সাধারণ গ্রন্থের মতো এ গ্রন্থেও প্রথম বিষয়বস্তু নির্ধারিত থাকবে, তারপর মূল আলোচ্য বিষয়কে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে বিন্যাসের ক্রমানুসারে এক একটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হবে। এভাবে জীবনের এক একটি বিভাগকে আলাদা আলাদাভাবে নিয়ে সে সম্পর্কে পূর্বোক্ত বিন্যাসের ক্রমানুসারে বিধান ও নির্দেশাবলী লিপিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু গ্রন্থটি খুলে পড়া শুরু করার পর তিনি দেখেন সম্পুর্ন ভিন্ন এক চিত্র। তিনি এখানে দেখেন এমন একটি বর্ণনাভংগী যার সাথে ইতিপূর্বে তার কোন পরিচয় ছিল না। এখানে তিনি দেখেন আকীদা – বিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়াবলী, নৈতিক বিধি-নির্দেশ, শরীয়াতের বিধান, দাওয়াত, উপদেশ, সতর্কবাণী, সমালোচনা-পর্যালোচনা, নিন্দা-তিরস্কার, ভীতি প্রদর্শন, সুসংবাদ সান্ত্বনা, যুক্তি-প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং ঐতিহাসিক কাহিনী ও প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের প্রতি ইংগিত। এগুলো বার বার একের পর এক আসছে। একই বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন শব্দের মোড়কে পুনর্ব্যাক্ত করা হচ্ছে। একটি বিষয়বস্তুর পর আর একটি এবং তারপর আকাঙ্খিতভাবে তৃতীয় আর একটি বিষয়বস্তু শুরু হয়ে যাচ্ছে। বরং কখনো কখনো একটি বিষয়বস্তুর মাঝখানে একটি বিষয়বস্তু অকস্মাৎ লাফিয়ে পড়ছে। বাক্যের প্রথম পুরুষ ও দ্বিতীয় পুরুষের দিক পরিবর্তন হচ্ছে বার বার এবং বক্তব্য বার বার মোড় পরিবর্তন করছে। বিষয়বস্তুগুলোকে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে বিভক্ত করার কোনো চিহ্নও নেই। ইতিহাস লেখার পদ্ধতিতে কোথাও ইতিহাস লেখা হয়নি। দর্শন ও অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াবলীকে ন্যায়শাস্ত্র ও দর্শনের ভাষায় লেখা হয়নি। মানুষ ও বিশ্ব-জাহানের বস্তু ও পদার্থের আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু জীববিদ্যা ও পদার্থ বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে করা হয়নি। সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু তাতে সমাজ বিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। আইনগত বিধান ও আইনের মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে আইনবিদদের পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে। নৈতিকতার যে শিক্ষা বিবৃত হয়েছে তার বর্ণনাভংগী নৈতিক দর্শন সম্পর্কিত বইপত্রে আলোচিত বর্ণনাভংগী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। সাধারণভাবে বইপত্রে যেভাবে লেখা হয় এসব কিছুই তার বিপরীত। এ দৃশ্য একজন পাঠককে বিব্রত করে। তিনি মনে করতে থাকেন, এটি একটি অবিন্যস্ত, অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্ত বক্তব্যের সমষ্টি এখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য ‘খণ্ড’ একত্রে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে এগুলোকে ধারাবাহিক রচনা আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিরোধিতার দৃষ্টিতে কুরআন অধ্যয়নকারীরা এরই উপর রাখেন তাদের সকল আপত্তি, অভিযোগ ও সন্দেহ-সংশয়ের ভিত্। অন্যদিকে অনুকুল দৃষ্টিভংগীর অধিকারীরা কখনো অর্থের দিক থেকে চোখ বন্ধ করে সন্দেহ সংশয় থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। কখনো কখনো তারা এই আপাত অবিন্যস্ত উপস্থাপনার ব্যাখ্যা করে নিজেদের মনকে বুঝাতে সক্ষম হন। কখনো কৃত্রিম পদ্ধতিতে যোগসূত্র অনুসন্ধান করে অদ্ভুত ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হন্ আবার কখনো ‘খণ্ড রচনার’ মতবাদটি গ্রহণ করে নেন, যার ফলে প্রত্যেকটি আয়াত তার পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে আলাদা হয়ে বক্তার উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী অর্থ প্রকাশ করতে থাকে।
আবার একটি বইকে ভালোভাবে বুঝতে হলে পাঠককে জানতে হবে তার বিষয়বস্তুর উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, মূল বক্তব্য ও দাবী এবং তার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়। সেই সাথে তার বর্ণনা পদ্ধতির সাথেও পরিচিত হতে হবে। তার পরিভাষা বিশেষ বিশ্লেষণ রীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। শব্দের উপরি কাঠামোর পেছনে তার বর্ণনাগুলো যেসব অবস্থা ও বিষয়াবলীর সাথে সম্পর্কিত সেগুলোও চোখের সামনে থাকতে হবে। সাধারণত যেসব বই আমরা পড়ে থাকি তার মধ্যে এগুলো সহজেই পাওয়া যায়। কাজেই তাদের বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করা আমাদে জন্য মোটেই কঠিন হয় না। কিন্তু অন্যান্য বইতে আমরা এগুলো যেভাবে পেতে অভ্যস্ত কুরআনে ঠিক সেভাবে পাওয়া যায় না। তাই একজন সাধারণ বই পাঠকের মানসিকতা নিয়ে যখন আমাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করতে থাকেন তখন তিনি খুঁজে পান না এই কিতাবের বিষয়বস্তু, মূল বক্তব্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়। এর বর্ণনা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিও তার কাছে নতুন ও অপরিচিত মনে হয়। অধিকাংশ জায়গায় এর বাক্য ও বক্তব্যগুলোর পটভূমিও তার চোখের আড়ালে থাকে। ফলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন আয়াতের মধ্যে জ্ঞানের যে উজ্জ্বল মুক্তোমালা জড়িয়ে রয়েছে তা থেকে কম বেশী কিছুটা লাভবান হওয়া সত্ত্বেও পাঠক আল্লাহর কালামের যথার্থ অন্তর্নিহিত প্রাণসত্তার সন্ধান পায় না। এ ক্ষেত্রে কিতাবের জ্ঞান লাভ করার পরিবর্তে তাকে নিছক কিতাবের কতিপয় বিক্ষিপ্ত তত্ত্ব ও উপদেশাবলী লাভ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বরং কুরআন অধ্যয়নের পর যেসব লোকের মনে নানা কারণে সন্দেহ জাগে তাদের অধিকাংশের বিভ্রান্তির একটি কারণ হচ্ছে এই যে, কুরআনের বক্তব্য অনুধাবন করার ব্যাপারে এই মৌখিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তাদের জানা থাকে না। এরপরও কুরআন পড়তে দিয়ে তারা দেখে তার পাতায় পাতায় বিভিন্ন বিষয়বস্তু ছড়িয়ে আছে। বহু আয়াতের গভীর অর্থ তাদের কাছে অনুদ্ঘাটিত থেকে গেছে। অনেকগুলো আয়াতের মধ্যে তারা জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য পেয়েছে কিন্তু আয়াতের পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষিতে এই বক্তব্য তাদের কাছে সম্পূর্ণ বেমানান মনে হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও বর্ণনাভংগীর সাথে অপরিচত থাকার কারণে আয়াতের আসল অর্থ থেকে তারা অন্যদিকে সরে গিয়েছে এবং অধিকাংশ স্থানে পটভূমি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে এভাবে তারা মারাত্মক ধরনের বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।
সংকট উত্তরণের উপায়
কুরআন কোন্ ধরনের কিতাব? এটি কিভাবে অবতীর্ণ হলো? এর সংকলন ও বিন্যাসের পদ্ধতি কি ছিল? এর বিষয়বস্ত ও আলোচ্য বিষয় কি? কোন্ কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুর সাথে এর অসংখ্য বিভিন্ন পর্যায়ের বিষয়ালী সন্পর্কিত? নিচের বক্তব্য উপস্থাপন পদ্ধতি ও সপ্রমাণ করার জন্য এতে কোন্ ধরনের বর্ণনাধারা ও যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর এবং এই ধরনের আরো কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব যদি পাঠক শুরুতেই পেয়ে যান তাহলে তিনি বহুবিধ আশংকা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। তার জন্য কুরআনের অর্থ অনুধাবন ও তার মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার পথ প্রশস্ত হয়ে যেতে পারে। যে ব্যক্তি কুরআন মজীদে প্রচলিত গ্রন্থের ন্যায় রচনা বিন্যাসের সন্ধান করেন এবং এর পাতায় তার সাক্ষাত না পেয়ে চতুর্দিকে হাতড়াতে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়েন, কুরআন সম্পর্কিত এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব জানা না থাকাই তার মানসিক অস্থিরতার মূল কারণ।“ধর্ম সম্পর্কিত” একটি বই পড়তে যাচ্ছেন – এই ধারণা নিয়ে তিনি কুরআন পড়তে শুরু করেন। “ধর্মসম্পর্কিত” এবং “বই” এ দু’টোর ব্যাপারে তার মনে সাধারণত ধর্ম ও বই সম্পর্কিত ধারণাই বিরাজ করতে থাকে। কিন্তু যখন সেখানে নিজের মানসিক ধ্যান-ধারণার সম্পুর্ণ বিপরীত একটি চিত্র তিনি দেখতে পান তখন তাঁর কাছে সেটি সম্পুর্ণ অপরিচিত মনে হতে থাকে। আলোচ্য বিষযের মূল কথার নাগাল না পাওয়ার কারণে প্রতিটি বাক্যের মধ্যে তিনি এমনভাবে বিভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করতে থাকেন যেন মনে হয় যে, আপনি যে কিতাবটি পড়তে যাচ্ছেন সেটি বইপত্রের জগতে কেটি সন্পূর্ন স্বতন্ত্র ও অভিনব বই। এটির রচনাপদ্ধতিও স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্টমন্ডিত। বিষয়বস্তু, বক্তব্য বিষয় ও আলোচনা বিন্যাসের দিক দিয়েও এখানে সম্পুর্ণ অভিনব পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। কাজেই এতদিন পর্যন্ত নানা ধরনের বইপত্র পড়ে আপনার মনে বই সম্পর্কে যে একটি কাঠামোগত ধারণা গড়ে উঠেছে, এ কিতাবটি বুঝার ব্যাপারে তা আপনার কোন কাজে লাগবে না। বরং উলটো এ ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। একে বুঝতে হলে নিজের মনের মধ্যে আগে থেকেই যে সব ধারণা ও কল্পনা বাসা বেঁধে আছে সেগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে এবং এই কিতাবের অভিনব বৈশিষ্টকে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নিতে হবে।
এ প্রসংগে পাঠককে সর্বপ্রথম মূল কুরআনের সাথে পরিচিত হতে হবে। এর প্রতি তার বিশ্বাস থাকা না থাকার প্রশ্ন এখানে নেই। তবে এ কিতাবকে বুঝতে হলে প্রারন্ভিক সূত্র হিসেবে এ কিতাব নিজে এবং এর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মূল বিষয় বিবৃত করেছেন তা গ্রহণ করতে হবে। এ মূল বিষয় নিম্নরূপ:
১. সমগ্র বিশ্ব-জাহানের প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও একচ্ছত্র শাসক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অংশবিশেষ এ পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে দান করেছেন জানার, বুঝার ও চিন্তা করার ক্ষমতা। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার, নির্বাচন, ইচ্ছা ও সংকল্প করার এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার স্বাধীনতা দান করেছেন। এক কথায় মানুষককে এক ধরনের স্বাধীনতা (Autonomy) দান করে তাকে দুনিয়ায় নিজের খলীফা বা প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত করেছেন।
২. মানুষকে এই পদে নিযুক্ত করার সময় বিশ্ব-জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের মনে একথা দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন: আমিই তোমাদের এবং সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির একমাত্র মালিক, মাবুদ ও প্রভু। আমার এই সাম্রাজ্যে তোমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নও, কারোর অধীনও নও এবং আমার ছাড়া আর কারোর তোমাদেরকে কিছু স্বাধীন ক্ষমতা ইখতিয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি আসলে তোমাদের জন্য পরীক্ষাকাল। এই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তোমাদের কাজগুলো যাঁচাই বাছাই করে আমি সিদ্ধান্ত নেবো তোমাদের মধ্য থেকে কে সফল হলো এবং কে হলো ব্যর্থ।
তোমাদের জন্য সঠিক কর্মনীতি একটিই: তোমারা আমাকে মেনে নেবে তোমাদের একমাত্র মাবুদ ও শাসক হিসেবে। আমি তোমাদের জন্য যে বিধান পাঠাবো সেই অনুযায়ী তোমারা দুনিয়ায় কাজ করবে। দুনিয়াকে পরীক্ষাগৃহ মনে করে এই চেতনা সহকারে জীবন যাপন করবে যেন আমার আদালতে শেষ বিচারে সফলকাম হওয়াই তোমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য। বিপরীত পক্ষে এর থেকে ভিন্নতর প্রত্যেকটি কর্মনীতি তোমাদের জন্য ভুল ও বিভ্রান্তিকর। প্রথম কর্মনীতি গ্রহণ করলে (যেটি গ্রহণ করার স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে) তোমরা দুনিয়ায় শান্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা লাভ করবে। তারপর আমার কাছে ফিরে আসলে আমি তোমাদের দান করবো চিরন্তন আরাম ও আনন্দের আবাস জান্নাত। আর দ্বিতীয় কর্মনীতিটি গ্রহণ করলে (যেটি গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা তোমাদের দেয়া হয়েছে) তোমাদের দুনিয়ায় বিপর্যয় ও অস্হিরতার মুখোমুখি হতে হবে এবং দুনিয়ার জীবন শেষ করে আখেরাতে প্রবেশকালে সেখানে জাহান্নাম নামক চিরন্তন মর্মজ্বালা দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের গভীর গর্ভে তোমরা নিক্ষিপ্ত হবে।
৩. একথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বিশ্ব-জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানব জাতির দুই সদস্য (আদম ও হাওয়া) বিশিষ্ট প্রথম গ্রুপকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্য বিধান দান করেন। এই বিধান অনুযায়ী তাদের ও তাদের সন্তান সন্ততিদের দুনিয়ার সমস্ত কাজ-কারবার চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই প্রাথমিক বংশধররা মূর্খতা, অজ্ঞতা, ও অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্টি হননি। তারা সত্যকে জানতেন। তাদেরকে জীবন বিধান দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর অনুগাত্য (অর্থাৎ ইসলাম) ছিল তাদের জীবন পদ্ধতি। তাঁরা তাদেঁর সন্তাদেরও আল্লাহর অনুগত বান্দাহ্ (মুসলিম) হিসাবে জীবন যাপন করার কথা শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শত শত বছরের জীবনাচরণে মানুষ ধীরে ধীরে এই সঠিক জীবন পদ্ধতি (অর্থাৎ দ্বীন) থেকে দূরে সরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল কর্মনীতি অবলম্বন করেছে। গাফিলতির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে তারা এক সময় এই সঠিক জীবন পদ্ধতি হারিয়ে ফেলেছে। আবার শয়তানী প্ররোচনায় একে বিকৃতও করেছে। তারা পৃথিবী ও আকাশের মানবিক ও অমানবিক এবং কাল্পনিক ও বস্তুগত বিভিন্ন সত্তাকে আল্লাহর সাথে তাঁর কাজ –কারবারে শরীক করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত যথার্থ জ্ঞানের (আল ইলম) মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কল্পনা, ভাববাদ, মনগড়া মতবাদ ও দর্শনের মিশ্রন ঘটিয়ে তারা অসংখ্য ধর্মের সৃষ্টি করেছে। তারা আল্লাহর নির্ধারিত ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ নৈত্তিক ও সাংস্কৃতিক নীতি (শরীয়াত) পরিহার বা বিকৃত করে নিজেদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও ঝোকপ্রবণতা অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্য নিজেরাই এমন বিধান তৈর করেছে যার ফলে আল্লাহর এই যমীন জুলুম-নিপীড়নে ভরে গেছে।
৪. আল্লাহ যদি তাঁর স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপথগামী মানুষদেরকে জোরপূর্বক সঠিক কর্মনীতি ও জীবনধারার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন তাহলে সেটি হতো মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত স্বাধীনতা দান নীতির পরিপন্থী। আবার এ ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই তিনি যদি মানুষকে ধ্বংস করে দিতেন তাহলে সেটি হতো সমগ্র মানব জাতিকে পৃথিবীতে কাজ করার জন্য তিনি যে সময় ও সুযোগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল।সৃষ্ঠির প্রথমদিকে থেকে তিনি যে দায়িত্বটি গ্রহণ করেছিলেন সেটি ছিল এই যে, মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে কাজের মাঝখানে যেসব সুযোগ-সুবিধে দেয়া হবে তার মধ্য দিয়েই তিনি তাকে পথনির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই নিজের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি মানব জাতির মধ্য থেকে এমন একদল লোককে ব্যবহার করতে শুরু করেন যাঁরা তাঁর ওপর ঈমান রাখতেন এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যেতেন। এদেঁরকে তিনি করেন নিজের প্রতিনিধি। এদেঁর কাছে পাঠান নিজের অলংঘনীয় বাণী। যথার্থ সত্য জ্ঞান ও জীবন যাপনের সঠিক বিধান এদেঁরকে তান কসে তিনি বনী আদমকে ভুল পথ থেকে এই সহজ সত্য পথের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দেয়ার জন্য এদেরকে নিযুক্ত করেন।
৫. এঁরা ছিলেন আল্লাহর নবী। বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে আল্লাহ তাঁর নবী পাঠাতে থাকেন। হাজার হাজার বছর থেকে তাদের আগমনের এ সিল্সিলা বা ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তাঁদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। তাঁরা সবাই একই দ্বীনের তথা জীবন পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মানুষকে যে সঠিক কর্মনীতির সাথে পরিচিত করানো হয়েছিল তাঁরা সবাই ছিলেন তারই অনুসারী তাঁরা সবাই ছিলেন একই হেদায়াতের প্রতি অনুগত। অর্থাৎ প্রথমদিন থেকেই মানুষের জন্য নৈতিক ও সমাজ-সংস্কৃতির যে চিরন্তন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছিল তাঁরা ছিলেন তারই প্রতি অনুগত। তাঁদের সবার একই মিশন ছিল। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের বংশধর, গোত্র ও জাতিকে এই দ্বীন ও হেদায়াতের দিকে আহবান জানান। তারপর যারা এ আহবান গ্রহণ করে তাদেরকে সংগঠিত করে এমন একটি উন্মাতে পরিণত করেন যাঁরা নিজেরা হন আল্লাহর আইনের অনুগত এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের আনুগত্য কায়েম করার এবং তাঁর আইনের বিরুদ্ধাচরণ প্রবণতা প্রতিরোধ করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে থাকেন। এই নবীগণ প্রত্যেকই তাঁদের নিজেদের যুগে অত্যন্ত সূচারুরূপে এ মিশনের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সবসময় দেখা গেছে মানব গোষ্টির একটি বিরাট অংশ তাঁদের দাওয়াত গ্রহণ করতে প্রস্তুতই হয়নি। আর যারা এই দাওয়াত গ্রহণ করে উন্মাতে মুসিলমার অংগীভূত হয় তারাও ধীরে ধীরে নিজেরাই বিকৃতির সাগরে তলিয়ে যেতে থাকে। এমনকি তাদের কোন কোন উম্মাত আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতকে একেবারেই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর বাণীর সাথে নিজেদের কথার মিশ্রণ ঘটিয়ে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে তার চেহারাই বিকৃত করে দেয়।
৬. সবশেষে বিশ্ব-জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরব দেশে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন নবীকে তিনি যে দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরও সেই একই দায়িত্ব অর্পণ করেন। সাধারণ মানুষের সাথে সাথে পূর্বের নবীদের প্রথভ্রষ্ট উম্মাতদেরকেও তিনি আল্লাহর দীনের দিকে আহবান জানান। সবাইকে সঠিক কর্মনীতি ও সঠিক পথ গ্রহণের দাওয়াত দেন। সবার কাছে নতুন করে আল্লাহর হেদায়াত পৌছিয়ে দেয়া এবং এই দাওয়াত ও হেদায়াত গ্রহণকারীদেরকে এমন একটি উম্মাতে পরিণত করাই ছিল তাঁর কাজ যেন একদিকে আল্লাহর হেদায়াতের উপর নিজেদের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অন্যদিকে সমগ্র দুনিয়ার সংশোধন ও সংস্কার সাধনের জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে। এই দাওয়াত ও হেদায়াতের কিতাব হচ্ছে এই কুরআন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের উপর আল্লাহ এই কিতাবটি অবতীর্ণ করেন।