৩. আল্লাহ্র প্রতি ঈমান
আল্লাহর প্রতি ঈমানের গুরুত্ব
ইসলামের প্রত্যয় ও আচরণের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রথম ও মৌলিক জিনিস হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান। প্রত্যয় ও ঈমানের আর যত দিক ও বিভাগ রয়েছে তা হচ্ছে ঐ এক মূল কাণ্ডেরই শাখা-প্রশাখা মাত্র। ইসলামের যত নৈতিক বিধি ব্যবস্থা ও সামাজিক আইন-কানুন রয়েছে, তা ঐ কেন্দ্রবিন্দু থেকেই শক্তি অর্জন করে থাকে। এখানকার প্রতিটি জিনিসেরই উৎস ও প্রত্যাবর্তনস্থল হচ্ছে আল্লাহ্র সত্তা। ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান পোষণের কারণ এই যে, তারা আল্লাহ্র ফেরেশতা। পয়গম্বরদের প্রতি ঈমান পোষণের কারণ এই যে, তাঁরা আল্লাহ্র প্রেরিত। কেয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান পোষণের কারণ এই যে, তা আল্লাহ্র নির্ধারিত বিচার ও হিসাব গ্রহণের দিন। ফরযসমূহ এ জন্যেই ফরয হয়েছে যে, সেগুলো আল্লাহ্ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। পারস্পরিক অধিকারগুলো এ জন্যেই অধিকার পদবাচ্য হয়েছে যে, সেগুলো আল্লাহ্র হুকুমের ওপর নির্ভরশীল। সৎকাজের প্রবর্তন ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধ এ জন্যেই আবশ্যক যে, আল্লাহ্ তার নির্দেশ দান করেছেন। ফল কথা, ইসলামের প্রতিটি জিনিসের তা প্রত্যয় হোক কি আচরন- ভিত্তিই এ (আল্লাহ্র প্রতি) ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ একটি মাত্র জিনিসকে বিছিন্ন করে ফেললে ফেরেশতা ও কেয়ামত দিবস একেবারে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। নবী, রসূল এবং তাঁদের আনীত কিতাবাদি আনুগত্য লাভের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফরয, ওয়াজিব, আনুগত্য, অধিকার ইত্যাদি তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। আদেশ-নিষেধ ও বিধি-ব্যবস্থায় কোন বাধ্য বাধকতা থাকে না। মোটকথা, এ একটি মাত্র কেন্দ্রবিন্দু অপসৃত হলেই ইসলামের গোটা ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, বরং ইসলাম বলে কোন জিনিসেরই অস্তিত্ব থাকে না।
আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের বিস্তৃত ধারনা
যে প্রত্যয়টি এ বিশাল আদর্শিক ও ব্যবহারিক ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রবিন্দু এবং শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করছে, তা কেবল এটুকু কথাই নয় যে, ‘আলাহ তায়ালা আছেন।’ বরং সে নিজের মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালার গুনরাজি সম্পর্কে একটি পূর্নাঙ্গ ও নির্ভুল ধারনাও (তাঁর সম্পর্কে মানুষের পক্ষে যতখানি ধারনা করা সম্ভব) পোষণ করে এবং গুনরাজি সম্পর্কিত এ ধারণা থেকে এমন শক্তি অর্জিত হয় যা মানুষের গোটা আদর্শিক ও ব্যবহারিক শক্তি নিচয়ের ওপর পরিব্যপ্ত ও কর্তৃত্বশীল হয়ে যায়। নিছক স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বীকৃতিই এমন কোন জিনিস নয়, যাকে ইসলামের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আখ্যা দেয়া যেতে পারে। অন্যন্য জাতিও কোন না কোনরূপে স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যে বস্তুটি ইসলামকে সকল ধর্ম ও দ্বীনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে, তাহলো এই যে, স্রষ্টার গুনরাজি সম্পর্কে সে এক নির্ভুল, পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত ধারণা পেশ করেছে। পরন্তু সেই জ্ঞানকে ঈমান, বরং ঈমানের ভিত্তি বানিয়ে তার সাহায্যে আত্মশুদ্ধি, নৈতিক সংশোধন, কর্ম সংগঠন, সৎকাজের প্রসার, দুষ্কৃতির প্রতিরোধ এবং সভ্যতার গোড়া পত্তনে এতো বড়ো কাজ সম্পাদন করা হয়েছে যে, দুনিয়ার কোন ধর্ম বা জাতিই তা করতে পারেনি।
আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের সংক্ষিপ্ত রূপটি হচ্ছে- যার মৌখিক স্বীকৃতি ও আন্তরিক বিশ্বাসকে ইসলামে প্রবেশ করার প্রাথমিক ও আবশ্যক শর্ত ঘোষণা করা হয়েছে- কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’। অর্থাৎ মুখে একথাটি স্বীকার করা এবং অন্তর দিয়ে একে বিশ্বাস করা যে, যে মহান সত্তা আল্লাহ্ নামে পরিচিত, তিনি ছাড়া আর কোন ‘ইলাহ’ (প্রভু) নেই। অন্য কথায় এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, ‘খোদায়ী’কে (******) বিশ্বপ্রকৃতির সকল বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল একটি মাত্র সত্তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে; এবং খোদায়ীর (*******) জন্যে নির্ধারিত সকল আবেগ-অনুভুতি, ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-কল্পনা, মতবিশ্বাস ও ইবাদাত আনুগত্যেকে সেই এক সত্তার সাথে সম্পৃক্ত করে দিতে হবে। এ সংক্ষিপ্ত কালেমাটির মূল উপাদান তিনটিঃ
একঃ প্রভুত্ব (******) সম্পর্কিত ধারণা।
দুইঃ সমস্ত বস্তুনিচয়ের প্রতি তার অস্বীকৃতি।
তিনঃ কেবল আল্লাহ্র জন্যে তার স্বীকৃতি।
বস্তুত আল্লাহ্র সত্তা ও গুনরাজি সম্পর্কে কুরআন মজীদে যা কিছু বলা হয়েছে, তা এ তিনটি বিষয়েরই বিস্তৃত ব্যাখ্যা মাত্র।
প্রথমত সে ‘খোদায়ী’ (*****) সম্পর্কে এমন এক পূর্নাঙ্গ ও নির্ভুল ধারণা পেশ করেছে, যা দুনিয়ার কোন কিতাব বা ধর্মেই আমরা দেখতে পাই না। অবশ্য একথা নিসন্দেহে যে, সমস্ত জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যেই এ ধারণা কোন না কোনভাবে বর্তমান রয়েছে। কিন্তু সর্বত্রই তা ভ্রান্ত কিংবা অসম্পূর্ণ। কোথাও ‘খোদায়ী’ (*****) বলা হয়েছে প্রারম্ভকে, কোথাও একে শুধু সূত্রপাত অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে। কোথাও একে শক্তি ও ক্ষমতার সমর্থক মনে করা হয়েছে, কোথাও এ শুধু ভীতি ও আতঙ্কের বস্তু হয়ে রয়েছে। কোথাও তা শুধু প্রেমের কেন্দ্রস্থল, কোথাও এর অর্থ কেবল প্রয়োজন পূরণ ও আমন্ত্রণ গ্রহণ। কোথাও তাকে মূর্তি ও প্রতিকৃতি দ্বারা কলঙ্কিত করা হয়েছে। কোথাও তিনি আসমানে অবস্থান করেন, আবার কোথাও তিনি মানুষের বেশ ধারণ করে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। এ সকল ভ্রান্ত ও অপূর্ণ ধারণাকে পরিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ করেছে একমাত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এ পবিত্র গ্রন্থই খোদায়ীকে (******) পবিত্রতা ও মহত্ত্ব দান করেছে। সে-ই আমাদের বলেছে যে, এমন সত্তাই কেবল ‘ইলাহ’ বা প্রভু হতে পারেন, যিনি বে-নিয়াজ, অন্য নিরপেক্ষ, আত্মনির্ভরশীল ও চিরঞ্জীব, যিনি চিরকাল ধরে আছেন এবং চিরদিন থাকবেন, যিনি একচ্ছত্র শাসক ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান, যার জ্ঞান সর্বত্র পরিব্যাপ্ত, যার রহমত ও অনুগ্রহ সবার জন্যে প্রসারিত, যার শক্তি সবার ওপর বিজয়ী, যার হিকমত ও বুদ্ধিমত্তায় কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই, যার আদল ও ইনসাফে যুলুমের চিহ্ন পর্যন্ত নেই, যিনি জীবনদাতা এবং জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণাদির সরবরাহকারী। যিনি ভালো-মন্দ এবং লাভ ও ক্ষতির যাবতীয় শক্তির অধিকারী, যার অনুগ্রহ ও হেফাযতের সবাই মুখাপেক্ষী, যার দিকেই সকল সৃষ্ট বস্তু প্রত্যাবর্তনশীল, যিনি সবার হিসাব গ্রহণকারী, শাস্তি ও পুরস্কার দানের একমাত্র মালিক, পরন্তু খোদায়ী সংক্রান্ত এ গুণাবলী বিভাজ্য ও খণ্ডনীয়ও নয় যে, একই সময়ে একাধিক আল্লাহ্ (*****) থাকবেন এবং তারা উল্লেখিত গুনরাজি কিংবা তার একটি অংশ দ্বারা গুণান্বিত হবেন, অথবা এ কোন সাময়িক এবং কালগত ব্যাপারও নয় যে, একজন আল্লাহ্ কখনো ঐগুলোর দ্বারা গুণান্বিত হবেন, আবার কখনো হবেন না, কিংবা এ কোন স্থানান্তরযোগ্য জিনিসও নয় যে, আজ একজন আল্লাহ্র মধ্যে এর অস্তিত্ব দেখা যায়, আবার কাল দেখা যায় অন্য জনের মধ্যে।
খোদায়ী সম্পর্কে এ পূর্ণাঙ্গ ও বিশুদ্ধ ধারণা পেশ করার পর কুরআন তার অনন্য বাচনভঙ্গির দ্বারা প্রমাণ করেছে যে, বিশ্বপ্রকৃতির সকল বস্তু ও শক্তি নিচয়ের মধ্যে কোন একটির প্রতিও এ অর্থপ্রয়োগ সঙ্গত হতে পারে না। কেননা বিশ্বের সকল সৃষ্ট বস্তুই অন্য নির্ভর, পরাধীন এবং ধ্বংস ও বিনাশশীল। তাদের পক্ষে অন্যের উপকারী বা অপকারী হওয়া তো দূরের কথা, তারা খোদ নিজেদের থেকে অপকারিতা দূর করতেও সমর্থ নয়। তাদের ক্রিয়াকাণ্ড ও প্রভাব প্রতিক্রিয়ার উৎস তাদের আপন সত্তার মধ্যে নয়, বরং তারা সবাই অন্য কোথাও থেকে জীবনী শক্তি, কর্মশক্তি ও প্রভাব শক্তি অর্জন করে থাকে। কাজেই বিশ্বপ্রকৃতিতে এমন কোন বস্তুই নেই, যার ভেতরে প্রভুত্বের অনুমাত্র যোগ্যতা আছে এবং যে আমাদের গোলামী ও আনুগত্যের একটি অংশ মাত্রও পাবার অধিকারী হতে পারে।
এ অস্বীকৃতির পর সে খোদায়ীকে একটি মাত্র সত্তার জন্যে সুনির্দিষ্ট করে দেয়, যার নাম হচ্ছে ‘আল্লাহ্’। সেই সাথে সে মানুষের কাছে দাবী করে যে, আর সবাইকে বর্জন করে কেবল এরই প্রতি ঈমান আনো, এর সামনেই নত হও, একেই সম্মান করো, একেই ভালোবাসো, একেই ভয় করো, এর কাছেই প্রত্যাশা করো, এর কাছেই কামনা করো, সর্বাবস্থায় এর ওপরই ভরসা করো, হামেশা মতে রাখো, একদিন তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে, তাঁর কাছেই হিসেব দিতে হবে, তোমাদের ভালো বা মন্দ পরিণতি তাঁর ফায়সালার ওপরই নির্ভরশীল।
আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের নৈতিক উপকার
খোদায়ী গুনরাজি সম্পর্কিত এ বিস্তৃত ধারণার সাথে আল্লাহ্র প্রতি যে ঈমান মানব হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়, তার ভেতরে এমন সব অসাধারণ উপকারিতা রয়েছে, যা অন্য কোন বিশ্বাস বা প্রত্যয় দ্বারা অর্জন করা যেতে পারে না।
দৃষ্টির প্রশস্ততা
আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের প্রথম সুফল এই যে, তা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে এতোটা প্রশস্ত করে দেয়, যতোটা প্রশস্ত আল্লাহর অসীম সাম্রাজ্য। মানুষ যতক্ষণ নিজের স্বার্থ সম্পর্কে বিবেচনা করে দুনিয়ার প্রতি তাকায়, তার দৃষ্টি এমন এক সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে আবদ্ধ থাকে, যার মধ্যে তার শক্তি ক্ষমতা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও কামনা-বাসনা সীমিত, এ পরিধির মধ্যেই সে নিজের জন্যে প্রয়োজন পূরণকারী তালাশ করে। এ পরিধির মধ্যে যেসব শক্তিমান রয়েছে, তাদের ভয়েই সে ভীত ও সঙ্কুচিত হয়, আর যারা দুর্বল ও কমজোর, তাদের ওপর কর্তৃত্ব চালায়। এ পরিধির মধ্যেই তার বন্ধুত্ব ও শত্রুতা, প্রীতি ও ঘৃণা, সম্মান ও তাচ্ছিল্য সীমিত থাকে-যার জন্যে ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া তার কোন মানদণ্ড থাকে না। কিন্তু আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের পর তার দৃষ্টি নিজস্ব পরিবেশের সীমাতিক্রম করে গোটা বিশ্বপ্রকৃতির ওপর প্রসারিত হয়ে যায়। এরপর সে বিশ্বপ্রকৃতির ওপর নিজস্ব স্বার্থ সম্পর্কের দিক থেকে নয়, বরং খোদাওন্দে করীমের সম্পর্কের দিক থেকে দৃষ্টিপাত করে। এবার এ বিশাল জগতের প্রতিটি জিনিসের সাথে তার একটি ভিন্ন রকমের সম্পর্ক কায়েম হয়ে যায়। এবার সে তার মধ্যে কোন প্রয়োজন পূরণকারী, কোন শক্তিধর, কোন অপকারী কিংবা কোন উপকারী দেখতে পায় না। এবার সে সম্মান বা তাচ্ছিল্য, ভয় বা প্রত্যাশার যোগ্য কাউকে খুঁজে পায় না। এবার তার বন্ধুত্ব বা শত্রুতা, প্রীতি বা ঘৃণা নিজের জন্যে নয়, বরং তা আল্লাহ্র জন্যে নির্ধারিত হয়। সে লক্ষ্য করে যে, যে আল্লাহ্কে আমি মানি, তিনি শুধু আমার, আমার বংশের কিংবা আমার দেশবাসীরই সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা নন, বরং তিনি সমগ্র আসমান ও জমিনের স্রষ্টা এবং সমগ্র জাহানের প্রতিপালক। তাঁর কর্তৃত্ব রাজত্ব শুধু আমার দেশ পর্যন্তই সীমিত নয়, বরং তিনি আসমান ও জমিনের বাদশাহ এবং সমগ্র সৃষ্টির প্রতিপালক। তাঁর ইবাদাত বন্দেগী শুধু আমি একাই করছি না বরং আসমান ও জমিনের সমগ্র বস্তু নিচয়ই তাঁর সামনে আত্মসমর্পিত। ************* (**********)********** সবাই তাঁরই প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা কীর্তনে মশগুল। **********************(********)******* এ প্রেক্ষিতে যখন তিনি বিশ্বপ্রকৃতিকে দেখেন, তখন কেউই তাঁর দৃষ্টির আড়ালে থাকে না, সবাই আপনা আপনিই তাঁর দৃষ্টির সামনে এসে ধরা দেয়। তাঁর সহানুভুতি, তাঁর ভালবাসা, তাঁর খেদমত এমন কোন পরিধির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না যার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে।
কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহ্র প্রতি ঈমান পোষণ করে, সে কখনো সংকীর্ণ দৃষ্টি হতে পারে না। তার দৃষ্টি এতোটা প্রশস্ত যে ‘আন্তর্জাতিকতা’ (Internationalism) কথাটিও তার ক্ষেত্রে সংকীর্ণ। তাকে তো ‘দিগ্বলয়ী’ ও ‘সৃষ্টিবাদী’ বলা উচিত।
আত্মসম্ভ্রম
পরন্তু আল্লাহ্র প্রতি এ ঈমানই মানুষকে হীনতা থেকে উদ্ধার করে আত্মসম্মান ও আত্মসম্ভ্রমের উচ্চতম স্তরে উন্নীত করে দেয়। যত দিন সে আল্লাহ্কে চিনতো না, দুনিয়ার প্রতিটি শক্তিমান বস্তু, প্রতিটি উপকারী বা অপকারী জিনিস, প্রতিটি জমকালো প্রকাণ্ড বস্তুর সামনেই সে মাথা নত করতো। তার ভয়ে সে ভীত হতো। তার সামনে হাত প্রসারিত করতো। তার কাছে প্রার্থনা প্রত্যাশা করতো। কিন্তু যখন সে আল্লাহ্কে চিনেছে তখন জানতে পেরেছ যে, যাদের সামনে সে হাত প্রসারিত করছিলো, তারা নিজেরাই অন্য নির্ভর, পরমুখাপেক্ষী(************)-************** যাদের বন্দেগী ও আনুগত্য সে করছিলো, তারা নিজেরাই তার মতো দাসানুদাস মাত্র। :***********
যাদের কাছে সে সাহায্যের প্রত্যাশা করতো, তারা তার সাহায্য তো দূরের কথা, নিজেই নিজের সাহায্য করতে সমর্থ নয়। *************(*********)-*********** কারণ প্রকৃত শক্তির মালিক তো হচ্ছেন আল্লাহ্। (************)-*************** তিনিই শাসনকর্তা, বিধানদাতা ও আদেশদাতা। (*************)-************** তিনি ছাড়া আর কোন সাহায্যকারী, পৃষ্ঠপোষক ও মদদগার নেই। *********** সাহায্য কেবল তাঁরই কাছ থেকে আসে।
****(************)-************ রেযকদাতা একমাত্র তিনিই। (**************)-**************** আসমান জমিনের চাবিকাঠি তাঁর হাতেই নিবদ্ধ। *************(*********)-***** মৃত্যুদাতা ও জীবনদাতা তিনিই; তাঁর অনুমতি ভিন্ন না কেউ কাউকে মারতে পারে, না কাউকে বাঁচাতে পারে। *************
উপকার অপকার করার আসল ক্ষমতা তাঁরই করায়ত্ত। *************
এরূপ জ্ঞান অর্জিত হবার পর সে তামাম দুনিয়ার শক্তিনিচয় থেকে বে-নিয়াজ বেপরোয়া ও নির্ভীক হয়ে যায়। আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন শক্তির সামনে তার মাথা নত হয় না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো সামনে তার হাত প্রসারিত হয় না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব তার মনে ঠাঁই পায় না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কাছে সে প্রার্থনা ও প্রত্যাশা করে না।
বিনয় ও নম্রতা
কিন্তু এ আত্মসম্মান তার শক্তি, সম্পদ, কিংবা যোগ্যতা ও প্রতিভার বলে অর্জিত কোন মিথ্যা আত্মসম্মান নয়। এ আত্মসম্ভ্রম এমন আত্মসম্ভ্রমও নয়, যা একজন বিপদগামী লোকের মধ্যেও গর্ব ও অহংকারের কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে। বরং এ হচ্ছে আল্লাহ্র সাথে নিজের এবং সমগ্র সৃষ্টিজগতের সম্পর্ককে যথাযথরূপে উপলব্ধি করার ফলশ্রুতি। এ কারণেই আল্লাহ্র প্রতি ঈমান পোষণকারীদের মধ্যে আত্মসম্মানের সাথে বিনয়ের এবং আত্মসম্ভ্রমের সাথে নম্রতা ও কোমলতার অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে জানে যে, আল্লাহ্র শক্তি ক্ষমতার সামনে আমি সম্পূর্ণ অসহায়। *********** আল্লাহ্র কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে আসা আমার কিংবা অন্য কোন সত্তার সাধ্যায়ত্ব নয়। ************** আমি তো কোন্ ছার, গোটা বিশ্বজাহানই আল্লাহ্র মুখাপেক্ষী, আর আল্লাহ্ হচ্ছেন বে-নিয়াজ, অমুখাপেক্ষী। *********** আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহ্র। *********** আর আমিও যা কিছু অনুগ্রহ সম্পদ পেয়েছি, আল্লাহ্র কাছ থেকেই পেয়েছি। এহেন বিশ্বাসের পর গর্ব ও অহংকার কোথায় থাকতে পারে। আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের তো অনিবার্য সুফলই হচ্ছে এই যে, তা মানুষকে আপাদমস্তক বিনয়ী করে তোলে।
************
“দয়াময় আল্লাহ্র বিশিষ্ট বান্দা তারাই, যারা দুনিয়ার বুকে বিনয়ের সাথে চলাফেরা করে আর যখন জাহেল লোকেরা তাদের সাথে জাহেলি কথা-বার্তা বলে, তখন সালাম করে চলে যায়।”-(সূরা আল ফুরকানঃ ৬৩)
অলীক প্রত্যাশার বিলুপ্তি
স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্কের নির্ভুল পরিচিতির আর একটি ফায়দা হলো এই যে, এর দ্বারা অপরিচয়জনিত সকল অলীক প্রত্যাশা ও মিথ্যা ভরসার পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই সাথে মানুষ খুব উত্তমরূপে বুঝে নেয় যে, তার জন্যে নির্ভুল বিশ্বাস ও সৎকার্যক্রম ছাড়া মুক্তি ও কল্যাণের আর কোন পথ নেই। পক্ষান্তরে এ পরিচয় থেকে যারা বঞ্চিত, তাদের কেউ কেউ মনে করে যে, আল্লাহ্র কাজে আরো অনেক ছোট ছোট আল্লাহ্ও শরীক রয়েছে; আমরা তাদের তোষামোদ করে সুপারিশ করিয়ে নেবো। ************ কেউ মনে করে আল্লাহ্র পুত্র সন্তান রয়েছে এবং সেই পুত্র আমাদের জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করে মুক্তির অধিকারকে সুরক্ষিত করে দিয়েছে। কেউ ভাবে, আমরা নিজেরাই আল্লাহ্র পুত্র এবং তার প্রিয়পাত্র। ************ আমরা যা কিছুই করি না কেন, আমাদের শাস্তি হতে পারে না।
এবম্বিধ বহু ভ্রান্ত প্রত্যাশাই লোকদের হামেশা গোনাহ ও পাপচক্রে ফাঁসিয়ে রাখে। কারণ, এ সবের ভরসায় তারা আত্ম পরিশুদ্ধি ও কর্ম সংশোধনের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। কিন্তু কুরআন যে আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের শিক্ষা দেয়, তাতে অলীক প্রত্যাশার কোন অবকাশ নেই। সে বলে যে, আল্লাহ্র সাথে কোন জাতি বা সম্প্রদায়েরই বিশেষ সম্পর্ক নেই। সবাই তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি সবার স্রষ্টা*********** মহত্ত্ব এবং বিশেষত্ব যা কিছুই রয়েছে, তা হচ্ছে ‘তাকওয়ার’ ওপর নির্ভরশীল। **************** আল্লাহ্র না কোন সন্তান আছে, আর না কোন অংশীদার ও মদদগার আছে। ***************** তোমরা যাদেরকে তাঁর সন্তান কিংবা অংশীদার মনে করো, তারা সবাই তাঁর বান্দাহ এবং গোলাম। (আরবী*****) তার অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করার মতো দুঃসাহসও কারো নেই। (আরবী*****) তোমরা যদি নাফরমানী করো তাহলে কোন সুপারিশকারী বা মদদগরিই তাঁর কবল থেকে তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। (আরবী*****)
আশাবাদ ও মানসিক শান্তি
এরই সাথে আল্লাহর প্রতি ঈমান মানুষের মধ্যে এমন একটা আশাপ্রদ মনোভাব সৃষ্টি করে, যা কোন অবস্থায়ই নৈরাশ্য ও নিরুৎসাহ দ্বারা পরাভূত হয় না। বস্তুত মু’মিনের পক্ষে ঈমান হচ্ছে আশা-আকাংখার এক অফুরন্ত ভান্ডার- যেখান থেকে সে আন্তরিক শক্তি ও আত্মিক প্রশান্তির চিরস্থায়ী ও অবিছিন্ন উপকরন পেতে থাকে। তাকে যাদ দুনিয়ার সমস্ত দরজা থেকেও বিমুখ করা হয়, সমগ্র সাজ-সরঞ্জাম থেকে বঞ্চিত করা হয়, উপায়-উপকরণাদি একে একে তার সঙ্গ ত্যাগ করে, তবু এক আল্লাহর অবলম্বন কখনো তার সঙ্গ ত্যাগ করে না। তাঁর ওপর নির্ভর করে হামেশাই সে আশা- আকাংখায় উদ্দপিতি থাক।ে এর কারণ এই য,ে যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে, তিনি বলেছেনঃ আমি তোমাদের খুব নিকটবর্তী, তোমাদের ডাক আমি শুনে থাকি। (আরবী*****) আমার কাছ থেকে যুলুমের ভয় করো না, কারণ আমি যালেম নই। (আরবী*****) বরং আমার রহমতের প্রত্যাশা করো, কারণ আমার রহমত প্রতিটি জিনিসের ওপর প্রসারিত। (আরবী*****) আমার রহমত থেকে নিরাশ তো কেবল সেই হয়ে থাকে, যে ব্যাক্তি আমার প্রতি ঈমান পোষণ করে না। (আরবী*****) পক্ষান্তরে মু’মিনের জন্যে নৈরাশ্যের কোনই স্থান নেই। সে যদি কোন অপরাধ করে ফেলে তাহলে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। (আরবী*****) অন্যত্র (আরবী*****) যদি দুনিয়ার সাজ সরঞ্জাম তার সহযোগিতা না করে, তবে তাদের ভরসা বর্জন করে সে আমাকে আঁকড়ে ধরুক, অতপর ভয়-ভীতি-শঙ্কা তার কাছেও ঘঁেষবে না। আমার স্মরণ হচ্ছে (আরবী*****) এমন জিনিস, যার দ্বারা মানক হৃদয় স্থিতি ও প্রশান্তি লাভ করে। (আরবী*****)
ধৈর্য-স্থৈর্য ও নির্ভরতা (আরবী*****)
পরন্তু এ আশাবাদই বিকাশ লাভ করে ধৈর্য-স্থৈর্য ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতার উচ্চ শিখরে উন্নীত হয়, যেখানে মু’মিনের হৃদয় এক কঠিন প্রস্তর ভ’মির ন্যায় মযবুত ও সুদৃঢ় হয়ে যায়। সারা দুনিয়ার বিপদাপদ, শত্রুতা, দুঃখ-কষ্ট, ক্ষয়-ক্ষতি ও বিরদ্ধ শক্তি একত্র হয়েও তাকে নিজের স্থান থেকে টলাতে পারে না। এ শক্তি মানুষ কেবল আল্লাহর প্রতি ঈমান ছাড়া আর কোন পন্থায় অর্জন করতে পারে না। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করে না, সে এমনসব বস্তুগত বা কাল্পনিক উপায়-উপকরনের ওপর নির্ভর করে, যা আদতেই কোন শক্তির অধিকারী নয়। এদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি প্রকারান্তরে মাকড়সার জালকেই অবলম্বন করে থাকে। (আরবী*****) এরূপ দুর্বল অবলম্বনের ওপর যার জীবন নির্ভরশীল, তার পক্ষে দুর্বল হয়ে পড়া অবধারিত। (আরবী*****) কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল, যে আল্লাহকে আকড়ে ধরেছে, তার অবলম্বন এমন মযবুত যে, তা কখনো চুরমার হতে পারে না। (আরবী*****) তার সাথে তো রয়েছে রাব্বুল আলামীনের অপরাজেয় শক্তি, তার উপরে কোন শক্তি প্রধান্য বিস্তাার করতে পারে? তাকে সমগ্র জাহানের বিপদ-মছীবত একত্র হয়েও ধৈর্য-স্থৈর্য, সংকল্প ও দৃঢ়তার স্থান থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। কারণ তার মতে ভালো-মন্দ সবকিছুই আসে আল্লাহর তরফ থেকে (আরবী*****) বিপদ মুসিবত যা কিছুই আসে, আল্লাহর নির্ধারিত বিধান অনুসারেই আসে এবং তাকে বিলম্বিত করাও আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। (আরবী*****)
নবীগণ (আ) যে অতি মানবিক শক্তি দ্বারা দুনিয়ায় ভয়াবহ বিপদাপদের মুকাবিলা করেছেন, বড় বড় সা¤্রাজ্য ও শক্তিমান জাতির সাথে এককভাবে লড়াই করেছেন, পার্থিব সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই দুনিয়া জয় করার সংকল্প নিয়ে এগিয়েছেন এবং বিপদাপদের প্রচন্ড ঝঞ্চার মুখেও নিজের মিশনকে অব্যাহত রেখেছেন, তা হচ্ছে এ সবর ও তাওয়াক্কল তথা ধৈর্য ও স্থর্যৈ নির্ভরতার শক্তি। দৃষ্টান্ত স্বরুপ হযরত ইবরাহীম (আ)- এর জীবন কাহিনী দেখুন। নিজ দেশের স্বৈরাচারী শাসকের সাথে তিনি তর্ক করেছেন, নিঃশঙ্কাভাবে আগুনের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েছেন এবং শেষ র্পযন্ত (আরবী******) বলে কোন উপায়-অবলম্বন ছাড়াই দেশ থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। এমনভাবে হযরত হূদ (আ)- এর জীবন কাহিনী দেখুন। আদ জাতির প্রচন্ড শক্তিকে তিনি কিভাবে চ্যালেঞ্জ দিয়েছনঃ
(আরবী*****************************)
“তোমরা সবাই মিলে ফন্দি খাটিয়ে দেখো এবং আমায় আদৌ কোন অবকাশ দিও না। আমি তো সেই আল্লাহর উপর ভরসা করেছি, যিনি আমার এবং তোমাদের প্রভু। এমন কোন প্রাণী নেই, যার টুটি তাঁর হাতে নিবন্ধ নয়।- (সূরা হূদঃ ৫৫-৫৬)
একইভাবে হযরত মূসা (আ)- এর জীবন কাহিনী দেখুন। একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে ফেরাউনের প্রচন্ড শক্তির সাথে তিনি মুকাবিলা করেছেন। ফেরাউন হত্যার হুমকি দিলে তিনি জবাব দেন যে, আমি প্রত্যেক অহংকারীর মুকাবিলায় তাঁর আশ্রয় গ্রহন করেছি, যিনি আমার এবং তোমার উভয়েরই প্রভু। (আরবী******) মিশর ত্যাগ করার সময় ফেরাউন তার পূর্ণ দলবলসহ তার পশ্চাদ্ধাবন করছে। তাঁর ভীরু সম্প্রদায় ভীত হয়ে বলছে যে, দুশমনরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে (আরবী*****) কিন্তু তিনি অত্যন্ত মানসিক প্রশান্তরি সাথে জবাব দেনঃ মোটেই নয়, আল্লাহর আমার সাথে রয়েছেন; তিনিই আমায় শান্তি নিরাপত্তার পথে চালিত করবেন। (আরবী*******) সবশেষে নবী আরবী (সা)- কে দেখুন। হিজরতের সময় একটি গিরিগুহায় তিনি আশ্রয় গ্রহন করেন। তাঁর সাথে রয়েছেন মাত্র একজন বন্ধু। রক্ত পিপাসু কাফেররা একেবারে গুহার মুখ পর্যন্ত এসে পৌছেছে। কিন্তু তখনও তাঁর মধ্যে অস্থরিতা দেখা দেয় না। বরং আপন সাথীকে তিনি বলেনঃ (আরবী******) আদৌ ঘাবড়িয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন। এহেন অপরাজেয় শক্তি, এ ইস্পাত কঠিন সংকল্প, এ পর্বত তুল্য স্থিরতা একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান ছাড়া আর কিসের দ্বারা অর্জিত হতে পারে?
বীরত্ব
এরই অনুরূপ আর একটি গুন আল্লাহর প্রতি ঈমানের দ্বারা অস্বাভাবিক রকমে সৃষ্টি হয়; তাহলো সাহসিকতা, নির্ভীকতা, বীর্যবত্তা ও শৌর্যশালীতা, মানুষকে দু’টি জিনিস ভীরুও কাপুরুষ বানিয়ে দেয়। প্রথম হচ্ছে নিজের প্রাণ, পরিবার-পরিজন ও ধন-মালের প্রতি ভালোবাসা। দ্বিতীয় হচ্ছে, ভয়-ভীতি, যা এ ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত যে, হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত দ্রব্যাদির মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে ক্ষয়-ক্ষতি ও ধ্বংস শক্তি নিহিত রয়েছে। আল্লাহর প্রতি ঈমান এ দু’টি জিনিসকেই মানুষের মন থেকে দূর করে দেয়। মু’মিনের শিরা-উপশিরায় এ বিশ্বাসের ধারা প্রবাহিত হয় যে, আল্লাহ সবার চেয়ে বেশী ভালোবাসা পাবার অধিকারী। (আরবী********) তার মনে একথা দৃঢ়মূল হয়ে যায় যে, ধন-মাল ও সন্তাান-সন্ততি সবই দুনিয়ার সৌন্দর্য সম্ভার মাত্র; এগুলোর কোন না কোন সময় ধ্বংস অবধারিত। কখনো ধ্বংস হবে না, এমন অক্ষয় ও অবিনশ্বর হচ্ছে আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্য জিনিস। (আরবী*******) দুনিয়ার জীবন মাত্র কয়েক দিনের জন্যে; একে রক্ষা করার জন্যে আমরা লাখো প্রচেষ্টা চালালেও মৃত্যু একদিন আসবেই, এটা সুনিশ্চিত। (আরবী********)
সুতরাং এ ক্ষনস্থায়ী জীবনকে ে কন সেই আনন্দ সুখময় জীবনের জন্যে উৎসর্গ করে দেবো না, যা আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া যাবে? (আরবী******)
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ও সাময়িক স্বার্থকে সেই আল্লাহর সন্তাোষ লাভের জন্যে নিবেদিত করে দেবো না, যিনি আমাদের জান ও মালের প্রকৃত মালিক- যিনি এর বিনিময়ে এর চেয়ে উত্তম জীবন এবং এর চেয়েও বেশী মঙ্গল দানের অধিকারী?
(আরবী******************)
এরপর ভয়-ভীতির কথা। মুমিনকে এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ক্ষতি ও বিনাশ করার প্রকৃত শক্তি মানুষ, পশু, গোলা বারুদ, তলোয়ার, কাঠ বা পাথরের মধ্যে নেই, বরং তা রয়েছে আল্লাহর নিরংকুশ শক্তির মুঠোর মধ্যে। দুনিয়ার সকল শক্তি একত্র হয়েও যদি কারো ক্ষতি করতে চায়, আর আল্লাহরই অনুমতি না হয়, তবে তার একটি চুল পর্যন্ত বাকা হতে পারে না। (আরবী*****) মুত্যুর যে সময় আল্লাহ নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তার পূর্বে কারোই মৃত্যু আসতে পারে না। ***** আর মৃত্যুর নির্ধারিত সময় যদি এসেই পড়ে, তবে কারো বাহানায় তা বিলম্বিতও হতে পারে না। (আরবী*****) সুতরাং ব্যাপারটা যখন এই, তখন মানুষকে ভয় করার চেয়ে আল্লাহকেই ভয় করা উচিত। (আরবী****) প্রকৃতপক্ষে তিনিই হচ্ছেন এমন সত্তা, যাকে ভয় করা কর্তব্য। (আরবী****) খোদার পথে সংগ্রাম করতে ইতস্তত করা এমন লোকের কাজ, যাদের হৃদয়ে ঈমান নেই, কেননা তারা আল্লাহর চেয়ে মানুষকে বেশী ভয় করে। (আরবী***) নতুবা যে ব্যক্তি সাচ্চা মুমিন, সে তো দুশমনকে দেখে ভীত হবার পরিবর্তে আরো বেশী সাহসী ও নির্ভীক হয়, কারন সে কোন পার্থিব শক্তির ওপর নয়, বরং আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছেঃ (আরবী****)
অল্পে তুষ্টি ও আত্মতৃপ্তি
আল্লাহর প্রতি এ ঈমানই মানুষের মন থেকে লোভ-লালসা ও হিংসা-দ্বেষের ঘৃণ্য প্রবণতাকে দূর করে দেয়, যা তাকে স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে হীন ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং মানব সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনে। ঈমানের সাথে মানুষের ভেতর অল্পে তুষ্টি ও আত্মতৃপ্তির সৃষ্টি হয়। অন্য মানুষের সাথে সে প্রতিযোগীতা বা প্রতিদ্বন্ধিতা করে না। অত্যাচার ও অবিচারের প্রতিকারে কখনো তাড়াহুড়ো করে না। হামেশা সম্মানজনক পন্থায় আপন প্রভুর অনুগ্রহ সম্পদ তালাশ করে বেড়ায়; এবং কম বেশী যা কিছুই পায় তাকেই আল্লাহর দান মনে করে শিরোধার্য করে নেয়। মুমিনকে এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। (আরবী************************) রেযেক আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ; তিনি যাকে যতো ইচ্ছা দান করে থাকেন। (আরবী************) রাষ্ট্রশক্তি ও শাসন ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালার করায়ত্ত; যাকে ইচ্ছা তিনি শাসনকর্তা বানিয়ে দেন। (আরবী***********) ধন ও সন্মান তাঁরই হাতে নিবদ্ধ; যাকে ইচ্ছা তিনি সন্মানিত করেন, আর যাকে ইচ্ছা অপদস্ত করেন। (আরবী************) পরন্তু দুনিয়ার ইজ্জত, দৌলত, শক্তি, সৌন্দর্য, খ্যাতি ও অন্যান্য অনুগ্রহ সম্পদ কারো বেশী পাওয়া আর কারো কম পাওয়ার ব্যবস্থাটি আল্লাহরই নির্ধারিত। আল্লাহ তাঁর কাজের ঔচিত্য ও যথার্থ নিজেই ভালো জানেন। তাঁর নির্ধারিত ব্যবস্থাকে বদলানোর চেষ্টা করা মানুষের পক্ষে সঙ্গতও নয়, আর তাতে কামিয়াবিরও সম্ভাবনা নেই। (আরবী*************)
নৈতিকতার সংশোধন ও কর্মের শৃংখলা
আল্লাহর প্রতি ঈমান থেকে সবচেয়ে বেশী উপকৃত হয় সমাজ জীবন। এর দ্বারা সমাজের লোকদের মধ্যে দাযিত্ববোধ জাগ্রত হয়। লোকদের আত্মায় পবিত্রতা এবং কাজ-কর্মে পরহেযগারি সৃষ্টি হয়। লোকদের পারস্পরিক লেন-দেন সুস্থ ও পরিশুদ্ধ হয়; আইনানুগত্যের চেতনা জাগ্রত হয়; আজ্ঞানুবর্তিতা ও সংযম- শৃংখলার যোগ্যতা সৃষ্টি হয় এবং লোকেরা এক প্রচন্ড অদৃশ্য শক্তি বলে ভেতরে ভেতরে মুক্ত শুদ্ধ হয়ে একটি সৎ ও সংহত সমাজ গঠনের উপযোগী হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমানের অলৌকিক ক্ষমতা (মুজেযা), আর এ জন্যেই এটি নির্ধারিত। দুনিয়ার কোন বিচক্ষণ শক্তি, শিক্ষা-দীক্ষা বা ওয়াজ-নসিহত দ্বারা নৈতিকতার সংশোধন ও কর্ম শৃংখলা স্থাপনের কাজ এতো ব্যাপকভাবে এবং এতো গভীর ভিত্তির ওপর সম্পাদিত হতে পারে না। পার্থিব শক্তিনিচয়ের দৌড় আত্মা পর্যন্ত নয়, মাত্র দেহ পর্যন্ত; আর দেহের ওপরও তার নিয়ন্ত্রণ সর্বত্র ও সর্বক্ষণ নয়। শিক্ষাদীক্ষা ও ওয়াজ-নসিহতের প্রভাবও শুধু বিচার-বুদ্ধি প্রবৃত্তি; সে শুধু নিজেই তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে না, বরং বিচার-বুদ্ধিকেও পরাভূত ও আচ্ছন্ন করতে ত্রুটি করে না। ঈমান হচ্ছে এমন জিনিস, যা তার সংস্কারক ও সংগঠক শক্তিনিচয় নিয়ে মানুষের হৃদয় ও আত্মার গভীরতম প্রদেশে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে সে এমন এক শক্তিশালী ও সচেতন বিবেকের উন্মেষ ঘটায়, যা সর্বদা ও সর্বত্র মানুষকে তাকওয়া ও আনুগত্যের সহজ-সরল পথনির্দেশ করতে থাকে। নিতান্ত অসৎ প্রবৃত্তির মধ্যেও তার ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের কিছু না কিছু প্রভাব বিস্তার না করে ছাড়ে না।
এ অভাবনীয় উপকার অর্জিত হয় একমাত্র আল্লাহর কুদরত সম্পর্কিত প্রত্যয় থেকে, যা ঈমানের একটি অপরিহার্য অংশ। কুরআন মজিদের বিভিন্ন জায়গায় মানুষেকে এ বলে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর জ্ঞান সকল জিনিসের ওপর পরিব্যাপ্ত এবং কোন জিনিসই তার থেকে গোপন থাকতে পারে না।
(আরবী**************)
পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর; তোমরা যে দিকে মুখ ফিরাবে, সেদিকেই আল্লাহ বর্তমান। নিসন্দেহে আল্লাহ অত্যন্ত প্রশস্ত এবং বিজ্ঞ।
(আরবী***************)
”তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সবাইকেই তলব কেরে নেবেন; নিসন্দেহে আল্লাহ সব জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান।”
(আরবী*************)
নিসন্দেহে আসমান ও জমিনের কোন জিনিসই আল্লাহর কাছ থেকে গোপন নয়।–(সূরা আলে ইমরানঃ ৫)
(আরবী**************)
“তাঁর কাছেই রয়েছে গায়েবের চাবিকাঠি, যার জ্ঞান তিনি ছাড়া আর কারো কাছে নেই, জলে-স্থলে যা কিছু আছে, সবই তিনি জানেন। এমন কি মাটিতে একটি পাতা পড়লেও আল্লাহ তা জেনে ফেলেন। আর দুনিয়ার ঘুটঘুটে অন্ধকারে এমন কোন দানা নেই এবং এমন কোন শুষ্ক ও সিক্ত জিনিস নেই, যা এক উজ্জ্বল কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই।”-(সূরা আল আনআমঃ ৫৯)
(আরবী************)
”আমরাই মানুষকে পয়দা করেছি, এবং আমারা এমন কথাও জানি যার ধারণা তার নফসের ভেতর জাগে। আমরা তার ঘাড়ের শিরার চেয়েও তার বেশী নিকটবর্তী।” -(সূরা কাফ : ১৬)
(আরবী***********)
”তিন ব্যক্তির মধ্যে কোন কানাঘুষা চলে না, যেখানে চতুর্থ আল্লাহ না থাকেন, পাঁচ ব্যাক্তির মধ্যে কোন কানাঘুষা চলে না; যেখানে ষষ্ঠ আল্লাহ না থাকেন। অনুরুপভাবে, এর চেয়ে কম কি বেশী লোকের মধ্যে কোন সমাবেশ হয় না, যেখানে তাদের সাথে তিনি না থাকেন – তা যেখানেই হোক না কেন।” –(সূরা আল মুজাদিলা : ৭)
(আরবী************)
”তারা লোকদের কাছ থেকে গোপন থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে গোপন থাকতে পারে না, আল্লাহ তখনো তাদের সাথে থাকেন যখন তাঁর সন্তুষ্টির বিরুদ্ধে রাত্রি বেলায় তারা কথাবার্তা বলে। আর তাঁরা যা কিছু করে, আল্লাহ তার ওপর ব্যাপ্তিময়।” –(সূরা আন নিসা : ১০৮)
(আরবী************)
”তাঁরা কি জানে না যে, তাঁরা গোপনে ও প্রকাশ্যে যা কিছুই করে, আল্লাহ তার খবর রাখেন?” – (সূরা আল বাকারা : ৭৭)
(আরবী***********)
“দু’জন নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশতা প্রত্যেকের ডানে ও বামে বসে নিয়ন্ত্রণ করছে; মুখ থেকে এমন কোন কথাই বেরোয় না যে, কোন তত্ত্বাবধানকারী তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৈরী থাকে না।” – (সূরা কাফঃ ১৭-১৮)
(আরবী***********)
“তোমাদের মধ্য থেকে কেউ গোপনে কথা বলুক কি উচ্চ স্বরে, কেউ রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকুক আর দিনের আলোয় চলাফেরা করুক তা সামনে ও পিছনে আল্লাহর গুপ্তচর নিযুক্ত রয়েছে, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে।” -(সূরা আর রা’দঃ ১০-১১)
সেই সাথে একথাও খুব ভালো করে মানব মনে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছে যে, একদিন অবশ্যই তাকে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে (আরবী***********) এবং তাকে প্রতিটি জিনিসের হিসেব দিতে হবে। (আরবী*****************) আল্লাহ তায়ালার ধরপাকড় অত্যন্ত কঠিন। (আরবী**************)
এই যে প্রত্যয়টিকে নানাভাবে মানব মনে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এটিই হচ্ছে ইসলামের গোটা আইন ব্যবস্থার কার্যকরী শক্তি। ইসলাম হারাম-হালালের যে সীমাই নির্ধারণ করে দিয়েছে; নৈতিকতা, সামাজিকতা ও পারস্পরিক লেনদেন সম্পর্কে যে বিধি-বিধানেই দিয়েছে, তার প্রবর্তন আসলে সৈন্য, পুলিশ বা শিক্ষা ও সদুপদেশের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা কার্যকরী শক্তি অর্জন করে এ প্রত্যয় থেকে যে, এর নিয়ামক হচ্ছে এমন এক পরাক্রমশালী শাসনকর্তা যার জ্ঞান ও ক্ষমতা প্রতিটি বস্তুর ওপরই পরিব্যাপ্ত। তাঁর বিধি-নির্দেশ অমান্যকারী না নিজের অপরাধ লুকাতে সমর্থ, আর না তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে কোনরুপ আত্নরক্ষা করতে সক্ষম। এ কারণেই কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় বিধি-নির্দেশ উল্লেখের পর এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে যে, এ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত সীমা বিশেষ; সাবধান! একে লঙ্ঘন করো না। (আরবী***************) স্মরণ রেখো, তোমরা যা কিছুই করো না কেন, আল্লাহ সবই দেখছেন। (আরবী************)