৪. অমুসলিমদের যে সব বাড়তি অধিকার দেয়া যায়
উপরে আমরা অমুসলিমদের যে সব অধিকারের উল্লেখ করেছি, সেগুলো তাদের জন্য শরীয়তে সুনির্দিষ্ট এবং সেগুলো যে কোনো ইসলামী শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভূক্ত হওয়া উচিত।
এক্ষণে আমি সংক্ষেপে বলবো যে, বর্তমান যুগে একটি ইসলামী রাষ্ট্র তার অমুসলিম নাগরিকদেরকে ইসলামী মূলনীতির আলোকে কি কি অতিরিক্ত অধিকার দিতে পারে।
রাষ্ট্র প্রধানের পদ
সর্ব প্রথম রাষ্ট্র প্রাধানের প্রশ্নে আসা যাক। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র, তাই ধর্মহীন জাতীয় প্রজাতন্ত্রগুলো সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার সম্পর্কে যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, ইসলামী রাষ্ট্র তার আশ্রয় নিতে পারে না। ইসলামে রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব হলো ইসলামের মূলনীতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। সুতরাং যারা ইসলামের মূলনীতিকেই মানে না, সে আর যাই হোক রাষ্ট্র প্রধানের পদে কোনোক্রমেই অভিষিক্ত হতে পারে না।
মজলিশে শূরা বা আইন সভা
এরপর আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মজলিশে শূরা বা পার্লামেন্ট তথা আইন সভা। এই আইন সভাকে যদি শতকরা একশো ভাগ খাঁটি ও নির্ভজাল ইসলামী আদর্শ মুতাবিক গঠন করতে হয়, তাহলে এখানেও অমুসলিম প্রতিনিধিত্ব শুদ্ধ নয়। তবে বর্তমান যুগের পরিস্থিতির আলোকে এর অবকাশ এই শর্তে সৃষ্টি করা যেতে পারে যে, দেশের সংবিধানে এই মর্মে সুস্পস্ট ও দ্ব্যর্থহীন নিশ্চয়তা দিতে হবে যে :
ক. আইন সভা কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না এবং এই সীমা লংঘনকারী যে কোন সিদ্ধান্ত আইনের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হবে।
খ. দেশের আইনের সর্বপ্রধান উত্স হবে কুরআন ও সুন্নাহ।
গ. আইনের চুড়ান্ত অনুমোদনের কাজটি যে ব্যক্তি করবেন তিনি মুসলমান হবেন।
এরূপ একটি পদ্ধতিও অবলম্বন করা যেতে পারে যে, অমুসলিমদেরকে দেশের আইন সভার অন্তর্ভূক্ত করার পরিবর্তে তাদের জন্য একটা আলাদা প্রতিনিধি পরিষদ বা আইন সভা গঠন করে দেয়া হবে। এই পরিষদ দ্বারা তারা নিজেদের সামষ্টিক প্রয়োজনও মেটাতে পারবে এবং দেশের প্রশাসন সংক্রান্ত ব্যাপারেও নিজেদের দৃষ্টিভংগি তুলে ধরতে পারবে। এই পরিষদের সমস্যপদ এবং ভোটাধিকার শুধুমাত্র অমুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে এবং এখানে তাদের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বধীনতা থাকবে। এই পরিষদের মাধ্যমে তারা নিম্নলিখিত কাজগুলো সমাধা করতে পারবে।
১. তারা নিজেদের পারিবারিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও আগে থেকে প্রচলিত সকল আইনের খসড়া রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত করতে পারবে।
২. তারা সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও মজলিশে শূরার সিদ্ধান্তসমূহ সম্পর্কে নিজেদের অভিযোগ, পরামর্শ ও প্রস্তাব অবাধে পেশ করতে পারবে এবং সরকার ইনসাফ সহকারে তার পর্যালোচনা করবে।
৩. তারা আপন সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও দেশের অন্যান্য ব্যাপারে প্রশ্নও করতে পারবে। সরকারের একজন প্রতিনিধি তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যও উপস্থিত থাকবে।
উপরোক্ত তিনটি পন্থার যে কোনো একটি পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুসারে গ্রহন করা যেতে পারে।
পৌরসভা ও স্থানীয় সরকারের স্তরগুলোতে [Local Bodies] অমুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ও ভোট দানের পূর্ণ অধিকার দেয়া যেতে পারে।
বাক স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা ইত্যাদি
ইসলামী রাষ্ট্র একজন মুসলমান যেমন বাক স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা এবং মতামত ও বিবেকের স্বাধীনতা ভোগ করে, অমুসলিমরাও অবিকল সেরূপ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এ ব্যাপারে যেসব আইনগত বিধি নিষেধ মুসলমানদের ওপর থাকবে, তা তাদের ওপরও থাকবে।
আইন সংগতভাবে তারা সরকার, সরকারী আমলা এবং স্বয়ং সরকার প্রধানেরও সমালোচনা করতে পারে।
তারা নিজেদের ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং একজন অমুসলিম যে কোনো ধর্ম গ্রহণ করলে তাতে সরকারের কোন আপত্তি থাকবে না। তবে কোনো মুসলমান ইসলামী রাষ্ট্রের চৌহদ্দীতে থাকা অবস্থায় আপন ধর্ম পরিবর্তন করতে পারবে না। তাবে এরূপ ধর্মত্যাগী মুসলমানকে আপন ধর্ম ত্যাগের ব্যাপারে যে জবাবদিহীর সম্মুখীন হতে হবে, সেটা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যে অমুসলিম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে ইসলাম ত্যাগ করেছে, তাকে এজন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না।
তাদেরকে তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো চিন্তা ও কর্ম অবলম্বনে বাধ্য করা যাবে না। দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী নয় এমন যে কোনো কাজ তারা আপন বিবেকের দাবী অনুসারে করতে পারবে।
শিক্ষা
ইসলামী রাষ্ট্র গোটা দেশের যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবে, তাদেরকে সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ইসলামের ধর্মীয় পুস্তকাদি পড়তে তাদেরকে বাধ্য করা যাবে না। দেশের সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা নিজেদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপন ধর্ম শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা করার পূর্ন স্বীধীনতা তাদের থাকবে।
চাকুরী
কতিপয় সংরক্ষিত পদ ছাড়া সকল চাকুরীতে তাদের প্রবেশাধিকার থাকেব এবং এ ব্যাপারে তাদের সাথে কোনো বৈষম্য করা চালবে না। মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের যোগ্যতার একই মাপকাঠি হবে এবং যোগ্য লোকদেরকে ধর্মীয পরিচয় নির্বিশেষে নির্বাচন করা হবে।
সংরক্ষিত পদসমূহ বলতে ইসলামের আদর্শগত ব্যবস্থায় মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন পদসমূহকে বুঝানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একটি দলের যথেষ্ট চিন্তা ভাবনার পর এই পদগুলোর তালিকা তৈরী করা যেতে পারে। আমি একটা দিক নির্দেশক মূলনীতি হিসেবে শুধু এই কথা বলতে পারি যে, যেসব পদ নীতি নির্ধারণ ও বিভিন্ন দিক নির্দেশনার সাথে জড়িত, সেগুলো মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন পদ। একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এইসব পদ কেবল সংশ্লিষ্ট আদর্শে বিশ্বাসীদেরকেই দেয়া যেতে পারে। এই পদগুলো বাদ দেয়ার পর বাদবাকী সমগ্র প্রশাসনের বড় বড় পদেও যোগ্যতা সাপেক্ষে অমুসলিমদেরকে নিয়োগ করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, রাষ্ট্রের মহা হিসাব রক্ষক, মহা প্রকৌশলী কিংবা পোষ্ট মাষ্টার জেনারেলের ন্যায় পদে সুযোগ্য অমুসলিম ব্যক্তিদের নিয়োগে কোনো বাধা নেই।
অনুরূপভাবে সেনাবাহিনীতেও শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ যুদ্ধ সংক্রান্ত দায়িত্ব সংরক্ষিত দায়িত্ব বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া অন্যান্য সামরিক বিভাগ যার কোনো সম্পর্ক সরাসরি যুদ্ধের সাথে নেই, অমুসলিমদের জন্য উন্মক্ত থাকবে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পেশা
শিল্প, কারিগরিম, বাণিজ্য, কৃষি ও অন্য সকল পেশার দুয়ার অমুসলিমদের জন্য উন্মক্ত থাকবে। এ সব ক্ষেত্রে মুসলমানরা যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে, তা অমুসলমানরাও ভোগ করবে এবং মুসলমানদের ওপর আরোপ করা হয় না এমন কোনো বিধি নিষেধ অমুসলিমদের ওপরও আরোপ করা যাবে না। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অর্থনৈতিক ময়দানে তত্পরতা চালানোর সমান অধিকার থাকবে।
অমুসলিমদের নিরাপত্তার একমাত্র উপায়
একটি ইসলামী রাষ্ট্র তার অমুসলিম নাগরিকদের যে অধিকারই দেবে, তা পার্শ্ববর্তী কোন অমুসলিম রাষ্ট্র তার মুসলিম নাগরিকদেরকে কি কি অধিকার দিয়ে থাকে, বা আদৌ দেয় না, তার পরোয়া না করেই দেবে। আমরা একথা মানি না যে, মুসলমানরা অমুসলিমদের দেখাদেখি আপন কর্মপন্থা নির্ণয় করবে। তারা ইনসাফ করলে এরাও ইনসাফ করবে আর তারা যুলুম করলে এরাও যুলুম করবে, এটা হতে পারে না। আমরা মুসলমান হিসেবে একটা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের অনুসারী। আমাদের যতোদূর সাধ্যে কুলায়, নিজস্ব নীতি ও আদর্শ অনুসারেই কাজ করতে হবে। আমরা যা দেবো তা আন্তরিকতা ও সুদুদ্দেশ্য নিয়েই দেবো এবং তা শুধু কাগজে কলমে নয় বরং বাস্তবেই দেবো। যে দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করবো তা পূর্ণ ইনসাফ ও সততার সাথে পালন করবো।
এরপর একথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা এই রাষ্ট্রগুলোকে পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা ছাড়া আর কোনোভাবে দেয়া সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্য বশত গোটা এই উপমহাদেশ জুড়ে যুলুম ও নিপীড়ণের যে পৈশাচিক বিভীষিকা চলছে, তাকে প্রশমিত করার এটাই একমাত্র অব্যর্থ উপায়। শুধুমাত্র এই প্রন্থা অবলম্বনেই পকিস্তানও হতে পারে ইনসাফের আবাসভূমি আর ভারত এবং অন্যান্য দেশও ইনসাফের পথ খুঁজে পেতে পারে। পরিতাপের বিষয় হলো, অমুসলিমরা দীর্ঘ কালব্যপী ইসলামের কেবল অপব্যাখ্যাই শুনে ও দেখে আসছে। তাই তারা ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলাম শাসনের কথা শুনতেই আতংকিত হয়। আর তাদের কেউ কেউ দাবী জানাতে থাকে যে, আমাদের এখানেও ভারতের ন্যায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র কায়েম হওয়া উচিত। বাস্তবিক পক্ষে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে কি এমন কোনো আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রত্যাশা করা যেতে পারে? তার পরিবর্তে এমন একটি ব্যবস্থার পরীক্ষা করা কি ভালো নয় যার ভিত্তি খোদাভীতি, সততা এবং শাশ্বত সুন্দর আদর্শের অনুসরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত? [তরজমানুল কুরআন : আগস্ট ১৯৪৮ ঈসায়ী]