স্বাস্থ্য রক্ষার উত্তম পন্থা
১. ভাল স্বাস্থ্য আল্লাহ তাআলার নে’আমত এবং আমানত। তাই সুস্থতার মর্যাদা রক্ষা করবে এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় কখনও অবহেলা করবে না। একবার স্বাস্থ্য নষ্ট হলে পুনঃ তা উদ্ধার করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উইপোকা যেমন বড় বড় পাঠাগারের পুস্তক (অল্পদিনের মধ্যে) খেয়ে ধ্বংস করে দয়ে তেমনি স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও সামান্যতম অবহেলায় ক্ষুদ্র একটি রোগ জীবনকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। স্বাস্থ্যের প্রতি অলসতা ও অবহেলা করা আল্লাহ তাআলার প্রতি অকৃতজ্ঞতাও বটে।
মানব জীবনের মূল রত্ন হলো জ্ঞান, চরিত্র, ঈমান ও উপলদ্ধি শক্তি। জ্ঞান, চরিত্র, ঈমান ও অনুভূতি শক্তির সুস্থতা ও অধিকাংশ সময় শারীরিক সুস্থতার উপর নির্ভরশীল। জ্ঞান-বুদ্ধির ক্রমবিকাশ, মহৎ চরিত্রের আবশ্যকতা এবং দীনি কর্তব্যসমূহ আদায় করার জন্য শারীরিক সুস্থতা একটা মৌলিক বিষয়ের মর্যাদা রাখে। অসুস্থ ব্যক্তির জ্ঞান-বুদ্ধিও দুর্বল হয়, আর তার কাজ কর্মও অত্যন্ত উদ্যমহীন হয়। জীবনের উচ্চশা, উচ্চাকাঙ্খা উৎসাহ-উদ্দীপনা থেকে মানুষ যখন বঞ্চিত হয় এবং ইচ্ছা শক্তি দুর্বল হয়, আর উত্তেজনা শক্তি লোপ পায় ও নিস্তেজ হয়ে যায়, তখন এমন চেতনাহীন জীবন দুর্বল শরীরের জন্যে রীতিমত বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
একজন মুমিনকে খেলাফতের যে মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে তার শারীরিক শক্তি, জ্ঞান, মস্তিষ্কের শক্তি, ইচ্ছা শক্তি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা অপরিহার্য। তার জীবন উদ্যম, উচ্চাশা ও আবেগে পরিপূর্ণ হতে হবে। সুস্থ ব্যক্তিদের দ্বারাই শক্তিশালী আদর্শ জাতি সৃষ্টি হয়। আর এরূপ জাতিই জীবনের কর্মস্থলের মহান কোরবানী পেশ করে নিজের আসন সুদৃঢ় করে নেয় এবং জীবনের মর্যাদা ও মহত্ব প্রকাশ করে।
২. সর্বদা হাসি-খুশি, কর্ম চঞ্চল ও সক্রিয় থাকবে, স্বচ্চরিত্র, মৃদু হাসি এবং সজীবতা দ্বারা জীবনকে সার্থক, আবেগময় ও সুস্থ রাখবে। চিন্তুা, রাগ, দুঃখ-হিংসা, কুচিন্তা, সংকীর্ণমনা, দুর্বলমনা ও মানসিক অস্থিরতা পাকস্থলীতে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আর পাকস্থলীর অসম অবস্থা স্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক শত্রু। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সাদাসিদে ভাবে থাক, মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং হাসি-খুশিতে থাক।“ (মেশকাত)
একবার রাসূল (সাঃ) দেখতে পেলেন যে, এক বৃদ্ধ ব্যক্তি তার দু’ছেলের কাঁধের ওপর ভর দিয়ে তাদের মাঝখানে ছেচঁড়াতে ছেচঁড়াতে যাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এ বুড়োর কি হয়েছে?” লোকেরা উত্তর দিল যে, লোকটি পায়ে হেঁটে বায়তুল্লাহ যাওয়ার মান্নত করেছিল। এজন্য পায়ে হাঁটার কসরত করছে। রাসূল (সাঃ) বললেন, “আল্লাহ তাআলা এ বুড়োর কষ্টভোগের মুখাপেক্ষী নন এবং ঐ বুড়ো লোকটিকে নির্দেশ দিলেন যে, সওয়ারীতে করে তোমার সফর সম্পন্ন কর।”
হযরত ওমর (রাঃ) এক যুবককে দেখতে পেলেন যে, সে দূর্বলে যে, সে দূর্বলের মত পথ চলছে। তিনি তাকে থামালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, “তোমার কি রোগ হয়েছে?” যুবকটি উত্তর দিল যে, কিছু হয়নি। তিনি (তাকে বেত্রাঘাত করার জন্য) বেত উঠালেন এবং ধমক দিয়ে বললেন, “রাস্তায় চলার পূর্ণ শক্তি নিয়ে চলবে।”
রাসূল (সাঃ) পথে হাঁটার সময় দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটতেন, এমন শক্তি নিয়ে হাঁটতেন (যে মনে হতো) যেন তিনি কোন নিম্নভূমির দিকে যাচ্ছেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন হারেস (রাঃ) বলেন, “আমি রাসূল (সাঃ) এর চেয়ে মৃদু হাসিসম্পন্ন আর কাউকে দেখিনি।” (তিরমিযি)
রাসূল (সাঃ) নিজ উম্মতদেরকে যে দোআ শিক্ষা দিয়েছেন তা পড়বে। দোয়াটি হলোঃ
اَللّٰهُم إِنِّي أَعُوْذُ بِك مِنَ الْهَمِّ وَالْحُزْنِ والْعَجْزِ والْكَسْلِ وَضَلْعِ الدَّيْنِ وغَلَبَةِ الرِّجَال (بخارى ومسلم)
“হে আল্লাহ!আমি অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, নিরুপায় অবস্থা, অলসতা, দুর্বলতা, ঋণের বোঝা থেকে এবং লোকদের দ্বারা আমাকে পরাজিত করা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (বুখারী, মুসলিম)
৩. শরীরে সহ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেবেনা, শারীরি শক্তিকে অন্যায়ভাবে নষ্ট করবে না, শারীরিক শক্তির অধিকারীর দায়িত্ব হলো এই যে, তাকে সংরক্ষণ করবে এবং তার থেকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী মধ্যম পন্থায় কার্য হাসিল করবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন ‘কাজ ততোটুকু করবে যতটুকু করার শক্তি তোমার আছে,কেননা আল্লাহ তাআলা সে পর্যন্ত বিরক্ত হননা, যে পর্যন্ত তোমরা বিরক্ত না হও। (বুখারী)
হযরত আবু কায়েস (রাঃ) বলেন যে, তিনি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখলেন তিনি খুৎবা দিচ্ছেন, এমতাবস্থায় হযরত আবু কায়েস রৌদ্রে দাঁড়িয়ে গেলেন, রাসূল (সাঃ) তাকে ছায়ায় চলে যেতে নির্দেশ দিলে তিনি ছায়ায় চলে গেলেন। (আল আদাবুল মুফরাদ)
রাসূল (সাঃ) শরীরের কিছু অংশ রৌদ্রে এবং কিছু অংশ ছায়ায় রাখতেও নিষেধ করেছেন।
বাহেলা গোত্রের মুজীবাহ (রাঃ) নাম্মী এক মহিলা বর্ণনা করেন যে, একবার আমার পিতা রাসূল (সাঃ) এর দরবারে দীনী ইলম শিক্ষা নেওয়ার জন্য গেলেন এবং দীন সম্পর্কিত কিছু জরুরী বিষয় অবগত হয়ে ফিরে এলেন। এক বছর পর তিনি আবার রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। এবার রাসূল (সাঃ) তাঁকে মোটেই চিনতে পারেননি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি কি আমাকে চিনতে পারেননি? রাসূল (সাঃ) বললেন, “না। তোমার পরিচয় দাও।” তিনি বললেন, “আমি বাহেলা গোত্রের একজন লোক, গত বছর আপনার খেদমতে উপস্থিত হয়েছিলাম।” তখন রাসূল (সাঃ) বললেনঃ তোমার এ কি অবস্থা হয়েছে! গত বছর যখন তুমি এসেছিলে তখন তোমার ছুরত ও অবস্থা বেশ ভাল ছিল। তিনি উত্তরে বললেন, আমি আপনার দরবার থেকে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত নিয়মিত রোযা রেখেছি শুধু রাতে খাবার খাই। রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি অনর্থক নিজকে শাস্তিতে রেখেছ,নিজের স্বাস্থ্যের খ্সতি করেছ। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি পুরো রমযান মাসের ফরয রোযাগুলো রাখবে আর প্রতি মাসে একটি করে রোযা রাখবে। লোকটি আবারও বলল, হুযুর (সাঃ)! আরো কিছু বেশীর অনুমিত দিন! হুযর (সাঃ)বললেন, আচ্ছা প্রতি বছর সম্মানিত মাসসমূহে রোযা রাখবে এবং মাঝে মাঝে ছেড়ে দিবে। এরূপ প্রতি বছর করবে।” বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল (সাঃ)একথা বলার সময় নিজের তিন আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করেছেন ঐ গুলোকে মিলায়েছেন এবং ছেড়ে দিয়েছেন। (এর দ্বারা এটা বুঝাতে চেয়েছেন যে, রজব, শাওয়াল, যিলক্বদ এবং যিলহজ্ব মাসের রোযা রাখবে এবং ছেড়ে দিবে আবার কোন বছর মোটেও রাখবে না।)
রাসূল (সাঃ) বলেন, “নিজেকে অপমানিত করা ঈমানদারের উচিত নয়।” সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, “ঈমানদার ব্যক্তি ভিাবে নিজেকে নিজে অপমানিত করে? তিনি উত্তরে বললেন, “(ঈমানদার ব্যক্তি)নিজেকে নিজে অসহনীয় পরীক্ষায় ফেলে। (তিরমিযি)
৪. সর্বদা ধৈর্য্য, সহনশীলতা, পরিশ্রম, কষ্ট ও বীরত্বের জীবন যাপন করবে, সব ধরনের বিপদ সহ্য করার এবং কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য অভ্যাস গড়তে হবে এবং দৃঢ়তার সাথে সাদাসিধে ভাবে জীবন যাপনের চেষ্টা করবে। আরাম প্রিয়, পরিশ্রম বিমুখ, কোলতা প্রিয়, অলস, সুখ প্রত্যাশী, হীনমনা ও দুনিয়াপূজারী হবেনা।
রাসূল (সাঃ) যখন হযরত মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামানের গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠাচ্ছিলেন তখন উপদেশ দিচ্ছিলেন যে, “মুআয! আরামপ্রয়তা থেকে বিরত থাকবে! কেননা আল্লাহর বান্দাগণ সব সময় আরামপ্রিয় হয় না। (মেশকাত)
হযরত আবু উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ)বলেছেনঃ সাদাসিদে জীবন যাপন করা ঈমানের বড় নিদর্শন।“ (আবু দাউদ)
রাসূল (সাঃ)-সর্বদা সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন এবং সর্বদা নিজের বীরত্বপূর্ণ শক্তিকে বর্দ্ধিত করার চেষ্টা করতেন। তিনি সাঁতার কাটতে পছন্দ করতেন। কেননা, সাঁতার কাটায় শরীরের ভ্যায়াম হয। একবার এক পুকুরে তিনি ও তাঁর কতিপয় সাহাবী সাতাঁর কাটছিলেন, তিনি সাঁতারুদের প্রত্যেকের জুড়ি ঠিক করে দিলেন, প্রত্যেকে সাঁতার কেটে আবার তার জুড়ির নিকট পৌঁছাবে। তাঁর জুড়ি নির্বাচিত হলেন হযরত আবু বকর (রাঃ)। তিনি সাঁতার কেটে আবু বকর (রাঃ) পর্যন্ত পৌঁছে তাঁর ঘাড় ধরে ফেললেন।
রাসূল (সাঃ) সওয়ারীর জন্যে (বাহন হিসাবে) ঘোড়া পছন্দ করতেন, নিজেই নিজের ঘোড়ার পরিচর্যা করতেন, নিজের আমার আস্তিন দ্বারা ঘোড়ার মুখ মুছে পরিষ্কার করে দিতেন,তার গ্রীবাদেশের কেশরসমূহকে নিজের পবিত্র আঙ্গুলী দ্বারা ঠিক করে দিতেন এবং বলতেন, “কয়ামত পর্যন্ত এর কপালের সাথে সৌভাগ্য জড়িত থাকবে।“
হযরত উকবা (রাঃ) বলেছেনঃ “তীরন্দাজী করা শিখো, ঘোড়ায় চড়ে তীর নিক্ষেপকারীগণ আমার নিকট ঘোড়ায় আরোহণ কারীদের থেকে প্রিয় এবং যে ব্যক্তি তীর নিক্ষেপ করা শিক্ষালাভ করার পর ছেড়ে দিল, সে আল্লাহর নেআমতের অমর্যাদা করল। (আবু দাউদ)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বিপদের সময় মুজাহিদদেরকে পাহারা দিল তার এ রাত লাইলাতুল কদরের রাত অপেক্ষা অধিক উত্তম।
রাসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমার উম্মাতের এপর ঐ সময় অত্যাসন্ন যে সময় অন্যান্য জাতির লোকেরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, যেমন খাবারের ওপর লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন কোন এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! তখন কি আমাদের সংখ্যা এতই কম হবে যে, ধ্বংস করার জন্য অন্য জাতির লোকেরা একত্রিত হয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, না, সে সময় তোমাদের সঙখ্যা কম হবেনা বরং অনেক বেশী হবে। কিন্তু তোমরা বন্যায় ভাসমান খড়কুটার মত হালকা হয়ে যাবে। তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব কমে যাবে এবং হীনমন্যতা ও কাপুরুষতা তোমাদেরকে ঘিরে ধরবে। অতঃপর জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ হীনমন্যতা কেন আসবে? তিনি বললেনঃ এই কারণে যে, ঐ সময় তোমাদের দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা বেড়ে যাবে এবং মৃত্যুকে বেশী ভয় করতে থাকবে।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “ উত্তম জীবন ঐ ব্যক্তির, যে নিজের ঘোড়ার লাগাম ধরে আল্লাহর পথে দ্রুতবেগে দৌঁড়িয়ে চলে, বিপদের কথা শুনলে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সেখানে দৌঁড়িয়ে চলে,বিপদের কথা শুনলে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সেখানে দৌঁড়িয়ে যায় এবং হত্যা ও মৃত্যু থেকে এমন নির্ভীক হয় যেন সে মৃত্যুর খোঁজেই আছে।” (মুসলিম)
৫. মহিলার বিপদে ধৈর্য্যশীল, পরিশ্রমী ও কষ্টের জীবন যাপন করবে। ঘরের কাজ-কর্ম নিজের হাতেই করবে। কষ্ট সহ্য করার অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং সন্তান-সন্ততিকেও প্রথম থেকে ধৈর্য্যশীল, সহনশীল ও পরিশ্রমী হিসাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে। ঘরে চাকর-নকর থাকা সত্বেও সন্তান-সন্ততিকে কথায় কথায় চাকর-নকরের সাহায্য নিতে নিষেধ করবে এবং সন্তান-সন্ততিকে নিজের কাজ নিজেদের করে নিতে অভ্যস্থ করে তুলবে। মহিলা সাহাবীগণ বেশীর ভাগ সময় নিজেদের করে নিতে অভ্যস্থ করে তুলবে। মহিলা সাহাবীগণ বেশীর ভাগ সময় নিজেদের কাজ নিজেদের হাতেই করতেন, পাকঘরের কাজ নিজেরাই করতেন, চাক্কি পিষতেন। পানি আনা, কাপড় ধোয়া, এমনকি কাপড় সেলাইরও কাজ করতেন। পরিশ্রম ও কষ্টের জীবন-যাপন করতেন, প্রয়োজন বোধে লড়াইয়ের ময়দানে আহতদেরকে সেবাযত্ন করতেন। ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগাতেন এবং যোদ্ধাদেরকে পানি পান করাবার দায়িত্ব পালন করতেন। এর দ্বারা মহিলাদের স্বাস্থ্য ও চরিত্র ভাল থাকে এবং সন্তান-সন্ততির উপরও এর শুভক্রিয়া প্রতিফলিত হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে উত্তম মহিলা সেই, যে ঘরের কাজ কর্মে এতা ব্যস্ত থাকে যে, তার চেহারা ও কপালে পরিশ্রমের চিহ্ন ফুটে উফে এবং পাক ঘরের ধোঁয়া-কালির মলিনতা প্রকাশ পায়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “কাল কিয়ামতের দিন আমি এবং মলিন চেহারার মহিলাগণ এভাবে হবো।” (একতা বলার সময় তিনি নিজের শাহাদাত অঙ্গুলী ও মধ্যমা অঙ্গুলী মিলিয়ে দেখিয়েছেন।)
৬. ভোবে উঠার অভ্যাস করবে, নিদ্রায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। যাতে করে শরীরের আরাম ও শান্তিতে ব্যঘাত না ঘটে এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্লান্তি ও অশান্তি অনুভূত না হয়। খুব বেশীও ঘুমাবেনা আবার কমও ঘুমাবে না যাতে করে দুর্বল হয়ে পড়। রাত্রে তাড়াতাড়ি নিদ্রা ও ভোরে তাড়াতাড়ি উঠার অভ্যাস গড়ে তুলবে।
ভোরে উঠে আল্লাহ তাআলার ইবাদাত করবে। অতঃপর বাগানে অথবা মাঠে পায়চারী করা ও ভ্রমণ করার জন্য বের হবে। ভোরের টাটকা বাতাস স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। দৈনিক নিজের শারীরিক শক্তি অনুযায়ী হালকা ব্যায়াম করারও চেষ্টা করবে।
রাসূল (সাঃ) বাগানে ভ্রমণ করাকে পছন্দ করতেন এবং কখনো কখনো তিনি নিজেই বাগানে চলে যেতেন। এশার পর জাগ্রত থাকা ও কথা বলতে নিষেধ করতেন। তিনি বলেন, “এশার পর এমন ব্যক্তি-ই জেগে থাকতে পারে যার দীনি আলোচনা করার অথবা ঘরের লোকদের সাথে জরুরী কথা বলার প্রয়োজন আছে।”
৭. নিজের নফস বা অহং আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলবে। উৎসাহ-উদ্দীপনা, চিন্তা ভাবনা ও কামনা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। নিজের অন্তরকে বিপথে পরিচালিত হওয়া, চিন্তাধারা বিক্ষিপ্ত হওয়া এবং দৃষ্টিকে অসৎ হওয়া থেকে রক্ষা করে চলবে। কামনা-বাসনার অসৎ ভাব ও কুদৃষ্টি দ্বারা মন মস্তিষ্ক শান্তি ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। এ ধরনের লোক চেহার, সৌন্দর্য্য ও সুপুরুষসুলভ গুণ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। অতঃপর সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভীরু ও কাপুরুষ হিসাবে প্রমাণিত হয়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “চোখের যেনা হলো কুদৃষ্টি আর মুখের যেনা হলো অশ্লীল আলোচনা, অতঃপর মন উহার আকাংখা করে এবং গুপ্তাংগ উহাকে সত্যে পরিণত করে অথবা মিথ্যায় প্রতিফলিত করে।”
এক বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন- মুসলিমগণ! তোমরা কুকাজের ধারেও যেয়োনা। কুকাজে ছয়টি ক্ষতি নিহিত আছে, তিনটি হলো দুনিয়ায় আর তিনটি হলো পরকালে।
দুনিয়ার তিনটি হলো-
(ক) এর দ্বারা মানুষের চেহারার সৌন্দর্য্য ও আকর্ষণ কমে যায়।
(খ) এর দ্বারা মানুসের উপর অভাব-অনটন পতিত হয়।
(গ) এর দ্বারা মানুষের বয়সও কমে যায়।
৮. নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকবে। নেশা জাতীয় দ্রব্য মস্তিষ্ক ও পাকস্থলীকে ক্রমশ ধ্বংস করে দেয়। মদ তো হারাম, কাজেই তা থেকে বিরত থাকবেই আর অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকেও বিরত থাকবে।
৯. প্রত্যেক কাজেই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। শারীরিক পরিশ্রমে, মস্তিষ্ক পরিচালনায়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে, পানাহারে, নিদ্রায় ও বিশ্রামে, দুঃখে-কষ্টে ও হাসি-খুশীতে, আনন্দ-উল্লাস ও ইবাদতে, চলাফেরা ও কথা-বার্তায় অর্থাৎ জীবনের প্রত্যেক কাজেই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ স্বচ্ছল অবস্থায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা কতই না সুন্দর! দরিদ্রাবস্থায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা কতইনা ভাল! ইবাদতের ক্ষেত্রেও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা কতই না উত্তম।”
(মুসনাদে বাযযার, কানযুল উম্মাল)
১০. খাবার সর্বদা সময় মত খাবে। পেট পূর্ণ করে খাবে না। সর্বদা পানাহারে মগ্ন থাকবে না। ক্ষুধা লাগলেই খাবে আবার ক্ষুধা একটু বাকী থাকতেই খাবার থেকে উঠে যাবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কখনো খাবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “মুমিনগণ এক অন্ত্রনালীতে খায় আর কাফের সাত অন্ত্রনালীতে খায়।” (তিরমিযি)
পাকস্থলীর সুস্থতার উপর স্বাস্থ্য নির্ভরশীল আর অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে পাকস্থলী রুগ্ন হয়ে যায়।
রাসূল (সাঃ) একটি উদাহরণের মাধ্যমে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
“পাকস্থলী শরীরের জন্য হাউজ স্বরূপ এবং রগগুলো ও হাইজ থেকে আর্দ্রতা গ্রহণ কর থাকে। সুতরাং পাকস্থলী সুস্থ ও সবল হলে রগগুলো সুস্থ হবে আর পাকস্থলী রুগ্ন ও দুর্বল হলে রগগুলোও রোগে আক্রান্ত হবে।”
কম খাওয়া সম্পর্কে উৎসাহ দিতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “একজনের খাবারই দুজনের জন্য যথেষ্ট হবে।”
১১. সর্বদা সাদাসিধে খাবারই খাবে। চালনী বিহীন আটার রুটি খাবে, অতিরিক্ত গরম খাদ্য এবং স্বাদ ও রুচির জন্য অতিরিক্ত গরম মসলা ব্যবহার করবেনা। যা সাদাসিধে ও দ্রুত হযম হয় এবং স্বাস্থ্য ও শরীরের পক্ষে কল্যাণকর হয় তা খাবে। শুধু স্বাদ গ্রহণ ও মুখের রুচির জন্য খাবেনা।
রাসূল (সাঃ) না চালা আটার রুটি পছন্দ করতেন, মিহি ময়দার পাতলা চাপাতি পছন্দ করতেন না, অতিরিক্ত গরম যা থেকে ধোঁয়া বের হয় এরূপ খাবার খেতেন না, একটু ঠান্ডা করে খেতেন। গরম খাবার সম্পর্কে কখনও বলতেন, “আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কখনো আগুন খাওয়াননি” আর কখনও বলতেন, “গরম খাদ্যে বরকত নেই।” তিনি গোস্ত পছন্দ করতেন। মূলতঃ শরীরকে শক্তি যোগানোর জন্য গোস্ত একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য। মুমিনের বক্ষ সব সময় বীরত্বের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত থাকা উচিত।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদ না করে মৃত্যু বরণ করল এমনকি তার অন্তরে জিহাদের আকাংখাও ছিলনা, সে ব্যক্তি মুনাফিকীর এক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল।” (মুসলিম)
১২. খাবার অত্যন্ত স্থিরতা ও রুচিসম্মতভাবে খাবে। চিন্তা, রাগ দুঃখ ও ভয়ের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া করবে না। খুশী ও শান্ত অবস্থায় স্থিরতার সাথে যে খাদ্য খাওয়া হয় তার দ্বারা শরীরে শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং দুঃখ-চিন্তা ও ভয়ের সাথে যে খাদ্য খাওয়া হয় তা পাকস্থলীর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে শরীরের চাহিদানুযায়ী শক্তি সৃষ্টি হয় না। খেতে বসে নির্জীব ও চিন্তিত ব্যক্তির ন্যায় চুপ-চাপ খাবেনা আবার হাস্য-রসে উল্লসিত হয়েও উঠবে না। খেতে বসে অট্ট হাসিতে মত্ত হওয়া অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
খাবার সময় মৃদু হাসি ও কথা-বার্তা বলবে, খুশী ও প্রফুল্লতা সহকারে খাবার খাবে এবং আল্লাহ তাআলার দানকৃত নেআমতের শুকরিয়া আদায় করবে। রুগ্নাবস্থায় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য থেকে বিরত থাকবে।
উম্মে মানফার (রাঃ) বলেন যে, একবার রাসূল (সাঃ) আমার ঘরে তাশরীফ আনলেন। আমার ঘরে ছিলো খেজুরের ছড়া লটকানো, হুজুর (সাঃ) ওখান থেকে খেতে আরম্ভ করলেন, হুজুরের সাথে হযরতআলী (রাঃ)ছিলেন, তিনিও খেতে আরম্ভ করলেন, হুজুরের সাথে হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন, তিনিও খেতে আরম্ভ করলেন। তখন রাসূল (সাঃ) তাঁকে বললেন, আলী! তুমি মাত্র রোগ শয্যা থেকে উঠে এসেছো, তাই খেজুর খেয়োনা। সুতরাং হযরত আলী (রাঃ) বিরত রইলেন এবং রাসূল (সাঃ) খেজুর খেতে থাকলেন। উম্মে মানযার (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি কিছু যব ও বীট নিয়ে রান্না করলাম। রাসূল (সাঃ) হযরত আলীকে বললেন, আলী এবার খাও এটা তোমার জন্য উপাদেয়। (শামায়েলে তিরমিযি)
রাসূল (সাঃ) যখন মেহমান নিয়ে খেতে বসতেন তখন মেহমানকে বার বার বলতেন, “খান আরো খান।” মেহমান তৃপ্ত হয়ে গেলে এবং খেতে অস্বীকার করলে তিনি আর একাধিকবার বলতেন না।
অর্থাৎ নবী করিম (সাঃ) অত্যন্ত পছন্দনীয় পরিবেশে ও হাসিখুশী অবস্থায় কথাবার্তার মাধ্যমে খাবার খেতেন।
১৩. দুপুরে খাবার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবে। রাত্রের খাবার পর কিছুক্ষণ পায়চারি করবে। খানা খাবার সাথে সাথে শারীরিক বা মানসিক কোন কঠিন কাজ করবে না।
আরবীতে একটি প্রবাদ আছে-
تَغْدُ تَنْمُوْ تَعْشُ تَمْشِ
অর্থঃ দুপুরের খেয়ে লম্বা হয়ে যাবে-রাতে খেয়ে পায়চারি করবে।
১৪. চোখের নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রাখবে। তীক্ষ্ম আলোর দিকে দৃষ্টি দেবে না। সূর্যের আলো স্থির দৃষ্টিতে দেখবে না। অত্যন্ত ক্ষীণ বা তীক্ষ্ম আলোতে পড়া-লেখা করবে না। পরিষ্কার ও স্বাভাবিক আলোতে লেখাপড়া করবে। অতিরিক্ত রাত জাগা থেকেও বিরত থাকবে, ধুলাবালি থেকে চক্ষুকে নিরাপদ রাখবে। খেত-খামার, বাগান ও শস্য-শ্যামল পরিবেশে ভ্রমণ করেব, সবুজ-শ্যামল বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত চোখের জ্যোতি বাড়ে, চোখকে সর্বদা কুদৃষ্টি থেকে বিরত রাখবে। এর দ্বারা চোখের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয় এবং স্বাস্থ্যের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রাসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের চোখেরও অধিকার আছে।” মুমিনের উপর কর্তব্য যে, সে যেনো আল্লাহ তাআলার ও নেআমতের মর্যাদা রক্ষা করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক তাকে ব্যবহার করে। এমন ধরনের কাজ করবে যার দ্বারা চোখের উপকার হয়। চোখের ক্ষতি হয় এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকবে। তদ্রূপ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শক্তি রক্ষায়ও খেয়াল রাখবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, “হে লোকেরা! তোমরা চোখে সুরমা ব্যবহার করবে, সুরমা চোখের ময়লা দূর করে এবং ভ্রু জন্মায়।” (তিরমিযি)
১৫. দাঁত পরিষ্কার ও সুরক্ষার চেষ্টা করবে। দাঁত পরিষ্কার রাখলে তৃপ্তি বোধ হয়, হযম শক্তি বৃদ্ধি পায় ও দাঁত শক্ত থাকে। মেসওয়াক ও মাজন ইত্যাদির ব্যবহার করবে, পান-তামাক ইত্যাদি বেশী ব্যবহার করে দাঁত নষ্ট করবে না। খাদ্য খাবার পর অবশ্যই দাঁত ভালভাবে পরিষ্কার করবে। দাঁত অপরিষ্কার থাকলে বিভিন্ন প্রকার অসুখ সৃষ্টি হয়। নবী করীম (সাঃ) এর অভ্যাস ছিল যে, তিনি ঘুম থেকে জেড়ে মেসওয়াক দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করে নিতেন। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ)-এর জন্য সব সময় অজুর পানি ও মেসওয়াক প্রস্তুত রাকতাম, যখনই তিনি আল্লাহর নির্দেশ পেতেন তখনই উঠে বসতেন ও মেসওয়াক করে নিতেন। অতঃপর অজু করে নামায আদায় করতেন। (মুসলিম)
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “আমি তোমাদেরকে মেসওয়াক করা সম্পর্কে অনেক গুরুত্ব প্রদান করছি।” (বুখারী)
হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাঃ) বলেছেনঃ “মেসওয়াক মুখ পরিষ্কার ও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে।” (নাসায়ী)
তিনি আরো বলেন, “যদি আমার উম্মতের কষ্ট হবে বলে মনে না করতাম তবে প্রত্যেক ওয়াক্তে মেসওয়াক করার জন্য নির্দেশ দিতাম।” (আবু দাউদ)
একবার কয়েকজন সাহাবী রাসূল (সাঃ) এর দরবারে উপস্থিত হলেন, তাদের দাঁত পরিষ্কার করার অভাবে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল, তিনি তা দেখতে পেয়ে বললেনঃ “তোমাদের দাঁত হলুদ বর্ণ দেখাচ্ছে কেন? মেসওয়াক করবে।” (মুসনাদে আহমাদ)
১৬. পায়খানা-প্রসাব আবশ্যক হওয়ার সাথে সাথেই তা সম্পন্ন করবে। এগুলোকে দমন করতে গেলে পাকস্থলী ও মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
১৭. পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার চেষ্টা করবে। কুরআনে আছে, “আল্লাহ তায়ালা ঐ সকল লোকদেরকে ভালবাসেন, যারা সর্বদা পবিত্র ও পরিষ্কার থাকে।” (সূরায়ে তওবা)
রাসূল (সাঃ) বলেন, “পবিত্রতা ঈমানের অর্দ্ধেক।” পরিষ্কার ও পবিত্রতার গুরুত্বের ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন। মাছি বসা ও পড়া খাবার খাবেনা, হাড়ি-পাতিল পরিষ্কার রাখবে। পোশাকাদি ও শোয়া-বসার বিছানাসমূহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। উঠা-বসার স্থানসমূহ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে। শরীর, পোষাক ও আবশ্যকীয় সকল কিছু পরিষ্কার ও পবিত্রতার দ্বারা আত্মার প্রশান্তি ও প্রফুল্লতা অর্জিত হয় এবং শরীরে আনন্দ ও সজীবতা অনুভূত হয় এবং মানসিক সুস্থতার ওপর সুফল প্রতিফলিত হয়।
একবার রাসূল (সাঃ) হযরত বেলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল কিভাবে তুমি আমার আগে বেহেশতে প্রবেশ করলে? তিনি জবাবে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। যখনই আযান দিই তখনই দুই রাকয়াত নামায আদায় করি আর যখনই অযু ছুটে যায় তখনই আবার অযু করে নেই।
হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ সকল মুসলমানের উপর আল্লাহর একটা হক আছে। সেটা হচ্ছে, প্রতি সপ্তাহে অন্তত পক্ষে একদিন গোসল করবে এবং মাথা ও শরীর ধৌত করবে।” (বুখারী)
পোষাকের নিয়ম
১. এরূপ পোষাক পরিধান করবে যাতে লজ্জা-শরম, মর্যাদাবোধ, আভিজাত্য ও লজ্জা রক্ষার প্রয়োজন পূরণ হয় এবং সভ্যতা সংস্কৃতি, শোভা ও সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায়।
কোরআন মাজিদে আল্লাহ পাক নিজের এ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে ঘোষণা করেছেন।
يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا
“হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য পোষাক প্রদান করেছি যাতে তোমাদের লজ্জা নিবারণ ও রক্ষা পায় এবং তা যেন শোভা ও সৌন্দর্য্যের উপকরণ হয়।”
(সূরায় আরাফ:২৬)
ريش অর্থঃ পাখির পালক। পাখির পালক হলো পাখির জন্য শোভা ও সৌন্দর্য্যের উপায় এবং তার শরীর রক্ষার উপায়ও বটে। সাধারণ ব্যবহারে ريش শব্দটি শোভা সৌন্দর্য্য ও উত্তম পোশাকের জন্য ব্যবহৃত হয়।
পোশাকরে উদ্দেশ্য হচ্ছে সৌন্দর্য্য, সাজ-সজ্জা ও আবহাওয়ার খারাপ প্রতিক্রিয়া থেকে শরীর রক্ষার মাধ্যম। মূল উদ্দেশ্য হলো লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করা। আল্লাহ আয়ালা লজ্জা-শরমকে মানুষের মধ্যে স্বভাবগত ভাবে সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) থেকে যখন বেহেশতের গৌরবময় পোষাক ছিনিয়ে নেয়া হলো তখন তাঁরা লজ্জা নিবারণের জন্য বেহেশতী পাতা ছিঁড়ে তাঁদের শরীর ঢাকতে লাগলেন। অতএব পোশাকের এ উদ্দেশ্যটিকে সর্বাধিক অগ্রগণ্য বলে মনে করবে। এরূপ পোষাক নির্বাচন করবে যার দ্বারা লজ্জা নিবারণের মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয়। সাথে সাথে এ খেয়াল রাখবে যে, পোষাক যেনো ঋতুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচার জন্য উপযোগী হয় আর যে পোষাক পরিধান করলে মানুষ অদ্ভুত অথবা খেলার পাত্রে পরিণত হয় এবং লোকদের জন্য হাসি ও পরিহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়ায় সেই পোষাক পরবে না।
২. পোষাক পরিধান করার সময় এ চিন্তা করবে যে, এটা ঐ নেয়ামত যা আল্লাহ তাআলা মানুষদেরকে দান করেছেন। অন্যান্য সৃষ্টি এ নেয়ামত থেকে বঞ্চিত, এ সম্মানিত দান ও পুরস্কারে ভূষিত হয় কখনও অকৃতজ্ঞতা ও নাফরমানী প্রদর্শন করবে না। পোষাক আল্লাহর এক স্মারক চিহ্ন। পোষাক পরিধান করে উপরোক্ত নেয়ামতের কথা নতুন করে স্মরণ করবে এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে এমন দোআ পড়বে যা রাসূল (সাঃ) মুমিনদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।
৩. সংযমশীলতা হচ্ছে উত্তম পোষাক, সংযমশীলতার পোষাক দ্বারা আধ্যাত্মিক এবং বাহ্যিক পবিত্রতা হাসিল হয়।
অর্থাৎ এরূপ পোষাক পরিধান করবে যা শরীয়তের দৃষ্টিতে সংযমশীলতা প্রকাশ পায়। মহিলাদের পোষাক যেন পুরুষদের সাথে সাদৃশ্যের কারণ না হয় এবং পুরুষদের পোষাক যেন মহিলাদের সাথে সাদৃশ্যের অছিলা না হয়। এমন পোষাক পরিধান করবে যা দেখে পোষাক পরিধানকরীকে আল্লাহ ভক্ত ও ভাল মানুষ মনে হয়। মহিলাগণ পোষাকের বেলায় ঐ সকল সীমারেখার কথা মনে রাখবে যা শরীয়ত তাদের জন্য নির্দ্ধারিত করেছে আর পুরুষগণও পোষাকের বলোয় ঐ সকল সীমারেখার কথা স্মরণ রাখবে যা শরীয়ত তাদের জন্য পূর্বেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
৪. নতুন পোষাক পরিধান করার সময় খুশী প্রকাশ করবে যে, আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে আমাকে এ কাপড় দান করেছেন এবং ঐ দোয়া পাঠ করবে যা রাসূল (সাঃ) পাঠ করতেন।
আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলাল্লাহ (সাঃ) যখন কোন নতুন কাপড়, পাগড়ী, জামা অথবা চাদর পরিধান করতেন তখন ঐ নতুন কাপড়ের নাম ধরে বলতেন,
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ ، أَنْتَ كَسَوْتَنِيهِ ، أَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِهِ وَخَيْرِ مَا صُنِعَ لَهُ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهِ وَشَرِّ مَا صُنِعَ لَهُ (ابو دادد)
“হে আল্লাহ!তোমার শোকর, তুমি আমাকে এ কাপড় পরিধান করিয়েছ, আমি তোমার নিকট কল্যাণকারীতার প্রত্যাশী যে কল্যাণের উদ্দেশ্যে এ কাপড় তৈরী করা হয়েছে এবং আমি তোমার আশ্রয় চাচ্ছি, এ কাপড়ের মন্দ থেকে।”
(আবু দাউদ)
দোআর অর্থ এই যে, হে আল্লাহ! আমি যেন তোমার পোষাক ভাল উদ্দেশ্যে পরিধান করতে পারি যে উদ্দেশ্য তোমার নিকট মহৎ ও পবিত্র। তুমি আমাকে তাওফীক দান কর যেন আমি লজ্জা-নিবারণ করতে পারি এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে নির্লজ্জতা থেকে মুক্ত থাকতে পারি আর শরীয়তের গন্ডির ভেতরে থেকে যেনো নিজের শরীরকে রক্ষা করতে পারি এবং যেনো গৌরব ও অহঙ্কার না করি, এ নেয়ামত প্রাপ্তির জন্য শরীয়তের সীমারেখা যেন লংঘন না করি যা তুমি তোমার বান্দাদের জন্য নির্দ্ধারিত করে দিয়েছ।
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নতুন কাপড় পরিধান করবে তার পক্ষে সম্ভব হলে পুরনো কাপড়টি কোন গরীব ব্যক্তিকে দান করে দেবে আর নতুন কাপড় পরিধান করার সময় এই দোয়াটি পড়বে।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي كَسَانِي مَا أُوَارِي بِهِ عَوْرَتِي , وَأَتَجَمَّلُ بِهِ فِي حَيَاتِي –
“সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ পাকের জন্য যিনি আমাকে কাপড় পরিধান করিয়েছেন এবং যার দ্বারা আমি লজ্জা নিবারণ করি ও আমার জীবনে শোভা ও সৌন্দর্য্য লাভ করি।
যে ব্যক্তি নতুন কাপড় পরিধান করার সময় এ দোআ পাঠ করবে, তাকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে স্বয়ং নিজের নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণে রাখবেন। (তিরমিযী)
৫. কাপড় পরার সময় ডান দিক থেকে আরম্ভ করবে, জামা শেরওয়ানী ও কোট-এর প্রথমে ডান আস্তিন পরবে, পায়জামা-প্যান্ট ইত্যাদিও। রাসূল (সাঃ) যখন জামা পরতেন তখন প্রথমে ডান হাত আস্তিনে প্রবেশ করাতেন, তৎপর বাম হাত বাম আস্তিনে প্রবেশ করাতেন। অনুরূপ প্রথমে ডান পা ডান পায়ের জুতায় প্রবেশ করাতেন অতঃপর বাম পা বাম পায়ের জুতায় প্রবেশ করাতেন। জুতা খুলবার সময় প্রথম বাম পায়ের জুতা খুলতেন তৎপর ডান পায়ের জুতা খুলতেন।
৬. কাপড় পরার আগে ঝেড়ে নেবে। কাপড়ের ভেতর কোন কষ্টদায়ক প্রাণী থাকতে পারে (আল্লাহ না করুন) তা কষ্ট দিতে পারে। রাসূল (সাঃ) একবার এক জঙ্গলে মোজা পরছিলেন। প্রথম মোজা পরিধান করার পর যখন দ্বিতীয় মোজা পরিধান করতে উদ্যত হলেন এমন সময় এটি কাক উড়ে এসে মোজাটি নিয়ে গেল এবং উপরে নিয়ে ছেড়ে দিল, মোজা উপর থেকে নিচে, পড়ার পর মোজা থেকে এক বিষাক্ত সাপ দূরে ছিটকে পড়ল। তা দেখে তিনি আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে বললেনঃ “প্রত্যেক মুমিনের মোজা পরিধান করার সময় তা ঝেড়ে নেয়া উচিত।”
৭. সাদা রংয়ের পোষাক পরিধান করবে, কেননা সাদা পোষাক পুরুষের জন্য পছন্দনীয়। রাসূল (সাঃ) বলেন, “সাদা কাপড় পরিধান করবে ইহা উত্তম পোশাক। জীবিতাবস্থায় সাদা কাপড় পরিধান করা উচিৎ এবং সাদা কাপড়েই মৃতকে দাফন করা উচিৎ। (তিরমিযী)
তিনি বলেন, “সাদা কাপড় পরিধান করবে। সাদা বেশী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে এবং এতে মৃতদের দাফন করবে।”
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার অর্থ হলো, সাদা কাপড়ে যদি সামান্যতম দাগও লাগে তবে তা সহজেই দৃষ্টিগোচরও হবে বলে মানুষ তাড়াতাড়ি তা ধুয়ে পরিষ্কার করে নেবে। আর রঙ্গীন কাপড়ে দাগ পড়লে তা সহজে দৃষ্টি গোচর হয় না তাই তা তাড়াতাড়ি ধুয়ে পরিষ্কার করারও প্রয়োজন হয় না। (তা অপরিষ্কারই থেকে যায়)।
রাসূল (সাঃ) সাদা পোষাক পরিধান করতেন অর্থাৎ তিনি নিজেও সাদা পোষাক পছন্দ করতেন এবং উম্মাতের পুরুষদেরকেও সাদা পোষাক পরতে উৎসাহ দিয়েছেন।
৮. পায়জামা, লুঙ্গি ইত্যাদি গিরা ঢেকে পরবেনা। যারা অহংকার ও গৌরব প্রকাশের ইচ্ছায় পায়জামা, প্যান্ট ও লুঙ্গি ইত্যাদি গিরার নিচে পরিধান করে তারা রাসূল (সাঃ)-এর দৃষ্টিতে বিফল মনোরথ ও কঠিন আযাবগ্রস্থ। রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেনঃ “তিন ধরনের লোক আছে যাদের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না এবং রহমতের দৃষ্টি দেবেন না। আর তাদেরকে পাক-পবিত্র করে বেহেশতেও প্রবেশ করাবেন না। তাদের কঠিন শাস্তি দেবেন। হযরত আবুযর গিফারী (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! এ হতভাগ্য লোকগুলো কারা? তিনি বললেন-
(ক) যারা গিরার নিচে কাপড় পরে।
(খ) যারা উপকার করে পরে খোটা দেয়।
(গ) যারা মিথ্যা শপথ পূর্বক ব্যবসা বাড়াতে চায়। (মুসলিম)
হযরত ওবাইদ বিন খালেদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি একবার মদীনা মুনাওয়ারা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। পেছন থেকে বলতে শুনলাম যে, “তহবন্দ ওপরে উঠাও। এর দ্বারা লোকেরা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে অপবিত্রতা থেকে রক্ষা পায়।” আমি পিছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম যে, রাসূল (সাঃ)। আমি বললাম, ইয়া রাসূলল্লাহ, এটা তো একটি সাধারণ চাদর। এতে কি আর গৌরব ও অহংকার হতে পারে? রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “তোমার জন্য আমার অনুসরণ করা কি কর্তব্য নয়? হুজুরের কথা শুনা মাত্র আমার দৃষ্টি তাঁর তহবন্দের প্রতি পড়ল। দেখতে পেলাম যে, হুজুরের তহবন্দ পায়ের অর্দ্ধেক গোছার উপরে।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “পায়জামা তহবন্দ ইত্যাদি গিরার উপরে রাখলে মানুষ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সর্ব প্রকার অপবিত্রতা থেকে রক্ষা পায়।”
এ কথাটি বড়ই অর্থবোধক! এর উদ্দেশ্য হলো এই যে, কাপড় নীচের দিকে ঝুলে থাকলে রাস্তার আবর্জনায় কাপড় ময়লা ও নষ্ট হবে। পাক রাখতে পারবেনা। এ কাজটি পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার একান্ত পরিপন্থী। অহংকার ও গৌরবের কারণে এমন হয়, গৌরব ও অহংকার হলো অপ্রকাশ্য আবর্জনা। একজন মুমিনের জন্য আল্লাহর এ ঘোষণাই যথেষ্ট যে, “আল্লাহর রাসূলের জীবনই তোমাদের জন্য অতি উত্তম আদর্শ।” (আল কোরআন)
আবু দাউদে উল্লেখিত এক হাদীসে তো তিনি ভয়ানক শাস্তির কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ
“মুমিনের তহবন্দ পায়ের গোছা পর্যন্ত হওয়া উচিত এবং তার নীচে গিরা পর্যন্ত হলেও কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু গিরার নীচে যতটুকু পর্যন্ত থাকবে ততোটুকু জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। আর যে ব্যক্তি গৌরব ও অহংকারের কারণে নিজের কাপড় গিরার নীচে লটকাবে তার প্রতি কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না।”
৯. রেশমী কাপড় পরিধান করবে না, কেননা এটা মহিলাদের পোশাক। রাসূল (সাঃ) পুরুষদেরকে মহিলাদের মত পোষাক পরিধান করতে আর তাদের মত ছুরত ধারণ করতে নিষেধ করেছেন।
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ রেশমী পোষাক পরিধান করো না, যে দুনিয়াতে পরিধান করবে সে আখেরাতে পরিধান করতে পারবে না।” (বুখারী-মুসলিম)
একবার রাসূল (সাঃ) আলী (রাঃ) কে বলেনঃ “রেশমী কাপড়টি[1] কেটে ওড়না তৈরী কর এবং ফাতেমাদের[2] মধ্যে বন্টন করে দাও। (মুসলিম)
উপরোক্ত হাদীসের মর্মানুযায়ী বুঝা যায় যে, মহিলাদের জন্য রেশমী কাপড় পরিধান করা অধিক পছন্দনীয়। সুতরাং তিনি নির্দ্দেশ দিয়েছেন যে, মহিলাদের ওড়না তৈরী করে দাও, অন্যথায় কাপড়খানা তো অন্য কাজেও লাগানো যেতো।
১০. মহিলারা পাতলা কাপড় পরিধান করবেনা যাতে শরীর দেখা যায় আর এরূপ আটসাট পেশাকও পরিধান করবেনা যার মধ্য থেকে শরীরের গঠন প্রকৃতি আরো আকর্ষণীয়ভাবে প্রদর্শিত হয়। আর তারা কাপড় পরিধান করা সত্বেও উলঙ্গ পরিগণিত হবে। রাসূল (সাঃ) এরূপ নির্লজ্জ মহিলাদের পরকালে কঠিন শাস্তির সংবাদ দিয়েছেন।
“যারা কাপড় পরিধান করা সত্বেও উলঙ্গ থাকে, তারা নিশ্চিত জাহান্নামী। তারা অপরকে সম্মোহিত করে আর নিজেরাও অপরের উপর সম্মোহিত হয়। তাদের মাতা প্রসিদ্ধ বুখত নগরের বড় উটের চোঁটের ন্যায় বাঁকা অর্থাৎ এরা চলার সময় অহংকারের কারণ ঘাড় হেলিয়ে দুলিয়ে চলে, এ সকল মহিলা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধও পাবেনা। বস্তুতঃ জান্নাতের সুগন্ধ বহুদূর থেকে পাওয়া যাবে।
(রিয়াদুস সালেহীন)
একবার হযরত আসমা (রাঃ) পাতলা কাপড় পরিধান করে রাসূল (সাঃ)এর দরবারে উপস্থিত হলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, আসমা! মেয়েরা যখন যুবতী হয় তখন তাদের জন্য মুখ ও হাত ব্যতীত শরীরের অন্য কোন অংশ দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত নয়।
১১. তহবন্দ ও পায়জামা পরার পরও এমনভাবে বসা বা শোয়া উচিত নয়-যাতে শরীরের গোপনীয় অংশ প্রকাশ হয়ে যাবার বা দেখা যাবার সম্ভাবনা থাকে।
রাসূল (সাঃ)বলেনঃ “এক পায়ে জুতা পরে হাঁটবেনা, তহবন্দ পরিধান করে এক হাটু পর্যন্ত উঠিয়ে বসবে না,বাম হাতে খাবে না, সারা শরীরে চাদর এভাবে পরিধান করবেনা যে, কাজ-কাম করতে, নামায আদায় করহে এবং হাত বের করতে অসুবিধা হয়। চিৎ হয়ে শুয়ে এক পায়ের উপর অন্য পা রাখবে না।
১২. মহিলা ও পুরুষরা এক ধরনের পোষাক পরিধান করবে না। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ ঐ সকল পুরুষদের ওপর লা’নত করেছেন যারা মহিলাদের মত পোষাক পরে; আর ঐ সকল নারীদের উপরও লা’নত করেছেন যারা পুরুষদের মত পোষাক পরে।”
(বুখারী)
হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ)বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ঐ পুরুষের ওপর অভিশাপ, যে নারীর মত পোষাক পরিধান করে।”
(আবুদাউদ)
একবার হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিকট কেউ বললেন যে, এক মহিলা পুরুষের অনুরূপ জুতা পরিধান করে; তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এসব মহিলাদের ওপর অভিশাপ করেছেন যারা পুরুষ সাজার চেষ্টা করে।”
১৩. মহিলাগণ ওড়না ব্যবহার করবে এবং তা দ্বারা মাথাও ঢেকে রাখবে। এমন পাতলা ওড়না পরবে না যার মধ্যে থেকে মাথার চুল দেখা যায়, উড়না পরিধান করার মূল উদ্দেশ্যই হ’ল সৌন্দর্য্যকে গোপন করা।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেনঃ
وَلْيَضْرِبنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوْبِهِنَّ
মহিলারা নিজেদের বক্ষস্থলের উপর উড়না ফেলে রাখবে।
একবার রাসূল (সাঃ)-এর নিকট মিশরের তৈরী কিছু পাতলা মখমল কাপড় আসল এবং তিনি তা থেকে কিছু কাপড় হাদিয়া স্বরূপ ক্বালবী (রাঃ)-কে দিয়ে বললেন যে, এটা থেকে একাংশ কেটে নিজের জন্যে জামা তৈরী করবে আর একাংশ দিয়ে তোমার স্ত্রীর জন্যে ওড়না তৈরী করতে দাও। কিন্তু তাকে বলে দিবে যে, তার নীচে যেনো একটা অন্য কাপড় লাগিয়ে নেয় যাতে শরীরের গঠন বাহির থেকে দেখা না যায়।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, “এ নির্দেশ নাযিলের পর মহিলারা পাতলা কাপড় ফেলে দিয়ে মোটা কাপড়ের ওড়না তৈরী আরম্ভ করলেন। (আবু দাউদ)
১৪. পোষাক নিজের ক্ষমতা ও মর্যাদা অনুযায়ী পরিধান করবে। এরূপ পোষাক পরবেনা যা দ্বারা নিজের অহংকার ও আড়ম্বর প্রদর্শিত হয় এবং অপরকে হেয় প্রতিপন্নপূর্বক নিজের অর্থের প্রাচুর্য্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য হয়। আর নিজের ক্ষমতার বর্হিভূত উচ্চ মূল্যের পোশাকও পরবেনা যদ্দরুন অযথা ব্যয় বাহুল্যের পাপে পতিত হতে হয়। আবার অত্যন্ত নিকৃষ্ট্ মানের পোষাক পরিধান করে সহায়-সম্বলহীনের বেশ ধারণ করে অপরের নিকট হেয় প্রতিপন্ন হবে না বরং সর্বদা নিজের ক্ষমতনুযায়ী রুচিপূর্ণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করবে।
অনেকে এমন আছে যারা ছেড়া কাপড়,তালি দেওয়া কাপড় পরিধান করে সহায়-সম্বলহীনের বেশ ধারণ করে বেড়ায় এবং এটাকে পরহেযগারী বলে মনে করে। এতটুকু যথেষ্ট নয় বরং যারা রুচিশীল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করে প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে দুনিয়াদার বলে মনে করাও ভূল।
একবার প্রখ্যাত ছুফী হযরত আবুল হাসান আলী শাযালী অত্যন্ত দামী কাপড় পরিহিত ছিলেন, এক ছুফী তাঁকে এমতাবস্থায় দেখে প্রতিবাদ করে বললেন যে, আল্লাহ ওয়ালাদের এত মূল্যবান জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক পরার কি প্রয়োজন? হযরত শাযালী বললেন, ভাই! এটা হলো মহান প্রতাপশালী মহা শক্তিশালী আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। আর তোমার এ সহায়-সম্বলহীনতা হলো ভিক্ষুকদের মতো, তুমি এ অবস্থার দ্বারা মানুষের নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করছ। প্রকৃতপক্ষে ছেড়া-ফাটা পুরনো, তালি দেওয়া নিম্ন মানের কাপড় পরিধান করার মধ্যেই পরহেযগারী সীমাবদ্ধ নয় এবং অত্যন্ত মূল্যবান গৌরবময় পোষাক পরিধান করার মধ্যেও নয়। পরহেযগারী মানুষের নিয়ত ও সার্বিক চিন্তাধারার উপর নির্ভরশীল। প্রকৃত সত্য কথা হলো মানুষ তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের ক্ষমতানযায়ী মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে সমতা রক্ষা করে চলবে। সহায়-সম্বলহীনতার বেশ ধারণ করে নিজের আত্মাকে অহংকারী হওয়ার সুযোগ দিবে না আর চমক লাগানো মূল্যবান চাকিচিক্যময় পোষাক পর গৌরব ও অহংকারও প্রদর্শণ করবে না।
হযরত আবু আহ্ওয়াছ (রাঃ) এর পিতা নিজের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন যে, আমি একবার নবী করিম (সাঃ)-এর দরবারে অত্যন্ত নিম্ন মানের কাপড়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি ধন-সম্পদ আছে?” আমি বললাম, জী আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কি ধরনের সম্পদ আছে আমি বললাম, আল্লাহ তাআলা আমাকে উট, গরু, বকরী, ঘোড়া, গোলাম ইত্যাদি সব প্রকার সম্পদই দান করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা যখন তোমাকে সব ধন-সম্পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন তখন তোমার শরীরেও তার দান ও অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে উচিৎ।
অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা যখন তোমাকে পর্যাপ্ত নেয়ামত দান করেছেন তখন তুমি নিঃস্ব ভিক্ষুকদের বেশ ধারণ করেছ কেন? এটাতো আল্লাহ তা’আলার নেয়ামতের না শোকরী!
হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, একদা রাসূল (সাঃ) আমাদের বাড়ীতে এলেন, তখন তিনি এক ব্যক্তিকে ধুলাবালি মিশ্রিত এবং তার মাথার চুলগুলো এলোমেলোভাবে দেখতে পেলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, তার নিকট কি একটা চিরুনীও নেই যে, সে মাথার চুলগুলো একটু ঠিক করে নিতে পারে? অন্য এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন যে,সে ময়লা কাপড় পরে আছে।তিনি বললেন, এর নিকট কি সাবান-সোডা জাতীয় এমন কোন জিনিস নেই যার দ্বারা কাপড়গুলো পরিষ্কার করে নিতে পারে? (মেশকাত)
এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার শখ হয় যে আমার পোষাক সুন্দর হোক, মাথায় তেল থাকুক, জুতাগুলোও উত্তম হোক। এভাবে অনেকগুলো জিনিসের কথা বললো। এমন কি সে বললো, আমার হাতের লাঠিটিও অত্যন্ত সুন্দর হোক!রাসূল (সাঃ) তদুত্তরে বললেন, “এসব কথা পছন্দনীয়, আর আল্লাহ তা’আলাও সুন্দর রুচিকে ভালবাসেন।”
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! আমার উত্তম কাপড় পরাটা কি গৌরব ও অহংকার হবে? তিনি বললেন, “না, ইহা তো সৌন্দর্য্য আর আল্লাহ তা’আলা সৌন্দর্য্যকে ভালবাসেন”
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “নামাযের জন্যে উত্তম কাপড় পরিধান করে যাবে। আল্লাহর তাআলার নিকট অত্যধিক যোগ্য সেই ব্যক্তি যে তাঁর দরবারে উপস্থিতির সময় (অর্থাৎ নামায আদায় কালে) ভালোভাবে সেজে গুজে যায়।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “ যার অন্তরে অনু পরিমাণও অহঙ্কার আছে সে বেহেশতে যেতে পারবেনা।” এক ব্যক্তি উঠে বললো, (ইয়া রাসূলাল্লাহ!)প্রত্যেক ব্যক্তিই তো এটা চায় যে, তার কাপড় এবং জুতা জোড়া সুন্দর হোক। (এও কি অহংকারের অন্তর্ভূক্ত?) রাসূল (সাঃ) বলেন, আল্লাহ সুন্দর, সুন্দরকে ভাল বাসেন। (অর্থাৎ উত্তম পোষাক অহংকারের নয় বরং উহা সৌন্দর্য্যের অন্তর্ভূক্ত।) প্রকৃতপক্ষে অহংকার হলো সত্যের পরোয়া না করা আর পরকে হীন ও নিকৃষ্ট মনে করা।” (মুসলিম)
১৫. পোশাক-পরিচ্ছদ সাজসজ্জা ও শালীনতার প্রতিও পূর্ণ দৃষ্টি রাখবে। জামার বুক খোলা রেখে ঘোরা-ফিরা করা, আড়াআড়িভাবে বুতাম লাগান, পায়জামার এক পা ওপরে উঠিয়ে রাখা, অন্য পা নীচে রাখা, অথবা চুল এলোমেলো রাখা ইত্যাদি রুচি ও শালীনতা বিরোধী।
একদিন রাসূল (সাঃ) মসজিদে (নববীতে)ছিলেন, এমন সময় উস্ক খুস্কু চুল দাড়ি নিয়ে এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলো, রাসূল (সাঃ) তার প্রতি হা দ্বারা চুলদাড়ি ঠিক করে আসতে ইঙ্গিত করলেন। তখন ঘরে গিয়ে চুল-দাড়ি পরিচর্যা করে আসলো। অতঃপর রাসূল (সাঃ) বললেন, “মানুষের চুল এলোমেলো থাকার চাইতে সুন্দর ও পরিপাটি করে রাখা কি উত্তম নয়?
হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “এক পায়ে জুতা পরে কেউ যেন চলাফেরা না করে, হয়তো উভয়টি পরবে অথবা খালি পায়ে চলবে”।
১৬. লাল, উজ্জল চমৎকার রং, কাল এবং গেরুয়া রং এর পোষাক পরবেনা। লাল উজ্জ্বল ঝিকমিক রং এবং জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক শুধুমাত্র মহিলাদের জন্যই শোভা পায়। তবে তাদেরও সীমা লংঘন করা উচিৎ নয়।আশ্চর্য ধরনের হাসির উদ্রেককারী পোষাক পরবে না যা পরিধান করলে অনর্থক বেঢং-অদ্ভুত দেখা যায় আর লোকেরা হাসি-ঠাট্টা ও পরিহাস করার জন্যে উৎসাহিত হয়।
১৭. সাদা, রুচিশীল পোষাক পরিধান করবে। পোশাকের ব্যাপারে বিলাসিতা ও প্রয়োজনের অধিক মাধুর্য্য পরিহার করে চলবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, “বিলাসিতা থেকে দূরে থেকো কেননা আল্লাহর নেক বান্দাগণ বেশী বিলাসপ্রিয় হয় না।” (মেশকাত)
রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন, “যে ব্যক্তি শক্তি ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শুধু মিনতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে সাদা-সিধা পোষাক পরিধান করে আল্লাহ তাআলা তাকে আভিজাত্যের পোশাকে ভূষিত করবেন। (আবু দাউদ)
সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) একদিন একত্রে বলে দুনিয়া সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, “সাদা-সিধা পোষাক ঈমানের আলামতসমূহের মধ্যে একটি। (আবু দাউদ)
একবার রাসূল (সাঃ) বললেন, “আল্লাহ তা’আলার এমন কিছু বান্দাহ আছে যাদের বাহ্যিক বেশ-ভূষা থাকে অত্যন্ত সাধা-সিধে। তাদের চুলগুলো পরিপাটি, পরনের কাপড়গুলো সাদা-সিধে ও মলিন, কিন্তু তাদের মর্যাদা এত বেশী যে তারা যদি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে তবে আল্লাহ তা’আলা তাদের পূর্ণ করে দেন। এ ধরনের লোকদের মধ্যে বারা বিন মালেক একজন”। (তিরমিযী)
১৮. আল্লাহ তা’আলার এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় স্বরূপ সে সব গরীবদেরকেও বস্ত্রদান করবে, যাদের শরীর ঢাকার মত কোন বস্ত্র নেই। রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে বস্ত্র দ্বারা তার শরীর আবৃত করল কাল কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা বেহেস্তের সবুজ পোষাক পরিধান করিয়ে তার শরীরও আবৃত করবেন”। (আবু দাউদ)
তিনি এও বলেছেন যে, “ কোন ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইকে বস্ত্র দিলে যতদিন ঐ বস্ত্র তার পরনে থাকবে ততদিন পর্যন্ত সে ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা নিজের হেফাজতে রাখবেন”।
১৯. যে সকল চাকর দিন রাত আপনার সেবায় নিয়োজিত তাদেরকে আপনার মর্যাদানুযায়ী উত্তম পোষাক পরাবেন।
রাসূল (সাঃ) বলেন, “দাস-দাসীরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাদেরকে যার অধীনস্থ করে দিয়েছন তার উচিত তাদেরকে তাই খাওয়ান যা সে নিজে খায়, আর তাদেরকে তাই পরাবে যা সে নিজে পরে। তাকে দিয়ে ততটুকু কাজ করাবে যতটুকু তার পক্ষে সম্ভব। অর্পিত কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব না হলে নিজেও অংশ করে তাকে সাহায্য করবে”।
পানাহারের আদবসমূহ
১. খাবার আগে হাত ধুয়ে নিবে। খাবারে ব্যবহৃত হাত পরিষ্কার থাকলে অন্তরেও শান্তি অনুভব হয়।
২. ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে খাওয়া শুরু করবে, ভুল হয়ে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্রই ‘বিসমিল্লাহি আউয়ালাহু ওয়া আখিরাহু’ বলবে। স্মরণ রাখবে, যে খাদ্যে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় না ঐ খাদ্য শয়তান নিজের জন্যে বৈধ করে নেয়।
৩. খাবার সময় হেলান দিয়ে বসবে না। বিনয়ের সাথে পায়ের তালু মাটিতে রেখে হাঁটু উঠিয়ে বসবে অথবা দুই হাঁটু বিছিয়ে (সালাতের ন্যায়) বসবে অথবা এক হাঁটু বিছিয়ে অপর হাঁটু উঠিয়ে বসবে কেননা আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এভাবে বসতেন।
৪. ডান হাতে খাবে তবে আবশ্যক বোধে বাম হাতের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
৫. তিন আঙ্গুলে খাবে, তবে আবশ্যক বোধে কনিষ্ঠাঙ্গুলী ছাড়া চার আঙ্গুলে খাওয় যাবে। আঙ্গুলের পর্যন্ত খাদ্য বস্তু লাগাবে না। (অর্থাৎ সারা হাতকে বিশ্রী করবে না। রুটি বা শুকনো খাদ্য খেতে তিন বা চার আঙ্গুলই যথেষ্ট তবে ভাত খেতে পাঁচ আঙ্গুলের প্রয়োজন হয়।
৬. লোকমা একেবারে বড়ও নেবেনা আবার একেবারে ছোটও নেবেনা। এক লোকমা গলাঃকরণ করার পর অন্য লোকমা নেবে।
৭. রুটি দ্বারা কখনও হাত পরিষ্কার করবে না। এটা অত্যন্ত ঘৃণিত অভ্যাস।
৮. রুটি ঝেড়ে বা আছড়িয়ে নেয়া ঠিক নয়।
৯. প্লেট থেকে নিজের দিক থেকে খাবে, প্লেটের মাঝখানে থেকে বা অপরের দিক থেকেও খাবেনা।
১০.খাদ্য বস্তু পড়ে যেলে তা উঠিয়ে পরিষ্কার করে অথবা ধুয়ে খাবে।
১১. সবাই একত্রে বসে খাবে, এভাবে খেলে পারস্পরিক স্নেহ-ভালবাসা বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্যে বরকতও হয়।
১২. খাদ্যে কখনও দোষ বের করবে না, পছন্দ না হলে খাবেনা।
১৩. মুখ পুড়ে যায় এমন গরম খাদ্য খাবে না।
১৪. খাবার সময় আট্টহাসি হাসা এবং অতিরিক্ত কথা বলা থেকে যতদূর সম্ভব বিরত থাকবে।
১৫. বিনা প্রয়োজনে খাদ্য বস্তুকে শুঁকবে না। খাবার সময় বার বার এমনভাবে মুখ খুলবে না যেন চিবানো খাদ্য অপরের দৃষ্টি গোচর হয় এবং বার বার মুখে হাত দিয়ে দাঁত থেকে কিছু বের করবে না, করাণ এতে লোকদের ঘৃণার উদ্রেক হয়।
১৬. খাবার বসে খাবে এবং পানিও বসে পান করবে। প্রয়োজনবোধে ফলাদি দাঁড়িয়ে খাওয়া যাবে এবং পানিও পান করা যাবে।
১৭. প্লেটে উচ্ছিষ্ট অবশিষ্ট খাদ্য তরল জাতীয় হলে পান করে নেবে আর ঘন জাতীয় হলে মুছে থালা পরিষ্কার করবে।
১৮. খাবার জিনিসে ফুঁ দেবেনা, কারণ পেটের অভ্যন্তর থেকে আসা শ্বাস দুর্গন্ধযুক্ত ও দূষিত হয়।
১৯. পানি তিন নিঃশ্বাসে থেমে থেমে পান করবে, এতে তৃপ্তিও হয়, তাছাড়া পানি এক সাথে পেটে ঢেলে দিলে অনেক সময় কষ্টও অনুভব হয়।
২০. একত্রে খেতে বসলে দেরীতে ও ধীরে ধীরে খাওয়ার লোকদের প্রতি খেয়াল রাখবে এবং সকলের সাথে একসাথে খাবার থেকে অবসর হবে।
২১. আঙ্গুল চেটে খাবে তারপর হাত ধুয়ে নিবে।
২২. ফল-ফলাদি খাবার সময় একসাথে দুইটা বা দু ফালি মুখে দেবে না।
২৩. ভাঙ্গা লোটা, সোরাই ইত্যাদি দ্বারা পানি পান করবে না। এমন পাত্রে পান করবে যার থেকে পানি দৃষ্টিগোচর হয় যেনো কোন পচা বা ক্ষতিকর বস্তু পেটে না ঢুকে যায়।
২৪. খাবার থেকে অবসর হয়ে এ দোআ পাঠ করবে।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا وَجَعَلَنَا مُسْلِمِينَ
“সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্যে যিনি আমাদেরকে পানাহার করিয়েছেন এবং মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
নিদ্রা ও জাগ্রত হওয়ার নিয়মনীতি
১. সন্ধ্যায় অন্ধকার ঘনিয়ে আসলে শিশুদেরকে ঘরে ডেকে আনবে এবং বাইরে খেলতে দেবেনা। রাত্রের কিছু অংশ অতিবাহিত হবার পর বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া যেতে পারে। সাবধানতা হিসেবে একান্ত অবশ্যকতা ব্যতীত শিশুদেরকে ঘর থেকে বাইরে যেতে দেয়া উচিৎ নয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যখন সন্ধ্যা হয় তখন ছোট শিশুদেরকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখবে। কেননা, এ সময় শয়তানের দল (দুষ্ট জ্বিনেরা) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে,তবে রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর শিশুদেরকে ছেড়ে দিতে পার।” (সিয়াহ সিত্তাহ, হেছনে হাছীন)
২. সন্ধ্যায় এ দোআ’পাঠ করবে। রাসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে এ দোআ পাঠ করতে শিক্ষা দিতেন।
اللّهُـمَّ بِكَ أَمْسَـينا وَبِكَ أَصْـبَحْنا، وَبِكَ نَحْـيا وَبِكَ نَمُـوتُ وَإِلَـيْكَ النُّشُوْرِ (ترمذى)
“আয় আল্লাহ! আমরা তোমারই অনু্গ্রহে সন্ধ্যা পেয়েছি, তোমারই সাহায্যে ভের পেয়েছি, তোমারই দয়ায় জীবিত আছি, তোমারই নির্দেশে মৃত্যুবরণ করব আর শেষ পর্যন্ত তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করব।”
(তিরমিযী)
মাগরিবের আযানের সময় এ দোআ পাঠ করবে।
اللَّهُمَّ هَذَا إِقْبَالُ لَيْلِكَ وَإِدْبَارُ نَهَارِكَ وَأَصْوَاتُ دُعَاتِكَ ، فَاغْفِرْ لِي (ترمذى ابو داود)
“হে আল্লাহ! এটা তোমার রাতের আগমনের সময়, তোমার দিনের প্রস্থানের সময়। তোমার আহ্বানকারীদের আহ্বানের সময়, তুমি আমাকে ক্ষমা কর।” (তিরমিযী, আবু দাউদ)
৩. এশার নামায আদায়ের আগি নিদ্রা যাবে না। এমতাবস্থায় অধিকাংশ সময় এশার নামায বাদ পড়ার ভয় থাকে, আর এমনও হতে পারে যে, হয়তো এ নিদ্রাই চির নিদ্রা হবে। রাসূল (সাঃ) এশার নামাজের পূর্বে কখনও নিদ্রা যেতেন না।
৪. রাত হওয়া মাত্রই ঘরে আলো জ্বালাবে। আলো জ্বালান হয়নি এমন ঘরে রাসূল (সাঃ) নিদ্রা যেতেন না।
৫. অনেক রাত পর্যন্ত জাগ্রত থাকবে না। রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে ও শেষরাতে তাড়াতাড়ি উঠতে অভ্যাস করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেন, এশার নামাযের পর আল্লাহ তাআলার যিকিরের জন্যে জাগ্রত থাকতে পারবে অথবা ঘরের লোকদের সাথে আবশ্যকীয় কথা-বার্তা বলার জন্যে জাগ্রত থাকা যাবে।
৬. রাত্রে জেগে দিনে নিদ্রা যাবে না। আল্লাহ তাআলা রাতকে সুখ ও শান্তির জন্যে সৃষ্টি করেচেন আর দিনকে জাগ্রত থাকা এবং জরুরী কাজে পরিশ্রম করার সময় হিসেবে নির্ধারিত করেছেন।
পবিত্র কোরআনে সূরা আল-ফুরক্বানের ৪৭ নং আয়াতে আছেঃ
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِبَاسًا وَالنَّوْمَ سُبَاتًا وَجَعَلَ النَّهَارَ نُشُورًا
“তিনি আল্লাহ যিনি রাতকে তোমাদের জন্যে পর্দাস্বরূপ, নিদ্রাকে সুখ ও শান্তির জন্যে এবং দিনকে (রুজীর সন্ধানে) ছড়িয়ে পড়ার জন্যে সৃষ্টি করেছেন।” সূরা আন নাবায় আছে-
وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا ، وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا ، وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا
“আমি তোমাদের জন্যে নিদ্রাকে সুখ ও শান্তি, রাতকে পর্দা ও দিনকে জীবিকার জন্যে কায়িক পরিশ্রম করার উত্তম সময় হিসেবে নির্ধারিত করেছি।”
সূরায়ে আন-নমলের ৮৬ নং আয়াতে আছে-
أَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا اللَّيْلَ لِيَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
“তারা কি দেখেনি যে, আমি রাতকে সৃষ্টি করেছি যেনো তারা তাতে সুখ ও শান্তি ভোগ করে আর দিনকে (সৃষ্টি করেছি) উজ্জ্বল হিসেবে (যেনো তারা তাতে জীবিকার জন্যে সাধ্যমত পরিশ্রম করে। নিঃসন্দেহে এতে মুমিনদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।”
“একবার রাসূল (সাঃ) আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি জানতে পারলাম যে, তুমি দিনে রোজা রাখ এবং সারা রাত নামাযে মগ্ন থাক, এটা কি সত্য? আবদুল্লাহ (রাঃ) উত্তরে বললেন, জ্বী হাঁ, সত্য। রাসূল (সাঃ) বললেন, না, এরূপ করবে না, কখনও কখনও রোযা রাখবে আবার কখনো কখনো রোযা রাখবেনা। তদ্রুপ ঘুমাবে আবার ঘুম থেকে উঠে নামাযও আদায় করবে। কেননা, তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে, তোমার ওপর তোমার চোখেরও অধিকার আছে।” (বুখারী)
৭. অতিরিক্ত আরামদায়ক বিছানায় আরাম করবে না। দুনিয়ায় মুমিনকে অধিক সুখ অন্বেষণ, আনন্দ উল্লাস ও বিলাস বসন থেকে বিরত থাকহে হবে। মু’মিনের জন্যে জীবন হলো জিহাদ হলো জিহাদ সমতুল্য, তাই মুমিনকে তার জীবন যুদ্ধে অধিক কষ্টসহিষ্ণু ও কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, “রাসূল (সাঃ)-এর বিছানা ছিল চামড়ার তৈরী এবং তাতে খেজুরের ছাল ভর্তি ছিল।” (শামায়েলে তিরমিযী)
“হযরত হাফছ (রাঃ)-কে কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনার ঘরে রাসূল (সাঃ)-এর বিছানা কেমন ছিল? তিনি উত্তরে বললেন, একটি চট ছিল যা আমি দু’ভাঁজ করে রাসূল (সাঃ)-এর জন্যে বিছিয়ে দিতাম, একদিন আমি ভাবলাম যে, চার ভাঁজ করে বিছিনো হলে হয়তো কিছুটা বেশী নরম হবে। সুতরাং আমি চার ভাঁজ করে বিছিয়ে দিলাম। ভোরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার পিঠের নিচে কি বিছিয়ে দিয়েছিলে? আমি উত্তরে বললাম, ঐ চটই ছিল, তবে আমি চার ভাঁজ করে বিছেয়ে দিয়েছেলাম। রাসূল (সাঃ) বললেন, না, উহাকে দুভাকেঁই থাকতে দাও। রাতে তাহাজ্জুদের জন্যে উঠতে নরম বিছানা আমার অলসতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল”। (শামায়েলে তিরমিযী)
“হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একবার এক আনসারী মহিলা আমাদের ঘরে এসে রাসূল (সাঃ)-এর বিছানা দেখলেন, সেই মহিলা তার ঘরে গিয়ে পশম ভর্তি নরম মোলায়েম বিছানা তৈরী করে পাঠিয়ে দিলেন। রাসূলে আকরাম (সাঃ) ঘরে এসে ঐ বিছানা দেখে বললেন, এটা কি? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অমুক আনসারী মহিলা আমাদের ঘরে এসে আপনার বিছানা দেখে গিয়েছিলেন, পরে তিনি এটা তৈরী করে আপনার জন্যে পাঠিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, না, এটা ফিরিয়ে দাও। ঐ বিছানাটা আমার অনেক পছন্দ হয়েফিল তাই তা ফেরৎ দিতে মন চাচ্ছিল না। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তা ফেরৎ দেওয়ার জন্যে এত জোর দিয়ে বলছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত আমাকে তা ফেরৎ দিতেই হলো”। (শামায়েলে তিরমিযী)
“রাসূল (সাঃ) একবার খালি চাটাইতে শোয়ার কারণে তাঁর শরীরে চাটাইর দাগ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি তা দেখে কাঁদতে লাগলাম। রাসূল (সাঃ) আমাকে কাঁদতে দেখে বললেন, তুমি কাঁদছ কেন? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রোম ও ইরানের বাদশাহগণ সিল্ক ও পশমের গদিতে ঘুমাবে আর আপনি দুনিয় ও আখিরাতের বাদশাহ হওয় সত্বেও চাটাইর উপর ঘুমাবেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, “এতে কাঁদার কিছু নেই। তাদের জন্যে শুধু দুনিয়া আর আমাদের জন্যে হ’লো আখিরাত”।
একবার রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “আমি কিভাবে সুখ-শান্তি ও নিশ্চিন্ত জীবন-যাপন করব? ইসরাফীল (আঃ) মুখে সিঙ্গা নিয়ে কান খাড়া করে অবনত মস্তকে অপেক্ষা করছেন যে, কখন সিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার আদেশ হয়”। (তিরমিযী)
৮. রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাতের দাবী হলো মুমিন এ পৃথিবীতে মুজাহিদের ন্যায় জীবন-যাপন করবে এবং সুখ অন্বেষণ থেকে বিরত থাকবে। ঘুমানোর পূর্বে অযু করারও গুরুত্ব দিবে এবং পবিত্র ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ঘুমাবে। হাতে কোন তৈলাক্ত জিনিস লেগে থাকলে হাত ধুয়ে ঘুমাবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, “কারো হাতে যদি কোন তৈলাক্ত বস্তু লেগে থাকে এবং সে যদি তা না ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে এবং এতে যদি তার কোন ক্ষতি হয় (অর্থাৎ বিষাক্ত প্রাণী আঘাত করে) তাহলে সে যেনো নিজেকেই নিজে তিরষ্কার করে।
রাসূল (সাঃ)-এর অভ্যাস ছিল যে, শোয়ার পূর্বে অযু করতেন।
৯. ঘুমানের সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে। পানাহারের পাত্র ঢেকে রাখবে।আলো নিভিয়ে দেবে।
একবার মদীনায় রাতের বেলায় আগুন লেগে গেল, তখন রাসূল (সাঃ) বললেনঃ আগুন হলো তোমাদের শত্রু, যখন তোমরা ঘুমাতে যাবে তখন আগুন নিভিয়ে দেবে।
১০. শোয়ার সময় বিছানার উপর বা বিছানার নিকট, পানি ও গ্লাস লোটা বা বদনা, লাঠি, আলোর জন্যে দিয়াশলাই, মেসওয়াক, তোয়ালে ইত্যাদি অবশ্যই রাখবে। কোথাও মেহমান হলে বাড়ীওয়ালাদের নিকট থেকে পায়খানা ইত্যাদির কথা অবশ্যই জেনে নেবে, কেননা, হয়তো রাতে আবশ্যক হতে পারে অন্যথায় কষ্ট হতে পারে। রাসূল (সাঃ) যখন আরাম করতেন তখন তাঁর শিয়রে নিম্নের সাতটি বস্তু রাখতেন-
(ক) তেলের শিশি।
(খ)চিরুনী।
(গ) সুরমাদানী।
(ঘ)কাঁশি।
(ঙ) মেসওয়াক।
(চ) আয়না।
(ছ) কাঠের একটি শলাকা যা মাথা ও শরীর চুলকানোর কাজে আসে।
১১. ঘুমানোর সময় জুতা ও ব্যবহারের কাপড় কাছেই রাখবে, যেনো ঘুম থেকে উঠে খুঁজতে না হয় এবং ঘুম থেকে উঠেই জুতা পায়ে দেবে না, তদ্রুপ না ঝেড়ে কাপড়ও পরিধান করবে না, আগে ঝেড়ে নেবে, হয়তো জুতা অথবা কাপড়ের ভেতর কোন কষ্টদায়ক প্রাণী লুকিয়ে থাকতে পারে। আর আল্লাহ না করুন! ঐ প্রাণী কষ্ট দিতে পারে।
১২. শোয়ার আগে বিছানা ভাল করে ঝেড়ে নেবে, প্রয়োজন বোধে শোয়া থেকে উঠে গেলে তারপর আবার এসে শুতে হলে তখনও বিছানা ভাল করে ঝেড়ে নেবে।
রাসূল (সাঃ) বলেন, “রাতে তোমাদের কেউ যখন বিছানা থেকে উঠে বাইরে যাবে এবং জরুরত সেরে পুনঃ বিছানায় ফিরে আসবে তখন নিজের পরনের তহবন্দের একমাথা দিয়ে তিন বার বিছানা ঝেড়ে নিবে। কেননা, সে জানেনা যে, তার প্রস্থানের পরে বিছানায় কি এসে পড়েছে।”
(তিরমিযী)
১৩. বিছানায় গিয়ে এ দোআ পড়বে। রাসূল (সাঃ)-এর বিশিষ্ট খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন বিছানায় যেতেন তখন এ দোআ টি পাঠ করতেন।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا وَكَفَانَا وَآوَانَا وَكَمْ مِمَّنْ لا كَافِي لَهُ وَلا مَأْوًى (شمايل ترمذى)
“সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি আমাদেরকে পানাহার করিয়েছেন, যিনি আমাদের কাজ-কর্মে সাহায্য করেছেন, যিনি আমাদের বসবাসের ঠিকানা দিয়েছেন। আর কত লোক আছে যাদের কোন সাহায্যকারী ও ঠিকানা দাতা নেই।
১৪. বিছানায় গিয়ে পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করবে। রাসূল (সাঃ) ঘুমানো পূর্বে পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করতেন। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি বিশ্রাম করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনের কোন সূরা পাঠ করে, তখন আল্লাহ তাআলা তার নিকট একজন ফিরিশতা প্রেরণ করেন, যে সে ঘুম থেকে চৈতন্য হওয়া পর্যন্ত তাকে প্রত্যেক কষ্টদায়ক বস্তু থেকে পাহারা দেয়।
(আহমাদ)
তিনি আরো বলেন, “মানুষ যখন বিছানায় গিয়ে পৌছেঁ তখন একজন ফিরিশতা ও একজন শয়তানও সেখানে গিয়ে পৌছেঁ। ফিরিশতা তাকে বলে-“ভাল কাজ দ্বারা তোমার কর্ম শেষ কর”।শয়তান বলে-“মন্দ কাজ দ্বারা তোমার কর্ম শেষ কর”। অতঃপর সে ব্যক্তি যদি আল্লাহকে স্মরণের কুরআন পাঠের মাধ্যমে ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে ফিরিশতা সারা রাত তাকে পাহার দিতে থাকে”।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, “রাসূল (সাঃ) বিছানায় গিয়ে দোআ করার মত হাত উত্তোলন করতেন এবং কুলহুআল্লাহু আহাদ, কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক্ব ও কুল আউযু বিরাব্বিন্নাস সূরাসমূহ পাঠ করে উভয় হাতে ফুঁক দিতেন, তারপর শরীরের যে পর্যন্ত হাত পৌঁছান সম্বব হতো সে পর্যন্ত সারা শরীর মর্দন করতেন। মাথা, চেহারা ও শরীরের সামনের অংশ থেকে মর্দন আরম্ভ করতেন। এরূপ তিন তিনবার করতেন”। (শামায়েলে তিরমিযী)
১৫. ঘুমানোর ইচ্ছা করলে ডান হাত ডান চোয়ালের নিচে রেখে ডান পাশে কাত হয়ে শুবে।
হযরত বারা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বিশ্রাম করার সময় ডান হাত ডান চোয়ালের নিচে রেখে এ দোআ পাঠ করতেন-
رَبِّ قِنِىْ عَذَبَكَ يَوْمًا تَبْعَثُ عِبَادَكَ
“হে আমার প্রতিপালক!তুমি আমাকে সে দিনের আযাব থেকে রক্ষা করো, যে দিন তুমি তোমার বান্দাহদেরকে উঠিয়ে তোমার নিকট হাযির করবে”। হেছনে হাছীন নামক কিতাবে আছে যে, তিনি এ শব্দগুলো তিনবার পাঠ করতেন।
১৬. উপুড় হয়ে ও বামপাশে ঘুমানো থেকে বিরত থাকবে। হযরত মুয়ী’শ (রাঃ)-এর পিতা তাফখাতুল গিফারী (রাঃ) বলেন, “আমি মসজিদে নববীতে উপাড় হয়ে শুয়েছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি পা দিয়ে নাড়িয়ে বলল, এভাবে শোয়াকে আল্লাহ পছন্দ করেন না, আমি চোখ খুলে দেখতে পেলাম যে, ঐ ব্যক্তি ছিলেন রাসূল (সাঃ)”। (আবু দাউদ)
১৭. ঘুমাবার জন্যে এমন স্থান নির্বাচন করবে যেখানে এরূপ বাতাস প্রবাহিত হয় না।
১৮. মুখ ঢেকে ঘুমাবে না যাতে স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়ে, মুখ খুলে ঘুমাবার অভ্যাস করবে যেনো (শ্বাস প্রশ্বাসে) নির্মল বাতাস গ্রহণ করা যায়।
১৯. দেওয়াল বা বেড়াবিহীন ঘরে ঘুমাবে না এবং ঘর থেকে নামার সিঁড়িতে পা রাখার আগেই আলোর ব্যবস্থা করবে। কেননা, অনেক সময় সাধারণ ভুলের কারণেও অসাধারণ কষ্ট ভোগ করতে হয়।
২০.যত প্রচণ্ড শীতই পড়ুক না কেন আগুনের কুণ্ডলী জ্বালিয়ে এবং বদ্ধ কামরাতে হারিকেন জ্বালিয়ে ঘুমাবে না। আবদ্ধ কামরায় জ্বলন্ত আগুনে যে গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমন কি অনেক সময় উহা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়া পারে।
২১. ঘুমানোর পূর্বে দোআ করবে। হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) ঘুমাবার আগে এ দোআ পাঠ করতেন।
بِاسْمِكَ رَبِّي وَضَعْتُ جَنْبي ، وَبِكَ أرْفَعُهُ ، إنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِي فَارْحَمْهَا ، وَإنْ أَرْسَلْتَهَا ، فاحْفَظْهَا بِمَا تَحْفَظُ بِهِ عِبَادَكَ الصَّالِحِينَ
“হে আমার প্রতিপালক! তোমারই নামে আমার শরীর বিছানায় শায়িত করলাম এবং তোমারই সাহায্যে বিছানা থেকে উঠব। তুমি যদি রাতেই আমার মৃত্যু দাও তাহলে তার প্রতি দয়া কর। আর তুমি যদি আত্মাকে ছেড়ে দিয়ে অবকাশ দাও, তাহলে তাকে হেফাজত করো।
যেমনভাবে তুমি তোমার নেক্কার বান্দাহকে হেফাজত করে থাকো”।
এ দোআ মুখস্থ না থাকলে নিম্নের ছোট দোআ পাঠ করবে।
اللهُمَّ بِاِسْمِكَ اَمُوْتُ وَاَحْيٰى
“হে আল্লাহ! আমি তোমারই নামে মৃত্যু বরণ করছি এবং তোমারই নামে জীবিত হয়ে উঠবো”।
২২.শেষ রাতে ওঠার অভ্যাস করবে। আত্মার উন্নতি ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির জন্যে শেষ রাতে উঠে আল্লাহকে স্মরণ করা অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত করা উচিত। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের বৈশষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, “তারা শেষ রাতে উঠে আল্লাহর দরবারে রুকু-সেজদা করে ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে”। রাসূল (সাঃ)-এর অভ্যাস ছিল যে, তিনি রাতের প্রথম ভাগে বিশ্রাম করতেন এবং শেষ রাতে উঠে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হতেন।
২৩. ঘুম থেকে উঠে এ দোআ পাঠ করবে।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانًا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ (بُخَارِى مُسْلِم)
“সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দানের পর আবার জীবিত করেন আর তাঁরই দিকে পুনরুত্থিত হতে হবে”।
২৪. যদি সুস্বপ্ন দেখ তবে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করবে এবং নিজের সু-সংবাদ বলে মনে করবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, এখন নবুয়ত থেকে বেশারত ছাড়া আর কিছু বাকী নেই। (কেননা, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শেষ নবী হওয়ার কারণে নবুয়তের দরজা একেবারে বন্ধ) সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, বেশারত অর্থ কি? তিনি বললেন, সুস্বপ্ন।(বুখারী) তিনি বলেছেন যে, “তোমাদের মধ্যে যে অধিক সত্যবাদী তার স্বপ্নও অধিক সত্য হবে”। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, “কোন স্বপ্ন দেখলে আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং ঈমানদার বন্ধুর নিকট বর্ণনা করবে”। রাসূল (সাঃ) কোন স্বপ্ন দেখলে তা সাহাবায়ে কেরামের নিকট বর্ণনা করতেন আর তাদেরকে বলতেন, “তোমাদের স্বপ্ন বর্ণনা কর, আমি উহার ব্যাখ্যা দেব”। (বুখারী)
২৫. দুরূদ শরীফ বেশী বেশী করে পড়বে, কেননা আশা করা যায় যে, এর বরকতে আল্লাহ তাআ’লা রাসূল (সাঃ) এর যিয়ারত নসীব করবেন।
হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আলী মুঙ্গের (রহঃ) একবার হযরত ফজলে রহমান গাঞ্জ মুরদাবাদী (রঃ) কে বললেন যে, “আমাকে এমন একটি দুরূদ শরীফ শিক্ষা দিন যা পড়লে রাসূল (সাঃ) এর দীদার নসীব হয়। তিনি বললেন, এমন কোন বিশেষ দরূদ নেই, শুধু আন্তরিকতা সৃষ্টি করে লও, উহাই যথেষ্ট। তারপর অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর তিনি বললেন, তবে হযরত সাইয়্যেদ হাসান (রঃ) এ দরূদ শরীফটি পাঠ করে বিশেষ ফল লাভ করেছিলেন।
আরবি
“হে আল্লাহ! তোমার জানা যত কিছু আছে তত সংখ্যক রহমত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর বংশধরগণের উপর নাযিল কর”।
রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে সে প্রকৃতপক্ষে আমাকেই দেখেছে, কেননা শয়তান কখনোই আমার রূপ ধারণ করতে পারে না”।
(শামায়েলে তিরমিযী)
হযরত ইয়াযীদ ফারসী (রঃ) পবিত্র কোরআন লিখতেন। একবার তিনি রাসূল (সাঃ)-কে স্বপ্নে দেখতে পেলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তখন জীবিত ছিলেন। হযরত ইয়াযীদ (রঃ) তাঁর নিকট স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাঁকে রাসূল (সাঃ)-এর এ হাদীস শুনিয়ে দিলেন যে, তিনি বলেছেন “যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে সে সত্যিই আমাকে দেখেছে, কেননা, শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম”।তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি স্বপ্নে যাকে দেখেছ তাঁর আকৃতির বর্ণনা দিতে পার”।হযরতইয়াযীদ (রঃ) বললেন, তাঁর শরীর ও দেহের উচ্চতা অত্যন্ত মধ্যমাকৃতির, তাঁর গায়ের রং শ্যামলা সাদা মিশ্রিত সুন্দর, চক্ষু যুগল সুরমা লাগানো। হাসি-খুশী মুখ, সুশ্রী গোল চেহারা, মুখমণ্ডল বেষ্টিত সিনার দিকে বিস্তৃত ঘন দাঁড়ি”। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তুমি যদি রাসূল (সাঃ)-কে জীবিতাবস্থায় দেখতে তা হলেও এর থেকে বেশী সুন্দর করে তাঁর আকৃতির বর্ণনা দিতে পারতে না (অর্থাৎ তুমি যে আকৃতির কথা বর্ণনা করেছ তা প্রকৃতপক্ষে রাসূল (সাঃ) এরই আকৃতি।
(শামায়েলে তিরমিযী)
২৬. আল্লাহ না করুন! কোন সময় অপছন্দনীয় ও ভীতিজনক কোন স্বপ্ন দেখলে তা কারো নিকট বলবেনা এবং ঐ স্বপ্নের অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। হযরত আবু সালমা বলেন, মন্দ স্বপ্নের কারণে বেশীরভাগ সময় আমি অসুস্থ থাকতাম। একদিন আমি হযরত আবু কাতাদা (রাঃ)-এর নিকট এ বিষয়ে অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে রাসূল (সাঃ)-এর হাদীস শোনালেন, “সু স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। তোমাদের কেউ যদি কোন স্বপ্ন দেখে তাহলে সে যেনো তার একান্ত বন্ধু ছাড়া আর কারো কাছে তা বর্ণনা না করে। আর কোন মন্দ স্বপ্ন দেখলে তা অন্য কাউকে বলবে না। বরং সচেতন হলে “আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম” বলে বামদিকে তিনবার থু থু ফেলবে এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করে শু’বে, তাহলে সে স্বপ্নের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাবে”।
(রিয়াদুস সালেহীন)
২৭. নিজের মন থেকে কখনো মিথ্যা স্বপ্ন তৈরী করে বর্ণনা করবে না। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মনগড়া মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করে, কিয়ামতের দিন তাকে দু’টি যবের মধ্যে গিরা দেওয়ার শাস্তি প্রদান করা হবে, বস্তুতঃ সে কখনো গিরা যবের মধ্যে গিরা দেওয়া শাস্তি প্রদান করা হবে, বস্তুতঃ সে কখনো গিরা দিতে পারবে না। সুতরাং সে আযাব ভোগ করতে থাকবে”।
(মুসলিম)
তিনি আরো বলেছেন, “মানুষ চোখে না দেখে যে কথা বলে তা হলো অত্যন্ত জঘন্য ধরনের মিথ্যারোপ”।
(বুখারী)
২৮. কোন বন্ধু যখন তার নিজের স্বপ্নের কথা বর্ণনা করে তখন তার স্বপ্নের উত্তম ব্যাখ্যা দেবে এবং তার মঙ্গলের জন্যে দোআ করবে। একবার এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর নিকট নিজের স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলে রাসূল (সাঃ) বললেন, “উত্তম স্বপ্ন দেখেছ, উত্তম ব্যাখ্যা হবে”।
আরবি
“ঐ স্বপ্নের শুভ ফল তোমার নসীব হোক, উহার খারাপ ফল থেকে তোমাকে রক্ষা করুন, আমাদের জন্যে উত্তম এবং আমাদের শত্রুদের দুর্ভাগ্য হোক, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক”।
২৯. কখনো স্বপ্নে ভয় পেলে অথবা চিন্তাযুক্ত স্বপ্ন দেখে অস্থির হয়ে পড়লে, ঐ ভয় ও অস্থিরতা দূর করার জন্যে এ দোআ পাঠ করবে এবং নিজেদের বুঝ-জ্ঞান সম্পন্ন বাচ্চাদেরকেও এ দোআটি মুখস্ত করিয়ে দেবে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) বলেন, যখন কোন ব্যক্তি স্বপ্ন দেখে ভীত অথবা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ত তখন রাসূল (সাঃ) তাদের অস্থিরতা দূর করার জন্য এ দোআটি শিক্ষা দিতেন এবং পড়তে বলতেন।
আরবি
“আমি আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর গযব ও ক্রোধ, তাঁর শাস্তি, তাঁর বান্দারেদ দুষ্টামী, শয়তানদের ওয়াসওয়াসা ও তারা আমার নিকট উপস্থিতির ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার পানাহ চাই”।
(আবু দাউদ, তিরমিযি)
পথ চলার আদব সমূহ
১. রাস্তায় সব সময় মধ্যম গতিতে চলবে। এত দ্রুত গতিতে চলবে না যে, লোকদের নিকট অনর্থক উপহাসের পাত্র হও, আবার এত ধীর গতিতেও চলবে না যে, লোকেরা দেখে অসুস্থ মনে করে অসুস্থতার বিষয় জিজ্ঞেস করে। রাসূল (সাঃ) মধ্যম গতিতে লম্বা কদমে পা উঠিয়ে হাঁটতেন, তিনি কখনও পা হেঁচড়িয়ে হাঁটতেন না।
২. পথ চলার সময় শিষ্টাচার ও গাম্ভীর্যের সাথে নিচের দিকে দেখে চলবে, রাস্তায় এদিকে সেদিকে দেখতে দেখতে চলবে না, এরূপ করা গাম্ভীর্য ও সভ্যতার খেলাফ।
রাসূল (সাঃ) পথ চলার সময় নিজের শরীর মুবারককে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে হাঁটতেন, মনে হত যেনো কেউ ওপর থেকে নিচের দিকে নামছে, তিনি গাম্ভীর্যের সাথে শরীর সামলিয়ে সামান্য দ্রুতগতিতে হাঁটতেন, এ সময় ডানে বামে দেখতেন না।
৩. বিনয় ও নম্রতার সাথে পা ফেলে চলবে এবং সদর্প পদক্ষেপে চলবে না, কেননা, পায়ের ঠোকরে যমীনও ছেদ করতে পারবে না আর পাহাড়ের চূড়ায়ও উঠতে পারবে না সুতরাং সদর্প পদক্ষেপে চলে আর লাভ কি?
৪. জুতা পরিধান করে চলবে, কখনো খালি পায়ে চলবে না, জুতা পরিধান করার কারণে পা কাঁটা, কঙ্কর ও অন্যান্য কষ্টদায়ক বস্তু থেকৈ নিরাপদ থাকে এবং কষ্টদায়ক প্রাণী থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। রাসূল (সাঃ) বলেন, “অধিকাংশ সময় জুতা পরিধান করে থাকবে মূলতঃ জুতা পরিধানকারীও এক প্রকারের আরোহী”।
৫. পথ চলতে উভয় পায়ে জুতা পরিধানি করে চলবে অথবা খালি পায়ে চলবে, এক পা নগ্ন আর এক পায়ে জুতা পরিধান করে চলা বড়ই হাস্যকর ব্যাপার। যদি প্রকৃত কোন ওযর না থাকে তাহলে এরূপ রুচিহীন ও সভ্যতা বিরোধী কার্য থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, “এক পায়ে জুতা চলবে না, উভয় পায়ে জুতা পরবে অথবা খালি পায়ে চলবে”।
(শামায়েলে তিরমিযী)
৬. পথ চলার সময় পরিধেয় কাপড় উপরের দিকে টেনে নিয়ে পথ চলবে যেনো অগোছালো কাপড় কোন ময়লা বা কষ্টদায়ক বস্তু জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকে। রাসূল (সাঃ) পথ চলার সময় নিজের কাপড় সামান্য উপরের দিকে উঠিয়ে নিতেন।
৭. সঙ্গীদের সাথে সাথে চলবে। আগে আগে হেঁটে নিজের মর্যাদার পার্থক্য দেখাবে না। কখনো কখনো নিঃসংকোচে সঙ্গীর হাত ধরে চলবে, রাসূল (সাঃ) সঙ্গীদের সাথে চলার সময় কখনো নিজের মর্যাদার পার্থক্য প্রদর্শন করতেন না। অধিকাংশ সময় তিনি সাহাবীদের পিছনে পিছনে হাঁটতেন আর কখনো কখনো সাথীর হাত ধরেও চলতেন।
৮. রাস্তার হক আদায় করবে। রাস্তায় থেকে অথবা বসে পথচারীদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। আর কখনো রাস্তায় থামতে হলে রাস্তার ৬টি হকের প্রতি লক্ষ্য রাখবে।
(ক)দৃষ্টি নিচের দিকে রাখবে।
(খ) রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূরে ফেলে দেবে।
(গ)সালামের জবাব দেবে।
(ঘ)ভাল কাজের আদেশ দেবে, খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে।
(ঙ) পথহারা পথিককে পথ দেখিয়ে দেবে।
(চ)বিপদগ্রস্থকে যথাসম্ভব সাহায্য করবে।
৯. রাস্তায় ভাল লোকদের সাথে চলবে। অসৎ লোকদের সাথে চলাফেরা করা পরিহার করবে।
১০. রাস্তায় নারী-পুরুষ একত্রে মিলেমিশে চলাচল করবে না। নারীরা রাস্তার মধ্যস্থল পুরুষদের জন্যে ছেড়ে দিয়ে এক পার্শ্ব দিয়ে চলাচল করবে, এবং পুরুষরা তাদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, পচা দুর্গন্ধময় কাদা মাখানো শুকরের সাথে ধাক্কা খাওয়া সহ্য করা যেতে পারে, কিন্তু নারীর সাথে ধাক্কা খাওয়া সহ্য করা যায় না।
১১. ভদ্র মহিলাগণ যখন কোন প্রয়োজনবশতঃ রাস্তায় চলাচল করবে তখন বোরকা অথবা চাদর দিয়ে নিজের শরীর, পোষাক ও রূপ চর্চার সকল বস্তু ঢেকে নিবে এবং চেহারায় ঘোমটা লাগাবে।
১২. মহিলারা চলাফেরায় ঝঙ্কার বা ঝনঝনে শব্দ সৃষ্টি হয় এমন কোন অলঙ্কার পরিধান করে চলাচল করবে না অথবা অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে চলবে যেনো তার শব্দ পর পুরুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট না করে।
১৩. মহিলারা সুগন্ধ বিস্তারকারী সুগন্ধি ব্যবহার করে রাস্তায় বের হবে না, এ ধরনের নারীদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত কঠিন ভায়ায় ভর্ৎসনা করেছেন।
১৪. ঘর থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি উঠিয়ে এ দোআ পাঠ করবে।
আরবি
“আল্লাহর নামেই আমি বাইরে পা রাখলাম এবং আল্লাহর উপরই আমি ভরসা রাখি। হে আল্লাহ! আমি পদস্খলন হওয়া অথবা আমাদেরকে পদস্খলিত করা থেকে, আমরা গোমরাহীতে লিপ্ত হওয়া অথবা, আমাদেরকে কেউ করে দেয়া, আমরা অত্যাচার করা অথবা আমরা আমাদের উপর মূর্খতাসূলভ ব্যবহার করা থেকে আনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি।
১৫. বাজারে গিয়ে এ দোআ পাঠ করবে,
আরবি
“মহান আল্লাহর নামে (বাজারে প্রবেশ করছি)। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এ বাজারের অধিকতর উত্তম এবং উহাতে যা কিছু আচে উহার অধিকতর ভালো কামনা করি। আমি আপনার নিকট এ বাজারের অনিষ্ট এবং এ বাজারে যা কিছু আছে তার অনিষ্টতা বলা-থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এ বাজারে মিথ্যা বলা থেকে অথবা অলাভজনক সওদা ক্রয় করে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”।
হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশ করার সময় এ দোআ পড়বে আল্লাহ তাআলা তার আমলনামায় দশ লাখ নেকী লিপিবদ্ধ করে দেবেন, দশ লাখ গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং দশ লাখ স্তর মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবেন।
“আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। সকল ক্ষমতার অধিকারী তিনি, সকল প্রশংসা তাঁর জন্য। তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন, তিনিই চিরঞ্জীব। তাঁর কোন মৃত্যু নেই, সকল প্রকার উত্তম কিছু তাঁরই ক্ষমতাধীন এবং তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান”।
(তিরমিযী)
সফরের উত্তম পদ্ধতি
১. সফরে বের হবার জন্যে এমন সময় নির্ধারণ করবে যাতে সময় কম ব্যয় হয় এবং নামাজের সময়ের প্রতিও লক্ষ্য থাকে। রাসূল (সাঃ) নিজে বা অপরকে সফরে রওয়ানা করিয়ে দিতে বৃহস্পতিবারকে বেশী উপযোগী দিন মনে করতেন।
২. একাকী সফর না করে কমপক্ষে তিনজন সাথীসহ সফর করবে, এতে পথিমধ্যে আসবাব-পত্রের পাহারা ও অন্যান্য আবশ্যকীয় কাজ-কাম স্বহস্তে সমাধা করা এবং অনেক বিপদাপদ থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। রাসূল (সাঃ) বলেন, “একাকী সফর করা বিপজ্জনক। এ সম্পর্কে আমি যা জানি তা যদি লোকেরা জানতো তা হলে কোন আরোহী কখনও রাত্রিবেলায় একা সফরে বের হতো না।
(বুখারী)
এক ব্যক্তি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে রাসূল (সাঃ) এর দরবারে হাযির হলেন। তিনি মুসাফির ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার সাথে আর কে আছে?” বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার সাথে তো আর কেউ নেই, আমি একাই এসেছি। তখন তিনি বললেন, একা ভ্রমণকারী শয়তান। দু’জন আরোহীও শয়তান। তিনজন আরোহীই আরোহী। (তিরমিযী) অর্থাৎ ভ্রমণকারী তিনজন হলে তারা প্রকৃত ভ্রমণকারী আর ভ্রমণকারী তিনজনের কম হলে তারা মূলত শয়তানের সাথী।
৩. মহিলাদের সর্বদা মুহরিম সঙ্গীর সাথে সফর করা উচিৎ। অবশ্যক সফরের রাস্তা একদিন অথবা অর্ধদিনের হলে একা গেলে তেমন ক্ষতি নেই। কিন্তু সাবধানতা হিসেবে কখনো একা সফর করতে নেই। রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে তার পক্ষে একাকী তিনদিন তিন রাতের পথ ভ্রমণ করা বৈধ নয়”। সে এত লম্বা সফর তখনই করতে পারবে যখন তার সাথে তার পিতা-মাতা, ভাই, স্বামী অথবা আপন ছেলে অথবা অন্য কোন মুহরিম ব্যক্তি থাকবে”। (বুখারী) অন্য একস্থানে তিনি এতটুকু পর্যন্ত বলেছেন, “মহিলারা একদিন এক রাতের দূরত্বের ভ্রমণে একা যেতে পারবে না”।
(বুখারী, মুসলিম)
৪. সফরে রওয়ানা হবার সময় যানবাহনে বসে এ দোআ করবে।
আরবি
“পবিত্র ও মহান সে আল্লাহ যিনি এটাকে আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন, মূলতঃ আমরা আয়ত্ব করতে সক্ষম ছিলাম না, আমরা অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তনকারী (আল কুরআন) আল্লাহ! আমার এ সফরে তোমাকে ভয় করার তাওফীক প্রার্থনা করছি আর তুমি সন্তুষ্ট হও এমন আমলের তাওফীক প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ, সহজ কর তুমি আমাদের এ সফরকে। আর ইহার দূরত্ব আমাদের জন্যে সংক্ষেপ করে দাও! তুমিই আমার এ সফরের সাথী এবং আমার পরিবারের প্রতিনিধি ও রক্ষক। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট সফরের কষ্ট থেকে, অসহনীয় দৃশ্য থেকে, আমার পরিবারস্থ লোকদের নিকট, ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্ততিতে মন্দ প্রভাব পড়া থেকে, আর অত্যাচারিতের সাক্ষাত থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”।
(মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি)
৫. চলার পথে অন্য সাথীদে বিশ্রামের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। সাথীদেরও অধিকার আছে বিশ্রামের, আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, আরবি
“পার্শ্বের সাথীর সাথে সদ্ব্যবহার করো”। পার্শ্বের সাথী বলতে এখানে এমন সব ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যারা যে কোন সময় কোন এক উপলক্ষে তোমার সাথী হয়েছিল। সফরকালীন সংক্ষিপ্ত সময়ের সাথীর (বন্ধুরও) তোমার প্রতি অধিকার আছে যে, তুমি তার সাথে সদ্ব্যবহার করবে এবং তোমার কোন কথা ও কর্ম দ্বারা যেনো তার শারীরিক বা মানসিক কোন কষ্ট না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখবে। রাসূল (সাঃ)বলেন, “জাতির নেতা তাদের সেবকই হয়, যে ব্যক্তি মানব সেবায় অন্য লোকদের থেকে অগ্রগামী হয়, শহীদগণ ব্যতীত আর কোন লোক নেকীতে তার থেকে অগ্রগামী নয়”।
(মেশকাত)
৬.সফরে রওয়ানা হবার সময় এবং সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে শোকরানা স্বরূপ দু’রাকাআত নফল নামায পড়বে, কেননা রাসূল (সাঃ) এরূপই করতেন।
৭. রেলগাড়ী, বাস, ট্যাক্সী ইত্যদি উপরের দিকে উঠার সময় এবং বিমান আকাশে উড্ডয়নের সময় এ দোআ পড়বে।
আরবি
“হে আল্লাহ! প্রত্যেক উচ্চতা ও শ্রেষ্ঠত্বের উপর আপনিই বড়, সর্বাবস্থায় সকল প্রশংসা আপনারই জন্যে নির্ধারিত”।
৮. রাতে কোথায়ও অবস্থান করতে হলে যথাসম্ভব সুরক্ষিত নিরাপদ স্থানে অবস্থান করবে, যেখানে জান ও মাল চোর ডাকাতদের থেকে রক্ষা পায় এবং কষ্টদায়ক প্রাণীদের অনিষ্টতার আশংকাও না থাকে।
৯. সফরের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবার পর তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে আসবে, অনর্থক ঘোরাফেরা করা থেকে বিরত থাকবে।
১০. সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের সংবাদ না দিয়ে বাড়ী প্রবেশ করবে না। আগে থেকে প্রত্যাবর্তনের তারিখ ও সময় সম্পর্কে অবহিত করে রাখবে, দরকার হলে মসজিদে দু’রাকায়াত নফল নামায আদায় করার জন্যে অপেক্ষা করে বাড়ীর লোকদেরকে সুযোগ দেবে যেন তারা সুন্দরভাবে অভ্যর্থনা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।
১১. সফরে কোন প্রাণী সাথে থাকলে তার আরাম ও বিশ্রামের প্রতিও খেয়াল রাখবে। কোন যানবাহন থাকলে তার আবশ্যকীয় জিনিসপত্র ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি লক্ষ্য রাখবে।
১২. শীতকালে বিছানাপত্র সাথে রাখবে, মেজবানকে বেশী অসুবিধায় ফেলবে না।
১৩. সফরে পানির পাত্র ও জায়নামায সাথে রাখবে যেনো এস্তেঞ্জা, অজু, নামায ও পানি পানে কোন সমস্যা না হয়।
১৪. সফর সঙ্গী হলে একজনকে আমীর নির্বাচন করে নেবে এবং প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র, টাকা পয়সা ও জরুরী আসবাবপত্র নিজ নিজ দায়িত্বে রাখবে।
১৫. সফরে কোথাও রাত হয়ে গেলে এ দোআ করবে-
আরবি
“হে যমীন। আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ! আমি আল্লাহ তাআলার নিকট তোমার ক্ষতি থেকে, তোমার মধ্যে আল্লাহ যেসব ক্ষতিকর প্রাণী সৃষ্টি করেছেন সে সব প্রাণীর অনিষ্টতা থেকে এবং তোমার উপর বিচরণকারী প্রাণীসমূহের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আল্লাহর নিকট আরো আশ্রয় প্রার্থনা করছি সিংহ, কাল সাপ ও বিচ্ছু, এ শহরবাসীদের অনিষ্টতা এবং এ শহরের প্রত্যেক পিতা ও সন্তানের অনিষ্টতা থেকে।
(আবু দাউদ)
১৬. সফর থেকে বাড়ী ফিরে এ দোআ পাঠ করবে।
আরবি
“প্রত্যাবর্তন! প্রত্যাবর্তন! আমাদের প্রতিপালকের নিকটই প্রত্যবর্তন! আমাদের প্রতিপালকের নিকট তাওবা করছি যেন তিনি আমাদের সকল গুনাহ মাফ করে দেন।
(হিসনে হাসিন)
১৭. কোন মুসাফিরকে বিদায় দেবার সময় তার সাথে কিছু পথ চলবে এবং তার নিকট দোআর আবেদন করবে, এ দোআ পড়ে তাকে বিদায় দেবে।
আরবি
“আমি তোমার দীন, আমানত ও কর্মের শেষ ফলাফল আল্লাহর নিকট সোপর্দ করছি”।
১৮. কেউ সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করলে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে এবং ভালোবাসাপূর্ণ কথা বলতে বলতে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে এবং ভালবাসাপূর্ণ কথা বলতে বলতে আবশ্যক ও সময় সুযোগের প্রতি লক্ষ্য রেখে মুসাফা করবে অথবা মুয়ানাকহ্ ও করবে।
দুঃখ-শোকের সময়ের নিয়ম
১. বিপদাপকে ধৈর্য্য ও নীরবতার সাথে সহ্য করবে, সাহস হারাবে না এবং শোককে কখনও সীমা অতিক্রম করতে দেবে না। দুনিয়ার জীবনে কোন মানুষ, দুঃখ-শোক, বিপদাপদ, ব্যর্থতা ও লোকসান থেকে সবসময় উদাসীন ও নিরাপদ থাকতে পারেনা। অবশ্য মুমিন ও কাফিরের কর্মনীতিতে এ পার্থক্য রয়েছে যে, কাফির দুঃখ ও শোকের কারণে জ্ঞান ও অনুভূতি শক্তি হারিয়ে ফেলে। নৈরাশ্যের শিকার হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে পড়ে। এমনকি অনেক সময় শোকের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে। মুমিন ব্যক্তি কোন বড় দুর্ঘটনায়ও ধৈর্য্যহারা হয়না এবং ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার উজ্জ্বল চিত্ররূপে পাথর খণ্ডের ন্যায় অটল থাকে, সে মনে করে যে, যা কিছু ঘটেছে, তা আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটেছে। আল্লাহর কোন নির্দেশই বিজ্ঞান ও যুক্তির বাইরে নয়, বরং আল্লাহ যা কিছু করেন বান্দাহর ভালর জন্যই করেন, নিশ্চয়ই এতে ভাল নিহিত আছে, এসব ধারণা করে মুমিন ব্যক্তি এমন শাস্তি ও প্রশান্তি লাভ করে যে, তার নিকট শোকের আঘাতেও অমৃত স্বাদ অনুভব করতে থাকে। তাক্বদীরের এ বিশ্বাস প্রত্যেক বিপদকে সহজ করে দেয়।
আল্লাহ বলেন-
আরবি
“যে সকল বিপদাপদ পৃথিবীতে আপতিত হয় এবং তোমাদের উপর যে সকল দুঃখ-কষ্ট পতিত হয়, এ সকল বিষয় সংঘটিত করার পূর্বেই এক কিতাব (লিপিবদ্ধ) থাকে। নিঃসন্দেহে ইহা আল্লাহর পক্ষে সহজ। যেন তোমরা তোমাদের অকৃতকার্যতার ফলে দুঃখ অনুভব না কর”।
অর্থাৎ-তাকদীরের উপর বিশ্বাস স্থাপনের এক উপকারিতা এই যে, মুমিন ব্যক্তি সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাকে নিজের ভাগ্যলিপির ফল মনে করে দুঃখ ও শোকে অস্থির ও চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে না, সে তার প্রত্যেক কাজে দয়াবান আল্লাহর দিকে দৃষ্টি স্থির করে নেয় এবং ধের্য্য ও শোকর করে প্রত্যেক মন্দের মধ্যেও নিজের জন্যে শুভফল বের করার চেষ্টা করে।
রাসূল (সাঃ) বলেন, “মুমিনের প্রত্যেক কাজই উত্তম, সে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন। সে যদি দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক ও অভাব-অনটনের সম্মুকীন হয় তাহলে সে শান্তি ও ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করে সুতরাং এ পরীক্ষাও তার জন্যে উত্তমই প্রমাণিত হয়, তার যদি শাস্তি ও স্বচ্ছলতা নসীব হয় তবে সে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে (অর্থাৎ দান-খয়রাত করে) সুতরাং স্বচ্ছলতাও তার জন্যে উত্তম প্রতিফল বলে আনে”।
(মুসলিম)
২. যখন দুঃখ-শোকের কোন সংবাদ শনবে অথবা কোন লোকসান হয় অথবা আল্লাহ না করুন হঠাৎ কোন বিপদাপদে জড়িয়ে পড়ো তখনই এ দোআ পাঠ করবে।
আরবি
“নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্যে আর নিশ্চিত আমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে”।
(আল-বাক্বারাহ)
অর্থাৎ-আমাদের নিকট যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। তিনিই আমাদেরকে দিয়েছেন আবার তিনিই তা নিয়ে যাবেন, আমরাও তাঁরই আবার তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করব। সর্বাবস্থায় তাঁর সন্তুষ্টির ওপর সন্তুষ্ট। তাঁর প্রতিটি কাজ যুক্তি, বিজ্ঞান ও ইনসাফ সম্মত। তিনি যা কিছু করেন তা মহান ও উত্তম। প্রভুভক্ত গোলামের কাজ হলো (মনিবের কোন কাজে তার ভ্রূ কুঞ্চিত হবেনা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
আরবি
“আর আমি কিছু ভয়ভীতি, দুর্ভিক্ষ, জান ও মালের এবং ফলাদির সামান্য ক্ষতি সাধন করে তোমাদেরকে পরীক্ষা করব। আপনি তাদেরকে সুসংবাদ দিন যারা বিপদে ধৈর্য্যধারণকারী এবং তারা যখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্যে আর নিশ্চয়ই আমাদেরকে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। ঐ সকল লোকের উপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বড় দান এবং রহমত (করুণা) বর্ষিত হবে আর তারাই হেদায়েত প্রাপ্ত।
(আল-বাক্বারা)
রাসূল (সাঃ) বলেন, “যখন কোন বান্দা বিপদে পড়ে,
আরবি
পাঠ করে তখন আল্লাহ তার বিপদ দূর করে দেন, তাকে পরিণামে মূল্যবান পুরষ্কার দান করেন আর তাকে উহার (বিপদের) প্রতিদান স্বরূপ তার পছন্দনীয় বস্তু দান করেন”।
একবার রাসূল (সাঃ) এর প্রদীপ নিভে গেলে তিনি পাঠ করলেন,(ইন্না লিল্লাহি ওয়অ ইন্নইলাইহি রাজিউন)। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! চেরাগ নিভে যাওয়াও কি কোন বিপদ? আল্লাহর নবী বললেন,হ্যাঁ, যার দ্বারা মুমিননের কষ্ট হয় তাই বিপদ”।
রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “যে কোন মুসলমানই মানসিক অশান্তি, শারীরিক কষ্ট, রোগ, দুঃখ-শোক এ আপতিত হয়, এমনটি তার শরীরে যদি একটি কাঁটাও বিঁধে আর সে তাতে ধৈর্য্যধারণ করে তখন আল্লাহ তাআলা তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন”।
(বুখারী, মুসলিম)
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, পরীক্ষা যত কঠিন ও বিপদ যত ভয়াবহ তার প্রতিদান তত মহান ও বিরাট। আল্লাহ যখন তাঁর কোন দাসকে ভালবাসেন তখন তাদেরকে খাঁটি ও বিশুদ্ধ স্বর্ণে পরিণত করার জন্যে নানাভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। সুতরাং যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন, আল্লাহও তাদের ওপর সন্তুষ্ট হন। আর যারা ঐ পরীক্ষার কারণে আল্লাহর অসন্তুষ্ট আল্লাহও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট।
(তিরমিযি)
হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যখন কোন বান্দাহর সন্তানের মৃত্যু হয় তখন আল্লাহ তাআলা ফিরিশতাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমার বান্দাহর সন্তানের জান কবজ করেছ? তাঁরা উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ’, তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি তার কলিজার টুকরার প্রাণ বের করেছ? তারা বলেন, হ্যাঁ, তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, তখন আমার বান্দাহ কি বলল? তারা বলেন, এ বিপদের সময়ও সে তোমার প্রশংসা করেছে এবং “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন” পড়েছে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বলেন, আমার ঐ বান্দাহের জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরী করো। এবং ঐ ঘরের নাম রাখ বাইতুল হামদ (প্রশংসার ঘর)”।
(তিরমিযি)
৩. কষ্ট ও দুর্ঘটনার পর শোক-দুঃখ প্রকাশ করা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এ ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করবে যে, শোক ও দুঃখের চূড়ান্ত তীব্রতায় যেন মুখ থেকে কোন অযথা অনর্থক বাক্য বের হয়ে না যায় এবং ধৈর্য্য ও শোকরের পথ পরিত্যাগ না করো।
রাসূল (সাঃ) এর প্রিয় সাহবেযাদা ইবরাহীম (রাঃ) মৃত্যুর সময় রাসূলূল্লাহ (সাঃ)-এর কোলে ছিলেন, রাসূল (সাঃ)-এর চোখ দিয়ে অশ্রুর ফোঁটা ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, “হে ইবরাহীম! আমি তোমার বিচ্ছেদে শোকাহত! কিন্তু মুখ থেকে তাই বেরুবে যা মহান প্রতিপালরেক সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে”।
(মুসলিম)
৪. শোকের আধিক্যতায়ও এমন কোন কথা বলবে না যার দ্বারা অকৃতজ্ঞতা (নাশোকরী) ও অভিযোগের সুর প্রকাশ পায় এবং যা শরীয়াত বিরোধী। হট্টগোল করে কান্নাকাটি করা, জামা ছিঁড়ে ফেলা, মুখে থাপ্পড় মারা, চিৎকার করে কাঁদা, শোকে মাথ ও বুকের ছাতি পিটানো মুমিনের জন্যে কখনো জায়েয নয়। রাসূল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি (শোকে) জামা ছিঁড়ে, মুখে থাপ্পড় মারে এবং জাহেলিয়াতের যুগের মানুষের ন্যায় চিৎকার ও বিলাপ করে কাদেঁ সে আমার উম্মত নয়”।
(তিরমিযি)
হযরত জাফর ত্বাইয়ার শহীদ হবার পর তাঁর শাহাদতের খবর য়কন বাড়ী পৌঁছলো তখন তাঁর বাড়ীর মহিলারা চিৎকার ও বিলাপ করে কান্নাকাটি শুরু করল। রাসূল (সাঃ) বলে পাঠালেন যে, “বিলাপ করা যাবে না”। তবুও তারা বিরত হলো না। অতঃপর তিনি আবারও নিষেধ করলেন, এবারও তারা মানল না। তখন তিনি নির্দেশ দিলেন যে, তাদের মুখে মাটি ভরে দাও।
(বুখারী)
একবার তিনি এক জানাযায় উপস্থিত ছিলেন, (ঐ জানাযার সাথে) এক মহিলা আগুনের পাতিল নিয়ে আসল, তিনি ঐ মহিলাকে এমন ধমক দিলেন যে, সে ভয়ে পালিয়ে গেল।
(সীরাতুন্নবী ৬ষ্ঠ খণ্ড)
রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন যে, জানাযার পেছনে কেউ আগুন ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যাবে না।
আরবদের মধ্যে এমন প্রচলন ছিল যে, জানাযার পেছনে শোক প্রকাশার্থে গায়ের চাদর ফেলে দিত, শুধু জামা থাকত। একবার তিনি সাহাবীদেরকে এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে বললেন, তোমরা অন্ধাকার যুগের রীতি পালন করছ। আমার মন চায় আমি তোমাদের ব্যাপারে এমন বদদোআ করি যেন তোমাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। সাহাবীগণ একথা শুনে নিজ নিজ চাদর পরে নিলেন আর কখনো এরূপ করেন নি।
(ইবনু মাজাহ)
৫. অসুখ হলে ভাল-মন্দ কিছু বলবে না, রোগ সম্পর্কে অভিযোগমূলক কো কথা মুখে আনবে না বরং অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা ধারণ করবে এবং এর জন্যে পরকালের পুরষ্কারের আশা করবে।
রোগ ভোগ ও কষ্ট সহ্য করার মাধ্যমে পাপ মোচন হয়ে নিষ্পাপ হওয়া যায় এবং পরকালে মহান পুরষ্কার লাভ হয়।
রাসূল (সাঃ) বলেন, শারীরিক কষ্ট, রোগ অথবা অন্য কোন কারণে মুমিনের যে কষ্ট হয় আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার জীবনের যাবতীয় পাপ ঝেড়ে পরিষ্কার করে দেন যেমন গাছের পাতাগুলো ঋতু পরিবর্তনের সময় ঝরে যায়।
(বুখারী, মুসলিম)
একবার এক মহিলাকে কাঁপতে দেখে রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে সায়েবের মাতা! তুমি কাঁপছ কেন? সে উত্তরে বলল, আমার জ্বর, রাসূল (সাঃ) উপদেশ দিলেন যে, জ্বরকে মন্দ বলবেনা, জ্বর মানুষের পাপরাশিকে এমনভাবে পরিষ্কার করে দেয় যেমনভাবে আগুন লোহা মরিচা দূর করে পরিষ্কার করে দেয়।
(মুসলিম)
“হযরত আতা বিন রেহাহ (রহঃ) নিজের এক ঘটনা বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত আব্বাস (রাঃ) কা’বার নিকট আমাকে বললেন, তোমাকে কি বেহেশতী মহিলা দেখাব? আমি বললাম, অবশ্যই দেখান। তিনি বললেন, কালো রং এর ঐ মহিলাটিকে দেখ। সে একবার রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার উপর মৃগী রোগের এমন প্রভাব যে, তা যখন উঠে তখন আমার হুশ জ্ঞান থাকে না, এমন কি আমার শরীরেরও কোন ঠিক থাকে না, এমতাবস্থায় আমি উলঙ্গ হয়ে যাই। হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য আল্লাহর নিকট দোআ করুন! রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি যদি ধৈর্য্য সহকারে এ কষ্ট সহ্য করতে পারো তাহলে আল্লাহ তোমাকে বেহেশত দান করেবন এবং তুমি যদি ইচ্ছা কর তা হলে আমি দোআ করে দেব যে, আল্লাহ তোমাকে রোগ মুক্ত করে দেবেন। একথা শুনে মহিলাটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ধৈর্য্যের সাথে রোগ যন্ত্রণা সহ্য করে যাব তবে আপনি আল্লাহর নিকট দোআ করুন! আমি যেনো এ অবস্থায় উলঙ্গ হয়ে না যাই। তখন রাসূল (সাঃ) তার জন্য দোআ করলেন। হযরত আতা বলেন, আমি ঐ লম্বা দেহী মহিলা উম্মে রাফযকে কা’বা ঘরের সিঁড়িতে দেখেছি”।
৬. আপনজনের মৃত্যুতে তিন দিনের বেশী শোক পালন করবে না। মৃত্যুতে শোকাহত হওয়া ও অশ্রু ঝরা স্বভাবগত ব্যাপার কিন্তু তার মুদ্দত তিন দিনের বেশী নয়। রাসূল (সাঃ) বলেন, কোন মুমিনের পক্ষে কারো জন্যে তিন দিনের বেশী শোক পালন করা নাজায়েয, অবশ্য বিধবা (তার স্বামীর জন্যে) চার মাস দশ দিন শোক পালন করতে পারে। এ সময়ের মধ্যে সে কোন প্রকার রঙ্গীন কাপড় পরবে না, সুগন্ধি ব্যবহার করবে না এবং সাজ-সজ্জা এবং রূপ চর্চা করবে না।
(তিরমিযি)
হযরত যয়নাব বিনতে জাহশের ভাইয়ের মৃত্যুর চতুর্থ দিন কিছু মহিলা শোক প্রকাশের জন্য তাঁর নিকট আসল। সকলের সম্মুখে তিনি সুগন্ধি লাগিয়ে বললেন, আমার এখন সুগন্ধি লাগানোর কোন প্রয়োজন ছিল না। আমি সুগন্ধী লাগানোর কোন প্রয়োজন ছিল না। আমি সুগন্ধী শুধু এজন্য লাগিয়েছে আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, “কোন মহিলাকেই স্বামী ব্যতিত অন্য কারো জন্যে তিন দিনের বেশী শোক পালন করা জায়েয নয়”।
৭. দুঃখ-শোক ও বিপদাপদে একে অন্যকে ধৈর্য্য ধারণের পরামর্শ দেবে। রাসূল (সাঃ) যখন ‘উহুদ প্রান্তর থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন মহিলারা নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনের সংবাদ জানার জন্যে উপস্থিত হলেন। হামনা বিনতে জাহস যখন রাসূল (সাঃ)-এর সামনে এলেন, তখন তিনি তাকে ধৈর্য্য ধারণের উপদেশ দিয়ে বললেন, তোমার ভাই আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে ধৈর্য্য ধারণ কর, তিনি “ইন্না-লিল্লাহি ও ইন্না-ইলাহি রাজিউন” পড়লেন এবং তার জন্যে মাগফিরাত কামনা করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, তোমার মামা হামযা (রাঃ)-এর উপরও ধৈর্য্য ধারণ কর, তিনি আবার “ইন্ন লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন” পড়লেন এবং তার জন্যেও মাগফিরাতের দোআ করলেন।
“হযরত আবু তালহা (রাঃ)-এর অসুস্থ ছেলেকে অসুস্থ রেখেই তিনি নিজের জরুরী কাজে চলে গেলেন, তাঁর যাবার পর ছেলেটি মারা গেল, বেগম আবু তালহা (রাঃ) স্ত্রী লোকদের বলে রাখল, আবু তালহা (রাঃ)-কে ছেলের মৃত্যুর এ সংবাদ না জানাতে। তিনি সন্ধ্যায় নিজের কাজ থেকে ফিরে এসে বিকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে কেমন আছে? তিনি বললেন, আগের থেকে অনেক নীরব বা শান্ত এবং তিনি তাঁর জন্যে খানা নিয়ে আসলেন, তিনি শান্তিমত খানা খেয়ে শুয়ে পড়লেন। ভোরে সতী বিবি হেকমতের সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা কেউ যদি কাউকে কোন বস্তু ধার দিয়ে তা আবার ফেরত চায় ত হলে তার কি ঐ বস্তু আটকিয়ে রাখার কোন অধিকার আছে? আবু তালাহ (রাঃ) বললেন, আচ্ছা এ হক কিভাবে পূরণ করা যাবে? তখন ধৈর্য্যশীলা বিবি বললেন, নিজের ছেলের ব্যাপারে ধৈর্য্যধারণ কর”।
(মুসলিম)
৮. সত্য পথে অর্থাৎ দীনের পথে আসা বিপদসমূহকে হাসি মুকে বরণ করে নেবে এবং ঐ পতে যে দুঃখ-কষ্ট আসে তাতে দুঃখিত না হয়ে ধৈর্য্যের সাথে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করবে যে, তিনি তাঁর পথে তোমার কোরবানী কবুল করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের (রাঃ)-এর মাতা হযরত আসমা (রাঃ) ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) যুদ্ধ থেকে ফিরে তার মার রোগ সেবার জন্য আসলেন, মা তাঁকে বললেন, বৎস! মনে বড় ইচ্ছা যেন দু’টি বিষয়ের যে কোন একটি দেখা পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে জীবিত রাখেন। একটি হলো তুমি বাতিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়ে যাবে এবং আমি তোমার শাহাদাতের সংবাদ শুনে ধৈর্য্য ধারণ করার সৌভাগ্য অর্জন করবো অথবা তুমি গাজী হবে আমি তোমাকে বিজয়ী হিসেবে দেখে শান্তি পাবো। আল্লাহর ইচ্ছায়-হযরত আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের তাঁর মাতার জীবিতাবস্থায়ই শাহাদাত বরণ করলেন, শাহাদাতের পর হাজ্জাজ যোবায়ের (রাঃ) এর লাশ শূলিতে চড়ালে হযরত আসমা (রাঃ) যথেষ্ট বৃদ্ধা ও অত্যন্ত দুর্বল হওয়া সত্বেও এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখার জন্যে শূলির নিকট এসে নিজের কলিজার টুকরার লাশ খোর পর কান্নাকাটি করার পরিবর্তে হাজ্জাজকে বললেন, “এ আরোহীর কি এখনো ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে নামার সময় হয়নি”?
৯. দুঃখ-কষ্টে একে অন্যের সহযোগিতা করবে। বন্ধু-বান্ধবের দুঃখ-শোকে অংশ গ্রহণ করবে এবং শোক ভুলিয়ে দেবার জন্যে সাধ্যমত সাহায্য করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেন, “সমগ্র মুসলিম জাতি একজন মানুষের শরীরের সমতুল্য, তার যদি চোখ অসুস্থ হয় তা হলে তার সারা শরীর দুঃখ অনুভব করে এবং তার যদি মাথা ব্যথা হয় তা হলে তার সারা শরীর ব্যথায় কষ্ট পায়”।
(মুসলিম)
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি সন্তানহারা কোন মহিলাকে সান্ত্বনা প্রদান করে আল্লাহ তাআলা তাকে বেহেশতে প্রবেশের অনুমতি দান করবেন এবং তাকে বেহেশতের পোশাক পরিধান করাবেন”।
(তিরমিযি)
রাসূল (সাঃ) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি কোন বিপদগ্রস্তকে সান্ত্বনা প্রদান করবে তিনি এমন পরিমাণ সওয়াব পাবেন যে পরিমাণ সওয়াব বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি বিপদে ধৈর্য্যধারণ করার কারণে পাবেন”।
(তিরমিযি)
রাসূল (সাঃ) জানাযায় অংশ গ্রহণ করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেন, যে জানাযায় অংশ গ্রহণ করে জানাযার নামায পড়ে সে এক ক্বীরাত পরিমাণ, আর যে জানযার নামাযের পর দাফনেও অংশ গ্রহণ করল সে দু’ক্বীরাত পরিমাণ সওয়াব পাবে। একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ দু’ক্বীরাত কত বড়? অর্থাৎ দু’ক্বীতরাতের পরিমাণ কতটুকু? তিনি বললেন, দুটি পাহাড়ের সমতুল্য”।
(বুখারী)
১০. বিপদ ও শোকে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং নামাজ পড়ে অত্যন্ত মিনতির সাথে আল্লাহ তাআলার নিকট দোআ করবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
আরবি
“হে মুমিনগণ! (বিপদ ও পরীক্ষায়) ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে (আল্লাহ তাআলার নিকট) সাহায্য প্রার্থনা কর”।
(আর-বাক্বারাহ)
শোক অবস্থায় চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হওয়া, দুঃখিত হওয়া স্বভাবগত ব্যাপার। অবশ্য চীৎকার করে জোরে জোরে কাঁদা অনুচিত। রাসূল (সাঃ) নিজেও কাঁদতেন, তবে তাঁর কান্নায় শব্দ হতো না। ঠাণ্ডা শ্বাস নিতেন চোখ থেকে অশ্রু বের হতো এবং বক্ষঃস্থল থেকে এমন শব্দ বের হতো যেনো কোন হাঁড়ি টগ বগ করছে অথবা কোন চাক্কি ঘুরছে, তিনি নিজেই নিজের শোক ও কান্নার অবস্থা এমনভাবে প্রকাশ করেছেন।
“চক্ষু অশ্রু প্রবাহিত করে, অন্তর দুঃখিত হয়, অথচ আমি মুখ থেকে এমন কথা প্রকাশ করি যার দ্বারা আমাদের প্রতিপালক সন্তুষ্ট হন”।
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন রাসূল (সাঃ) যখন চিন্তিত হতেন, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেন, “সুবহানাল্লাহিল আযীম” (মহান মর্যাদাসম্পন্ন আল্লাহ পবিত্র ও মহিমান্বিত)। আর যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন এবং দোআয় মগ্ন হয়ে যেতেন তখন বলতেন, ইয়া হাইয়্যু ইয়া ক্বাইয়্যুম (হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী)।
(তিরমিযি)
১১.সা’দবিনআবীওয়াক্কাস(রাঃ)থেকেবর্ণিত,রাসূল(সাঃ)বলেছেন,“যুনুনূন1 মাছের পেটে থাকাবস্থায় দোআ করেছিল”। তা ছিল এই-
আরবি
“আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, আপনি ত্রুটিমুক্ত ও পবিত্র, আমি নিশ্চয়ই অত্যাচারীদের মধ্যে গণ্য ছিলাম।
সুতরাং যে কোন মুসলমান তাদের দুঃখ-কষ্টে এ দোআ দ্বারা প্রার্থনা করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তার দোআ কবুল করবেন”।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) যখন দুঃখ-শোকে আপতিত হতেন তখন এ দো’আ করতেন।
আরবি
“আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তিনি আরশের মালিক, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, আসমান ও যমিনের প্রতিপালক, তিনি মহান আরশের মালিক।
(বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন-
আরবি
এ দোয়া ৯৯টি রোগের মহৌষধ। মূল কথা হচ্ছে এ দোআ পাঠকারী দুঃখ ও শোক থেকে নিরাপদ থাকতে পারে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেন, যে বান্দাহ দুঃখ-কষ্টে এ দোআ পাঠ করে, আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তার দুঃখ ও শোককে খুশী ও শান্তিতে রূপান্তরিত করে দেন।
আরবি
“হে আল্লাহ! আমি তোমার বান্দাহ, তোমার বান্দাহর ছেলে, তোমার বান্দির ছেলে, আমার দেশ তোমার হাতে অর্থাৎ আমার সব কিছু তোমার ইচ্ছাধীন, আমার ব্যাপারে তোমারই নির্দেশ কার্যকর, আমার সম্পর্কে তোমারই সিদ্ধান্ত ন্যায়সঙ্গত, আমি তোমার ঐ সকল নামের অসীলায় যে সকল নামে তুমি নিজে সম্বোধিত হয়েছ অথবা যে সকল নাম তুমি তোমার কিতাবে উল্লেখ করেছ অথবা যে সকল নাম তোমার মাখলুককে দীক্ষা দিয়েছ অথবা তোমার গোপন ভাণ্ডারে লুকায়িত রেখেছ তোমার নিকট আবেদন করছি তুমি কুরআন মজীদকে আমার আত্মার শান্তি, আমার চোখের জ্যোতি, আমার শোকের চিকিৎসা ও আমার চিন্তা দূরীকরণের উপকরণ করে দাও”।
(আহমদ, ইনে হাম্বাল, হাকেম)
১২. আল্লাহ না করুক! কোন সময় যদি বিপদ-আপদ চতুর্দিকে থেকে ঘিরে ধরে জীবন কঠিন হয়ে ওঠে এবং শোক-দুঃক এমন ভয়ানক রূপ ধারণ করে যে, জীবন হয়ে যাবে বিষাদময় তখনও মৃত্যু কামনা করবে না এবং কখনও নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংস করার লজ্জাস্কর চিন্তাও করবে না। কাপুরুষতা, খেয়ানতও মহাপাপ, এরূপ অস্থিরতা ও অশান্তির সময় নিয়মিত আল্লাহর দরবারে এ দোআ’করবে-
আরবি
“আয় আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত আমার জীবিত থাকা ভালো মনে কর ততদিন আমাকে জীবিত রাখ। আর যখন মৃত্যু ভালো হয তখন মৃত্যু দান কর”।
(বুখারী, মুসলিম)
১৩. কোন বিপদগ্রস্তকে দেখে এ দোআ করবে।
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে কোন বিপদগ্রস্তকে দেখে এ দোআ করবে সে নিশ্চয়ই ঐ বিপদ থেকে নিরাপদ থাকবে।
আরবি
“সকল প্রশংসা কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্যে যিনি তোমাকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আর অনেক সৃষ্টির উপর তোমাকে মর্যাদা দান করেছেন”।
ভয়-ভীতির সময় করণীয়
১. দীনের শত্রুদের হত্যা ও লুণ্ঠন, অত্যাচার ও বর্বরতা, ফিৎনা-ফাসাদের আতঙ্ক প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা ধ্বংস লীলার ভয় ইত্যাদি সর্বাবস্থায় মুমিনের কাজ হচ্ছে মূল কারণ খুঁজে বরে করা। ভাসা ভাসা প্রচেষ্টায় সময় নষ্ট না করে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশিত পথে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে,
আরবি
“তোমাদের উপর যে সকল বিপদাপদ আসে তা তোমাদেরই কৃত-কর্মের ফল এবং আল্লাহ তার অনেকগুলোই ক্ষমা করে দেন”।
(শূরা ৩০)
পবিত্র কুরআনে-এর চিকিৎসাও দিয়েছেন।
আরবি
“তোমরা সকলে একত্রিত হয়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর। হে মুমিনগণ! যেনো তোমরা কল্যাণ লাভ কর”।
তাওবা শব্দের অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা। পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত উম্মত যখন নিজেদের পাপরাশির উপর লজ্জিত হয়ে আল্লাহর দিকে পুনঃ ইবাদতের আবেগ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে এবং লজ্জা অশ্রু দ্বারা নিজ পাপের আবর্জনা ও জঞ্জাল ধুয়ে পরিষ্কার করে আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত কর্মের ওয়াদা পূরণের অঙ্গীকার করে, পবিত্র কুরআনের পরিভাষায় তাওবাহ বলে তাকেই। এ তাওবাই ও ইস্তেগফার সর্ব প্রকার ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক থেকে নিরাপদ থাকার প্রকৃত চিকিৎসা।
২. দীনের শত্রুদের যুলুম অত্যাচারে যালেমের নিকট দয়া ভিক্ষা করার মাধ্যমে নিজের দীনী চরিত্রকে কলুষিত না করে বরং দুর্বলতার মুকাবেলায় সাহসিকতা প্রদর্শন করতে হবে।
যে কারণে ভীরুতা সৃষ্টি হয এবং দীনের শত্রুরা তোমার উপর অত্যাচার করতে ও মুসলমানকে গ্রাস করতে সাহস পাচ্ছে। রাসূল (সাঃ) এ দু’টি কারণ উল্লেক করেছেনঃ
(ক) দুনিয়ার মহব্বত এবং
(খ) মৃত্যু ভয়।
এমন সংকল্প করবে যাতে শুধু নিজের নয় এমনটি সমগ্র জাতির অন্তর থেকে এসব রোগ দূর হয়ে যায়।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “আমার উম্মতের ওপর ঐ সময় আসন্ন যখন অন্যান্য জাতি (সহজ শিকার মনে করে) তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে যেমন পেটুক লোকেরা দস্তরখানে খাদ্য বস্তুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ঐ সময় কি আমরা সংখ্যায় এতই নগণ্য হব যে, অন্যান্য জাতি একত্রিত হয়ে আমাদেরকে গ্রাস করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে? “তিনি বললেন, না! ঐ সময় তোমাদের সংখ্যা নগণ্য হবে না বরং তোমরা বন্যায় ভেসে যাওয়া খড়কুটার মত ওজনতীন হবে এবং তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর তোমাদের মধ্যে ভীরুতা কাপুরুষতা দেখা দেবে। এ সময় জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কাপুরুষতা কেন সৃষ্টি হবে? তিনি বললেন, এ কারণে যে-
- দুনিয়ার প্রতি তোমাদের মহব্বত বৃদ্ধি পাবে।
- তোমাদের মধ্যে মৃত্যু ভয় বাড়বে এবং তোমরা মৃত্যুকে ঘৃণা করবে। (বুখারী)
৩. স্বার্থপরতা, বিলাসিতা, নারী নেতৃত্ব এবং পাপাচার থেকে সমাজকে পবিত্র করবে এবং নিজের সমাজ বা সংগঠনকে অধিক শক্তিশালী করে সম্মিলিত শক্তি দ্বারা সমাজ থেকে ফেৎনা-ফাসাদ নির্মূল করে জাতির মধ্যে বীরত্ব, উৎসাহ-উদ্দীপনা, জীবন চেতনা সৃষ্টির চেষ্টা করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ যেখন তোমাদের শাসকগন হবে (সমাজের) উত্তম লোক, তোমাদের ধনীরা হবে দানশীল ও উদার এবং তোমাদের পারস্পরিক কাজসমূহ সমাধা হবে পরামর্শের ভিত্তিতে তখন অবশ্যই যমিনের এপিঠ (জীবনকাল) হবে যমিনের নিচের পিঠ থেকে উত্তম। আর যখন তোমাদের শাসকরা হবে দুর্নীতিবাজ ও দুশ্চরিত্র লোক, তোমাদের মহিলাদের নেতৃত্বে চলবে তখন যমিনের নিচের অংশ অর্থাৎ মৃত্যু হবে উপরের অংশের (অর্থাৎ জীবন থাকার) তুলনায় উত্তম।
(তিরমিযি)
৪. অবস্তা যতই নাজুক হোকনা কেন অর্থাৎ পরিবেশ যতই প্রতিকূল হোক ঐ প্রতিকূল পরিবেশেও সত্যের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা থেকে দূরে থাকবে না। সত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় জীবন দান করা নির্লজ্জের জীবন থেকে অনেক উত্তম। কঠিন থেকে কঠিনতম পরীক্ষায় এবং কঠোর থেকে কঠোরতম অবস্থায়ও সত্য থেকে পিছু হটবে না। কেউ মৃত্যুর ভয় দেখালে তাকে মুচকি হাসি দ্বারা উত্তর প্রদান করবে। শাহাদাতের সুযোগ আসলে আগ্রহ ও আকাংখার সাথে তাকে গ্রহণ করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “চাকা ঘূর্ণায়মান। সুতরাং যে দিকে কুরআনের গতি হবে তোমরাও সে দিকে ঘুরবে। সাবধান! অতি অল্প দিনের মধ্যেই কুরআন ও বাতিল আলাদা হয়ে যাবে। (সাবধান!) তোমরা কুরআন ছাড়বে না। ভবিষ্যতে এমন শাসক আসবে যারা তোমাদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক হবে। তোমরা তাদের আনুগত্য স্বীকার করলে তোমাদেরকে সত্য পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। আর যদি তোমরা তাদের বিরোধিতা করো তা হলে তারা তোমাদেরকে মৃত্যুর মতো কঠিন শাস্তি প্রদান করবে, এমনকি তা মৃত্যু দণ্ডও হতে পারে। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তখন আমরা কি করব? তিনি বললেন, তোমরা তা-ই করবে যা হযরত ঈসা (আঃ)-এর সাথীর করেছেন। তাদেরকে করাত দ্বারা ফাড়া হয়েছে এবং শূলীতে চড়ানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলার নাফরমানী করে জীবিত থাকার চেয়ে আল্লাহর পথে জীবন দান করা উত্তম”।
৫. যে সমস্ত কারণে সমাজে ভয়-ভীতি বৃদ্ধি পায়, অভাব-অনটন, দুর্ভিক্ষ, হত্যা ছড়িয়ে পড়ে, শত্রুদের যুলুম অত্যাচারে জাতি দিশেহারা হয়ে পড়ে ঐ সব সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ)বলেন, যে জাতির অন্তরে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে দেন, যেন সমাজে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে সে সমাজ দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়, যে সমাজে বিশ্বাসঘাতকতার রীতি প্রচলিত হবে, তারা অবশ্যই অভাব অনটনের শিকার হবে।
যে সমাজে অবিচার চালু হবে সে সমাজে হত্যা, খুন সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হবে। যে জাতি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে সে জাতির উপর শত্রুর আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী।
(মিশকাত)
৬. শত্রু পক্ষ থেকে ভয় অনুভব হলে এ দোআ পাঠ করবে।
আরবি
“হে আল্লাহ! আমরা ঐ শত্রুদের মোকাবেলায় তোমাকেই ঢাল হিসেবে পেশ করছি এবং তাদের অনিষ্টতা ও দুষ্টামী থেকে মুক্তির জন্য তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি”।
(আবু দাউদ, নাসায়ী)
৭. শত্রু বেষ্টিত স্থানে আবদ্ধ হয়ে গেলে এ দোআ পাঠ করবে।
আরবি
“আয় আল্লাহ! তুমি আমাদের ইজ্জত ও সম্মান রক্ষা করো এবং আমাদেরকে ভয়-ভীতি থেকে নিরাপদ রাখো”।
৮. যখন ঘূর্ণিঝড় অথবা মেঘ বাদল উঠতে দেখা যায় তখন অস্থিরতা ও ভয় অনুভব করবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূল (সাঃ)-কে মুখ খুলে হা-হা করে হাসতে দেখিনি। তিনি ঘাবড়িয়ে যেতেন এবং দোআ করতে শুরু করতেন। ভয়ের কারণে কখনো উঠতেন কখনো বসতেন, বৃষ্টি বর্ষণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করতো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি লোকদেরকে দেখছি যে, তারা মেঘ-বাদল দেখলে খুশী হয় যে, বৃষ্টি বর্ষিত হবে। অথচ আপনাকে দেখতে পাচ্ছি যে, মেঘ-বাদল দেখলে আপনার চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায় এবং আপনি অস্থির হয়ে পড়েন। এর উত্তরে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
হে আয়শা! আমি কি করে নির্ভয় হয়ে যাব যে, এ মেঘের মধ্যে শাস্তি নিহিত নেই যে মেঘ দ্বারা আদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল সে মেঘ দেখেও তারা বলেছিল, এ মেঘ আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করবে।
(বুখারী, মুসলিম)
আর এ দোআ পাঠ করবে-
আরবি
“হে আল্লাহ! বাতাসকে শান্তির বাতাস করে দাও, অশান্তির বাতাস নয়! আয় আল্লাহ! একে রহমত হিসেবে নাযিল কর কিন্তু আযাব হিসেবে নয়।
ঘূর্ণিঝড়ের সাথে যদি ঘোর আঁধারও ছেয়ে যায় তা হলে “কুলআউযু বিরাব্বিল ফালাক্ব” ও “কুলআউযু বিরাব্বিন্নাস ও পাঠ করবে”।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) ঘূর্ণিঝড় উঠেছে দেখতে পেলে এ দোআ পাঠ করতেন-
আরবি
“আয় আল্লাহ! আমি তোমার নিকট এ ঘূর্ণিঝড়ের ভালো দিক এর মধ্যে যা আছে তাই এবং যে উদ্দেশ্যে একে প্রেরণ করা হয়েছে তার ভালো দিক কামনা করছি। এ ঘূর্ণিঝড়ের খারাপ দিক, যা আছে তা এবং একে যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে তার খারাপ দিক হতে তোমার আশ্রয় কামনা করি।
(মুসলিম,তিরমিযি)
৯. অত্যধিক বৃষ্টির কারণে ক্ষতির ভয় দেখা দিলে এ দোআ করবে।
আরবি
“আয় আল্লাহ! আমাদের আশেপাশে বর্ষিত হোক, কিন্তু আমাদের উপর নয়। আয় আল্লাহ! পাহাড়ের উপর টিলা এবং উচ্চ ভূমির উপর, মাঠে ময়দানে এবং ক্ষেত-খামার ও তরুলতা জন্মানোর স্থানে বর্ষিত হোক।
(বুখারী,মুসলিম)
১০. যখন মেঘের গর্জনও বজ্রপাতের শব্দ শুনবে তখন কথাবার্তা বন্ধ করে পবিত্র কুরআনের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করবে-
আরবি
আর মেঘের গর্জনও আল্লাহর প্রশংসাসূচক তাসবীহ পাঠ করে, ফিরিশতাগণ আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে তাঁর তাসবিহ পাঠ করে।
(সূরায়ে রা’দ ১৩)
হযরত আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের মেঘের গর্জন শুনে কথাবার্তা বন্ধ করে আয়াত পাঠ করতেন।
(আল-আদাবুল মুফরাদ)
হযরত কা’ব বলেন, যে ব্যক্তি মেঘের গর্জনের সময় তিনবার এ আয়াত পাঠ করবে সে গর্জনের দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদে থাকবে।
(তিরমিযি)
রাসূল (সাঃ) যখন মেঘ গর্জন ও বজ্রপাতের শব্দ শুনতেন তখন এ দোআ করতেন-
আরবি
“আয় আল্লাহ! আমাদেরকে তোমার গযব দ্বারা ধ্বংস করোনা। আমাদেরকে তোমার আযাব দ্বারা এবং এ ধরনের শাস্তি আসার পূর্বে নিরাপত্তা দান কর”।
(আল-আদাবুল,মুফরাদ)
১১. যখন কোথাও আগুন লেগে যায় তখন নিভাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে এবং মুখে “আল্লাহু আকবার” বলতে থাকবে।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “যখন আগুন লাগতে দেখবে তখন (উচ্চঃস্বরে) “আল্লাহ আকবার” বলবে, তাহলে তাকবীর আগুনকে নিভিয়ে দেয়”।
১২. ভয়-ভীতির আশংকা বেশী হলে এ দোআ পাঠ করবে, আল্লাহর ইচ্ছায় ভীতি দূর হবে এবং শান্তি ও সন্তোষ লাভ হবে। হযরত বারা-বিন আযেব বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট অভিযোগ করলো আমার উপর ভয়-ভীতির প্রভাব লেগেই থাকে। তিনি বললেন, “এ দোআ পাঠ করবে”। সে এ দোআ পাঠ করতে লাগলো, আল্লাহ তাআলা তার মন থেকে ভয়-ভীতি দূর করে দিলেন।
(তিবরানী)
আরবি
“আমি সে মহান আল্লাহর গুণগান প্রকাশ করছি। যিনি সকল পবিত্রতার মালিক এবং ফিরিশতাগণের ও জিব্রাইল (আঃ)-এর প্রতিপালক! সমগ্র আকাশমন্ডল ও পৃথিবীতে তোমারই ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য বিরাজমান।
খুশীর সময় করণীয়
১. যখন খুশী বা আনন্দ প্রকাশের সুযোগ আসে তখন আনন্দ প্রকাশ করবে। খুশী মানুষের জন্য একটি স্বাভাবিক দাবী ও প্রাকৃতিক নিয়ম। দীন মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা ও গুরুত্ব অনুভব করে এবং কতিপয় সীমারেখা ও শর্তসাপেক্ষে ঐ প্রয়োজনসমূহ পূরণ করতে উৎসাহ প্রদান করে। দীন কখনো এটা চায়না যে তুমি কপট গাম্ভীর্য, অবাঞ্ছিত মর্যাদা, সর্বদা মনমরা ভাব ও নির্জীবতা দ্বারা তোমার কর্মকশলতা ও যোগ্যতাকে নিস্তেজ করে দেবে। সে (দীন) তোমাকে খুশী ও আনন্দ প্রকাশের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে এও দাবী করে যে, তুমি সর্বদা উচ্চ আকাংখা, সজীব উদ্যম ও নব উদ্দীপনায় সজীব থাকো।
জায়েয স্থানসমূহে খুশী প্রকাশ না করা এবং খুশী বা আনন্দ উদযাপনকে দীনী মর্যাদার পরিপন্থী মনে করা দীনের প্রকৃত জ্ঞান নেই এমন লোকের পক্ষেই সম্ভব। তোমার কোন দীনী কর্তব্য পালনের সৌভাগ্য লাভ হলো, তুমি, অথবা তোমার কোন বন্ধু যোগ্যতার দ্বারা উচ্চাসন লাভ করলেন, আল্লাহ তাআলা তোমাকে ধন-দৌলত অথবা অন্য কোন নেয়ামত দান করলেন, তুমি কোন দীনী সফর শেষে বাড়ীতে ফিরলে, তোমার বাড়ীতে কোন সম্মানিত মেহমানের আগমন ঘটল, তোমার বাড়ীতে বিয়ে-শাদী অথবা শিশু জন্মগ্রহণ করল এবং কোন প্রিয়জনের সুস্থ অথবা মঙ্গলের সুসংবাদ আসলো অথবা কোন মুসলিম সেনা বাহিনীর বিজয় সংবাদ শুনলে বা যে কোন ধরনের উৎসব পালন অবশ্যই তোমার জন্মগত অধিকার। ইসলাম শুধু আনন্দ উদযাপনের অনুমতিই দেয় না বরং দীনী দাবীর অংশ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়।
হযরত কাআ’ব বিন মালেকের বর্ণনাঃ আল্লাহ তাআলা আমার তওবাহ কবুল করেছেন এই সুসংবাদ জানতে পেরে আমি তাড়াতাড়ি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে গিয়ে পৌঁছলাম। আমি গিয়ে সালাম দিলাম ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর মুখমণ্ডল ঝকঝক করছিল। প্রকৃতপক্ষে রাসূল (সাঃ) যখন খুশী হতেন তখন তাঁর মুখমণ্ডল এমন ঝিকিমিকি করতো যেনো চাঁদের একটি টুকরো। তাঁর মুখমণ্ডলে উজ্জ্বল প্রভা দেখেই আমরা বুঝতে পারতাম যে, তিনি খুশী অবস্থায় আছেন।
(রিয়াদুস সালেহীন)
২. উৎসব উপলক্ষে মন খুলে আনন্দ করবে এবং নিজকে কিছুক্ষণের জন্যে আনন্দ উদযাপনে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবে। অবশ্য তা যেন সীমার মধ্যে থাকে।
রাসূল (সাঃ) যখন (হিজরত করে) মদীনায় তাশরীফ আনলেন তখন বললেনঃ তোমরা বছরে যে দু’দিন আনন্দ উদযাপন করতে, এখন আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তার চেয়ে উত্তম দু’দিন দান করেছেন অর্থাৎ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। সুতরাং বছরের এ দু’ইসলামী উৎসবে আনন্দ খুশীর পরিপূর্ণ প্রদর্শনী করবে এবং মিলেমিশে খোলামনে স্বাভাবিক নিয়মে কিছু চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করবে। এ কারণে উৎসবের এ দু’দিন রোজা রাখা হারাম। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
এ দিন উত্তম পানাহার, পরস্পর উৎসবের স্বাদ গ্রহণ ও আল্লাহকে স্মরণ করার জন্যে”।
(শরহে মা আনিউল আসার)
ঈদের দিন গুরুত্বের সাথে পরিচ্ছন্নতা এবং নাওয়া-ধোয়ার ব্যবস্থা করবে। ক্ষমতানুযায়ী সর্বোত্তম কাপড় পরে সুগন্ধি ব্যবহার করবে, খাদ্য খাবে এবং শিশুদেরকে জায়েয পন্থায় আনন্দফূর্তি ও খেলাধুলা করে চিত্তবিনোদন ও মনোরঞ্জনের সুযোগ দেবে। যেনো তারা খোলা মনে আনন্দ উদযাপন করতে পারে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, ঈদের দিন আনসারী মেয়েরা (আমার ঘরে) বসে আনসাররা ‘বুআস’1 যদ্ধের সময় যে গান গেয়েছিল সে গান গাচ্ছিল। এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর (রাঃ) এসে বললো, “নবীর ঘরে এ গান-বাদ্য!” রাসূল (সাঃ) বললেন, “আবু বকর! তাদের কিছু বলো না, প্রত্যেক জাতিরই উৎসবের একটি দিন থাকে-আজ আমাদের ঈদের দিন”।
একবার ঈদের দিন কিছু হাবশী (কাফ্রী) বাজিকর যুদ্ধ নৈপুণ্য দেখাচ্ছিল। রাসূল (সাঃ) নিজেও দেখছিলেন এবং হযরত আয়েশা (রাঃ)-কেও নিজের আড়ালে রেখে দেখাচ্ছিলেন, তিনি বাজিকরদেরকে ধন্যবাদও দিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত আয়েশা যখন দেখতে দেখতে পরিশ্রান্ত হয়ে গেলেন তখন তিনি বললেন, আচ্ছা এখন যাও।
(বুখারী)
৩. আনন্দ উদযাপনে ইসলামী রুচি, ইসলামী নির্দেশ ও রীতি-নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখবে। যখন আনন্দ উপভোগ করবে তখন প্রকৃত আনন্দদাতা আল্লাহ তা’আলার শুকরিয়া আদায় করবে। তাঁর দরবারে সেজদায় শোকর আদায় করবে। আনন্দের উত্তেজনায় ইসলাম বিরোধী কোন কার্য বা রীতিনীতি ওআকীদা বিরোধী কোন কার্যকলাপ করবে না। আনন্দ প্রকাশ অবশ্যই করবে কিন্তু কখনও সীমালংঘন করবে না। আনন্দ প্রকাশে এত বাড়াবাড়ির করবে না যাতে গৌরব অহংকার প্রকাশ পায়। আর আবেদন-নিবেদন, বন্দেগীতেও ও বিনয়ের লোপ পায়।
পবিত্র কুরআনে আছে-
আরবি
আল্লাহর নেয়ামত পেয়ে তোমরা অহংকার করবে না, কেননা আল্লাহ অহংকরীকে ভালোবাসেন না।
(সূরায়ে আল-হাদীদ, আয়াত-২৩)
আনন্দে এমন বিভোর হয়ে যাবে না যে, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যাবে, মুমিনের আনন্দ প্রকাশের ধারা এই যে, মূল আনন্দদাতা আল্লাহকে আরো বেশী বেশী স্মরণ করা। তাঁর দরবারে সেজদায় শোকর এবং নিজের কথা ও কাজে আল্লাহর দান, মাহাত্ম্য ও মহিমা প্রকাশ করা।
রমযানের পূর্ণ মাস রোযা পালন করে এবং রাত্রিকালে কুরআন তেলাওয়াত ও তারাবীহের সুযোগ পেয়ে যখন ঈদের চাঁদ দেখ তখন আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উঠ। কারণ, আল্লাহ তাআলা তোমাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা আল্লাহর অনুগ্রহে পালন করতে সফলকাম হয়েছ। তাই তুমি তাড়াতাড়ি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ আল্লাহ তোমাকে যে ধন-দৌলত দান করেছেন তার একটা অংশ (ছাদক্বাতুল ফিতর) তোমার গরীব মিসকীন ভাইদের মধ্যে বন্টন করে দেবে যেনো তোমার বন্দেগীতে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকলে তার ক্ষতিপূরণ হয়ে যায় এবং আল্লাহর গরীব বান্দাগণও যেনো এ অর্থ পেয়ে ঈদের আনন্দে শরীক হয়ে সবাই ঈদের আনন্দ প্রকাশ করতে পারে। সুতরাং তুমি এসব নেয়ামত লাভের শোকরিয়া স্বরূপ ঈদের মাঠে গিয়ে জামায়াতের সাথে দু’রাকাআত নামায আদায় করে সঠিক আনন্দ প্রকাশ কর। আর ইহাই হলো সালাতুল ঈদ। অনুরূপভাবে ঈদুল আযহার দিন হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর মহান ও অনুপম কোরবানীর স্মৃতি স্মারক উদযাপন করে কোরবানীর উদ্দীপনায় নিজের অন্তরাত্মাকে মাতোয়ারা করে শুকরিয়ার সেজদা আদায় কর। ইহাই সালাতুল ঈদুল আযহা।
অতঃপর প্রতিটি জনবসতির অলিগলি, রাস্তা-ঘাট তাকবীর তাহলীল ও আল্লাহর মহানত্বের ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। আবার যখন শরীয়তানুযায়ী ঈদের দিনগুলোতে ভালো খাদ্য আহার কর, ভালো কাপড় পরিধান এবং আনন্দ প্রকাশের জন্যে জায়েয পন্থা গুলোকে অবলম্বন কর, তখন তোমার প্রতিটি কর্মকাণ্ড তোমার ইবাদতে পরিগণিত হয়।
৪. নিজের আনন্দে অন্যকে শরীক করবে অনুরূপভাবে অন্যের আনন্দে নিজে এবং আনন্দ প্রকাশের সুযোগ লাভে ধন্যবাদ দেয়ারও চেষ্টা করবে।
কা’আব বিন মালেক (রাঃ) এর তাওবা কবুল হওয়ার সংবাদ সাহাবায়ে কেরাম জানতে পেরে তাঁরা দলে দলে এসে তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে লাগলেন এবং আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন। এমনকি হযরত তালহা (রাঃ) এর কৃতজ্ঞতা এবং আনন্দ প্রকাশে হযরত কা’আব এতই আবেগাপ্লুত হন যে, জীবনভর তাঁর নিকট স্মরণীয় হয়েছিল। হযরত কা’আব বৃদ্ধাবস্থায় যখন নিজের পরীক্ষা ও তাওবা কবুলের ঘটনা নিজ ছেলে আবদুল্লাহকে বিস্তারিত বললেন, তখন বিশেষ করে হযরত তালহা (রাঃ)-এর আনন্দ প্রকাশের কথা আলোচনা করলেন এবং বললেন, আমি (হযরত) তালহা (রাঃ)-এর ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও আনন্দ প্রকাশের আকর্ষণকে কখনও ভুলতে পারব না। স্বয়ং রাসূল (সাঃ) যখন হযরত কা’আব (রাঃ)-কে তাওবা কবুলের সুসংবাদ দিলেন তখন অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করে বললেন, “কা’আব! এটা তোমার জীবনের চাইতে বেশী খুশীর দিন।
(রিয়াদুস সালেহীন)
কারো বিয়ের অনুষ্ঠানে অথবা কারো সন্তানের জন্ম দিনে অথবা অনুরূপ অন্য কোন আনন্দ উৎসবে যোগাদন করবে এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবে।
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) যখন কারো বিয়েতে যেতেন তাকে মোবারকবাদ দিতেন ও এরূপ বলতেন-
আরবি
“আল্লাহ তোমাকে বরকতময় রাখুন! তোমাদের উভয়ের উপর বরকত নাযিল করুন! এবং তোমাদের উভয়ের মধ্যে ভালো ও সুন্দর জীবন-যাপনের তাওফীক দিন”।
একবার হযরত হোসাইন (রাঃ) একজনের সন্তানের জন্মে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের নিয়ম শিক্ষা দিতে গিয়ে বললেন, “এভাবে বলবে যে, আল্লাহ! তোমাকে এ দ্বারা খায়ের ও বরকত দান করুন! তাঁর শুকরিয়া আদায় করার তওফীক দিন, সন্তানকে যৌবনের সখ ও সৌন্দর্য দেখার সুযোগ দিন। আর তাকে তোমার অনুগত করে দিন”।
৫. কারো কোন প্রিয়জন অথবা হিতকারী ব্যক্তি দীর্ঘ সফর শেষে যখন ফিরে আসে তখন তাকে অভ্যর্থনা জানাবে এবং তার সুস্থ শরীরে বাড়ী ফিরে আসা ও সফলকাম হওয়ার জন্যে আনন্দ প্রকাশ করবে। সে যদি শান্তিতে দেশে ফিরে আসার শুকরিয়া স্বরূপ কোন উৎসবের ব্যবস্থা করে থাকে তা হলে তাতে যোগদান করবে। তুমি যদি বিদেশ থেকে শান্তি ও সুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরে আসার শুকরিয়া স্বরূপ কোন আনন্দ উদযাপনের ব্যবস্থা কর তাহলে এ আনন্দ উৎসবেও অন্যদেরকে শরীক রাখবে। তবে অনর্থক অতিরিক্ত খরচ ও লোক দেখানো কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে আর নিজের শক্তির বাইরে খরচ করবে না।
রাসূল (সাঃ) যখন বিজয়ী বেশে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম ও শিশু-কিশোররা অভ্যর্থনার জন্য সানিয়াতুল বেদা (বিদায়ী ঘাঁটি) পর্যন্ত আসে।
(আবু দাউদ)
রাসূল (সাঃ) যখন মক্কা থেকে হিজরত শেষে মদীনায় পৌঁছে দক্ষিণ দিক থেকে শহরে প্রবেশ করতে লাগলেন তখন মুসলমান পুরুষ-মহিলা, সন্তান-সন্ততি সবাই অভ্যর্থনা জানাবার জন্য শহর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন এবং তখন আনসারদের ছোট ছোট মেয়েরা মনের আনন্দে গান গাচ্ছিল-
আরবি
“(আজ) আমাদের উপর পূর্ণিমার চাঁদ উদয় হলো, (দক্ষিণ দিকের) সানিয়াতুল বিদা1 থেকে, আমাদের উপর শোকর ওয়াজিব, আহ্বানকারী আল্লাহর পথে যে আহ্বান করেছেন তার জন্যে হাজার শোকরিয়া।
হে, আমাদের মধ্যে প্রেরিত ব্যক্তি! আপনি এমনি দীন এনেছেন আমরা যার অনুসরণ করব”।
“একদা রাসূল (সাঃ) সফর থেকে মদীনায় পৌঁছে উট যবেহ করে লোকদের দাওয়াত করেন”।
(আবু দাউদ)
৬. বিয়ে শাদী উপলক্ষেও আনন্দ করবে। এ আনন্দে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদেরকেও শরীক করবে। এ উপলক্ষে রাসূল (সাঃ) কিছু ভালো গান পরিবেশন করতে ও দফ নাম বাদ্যযন্ত্র বাজাতেও অনুমতি দিয়েছেন। এর দ্বারা আনন্দের মত্ততা প্রশমিত করা এবং বিবাহের সাধারণ প্রচার ও এর প্রসিদ্ধিও উদ্দেশ্য।
হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজের এক আত্মীয় মহিলার সাথে জনৈক আনসারী পুরুষের বিবাহ দিলেন। তাকে যখন বিদায় দেয়া হল তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, লোকেরা তার সাথে কেন একটি দাসী পাঠালোনা, যে দফ বাজাত।
(বুখারী)
হযরত রবী’ বিনতে মাসউদ (রাঃ)-এর বিয়ে হলো। এজন্য কিছু মেয়ে তাঁর নিকট বসে দফ বাজাচ্ছিল এবং বদর যুদ্ধে যারা শাহাদাত বরণ করেছিলেন তাদের প্রশংসা সূচক কবিতা দিয়ে গান গাচ্ছিল, একটি মেয়ে কবিতার এক পংক্তি পাঠ করলোঃ (যার অর্থ হলো)
আমাদের মধ্যে এমন এক নবী আছেন যিনি আগামী দিনের কথা জানেন।
রাসূল (সাঃ) শুনে বললেনঃ এটা বাদ রাখ, আগে যা গাচ্ছিলে তাই গাইতে থাক।
৭. বিয়ে-শাদীর খুশীতে নিজের সাধ্য ও ক্ষমতানুযায়ী নিজের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে কিছু পানাহার করানোর ব্যবস্থা রাখবে। রাসূল (সাঃ) নিজের বিয়েতেও ওলীমার দাওয়াত করেছেন এবং অন্যকেও এরূপ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ
“বিয়েতে যাওয়ার সুযোগ না হলে অন্ততঃপক্ষে ধন্যবাদ বাণী পাঠিয়ে দেবে। বিয়ে-শাদী বা এ জাতীয় আনন্দ প্রকাশের অনুষ্ঠানসমূহে উপহার সামগ্রী উপঢৌকন দিলে পারস্পরিক সম্পর্কে সজীবতা ও দৃঢ়তা সৃষ্টি হয় এবং বন্ধুত্বও বৃদ্ধি পায়। হ্যাঁ এদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবে যে, উপহার যেনো নিজের ক্ষমতানুযায়ী দেয়া হয়, লোক দেখানো ও প্রদর্শনীসুলভ না হয় আর তাতে নিজের অকপটতার হিসাব নিকাশ অবশ্যই করবে।
সন্তানের উত্তম নাম রাখা
নামেও মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ পায় এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও নামের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। নাদুস-নুদুস সুশ্রী শিশুদেরকে সবাই আদর করতে চায়। কিন্তু যখন তার নাম জিজ্ঞেস করা হয় এবং যে কোন অর্থহীন এবং বিশ্রী নাম বলে তখন মনটা দমে যায়। এ সময় মন চায় যে, আহা! তার নামও যদি তার চেহারার মতো হতো। প্রকৃত ব্যাপার হলো, সুন্দর নাম অনুভূতি এবং আবেগের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। ফলে কোন মহিলাকে যদি বিশ্রী এবং খারাপ নামে ডাকা হয় তাহলে তার ক্রোধমূলক প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যায়। খারাপ নামে সম্বোধন করায় তার খারাপ আবেগই প্রকাশ পায়। পক্ষান্তরে যদি কোন মহিলাকে সুন্দর নামে ডাকা হয়, তাহলে সে মহিলা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ও ভালোভাবে জবাবও দিয়ে থাকে কারণ নিজের ভালো নাম শুনে সে নিজেকে মর্যাদাবান বলে মনে করে।
১. লোকজন সন্তানকে ভালো নামে ডাকুক, এটাই মাতা-পিতার স্বাভাবিক আকাংখা। ভালো নামে ডাকার ফলে একদিকে যেমন শিশু খুশী হয়। অন্যদিকে যিনি ডাকেন তার অন্তরেও তার জন্য ভালো ধারণা সৃষ্টি হয়। কিন্তু এটা নিজের সন্তানের ভালো নাম রাখার উপর। আপনার উপর আপনার প্রিয় সন্তানের অধিকার হলো আপনি তার সুন্দর রুচিসম্মত ও পবিত্র নাম রাখবেন।
রাসুল (সাঃ) সন্তানের ভালো এবং পবিত্র নাম রাখার তাগিদ দিয়েছেন। সাহাবীরা (রাঃ) যখনই রাসূল (সাঃ)-এর নিকট নিজের সন্তানের নাম রাখঅর জন্য আবেদন জানাতেন তখনই তিনি অত্যন্ত পবিত্র ও উদ্দেশ্যপূর্ণ নাম প্রস্তাব করতেন। কারো নিকট তার নাম জিজ্ঞেস করা হলে সে যদি অর্থহীন এবং অপছন্দনীয় নাম বলতো তাহলে রাসূল (সাঃ) অপছন্দ করতেন এবং তাকে নিজের কোন কাজ করতে বলতেন না। পক্ষান্তরে সুন্দর ও পবিত্র নাম উচ্চারণ করলে তিনি পছন্দ করতেন। তার জন্য দোয়া করতেন এবং নিজের কাজ করতে দিতেন। প্রিয় নবী (সাঃ) নিজের কোন প্রয়োজন বাইরে বেরুলে তিনি ‘ওয়া নাজিহ’ অথবা ইয়ারাশেদ এর মত বাক্য শুনতে পছন্দ করতেন। যখন কাউকে কোন স্থানের দায়িত্বশীল বানিয়ে প্রেরণ করতেন তখন তার নাম জিজ্ঞেস করতেন। সে তার নাম বলার পর, তাঁর পছন্দ হলে খুব খুশী হতেন এবং খুশীল আলামত তাঁর চেহারায় উদ্ভাসিত হতো। যদি তার নাম তিনি অপছন্দ করতেন তাহলে তার প্রবাব চেহারায় ফুটে উঠতো। যখন তিনি কোন বস্তিতে প্রবেশ করতেন তখন সে বস্তির নাম জিজ্ঞেস করতেন। যদি সে বস্তির নাম তাঁর পছন্দ হতো তাহলে তিনি খুবই আনন্দিত হতেন। অধিকাংশ সময় এটাও হতো যে তিনি অপছন্দনীয় নাম পরিবর্তন করে দিতেন। খারাপ নাম তিনি কোন বস্তুর জন্যই মেনে নিতে পারতেন না। একটি স্থানের নাম হুজরাহ অর্থাৎ বাঁজা বা বন্ধ্যা বলে ডাকতো। তিনি সে স্থানের নাম পরিবর্তন করে খুজরাই অর্থাৎ চির-সবুজ ও শস্য-শ্যামল রেখে দিলেন। একটি ঘাঁটিকে গুমরাহির ঘাঁটি বলা হতো। তিনি তার নাম রাখলেন হেদায়তের ঘাঁটি। এমনিভাবে তিনি অনেক পুরুষ এবং মহিলার নামও পরিবর্তন করে দেন। যে ব্যক্তি তাঁর পরিবর্তিত নামের পরিবর্তে পূর্বের নাম সম্পর্কেই পীড়াপীড়ি করতো তাহলে সে তার পূর্বের নামের খারাপ প্রভাব নিজের ব্যক্তিত্বের উপরও অনুভব করতো এবং বংশধরদের উপর তার খারাপ প্রভাব অবশিষ্ট থাকতো।
২. তোমার শিশুর জন্য পছন্দনীয় নাম বলতে সেসব নাম বুঝায় যাতে কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া এবং কিছু বিষয় থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা হয়েছে।
একঃ আল্লাহর জাত অথবা ছিফতি নামের সাথে আবদ অথবা আমাতাহু শব্দ মিলিয়ে কিছু বানানো হয়েছে। যেমন আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার, আমাতাহুল্লাহু, আমাতাহুর রহমান ইত্যাদি। অথবা এমন নাম হবে যা দিয়ে আল্লাহর প্রশংসার প্রকাশ ঘটে।
দুইঃ কোন পয়গাম্বরের নামানুসারে নাম রাখা। যেমনঃ ইয়াকুব, ইউসুফ, ইদরিস, আহমদ, ইবরাহিম, ইসমাইল প্রভৃতি।
তিনঃ কোন মুজাহিদ, ওলি এবং দীনের খাদেমের নামানুসারে নাম রাখা, যেমনঃ ফারুক, খালিদ, আবদুল কাদের, হাজেরা, মরিয়ম, উম্মে সালমাহ, সুমাইয়াহ প্রভৃতি।
চারঃ নাম যে দীনি আবেগ ও সুন্দর আকাংখার প্রতিবিম্ব হয়। উদাহরণ স্বরূপ মিল্লাতের বর্তমান দুরবস্থা দেখে তুমি তোমার শিশুর নাম ওমর এবং সালাহউদ্দিন প্রভৃতি রাখতে পার এবং এ ইচ্ছা পোষণ করতে পার যে, তোমার শিশু বড় হয়ে মিল্লাতের ডুবন্ত তরীকে তীরে ভেড়াবে এবং দীনকে পুনরুজ্জীবিত করবে।
পাঁচঃ কোন দীনি সফলতা সামনে রেখে নাম প্রস্তাব করা। যেমন পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে করতে এ আয়াত সামনে এলোঃ
আরবি
“যখন সেদিন আসবে, যেদিন তুমি কারো সাথে কথা বলার শক্তি পাবে না। তবে আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে কথা বলতে পারবে। অতঃপর সেদিন কিছু মানুষ হতভাগা হবে এবং কিছু মানুষ ভাগ্যবান হবে”।
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সমগ্র মানবজাতি দু’ভাবে বিভক্ত হবে। এক গ্রুপ হবে হতভাগা এবং অপর গ্রুপ হবে সৌভাগ্যবান। এ আয়াত পড়ে অযাচিতভাবে তোমার অন্তর থেকে দোয়া হলো যে, হে পরওয়ারদিগার আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে সে ভাগ্যবানদের অন্তর্ভূক্ত করে দিন এবং তুমি সন্তানের ভূমিষ্ট হবার পর তার নাম রাখ সাঈদ।
পকৃতপক্ষে তুমি তোমার ইচ্ছা, আবেগ, আশা, ও আকাংখা অনুযায়ী সচেতন অথবা অচেতনভাবে নাম প্রস্তাব করে থাক এবং এসব আশা-আকাংখার ভিত্তিতেই শিশু বড় হতে থাকে এবং প্রকৃতিগতভাবে সাধারণ অবস্থায় সে তোমার স্বপ্নের বাস্তবায়নই করে থাকে।
এসব বিষয়ে নাম প্রস্তাব করার সময় সামনে রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আবার কিছু বিষয় এমন আছে যা নাম প্রস্তাব করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।
একঃ এমন চিন্তা ও অনুভূতি যা ইসলামী আকীদা এবং আদর্শের পরিপন্থী। বিশেষভাবে যে নামে তাওহীদি ধ্যান-ধারণায় আঘাত লাগে। যেমন নবী বখশ, আবদুর রাসূল ইত্যাদি।
দুইঃ কোন এমন শব্দ যা দিয়ে গর্ব অহংকার অথবা নিজের পবিত্রতা ও বড়াই প্রকাশ পায়।
তিনঃ এমন নাম যা অনৈসলামিক আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটায় এবং আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির কোন আশা থাকে না।
উত্তম নাম রাখার হেদায়াত ও হিকমত
আরবি
“রাসূল (সাঃ) ফরমান, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে নিজের এবং পিতার নামে ডাকা হবে। অতএব উত্তম নাম রাখো”।
(আবু দাউদ)
আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নাম-
আরবি
“হযরত আবু ওয়াহাব রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, নবীদের নামে নাম রাখো এবং আল্লাহর পছন্দীয় নাম হলো আবদুল্লাহ এবং আবদুর রহমান প্রিয় নাম হলো হারেছ এবং হাম্মাম তাছাড়া অত্যন্ত অপছন্দীয় নাম হারব ও মুররাহ”।
(আবু দাউদ নাসায়ী)
‘আল্লাহ’ শব্দ আল্লাহর জাতি নাম। রহমান আল্লাহর জাতি নাম নয়। তবে ইসলামের পূর্বে কতিপয় জাতির মধ্যে এটা আল্লাহর জাতি নাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ জন্যে তারও অন্যান্য গুণের বা ছিফাতের তুলনায় গুরুত্ব রয়েছে। হাদীসে শুধু এ দু’নামের উল্লেখের উদ্দেশ্য এ নয় যে, শুধু এ দু’নামই রাখা যাবে এবং শুধু এটাই আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। শুধুমাত্র এটাকে উদাহরণ স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর কোন সিফাতের সাথে আবদ শব্দ লাগিয়ে নাম রাখা হলে তাই আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নাম। সম্ভবত রাসূল (সাঃ) শুধুমাত্র এ দু’নামের উল্লেখ এ জন্যেও করে থাকতে পারেন যে, পবিত্র কুরআনে আবদের সম্বন্ধের সাথে বিশেষভাবে এ দু’নামের উল্লেখ করা হয়েছে।
হারিছ সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কৃষি এবং আয়ের কাজে লেগে থাকে। যদি সে হালাল উপায়ে দুনিয়া কামাই করে তাহলেও উত্তম আর যদি সে পরকাল কামাইয়ে লেগে থাকে তাহলে তার থেকে উত্তম আর কি হতে পারে!
হাম্মাম বলা হয়-সুদঢ় ইচ্ছা পোষণকারী ব্যক্তিকে, যে এক কাজ শেষে অন্য কাজে লেগে যায়।
হারব-যুদ্ধকে বলা হয়, এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, যুদ্ধ কোন পছন্দীয় কাজ নয়।
মুররাহঃ তিতো জিনিসকে বলা হয়, আর তিতো নিশ্চয়ই সবার পছন্দীয় নয়।
ভালো নাম মানে শুভ সূচনা
হযরত ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ (রাঃ) থেকে, বর্ণিত, নবী করিম (সাঃ) এক উটনী দোহানোর জন্য লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
আরবি
“এ উটনীকে কে দুধ দোহন করবে? এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালে, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি? সে বললো তার নাম হলো মুররাহ। তিনি বললেন, বসো। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন এ উটনীকে কে দুধ দোহন করবে? অন্য এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি? সে বললো, তার নাম হারব। তিনি বললেন, বসে পড়। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ উটনীকে কে দুধ দোহন করবে? এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি? সে বললো, তার নাম ইয়ায়িশ। তিনি বললেন, ঠিক আছে তুমিই দুধ দোহন কর।
(জাময়ল ফাওয়ারেদ বাহাওয়ালা মুরাত্তা ইমাম মালিক)
প্রথম দু’নামের ভাবার্থ অপছন্দনীয় এবং সর্বশেষ নামের ভাবার্থ পছন্দনীয়। ইয়ায়িশ শব্দ জীবন্ত থাকার অর্থবোধক।
এমনিভাবে ইমাম বুখারীও একটি হাদীস নকল করেছেন।
“রাসূল (সাঃ) লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের এ উটকে কে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে? অথবা তিনি বলেছিলেন, “কে তাকে পৌঁছাবে?” এক ব্যক্তি বললো, আমি। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি?” সে বললো, আমার নাম হলো এই। তিনি বললেন, “বসে পড়”। অতঃপর দ্বিতীয় ব্যক্তি এ উদ্দেশ্য দাঁড়িয়ে গেল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি?” তিনিও বললেন, “আমার নাম এই”। তিনি বললেন, “বসে পড়”। অতঃপর তৃতীয় ব্যক্তি দাঁড়ালো। তার নিকটও তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি?” সে বললো, তাঁর নাম নাজিয়াহ”। তিনি বললেন, “তুমি এ কাজের উপযুক্ত। হাঁকিয়ে নিয়ে যাও”।