দ্বীনী হেদায়াত হাসিল করার সঠিক উপায়
আল্লাহ পাক মানব জাতির হেদায়াতের জন্য রাসূল ও নবী পাঠিয়েছেন। তাঁদের বাস্তব জীবনই মানুষের জন্য প্রকৃত আদর্শ। তাঁরা আল্লাহর রচিত জীবন বিধানকে বাস্তব জীবনে পালন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। শেষ নবীর নিকট কোরআন পাকের আকারে মানব জাতির জন্য যে হেদায়াত এসেছে তা যদি কেউ আন্তরিকভাবে অনুসরণ করতে চায় তাহলে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাগ (সা)-কে পূর্ণরূপে অনুকরণ করতে হবে। আল্লাহ পাক তাঁকেই (আরবী****) বা সুন্তরতম আদর্শ বলে কোরআনে ঘোষণা করেছেন। এমনকি হজরত ঈসা (আঃ) আবার যখন দুনিয়ায় আসবেন তখন তিনিও এ আদর্শকেই অনুসরণ করবেন। কিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির নিকট একমাত্র আদর্শ মানব তিনিই। কিয়ামতের দিন মানুষকে এ হিসাবই দিতে হবে যে তারা রাসূলকে অনুসরণ করেছেন কিনা। রাসূল ছাড়া আর কোন বুযুক্গ অীল বা ইমামকে আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা সে হিসাব চাওয়া হবে না।
আমরা অবশ্যই দ্বীনের দাবী হিসেবে সাহাবায়ে কেরামকে (রা)- অনুরকরণ যোগ্য মনে করি। এর কারণ এই যে, আমরা তাঁদেরকে রাসূলের সত্যিকার অনুসারী বলে বিশ্বাস করি। এর অর্থ এই যে, আমরা রাসূলের আনুগত্য করার জন্যই সাহাবায়ে কেরামকে (রা) মানি। তাঁদেরকে অনুসরণ করাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তাঁদের কাছ থেকে রাসূলের আনুগত্য শেখাই উদ্দেশ্য। যারা কেন মাযাহাবকে মানেন তাদের এ মানার একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো রাসূলের অনুসরণ। আমরা কোন পীর আলেম বা বুযুর্গকেও রাসূলের আনুগত্য করার আশা নিয়েই মানি। সুতরাং আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ, এ কথা যদি আমাদের মন-মগজে সজাগ থাকে তাহলে কোন ব্যক্তিকে আমরা অন্ধভাবে অনুসরণ করব না এবং তাঁর অভ্যাস, পোশাক, চালচলন ইত্যাদি অনুকরণ করা প্রয়োজন মনে করব না।
এ কথা অবশ্যই বাস্তব সত্য যে দ্বীনী জিন্দেগী যাপন করতে হলে কোন জামায়াত বা ব্যক্তির সহায়তা অবশ্যই জরুরী। সাধারণ লোকের তো কথাই নেই আলেম হলেও বহু দ্বীনী বিষয়ে এমন সব লোকের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া দরকার হয় যাঁদের ইলম ও আমলের উপর আস্থা স্থাপন করা যায়। দ্বীনের ব্যাপারে যার কাছ থেকে হেদায়াত ও পরামর্শ পাওয়া যায় তিনি আলেম, শায়েখ, পীর ইত্যাদি যে নামেই পরিচিত হন তাতে কিছু আসে যায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে তাঁর নিকট কি নিয়তে যাচ্ছি। যদি এ নিয়ত হয় যে “অমুক ব্যক্তি আল্লাহ ওয়ালা লোক-তিনি যা বলেন বা করেন তাই আমার গ্রহণ করতে হবে” তাহলে এটা ইসলামের নীতি বিরোধী হবে। যার কাছেই যাই একমাত্র রাসূলের অনুসরণের নিয়তেই যেতে হবে। তাহলে সজাগ দৃষ্টি থাকবে যে রাসূলের জীবন তিনি যতটুকুই অনুসরণ করছেন বলে বুঝা যায় ততটুকু তাঁকে মানবো।
এ দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবেই আমাদের মধ্যে সংকীর্ণতা সৃষ্টি হচ্ছে। যারা মাদরাসায় দ্বীন শিক্ষা করছেন তারা উস্তাদদেরকে যদি পূর্ণ আদর্শ মনে করে বসেন তাহলে অন্যান্য খেদমতকে কোন গুরুত্বই দেবেন না। যারা তাবলীগ জামায়াতের কাজকে রাসূলের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মনে করবেন তাদের নিকট দ্বীনের অন্যান্য কাজ একেবারেই বেকার মনে হবে। পীরের কাছে যেটুকু শিক্ষা পাওয়া গেল সেটুকুকেই দ্বীনের সবকিছু মনে করলে আর সব দ্বীনের কাজকে তুচ্ছ মনে করা হবে।
যারা যেখানে যতটুকু দ্বীনের কাজ করেছেন, সেখানে রাসূলের যে পরিমাণ অনুসরণ হচ্ছে সেটাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। কিন্তু দ্বীনের দাবী কতটা তা জানতে হবে রাসূলের জীবন থেকে এবং যেখানে রাসূলের যতটুকু শিক্ষা পাওয়া যায় সেটুকুই নিতে হবে। রাসূলের পূর্ণ অনুসরণ কোন এক ব্যক্তি করেছেন মনে করেন যদি তাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করা হয় তাহলে তার জীবনে ইসলাম অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। কারণ কোন ব্যক্তিই রাসূলের পূর্ণ আগনুগত্য করতে সক্ষম নন। এ কথাও সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে যে রাসূলকে যে যতটুকু অনুসরণ করেছেন ততটুকুর জন্য তিনি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। এ দৃষ্টিতে বিচার করলে দ্বীনের খাদেমগণের সবার মধ্যেই রাসূলের আদর্শ কিছু অবশ্যই পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে কারো মধ্যে যেটুকু অভাব দেখা যাবে সেটুকুর জন্য তাঁর সমালোচনা ও গীবত না করে সেক্ষেত্রে অন্যের কাছে রাসূলের বাকী আদর্শ তালাশ করতে হবে। যদি আমরা এ নিয়মে দ্বীনী হেদায়াত হাসিলের চেষ্টা করি তাহলে দ্বীনের যত রকম খেদমত হচ্ছে এবং যত জামায়াত দ্বীনের কাজ করছে সবাইকে জানার চেষ্টা করা প্রয়োজন মনে হবে। রাসূলের আদর্শ তালাশ করার জন্য অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে সবাইকে বিচার করার যোগ্যতাও হবে এবং যেখানে যতটুকু দ্বীনের শিক্ষা পাওয়া সেটুকু গ্রহণ করে নিজেদের জীবন ইসলামকে পূর্ণরূপ অনুসরণ করা সম্ভব ও সহজ হবে। তা না হলে ইসলামের কোন এক বা একাধিক অংশকেই সম্পূর্ণ ইসলাম মনে করে আখেরাতের বড় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের পরিচিতি
১৯৭১ সাল থেকে যে ভূখন্ডটি ‘বাংলাদেশ’ নামে পৃথিবীর মানচিত্রে আসন লাভ করেছে সে এলাকাটি ‘১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ নাম ধারণ করে তদানীন্তন ভারত উপমহাদেশ থেকে আলাদা হবার পর থেকে বিপুল মুসলিম সংখ্রাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত হয়। শতকরা ৮৫ জন মুসলমানের বাসস্থান হিসেবে এ দেশটি বর্তমানে দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ।
ভারত বিভাগের পূর্বে ১৯৪১ সালে লাহোর শহরে জামায়াতে ইসলামী নামে যে বিপ্লবী ইসলামী আন্দোলনের সূচনা হয় তাঁর ঢেউ ১৯৪৭ সাল পর্যন্তও এদেশে পৌছেনি। ভারত বিভাগের পরে বিহার ও ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকে যেসব কর্মী ছিলেন। তারা উর্দুভাষী ছিলেন এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের যে সামান্য পরিমাণ সাহিত্য এ দেশে পৌছে তাও উর্দু ভাষায় ছিল। তখন এদেশে মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীমই একমাত্র বাংলাভাষী ছিলিন যিনি জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কি ছিলেন। কিন্তু তখও প্রদেশভিত্তিক কোন সংগঠন করয়েম হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাওলানা রফী আহমদ ইন্দোরীকে ১৯৪৮ সালের মে মাসে ঢাকা পাঠান হয়। ঐ মাসেই সর্বপ্রথম ঢাকায় ২০৫ নং নওয়াবপুর রোডে প্রাদেশিক জামায়াতে ইসলামীর অফিস কায়েম করা হয় এবং চারজন সদস্য সমন্বয়ে স্থানীয় জামায়াত গঠন করা হয়। মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম সাহেব তখন বরিশালের এক মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। সেখান হতে তাঁকে জামায়াতের সাহিত্যকে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য ঐ মাসেই ঢাকায় আনা হয়। ১৯৫১ সালে মাওলানা রফী আহমদ ইন্দোরী লাহোর ফিরে গেল মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল রহীমের উপর প্রাদেশিক জামায়াতের দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং ১৯৫৩ সালে চৌধুরী আলী আহমদ খান এ দায়িত্ব গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি তা পালন করেন।
মাওলানা ইন্দোরী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় জামায়াতের পক্ষ থেকে ঢাকায় প্রেরিত হবার পূর্ব পর্যন্ত জামায়াতের প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলে সম্ভব হয়নি। তাই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে স্বয়ং কেন্দ্রীয় জামায়াত। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের উদ্যোগ ব্যতীত স্থানীয়ভাবে এ অঞ্চলে জামায়াতের সংগঠন সম্ভব হয়নি বলেই মাওলানা রফী সাহেবকে কেন্দ্র থেকে পাঠাতে হয়েছিল। আর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে মাওলানা রফীকেই এখানে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা বলা চলে।
মাওলানা রফী আহমদ ইন্দোরী এদেশের আলেমগণকে উর্দূ ভাষায় রচিত জামায়াতের সাহিত্যের সাথে পরিচিত করার চেষ্টা করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর ৬ সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধি দল এ দেশে সফর করায় সর্বপ্রথম জেলা শহরগুলোর কিছু লোক জামায়াতে বিপ্লবী দাওয়াতের সামান্য পরিচয় লাভ করলেও সংগঠনের অভাবে সত্যিকারভাবে তখনও কাজ শুরুত হয়নি।
উক্ত প্রতিনিধি দলের অন্যতম চৌধুরী আলী আহমদ খান মরহুম ১৯৫৩ সালেই এদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাংগঠনিক কাঠামো কিছুটা মজবুত হবার পরই মাওলানা মওদুদীকে আনিয়ে এ দেশবাসীর নিকট ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী দাওয়াত পেশ করার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর্যন্ত জেলে আটক থাকায় ১৯৫৬ সালের পূর্বে এ বিরাট ইসলামী চিন্তানায়তের এ দেশে আসা সম্ভবপর হয়নি।
১৯৫৬ সালের প্রথম ভাগে সর্বপ্রথম তিনি এদেশে ৪০ দিন ব্যাপক সফর করে জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত জনগণের নিকট পেশ করেন। প্রতিটি জনসভা ও সুধী সমাবেশ তিনি ইসলামী আন্দোলনের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে হলেও বর্জন করার আন্দোলন চালাবার চেষ্টা করায় মাওলানা মওদুদীকেও মন্দের ভাল হিসেবে ঐ শাসনতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে হয়। ইসলামী ও গণতান্ত্রিক শাসনতন্দ্রের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ঐ শাসনতন্ত্রের গণদাবী যতটুকু স্বীকার করা হয়েছে তা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্রহীন অবস্থার অবসান ঘটিয়ে ক্রমে দেশকে আরও অগ্রসর করার আহবানই তিনি জানালেন। ফলে তাঁর ঐ প্রথম সফরটি বাস্তবে রাজনৈতিক সফরে পরিণত হয় এবং তাঁর ইসলামী দাওয়াত ঐ পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই গৌণ হয়ে পড়ে।
জামায়াতে ইসলামী প্রচলিত অর্থে কোন কালেই নিছক ‘রাজনৈতিক’ দল ছিল না। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সর্বক্ষেত্রে ইসলামী জীবন বিধানকে কায়েমের আন্দোলনই জামায়াতের লক্ষ্য। ফলে দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন থেকে আলাদা হয়ে থাকা জামায়াতে পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে যখন এ দেশে জামায়াতে ইসলামী প্রসার লাভ করা শুরু করে তখন থেকে এমন সব রাজনৈতিক মত ও পথ দেশকে দোলা দিতে থাকে যে জামায়াত তার বুনিয়াদী ইসলামী দাওয়াত ও কর্মসূচীকে জনগণের নিকট পেশ করার জন্য কোন সুস্থির পরিবেশ পায়নি। রাজনৈতিক ইস্যুতে জামায়াতের যে বক্তব্য সেটাকেই বড় করে দেখা হয়েছে এবং জামায়াতের মূল দাওয়াত নিরেপক্ষ মনে বিবেচনার সুযোগ কমই হয়েছে। মাওলানা মওদুদী যতবার এদেশে সফর করেছেন ততবারই কোন কোন রাজনৈতিক ইস্যূ যোগটা পরিবেশকে অশান্ত করে রাখায় তিনি এ দেশে প্রধানতঃ একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেই পরিচিত হয়ে গেলেন। বর্তমান দুনিয়ায় এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি সকল দেশে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে যে বিরাট শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছেন, তাঁর সে মহান পরিচিতি থেকে এ দেশ এখনও বঞ্চিত রয়েছে। এ দেশের ইসলাম প্রিয় কোটি কোটি মানুষের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক দুর্ঘটনা। এ কারণেই বাংলাদেশের সুধী ও বৃহত্তর জনসমাজে ইসলামী আন্দোলন সঠিকরূপে পরিচিত হতে সময় লেগে গেছে।
জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত ও কর্মসূচী
জামায়াতের তিন দফা দাওয়াতঃ- জামায়াতে ইসলামী মানুষকে কোন নতুন বিষয়ের দিকে দাওয়াত দেয় না। আবহমান কাল থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীগণ মহান প্রতিপালকের দাসত্ব করার যে চিরন্তন দাওয়াত দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী সে দাওয়াতই দেয়। নবীগণের দাওয়াতে যারা সাড়া দিয়েছেন তাদের জীবনকে শিরক ও পঙ্কিলতা থেকে তাঁরা পাক করেছেন। যখন প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্য সাথী যোগাড় হয়েছে তখন সমাজ থেকে খোদাদ্রোহী ও অসৎ লোকের নেতৃত্ব খতম করে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর বান্দাদের দ্বারা আল্লাহর আইন চালু করেছেন। নবীদের ঐ দাওয়াত ও কর্যক্রমকেই জামায়াতে ইসলামী সুস্পষ্ট ভাষায় তিনটি দফায় পেশ করে থাকে।
সাধারণত : সকল মানুষের নিকট এবং বিশেষভাবে মুসলমানদের নিকট জামায়াতে ইসলামী নিম্নরূপ দাওয়াত দেয় :
এক : দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি পেতে হলে দ্বীন ইসলামকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করুন এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র মনিব ও তাঁর রাসূল (সা) কে অনুকরণযোগ্য একমাত্র আদর্শ মানব মেনে নিন।
দুই : আপনি সত্যিই ইসলামের দাবীদার হলে আপনার বাস্তব জীবন থেকে ইসলামের বিপরীত চিন্তা, কাজ, অভ্যাস ও যাবতীয় মুনাফেকী দূর করুন।
তিন : খাঁটি মুসলিম হিসেবে জীবন-যাপন করতে চাইলে জামায়াত বদ্ধভাবে চেষ্টা করুন যাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ঈমানদার, খোদাভীরু চরিত্রবান ও যোগ্য লোকের নেতৃত্ব কায়েম হয় এবং অসৎ, খোদাদ্রোহী ও খোদা বিমুখ নেতৃব খতম হয়।
জামায়াতের চার দফা কর্মসূচী : জামায়াতে ইসলামী একটি বিজ্ঞান সম্মত বিপ্লবী আন্দোলন। জামায়া হৈ-হাংগামার মাধ্যমে বিপ্লব সাধন করতে চায় না। স্থায়ী, ফলপ্রসু ও কল্যাণকর বিপ্লববের জন্য প্রধমে মানুষের চিন্তাধারাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে হবে। চিন্তা শক্তিই মানুষের পরিচালক। যারা চিন্তার ক্ষেত্রে ঐক্যমতে পৌঁছে তাদেরকে সুসংগঠিত করে আন্দোলনের যোগ্য নেতা ও কর্মী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। তাদেরকে সমাজের খেদমতে নিযুক্ত করে সমস্যা সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও সমাধান পেশ করার যোগ্য নিঃস্বার্থ খাদেমরূপে তৈরী করতে হবে। এরপর যখনই আল্লাহ পাক সুযোগ দেন তখন জন সমর্থন নিয়ে সরকারী দায়িত্ব গ্রহণ করে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ইসলামী আদর্শ অনযায়ী ঢেলে সাজাতে হবে। এ সব কর্মধারাকে জামায়াত চারটি দফায় নিম্নরূপ ভাষায় প্রকাশ করে:
১। দাওয়াত ও তাবলীগ-ইসলাম প্রচার ও আল্লাহর দিকে আহবান :
(ক) কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে মানুষের চিন্তার বিশুদ্ধিকরণ ও সঠিক ইসলামী চিন্তাধরা গড়ে তুলবার ব্যাপক আন্দোলন চালানো।
(খ) আধুনিক গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফসলকে ইসলামের কষ্টি পাথরে যাচাই করে গ্রহণ ও বর্জনের নীতি চালু করা। অন্ধভাবে সবই গ্রহণ বা সবই ঘৃণাভরে বর্জন না করে জ্ঞান, যুক্তি ও কল্যাণের দৃষ্টিতে বিচার করে গ্রহণ বা বর্জন করা।
(গ) বর্তমান যুগের যাবতীয় সমস্যার ইসলামী সমাধান পেশ করে প্রচলিত অন্যান্য মতবাদের ভুল ধরিয়ে দেয়া।
এ তিন ধরনের কাজের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের জ্ঞান-বিতরণ ও সে জ্ঞান ভিত্তিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের দাওয়াতই জামায়াত দিয়ে থাকে।
২। তানযীম ও তারবীয়াত-সংগঠন ও প্রশিক্ষণ :
(ক) ইসলামের প্রতি আগ্রহশীল, সমাজ সচেতন, সৎলোকের সন্ধান ও সংগঠন।
(খ) বাস্তবমূখী কার্যক্রমের মারফতে তাদেরকে আল্লাহর খাঁটি গোলাম ও দ্বীনের যোগ্য খাদেম বানাবার জন্য উপযোগী তারবিয়াত বা ট্রেনিং দান।
(গ) চরিত্রবান কর্মী বাহিনী তৈরী করে সমাজকে সৎ নেতৃত্ব দানের ব্যবস্থা করা।
৩। ইসলাহে মো‘য়াশারা- সমাজ সংস্কার :
(ক) সমাজ গঠন ও সমাজ সেবায় সকল রকম কাজের মাধ্যমে দেশকে এবং দেশবাসীকে উন্নত করার চেষ্টা।
(খ) সকল পেশা, শ্রেণী ও স্তরের লোকদেরকে গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে সমাজ সচেতন করা ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক মনোভাব পরিত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করা।
(গ) জনগণকে সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ নিয়মতহান্ত্রিকভাবে নিয়োজিত করা।
৪। ইসলাহে হুকুমাত- সরকার ও শাসন ব্যবস্থার সংস্কার :
(ক) অভন্তরীন শাসন শৃংখলা, বৈদেশিক নীতি, আইন-কানুন, জাগণের নৈতিক-পার্তিব উন্নতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নয়নমূলক কাজ ও দেশের সঠিক উন্নতি সম্পর্কে ইসলামের আলোকে সরকারকে উপযুক্ত পরামর্শ দান করা।
(খ) খোদাদ্রোহী, ধর্ম নিরপেক্ষ, অসচ্চরিত্র নেতৃত্বের অপসারণ ব্যতীত সমাজের পূর্ণরূপ সংশোধন অসম্ভব। তাই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আরম্ভ করে সকল সরকারী দায়িত্ব থেকে এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অপসারণের উদ্দেশ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে সৎ নেতৃত্ব কায়েম করা।
(গ) যুক্তি ভিত্তিক রাজনীতির প্রচলন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শক্তি প্রয়োগ ও অস্ত্রের ব্যবহার রোধ এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে একনায়কত্বের অবসান ঘটাবার জন্য নিয়মান্ত্রিক উপায়ে গণ আন্দোলন করা।
(ঘ) রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদেরকে ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা এবং সকল স্তরের নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য লোককে বিজয়ী করার চেষ্টা করা। যেখানে জামায়াতে ইসলামীর তৈরী লোককে অন্যদের চেয়ে অধিকতর যোগ্য মনে করা হবে সেখান তাকেই নির্বাচিত হবার সুযোগ দান করা।
এ কর্মসূচী সম্পর্কে বিশেষ বিবেচ্য
এ ৪ দফা কর্মসূচীর প্রত্যেকটি দফাই অপর সব কয়টি সহায়ক ও পরিপূরক। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এ ৪টি দফা অনুযায়ী অত্যন্ত সুবিবেচনার মধ্যে কাজ করে যেতে হবে- যাতে আন্দোলনের মূল লক্ষ্যের দিকে পরিপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রেখে অগ্রগতি সম্ভব হয়। এ সম্পর্কে একটি কথা বিশেষভাবে চিন্তা করে দেখো দরকার। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন কার্যকলা, চরম নৈতিক অথঃপতন, স্বার্থপর নেতৃত্ব, সুবিধাবাদী রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে দেশ এমন এক দুঃজনক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থেই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যাতে চতুর্থ দফার কাজ যোগ্যতার সাথে করা সম্ভবপর হয়।
জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত পরিচয়
উপরোক্ত তিন দফা দাওয়াত ও চার দফা কর্মসূচী থেকে একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে-
১। এ জামায়াত মূলতঃ একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। এর ব্যাপকতা ততটুকুই যতটুকু ইসলাম ব্যাপক। ইসলাম যেহেতু অনুসারী হিসেবে গোটা ইসলামকে কায়েম করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত।
২। এ জামায়াত স্বাভাবিক গতিতে সমাজ বিপ্লব সৃষ্টি করতে চায়। তাই এর কার্যক্রম তানুদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। সে হিসেবে জামায়াতকে প্রধানতঃ ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলা যায়।
৩। জামায়াত রাজনীতি বর্জিত নিছক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ব নবীর আন্দোলন যদি ধর্ম সর্বস্বহতো তাহলে বাতিল রাজশক্তির সাথে তাঁর সংঘর্ষ হতো না বা মদীনায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতেন না। জামায়াত ততটুকুই রাজনীতি প্রধান দল নয়। প্রত্যক্ষ রাজনীতি জামায়াতের চার দফা কর্মসূচীর চতুর্থ দফা মাত্র। অর্থাৎ জামায়াতের গোটা কার্যক্রমের এক চতুর্থাংশ মাত্র প্রত্যক্ষ রাজনীতি। আর সে রাজনীতিও একমাত্র ইসলামী নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। লাগমহীন রাজনীতি, মিথ্যার রাজনীতি ও ধোঁকাবাজীর রাজনীতির সাথে জামায়াতের কোন সম্পর্ক নেই।
৪। এ কথা অবশ্য তাৎপর্যপূর্ণ যে কালেমায়ে তাইয়্যেবাও রাজনীতি বর্জিত নয়। আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই বলে কালেমায় যে প্রথম স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম হতেহ
য সেটুকুতে রাজনীতি নেই? আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কোন হুকুম পালন না করার ঘোষণাই কালেমায় রয়েছে। সুতরাং সঠিক মর্ম বুঝে কালেমা তাইয়্যেবাকে কবুল করা মানে অনৈসলামী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা। তাই রাজনীতি শুরু থেকেই মুসলিম জীবনের অংশ। তবু জামায়াতে ইসলামী কার্যসূচীতে সরাসরি রাজননৈতিক প্রোগ্রাম ৪র্থ দফায়ই শুধু রয়েছে।
আমার দ্বীনী জিন্দেগী
সর্বশেশে আমার দ্বীনি জিন্দেগী সম্পর্কে এ পুস্তিকার পাঠকগণকে সামান্য একটু ধারণা দেবার চেষ্টা করছি যাতে আমার বক্তব্যকে উদার মনে গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
আমার দাদা অধ্যসায়ী আলেম ছিলেন। কোরআন শরীফ পড়া তার কাছ থেকেই শিখেছিলাম। কিন্তু আমি ৫ম শ্রেণী ছাত্র থাকাকালে তার এন্তেকাল হওয়ায় তার সোহবত থেকে ফায়দা উঠাবার সৌভাগ্য হয়নি। আমার মরহুম আব্বা আলেম ও আধুনিক শিক্ষিত ছিলেন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের অনুসরণের উপর ইত গুরুত্ব দিতেন যে, আমাদের কোন ভাইকেই ছাত্রজীবনেও দাড়ি পর্যন্ত কামাতে দেননি, যদিও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেটিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছিলাম।
আব্বারই তাগিতে ও অনুপ্রেরণায় ৭ম শ্রেণী থেকেই ইসলাম সম্বন্ধে বই-পুস্তক পড়ায় মনোযোগী হই। তখন থেকে মাসিক নেয়ামত পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলাম। তাতে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাঃ) এর কোরআন হাদীস-ভিত্তিক বলিষ্ঠ ও যুক্তিপূর্ণ ওয়ায আমাকে এত অভিভূত করতো যে বাংলা ভাষায় থানভী (রাঃ)-এর সব বই যোগাড় করে পড়তাম। এভাবে ছাত্রকাল থেমে মাওলানা শামসুল হক ফরীদপুরূ (রঃ)-এর সাথে এত মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
এম, এ ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক মাস পূর্বে আমার আব্বারই নির্দেশে তাবলীগ জামায়াতে যোগদান করি। পরীক্ষার পর একটানা তিন চিল্লায় বেরিয়ে পড়ি এবং দিল্লীতে যেয়ে এক জামায়াতের সাথে এক চিল্লার বেশি সময় হিন্দস্থানে কাটাই। রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনাকালে তমদ্দুন মজলিসের সাথে ঘনিষ্ঠ হই। তিন বছর একযোগেই তাবলীগ জামায়াত ও তমদ্দুন মজলিসে কাজ করি। ইসলারেম ধর্মীয় দিক এবং তমদ্দুন মজলিসে ইসলামের রাজণৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক মিলিয়ে আমি পূর্ণ দ্বীন-ইসলাম সম্বন্ধে চর্চা করতাম।
তমদ্দুন মজলিসের মারফতেই সর্বপ্রথম আমি মাওলানা মওদূদী (রঃ) কয়েকখানা বই বাংলা ও ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ পাই। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে সর্বপ্রথম গাইবান্ধা জামায়াতে ইসলামীর সংগঠক জনাব আবদুল খালেক মরহুমের নিকট থেকে জামায়াতের দাওয়াত পাই। তিনি জামায়াতের সংগঠনে আমাকে শামিল করে রংপুর শহর ও কলেজে জামায়াতের শাখা পরিচালনা শিক্ষা দেন। তিনি ১৯৭৯ সালে এন্তেকাল করা পর্যন্ত এদেশে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীতে শামিল হবার এক বছর পর ইসলামের ধর্মী ও সামাজিক দিক সহ পূর্ণ দ্বীনের খেদমত এক সাথেই করার প্রেরণা নিয়ে চাকুরী জীবন ছেড়ে ইসলামী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করি। জামায়াতে ইসলামীর বিপুল সাহিত্য বিশেষ করে মাওলানা মওদূদীর বিপ্লবী তাফসীর তাফহীমূল কোরআন- অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়েই উর্দূভাষা শিখি। এভাবেই উর্দূভাষার বিশাল ইসলামী সাহিত্যের নাগাল পাই।
দেশের বহু প্রসিদ্ধ আলেমের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ও মহব্বত থাকায় মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে প্রকাশিত ফাতোয়া ও পুস্তকাদি আমার হস্তগত হয়। আমি নিরপেক্ষ মন নিয়ে ঐ সব পড়েছি। এর ফলে আমার জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে মাওলানা মওদূদীর সমালোচকগণের যুক্তিগুলো আমার বিবেচনা করার সুযোগও পেলাম! এতে আমার দুটো সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছেঃ
এক : প্রথমত : ওলামাদের সমালোচনার যেসব যুক্তি আমার নিকট গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে তার ভিত্তিতে মাওলানা মওদূদীর সব কথা চবিচার করেই আমি গ্রহণ করি। মাওলানা মওদূদী বলেছেন বলেই অন্থভাবে কোন কথা গ্রহণ করি না।
দুই : ওলামাদের মধ্যে যারা মাওলানার ভুল দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁদের ভাষা ও বলার ভংগী থেকে তাঁদের চিনতে সহজ হয়েছে যে, কে ইখলাসের সাতে সংশোধন চান এবং কে বিদ্বেষ বশতঃ বিরোধিতা করেন।
মাওলানা জাফর আমত ওসমানী (রঃ) ও মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী )রঃ)-এর দেখিয়ে দেয়া কোন কোন বুল যে মাওলানা মওদূদী সংশোধান করেছেন সে কথা মওলানা মওদূদী স্বয়ং আমাকে বলেছেন। এ জন্যই আমি প্রত্যেক হক-পরস্ত ও মুখলিস আলেমের নিকট সবিনয় দরখাস্ত করছি যে, আরব দুনিয়ার গোটা আলেম সমাজ তাঁকে এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। তার লেখা কিতাবাদি নিজেরা পড়ে বিচার-বিবেচনা করে দেখুন। বিন্ তাহকীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আলেমগণের শোভা পায় না। মাওলানা মওদূদীর সমালোচনা যে শ্রদ্ধেয় আলেমগণ করেছেন তাদের লেখা পড়ার পর তাঁরা মাওলানার যেসব বই-এর সমালোচনা করেছেন সে বইগুলো না পড়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া নিরাপদ নয়। কারণ সমালোচকগণের ইজতেহাদী ভুল হতে পার। তাই নিরপেক্ষ মন নিয় বিচার করার আকুল আহবান জানাচ্ছি।
আমি কোন আলিয়া বা কওমী মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রী নেবার সুযোগ পাইনি বলে স্বাভাবিক ভাবেই ওলামা শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ নই। কিন্তু আলআহ পাকের অসীম মেহেরবাণীতে দ্বণকে সাধ্যমতো জানা ও বুঝার সুযোগ লাভ করেছি। দ্বীনের এ আলো এককভাবে কোন মহল থেকে আমি পাইনি। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রাঃ)-এর তাফসীর “বায়ানুল কোরআন” ও অন্যান্য ইসলামী সাহিত্য আমাকে দ্বীনী বিষয়ে নকলী ও আকলী দলিলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন। তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলইয়াস )রঃ) এর আজীবন তাবলীগ সাধনা এবং তাবলীগ জামায়াতের বাংলাদেশের আমীর হযরত মাওলানা আবদুল আযীযের সাথে দীর্ঘ তাবলীগী সফর আমার জীবনে ইসলাম প্রচারে সত্যিকার প্রেরণা যুগিয়েছে। আর হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রঃ) থেকে আমি পেয়েছি ইসলামের ব্যাপক ধারণা, জীবন সমস্যার ইসলামী সমাধান, এ যুগের উপযোগী ইসলামী সংগঠনের বিজ্ঞানসম্মত কাঠামো ও বাতিল শক্তিকে অগ্রাহ্য করে ইসলামের বিজয়ের জন্য নির্ভীকভাবে কাজ করার অদম্য সাহস। এ ছাড়াও অগণিত ওলামার সান্নিধ্যে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভংগীর গুরুতব উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে এবং তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে মুসলিম জীবনের বিভিন্ন গুলণাবলী দ্বারা গভীরভাবে আকৃষ্ট হবার সৌভাগ্যও হয়েছে।
আমি হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের বড় বড় আলেমগণের কয়েকজনের সাথে মিশবার সুযোগ পেলেও তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশের কয়েকজন আলেমের চরিত্র চিরদিন আমার অন্তরে প্রেরণা যোগাবে। দুর্ভাগ্য বশতঃ তাঁদের একজনও বর্তমানে দুনিয়ায় নেই। তাদের পরিচয় অনেকে জানে। আমি তাঁদে নাম অতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করিঃ
১। হযরত মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মুস্তফা আল মাদানী শহীদ (রঃ)
২। হযরত মাওলানা সাইয়েদ শামসুল হক ফরিদপুরী (রঃ)
৩। হযরত মাওলানা নূর মাহাম্মদ আযমী (রঃ)
৪। হযরত মাওলানা আতহার আলী (রঃ)
৫। হযরত মাওলানা মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ (রঃ)
৬। হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়েদ আমীমুল ইহসান (রঃ)
৭। হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান।
দ্বীনের খেদমতের ব্যাপারে এদের সবাই এক ধরনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন না। তাঁরা মাওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামের অনূসারীও হননি। কিন্তু মাওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে এক শ্রেণীর আলেমগণের মধ্যে যে চরম বিদ্বেষ দেখা যায় তা তাঁদের মধ্যেও কখনও দেখিনি।
মাওলানা মওদূদী (রঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় হবার পর পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের বড় বড় কয়েকজন আলেম দরদ ভরা মন্তব্য এদেশের উপরোক্ত সাতজন মহান ব্যক্তির উদার মনের কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তানের হযরত মাওলানা মুফতী মাহুমূদ, দেওবন্দের হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মদ তাইয়েব, মজলিশে মুশাওরাতের সভাপতি মাওলানা মূফতী মুহাম্মদ আতীকু রহমান, লক্ষ্নৌর নাদওয়াতুল মুফান্নিফিনের হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদভী ও মাসিক আল-ফোরকানের সম্পাদক হযরত মুহাম্মদ মঞ্জুর নোমানীর মতো ব্যক্তিগণ মাওলানা মওদূদীর এন্তেকালে যে মহব্বতপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন তার ফলে আলেম সমাজে উদার মনোভাব বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ পাক এ মনোভাব সবার মধ্যে সৃষ্টি করে দ্বীনী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করুন- আমীন
— সমাপ্ত —