নামাযে কি পড়েন
নামায মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত, দাসত্ব ও আনুগ্যত স্বীকার করে চলার জন্য কিভাবে প্রস্তুত করে, তা পূর্বে বিস্তারিতরূপে আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে যা কিছু লেখা হয়েছে তা পাঠ করে আপনি পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, একজন মানুষ যদি আল্লাহর হুকুম এবং ফরয মনে করে রীতিমতো নামায আদায় করে, তবে সে নামাযে দোআ ও সুরাগুলের কোন অর্থ বুঝতে না পারলেও এ নামাজ তার মনে আল্লাহর ভয়, আল্লাহর হাযের-নাযের হওয়ার কথা এবং তাঁর আদালতে একদিন উপস্থিত হওয়ার বিশ্বাস নিসন্দেহে সবসময়ই জাগরুক রাখবে। সবসময় সে মনে করবে যে, সে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো দাস নয়- আল্লাহই তার প্রকৃত বাদশাহ এবং প্রভু। এরই ফলে তার মধ্যে কর্তব্য পালনের অভ্যাস হবে এবং সকল অবস্থায়ই সে আল্লাহর বিধান পালন করে চলার জন্য প্রস্তুত থাকবে। মানুষের সমগ্র জীবনকে আল্লাহর বন্দেগীর অধীনে যাপন করতে এবং গোটা জীবনকে এবাদাতে পরিনত করতে হলে যে সব গুন -সিফাত অবশ্য প্রয়োজনীয় তাও এ নামাযের সাহায্যে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়। নামায দ্বারা এ উপকার কিরূপে লাভ করা যায় তাও আপনারা পূর্বের প্রবন্ধে ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন আশা করি।
এখন বুঝে দেখতে হবে যে, নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ না বুঝে নামায পড়লে যদি এতবড় উপকার লাভ করা যায়, তাহলে কেউ যদি নামায ভালোভাবে বুঝে-শুনে পড়ে, সে যা পড়ছে তা যদি সে হৃদয়-মন দিয়ে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে তবে তার বিশ্বাস, মতবাদ, চিন্তাধারা এবং অভ্যাস ও স্বভাবের কি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হতে পারে এবং তার গোটা জীবন কিরূপ আদর্শে গঠিত হতে পারে, এখানে আমি এ বিষয়ই পুংখানুপুংখরূপে আলোচনার চেষ্টা করবো।
সর্বপ্রথম আযান সম্পর্কে ভেবে দেখুন। দৈনিক পাঁচবার আপনাকে কি বলে ডাকা হয়? বলা হয়ঃ
ٱللهُ أَكْبَر -‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সকলের বড়।’
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَـٰهَ إِلَّا ٱللهُ -‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ভিন্ন আর কোন মা’বুদ নেই। বন্দেগীর যোগ্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।’
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رُسُولُ ٱلله – ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।’
حَيَّ عَلَىٰ ٱلصَّلاة – ‘নামাজের জন্য আস’
حَيَّ عَلَىٰ ٱلْفَلاَح -‘যে কাজে কল্যান ও মঙ্গল সেই কাজের দিকে আস।’
الله أكبر -‘আল্লাহ্ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
لا إله إلا الله -‘আল্লাহ্ ছাড়া ভিন্ন কোনো মা’বুদ নেই।’
ভেবে দেখুন, এটা কত বড় শক্তিশালী ডাক। এ ডাক প্রত্যেক দিন পাঁচবার আপনাদেরকে একথায়ই স্মরণ করিয়ে দেয়, “পৃথিবীতে যতবড় খোদায়ীর দাবিদার দেখা যাচ্ছে, তারা সকলেই মিথ্যাবাদী, আকাশ ও পৃথিবীতে মাত্র একজনই খোদায়ী ও প্রভুত্বের অধিকারী এবং কেবল তিনি ইবাদাতের যোগ্য। আসুন আমরা সকলে মিলে তাঁরই ইবাদাত করি। ইবাদাতেই আমাদের সকলের জন্য ইহকালের ও পরকালের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।”
এ মর্মস্পর্শী আওয়ায শুনে কে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে পারে? যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান আছে, এতবড় নির্ভীক সাক্ষ্য এবং এত স্পষ্ট আহবান শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা তার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয় এবং প্রকৃত প্রভূ-মালিকের দরবারে হাজির হয়ে তার সামনে মাথা নত না করেও সে কিছুতেই থাকতে পারে না।
এ ডাক শুনেই আপনি উঠে পড়েন এবং সর্বপ্রথমেই আপনি চিন্তা করে দেখেন, আমি কি পবিত্র, না অপবিত্র? আমার জামা-কাপড় পাক কিনা? আমার অযু আছে কি নেই? অন্য কথায় আপনার সুস্পষ্ট অনুভূতি থাকে যে, উভয় জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজিরা দেয়ার বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য সকল বিষয় হতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। অন্যান্য কাজ তো সকল অবস্থাতেই করা যায়, কিন্তু এ মহান দরবারে শুধু দেহ ও কাপড়-চোপড়ের পবিত্রতাই যথেষ্ট নয় অতিরিক্ত (বিশেষ) পবিত্রতাও (অর্থাৎ অযু) একান্ত অপরিহার্য। এরূপ পবিত্রতা ছাড়া এখানে হাজিরা দেয়া ভীষণ বেয়াদবী। এ অনুভূতির সাথেই আপনি প্রথমে পবিত্র হওয়ার কথা চিন্তা করেন এবং তারপরে অযু করা আরম্ভ করেন। এ অযুর সময়ে যদি আপনি প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ ধোয়ার সময় এবং অযু শেষ করার পর হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখানো দোআসমূহ পাঠ করেন এবং আল্লাহকে যথাযথরূপে স্মরণ করেন, তাহলে শুধু যে আপনার অংগ-প্রত্যংগই ধোয়া হবে তা নয়, বরং আপনার অন্তরকেও ধৌত (পবিত্র) করা হবে। অযু শেষ করার পর নিম্ন দো’আ পড়তে হবেঃ
اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ” “أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক ও অদ্বিতীয় লা-শরীক আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তাওবাকারীদের অন্তুর্ভূক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অবলম্বনকারী বানাও।”
এরপর আপনি নামাযের জন্য দাঁড়ান। আপনার মুখ থাকে পবিত্র কেবলার দিকে। আপনি পাক-পবিত্র হয়ে সমগ্র জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজির হন।
সর্বপ্রথমেই আপনার মুখ থেকে বের হয়ঃ ٱللهُ أَكْبَر‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
মনে ও মুখে এ বিরাট অঙ্গীকার উচ্চারণ করে আপনি দুনিয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস হতে নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করার প্রতীক হিসেবে কান পর্যন্ত দু’হাত তোলেন এবং আপনার বাদশার সামনে হাত বেঁধে দণ্ডায়মান হন। এরপরে নিরতিশয় বিনয় সহকারে আপনি আরয করেনঃ
سبحانك اللهم و بحمدك، وتبارك اسمك، و تعالى جدك، ولا إله غيرك
“হে আল্লাহ! আমি তোমারই পবিত্রতা বর্ণনা করছি, তোমার প্রশংসা সহকারে তোমার নামের বরকত ও মাহাত্ন্য সত্যই অতুলনীয়। তুমি সর্বশ্রেষ্ট, তোমার সম্মন সকলের উচ্চে। তুমি ছাড়া কেউ মা’বুদ নেই।”
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
“অভিশপ্ত মরদুদ শয়তানের কবল হতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।”
بسم الله الرحمن الرحيم
“মেহেরবান-দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি।”
الحمد لله رب العالمين
-“সারাজাহানের পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই সমগ্র ও সর্বপ্রকার তারীফ-প্রশংসা।”
الرحمن الرحيم
-তিনি অত্যন্ত দয়াময় ও মেহেরবান।
مالك يوم الدين
-তিনি বিচার দিনের একমাত্র মালিক। যেদিন মানুষের যাবতীয় কর্মের বিচার করা হবে এবং প্রত্যেককে তার কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
إياك نعبدوإياك نستعين
-হে মালিক! আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।
اهدنا الصراط المستقيم
-আমাদেরকে সহজ, সোজা, সঠিক পথ দেখাও।
صراط الذين أنعمت عليهم
-তাদের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ ও পুরস্কার প্রাপ্ত।
غير المغضوب عليهم ولأ الضا لين
-আর যারা অভিশপ্ত ও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত নয়।
-হে আল্লাহ! আমাদের দোআ কবুল কর, মনোবাঞ্চনা পূর্ণ কর।
এরপর কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত পড়তে হয়। কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতই অমৃতে পরিপূর্ণ। তাতে অমূল্য উপদেশ, শিক্ষা এবং সত্য পথের দিকে আহবান রয়েছে। সূরা ফাতেহায় যে সহজ ও সোজা পথের জন্য দোআ করা হয়, তাতে সেই সোজা পথেরই হেদায়াত ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি সূরার উল্লেখ করা হচ্ছেঃ
وَالعَصرِ إِنَّ الإِنسانَ لَفي خُسرٍ إِلَّا الَّذينَ آمَنوا وَعَمِلُوا الصّالِحاتِ وَتَواصَوا بِالحَقِّ وَتَواصَوا بِالصَّبرِ
“কালের শপথ! সমগ্র মানুষ ধ্বংসের মুখে। কেবল তারা ছাড়া যারা ঈমানদার এবং (ঈমানের দাবি অনুযায়ী) সৎকর্মশীল এবং যারা পরস্পর পরস্পরকে সত্য পথে চলতে উপদেশ ও পরামর্শ দেয় এবং সত্য পথে দৃঢ় ও মযবুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে (কেবল তারাই ধ্বংসের পথ হতে রক্ষা পেতে পারে)।”
এ ছোট সূরাটি হতে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, ধ্বংস ও ব্যর্থতা হতে মানুষ কেবল একটি মাত্র উপায়ে বাঁচতে পারে। তা এই যে, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী আমল করাই যথেষ্ঠ নয়, বরং সাথে সাথে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদের এমন একটা সুসংগঠিত দলও থাকা আবশ্যক, যে দল পরস্পরকে এবং দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে সত্যের পথে- ন্যায়ের দিকে আহবান জানাবে এবং সর্বপ্রকার দুঃখ-বিপদে আল্লাহর দ্বীন ইসলামের ওপর সুদৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে।
কিংবা অন্য কোনো সূরা যেমনঃ
أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ
فَذَٰلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ
وَلَا يَحُضُّ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ
الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ
وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ
“হিসাব-নিকাশের দিন-কেয়ামতের প্রতি অবিশ্বাসী ব্যক্তি কি রকম হয়, তা তুমি দেখেছ কি? এ ধরনের মানুষই এতিমকে বিতাড়িত করে এবং গরীব মিসকীনকে নিজেরা তো আহার দান করেই না- এমনকি অন্য লোকদেরকেও এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য এতটুকু কষ্ট স্বীকার করে না। এমন সব নামাযীর জন্য ধ্বংস (পরকালের প্রতি অবিশ্বাস করার কারনে) যারা নামাযে গাফলতি করে, এরা নামায পড়লেও তা কেবল লোক দেখানোর জন্যই পড়ে এবং তাদের মন এত সংকীর্ণ যে, অতি সামান্য ও ছোট-খাটো জিনিসও অভাবীদেরকে দিতে কুন্ঠিত হয়।”
এ সূরাটির মূল শিক্ষা এই যে, পরকালের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করা ইসলামের প্রাণ স্বরূপ। (এটা না থাকলে ইসলামের কাজই প্রাণহীন দেহের মতই অর্থহীন)। এছাড়া কোনো মানুষই আল্লাহর দেখানো সহজ সরল পথে চলতে পারে না। আর একটি সূরাঃ
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ
يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ
كَلَّا ۖ لَيُنبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ
نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ
الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ
إِنَّهَا عَلَيْهِم مُّؤْصَدَةٌ
فِي عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ
“অন্যের দোষ অন্বেষণ করা এবং পরকে হীন প্রতিপন্ন করে অপমানসূচক কথা বলা-ই যাদের অভ্যাস তাদের সকলের জন্য আফসোস। তারা কেবল টাকা-পয়সা জমা করে এবং (তা কি রকম বাড়ছে) বার বার গুনে দেখে। তাদের ধারণা এই যে, তাদের ধন-সম্পত্তি তাদের কাছে চিরদিন থাকবে। তা কখনই নয়। একদিন তারা নিশ্চয় মরবে এবং হুতামা নামক জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জান হুতামা কি? তা আল্লাহর জ্বালানো অগ্নিকুণ্ড; তার লেলিহান শিখা কলিজা পর্যন্ত ভষ্ম করে। তা বড় এবং সুউচ্চ স্তম্ভের ন্যায় অগ্নি শিখা যা তাদেরকে ঘিরে ফেলবে।”
এভাবে নামাযে কুরআন শরীফের যেসব সূরা এবং আয়াত পাঠ করা হয় তাদের মধ্যে কোনো না কোনো মূল্যবান শিক্ষা এবং উপদেশ থাকে। তা মানবকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয় যে, মানুষের প্রতি আল্লাহর এ হুকুম অনুসারে দুনিয়াতে কাজ করতে হবে। এসব হেদায়াত ও উপদেশের আয়াত পড়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে রুকূ’তে যান। হাঁটুর ওপর হাত রেখে দুনিয়া জাহানের আল্লাহ তাআলার সামনে মাথা নত করে বারবার বলতে থাকেনঃ
“অতি পবিত্র আমার মহান পালনকর্তা পরওয়ারদেগার।” তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং বলেনঃ (আরবী***) “যে ব্যাক্তি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করলো, তার কথা আল্লাহ্ শুনতে পেয়েছেন।” এরপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মাটির সাথে মাথা মিশিয়ে সেজদা করেন এবং বলেনঃ (আরবী***) “আমি মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।” পরে মাথা উঠান এবং আদবের সাথে বসে পাঠ করেনঃ
তা التحيات لله والصلوات والطيبات، السلام عليك أيها النبي ورحمة لله
وبركاته، السلام علينا و على عباد الله الصالحين، أشهد أن لا إله إلا الله، وأشهد أن محمدا عبده و رسوله.
“আমাদের সব সালাম-শ্রদ্ধা, আমাদের সব নামায এবং সকল প্রকার পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য।”
-হে নবী! আপনার প্রতি সালাম, আপনার ওপর আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।
-আমাদের ও আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ প্রভূ ও মা’বুদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ তাআলার বান্দাহ এবং রাসূল।”
এভাবে আপনি যখন সাক্ষ্য দেন তখন আপনাকে শাহাদাত আঙ্গুল ওঠাতে হয়। কেননা এ আঙ্গুলি সংকেত দ্বারা নামাযের মধ্যেই আপনার আকীদা ও বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করা হয় এবং এ সাক্ষ্যের কথাটি মুখে বলার সময় বিশেষভাবে মনোযোগ স্থাপন করতে এবং মন-মগযের ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়। এরপর আপনাকে নিম্নের দরূদ পাঠ করতে হয়ঃ
اللهم صل على محمد وعلى آل محمد، كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم، وبارك على محمد وعلى آل محمد، كما باركت على إبراهيم
وعلى آل إبراهيم، في العالمين إنك حميد مجيد.
“হে আল্লাহ! দয়া ও রহমত কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি, যেমন তুমি রহমত করেছো হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি অতি উত্তম গুনের আধার এবং মহান। হে আল্লাহ! বরকত নাযিল কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার বংশধরদের ওপর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং তার বংশধরদের ওপরে করেছো। নিশ্চয়ই তুমি অতীব সৎগুন বিশিষ্ট ও মহান।”
দরূদ পড়ার পরে আল্লাহর কাছে এভাবে দোআ করেনঃ
اللهم إني أعوذ بك من عذاب جهنم، و من عذاب القبر، و من فتنة المحيا و الممات، و من فتنة المسيح الدجال، رب اغفر لي و لوالدي رب ارحمهما كما ربياني صغيرا.
“হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের আযাব হতে বাঁচার জন্য তোমার কাছে আশ্রয় চাই। কবরের আযাব থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই। সেই পথভ্রষ্টকারী দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তোমার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর অনিষ্ট থেকে । হে আল্লাহ! অন্যায় কাজ এবং ঋণ থেকেও তোমার কাছে আশ্রয় চাই।”
এ দোআ পাঠ করার পর নামায পূর্ণ হয়ে যায়। রাব্বুল আলামীনের দরবার থেকে বিদায় নিয়ে সর্বপ্রথম ডান ও বাম দিকে ফিরে উপস্থিত সকলের এবং দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য রহমত ও শান্তি প্রার্থনা করে বলেনঃ
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ
“আপনাদের প্রতি আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।” এটা যেন একটি শুভ সংবাদ; নামাযের পর আল্লাহর দরবার থেকে এটা নিয়েই আপনি ফিরে এসেছেন। এভাবেই নামায আদায় করেন অতি ভোরে উঠে দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম শুরু করার পূর্বেই। তারপর অনেক ঘণ্টা যাবত দুনিয়ার নানা কাজে লিপ্ত থাকেন। দ্বিপ্রহরের একটু পরেই আবার আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে নামায আদায় করেন-তার কয়েক ঘণ্টা পরেই বেলা তৃতীয় প্রহরেও আবার এ নামায আদায় করেন। আবার কয়েক ঘণ্টা কাজ-কর্ম করার পর সূর্যাস্ত হলেই আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে এ নামায আদায় করেন। তারপর দুনিয়ার কাজ-কর্ম শেষ হয়ে গেলে ঘুমাবার পূর্বে শেষবারের মত আল্লাহর সামনে হাজির হন। এ শেষ নামাযের শেষ তিন রাকআতের নাম ‘বেতেরের নামায।’ এর তৃতীয় রাকআতে আল্লাহর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিজ্ঞা করেন। এ প্রতিজ্ঞার নাম ‘দোআয়ে কুনুত।’ এ দোআর মরফতে নামাযী আল্লাহর সামনে অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্রতার সাথে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের শপথ গ্রহন করে। তাঁর অনুগত হয়ে চলার ওয়াদা করে। এ প্রতিজ্ঞায় আপনি কি বলেন মনোযোগ সহকারে শুনুনঃ
اللهم إنا نستعينك ونستغفرك ونؤمن بك ونتوكل عليك ونثني عليك الخير ونشكرك ولا نكفرك ونخلع ونترك من يفجرك
اللهم إياك نعبد ولك نصلي ونسجد وإليك نسعى ونحفد ونرجو رحمتك ونخشى عذابك إن عذابك بالكفار ملحق
“হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই। তোমার কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। তোমার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি। আমরা কেবলমাত্র তোমার ওপরেই ভরসা করি। সর্বপ্রকার কল্যাণ ও মঙ্গলের সাথে তোমার প্রশংসা করি। আমরা তোমার শোকর আদায় করি, তোমার দানকে অস্বীকার করি না। আমরা তোমার কাছে ওয়াদা করছি যে, তোমার অবাধ্য লোকদের সাথে আমরা কোনো সম্পর্ক রাখবো না-তাদেরকে পরিত্যাগ করবো। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব স্বীকার করি। কেবলমাত্র তোমার জন্যই নামায পড়ি, কেবল তোমাকেই সিজদা করি এবং আমাদের সকল প্রকার চেষ্টা-সাধনা ও সকল কষ্ট স্বীকার কেবল তোমার সন্তুষ্টির জন্যই। কষ্ট আমরা কেবল তোমারই রহমত লাভের আশায় করি, তোমার আযাবকে আমরা ভয় করি। নিশ্চয়ই তোমার আযাবে কেবল কাফেরগণই নিক্ষিপ্ত হবে।”
একটু ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচবার আযানের ধ্বনি শুনে এবং চিন্তা করে দেখে যে, কত বড় কথা সেই আযানেই ঘোষণা করা হচ্ছে এবং তা দ্বারা কত বড় মহান বাদশাহর কাছে হাজির হবার জন্য আহবান হানানো হচ্ছে। প্রতিবার আযান শুনে যে ব্যক্তি তা মনে মনে অনুভব করে নিজের সকল কাজ-কর্ম ছেড়ে সারাজাহানের মালিক ও প্রভুর দরবারে হাজির হয়, প্রতি নামাযের পূর্বে অযু করে নিজের দেহ ও মনকে পবিত্র করে নেয় এবং বারবার নামাযে উল্লেখিত রূপে সূরা ও দোয়া মনোযোগ সহকারে পাঠ করে প্রকৃতপক্ষে তার হৃদয়-মনে আল্লাহর ভয় না জেগে পারে না। আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে তার লজ্জা না হয়ে পারে না। পাপ ও অন্যায় কাজের কালো চিহ্ন নিয়ে আল্লাহর দরবারে বারবার হাজির হতে তার অন্তরাত্না নিশ্চয় কেঁপে ওঠবে। নামাযে আল্লাহর দাসত্ব এবং তাঁর আনুগত্য করে চলার কথা বলা এবং আল্লাহকে বিচার দিনের মালিক বলে বারবার স্বীকার করার পর কোন মানুষ বাহির দুনিয়ায় নিজের কাজ-কর্মের মধ্যে ফিরে এসে মিথ্যা কথা বলা, বেঈমানী করা, পরের হক আত্নসাৎ করা, ঘুষ খাওয়া ও দেয়া , সুদ খাওয়া ও দেয়া, অন্য মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া, নির্লজ্জতা, ব্যাভিচার ও অন্যায় প্রভৃতি কাজ কিছুই করতে পারে না কিংবা এগুলো করার পর পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে এসব কথা মুখে স্বীকার করার দুঃসাহস করতে পারে না। আপনি জেনে বুঝে দৈনিক অসংখ্যবার আল্লাহর সামনে স্বীকার করেন, “হে আল্লাহ! আমি কেবল তোমার দাসত্ব করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।” এটা স্বীকার করে আপনার পক্ষে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করা এবং অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? একবার এসব স্বীকার করে তার বিরোধিতা করলে পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হতে আপনার মন আপনাকে তিরস্কার করবে, লজ্জায় আপনার মাথা নত হয়ে পড়বে। আবার বিরোধিতা করলে আরো বেশী লজ্জা হবে এবং বিবেক আপনাকে আরো বেশী দংশন করবে। সমস্ত জীবন ভরে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়া সত্ত্বেও আপনার কাজ-কর্ম ও চরিত্র ঠিক না হওয়া এবং আপনার জীবনের আমূল পরিবর্তন সূচিত না হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা নামাযের এ সুফল দান প্রসংগে বলেছেনঃ
إِنَّ الصَّلاةَ تَنهىٰ عَنِ الفَحشاءِ وَالمُنكَرِ
“নিশ্চয়ই নামায মানুষকে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা ও সর্বপ্রকার পাপকার্য হতে বিরত রাখে।”
কিন্তু মানুষের মন ও চরিত্র সংশোধন করার এতবড় উপায় থাকা সত্ত্বেও এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সত্ত্বেও যদি কারো চরিত্র ঠিক না হয়, যদি কেউ পাপ পথ থেকে বিরত না থাকে তবে বুঝতে হবে যে, আসলে তারই স্বভাব খারাপ। সে জন্য নামাযের কোনো ত্রুটি নেই। পানি ও সাবান কাপড়ের ময়লা পরিস্কার করে বটে; কিন্তু তাতে কয়লার ময়লা দূর না হলে সে জন্য পানি ও সাবানের কোনো দোষ দেয়া যায় না-দোষ কয়লারই হবে।
কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, আমরা নামাযে যা কিছু পড়ি তা মোটেই বুঝি না বা বুঝেও পড়ি না। আমাদের নামাযে এটা একটি অতি বড় অভাব। এটা শেখার জন্য কিছু সময় ব্যয় করলেই অভাব পূরন হতে পারে-নিজেদের মাতৃভাষায় নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ ও ভাব অনায়াসেই আপনারা শিখতে পারেন। আমি মনে করি, এতে আপনাদের বড়ই উপকার হবে।