পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ মুহকাম, মুতাশাবিহ, কেনায়া, তা’রীয, মাজাযে আকলীর আয়াত সমূহ
কুরআনে মুহকাম ও মুতাশাবাহি দু’ধরনের আয়াত রয়েছে। মুহকাম বলতে সে আয়াতগুলো বুঝায়, যেগুলোর অর্থ বুঝতে আরবী ভাষাডবিদ কারুরই কোন দ্বিধা আসে না। সেগুলোর সহজ ও পরিস্কার অর্থ যা ধরা দেয়, তা ছাড়া আর কোন কিছুই হতে পারে না। ভাষাবিদ ও অভিজ্ঞ হবার মানদন্ড অবশ্য সেই প্রাচীন আরববাসী। এ যুগের সে সব ছিদ্রান্বেষী নয়, যারা গবেষার দাপটে মুহ্কাম আয়াত মাতাশাবহি ও সহজ-সরল আয়াতকে দুর্বোধ্য করে এবং কাছের অর্থকে দূরে ঠেলে দেয়।
মুতাশাবিহ আয়াত বলতে সেগুলোকে বুঝায়, যা থেকে একই সময়ে দুটো অর্থ নেয়া যেতে পারে। বাহ্যত এমন কোন নিদর্শন মেলে না, যা দিয়ে তার একটি অর্থকে নির্দিষ্ট করা যায়। দুটোরই সম্ভাবনা সমান। এ ধরনের সন্দেহ সৃষ্টির কারণ অনেক হতে পারে। কখনও বাক্যের মধ্যে এমন একটা সর্বনাম আনা হয় যার সংশ্লিষ্টতা দু’জনের বেলায় সমান। যেমন কেউ বলল:
(আরবী******************)
আমীর আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন অমুককে অভিশাপ দেয়ার জন্যে। আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করুন।
এখানে কাকে অভিশাপ করতে বলা হল? অমুককে, না আমীরকে? ‘হু’ সর্বনামটি তো দু’জনের বেলাই সমান সংশ্লিষ্ট। এখঅনে নিয়তের ওপরেই সব নির্ভর করছে। অন্যের কিছুই বলার নেই।
কখনও আয়াতে এমন দ্ব্যার্থবোধক শব্দ ব্যবহৃত হয়, যার দুটো অর্থই সমান পর্যায়ের। যেমন (**) অর্থাৎ তাকে স্পর্শ করেছ। (সূরা নিসা-৪৩)
**আবার এর দ্বারা সহবাসও বুঝায়। এ দুটো অর্থ এরূপ সমান ক্ষমতাবান যে, কোন নিদর্শন ছাড়া একটির পক্ষে মত দেওয়া চলে না।
** কখনও আয়াতে এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়, যা ভিন্ন ভিন্ন দুটি বাক্যের সাথে সংযুক্ত হবার সম্ভাবনা রাখে। অথচ এমন কোন নিদর্শন নেই, যা দিয়ে কাছের কিংবা দুরের বাক্যটির সাথে নিশ্চিতভাবে যুক্ত করা চলে। যেমন:
(আরবী******************)
আর মুছে নাও তোমাদের মাথা এবং তোমাদে পা’ গুলো। (সূরা মায়েদা-৬)
অর্থাৎ এখানে যদি (***) ‘লাম’ অক্ষরে ‘যের’ দিয়ে পড়া হয়, তা হলে (***) এর সাথে এবং ‘যবর’ দিয়ে পড়লে দূরবর্তী (****) এর সাথে সংযুক্ত হতে পারে। সুতরাং অর্থে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় যে, পা কি ধুতে হবে, না শুধু মুছে নিলেই চলবে?
** এভাবে যদি কোন বাক্যের কিংবা বাক্যাংশের ব্যাপারে এটা ধরা না যায় যে, এটা কি পূর্বের সাথে সংশ্লিষ্ট, না নতুন শুরু হল, তখনও কোন নিদর্শন না মিললে সন্দেহে পড়তে হয়। যেমন:
(আরবী******************)
এর ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড় কেউ জানে না এবং জ্ঞানের যারা পোক্ত হয়েছে। (সূরা আল-ইমরান-৭)
এখানে (*******) বাক্যটির অবস্থা অনির্দিষ্ট হয়ে আছে। এটা শব্দের সাথে সংযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা যতখানি রাখে, ততখানিই আবার নতুনভাবে শুরু হবার সম্ভাবনাও রাখে।
কেনায়া:
কেনায়া অর্থ এমন কোন কথা বলা, যাতে বাহ্যিক অর্থ বুঝানো উদ্দেশ্য না হয়ে বরং সেটার অপরিহার্য পরিণতি বুঝানো উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
এ অপরিহার্যতা দু’ধরনের হতে পারে। স্বাভাবিক ও যুক্তিভিত্তিক। যদি বক্তব্যের পরিণতিটা স্বভাবতই বুঝা যায়, তবে হয় স্বাভাবিক। আর যদি বক্তব্য থেকে সাহায্যে পরিণতি বের করতে হয়, তা হলে হয় যুক্তিভিত্তিক। যেমন, তার পাক ঘর থেকে সর্বদা ধোঁয়া বেরোয়। তার মেহমান অনেক। অর্থাৎ, সে যাকে পায় দাওয়াত দেয়। আর সর্বদা পাক চলে বলেই সব সময়ে পাক ঘরে চুলা জ্বলে। এধরনের কেনায়া বাক্য হচ্ছে: (আরবী******************)
অর্থাৎ ‘তার হাত বড় খোলা। মানে, সে খুব দাতা। (সূরা মায়েদা-৬৪)
ঠিক, তেমনি যদি কল্পিত কোন বস্তুকে বাস্তব কোন কিছুর সাহায্যে বুঝানো হয়, তখন তা হয় ইস্তেয়ারা যা কেনায়ার মতই।
এ ধরনের বাক্য ব্যবহার আরবদের ভেতরে ব্যাপক দেখা যায়। কুরআন-হাদীসেও এর নজীর প্রচুর। যেমন:
(আরবী******************)
অর্থাৎ তাদের ওপরে পদতিক ও অশ্বারোহী চড়াও কর। (সূরা ইসরা-৬৪)
এ আয়াতে ডাকাতদের এমন এক সর্দারের কথা উল্লেখ করা হল, যে তার সাথীদের নির্দেষ দিচ্ছে, তোমাদের একদল ওদিক থেকে আর একদল এদকি থেকে পথচারীদের ওপর হামলা কর।
(আরবী******************)
‘আমি তাদের সামনে দেয়াল তুলেছি, পেছনেও দেয়াল তুলেছি। (সূরা ইয়াছিন-৯)
(আরবী******************)
আর তাদের ঘারে বেড়ী লাগিয়েছি। ’ (সূরা ইয়াছিন-৮)
এখানে কাফিরদের মনেরভাব ও উদ্দেশ্যের অসহায়তা ও সংকীর্ণতা ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের যেন চারদিকে প্রাচীর আর ঘঅরে বেড়ী রয়েছে। তাই যে অবস্থায় আছে, তা থেকে চুল পরিমাণ নড়তে পারছে না। আর ভাল-মন্দ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
(আরবী******************)
‘এবং ভয়ে তুমি জড়োসড়ো হয়ে পা হাত গুটিয়ে বস। (সূরা কাছাছ-৩২)
অর্থাৎ মন স্থির করে চিন্তার বিশৃঙ্খলা ও কলুষতা বর্জন কর।
আরববাসীর কথোপকথনে এ ধরনের উদাহরণ অনেক মেলে। যেমন, তারা যখন কারুর বীরত্ব প্রকাশ করে, তখন নিজ তরবারির দিকে ইংগিত করে বলে, ‘কখনও এদিকে মারে, কখনও ওদেক মারে। এতে সে বুঝাতে চায়, বীরত্বে পৃথিবীতে তার তুলনা নেই। অথচ জীবনেই সে হয়ত তরবারি হাতে নেয়নি। কখনও বলে ‘অমুক বলছে, দুনিয়ায় কেউ নেই তার সামনে দাঁড়াবে। ’ কখনও ‘অমুক এরূপ করছিল’ বলেই এমন কিছু করে দেখায় যেন রণাংনে শত্রুকে কাবুতে পেয়ে মহাবীর কিছু করছে আর কি। হয়ত সে বেচারা না এরূপ করেছে, না বলেছে। কখনও বলে, ‘অমুক আমার গলা টিপে ধরেছে। ’ কখনও বলে, ‘অমুকে আমার গলায় আংগুল দিয়ে লোকমা বের করে নিয়েছে। ’
এটা স্পষ্ট ব্যাপার যে, এ ধরনের কথা দিযে সাধারণ অর্থ বোঝানো হয় না। আমাদের ভাষা ও বাগধারায়ও এরূপ অনেক কথা প্রচলিত আছে।
তারীজ
অর্থ হচ্ছে পরোক্ষ আলোচনা। মানে, কথাটা সাধারণভাবেই বলে বিশেষ ব্যক্তিকে ইংগিত করা। সে জন্যে তার দু’ একটা বৈশিষ্ট্য মাত্র বলে শ্রোতাকে আভাষে বুঝানো।
কুরআনে যখন এ ধরনের বর্ণনারীতি দেখা দেয়, তখন তা বুঝার জন্যে সংশ্লিষ্ট কাহিনী বা ঘটনাটি জানা থাকা দরকার হয়।
আমাদের হযরত (স) যখন কারুর ব্যাপারে বিরক্ত প্রকাশ করতেন, তখন তার নাম না নিয়ে বলতেন:
(আরবী******************) হল কি তাদের? এ সব করছে কেন?
কিংবা কুরানে আভে : (আরবী******************)
‘আল্লাহ্, ও তাঁর রসূলের কোন মীমাংসার পরে ঈমানদার নর-নারীর কিছুই বলার অধিকার থাকে না। (সূরা আহযাব-৩৬)
এখানে সাধারণভাবে মুমিন ও মুমিনাতদের কথা বলে মূলত বুঝানো হয়েছে। হযরত যায়নব (রা) ও তাঁর ভাইকে। আর :
(আরবী******************)
এ আয়াতে মর্যাদ ও অবদান প্রাপ্তদের উল্লেখ করে কুরআনে মূলত হযরত আবুবকর (রা)-কে বুঝিয়েছে। (সূরা নূর-২২)
এ সব অবস্থায় মূল ঘটনা জানা না থাকলে মর্মোদ্ধার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
মাযাযে আকলী
অর্থাৎ ক্রিয়াকে মূলকতর্তা ছেড়ে অন্য এক কর্তার সাথে জুড়ে দেয়া কিংবা মূলকর্ম ছেড়ে অন্য কিছুকে সেটার কর্ম বলে দেয়া।
এটা তো করা হয় যখন সেই ক্রিয়া ও তার কৃত্রিম কর্তার ও কর্মের ভেতরে কোথাও সাদৃশ্য থাকে, কিংবা বক্তা যার ব্যাপারে এরূপ বলে সেও মূল কর্তা বা কর্মের কেউ নয়, কিংবা তার সাথে যোগ রাখে। যেমন, সাধারণত বলা হয়: (আরবী******************) (আমীর দালান গড়েছে।
অথচ আমীর তো আর নিজে গড়েনি। তেমনি বলা হয়: (আরবী******************)
বসন্ত তরি-তরকারী জন্ম দিযেছে
এখানে বসন্ত তো আর তা জন্মায় না।
এ ধরনের বর্ণনারীতি কুরআনের অধিকাংশ স্থানে মেলে।