ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা
ড. আবদুল করিম জায়দান
অনুবাদ
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম
ইসলামী শরীয়তে রাষ্ট্রের মর্যাদা
সাধারণত মনে করা হয় ইসলাম একটি ধর্ম মাত্র এবং ইসলামী শরীয়ত কেবলমাত্র নৈতিক চরিত্র ও আল্লাহর সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক স্থাপনের নিয়ম-বিধানই পেশ করে। এছাড়া মানব জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ইসলামের কিছুই বলার নেই। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে ইসলাম একেবারেই নীরব এবং সে পর্যায়ে মুসলমানরা যে কোনো নীতি বা আদর্শ গ্রহণে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ইসলামের পূর্নাঙ্গ বিধান এ ধারণার তীব্র প্রতিবাদ করে। এ পর্যায়ে আমার বক্তব্য এখানে পেশ করছিঃ
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের নির্দেশ
ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামী শরীয়তে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ এবং সকল কাজ ও ব্যাপার সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন ও বিধান। জীবনের এমন কোনো দিক ও বিভাগের উল্লেখ করা যেতে পারে না, যে বিষয়ে ইসলামী শরীয়তে কোনো নির্দেশ পাওয়া যায় না। ইসলামের পূর্নাঙ্গ ব্যবস্থায় রয়েছে ইবাদাত, নৈতিক চরিত্র, আকীদা-বিশ্বাস এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাজকর্ম এবং লেনদেন পর্যায়ে সুস্পষ্ট বিধান। এর প্রত্যেকটি বিষয়ই ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য। মানব সমাজের ব্যক্তি ও সমষ্টি-স্বতন্ত্রভাবে এক একজন ব্যক্তি অথবা সমষ্টিগতভাবে গোটা সমাজ সম্পর্কেই আইন-বিধান রয়েছে ইসলামী শরীয়তে। এভাবে আল্লাহর এ দাবী সত্য হয়েই দেখা দিয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
***আরবী***
আল কিতাব-কুরআন মজীদে আমি কিছুই অবর্ণিত রাখিনি।
-সূরা আল আনআমঃ ৩৮
অন্য কথায় আল্লাহর দাবী হলো, কুরআনেই আমি জরুরী সব কথা বলে দিয়েছি। কিছুই বাদ রাখিনি, বাকী রাখিনি।
বস্তুত ইসলামী শরীয়তের বিধান আল্লাহর এ দাবীর সত্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে। শরীয়তের বিধানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়েই আইন-বিধান দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রকৃতি, তার পরামর্শভিত্তিক তথা গণতান্ত্রিক হওয়া, শাসন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা, ন্যায়সঙ্গত কাজে তাদের আনুগত্য, যুদ্ধ, সন্ধি, চুক্তি প্রভৃতি সর্ববিষয়ে অকাট্য বিধান রয়েছে ইসলামী শরীয়তে। আর তা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তাই নয়, রসূলে করীম স.-এর সুন্নাতেও রয়েছে তার ব্যাখ্যা ও বাস্তবরূপ সংক্রান্ত বিধান। কুরআন-হাদীসে আমীর, ইমাম ও সুলতান প্রভৃতি পারিভাষিক শব্দগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দগুলো বুঝায় সেই ব্যক্তিকে যার হাতে রয়েছে সার্বভৌমত্ব, শাসন ও আইন রচনার ক্ষমতা। আধুনিক পরিভাষায় তাই হলো সরকার বা গভর্নমেন্ট। সরকার বা গভর্নমেন্ট হলো রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাজেই যেসব আয়াত এবং হাদীসের যেসব উক্তিতে এ পরিভাষাগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করা একান্তই জরুরী। কেননা, এগুলো শুধু পড়া বা মুখে উচ্চারণের জন্যেই বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে এজন্যে যে, তা যেমন পড়া হবে তেমনি তাকে কার্যকরী করাও হবে। আর এগুলো কার্যকরী করতে হলে ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান অনুযায়ী পূর্নাঙ্গ রাষ্ট্র কায়েম করা অপরিহার্য।
শরীয়তের নির্দেশ পালন ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
তাছাড়া শরীয়তের এমন অনেকগুলো আইন-বিধান রয়েছে যা কার্যকরী করতে হলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করে সেগুলোর বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভবপর নয়। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মানুষের পরস্পরের বিচার-ফায়সালা করার এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে কুরআন-হাদীসে। কিন্তু রাষ্ট্র যতক্ষণ পর্যন্ত এ কাজ না করবে ততক্ষণ কোনো ব্যক্তি বা সমাজের সাধারণ মানুষের পক্ষে তা করা কিছুতেই সম্ভবপর হতে পারে না। এজন্যেই জনগণের উপর কোনো কিছু কার্যকরী করার ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা একান্তই জরুরী। এ পর্যায়ের যাবতীয় হুকুম-বিধানের প্রকৃতিই এমনি। একথাটি বোঝাবার জন্যেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ
*******আরবী***********
জনগণের যাবতীয় ব্যাপার সুসম্পন্ন করা-রাষ্ট্র কায়েম করা দীনের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। বরং রাষ্ট্র ছাড়া দীন প্রতিষ্ঠা হতেই পারে না। আরো কথা এই যে, আল্লাহ তায়ালা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং নিপীড়িতদের সাহায্য করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি জিহাদ, ইনসাফ ও আইন-শাসন প্রভৃতি যেসব কাজ ওয়াজিব করে দিয়েছেন তা রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র কর্তৃত্ব ছাড়া কিছুতেই সম্পন্ন হতে পারে না।
-আস-সিযাসাতুশ শরইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-১৭২-১৭৩।
অতএব শরীয়তের আইন-বিধান জারী ও কার্যকরী করার জন্যে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা একটি অপরিহার্য জরুরী কর্তব্য।
আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে ইসলামী রাষ্ট্র জরুরী
কথা এখানেই শেষ নয়। আল্লাহর ইবাদাতের দায়িত্ব পালনের জন্যেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে তাঁরই ইবাদাত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী**********
আমি জ্বিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু এ উদ্দেশ্যে যে, তারা আমারই ইবাদাত করবে।-সূরা আয যারিয়াতঃ ৫৬
কুরআনের এ ইবাদাত শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক পরিভাষা। আল্লাহ তায়ালা যেসব কথা, কাজ-প্রকাশ্য বা গোপনীয়-ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন তা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। *******আরবী*******
ইবাদাত শব্দের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে মানুষের যাবতীয় কথা, কাজ ব্যবহার প্রয়োগ, আয়-ব্যয় ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধ-এক কথায় মানুষের সমগ্র জীবন ইসলামী শরীয়ত নির্ধারিত পথও পন্থা এবং নিয়ম ও পদ্ধতি অনুযায়ী সুসম্পন্ন হওয়া কর্তব্য হয়। তা যদি করা হয় তাহলেই আল্লাহর মানব সৃষ্টি সংক্রান্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সার্থক হতে পারে। অন্যথায় মানুষের জীবনে আল্লাহর উদ্দেশ্য পূর্ণ হতে পারে না, আল্লাহর উদ্দেশ্যের দৃষ্টিতে মানব জীবন ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু মানুষের জীবনকে এদিক দিয়ে সার্থক করতে হলে গোটা সমাজ ও পরিবেশকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে এ দৃষ্টিতে জীবন যাপন করা তাদের পক্ষেই সহজ-সাধ্য হয়ে উঠে। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যেই যাপিত হয় মানুষের জীবন আর মানুষ যে সমাজ পরিবেশে বসবাস করে তার দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়াই হচ্ছে মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি। এ প্রভাব স্বীকৃতির ফলেই মানুষ যেমন ভালো হয় তেমন মন্দও হয়। যেমন হয় হেদায়েতের পথের পথিক তেমনি হয় গোমরাহীর আঁধার পথের যাত্রী। সহীহ হাদীস থেকে সমাজ-পরিবেশের এ অনস্বীকার্য প্রভাবের কথা সমর্থিত। নবী করীম স. ইরশাদ করেছেনঃ
***********আরবী********
প্রত্যেকটি সন্তানই প্রাকৃতিক ব্যবস্থাধীন জন্মগত প্রকৃতিতে ভূমিষ্ঠ হয়। অতঃপর তার পিতামাতা হয় তাদের ইহুদী বানিয়ে দেয়, নয় খৃষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক। ঠিক যেমন করে পশু প্রসব করে তার পূর্নাঙ্গ শাবক। তাতে তোমরা কোনো খুঁত দেখতে পাও কি, যতক্ষণ না তোমরা নিজেরা তাতে খুঁত সৃষ্টি করে দাও?- আল মুনতাখাব মিনাস সুন্নাহ, ৩৯১ পৃষ্ঠা।
এ হাদীস অনুযায়ী ছোট্ট শিশুর পিতামাতা সমন্বিত সমাজই হচ্ছে তার জন্যে ছোট্ট সমাজ। এ সমাজ পরিবেশেই তার জন্ম, লালন-পালন এবং ক্রমবৃদ্ধি। অতএব পিতামাতা যে রকম হবে তাদের সন্তান হবে ঠিক তেমনি। তারা যদি পথভ্রষ্ট হয়, তাহলে তারা তাদের সন্তানকেও পৌঁছে দেবে গোমরাহীর অতল গহবরে। আল্লাহ যে সুস্থ প্রশান্ত প্রকৃতির উপর শিশুকে পয়দা করেছেন তা থেকে তারা বহিষ্কৃত করে নেয়। পক্ষান্তরে তারা যদি সত্যদর্শী ও নেককার হয় তাহলে তারা তাদের সন্তানকে আল্লাহর সৃষ্টি প্রকৃতির ওপর বহাল রাখতে এবং একে কল্যাণের পথে পরিচালিত করতে পারে। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছে যে, বিপর্যস্ত সমাজ ইসলামের বিধি-নিষেধ কার্যকরী করার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। ফলে মুসলমান সেখানে ইসলামের উদ্দেশ্যানুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে না। তখন সেখান থেকে অন্যত্র এক অনুকূল সমাজ পরিবেশে হিজরত করে চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মুসলমানকে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
*******আরবী*********
ফেরেশতাগণ যেসব লোকের জান এ অবস্থায় কবজ করেছে যে, তারা ছিল আত্ম-অত্যাচারী, তাদের জিজ্ঞেস করবে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলবে, আমরা দুনিয়ায় দুর্বল ছিলাম। তখন ফেরেশতাগণ বলবেন, আল্লাহর যমীন কি বিশাল প্রশস্ত ছিল না, সেখানে তোমরা হিজরত করে যেতে পারতে? এসব লোকের পরিণাম হলো জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত খারাপ জায়গা।-সূরা আন নিসাঃ ৯৭
এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর বলেনঃ
এ আয়াত নাযিল হয়েছে সাধারণভাবে সেসব লোক সম্পর্কে যারা মুশরিক সমাজে বসবাস করে এমতাবস্থায় যে, তারা দীন কায়েম করতে সক্ষম না হলেও তারা সেখান থেকে হিজরত করে অন্যত্র চলে যেতে পারে। এরূপ অবস্থায় তারা হয় আত্ম-অত্যাচারী। হিজরত না করেও কুফরি সমজে বাস করে তারা যে হারাম কাজ করেছে এ বিষয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে ইজমা রয়েছে।-তাফসীরে ইবনে কাছীর, ১ম খন্ড, ৫৪২ পৃষ্ঠা।
উপরোক্ত আয়াত এবং তার তাফসীর অনুযায়ী স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইসলামের শিক্ষানুযায়ী জীবন যাপন করা এবং শরীয়তের বিধান মত সমাজের লোকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে কেবল গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তোলার মাধ্যমে ব্যক্তির পক্ষে ইসলামী জীবন যাপন কেবল এরূপ পবিত্র পরিবেশেই সম্ভব, সম্ভব নানা প্রকারের ইবাদাত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও আত্মপূর্ণতা লাভ করা। যে সমাজ সেরূপ নয় সেখানে তা সম্ভবও নয়।
কিন্তু ইসলামী সমাজ গঠন করা কিভাবে সম্ভব? তা কি শুধু ওয়াজ-নসীহত বক্তৃতা-ভাষণেই কায়েম হতে পারে?…না তা সম্ভব নয়। সে জন্যে প্রয়োজন পূর্নাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। ইসলামী রাষ্ট্রের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সম্ভব ইসলামের আদর্শ সমাজ গঠন। কেননা, এরূপ একটি রাষ্ট্র কায়েম হলেই তা দ্বারা ইসলামের পক্ষে ক্ষতিকর মতামত প্রচার ও শরীয়ত বিরোধী কাজ-কর্ম বন্ধ করা সম্ভব। এ কাজের জন্যে যে শক্তি ও ক্ষমতার প্রয়োজন তা কেবল এ রাষ্ট্রের হাতেই থাকতে পারে, কোনো বেসরকারী ব্যক্তি বা সমাজ সাধারণের হাতে এ শক্তি ও ক্ষমতা কখনো থাকে না। কুরআনের আয়াত থেকেও তা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
**********আরবী***************
বস্তুত আমি পাঠিয়েছি আমার নবী-রসূলগণকে এবং তাদের সাথে নাযিল করেছি কিতাব ও মানদণ্ড-যেন লোকেরা ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আরো নাযিল করেছি লৌহ। এর মধ্যে রয়েছে বিযুক্ত অনমনীয় শক্তি এবং জনগণের জন্য অশেষ কল্যাণ। আরো এজন্য যে, কে আল্লাহ এবং তার রসূলের অগোচরে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে তাকে যেন আল্লাহ জানতে পারেন।-সূরা আল হাদীদঃ ২৫
লৌহ মানে শক্তি-রাষ্ট্রশক্তি, যে লোক কুরআনের হেদায়াত পেয়ে দীনের পথে চলতে উদ্যোগী হবে না, রাষ্ট্রশক্তি তাকে গোমরাহী ও বিপর্যয় সৃষ্টির পথ থেকে বিরত রাখতে পারবে। নৌকার আরোহীরা ডুবে মরুক – এ উদ্দেশ্যে নৌকায় ছিদ্র সৃষ্টি করার অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পারে না। সমাজকে য শক্তি বিপর্যয় ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করতে পারে তাহলো রাষ্ট্রশক্তি, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। হযরত উসমানের একটি কথা স্মরনীয়ঃ
কুরআন দ্বারা যে হেদায়াত প্রাপ্ত হয় না আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা হেদায়াত করেন।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যখন ইসলামী শরীয়তের স্বাভাবিক দাবীও প্রবণতা, শুধু তা-ই নয় ইসলামী শরীয়ত যখন তারই জন্য নির্দেশ দেয় তখন সে কাজ রসূলে করী স. এরও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পারে না। তাই ইতিহাস প্রমাণ করেছে, রসূলে করীম স. এমনি একটি রাষ্ট্র কায়েমের জন্য মক্কা শরীফে থাকাবস্থায়-ই বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আর তার সূচনা হয়েছিল আকাবার দ্বিতীয়বারের শপথ কালে এবং মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করার পূর্বেই এ প্রচেষ্টা সম্পূর্ণতা লাভ করেছিলো। ইতিহাসে এ পর্যায়ে যে বিস্তারিত বিবরণ উদ্ধৃত হয়েছে তার সারকথা হলোঃ মদীনার মুসলমানদের একটি প্রতিনিধি দল মক্কা শরীফে এক গোপন স্থানে রসূলে করীম স.-এর সাথে মিলিত হয়। পুরুষ ও নারী মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ছিলো তিয়াত্তর জন। এ গোপন বৈঠকে রসূলে করীম স. তাদের সামনে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করার দাওয়াত পেশ করেন। এ দাওয়াত পেশ করার পর প্রতিনিধি দলের একজন বলেনঃ হে রসূল! আপনার হাতে বাইয়াত করবো কোন কথার ওপর? রসূলে করীম স. বলেনঃ তোমরা আমার হাতে এই বলে বাইয়াত করবে যে, তোমরা ভালো ও মন্দ উভয় অবস্থাতেই আমার কথা শুনতে ও মেনে চলতে প্রস্তুত থাকবে, তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ থেকে লোকদের নিষেধ করবে-বিরত রাখবে। আর তোমরা আল্লাহর কথা বলবে, কিন্তু তাতে কোনো উৎপীড়কের ভয় করবে না। আর তোমাদের বাইয়াত হবে একথার ওপর যে, তোমরা আমার সার্বিক সাহায্য করবে। আর আমি যখন তোমাদের মাঝে এসে বসবাস করতে থাকবো তখন যেসব ব্যাপার থেকে তোমরা নিজেদেরকে, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে রক্ষা করো তা থেকে তোমরা আমাকেও রক্ষা করবে। আর এর বিনিময়ে তোমাদের জন্যে জান্নাত নির্দিষ্ট থাকবে।
(আলবেদায়াতু ওয়ান নেহায়াতু লিল ইমাম ইবনে কাছীর, ৩য় খণ্ড, ১৫৯ পৃ, সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, ৪৮ পৃষ্ঠা এবং ইমতাউল ইসমা লিল মিকারিযী, ৩৫ পৃষ্ঠা) একথা শুনে প্রতিনিধি দলের লোকেরা রসূলে করীম স.-এর সামনে উঠে দাঁড়ালো এবং রসূল স.-এর উল্লেখিত শর্তাবলী মেনে নিয়ে বাইয়াত করলো। (ঐ)
প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
বস্তুত রসূলে করীম স. এবং মুসলিম প্রতিনিধি দলের মাঝে এভাবে যে বাইয়াত অনুষ্ঠিত হলো, তা-ই ছিলো প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক সুস্পষ্ট চুক্তিনামা (Contract)। এ চুক্তিনামায় আল্লাহর প্রভুত্বের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার রসূলে করীম স.-এর থাকবে এবং তারা তা অবশ্যই মেনে চলবে বলে স্বীকার করে নিয়েছিলো। নতুন প্রতিষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রের আওতায় যাবতীয় বিষয়ে রসূলের আনুগত্য করে চলা, তাঁকে বাস্তব সাহায্য করা এবং তাঁর প্রতিরক্ষায় পূর্ণ মাত্রায় সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি পেশ করা হয়েছিলো। আর এই হলো রাষ্ট্রের বুনিয়াদ। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রনীতি ও আদর্শেরও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন রসূলে করীম স.-এর কথায় উল্লিখিত হয়েছে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ।
অতঃপর নবী করীম স. মদীনায় হিজরত করেন। তাঁর সাহাবীদেরও তিনি মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেনঃ
*******আরবী*******
আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্যে বহু ভাই সংগ্রহ করে দিয়েছেন এবং এমন এক স্থান জোগাড় করে দিয়েছেন যেখানে তোমরা আশ্রয় নিতে পারো।-সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, ১১০ পৃ.।
নবী করীম স. মদীনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন এবং তাঁর মসজিদ নির্মাণ করলেন, তখনঃ নবী করীম স. মুহাজির ও আনসারদের মাঝে একটি চুক্তিনামা রচনা করলেন তাতে ইহুদীদেরও শরীক করা হলো। তাদের সাথে একটা চুক্তি স্থিরীকৃত হলো। তাতে তাদেরকে তাদের ধর্ম ও ধন-সম্পদের ওপর তাদের অধিকার স্বীকার করা হলো। তাদের ওপর কিছু কর্তব্য আরোপিত হলো এবং তাদের জন্য কিছু অধিকার স্বীকার করে নেয়া হলো।-সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, ১১৯পৃ.।
এমনিভাবে দুনিয়ার প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ সংস্থাপিত হলো। আর রসূলে করীম স. ছিলেন এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান। এ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই তিনি ইহুদীদের সাথে সন্ধি করেছিলেন। এ সন্ধিও ছিলো রসূলে করীম স.-এর রাষ্ট্রশক্তির বহিঃপ্রকাশ। অতঃপর তিনি আভ্যন্তরীণ বিষয়ের দিকে লক্ষ্য আরোপ করেন এবং মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সংস্থাপন করেন। এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের ফলেই তারা পরস্পরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে প্রস্তুত হলো। যদিও পরে মীরাসী আইন নাযিল হয়ে এ বিষয়ের চূড়ান্ত মীমাংসা করে দেয়।-আল বেদায়াতু ওয়ান নেহায়াতু লি-ইবনে কাছীর, ৩য় খণ্ড, ২২৪ পৃ.।
রাষ্ট্রের নানা বিভাগ
আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পরিভাষায় রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এইঃ এক সুসংবদ্ধ জনসমাজ, একটি নির্দিষ্ট এলাকা যার মালিকানাধীন, যার সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা রয়েছে এবং যার রয়েছে একটা স্বাতন্ত্র্য, তা-ই রাষ্ট্র।
ড. মুস্তফা কামিল-জনৈক আরব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেনঃ জনগণের একটি সুগঠিত দল, যা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অধিকারী সার্বভৌমত্ব সম্পন্ন যার একটি ভাবপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে।-শারহুল কানুনুদ দস্তুরী, ২৫পৃ.।
রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞাই দেয়া হোক না কেন, তা পাঁচটা দিক অনিবার্যঃ ১. সুসংবদ্ধ জনসমাজ, ২. যা একটি ব্যাপক ব্যবস্থার অনুগত, ৩) একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী, ৪) সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন, ৫) আর তার রয়েছে ভাবগত স্বাতন্ত্র্য। নবী করীম স. মদীনায় যে রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন তাতে রাষ্ট্রের এসব কয়টি উপাদানই যথাযথভাবে বর্তমান ছিল। জনসমাজ বলতে সেখানে ছিল মাহজির ও আনসার মুসলিম গন। তারা যে সামগ্রিক ব্যবস্থা মেনে চলতো, তা ছিল ইসলামী শরীয়তের আইন ও বিধান। আর মদীনা ছিল রাষ্ট্রের অঞ্চল। তাদের জন্যে যে সার্বভৌমত্ব ছিল তা রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে নবী করীম স. জনগণের কল্যাণে ব্যবহার ও প্রয়োগ করতেন। এ সমাজের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব ছিল সুস্পষ্ট, সুপ্রকাশিত। নবী করীম স. রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে যেসব চুক্তি সম্পন্ন করতেন তা পালন ও রক্ষা করে চলা জনগণের সেকলের পক্ষেই অপরিহার্য কর্তব্য হতো। ব্যক্তিগতভাবে কেবল রসূলে করীম স. সে জন্যে দায়ী হতেন না।
রসূলে ব্যক্তিত্বে নবুওয়াত ও প্রশাসকতার সমন্বয়
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার দরুন রসূলের ব্যক্তিত্বের একই সাথে কয়েক প্রকারের গুণের সমাবেশ ঘটে। নবুওয়াত ও আল্লাহর দীন প্রচারের গুণ, ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার গুণ, লোকদের পরস্পরের ফায়সালা করা ও ইনসাফ কায়েম করে যে বিচারক-সেই বিচারক হওয়ার গুণ। অনুরূপভাবে প্রশাসন ক্ষমতা ও বিচার ক্ষমতারও সমন্বয় সাধন হয় রসূলে করীম স.-এর ব্যক্তিসত্তায়। সর্বোপরি তিনি ছিলেন আল্লাহর শরীয়তের মুবাল্লিগ, নবী ও রসূল।
ইসলামের ফিকাহবিদগণ রসূলে করীম স.-এর ব্যক্তিত্বে এ গুণসমূহের সমাবেশের কথা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন এবং এর বিভিন্ন দিকের গুণের দিক দিয়ে তিনি যেসব আদর্শ ও হুকুম দিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। তাঁরা বলেছেনঃ তিনি নবী হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বিধান পেশ করেছেন তাহলো সর্বসাধারণের জন্যে প্রযোজ্য বিধান। সবার ওপরে সে আইন অবশ্যই জারি করতে হবে। আর যেসব বিধান তিনি মুসলমানদের নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে দান করেছেন তা কেবল রাষ্ট্রপ্রধানেরই করণীয়। আর বিচারপতি হিসাবে যে ফায়সালা দিয়েছেন সেরূপ ফায়সালা একজন বিচারক বা বিচারপতিই দিতে পারেন। এখন রসূল স.-এর কোন কথাটি কোন হিসাবে দেয়া নবী হিসাবে না রাষ্ট্রপ্রধান বা কাজী হিসাবে? তা নিয়ে ফিকাহবিদদের ইজতিহাদ কিছুটা মতপার্থক্য ঘটেছে। যেমন, রসূল স.-এর একটি ফরমান হলোঃ
******আরবী********
যে লোক কোনো মৃত যমীন চাষাবাদ করে জীবন্ত ও ফসলযোগ্য বানালো তা তারই জন্যে।
এ ফরমানটি তিনি কোন হিসাবে দিয়েছেন?…..রসূল হিসাবে, রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে?…..না কাজী ও বিচারক হিসাবে? সব ফিকাহবিদই এ হাদীসের উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু কেউ বলেছেন, এটি হচ্ছে রসূলে করীম স.-এর একটি ফতোয়া এবং একথা বলে তিনি আল্লাহর ফায়সালাই পৌছিয়ে দিয়েছেন মাত্র। অতএব এ ফায়সালা সর্বসাধারণের জন্যে এবং যে লোকই এ কাজ করবে সেই সংশ্লিষ্ট জমির মালিক হতে পারবে, রাষ্ট্রপ্রধান তার অনুমতি দিক আর নাই দিক। ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ী মত পোষণ করেছেন। আবার একটি মত হলো, একথা তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে বলেছিলেন, অতএব মৃত জমি কেবল জীবন্ত করে তুললেই তার মালিক হওয়া যাবে না, বরং সে জন্যে সরকার ও কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। এ মত হচ্ছে ইমাম আবু হানিফার। এমনিভাবে তা৭র আর একটি হুকুম হচ্ছে, তিনি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাকে বলেছিলেনঃ
**********আরবী**************
তোমার নিজের ও তোমার সন্তানের জন্যে প্রচলিত নিয়মে যা কিছু প্রয়োজন সেই পরিমাণ তুমি অনায়াসেই এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়াই তার ধন-সম্পদ থেকে গ্রহণ করতে পারো।
এ হাদীসকে ভিত্তি করে কেউ কেউ বলেছেনঃ নবী করীম স.-এর কথাটি হলো তাঁর একটি ফতোয়া, শরীয়তের হুকুম পৌছিয়ে দেয়ারই কাজ। কাজেই এ ফতোয়ার ভিত্তিতে যে কেউ তার হক আদায় করে নিতে পারে তার স্বামীকে না জানিয়েও এবং তা সম্পূর্ণ জায়েয হবে। ইমাম শাফেয়ী এ মতই গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে কেউ কেউ বলেছেনঃ এ হচ্ছে নবী করীম স. -এর বিচারপতি হিসাবে দেয়া ফায়সালা। অতএব বিচারকের ফায়সালা ছাড়া কেউ তার হক স্বামীকে না জানিয়ে তার ধন-সম্পদ থেকে গ্রহণ করতে পারে না।-আলফূরক কিরাফী, ১ম খণ্ড, ২০৭-২০৮পৃ.।
দারুল ইসলাম
দারুল ইসলাম কথাটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের একটি বিশেষ পরিভাষা। এ পরিভাষা অনুযায়ী রাষ্ট্রই হলো দারুল ইসলাম-ইসলামের দেশ। মুসলিম ফিকাহবিদগন ইসলামী রাষ্ট্রকে দারুল ইসলাম বলেই উল্লেখ করেছেন। এখানে দার শব্দটি আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানের রাষ্ট্র বা এরই সমার্থক। ফিকাহবিদগণ দারুল ইসলামের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেনঃ
*********আরবী*************
দারুল ইসলাম এমন অঞ্চলের নাম যা মুসলমানদের কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে-শারহু সিয়ারিল কবীর লিসসারাখসী, ১ম খণ্ড, ৮১ পৃ.।
এ সংজ্ঞায় দুটো জিনিসের উল্লেখ রয়েছে স্পষ্ট-একটি হলো রাষ্ট্র, অপরটি অঞ্চল, রাষ্ট্র সংক্রান্ত অন্যান্য কথাও এর মধ্যে রয়েছে। যেমন রাষ্ট্রের অধিবাসী জনতা, আর দ্বিতীয় হলো রাষ্ট্রীয় আদর্শ। কেননা, একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, মুসলমানরা আল্লাহ ও রসূল এবং কুরআন ও সুন্নায় বিশ্বাসী বলে তারা যখন দুনিয়ার কোনো ভৌগলিক এলাকায় শাসল কর্তৃত্ব স্থাপন করে, তখন অবশ্যই ইসলামী আইন-বিধান মুতাবিক যাবতীয় কাজ সম্পাদন করবে। ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এ ভাষায়ও দেয়া হয়েছেঃ
*****আরবী*******
দারুল ইসলাম হলো এমন দেশ, যেখানে ইসলামের যাবতীয় নিয়ম বিধান সপ্রকাশিত ও বিজয়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।-শারহুল আযহার, ৫ম খণ্ড, ৫৭১-৫৭২ পৃ.।
এ সংজ্ঞায় উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কথা। সেই সাথে এতে রয়েছে রাষ্ট্রের অপরাপর উপাদানের কথাও। যেমন জনতা ও ভৌগলিক অঞ্চল। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার জন্যে দেশের সকল বাসিন্দাদের মুসলমান হতে হবে এমন কোনো শর্তই ফিকাহবিদদের দেয়া সংজ্ঞা খেকে প্রমাণিত হয়না। বরং সেখানে অমুসলিম নাগরিকও থাকতে পারে, থেকেছেও। এজন্যে ফিকাহবিদগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ
***********আরবী**********
যেমন অমুসলিম অধিবাসীরাও দারুল ইসলামের (ইসলামী রাষ্ট্রের) নাগরিক। – আলমাবসুতু লিসসারাখসী, ১ম খণ্ড, ৮২ পৃ. এবং আল মুগনী, ৫ম খণ্ড, ৫১৬ পৃ.।
অবশ্য কোনো কোনো ফিকাহবিদ কথাটিকে আরো উদারভাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মতে ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার জন্যে অধিবাসীদের মুসলমান হওয়াও শর্ত নয়। বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌম শাসকের মুসলিম হওয়া এবং ইসলামী আইন-বিধান মোতাবেক শাসন সম্পাদন করাই ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। ইমাম শাফেয়ী এ মত পোষণ করতেন। তিনি বলেছেনঃ
*****************আরবী******************
দারুল ইসলামে কেবল অধিবাসী মুসলমান হওয়া শর্ত নয় বরং রাষ্ট্র শাসকের মুসলিম হওয়াও ইসলাম অনুসরণ করাই সে জন্যে যথেষ্ট।-ফাতহুল আযীয, ৮ম খণ্ড, ১৫পৃ.।
তার মানে নিশ্চয় এ নয় যে, ইমাম শাফেয়ীর মতে অমুসলিম নাগরিকদের ওপরও ইসলামী আইন জারি হবে। তার কথার তাৎপর্য এই যে, একটি রাষ্ট্রকে ইসলামী বলে চিহ্নিত করার জন্যে রাষ্ট্র শাসকের মুসলিম হওয়া ও ইসলামী বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র শাসন করাই প্রথম শর্ত। এ হয়ে গেলেই তাকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যাবে।
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও লক্ষ্য
বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শিক চিন্তামূলক রাষ্ট্র। তা প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী আকীদা ও বিশ্বাসের উপর, ইসলামী আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের ওপর। এজন্যে ইসলামী রাষ্ট্র কোনো ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সীমিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়। নয় বিশেষ কোনো জাতি, শ্রেণী, সম্প্রদায় বা গোত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, প্রকৃত পক্ষে তাহলো একটি মতাদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র এবং তার সীমা আওতা ও প্রভাব বিস্তীর্ণ ততখানি, যতখানি সম্প্রসারিত এ আদর্শের প্রভাব। এ কারণে তার জন্যে কোনো বিশেষ বর্ণ, জাতীয়তা বা আঞ্চলিকতার গুরুত্ব স্বীকৃত নয়। এ প্রকৃতির কারণেই ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব বিশ্বরাষ্ট্র হওয়া, যেখানে থাকবে অসংখ্য জাতি, সম্প্রদায়, শ্রেণী, বর্ণ ও গোত্রের লোক সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে। কোনো আকীদা-বিশ্বাস ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে তা কবুল করা যে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। আর যখনি একজন লোক সে আকীদা গ্রহণ করে অমনি ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার অধিকারী হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তাই, যা প্রমাণিত ও স্বতপ্রকাশিত হয় তার প্রকৃতি থেকে। তা যতদিন একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন তা থাকবে ইসলামী আদর্শ ও বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই অতি স্বাভাবিকভাবেই সে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে তাই যা ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ কারণে নাগরিকদের জন্যে শুধু শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের জীবন সংরক্ষণ ও বহিরাক্রমণ প্রতিরোধ পর্যন্তই তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও দায়িত্ব সীমিত হয়ে যেতে পারে না। বরং রাষ্ট্রের সর্বদিকে সর্ব ব্যাপারে ও সর্ব ক্ষেত্রেই ইসলামী আইন বিধান পূর্ণ মাত্রায় কার্যকরী করা, জারি করা এবং মানব সমাজের সর্বস্তরে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছে দেয়াও তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। সেই সাথে ইসলামী আকীদা মোতাবেক ব্যক্তিগণকে আল্লাহর বন্দেগী করা, বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ এবং ইসলামী বিধান মোতাবেক বাস্তব পূর্নাঙ্গ জীবন যাপনের অবাধ সুযোগ সুবিধে করে দেয়াও তার কাজ। ইসলামের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা, শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকদের মন-মগজ ও মানসিকতা এবং স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণকে ইসলাম অনুরূপ বানিয়ে দেয়াও তার বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এখানেই শেষ নয়, ইসলামী আদর্শের বিকাশদান ও তা অনুসরণ করে চলার পথে যত প্রকারেরই প্রতিবন্ধকতা হতে পারে তার সব দূর করা, ইসলাম বিরোধী চিন্তা, সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কীয় মতের প্রতিরোধ করাও তার কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। একথাই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন নিম্নোক্ত আয়াতেঃ
**********আরবী************
তারা সেইসব লোক, যাদের আমি যদি দুনিয়ার কোনো অংশে ক্ষমতাসীন করে দেই, তাহলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রচলন করবে, লোকদেরকে যাবতীয় মারূফ কাজে বাধ্য করবে ও শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত সব ব্যাপারে চূড়ান্ত ক্ষমতা আল্লাহরই জন্যে।-সূরা আল হাজ্জঃ ৪১
এখানে নামায কায়েম করার কথা বলে বুঝানো হয়েছে, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিককে আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে তৈরী করার কাজ। যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে জন কল্যাণের সুষ্ঠু বুনিয়াদে পুনর্গঠিত গ্রহণের কথা বলে রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে জনকল্যাণের সুষ্ঠু বুনিয়াদে পুনর্গঠিত করার কথা বুঝানো হয়েছে। আর মারূফ কাজের আদেশ ও শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে বিরত রাখার কথা বলে ইংগিত করা হয়েছে জনগণের জন্য ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জীবন যাপনের সুযোগ-সুবিধে করে দেয়া ও সর্ব ব্যাপারে ইসলামী আইন-কানুন জারি করার দিকে। এসবই হলো ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এসব কিছুরই লক্ষ্য রাষ্ট্রের জনগণের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে শরীয়ত ভিত্তিক কল্যাণ সাধন। এ কারণেরই ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে অন্যান্য সর্বপ্রকার রাষ্ট্রের তুলনায় অধিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।