অধ্যায় দুই
ইসলামী চিন্তাধারা পুরনো পদ্ধতি
বিচার –বিবেচনা ও সমালোচনা
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, পুরনো সমাধান, হোক তা ইতিহাস নির্ভর বা বিজাতীয়, ব্যর্থ, কারণ তাতে সংস্কারের সঠিক দৃষ্টিবঙ্গি নেই। উম্মাহর সংকট সামর্থের বা সম্পদের নয় বরং ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির। এ ধারণাগত সংকট বিশ্বাস, মূল্যবোধ অথবা নীতির সংকট নয় বরং চিন্তাধারা ও পদ্ধতির দীর্ঘস্থায়ী সংকট। উম্মাহর রাজনৈতিক ভিত্তিমূল পরিবর্তনের ফলেই এ সংকটের সৃষ্টি এবং তার ফলে যে কোনো ধরনের সামাজিক দায়িত্ব থেকে বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের দূরত্বের অবস্থান। এ একটি ঘটনাই সকল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি থামিয়ে দিয়েছে এবং উম্মাহকে উন্নয়ন এবং চ্যালেঞ্জের সাথে তাল মিলিয়ে চলার অযোগ্য করে তুলেছে। সভ্যতার অগ্রযাত্র সম্বন্ধে অবহিত থাকার এ অপারগত হলো সংকটের মূল কারণ। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না যদি কয়েকিট বিষয়ে মনোযোগ দেয়া না যায় এবং মুসলিম মনের গতি ঠিক না হয়। যেসব বিষয়ে মুসলিম চিন্তাধারার বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় তা শোধরাতে হবে এবং বিভিন্ন ঘটনা, চ্যালেঞ্জ, সম্বন্ধ এবং সমাজ জীবনের অন্য করণীয় সব কিছুকে উপযোগী করে পদ্ধতি বিজ্ঞান সুষ্ঠু ও সঠিক হলে তার চিন্তাধারাই সংস্কার প্রচেষ্টা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় শক্তি যোগাতে পারবে।
এ কারণে মুসলিম মন-মানস ও চিন্তাধারাকে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য এবং তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা আরো ভালোভাবে চিহ্নিত করার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই তাদের মন-মানস ও চিন্তাধারার পদ্ধতিবিজ্ঞানের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তারপরই আমরা মুসলিম মনের সংস্কার কি উপায়ে করা যায় সে সম্পর্কে কিছু পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবো।
আল-উসূলঃ সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা
উসূল আল ফিকহ বিজ্ঞান (আইনগত উৎস সম্পর্কিত পদ্ধতি বিজ্ঞান) হচ্ছে ইসলামী চিন্তাধারার ঐতিহাসিক পদ্ধতিবিজ্ঞান। এ বিজ্ঞান পুরনো ইসলামী শিক্ষায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তন্মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে অন্ধভাবে না হলেও নিষ্ক্রিয়তার বাধাকে গ্রহণ করা।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ পদ্ধতিবিজ্ঞানের ব্যাপক নীতি ও বিশ্বজনীন বিধানের মধ্য দিয়ে ইসলামী চিন্তাধারা, প্রকৃতি এবং ইসলামিক মিশনের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে। ইসলামের মৌলনীতি ও তার সৃজনশীল প্রয়োগের প্রকৃত দৃষ্টান্ত খোলাফায়ে রাশেদার আমলেই দেখা গিয়েছিল। এক সময় ওহীকে পধ নির্দেশ ও পরিচালনার উৎস হিসেবে নেয়া হয়েছিল এবং যুক্তি ও ইজতিহাদের মাধ্যমে ওহীকে উপলব্ধি করা ও তার ব্যাখ্যা দেয়ার পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। এছাড়া যক্তি ও ইজতিহাদকে বিভিন্ন ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে করণীয় ও নীতি প্রণয়নের জন্য কাজে লাগানো হতো। পরবর্তী সময়ে ইজতিহাদের যুগে উম্মাহর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের মধ্যে যখন বিভেদ সৃষ্টি হয়, মুসলিম চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতগণ তখনো ইসলামের বাণীর মর্ম এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের পদ্ধতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখে চলছিলেন। ফলে তাঁরা প্রাথমিক যুগের পদ্ধতির বিজ্ঞানের ভিত্তিতে লেখনী ধারণ ও চিন্তা করেন। তারেদ মধ্যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়ার পর একাডেমিক বিষয়াবলী ছাড়া বাকি সব কিছু তারা পরিত্যাগ করতে শুরু করলেন। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করতেন ও লিখতেন। কুরআন ও সুন্নাহর মূল বক্তব্যের ভিতর থেকে এককভাবে তারা ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখতেন। যেমন, ইবাদত মেয়ামেলাত (লেনদেন)। কিন্তু তারা রাজনীতি, সরকার, সামাজিক প্রতিষ্ঠিান এবং বিভিন্ন গ্রুপ ও সমাজের সাথে সম্পর্কিত প্রশ্ন বা বিষয়গুলো উপেক্ষা করলেন। এর ফলে তারা পদ্ধতি বিজ্ঞানের যে সূত্র ব্যবহার করতেন তা যে পরিস্থিতিতে সৃষ্টি করা হয়েছিল তার সাথে সংগতি রেখে এবং যার উপর মুসলিম জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না তার দ্বারা তারা প্রভাবত হয়ে ব্যবহৃত হতে লাগলেন। তারপরও তাদের পদ্ধতি বিজ্ঞানের সাধারণ নীতি বিকাশের এবং তার মাধ্যমে বাস্তব অবদান রাখার পথ খোলা রইল। কিন্তু তকলিদের বিপরীতে নতুন কিচু উদ্ভাবন বা সৃজন এবং চেতনা নির্ভর এ অব্যাহত বিকাশকে মেনে চলা পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব হিসাবে দেখা দিল। একমাত্র প্রগতির চেতনায় উদ্ভাসিত হলেই পদ্ধতিবিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহার, এর থেকে কল্যাণ লাভ করা যাবে এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একে আরো উন্নত করা সম্ভব এমন চেতনাই পদ্ধতি বিজ্ঞানকে ইতবাচক ও কার্যকরভাবে বিকাশের পথে নিয়ে যাবে এবং এভাবেই পদ্ধতিবিজ্ঞান ব্যক্তিজীবনের চৌহদ্দীর বাইরে অবদান রাখতে পারবে। এ চেতনা বা মনোভঙ্গি ইসলামী চিন্তাধারার সর্বাত্মক ও মৌলিক প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং তার ইজতিহাদ ও ইজতিহাদের বিভিন্ন উৎস ও শিক্ষার পরিরপূরকতাকে রক্ষা করতে পারবে।
আমরা বর্তানে যতটুকু জানি তারই সূত্র ধরে ইসলামী চিন্তাধারা প্রচলিত পদ্ধতি বিজ্ঞানের সার্বজনীন নীতিগুলো উপর স্বল্প পরিসরে একটি সমীক্ষা চালানো আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। তারপরই আসবে সে সমীক্ষার মৌলিক ও অপরিহার্য কয়েকটি দিক এবং সেই পদ্ধতি বিজ্ঞানের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর উপর আলোচনা। আমরা জানি বর্তমানে উসূল আল ফিকহ হচ্ছে ইসলামী চিন্তাধারা পদ্ধতি বিজ্ঞান। অপর দিকে তার সাধারণ নীতি বা স্বতঃসিদ্ধনীতিগুলো মুসলিম মন-মানসের যৌক্তিক বুনিয়াদ, মৌলনীতি ও কর্মবিধানসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে। শিক্ষার একটি বিষয় হিসাবে উসূল আল ফিকহ খোলাফায়ে রাশেদার পরে সাহাবাদের পরবর্তী তাবেঈন তাবে তাবেঈনরা উদ্ভাবন করেছিলেন। এভাবে দেখা যায় ইমাম শাফেয়ীর আল-রিসালাকে সাধারণভাবে ইসলামী চিন্তাধারা পদ্ধতিবিজ্ঞানের প্রাচীনতম গ্রন্থ এবং বিশেষভাবে উসূল আল ফিকহকে বিজ্ঞানের প্রাচীনতম সংকলন হিসেবে মনে করা হয়।
যেসব মৌলনীতির উপর এ বিজ্ঞান ও পদ্ধতি দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোকে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায় এ দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক বুনিয়াদগুলো কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা (জ্ঞানীজনদে ঐক্যমত এবং কিয়াস সাদৃশ্য) এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়বলী নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের বুনিয়াদ বলতে বোঝা যায় ঐসব সে সম্পর্কে পণ্ডিতদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে (আল আদিল্লাহ আল মুখতালিফ ফিহা)। দ্বিতীয় পর্যায়ের এসব উৎসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইসতিহসান (অধিকতর যুক্তিসংগত সাদৃশ্য বিধান), আল মাসালিহ আল মুসছালা (জাতির ব্যাপক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট), সাদ আল জারাই (অবৈধ লক্ষ্য হাসিলে প্রকাশ্যে বৈধ উপায়ে প্রতিবন্ধকতা) উরফ্ (প্রথা এবং আইনগত ব্যবহার, সাহাবাদের কথা এবং মদীনাবাসীদের বাস্তব আচরণ)।
এ বিভাজনের ভিত্তিতে ইসলামের প্রথম যুগ থেকে ইসলামী জবিজ্ঞান ও শিক্ষাকে বিজ্ঞানের পার্থক্য সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্য হলো কুরআন ও সুন্নাহর আইনগত ব্যাখ্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর ভিত্তিতে বলা যায় কুরআন, সুন্নাহ, ফিকহ, ধর্মতত্ত্ব এবং প্রাচীন আরবি ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে শরিয়া শরিয়া বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে। প্রাচীন আরবি ভাষাকে শরিয়া বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্তকিরার পেছনে কারণ ছিল কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যয়নে আরবি ভাষার একটি অপরিহার্য উপাদান।
ইসলামী চিন্তাধারা পদ্ধতি বিজ্ঞানের বুনিয়াদের এ বিভক্তি থেকে আমরা শরিয়াহ বিজ্ঞানের সর্বশেষ ধাপে ধর্মতত্ত্ব বিজ্ঞানের (ইল আল কালাম) অবস্থান সম্পর্কে বুঝতে পারি। ইসলামী আকিদা বিশ্বাস ও মতবাদ ধর্মত্ত্ব বিজ্ঞানের মূল বিষয় হলেও ধর্মশাস্ত্রের তুলনামূলক বিষয়ে ইলম আল কালামের প্রবেশ এবং অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা ও গ্রীক দর্শনের এতে অনুপ্রবেশের ফলে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ও মতবাদের আলোচনা ও অধ্যয়নের গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং এসব বিষয়ের আলোচক ও গবেষকদেরকে প্রচণ্ড বাক বিতন্ডা ও বিভক্তির মাঝে ঠেলে দেয়। এভাবে উম্মাহর চিন্তাধারায় ধর্মতত্ত্ব দুর্বলতার একটি উৎস রইল। এর ফলে উম্মাহ ধর্মত্ত্বকে তার সামজিক ও সভ্যতার সহায়ক সংগঠনসমূহ ও উন্নয়নের কাজেও লাগাতে পারেনি। ফলে ব্যক্তির স্বার্থকেন্দ্রিক আইন বিজ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষামূলক ও সার্বজনীন লক্ষ্যভিসারী ধর্মতত্ত্ব বিজ্ঞানের আরো একটি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হলো। আইনস বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্ব বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি বলেই ব্যাপকভাবে কোনো ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠেনি। পরিণামে এ দুটি বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বিকাশ হলো অপূর্ণাঙ্গ ও অসম্পূর্ণ। তার ফলে পরবর্তীতে উম্মাহ যেসব পরিবর্ন ও চ্যালেঞ্জেরন সম্মুখীন হয় সে সম্পর্কে তারা অবহিত থাকতে পারেনি।
আলোচনার এ পর্যায়ের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী চিন্তাধারা কাঠামোতে যেসব মূল বিষয় রয়েছে তাদের প্রত্যেকটির উপর আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে এ ত্রুটি-বিচ্যুতির পেছনে যেসব কারণ রয়েছে সেগুলো সর্বোত্তম উপায়ে কীভাবে সমাধান করবো তাও আমরা বুঝতে পারবো।
ইসলামের প্রাথমিক উৎস হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ। প্রাচীন পদ্ধতিবিজ্ঞান অনুযায়ী এ দু’টি অধ্যয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে ইতিহাস, মতবাদ ও ভাষাগত জ্ঞান থাকা। পুরনো সকল ইসলামী শিক্ষা ও বিষয় হেচ্ছে সম্পূর্ণভাবে আত্মিনির্ভর। অপরদিকে এ দু’টি উৎসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী (অর্থাৎ ব্যাখ্যা বা ভাষা এবং বাস্তব অবস্থা পরিস্থিতির সাথে তার প্রাসঙ্গিকতা) দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্ব পেল। এসব উপাদানের ব্যবহার হঠাৎ কোনো ঘটনা, পণ্ডিত ব্যক্তিদের যোগ্যতা এবং ব্যক্তিগত জীবনযাপন পদ্ধতির উপর নির্ভর করতো। এ উপলব্ধি থেকেই বিভিন্ন ইসলামী বিষয়, বিজ্ঞান ও শিক্ষার উপর নির্ভর করতো। এ উপলব্ধি থেকেই বিভিন্ন ইসলামী বিষয়, বিজ্ঞান ও শিক্ষার উপর শব্দার্থ ভিত্তিক পদ্ধতিবিজ্ঞানের একচ্ছত্র প্রবাব ও ইজতিহাদের অন্তর্ধানের কারণ অনুধাবন করা যায়। অধিকিন্তু, ইজতিহাদ নামক ইনস্টিটিউশটির দীর্ঘদিনের স্থবিরতা সত্ত্বেও মষ্টিমেয় কিছু প্রতিভাবান মনীষী শতাব্দীব্যাপী যে ইজতিহাদ করেছেন, তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভা আরো পূর্ণাঙ্গভাবে মূল্যায়ন কারা যায়। তাদের উজ্জ্বল প্রতিভার পটভূমি হিসেবে আমরা নিশ্চিতভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের অংশ গ্রহণকে চিহ্নিত করতে পারে। সমাজ ও রাজনীতিতে প্রবেশের ফলেই তারা সমসাময়িক বিজ্ঞানে বুৎপত্তি অর্জন, গোটা উম্মাহর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং বিভিন্ন সমস্যা সম্পূর্ণভাবে তাত্ত্বিক বা আভিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে না দেখে বাস্তবভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে লক্ষ্য করা যায়, কুরআন ও সুন্নাহকে প্রাচীন পদ্ধতিতে অধ্যয়নের ফলে প্রায়ই এ দু’টি র মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয় এবং পরস্পরের বাস্তব অবস্থান এবং যেসব পদ্ধতিতে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের বিষয় হয়। এগুলো থেকে গবেষণার কোনো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের বিষয় হয়। এগুলো থেকে গবেষণার কোনো প্রকার বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ভূমিকা নির্ণয় অথবা কুরআন ও সুন্নাহর মধ্য থেকে কোনো একটির বিশেষ অবদান চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই সমসাময়িক ইসলামী বিষয়ে গবেষণা প্রচলিত ঐতিহাসিক তকলিদ এবং বাতিলকরণ সংক্রান্ত তত্ত্বের (নসখ) নিচে চাপা পড়ে গেছে। পরিণতিতে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মাঝে পরিব্যাপ্ত প্রজ্ঞা, প্রাসঙ্গিক এবং জীবন জিজ্ঞাসার জবাব দিতে সক্ষম এমন ফিকহ হারিয়ে গেছে। উপরুন্তু মননশীলতার ক্ষেত্রে বর্তমান স্থবিরতার ফলে সময় ও স্থানের মৌলিক বিষয়ে ওহীর সাধারণ ও স্বীকৃত অর্থের প্রেক্ষাপটে সুনির্দিষ্ট ও প্রাসঙ্গিক মূল বিষয়ের মর্যাদা এবং মানবজাতি ও বিশ্বজগতের প্রকুতি সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
এ ধরনের পরিস্থিতি সুন্নাহর বিপরীত বা খলিফা ও তাদের সমসাময়িক মহান ব্যক্তিগণের মতামতের বিপরীত। এ ভাবেই সুন্নাহর অধ্যয়ন হাদিসের সনদ ও রাবী সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতর জটিল প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়। আমরা এসব অধ্যয়নের গুরুত্বকে অস্বীকার করার জন্য নয় বরং এসব বিষয়গুলোকে গুরুত্ব অনুযায়ী কয়েক শতাব্দী পূর্বে নিষ্পন্ন শ্রেণী বিন্যাস ও সংকলিত বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছি। এ ধারণাকে সুস্পষ্ট করার জন্যই ঐ বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, একই ধরনের হাদিস গুরুত্ব ও মানের দিক থেকে বুদ্ধিজীবীদের সাথে সমানভাবে বিবেচিত হয়নি। অনুরূপভাবে ইজমার মৌলিক ধারণা সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রচলিত উসূলের সংজ্ঞানুযায়ী এর লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে স্বীকৃত নয় এবং সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত, যাতে ভিন্ন মতের কোনো অবকাশ নেই। যারা ইজমার চর্চা করেছেন, তারা উপলব্ধি করেছেন যে, কুরআন ও সুন্নাহ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত ঐসব মৌলিক বিষয়াবলীর জন্য না হলে ইজমাকে আকায়েদ বা বিচার ব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ কোনো বিষয়ে ব্যবহার করা বাস্তবেই অসম্ভব। অবশ্য, যে সব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বিষয়গুলো পাওয়া যায় সেখানে ইজমার কোনো প্রয়োজন নেই।
অধিকন্তু উসূলে ফিকহ শাস্ত্রের পণ্ডিত যে ধরনের প্রচলিত ইজমার সংজ্ঞা দিয়েছেন তা কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে গবেষণা ও অধয়নকালে বিশেষ তত্ত্ববিদদের নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রুপ ছাড়া আর কেউ উল্লেখ করেননি। এভাবে একান্তই ইজমা সৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দিলেও তবু তা হবে অবশ্যিই একটি তাত্ত্বিক ব্যাপার, সমসাময়িককালের মুসলিম জীবনের চাহিদা ও প্রয়োজনের উপর তা কোনো বিস্তার করবে না। এটি আমাদের চিন্তাচেতনার বাইরে এবং আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। এ পরিস্থিতির তাত্ত্বিক ও কিতাবি মাত্রা চাড়াও বাস্তব সামাজিকি ও রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। কারণ এ পরিস্থিতি ইজমাকে উম্মাহর বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যকার ফাটলকে টিকিয়ে রাখার ও উৎসাহিত করার একটি বিষয়ে পরিণত করে। ফলে পুরো সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বাস্তব বিবেচনায় নেতৃত্বের দু’টি গ্রুপের সম্প্রীতি ও বৈধতার উপর ভিত্তি করে উম্মাহ বা মুসলিম সমাজের প্রকৃত ভুল বুঝাবুঝির ঘটায়। সুতরাং উসূলবিদদের ধারণা অনুসারে ইজমা যথার্থই একটি তাত্ত্বিক বিষয়, এটি কোনো বস্তুর বা নির্ভরযোগ্য সূত্রের প্রতিনিধিত্ব করে না এবং ইসলামের সামাজিক বা রাজনৈতিক গতিবিজ্ঞানের কোনো বাস্তব অভিব্যক্তিও নয়। এ কারণেই সমাময়িক মুসলিম সমাজের রাজনীতি, সরকার বা আইন প্রণয়নে ইজমা কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না।
আরেক ধরনের ইজমা প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের সচেষ্ট হওয়া উচিত। এর ভিত্তি হবে ইজতিহাদ ও শূরা- যা যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা গ্রুপ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা নির্বিষে ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ সমাজনেতারেদ ধ্যনধারণা থেকে প্রতিষ্ঠিত হবে।
কাঙ্ক্ষিত ইজমা সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের ধারণা থেকেও লাভ করা যায়। এ ইজমা (ঐকমত্য) সংখ্যাগরিষ্ঠের (majority) শাসনের ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিনিধিত্ব করবে সত্যিকার দায়িত্বশীল নেতৃত্বের (leadership)। এভাবে ব্যক্তিগত মতামত ভিত্তিক তাত্ত্বিক গবেষণা (বিশেষত লেনদেন, সংগঠন, সরকারি নীতি সংক্রান্ত বিষয়াবলী নিয়ে), বাস্তব, মতবাদগত ও নৈতিক দিক থেকে মুসলিম জীবনের উপর প্রভাব বিস্তারকারী। রাজনৈতিক ও আইনগত দিক থেকে অবশ্য পালনীয় । আইনের মধ্যে সহজে পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। চতুর্থ প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে কিয়াস। যেসব বিষয়ে কুরআন অথবা সুন্নাহ থেকে কোনো নির্দেশ বা হুকুম খুঁজে পাওয়া যায় না সেসব বিষয়ে যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করাই কিয়াস।
এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোচ্য ঘটনা এবং বিশ্বনবী (সা)-এর জীবদ্দশায় সংঘটিত অনুরূপ ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য সৃষ্টি করা বা খুঁজে বের করা, তখন এর পেছনে এ বিশ্বাস সক্রিয় থাকে যে, দু’টি ঘটনার মধ্যে দৃষ্ট সাদৃশ্যের কারণে উভয় ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণ সামাজিক পরিস্থিতি সমান্তরাল অবস্থানে থাকতে হবে। কোনো কিছু ভিন্ন ধারনের হলে এ বিষয় নির্ধারণ করতে হবে যে, এ পার্থক্য বা পার্থক্যগুলো অতি ক্ষুদ্র কি না, মৌলিক নীতির সাথে না হয়ে খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে সীমিত কী না এবং মনোযোগ নিবদ্ধ করার উপযোগী কী না। পার্থক্যগুলো পরস্পর বিপরীত না হলে ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টি করা যেতে পারে এবং একই হুকুম বা সমাধান প্রয়োগ করা যেতে পারে।
উমর (রা)-এর খেলাফত আমল ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণকাল থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। কাজেই উপরোল্লিখিত সীমিত আকারের কিয়াস সমসাময়িক সমস্যা ও পরিবর্তনগুলো মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে মোটেই বাস্তব বা উপযোগী নয়। এ বিষয়টি কিছু পুরনো প্রাজ্ঞ পান্ডিত এগিয়ে নিয়ে যান। এ পদ্ধতিগত সূত্রটি সর্ব প্রথম ইরাক, পারস্য ও মধ্য এশিয়ার ফিকাহ্বিদদের মধ্যে প্রসার লাভ করে। অধিকন্তু ঐ সমস্ত এলাকায় প্রথমে ইসতিহ্সানের চর্চা শুরু হওয়ার পেছনে কারণ ছিল খিলাফতে রাশেদার আমলে সমাজে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনার উদ্ভব, পারস্যে ইসলামী চিন্তা এবং আব্বাসীয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। এ সময়টি ছিল জনসংখ্যা বিষয়ক এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপক পরিবর্তনের যুগ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে বা আর উপদ্বীপে এমন ব্যাপক পরিবর্তন ইতোপূর্বে আর দেখা যায়নি। আরব উপদ্বীপে প্রথম খলিফার পর বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক ভূমিকার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। উসূলে ফিকহ শাস্ত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎস তালিকার শীর্ষে ইসতিহ্সানর অবস্থান। এ উদ্ভব সুস্পষ্টভাবে সমাজের পরিবর্তনশীল আইনগত ও সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজনকে দেখিয়ে দেয়। বিশেষ করে যেসব দেশ প্রাক ইসলামী সভ্যতায় সমৃদ্ধ ছিল সেসব দেশের অধিকতর উন্নত নাগরিক আবহে ইসতিহ্সানের বিকাশ ঘটে। কিয়াসের প্রচলিত ধারণা এবং সর্বক্ষেত্রে না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরকম দু’টি ঘটনাকে পরস্পর তুলনা করার পদ্ধতিটি ছিল একান্তই সরলীকরণ পদ্ধতি। এ ধরনের পদ্ধতি ছিল বাস্তব বিভ্রান্তির। কারণ এ পদ্ধতটি বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদেরকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা থেকে বিরত রাখে এবং এর পরিবর্তে তাদেরকে উক্ত পরিস্থিতির সামগ্রিক চিত্র বা সভ্যতার বিপরীত পরিস্থিতির ভিত্তিতে তাদের আইনগত রুলিং ও রায় প্রদানের দিকে পরিচালিত করে। সুতরাং ইসতিহ্সানের প্রয়োজন ও চাহিদা ছিল সুস্পষ্ট। কারণ কোনো আইনবিদ ইসতিহ্সান ছাড়া কিয়াসের মাধ্যমে সীমিত দৃষ্টিবঙ্গিকে অতিক্রম করে সামনে এগুতে পারে না এবং শরিয়াহ উচ্চতর লক্ষ্য ও অগ্রিধাকারসমূহ বিবেচনায় সক্ষম ব্যাপক দৃষ্টিবঙ্গি গ্রহণে তার অক্ষমতাকে কাটিয়ে উঠে অগ্রসর হতে পারে না। একমাত্র এ পথেই একজন আইনবিদ তার সামনে উপস্থিত সমস্যাবলীর সীমিত বিবরণের বাইরে যেতে পারেন এবং শরিয়াহর চেতনা ও তার লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে তার সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ইসলামের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক পরিবর্তনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, পুরনো পণ্ডিতদের অনেকেই যারা আইনের আক্ষরিক দিক কঠোভাবে মেনে চলেন, তাদের পক্ষ থেকে সামাজিক ফলাফলকে মেনে নেয়া হয়। শরিয়াহর নীতি অগ্রাধিকারসমূহ বিবেচনার জন্য আক্ষরিকতাবাদী পদ্ধতিবিজ্ঞান ও তার সংকুচিত দিগন্তের সীমানা বাড়ানো ছাড়া তাদের জন্য আর কোনো ঠিকানা ছিল না। এ নতুন পরিস্থিতির অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা হলেও এবং এ বক্তব্য বিদ্যমান থাকা অবস্থায় এবং সুন্নাহর সব কিছু আক্ষরিকভাবে গ্রহণের জন্য বুদ্ধিজীবীদের স্বাভাবিক ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও তারা মূল্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে বিশেষজ্ঞ মত প্রদান করলেন। কারণ এটি তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল যে, তারা এ ধরনের রায় না দলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জুলুম শুরু হবে। তারা ভারসাম্য পুনঃ প্রতিষ্ঠায় অক্ষম ছিলেন, সেহেতু মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ বিশেষ করে জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না।
সমাজ বিজ্ঞানের অবহেলা
সাধারণ বিধিবিধানের মাধ্যমে অনুসৃত সনাতনি উসূল ও পদ্ধতিবিজ্ঞান এবং এগুলোর উৎস বিকাশ-এর ন্যায় বিষয়গুলো ইসলামী যক্তিবাদ ও জীবনের বাস্তবতার নিরিখে দ্বিতীয় পর্যায়ের উসূলৈর মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। এগুলোতে ইজতিহাদের ভিত্তি ও বাস্তব প্রয়োগের বিষয়টি দেখা গেলেও এগুলোতে দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর এভাবেই সুস্পষ্টভাবে ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞানে যে ত্রুটিবিচ্যুটি ঢুকে পড়েছিল এতে তাই প্রমাণিত হয়। এসবই ছিল সামাজিক, সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার মাইল ফলক। এর পরিণামে দেখা দেয় উম্মাহর পতন।
জনজীবন থেকে বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের (বাধ্য হয়ে বা ভিন্ন কারণে) বিদায়ের স্পষ্ট ফল ছিল যে, তাদের নীতি এবং পদ্ধতিগত বিষয়গুলোকে সুস্পষ্টভাবে ইসলামী ফিকহ শাস্ত্র এবং মুসলিম সমাজকে (বর্তমান কালের সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ের আলোকে) গড়ে তোলার কাজে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয়নি। ভয়াবহ ফিতনা শুরু হয় উসমান বিন আফফান (রা)-এ শাহাদাতের পর থেকে যার ফলে উমাইয়া বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। রাজনৈতিক গোলযোগের ফলে উম্মাহর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব পৃথক পথে অগ্রসর হয়। আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার সব আসন থেকে ছিটকে পড়ার কারণে ইসলামী চিন্তাধারা সমাজকল্যাণের সংগঠনের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান ও শিক্ষার উন্নয়ন এবং বিকাশে তারা উসূলকে কাজে লাগানো থেকে বিরত থাকে। তারা বরং ব্যক্তি মুসলিমের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক চাহিদার উপর আলোকপাত করা ও তাকে গুরুত্ব দেয়ার পথ বেছে নেয়।
ইসলামী চিন্তাধারা এবং তার পদ্ধতিবিজ্ঞানের সৃষ্টি, উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য দায়িী ঘটনাবলী বিবেচনার পর আমরা এখন ইসলামী যুক্তিবাদের ব্যর্থতার পেছনের কারণসমূহ এবং উম্মাহর ইতিহাস, ক্ষতিকারক ইজতিহাদ এবং মননশীল উদ্যোগের দ্বার এত তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেল কেন তা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি। এসব ক্ষেত্রে কিচু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর অনন্য সাধারণ অবদান ছিল ঠিকেই, তবে সেগুলোকে বড়জোর কিছু ব্যক্তি, মানুষের প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে এবং এসব প্রচেষ্টা ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম হয়নি। এ কারণে আমরা ফিকহ শাস্ত্রে সমাজের প্রকৃতি ও কর্মকান্ড নিয়ে গভীর চিন্তাধারা উদাহরণ দেখতে পাই। এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারাকে কোনোভাবেই ইসলামী সমাজবিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অথবা এসব চিন্তাধারা ইসলামী চিন্তাধারার অভ্যন্তরে একটি নতুন ধারায় পরিণত হবে বা উম্মাহ এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সমস্যা সমাধানে দিক নির্দেশনা দেবে তারও প্রত্যাশা করা যায় না।
ইসলামী চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদের অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা সমাজের সাধারণ সংগঠন এবং ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, সরকার, খেলাফত ও রাজনীতি বিষয়ে গভীর মননশীল অধ্যয়নের যে অভাব রয়েছে তার কারণ সহজেই অনুধাবন করতে পারি। এভাবেই উম্মাহর গঠনের মূল উপাদান এবং তার অস্তিত্বের সার-নির্যাস কি তা হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করা হয় অথবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখা কিছু পুস্তিকার আলোচনা প্রসঙ্গে এসবে উল্লেখ করা হয়। উম্মাহর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ভুত বুদ্ধিবৃত্তিক রূপরেখা ইসলামী চিন্তাধারা বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি বিজ্ঞানের উপর এবং ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও তাদের সীমা-পরিসীমার উপর প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে এসব গবেষণা (studies) হয় বর্ণনামূলক এবং পুরনো। আক্ষরিকতার মধ্যে এগুলো নৈরাশ্যকরভাবে আটকে যায়। এর মাধ্যমেই আমাদের ক্লাসিক্যাল পণ্ডিতগণ (Classical scholars) ভাষা, সাহিত্য এবং যা কিছু কুরআন-সুন্নাহকে বুঝতে সাহায্য করে তার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে এ ব্যবধান উম্মাহর মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি করে। এক দিকে ছিল ব্যক্তি, অপর দিকে ছিল পুরো সমাজ। প্রচীনপন্থি ইসলামী বিজ্ঞজন ব্যক্তির উপরেই তাদের সব মনোযোগ নিবদ্ধ করলেন, বিশেষ করে ইবাদত-বন্দেগী, আচার-অনুষ্ঠান, ব্যক্তিজীবন, সংশ্লিষ্ট আইন এবং কাজ-কারবার, লেনদেন ইত্যাদি তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এভাবে দেখা গেল ব্যক্তি মুসলমানের জীবনের অধিকাংশ বিষয় আইনজ্ঞদের মতামত ও তাদের আইনগত ঘোষণা বা ফতওয়ার সাহায্যে পরিচালিত হতো। সামগ্রিকভাবে সমাজের বিভিন্ন বিষয় রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড, রাজপরিবার এবং সামন্ত বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর এখতিয়ারভুক্ত বিষয়ে পরিণত হয়। এসব নেতা ও কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষ এবং মনীষীদের চোখে অবিশ্বস্ত ও সন্দেহভাজন বলে পরিগণিত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতার এ পরিবেশ বর্তমান থাকার কারণে প্রাচীনপন্থি পণ্ডিতবর্ক রাজনীতি এবং সাধারণভাবে সমাজ সম্পর্কে খুবই অকিঞ্চিতকর ও অসম্পূর্ণ ধারণা লাভ করেন। তারপর বিজ্ঞজনদের দিক নির্দেশনা ও জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে উম্মাহর নীতি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের বাস্তব সহায়তারয় প্রকৃত ইসলামী প্রতিষ্ঠান কখনো গড়ে ওঠেনি। এর স্থলে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে সেগুলো দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের কবলে পড়ে। ফলে সমগ্র উম্মাহর অস্তিত্ব, উম্মাহর সন্তুষ্টি, রাষ্ট্র বা সমাজ কখনো মুসলিম জাতির অন্তরাত্মায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।
এ ব্যবধানে আরো একটি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তা হলো ইসলামের শিক্ষা ও নীতির প্রতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষীণ অঙ্গীকার এবং কোনো আনুষ্ঠানিক অথবা সমন্বিত শিক্ষার অথা সাংস্কৃতিক কর্মসূচির অভাব। উম্মাহ এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। একই সাথে দুর্বলতা দেখা দেয় নেতৃত্বের ভূমিকায় ও তার আইনে। শেষ পর্যন্ত উম্মাহ বিভক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন ফেরকা, গোত্র, ভূমিদাস এবং পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নানা গ্রুপে। ধর্ম বা বিবেক তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
এসব কারণে ইসলামী চিন্তাধারা ও শিক্ষার মূল বিষয় রূপান্তরিত হলো ভয়, বাধ্যবাধকতা ও আত্মসমর্পণে। নানাভাবে এটি অনুশীলন ও প্রচার করা হতো এবং উৎসাহিত করা হতো উম্মাহর সকল স্তরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের ইচছায় বা অনিচ্ছায়।
ওহী ও যুক্তির দ্বন্দ্ব
বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের মধ্যে ছিল যুক্তি ও ওহীর মধ্যে একটি কাল্পনিক সংগ্রামের অস্তিত্ব। এ লড়াইয়ের ফলে সৃষ্টি হলো ফিকহ্ এবং ইলমুল কালামের মধ্যে এক অস্বাভাবিক ভাঙন বা ফাটল। এ ভাঙন বাহ্যিক চেহারা বা কোনো সুনির্দিষ্ট বিশেষ তত্ত্বের মধ্যে সীমিত ছিল না, কারণ এটি ছিল একটি মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক ভাঙন। একদিকে ধর্মের ধারণা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং অপরদিকে সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সম্পর্কের উপর এটা গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এর একটি ফল হলো, এ ধর্মতত্ত্ব বিদ্যা দার্শনিক যুক্তি এবং যুক্তিবাদী বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে (অধিকাংশ সময়ের অদৃশ্ব জগরের সাথে সম্পর্কিত অধিবিদ্যামূলক বিষয়াদি নিয়ে)। ইসলামী মননশীলতার বিষয়গুলোর সাথে এগুলোর কোনো বিষয় মননকে নিঃশেষ করে দেয় এবং সত্যিকার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিকে ঝাপসা করে দেয়। এভাবেই মুসলিম মনন বা বোধশক্তিকে দৃশ্য ও অদৃশ্য বিষয় আলোচনায় নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। (অর্থাৎ ওহী, যুক্তি, ঈমান, তকদীর ও স্বাধীণ ইচ্ছা, আল্লাহর নাম ও গুণাবলী এবং উম্মাহর চিন্তাধারা বা তার ঈমানের ক্ষেত্রে কোনোরূপ অবদান রাখতে পারেনি- এমনি ধরনের নিরর্থক বুদ্ধিবৃত্তিক কূটতর্ক)। ফলে ফিকহ শাস্ত্র এবং সাধারণভাবে ইসলামী চিন্তাধারা উম্মাহর জন্য সমাজিকভাবে ও সাংগঠনিক দিক থেকে অগ্রগতি সাধন বা উন্নয়নের সহায়তা লক্ষ্য নীতি নির্ধারণের জন্য সুস্পষ্টভাবে কোনো ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি উপস্থাপন করতে পারেনি। এভাবে ইসলামী মন ও চিন্তাধারা একটি সুনির্দিষ্ট ও সীমিত পদ্ধতি বিজ্ঞানের কাছে বন্দী হয়ে যায় যার ফলে উন্নয়ন ও বিকাশের পথে এগুতে পারেনি এবং পরিবর্তনশীল বাস্তবতা, চাহিদা ও সম্ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি।
বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যকার এ ব্যবধান ইসলামী চিন্তাধারা আরেকটি পুরনো বিষয়, যার এখনো কোনো সমাধান করা যায়নি, তা হলো কুরআন ও সুন্নাহর মূল পাঠ বাতিল বা মনসুখ করা। এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে মনে করা হয় যে, ওহীর মাধ্যমে সর্বশেষ যে আয়াতসমূহ পাওয়া গেছে তার মধ্যেই সঠিক আইনগত সিদ্ধান্ত বা শিক্ষা নিহিত রয়েছে এবং এর আগে নাজিলকৃত আয়াতসমূহ থেকে যে অর্থ বা সিদ্ধান্ত ইতোপূর্বে গ্রহণ করা হতো তা বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু পূর্বেকার সিদ্ধান্ত বাতিল করার সময়ে কোন্ পরিস্থিতির আলোকে সে সময় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বা সে সময় এ ধরনের আইনের পেছনে কোন্ প্রজ্ঞা কার করেছিল, তা বিবেচনা করা হয়নি। এভাবে ইসলামী আইনে মনসুখের ধারণার সাথে নাসখ প্রায় সার্থবোধক হয়ে গেল, অথচ ইসলামী আইন ও মানুষ তৈরি আইনে পরিবেশ পরিস্থিতির পার্থক্য অনুসারে সাবে আইনের উপর বর্তমান আইন অধিক গুরুত্ব লাভ করে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে এ মতবাদ থেকে এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ইসলামী আইন প্রণয়নের সকল ক্ষেত্রে ও সামজিক সংগঠনে প্রিয়নবী (সা)-এর জীবনকালের শেষভাগে মদীনা ও মক্কা বিজয়ের পরবর্তী সময়ের উদাহরণগুলো অনুসরণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী তা ঢেলে সাজাতে হবে। এটিকে আমরা প্রথম মাদানী যুগ থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে দ্বিতীয় মাদানী যুগ বলতে পারি। প্রথম মাদানী যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল ভয়, দুর্বলতা ও অদক্ষতা। কারণ এটি ছিল একটি বৈরী পরিবেশে সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণের যুগ। আমার মতে বিশ্বনবী (সা)-এ সময়কালকে সুষ্ঠুভাবে তিনটি ভাগে দেখা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ঃ এ সময় ইসলামের প্রচার ও প্রসারে জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ের তাবলীগের পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। এ সময়কালে ঈমানের মৌলনীতিত এবং সমাজ পরিবর্তনের নীতিসমূহ সাধারণভাবে সমাজের কাছে তুলে ধরা হতো, তারপর প্রথম মাদানী যুগ এবং সর্বশেষ দ্বিতীয় মাদানী যুগ।
ক্রমাগত ওহী নাযিল এবং নবীল (সা) কাজের ধারাবাহিকতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন অবস্থা ও পরিস্থিতি মোকাবিলার যেসব নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হতো তা ভিন্ন ভিন্ন হলেও তাতে কোদায়ী একক উৎস থেকে উৎসারিত এবং একই মূলনীতি মেনে চলা হতো। মক্কী জিন্দেগী বা মক্কার সময়কাল ছিল প্রচারের যুগ এবং নতুন ও উন্নত আদর্শের ভিত্তিতে সংস্কারের যুগ। এ কারণে এ যুগের সংশ্লিষ্টতা ছিল দাওয়া, মৌলনীতি সম্পর্কিত সংলাপ ও সার্বজনীনতার সাথে। এ কারণেও রাসূল (সা) মোকাবিলার পদ্ধতি অবলম্বন না করতে অথবা শত্রুতার জবাব শত্রুতিা দিয়ে না দিতে অনুসারীদের গুরুত্ব সহকারে বলতেন। এ দুঃখ ও যাতনা ভোগ করে তাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হলেও প্রাথমিক যুগের মুসলিমরা তাদের মূল কা সমাজ সংস্কার থেকে কখনো মুখ ফিরিয়ে থকেননি। অধিকন্তু সাধারণভাবে বলতে গেলে এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ইস্যু। যে বিষয় রাজনীতিবিদদের প্রভাবিত করতে পারে তা হচ্ছে রাজনীতি। অধিকন্তু সহিংসতার জবাবে সহিংসতার আশ্রয় নিলে সারা বিশ্বের সামনে আগ্রাসী শক্তির মুখোশ খুলে যায় এবং বিবাদ-বিসম্বাদ ও মতবিরোধের বিষয়টি ছোট হোক বা বড় হোক, সবার মনোযোগ ও সাহানুভূতিআকর্ষণ করে।
প্রথম মাদানী যুগ হোদায়বিয়া সন্ধির আগের যুগ। এ সময় আরবের বিভিন্ন গোত্র ইহুদী জোটের ষড়যন্ত্রের মুখে তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আমরা দেখি এ সময়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শৃঙ্খলা ও ত্যাগ এবং শত্রুদের ভীত করে তোলা এবং মুসলমানের বিরুদ্ধে সহিংসতা অবলম্বন থেকে চিরতরে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে শক্তির জবাবে শক্তি প্রয়োগ করা।
দ্বিতীয় মাদানী যুগ ছিল হোদায়বিয়া সন্ধির পর থেকে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের সব দুশমনের উপর নিরঙ্কুষ আধিপত্য বিস্তারের সময় পর্যন্ত। এর বৈশিষ্ট্য ছিল নয়া সমাজ ও তার অগ্রগতি হেফাজত করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা। এ আমলেই নতুন মুসলিম রাষ্ট্র তার শত্রু পক্ষ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি ক্ষমা ও সমঝোতার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল।
এখানে আমরা দেখি কী উপায়ে ও পদ্ধতিহতে বিভিন্ন কার জরা হতো এবং সে সময়ের আইন প্রণয়নের ধরন কী ছিল। যদিও এগুলো সম দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিল এবং সে সময়ের বাস্তবতা ও উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতিমালার প্রতিফলন, সে ধরনের অবস্থা বা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করা, তাতে দিক নির্দেশনা প্রদান করা এবং তাতে অর্থবহ পরিবর্তন নিয়ে আাসাই ছিল এসবের লক্ষ্য।
ঐ সময়ে যে কোনো কাজ ও আইন প্রণয়যেন সুনির্দিষ্ট স্বাভাবিক অবস্থা বিবেচনা না করার ধারণা উম্মাহর বিরুদ্ধে অপরাধ সংগটনের অনুরূপ হলে ইসলামের দিক নির্দেশনা ও বাস্তবতা, পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং প্রত্যেক পর্যায়ের উপযোগী নীতি ও কৌশল থেকে বিচ্ছিন্ন একটি তাত্ত্বিক বিষয়ে পরিণত হবে। কাজেই একটি পুরোপুরি একাডেমিক ও আইনগত দৃষ্টিভঙ্গিতে নাসখ মতবাদকে পরবর্তী সাহায্যে পূর্ববর্তীকে বাতিল করার মতবাদ হিসাবে ধরে নেয়া হলে কঠোরভাবে সংসদীয় আইনে পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কোথাও এটি প্রযোজ্য হবে (এর সুস্পষ্ট কারণ, একমাত্র এসব প্রতিষ্ঠানেই আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ উপযোগী প্রতিষ্ঠিত দিক নির্দেশনা রয়েছে)। এভাবে পরবর্তীতে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে যে আইনই প্রণয়ন করা হোক না কনে তা স্বাভাবিকভাবে আগে প্রণীত আইনকে আইনগতভাবে বাতিলে করে দেবে। তবে এ বিষয়টি ওহীর ব্যাখ্যা করার বিষয় থেকে ভিন্ন। অথবা যে কোনো সয়ে ও যে কোনো স্থানে মানবিক বিষয়ে তার কাছে দিক নির্দেশনা প্রার্থনা করার বিষয়ও এটি নয়।
নাসখের ধারণা সম্পর্কে আগে থেকেই আমরা জানতে পেরেছি এটি ইসলামী চিন্তাধারা পদ্ধতি বিজ্ঞানে একটি স্থবির উপলব্ধির প্রতিফলন। কারণ এ মতবাদ কুরআনের সাধারণ ও বিশ্বজনীন শিক্ষার বিপররীতে সুন্নায় বিভিন্ন বিষয়ে যে সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ বিবেচনা করা হয়েছে তার মধ্যকার পার্থক্য লক্ষ্য না করেই অগ্রসর হয়। নাসখের ঐতিহ্যগত ধারণায় কুযরআনের নাজিলকৃত ব্যাখ্যা বা প্রয়োগ পক্রিয়ায় সময় ও স্থানের যে উপাদান রয়েছে তা মোটেই গ্রহ্য না করার বিষয়ে শামিল রয়েছে। নাজিলকৃত অংশগুলো তুলনা ও বিশ্লেষণের বেলঅয়ও সময় ও স্থানের উপাদানগুলো বিবেচনা করে না। আসবাব আর নুজুলের (কুরআন বিভিন্ন আয়াত নাজিলের উপলক্ষ) প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দেয়া এবং এ বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখার অনুপস্থিতি থেকে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। এমনকি রাসূল (সা) কি কারণে কোন্ উপলক্ষে কি বলেছেন বা করেছেন সে সম্পর্কে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা বরং আরো কম পাওয়া যায়।
পদ্ধতিগত উসূল অধ্যয়নে ঐতিহ্যগতভাবে নাসখে যে ধারণা পাওয়া যায় (এ মতবাদ মানুষের তৈরি আইন প্রণয়ন পদ্ধতির অনুকরণে পরস্পর বিরোধিতা এবং বিলুপ্ত জন্ম দেয়) তা পণ্ডি, চিন্তাবিদ, আইন প্রণেতা বা নেতার সংবেদনশীলতায় তাৎক্ষনিকভাবে আঘাত হানে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের দিক নির্দেশনা, আেইনগত সিদ্ধান্ত, নীত, ভাবধারা ও সমাধানের জন্যে নবী (সা) যুগের বিষয়ের সাথে নবী যুগের ঘটনাবলীর কিছু মিল থাকলেও গরমিল অনেক বেশি।
আজকের যুগের মুসলিম ছাত্ররা লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে যে, ঐতিহ্যগতভাবে নাসখের ধারণা বা মতবাদ অহীর অনেক মৌলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। নাসখ আসলে ওহীর মৌলীনীতিগুলোকে শুধু দ্বিতীয় মাদানী যুগের প্রাসঙ্গিক ঘটনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তার প্রয়োগরে চৌহদ্দীকে বাতিল বা সীমিত করে দিয়েছে। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাই যে, নাসখের ঐতিহ্যগত ব্যাখ্যা এ পরিস্থিতি থেকে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, চারিত্রিক বিশুদ্ধিকরণ এবং প্রতিরোধ সৃষ্টিতে সক্ষম এমন শক্তির সাহায্যে অবিচার ও জুলুমের মোকাবিলার প্রয়োজনীয় প্রেক্ষিতকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনতে পারেনি। এর পরিবর্তে দাওয়ার এবং অমুসলিমদের সাথে সব ধরনের আচোনার ক্ষেত্রে এ প্রচলিত ব্যাখ্যা প্রয়োগ করা হয়। এসব ঘটনা থেকে সামঞ্জস্য খুঁজে বের করে সম পর্যায়ভুক্তদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে তা জানা যায়। সৎকর্মশীলদের পাওনা আদায় করা এবং যারা ইসল ামের কাছাকাছি এসে গেছে তাদের অন্তরকে কোমল করার ফলে এসব কিছুর চেতনা হারিয়ে যায়। এভাবে পরমতসহিষ্ণুতার ধারণাটি একটি শর্তযুক্ত বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যবহারযোগ্য একটি মূল্যবোধে পরিণত হলো। অপরদিকে ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা সীমিত করার বিরুদ্ধে বাঁধাধরা বিষয় হয়ে গেল।।
একইভাবে কুরআনের পরিভাষা, ‘আহলে কিতাব’ অর্থ এবং রাসূল (সা) যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন তার ব্যাপকতা হারিয়ে ফেলে এবং সকল উন্নত সভ্যতা ও ধর্মের অনুসারীদের আহলে কিতাবদের মধ্যে শামিল করা হয়নি। এর পরিবর্তে কুরআনের অনুসারীদের আহলে কিতাবদের মধ্যে শামিল করা হয়নি। এর পরিবর্তে কুরআনের নাসখের ধারণার নেতিবাচক ফলাফলে দুটি উদাহরণ হচ্ছে মুসলিম ও অমুসলিমের সম্পর্কে বিষয়। দাওয়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইসলামী আইন এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের কৌশলের উপর ভুল ব্যাখ্যার কারণে যে প্রভাব পড়েছে সে ব্যাপপরে মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই কুরআনে বলা হয়েছে ‘পৌত্তলিকদের যেখানে দেখা পাও, সেখানে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো’ (৯:৫)। নাসখকে বাতিল বা রদ করে যে প্রাচীনপন্থি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তার নেতিবাচক ফলাফলের এটি একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত।
এ আয়াত দ্বিতীয় মাদানী যুগের শেষ দিকে নাজিল হয় এবং এটি সে সময়ের নাজিল হয় যখন মুসলিমরা পৌত্তলিক আরবদের উপর ক্ষমতা ও আধিপত্যকে সুদৃঢ় করে নিয়েছিল। এসব পৌত্তলিকরা প্রায় দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মুসলিমদের এবং মুসলিম রাষ্ট্রের কূটনীতি, শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ইসলারেম মিশন ও বাণীর প্রকাশ্য বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র এবং বারংবার চুক্তিভঙ্গের মাধ্যমে বিরোধিতা করেছে। এভাবে অবাধ্য ও উদ্ধত পৌত্তলিকরা যে পর্যন্ত ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করে সংহত ও সুসভ্য মুসলিম সমাজের সদস্য না হয়, সে পর্যন্ত কুরআন তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বন করলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং তাদের আগ্রাসন বন্ধ হবে। নাসখ সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণের কারণে একটি ভুল করে অপরটির জন্য অবস্থান নেয়া যাবে না। অন্য কথায় আইনগত সিদ্ধান্তের প্রয়োগ বিশেষ পরিস্থিতির উপর সব সময় ডিনর্ভরশীল। যাই হোক, পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে একটি অপ্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত বহাল রাখার পীড়াপীড়ি করা অর্থহীন, বরং নতুন পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার আলোকে নতুন সিদ্ধান্ত কামনা করা উচিত। এমন করেই আমরা তরবারির আয়াতকে কুরআনুল করিমে অমুসলিমদের প্রতি ব্যবহারে সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যের উপর যে জোর দেয়া হয়েছে তাকে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল হিসাবে বুঝতে পারি।
এ কারণে এ আয়াতের ব্যাখ্যাকে এ বিষয়ে সর্বশেষ নাজিলকৃত কালাম বলে গণ্য করা এবং রাসূল (সা)-এ চূড়ান্ত আমল হিসেবে ধরে নেয়া, বস্তুত ইসলামের পরিপূর্ণতা ও বিশ্বজনীন মিশনের বিরোধিতারই নামান্তর। প্রিয় নবী (সা)-এর ওফাত কালে নতুন ইসলামী সমাজ সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলামের দুশমনদের উপর প্রকৃত অর্থেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফত আমলে যখন ইজতিহাদ চালু ছিল এবং প্রাচীন ফিকাহর মাজহাবগুলো প্রচলিত ছিল তখন ঐ সমস্ত শর্ত অপরিবর্তনীয় ছিল। দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লিখিত ইহুদী, খ্রিস্টান এবং অগ্নি উপাসকদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের বেলায় সীমিত হয়ে গেল।
এ বিষয় এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় আমার লিখিত The islamic Theory of International Relations : New Directions for Islamic Methodology and Thought বইতে আলোচনা করা হয়েছে। এ বইতে সুচিন্তিত মতহ প্রকাশ করা হয়েছে, নাজিলকৃত ওহী এবং শরিয়াহর সিদ্ধান্তের মধ্যে দৃশ্যত যে পরস্পর বিরোধিতা বা বৈপরিত্য দেখা যায় তার দ্বারা অবশ্যই এ কথা বুঝায় না যে, এ দু’টোর একটি রহিত হয়ে গেছে। বরং এ ধরনের পরস্পর বিরোধিতা বা অসংগতির সত্যিকার তাৎপর্য হচ্ছে এ যে, মানব জীবন ও সমাজ বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তার ভিন্ন ভিন্ন রকমের নিয়ন্ত্রণ বা বিধির প্রয়োজন হয়। তবে শরিয়াহর একটি সিদ্ধান্ত বা রায়ের প্রয়োগ বিদ্যমান পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। উদাহরণ স্বরূপ, যখন অমুসলিমরা মুসলিমদের সাথে শান্তিতে বাস করে এবং শোভন আচরণ করে তখন মুসলিমদেরও উচিত তাদের সাথে অনুরূপ আচরণ করা। কিন্তু যখন অমুসলিমরা ইসলাম ও মুসলিমদের উপর আগ্রাসন চালায় তখন মুসলিমদের পক্ষ থেকে সঠিক জবাব হবে তাদের মোকাবিলা করা, প্রয়োজনে প্রকাশ্য বিরোধিতায় লিপ্ত হওয়া। নাসখের পুরনো ব্যাখ্যার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত হলো দাওয়ার কৌশল। এটি ইসলামী চিন্তাধারা অবস্থান এবং ইসলামী আইনের বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মূলতঃ এসব ব্যাপারে দু’ধরনের চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যায়। প্রথম দলের মতে মুসলিম বিশ্বের বর্তামান অবস্থা, মক্কা জিন্দেগী ও প্রখম মাদানী যুগের মত তাদেরকে প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের ধর্মীয় বিষয় এবং তার প্রচার নিয়ে ব্যস্ত থাকা উচিত। কাজকারবার, লেনদেন ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের মতো বিষয়গুলো দ্বিতীয় মাদানী যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল এবং এসব বিষয় এখন বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই। অপর দলটি মনে করেন বর্তমান অবস্থার সঙ্গে দ্বিতীয় মাদানী যুগের অবস্থার মিল বেশি মিল রয়েছে। এ সময় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। যেহেতু এ দ্বিতীয় দলটি নাসখ বলতে বোঝেন দ্বিতীয় মাদানী যুগের সিদ্ধান্ত ও নীতি প্রাথমিক যুগের সিদ্ধান্ত ও নীতিকে বাতিল করে দিয়েছে, সেহেতু তারা দ্বিতীয় মাদানী যুগের শিক্ষা মেনে চলাকেই তাদের জন্য যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। মক্কা নগরীতে শুরুতে যারা মুসলমান হয়েছিলেন তারা যেসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, যে সময়ে তারা প্রথম ইথিওপিয়া হিজরত করলেন, প্রথম মাদানী যুগের হোদায়বিয়া সন্ধি এবং মক্কা বিজয়ের আগে, শত্রুপক্ষ যখন তাদের মৃত্যু ও ধ্বংসের হুমকি দিচ্ছিল, বর্তমান যুগের মুসলিমরাও অনুরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। সমসাময়িক যুগের মুসলিমরা ইসলামের শিক্ষাকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলে এবং হোদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের আগে রাসূল (সা) কোন্ বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, তাঁর নীতি, সংগঠন ও রণকৌশল কি এবং কেমন ছিল তা ভেবে দেখেলে, মজলুম, দুর্বল ও অস্ত্রশস্ত্র ও পার্থিব সামর্থ্যহীন জাতিগুলো শক্তিশালী দুশমনের চ্যালেঞ্জ কত দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে পারে তা বেশ ভালোভাবেই শিখতে পারবে। বিশ্বনবী ( সা) সে সময়কালের প্রতিকূল অবস্থায় নিপতিত সমাজের অর্থনৈতিক, রাচনৈতিক এবং সামরিক উন্নতি ও প্রগতির জন্য যেসব নীতি ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে এ কালের দুর্বল ও নির্যাতিত মুসলিমদের অনেক কিছুই শেখার আছে। অবশ্য আমাদের সন্দেহ নেই যে, প্রাথমিক যুগের কিছু সিদ্ধান্ত বা ফতোয়া এবং শিক্ষা পরবর্তীযুগে পরিবর্তন করা হয়েছিল। তবে আমাদের এ কথাও বিশ্বাস করতে হবে যে, ধর্ম ও মিশন বাস্তবে একই বিষয়ের দু’টি অংশ। কাজেই এ কথা বললে ভুল হবে যে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বর্তমানে প্রায় মক্কী যুগের সময় অতিক্রম করছে এবং সে কারণে সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বর্তমানে প্রায় মক্কী যুগের সময় অতিক্রম করছে এবং সে কারণে সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পরবর্তী মাদানী যুগের শিক্ষা মেনে চলতে হবে না। বরং আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা এবং মিখরের নমনীয়তা কয়েকটি সুস্পষ্ট পৃথক পর্যায় অতিক্রম করেছে এবং আমরা ঐসব স্তর বা পর্যায়কে বর্তমান সময়ের সাথে তুলনা করতে পারি না। কারণ, ইতিহাসের যে কোনো সময়কে বিকৃত করে একটি সাদৃশ্য ঘটনাকে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হবে অযৌক্তিক। কারণ ওহী নাজিল পর্ব সম্পূর্ণ হওয়ার পর যারা এসব করছে তাঁদেগর সাথে যারা ওহী নাজিল হওয়ার সময়ে জীবিত ছিলেন তাঁদের কোনো তুলনা হতে পারে না।
১. প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে কতগুলো বিশেষ বিষয় এবং কতগুলো সাধারণ বিষয়। ইসলামী চিন্তাধারার পদ্ধতিবিজ্ঞান, সমাজ গঠনে স্থান-কালকে বিষয় ধরে নিয়ে আইনগত সাদৃশ্য বা কিয়াসের মাধ্যমে তাদের শতাব্দীকালের সিদ্ধান্ত বা রায়কে অনুসরণ কারা বিষয়; এমনকি না বুঝেই সফলদের শ্রদ্ধা করা সম্পর্কিত আমাদের যে মিথ্যা বোধ রয়েছে তা একটি চাবুকে পরিণত হয়েছে এবং আমরা যেন নিজেরা নিজেদেরকে এ ব্যাপারে বেত্রাঘাত করছি।
২. এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার পেছনে যে প্রজ্ঞা কাজ করছিল তা ছিল মালিকদেরকে তাদের জমি উৎপাদনশীল করে গড়ে তোলার জন্য উৎসাহিত করা। প্রাচীনপন্থি ফকিহরা এ নিষেধাজ্ঞাকে রিবা হিসেবে বুঝেছেন। তাঁদের মতে চুক্তি করার সময় একটি শস্য যার পরিমাণ জানা নেই তার একটি অংশ দেয়ার জন্য চুক্তি হচ্ছে এক ধরনের Deferewd payment. এটি এবটি নিষিদ্ধকৃত নসিয়াহ, যার অর্থ একটি অজ্ঞাত জিনিস বা বস্তুর জন্য কোনো কিছু প্রদান করা।
৩. ফকিহগণ প্রায়ই এ ধরনের সিদ্ধান্তসমূহ রাজপরিবার বা ধনী ভূমি মালিকদের চাপে পড়ে নিতে বাধ্য হতেন।
৪. এসব এবং অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন লেখকের Introduction to Islamic Economic Theories : Contemporaryt Aspects of Economic anb Social Thinkinb in Islam, American Trust Publications Plainfield । পদ্ধতিবিজ্ঞান ও চিন্তাধারায় এ ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতির ফলে দেখা গেল অভিজ্ঞ মুসলিম অর্থনীতিবিদগণ যখন ইসলামী অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়কে পেশাজীবীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তখন মুসলিম আর্থিক নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও মননশীল ধারায় সূচনা করলো। আশা করা যায় যে, ইসলামী অর্থনীতির চিন্তা ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্র সমসাময়িক যুগে একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে। এভাবে সামনে অগ্রসর হলে ইসলামী চিন্তাধারার এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ধারণা সংস্থা ও অগ্রগতির উদ্যোগের পথ আগলে দাঁড়ায়। এ কারণেই আমরা দেখি যে, সমসাময়িক যুগের পণ্ডিত বা মনীষীদের আলোকিত ধারণা ও চিন্তাধারা প্রাচীন পাঠকদের হাতে বিকৃত হচ্ছে। তাদের মতে সেসব চিন্তাধারা বা তত্ত্বের সঙ্গে অবশ্যই পূর্বর্তীদের চিন্তাধারা বা তত্ত্বের মিল থাকতে হবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, এটা এখন স্পষ্ট যে, ইসলামের ঐতিহ্যানুসারী পদ্ধতিবিজ্ঞান সে যুগের রাজনৈতিক ও সভ্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমাধানের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই পদ্ধতি বিজ্ঞানের অনেকগুলো ত্রুটি-বিচ্যুটি ছিল, একটি ত্রুটি বিচ্যুতির কারণ হলো উম্মাহকে অগ্রগতি এবং উন্নয়নের বিষয়সমূহ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সাহায্য না করে তহার দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর আবর্ত থেকে বের করে আনার ব্যর্থ পচেষ্টা চালানো। যদিও পুরনো মতামদের মধ্যে সমাজ বিজ্ঞানের অনুসন্ধানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পদ্ধতি বিজ্ঞানের বীজ উপ্ত রয়েছে, কিন্তু বংশ পরম্পরায় পন্ডিতেরা এ বীজগুলো কখনো বপন বা লালন করার অবকাশ পাননি। আমাদের জন্য এটা জানা জরুরী যে, বর্তমান কালের সমস্যাগুলোর মোকাবিলায় পুরনো দিনের পদ্ধতিবিজ্ঞান কোথায়ও খাপ খাওয়াতে পারছে না। কারণ এ বিষয়টি অকার্যকর হওয়ার পেছনে শুধু পদ্ধতি বিজ্ঞানের ত্রুটিই দায়ী নয়, বরং পুরনো দিনের পন্ডিতেরা যে ত্রুটি চালিয়েছেন তাও দায়ী।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগত বিষয় সম্পর্কে মনে রাখতে হবে। সে বিষয়টি সুন্নাহের মূল পাঠ্যাংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আশ্চের বিষয় যে, সুন্নাহ সংকলন ও সংরক্ষণের পর এত সময় অতিবাহিত হলেও এখনো পণ্ডিতগণ এর বিশুদ্ধতা ও প্রামাণ্যতার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন। অনুরূপভাবে আগেকার হাদিস বিশারদগণ যে উন্নতমানের টেকনিক্যাল শব্দার্থ বিজ্ঞোনের বিকাশ ঘটিয়েছেন, তা সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাবিদগণের বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে পারেনি। ফলে যখন কোনো গ্রণ্থকার কোন হাদিসের উদ্ধৃতি দেন তিনি আপনা আপনিই সমালোচনার সম্মুখীন হন এবং পাঠককে অপ্রয়োজনীয়ভাবে উক্ত হাদিসের সনদ সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয়ে বিরোধের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন। ফলে লেখক যে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন তা থেকে তাদের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারেননি। সুতরাং এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি যে, প্রামাণ্য সুন্নাহর মূল পাঠগুলি হুবহু সংগ্রহ করা, শ্রেণীবিন্যাস করা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পণ্ডিত, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। এ সব মূল পাঠগুলির অবশ্যই সূচী তৈরি করতে হবে এং উপাদানের গুরুত্ব অনুধাবনের ব্যর্থতা দূর করতে হবে এবং যুক্তি ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ জ্ঞানের উৎসরূপে ওহীর ধারণা গ্রহণ করতে হবে যাতে মানবজাতি পৃথিবীতে সৎকর্ম করার ভূমিকা পূর্ণরূপে পালন করে যেতে পারে। বিভিন্ন দেশ ও কাল, ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে পরিবেশ পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা, চাহিদা-প্রয়োজন ও চ্যালেঞ্জের পার্থক্য থাকবে। সমসাময়িক যুগের বিভিন্ন সমাজের মদ্যে চিন্তার পার্থক্য থাকবে যাতে যুগ থেকে যুগান্তরের পার্থক্যকে দেশ থেকে দেশান্তহরের পার্থক্যের তুলনায় খুব কমিই তাৎপর্যবহ বলে মনে হবে। এভাবে বিষয়টির প্রতি আমরা যখন তাকাই তখন কোনো পরিস্থিতি অবস্থা বা সময়কে মক্কী বা মাদানী অভিধায় অভিহিত করার অবকাশ থাকে না।
বরং এ ব্যপারে উচিত হবে সব পরিস্থিতিকেই বাস্তবতার নিরিখে মূল্যায়ন করা এবং মূল্যায়নের ভিত্তি হবে প্রাকৃতিক আইন এবং শরিয়াহর উচ্চতর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতি। অতীত যুগের সেকেলে এবং চাপিয়ে দেয়া আইনগত সাদৃশ্য ঘটনা বা কিয়াসের ভিত্তিতে না হয়ে আমাদের প্রয়োজন সমসাময়িক সমাজের পরিস্থিতি বা অবস্থার উপযোগী প্রাণশক্তিতে ভরপুর চিন্তাধারার বুনিয়াদে গঠিত একটি গতিশীল ফিকাহ। এভাবেই প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজ শরিয়াহর উদার ও বিস্তৃত নীতির আলোকে নিজস্ব বিশেষ স্তর পার হয়ে সম্মুখে এগুবে।
বর্তমানের উম্মাহ যেসব সমস্যায় আক্রান্ত, তন্মধ্যে একটি হচ্ছে রিবা (সুদ) সমস্যা। এ বিষয়ে মুসলিম পণ্ডিত ও ছাত্ররা সমসাময়িক যুগে ঐতিহ্য অনুযায়ী যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তাতে তারা হাদিসের মূল পাঠের কড়াকড়ি অনুসরণের সাথে সাথে আেইনের প্রকৃত পরিবর্তন ঘটাতে পারেন।
রফী ইবনে খুদাইজ বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে। এ হাদিসটিতে প্রিয়নবী (সা) একজন মালিককে উৎপাদিত শস্যের সমানুপাতিক অংশের বিনিময়ে একজন কৃষকের কাছে জমি ভাড়া দিতে নিষেধ করেছিলেন। এসব প্রাচীনপন্থি ফকিহরা মত প্রকাশ করেছেন যে, জমির মালিক কৃষককে বীজ সরবরাহ করলে তিনি আইনসম্মতভাবেই ফসলের একটি অংশ নিতে পারেন। প্রাচীনপন্থি ফেকাহবিদদের আরেকটি গ্রুপ যে মত প্রকাশ করেন তাতে শরিয়াহর উচ্চতর অর্থনৈতিক লক্ষ্য এবং প্রজ্ঞাকে বিসর্জন দেয়ার শামিল। তবে তা শুধু হাদিসের বর্ণিত রিবা আল ফযলের (সোনা, রূপা, লবণ) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তারা বলেন, ব্যাপক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগের প্রয়োজন নেই।
আবু সাঈদ খুদরী (রা) এবং আরো কয়েকজন এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী এতে নবী করিম (সা) বলেছেন, সোনার জন্য সোনা, রৌপ্যের জন্য রৌপ্য, জবের জন্য জব, গমের জন্য গম, খেজুরের জন্য খেজুর, লবণের জন্য লবণ একই পরিমাণের এবং এক হাত থেকে আরেক হাতে। যে কেউ এর বৃদ্ধি করে অথবা বাড়ানোর নির্দেশ দেয় সে যেন সুদ নিল।
কুরআনের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনা এবং নবী করিম (সা)-এর আমলের আলোকে এটি যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক বিষয় এবং সমাজ বিজ্ঞানে মুসলিম পণ্ডিতদের সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার কারণে এসব ত্রুটি বিচ্যুটি দেখা দিয়েছে। মুসলিম পণ্ডিত ও ছাত্রদের প্রচেষ্টার কারণে এ শব্দের অর্থ ও তাৎপর্যের ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী অনুশীলন করা হয়েছে। বর্তমানে এ একটি মাত্র বিষয়ে ২০টিরও বেশি চিন্তাধারার অনুসারী রয়েছে।
লক্ষণীয় যে, বেশ কয়েকটি চিন্তাধারার অনুসারীরা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য হাদিসকে এড়িয়ে গেছেন। অথচ এ হাদিসকে ব্যাপক অর্থনৈ তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে রাসূল (সা)-এর অর্থনৈতিক নীতিসমূহের পেছনে কী যুক্তি ছিল এবং তা কোন্ কোনে্ স্তর বা পর্যায় অতিক্রম করেছে তার অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে দাঁড়াত। উসমান ইবনে জাহেদ (রা) বর্ণিত এ হাদিসে দেখা যায় ছয়টিচ সমজাতীয় পণ্যের বিনিময় ক্ষেত্রে রিা কীভাবে Deferred Payment এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি বিজ্ঞানের কারণে কয়েকটি পুরনো চিন্তাধারার অনুসারীরা আইনগত চাতুর্যের প্রাণশক্তি ও সর্বাত্মক রূপ নিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
পদ্ধতিবিজ্ঞানের আরেকটি ত্রুটি যারা এটি প্রয়োগের প্রচেষ্টা চালান তাদের মতে পূর্ববর্তীদের কথা এবং মতামতও কম পবিত্র নয়। পূর্বর্তীদের বোধশক্তি, ইজতিহাদ এবং ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে সত্য হবে এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটিকে ঐতিহ্যানুসারীগণ ওহীর অবস্থানে উন্নীত করেছেন। সুতরাং স্থান কালের পরিপ্রেক্ষিতে মানবীয় সীমাবদ্ধতার পরিবেশ স্বীকার করে নিলেও খোদায়ী ওহী ছাড়া আর কোনো কিছুই পবিত্র নয়। এ মর্মে তত্ত্বগতভাবে নিশ্চিত হওয়ার পরও আমরা দেখতে পাই মুসলিমরা সফল হয়েছে বা পূর্বর্তীদের লেখা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। এগুলো থেকে সমসাময়িক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রামাণ্য ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রেক্ষিত বের করার উদ্দেশ্যে নয় বরং আমাদের অবস্থা বা পরিস্থিতিকে তারেদ অবস্থা বা পরিস্থিতি হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
ইসলামের প্রথম বিজয় যুগের পর উম্মাহর উপর যে দুর্যোগ নেমে আসে সে বিপর্যয়ের ফলে খেলাফতের পতন হয় তা ইসলামী চিন্তাধারার কারণে নয়, এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুলভ্রান্তি বা বাড়াবাড়ি কারণেও নয়। বরং দুর্যোগ ও বিপর্যয়কে পতনের প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সঠিকভাবে ইসলামী জীবন ধারার সাথে একাত্ম হওয়ার আগেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও জাতির ইসলামী সমাজে প্রবেশ অথবা (ইসলামের আদর্শ ও লক্ষ্য এবং মহৎ মূল্যবোধ সম্পর্কে নিজেদের শিক্ষিত করে তোলার আগেই ইসলামী সমাজে শামিল হওয়ার ঘটনা) নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমনটি হওয়া উচিত ছিল সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এর পরিবর্তে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামাজিক নেতৃত্ব পুরনো প্রাক-ইসলামী জীবনধারা ও নতুন জীবনধারার এবং অদ্ভুত জোড়াতালি দেয়া ব্যবস্থার প্রতিভূ হয়ে গেল। এ কারণে বিশেষ করে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী নেতৃত্ব পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ইসলামী চিন্তাধারার কার্য উপযোগিতা কখনো প্রশাসন বা অসামরিক বিজ্ঞানে প্রসারিত হয়নি, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এসব কিছু সত্ত্বেও প্রাথমিক যুগে সে চিন্তাধারার ফলে যা অর্জিত হয়েছিল বা যে সফলতা এসেছিল তা মানব জাতির জন্য আলো, দিক নির্দেশনা ও জ্ঞান দানের জন্য যথেষ্ট ছিল। বর্তমান মুসলিমগণ পূর্ব পুরুষদের সাফল্যের প্রেক্ষাপটে যা অর্জন করতে পারেনি সে জন্য তাদের দোষারোপ করার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না।
অবাক হওয়ার কিছুই নেই যখনস আমরা দেখি যে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা পুরোপুরি দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হয়ে গেল। উম্মাহর চিন্তাধাদরা শুধু নিছক অনুষ্ঠানের অন্তঃসারশূন্য বুলি, শ্রদ্ধাষ্পদ উত্তরাধিকারে রূপান্তরিত হলো, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম তাকে প্রচন্ড ভাবে ভুল বুঝল। এভাবে দেখা যায় সাধারণভাবে মানবজাতি এবং বিশেষভাবে উম্মাহর কল্যাণে ইসলামী চিন্তাধারার সাফল্যে আমরা গর্ব অনুভব করছি। বাস্তবিকই আমাদের ইতিহাসের কোনো অর্জন বা সাফল্যকেই ইসলামের অবদান, তার চিন্তাপদ্ধতি, সভ্যতা ও সংস্কার ভিন্ন অন্য কিছুর ফলশ্রুতি হিসাবে দেখা যায় না। সুতরাং এটির যা দেয়ার সামর্থ্য ছিল তার সব কিছু দিতে না পারলেও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তার পথে বিস্তর বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও সে অনেক কিছুই উপহার দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, আমাদের ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটেছে অন্য জাতি ও সম্প্রদায়ের বেলায়ও তা ঘটে থাকে। কিন্তু জাতিসমূহের অগ্রযাত্রা যখন ব্যাহত হয় তখন প্রয়োজন পড়ে তাদের মৌলিক ও বিশুদ্ধ নির্ভেজাল দৃষ্টিভঙ্গি পুনরায় ফিরিয়ে আনার, যাতে তারা নতুন সকল ধরনের সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
সুন্নাহর এ ধরনের শ্যেণীবিন্যাস নিম্নোক্তভাবে সাজানো হবে:
১. যে সব হাদিস সনদের দিক থেকে বিশুদ্ধ এবং অর্থের দিক থেকে সুস্পষ্ট সেগুলিকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
২. সনদের দিক থেকে বিতর্ক থাকলেও অর্থের দিক থেকে সুস্পষ্ট হলে সেসব হাদিসকেও প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
৩. যেসব হাদিস বিশুদ্ধতা অথবা সনদ সম্পর্কে যাই বলা হোক না কেন, অর্থের দিক থেকে প্রশ্নাকীত নয়, অর্থাৎ তাদের অর্থ কোনো কোনোভাবে শরিয়াহর নীতি ও উদ্দেশ্যের সাথে বিরোধী বলে মনে হয়।
৪. যেসব প্রমাণ হাদিসের সনদের দিক থেকে সন্দেহজনক এবং অর্থের দিক থেকে বিরোধপূর্ণ সেগুলিকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বিবেচনায় আনা যাবে না।
পদ্ধতিবিজ্ঞান সংক্রান্ত এ বিষয়টির গুরুত্ব সুন্নাহর অসাবধান ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কারণ অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম মন ত্রুটিপূর্ণ অগভীর বিষয় নিয়ে অভিভূত হয়। ফলে যখন সে কোনো ত্রুটিপূর্ণ বিষয়কে ত্রুটিহীন বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে, সে তখন বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না এবং প্রতিটি বিষয়কে তার যথার্থরূপে আবিষ্কার করতে পারে না। সবশেষে দেখা যায় মুসলিম মন, চিন্তাধারা এবং পদ্ধতিবিজ্ঞান যখন কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত নীতি গ্রহণে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে তখন তার মন, মূল্য ও উপযোগিতা বিলীন হয়ে যায়। তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে, চিন্তাধারার নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সচেতন এবং শরিয়তের নীতি, মূল্যবোধ সম্পর্কেও অনুরূপভাবে সজাগ থাকার মধ্যেই রয়েছে ওহী, বিশ্বনবী (সা)-এর বাণী এবং শরিয়তের সব বিকৃতি ও ভ্রান্ত উপস্থাপনা থেকে সংরক্ষণের প্রকৃত মাপকাঠি। একইভাবে এসব গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিই মুসলিম মন ও পদ্ধতিবিজ্ঞানের স্বাধীনতা ও বিশুদ্ধতার গ্যারান্টি দিতে পারে। অধিকন্তু মুসলিম মন ও পদ্ধতিবিজ্ঞানের হেফাজতের কাজটি খোদ ইসলামের হেফাজতের শামিল।
সুন্নাহর ক্ষেত্রে যা সত্যি ঐতিহ্যধারার মাধ্যমে প্রাপ্ত সাহিত্যকর্মের বেলায় তার ব্যতিক্রম নেই। আমাদের পুরো-সাহিত্যে বিদ্বজ্জনদের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে সে অধিকার উপলব্ধির ও অধিগত করার অধিকার। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে আসা এ সাহিত্যকর্ম অবশ্য বিশ্লেষিত হতে হবে এবং এমন আঙ্গিকে তা উপস্থাপন করতে হবে যেন বিজাতীয় প্রভাব বৃদ্ধি সত্ত্বেও ইসলামের সরল সহজ ও মহান শিক্ষাগুলো আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এভাবেই আমাদের পুরো-সাহিত্য সামগ্রিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধ নবায়নের উপায় হিসেবে গণ্য না হয়ে সমসাময়িক প্রাঞ্জল মুসলিম চিন্তাধারার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো (পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে) ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞানে ওহী ও যুক্তির ভূমিকা সম্পর্কে বিভ্রান্তি। প্রথম দিকে ইসলামের বিজয় ও সম্প্রসারণের পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে মুসলিমগণ যখন বিজাতীয় সভ্যতা ও ধর্মের (প্রধানত রোমান ও গ্রিক) সংস্পর্শে এসে তাদের দেখলেন, তখন তাঁরা ধর্মবিদ্যা সম্পর্কে গবেষণা শুরু করলেন। এমনকি নেতৃস্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদগণ মুতাজিলাদের এক বিরাট অংশের ন্যায় দুর্বোধ্য অধিবিদ্যামূলক গবেষণার দ্বারা প্রভাবান্বিত হলেন। বহু গোঁড়া লোক ইসলামী ব্যক্তির যুক্তি ও তার ভূমিকাকে প্রত্যাখানের চরম অবস্থানে ফেলে দিলেন। এভাবেই ইসলামী চিন্তাধারাকে কালামে ওহীর আক্ষরিক ও বর্ণনামূলক অধ্যয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলো। এ ধরনের অধ্যয়নের প্রভাব দীর্ঘায়িতভাবে ইসলামী চিন্তাধারার উপর পড়েছে। ফলে ইসলামী চিন্তাধারার কাছে সব ধরনের যুক্তিবাদী গবেষণা সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে।
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের এ সংক্ষিপ্ত সমালোচনা শেষে আমাদের জন্য এটি অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে যে, সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারার পরিস্থিতি এবং আধুনিক বিশ্ব ক্রমবর্ধমান হারে তার সামনে যেসব সমস্যা তুলে ধরেছে তা থেক উদ্ভূত কিছু প্রশ্ন বিবেচনা করার জন্য আমাদের একটু স্থির হতে হবে। সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে যে, এ ধরনের প্রশ্ন করার কোনো অবকাশ এখানে নেই। শুধু এটিই গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, আমরা এ দায়িত্ব বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা যুগের উপর চাপিয়ে দিতে পারবো না। এ ধরনের অনুশীলন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমস্যার সঠিক উপলব্ধি থেকে আমাদের ফিরিয়ে রাখে এবং উম্মাহ যে অগ্রগতি লাভ করেছে তার সঠিক ত্রি গ্রহণে আমাদের বাধা দেয়। বরং আমাদের জানা প্রয়োজন, যেসব সমস্যা আমাদের মোকাবিলা করা দরকার তার মাত্রা উপলব্ধি করার জন্য সঠিক রূপরেখা কি হবে? আমরা যে পথ বেছে নিয়েছে তার রূপরেখা নির্ণয় কীভাবে করতে পারি? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই নিচের বিশ্লেষণগুলো করতে হবে।
১. আমাদের অতীতকে অবশ্যই বুঝতে হবে, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং তার ইতিবাচক দিকগুলোর উপর মনোযোগ দিয়ে তার উপর ভিত্তি কর উন্নতি লাভ করতে হবে। আমাদের ইতিহাসের নেতিবাচক দিকগুলোকে নিয়ে আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী বৃথা সময় কাটিয়ে দিয়েছি এবং এটা নিশ্চিত করে বলা যায় আমরা এ ধরনের বিষয় নিয়ে আর সময় নষ্ট করতে পারি না বা এ ধরনের প্রচেষ্টায় জড়িয়ে পড়ার সময় আর নেই।
২. এগিয়ে যেতে হলে আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, অতীতে সদুদ্দেশ্য নিয়েই আমরা ভুল করেছি। সুতরাং এটা আমাদের জন্য মানানসই হবে যদি আমরা শুধু ইতিবাচক ও কল্যাণকর দিকগুলো গ্রহণের জন্য অতীতকে অধ্যয়ন করি। অধিকন্তু আমাদের ইতিহাসের মারাত্মক অধ্যায়গুলো পুনরায় অধ্যয়নের পক্ষে কোনো যক্তি নেই। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, অতীতে ইসলাম, ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতি বিজ্ঞান অনুসারণের ফলে উম্মাহ সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল। ইসলাম এবং শুধু ইসলামই উম্মাহকে সারা বিশ্বে তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছে, তথাপি এ অধ্যয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠকদের দৃষ্টি ও মনোযোগকে ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করা যাতে উম্মাহ অব্যাহতভাবে উন্নতি লাভ করতে পারে এবং নতুন দিগন্তে পৌছাতে পারে। শুধু এ পদ্ধতিতে চিন্তা করেই উম্মাহ তার শক্তি, নেতৃত্ব ও সংস্কারমূলক প্রাণশক্তি পুনরায় ফিরে পেতে পারে।
৩. উম্মাহকে তালফিক প্রবণতা অথবা নিজেদের রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলীতে পাশ্চাত্য সমাধান ঢুকিয়ে দেয়ার জিদ বা হঠকারিতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তালফিক ও তাকলিদের পরিবর্তে আমাদেরকে অবশ্যেই মৌলিক ও অখন্ড ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গ বা উদ্যোগ নিয়ে আসতে হবে যা অনুকরণকে প্রত্যাখান করবে। এ সংস্কারমূলক আন্দোলন ইসলামী ধ্যান-ধারণা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটবে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণ এ জন্যে প্রয়োজন যেহেতু ইসলামী সমাজবিজ্ঞান লালিত স্বাধীনতা ইসলামী মননশীল গবেষণা যা তার উৎস এবং অসাধারণ ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নির্ধারিত। শেষ কথা হচ্ছে একটি মৌলিক ও সুসংবদ্ধ মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে, যা অন্যের অর্জিত সাফল্য ও কৃতিত্বের কারণে দুর্বল হয়ে পড়বে না বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বরং তাদের সাফল্যকে স্বাগত জানাবে এবং নিজেদের অনুপম দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে যাচােই করে সেগুলোকে উম্মাহর উপযোগী করে নেবে।
কী করে পথের দিশা খুঁজে বের করা যাবে? সুতরাং এখানে আমরা পুনরায় প্রশ্ন করতে পারি আমাদের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল কেন? কীভাবে আমরা পুনরায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের শক্তি ফিরে পেতে পারি এবং চলার পথ নির্ভুল করতে পারি? আমাদের অধ্যয়ন ও গবেষণার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির নবায়নের লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া, আমাদের পদ্ধতি বিজ্ঞান সংস্কার করা এবং শক্তির উৎসগুলোকে সমৃদ্ধ করা। সমীক্ষার এ পর্যায়ে আমরা একটি উপযুক্ত স্থানে পৌঁছেছি। আমরা বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি তা পুরোপুরি সামনে রেখে এখান থেকে আমরা আমাদের চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের দিকে সর্বাত্মক দৃষ্টিপাত করতে পারি।
ইসলাম এসেছিল ইতিহাসের এক অজ্ঞানতার যুগে সমগ্র সৃষ্টির কাছে হিদায়াত বা পথ নির্দেশনারূপে যখন আগের যুগের আসমানী কিতাবসমূহকে বিকৃত করা হয়েছিল এবং সারা বিশ্বে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলাম এসে জনগণের মন ও মননের উপর আলো, শিক্ষা ও সভ্যতার দ্বার উন্মুক্ত করে দিলো।
ইসলামের শুরুতে প্রথম যুগে ইসলামের পদ্ধতিবিজ্ঞান ছিল একটি স্বাভাবিক ও স্বয়ংক্রিয় ধরনের পদ্ধতিবিজ্ঞান। এ পদ্ধতিবিজ্ঞান নির্ভর করতো ওহীর প্রজ্ঞা মানবিক যুক্তির বিশুদ্ধতা এবং ইজতিহাদের উপর, যার উৎস ছিল অমলিন ও মানবীয় স্বাভাবিক প্রবণতা। এভাবেই বলা যায় সকল প্রজন্মের মানুষের জন্য প্রিয়নবী ও খলিফাদের যুগই ছিল মানবীয় চেতনার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আজরেক যুগে বিভিন্ন মুসলিম দেশে আমরা যা কিছু ভালো দেখতে পাই তা সরাসরি ইসলামী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কারণেই হয়েছে। কাজেই এ কথা নির্দিধায় বলা যায় মুসলিম জাহানের পতনের সবগুলো উপাদান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ইসলামই উম্মাহর জন্য একমাত্র আশ্রয়স্থল।